১.৩ ব্যারাকের মতো দালান

তিন দিকে লম্বা লম্বা ব্যারাকের মতো দোতালা-তেতলা দালান ছাড়াও রয়েছে টিনের বা টালির চালের বেশ কিছু বাড়ি। বেশির ভাগ বাড়ির একতলায় নানা ধরনের দোকানপাট। মুদিখানা, ধোবিখানা, ওষুধের দোকান, জামাকাপড়ের দোকান, দাওয়াখানা, ছোটখাট হোটেল ইত্যাদি ইত্যাদি। বিজলিবাতি ছাড়াও কোনও কোনওটায় গ্যাসের আলোও জ্বলছে।

মস্ত মাঠটা বাজারের সামনের দিকে। সেখানে চল্লিশ-পঞ্চাশটা বাঁশের খুঁটি পুঁতে সেগুলোর গায়ে লম্বা ইলেকট্রিকের তার বেঁধে বাল্ব জ্বালানো হয়েছে। মাঠের বেশ খানিকটা জায়গা জুড়ে বসার জন্য চট পাতা। একধারে কটা চেয়ার এবং সাদা ধবধবে চাদর দিয়ে ঢাকা একটা টেবিল।

প্রচুর লোকজন জমা হয়েছে এখানে। চেহারা দেখে বোঝা যায়। এদের কেউ শিখ, কেউ মাদ্রাজি, কেউ বর্মী, কেউ পাঠান এবং ভারতের নানা অঞ্চলের মানুষ। জনতা কিন্তু চটের ওপর বসেনি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। চারপাশ থেকে অজস্র মাছির ভনভনানির মতো আওয়াজ আসছে।

এই মাঠে আজ কি মিটিং টিটিং কিছু আছে? যদি থাকেও তার সঙ্গে মেনল্যান্ড থেকে আসা উদ্বাস্তুদের কী সম্পর্ক? তাদের এখানে নিয়ে আসা হল কেন? বুঝতে না পেরে ধন্দে পড়ে যায় বিনয়। সে কিছু জিগ্যেস করতে যাচ্ছিল, তার আগেই বিশ্বজিৎ বললেন, ‘যে মাঠটায় আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি তার সঙ্গে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের একটা গ্লোরিয়াস চ্যাপটার জড়িয়ে আছে।‘

আন্দামান সম্পর্কে নানা বইপত্র পড়েছে বিনয়। সে জানে আঠারোশো সাতান্নর মিউটিনির পর ইংরেজরা বহু সিপাহিকে গুলি করে বা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে। অনেককে পোর্ট ব্লেয়ারে নির্বাসনে পাঠায়। তারপর বিশ শতকের গোড়ার দিকে। দেশের মুক্তির জন্য যখন সশস্ত্র অভ্যুত্থান শুরু হল তখন বাংলা, পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্র এবং ভারতের অন্য সব প্রভিন্স থেকে বিপ্লবীদের ধরে ধরে বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপে নিয়ে আসা হয়। এবারডিন মার্কেটের সামনের মাঠটায় এমন কিছু কি ঘটেছিল যাতে বিদ্রোহী সিপাহি বা পরবর্তী কালের বিপ্লবীরা জড়িত ছিলেন? বিনয়ের তা জানা নেই।

বিশ্বজিৎ বললেন, ‘সেকেন্ড গ্রেট ওয়ারের সময় নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্দামানে এসেছিলেন। এই মাঠে তিনি আমাদের জাতীয় পতাকা তুলেছেন।‘

সারা শরীরে শিহরন অনুভব করে বিনয়। পরক্ষণে গভীর বিষাদে মন ভরে যায়। দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক আর ফিরে আসেননি। কাগজে মাঝে মাঝেই খবর বেরয়, তিনি আসছেন, তিনি আসছেন। কিন্তু আসেন আর না। দেশের মানুষ বিপুল প্রত্যাশা আর অসীম উৎকণ্ঠা নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। বিনয় তাদেরই একজন। হঠাৎ তার মনে হল, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শেষ হয়েছে এই তো সেদিন। মাত্র কয়েক বছর আগে। তখন কি বিশ্বজিৎ এই দ্বীপে ছিলেন? থাকা অসম্ভব নয়। উৎসুক সুরে জিগ্যেস করে, ‘আপনি কি নেতাজিকে দেখেছেন?’

‘না। আমি স্বাধীনতার পর পোর্ট ব্লেয়ারে এসেছি।‘ বিশ্বজিৎ বললেন, ‘তবে আমার কাকা তাকে দেখেছেন।‘

সব কেমন যেন গুলিয়ে গেল। রীতিমতো অবাকই হল বিনয়। বলল, ‘আপনার কাকা! তিনি কীভাবে—’

তাকে শেষ করতে দিলেন না বিশ্বজিৎ। ‘কাকা নাইনটিন টোয়েন্টিতে আন্দামানে এসেছিলেন। সেই থেকে এখানেই আছেন।‘

নাইনটিন টোয়েন্টি। অর্থাৎ সেটা ইংরেজ আমল। বিশ্বজিতের কাকা সম্পর্কে কৌতূহল প্রবল হয়ে ওঠে বিনয়ের। সে জানতে চায়, উনি কি ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের কোনও সারভিস নিয়ে এই আইল্যান্ডে এসেছিলেন?

‘একেবারে উলটো।‘ বিশ্বজিৎ হাসলেন।–’ইংরেজদের গোলামি করার কথা তিনি কল্পনাও করতে পারতেন না। বরং এ দেশ থেকে তাদের উৎখাত করাই ছিল তার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। কাকা ছিলেন একজন সশস্ত্র বিপ্লবী–ইংরেজরা বলত টেররিস্ট।‘

বিশ্বজিৎ বিশদভাবে জানালেন তাঁর কাকা শেখরনাথ কর এবং আরও কয়েকজন বিপ্লবী উনিশশো আঠারোয় বিহারে একটি মেল ট্রেনে হানা দিয়েছিলেন। কানপুর থেকে একটা বগিতে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ট্রেনটা কলকাতায় যাচ্ছিল। শেখরনাথদের উদ্দেশ্য, অস্ত্রগুলো লুট করা।

বগিটা পাহারা দিয়ে আনছিল পুলিশের বড়সড় একটা বাহিনী আর দু’জন জঁদরেল ব্রিটিশ অফিসার। দু’পক্ষের গোলাগুলিতে তিনজন বিপ্লবী মারা যান, কয়েকজন মারাত্মক জখম হন। ওদিকে একজন ব্রিটিশ অফিসার আর তিনজন কনস্টেবলেরও মৃত্যু হয়, চার-পাঁচজন কনস্টেবলেরও গুরুতর চোট লাগে। তখন মধ্যরাত। অন্য কামরাগুলোতে যাত্রীরা ঘুমাচ্ছিল। গুলির আওয়াজে তারা জেগে ওঠে। আতঙ্কে হইচই করতে করতে ট্রেনের অ্যালার্ম চেন টেনে দেয়। শেখরনাথ এবং তার পাঁচ সঙ্গীর হাতে পায়ে গুলি লেগেছিল। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল সারা গা। সেই অবস্থাতেই ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়ে পালিয়ে যান।

অন্ধকারে তিন বিপ্লবী দৌড়তে দৌড়তে বিহারের এক অজ দেহাতে লুকিয়ে ছিলেন কিন্তু পুলিশ গন্ধ শুঁকে শুঁকে সেখানে পৌঁছে যায়। ধরা পড়ার পর কিছুদিন অকথ্য নির্যাতন চলে। তারপর বিচার। আইনকানুন ইংরেজদের, আদালত ইংরেজের, বিচারক ইংরেজ। ফলে যা হবার তা-ই হল। দুই বিপ্লবীর ফাঁসি হয়ে গেল আর শেখরনাথকে পাঠানো হল সেলুলার জেলে। বাকি। জীবন এখানেই তাকে কাটাতে হবে। সেলুলার জেলের সলিটারি সেলে কয়েক বছর আটকে রাখার পর তাকে জেলখানার বাইরে আনা হয়। তখন পোর্টব্লেয়ারে পাহাড় কেটে নতুন নতুন রাস্তা বানাচ্ছে পি.ডব্লু.ডি, শেখরনাথকে সেখানে হিসাব রাখার কাজ দেওয়া হয়। কারাগারের নির্জন কুঠুরি থেকে একটুখানি মুক্তি পেলেন ঠিকই, কিন্তু মেনল্যান্ডে যে পালিয়ে আসবেন তার উপায় নেই। চারদিকে গভীর জঙ্গল আর সমুদ্র। জঙ্গলে রয়েছে হিংস্র আদিবাসীরা, সমুদ্রে তাদের চেয়েও ভয়ংকর ঝাঁকে ঝাকে হাঙর। যেদিকেই যান, পালানো অসম্ভব। ধীরে ধীরে আন্দামানকে ভালোবেসে ফেললেন শেখরনাথ, আশ্চর্য এক মায়ায় জড়িয়ে গেলেন বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপমালার সঙ্গে। স্বাধীনতার পর ইন্ডিয়ার মেনল্যান্ডে ফিরে যেতে পারতেন। যাওয়া হয়নি।

অবাক বিস্ময়ে শুনে যাচ্ছিল বিনয়। যেন এক অবিশ্বাস্য রোমাঞ্চকর কাহিনি। জগদীশ গুহঠাকুরতা বারবার বলে দিয়েছিলেন, শুধুমাত্র উদ্বাস্তু পুনর্বাসন নয়, আন্দামনের সমস্ত দিক নিয়ে তাকে লেখা পাঠাতে হবে। বিশেষ করে জোর দিতে হবে। সেলুলার জেলের ওপর। কুখ্যাত এই জেলখানায় জীবনের বহু মূল্যবান সময় কাটিয়ে দিয়েছেন শেখরনাথ। তার কাছ থেকে ব্রিটিশ আমলে এই বন্দিশালায় কী ধরনের নির্মম উৎপীড়ন চালানো হত, সেসব তথ্য জানা যাবে।

বিনয় ব্যগ্র হয়ে ওঠে।-কাকার সঙ্গে আলাপ করতে চাই। ওঁকে কোথায় পাওয়া যাবে?

বিশ্বজিৎ বললেন, ‘নিশ্চয়ই আলাপ হবে। তবে আপাতত উনি পোর্টব্লেয়ারে নেই, লিটল আন্দামানে গেছেন। দু’চার দিনের ভেতর ফিরে আসবেন।‘

‘আজ যে উদ্বাস্তুরা এসেছে আমি তো তাদের সঙ্গে পুনর্বাসনের জায়গায় চলে যাব। কাকার সঙ্গে দেখা হবে কী করে? বিনয়ের গলায় হতাশা ফুটে বেরয়।

তার মনোভাবটা আঁচ করে নিয়ে বিশ্বজিৎ বললেন, কাকা এখন উদ্বাস্তুদের মধ্যে কাজ করছেন। আপনি যেখানে যাচ্ছেন, লিটল আন্দামান থেকে ফিরেই তিনি সেখানে চলে যাবেন।

আরও অনেক প্রশ্ন ছিল বিনয়ের, কিন্তু সেসব করা হল না।

‘বইয়া (বসে) পড়েন, বইয়া পড়েন।’ ওদিকে তুমুল হাঁকাহাঁকি করে চটের আসনের ওপর বসিয়ে দিতে লাগল নিরঞ্জন আর বিভাস। সভাটভা যা-ই হোক তা যে উদ্বাস্তুদের জন্যই, সেটা এখন বোঝা যাচ্ছে। তবে উদ্দেশ্য ধরা যাচ্ছেনা।

এলাকাটা ঘিরে আগে থেকেই জমায়েত হয়েছিল, তাদের মধ্যে হঠাৎ চাঞ্চল্য দেখা গেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একটা ধবধবে ফিয়েট গাড়ি আর একটা জিপ এসে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে পড়ে। জিপ থেকে নেমে আসে তিন চারজন কনস্টেবল। ফিয়েট থেকে মাঝবয়সি একজন–বেশ সুপুরষ। চোখে পুরু ফ্রেমের চশমা, মাথায় ব্যাকব্রাশ করা কাঁচাপাকা চুল। চেহারায় প্রবল একটা ব্যক্তিত্ব রয়েছে। পরনে ঢোলা ট্রাউজার্স এবং শার্ট।

বিশ্বজিৎ বললেন, ‘চিফ কমিশনার এসে গেছেন। চলুন আমার সঙ্গে।’ বলে ব্যস্তভাবে এগিয়ে গেলেন। তার পাশাপাশি লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতে লাগল বিনয়। প্রৌঢ়টি যে চিফ কমিশনার, আন্দাজ করে নিতে অসুবিধা হয় না।

চিফ কমিশনারের কাছে এসে সসম্ভ্রমে বিশ্বজিৎ বললেন, ‘আসুন স্যার–’ টেবিল চেয়ারগুলো যেখানে সাজানো রয়েছে। তাকে সেখানে নিয়ে গেলেন। একটু দূরে দাঁড়িয়ে রইল বিনয়।

ইংরেজিতেই কথা বলছিলেন বিশ্বজিৎরা। বোঝা গেল, চিফ কমিশনার অবাঙালি। তিনি চেয়ারে বসলেন না, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে উদ্বাস্তুদের উদ্দেশে যা বললেন, মোটামুটি এইরকম। ‘আন্দামানে আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি। দেশভাগের পর সব কিছু হারিয়ে আপনারা ভারতে চলে এসেছিলেন। নিদারুণ কষ্ট আর দুর্ভোগের মধ্যে আপনাদের দিন কেটেছে। পশ্চিমবাংলা ছোট রাজ্য। সেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষকে দেবার মতো যথেষ্ট জমি নেই। তাই বাংলার বাইরে উদ্বাস্তুদের পাঠানোর ব্যবস্থা হয়েছে। বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরের মাঝখানের এই দ্বীপে। কিন্তু আন্দামান সম্পর্কে ইন্ডিয়ান মেনল্যান্ডের মানুষের ভীষণ ভয়, অস্বস্তি। সংশয় কাটিয়ে আপনারা যে শেষ পর্যন্ত এখানে এসেছেন, এতে আপনাদের ভালোই হবে। আপনাদের জন্য প্রচুর জমি ঠিক করা আছে। এখানে সুখে শান্তিতে বাস করুন। আন্দামানের সব অফিসার আর কর্মী আপনাদের সমস্তরকম সাহায্য করবেন।’

পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর কথাগুলো বাংলায় তরজমা করে দিতে লাগলেন বিশ্বজিৎ।

ভাষণ শেষ করে চিফ কমিশনার উদ্বাস্তুদের মধ্যে চলে গেলেন। নিরঞ্জন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ‘আপনেরা হলে উইঠা খাড়। চিফ কমিশনার সাহেব আপনেগো লগে আলাপ করবেন।

উদ্বাস্তুরা লহমায় উঠে দাঁড়াল। সবাই ত্রস্ত, সচকিত।

চিফ কমিশনারের সঙ্গে বিশ্বজিৎও এসেছিলেন। উদ্বাস্তুদের চোখমুখের চেহারা লক্ষ করে বললেন, ভয়ের কিছু নেই। আমি তো আছি। উনি যা জিগ্যেস করছেন তার জবাব দেবেন।

বয়স্কদের সঙ্গে কথা বলতে লাগলেন চিফ কমিশনার। পূর্ব পাকিস্তানে কার বাড়ি কোথায় ছিল, কতদিন আগে দেশ থেকে চলে এসেছে, কলকাতায় কোথায় কাটিয়েছে, জাহাজে পোর্টব্লেয়ারে আসতে কোনওরকম কষ্ট হয়েছে কি না, ‘রস’ আইল্যান্ডে নেমে খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করেছে কি না ইত্যাদি।

বিশ্বজিতের ভূমিকাটা দোভাষীর। সমানে ইংরেজি থেকে বাংলা এবং বাংলা থেকে ইংরেজি করে যাচ্ছিলেন।

আলাপ-টালাপ হয়ে গেলে আবার সেই টেবিল চেয়ারগুলোর কাছে চলে এলেন চিফ কমিশনার। বিশ্বজিৎকে জিগ্যেস করলেন, ‘এদের কি কাল রিহ্যাবিলিটেশনের জায়গায় নিয়ে যাওয়া হবে, না দু’একদিন ওরা পোর্টব্লেয়ারে থেকে যাবে?’

বিশ্বজিৎ জানালেন, ‘না স্যার। রাতটা এখানে কাটিয়ে কাল সকালে ডি.পি ফ্যামিলিগুলোকে নিয়ে যাওয়া হবে।’

‘দেখো, ওদের যেন কোনও অসুবিধে না হয়।’

‘হবে না। সব ব্যবস্থা করা আছে।’

‘গুড। আমি এখন যাচ্ছি–’

চিফ কমিশনার তার ফিয়েটের দিকে পা বাড়াতে যাবেন, হঠাৎ বিনয়ের কথা মনে পড়ে গেল বিশ্বজিতের। বলল, ‘স্যার, একজনের সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দেব।

‘কে?’

বিশ্বজিৎ বিনয়কে ডেকে আলাপ করিয়ে দিলেন। চিফ কমিশনার রীতিমতো খুশি। বললেন, ‘আপনিই বোধহয় প্রথম সাংবাদিক যিনি আন্দামানের রিফিউজি সেটলমেন্ট দেখতে এলেন। মোস্ট ওয়েলকাম।‘ একটু থেমে ফের বলেন, ‘খবর পাচ্ছি রিফিউজিরা যাতে এখানে না আসে সে জন্যে কোনও কোনও পলিটিক্যাল পার্টি কলকাতায় অ্যাজিটেশন শুরু করেছে? কী চাইছে পার্টিগুলো? ওদের মুভমেন্ট কি বিরাট আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে?’

এসব প্রশ্নের সঠিক জবাব জানা নেই বিনয়ের। কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় এখন রিফিউজিদের নিয়ে কত যে মিছিল চোখে পড়ে! পার্কে পার্কে মিটিং। স্লোগানে স্লোগানে আকাশ চৌচির হয়ে যায়। নিজের চোখে বিনয় ক’মাস আগে মিশন রো’তে উদ্বাস্তুদের সঙ্গে পুলিশের তুমুল লড়াই দেখেছে। বেপরোয়া লাঠি, টিয়ার গ্যাস, এমনকী গুলিও চালিয়েছে পুলিশ। উদ্বাস্তুরা মুখ বুজে বরদাস্ত করেনি; খোয়া ইট হাতের কাছে যা পেয়েছে তারাও পুলিশের দিকে তাক করে সমানে ছুঁড়ে গেছে।

অনেকে বলে কমিউনিস্ট পার্টি এবং অন্য বামপন্থী দলগুলো উদ্বাস্তুদের মধ্যে ‘বেস’ তৈরি করার জন্য তাদের খেপিয়ে তুলছে। লক্ষ লক্ষ শরণার্থী যাদের কোনও আশা নেই, ভবিষ্যৎ নেই, চোখের সামনে শুধুই অনন্ত তমসা, এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে নিয়ে ওরা নিজেদের শক্তি বাড়াতে চায়।

বিনয় অস্বস্তি বোধ করছিল। বলল, ‘পার্টিগুলোর মোটিভ কী, আমি ঠিক বলতে পারব না। তবে নানা লোকে নানা কথা বলে।‘ কী বলে সেটা আর জানায় না।

চিফ কমিশনার এ ব্যাপারে আর কিছু জিগ্যেস করলেন না। একেবারে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন।–’আপনি রিফিউজি সেটলমেন্টগুলোতে যান। ঘুরে ঘুরে দেখুন রিহ্যাবিলিটেশনের কাজ কীভাবে চলছে। ত্রুটি চোখে পড়লে নিশ্চয়ই লিখবেন। কনস্ট্রাকটিভ সমালোচনা সব সময় কাম্য। কিন্তু দয়া করে এমন কিছু লিখবেন না যাতে কলকাতায় আগুন লেগে যায়। তাহলে যা-ও রিফিওজি আসছে, সেটা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। পুনর্বাসনের এত বড় একটা পরিকল্পনা যাতে বানচাল না হয়ে যায়। সেটা মাথায় রাখবেন। আচ্ছা, নমস্কার—’ ক’পা এগিয়ে তিনি তার গাড়িতে উঠে পড়েন।

এধারে নিরঞ্জন আর বিভাস চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছিল, মালপত্তর কান্ধে (কাঁধে) তুইলা আমাগো লগে চলেন। নিশ্চয় হগলটির (সকলের) ক্ষুদা পাইছে। কয়দিন সমুন্দুরে ঝড়-তুফানে। আপনেগো দলামোচড়া কইরা ছাড়বে। আইজ সকালে ‘রস’-এ। নামনের পর সারাটা দিন শরীলের উপর দিয়া মেলা (অনেক) তাফাল গেছে। আমাগো লোকেরা ভাত ডাইল মাছ তরকারি রাইন্ধা বাড়ছে। গিয়া খাইয়া শুইয়া পড়বেন। ঘুমটা জবর দরকার।

উদ্বাস্তুরা যাবার জন্য তৈরি হতে লাগল।

শহরের যেসব দোকানদার, হোটেলওয়ালা, মুদি, সেলুনওয়ালা জড়ো হয়েছিল, চিফ কমিশনার গাড়িতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তারাও সরে পড়েছে।

এধারে বিনয় বলছিল, সকালে পোর্টব্লেয়ারের ভি আই পি বাঙালিরা রিফিউজিদের রিসিভ করতে ‘রস’ আইল্যান্ডে গিয়েছিলেন। সন্ধেবেলা চিফ কমিশনার এবারডিন মার্কেটের সামনে তাদের রিসিভ করলেন। এটাই নিয়ম নাকি?’

‘আপনি লক্ষ করেছেন দেখছি।’ বিশ্বজিৎ বলতে লাগলেন, ‘নিয়ম ঠিক নয়, তবে আন্দামানের রিফিউজি আসা শুরু হতেই এটা চলছে। আসুন, আপনি আমার সঙ্গে যাবেন—’

একটু অবাক হল বিনয়! –’কোথায়?’

‘কোথায় আবার? আমার বাংলোয়।’

‘সে হয় না। রিফিউজিরা আমাকে কিছুতেই ছাড়বে না।’

‘আমি ওদের সঙ্গে কথা বলছি।’

‘কিন্তু—’

‘আবার কী?’

‘কাল সকালে ওরা নতুন সেটলমেন্টের জায়গায় চলে যাবে। ওদের সঙ্গে আমারও তো যাওয়া দরকার।‘

বিশ্বজিৎ হাসলেন।–’যাবেন, নিশ্চয়ই যাবেন। আমিও আপনাদের সঙ্গে যাব। চিন্তা করবেন না।’

উদ্বাস্তুরা কিন্তু নাছোড়। রাত্তিরটা বিশ্বজিতের বাংলোয় গিয়ে বিনয় থাকবে, এটা জানাতেই হুলস্থুল বেধে গেল। বিনয় কড়ার করেছিল, যতদিন না আন্দামানের পুনর্বাসন কেন্দ্রে শরণার্থীরা থিতু হয়ে বসছে সে তাদের সঙ্গে থাকবে। বিনয় আন্দামানে পা দিয়েই যদি অন্য কোথাও রাত কাটাতে যায় কার ভরসায় তারা থাকবে? বিনয় কাছে না থাকলে তারা সেটলমেন্টে তো যাবেই না, এমনকী আজ রাতের জন্য নিরঞ্জনরা সেখানে তাদের নিয়ে যেতে চাইছে, যেখানেও যাবে না।

উদ্বাস্তুদের আশঙ্কাটা কোথায়, মোটামুটি আঁচ করতে পেরেছিল বিনয়। ওরা হয়তো ভেবেছে, ভুজুং ভাজুং দিয়ে আন্দামানে তাদের পৌঁছে দিয়ে বিনয় কলকাতায় চলে যাবে। বিশ্বজিৎ রাহার বাংলোয় রাত কাটাতে যাওয়াটা কৌশলমাত্র। কাল আর সে তাদের কাছে ফিরে আসবে না। আন্দামানের চিফ কমিশনার থেকে বড় বড় অফিসার এবং পুরো পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীরা তাদের যথেষ্ট খাতিরযত্ন করেছে। কিন্তু তাদের ওপর মাত্র একদিনে উদ্বাস্তুদের আস্থা তৈরি হয়নি। বিনয়কে তাদের পাশে চাইই চাই।

বিনয় বলল, ‘আপনাদের হয়তো মনে হয়েছে, এই যে রাহাসাহেব আমাকে তার বাংলোয় নিয়ে যেতে চাইছেন, এর পেছনে আমার কু-মতলব রয়েছে। কিন্তু আপনারা তো শুনেছেন, মুখের কথা খসালেই কলকাতায় ফেরা যায় না। তিন সপ্তাহ পর পর এখান থেকে কলকাতার জাহাজ ছাড়ে। কম করে তিন সপ্তাহ আমাকে এখানে থাকতেই হবে। নিশ্চিন্ত থাকুন, কাল সকালেই আপনাদের কাছে চলে আসব।‘

উদ্বাস্তুরা তাকে ঘিরে ধরেছিল৷ ভিড়ের সামনের দিকে রয়েছে হলধর দাস। তার কাঁধে একটা হাত রেখে বিনয় বলল, ‘আপনি তো জানেন, আপনাদের হেমকর্তার নাতি মিছে কথা বলে না।

অনেক বোঝানোর পর উদ্বাস্তুরা অনিচ্ছাসত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত রাজি হল। আজ রাতটা বিনয় বিশ্বজিৎ রাহার বাংলোয় থাকতে পারে।

বিশ্বজিতের ড্রাইভার কালীপদ তার জিপ নিয়ে ঘুরপথে মাঠের পাশের রাস্তায় এসে অপেক্ষা করছিল। বিনয়কে সঙ্গে করে তিনি সেদিকে চলে গেলেন।

এদিকে বিভাস আর নিরঞ্জন লাইন দিয়ে উদ্বাস্তুদের নিয়ে চলেছে এবারডিন মার্কেটের ডানধারের রাস্তার দিকে। বিনয়ের ধারণা ওখানেই কোথাও শরণার্থীদের রাতে থাকার বন্দোবস্ত করা হয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *