১৩. পোয়ারোর কৃতিত্ব

পোয়ারোকে নিয়ে সত্যি আর পারা যায় না। ও আমাকে খুব বোকা বানিয়েছে। মনে মনে খুব রাগ হল, তাই ওকে জিজ্ঞাসা করলাম কেন ও এভাবে আমাকে ঠকিয়েছে।

পড়ার ঘরে বসে আমরা কথা বলছিলাম। কয়েকটা দিন যেভাবে কাটল। জন ছাড়া পেয়েছে। মেরীর সঙ্গে তার পুনর্মিলন ঘটেছে। অ্যালফ্রেড ইঙ্গলথর্প আর মিস হাওয়ার্ড পুলিশের হেফাজতে–এসবই পোয়ারোর কৃতিত্ব।

আমার অভিযোগ শুনে পোয়ারো বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। তারপর একসময় বলল সে আমাকে ঠকায়নি, আমি নাকি নিজেই ঠকে গেছি। তার কারণ আমার মনটা খুব সরল। মনের ভার আমি গোপন রাখতে পারি না। পোয়ারো যদি তার ধারণার কথা আমাকে আগে বলত তাহলে মিঃ ইঙ্গলথর্প আমার মুখ দেখে কিছু আঁচ করে ফেলত আর তাকে কোনোদিনই ধরা সম্ভব হত না। সেজন্য পোয়ারো আমাকে কিছু বলেনি।

পোয়ারোর কথা শুনে আমার রাগটা একটু কম। আমি বললাম তবু সে তো আমাকে একটু আকারে ইঙ্গিত আভাস দিতে পারত।

পোয়ারো কলল সে আমাকে অনেকবারই আভাস দিয়েছে। যেমন সে জনকে অপরাধী বলে ভাবেনি বলেই বার বার বলেছিল জন ছাড়া পাবে বলেই তার ধারণা। আবার এও বলেছিল হত্যাকারীকে ধরা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এছাড়া বলেছিল মিঃ ইঙ্গলথর্পকে এখনই গ্রেপ্তার করা উচিৎ হবে না।

আমি বললাম তাহলে কি পোয়ারো প্রথম থেকেই মিঃ ইঙ্গলথর্প কে সন্দেহ করেছিল।

পোয়ারো মাথা নেড়ে বলল প্রথমেই তার মনে হয়েছিল মিসেস ইঙ্গলথর্পের মৃত্যুতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে তার স্বামী। কিন্তু মিঃ ইঙ্গলথর্পের বিরুদ্ধে প্রমাণগুলো এত প্রকট হয়ে দাঁড়াচ্ছিল যে একসময় পোয়ারোর মনে হয়েছিল মিঃ ইঙ্গলথর্প বোধ হয় হত্যাটা করেননি। সেজন্য পোয়ারোর ধারণা চিন্তাভাবনা সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল।

পোয়ারো বলতে লাগল সে যতই মিঃ ইঙ্গলথর্পপকে আড়ালে রাখতে চাইছিল ততই তিনি গ্রেপ্তার হওয়ার জন্য তৎপর হয়ে পড়ছেন। তারপর যখন সে দেখল রেইকসের সঙ্গে মাখামাখিটা ওর নয় জনের তখনই পোয়ারো নিশ্চিত হল।

আমি জানতে চাইলাম কি করে সে এতটা নিশ্চিত হল।

পোয়ারো বলল যদি ইঙ্গলথর্পের সঙ্গে মিসেস রেইকসের কোনো ঘনিষ্ঠতা থাকত তাহলে ওঁর চুপ করে থাকার একটা অর্থ হয়, কিন্তু জানা গেল জন রেইকসের প্রতি আকৃষ্ট আর গ্রামের সকলেই ব্যাপারটা জানে তখনই মিঃ ইঙ্গলথর্পের মৌনতার অন্য রকম অর্থ দাঁড়ায়। পোয়ারো বুঝতে পেরেছিল ইঙ্গলথর্পের কলঙ্কের ভয় ছিল না। তিনি যেনতেন প্রকারে গ্রেপ্তার হতে চান। সেই মুহূর্ত থেকে পোয়ারো স্থির করে ফেলল কিছুতেই ওকে গ্রেপ্তার হতে দেবে না।

আমি বললাম মিঃ ইঙ্গলথর্প শুধু শুধু কেন গ্রেপ্তার হতে চাইছিলেন বুঝতে পারছি না।

পোয়ারো আমাকে বুঝিয়ে বলল আমাদের দেশের আইনটাই এরকম। একবার ছাড়া পেয়ে গেলে সেই একই অপরাধের জন্য একজনের দুবার বিচার করা যায় না। লোকটা সেজন্যই কিছু বানানো সাক্ষ্য নিজের বিরুদ্ধে তৈরি করে যাতে সহজে গ্রেপ্তার হতে পারে। আর তাহলেই সারা জীবনের মত নিশ্চিন্ত।

এবার আমি জানতে চাইলাম মিঃ ইঙ্গলথর্প কি করে একই সময়ে অজুহাতের ব্যবস্থা করল আবার ওষুধের দোকান থেকে স্ট্রিকনিনও কিনল।

পোয়ারো আমার কথা শুনে অবাক হয়ে প্রশ্ন করল আমি এসব কি বলছি। আমি কি এখনও জানি না যে মিস হাওয়ার্ড স্ট্রিকনিন কিনতে দোকানে ঢুকেছিল।

আমি হাঁ হয়ে গেলাম। পোয়ারো বলল এই কাজটা করতে মিস হাওয়ার্ডকে এতটুকু বেগ পেতে হয়নি। ওকে বেশ লম্বাই বলা যায়, তার ওপর ওর গলার স্বরটাও পুরুষালী। তাছাড়া মিঃ ইঙ্গলথর্প আর মিস ওয়ার্ড মামাতো পিসতুতো ভাই বোন, দুজনের মধ্যে তাই যথেষ্ট মিল রয়েছে। সেজন্য ব্যাপারটা খুবই সহজ হয়ে গেছে।

ব্রোমাইডের ব্যাপারটা কি জানতে চাইলাম।

পোয়ারো বলতে লাগল। তার ধারণা এই ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে মিস হাওয়ার্ডই আসল উদ্যোক্তা। তিনি একসময় বলেছিলেন তার বাবা ডাক্তার ছিলেন। হয়ত সেই সূত্রেই ওষুধ বানানো শিখেছিলেন তিনি, নয়ত বা সিনথিয়ার পড়ার বই ঘেঁটে মিস হাওয়ার্ড ব্রোমাইডের ব্যাপারটা জেনেছিলেন। এও জেনেছিলেন যে স্ত্রিকনিন দিয়ে তৈরি ওষুধের মধ্যে ব্রোমাইড মিশিয়ে দিলে স্ত্রিকনিন ব্রোমাইডের স্ফটিক জমা হয়।

মিসেস ইঙ্গলথর্প মাঝে মাঝে ঘুমের ওষুধ খেতেন রাত্রিবেলা। ব্রোমাইড পাউডারের পুরিয়া সেজন্য রাখা থাকত। কেটসের দোকান থেকে ওর ওষুধের বোতল এলে ঐ বোতলে দু-এক পুরিয়া ব্রোমাইড পাউডার মিশিয়ে দিলেই কাজ হয়ে যাবে। কেউ জানতেও পারবে না–কারণ মৃত্যুটা অন্তত পনেরো দিন আগে তো হচ্ছে না। মিস হাওয়ার্ড ইতিমধ্যে একটা ঝগড়ার ব্যবস্থা পাকা করে ফেলবেন এবং বাড়ি ছেড়েও চলে যাবেন। তার অনুপস্থিতিতে কেউ তাকে সন্দেহ করবে না।

সন্দেহটা জনের ওপর ফেলার ব্যবস্থাও ওরা পাকা করে রেখেছিল, ওর হাতের লেখা নকল করে দোকান থেকে স্ট্রিকনিন কিনে।

পোয়ারোর কথাগুলো শুনে সত্যিই আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম।

পোয়ারো বলে যেতে লাগল, সোমবার মিসেস ইঙ্গলথর্পের শেষ ওষুধের দাগটা খাবার কথা। সেজন্য মিঃ ইঙ্গলথর্প সন্ধ্যাবেলা ছটার সময় এমন ব্যবস্থা করলেন যাতে অনেকেই তাকে গ্রামের থেকে বেশ দূরে কোথাও দেখে।

মিস হাওয়ার্ডও ইতিমধ্যে মিসেস রেইসকে নিয়ে একটা কাল্পনিক গুজবও তৈরি করে রেখেছেন। সন্ধ্যা ছটার সময় মিস হাওয়ার্ড মিঃ ইঙ্গলথর্পের ছদ্মবেশে দোকান থেকে কুকুরের জন্য স্ট্রিকনিন কিনলেন। সইটা করলেন মিঃ ইঙ্গলথর্পেরই নামে জনের হাতের লেখা নকল করে।

জন কোনো অজুহাত হাজির যাতে করতে না পারে সেজন্য মিস হাওয়ার্ড জনেরই লেখা নকল করে একটা চিরকূট লিখলেন জনের কাছে। এর ফলেও জনও অনেক দূরের এক নির্জন জায়গায় যেতে বাধ্য হল। সব কিছুই পরিকল্পনা মাফিক চলল। মিস হাওয়ার্ড মিডলিংহ্যাম ফিরে গেলেন, অ্যালফ্রেড ইঙ্গলথর্পপও স্টাইলসে ফিরলেন। সুতরাং ধরা পড়ারও আর সম্ভাবনা রইল না।

পরিকল্পনাটা একটু গোলমাল হয়ে গেল, যখন মিসেস ইঙ্গলথর্প সোমবার রাত্রে ওষুধ খেতে ভুলে গেলেন। এর ফলে মিঃ ইঙ্গলথর্পপও সবচেয়ে মারাত্মক ভুলটা করে বসলেন। মিসেস ইঙ্গলথর্প বাইরে বেরিয়ে যেতেই উনি তার দুষ্কর্মের সঙ্গী মিস হাওয়ার্ডকে চিঠি লিখতে বসলেন। কারণ তার মনে ভয় হল পাছে পরিকল্পনা মাফিক কাজ না হওয়ায় মিস হাওয়ার্ড ঘাবড়ে যায়। সেদিন মিসেস ইঙ্গলথর্প হয়ত একটু তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরেছিলেন। মিঃ ইঙ্গলথর্প তাই ধরা পড়ার ভয়ে চিঠিটা ডেস্কের মধ্যে চাবি দিয়ে রেখে দিলেন। তার ভয় হল ঘরের মধ্যে থাকলে হয়ত ডেস্কটা খুলতে হতে পারে আর তাহলেই স্ত্রীর চোখে চিঠিটাও পড়ে যেতে পারে। তাই মিঃ ইঙ্গলথর্প তাড়াতাড়ি বাগানে চলে গেলেন। তার একবারও মনে হল না যে তার স্ত্রী ডেস্কটা খুলতে পারেন।

মিসেস ইঙ্গলথর্প ডেস্কটা খুললেন এবং চিঠিটা দেখে ফেললেন। ফলে মিঃ ইঙ্গলথর্প আর মিস হাওয়ার্ডের গোপন ষড়যন্ত্রের ব্যাপারটাও তার অজানা রইল না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ ব্রোমাইডের কথাটা উনি বুঝতে পারলেন না। স্বামীকে কিছু বলবেন না স্থির করে মিসেস ইঙ্গলথর্প আইনজ্ঞের কাছে চিঠি লিখে পরদিন দেখা করতে বললেন এবং উইলটাও নষ্ট করে ফেলবেন ঠিক করলেন। শুধু ঐ মারাত্মক চিঠিটা রেখে দিলেন।

আমি বললাম তাহলে ঐ চিঠিটার জন্য মিঃ ইঙ্গলথর্প তার স্ত্রীর নথীব্যাগটা জোর করে খুলেছিলেন।

পোয়ারো বলল ঠিক এরকমই ঘটেছে। মিঃ ইঙ্গলথর্প এই মারাত্মক ঝুঁকিটা নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, ঐ চিঠিটা না থাকলে ওর ধরা পড়ার কোনো সম্ভাবনা থাকবে না।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, চিঠিটা হাতে আসার সঙ্গে সঙ্গে ইঙ্গলথর্প ওটা নষ্ট করে ফেললেন না কেন।

পোয়ারো বলল ওরকম মারাত্মক ঝুঁকি উনি নিতে চাননি। চিঠিটা নিজের কাছে রাখলেও সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।

আমি পোয়ারোকে বললাম ব্যাপারটা ঠিক আমার বোধগম্য হচ্ছে না। পোয়ারো এবার আমাকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দেবার জন্য বলতে শুরু করল। আমাদের সেদিন ওখানে উপস্থিত হওয়ার মিনিট পাঁচেক আগে ইঙ্গলথর্প চিঠিটা পেয়েছিলেন। এর আগে অ্যামি সিঁড়ি বঁট দিচ্ছিল। সুতরাং বারান্দার ডানদিকে কেউ গেলেই ওর নজরে পড়তো। ইঙ্গলথর্প অন্যদিকের দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকলেন। তাড়াতাড়ি নথী ব্যাগটা খুলতে গিয়ে দেখলেন চাবিটা কাছে নেই। মহাবিপদে পড়লেন তিনি। কিন্তু চিঠিটা যে তাকে পেতেই হবে, তাই চাবির বদলে একটা ছুরি দিয়ে তালাটায় চাপ দিয়ে নথীব্যাগটা খুললেন, কাগজপত্র ঘেঁটে আসল চিঠিটা উদ্ধার করলেন।

এবার কাগজটা রাখা নিয়ে সমস্যা দেখা দিল। চিঠিটা যদি নিজের কাছে রাখেন তাহলে ঘর থেকে বেরোনোর সময় কেউ দেখতে পেয়ে যদি তাকে খানাতল্লাশ করে তাহলে তো সর্বনাশ হবে। দিশেহারা হয়ে গেলেন কাগজটা কোথায় রাখবেন ভেবে। বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেললে হবে না। কেউ ওগুলো পরীক্ষা করতে পারে। তাহলে কী করা যায় চিন্তা করতে লাগলেন মিঃ ইঙ্গলথর্প।

হঠাৎ উপায়ন্তর না দেখে কাগজটাকে তিনটে সরু ফালি করে তিনি ছিঁড়ে ফেললেন। তারপর দলা পাকিয়ে তাপচুল্লীর তাকের ওপরের ফুলদানীর মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন।

আমি বললাম তাহলে ঐ কাগজের টুকরোগুলো বরাবরই ফুলদানীর মধ্যে ছিল।

 পোয়ারো মাথা নাড়ল। আর ওখান থেকে ওগুলো উদ্ধার করতে পারার জন্য আমার কাছে ঋণী। আমি কথাটা অর্থ বুঝতে না পেরে বোকার মত তাকিয়ে রইলাম। পোয়ারো আমাকে মনে করিয়ে দিল সেদিন আমি তাকে বলেছিলাম তাপচুল্লীর তাকের খেলনাগুলো নাড়াচাড়া করার সময় আমার হাত খুব কাঁপছিল। এই কথাটা শুনেই পোয়ারোর মনে একটা কথা আসে যে তাপচুল্লীর ওপরের তাকের খেলনাগুলো তো গোছানো থাকারই কথা কিন্তু তাহলে সে সেগুলো গুছিয়ে রাখছিল কেন, নিশ্চয়ই সেগুলো অগোছালো অবস্থায় ছিল। তার মানে কেউ ওখানে হাত দিয়েছিল।

আমি বললাম সবই বুঝতে পারছি। তবে মিঃ ইঙ্গলথর্প তো অনেক সুযোগই পেয়েছিলেন কাগজগুলো সরিয়ে নেবার।

পোয়ারো বলল ইঙ্গলথর্প যাতে তা করতে না পেরে সেই ব্যবস্থা সে আগে থেকে করে রেখেছিল। আমি জানতে চাইলাম কিভাবে ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল আমার মনে আছে কিনা যে সে বাড়ির মধ্যে সবাইকে চিৎকার করে জানাচ্ছিল বলে আমি তাকে বকাবকি করেছিলাম। আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। পোয়ারো বলল সে বুঝেছিল তার সামনে একটি মাত্র রাস্তাই আছে। অবশ্যই তখন সে জানত না যে ইঙ্গলথর্প দোষী কি না। আর দোষী হলে কাগজটা নিশ্চয়ই ওর কাছে নেই, অন্য কোথাও লুকানো আছে, এই সময় বাড়ির সকলকে একটু সতর্ক করে দিতে পারলেই ইঙ্গলথর্পের পক্ষে আর কারও নজর এড়িয়ে কাগজটা পাওয়া সম্ভব হবে না। সবাই তখন ওকে সন্দেহের চোখে দেখছিল। তার ওপর তার এই চিৎকার শুনে অন্ততপক্ষে দশজন সৌখিন গোয়েন্দা তার ওপর অনবরত নজর রাখছিল। ফলে ইঙ্গলথর্পের পক্ষে কাগজটা নষ্ট করা সম্ভব হল না। ফুলদানীর মধ্যে ওটা রেখেই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হল।

আমি বললাম মিস হাওয়ার্ড তো কাগজটা সরিয়ে ফেলতে পারতেন।

পোয়ারো বলল মিস হাওয়ার্ড এই কাগজটার কথা জানতেনই না। আসলে ওরা দুজনে কখনও কথা বলবে না বলে ঠিক করে রেখেছিল। ওদের আচরণে সকলে ভাবত ওরা পরস্পরের মহাশত্রু। জন ক্যাভেণ্ডিসের যতক্ষণ পর্যন্ত না বিচার হচ্ছে ততক্ষণ ওরা কোনো ঝুঁকি নিতে চায়নি। পোয়ারো বলল সে মিঃ ইঙ্গলথর্পের ওপর নজর রেখেছিল যদি ওরা কোথাও দেখা করে। কিন্তু লোকটা এত ধুরন্ধর যে এসবের ধার দিয়েও যায়নি। কাগজটা এতদিন যেমন ফুলদানীতে ছিল আরও কিছুদিন থাকতে পারত। কিন্তু আমার সেই হঠাৎ মন্তব্য শুনে পোয়ারো ছুটে গিয়ে এই মহামূল্যবান সূত্রটা আবিষ্কার করে। এজন্য সে আমাকে ধন্যবাদ দিতে লাগল।

এবার আমি প্রশ্ন করলাম পোয়ারো কখন থেকে মিস হাওয়ার্ডকে সন্দেহ করতে শুরু করেছিল।

পোয়ারো বলল যখন তদন্তের সময় সে লক্ষ্য করল যে মিস হাওয়ার্ড মিসেস ইঙ্গলথর্পের চিঠিটা লেখার ব্যাপারে মিথ্যা কথা বলছেন তখন থেকে মিস হাওয়ার্ড সন্দেহের তালিকায় এলেন।

আমি বললাম চিঠিটাতো আমিও পড়েছি কিন্তু কোনো গলদ তো আমার চোখে পড়েনি। পোয়ারো বলল মিসেস ইঙ্গলথর্পের হাতের লেখা বেশ পরিচ্ছন্ন। প্রত্যেকটি শব্দের মাঝে বেশ ফঁক থাকে। এবার চিঠিটার একদম পরে ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে ১৭ই জুলাই কথাটা একটু বিসদৃশ।

আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। পোয়ারো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলল, চিঠিটা আদৌ ১৭ই তারিখে লেখা হয়নি, লেখা হয়েছিল ৭ই তারিখে। মিস হাওয়ার্ড চলে যাবার পরের দিন। ৭ই কথাটার আগে একটা ১ বসিয়ে ওটাকে ১৭ই করা হয়েছে।

মিস হাওয়ার্ড এরকম কেন করলেন জিজ্ঞাসা করলাম। পোয়ারো বলল সে প্রথমে এটা বুঝতে পারছিল না। পরে এটারও সমাধান সে করতে পেরেছে। পোয়ারো বলল যেহেতু মিস হাওয়ার্ড ও মিঃ ইঙ্গলথর্প মামাতো পিসতুতো ভাই-বোন সেহেতু মিস হাওয়ার্ড খুন না করলেও ইঙ্গলথর্পের সহচরী হতে কোনো বাধা নেই। আসলে ওদের মতলব ছিল ঐ সরল বৃদ্ধাকে বিয়ে করে এই উইল লিখিয়ে নেওয়া তারপর সুযোগ সুবিধা মতো ওঁকে খুন করে ফেলা। এরপর বাকি জীবন ওঁরই টাকাতে বাইরে কোথাও পালিয়ে গিয়ে আরামে জীবন কাটানো।

ইঙ্গলথর্পের ওপর যতক্ষণে সকলের সন্দেহ পড়ার ততক্ষণে মিস হাওয়ার্ড সম্পূর্ণ ব্যবস্থা পাকা করে ফেলবেন–এই ছিল তাদের পরিকল্পনা।

মিস হাওয়ার্ড যখন মিডলিংহ্যাম থেকে এলেন তখন কেউ কোনো সন্দেহ করল না। সুযোগমত জনের ঘরে ঐ স্ট্রিকনিন লুকিয়ে রাখলেন। সিন্দুকের মধ্যে দাড়ির গোছাও রেখে দিলেন। ওগুলো যে সময়মত কারও চোখে পড়বে একথা তার জানা ছিল।

আমি বললাম ওরা জনের ওপর দোষ চাপাতে গেল কেন, লরেন্সের ওপরও চাপাতে পারত। আর লরেন্সের হাবভাবও বিশেষ সুবিধের লাগছিল না।

পোয়ারো বলল আমি সেই কারণটা জানি না বলেই একথা বলছি। আসলে লরেন্স ভেবেছিল সিনথিয়াই অপরাধী। আমি বললাম এটা কখনই সম্ভব নয়। পোয়ারো বলল যে অসম্ভব না হওয়ার কিছু নেই। সিনথিয়া ব্রোমাইড পাউডার তৈরি করেছিলেন। ডরকাস বলেছিল যে সিনথিয়া পুরুষের ছদ্মবেশ নিতে পারদর্শী। সুতরাং ওর বিরুদ্ধেই সকলের চেয়ে বেশি সন্দেহ পড়েছে।

পোয়ারো বলতে লাগল, সেই দুর্ঘটনার রাতে লরেন্স তার মার ঘরে ঢুকে খুব ভয় পেয়েছিল। আমি বললাম একথাটা তো আমিই তাকে বলেছিলাম। পোয়ারো মাথা নেড়ে বলে যেতে লাগলেন লরেন্সের সেইসময় নজরে পড়েছিল সিনথিয়ার ঘরে ঢোকার দরজাটার দিকে, এটা ভোলা ছিল।

আমি বললাম লরেন্সই তো বলেছিল দরজাটা বন্ধ ছিল।

পোয়ারো বলল সেজন্যই তো বুঝতে পারা গেল যে লরেন্স সিনথিয়াকে বাঁচাতে চাইছেন।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম বাঁচাতে চাইছে কেন। পোয়ারো বলল লরেন্স সিনথিয়ার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন।

কথাটা শুনে আমি হো হো করে হেসে উঠলাম, বললাম আমি ভালো ভাবেই জানি লরেন্স সিনথিয়াকে এতটুকু পছন্দ করে না।

পোয়ারো মৃদু হেসে জানতে চাইল আমি একথা কি করে জানলাম। আমি বললাম সিনথিয়া নিজেই বলেছে লরেন্সের পছন্দে-অপছন্দে ওর কিছু যায়-আসে না। পোয়ারো বলল স্ত্রীয়াশ্চরিত্রম্ বোঝা দুষ্কর।

আমি যেন কথাটা বিশ্বাস করতে পারলাম না। পোয়ারো বলল এতে অবাক হবার কিছু নেই। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যেত যে সিনথিয়া যখনই জন ক্যাভেণ্ডিসের সঙ্গে হেসে কথা বলেছে তখন লরেন্স ভয়ানক অসন্তুষ্ট হয়েছেন। এর কারণ লরেন্স ভেবেছিলেন সিনথিয়া জনের সঙ্গে প্রেম করছে। সেজন্য যখন লরেন্স দেখলেন ওর মা বিষের দ্বারা মারা গেছেন, তখনও ওর ধারণা হল সিনথিয়া অনেক কিছু জানে। কথাটা ভেবে লরেন্স প্রচণ্ড রেগে গেলেন তাই প্রথমেই কফির কাপটা গুঁড়িয়ে ফেললেন যাতে ওর তলানি আর পরীক্ষা করা না যায়। এরপর থেকেই উনি বলতে লাগলেন মিসেস ইঙ্গলথর্পের মৃত্যুটা স্বাভাবিক।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম তাহলে বাড়তি কফির কাপের ব্যাপারটা কি।

পোয়ারো বলল সে নিশ্চিতভাবে জানত যে মিসেস ক্যাভেণ্ডিসই কফির কাপটা লুকিয়েছেন। তাসত্ত্বেও সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত হওয়ার জন্য সে লরেন্সকে ঐ কাপটা খুঁজতে বলেছিল। লরেন্সও দেখল এরকম একটা কাপ খুঁজে বের করতে পারলে ওর প্রেমিকার ওপর থেকে সব সন্দেহ দূর হয়ে যাবে। এবং বাস্তবে তাই ঘটেছে।

এবার আমার মনের আরেকটা প্রশ্ন পোয়ারোকে করলাম সেটা হল মিসেস ইঙ্গলথর্প মারা যাবার সময় যা বলেছিলেন সেগুলোর কি অর্থ? পোয়ারো বলল সেগুলো তার স্বামীর প্রতি দোষারোপ ছাড়া কিছু নয়।

আমি বললাম শেষ পর্যন্ত তাহলে সব ভালোভাবেই মিটল। জনের সঙ্গে মেরীর মিলন ঘটল।

পোয়ারো বলল এজন্য তাকে ধন্যবাদ দিতে। আমি জানতে চাইলাম কেন তাকে ধন্যবাদ দিতে হবে।

পোয়ারো বলল এরকম একটা ঘটনা ঘটল বলেই ওরা পরস্পরের কাছাকাছি আসার সুযোগ পেল এবং মিলন সম্ভব হল। জন ক্যাভেণ্ডিস যে তার স্ত্রীকে খুব ভালোবাসতেন তা লক্ষ্য করলেই বোঝা যায়। মেরীরও ভালোবাসার অভাব ছিল না কিন্তু সামান্য ভুল বোঝাবুঝিই ওদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করেছিল। মেরী ভালো না বেসেই জনকে বিয়ে করেছিলেন–জন একথা জানত। তবুও সে কখনই মেরীর ওপর জোর করে ভালোবাসা চাপাতে দেয়নি। শুধু ওরা পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছিল।

আর ঠিক সেই মুহূর্তেই মেরীর মনে প্রেম জেগে ওঠে। কিন্তু ওদের অহমিকাই পরস্পরের কাছে আসার পথে দুস্তর বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এরই ফলস্বরূপ জন মিসেস রেইকসের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হলেন আর মেরী ডঃ বরস্টিনের সঙ্গে বন্ধুত্বের ভান করলেন।

পোয়ারো একটা অদ্ভুত কথা শোনাল। ইচ্ছে করলেই সে জন ক্যাভেণ্ডিসকে তাড়াতাড়ি মুক্তি দেবার ব্যবস্থা করতে পারত। কিন্তু মেরীর কথা ভেবেই সে তা করেনি। যে চরম বিপদের মধ্য দিয়ে তাদের যেতে হয়েছে সেটা না হলে ওদের মত দাম্ভিক স্বামী-স্ত্রীর পুনর্মিলন কখনও সম্ভব হত না।

আমি অবাক বিস্ময়ে পোয়ারোর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ঐ ছোটখাটো মানুষটাকে কত বড়, কত মহৎ মনে হচ্ছে। মনে মনে ভাবলাম সত্যি পোয়ারো ছাড়া আর কারও পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব নয়। খুনের কিনারা করতে গিয়ে সে প্রেমের পুনরুজ্জীবন ঘটাল।

পোয়ারো বোধহয় আমার মনের কথাটা বুঝতে পেরেছিল। হাসি মুখে তবু জানতে চাইল আমি এত কি ভাবছি।

আমি প্রত্যুত্তরে শুধু একটু হাসলাম।

হঠাৎ দরজায় টোকার শব্দ ফিরে তাকিয়ে দেখলাম সিনথিয়া দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকে ঘরের ভেতরে আসার জন্য অভ্যর্থনা জানালাম। সিনথিয়া ঘরের ভেতরে এলেও বসতে রাজী হল না। সে বলল আমাদেরকে সে একটা কথা বলতে এসেছে।

আমি বললাম কি সেই কথা।

হঠাৎ একটু ইতস্ততঃ করল সিনথিয়া, তারপর তাড়াতাড়ি বলল আমরা নাকি ভীষণ ভালো। এরপর আমাকে আর পোয়ারোকে একটু আদর করেই এক দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

ঘটনার আকস্মিকতায় দারুণ অবাক হলাম। সিনথিয়ার কাছে আদর পাওয়ার মজাটা যেন মাটি হয়ে গেল এত খোলাখুলি হওয়ায়।

পোয়ারো জিজ্ঞাসা করল আমি কিছু বুঝেছি কিনা। আসল ব্যাপারটা হল সিনথিয়া এবার বুঝতে পেরেছেন লরেন্স আর ওকে অপছন্দ করছেন না।

আমি কিছু বলতে গেলাম। পোয়ারো আমাকে বাধা দিয়ে বলল আর কিছু বলার নেই। মঁসিয়ে লরেন্সও এসে গেছেন।

আমি পেছন ফিরতেই দরজার পাশে লরেন্সকে দেখতে পেলাম। পোয়ারো তাকে। অভিনন্দন জানাল। পোয়ারোর কথায় লরেন্সের মুখটা লাল হয়ে উঠল। আমতা আমতা করে একটু হাসল শুধু।

আমার মনে হল সত্যি প্রেমে পড়লে মানুষ বোধ হয় এরকম বোকা হয়ে যায়। সিনথিয়ার সুন্দর মুখটা মনের পর্দায় ভেসে উঠল। আমার বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।

পোয়ারো জানতে চাইল আমার কিছু হয়েছে কিনা। আমি বললাম কিছুই হয়নি। তারপর হঠাৎ বলে ফেললাম মেরী ও সিনথিয়া দুটো মেয়েই খুব ভালো।

পোয়ারো মজা করে বলল ওদের দুজনের কেউ আমার জন্য নয়। সে আমাকে হতাশ হতে বারণ করল। আবার নতুনভাবে কোথাও ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য আহ্বান জানাল।

আমার মনের কথা এভাবে বুঝতে পারল দেখে আমি সম্মোহিতের মত পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে রইলাম।