০৭. শঙ্কা

৭। শঙ্কা

 মানুষের এই চরম বিজয়গৌরবের কথা ভাবছি, এমন সময়ে উত্তর-পূর্বের আকাশ রুপোর ধারায় ধুইয়ে দিয়ে উঠে এল দ্বাদশীর হলদেটে চাঁদ। নিচে খুদে মানুষের চলাফেরা আর দেখতে পেলাম না। মাথার ওপর দিয়ে নিঃশব্দে উড়ে গেল পেঁচাজাতীয় একটা নিশাচর পাখি। বেশ কনকনে ঠান্ডা অনুভব করলাম। এবার কোথাও ঘুমের আয়োজন করা দরকার। যে বাড়িটা আমি চিনি, সেটার খোঁজে তাকালাম নিচের দিকে। তখনই চাঁদের আলোয় ব্রোঞ্জের বেদির ওপর বসা সাদা স্ফিংক্স মূর্তিটা চোখে পড়ল। সিলভার বাৰ্চটাও নজর এড়াল না। ফ্যাকাশে আলোয় ছায়াকালো রডোডেনড্রনকুঞ্জও দেখতে পেলাম। আর দেখলাম ছোট লনটা। কিন্তু এইটাই কি সেই লন? না, কখনওই নয়।

কিন্তু সত্যিই এইটাই সেই লন। কেননা, স্ফিংক্স-এর কুষ্ঠরোগীর মতো সাদা মুখটা সেইদিকেই ফেরানো। আর সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ যখন আমার রইল না, তখন আমার যে কী মনের অবস্থা হল, তা আপনারা কল্পনা করতে পারবেন না। কেননা, লনের মধ্যে টাইম মেশিনের কোনও চিহ্নই দেখতে পেলাম না আমি!

যেন চাবুকের ঘায়ে ছিটকে দাঁড়িয়ে উঠলাম। টাইম মেশিন নেই, তার মানে ঊনবিংশ শতাব্দীতে ফিরে যাওয়ার পথ হল বন্ধ। পরের মুহূর্তে ভয়ে বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে পাগলের মতো ছুটে চললাম নিচের দিকে। একবার দারুণ আছাড় খেয়ে গভীরভাবে কেটে গেল মাথার কাছে, কিন্তু ভ্রূক্ষেপ না করে উঠে দাঁড়িয়েই আবার ছুটলাম ঊর্ধ্বশ্বাসে। গাল আর চিবুকের ওপর দিয়ে রক্তের উষ্ণধারা গড়িয়ে পড়তে লাগল, কিন্তু আমার খেয়াল নেই। প্রতিমুহূর্তে মনকে আশ্বাস দিলাম, ওরা হয়তো মেশিনটাকে চোখের সামনে থেকে ঝোপঝাড়ে সরিয়ে রেখেছে। কিন্তু তবুও ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এল আমার। ঝড়ের বেগে ছুটতে ছুটতে এই বয়সেও দুমাইল পথ দশ মিনিটের মধ্যে পেরিয়ে এসে পৌঁছালাম লনে। বারকয়েক সজোরে চিৎকার করে ডাকলাম ওদের, কিন্তু কারও সাড়াশব্দ পেলাম না।

লনের আশপাশে টাইম মেশিনের কোনও চিহ্ন দেখতে পেলাম না। এদিকে-সেদিকে পাগলের মতো ছুটতে লাগলাম কিন্তু বৃথা। জাদুমন্ত্রবলে অত বড় মেশিনটা যেন একেবারে উবে গেছে। এই সময়ে হঠাৎ ওপরে চোখ পড়তে দাঁড়িয়ে গেলাম আমি। আমার সামনেই ব্রোঞ্জ বেদির ওপর মাথা তুলে বসে ছিল স্ফিংক্স–চাঁদের ধবধবে আলোয় চিকমিক করছিল তার সাদা ফ্যাকাশে মুখ। মনে হল, আমার দুরবস্থা দেখে যেন শ্লেষ বঙ্কিম হাসি ফুঠেছে তার ঠোঁটের কোণে।

খুদে মানুষরা মেশিনটা লুকিয়ে রেখেছে কোথাও, এই বলে হয়তো মনকে সান্ত্বনা দিতে পারতাম। কিন্তু তা-ও তো সম্ভব নয়। আমি তো দেখেছি তাদের দৈহিক আর মানসিক শক্তির স্বল্পতা। আর সেই কারণেই আমি আরও ভয় পেলাম। বুঝলাম, মেশিনটাকে সরিয়েছে এমন এক শক্তি, যার সন্দেহ একেবারেই আসেনি আমার মাথায়। অবশ্য একদিক দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম। মেশিনটা যে-ই চুরি করুক-না কেন, চালাবার কোনও উপায় তার নেই। কেননা, স্টার্ট দেওয়ার লিভারটা আগে থেকেই রেখে দিয়েছিলাম আমার পকেটে।

কীরকম যেন উন্মাদ হয়ে গেলাম আমি। মনে আছে, স্ফিংক্স-এর আশপাশে চাঁদের ফুটফুটে আলোয় ঝোপের মধ্যে এলোমেলো ছুটোছুটি শুরু করেছিলাম; একবার হরিণজাতীয় একটা সাদা জানোয়ার চমকে গিয়ে ছুট দিলে চোখের আড়ালে। মনে আছে, গভীর রাতে ঝোপেঝাড়ে এলোপাথাড়ি ঘুসি চালিয়ে কেটেকুটে রক্তাক্ত করে ফেলেছিলাম আঙুলের গাঁটগুলো। তারপর রাগে-ভয়ে পাগলের মতো ছুটে গিয়েছিলাম বিরাট পাষাণ প্রাচীরের মধ্যে। অন্ধকার, নিস্তব্ধ জনশূন্য হলঘরটায় ছুটতে গিয়ে একটা ম্যালেকাইট টেবিলে হোঁচট খাওয়ায় ভাঙতে ভাঙতে বেঁচে গিয়েছিল আমার পায়ের হাড়। দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালিয়ে ধূলিধূসর পরদাগুলো পেরিয়ে গিয়েছিলাম ওদিকে।

ওপাশে গিয়ে দেখলাম আর-একটা হলঘর। খুব নরম গদি-মোড়া বিছানায় প্রায় বিশজন খুদে মানুষ শুয়ে ছিল। হঠাৎ মিশমিশে অন্ধকারের মধ্যে থেকে বিড়বিড় করে বকতে বকতে জ্বলন্ত কাঠি হাতে আমাকে বেরিয়ে আসতে দেখে, বিশেষ করে আমার শ্রীহীন উশকোখুশকো চেহারা দেখে নিশ্চয় অবাক হয়ে গিয়েছিল ওরা। তা ছাড়া দেশলাই কী জিনিস তা তো ওরা ভুলেই গেছে। দুহাতে ওদের ঝাঁকানি দিয়ে উঠলাম আমি, আমার টাইম মেশিন কোথায়? কোথায় রেখেছ আমার মেশিন? ওরা আমার এই অদ্ভুত মূর্তি আর আচরণ দেখে যেন বেশ মজা পেল। অনেকে হেসেই উঠল। কেউ কেউ অবশ্য একটু ভয় ভয় চোখে তাকিয়ে রইল। আমার চারপাশে ওদের ওইভাবে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হঠাৎ ভাবলাম, এ কী বোকার মতো কাজ করছি আমি? দিনের আলোতেই তো দেখেছি, ভয় কী জিনিস তা এরা ভুলে গেছে। আমার এই দুরবস্থায় জোর করে ওদের ভয় পাইয়ে দেওয়া তো চরম বোকামো!

ফস করে কাঠিটা নিবিয়ে দিয়ে একজনকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে হাতড়াতে হাতড়াতে আবার বেরিয়ে এলাম চাঁদের আলোয় ধোয়া আকাশের নিচে। শুনতে পেলাম, আতঙ্কে চিৎকার করে ওরা এলোমেলোভাবে ছুটোছুটি করছে। চাঁদ ক্রমশ উঠতে লাগল ওপরে, কিন্তু এরপর কী যে আমি করেছি তা আর সঠিক মনে নেই। উন্মাদের মতো কেঁদে চেঁচিয়ে চাঁদের আলোয় উজ্জ্বল ধ্বংসস্তূপ আর সবুজ প্রকৃতির মাঝে কতক্ষণ দাপাদাপি করে বেড়িয়েছি, তা জানি না। তারপর কখন জানি নিরাশায় আর পরিশ্রমে অবসন্ন হয়ে স্ফিংক্স এর পাশে ঘাসের ওপর শুয়ে পড়েছিলাম, ঘুমের ঘোরে ঢলে পড়ে ভুলে গিয়েছিলাম আমার সব দুঃখ।

ঘুম যখন ভাঙল তখন ভোর হয়েছে। এক জোড়া চড়ই আমার হাতের নাগালের মধ্যেই কিচিরমিচির শব্দে নেচে নেচে খেলা করছে।

ঘুমিয়ে ওঠার ফলে বেশ ঝরঝরে হয়ে উঠেছিল শরীর। মনের সে অবসাদও আর ছিল না। প্রথমেই টাইম মেশিনের চিন্তা মনে এল। উঠে বসে ভাবতে লাগলাম কী করা যায়। ফুটফুটে কয়েকজন খুদে মানুষ ঝরনার মতো মিষ্টি হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠে ছুটোছুটি করছিল। ওদের ডেকে আকারে ইঙ্গিতে অনেকভাবে জিজ্ঞেস করলাম মেশিনটার খবর। কিন্তু হদিশ দেওয়া তো দূরের কথা, কেউ কেউ ফ্যালফ্যাল নিরেট আহাম্মকের মতো তাকিয়ে রইল, আর কেউবা হাসতে হাসতে চলে গেল অন্যদিকে। এক-একবার অদম্য ইচ্ছে হল, দুহাতে চড়চাপড় মেরে শিক্ষা দিয়ে দিই পুঁচকে উজবুকগুলোকে। কিন্তু অনেক কষ্টে সামলে নিলাম নিজেকে।

কী আর করা যায় ভাবতে ভাবতে লনের মাটি পরীক্ষা করতে গিয়েই আনন্দে আমার মন নেচে উঠল। ঘাসজমির ওপর মেশিনটা টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার স্পষ্ট চিহ্ন দেখলাম। আর দেখলাম, ছোট ছোট একরকম পদচিহ্ন, অনেকটা স্লথের পায়ের দাগের মতো। দাগগুলো শেষ হয়েছে ব্রোঞ্জের বেদীর সামনে। খুঁটিয়ে দেখতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, বেদীটা নিরেট নয় মোটেই, অনেকগুলো পর, ব্রোঞ্জের পাত জুড়ে তা তৈরি। জোড়ের মুখে বিচিত্র কারুকাজ করা। পাতগুলোর ওপরে অবশ্য কোনও চাবীর গর্ত বা হ্যাণ্ডেল দেখতে পেলাম না, কিন্তু তবুও মনে হল ওগুলো নিশ্চয় খোলা যায় ভেতর থেকে। আমার টাইম মেশিন যে ওই বেদীর মধ্যেই সেঁধিয়েছে, সে বিষয়ে আর কোনও সন্দেহ রইল না আমার। কিন্তু কী করে যে ওখানে গেল, সে সমস্যার সমাধান করতে পারলাম না।

কমলা রঙের পোশাক-পরা জনাদুয়েক মানুষ ঝোপের মাঝদিয়ে এগিয়ে আসছিল, হাসিমুখে তাদের ডাকলাম আমি। ওরা আসতে ব্রোঞ্জের বেদীটা ইঙ্গিতে খুলে ফেলতে অনুরোধ করলাম। খুব সাধারণ অনুরোধ, ওরা তা বুঝতেও পারল। কিন্তু তারপরেই তাদের অদ্ভুত আচরণ দেখে বাস্তবিকই হতভম্ব হয়ে গেলাম। যেন নিদারুণ অপমানিত হয়েছে, এমনি ভাব চোখেমুখে ফুটিয়ে তুলে সরে গেল ওরা। কিছুই বুঝলাম না। যাই হোক, আর একজন ফুটফুটে মানুষকে পাকড়ালাম। কিন্তু তার মুখেও সেই ভাবতরঙ্গ দেখে নিজেরই যেন লজ্জা হল। কিন্তু সে পেছন ফিরতেই আমার মেজাজ গেল বিগড়ে। যেন তেন-প্রকারেণ ও মেশিন আমার চাই-ই। তিন লাফে গিয়ে খুদে মানুষটার জামা ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে এলাম বেদীর কাছে। কিন্তু চোখেমুখে তার অপরিসীম আতঙ্কের ছবি দেখে মনটা আবার নরম হয়ে পড়ল–ছেড়ে দিলাম তাকে।

কিন্তু এত সহজে দমে যাবার পাত্র আমি নই। দমাদম শব্দে ব্রোঞ্জের পাতের ওপর ঘুষি মারতে শুরু করলাম। মনে হল, একটা কিছু নড়াচড়ার শব্দ শুনলাম ভেতরে। কে যেন খুক। খুক করে হেসে উঠল। আমার ভুলও হতে পারে। নদীর ধার থেকে বড়সড় আকারের একটা পাথর তুলে এনে সমস্ত শক্তি দিয়ে মারতে লাগলাম সামনের পাতটার ওপর, কিছু কিছু অলংকরণ নষ্ট হয়ে পাতটা খানিকটা তুবড়ে গেল, কিছু ব্রোঞ্জের গুড়োও ঝরে পড়ল। কিন্তু তবুও অটল অনড় রইল সে দুর্ভেদ্য বেদী। দমদম শব্দ শুনে ফুটফুটে মানুষগুলো দূরে দূরে ভীড় করে দাঁড়িয়েছিল, চোখে তাদের অদ্ভুত দৃষ্টি। শেষকালে ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে বসে পড়লাম আমি।

কিন্তু একনাগাড়ে কাঁহাতক আর বেদীটাকে চোখে চোখে রাখা যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজে ডুবে থাকা খুবই সহজ আমার পক্ষে। কিন্তু নির্মা হয়ে বসে থাকার মতো কষ্টকর আর কিছু নেই। তাই এক সময়ে উঠে পড়ে এলোমেলোভাবে হাঁটতে শুরু করলাম। মনে মনে বললাম, ধৈর্য ধর। মেশিন যে-ই নিক না কেন, বেদীর ওপর দারুণ শব্দ শুনেই সে বুঝেছে, মেশিন নেওয়ায় তুমি খুশী হওনি। কাজেই হয়তো একদিন আপনি ফেরত দিয়ে যাবে। ইতিমধ্যে জড়ভরৎ হয়ে বসে না থেকে দেখে নাও, প্রবীণ জগতের সবকিছু দুচোখ ভরে দেখে নাও।

তাই দেখতে বেরোলাম আমি। বিজ্ঞানী সুলভ দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে সবকিছুই তন্ন তন্ন করে দেখলাম আর বিচার করলাম। তারপর একসময়ে ঢুকলাম বড় প্রাসাদটায়। লক্ষ্য করলাম খুদে মানুষগুলো যেন আমাকে এড়িয়ে থাকতে চায়। বোধ হয় ব্রোঞ্জের বেদী তুবড়ে দেওয়ার প্রতিক্রিয়া দেখে আমিও বিশেষ মেলামেশা করার চেষ্টা করলাম না। দিন দুয়েকের মধ্যে অবশ্য সবকিছু আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। আমিও ভাষা শেখার চেষ্টায় খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ভাষা শেখার পেছনে আমার একটা বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। তা হল ব্রোঞ্জের বেদীর মধ্যে টাইম মেশিন সেঁধেনোর ব্যাপারটা তাদের মগজে, তাদেরই ভাষার সাহায্যে ঢোকানোর চেষ্টা। মেশিন উদ্ধার আমাকে করতেই হবে। সেজন্যে কোনও কিছুই করতে কসুর করলাম না আমি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *