১৩. সাদা স্ফিংক্সে-এর ফাঁদ

১৩। সাদা স্ফিংক্সে-এর ফাঁদ

সকাল আটটা-নটা নাগাদ হলদে ধাতুর আসনের কাছে পৌঁছালাম আমি। চারদিক রোদ্দুরে ভরে উঠেছিল। গভীর প্রশান্তিতে ছেয়ে ছিল দিগদিগন্ত। সে প্রশান্তি আমার মনের জ্বালাযন্ত্রণাও স্নিগ্ধ হাতে জুড়িয়ে দিলে। গত রাতের দুঃস্বপ্নের মতো বিভীষিকা মিলিয়ে গেল মন থেকে, নিদারুণ শ্রান্তিতে সেই কবোষ্ণ সকালে ঘুমিয়ে পড়লাম আমি ঘাসজমির ওপর।

ঘুম যখন ভাঙল, সূর্য ডুবতে তখন আর বেশি দেরি নেই। আড়মোড়া ভেঙে তাড়াতাড়ি নেমে এলাম নিচে সাদা স্ফিংক্স-এর দিকে। এক হাতে পকেটে দেশলাই কাঠি নাড়াচাড়া করতে করতে অপর হাতে লোহার ডান্ডা বাগিয়ে ধরে নির্ভয়ে এগিয়ে গেলাম বেদির সামনে।

আর তারপরেই যা দেখলাম, তা আশা করিনি মোটেই। স্ফিংক্স-এর বেদির সামনে গিয়ে দেখি ব্রোঞ্জের দরজা খোলা, মজবুত পাতগুলো সরে গেছে পাশের খাঁজে।

দেখেই থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম–ঢোকা কি উচিত হবে?

ছোট্ট একটা কামরা দেখলাম ভেতরে, এক কোণে উঁচু জায়গার ওপর রয়েছে টাইম মেশিনটা। ছোট লিভারটা পকেটেই ছিল। ভাবলাম সাদা স্ফিংক্স আক্রমণের এত তোড়জোড় তাহলে সবই বৃথা, শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করল ওরা! লোহার ডান্ডা ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। কাজে লাগল না বলে দুঃখ যে হল না তা নয়।

ভেতরে ঢোকার মুখে আবার থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। কোনও বদ মতলব নেই তো হতভাগাদের? কিন্তু পরক্ষণেই দমকা হাসি চেপে ব্রোঞ্জ ফ্রেম পেরিয়ে সিধে এগিয়ে গেলাম টাইম মেশিনের কাছে। অবাক হয়ে দেখলাম, তেল-টেল দিয়ে বেশ পরিষ্কার করে রাখা হয়েছে মেশিনটা। ওরা হয়তো যন্ত্রটার রহস্য বোঝার জন্যে কতকগুলো অংশ খুলেও ফেলেছিল, না পেরে আগের মতোই ভ্রু এঁটে রেখে দিয়েছিল এক কোণে।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেশ খুশি-খুশি মনে মেশিনটার গায়ে হাত বোলাচ্ছি এমন সময়ে যে ভয় করেছিলাম তা-ই হল। হঠাৎ ব্রোঞ্জের পাত দুটো সড়ত করে বেরিয়ে এসে ঘটাং করে বন্ধ করে দিলে বেদির প্রবেশপথ। নিকষকালো অন্ধকারে কিছুই আর দেখতে পেলাম না, ফাঁদে পড়লাম আমি। মর্লকদের তাহলে এই মতলবই ছিল। আমার কিন্তু বেজায় হাসি পেয়ে গেল ওই অন্ধকারেও।

ইতিমধ্যে গুনগুন ধ্বনির মতো হাসির শব্দ এগিয়ে আসছিল আমার দিকে। খুব শান্তভাবে দেশলাইয়ের একটা কাঠি ঘষলাম মেশিনের গায়ে। লিভারটা যথাস্থানে বসানোর সময়টুকু শুধু আমার দরকার, তারপরেই ভূতের মতো যাব মিলিয়ে। কিন্তু একটি ছোট্ট জিনিস আমি একেবারেই ভেবে দেখিনি। যে দেশলাইয়ের কাঠি বারবার বারুদে না ঘষলে জ্বলে না, এ হল সেই জাতীয় কাঠি।

বুঝতেই পারছেন, কীভাবে মুখের হাসি মিলাল আমার। ততক্ষণে আমার ওপর এসে পড়েছে পুঁচকে জানোয়ারগুলো। একজন আমাকে ছুঁতেই হাতের লিভার দিয়ে এক ঘা বসিয়ে দিয়ে কোনওমতে উঠে বসলাম মেশিনের আসনে। আর-একটা হাত এসে পড়ল আমার ওপর, তারপরেই আবার একটা। কিলবিলে সাপের মতো হাতগুলো চেপে বসতে না বসতেই সরু সরু আঙুল দিয়ে লিভারটা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল ওরা– আর সমানে ঘুসি-লাথি চালিয়ে কোনওরকমে ওদের ঠেকিয়ে রেখে মেশিনের গায়ে লিভারের খাঁজটা হাত বুলিয়ে বুলিয়ে খুঁজতে লাগলাম। একজন তো আচমকা হাত থেকে কেড়েই নিল লিভারটা, তৎক্ষণাৎ মাথা দিয়ে এক দারুণ ঢু মেরে উদ্ধার করলাম সেটা। বেশ কিছুক্ষণ ঝটাপটি করার পর শেষে লিভারটা আটকে গেল খাঁজে, ঠেলেও দিলাম সামনের দিকে। স্যাঁতসেঁতে হাতগুলো পিছলে গেল আমার দেহ থেকে। নিকষ অন্ধকার গেল মিলিয়ে। আগে যেরকম বলেছি, ঠিক সেইরকম ধূসর আলো আর মৃদু গুনগুনানির মধ্যে এসে পড়লাম আবার।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *