উপন্যাস
গল্প

ডেভিডসনের আশ্চর্য চোখ

ডেভিডসনের আশ্চর্য চোখ ( The Remarkable Case of Davidsons Eyes )

[‘The Remarkable Case of Davidsons Eyes’ প্রথম প্রকাশিত হয় ‘The Story of Davidsons Eyes’ নামে, ১৮৯৫ সালের মার্চ মাসে ‘Pall Mall Budget’ পত্রিকায়। যদিও ওয়েলসের খুব বিখ্যাত গল্পগুলির মধ্যে একে গণ্য করা হয় না, গল্পটি সে যুগের রিমোট ভিউইং গোত্রের গল্পগুলির মধ্যে এটি উল্লেখযোগ্য। এরপর গল্পটি পুনঃপ্রকাশিত হয় বিখ্যাত সাই-ফাই পত্রিকা ‘Amazing Stories’-তে, প্রথম বর্ষপূর্তি সংখ্যায় ১৯২৭ সালের এপ্রিল মাসে। অদ্রীশের কলমে গল্পটি বাংলায় অনুদিত হয় অধুনালুপ্ত কিশোর মন পত্রিকায় ১৯৮০-র দশকে ‘ডেভিডসনের আশ্চর্য চোখ’ নামে।]

সিডনি ডেভিডসনের ক্ষণস্থায়ী মানসিক ভ্রান্তি এমনিতেই রীতিমতো চমকপ্রদ। ওয়েড যে ব্যাখা শুনিয়েছেন, তা মানতে গেলে ব্যাপারটা আরও বেশি চমকপ্রদ হয়ে দাঁড়ায়। দূর ভবিষ্যতে নাকি দারুণ দারুণ ঘটনা ঘটবে যোগাযোগব্যবস্থায়। পৃথিবীর এ পিঠ আর ও পিঠের মধ্যে দূরত্ব বলে আর কিছুই থাকবে না। স্বচ্ছন্দে মিনিট পাঁচেক কাটিয়ে আসা যাবে পৃথিবীর উলটোদিকে। ঘর ছেড়ে বেরতেই হবে না–চেয়ার ছেড়েও নড়তে হবে না। এমনও হতে পারে, লুকিয়ে-চুরিয়ে কোনও গোপন কাজই আর করা যাবে না। অদৃশ্য চাহনি খর-নজর রাখবে আমাদের প্রতিটি গুপ্ত ক্রিয়াকলাপের ওপর। ভবিষ্যতে এমনি অনেক পিলে-চমকানো সম্ভাবনা সত্যি সত্যিই পিলে চমকে দেবে বাস্তবের চেহারা নিয়ে। ডেভিডসন এই সৃষ্টিছাড়া ভ্রান্তি-ঘোরে আক্রান্ত হয়েছিল আমার সামনেই। প্রথম প্রত্যক্ষদর্শী আমিই। কাজেই কাহিনিটা কাগজে-কলমে প্রকাশ করার দায়িত্বও আমার।

ঘটনাস্থলে প্রথম হাজির হয়েছিলাম আমি–তাই আমি সেই মুহূর্তের প্রত্যক্ষদর্শী। আশ্চর্য ব্যাপারটা ঘটেছিল হার্লো টেকনিক্যাল কলেজে-হাইগেট আর্চওয়ের পাশেই। ছোট ঘরটায় ছিলাম আমি। নোট লিখছিলাম। ওজন করার সরঞ্জাম থাকে এই ঘরেই। কাজে অবশ্য মন দিতে পারছি না। লন্ডন শহরটার ঝুঁটি ধরে যেন ঝাঁকুনি দিচ্ছে সাংঘাতিক ঝড়। সেই সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, বাজ পড়ছে। আচমকা একটা বাজের আওয়াজে কানের পরদা যেন। ফালাফালা হয়ে গেল! দারুণ চমকে উঠেছিলাম। বজ্রপাতের কানফাটা আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে আরও একটা আওয়াজ যেন ভেসে এল কানে পাশের ঘর থেকে। কাচ ভাঙার ঝনঝন শব্দ। লেখা থামিয়ে কান খাড়া করলাম। সেকেন্ডকয়েক আর কোনও আওয়াজ পেলাম না। ঢেউখেলানো দস্তা-ছাদের ওপর শিলাবৃষ্টির ঝমাঝম আওয়াজ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। ঠিক যেন শয়তানের আঙুলের বাদ্যি। খট খটা খট! খট খটা খট! খট খটা খট! তারপরেই আবার কানে এল আর-একটা আওয়াজ। দড়াম করে কী যেন আছড়ে পড়ল বেঞ্চি থেকে নিচে। বেশ ভারী জিনিস। না, এবার আর কানের ভুল নয়। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে দরজা খুলে ঢুকলাম বড় ল্যাবরেটরির মধ্যে।

অবাক হয়ে গিয়েছিলাম বিদঘুটে একটা হাসির আওয়াজ শুনে। ডেভিডসনকে অপ্রকৃতিস্থের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম ঘরের মাঝখানে। পা টলছে। চোখে-মুখে ভ্যাবাচ্যাকা ভাব। দেখেই প্রথমে মনে হয়েছিল, নেশা করেছে। আমাকে লক্ষই করল না। হাত বাড়িয়ে বাতাসে কী যেন খামচে ধরার চেষ্টা করছে দশ আঙুল দিয়ে। জিনিসটা কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। ডেভিডসনের রকমসকম দেখে মনে হচ্ছে, অদৃশ্য বস্তুটা রয়েছে চোখের গজখানেক সামনে। হাত বাড়িয়ে দিল খুব আস্তে আস্তে। বেশ দ্বিধার সঙ্গে খামচে ধরল বস্তুটা। কিন্তু পেল না কিছুই। আপন মনেই বললে, ব্যাপার কী বুঝছি না। দশ আঙুল ছড়িয়ে হাত বুলিয়ে নিলে মুখে। কী আশ্চর্য! বলেই পা তুলল বদ্ধপাগলের মতো–যেন পা আটকে যাচ্ছে মেঝেতে বেগ পেতে হচ্ছে পা তুলতে।

চিৎকার করে বলেছিলাম, ডেভিডসন! হল কী তোমার? বোঁ করে আমার দিকে ফিরে তাকাতে লাগল ডেভিডসন আমার আশপাশ দিয়ে। কখনও তাকায় আমার ঘাড়ের ওপর দিয়ে পেছনে, কখনও দুপাশে, কখনও সোজাসুজি আমার দিকেই। অথচ দেখতে পেয়েছে বলে মনেও হল না। বিড়বিড় করে বললে নিজের মনে–ঢেউ! ঢেউ! পালতোলা জাহাজটাও কী সুন্দর। বেলোজের গলা শুনলাম না? হ্যাঁ, বেলোজের গলাই তো বটে! না, ভুল হয়নি। হ্যাল্লো? তুমি কোথায়? আচমকা চেঁচিয়ে উঠল গলার শির তুলে।

আমি ভাবলাম বুঝি ফচকেমি শুরু করেছে ডেভিডসন। তারপরেই দেখলাম, তার পায়ের কাছে ভেঙেচুরে পড়ে রয়েছে ল্যাবরেটরির সবচেয়ে ভালো ইলেকট্রোমিটারটা। বললাম, কী চ্যাংড়ামি হচ্ছে ডেভিডসন? ইলেকট্রোমিটারটা ভাঙলে কেন?

আরে গেল যা! বেলোজই তো চেঁচাচ্ছে। ইলেকট্রোমিটার ভেঙেছি? বেলোজ! এ বেলোজ! কোথায় তুমি? বলেই আচমকা টলতে টলতে এগিয়ে এল আমার দিকে। বেঞ্চির সামনে এসেই যেন কুঁচকে গেল। মাখনের মধ্যে পা চালিয়ে এলাম যেন এতক্ষণ। এখন তো আর পারছি না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুলতে লাগল মাতালের মতো।

এবার ভয় পেলাম। বললাম, কী হল তোমার?

ডাইনে-বাঁয়ে সামনে-পেছনে ঘুরে ঘুরে আমাকে খুঁজল ডেভিডসন। বললে আপন মনে, বেলোজের গলা। কিন্তু বেলোজ! কী ইয়ারকি হচ্ছে? সামনে এসো-না!

ডেভিডসন কি হঠাৎ অন্ধ হয়ে গেছে? সন্দেহটা বিদ্যুঝলকের মতোই ঝলসে উঠল মাথার মধ্যে। টেবিলটাকে পাক দিয়ে ওর হাতে হাত রাখলাম, সাংঘাতিক চমকে উঠল ডেভিডসন। জীবনে এভাবে চমকে উঠতে কাউকে দেখিনি। আতঙ্কে বিকৃত মুখভঙ্গি করে দাঁড়াল আত্মরক্ষার ভঙ্গিমায়। সেই সঙ্গে সেই অর্থহীন চিৎকার–যাচ্চলে! এ আবার কে?

আমি–ডেভিডসন–আমি বেলোজ!

তিড়িং করে লাফিয়ে উঠেই ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল ডেভিডসন–আমাকে ছুঁড়ে আমার মধ্যে দিয়ে ওর দৃষ্টি চলে গেল অনেক দূর!

তারপরই শুরু হল বিড়বিড় বকুনি। নিজের মনেই বকে চলেছে–আমার উদ্দেশে বলছে না কিছুই–এই তো দিনের আলো… ঝকঝক করছে সমুদ্রসৈকত। লুকিয়ে থাকবে কোথায়? পাগলের মতো চাইল ডাইনে-বাঁয়ে সামনে-পেছনে। দেখি তো কোথায়? আচমকা ঘুরে দাঁড়িয়েই ধাঁ করে ধেয়ে গেল সটান বড় ইলেকট্রোম্যাগনেটটা লক্ষ্য করে– পরক্ষণেই ধাঁই করে এক ধাক্কা। পরে দেখেছিলাম, কাঁধ আর চোয়ালের হাড়ে কালশিটে পড়ে থেঁতলে গিয়েছিল এইভাবে দমাস করে আছড়ে পড়ায়। যন্ত্রণায় মুখ বেঁকিয়ে এক পা পেছিয়ে এসে সে কী গোঙানি–হে ভগবান! এ কী হল আমার! বিষম আতঙ্কে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল ডান হাত দিয়ে বাঁ হাত খামচে ধরে–ম্যাগনেট চোট দিয়েছিল সেখানেও।

উদ্ভট এই কাণ্ডকারখানা দেখে আমি কিন্তু ততক্ষণে যেমন উত্তেজিত, তেমনি ভয় পেয়েছি। তা সত্ত্বেও অভয় দিয়েছিলাম মিনমিনে স্বরে। ও কিন্তু আমার গলা শুনেই আবার আগের মতোই আঁতকে উঠেছিল একটু বেশিরকমভাবেই। কেশে গলা সাফ করে পরিষ্কারভাবে আবার অভয় দিতে ও জানতে চেয়েছিল আমিই বেলোজ কি না।

কেন? চোখে দেখতে পাচ্ছ না? বলেছিলাম আমি। আবার সেই বিতিকিচ্ছিরি হাসি হেসেছিল ডেভিডসন। নিজেকেই নাকি দেখতে পাচ্ছে না, আমাকে দেখার প্রশ্নই উঠছে। না!

আমি বলেছিলাম, সে কী! ল্যাবরেটরিতে দাঁড়িয়ে আছি তোমার সামনেই।

ল্যাবরেটরি! বিমূঢ় স্বরে জবাব দিয়েছিল ডেভিডসন–ল্যাবরেটরিতে তো ছিলাম দারুণ ঝলকে চোখ ঝলসে যাওয়ার আগে পর্যন্ত। এখন তো সেখানে নেই। যাক গে! জাহাজটা দেখছ?

জাহাজ? কী আবোল-তাবোল বকছ?

তেড়ে উঠেছিল ডেভিডসন। স্পষ্ট দেখছে, জাহাজ ভাসছে জলে, ঢেউ নাচছে সমুদ্রে– বললেই হল জাহাজ নেই! তাহলে নিশ্চয় অক্কা পেয়েছি দুজনেই। কিন্তু মজা তো সেখানেই। মরে গেলে কি দেহ থাকে? দেহের যন্ত্রণা থাকে? ওর নাকি দেহ আছে–কিন্তু দেহটাকে বাগে আনতে পারছে না কিছুতেই। ধমক দিয়েছিলাম আমি। পাগলামির একটা সীমা আছে। বহাল তবিয়তে ল্যাবরেটরির মধ্যে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের ঢেউ আর জাহাজ দেখা যায়? এইমাত্র একটা ইলেকট্রোমিটার ভাঙা হল তো এইখানেই–বয়েস এসেই তো একহাত নেবে।

ক্রায়োহাইড্রেটসের রেখাচিত্রের দিকে যেতে যেতে ডেভিডসন বলেছিল, কালা হয়ে গেলাম নাকি? কামান ছুঁড়েছে জাহাজ থেকে ধোঁয়া দেখতে পাচ্ছি আওয়াজ তো পেলাম না।

এ তো আচ্ছা জ্বালা! আবার হাত রেখেছিলাম ওর হাতে। এবার আর ভূত দেখার মতো চমকে ওঠেনি। বলেছিল অনেকটা আত্মস্থ স্বরে, তবে কি দুজনেই অদৃশ্য দেহ পেয়ে বসেছি? বেলোজ, দেখতে পাচ্ছ না? নৌকো আসছে–ডাঙার দিকে আসছে–দেখছ?

ডেভিডসন! জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলেছিলাম, জাগ, বন্ধু, জাগ!

ঠিক এই সময়ে ঘরে ঢুকেছিল বয়েস। ওর গলা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সে কী চিৎকার ডেভিডসনের–বয়েস! তুমিও মারা গেছ! কী সর্বনাশ!

বয়েসকে তাড়াতাড়ি বুঝিয়ে দিয়েছিলাম ব্যাপারটা। ঘুমের ঘোরে হাঁটাচলার রোগে পেয়েছে নিশ্চয় ডেভিডসনকে। শুনেই কৌতূহল জাগ্রত হয়েছিল বয়েসের। ঘোর কাটিয়ে দেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছিলাম দুজনে। প্রশ্নের জবাব দিয়েছিল। ডেভিডসন নিজেও প্রশ্ন করেছিল, কিন্তু মনটা পড়ে রয়েছে যেন সৈকত আর জাহাজের দিকে। মরীচিকা কাটিয়ে উঠতে পারছে না কিছুতেই। ছায়ামায়ায় ভরা বীক্ষণাগারের মধ্যে ও নাকি সমানে দেখতে পাচ্ছে পাল আর জাহাজ, নৌকো আর ঢেউ। শুনলেও গা শিরশির করে।

বেশ বুঝলাম, চোখের দৃষ্টি একেবারেই হারিয়েছে। নিতান্ত অসহায়। দুজনে দুপাশ থেকে কনুই ধরে করিডর বরাবর হাঁটিয়ে নিয়ে গেলাম বয়েসের প্রাইভেট ঘরে।

ডেভিডসনের মনে, চোখে ভাসছে কিন্তু সেই অবাস্তব জাহাজ। বয়েসও ছেলে ভোলানোর মতো সায় দিয়ে গেছে সমানে। ঘরে পৌঁছে খবর পাঠিয়েছিলাম কলেজের ডিন বুড়ো ওয়েডকে। ওঁর গলা শোনার পর একটু যেন শান্ত হয়েছিল ডেভিডসন। ঘ্যানর ঘ্যানর কিন্তু কমেনি। জানতে চেয়েছিল, হাত দুখানা তার কোন চুলোয়–দেখা যাচ্ছে না কেন? কোমরসমান উঁচু জমির মধ্যে দিয়েই বা তাকে হাঁটিয়ে আনা হল কেন? শুনে-টুনে ভুরু কপাল কুঁচকে চেয়ে রইলেন বুড়ো ওয়েড। তারপর ডেভিডসনের হাতখানা তুলে ধরে কৌচ ছুঁইয়ে বললেন, এই তো তোমার হাত-হাত দিয়েছ কৌচে–প্রফেসার বয়েসের প্রাইভেট রুমে। ঘোড়ার চুল-ঠাসা কুশন–তা-ই না?

হাত বুলিয়ে আরও ঘাবড়ে গিয়েছিল ডেভিডসন। হাতে টের পাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু চোখে তো দেখছে না।

তাহলে দেখছটা কী? জানতে চেয়েছিলেন ওয়েড। ডেভিডসন আবার আরম্ভ করেছিল একই ধানাইপানাই। রাশি রাশি বালি, ভাঙা ঝিনুক ছাড়া চোখে তো আর কিছুই পড়ছে না ঠিক এই জায়গাটায়।

ওয়েড আরও খানকয়েক জিনিস ধরিয়ে দিয়েছিলেন ডেভিডসনের হাতে। জানতে চেয়েছিলেন জিনিসগুলো কী। তীক্ষ্ণ চোখে দেখছিলেন মুখের চেহারা।

কিন্তু জবাবটা এসেছিল খাপছাড়া–জাহাজ নোঙর ফেলছে মনে হচ্ছে? আত্মগত স্বর ডেভিডসনের।

মৃদু ভর্ৎসনা করেছিলেন ওয়েড। জাহাজ নিয়ে পরে মাথা ঘামালেও চলবে। মরীচিকা দর্শন মানেটা কি জানা আছে ডেভিডসনের?

একটু একটু, আনমনাভাবে বলেছিল ডেভিডসন!

যা দেখছ, সবই মরীচিকা।

বিশপ বার্কলে, আবার সেই খাপছাড়া জবাব।

দূর! পাদরির দরকার হবে কেন? দিব্যি বেঁচে রয়েছ। তবে চোখের গোলমাল হয়েছে দেখা যাচ্ছে। শুনতে পাচ্ছ, হাত বুলিয়ে টের পাচ্ছ–অথচ দেখতে পাচ্ছ না। বুঝেছ?

খুব ভালোভাবেই দেখতে পাচ্ছি, চোখ ডলে বলেছিল ডেভিডসন।

হয়েছে, হয়েছে। যা দেখছ, তা নিয়ে মাথাটাকে আর কষ্ট দিয়ো না। গাড়ি আনাচ্ছি– বেলোজ আর আমি পৌঁছে দেব বাড়িতে।

দাঁড়ান।–ধরে বসিয়ে দেবেন?… ঠিক আছে… এবার বলুন গোড়া থেকে ব্যাপারটা কী?

ধৈর্য না হারিয়ে পুনরাবৃত্তি করে গেলেন ওয়েড। চোখ মুদে কপালে হাত রেখে সব শুনল ডেভিডসন। তারপর বললে চোখ মুদেই, এখন তো মনে হচ্ছে, সবই ঠিক আছে। ইংল্যান্ডেই রয়েছি। বেলোজ বসে রয়েছে পাশে, কৌচে। অন্ধকার।

বলেই খুলল চোখ–ওই দেখা যাচ্ছে সূর্য। জাহাজ। পাগলা সমুদ্র। উড়ন্ত পাখি। সত্যি, একেবারে সত্যি। বসে রয়েছি বালির ঢিপিতে।

চোখ ঢাকা দিয়ে হেঁট হয়েই ফের চোখ খুলে যেন ককিয়ে উঠল পরক্ষণেই–কালো সমুদ্র আর সূর্যোদয়! তা সত্ত্বেও কিন্তু বসে রয়েছি বয়েসের ঘরে–ওরই সোফায়!… এ কী হল আমার!

সেই শুরু। ঝাড়া তিন-তিনটে হপ্তা চলেছিল এই বিচিত্র ভোগান্তি। আক্কেল গুড়ুম করে ছেড়েছিল আমাদের ডেভিডসনের দু-দুটো চোখ, যে চোখে দৃষ্টি আছে, অথচ দৃষ্টি নেই। যেখানে বসে, সেখানকার কিছুই দেখছে না–দেখছে অন্য এক জায়গার দৃশ্য। অন্ধ হওয়াও বরং এর চাইতে ভালো। ওর সেই অসহায় অবস্থা ভাবলেও কষ্ট হয়। সদ্য ডিম ফোঁটা পাখির ছানাকে যেভাবে খাইয়ে দিতে হয়, সেইভাবেই তাকে খাওয়াতে হয়েছে দিনের পর দিন, হাত ধরে নিয়ে যেতে হয়েছে কলতলায়, জামাকাপড় খুলে আবার পরিয়ে দিতে হয়েছে বাচ্চা ছেলের মতো। নিজের চেষ্টায় হাঁটতে গেলেই হুমড়ি খেয়ে পড়েছে দেওয়ালে বা দরজায়–হোঁচট খেয়েছে পায়ের কাছে রাখা জিনিসের ওপর। দু-একদিন পরে অবশ্য আমাদের দেখতে না পেলেও গলা শুনে আর অমন আঁতকে উঠত না। আমার বোনের সঙ্গে ওর বিয়ে ঠিক হয়েছিল। বোন এসে বসে থাকত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ডেভিডসন আশ মিটিয়ে শোনাত সাগর আর সৈকতের অলীক কাহিনি। কলেজ থেকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময়ে সে আর-এক ফ্যাসাদ। বাড়ি তো সেই হ্যাঁম্পস্টিড গ্রামে। গাড়ি নাকি ওকে নিয়ে সোজা একটা বালিয়াড়ি ভেদ করে বেরিয়ে গিয়েছিল। চোখে কিছু দেখতে পায়নি… অন্ধকার… কুচকুচে অন্ধকার। ওপাশ দিয়ে বেরিয়ে আসার পর আবার চোখে পড়েছে গাছ, পাথর, নিরেট জিনিস। গাড়ি নাকি এই সবকিছুর মধ্যে দিয়েই ওকে নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে–অথচ গাছ, পাথর, নিরেট বস্তু বালিয়াড়িটার মতোই ওকে আটকে রাখতে পারেনি। বাড়ি পৌঁছে ওপরতলার ঘরে নিয়ে যাওয়ার সময়ে সে কী পরিত্রাহি চিৎকার। কাল্পনিক দেশের পাথুরে জমির তিরিশ থেকে পঞ্চাশ ফুট ওপরে শূন্যে তোলা হচ্ছে কেন? পড়ে গেলে ছাতু হয়ে যাবে যে! ডিমের মতো ফট করে ফেটে যাবে মাথার খুলি। একনাগাড়ে এই কাঁইমাই সহ্য করা যায়? নামিয়ে আনা হল একতলায়। বাবার কনসাল্টিং রুমের একটা সোফায় বসে তবে নিশ্চিন্ত হল ডেভিডসন।

দ্বীপটার বর্ণনা শুনেছিলাম ওরই মুখে। মন দমে যাওয়ায় মতো জায়গা। গাছপালা অতি সামান্যই। বেশির ভাগই নেড়া পাথর, পেঙ্গুইন আছে বিস্তর, পাথর সাদা হয়ে থাকে– সংখ্যায় এত, দেখতে অতি বিচ্ছিরি, সমুদ্র মাঝেমধ্যে দামাল। প্রথম দু-একদিনের মধ্যে বজ্রবিদ্যুৎসহ ঝড়ও দেখেছে। বজ্রপাত দেখেছে, বিদ্যুতের চমক দেখে নিজেই চমকে চমকে উঠে সমানে চেঁচিয়ে গেছে কিন্তু বজ্রের আওয়াজ, মেঘ ডাকার গুরগুর শব্দ কানে ভেসে আসেনি। নিঃশব্দ সেই বজ্রপাত নাকি এমনই রোমাঞ্চকর যে ভাষায় বর্ণনা করা দুঃসাধ্য। বার দুয়েক বালির ওপর সিল মাছ উঠে এসেছে। পেঙ্গুইনরা নাকি ওর দেহ কুঁড়ে হেলেদুলে দিব্যি চলে গিয়েছে–কারও কোনও অসুবিধে হয়নি। ওর শুয়ে থাকার জন্যে পেঙ্গুইনরা তিলমাত্র বিচলিত বোধ করেনি।

অদ্ভুত একটা ব্যাপার বেশ মনে আছে। সিগারেট খাওয়ার খুব ইচ্ছে হয়েছিল ডেভিডসনের। আঙুলে পাইপ গুঁজে দিয়েছিলাম। কোটর থেকে চোখ দুটো প্রায় ঠেলে বার করে এনেও সিগারেট বা পাইপ কোনওটাই দেখতে পায়নি। ধরিয়ে দিয়েছিলাম সিগারেট। টেনে কোনও স্বাদ পায়নি। এ ব্যাপার আমার ক্ষেত্রেও ঘটেছে। ধোঁয়া না দেখতে পেলে তামাক খাওয়ার মজা পাওয়া যায় না।

আশ্চর্য দর্শনের সবচেয়ে অদ্ভুত অংশটা শুরু হয়েছিল ঠেলা-চেয়ারে বসিয়ে ওকে হাওয়া খেতে নিয়ে যাওয়ার সময়ে। আমার বোন গিয়েছিল সঙ্গে। কেঁদে ফেলেছিল নাকি ডেভিডসন। কাকুতিমিনতি করেছিল বোনের কাছে। ভয়াবহ এই অন্ধকারে আর সে থাকতে পারছে না। অসহ্য! অসহ্য! বোনের হাত খামচে ধরে বলেছিল কাঁদতে কাঁদতে, নিয়ে চল, নিয়ে চল এই অন্ধকারের বাইরে–নইলে আর বাঁচব না। খুলে বলতে পারেনি। ডেভিডসন। বোন ওকে নিয়ে বাড়িমুখে রওনা হয়েছিল তৎক্ষণাৎ চড়াই ভেঙে হ্যাঁম্পস্টিডের দিকে যেতে যেতেই বিভীষিকা থেকে মুক্তি পেয়েছিল বন্ধুবর। আবার নাকি তারা দেখা যাচ্ছে–অথচ তখন সূর্য মাথার ওপর।

পরে আমাকে বলেছিল, মনে হচ্ছিল যেন জলের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আমাকে– বাধা দিতে পারছি না। প্রথমে অতটা ভয় পাইনি। যদিও তখন নিশুতি রাত–কিন্তু বড় সুন্দর রাত।

হ্যাঁ। এখানে যখন দিন, ওখানে তখন রাত।… জলের মধ্যে সটান ঢুকে গেলাম তারপরেই। ফুলে ফুলে উঠছে জল–চওড়া হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে দিগন্ত পর্যন্ত–ঠিক যেন চকচকে চামড়া দিয়ে ঢাকা ফোঁপরা গহ্বরের মধ্যে নেমে যাচ্ছি আস্তে আস্তে। নামছি ঢালু পথে। জল উঠে এল চোখ পর্যন্ত। তারপর চলে এলাম জলের তলায়। চকচকে চামড়া টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গিয়ে ফের জুড়ে গেল মাথার ওপর। চাঁদ লাফ দিয়ে উঠল আকাশে, সবুজ চাঁদ। অস্পষ্ট। চারপাশে খেলছে আবছা দ্যুতিময় মাছ। ঠিক যেন কাচের মাছ-গা থেকে আলো ছিটকে যাচ্ছে। সামুদ্রিক উদ্ভিদের একটা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে নেমে এলাম আস্তে আস্তে–তেলতেলে আভা বেরুচ্ছে জঙ্গল থেকে। নামছি, নামছি, আরও নামছি। একে একে নিবে গেল একটার পর একটা তারা। আরও সবুজ হয়ে এল চাঁদ আরও গাঢ়। বেগুনি-লাল হয়ে এল সামুদ্রিক উদ্ভিদ। রহস্যময় সেই আলো-আঁধারির মধ্যে সবই থিরথির করে কাঁপছে আবছাভাবে। কানে ভেসে আসছে একটানা শব্দের পর শব্দ এই জগতের শব্দ… চেয়ার গড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ… আশপাশে জুতো মশমশিয়ে লোকজনের হাঁটাচলার শব্দ… দূরে খবরের কাগজ ফেরি করার চিৎকার–নেমে গেলাম জলের আরও গভীরে। কালির মতো কালো হয়ে এল চারদিক… নিঃসীম সেই অন্ধকারে বাইরের কোনও আলো ঢোকার যেন অধিকার নেই… অন্ধকার… অন্ধকার… সীমাহীন নিবিড় তমিস্রা ভেদ করে চলেছি তো চলেইছি… ফসফরাস-দ্যুতি বিকিরণ করে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছে অন্ধকারের প্রাণীরা… গভীর জলের উদ্ভিদের সর্পিল শাখা নড়ছে স্পিরিট-ল্যাম্পের জ্বলন্ত শিখার মতো… আরও কিছুক্ষণ পরে উদ্ভিদও আর চোখে পড়ল না। বিকট হাঁ আর ড্যাবডেবে চোখ মেলে সটান আমাকে ছুঁড়ে বেরিয়ে গেল ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ। হাঁ-মুখ দেখে প্রথমে ভয় পেয়েছিলাম–তারপর কিছুই টের পেলাম না– মাছেরাও পেল না। সমুদ্রে যে এরকম বিকট মাছ আছে, কোনওদিন কল্পনাতেও ভাবতে পারিনি।

আলোকময় পেনসিল দিয়ে আঁকা যেন মাছগুলো-কিনারা ঘিরে ঠিকরে যাচ্ছে আগুন। কিলবিলে অনেকগুলো হাত মেলে বিকটাকার একটা প্রাণী পেছনদিকে সাঁতরে আসতেই আঁতকে উঠেছিলাম। তারপরেই কাঠ হয়ে গেলাম অস্পষ্ট বিশাল একটা আলোকপুঞ্জকে ধীরে ধীরে আমার দিকেই এগিয়ে আসতে দেখে। জমাট আঁধারের মধ্যে থেকে একটু একটু করে স্পষ্ট হয়ে উঠছে বহু দুরের চাপ-বাঁধা আলোর ডেলা। কাছে আসতেই টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে গেল আলোর কণা। মাছ। ভাসমান কী যেন একটা ঘিরে ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুরছে দ্যুতিময় মাছ। আমি চেয়ারে বসে সটান চলেছি সেইদিকেই। আরও কাছে… আরও কাছে… হঠাৎ দেখলাম একটা ভাঙা বরগা… মাছেদের আলোয় তুলকালাম কাণ্ডের মধ্যে মাথার ওপরে ভাসতে দেখলাম লম্বা কাঠখানা… জমাট কালো অন্ধকারের মতো একটা জাহাজের খোলও দেখলাম, কাত হয়ে রয়েছে মাথার ওপর… অন্ধকার কিন্তু ফিকে হয়ে এসেছে ফসফরাস-দ্যুতিতে… মাছেদের ঠোকরানিতে ফুলিঙ্গের মতো ফসফরাস-দ্যুতি ঠিকরে ঠিকরে যাচ্ছে কতকগুলো আকৃতি থেকে… আতঙ্কে দমবন্ধ হয়ে এসেছিল আমার… চেঁচিয়ে ডেকেছিলাম তোমার বোনকে… আধখাওয়া সেই মড়াদের গায়ে অজস্র ছেদা… আমাকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল সেইদিকেই… মড়াদের গায়ের ফুটোগুলোর দিকেই…! উঃ! কী বীভৎস! গায়ে কাঁটা দিচ্ছে, তাই না বেলোজ? দেখ তো হাতটা?

তিন-তিনটে সপ্তাহ সেই অপচ্ছায়া-জগতের মধ্যে কাটিয়েছে ডেভিডসন–নিজের চারপাশের এই জগৎকে দেখতে পায়নি একটুও। তারপর এক মঙ্গলবারে দেখা করতে যেতেই ওর বুড়ো বাবার মুখোমুখি হলাম করিডরে। ওভারকোটে হাত গলাতে গলাতে ছুটছেন। আমাকে দেখেই সজল চোখে ধরা গলায় বললেন, বেলোজ, ছেলেটা এবার ঠিক হয়ে যাবে। দেখতে পাচ্ছে… নিজের বুড়ো আঙুলটা এদ্দিনে দেখতে পেয়েছে।

দৌড়ালাম। ডেভিডসন একটা বই চোখের সামনে ধরে বসে ছিল–হাসছিল আপন মনে –অনেকটা পাগলের মতো। বলেছিল, কী আশ্চর্য! এইখানটা… এই জায়গাটা একটুখানি দেখা যাচ্ছে– আঙুল রেখেছিল বইয়ের পাতায় এক জায়গায়–পাথরের ওপর বসে রয়েছি কিন্তু এখনও। বড় গোলমাল করছে পেঙ্গুইনগুলো। দূরে মাঝে মাঝে দেখছি একটা তিমিকে। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু এইখানে কিছু ধর–দেখতে পাব… খুব অস্পষ্ট… ভাঙা ভাঙা… তবুও দেখা যাচ্ছে… অস্পষ্ট প্রেতচ্ছায়ার মতো। আজ সকালে জামাকাপড় পরানোর সময়ে প্রথম দেখেছিলাম। নারকীয় এই অপচ্ছায়া-জগতের মধ্যে যেন একটা ফুটো। রাখ–তোমার হাতটা রাখ এইখানে… না… না… ওখানে নয়। হ্যাঁ… ঠিক হয়েছে! দেখতে পাচ্ছি… তোমারই বুড়ো আঙুল… তলার দিক আর শার্টের হাতার একটুখানি। অন্ধকার আকাশ ফুটো করে যেন বেরিয়ে আছে তোমার ভূতুড়ে হাতের একটুখানি! ঠিক পাশেই ভাসছে একদঙ্গল নক্ষত্র!

সেই থেকেই একটু একটু করে সেরে উঠতে লাগল ডেভিডসন। অপচ্ছায়া-জগৎ দেখে যে বর্ণনা দিয়েছিল–নিখুঁত সেই বর্ণনার মতোই দৃশ্য পরিবর্তনের এই বর্ণনাও বিশ্বাস না করে পারা যায় না। অপচ্ছায়া-জগতের জায়গায় জায়গায় যেন ছেদা হয়ে যাচ্ছে… ছায়াবাজির মতো অলীক জগৎ ছিঁড়েখুঁড়ে উড়ে যাচ্ছে… অর্ধস্বচ্ছ ফুটোর মধ্যে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে স্বচ্ছ, অস্পষ্ট এই সত্যিকারের জগতের ছেঁড়া ছেঁড়া দৃশ্য। ক্রশঃ পরিধি বেড়েছে ফুটোগুলোর… বেড়েছে সংখ্যায়… আস্তে আস্তে গায়ে গায়ে লেগে গিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সত্যিকারের এই জগতের দৃশ্যর ওপর–অলীক অপচ্ছায়া-জগৎ অস্পষ্ট ছেঁড়া-ছেঁড়াভাবে দেখা গিয়েছে এখানে-সেখানে। চোখের ওপর অন্ধত্ব দানা আকারে যেন জমে রয়েছে–সেই দানার জায়গাগুলোয় তখনও ঠেলাঠেলি করে ফুটে উঠছে অবাস্তব সেই জগতের মরীচিকাদৃশ্য। নিজে থেকে উঠে বসা, চলাফেরা, খাওয়াদাওয়া, ধূমপান করা, বই পড়ায় অভ্যস্ত হল আস্তে আস্তে। দুটো ছবি ওপর-ওপর থাকায় প্রথমটা একটু গোলমাল লাগত। তা-ও সয়ে গেল দুদিনেই। অলীক মায়াজগতের দৃশ্য আর বাস্তব জগতের দৃশ্য আলাদা করে নিতে পারল সহজেই।

প্রথমটা দারুণ খুশি হয়েছিল ডেভিডসন। ফেটে পড়েছিল মুক্তি পাওয়ার আনন্দে। তারপরেই শুরু হল উলটো টান। বিলীয়মান আশ্চর্য দ্বীপ, বিচিত্র সমুদ্র, পেঙ্গুইনের পাল, সমুদ্রের গভীরে ভাসমান জাহাজের খোল আবার ভালো করে দেখার জন্যে ব্যাকুল হয়েছিল। একা একা ছুটে যেত হ্যাঁম্পস্টিডের নিচু অঞ্চলে। কিন্তু সত্যিকারের দুনিয়ার চড়া রোদ দুদিনেই মিথ্যে দুনিয়ার রাতের অন্ধকারকে মুছে দিলে একেবারে। ছেঁড়া-ছেঁড়া দৃশ্য একটু একটু করে ফিকে হতে হতে একেবারেই গেল মিলিয়ে। তা সত্ত্বেও গভীর রাতে অন্ধকার ঘরে দেখতে পেত অলীক দ্বীপের রোদে তেতে-ওঠা সাদা পাথর, পেঙ্গুইনদের হেলেদুলে চলা। আস্তে আস্তে এ দৃশ্যও সরে গেল তার চোখের সামনে থেকে নিশুতি রাতেও। আমার বোনকে বিয়ে করার পর অলীকদর্শন তিরোহিত হল একেবারেই।

সবচেয়ে উদ্ভট ঘটনাটায় এবার আসা যাক। বিয়ের দুবছর পরে ডিনার খেতে গিয়েছিলাম ডেভিডসন-দম্পতির সঙ্গে। খাওয়াদাওয়ার পর অ্যাটকিন্স নামে একজন ভদ্রলোক এলেন ঘরে। রয়াল নেভির লেফটেন্যান্ট। ভারী চমৎকার মানুষ। আড্ডাবাজ। আসর জমাতে ওস্তাদ। কথায় কথায় পকেট থেকে একটা ফোটো বার করে দেখিয়েছিলেন আমাদের। ছবিটা একটা জাহাজের।

দেখেই আঁতকে উঠেছিল ডেভিডসন!

সেই জাহাজ! যে জাহাজ সে বারবার দেখেছে অলীকদর্শনে–নিখুঁত বর্ণনাও শুনিয়েছে।

অ্যাটকিন্স তো অবাক! এ জাহাজ ডেভিডসন দেখবে কী করে? অ্যান্টিপোড আইল্যান্ডের দক্ষিণে জাহাজ নোঙর করে অ্যাটকিন্স নৌকো নিয়ে দ্বীপে নেমেছিলেন পেঙ্গুইনের ডিম আনবেন বলে। দ্বীপের বর্ণনা, পেঙ্গুইনের বর্ণনা, জাহাজের বর্ণনা কিন্তু অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল ডেভিডসনের বর্ণনার সঙ্গে। হ্যাঁ, বজ্রবিদ্যুৎসহ ঝড় উঠেছিল সেই রাতে বাধ্য হয়ে রাত কাটাতে হয়েছিল দ্বীপে।

সব শোনবার পর পরিষ্কার বোঝা গেল, সেরাতের সবকিছুই ডেভিডসন দেখেছে। এই লন্ডন শহরে সে যখন এখানে-সেখানে ঘুরছে আমাদের সঙ্গে–অব্যাখ্যাতভাবে তার দৃষ্টিশক্তি বহু দূরের সেই দ্বীপে ঘুরে বেড়িয়েছে এক জায়গা থেকে আর-এক জায়গায়। কীভাবে, আজও তা রহস্য।

ডেভিডসনের আশ্চর্য চোখের অত্যাশ্চর্য কাহিনির পরিসমাপ্তি এইখানেই। দূরের দৃশ্য চামড়ার চোখ দিয়ে দেখার এত বড় নজির আর কেউ দিতে পারবেন না। ব্যাখ্যা অনেকরকমই শোনা যাচ্ছে–প্রফেসার ওয়েডের ব্যাখ্যাটাই সবচেয়ে জোরালো। কিন্তু তাঁর ব্যাখ্যা চতুর্থ মাত্রিক জগৎকে কেন্দ্র করে রচিত, স্থান সম্পর্কে তত্ত্বকথাপূর্ণ ভারী নিবন্ধ ফোর্থ ডাইমেনশনের হেঁয়ালিতে পূর্ণ। দড়ি বা তার যেমন পাকিয়ে যায়, স্থান বা স্পেসও নাকি হঠাৎ পাকিয়ে গিয়ে এই অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছে। হাস্যকর ব্যাখ্যা, সন্দেহ। নেই। এক্কেবারেই উদ্ভট। অবশ্য অঙ্ক জিনিসটা আমার মাথায় ঢোকে না কোনওকালেই। আট হাজার মাইলের ব্যবধান রয়েছে দুটো জায়গার মধ্যে–এটা একটা ঘটনা এবং কোনও তত্ত্বই এ ঘটনাকে উলটে দিতে পারে না। আমার এই জবর যুক্তি শুনে প্রফেসার শুধু বলেছিলেন, এক তা কাগজের ওপর দুটো বিন্দু এক গজ তফাতে রেখেও অনায়াসে মিলিয়ে দেওয়া যায় কাগজটাকে মুড়ে ধরলেই। ফোর্থ ডাইমেনশনের স্থানও নাকি ওইভাবে মোচড় খেয়ে এক হয়ে গিয়েছিল। সুধী পাঠক-পাঠিকা হয়তো তাঁর এই যুক্তির সারবত্তা বুঝতে পারবেন। আমি পারিনি–পারবও না। প্রফেসারের আইডিয়া মাথায় আনতে গেলে মাথা ঘুরতে থাকে আমার। ডেভিডসন বড় ইলেকট্রোম্যাগনেটের দুই প্রান্তের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকার সময়েই নাকি এই বৈজ্ঞানিক বিস্ময়টি ঘটে যায় চকিতের মধ্যে, অস্বাভাবিক এক মোচড় মুচড়ে দেয় তার অক্ষিপটের মৌলকে–এবং সেটা ঘটে বজ্রপাতের ফলে শক্তিক্ষেত্র অকস্মাৎ পালটে যাওয়ার।

প্রফেসারের বিশ্বাস, এর পরিণামস্বরূপ, পৃথিবীর এক জায়গায় দেহ নিয়ে বিদ্যমান থেকে অপর জায়গায় শুধু চোখে দেখার জগৎ নিয়ে দিব্যি বসবাস করা অসম্ভব কিছু নয়। আইডিয়াটা সপ্রমাণ করার জন্যে কিছু এক্সপেরিমেন্টও করেছিলেন, কিন্তু কয়েকটাকুকুরকে অন্ধ করে দেওয়া ছাড়া ফললাভ কিছু ঘটেনি। বেশ কয়েক হপ্তা আর দেখা হয়নি প্রফেসারের সঙ্গে। জানি না এখনও তাঁর ওই ফ্যান্টাস্টিক তত্ত্ব নিয়ে হেদিয়ে মরছেন কি না। আমার কিন্তু ধ্রুব বিশ্বাস, ডেভিডসনের অত্যাশ্চর্য অভিজ্ঞতার মূল অন্যত্র–ফোর্থ ডাইমেনশনের উদ্ভট গণ্ডির মধ্যে অন্তত নয়।

ডেভিডসনের আশ্চর্য চোখ

ডেভিডসনের আশ্চর্য চোখ

ডেভিডসনের আশ্চর্য চোখ ( The Remarkable Case of Davidsons Eyes )

[‘The Remarkable Case of Davidsons Eyes’ প্রথম প্রকাশিত হয় ‘The Story of Davidsons Eyes’ নামে, ১৮৯৫ সালের মার্চ মাসে ‘Pall Mall Budget’ পত্রিকায়। যদিও ওয়েলসের খুব বিখ্যাত গল্পগুলির মধ্যে একে গণ্য করা হয় না, গল্পটি সে যুগের রিমোট ভিউইং গোত্রের গল্পগুলির মধ্যে এটি উল্লেখযোগ্য। এরপর গল্পটি পুনঃপ্রকাশিত হয় বিখ্যাত সাই-ফাই পত্রিকা ‘Amazing Stories’-তে, প্রথম বর্ষপূর্তি সংখ্যায় ১৯২৭ সালের এপ্রিল মাসে। অদ্রীশের কলমে গল্পটি বাংলায় অনুদিত হয় অধুনালুপ্ত কিশোর মন পত্রিকায় ১৯৮০-র দশকে ‘ডেভিডসনের আশ্চর্য চোখ’ নামে।]

সিডনি ডেভিডসনের ক্ষণস্থায়ী মানসিক ভ্রান্তি এমনিতেই রীতিমতো চমকপ্রদ। ওয়েড যে ব্যাখা শুনিয়েছেন, তা মানতে গেলে ব্যাপারটা আরও বেশি চমকপ্রদ হয়ে দাঁড়ায়। দূর ভবিষ্যতে নাকি দারুণ দারুণ ঘটনা ঘটবে যোগাযোগব্যবস্থায়। পৃথিবীর এ পিঠ আর ও পিঠের মধ্যে দূরত্ব বলে আর কিছুই থাকবে না। স্বচ্ছন্দে মিনিট পাঁচেক কাটিয়ে আসা যাবে পৃথিবীর উলটোদিকে। ঘর ছেড়ে বেরতেই হবে না–চেয়ার ছেড়েও নড়তে হবে না। এমনও হতে পারে, লুকিয়ে-চুরিয়ে কোনও গোপন কাজই আর করা যাবে না। অদৃশ্য চাহনি খর-নজর রাখবে আমাদের প্রতিটি গুপ্ত ক্রিয়াকলাপের ওপর। ভবিষ্যতে এমনি অনেক পিলে-চমকানো সম্ভাবনা সত্যি সত্যিই পিলে চমকে দেবে বাস্তবের চেহারা নিয়ে। ডেভিডসন এই সৃষ্টিছাড়া ভ্রান্তি-ঘোরে আক্রান্ত হয়েছিল আমার সামনেই। প্রথম প্রত্যক্ষদর্শী আমিই। কাজেই কাহিনিটা কাগজে-কলমে প্রকাশ করার দায়িত্বও আমার।

ঘটনাস্থলে প্রথম হাজির হয়েছিলাম আমি–তাই আমি সেই মুহূর্তের প্রত্যক্ষদর্শী। আশ্চর্য ব্যাপারটা ঘটেছিল হার্লো টেকনিক্যাল কলেজে-হাইগেট আর্চওয়ের পাশেই। ছোট ঘরটায় ছিলাম আমি। নোট লিখছিলাম। ওজন করার সরঞ্জাম থাকে এই ঘরেই। কাজে অবশ্য মন দিতে পারছি না। লন্ডন শহরটার ঝুঁটি ধরে যেন ঝাঁকুনি দিচ্ছে সাংঘাতিক ঝড়। সেই সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, বাজ পড়ছে। আচমকা একটা বাজের আওয়াজে কানের পরদা যেন। ফালাফালা হয়ে গেল! দারুণ চমকে উঠেছিলাম। বজ্রপাতের কানফাটা আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে আরও একটা আওয়াজ যেন ভেসে এল কানে পাশের ঘর থেকে। কাচ ভাঙার ঝনঝন শব্দ। লেখা থামিয়ে কান খাড়া করলাম। সেকেন্ডকয়েক আর কোনও আওয়াজ পেলাম না। ঢেউখেলানো দস্তা-ছাদের ওপর শিলাবৃষ্টির ঝমাঝম আওয়াজ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। ঠিক যেন শয়তানের আঙুলের বাদ্যি। খট খটা খট! খট খটা খট! খট খটা খট! তারপরেই আবার কানে এল আর-একটা আওয়াজ। দড়াম করে কী যেন আছড়ে পড়ল বেঞ্চি থেকে নিচে। বেশ ভারী জিনিস। না, এবার আর কানের ভুল নয়। তড়াক করে লাফিয়ে উঠে দরজা খুলে ঢুকলাম বড় ল্যাবরেটরির মধ্যে।

অবাক হয়ে গিয়েছিলাম বিদঘুটে একটা হাসির আওয়াজ শুনে। ডেভিডসনকে অপ্রকৃতিস্থের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম ঘরের মাঝখানে। পা টলছে। চোখে-মুখে ভ্যাবাচ্যাকা ভাব। দেখেই প্রথমে মনে হয়েছিল, নেশা করেছে। আমাকে লক্ষই করল না। হাত বাড়িয়ে বাতাসে কী যেন খামচে ধরার চেষ্টা করছে দশ আঙুল দিয়ে। জিনিসটা কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। ডেভিডসনের রকমসকম দেখে মনে হচ্ছে, অদৃশ্য বস্তুটা রয়েছে চোখের গজখানেক সামনে। হাত বাড়িয়ে দিল খুব আস্তে আস্তে। বেশ দ্বিধার সঙ্গে খামচে ধরল বস্তুটা। কিন্তু পেল না কিছুই। আপন মনেই বললে, ব্যাপার কী বুঝছি না। দশ আঙুল ছড়িয়ে হাত বুলিয়ে নিলে মুখে। কী আশ্চর্য! বলেই পা তুলল বদ্ধপাগলের মতো–যেন পা আটকে যাচ্ছে মেঝেতে বেগ পেতে হচ্ছে পা তুলতে।

চিৎকার করে বলেছিলাম, ডেভিডসন! হল কী তোমার? বোঁ করে আমার দিকে ফিরে তাকাতে লাগল ডেভিডসন আমার আশপাশ দিয়ে। কখনও তাকায় আমার ঘাড়ের ওপর দিয়ে পেছনে, কখনও দুপাশে, কখনও সোজাসুজি আমার দিকেই। অথচ দেখতে পেয়েছে বলে মনেও হল না। বিড়বিড় করে বললে নিজের মনে–ঢেউ! ঢেউ! পালতোলা জাহাজটাও কী সুন্দর। বেলোজের গলা শুনলাম না? হ্যাঁ, বেলোজের গলাই তো বটে! না, ভুল হয়নি। হ্যাল্লো? তুমি কোথায়? আচমকা চেঁচিয়ে উঠল গলার শির তুলে।

আমি ভাবলাম বুঝি ফচকেমি শুরু করেছে ডেভিডসন। তারপরেই দেখলাম, তার পায়ের কাছে ভেঙেচুরে পড়ে রয়েছে ল্যাবরেটরির সবচেয়ে ভালো ইলেকট্রোমিটারটা। বললাম, কী চ্যাংড়ামি হচ্ছে ডেভিডসন? ইলেকট্রোমিটারটা ভাঙলে কেন?

আরে গেল যা! বেলোজই তো চেঁচাচ্ছে। ইলেকট্রোমিটার ভেঙেছি? বেলোজ! এ বেলোজ! কোথায় তুমি? বলেই আচমকা টলতে টলতে এগিয়ে এল আমার দিকে। বেঞ্চির সামনে এসেই যেন কুঁচকে গেল। মাখনের মধ্যে পা চালিয়ে এলাম যেন এতক্ষণ। এখন তো আর পারছি না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুলতে লাগল মাতালের মতো।

এবার ভয় পেলাম। বললাম, কী হল তোমার?

ডাইনে-বাঁয়ে সামনে-পেছনে ঘুরে ঘুরে আমাকে খুঁজল ডেভিডসন। বললে আপন মনে, বেলোজের গলা। কিন্তু বেলোজ! কী ইয়ারকি হচ্ছে? সামনে এসো-না!

ডেভিডসন কি হঠাৎ অন্ধ হয়ে গেছে? সন্দেহটা বিদ্যুঝলকের মতোই ঝলসে উঠল মাথার মধ্যে। টেবিলটাকে পাক দিয়ে ওর হাতে হাত রাখলাম, সাংঘাতিক চমকে উঠল ডেভিডসন। জীবনে এভাবে চমকে উঠতে কাউকে দেখিনি। আতঙ্কে বিকৃত মুখভঙ্গি করে দাঁড়াল আত্মরক্ষার ভঙ্গিমায়। সেই সঙ্গে সেই অর্থহীন চিৎকার–যাচ্চলে! এ আবার কে?

আমি–ডেভিডসন–আমি বেলোজ!

তিড়িং করে লাফিয়ে উঠেই ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল ডেভিডসন–আমাকে ছুঁড়ে আমার মধ্যে দিয়ে ওর দৃষ্টি চলে গেল অনেক দূর!

তারপরই শুরু হল বিড়বিড় বকুনি। নিজের মনেই বকে চলেছে–আমার উদ্দেশে বলছে না কিছুই–এই তো দিনের আলো… ঝকঝক করছে সমুদ্রসৈকত। লুকিয়ে থাকবে কোথায়? পাগলের মতো চাইল ডাইনে-বাঁয়ে সামনে-পেছনে। দেখি তো কোথায়? আচমকা ঘুরে দাঁড়িয়েই ধাঁ করে ধেয়ে গেল সটান বড় ইলেকট্রোম্যাগনেটটা লক্ষ্য করে– পরক্ষণেই ধাঁই করে এক ধাক্কা। পরে দেখেছিলাম, কাঁধ আর চোয়ালের হাড়ে কালশিটে পড়ে থেঁতলে গিয়েছিল এইভাবে দমাস করে আছড়ে পড়ায়। যন্ত্রণায় মুখ বেঁকিয়ে এক পা পেছিয়ে এসে সে কী গোঙানি–হে ভগবান! এ কী হল আমার! বিষম আতঙ্কে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল ডান হাত দিয়ে বাঁ হাত খামচে ধরে–ম্যাগনেট চোট দিয়েছিল সেখানেও।

উদ্ভট এই কাণ্ডকারখানা দেখে আমি কিন্তু ততক্ষণে যেমন উত্তেজিত, তেমনি ভয় পেয়েছি। তা সত্ত্বেও অভয় দিয়েছিলাম মিনমিনে স্বরে। ও কিন্তু আমার গলা শুনেই আবার আগের মতোই আঁতকে উঠেছিল একটু বেশিরকমভাবেই। কেশে গলা সাফ করে পরিষ্কারভাবে আবার অভয় দিতে ও জানতে চেয়েছিল আমিই বেলোজ কি না।

কেন? চোখে দেখতে পাচ্ছ না? বলেছিলাম আমি। আবার সেই বিতিকিচ্ছিরি হাসি হেসেছিল ডেভিডসন। নিজেকেই নাকি দেখতে পাচ্ছে না, আমাকে দেখার প্রশ্নই উঠছে। না!

আমি বলেছিলাম, সে কী! ল্যাবরেটরিতে দাঁড়িয়ে আছি তোমার সামনেই।

ল্যাবরেটরি! বিমূঢ় স্বরে জবাব দিয়েছিল ডেভিডসন–ল্যাবরেটরিতে তো ছিলাম দারুণ ঝলকে চোখ ঝলসে যাওয়ার আগে পর্যন্ত। এখন তো সেখানে নেই। যাক গে! জাহাজটা দেখছ?

জাহাজ? কী আবোল-তাবোল বকছ?

তেড়ে উঠেছিল ডেভিডসন। স্পষ্ট দেখছে, জাহাজ ভাসছে জলে, ঢেউ নাচছে সমুদ্রে– বললেই হল জাহাজ নেই! তাহলে নিশ্চয় অক্কা পেয়েছি দুজনেই। কিন্তু মজা তো সেখানেই। মরে গেলে কি দেহ থাকে? দেহের যন্ত্রণা থাকে? ওর নাকি দেহ আছে–কিন্তু দেহটাকে বাগে আনতে পারছে না কিছুতেই। ধমক দিয়েছিলাম আমি। পাগলামির একটা সীমা আছে। বহাল তবিয়তে ল্যাবরেটরির মধ্যে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের ঢেউ আর জাহাজ দেখা যায়? এইমাত্র একটা ইলেকট্রোমিটার ভাঙা হল তো এইখানেই–বয়েস এসেই তো একহাত নেবে।

ক্রায়োহাইড্রেটসের রেখাচিত্রের দিকে যেতে যেতে ডেভিডসন বলেছিল, কালা হয়ে গেলাম নাকি? কামান ছুঁড়েছে জাহাজ থেকে ধোঁয়া দেখতে পাচ্ছি আওয়াজ তো পেলাম না।

এ তো আচ্ছা জ্বালা! আবার হাত রেখেছিলাম ওর হাতে। এবার আর ভূত দেখার মতো চমকে ওঠেনি। বলেছিল অনেকটা আত্মস্থ স্বরে, তবে কি দুজনেই অদৃশ্য দেহ পেয়ে বসেছি? বেলোজ, দেখতে পাচ্ছ না? নৌকো আসছে–ডাঙার দিকে আসছে–দেখছ?

ডেভিডসন! জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলেছিলাম, জাগ, বন্ধু, জাগ!

ঠিক এই সময়ে ঘরে ঢুকেছিল বয়েস। ওর গলা শোনার সঙ্গে সঙ্গে সে কী চিৎকার ডেভিডসনের–বয়েস! তুমিও মারা গেছ! কী সর্বনাশ!

বয়েসকে তাড়াতাড়ি বুঝিয়ে দিয়েছিলাম ব্যাপারটা। ঘুমের ঘোরে হাঁটাচলার রোগে পেয়েছে নিশ্চয় ডেভিডসনকে। শুনেই কৌতূহল জাগ্রত হয়েছিল বয়েসের। ঘোর কাটিয়ে দেওয়ার অনেক চেষ্টা করেছিলাম দুজনে। প্রশ্নের জবাব দিয়েছিল। ডেভিডসন নিজেও প্রশ্ন করেছিল, কিন্তু মনটা পড়ে রয়েছে যেন সৈকত আর জাহাজের দিকে। মরীচিকা কাটিয়ে উঠতে পারছে না কিছুতেই। ছায়ামায়ায় ভরা বীক্ষণাগারের মধ্যে ও নাকি সমানে দেখতে পাচ্ছে পাল আর জাহাজ, নৌকো আর ঢেউ। শুনলেও গা শিরশির করে।

বেশ বুঝলাম, চোখের দৃষ্টি একেবারেই হারিয়েছে। নিতান্ত অসহায়। দুজনে দুপাশ থেকে কনুই ধরে করিডর বরাবর হাঁটিয়ে নিয়ে গেলাম বয়েসের প্রাইভেট ঘরে।

ডেভিডসনের মনে, চোখে ভাসছে কিন্তু সেই অবাস্তব জাহাজ। বয়েসও ছেলে ভোলানোর মতো সায় দিয়ে গেছে সমানে। ঘরে পৌঁছে খবর পাঠিয়েছিলাম কলেজের ডিন বুড়ো ওয়েডকে। ওঁর গলা শোনার পর একটু যেন শান্ত হয়েছিল ডেভিডসন। ঘ্যানর ঘ্যানর কিন্তু কমেনি। জানতে চেয়েছিল, হাত দুখানা তার কোন চুলোয়–দেখা যাচ্ছে না কেন? কোমরসমান উঁচু জমির মধ্যে দিয়েই বা তাকে হাঁটিয়ে আনা হল কেন? শুনে-টুনে ভুরু কপাল কুঁচকে চেয়ে রইলেন বুড়ো ওয়েড। তারপর ডেভিডসনের হাতখানা তুলে ধরে কৌচ ছুঁইয়ে বললেন, এই তো তোমার হাত-হাত দিয়েছ কৌচে–প্রফেসার বয়েসের প্রাইভেট রুমে। ঘোড়ার চুল-ঠাসা কুশন–তা-ই না?

হাত বুলিয়ে আরও ঘাবড়ে গিয়েছিল ডেভিডসন। হাতে টের পাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু চোখে তো দেখছে না।

তাহলে দেখছটা কী? জানতে চেয়েছিলেন ওয়েড। ডেভিডসন আবার আরম্ভ করেছিল একই ধানাইপানাই। রাশি রাশি বালি, ভাঙা ঝিনুক ছাড়া চোখে তো আর কিছুই পড়ছে না ঠিক এই জায়গাটায়।

ওয়েড আরও খানকয়েক জিনিস ধরিয়ে দিয়েছিলেন ডেভিডসনের হাতে। জানতে চেয়েছিলেন জিনিসগুলো কী। তীক্ষ্ণ চোখে দেখছিলেন মুখের চেহারা।

কিন্তু জবাবটা এসেছিল খাপছাড়া–জাহাজ নোঙর ফেলছে মনে হচ্ছে? আত্মগত স্বর ডেভিডসনের।

মৃদু ভর্ৎসনা করেছিলেন ওয়েড। জাহাজ নিয়ে পরে মাথা ঘামালেও চলবে। মরীচিকা দর্শন মানেটা কি জানা আছে ডেভিডসনের?

একটু একটু, আনমনাভাবে বলেছিল ডেভিডসন!

যা দেখছ, সবই মরীচিকা।

বিশপ বার্কলে, আবার সেই খাপছাড়া জবাব।

দূর! পাদরির দরকার হবে কেন? দিব্যি বেঁচে রয়েছ। তবে চোখের গোলমাল হয়েছে দেখা যাচ্ছে। শুনতে পাচ্ছ, হাত বুলিয়ে টের পাচ্ছ–অথচ দেখতে পাচ্ছ না। বুঝেছ?

খুব ভালোভাবেই দেখতে পাচ্ছি, চোখ ডলে বলেছিল ডেভিডসন।

হয়েছে, হয়েছে। যা দেখছ, তা নিয়ে মাথাটাকে আর কষ্ট দিয়ো না। গাড়ি আনাচ্ছি– বেলোজ আর আমি পৌঁছে দেব বাড়িতে।

দাঁড়ান।–ধরে বসিয়ে দেবেন?… ঠিক আছে… এবার বলুন গোড়া থেকে ব্যাপারটা কী?

ধৈর্য না হারিয়ে পুনরাবৃত্তি করে গেলেন ওয়েড। চোখ মুদে কপালে হাত রেখে সব শুনল ডেভিডসন। তারপর বললে চোখ মুদেই, এখন তো মনে হচ্ছে, সবই ঠিক আছে। ইংল্যান্ডেই রয়েছি। বেলোজ বসে রয়েছে পাশে, কৌচে। অন্ধকার।

বলেই খুলল চোখ–ওই দেখা যাচ্ছে সূর্য। জাহাজ। পাগলা সমুদ্র। উড়ন্ত পাখি। সত্যি, একেবারে সত্যি। বসে রয়েছি বালির ঢিপিতে।

চোখ ঢাকা দিয়ে হেঁট হয়েই ফের চোখ খুলে যেন ককিয়ে উঠল পরক্ষণেই–কালো সমুদ্র আর সূর্যোদয়! তা সত্ত্বেও কিন্তু বসে রয়েছি বয়েসের ঘরে–ওরই সোফায়!… এ কী হল আমার!

সেই শুরু। ঝাড়া তিন-তিনটে হপ্তা চলেছিল এই বিচিত্র ভোগান্তি। আক্কেল গুড়ুম করে ছেড়েছিল আমাদের ডেভিডসনের দু-দুটো চোখ, যে চোখে দৃষ্টি আছে, অথচ দৃষ্টি নেই। যেখানে বসে, সেখানকার কিছুই দেখছে না–দেখছে অন্য এক জায়গার দৃশ্য। অন্ধ হওয়াও বরং এর চাইতে ভালো। ওর সেই অসহায় অবস্থা ভাবলেও কষ্ট হয়। সদ্য ডিম ফোঁটা পাখির ছানাকে যেভাবে খাইয়ে দিতে হয়, সেইভাবেই তাকে খাওয়াতে হয়েছে দিনের পর দিন, হাত ধরে নিয়ে যেতে হয়েছে কলতলায়, জামাকাপড় খুলে আবার পরিয়ে দিতে হয়েছে বাচ্চা ছেলের মতো। নিজের চেষ্টায় হাঁটতে গেলেই হুমড়ি খেয়ে পড়েছে দেওয়ালে বা দরজায়–হোঁচট খেয়েছে পায়ের কাছে রাখা জিনিসের ওপর। দু-একদিন পরে অবশ্য আমাদের দেখতে না পেলেও গলা শুনে আর অমন আঁতকে উঠত না। আমার বোনের সঙ্গে ওর বিয়ে ঠিক হয়েছিল। বোন এসে বসে থাকত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ডেভিডসন আশ মিটিয়ে শোনাত সাগর আর সৈকতের অলীক কাহিনি। কলেজ থেকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময়ে সে আর-এক ফ্যাসাদ। বাড়ি তো সেই হ্যাঁম্পস্টিড গ্রামে। গাড়ি নাকি ওকে নিয়ে সোজা একটা বালিয়াড়ি ভেদ করে বেরিয়ে গিয়েছিল। চোখে কিছু দেখতে পায়নি… অন্ধকার… কুচকুচে অন্ধকার। ওপাশ দিয়ে বেরিয়ে আসার পর আবার চোখে পড়েছে গাছ, পাথর, নিরেট জিনিস। গাড়ি নাকি এই সবকিছুর মধ্যে দিয়েই ওকে নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে–অথচ গাছ, পাথর, নিরেট বস্তু বালিয়াড়িটার মতোই ওকে আটকে রাখতে পারেনি। বাড়ি পৌঁছে ওপরতলার ঘরে নিয়ে যাওয়ার সময়ে সে কী পরিত্রাহি চিৎকার। কাল্পনিক দেশের পাথুরে জমির তিরিশ থেকে পঞ্চাশ ফুট ওপরে শূন্যে তোলা হচ্ছে কেন? পড়ে গেলে ছাতু হয়ে যাবে যে! ডিমের মতো ফট করে ফেটে যাবে মাথার খুলি। একনাগাড়ে এই কাঁইমাই সহ্য করা যায়? নামিয়ে আনা হল একতলায়। বাবার কনসাল্টিং রুমের একটা সোফায় বসে তবে নিশ্চিন্ত হল ডেভিডসন।

দ্বীপটার বর্ণনা শুনেছিলাম ওরই মুখে। মন দমে যাওয়ায় মতো জায়গা। গাছপালা অতি সামান্যই। বেশির ভাগই নেড়া পাথর, পেঙ্গুইন আছে বিস্তর, পাথর সাদা হয়ে থাকে– সংখ্যায় এত, দেখতে অতি বিচ্ছিরি, সমুদ্র মাঝেমধ্যে দামাল। প্রথম দু-একদিনের মধ্যে বজ্রবিদ্যুৎসহ ঝড়ও দেখেছে। বজ্রপাত দেখেছে, বিদ্যুতের চমক দেখে নিজেই চমকে চমকে উঠে সমানে চেঁচিয়ে গেছে কিন্তু বজ্রের আওয়াজ, মেঘ ডাকার গুরগুর শব্দ কানে ভেসে আসেনি। নিঃশব্দ সেই বজ্রপাত নাকি এমনই রোমাঞ্চকর যে ভাষায় বর্ণনা করা দুঃসাধ্য। বার দুয়েক বালির ওপর সিল মাছ উঠে এসেছে। পেঙ্গুইনরা নাকি ওর দেহ কুঁড়ে হেলেদুলে দিব্যি চলে গিয়েছে–কারও কোনও অসুবিধে হয়নি। ওর শুয়ে থাকার জন্যে পেঙ্গুইনরা তিলমাত্র বিচলিত বোধ করেনি।

অদ্ভুত একটা ব্যাপার বেশ মনে আছে। সিগারেট খাওয়ার খুব ইচ্ছে হয়েছিল ডেভিডসনের। আঙুলে পাইপ গুঁজে দিয়েছিলাম। কোটর থেকে চোখ দুটো প্রায় ঠেলে বার করে এনেও সিগারেট বা পাইপ কোনওটাই দেখতে পায়নি। ধরিয়ে দিয়েছিলাম সিগারেট। টেনে কোনও স্বাদ পায়নি। এ ব্যাপার আমার ক্ষেত্রেও ঘটেছে। ধোঁয়া না দেখতে পেলে তামাক খাওয়ার মজা পাওয়া যায় না।

আশ্চর্য দর্শনের সবচেয়ে অদ্ভুত অংশটা শুরু হয়েছিল ঠেলা-চেয়ারে বসিয়ে ওকে হাওয়া খেতে নিয়ে যাওয়ার সময়ে। আমার বোন গিয়েছিল সঙ্গে। কেঁদে ফেলেছিল নাকি ডেভিডসন। কাকুতিমিনতি করেছিল বোনের কাছে। ভয়াবহ এই অন্ধকারে আর সে থাকতে পারছে না। অসহ্য! অসহ্য! বোনের হাত খামচে ধরে বলেছিল কাঁদতে কাঁদতে, নিয়ে চল, নিয়ে চল এই অন্ধকারের বাইরে–নইলে আর বাঁচব না। খুলে বলতে পারেনি। ডেভিডসন। বোন ওকে নিয়ে বাড়িমুখে রওনা হয়েছিল তৎক্ষণাৎ চড়াই ভেঙে হ্যাঁম্পস্টিডের দিকে যেতে যেতেই বিভীষিকা থেকে মুক্তি পেয়েছিল বন্ধুবর। আবার নাকি তারা দেখা যাচ্ছে–অথচ তখন সূর্য মাথার ওপর।

পরে আমাকে বলেছিল, মনে হচ্ছিল যেন জলের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আমাকে– বাধা দিতে পারছি না। প্রথমে অতটা ভয় পাইনি। যদিও তখন নিশুতি রাত–কিন্তু বড় সুন্দর রাত।

হ্যাঁ। এখানে যখন দিন, ওখানে তখন রাত।… জলের মধ্যে সটান ঢুকে গেলাম তারপরেই। ফুলে ফুলে উঠছে জল–চওড়া হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে দিগন্ত পর্যন্ত–ঠিক যেন চকচকে চামড়া দিয়ে ঢাকা ফোঁপরা গহ্বরের মধ্যে নেমে যাচ্ছি আস্তে আস্তে। নামছি ঢালু পথে। জল উঠে এল চোখ পর্যন্ত। তারপর চলে এলাম জলের তলায়। চকচকে চামড়া টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে গিয়ে ফের জুড়ে গেল মাথার ওপর। চাঁদ লাফ দিয়ে উঠল আকাশে, সবুজ চাঁদ। অস্পষ্ট। চারপাশে খেলছে আবছা দ্যুতিময় মাছ। ঠিক যেন কাচের মাছ-গা থেকে আলো ছিটকে যাচ্ছে। সামুদ্রিক উদ্ভিদের একটা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে নেমে এলাম আস্তে আস্তে–তেলতেলে আভা বেরুচ্ছে জঙ্গল থেকে। নামছি, নামছি, আরও নামছি। একে একে নিবে গেল একটার পর একটা তারা। আরও সবুজ হয়ে এল চাঁদ আরও গাঢ়। বেগুনি-লাল হয়ে এল সামুদ্রিক উদ্ভিদ। রহস্যময় সেই আলো-আঁধারির মধ্যে সবই থিরথির করে কাঁপছে আবছাভাবে। কানে ভেসে আসছে একটানা শব্দের পর শব্দ এই জগতের শব্দ… চেয়ার গড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ… আশপাশে জুতো মশমশিয়ে লোকজনের হাঁটাচলার শব্দ… দূরে খবরের কাগজ ফেরি করার চিৎকার–নেমে গেলাম জলের আরও গভীরে। কালির মতো কালো হয়ে এল চারদিক… নিঃসীম সেই অন্ধকারে বাইরের কোনও আলো ঢোকার যেন অধিকার নেই… অন্ধকার… অন্ধকার… সীমাহীন নিবিড় তমিস্রা ভেদ করে চলেছি তো চলেইছি… ফসফরাস-দ্যুতি বিকিরণ করে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠছে অন্ধকারের প্রাণীরা… গভীর জলের উদ্ভিদের সর্পিল শাখা নড়ছে স্পিরিট-ল্যাম্পের জ্বলন্ত শিখার মতো… আরও কিছুক্ষণ পরে উদ্ভিদও আর চোখে পড়ল না। বিকট হাঁ আর ড্যাবডেবে চোখ মেলে সটান আমাকে ছুঁড়ে বেরিয়ে গেল ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ। হাঁ-মুখ দেখে প্রথমে ভয় পেয়েছিলাম–তারপর কিছুই টের পেলাম না– মাছেরাও পেল না। সমুদ্রে যে এরকম বিকট মাছ আছে, কোনওদিন কল্পনাতেও ভাবতে পারিনি।

আলোকময় পেনসিল দিয়ে আঁকা যেন মাছগুলো-কিনারা ঘিরে ঠিকরে যাচ্ছে আগুন। কিলবিলে অনেকগুলো হাত মেলে বিকটাকার একটা প্রাণী পেছনদিকে সাঁতরে আসতেই আঁতকে উঠেছিলাম। তারপরেই কাঠ হয়ে গেলাম অস্পষ্ট বিশাল একটা আলোকপুঞ্জকে ধীরে ধীরে আমার দিকেই এগিয়ে আসতে দেখে। জমাট আঁধারের মধ্যে থেকে একটু একটু করে স্পষ্ট হয়ে উঠছে বহু দুরের চাপ-বাঁধা আলোর ডেলা। কাছে আসতেই টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে গেল আলোর কণা। মাছ। ভাসমান কী যেন একটা ঘিরে ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুরছে দ্যুতিময় মাছ। আমি চেয়ারে বসে সটান চলেছি সেইদিকেই। আরও কাছে… আরও কাছে… হঠাৎ দেখলাম একটা ভাঙা বরগা… মাছেদের আলোয় তুলকালাম কাণ্ডের মধ্যে মাথার ওপরে ভাসতে দেখলাম লম্বা কাঠখানা… জমাট কালো অন্ধকারের মতো একটা জাহাজের খোলও দেখলাম, কাত হয়ে রয়েছে মাথার ওপর… অন্ধকার কিন্তু ফিকে হয়ে এসেছে ফসফরাস-দ্যুতিতে… মাছেদের ঠোকরানিতে ফুলিঙ্গের মতো ফসফরাস-দ্যুতি ঠিকরে ঠিকরে যাচ্ছে কতকগুলো আকৃতি থেকে… আতঙ্কে দমবন্ধ হয়ে এসেছিল আমার… চেঁচিয়ে ডেকেছিলাম তোমার বোনকে… আধখাওয়া সেই মড়াদের গায়ে অজস্র ছেদা… আমাকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল সেইদিকেই… মড়াদের গায়ের ফুটোগুলোর দিকেই…! উঃ! কী বীভৎস! গায়ে কাঁটা দিচ্ছে, তাই না বেলোজ? দেখ তো হাতটা?

তিন-তিনটে সপ্তাহ সেই অপচ্ছায়া-জগতের মধ্যে কাটিয়েছে ডেভিডসন–নিজের চারপাশের এই জগৎকে দেখতে পায়নি একটুও। তারপর এক মঙ্গলবারে দেখা করতে যেতেই ওর বুড়ো বাবার মুখোমুখি হলাম করিডরে। ওভারকোটে হাত গলাতে গলাতে ছুটছেন। আমাকে দেখেই সজল চোখে ধরা গলায় বললেন, বেলোজ, ছেলেটা এবার ঠিক হয়ে যাবে। দেখতে পাচ্ছে… নিজের বুড়ো আঙুলটা এদ্দিনে দেখতে পেয়েছে।

দৌড়ালাম। ডেভিডসন একটা বই চোখের সামনে ধরে বসে ছিল–হাসছিল আপন মনে –অনেকটা পাগলের মতো। বলেছিল, কী আশ্চর্য! এইখানটা… এই জায়গাটা একটুখানি দেখা যাচ্ছে– আঙুল রেখেছিল বইয়ের পাতায় এক জায়গায়–পাথরের ওপর বসে রয়েছি কিন্তু এখনও। বড় গোলমাল করছে পেঙ্গুইনগুলো। দূরে মাঝে মাঝে দেখছি একটা তিমিকে। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু এইখানে কিছু ধর–দেখতে পাব… খুব অস্পষ্ট… ভাঙা ভাঙা… তবুও দেখা যাচ্ছে… অস্পষ্ট প্রেতচ্ছায়ার মতো। আজ সকালে জামাকাপড় পরানোর সময়ে প্রথম দেখেছিলাম। নারকীয় এই অপচ্ছায়া-জগতের মধ্যে যেন একটা ফুটো। রাখ–তোমার হাতটা রাখ এইখানে… না… না… ওখানে নয়। হ্যাঁ… ঠিক হয়েছে! দেখতে পাচ্ছি… তোমারই বুড়ো আঙুল… তলার দিক আর শার্টের হাতার একটুখানি। অন্ধকার আকাশ ফুটো করে যেন বেরিয়ে আছে তোমার ভূতুড়ে হাতের একটুখানি! ঠিক পাশেই ভাসছে একদঙ্গল নক্ষত্র!

সেই থেকেই একটু একটু করে সেরে উঠতে লাগল ডেভিডসন। অপচ্ছায়া-জগৎ দেখে যে বর্ণনা দিয়েছিল–নিখুঁত সেই বর্ণনার মতোই দৃশ্য পরিবর্তনের এই বর্ণনাও বিশ্বাস না করে পারা যায় না। অপচ্ছায়া-জগতের জায়গায় জায়গায় যেন ছেদা হয়ে যাচ্ছে… ছায়াবাজির মতো অলীক জগৎ ছিঁড়েখুঁড়ে উড়ে যাচ্ছে… অর্ধস্বচ্ছ ফুটোর মধ্যে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে স্বচ্ছ, অস্পষ্ট এই সত্যিকারের জগতের ছেঁড়া ছেঁড়া দৃশ্য। ক্রশঃ পরিধি বেড়েছে ফুটোগুলোর… বেড়েছে সংখ্যায়… আস্তে আস্তে গায়ে গায়ে লেগে গিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সত্যিকারের এই জগতের দৃশ্যর ওপর–অলীক অপচ্ছায়া-জগৎ অস্পষ্ট ছেঁড়া-ছেঁড়াভাবে দেখা গিয়েছে এখানে-সেখানে। চোখের ওপর অন্ধত্ব দানা আকারে যেন জমে রয়েছে–সেই দানার জায়গাগুলোয় তখনও ঠেলাঠেলি করে ফুটে উঠছে অবাস্তব সেই জগতের মরীচিকাদৃশ্য। নিজে থেকে উঠে বসা, চলাফেরা, খাওয়াদাওয়া, ধূমপান করা, বই পড়ায় অভ্যস্ত হল আস্তে আস্তে। দুটো ছবি ওপর-ওপর থাকায় প্রথমটা একটু গোলমাল লাগত। তা-ও সয়ে গেল দুদিনেই। অলীক মায়াজগতের দৃশ্য আর বাস্তব জগতের দৃশ্য আলাদা করে নিতে পারল সহজেই।

প্রথমটা দারুণ খুশি হয়েছিল ডেভিডসন। ফেটে পড়েছিল মুক্তি পাওয়ার আনন্দে। তারপরেই শুরু হল উলটো টান। বিলীয়মান আশ্চর্য দ্বীপ, বিচিত্র সমুদ্র, পেঙ্গুইনের পাল, সমুদ্রের গভীরে ভাসমান জাহাজের খোল আবার ভালো করে দেখার জন্যে ব্যাকুল হয়েছিল। একা একা ছুটে যেত হ্যাঁম্পস্টিডের নিচু অঞ্চলে। কিন্তু সত্যিকারের দুনিয়ার চড়া রোদ দুদিনেই মিথ্যে দুনিয়ার রাতের অন্ধকারকে মুছে দিলে একেবারে। ছেঁড়া-ছেঁড়া দৃশ্য একটু একটু করে ফিকে হতে হতে একেবারেই গেল মিলিয়ে। তা সত্ত্বেও গভীর রাতে অন্ধকার ঘরে দেখতে পেত অলীক দ্বীপের রোদে তেতে-ওঠা সাদা পাথর, পেঙ্গুইনদের হেলেদুলে চলা। আস্তে আস্তে এ দৃশ্যও সরে গেল তার চোখের সামনে থেকে নিশুতি রাতেও। আমার বোনকে বিয়ে করার পর অলীকদর্শন তিরোহিত হল একেবারেই।

সবচেয়ে উদ্ভট ঘটনাটায় এবার আসা যাক। বিয়ের দুবছর পরে ডিনার খেতে গিয়েছিলাম ডেভিডসন-দম্পতির সঙ্গে। খাওয়াদাওয়ার পর অ্যাটকিন্স নামে একজন ভদ্রলোক এলেন ঘরে। রয়াল নেভির লেফটেন্যান্ট। ভারী চমৎকার মানুষ। আড্ডাবাজ। আসর জমাতে ওস্তাদ। কথায় কথায় পকেট থেকে একটা ফোটো বার করে দেখিয়েছিলেন আমাদের। ছবিটা একটা জাহাজের।

দেখেই আঁতকে উঠেছিল ডেভিডসন!

সেই জাহাজ! যে জাহাজ সে বারবার দেখেছে অলীকদর্শনে–নিখুঁত বর্ণনাও শুনিয়েছে।

অ্যাটকিন্স তো অবাক! এ জাহাজ ডেভিডসন দেখবে কী করে? অ্যান্টিপোড আইল্যান্ডের দক্ষিণে জাহাজ নোঙর করে অ্যাটকিন্স নৌকো নিয়ে দ্বীপে নেমেছিলেন পেঙ্গুইনের ডিম আনবেন বলে। দ্বীপের বর্ণনা, পেঙ্গুইনের বর্ণনা, জাহাজের বর্ণনা কিন্তু অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল ডেভিডসনের বর্ণনার সঙ্গে। হ্যাঁ, বজ্রবিদ্যুৎসহ ঝড় উঠেছিল সেই রাতে বাধ্য হয়ে রাত কাটাতে হয়েছিল দ্বীপে।

সব শোনবার পর পরিষ্কার বোঝা গেল, সেরাতের সবকিছুই ডেভিডসন দেখেছে। এই লন্ডন শহরে সে যখন এখানে-সেখানে ঘুরছে আমাদের সঙ্গে–অব্যাখ্যাতভাবে তার দৃষ্টিশক্তি বহু দূরের সেই দ্বীপে ঘুরে বেড়িয়েছে এক জায়গা থেকে আর-এক জায়গায়। কীভাবে, আজও তা রহস্য।

ডেভিডসনের আশ্চর্য চোখের অত্যাশ্চর্য কাহিনির পরিসমাপ্তি এইখানেই। দূরের দৃশ্য চামড়ার চোখ দিয়ে দেখার এত বড় নজির আর কেউ দিতে পারবেন না। ব্যাখ্যা অনেকরকমই শোনা যাচ্ছে–প্রফেসার ওয়েডের ব্যাখ্যাটাই সবচেয়ে জোরালো। কিন্তু তাঁর ব্যাখ্যা চতুর্থ মাত্রিক জগৎকে কেন্দ্র করে রচিত, স্থান সম্পর্কে তত্ত্বকথাপূর্ণ ভারী নিবন্ধ ফোর্থ ডাইমেনশনের হেঁয়ালিতে পূর্ণ। দড়ি বা তার যেমন পাকিয়ে যায়, স্থান বা স্পেসও নাকি হঠাৎ পাকিয়ে গিয়ে এই অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছে। হাস্যকর ব্যাখ্যা, সন্দেহ। নেই। এক্কেবারেই উদ্ভট। অবশ্য অঙ্ক জিনিসটা আমার মাথায় ঢোকে না কোনওকালেই। আট হাজার মাইলের ব্যবধান রয়েছে দুটো জায়গার মধ্যে–এটা একটা ঘটনা এবং কোনও তত্ত্বই এ ঘটনাকে উলটে দিতে পারে না। আমার এই জবর যুক্তি শুনে প্রফেসার শুধু বলেছিলেন, এক তা কাগজের ওপর দুটো বিন্দু এক গজ তফাতে রেখেও অনায়াসে মিলিয়ে দেওয়া যায় কাগজটাকে মুড়ে ধরলেই। ফোর্থ ডাইমেনশনের স্থানও নাকি ওইভাবে মোচড় খেয়ে এক হয়ে গিয়েছিল। সুধী পাঠক-পাঠিকা হয়তো তাঁর এই যুক্তির সারবত্তা বুঝতে পারবেন। আমি পারিনি–পারবও না। প্রফেসারের আইডিয়া মাথায় আনতে গেলে মাথা ঘুরতে থাকে আমার। ডেভিডসন বড় ইলেকট্রোম্যাগনেটের দুই প্রান্তের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকার সময়েই নাকি এই বৈজ্ঞানিক বিস্ময়টি ঘটে যায় চকিতের মধ্যে, অস্বাভাবিক এক মোচড় মুচড়ে দেয় তার অক্ষিপটের মৌলকে–এবং সেটা ঘটে বজ্রপাতের ফলে শক্তিক্ষেত্র অকস্মাৎ পালটে যাওয়ার।

প্রফেসারের বিশ্বাস, এর পরিণামস্বরূপ, পৃথিবীর এক জায়গায় দেহ নিয়ে বিদ্যমান থেকে অপর জায়গায় শুধু চোখে দেখার জগৎ নিয়ে দিব্যি বসবাস করা অসম্ভব কিছু নয়। আইডিয়াটা সপ্রমাণ করার জন্যে কিছু এক্সপেরিমেন্টও করেছিলেন, কিন্তু কয়েকটাকুকুরকে অন্ধ করে দেওয়া ছাড়া ফললাভ কিছু ঘটেনি। বেশ কয়েক হপ্তা আর দেখা হয়নি প্রফেসারের সঙ্গে। জানি না এখনও তাঁর ওই ফ্যান্টাস্টিক তত্ত্ব নিয়ে হেদিয়ে মরছেন কি না। আমার কিন্তু ধ্রুব বিশ্বাস, ডেভিডসনের অত্যাশ্চর্য অভিজ্ঞতার মূল অন্যত্র–ফোর্থ ডাইমেনশনের উদ্ভট গণ্ডির মধ্যে অন্তত নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *