০৬. অস্তগামী মানবজাতি

৬। অস্তগামী মানবজাতি

 অল্পক্ষণের মধ্যেই খুদে মানুষদের মধ্যেই একটা জিনিসের বিশেষ অভাব দেখলাম, তা হল আগ্রহ। ছেলেমানুষের মতো হুল্লোড় করে অবাক হয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে ওরা আমাকে ঘিরে ধরত, কিন্তু ক্ষণ পরেই আমাকে ছেড়ে ছুটত নতুন কোনও খেলার সন্ধানে। ডিনার খাওয়ার সময়ে যারা আমাকে ঘিরে বসেছিল, খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই দেখলাম তাদের অনেকেই আর নেই। এরপরেও যখনই বাইরে বেরতাম, কতশত পুঁচকে মানুষ ছুটে এসে ঘিরে ধরত আমাকে, কিন্তু আগ্রহ ফুরাতে বেশিক্ষণ লাগত না। যেন তাদেরই একজন আমি, এমনিভাবে কিছুক্ষণ হাসাহাসি হুটোপাটি করে চলে যেত অন্যদিকে।

বিরাট হলঘর ছেড়ে যখন বাইরে বেরলাম, সূর্য তখন ডুবুডুবু। লাল আভায় রাঙিয়ে উঠেছে চারদিক। ছেড়ে-আসা বিরাট বাড়িটা দেখলাম মস্ত চওড়া একটা নদীর উপত্যকার ওপর। আমাদের টেমস নদী বর্তমান স্থান ছেড়ে মাইলখানেক দূরে সরে গেছে। ঠিক। করলাম, মাইল দেড়েক দূরের পাহাড়টার চুড়োয় উঠে আট লক্ষ দুহাজার সাতশো এক সালের পৃথিবীকে আশ মিটিয়ে দেখতে হবে। সালটা অবশ্য আমার মেশিনের ছোট ডায়াল থেকে পেয়েছিলাম। পাহাড়ের ওপর একটু উঠতেই দেখলাম গ্রানাইটের বিরাট একটা স্তূপ। রাশি রাশি অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে পরস্পর জোড়া পাথরের তৈরি ভাঙাচোরা উঁচু উঁচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা বিপুল একটা গোলকধাঁধা। এখানে-সেখানে রাশি রাশি প্যাগোডার মতো ছড়ানো ভারী সুন্দর গাছ, বোধহয় বিছুটি হবে। পাতাগুলোয় কিন্তু আশ্চর্য সুন্দর বাদামি ছোপ, তা ছাড়া বিছুটির সে তীব্র জ্বলুনিও নেই তাতে৷ দেখেই বুঝলাম বিরাট কোনও স্থাপত্যের ধ্বংসস্তূপ সেটা। এরকম ধ্বংসস্তূপ এখানে-সেখানে অনেক দেখলাম। কিন্তু এই বিশেষ স্তূপটাতেই আমি এক অতি বিচিত্র অভিজ্ঞতার, বিচিত্রতর আবিষ্কারের সম্মুখীন হয়েছিলাম কিন্তু সে কথা পরে আসছে।

উঁচু থেকে আরও একটা জিনিস লক্ষ করলাম। ছোট আকারের বাড়ি দেখতে পেলাম না কোথাও। স্বতন্ত্র গৃহস্থালিও উবে গেছে একেবারে। সবুজ প্রকৃতির মাঝে এখানে-সেখানে শুধু বিপুল আকারের মর্মর-প্রাসাদ। ইংলিশ কটেজের চিহ্ন নেই কোথাও।

কমিউনিজম, আপন মনেই বলি আমি।

আমার পেছনে তখনও জনা ছয়েক পুঁচকে মানুষ আসছিল। তাদের পানে চোখ পড়তে আচমকা আর-একটা বৈশিষ্ট্য লক্ষ করলাম। ওদের প্রত্যেকেরই একই পোশাক, একই রকম কেশহীন নরম মুখ আর মেয়েদের মতো সুডৌল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। এতক্ষণ এই আশ্চর্য বৈশিষ্ট্যটুকু চোখেই পড়েনি আমার। কিন্তু একটু ভাবতেই বুঝলাম আসল কারণটা। এ যুগের মানুষদের নারী-পুরুষের আকৃতি একই। শুধু পোশাকের বুনন আর অন্যান্য কয়েকটি তফাত দেখে বুঝে নিতে হয় নারী-পুরুষের প্রভেদ। খুদে মানুষদের ছেলেমেয়েরা কিন্তু বাপ-মায়েদের ছোট সংস্করণ। একটা জিনিস দেখেছি, এরপরেও ও যুগের খোকাখুকুরা শুধু দেহে নয়, মনের দিক দিয়েও অনেক অকালপক্ক।

নারী-পুরুষের এই অভিন্নতা দেখে খুব বেশি অবাক হলাম না। বরং ভাবলাম, এই তো স্বাভাবিক। যে যুগে দৈহিক বলের প্রাধান্য বেশি, সেই যুগেই তো পুরুষের শক্তি, নারীর ল্যবণ্য আর রকমারি পেশার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কিন্তু যে যুগে নিটোল নিরাপত্তা মানুষের জীবন ছেয়ে আছে সেখানে, এ ভেদাভেদ লোপ পাওয়াটাই তো স্বাভাবিক।

পাহাড়ের ওপরের দিকে কিন্তু বড় বাড়ি আর একটাও দেখতে পেলাম না। তবে অত উন্নত যুগেও গুমটিঘরের মতো ছাউনির নিচে একটা কুয়ো দেখে একটু অবাক হলাম। যা ই হোক, আমার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পেরে খুদে মানুষরা অনেক আগেই আমার সঙ্গ ত্যাগ করেছিল। এখন পাহাড়ের চুড়োয় এসে পৌঁছালাম আমি। নাম-না-জানা একরকম হলদে ধাতুর তৈরি একটা আসন দেখলাম সেখানে, লালচে রঙের মরচে আর নরম শেওলায় ছেয়ে গিয়েছিল ওপরটা। হাত দুটো গ্রিফিনের ছাঁচে ঢালাই করা। এই আসনে বসে সূর্যের পড়ন্ত আলোয় দেখলাম প্রাচীন পৃথিবীর বিচিত্র রূপ। সূর্য তখন দিক্‌রেখার নিচে নেমে গেছে, সিঁদুরে আভার সঙ্গে সোনালি ঝিকিমিকিতে রঙিন হয়ে উঠেছে পশ্চিমের আকাশ। বহু নিচে পালিশ-করা ইস্পাতের তরোয়ালের মতো রয়েছে টেমস নদী। সবুজ ভূমির মাঝে এখানে-সেখানে ছড়িয়ে রয়েছে বিপুলাকার প্রাসাদ আর প্রাসাদকিছু কিছু ভেঙেচুরে গিয়ে মাটি আশ্রয় করেছে। ধরণির অবারণ বাড়ন্তে ভরা বাগিচার মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে সাদা বা রুপোলি মূর্তি, কোথাও বা গম্বুজ আর চার কোণে থামের ছুঁচোলো শীর্ষবিন্দু৷ বেড়া দিয়ে ঘেরা কোনও স্থান নেই, মালিকানাস্বত্বের কোনও চিহ্ন নেই, কৃষিকাজের কোনও প্রমাণ নেই। সমস্ত ধরণি জুড়ে শুধু একটি বাগান, আর কিছুই নেই।

সেই অপরূপ সন্ধ্যায় এই দৃশ্য দেখে আমার বিজ্ঞানী বিচারবুদ্ধি-বিবেচনা যে সিদ্ধান্তে এল, তা সংক্ষেপে এই–

ক্ষীয়মাণ মানবজাতির মাঝে এসে দাঁড়িয়েছি আমি। চাহিদা থেকে সৃষ্টি শক্তির সুনিরাপত্তা জন্ম দেয় দুর্বলতার। যে সামাজিক ব্যবস্থাকে সুষ্ঠু করার প্রচেষ্টায় আমরা সর্বশক্তি নিয়োগ করছি, তার কুফল সেদিন উপলব্ধি করলাম। অযুত বছরের চেষ্টায় মানুষ জয় করেছে দুর্জয় প্রকৃতিকে, সমাজের শত সমস্যাকে। আর তাই অখণ্ড নিরাপত্তার মাঝে থেকে ধীরে ধীরে অনন্ত সুপ্তির কোলে ঢলে পড়েছে তাদের শক্তি, মেধা, উদ্যম।

চাষবাস, বাগান তৈরি আর পশুপালন তারা সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে। মানবজাতির প্রয়োজনে যেটুকু শুধু প্রয়োজন, তা ছাড়া বাদবাকি অদৃশ্য হয়ে গেছে ধরণির বুক থেকে। বাতাস দেখলাম মশকশূন্য, ছত্রাক বা আগাছার চিহ্ন কোথাও দেখলাম না। যেদিকে তাকাই শুধু সুন্দর ফুল, মিষ্টি আর ঝলমলে প্রজাপতি। ব্যাধি লোপ পেয়েছে চিরতরে। যে কদিন ছিলাম সেখানে, কোনও সংক্রামক রোগের সন্ধান পাইনি আমি। পচন আর ক্ষয় আর উদ্ৰব্যস্ত করে না মানুষকে।

সামাজিক ব্যবস্থার চরম উৎকর্ষ দেখলাম। জমকালো বাড়িতে ঝলমলে পোশাক-পরা ফটফটে নির্ঝঞ্ঝাট জীবনযাপন করছে, দৈনিক পরিশ্রমের কোনও বালাই নেই। সামাজিক বা অর্থনৈতিক কোনও সংগ্রামের চিহ্ন দেখলাম না। ব্যাবসা, বাণিজ্য, দোকানপাট, বিজ্ঞাপন ইত্যাদি কিছুই আর নেই। সে এক সামাজিক স্বর্গ।

প্রকৃতি বিজয় যে সম্পূর্ণ হয়েছে, আমার সে বিশ্বাস মানুষদের দৈহিক খবৰ্তা, তাদের ধীশক্তির অভাব আর বড় বড় প্রচুর ধ্বংসস্তূপ দেখে বদ্ধমূল হল। সংগ্রামের পরেই আসে প্রশান্তি। শক্তি, উদ্যম, মেধায় বলীয়ান হয়ে উঠেছিল মানবকুল, তাই তাদের অফুরন্ত প্রাণশক্তি নিয়োগ করলে জীবনধারণকে সহজ করে তোলার প্রচেষ্টায়। সফল হল তারা, কিন্তু তারপরেই শুরু হল তার প্রতিক্রিয়া।

অনাবিল স্বাচ্ছন্দ্য আর নিশ্চিন্ত নিরাপত্তা মানেই মানুষের চিরন্তন অশান্ত উদ্যমের পরিসমাপ্তি; অর্থাৎ যা আমাদের কাছে শক্তি, তা-ই এসে দাঁড়ায় দুর্বলতায়। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে যুদ্ধবিগ্রহের ভয়াবহতা এদের স্পর্শ করেনি। বুনো জন্তু বা রোগের প্রকোপ যে মানুষের মহাশত্রু, তা-ও তারা জানেনি। দৈহিক পরিশ্রমের কোনও প্রয়োজন হয়নি। যে বিশাল প্রাসাদগুলো দেখলাম, সেগুলো পূর্ববর্তী সংগ্রামশীল মানবজাতি গঠন করে সূচনা করে গেছে অসীম শান্তিভরা শেষ পরিচ্ছেদের। তাই নিরাপত্তার সোনার খাঁচায় মৃত্যু হল উদ্যম শক্তির। এল সূক্ষ্ম শিল্পচর্চা।

কিন্তু তা-ও লোপ পাবে ধীরে ধীরে। খুদে মানুষদের মাঝে সেই চিহ্নই দেখলাম আমি। সূর্যের আলোয় নাচ, গান আর ফুলপ্রীতি ছাড়া নতুন কোনও শিল্পবোধই নেই তাদের মধ্যে। এ-ও একদিন ক্ষীণ হয়ে হারিয়ে যাবে পরিতৃপ্ত নিষ্ক্রিয়তার মাঝে। বেদনা আর চাহিদার জাঁতাকল-নিষ্পেষ থেকেই শিল্পচেতনার প্রকাশ। কাজেই যেখানে নেই ক্লেশ, অভাব, দুঃখ–সেখানে শিল্পের মৃত্যু তো স্বাভাবিক!

জনসংখ্যা বৃদ্ধিও রুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু বিপরীত প্রতিক্রিয়া-সূত্র অনুসারে সংখ্যা আরও কমে আসছে। এত ধ্বংসস্তূপই তার প্রমাণ।

ঘনিয়ে-আসা আঁধারের মাঝে বসে জগতের এই আপাত অবিশ্বাস্য শেষ পরিণতির কথাই চিন্তা করলাম সেদিন।…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *