০৩. দ্বিতীয় তলের একটা ধারণা

এই অধ্যায়টি বোধগম্য হবার জন্য বাড়িটার দ্বিতীয় তলের একটা ধারণা থাকা আবশ্যক। শুধুমাত্র পুব দিক দিয়েই পরিচারিকাদের ঘরে যাওয়া যায়। মিঃ ও মিসেস ইঙ্গলথর্প বাড়িটির দক্ষিণ অংশে থাকেন–পরিচারকদের ঐ অংশে প্রবেশ করার উপায় নেই।

তখন প্রায় মধ্যরাত। লরেন্সের ডাকাডাকিতে আমার ঘুম ভেঙে গেল। লরেন্সের হাতে একটা বাতি ছিল। সেই আলোয় লরেন্সের উত্তেজিত মুখ দেখে বুঝলাম কোনো অঘটন ঘটেছে। ধড়মড়িয়ে বিছানায় উঠে বসলাম।

কি হয়েছে জানতে চাওয়ায় লরেন্স বলল তার মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি আবার ঘরের ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে রেখেছেন।

ড্রেসিং গাউনটা টেনে নিয়ে লরেন্সের সঙ্গে মিসেস ইঙ্গলথর্পের ঘরের দিকে ছুটলাম। জন ও কয়েকজন পরিচারক সেখানে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

লরেন্স উদগ্রীব হয়ে ভাইয়ের দিকে তাকালো। জন মিসেস ইঙ্গলথর্পের ঘরের দরজার হাতলটা ধরে জোরে ঝাঁকুনি দিল। কিন্তু দরজা খুলল না।

ঘরের ভেতর থেকে মাঝে মাঝে একটা গোঙানির শব্দ আসছে।

ডরকাস বলল, মিঃ ইঙ্গলথর্পের ঘরের দরজা দিয়ে ঢোকা যায় কিনা দেখতে। কথাটা শুনেই চারদিকে তাকালাম, দেখলাম মিঃ ইঙ্গলথর্প আমাদের মধ্যে নেই। জন তাড়াতাড়ি ওর ঘরটা খুলে ঢুকলো, বাতি হাতে নিয়ে লরেন্সও ঢুকলো। হালকা বাতির আলোয় দেখতে পেলাম নির্ভাজ শয্যা, বিছানাটা যে কেউ ব্যবহার করেনি তা পরিষ্কার বোঝা গেল।

দুই ঘরের মাঝের দরজাটাও বন্ধ। মিসেস ইঙ্গলথর্পের ঘরে ঢোকার কোনো উপায় নেই।

ডরকাস কেঁদে বলল তাহলে কি করা যাবে?

জন বলল দরজা ভেঙে ফেলা ছাড়া কোনো উপায় নেই, যদিও কাজটা খুব শক্ত। জন বলল কেউ যেন নিচে গিয়ে বেইলীকে ডেকে তাড়াতাড়ি ডাঃ উইলকিন্সকে খবর দিতে বলে।

হঠাৎ সে বলে উঠল, সিনথিয়ায় ঘর দিয়েও তো ঢোকা যেতে পারে, জন দৌড়ে সিনথিয়ার ঘরে গেল। মেরী ক্যাভেণ্ডিস সিনথিয়াকে ঘুম থেকে তোলার চেষ্টা করছিলেন, সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।

একটু পরে জন বেরিয়ে এসে জানাল ঐ দরজাটাও বন্ধ। সুতরাং দরজা ভাঙা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

আমরা সবাই মিলেই প্রচণ্ড ধাক্কা দিলাম। মনে হল বৃথা চেষ্টা করছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সকলের মিলিত প্রচেষ্টায় দরজাটা সশব্দে ভেঙে পড়ল। সকলে একসাথে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লাম।

লরেন্স আলোটা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। দেখলাম–মিসেস ইঙ্গলথর্প বিছানায় পড়ে আছেন– সারা শরীর কাঁপছে। বিছানার পাশে একটা টেবিল উল্টে পড়ে আছে। দুএক মুহূর্তের মধ্যেই মিসেস ইঙ্গলথর্প শিথিল ভঙ্গীতে বালিশের ওপর পড়ে গেলেন।

জন তাড়াতাড়ি গিয়ে গ্যাসটা জ্বালাল। পরিচারিকা অ্যানিকে ডেকে একটু ব্র্যাণ্ডি আনতে বলেই মার কাছে এগিয়ে গেল। আমি বারান্দার দিকের দরজাটা খুলে দিলাম।

হঠাৎ লরেন্সের মুখ দেখে অবাক হয়ে গেলাম। কী ভয়ার্ত মুখ! বাতি ধরে থাকা হাতটা কাঁপছে আর ও উল্টো দিকের দেওয়ালে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা দেখে যেন ও পাথর হয়ে গেছে। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে কিছুই বুঝতে পারলাম না।

মিসেস ইঙ্গলথর্পের দিকে এবার তাকালাম, মনে হল উনি যেন কিছুটা সামলে উঠেছেন, দুএক কথা বললেন।

দরজার দিকে মেরী ক্যাভেণ্ডিস সিনথিয়াকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়েছেন। মেরী বললেন, সিনথিয়া খুব ভয় পেয়েছে।

বাইরে ভোরের আলো ফুটে উঠেছে, ঘড়িতে দেখলাম পাঁচটা বাজে। একটা ঘড়ঘড় শব্দ শুনে মিসেস ইঙ্গলথর্পের দিকে তাকালাম। আবার ব্যথায় কাতরে উঠেছেন তিনি। হঠাৎ মাথাটা অনেকটা উঁচু করলেন তিনি, দেহটা ধনুকের মত বেঁকে গেল একবার। জন আর মেরী বৃথা ব্র্যাণ্ডি পান করানোর চেষ্টা করতে লাগল-ব্যথার কোনো উপশম হল না।

এমন সময় ঘরে ঢুকলেন ডাঃ বরস্টিন। যন্ত্রণার শরীরটার দিকে স্তম্ভিতভাবে তাকিয়ে রইলেন শুধু। আর ঠিক তখনই মিসেস ইঙ্গলথর্প ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে শ্বাসরুদ্ধ কণ্ঠে আলফ্রেড অর্থাৎ তার স্বামীর নাম নিলেন আর তারপরেই অচেতন অবস্থায় বিছানায় ঢলে পড়লেন।

ডাক্তার তাড়াতাড়ি বিছানার কাছে এগিয়ে গিয়ে রোগিণীর একটা হাত তুলে ঝাঁকাতে লাগলেন। আমাদের হাতের ইঙ্গিতে দরজার দিকে সরে যেতে বললেন। কিন্তু অল্পক্ষণের মধ্যেই সব শেষ হয়ে গেল।

এই সময় ঘরে ঢুকলেন ডঃ উইলকিন্স, মিসেস ইঙ্গলথর্পের পারিবারিক চিকিৎসক।

ডাঃ বরস্টিন ডাঃ উইলকিন্সের দিকে এগিয়ে গেলেন। দুএক কথায় জানালেন কিভাবে তিনি এখানে এসেছেন। বাড়ির প্রধান ফটকের সামনে নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি ব্যাপারটা গাড়ির চালকের কাছে শোনেন। সেই মুহূর্তে তিনি ছুটে এসেছেন।

ডাঃ উইলকিন্স গভীর সমবেদনা জানালেন। তিনি বললেন মিসেস ইঙ্গলথর্প তার উপদেশ একদম শুনতেন না। তিনি এত কাজ পাগল ছিলেন যে কাজ নিয়ে সবসময় ব্যস্ত থাকতেন।

ডাঃ বরস্টিন ধীরে ধীরে ডঃ উইলকিন্সকে বললেন রোগিণীর অবস্থা ধনুষ্টংকারের চেয়েও মারাত্মক হয়েছিল। ডাঃ উইলকিন্স বিস্ময় প্রকাশ করলেন। ডাঃ বরস্টিন জনকে বললেন তিনি ডাঃ উইলকিন্সের সঙ্গে কিছু গোপনীয় আলোচনা করতে চান। এ ব্যাপারে জনের কোনো আপত্তি আছে কিনা জানতে চাইলেন। জন বলল তার কোনো আপত্তি নেই।

সবাই বারান্দায় বেরিয়ে এলে ডাক্তার দরজা বন্ধ করে দিলেন।

আমরা ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলাম। মনে মনে বেশ উত্তেজনা অনুভব করতে লাগলাম। বিভিন্ন অদ্ভুত চিন্তা এল মনের মধ্যে।

জন ও লরেন্সের সঙ্গে খাওয়ার ঘরে এসে বসলাম। সকলেই চুপচাপ বসে আছে। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেছে, হঠাৎ সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনে বুঝতে পারলাম দুই ডাক্তার নেমে আসছেন। ডাঃ উইলকিন্সকে চিন্তিত দেখাল, ডাঃ বরস্টিনের মুখটাও গম্ভীর, ডাঃ উইলকিন্স জনের দিকে তাকিয়ে জানালেন তাদের ইচ্ছা মৃতদেহ ময়নাতদন্ত করা। এ ব্যাপারে তারা জনের অনুমতি চান।

জনের মুখটা খুবই করুণ দেখাল। সে জিজ্ঞাসা করল এটা করা কি একান্তই দরকার। ডাঃ বরস্টিন বললেন, তাদের দুজনের কেউই এক্ষেত্রে ডেথ সার্টিফিকেট দিতে পারছেন না।

জন শেষ পর্যন্ত সম্মতি দিল।

ডাঃ বরস্টিন জনের হাতে দুটো চাবি দিয়ে বললেন তিনি দরজায় চাবি লাগিয়ে দিয়েছেন, কারণ ঘর দুটো আপাততঃ বন্ধ থাকাই ভালো।

দুই ডাক্তার এবার বিদায় নিলেন।

অনেকক্ষণ ধরে মনের মধ্যে একটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। ভাবছিলাম জনকে বলি, কিন্তু জন খুবই নির্বিরোধী মানুষ, প্রচার জিনিসটাকে ভীষণ ভয় করে। শেষ পর্যন্ত অনেক ভেবে জনকে বললাম তার সঙ্গে আমার কথা আছে।

জন জানতে চাইল আমি কি বলতে চাইছি। আমি বললাম সে যদি রাজী থাকে তাহলে এই ব্যাপারে তদন্ত করার জন্য বিখ্যাত গোয়েন্দা পোয়ারোকে ডাকতে পারি, যিনি আপাতত এখানেই আছেন। জন চমকে উঠল, বলল ময়না তদন্তের আগেই এসব করা কি ঠিক হবে। আমি বললাম, ডাকতে হলে এখনই ডাকতে হবে কারণ সত্যিই যদি কোনো রহস্য থাকে তাহলে জানা যাবে।

কথাটা শুনে লরেন্স রেগে বলল রহস্য-টহস্য সব বাজে কথা। এসব বরস্টিনের পাগলামি। সেই ডাঃ উইলকিন্সের মাথায় এই ভুল ধারণাটা ঢুকিয়ে দিয়েছে। বরস্টিন সব সময় বিষ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে বলে সব কিছুর মধ্যেই বিষ দেখে।

লরেন্সকে এরকম রেগে যেতে কখনও দেখিনি, জন অবশ্য একটু ইতস্ততঃ করতে লাগল। শেষ পর্যন্ত জনই লরেন্সকে বলল আমার কথা মত একটা চেষ্টা চালাতে। তবে সে কেলেঙ্কারীর কথা ভেবে একটু দ্বিধা করতে লাগল।

আমি তাকে আশ্বস্ত করে বললাম কেলেঙ্কারীর কোনো ভয় নেই, এ ব্যাপারে পোয়ারোকে অনায়াসে বিশ্বাস করা যেতে পারে। জন আমার ওপর সব ভার ছেড়ে দিতে চাইল।

ঘড়িতে দেখলাম ছটা বাজে। সুতরাং আর সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে পড়লাম, শুধু বেরোনোর আগে একটা বইয়ের পাতা ঘেঁটে স্ট্রিকনিন প্রয়োগের ফলাফল কি হয় দেখে নিলাম।