৫. বিনডনের হস্তক্ষেপ

৫৷ বিনডনের হস্তক্ষেপ

 বিচিত্র পন্থায় ডেনটনের ওপর প্রতিশোধ নিল বিনডন।

বিচিত্র তার চরিত্র। আশ্চর্য এই কাহিনির মধ্যে প্রহেলিকা বলে যদি কিছু থাকে, তবে তা বিনডেনের চরিত্র।

ছেলেবেলা থেকেই উচ্চুঙ্খল জীবনযাপন করে ধাপে ধাপে সে উঠেছে কর্তৃত্বের শিখরে। ফাটকাবাজি করে পয়সা কামিয়েছে দেদার। বাকি জীবনটা বুদ্ধি খরচ করে কেবল জুয়ো নিয়েই মেতে থেকেছে। নামযশের মোহে ব্যাবসায় নেমেছে। পৃথিবীর সমস্ত উড়ুক্কু যান এসে নামে লন্ডনের যে ফ্লায়িং স্টেজে, সেই কোম্পানির শেয়ার কিনে নিয়ে কোম্পানির সর্বেসর্বা হয়ে বসেছে। দশজনের সামনে মান্যগণ্য হওয়ার পর নিমগ্ন থেকেছে নিজস্ব একান্ত গোপনীয় সাধ-আহ্লাদ নিয়ে।

চেহারাটা তার চিরকালই অ-সুন্দর। খর্বকায়, অস্থিসার এবং কৃষ্ণকায়। সূক্ষ্ম মুখাবয়বে কখনও প্রকট হয় ধীশক্তি, কখনও আত্মসন্তুষ্টি। যুগের ফ্যাশন অনুযায়ী পোশাকের রঙের সঙ্গে রং মিলিয়ে চুলের রং পালটে যায় যখন-তখন। কখনও পরে বাতাস ভরতি পোশাক, কখনও বিচিত্র টুপি, কখনও কালো সাটিনের টাইট ধরাচূড়া, কখনও চীনে রেশমের আলখাল্লা ঝুলতে থাকে বাতাস-চওড়া কাঁধের পোশাক থেকে। এলিজাবেথিটার মন জয় করার বাসনা নিয়ে পরেছিল গোলাপি রঙের আঁটসাঁট জামা, মাথায় এঁটেছিল জোড়া শিং, সারা গায়ে রকমারি আঁচিল। অপদার্থ ডেনটনের প্রেমে মজে না থাকলে এলিজাবেথিটা আকৃষ্ট না হয়ে পারত না। ওর বাবাও তা-ই বলেছিল। এমন খাসা পোশাক দেখেই না মুন্ডু ঘুরে যায় দ্বাবিংশ শতাব্দীর মেয়েদের! চলতে-ফিরতে রং পালটে যেত অপূর্ব জামাকাপড়ের, মেয়েদের চক্ষু চড়কগাছ না হয়ে পারে? কিন্তু হিপনোটিজমঘটিত অঘটনের পর দেখা গেল ধারণাটা একেবারেই ভিত্তিহীন।

বেপরোয়া জীবনযাপন করে যকৃৎ এবং স্নায়ুর দফারফা করে এনেছিল বিনডন। শরীর যখন বিধ্বস্ত, তখন খেয়াল হয়েছিল, বিয়ে-থা করে ঘরকন্নার মধ্যে ঢুকে পড়লে হয়তো স্বভাব পালটে সুস্থ শরীরে টিকে থাকা যাবে আরও কিছুদিন। কিন্তু মনের মতো পাত্রী পাওয়াই তো মুশকিল। ষোলো বছর বয়স থেকেই হরদম প্রেমে পড়েও সত্যিকারের প্রেমে কখনও পড়েনি বিনডন।

পড়ল, এলিজাবেথিটাকে যখন তার বাবা এনে হাজির করল তার সামনে–অবশ্যই নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্যে। প্রথম দর্শনেই প্রেমে হাবুডুবু খেল বিনডন–এ প্রেম নিখাদ প্রেম, নিকষিত হেম! এলিজাবেথিটার মনের মানুষ হওয়ার উৎসাহে শেলি আর গ্যেটের জগাখিচুড়ি মুখস্থ করে নিয়ে গেল দিনের পর দিন।

এলিজাবেথিটার মনের মানুষ যে আসলে আর-একজন, বিনডন তার কোনও খবরই রাখত না। এমনকী উচ্চাভিলাষী কুটিল-মস্তিষ্ক স্বরেস যে হিপনোটাইজ করে রেখেছে। মেয়েকে–তা-ও জানত না। এলিজাবেথিটার শান্ত সুমিষ্ট ব্যবহারে ভেবেছে, সার্থক হয়েছে প্রচেষ্টা। দামি দামি গয়না আর প্রসাধনসামগ্রী উপহার দিয়ে গেছে দিনের পর দিন। তারপরেই একদিন উধাও হয়ে গেল এলিজাবেথিটা।

বিনডনের আকাশচুম্বী আত্মশ্লাঘা ধূলিসাৎ হল নিমেষে। ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে প্রথমেই একহাত নিল স্বরেসকে। যাচ্ছেতাই ভাষায় অপমান করার পর শহরময় চরকিপাক দিয়ে বারোটা বাজিয়ে ছাড়ল স্বরেসের। মেয়ের বিয়ে দিয়ে নিজের দিন কেনার স্বপ্ন দেখতে গিয়ে পথে বসল উচ্চাভিলাষী স্বরেস।

নিখুঁতভাবে কাজটা সমাধান করে যৌবনকালের মদ্যশালায় খুশি খুশি মনে গিয়ে বসল বিনডন। পুরানো দোস্তও জুটে গেল জনা দুয়েক। না, সঙ্গিনী সে জোটায়নি। মেয়ে জাতটার ওপরেই যে হাড়পিত্তি জ্বলে গিয়েছিল বিনডনের।

ফল যা হবার হল পরের দিন সকালে। যকৃতের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে লাথি মেরে গুঁড়িয়ে। দিল ফোনোগ্রাফিক মেশিন, বরখাস্ত করল প্রধান পরিচারককে এবং ঠিক করল, প্রচণ্ড প্রতিশোধ নিতে হবে এলিজাবেথিটা আর ডেনটনের ওপর। প্ল্যানটাও ছকে ফেলল মাথার মধ্যে।

গেল স্বরেসের কাছে। পথের ফকির হয়ে স্বরেস তখন মাথায় হাত দিয়ে বসে। বিত্ত উদ্ধারের জন্য চিত্ত বিক্রয়ে প্রস্তুত যে কোনও দামে। মায়ের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে হবে এলিজাবেথিটাকে? হাতে পয়সা না থাকলেই লেবার কোম্পানিতে চাকরি নেবে দুজনে? তারপর? তারপর? তারপর আর কী! অনটনের সংসারে ঝগড়া লাগবে দুজনে– বিবাহবিচ্ছেদ ঘটিয়ে এলিজাবেথিটাকে ঘরে এনে তুলবে বিনডন।

কাজ হল প্ল্যাননমাফিক–অক্ষরে অক্ষরে–অন্তত প্ল্যানের প্রথম অংশটা।

লেবার কোম্পানির দরজার সামনেই উঁচুতলার ফ্ল্যাট থেকে বিনডন দেখল সেই দৃশ্য নীল ক্যাম্বিস পরতে চলেছে অনাহারে শুষ্ক এলিজাবেথিটা আর ডেনটন।

তৎক্ষণাৎ তলব পড়ল স্বরেসের। এবার চলুক মানসিক নির্যাতন। এলিজাবেথিটা যেন হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারে–ডেনটন তার উপযুক্ত নয়।

ইতিমধ্যে ওদের একমাত্র মেয়ে অক্কা পাওয়ায় সে কী ফুর্তি বিনডনের। টাকায় কী না হয়। টাকার জোরেই অঘটন ঘটিয়ে চলেছে সে পরের পর। এবার শেষ পর্ব!

স্বরেস যাক এলিজাবেথিটার কাছে–অপদার্থ ডেনটনকে পরিত্যাগ করার প্রস্তাব নিয়ে।

সুড়সুড় করে হুকুম তামিল করল স্বরেস!

 তারপর?

রিপোর্ট দিয়ে গেল স্বরেস। বিবাহবিচ্ছেদের প্রস্তাব শুনে নাকি ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেছে এলিজাবেথিটা। হাউহাউ করে বলে গেছে নিজের দুঃখ-দুর্দশার কাহিনি।

আহা! আহা! বলতে বলতে অকস্মাৎ ককিয়ে উঠেছিল বিনডন। যকৃতের সেই যন্ত্রণাটা ছুরির মতো খুঁচিয়ে চলেছে। পরপর দুবার কোনওমতে সইবার পর তৃতীয় খোঁচাটা খেয়েই দৌড়েছিল ডাক্তারের কাছে।

আগাপাশতলা পরীক্ষা করে ডাক্তার জানতে চেয়েছিল, ছেলেপুলে হয়েছে কি বিনডনের? হয়নি তো! তবে আর বাঁধন কীসের! ইউথ্যানাসিয়ার শরণ নেওয়া হোক–এখুনি।

ইউথ্যানাসিয়া! সেটা আবার কী?

স্বেচ্ছামৃত্যু! আর মাত্র তিন দিন আয়ু আছে বিনডনের। সারাজীবন ধরে আত্মহত্যাই করে এসেছে–এবার তা ত্বরান্বিত হোক তিন দিনের মধ্যে! দুনিয়ার কোনও ডাক্তারই পারবে না তার জীর্ণ দেহযন্ত্রগুলিকে নতুন করে তাজা করতে। আয়ু ফুরিয়েছে। অতএব

ডাক্তারের পিণ্ডি চটকে বিনডন যন্ত্রণায় ককাতে ককাতে শহর চষে ফেলেছিল। বাঘা বাঘা ডাক্তারকে দেখিয়েছিল। কিন্তু সব শেয়ালেরই যে এক ডাক!

আয়ু ফুরিয়েছে বিনডনের। কুবের সম্পদ ঢেলেও আর তা টেনে লম্বা করা যাবে না।

গোল্লায় যাক বিজ্ঞান! নিজের নিভৃত ঘরে বসে বেশ কিছুক্ষণ ধরে বিজ্ঞানভিত্তিক সভ্যতাটার মুন্ডুপাত করেছিল বিনডন। এলিজাবেথিটা তার মনে দাগা দিয়ে যাওয়ার পর কিছুদিন মঠে-মন্দিরে ঘুরে শান্তি খুঁজতে গিয়ে যে কথাটা শুনেছিল, মনের মধ্যে বারবার প্রতিধ্বনিত হল সেই কথা। এ দুনিয়ায় নশ্বর সবই–জরা এসে একদিন গ্রাস করবেই এই দেহকে। সবই পড়ে থাকবে–অবিনশ্বর শুধু আত্মা–শুদ্ধ রাখ সেই আত্মাকে।

আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে এল বিনডন। এলিজাবেথিটা তাকে ভুল বুঝেছে। তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে, বিনডন কী চরিত্রের মানুষ। তার মন জয় করা না গেলেও, মনে ছাপ ফেলে দেওয়া তো যাবে। এমন ছাপ এঁকে যাবে বিনডন, যার পরে অনুতপ্ত হবেই এলিজাবেথিটা –বিনডনের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের জন্যে। চরম উদারতা দেখিয়ে যাবে বিনডন–রিক্তা এলিজাবেথিটাকে এনে বসাবে বিত্তের সিংহাসনে-পাশে থাকবে ডেনটন।

সেই হবে বিনডনের ভয়ানক প্রতিশোধ!

 টেলিফোন করল আইনবিদকে তৎক্ষণাৎ। দশ মিনিটের মধ্যেই তৈরি হয়ে গেল ইষ্টিপত্র –টিপসই চলে গেল তিন মাইল দূরে আইনজ্ঞের দপ্তরে–যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে।

কিছুক্ষণ এলিয়ে বসে থাকার পর রিসিভার তুলে নিয়ে ডাক দিল ইউথ্যানাসিয়া কোম্পানিকে–এত জরুরি তলব কখনও আসেনি এই কোম্পানিতে।…

দিনকয়েক পরে দেখা গেল, তার ফ্ল্যাটে, তার চেয়ারে পাশাপাশি বসে এলিজাবেথিটা আর ডেনটন–দৃষ্টি প্রসারিত সুদূরের আকাশপানে।…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *