১.২ সেসোস্ট্রেস বে পেরিয়ে

সেসোস্ট্রেস বে পেরিয়ে কোনাকুনি এপারে এলে পোর্ট ব্লেয়ারের গা ঘেঁষে পাশাপাশি দুটো জেটি। দুই স্টিম লঞ্চ সেখানে এসে ভিড়ল। লঞ্চের খালাসি এবং পুনর্বাসন বিভাগের কর্মীদের ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়।

রেলিং-লাগানো কাঠের পাটাতন ফেলে চোখের পলকে ‘রস’ আইল্যান্ডের মতোই এপারের জেটিতে দুই লঞ্চকে জুড়ে দেওয়া হল। এক লঞ্চে এসেছিল বিভাস, অন লঞ্চটায় নিরঞ্জন। তারা হই হই করে উদ্বাস্তুদের নামাতে শুরু করল। মিনিট পনেরোর ভেতর দুই লঞ্চ কঁকা হয়ে গেল। সবার সঙ্গে অফিসাররাও নেমে এসেছেন। বিনয়ও।

জেটি দুটোর পাশ দিয়ে রাস্তা চলে গেছে। একটা সমুদ্রের ধার দিয়ে দিয়ে। অন্যটা উঁচু উঁচু টিলা পেরিয়ে সোজা ওপর দিকে। রাস্তায় জিপ ছাড়াও অনেকগুলো নানা ধরনের মোটর দাঁড়িয়ে আছে। ফিয়েট, হিন্দুস্থান, অষ্টিন ইত্যাদি ইত্যাদি। বিনয় আন্দাজ করে নিল ওগুলো সরকারি অফিসারদের গাড়ি।

সেনসাহেব, মণ্ডলসাহেবরা সেই সকাল থেকে ‘রস’ আইল্যান্ডে কাটিয়ে এসেছেন। সারাদিনের ধকলে ক্লান্তিবোধ করছিলেন। সবার কাছ থেকে আপাতত বিদায় নিয়ে যে যার গাড়িতে উঠে পড়লেন। বিনয়কে বললেন, আপনি তো এখন কিছুদিন আন্দামানে আছেন। পরে আবার দেখা হবে।

অফিসারদের মধ্যে একমাত্র বিশ্বজিৎ রাহাই থেকে গেলেন। আর রইল পুনর্বাসন দপ্তরের কর্মীরা। আজ মেনল্যান্ড থেকে উদ্বাস্তুরা এসেছে ফেলে তো চলে যাওয়া যায় না।

সূর্যটা খানিক আগে আকাশের ঢালে সিনেমার ফ্রিজ শটের মতো আটকে ছিল। এখন আর সেটাকে দেখা যাচ্ছে না। পশ্চিম দিকের উঁচু পাহাড়ের আড়ালে নেমে গেছে। বাসি হলুদের মতো দিনের শেষ ম্যাড়ম্যাড়ে আলো এখনও জঙ্গলে পাহাড়ে এবং উপসাগরে আলতো ভাবে আটকে আছে। বড়জোর আর মিনিট পনেরো; তারপর সেটুকুও থাকবে না। ঝপ করে সন্ধে নেমে যাবে।

উদ্বাস্তুদের জন্য নতুন নতুন বসতির যে পত্তন হচ্ছে সেগুলো পোর্ট ব্লেয়ার থেকে তিরিশ-চল্লিশ কি পঞ্চাশ মাইল দূরে। আজ সকালে চারদিন বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে তারা ‘রস’ আইল্যান্ডে পৌঁছেছে। একটানা সমুদ্রযাত্রার কারণে তাদের সবার শরীর জুড়ে অপার ক্লান্তি। মুখচোখ দেখে টের পাওয়া যায় হাত-পা যেন ভেঙে আসছে। এই অবস্থায় কি ওদের সুদুর জঙ্গলে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে? উদ্বাস্তুদের এই দঙ্গলে শক্তপোক্ত যুবক যুবতী ছাড়াও রয়েছে বাচ্চাকাচ্চা এবং হাড়ের ওপর চামড়াজড়ানো শীর্ণ থুথুড়ে বুড়োবুড়িরা। পাহাড়ি রাস্তায় টাল খেতে খেতে নতুন বসতিতে পৌঁছতে কত রাত হয়ে যাবে, কে জানে। সেই ধাক্কা কি বয়স্ক মানুষগুলো আর বাচ্চারা সামলাতে পারবে?

ঝিনুকের চিন্তাটা বিনয়কে উতলা করে রেখেছিল। তার ফাঁকে ঝাঁকে উদ্বাস্তুদের নিয়ে এই সব ভাবনা তার মাথায় ঢুকে পড়ছে।

বিভাস আর নিরঞ্জনের কর্মকাণ্ডে লেশমাত্র ত্রুটি নেই। হাঁকডাক করে তারা উদ্বাস্তুদের লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। শরণার্থীদের মাথায় বা হাতে তাদের লটবহর। নানা বয়সের বিবাহিত মেয়েদের কোলে কাখে ছোট ছোট দুধের শিশু, সেই সঙ্গে কাধ থেকে ঝুলছে ময়লা চট কি মোট কাপড়ের ঝুলি। সেগুলোর ভেতর টুকিটাকি নানা জিনিসপত্র।

বিভাস টিনের চোঙা মুখে লাগিয়ে উদ্বাস্তুদের উদ্দেশে সমানে চিৎকার করে যাচ্ছিল, ভাইয়েরা বইনেরা মায়েরা, কয়টা দিন। আপনাগো উপুর দিয়া মেলা (অনেক) তাফাল গ্যাচে। আইজ আর আপনাগো নয়া বসতে নিয়া যামু না। রাইতখন পোর্ট ব্লেয়ারে কাটাইয়া কাইল সকালে রওনা দিবেন। সে একনাগাড়ে বলতে লাগল, ‘অহন আমরা যামু এবারডিন বাজারের সুমখে। হেইহানে আপনেগো থাকনের ব্যবস্থা করা আছে। জাগাখান (জায়গা) বেশি। দূরে না। হাইটাই যাওন যাইব। আহেন, আমাগো লগে আহেন-’

এদিকে বিশ্বজিৎ রাহা বিনয়ের কাছে চলে এসেছিলেন। বললেন, ‘চলুন, আমার সঙ্গে গাড়িতে যাবেন।‘

অন্য সব গাড়ি চলে গেলেও একটিমাত্র জিপ রাস্তার একধারে দাঁড়িয়ে ছিল। বিশ্বজিৎ সেদিকে পা বাড়াতে যাবেন, হঠাৎ বিনয়ের মনে পড়ল, হলধরদের কথা দেওয়া হয়েছে আন্দামানে সে যতদিন। আছে তাদের সঙ্গে থাকবে। অঙ্গীকার তো ভাঙা যায় না। অবশ্য এটাও ঠিক, আন্দামানের নানা জায়গা তাকে যেতে হবে। সারাটা। সফর ওদের সঙ্গে কাটানো সম্ভব নয়। কিন্তু প্রথম দিকের বেশ কয়েকটা দিন ওদের কাছে থাকতেই হবে।

বিনয় বলল, ‘কিছু মনে করবেন না। আমি ওদের সঙ্গেই যেতে চাই’ কেন যাওয়া দরকার সেটা বুঝিয়ে বলল।

বুঝেছি, অজানা নতুন জায়গায় ওরা আপনার ওপর খুব ডিপেন্ড করছে। বিশ্বজিৎ একটু হেসে বললেন, ‘চলুন, আমিও হাঁটতে হাঁটতে যাই। এবারডিন বাজারের সামনের মাঠে আমাকেও যেতে হবে। রাত্তিরে রিফিউজিদের খাওয়া-থাকার কী ব্যবস্থা হয়েছে, কোথাও কোনও ত্রুটি আছে কিনা সেসব দেখে রাত্তিরে আমার বাংলোয় ফিরব।’ তার জিপের ড্রাইভার কালীপদকে–রোগা, কালো, লম্বাটে মুখ, ঝাকড়া চুল, বছর পঁচিশ বয়স- ডেকে জিপ নিয়ে এবারডিন বাজারে চলে যেতে বললেন।

এদিকে উদ্বাস্তুদের দলটা সারি দিয়ে চলতে শুরু করেছে। দক্ষ গাইডের মতো বিভাস আর নিরঞ্জন তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।

সমুদ্রের ধার ঘেঁষে যে রাস্তাটা ডাইনে এবং বয়ে গেছে সেটা ধরে নয়; যে রাস্তাটা সোজা টিলার পর টিলা পেরিয়ে ওপরে উঠেছে সেটা দিয়েই এগিয়ে চলেছে সবাই। মাঝখানে একটু দুরত্ব রেখে বিশ্বজিৎ আর বিনয় উদ্বাস্তুদের পাশাপাশি হাঁটছিল।

‘রস’ আইল্যান্ডে নিরঞ্জন পরিচয় করিয়ে দেবার সময় বিনয় আন্দাজ করেছিল বিশ্বজিতের বয়স-বত্রিশ তেত্রিশ হবে। অর্থাৎ তার চেয়ে মোটামুটি বছর দশেকের বড়। সতেজ, মেদহীন চেহারা। পরিপূর্ণ যুবকই বলা যায় তাঁকে।

কম বয়সে বিরাট সরকারি দায়িত্ব পেলে প্রায় সবারই একটা ভারিক্কি ভাব এসে যায়। সারাক্ষণ গম্ভীর। চারপাশে উঁচু উঁচু দেওয়াল তুলে তার ভেতর ঢুকে যায় তারা। বুঝিয়ে দেয় তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। বিশ্বজিৎ কিন্তু তেমনটা নন। হাসিখুশি, কোনও রকম চাতুরি নেই, মৰ্জা করতে পারেন, প্রাণ খুলে হাসতে পারেন। আলাপ হবার সঙ্গে সঙ্গে তাকে ভীষণ ভালো লেগে গিয়েছিল বিনয়ের। আন্দামানে একজন চমৎকার বন্ধু পাওয়া গেছে।

হাঁটতে হাঁটতে কথাও হচ্ছিল। বিশ্বজিৎ বলছিলেন, তখন রিডিউজিদের নিয়ে এমন ব্যস্ত ছিলাম যে ভালো করে আলাপটাই হয়নি। জগদীশকাকা লিখেছেন, আপনাকে যেন সাহায্য করি। ব্যস, এটুকুই। একটু থেমে ফের বলেন, ‘আপনিই প্রথম একজন জার্নালিস্ট যিনি আন্দামানে রিফিউজি সেটেলমেন্ট কভার করতে এসেছেন। আপনার সম্বন্ধে খুব জানতে ইচ্ছে করছে।‘

নিজের থেকে বিনয়কে কিছু বলতে হল না। কয়েক মিনিটের ভেতর নানা প্রশ্ন করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তার সম্পর্কে প্রায় সমস্ত কিছু জেনে নিলেন বিশ্বজিৎ। ঝিনুকের ব্যাপারটা বাদেবাকি সবই বলে। গেল বিনয়। এই একটা গোপন দুর্বল জায়গা আছে তার বুকের ভেতর। নিদারুণ কষ্টকরও। ঝিনুকের কথা যারা জানে তারা জানে। নিজের মুখে বিনয় অন্য কারওকে বলতে পারবে না।

বিশ্বজিৎ গভীর আগ্রহে শুনছিলেন। সহানুভূতিতে তার মন ভরে যায়। ভারী গলায় বললেন, আপনি নিজেও তাহলে দেশভাগের একজন ভিকটিম। তাই উদ্বাস্তুদের সম্বন্ধে এত সিমপ্যাথি। সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আন্দামান অব্দি তাদের সঙ্গে চলে এসেছেন।

কথাটা মোটামুটি ঠিকই। আন্দামানে আসার জন্য ব্যগ্র হয়ে ছিল সে। ‘নতুন ভারত’ অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়ায় এখানে আসা সম্ভব হয়েছে। নইলে এত তাড়াতাড়ি আসা সম্ভব হত না। তবে একদিন।

একদিন, দু বছর পরেই হোক বা চার বছর পরে, এই দ্বীপপুঞ্জে আসতই। পূর্ব পাকিস্তান থেকে যে লক্ষ লক্ষ মানুষ চোদ্দোপুরুষের ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হয়ে সীমান্তের এপারে চলে এসেছে, তারা কোথায় কীভাবে নতুন করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে, নাকি ভেঙেচুরে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, সেসব নিজের চোখে দেখতে চায় সে। শিয়ালদা স্টেশনে, কলকাতার চারপাশের কলোনি আর ত্রাণশিবিরগুলোতে দিনের পর দিন গেছে সে। এখন এসেছে আন্দামানে। শোনা যাচ্ছে, ভারতবর্ষের নানা প্রভিন্সে পুনর্বাসনের জন্য শরণার্থীদের পাঠানো হবে। যেখানেই তারা যাক, বিনয় সেখানেই যাবে।

বিশ্বজিৎ বললেন, ‘আমাদের বাড়িও ছিল ওপারে। আনডিভাইডেড বেঙ্গলের মাইমেনসিং ডিস্ট্রিক্টে। তবে আমরা রিফিউজি না, পার্টিশনের অনেক আগেই চলে এসেছিলাম।’

এই মানুষটি সম্পর্কে বিনয়েরও জানার আগ্রহ কম নয়। কিন্তু বিশ্বজিৎ নিজের ব্যাপারে আর একটি কথাও বললেন না। বিনয় যে জিগ্যেস করবে তেমন সাহস হল না। বেশি কৌতূহল দেখালে বিশ্বজিৎ বিরক্ত হতে পারেন। আন্দামানে যখন আসাই হয়েছে, সবই জানা যাবে।

একটু চুপচাপ। দিনের আলো আরও কমে গেছে। রাস্তার দুধারে কত যে। নারকেল গাছ আকাশের দিকে মাথা তুলে আছে! আর আছে। বিশাল বিশাল শিশু, রেন-ট্রি এবং নাম না জানা মহাবৃক্ষের সারি। সেসবের ফাঁকে ফাঁকে অল্প কিছু কাঠের বাড়ি, ক্কচিৎ দু চারটে পাকা দালান।

অগুনতি গাছের ছায়ায় চারপাশ ঢেকে যাচ্ছে। সব কেমন যেন। ঝাপসা ঝাপসা।

উদ্বাস্তুরা প্রায় নিঃশব্দে হাঁটছে তো হাঁটছেই। তাদের দেখতে দেখতে মনে হল, মধ্যযুগের যাযাবরেরা এইভাবেই বুঝিবা খাদ্যের সন্ধানে, নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পাহাড় পর্বত মরুভূমি পার হয়ে। ঘুরে বেড়াত।

একটা টিলার মাথায় চলে এসেছিল বিনয়রা। পথ এবার নিচের দিকে নেমে দূরে অন্য একটা টিলায় গিয়ে উঠেছে।

বিশ্বজিৎ দূরের টিলাটার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘আমরা প্রায় এসে গেছি। ওই টিলাটার পর এবারডিন বাজার। তারপর জিগ্যেস করলেন, ‘জগদীশকাকার কাগজ কেমন চলছে?’

বিনয় বলল, ‘বেশ ভালো। এখানে ‘নতুন ভারত’ আসে?’

‘আসে। তবে রোজ নয়। উইকে তিনদিন প্লেন সারভিস আছে। প্লেনের সঙ্গে কাগজও আসে।’ বিশ্বজিৎ বলতে লাগলেন, ‘আপনাদের কাগজ রিফিউজি প্রবলেমের ওপর অন্য পেপারগুলোর চাইতে অনেক বেশি ইমপর্টান্স দিচ্ছে। তার ওপর অন্যেরা যা করেনি, আপনারা তাই করতে চলেছেন। আন্দামান সেটেলমেন্ট কভার করবেন। আশা করি, সার্কুলেশন হুহু করে বেড়ে যাবে।’

বিশ্বজিৎ অত্যন্ত বুদ্ধিমান। ‘নতুন ভারত’-এর পরিকল্পনা আপাতত তা-ই। উদ্বাস্তু সমস্যার ওপর বিশেষ করে জোর দেওয়া। সেটা সঠিক ধরে ফেলেছেন বিশ্বজিৎ।

বিনয় একটু হাসল। তবে ‘নতুন ভারত’ নিয়ে কোনও মন্তব্য করল না। বলল, ‘এখানকার রিহ্যাবিলিটেশনের কাজ কেমন চলছে?’

বিশ্বজিৎ আস্তে মাথা নাড়লেন। ‘আমি কিছু বলব না। নিজের চোখে দেখে আপনাকে সেটা বুঝে নিতে হবে।’

আবার কিছুক্ষণ নীরবতা।

ঝিনুকের চিন্তাটা ভেতরে ভেতরে চলছিলই। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো মনে হল, পুনর্বাসন দপ্তরের এই মহা ক্ষমতাবান অফিসারটি ইচ্ছা করলে ঝিনুকের সঙ্গে তার যোগাযোগ ঘটিয়ে দিতে পারেন। কিন্তু সরাসরি তো বলা যায় না, আমাকে মিডল আন্দামানে যাওয়ার বন্দোবস্ত করে দিন। পোর্ট ব্লেয়ারকে ঘিরে দক্ষিণ আন্দামানের শরণার্থীদের নতুন নতুন বসতিগুলো না দেখেই কেন সে মধ্য আন্দামানে যেতে চাইছে এই নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠবে। সেগুলো তার পক্ষে খুবই অস্বস্তিকর।

কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বিনয় জিগ্যেস করল, ‘মিডল আন্দামান এখান থেকে কতদূর?

বিশ্বজিৎ বললেন, ‘ষাট বাষট্টি মাইল।‘

‘নিরঞ্জনবাবু বলেছেন, ইন্টার-আইল্যান্ড শিপ সারভিসের জাহাজ মাসে একবার মাত্র ওখানে যায়।‘

‘ঠিকই বলেছে।‘

‘এছাড়া আর কোনওভাবে সেখানে যাওয়া যায় না? চলতে চলতে ঘাড় ফিরিয়ে কয়েক পলক বিনয়কে লক্ষ করলেন বিশ্বজিৎ। তারপর বললেন, যায়। শেল কালেক্টরদের মোর্টর বোট আইল্যান্ডের কোস্ট ধরে ধরে মাঝে মাঝে মিডল আইল্যান্ড, এমনকী আরও দূরে নর্থ আইল্যান্ড অব্দি চলে যায়।তবে কতদিনে যাবে তার ঠিক নেই।’

‘শেল কালেক্টর কাদের বলে?’

বিশ্বজিৎ বুঝিয়ে দিলেন, সমুদ্রে ডুবুরি নামিয়ে যারা শঙ্খ, কড়ি, যেমন টার্বো ট্রোকাসনটিলাস এমনি নানা জিনিস তুলে আনে তারা হল শেল-কালেক্টর। সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স নিয়ে তবেই এসব শেল তোলা যায়। তোলার পর অ্যাসিড দিয়ে সাফ করে পালিশ লাগিয়ে এগুলো বাইরে চালান করা হয়। বিদেশের বাজারে আন্দামানের টার্বো ট্রোকাস নটিলাসের বিপুল চাহিদা।

বিশ্বজিৎ বলতে লাগলেন, ‘তা ছাড়া নর্থ আন্দামানের মায়াবন্দরে একটা কোম্পানির অনেকগুলো বিরাট বিরাট কাঠের কারখানা রয়েছে। তাদের ছোট জাহাজ আছে একটা। সেটা মিডল আন্দামান হয়ে কখনও পনেরো দিন, কখনও বা দু তিন মাস পর পোর্ট ব্লেয়ার থেকে মায়াবন্দর যায়।’

নিরাশই হয়ে পড়ে বিনয়। শেল কালেক্টরদের বোট বা কাঠের কারখানার জাহাজের ব্যাপারটা অনেকখানিই অনিশ্চিত। কবে ওদের মিডল আর নর্থ আন্দামানে যাবার দরকার হবে, কে জানে। এমনও তো হতে পারে, পাঁচ-সাত দিনের ভেতর যাবে।

বিনয় জিগ্যেস করে, ‘ওরা কি নিজেদের লোক ছাড়া অন্য কারওকে নিয়ে যায়?

‘না। তবে–’

‘সরকারি অফিসাররা বললে নিশ্চয়ই নিয়ে যাবে।’

আশার একটু সংকেত যেন দেখতে পায় বিনয়। গভীর আগ্রহে বলে, কয়েকদিনের মধ্যে ওদের বোট বা জাহাজ মিডল আন্দামানে যাবে কিনা সেটা কি জানা যায়।

‘তা হয়তো যায়।’ বলেই বিশ্বজিতের খেয়াল হল, মধ্য আন্দামান সম্পর্কে বিনয়ের কেন এত ঔৎসুক্য? জানতে চাইলেন, ‘আপনি কি মিডল আন্দামানে যেতে চাইছেন?’

হ্যাঁ। আস্তে মাথা নাড়ে বিনয়।’-ওখানে তো সেটেলমেন্ট হচ্ছে। সেটা দেখাও খুব জরুরি।’

‘অবশ্যই। আগে সাউথ আন্দামানের সেটেলমেন্ট দেখে নিন। তারপর মিডল আন্দামানে যাবেন। আমি সব ব্যবস্থা করে দেব।’

বিনয় বুঝতে পারছে, বিশ্বজিৎ ইচ্ছা করলে শেল কালেক্টরদের বোটে বা কাঠের কারবারিদের জাহাজে তাকে পাঠিয়ে দিতে পারেন। তার মতো বিপুল ক্ষমতাবান অফিসারের হুকুম অমান্য করার মতো বুকের পাটা ওদের কারও হবে না। কিন্তু বোট বা জাহাজ কবে ছাড়বে সেটা বড় মাপের প্রশ্ন। তা ছাড়া এখানে পা। দিতে না দিতেই পোর্ট ব্লেয়ারের চারপাশের পুনর্বাসনের হাল না দেখে সত্তর মাইল দূরের মধ্য আন্দামানে যাবার জন্য এত ব্যগ্র হয়ে ওঠাটা একটু দৃষ্টিকটুই। যতই ব্যাকুল হোক ঝিনুকের সঙ্গে এখনই দেখা হবার সম্ভাবনা নেই। আপাতত বেশ কিছুদিন বিনয়কে দক্ষিণ আন্দামানেই কাটাতে হবে।

খানিক আগে বিশ্বজিৎ যে উঁচু টিলাটা দেখিয়েছিলেন, চড়াই বেয়ে বেয়ে সবাই এখন সেটার মাথায় উঠছে। নিঃশব্দে খানিকটা চলার পর বিনয় জিগ্যেস করে,

‘একটা খবর জানা যেতে পারে?’

বিশ্বজিৎ জানতে চাইলেন।–’কী খবর?’

‘একটি মেয়ে, উনিশ কুড়ি বছর বয়স, আজ আমাদের সঙ্গে ‘রস’ আইল্যান্ডে এসেছে। সে ‘চলুঙ্গা’ জাহাজে মিডল আন্দামানে গেছে। ও কোন ফ্যামিলির সঙ্গে ওখানকার কোন সেটেলমেন্টে গেল, দয়া করে যদি একটু খোঁজ নেন—’

‘কী নাম মেয়েটির?

‘তাপসী লাহিড়ি। ডাকনাম ঝিনুক।’ বলেই হকচকিয়ে যায় বিনয়। ঝিনুকের নামটা গোপনই রাখতে চেয়েছিল সে। ভেবেছিল, মিডল আন্দামানে গিয়ে সেখানকার সেটেলমেন্টগুলোতে ঘুরে তাকে খুঁজে বার করবে। কিন্তু বিশ্বজিতের সঙ্গে কথা বলতে বলতে নিজের এই সংকল্পের কথাটা লহমার জন্য ভুলে গিয়েছিল বিনয়। নিজের অজান্তে ঝিনুকের নাম তার মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে।

চলতে চলতে পলকহীন বিনয়ের দিকে তাকাতে থাকেন বিশ্বজিৎ। রীতিমতো অবাকই হন। বিস্ময়টা থিতিয়ে এলে হেসে হেসে বলেন, ‘আশ্চর্য!’

আশ্চর্যটা কী কারণে আন্দাজ করতে পারল না বিনয়। বিশ্বজিৎ এরপর কী বলবেন সেজন্য চুপচাপ অপেক্ষা করতে থাকে।

বিশ্বজিৎ লঘু সুরে এবার বললেন, ‘মহারাজা’ জাহাজে চারদিন একসঙ্গে কাটালেন। ‘রস’ আইল্যান্ডেও বেশ কয়েক ঘণ্টা কাটিয়েছেন। মেয়েটি কোন ফ্যামিলির সঙ্গে এসেছে, তাকেই তো জিগ্যেস করতে পারতেন।‘ পারতপক্ষে মিথ্যে বলে না বিনয়। তেমন অভ্যাসই নেই। এখন অবলীলায় তাই বলতে হল।-’জাহাজে কি ‘রস’-এ ওকে লক্ষ করিনি। রিফিউজিরা থাকত শিপের খোলে। আমি আপার ডেকে। ও যখন ‘চলুঙ্গা’ জাহাজে মিডল আন্দামান যাচ্ছে তখন দেখতে পেলাম। কিন্তু ‘চলুঙ্গা’ অনেকটা দূরে চলে গেছে।‘

‘নামটাম যখন বলতে পারছেন, মেয়েটিকে ভালোই চেনেন মনে হচ্ছে।’

প্রচণ্ড অস্বস্তি হতে থাকে বিনয়ের। মুখ ফসকে যখন ঝিনুকের নামটা বেরিয়েই এসেছে কতরকম প্রশ্নের জবাবদিহি করতে হবে, কে জানে। বিশ্বজিৎ প্রথমেই অবধারিত যা জানতে চাইবেন, এত পরিচিত মেয়েটি কোন পরিবারের সঙ্গে আন্দামানে এসেছে, বিনয় তার খবর রাখে না, সেটাই বিস্ময়কর। এই সুতো ধরে কথা যে উঠবে! গোপন ব্যাপারটা হয়তো আর রাখা যাবে না। বিনয় টের পেল, কপালে দানা দানা ঘাম জমেছে। ঝাপসা গলায় বলল, ‘হ্যাঁ, চিনি।‘

বিশ্বজিৎ এ নিয়ে আর কোনও প্রশ্ন করলেন না। বললেন, ‘আপনি যা জানতে চাইছেন, খুব সহজেই তা জানা যাবে। যে রিফিউজিরা আজ এসেছে, তাদের নাম, বয়স, তারা কোন কোন ফ্যামিলির মেম্বার, সেই ফ্যামিলিগুলোর হৈড় কারা, দেশ ইস্ট পাকিস্তানের কোন ডিস্ট্রিক্টে ছিল–ডিটেলে তার লিস্ট আমার অ্যাটাচি কেসে আছে। আমার ড্রাইভার অ্যাটাচিটা নিয়ে জিপে চলে গেছে। সেটা দেখে আপনাকে বলে দেব।’

এটা শুক্লপক্ষ। সূর্যাস্ত হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। চাঁদ উঠে আসছে। কারা যেন জাদুল্লস উপুড় করে রুপোলি জ্যোৎস্না ঢেলে দিতে শুরু করেছে সারা চরাচর জুড়ে।

খাড়াই ভেঙে টিলার মাথায় চলে এসেছিল বিনয়রা। এবার তাদের এ ধারের ঢাল বেয়ে নিচে নামতে হবে। চড়াই বেয়ে ওঠাটা ভীষণ কষ্টের, কিন্তু উতরাই দিয়ে নামাটা অনেক আরামের।

বেশ খানিকটা দূরে টিম টিম করে প্রচুর আলো জ্বলছিল। বিশ্বজিৎ বললেন, ওই হল এবারডিন মার্কেট। আমাদের ডেস্টিনেশন।

1 Comment
Collapse Comments

Can you include Upal Upakule book by Shams Rashid in ebangla library. Thanks!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *