৩. ক্ষমতা এবং গৌরব

তৃতীয় খণ্ড – ক্ষমতা এবং গৌরব

১৩. বিজয়ের শহর

ভবিষ্যৎ বংশধরদের কাছে বাংলা এবং গুজরাটের মহান বিজয়কে স্মরণীয় করে রাখার জন্য আমি এই শহরের নতুন নাম দিচ্ছি “ফতেহপুর শিক্রি”, “শিক্রি, বিজয়ের শহর”। আগামী সময়ে যারা ফতেপুর শিক্রির এই উঁচু লাল বালুপাথরের প্রাচীর প্রত্যক্ষ করবে তারা সেইসব বীর মোগল যোদ্ধাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে যারা এই বিজয়ে অবদান রেখেছে। আজ যারা এখানে উপস্থিত রয়েছেন তারা সকলে ঐ সব কীর্তির অংশীদার। আপনাদের পুত্র, দৌহিত্র এবং যে প্রজন্ম এখনো জন্মগ্রহণ করেনি তারা সকলে এই সত্য জেনে গর্ববোধ করবে যে আপনাদের বীরত্বপূর্ণ রক্ত তাঁদের শিরায়ও প্রবাহিত হচ্ছে। মার্বেল পাথরে তৈরি অনুপ তালাও বা অতুলনীয় জলকুণ্ড নামক শাপলা ফোঁটা জলাশয়ের পিছনে অবস্থিত বিশাল রাজপ্রাসাদের বারান্দায় বসে আকবর বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। তার পরনে হিরা এবং চুনি খচিত মাখন রঙের রেশমের জোব্বা। নিচের বিশাল উঠানে সবুজ রেশমের শামিয়ানার নিচে তার সেনাপতি এবং সেনাকর্তাগণ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে তার বক্তব্য শুনছেন। সামনের সারিতে নকশা খোদাই করা একটি কাঠের লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন যুদ্ধাহত মোহাম্মদ বেগ। লাঠিটি আকবর তাকে উপহার দিয়েছেন। হেকিমের অক্লান্ত চিকিৎসায় বর্ষিয়ান যোদ্ধাটি দ্রুত সুস্থ্য হয়ে উঠছেন। কিন্তু তার আঘাত গুলি এতো মানাত্মক। যে ভবিষ্যতে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন আহমেদ খান। তার দীর্ঘ দাড়িগুচ্ছ এই প্রথম বারের মতো যত্ন সহকারে আচড়ানো দেখা যাচ্ছে। তার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন আকবরের স্ত্রীর বড়ভাই রাজা ভগবান দাশ এবং সেনাপতি রাজা রবি সিং। আকবরের উচ্চপদস্থ সেনাপতিদের পিছনে পদাধিকার অনুসারে অন্যান্য সেনাকর্তাগণ দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাদের মধ্যে আকবরের তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে চওড়া বক্ষ বিশিষ্ট বিশালদেহী অলীগুল নজরে পড়লো। সে তার তাজিক সঙ্গীদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে এবং তার চিরাচরিত সুতির পোষাকের পরিবর্তে সোনারূপার কারুকাজ খচিত বেগুনী ও সোনালী রঙের জোব্বা পড়েছে। তার পেছনে রয়েছে বারাকসানি সেনাকর্তাগণ।

 আকবরের বক্তব্যের সমর্থনে উপস্থিত সকলে একত্রে প্রশংসাসূচক ধ্বনি তুললো। তাদের চেহারায় যেনো আকবরের নিজের গৌরবই প্রতিফলিত হলো। সাফল্যের স্বাদ অত্যন্ত মিষ্টি। তিন দিন আগে একটি জাঁকজমকপূর্ণ বিশাল শোভাযাত্রার নেতৃত্ব দান করে আকবর শিক্রিতে আগমন করেন। মিছিলের সম্মুখে ছিলো মণিমাণিক্যখচিত লাগাম এবং হীরা খচিত মস্তক আবরণ বিশিষ্ট কালো ঘোড়ার পিঠে সওয়ার ঢোল এবং শিঙ্গা বাদক। তাঁদের সঙ্গে ছিলো একদল অভিজাত অশ্বারোহী। তাদের পেছনে ছিলো আকবরের সবচেয়ে উঁচু এবং সম্ভ্রান্ত যুদ্ধ হাতির দল। একদম সম্মুখের হাতিটির পিঠের মণিমাণিক্যের আবরণযুক্ত হাওদায় আকবর স্বয়ং বসে ছিলেন। পূর্বেই অনুচরেরা তার চলার পথে গোলাপ এবং জেসমিন ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে অগ্রসর হয়েছে। সকল অস্ত্রের ফলা শান দিয়ে ঝকঝকে করা হয়েছে, সকল ব্রোঞ্জ কামান পালিশ করা হয়েছে। আকবরের নির্দেশে তাঁর এক হাজার যুদ্ধহাতির সারা দেহ সোনালী রঙ করা হয়েছে দেখানোর জন্য যে তারা যুদ্ধ থেকে বিজয়ীর বেশে ফিরছে।

 বাংলা জয় করে ফেরার পর থেকেই আকবর তার বক্তৃতা প্রস্তুত করতে সময় ব্যয় করছেন। সেই সব উত্তম বাক্য চয়ন এবং মুখস্ত করেছেন যা তার শাসন আমলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। তিনি ইতোমধ্যে অনেক গৌরব অর্জন করেছেন কিন্তু তাঁর লোকদের বুঝাতে হবে মোগল সাম্রাজ্যের জন্য আরো অধিক মহত্বর গৌরব ভবিষ্যতে অপেক্ষা করছে। তার সিংহাসনের ডান পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তিন পুত্রের দিকে তিনি সহজাত প্রেরণায় এক পলক তাকালেন। যুদ্ধ থেকে ফেরার পর তিনি তাদের সঙ্গে বেশি সময় কাটাতে পারেননি। তবে তিনি উপলব্ধি করছিলেন ভবিষ্যতের কোনো এক সময়ে তারাই সাম্রাজ্যের নিয়তির ধারক বাহক হবে। সাত বছর বয়সী সেলিমকে বেশ উত্তেজিত মনে হচ্ছিলো, সবুজ রেশমের পাগড়ির নিচে অবস্থিত তার নিখুঁত গড়নের মুখটি প্রাণবন্ত দেখাচ্ছিলো। ছয় বছর বয়সী মুরাদকে দেখেও স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিলো সে অনুষ্ঠানটি স্বতস্ফূর্তভাবে উপভোগ করছে। তিনজনের মধ্যে অকবরের অনুপস্থিতির সময় তার মাঝেই সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন এসেছে। সে এখন প্রায় সেলিমের সমান লম্বা। তার বাম চোয়াল এবং গালে কালশিরে পড়েছে। তার শিক্ষক জানিয়েছেন আমগাছে উঠে পাখীর ডিম সন্ধান করতে গিয়ে পড়ে গিয়ে তার এই দশা হয়েছে। ছোট্ট দানিয়াল এখনো নধর রয়েছে, সে চোখ গোল করে অবাক দৃষ্টিতে বিশাল জনসমাবেশ প্রত্যক্ষ করছে।

আকবর হাত তুলে সবাইকে চুপ করতে ইঙ্গিত করলেন এবং উৎফুল্ল সরোগোল শান্ত হয়ে এলো। ইতোমধ্যে আপনাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধার নিদর্শন স্বরূপ প্রদত্ত জাগতিক উপঢৌকন সমূহ আপনারা লাভ করেছেন সম্মানসূচক আলখাল্লা, রত্নখচিত ছোরা এবং তলোয়ার, বাতাসের মতো দ্রুতগামী ঘোড়া, উচ্চতর পদমর্যাদা এবং শাসনের জন্য অধিক সমৃদ্ধ জায়গির। আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁদের দেহের ওজনের সমান স্বর্ণও লাভ করেছেন। আপনারা এইসব উপহার নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করে অর্জন করেছেন এবং আমি কথা দিচ্ছি আগামী বছরগুলিতে আরো বেশি উপহার আপনারা পাবেন।

এমন কে আছে যে আমাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে পারে? মাত্র গতকাল আমি বংলা থেকে একটি বার্তা পেয়েছি। তা থেকে জানা গেছে। শাহ্ দাউদ, যে কিনা বোকার মতো মোগল ক্ষমতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলো, তাকে পাকড়াও করে হত্যা করা হয়েছে। এই মুহূর্তে তার ছিন্ন মস্তক ফতেহপুর শিক্রির পথে রয়েছে এবং তার দেহটি বাংলার প্রধান শহরের বাজারে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। শাহ্ দাউদ তার প্রতারণার জন্য যে পরিমাণ মৃত্যু এবং দুর্ভোগ বয়ে এনেছে তার মূল্য নিজের জীবন দিয়ে পরিশোধ করছে। সে যদি আমার প্রতি বিশ্বস্ত থাকতো তাহলে আমার পক্ষ থেকে তার ভয়ের কিছু ছিলো না। কিন্তু সে অধ্যায় এখন অতীত। এখন আমাদের দায়িত্ব আমাদের সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা। আমরা ইতিহাস থেকে শিখেছি যে নতুন ভূখণ্ড জয় করার তুলনায় একে নিয়ন্ত্রণে রাখা অনেক বেশি কঠিন। আমার পিতামহ বাবরের আগমনের পূর্বে নয়টি রাজবংশ হিন্দুস্তান শাসন করেছে। কিন্তু তাঁদের অধিকাংশই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি। তাদের আলস্য এবং অতিমাত্রায় আত্মগর্বের কারণে ঐ সব শাসকেরা যা কিছু অর্জন করেছিলো তা মুঠির ফাঁক দিয়ে পড়ে যাওয়া বলুর মতো নিঃশেষ হয়ে গেছে। তারা যেসব ভুলের কারণে ধ্বংস হয়েছে সেসব ভুল আমরা করবো না। আপনাদের সহায়তায় আমি মোগল সাম্রাজ্যকে সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে এক বিস্ময়কর সাম্রাজ্যে পরিণত করবো। এই সাম্রাজ্য সমৃদ্ধিশালী হবে কেবল এই জন্য নয় যে আমাদের সেনাবাহিনী সবচেয়ে নির্ভীক ও শক্তিশালী, বরং যারা এর সীমানার মধ্যে বাস করবে তারা এই সাম্রাজ্যের একজন প্রজা হওয়ায় জন্য গর্বও বোধ করবে।

আমি কেবল সেই সব প্রজাদের কথা বলছি না যারা মুসলমান, বরং ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই এই সাম্রাজ্যের সুযোগ সুবিধা সমান ভাবে ভোগ করবে। অনেক হিন্দু শাসক-যেমন রাজা রবি সিং যাকে আমি সামনে দেখতে পাচ্ছি- ইদানিংকার যুদ্ধ গুলিতে আমার সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছেন। তিনি এবং তার অনুসারীরা মোগলদের স্বার্থে রক্ত ঝরিয়েছেন। সেটা এই জন্য যে তারা এবং আমার প্রতি বিশ্বস্ত যে কোনো ধর্মের অনুসারী ব্যক্তি আমার রাজ সভায় এবং সেনাবাহিনীতে আনুকূল্য ও সমৃদ্ধি লাভ করবেন। এবং এটা সকলের অধিকার এবং প্রাপ্য সম্মান যে প্রত্যেকে কোনো প্রকার হয়রানি বা উৎপীড়নের শিকার না হয়ে নিজ নিজ ধর্ম পালন কারার স্বাধীনতা পাবে।

আকবর একটু থামলেন এবং সহজাত প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে দুজন কালো আলখাল্লা পরিহিত মুসলিম যাজকের দিকে তাকালেন। তারা অনুপ তালাও এর একপাশে হাঁটাপথের আচ্ছাদনের নিচে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন মজবুত গড়নের বর্ষিয়ান লোক, তরমুজের মতো গোলাকার ভুড়ির উপর দুহাত জড়ো করে দাঁড়িয়ে আছেন। আকবর তাকে ভালোভাবে চিনেন-শেখ আহমেদ, একজন গোঁড়া সুন্নি এবং ওলামাদের প্রধান, যারা আকবরের উচ্চপদস্থ ধর্মীয় উপদেষ্টা। এই শেখ তাঁদের মধ্যে অন্যতম যারা আকবরের হিন্দু নারী বিয়ে করার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি বিরোধিতা করেছে। দ্বিতীয় যাজকটি হলেন আবুল ফজলের বাবা শেখ মোবারক, যার শীর্ণ বসন্তের দাগ বিশিষ্ট মুখটিকে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছিলো।

দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ কণ্ঠে আকবর আবার বক্তব্য শুরু করলেন। মোগল সাম্রাজ্য কেবল তখনই প্রকৃত সমৃদ্ধি অর্জন করবে যখন এর সকল প্রজার জীবনে সমান উন্নতি ঘটবে। আমি যা বললোম তার প্রত্যক্ষ বাস্তায়নের নমুনা স্বরূপ আমি ঘোষণা করছি যে আজ থেকে অমুসলিমদের উপর আরোপ করা সকল সাম্প্রদায়িক কর রহিত করা হলো। কারণ কোনো ব্যক্তির উপর ইসলাম ধর্ম অনুসরণ না করার জন্য অতিরিক্ত কর আরোপ করা আমার কাছে যুক্তিসঙ্গত মনে হচ্ছে না। তাছাড়া আমি মোগল আমলের পূর্ব থেকে প্রচলিত হিন্দু তীর্থ যাত্রীদের উপর আরোপ করা কর প্রথাও বিলোপ করছি।

 শেখ আহমেদ প্রকাশ্যে মাথা নাড়ছিলো। অনুবিধা নেই মাথা নাড়াক। শীঘ্রই তিনি এমন আরো অনেক কিছু প্রত্যক্ষ করবেন যাতে তার সম্মতি থাকবে না। শিক্রিতে আসার অবকাশযাত্রার সময় যে সব শহর এবং গ্রাম আকবর অতিক্রম করেছেন সেগুলির নেতা বা প্রধানদের ডেকে পাঠিয়ে তিনি আলাপ করেছেন সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানার জন্য। এর আগে তিনি জানতেন না হিন্দু প্রজাদের উপর ধর্মীয় ভিন্নতার কারণে অতিরিক্ত কর আরোপের প্রথা চালু রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে তিনি যতোই চিন্তা করেছেন ততোই উপলব্ধি করেছেন যে এ ধরনের কর শুধু অন্যায়ই নয় বরং এর ফলে সাম্প্রদায়িক বিভেদও সৃষ্টি হচ্ছে। সাম্রাজ্যের ঐক্য নিশ্চিত করার জন্য তিনি একাধিক হিন্দু স্ত্রী গ্রহণ করেছেন এবং তাদের নিজ নিজ ধর্মচর্চার পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করেছেন। নিশ্চিতভাবেই এটা তার একটি বিচক্ষণ এবং ন্যায্য পদক্ষেপ-সকলের মধ্যে সহনশীলতা এবং সমতার বোধ সৃষ্টি করার জন্য।

তিনি হিন্দু ধর্মের প্রতি ক্রমশ অধিক উৎসুক হয়ে উঠছিলেন। অতীতে তিনি যখন এই ধর্মটি নিয়ে ভেবেছেন তখন তাঁর কাছে একে অদ্ভূত, দুর্বোধ্য এমনকি ছেলেমানুষী সুলভ বিশ্বাস বলে মনে হতো যা মূর্তিপূজা এবং কতিপয় কাল্পনিক কাহিনী নিয়ে গঠিত। কিন্তু রবি সিং তাঁকে দুটি চমৎকারভাবে বাধাই করা হিন্দু ধর্মগ্রন্থ উপহার দিয়েছে-একটি উপনিসদ এবং অপরটি রামায়ণ-ফার্সী ভাষায় অনুবাদ করা। শোভাযাত্রা নিয়ে রাজধানীতে আসার পথে প্রতি রাতে তিনি তার পরিচারকদের সেগুলি পড়ে শোনাতে বলেন। আধোঅন্ধকারে সেই সব পুস্তকের সমৃদ্ধ ভাষা এবং ধ্বনিময় বাণী শ্রবণ করতে করতে তার মনে হত-যে মানুষ খাঁটি হৃদয়ের অধিকারী তার ধর্ম বা বর্ণ যাই হোকনা কেনো সে ঈশ্বরকে খুঁজে পেতে পারে এবং অনাবিল শান্তির অধিকারী হতে পারে।

আকবর উপলব্ধি করেছেন বর্তমান সময়ের আগে তিনি ধর্ম নিয়ে তেমন চিন্তা করেন নি, এমনকি তার নিজের ধর্ম ইসলামের বিষয়েও নয়। তিনি তার ধর্মের বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতা অবশ্য পালন করেছেন কারণ সেটা সকলে তার কাছে আশা করে। কিন্তু হিন্দু ধর্মগ্রন্থের জ্ঞানগর্ভ বাণী সমূহ তিনি যতোই শ্রবণ করছিলেন ততোই নিশ্চিত হচ্ছিলেন যে বহু চিরন্তন সত্য রয়েছে, কিছু সাধারণ নীতি রয়েছে যা সকল ধর্মেই অনুসরণ করা হয় এবং এই সব ধারণা খোলা মনের মানুষদের উঘাটনের অপেক্ষায় এখনো গুপ্ত রয়েছে। যেমনটা সুফি সাধক শেখ সেলিম চিশতি তাঁর অমায়িক অতীন্দ্রিয় ইসলামিক ধর্মচিন্তার আলোকে আকবরকে জানিয়েছেন, ঈশ্বর আমাদের সকলের…।

 আকবর উঠে দাঁড়ালেন এবং তার পেছনে দাঁড়ানো চারজন শিঙ্গা বাদক শিঙ্গায় ফুঁ দিয়ে তীব্র আর্তনাদ তুলে জানান দিলো তাঁর বক্তব্য সমাপ্ত হয়েছে। তিনি ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্রুত পায়ে খিলান আকৃতির দরজাপথে নিজের ব্যক্তিগত কক্ষের দিকে অগ্রসর হলেন। তিনি অত্যন্ত ক্লান্ত বোধ করছেন। বাংলার যুদ্ধ শেষে ফেরার পর তাকে এতো বিষয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে যে তিনি ঠিকমতো ঘুমাতেও পারেননি। হামিদা, গুলবদন এবং অবশ্যই হীরাবাঈ ব্যতীত তাঁর অন্যান্য স্ত্রীরা উদগ্রীব হয়ে ছিলেন তাঁর যুদ্ধ অভিযানের কাহিনী শোনার জন্য এবং তাঁর অনুপস্থিতিতে রাজপ্রাসাদে যা কিছু ঘটেছে সেসব বিষয় তাঁকে জানানোর জন্য। কিন্তু পুরো সময়টা তার মন কেন্দ্রীভূত ছিলো তাঁর নতুন রাজধানীর চিন্তায়। তিনি তার নিজ প্রাসাদ পরিদর্শন সমাপ্ত করেছেন কিন্তু অধীর হয়ে ছিলেন শহরের বাকি অংশ পর্যবেক্ষণের জন্য। অবশেষে এখন তিনি সেই ফুসরত পেলেন।

 আধঘন্টা পর তিনি তাঁর প্রধান স্থপতিকে নিয়ে শহর প্রাচীরের পাশে হাঁটছিলেন। তুমি আমাকে প্রদান করা তোমার অঙ্গীকার রক্ষা করেছো তুহিন দাশ। লাল বালুপাথরের নিরাপত্তা পাঁচিল এবং কেল্লা দেখতে দেখতে আকবর মন্তব্য করলেন।

 শ্রমিকরা পালাক্রমে কাজ করেছে জাহাপনা। এমন কোনো দিন, রাত বা ঘন্টা অতিক্রান্ত হয়নি যখন তাঁদের কাজ অব্যাহত ছিলো না।

তারা আধার নামার পর কাজ করেছে কীভাবে?

রাতে অগ্নিকুণ্ড এবং মশাল জ্বালা হয়েছিলো। পাথর সংগ্রহের জায়গায় আকার অনুযায়ী পাথর কাটার যে পরামর্শ আপনি দিয়েছিলেন সেই বুদ্ধিও কাজের গতি দ্রুত করেছে। আসুন জাহাপনা, এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করার পর আমরা সেনাভবন এবং রাজকীয় টাকশাল দেখতে পাবো।

 হিন্দু নকশা শিল্পীরা চমৎকার কাজ দেখিয়েছে। আকবর টাকশালের বালুপাথরের ছাদে নিখুঁতভাবে খোদাই করা তারার আকৃতি এবং ষড়ভুজ গুলি দেখতে দেখতে বললেন। সত্যিই তিনি যে দিকে তাকাচ্ছিলেন সেদিকেই নির্মাণশিল্পীদের কাজের পুঙ্খানুপুঙ্খতা এবং উৎকর্ষ প্রত্যক্ষ করে অবাক না হয়ে পারছিলেন না। স্তম্ভ এবং দেয়ালে খোদাই করা ফুল পাতা এবং বৃক্ষের প্রতিকৃতি একদম প্রাকৃতিক আকার, অবয়ব এবং সতেজতা লাভ করেছে।

 এটি দেখুন জাঁহাপনা। তুহিন দাশ দুধসাদা রঙের মার্বেলে তৈরি জালির (পর্দার মতো আড়াল সৃষ্টি করতে পারে এমন কাঠামো) দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করলেন। কারিগরেরা বালুপাথর খোদাই করায় যতোটা দক্ষ অনুরূপ দক্ষ মার্বেল পাথরের কাজে। তুহিন দাশ ঠিকই বলেছে, আকবর ভাবলেন। জালিটিকে এতো সূক্ষ্ম এবং ভঙ্গুর মনে হলো যেনো সেটা বরফে জমে যাওয়া মাকড়সার জাল।

সদ্য নির্মিত হওয়ায় শহরটিতে কিছুটা অপরিচ্ছন্নতা এবং রুক্ষতা বিরাজ করছিলো এতে কোনো সন্দেহ নেই। সীমানায় রোপণ করা বৃক্ষ এবং ফুলগাছ দৃষ্টিনন্দন কোমল আবহ সৃষ্টি করবে। বাগান গুলিতে রোপণ করা চারাগাছের কি অবস্থা?

 উত্তম জাহাপনা। ঐ দিকে আপনার দেওয়ান-ই-খাশ এর বাইরের বাগানে মালিরা এখনো কাজ করছে।

আকবর তুহিন দাশকে অনুসরণ করে টাকশালের বাইরে এলেন। আবারো তিনি তার প্রধান স্থপতির কাজের সুনিপুণ ধারাবাহিকতা দেখতে পেলেন। একদল নারী পুরুষ লাল মাটির উপর উবু হয়ে বসে সারিবদ্ধভাবে তরুণ পাইন গাছের চারার ফাঁকে ফাঁকে ঘন সবুজ বর্ণের সাইপ্রেস গাছের চারা রোপণ করছে। অন্য আরেকটি জমিতে আম গাছ, মিষ্টি গন্ধযুক্ত চম্পা এবং উজ্জ্বল সিঁদুর বর্ণের মোরগচূড়া ফুলগাছ সুন্দর বেড়ে উঠছে।

দয়া করে দেওয়ান-ই-খাশ এ প্রবেশ করুন জাহাপনা। আমি আশা করছি আপনি সন্তুষ্ট হবেন। অঙ্কনে যেমন ছিলো হুবহু তেমনিভাবে এটি তৈরি করা হয়েছে।

সত্যিই তাই, অভিজাত নকশা এবং গড়নে সুসজ্জিত ভবনে প্রবেশ করে আকবর দেখতে পেলেন। অনেক উঁচু ছাদ বিশিষ্ট একক কক্ষটির মাঝখানে ক্রমশ উপর দিকে প্রসারিত স্তম্ভটি আশ্চর্যজনক সুন্দর খোদাই কর্ম বিশিষ্ট, কাগজে যার অঙ্কন দেখে তিনি ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। এর উপর অবস্থিত বৃত্তাকার মঞ্চের সঙ্গে চারটি ঝুলন্ত সেতু মিলিত হয়েছে। এই মঞ্চের উপর তিনি আসন গ্রহণ করবেন। দেখেছেন জাহাপনা, ওখানে বসার পর মনে হবে আপনি যেনো পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দুতে বসে আছেন…যেনো সর্বোচ্চ মানবীয় ক্ষমতা ঐ স্থানকে ঘিরে উৎসারিত হচ্ছে। এর আকৃতি আমাদের হিন্দু মান্দালার মতো-স্তম্ভটি পৃথিবীর মেরুরেখার প্রতিনিধিত্ব করছে।

 সেই দিন বেলা শেষে নীলা শোভিত রূপার পাত্রে রাখা ঠাণ্ডা পানির ঝাঁপটা দিয়ে মুখ চোখ ধোয়ার সময় আকবর গভীর সন্তুষ্টি অনুভব করলেন। তাঁর যুদ্ধাভিযান সফল হয়েছে এবং তাঁর রাজধানী ততোটাই চমৎকার হয়েছে যা তিনি আশা করেছিলেন। আগামী কিছু ঘন্টার জন্য

যতোক্ষণ পর্যন্ত না ভোরের উজ্জ্বল সূর্য নিচের পাথুরে মরুভূমিতে উত্তাপ বিকিরণ আরম্ভ করে তিনি সাম্রাজ্য, যুদ্ধজয়, প্রজাবৎসল্য ইত্যাদি সবকিছু ভুলে হেরেমে প্রবেশ করতে পারেন। ফতেহপুর শিক্রিতে নির্মিত সকল ভবনের মধ্যে তাঁর মা, ফুফু, স্ত্রী এবং রক্ষিতাদের জন্য নির্মিত পাঁচমহলই তাকে সবচেয়ে বেশি সন্তুষ্ট করেছে।

হেরেমের প্রধান প্রবেশ পথটি ধনুকাকৃতির এবং বালুপাথর দ্বারা নির্মিত। এর পাহারায় নিযুক্ত রয়েছে অভিজাত রাজপুত রক্ষীরা। এর অভ্যন্তরে মহিলাদের পরিচর্যায় নিয়োজিত করা হয়েছে খোঁজাদের- আকবর ব্যতীত এই অণ্ডকোষ কর্তিত পুরুষগুলিই কেবল এখানে প্রবেশ করতে পারে। এদের সহযোগী হিসেবে সেখানে আরো নিয়োজিত রয়েছে তুরস্ক এবং আবিসিনিয়ার কিছু নারী, দৈহিক শক্তির বিবেচনায় তাদের নির্বাচন করা হয়েছে। আকবর হেরেমের নিরাপত্তা এবং স্বচ্ছন্দ ব্যবস্থাপনার বিষয়ে বিস্তারিত নির্দেশাবলী খাজানসারাকে প্রদান করেছেন। হেরেমের যাবতীয় কর্মকাণ্ড এই খাজানসারার তীক্ষ্ম নজরদারী ও তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়।

খাজানসারা আকবরকে জানিয়েছে তিনি যখন অভিযানে ছিলেন তখনো অনেক শাসক তার নেকদৃষ্টি লাভের আশায় মেয়ে পাঠিয়েছে তাঁর রক্ষিতার স্থান পূরণ করার জন্য-বলিষ্ঠ দেহ ও চওড়া চোয়ালের অধিকারী, বাদামি বর্ণের চোখ বিশিষ্ট নারী এসেছে সুদূর তিব্বত থেকে। এছাড়াও রয়েছে অল্প সবুজাভ চোখ বিশিষ্ট আফগানী নারী যদের গায়ের রঙ মধুতুল্য, ইন্দ্রিয়পরিতৃপ্তিকর দীর্ঘাঙ্গী আরব নারী যাদের মোহনীয় চোখ কাজল টানা এবং দেহে প্রলুব্ধকর মেহেদির জটিল নকশা আঁকা….।

হেরেমের সুরক্ষিত দ্বারের আড়ালের জগতে অপেক্ষারত ইন্দ্রিয় সুখের চিন্তায় আকবরের দেহের রক্তপ্রবাহ দ্রুততর হলো। তার এই নতুন হেরেম তাঁর ব্যক্তিগত স্বর্গ-গোলাপ জলের ঝর্না এবং রেশমের পর্দায় সুসজ্জিত বিলাসবহুল অবকাশ কেন্দ্র-যেখানে তিনি একজন সম্রাট হিসেবে তাঁর সকল দুর্ভাবনা ঝেড়ে ফেলে একজন সাধারণ মানুষের নিখাদ আনন্দকে আলিঙ্গন করতে পারেন।

আজ রাতে তিনি কাকে তার সঙ্গিনী করবেন? মশাল জ্বালা ভূগর্ভস্থ সুরঙ্গে প্রবেশ করে আকবর ভাবলেন, এটি তাঁর হেরেমে প্রবেশের ব্যক্তিগত পথ। তাঁর চিন্তা অল্প সময়ের জন্য তাঁর স্ত্রীদের উপর কেন্দ্রীভূত হলো। পারসিক নারীটি নয়, নয় জয়সলমিরের রাজকন্যাও…অন্তত আজ রাতের জন্য। আর হীরাবাঈ এর ব্যাপারে তিনি তাঁর কথা রখেছেন, তিনি সেলিমের জম্মের পর থেকে তাকে আর শয্যাসঙ্গিনী করেন নি। তবে অভিযান থেকে ফিরে তিনি তার সঙ্গে একবার সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন- এমনকি তাকে একটি হীরার বালাও উপহার দিয়েছেন যেটি একসময় শাহ্ দাউদের কোনো এক স্ত্রীর কব্জিতে শোভা পেয়েছে। হীরাবাঈ এর আচরণ ছিলো ঠাণ্ডা, অভিব্যক্তিহীন মুখে সে এই চমৎকার উপহারটি তার এক রাজপুত পরিচারিকার কাছে হস্তান্তর করে। তার এই আচরণ আকবরের কাছে অপরিচিত নয়, তবুও হীরাবাঈ এর অক্ষয় ঘৃণা এখনো তাকে আঘাত করতে সক্ষম বলে তিনি তখন উপলব্ধি করেছিলেন।

আকবর তার মনকে অধিক আনন্দময় চিন্তার দিকে ঘুরিয়ে নিলেন। তিনি খাজানসারাকে বলতে পারেন নবাগত সবচেয়ে আকর্ষণীয় মেয়েগুলিকে তার সম্মুখে হাজির করতে। তারা তাদের গহনা অপসারণ করার পর (গহনার জন্য খেলায় বিঘ্ন ঘটতে পারে তাই) তিনি তাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে পারেন। যে মেয়েটি তাঁকে ফাঁকি দিয়ে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় লুকিয়ে থাকতে পারবে তাকেই তিনি শয্যাসঙ্গিনী করবেন। অথবা হেরেমের উঠানে পাথরনির্মিত কালো ও সাদা বর্গক্ষেত্রাকার বিশাল ছকে তাঁদের ঘুটি হিসেবে সাজিয়ে তিনি জীবন্ত দাবা খেলতে পারেন। স্বচ্ছ পোশাক পরিহিত মেয়ে গুলি যখন অনেক সময় ধরে ছকের উপর চাল অনুযায়ী চলাফেরা করবে তখন তাদের কাউকে পছন্দ করার মতো প্রচুর সময় তিনি পাবেন। তাদের মধ্যে যে কেউ তার দ্বারা নির্বাচিত হওয়ার জন্য নিজেকে ধন্য মনে করবে…

ছয় সপ্তাহ পর আকবর তাঁর মায়ের কক্ষে প্রবেশ করলেন। কক্ষটির বালুপাথরের নকশা বিশিষ্ট দেয়ালের কাছে মুক্তার কাজ করা হালকা গোলাপি বর্ণের রেশমের পর্দা দুলছে। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাইরের উঠানে অবস্থিত নার্গিস গাছের আদলে তৈরি ঝর্না থেকে স্বচ্ছ পানি গড়িয়ে পড়ছে। এই মোহনীয় আবাস কক্ষ নিয়ে মা নিশ্চয়ই সন্তুষ্ট, আকবর ভাবলেন। ইদানিং কদাচিৎ তিনি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ভেবে কিছুটা অপরাধবোধও মনে কাজ করছে।

কি হয়েছে মা? তুমি আমাকে দেখা করতে বলেছো কেনো?

 হামিদা তার পাশে বসা গুলবদনের দিকে এক পলক চাইলেন। আকবর আমরা দুজনে তোমাকে কিছু বলতে চাই। তোমার এই উঁচু দেয়াল বিশিষ্ট বহু সৈন্য পরিবেষ্ঠিত হেরেমের মধ্যে অমাদের নিজেদেরকে বন্দীর মতো মনে হয়।

আকবর অবাক দৃষ্টিতে তাকালেন। এসব তো তোমাদের নিরাপত্তার জন্যই।

 নিশ্চয়ই আমাদের নিরাপত্তার প্রয়োজন রয়েছে কিন্তু আমরা বন্দীর মতো অবরুদ্ধ থাকতে চাই না।

 কিন্তু রাজপরিবারের নারীদের সর্বদাই তো হেরেমের নিভৃতে বসবাসের রেওয়াজ প্রচলিত রয়েছে।

সেটা এমন বাইরের জগত থেকে বিচ্ছিন্নভাবে নয়। তুমি কি আমাদের মর্যাদা ভুলে গেছো? আমরা কেবল রাজপরিবারের নারী নই, আমরা মোগল। নারীও। অতীতে আমরা আমাদের স্বামী, ভাই বা পুত্রদের সঙ্গ দিয়েছি তাদের যুদ্ধাভিযানের সময়। আমরা খচ্চর বা উটের পিঠে চড়ে শত শত মাইল পারি দিয়েছি, অস্থায়ী তাবু এবং মাটির দেয়াল ঘেরা শিবিরে রাত্রিযাপন করেছি। পুরুষ সঙ্গীদের সঙ্গে আহার করেছি, তাঁদের পরিকল্পনায় অংশ নিয়েছি-তাদের উপদেষ্টা, প্রতিনিধি এবং মাধ্যম হিসেবে কাজ করেছি।

 হ্যাঁ, গুলবদন মুখ খুললেন, তোমার চাচারা যখন তোমাকে বন্দী করেছিলো তখন দুই বার আমি যুদ্ধক্ষেত্রের সীমারেখা অতিক্রম করে তদের সঙ্গে আপোষ আলোচনা করতে গিয়েছিলাম…কর্মক্ষেত্রে নিয়োজিত থাকা যে কোনো মোগল যোদ্ধার মতোই আমি জীবনের ঝুঁকি নিয়েছি এবং সেজন্য পরিতৃপ্তিও অনুভব করেছি।

 তোমাদের এ কারণে খুশি হওয়া উচিত যে সেই সব দুঃসময় অতিক্রান্ত হয়েছে…আমরা আর পূর্বের মতো নির্দিষ্ট ভূখণ্ডহীন যাযাবর নই। বর্তমানে আমি একজন শক্তিশালী শাসক-একজন সম্রাট। তোমাদের মর্যাদা এবং লিঙ্গ অনুযায়ী যাবতীয় রাজনৈতিক দুর্ভাবনা থেকে মুক্ত রেখে আমি যদি তোমাদের বিলাসী জীবনের স্বাদ দিতে না পারি তাহলে সেটা আমার জন্য অসম্মানজনক হবে।

 আমাদের মর্যাদা? আমি একজন খানিম, চিবুক উঁচিয়ে গুলবদন বললেন, আমি চেঙ্গিস খানের বংশধর যাকে সবাই বলতো সমুদ্রযোদ্ধা কারণ তার অধিকৃত ভূখণ্ড এক সময় এক সাগর থেকে অন্য সাগরে বিস্তৃত ছিলো। তার এবং তৈমুরের রক্ত আমার শিরায় প্রবাহিত যার দ্বারা আমি সবল। আমার মনে হচ্ছে তুমি এই বাস্তবতা ভুলে গেছো আকবর। গুলবদনের কণ্ঠস্বর শান্ত শোনালো।

তোমরা যেসব প্রতিকূলতা সহ্য করেছে সে সম্পর্কে আমি জানি, কারণ তোমরা সেসব গল্প বিভিন্ন সময় আমাকে শুনিয়েছে-কীভাবে তোমরা বরফ ঢাকা পার্বত্য এলাকা এবং উষ্ণ মরুভূমি পেরিয়েছে, খাদ্যের অভাবে মৃত্যু মুখে পতিত হয়েছে। আমি তোমাদের সাহসকে শ্রদ্ধা করি, কিন্তু আমার মনে হয়েছে তোমরা আর সেরকম ঝুঁকিপূর্ণ জীবন চাওনা।

আমাদের জন্য কি ভালো বা আমরা কি চাই সে সম্পর্কে অনুমান করার পরিবর্তে তুমি আমাদের সরাসরি জিজ্ঞাসা করোনা কেনো? আমরা আশা করি তুমি আমাদের প্রতি তেমন ব্যবহার করো যা প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য প্রযোজ্য- তোমার কাছ থেকে আমরা শিশুর মতো প্রশ্রয় বা খেলনার উপকরণ আশা করি না আমাদের আনন্দের জন্য। সবাই তোমার রক্ষিতাঁদের মতো আমোদ আহ্লাদ আর দামী উপহার পেয়ে সন্তুষ্ট এবং প্রশ্নহীন থাকবে এমনটা কেনো তুমি মনে করছ। আমাদের জীবন যাপনের নিজস্ব রীতি রয়েছে, হামিদা উত্তর দিলেন। উঠে দাঁড়িয়ে তিনি আকবরের দিকে এগিয়ে গেলেন এবং তার কাঁধে হাত রাখলেন। গতকাল আমি আমার এক বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলাম- সে তোমার এক সেনাপতির স্ত্রী যে পশ্চিম দিকের প্রবেশ দ্বারের কাছে থাকে। এই জন্য আমি বেশ কিছু সংখ্যক পরিচারিকাকে নিয়ে আমার প্রাসাদ থেকে বের হয়ে হেরেমের দ্বারে উপস্থিত হই, কিন্তু দায়িত্ব পালনরত রক্ষীরা আমাকে জানায় যে কারো বাইরে যাওয়ার অনুমতি নেই…একমাত্র খাজানসারার অনুমতি ব্যতীত তারা দরজা খুলতে পারবে না। তুমি যদি মনে করো এ ধরনের অচরণ আমাদের উপকার এবং নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজন, তাহলে তুমি ভুল করছে। এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা আমার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়। যদিও তুমি সম্রাট আকবর, কিন্তু তুমি আমার পুত্রও এবং আমি তোমাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছি যে এ ধরনের ব্যবহার আমার পক্ষে মেনে নেয়া কিছুতেই সম্ভব নয়।

 দুঃখিত মা, আমি বুঝতে পারিনি…আমি এ ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতি আর যাতে না ঘটে সে জন্য চিন্তাভাবনা করবো।

 না, তার দরকার নেই। তুমি খাজানসারা, রক্ষীদের অধিনায়ক এবং খোঁজাদের প্রধানকে জানাবে এখন থেকে আমার অর্থাৎ সম্রাটের মায়ের আদেশে হেরেমের সবকিছু চলবে। আমি এবং তোমার ফুফু যখন খুশি হেরেমের বাইরে যাব অথবা ভিতরে প্রবেশ করবো কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই। হামিদা আকবরের কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে নিলেন। এবং তুমি যখন কোনো যুদ্ধাভিযান বা রাজকীয় সফরে বের হবে তখন ইচ্ছা হলে আমরা তোমার সঙ্গে যাবো, অবশ্যই আমরা অবস্থান করবো যথোপযুক্ত পর্দার আড়ালে। এবং জালির আড়ালে উপস্থিত থেকে পরিষদমণ্ডলী সভার কার্যবিধি শ্রবণ করবো যা সর্বদাই আমদের গোত্রের রীতি ছিলো…এবং পরে আমাদের যদি কোনো পরামর্শ থাকে তা তোমাকে জানাবো।

 হামিদা থামলেন এবং আকবরকে পর্যবেক্ষণ করলেন। তুমি তোমার ক্ষমতা এবং জাঁক-জমকের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছ- সমগ্র জগৎ তোমাকে কোনো দৃষ্টিতে দেখছে সে বিষয়েই তোমার চিন্তা কেন্দ্রীভূত। তোমার জীবনে সাফল্য খুব সহজেই এসেছে আকবর- তোমার বাবা বা পিতামহের তুলনায় অনেক বেশি অনায়াসে। এর চমাকারিত্বের কারণে তোমার কাছের মানুষদের অনুভূতির প্রতি অন্ধ হওয়া থেকে নিজেকে বিরত করো। যদি তা না পারো, তাহলে একজন মানুষ হিসেবে এবং সম্রাট হিসেবে তুমি ক্রমশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

 তুমি অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে আমাকে বিচার করছে। আমি তোমাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করি মা, এবং ফুফু তোমাকেও। আমি জানি, তোমাদের সাহায্য ছাড়া আমি কখনোই সম্রাট হতে পারতাম না এবং সেইজন্য আমি কৃতজ্ঞও।

তাহলে তোমার আচরণ দ্বারা তা প্রমাণ করো, শুধু আমাদের ক্ষেত্রে নয় বরং অন্য যারা তোমার কাছের মানুষ তাদের জন্যেও, যেমন তোমার পুত্ররা। যুদ্ধের কারণে বহু মাস ধরে তুমি ওদের কাছ থেকে দূরে ছিলে। এখন যেহেতু তুমি ফিরে এসেছো তাই ওদেরকে তোমার আরো বেশি সময় দেয়া উচিত। তাদেরকে আরো নিবিঢ় ভাবে বোঝার চেষ্টা করো, অধিকাংশ সময় তাদের শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে না রেখে।

আকবর মাথা ঝাঁকালেন, যেনো তিনি তার মায়ের সকল উপদেশ মেনে নিয়েছেন, কিন্তু অন্তরে তিনি অত্যন্ত অসন্তোষ বোধ করলেন। কীভাবে সবকিছু পরিচালনা করতে হবে কিম্বা কেমন আচরণ করতে হবে সে বিষয়ে এতো উপদেশ তার প্রয়োজন ছিলো না। তাঁর সন্তানদের প্রতি কেমন আচরণ করতে হবে তার ফিরিস্তি আরো বেশি অপ্রয়োজনীয়।

*

জাহাপনা, আপনি যে খ্রিস্টান যাজকদের গোয়া থেকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তারা এসেছে।

 ধন্যবাদ জওহর, আমি শীঘ্রই আসছি। আকবর আবুল ফজলের দিকে ফিরলেন, তিনি তাকে রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত তার নতুন সংস্কার সম্পর্কে অবগত করছিলেন। আমরা পরে আবার শুরু করবো। যা বললোম তার বিস্তারিত বর্ণনা ঘটনাপঞ্জিতে লিপিবদ্ধ করবে।

 নিশ্চয়ই জাহাপনা। আপনার পরবর্তী প্রজন্ম আপনার প্রসারণশীল সাম্রাজ্যের চমৎকার প্রশাসনিক সংস্কার সংক্রান্ত পদক্ষেপগুলি থেকে অনেক মূল্যবান শিক্ষা লাভ করবে।

আকবর সংক্ষেপে হাসলেন। আবুল ফজলকে তার ঘটনাপঞ্জিকার হিসেবে নিয়োগদানের পর দীর্ঘ সময় ধরে মাঝে মাঝে তার অতিরঞ্জিত এবং বর্ণাঢ্য লেখনির প্রয়াস তাঁর কাছে গা সওয়া হয়ে গেছে। আমার সঙ্গে এসো। আমি চাই তুমি এই অদ্ভুত প্রাণী গুলিকে দেখো। আমি শুনেছি তাঁদের কেউ কেউ মাথার তালুতে বৃত্তাকার সামান্য চুল রেখে বাকি অংশ কামিয়ে ন্যাড়া হয়ে থাকে।

 আমিও তাঁদের সম্পর্কে কৌতূহলী জাঁহাপনা। আমি শুনেছি তাঁদের স্বজাতীয়রা তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে, এমনকি তাদেরকে সম্ভবত ভয়ও পায়। গোস্তাকি মাফ করবেন জাঁহাপনা, আমি কি জানতে পারি আপনি কেনো ওদেরকে আপনার সভায় আমন্ত্রণ জানিয়েছেন?

আমি ওদের ধর্ম সম্পর্কে জানতে আগ্রহী। আমার হিন্দু প্রজাদের ধর্ম সম্পর্কে আমি বর্তমানে সামান্য কিছু জানি। কিন্তু তাঁদের ঈশ্বর সম্পর্কে আমি প্রায় কিছুই জানি না, কেবল শুনেছি তারা বিশ্বাস করে তাঁদের ঈশ্বর এক সময় একজন মানুষ ছিলেন, যাকে হত্যা করার পর সে আবার জীবন ফিরে পেয়েছিলো।

তারা তাহলে আমাদের মতোই একজন ঈশ্বরকে বিশ্বাস করে?

 সেরকমই মনে হচ্ছে কেবল এমন বিশ্বাস ছাড়া যে তাঁদের এই ঈশ্বর তিনটি রূপে আবির্ভূত হয়েছেন-তারা তাদের ডাকে পিতা, পুত্র এবং পবিত্র আত্মা নামে। হয়তো তাদের এই বিশ্বাসের সঙ্গে হিন্দুদের ত্রিত্ববাদ- বিষ্ণু, শিব এবং ব্রহ্মার মিল রয়েছে।

বিশ মিনিট পর, হীরকশোভিত পাগড়ি পরিহিত আকবর তার দেওয়ান-ই খাস এর বেদীর মতো ঝুল বরান্দার সিংহাসনে আসন গ্রহণ করলেন। নিচে তাঁর রাজসভার সদস্যগণ জামায়েত হয়েছেন। আকবর খেয়াল করলেন তাঁদের পেছন দিকে সেলিম দাঁড়িয়ে আছে। ভালোই হলো ছেলেটি এখানে উপস্থিত রয়েছে। সে ইউরোপীয় কোনো লোক আগে দেখেনি।

 অতিথিদের আমার সামনে হাজির করো, আকবর তার পাশে দাঁড়ানো কোর্চিকে আদেশ দিলেন। কয়েক মুহূর্ত পর বাদকদের গ্যালারিতে বেজে উঠা ঢাকের শব্দের সাথে তরুণ কোৰ্চিটি আকবরের দিকে প্রসারিত ঝুলন্ত সেতু দিয়ে অতিথি যাজকদের পথ দেখিয়ে অগ্রসর হলো। প্রায় মেঝে স্পর্শকরা জোব্বা পরিহিত যাজক দুজন আকবরের কাছ থেকে বারো গজ দূরে থাকতে পরিচারকটি তাদের থামতে ইশারা করলো। আকবর লক্ষ্য করলেন তাঁদের একজন বেটে আকারের তবে মজবুত গড়নের অধিকারী। অন্য জন বেশ লম্বা ও ফ্যাকাশে বর্ণের এবং তার ন্যাড়া মাথা রোদে পুড়ে গাঢ়বর্ণ ধারণ করেছে। আকবর তার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা দোভাষীকে কাছে ডাকলেন। তাদের বলল আমি তাদেরকে আমার রাজসভায় স্বাগত জানাচ্ছি। কিন্তু দোভাষী কিছু বলতে পারার আগেই বেটে যাজকটি আকবরকে সরাসরি বিশুদ্ধ ফার্সী ভাষায় সম্বোধন করলো।

 ফতেহপুর শিক্রিতে আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে আপনি সে সৌজন্য প্রদর্শন করেছেন সে জন্য আমরা কৃতজ্ঞ। আমরা জেসুইট পুরোহিত। আমার নাম ফাদার ফ্রান্সিসকো হেনরিকস। আমি জন্মগতভাবে পারসিক এবং এক সময় ইসলাম ধর্মের অনুসারী ছিলাম। কিন্তু এখন আমি খ্রিস্টান। আমার এই সঙ্গীটি হলেন ফাদার এ্যান্টোনিও মোনসেরেট।

আমার আমন্ত্রণ পত্রের উত্তরে আপনি জানিয়েছিলেন আপনি আমার কাছে কিছু সত্য উন্মোচন করতে চান। সেগুলি কি বলুন।

ফাদার ফ্রান্সিসকোকে গম্ভীর দেখালো। সেগুলি ব্যাখ্যা করতে বহু ঘন্টা সময় প্রয়োজন হবে জাঁহাপনা এবং আপনি হয়তো ধৈর্য হারিয়ে ফেলবেন। কিন্তু আমরা আপনার জন্য একটি উপহার বয়ে এনেছি-ল্যাটিন ভাষায় লেখা আমাদের খ্রিস্টান গসপেল, ল্যাটিন আমাদের গির্জার ভাষা। আমরা জানি আপনার রাজসভায় অনেক বিদ্বান ব্যক্তি রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কেউ এটি অনুবাদ করে দিলে আপনি নিজেই তা পড়তে পারবেন। আপনি যখন জানবেন আমাদের গসপেল গুলিতে কি লেখা রয়েছে তখন হয়তো আবার আমরা আপনার সঙ্গে আলোচনা করার সুযোগ পাব।

কিছু বিষয়ে তারা যথেষ্ট তথ্য রাখে, আকবর ভাবলেন। এটি সত্য যে তিনি কিছু বিদ্বান ব্যক্তিকে নিযুক্ত করছেন-তাঁদের মধ্যে কয়েকজন তৈমুর বংশীয় ঘটনাপঞ্জি তুর্কী ভাষা থেকে ফারসী ভাষায় অনুবাদ করছে, অন্যরা হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলি মূল সংস্কৃত ভাষা থেকে ফারসী ভাষায় অনুবাদ করছে। কিন্তু স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে অতিথি পুরোহিতরা জানে না যে তিনি নিজে পড়তে পারেন না। শাহ দাউদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযানের সময় দীর্ঘ নৌযাত্রার বর্ষণমুখর ঘন্টাগুলিতে আহমেদ খান তাঁকে পড়া শেখাতে চেষ্টা করেছেন এবং যুদ্ধ থেকে ফেরার পরের সময় থেকে তিনি নিজে পড়তে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু শৈশবের মতোই লেখা গুলি তার চোখের সামনে নাচানাচি করেছে এবং তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। এর থেকে সৃষ্ট হতাশা তাঁর পুস্তকের জ্ঞানভাণ্ডার সম্পর্কে জানার আকাঙ্ক্ষা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি সর্বদাই একজন বিদ্বান ব্যক্তিকে কাছে রাখছিলেন বিভিন্ন বই পড়ে শোনানোর জন্য এবং পুস্তকের একটি বিশাল সংগ্রশালা তৈরি করছিলেন যা তার পূর্বপুরুষ কর্তৃক সমরকন্দ ও হেরাতে তৈরি করা পাঠাগারের তুলনায় অধিক সমৃদ্ধ।

আমি আপনাদের এই উপহারটি অনুবাদের ব্যবস্থা করছি এবং যখনই এর প্রাথমিক পাতাগুলি অনুবাদ করা সম্পন্ন হবে তখন আপনাদের সঙ্গে আবার আলাপ করবো। আমি আশা করছি ততোদিন আমার অতিথি হিসেবে এখানে অবস্থান করতে আপনারা আপত্তি করবেন না, আকবর এক মুহূর্ত পর বললেন।

 আপনার আতিথ্য গ্রহণ করা আমাদের জন্য অত্যন্ত সম্মানজনক হবে জাহাপনা। আমাদের ত্রাণকর্তার মহিমান্বিত আলো আপনার উপর বর্ষিত হওয়ার পথে আমরা কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে চাই না। ফাদার ফ্রান্সিসকো যখন কথাগুলি বললেন তখন তার গাঢ় চোখগুলি দীপ্তিময় হয়ে উঠলো এবং তার সমগ্র মুখমণ্ডল গভীর আবেগে আচ্ছন্ন হলো। পুরোহিত দুজন যখন প্রস্থান করছিলো তখন আকবরের মনে হলো, যে ব্যক্তি একসময় ইসলামের অনুসারী ছিলো কিন্তু পড়ে সেই পথ থেকে সরে গেছে তার সঙ্গে ধর্ম বিষয়ক তর্ক নিশ্চয়ই খুব জমে উঠবে। আর তথাকথিত গসপেল এ লেখা বিষয়গুলিও নিশ্চয়ই অভিনব হবে তার জন্য। ফাদার ফ্রান্সিসকোর কথা থেকে মনে হয়েছে এর ভাষা বেশ জটিল এবং রহস্যময় হবে। এর থেকে কি সত্যিই নতুন কোনো সত্য উঘাটিত হবে? এবং কে ছিলেন তাঁদের এই ত্রাণকর্তা? কীভাবে তার মাঝে ঈশ্বরের আবির্ভাব ঘটেছিলো? এ সব বিষয় জানার জন্য তিনি অধৈর্য বোধ করলেন।

তিনি আরো উৎসুক হলেন জানার জন্য যে তাঁদের বিষয়ে সেলিম এর অনুভূতি কি। তিনি একজন পরিচারককে আদেশ দিলেন সেলিমকে তার ব্যক্তিগত কক্ষে নিয়ে আসার জন্য। আধ ঘন্টা পরের ঘটনা। আকবর তার সন্তানের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আমি দেখলাম তুমি খ্রিস্টান পুরোহিতদের কথা শুনছিলে। তাদেরকে তোমার কেমন মনে হয়েছে?

 তারা দেখতে অদ্ভূত।

 সেটা কেমন? তাঁদের পোক?

 হা, কিন্তু তারচেয়েও বেশি…তাদের চেহারার ভাব…মনে হচ্ছিলো তারা যেনো কিছুর জন্য তীব্র আকাক্ষা অনুভব করছে।

 তোমার অনুমান সঠিক। তারা মনে করছে তারা আমাদেরকে খ্রিস্টান বানিয়ে ফেলবে।

আমি শুনেছি আমাদের একজন মাওলানা তাদেরকে বিদেশী বিধর্মী বলেছে এবং এও বলেছে যে তোমার উচিত হয়নি ওদের আমন্ত্রণ জানানো।

 তোমার নিজের কি মনে হয়েছে?

 সেলিমকে কিছুটা বিভ্রান্ত মনে হলো। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।

 তোমার কি মনে হয় না অন্য মানুষদের বিশ্বাস সম্পর্কে যতদূর সম্ভব জানার চেষ্টা করা উচিত? তাছাড়া তুমি কীভাবে প্রমাণ করবে যে তারা ভুল করছে, যদি তুমি না জানো তারা কি চিন্তা করে?

এবার সেলিম আর কিছু বললো না, বারং অপ্রস্তুত দৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলো।

একজন শক্তিশালী এবং আত্মবিশ্বাসী সম্রাটের তাদের ভয় করার কোনো কারণ নেই যারা ভিন্ন মতাদর্শে বিশ্বাস করে, আছে কি? এ বিষয়ে চিন্তা করো সেলিম। তোমার নিজের পড়াশোনা কি তোমাকে তোমার সীমাবদ্ধ গণ্ডির বাইরের বিষয়ের প্রতি কৌতূহলী করে তুলে না?

সেলিম দরজার দিকে তাকালো, স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সে চাইছে এই সাক্ষাতকার এখনই সমাপ্ত হোক এবং আকবর তার আচরণে কিছুটা অসহিষ্ণু বোধ করলেন। তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্রের কাছে আরো বেশি কিছু আশা করেছিলেন। যদিও সেলিমের বয়স অল্প তবুও তার বয়সে তিনি অনেক বুদ্ধিমানের মতো প্রশ্ন করতে পারতেন। তোমার নিজস্ব মতামত থাকা উচিত, আকবর চাপ দিলেন। তাছাড়া তুমি একাই কেনো পুরোহিতদের দেখতে এলে? আমি তো তোমার অন্য ভাইদের সেখানে দেখিনি।

 আমি জানতে চেয়েছিলাম খ্রিস্টান পুরোহিতরা দেখতে কেমন…আমি তাদের সম্পর্কে বিভিন্ন গল্প শুনেছি। আমার একজন শিক্ষককে এক লোক একটি চিঠি পাঠিয়েছে যার সাথে এই পুরোহিতদের দিল্লীতে দেখা হয়েছিলো। এই চিঠিতে লেখা আছে খ্রিস্টানরা কাঠের ক্রুশবিদ্ধ এক ব্যক্তির উপাসনা করে এবং চিঠিটা এখন আমার কাছে। সেলিম তার কমলা বর্ণের জোব্বার ভিতর হাত ঢুকিয়ে একটি ভাঁজ করা কাগজ বের করে আনলো। এর মধ্যে কুশটির একটি চিত্র রয়েছে, কিন্তু দেখ চিঠিটিতে কি লেখা রয়েছে বাবা-বিশেষ করে শেষ লাইন গুলিতে, কীভাবে খ্রিস্টানরা প্রার্থনা করে।

আকবর তাঁর পুত্রের বাড়িয়ে দেয়া হাতে ধরা চিঠিটির দিকে তাকালেন। সেলিম অবশ্যই জানে যে তিনি পড়তে পারেন না…ধীরে তিনি চিঠিটা নিয়ে এর ভাঁজ খুললেন। কাগজটির শীর্ষে ক্রুশবিদ্ধ এক কঙ্কালসার ব্যক্তির চিত্র অঙ্কিত রয়েছে, তার চেহারা যন্ত্রণা কাতর এবং মাথা নিচের দিকে ঝুলে রয়েছে। চিত্রটির নিচে ঘন ভাবে কিছু লেখা রয়েছে স্বাভাবিক ভাবেই যা তাঁর কাছে অর্থহীন। এটা আমার কাছে থাক পরে দেখবো, আকবর বললেন, কিন্তু তার কণ্ঠে প্রকাশিত হয়ে পড়া ক্রোধ দমিয়ে রাখতে ব্যর্থ হলেন। তুমি এখন যেতে পারো।

 তাঁর পুত্র কি তাঁকে ইচ্ছাকৃতভাবে অপ্রস্তুত করতে চেয়েছে? সেলিম প্রস্থান করার পর নিজ কক্ষে পায়চারি করতে করতে আকবর ভাবতে লাগলেন। নিশ্চয়ই না। সে এমনটা কেনো করবে? কিন্তু সেই মুহূর্তে হীরাবাঈ এর গর্বিত অনমনীয় মুখটি তাঁর মনের পর্দায় ভেসে উঠলো। সে কি সেলিমকে তাঁকে ঘৃণা করার জন্য উৎসাহ প্রদান করছে, যেমনটা সে নিজে করে? তিনি সেলিমের শিক্ষককে প্রশ্ন করে জানতে পেরেছেন ইদানিং সে তার মায়ের সঙ্গে অনেক বেশি সময় কাটাচ্ছে। হীরাবাঈ তার ভাই ভগবান দাশ বা ভাগ্নে মানসিং এর সঙ্গে দেখা করে না তারা যখন রাজপ্রসাদে বেড়াতে আসে। সে কোনো আনন্দ আয়োজন বা দাওয়াতেও অংশ গ্রহণ করে না নিজেকে সবকিছু থেকে দূরে রাখে। অধিকাংশ সময় অধ্যয়ন করে বা গেলোই করে সময় কাটায় এবং তার হিন্দু দেবতাদের পূজা করে। প্রতি মাসে পূর্ণিমার সময় সে ছাদের চাতালে গিয়ে স্বর্গের দিকে তাকিয়ে থাকে এবং প্রার্থনা করে।

 হয়তো হীরাবাঈ ইচ্ছাকৃতভাবে আকবরের কাছ থেকে দূরে থাকার কারণে সেলিমের উপর বিরুপ প্রভাব পড়ছে, ছেলেটি তার সঙ্গে তার মায়ের মতোই আচরণ করছে। সেলিম অনেক খোলামেলা এবং সহজ সরল ছিলো যেমনটা এখন আর নেই। বিষয়টি নিয়ে এখন যখন আকবর বলেন, তিনি উপলব্ধি করলেন কেবল আজই যে ছেলেটি তার উপস্থিতিতে বিব্রত এবং জড়তার ভাব প্রদর্শন করলো তা নয়। আকবরের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। হীরাবাঈ তার নিজের পছন্দ মতো জীবন যাপন করুক কিন্তু তাকে তার পুত্রের উপর প্রভাব বিস্তার করতে দেয়া যাবে না। তবে তিনি হীরাবাঈ এর সঙ্গে সেলিমের দেখা সাক্ষাৎ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে চান না। কিন্তু তাদের সাক্ষাতের সময় তিনি সংক্ষিপ্ত করবেন এবং তারা দুজনে যাতে সম্পূর্ণ নিভৃতে সময় না কাটায় সে ব্যবস্থা করবেন।

.

১৪. নারী জগতের সূর্য

জীবন ভালোই কাটছে। সামনে পিছনে নড়তে থাকা রেশমের টানাপাখার নিচে অবস্থিত বিছানায় আকবর নগ্নদেহে শুয়ে আছেন, তার চোখ বন্ধ। কক্ষের মধ্যে অবস্থিত ছোট আকৃতির ফোয়ারা থেকে জল গড়িয়ে পড়ার শব্দ তার কানে আসছে। জনালা দিয়ে বয়ে আসা উষ্ণ ও শুষ্ক মরু হাওয়াকে কিছুটা ঠাণ্ডা করার জন্য জানালা ঘিরে স্থাপন করা হয়েছে সুগন্ধযুক্ত কাশ ঘাস।

বিগত কয়েক ঘন্টা তিনি দিল্লী থেকে আগত এক সুন্দরী বাঈজীর কোমল স্পর্শে কাটিয়েছেন যার দীর্ঘ, জেসমিনের ঘ্রাণযুক্ত চুল নিতম্ব পর্যন্ত বিস্তৃত। যদিও আকবরের বয়স এখন তিরিশ এবং চল্লিশের মাঝামাঝি তবুও তার যৌন ক্ষমতা এখনো যে কোনো তরুণ বয়সের পুরুষের তুলনায় কম নয়। এই জন্য তিনি তাঁর নিজের প্রতি কৃতজ্ঞতা অনুভব করেন। স্পষ্টতই তার জন্য হেকিমের কাম-উদ্দীপক দাওয়াই এর প্রয়োজন ছিলো না যার নাম অশ্ব বীর্য শক্তি- এটি বিভিন্ন উপদানের মিশ্রণে তৈরি গাঢ় সবুজ বর্ণের একটি দুর্গন্ধযুক্ত তরল, ধারণা করা হয় যা পান করলে একজন কাহিল মানুষ একটি স্ট্যালিয়ন ঘোড়ার মতো যৌন শক্তি লাভ করতে পারে। হেরেমে এমন গুজব প্রচলিত ছিলো যে, রাজসভার কিছু বয়স্ক সদস্য এই দাওয়াই এর প্রতি আসক্ত। তবে আকবর আনন্দ লাভের নতুন নতুন উপায় উদ্ভাবন করতে পছন্দ করেন। মাঝে মাঝে তিনি তাঁর রক্ষিতাঁদের আদেশ করেন শতাব্দী প্রাচীন হিন্দু কামসূত্রের গ্রন্থ থেকে তাঁকে পড়ে শোনাতে। এতে রতিকর্মের বহু বিস্ময়কর প্রক্রিয়ার উল্লেখ রয়েছে। অনেক বছর আগে বালক অবস্থায় মায়ালার সঙ্গে তাঁর যে সব অভিজ্ঞতা হয়েছিলো সেগুলি মনে পড়ে যাওয়ার তিনি হাসলেন। তিনি তখন কল্পনাও করেন নি যে একদিন তার হেরেম এতো বিশাল আকৃতি ধারণ করবে।

হঠাৎ একটি সভা সম্পর্কিত চিন্তার কারণে তাঁর যৌনকর্ম পরবর্তী তৃপ্তি ও অবসাদে ভাটা পড়লো। একটু পরেই তাকে দেওয়ান-ই-খাস এ যেতে হবে ওলামাবৃন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য। ওলামারা কি বলতে চায় সে সম্পর্কে জওহর তাঁকে আগেই সতর্ক করেছে। তারা তার আরো স্ত্রী গ্রহণ করার বিষয়ে প্রতিবাদ জানাতে চায়, কারণ কিছুদনি আগে দক্ষিণ দিকের এক জায়গিরদারের কন্যাকে বিয়ে করার পর তার স্ত্রীর সংখ্যা চারজন পূরণ হয়েছে, সুন্নী মুসলমানদের জন্য এর চেয়ে বেশি সংখ্যক স্ত্রী গ্রহণ করা ধর্ম দ্বারা স্বীকৃত নয়। আকবর উঠে বসলেন। তিনি তার সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কোনো অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ সহ্য করবেন না। সাম্রাজ্যের বিস্তার এবং এর শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার মূলনীতি হিসেবে তিনি এই রাজবংশীয় বিবাহের প্রথা অনুসরণ করছেন এবং এতে ফলও পাওয়া যাচ্ছে। তাঁর সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজন হলে তিনি একশ কিম্বা দুইশ স্ত্রী গ্রহণ করবেন, তারা রাজপুত রাজকন্যা হতে পারে, হতে পারে প্রাচীন মোগল গোত্রের কোনো নারী অথবা সম্ভ্রান্ত হিন্দুস্তানী মুসলমান সাদামাটা অথবা সুন্দরী।

অবশ্য তাঁর পিতার জীবন অন্যরকম ছিলো। হুমায়ূন তার হৃদয় ও মনের প্রতিফলন একটি মাত্র নারীর মাঝেই দেখতে পেয়েছিলেন- তিনি হলেন হামিদা। মাঝে মাঝে আকবরের মনে হয়েছে তিনিও একজন নারীর প্রতি অনুরূপ ভালোবাসা অনুভব করতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু তেমনটা এখনো ঘটেনি এবং ভবিষ্যতে ঘটবে বলেও মনে হয় না। তাঁর এই বিবাহ গুলিরে ফলে একদিকে যেমন কৌশলগত ভাবে মিত্ৰতা তৈরি হচ্ছে, অন্যদিকে তিনি ব্যাপক বৈচিত্রময় যৌন অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ পাচ্ছেন। এছাড়া তাঁর হেরেমে বর্তমানে তিনশো এর বেশি রক্ষিতা রয়েছে। বেশিরভাগ মানুষই তাঁদের ঈর্ষা করবে। মনে মনে বাঈজীটির সুগন্ধী তেল মাখা নমনীয় দেহটির কথা আরেকবার কল্পনা করে তিনি গোমড়ামুখী ওলামাদের চিন্তা ঠেলে সরিয়ে দিলেন।

দুই ঘন্টা পড়ে রাজকীয় পোষাকে সুসজ্জিত আকবর তার দেওয়ান-ই-খাস এর সিংহাসনে আসন গ্রহণ করলেন। আবুল ফজল এবং তার ঝুঁকে পড়া দেহের অধিকারী বৃদ্ধ উজির জওহর সিংহাসনের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে। অপর একটি বারান্দায় ওলামা দলের সদস্যরা দাঁড়িয়ে আছে। শেখ আহমেদ অন্যদের তুলনায় কিছুটা সামনে রয়েছে, স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে তিনি আশা করছেন তাকে সেতু পথ ধরে আকবরের কাছে এগিয়ে আসতে বলা হবে। কিন্তু আকবর তাকে ইশারা করলেন যেখানে আছে সেখানেই থাকতে।

বলুন শেখ আহমেদ, আপনি আমাকে কি বলতে চান?

শেখ আহমেদের হাত তার বুক স্পর্শ করলো কিন্তু আকবরের উপর নিবদ্ধ তার দৃষ্টিতে কোনো রকম বিনয় প্রকাশ পেলো না। জাহাপনা, সোজাভাবে কথা বলার সময় উপস্থিত হয়েছে, আপনার আরো স্ত্রী গ্রহণ কারার পরিকল্পনাটি ঈশ্বরের বিরোধীতার সমতুল্য।

 আকবর সামনের দিকে ঝুঁকে এলেন। সাবধানে কথা বলুন।

 কোরানে যা লেখা রয়েছে আপনি তা অমান্য করছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে এ বিষয়ে আপনার সঙ্গে বহুবার আলোচনা করেছি, কিন্তু আপনি কর্ণপাত করেননি। ফলে আমি সবার সামনে এ বিষয়ে বক্তব্য উত্থাপনে বাধ্য হয়েছি। এখনো যদি আপনি আমার বক্তব্যের প্রতি গুরুত্ব না দেন তাহলে আমি আগামী শুক্রবারের জুম্মার সময় মসজিদের বেদী থেকে আমার বক্তব্য প্রচার করবো। শেখের মুখমণ্ডল লাল হয়ে উঠেছে এবং আকবরের নীরবতা তাকে আরো উৎসাহী করে তুললো। হৃষ্টপুষ্ট দেহটিকে সবলে খাড়া করে তিনি তার সহকর্মীদের দিকে বিজয়ীর দৃষ্টিতে এক পলক চাইলেন। কোরানে উল্লেখ রয়েছে কোনো পুরুষ কেবল চারটি বিয়ে করতে পারে। কিন্তু আমি শুনেছি আপনি আরো অনেক স্ত্রী গ্রহণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন তাঁদের অনেকে মুসলমান নয়। আপনি যদি এই পরিকল্পনা থেকে বিরত না হোন, তাহলে ঈশ্বর আপনাকে এবং আমাদের সমগ্র সাম্রাজ্যকে কঠিন শাস্তি প্রদান করবেন।

 ইতোমধ্যেই আমার দুজন হিন্দু স্ত্রী রয়েছে, আপনি সেটা ভালো করেই জানেন। তারা আমাকে সন্তানও উপহার দিয়েছে। আপনি কি আমাকে তাঁদের পরিত্যাগ করার পরামর্শ দিচ্ছেন?

 শেখ সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো, তারা আপনার রক্ষিতার মর্যাদা পেতে পারে জাহাপনা। অবশ্য তাঁদের সন্তানেরা যুবরাজের মর্যাদাই উপভোগ করতে পারে। অতীতে বহু যুবরাজের জন্ম রক্ষিতাঁদের গর্ভে হয়েছে…যেমন আপনার নিজ পিতামহের ভাই…

আকবর মাওলানার দিকে তাকালেন, ভাবছেন তলোয়ারের এক কোপে তার মাংসল গলা থেকে মাথাটা আলাদা করে দিলে কেমন হয়? কিন্তু তার মনে হলো ধর থেকে মাথাটা আলাদা হওয়ার পরও হয়তো সেটা বকবক করতে থাকবে।

শেখ আহমেদ, আমি আপনার বক্তব্য ধৈর্য সহকারে শ্রবণ করেছি। এখন আমার মতামত শুনুন। আমি সম্রাট। আমার সাম্রাজ্য এবং প্রজাদের জন্য কি মঙ্গল জনক সে ব্যাপারে আমি নিজেই সিদ্ধান্ত নেবো। এ বিষয়ে আপনার হস্তক্ষেপ আমি বরদাস্ত করবো না।

শেখ আহমেদ উত্তেজনায় কাঁপতে থাকলো তবে কোনো মন্তব্য করলো না। আকবর ওলামাদের বিদায় করতে যাচ্ছিলেন কিন্তু সেই মুহূর্তে আবুল ফজলের পিতা শেখ মোবারক কিছু বলার জন্য এগিয়ে এলেন। আকবর তাকে এর আগে লক্ষ্য করেননি।

জাহাপনা, দয়া করে আমাকে যদি কথা বলার অনুমতি দেন তাহলে আমি এই সমস্যা সমাধানের বিষয়ে একটি প্রস্তাব পেশ করতে পারি।

খুব ভালো, বলুন কি বলতে চান।

 শেখ আহমেদ এর মতো আমিও একজন সুন্নী মুসলমান, কিন্তু কয়েক বছর যাবৎ আমি আমাদের শিয়া ভাইদের ধর্মীয় আচার আচরণ সম্পর্কে গবেষণা করেছি। এর ফলে আমি জানতে পেরেছি তারাও আমাদের নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) কে অনুসরণ করে এবং কিছু মতাদর্শগত পার্থক্যের জন্য তাদেরকে আমাদের শত্রু ভাবা উচিত নয়।

আপনার বক্তব্য যথেষ্ট বিচক্ষণতা সম্পন্ন কিন্তু এর সঙ্গে আজকের সভার আলোচ্য বিষয়ের সম্পর্ক কি?

সম্পর্ক আছে জাঁহাপনা। শিয়ারা বিশ্বাস করে কোরান আরেক ধরনের অপেক্ষাকৃত কম মর্যাদাপূর্ণ বিবাহ অনুমোদন করে। একে মুতা বলা হয়। এই নিয়মে কোনো পুরুষ যে কোনো সংখ্যক নারীকে মুতা করতে পারে তাদের ধর্ম যাই হোক না কেনো এবং এর জন্য কোনো ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন হয় না।

সেটা অধর্ম…কোনো ঈমাণদার ব্যক্তি এমন পন্থা অনুসরণ করতে পারে না, ক্রোধে মাথা নাড়তে নাড়তে শেখ আহমেদ মন্তব্য করলেন।

হয়তো এটা অধর্ম নয়। আমি এ বিষয়ে কোরানের একটি নির্দিষ্ট আয়াত দেখাতে পারি যাতে এই মুতা বিবাহের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। পারস্যে বহু লোক এই প্রথা অনুসরণ করে।

 হা পথভ্রষ্ট দেশের ধর্মদ্রোহিদাপূর্ণ প্রথা আমদের দেশেও ছড়িয়ে পড়ছে। আমি শুনেছি আমাদের সাম্রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত অবকাশযাপন কেন্দ্রের মালিকরা সওদাগরদের প্রলুব্ধ করতে এক রাতের জন্য তাদের মুতা স্ত্রী প্রদান করে। এটা পতিতাবৃত্তিকে জায়েজ করার একটা ঘৃণ্য কৌশল ছাড়া কিছু নয়!

শেখ আহমেদ তার ক্রোধান্বিত বক্তব্য অব্যাহত রাখলো কিন্তু আকবর তার কথা আর শুনছিলেন না। শেখ মোবারক এর প্রস্তাব বেশ আকর্ষণীয় এবং তিনি এ বিষয়ে আরো জানতে চান। কোরান যদি সত্যিই পুরুষের বহু বিবাহে স্বীকৃতি দেয় তাহলে তা ওলামাবৃন্দের গোড়া সদস্যদের মোকাবেলায় কাজে লাগবে। কিন্তু মোবারকের বক্তব্য আকবরের মনের একটি গভীর তারে ঝংঙ্কার তুললো। সাধুগণ, সুন্নী মুসলমান, হিন্দু, খ্রিস্টান- এরা সকলে কি একই মৌলিক সত্যের সন্ধান করছে না-এই অনিশ্চিত পৃথিবীতে কিছুটা নিশ্চয়তার ছায়া কি তারা সকলেই খুঁজছে না? যে সব আনুষ্ঠানিকতা তারা চালু করেছে, যে সব নীতি তারা অনুসরণ করে এর সবই তো মানুষের তৈরি। এই সব বিষয়কে অপসারণ করা হলে যা অবশিষ্ট থাকে তা হলো মানুষের ঈশ্বরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা এবং উত্তম ভাবে জীবন যাপন করার প্রয়াস।

হঠাৎ আকবর উপলব্ধি করলেন শেখ আহমেদের আস্ফালন থেমেছে এবং সকলে তার মতামত শোনার জন্য অপেক্ষা করছে। আকবর তার এক হাত তুললেন। সভা এখানেই সমাপ্ত করছি। যা শুনলাম সে সম্পর্কে আমি চিন্তাভাবনা করবো। শেখ আহমেদ, আপনি আগামীকাল আমার সঙ্গে দেখা করবেন এবং আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো। তবে সকলকে একটি বিষয় উপলব্ধি করতে হবে। আমি ম্রাট এবং এই মর্যাদা বলে আমি পৃথিবীতে ঈশ্বরের ছায়া স্বরূপ। আমার জীবন কীভাবে চলবে সে সিদ্ধান্ত আমি নিজেই নেবো। আমার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অন্য কোনো মানুষের মতামত বা হস্তক্ষেপ আমি সহ্য করবো না।

 ওলামাবৃন্দ পিছন দিকে সরে প্রস্থান করলো। আকবর কিছুক্ষণ চিন্ত মিগ্নভাবে বসে রইলেন। অল্প সময় পর জওহর তাঁকে ফিস ফিস করে বললো, জাহাপনা, রাজ দরবারে একজন আগন্তুক এসেছে- দৈবক্রমে যে দেশ সম্পর্কে একটু আগে আলোচনা হচ্ছিলো সে সেই পারস্যের লোক। সে আপনার সাক্ষাৎ প্রার্থনা করছে। আকবর বলতে যাচ্ছিলেন তাঁর আর ধৈর্য নেই তাই আজ আর কারো সঙ্গে দেখা করবেন না, কিন্তু জওহর আরো বললো, তার একটি আকর্ষণীয় কাহিনী আছে জাহাপনা এবং সে কোনো সাধারণ ভ্রমণকারী নয়।

আকবর এক মুহূর্ত চিন্তা করলেন। তার ইচ্ছা করছিলো ঘোড়ায় চড়ে একটু বেড়াতে। মরুভূমির বুকে খানিক্ষণ ঘোড়া ছুটালে হয়তো তাঁর অবসাদ কিছুটা লাঘব হতো। কিন্তু বেড়াতে যাওয়ার জন্য বাইরের আবহাওয়া তখনো বেশ উষ্ণ। ঠিক আছে, তাকে পাঠাও।

দশ মিনিট পর একজন লম্বা শীর্ণ গড়নের লোককে দরবার-ই-খাস এর বারান্দাগুলির একটিতে নিয়ে আসা হলো। সে যে জোব্বাটি পড়ে আছে সেটা তার দেহের তুলনায় ছোট এবং তার আঙ্গুলে কোনো আংটি নেই। কাছে এসো। কে তুমি?

 আমার নাম গিয়াস বেগ। আমি পারস্যের একটি সম্ভ্রান্ত বংশের সন্তান। আমার বাড়ি ছিলো খুরাসানে। আমার পিতা শাহ্ এর দরবারের একজন সভাসদ ছিলেন এবং বৈবাহিক সূত্রে রাজপরিবারের সঙ্গে আমার পরিবারের সম্পর্ক রয়েছে।

 আমার দরবারে আসার উদ্দেশ্য কি?

এক মারাত্মক রোগের প্রদুর্ভাবে আমার ভূ-সম্পত্তির সব ফসল নষ্ট হয়ে যায়। ফলে আমি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ি এবং আমার পরিবার দারিদ্রের মাঝে পতিত হয়। আমি বহু পারসিকের কথা জানি যারা আপনার দরবারে এসে অনেক উপকার লাভ করেছে। সেই জন্য আমি আমার পরিবার সহ হিন্দুস্ত নে এসে আপনার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার সিদ্ধান্ত নেই। গিয়াস বেগ বিরতি নিলো এবং অল্প সময়ের জন্য তার কালশিরে পড়া চোখ ঘষলো। তার গলার স্বর গভীর এবং ছন্দময় এবং সে পারসিক রাজসভায় প্রচলিত শুদ্ধ ফার্সিতেই কথা বলছে। যদিও স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে বর্তমানে সে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে তবুও তার অভিব্যক্তি থেকে মনে হচ্ছিলো মানুষকে আদেশ প্রদান করতেই সে বেশি অভ্যস্ত কারো কাছে সাহায্য চাওয়ার পরিবর্তে। আকবর তার প্রতি অধিক আগ্রহী হয়ে উঠলেন।

জাহাপনা, আপনার সম্মুখে আমাকে ভিক্ষুকের বেশে উপস্থিত হতে হয়েছে, কারণ যাত্রা পথে আমি ভয়ানক দুর্যোগের শিকার হয়েছিলাম। তবে ছিন্ন বস্ত্র পরিহিত অবস্থায় আপনার সামনে উপস্থিত হওয়া থেকে রক্ষা পেয়েছি কারণ- আপনার গ্রন্থাগারের একজন বিদ্বান ব্যক্তি আমার বন্ধু- সে আমাকে পরিষ্কার পোশাক প্রদান করেছে। আপনি হয়তো ভাবছেন এই দরিদ্র প্রাণীটি যতো তাড়াতাড়ি বিদায় হয় ততোই মঙ্গল, কিন্তু আমি আপনাকে সবিনয়ে অনুরোধ করবো আমার যাত্রা পথের কাহিনীটি শোনার জন্য।

 ঠিক আছে, বলল তোমার কাহিনী।

 আমার সঙ্গে আমার গর্ভবতী স্ত্রী এবং অল্প বয়সী পুত্র ছিলো- স্ত্রীর গর্ভাবস্থা শেষ দিকে পৌঁছেছিলো। আমরা নিরাপদে হেলমান্দ নদী অতিক্রম করে পারস্য ত্যাগ করি। এরপর থেকেই আমাদের দুর্যোগ আরম্ভ হয়। হিন্দুস্তানের পথে ক্রমশ জঙ্গল, পাহাড় এবং জনবসতিহীনতা আবির্ভূত হতে থাকে।

আমি জানি। ঐ পথে অগ্রসর হতে গিয়ে একবার আমার পিতার জীবন ঝুঁকির সম্মুখীন হয়েছিলো। তুমি কীভাবে টিকে গেলে?

আমার পরিবারের নিরাপত্তার জন্য আমি একটি বড় কাফেলার সঙ্গে যোগ দেই। কিন্তু আমার স্ত্রীর দুর্বল দশা এবং আমাদের বহনকারী খচ্চর গুলির রুগ্ন অবস্থার জন্য আমরা পিছিয়ে পড়ি। একদিন রাতে একটি সংকীর্ণ গিরিপথ পেরুনোর সময় পাহাড়ের ঢাল বেয়ে একদল ডাকাত নেমে এসে আমাদের আক্রমণ করে। আমার স্ত্রী যে বুড়ো খচরটির পিঠে চড়েছিলো সেটি ছাড়া বাকি সবকিছু তারা লুট করে নেয়। পরদিন আমরা মরিয়া হয়ে অগ্রসর হতে থাকি আবার কাফেলাটির নাগাল পাওয়ার জন্য। কিন্তু আধার নেমে পড়ায় সেই রাতের জন্য একটি পাহাড়ের পাদদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হই। তখন হেমন্ত কালের শেষ ভাগ চলছে, ইতোমধ্যে পাহাড়ের উপর থেকে হাড় বিদ্ধকারী শীতল বায়ুপ্রবাহ শুরু হয়েছে। ঐ দিন রাতে, হয়তো আক্রমণের অভিঘাতের কারণে আমার স্ত্রী একটি কন্যা সন্তান প্রসব করে।

এতো দুর্যোগের মধ্যেও ঈশ্বর তোমাদের উপর করুণা বর্ষণ করলেন তাহলে…

গিয়াস বেগের হাড্ডিসার মুখটিতে অটুট গাম্ভীর্য বিরাজ করছে। আমরা বিপুল আনন্দের সঙ্গে তার নাম রাখলাম মেহেরুন্নিসা যার অর্থ নারীদের মধ্যস্থিত সূর্য, কারণ তার জন্মের পর পর আমাদের আধার জীবন যেনো আলোকিত হয়ে উঠলো। কিন্তু আমাদের আনন্দ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। পরদিন সকালে শীতল ভোরের আলোতে আমি প্রতিকূল বাস্তবতার মুখোমুখী হলাম। আমাদের পেটে খাবার নেই এবং সাহায্য করার মতো আশেপাশে কোনো মানুষজনও নেই। নবজাত শিশুটিকে হয়তো বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হবে না। আমি আমার প্রায় অচেতন স্ত্রীর কোল থেকে মেহেরুন্নিসাকে নিলাম এবং বিশাল একটি গাছের শিকড়ে সৃষ্ট ফাটলের মধ্যে তাকে রাখলাম। প্রার্থনা করলোম শিয়াল বা অন্য কোনো বন্য প্রাণী তাকে আবিষ্কার করার আগেই যেনো সে ঠাণ্ডায় মারা যায়। আমি এও স্বীকার করছি, তখন একবার আমার মনে হয়েছিলো তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করি। কিন্তু সেটা মহাপাপ হবে। আমি ধীরে সেখান থেকে সরে আসলাম, আমার কন্যার অস্পষ্ট কান্নার শব্দ তখনো আমার কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিলো।

গিয়াস বেগ এক মুহূর্তের জন্য চুপ করলো। আকবর কল্পনায় সেই বিহ্বল দুর্ভাগ্য তাড়িত পিতাটিকে দেখতে পেলেন যে প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে সম্মুখে মৃত্যু এবং হতাশা ব্যতীত আর কিছু দেখতে পাচ্ছে না। তিনি নিজে কি তাঁর কোনো পুত্রকে অনুরূপ পরিস্থিতিতে ত্যাগ করতে পারতেন? যেনো তার সন্তানদের বিষয়ে চিন্তার জাদুকরী প্রভাবে তাঁদের একজন সেখানে হাজির হলো, আকবর সেলিমে একটি থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। সে এতোক্ষণ উৎকর্ণ হয়ে গিয়াস বেগের গল্প শুনছিলো।

তারপর কি হলো? তিনি জিজ্ঞাসা করলেন।

এক অপ্রত্যাশিত হাসি পারসিকটির মুখমণ্ডল কোমর করে তুললো। মরণশীল মানুষ জানে না ঈশ্বর তাঁদের কোনো পথে ধাবিত করবেন। কোনো কারণে তিনি আমার উপর অসীম করুণা বর্ষণ করলেন। কাফেলার একজন পারসিক বণিকের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিলো-সেও খুরাসানের লোক। কাফেলাটি যখন রাতের বিশ্রামের জন্য থামে তখন সে খেয়াল করে আমরা তাদের দলের মধ্যে অনুপস্থিত। সে আমার স্ত্রীর অবস্থা জানতে এবং অনুমান করে তার প্রসবের সময় হয়তো হয়ে এসেছে। ভোরের প্রথম আলো ফুটতেই সে তার দুজন ভৃত্যকে নিয়ে আমাদের খোঁজে ফিরে আসে। অলৌকিক ভাবে সে আমার সন্ধান পায় যখন আমি একটি অগভীর জলধারা পার হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।

 আমি যখন তাকে আমার কন্যার কথা বললোম, সঙ্গে সঙ্গে সে তার একজন ভৃত্যের ঘোড়া আমাদের দিয়ে দিলো। আমি দ্রুত ফিরতি পথ ধরলাম- বাস্তবে আমি বেশি দূর অগ্রসর হতে পারিনি- প্রার্থনা করছি। মেহেরুন্নিসা যাতে তখনো বেঁচে থাকে। যখন আমি বাতাসে তার কান্নার শব্দ পেলাম উপলব্ধি করলোম আমার প্রার্থনা শ্রুত হয়েছে। সে অক্ষত ছিলো তবে ভীষণ ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিলো, তার ছোট্ট ঠোঁট জোড়া নীল বর্ণ ধারণ করেছে। আমি ঘোড়ার জিনের উপর বিছান ভেড়ার চামড়াটি তুলে নিয়ে তাকে ভালোমতো পেচিয়ে নিলাম। কয়েক মুহূর্ত পর লক্ষ্য করলোম তার মুখের স্বাভাবিক রং ফিরে আসছে এবং তখন আমি আবার নতুন আশায় উদ্বুদ্ধ হলাম।

বণিকটি আমাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে, সে আমাদের খাদ্য প্রদান করলো এবং তারই একটি ষাঁড় টানা গাড়িতে চড়ে চারদিন আগে আমরা ফতেহপুর শিক্রির কাছে পৌঁছাই। দূর থেকে এই মহান শহরের উঁচু দেয়াল দেখতে পেয়ে আমাদের মন আনন্দে ভরে উঠে। আমি আপনার অনেক সময় নষ্ট করলোম জাহাপনা। আমার কাহিনী যদি আপনাকে সন্তুষ্ট করে থাকে তাহলে আপনার দরবারের যেকোনো একটি কাজ আমাকে দিন, আপনি আমাকে একজন কৃতজ্ঞ এবং নিবেদিত প্রাণ সেবক হিসেবে পাবেন।

আকবর গিয়াস বেগের লম্বা এবং দুর্যোগে বিধ্বস্ত অবয়বটি মনযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করলেন। পারসিকটির বিপদ এবং দুর্যোগ সংক্রান্ত গল্পটির বিষয়ে তিনি সন্দেহ পোষণ করছেন না। লোকটির অবস্থার সঙ্গে তার কাহিনীর সত্যিই সামঞ্জস্য রয়েছে। কিন্তু এই মার্জিত মিষ্টভাষী লোকটি নিজের যে পরিচয় দিয়েছে তা কি সম্পূর্ণ সত্যি? জেনেশুনে এমন বিপদসঙ্কুল যাত্রায় অল্পবয়সী পুত্র এবং গর্ভবতী স্ত্রীকে নিয়ে সে কেনো অগ্রসর হলো? দারিদ্র থেকে মুক্তি বা ভাগ্যান্বেষণের যে উদ্যোগের কথা সে সাবলীল ভাষায় বর্ণনা করলে তা মিথ্যাও হতে পারে। হয়তো তার পারস্য ত্যাগের অন্য কোনো কারণ রয়েছে দুর্নীতি বা বিদ্রোহ বা অন্য কিছু তাকে নিজ দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য করেছে…

যেনো আকবর তাকে সন্দেহ করছেন বুঝতে পেরেই গিয়াস বেগ হতাশায় কিছুটা নুয়ে পড়লো। তার এই ক্ষুদ্র নিরাশাসূচক ভঙ্গীমার উপর নির্ভর করেই আকবর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। সামান্য অনিশ্চিত হওয়া সত্ত্বেও তিনি পারসিকটিকে একটি সুযোগ দিবেন, কারন একজন সম্রাটের অবশ্যই দয়ালু হওয়া উচিত। তিনি তাকে এমন জায়গায় পাঠাবেন যে, যদি সে তার দাবি অনুযায়ী সত্যিই পরিশ্রমী হয় তাহলে সে সেখানে ভালো উন্নতি করতে পারবে। কিন্তু সে যদি অসৎ অথবা প্রতারক হয় তাহলে তার অপরাধ দ্রুত উন্মোচিত হয়ে পড়বে।

 গিয়াস বেগ তোমার কাহিনী আমার হৃদয় স্পর্শ করেছে। আমি মনে করি তুমি একজন সাহসী এবং সৎ ব্যক্তি এবং আমার আনুকূল্য লাভের উপযুক্ত। জওহর…. আকবর তার বয়স্ক উজিরের দিকে তাকালেন। কিছু দিন আগে তুমি আমাকে বলেছিলে কাবুলে আমার একজন সহকারী হিসাবরক্ষক মৃত্যুবরণ করেছে, তাই না?

জ্বী জাহাপনা, সে গুটি বসন্তে মারা গেছে।

গিয়াস বেগ, তুমি কি এই পদটি গ্রহণ করবে? তুমি যদি এ পদে কাজ করে দক্ষতার পরিচয় দিতে পারো তাহলে ভবিষ্যতে তুমি আরো মর্যাদাজনক পদে অধিষ্ঠিত হতে পারবে।

গিয়াস বেগের চেহারায় স্বস্তির ভাব ফুটে উঠলো। আমি কাবুলে আমার সর্বোত্তম সামর্থ দিয়ে কাজ করবো জাহাপনা।

 ঠিক আছে তাহলে।

 পারসিকটি প্রস্থান করার পর আকবর ইশারায় জওহরকে কাছে ডাকলেন। কাবুলে আমার রাজ্যপালকে একটি চিঠি লিখো, তাকে বলবে গিয়াস বেগের উপর নজর রাখতে, যাতে কোনো অঘটন না ঘটে। এরপর তিনি তার পুত্রের খোঁজ করলেন। সেলিম নিঃশব্দে প্রস্থান করেছে বুঝতে পেরে তিনি অবাক হলেন না। জেসুইট পুরোহিতদের বিষয়ে প্রশ্ন করার দিন থেকেই ছেলেটি তাকে এড়িয়ে চলছে। যখনই তিনি তার পড়ার সময় অথবা তলোয়ার চালনা, কুস্তি বা তীর ছোঁড়ার প্রশিক্ষণের সময় তার কাছে গিয়েছেন- তখনই সে তার দক্ষতা প্রদর্শনের সুযোগ কাজে লাগানোর পরিবর্তে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। সেলিমের স্পষ্ট অস্বস্তি আকবরের পক্ষ থেকে তাকে কিছু বলা বা তার জন্য কিছু করা অনেক কঠিন করে তুলেছে। অবশ্য তিনি নিজে অনেক অল্প বয়স থেকেই তার চারপাশের মানুষদের ভালোবাসা এবং প্রশংসাকে অনায়াস লব্ধ বলেই গণ্য করেছেন। তাঁর পুত্রের আচরণের বিপরীতে তাঁর প্রতিক্রিয়া কেমন হওয়া উচিত? তাঁকে ধৈর্যধারণ করতে হবে। তিনি যদি অপেক্ষা করেন তাহলে একদিন সেলিম নিজ তাগিদেই তাঁর কাছে আসবে, তার মা তাকে যাই বলুক না কেনো…প্রতিটি ছেলেরই তাদের বাবাকে প্রয়োজন আছে।

*

আমি কৌতূহল অনুভব করছি। গিয়াস বেগ লোকটি দেখতে কেমন ছিলো? হামিদা জিজ্ঞাসা করলেন।

 সে লম্বা এবং রোগা এবং যে জোব্বাটি পড়ে ছিলো সেটা তার দেহের তুলনায় ছোট ছিলো। তার হাড়সর্বস্ব মোটা কব্জিগুলি হাতার ভেতর থেকে অনেক দূর পর্যন্ত বেরিয়ে ছিলো, সেলিম উত্তর দিলো।

 এবং সে একজন পারসিক?

হ্যাঁ।

সে আমাদের দরবারে কেনো এসেছে?

 বাবার সাহায্য লাভের আশায়।

 সে কি প্রার্থনা করলো?

যে কোনো একটি কাজ চাইলো।

 সে যা যা বলেছে সব আমাকে বলো।

 হামিদা মনযোগ সহকারে সেলিমের মুখে সব কিছু শুনতে লাগলেন। তার বক্তব্য শেষ হওয়ার পর তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। জীবন খুবই বিস্ময়কর, অবশেষে তিনি বললেন। একাধিক মানুষের জীবনে একই রকম ঘটনা ঘটে- তোমার পিতামহ অর্থাৎ আমার স্বামীর জীবনেও এই ধরনের ঘটনা ঘটেছিলো। তবে আমার মনে হচ্ছে কি জানো, এই গিয়াস বেগ একদিন আমাদের সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তি হয়ে উঠবে। তার জীবনে যেমন ঘটনা ঘটেছে এর সঙ্গে আমাদের পরিবারে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনার সূক্ষ্ম মিল রয়েছে। তুমি বলছিলে সে পারস্য থেকে প্রায় খালি হাতে এসেছে এবং নিজ সদ্যোজাত কন্যাকে প্রায় ত্যাগ করার উপক্রম করেছিলো। প্রায় একই রকম দুর্দশার কারণে আমি এবং তোমার পিতামহ পারস্যে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম শাহ্ এর সাহায্য লাভের আশায়। আমাদেরও খাদ্য বস্ত্রের অভাব ঘটেছিলো। তবে তার থেকেও মারাত্মক যা ঘটেছিলো তা হলো তোমার পিতার ঘটনা- তখন সে একটি শিশু, আমাদের কাছ থেকে চুরি হয়ে গিয়েছিলো।

 সেই সময়ের কথা কল্পনা করো যখন আমরা দুর্বিসহ যাত্রা শেষে পারস্যে পৌঁছাই…কয়েক সপ্তাহ ধরে আমরা ঠিক মতো খেতে পাইনি এবং শাহ্ আমাদের আদৌ তার রাজ্যে থাকতে দিবেন কি না সেটাও অনিশ্চিত ছিলো। কিন্তু যখন তিনি আমাদের আগমনের কথা জানতে পারলেন তখন দশ হাজার অশ্বারোহীর বিশাল এক সৈন্য দল পাঠিয়েছিলেন আমাদেরকে তার গ্রীষ্মকালীন রাজধানীতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। বেগুনী বর্ণের রেশমের পোশাক পরিহিত ভৃত্যরা আমাদের সম্মুখের রাস্তার উপর গোলাপ জল ছিটিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলো যাতে ধূলা না উড়ে। নৈশ ভোজের সময় পরিচারকরা আমাদের প্রায় পাঁচশো প্রকার উপাদেয় খাবার পরিবেশন করে এবং সেই সঙ্গে মিষ্টান্ন ও বরফ যুক্ত অতুলনীয় স্বাদের শরবত। পরে রাজকীয় তাবুতে সুগন্ধিযুক্ত সাটিনের মসৃণ বিছানায় আমরা ঘুমিয়েছি। প্রতি বেলার আহার শেষে আমাদের নতুন নতুন উপহার প্রদান করা হতো। নিখাদ সোনার তৈরি খাঁচায় বন্দী গানের পাখি যার গলার ছিলো রত্নহার, হাতির দাঁতের পটে আঁকা তৈমুরের চিত্র যেটি এখনো আমার কাছে রয়েছে। তবে যদিও আমরা শাহ্ এর কাছে সাহায্যপ্রার্থী ছিলাম তবুও আমরা কখনোই তার সঙ্গে শরণার্থীর মতো আচরণ করিনি। তোমার পিতামহ তাকে একটি চমৎকার উপহার দিয়েছিলেন- যা তাকে কারো প্রদান করা শ্রেষ্ঠতম উপহার। সেটা ছিলো কোহিনূর হীরা যাকে আলোর পাহাড় নামে ডাকা হতো।

কিন্তু দাদা শাহকে ঐ চমৎকার হীরাটি দিয়েছিলেন কেনো?

হামিদা হাসলেন, একটু বিষণ্ণভাবে, অন্তত সেলিমের কাছে তাই মনে হলো। তোমাকে বুঝতে হবে তখনকার পরিস্থিতি কেমন ছিলো। বিষয়টি তোমার জন্য শিক্ষনীয়। ভেবে দেখো, অন্য একজন শাসকের দয়ার কাছে নিজেকে সমর্পণ করা তোমার দাদার জন্য কতোটা মানহানিকর ছিলো। শাহকে কোহিনূর হীরাটি উপহার দেয়ার মাধ্যমে তিনি ঐ পরিস্থিতিতে কিছুটা ভারসাম্য আনার প্রয়াস চালিয়েছিলেন। দেখাতে চেয়েছিলেন তার সম্মান শাহ্ এর তুলনায় কম নয় এবং এভাবেই সেই দুর্দিনে তিনি নিজের। মর্যাদা রক্ষা করেছিলেন। একটি রত্ন, সেটি যতোই দুপ্রাপ্য বা চমৎকার হোক না কেনো, আমাদের রাজবংশের মর্যাদার সাথে কি তার তুলনা চলে? হঠাৎ হামিদার চোখ দুটি অত্যন্ত উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

হামিদা যখন কথা বলছিলেন তখন সেখানে গুলবদন প্রবেশ করেছিলেন। সেলিমের দিকে তাকিয়ে তিনি উষ্ণ হাসি দিলেন, সেলিমও হেসে তার প্রত্যুত্তর দিলো। সে তার এই উভয় পিতামহীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পছন্দ করে। তাদের সান্নিধ্যে সে নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তাও অনুভব করে। তারা তার সমালোচনা করেন না এবং মজার মজার গল্প বলেন। তার পিতামহের পুনরায় হিন্দুস্তান জয় করার কাহিনী যখন তারা তাকে বলেন তখন সে কল্পনার চোখে দেখতে পায় মোগল অশ্বারোহীদের ইস্পাতের ফলা বিশিষ্ট বর্শার মাথায় পতপত করে পতাকা উড়ছে যখন তারা পাথুরে ভূমির উপর দিয়ে শত্রুর দিকে অগ্রসর হচ্ছে এবং মোগলদের কামানের মুখ থেকে গোলা বর্ষণের সময় সাদা ধোঁয়া উঠে আকাশকে গ্রাস করেছে। বন্দুকের বারুদের ঝাঁঝালো গন্ধ যেনো তার নাকে আসে এবং সে যুদ্ধহাতির গভীর চিৎকার শুনতে পায়।

তোমার এই দাদীকে ঐ পারসিকটি সম্পর্কে বলো যে রাজসভায় এসেছে। হামিদা সেলিমকে বললেন।

 তোমার বাবা কি এই গিয়াস বেগকে সাহায্য করতে রাজি হয়েছে? সেলিমের গল্প শেষ হতে গুলবদন জিজ্ঞাসা করলেন।

 হ্যাঁ। বাবা তাকে কাবুলে একটি কাজ দিয়েছেন।

 তোমার বাবার মানুষের চরিত্র বিচার করার ক্ষমতা অনেক ভালো, গুলবদন বললেন, কিন্তু সে সবসময় এমনটা ছিলো না। সে যখন তরুণ ছিলো তখন সে কোনো বিষয়ে খুব বেশি চিন্তাভাবনা করতো না এবং খুব সহজেই অন্যদের দ্বারা প্রভাবিত হতো। কিন্তু ধীরে ধীরে সে সতর্ক হতে শিখেছে। তাকে সবসময় পর্যবেক্ষণ করবে সেলিম। তাকে তার সিদ্ধান্ত গুলির পেছনের কারণ জিজ্ঞাসা করবে…তার কাছ থেকে সবকিছু শেখার চেষ্টা করবে।

এটা ওনার জন্য বলা খুব সহজ, সেলিম ভাবলো। কিন্তু মুখে সে বললো, আমি সব সময় দেওয়ান-ই-খাস এ যাই এবং বাবাকে সিংহাসনে বসে কথা বলতে দেখি। কিন্তু আমি বুঝতে পারি না লোকেরা তার সামনে অগ্রসর হওয়ার সাহস পায় কীভাবে। তাকে তখন আমার মনে হয় অন্তঙ্গতাবর্জিত দূরবর্তী কোনো মানুষ অনেকটা ঈশ্বরের মতো…

একজন শাসকের দায়িত্ব হলো আস্থা সৃষ্টি করা, মানুষকে বোঝান যে তিনি শ্রবণ করতে প্রস্তুত, হামিদা বললেন। মানুষ তার কাছে যায় কারণ তারা তাকে বিশ্বাস করে, তোমারও একই আচরণ করা উচিত।

 তোমার দাদী-আম্মা ঠিকই বলেছেন, গুলবদন বললেন। একজন শাসকের প্রজাদের প্রতি এমন ভাব প্রদর্শন করা দরকার যে তিনি তাদের নিয়ে চিন্তা করেন। এই জন্যই তোমার বাবা প্রতিদিন ভোরে ঝরোকা বারান্দায় হাজির হোন নিজেকে প্রজাদের সম্মুখে প্রদর্শন করার জন্য। এর দ্বারা শুধু এটাই প্রমাণ হয় না যে সম্রাট জীবিত আছেন বরং তাদের প্রতি তার বাৎসল্যও প্রকাশ পায়।

 তিনি যদি সত্যিই তার পিতা হোন তাহলে তার সঙ্গে কথা বলতে তার এতো ভয় লাগে কেনো? সেলিম ভাবলো। যখনই সে তার পিতার মুখোমুখী হয় তখনই তার মনে হয় তিনি তাকে যাচাই করছেন, তার অন্ত রে কি রয়েছে তা উদঘাটনের চেষ্টা করছেন, তার বুদ্ধি এবং জ্ঞানের পরিধি মাপার চেষ্টা করছেন।

কি হয়েছে সেলিম? তোমাকে বিষণ্ণ দেখাচ্ছে কেনো?, হামিদা জিজ্ঞাসা করলেন। তুমি বলছো বাবার সঙ্গে কথা বলতে কিন্তু সেটা আমার জন্য খুব কঠিন…আমি বুঝতে পারি না তিনি আমার বক্তব্য সাদরে গ্রহণ করবেন কি না। তাকে আমার সর্বদাই ত্রুটিহীন এবং পরিপাটি মনে হয়- পেশাকে এবং আচরণে। তাছাড়া তিনি সর্বদাই ব্যস্ত থাকেন, সভাসদ এবং সেনাপতিরা তাকে সব সময় ঘিরে রাখে। মাঝে মাঝে তিনি আমার পড়াশোনার খোঁজখবর নিতে আসেন কিন্তু যখন তিনি প্রশ্ন করেন আমি বিভ্রান্ত বোধ করি…বোকা হয়ে যাই…মনে হয় আমি যা বলব তা ওনার পছন্দ হবে না, ফলে আমি কোনো উত্তরই দিতে পারি না। এর ফলে তিনি আরো বেশি বিরক্ত হোন।

 শুধু এটাই কি তোমার সমস্যা? হামিদা হাসলেন। এতো বোকার মতো ভয় পাওয়ার কোনো কারণ তোমার নেই। মনে রেখো, তোমার বাবা। আমার ছেলে। সে সর্বদাই এমন গুরুগম্ভীর ছিলো না। এক সময় সে তোমার মতোই ছোট্ট বালক ছিলো, সঙ্গীদের সাথে খেলতে গিয়ে হাঁটু ছিলে ফেলত, পোশাক নষ্ট করে ফেলতো। সত্যি কথা বলতে কি লেখা পড়ায় সে তোমার তুলনায় অর্ধেক পারদর্শীও ছিলো না এবং তুমি তোমার পরিবেশ সম্পর্কে যতোটা কৌতূহলী তার মাঝে ততোটা কৌতূহলও ছিলো না। কিন্তু আমি জানি সে তোমাকে নিয়ে কতোটা গর্বিত। তোমার নিজেকে তুচ্ছ ভাবার কোনোই কারণ নেই।

সেলিম মৃদু হাসলো কিন্তু কোনো কথা বললো না। ওনারা বুঝতে পারছেন না। আর কেউ বুঝবে কীভাবে যখন সে নিজেই নিজের অনুভূতি গুলি বুঝতে পারে না?

*

তোমাকে দেখে আমি খুশি হয়েছি সেলিম। আমার সঙ্গে ছাদের উপর চলো। আমি সেখানে প্রার্থনা করতে যাচ্ছিলাম। সেলিম তার মায়ের সঙ্গে বালুপাথর নির্মিত পেচানো সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলো। হীরাবাঈ এর ডান হাতে ধরা মাটির প্রদীপটি থেকে যতোটা আলো আসছে তাতে সে কেবল মাত্র সিঁড়ির ধাপগুলি দেখতে পাচ্ছে, একটি বাঁক ঘুরার সময় সে হোঁচট খেলো। সে যখন সমতল ছাদে বেরিয়ে এলো দেখতে পেলো তার মা তার ছোট আকৃতির মন্দিরটির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে প্রার্থনা আরম্ভ করে দিয়েছে। মায়ের মাথার চুলের বেনীতে জেসমিন ফুলের মালা জড়ানো। তখন সন্ধ্যাবেলা, পরিবেশ খানিটা উষ্ণ এবং বাতাস বইছিলো না। আকাশের দিকে তাকিয়ে সেলিম চাঁদের ফ্যাকাশে রূপালী আলো দেখতে পেলো।

 হীরাবাঈ মেঝের কাছাকাছি নুয়ে প্রার্থনা করছিলো। যদিও তিনি কখনো কখনো নিজের হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাসের কথা বলতেন, সেলিমের কাছে সে সব অদ্ভুত মনে হতো, সে মুসলমান হিসেবে এক ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে বড় হচ্ছিল এবং দেব-দেবীর মূর্তি বা অঙ্কিত চিত্রকে তার অস্বস্তিকর মনে হতো। এক সময় হীরাবাঈ এর প্রার্থনা শেষ হলো। সে উঠে দাঁড়িয়ে সেলিমের দিকে ফিরলো। চাঁদটিকে দেখো। আমরা রাজপুতরা রাতের বেলা ওর সন্তান হয়ে যাই এবং দিনের বেলা আমরা সূর্যের সন্তান। চাঁদ অমাদের প্রদান করে সীমাহীন ধৈর্যশক্তি এবং সূর্য আমদের দান করে দুর্দমনীয় সাহস। হীরাবাঈ এর গাঢ় বর্ণের চোখের পাতা প্রকম্পিত হলো যখন সে সেলিমের দিকে চাইলো। সেলিম তার প্রতি তার মায়ের ভালোবাসার তীব্রতা অনুভব করতে পারলো এবং আশা করলে তিনি তাকে আলিঙ্গন করবেন, কিন্তু এটা তার স্বভাব নয় এবং তার বাহু দুটি তার দেহের দুপাশেই স্থির রইলো।

মা, তুমি সব সময় রাজপুতদের কথা বলো, কিন্তু আমি তো একজন মোগলও, তাই না? সেলিম তার মায়ের কাছে এসেছে এই জন্য যে সে আশা করছে তিনি হয়তো তার মনে সৃষ্টি হওয়া বিভ্রান্তি এবং অনিশ্চয়তার কিছুটা সুরাহা করতে পারবেন। এবং সে পরিচারকদের চোখে ফাঁকি দিয়ে একা এসেছে, তার ধারণা মায়ের সঙ্গে তার আলাপের বিবরণ বাবাকে জানানোর বিষয়ে তাদের উপর নির্দেশ রয়েছে।

একজন মোগল রাজপুত্র হিসেবে তুমি বড় হচ্ছ সে জন্য আমি অত্যন্ত ব্যথিত। তোমার শিক্ষকরা তোমার পিতামহ হুমায়ুন এবং প্রপিতামহ বাবরের বীরত্বের কাহিনী দিয়ে তোমার কান ভারী করছে- কীভাবে তারা ইন্দুস নদী অতিক্রম করলো এবং হিন্দুস্তান জয় করলো…

আমার বাবা যেহেতু হিন্দুস্তানের সম্রাট, আমাকে তো এই ভূখণ্ডের ইতিহাস জানতেই হবে, তাই না?

 নিশ্চয়ই। কিন্তু তোমাকে সত্যও জানতে হবে। তোমার শিক্ষকরা মোগল গোত্র গুলির বীরত্ব ও সাহস সম্পর্কে বহু প্রশংনীয় গল্প তোমাকে বলে কিন্তু তারা তো এ কথা বলে না যে, যা এক সময় রাজপুতদের ন্যায্য অধিকার ছিলো মোগলরা তা চুরি করেছে।

তুমি কি বোঝাতে চাইছো মা?

 তোমার বাবা তোমাকে এই ধারণা দিয়ে বড় করছে যে এই ভূখণ্ড তোমাদের। সে তোমাকে ভ্রান্ত ধারণা প্রদান করছে, তার উদ্ধত স্বভাব এবং অতিগর্ব দ্বারা সে নিজেও অনুরূপ বিভ্রান্ত। বাস্তবতা হলো মোগলরা গরুচোরদের সমতুল্য যারা রাতের অন্ধকারে দলবদ্ধভাবে অনুপ্রবেশ করে অন্যের সম্পদ লুট করে নেয়। তারা হিন্দুস্তানের এক দুর্বল মুহূর্তের সুযোগ নিয়েছে হামলা করার জন্য। মোগলরা দাবি করে তৈমুরের হিন্দুস্তান জয় তাদের এই ভূখণ্ড শাসন করার অধিকার দিয়েছে। কিন্তু তৈমুরের পরিচয় কি? সে উত্তর থেকে আগত আর একজন অসভ্য বর্বর ছাড়া অন্য কিছু তো নয়!

হিন্দুস্তানের প্রকৃত শাসক আমার জনগণ রাজপুতরা- তারা তোমারও স্বজাতীয় সেলিম। বাবর এবং তার যাযাবর উপজতির দল আমাদের ভূখণ্ডে আগ্রাসন চালানোর ঠিক আগমুহূর্তে রাজপুত রাজারা চিত্তরগড়ের রানা সাঙ্গার নেতৃত্বে একটি মিত্রজোট গঠন করছিলেন দুর্বল, আরামপ্রিয় লোদি শাসকদের সিংহাসন চ্যুত করে হিন্দুস্তানকে পুনরায় আমাদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য। হয়তো কোনো কারণে আমরা দেবতাদের বিরাগভাজন হয়েছিলাম এবং মোগল আগ্রাসন আমাদের উপর বর্ষিত দেবতাদের শাস্তি।

 মোগলরা লোদি রাজবংশকে পরাজিত করার পরেও আমাদের জনগণ লড়াই এর দুর্ধর্ষ পথ থেকে বিচ্যুত হয়নি। বাবর তাঁদের বিধর্মী বলে বিদ্রূপ করেছে কিন্তু তারা তাকে দেখিয়ে দিয়েছে হিন্দু যোদ্ধাশ্রেণী কতোটা বিক্রমের সঙ্গে লড়াই করতে পারে। তারা তাকে খানুয়াতে আক্রমণ করে এবং প্রায় পরাজিত করার উপক্রম করে। হীরাবাঈ এর চোখ জোড়া উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে যেনো সে নিজেও সেই রাজপুত যোদ্ধাদের সঙ্গে রক্ত ঝড়িয়েছে।

তুমি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলে তুমি একজন মোগল কি না, তাই না? হা তুমি মোগল, কিন্তু আংশিক। কখনও ভুলে যেও না তুমি যেমন আকবরের সন্তান তেমনি আমার সন্তান। এবং রাজকীয় রাজপুত রক্ত যা মোগল রক্তের তুলনায় হাজার গুণে পবিত্র- তা তোমার শিরায় প্রবাহিত। তুমি যে সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হওয়ার আশা করছে তা তোমার নাও হতে পারে…কারণ তোমার বাবা তোমার ভাইদের মধ্যে যে কাউকে সিংহাসনের জন্য নির্বাচন করতে পারে। তবে তোমারও পছন্দ করার সুযোগ রয়েছে…

সেলিম চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো, তার কি ভাবা উচিত সে বিষয়ে সে আরো বেশি বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। নিজের রাজপুত স্বজাতীয়দের সম্পর্কে তার মায়ের বিলাপ এবং মোগলদের বীরত্বগাথা সম্পর্কে তার শিক্ষকদের প্রদত্ত জ্ঞানের মধ্যে কোথায় সত্যের অবস্থান? এবং এই দুই ভিন্ন মতের মাঝে তার অবস্থানই বা কোথায়? মা কি তাকে এমন ইঙ্গিত দেয়ার চেষ্টা করেছেন যে, তার পিতার বড় ছেলে হওয়া সত্ত্বেও তাকে তার উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারেন এবং তার জীবনে এমন মুহূর্ত আসতে পারে যখন তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে মোগল ও রাজপুত উত্তরাধীকারের মধ্যে কোনটা সে বেছে নেবে? দ্বিতীয় ইঙ্গিতটি অর্থহীন কারণ এ বিষয়ে তার বাবার ঘোষণাটি তার মনে পড়লো। তিনি বলেছেন তার রাজ্যে সকলের অধিকার সমান এবং অবশ্যই তাদেরও সমান অধিকার রয়েছে যে সব রাজপুত মোগলদের মিত্র হিসেবে তাঁদের সঙ্গে জোটবদ্ধ।

কিন্তু মা, তোমার নিজের পরিবারের সদস্যরা অর্থাৎ অম্বরের রাজপরিবারও তো মোগলদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ- যেমন তোমার ভাই ভগবান দাশ এবং ভ্রাতুস্পুত্র মান সিং। মোগলদের সঙ্গে মিত্রতা করা যদি অসম্মানজনক হতো তাহলে কি তারা আমার বাবার সঙ্গে যোগ দিত?

আনেক মানুষকেই ক্রয় করা যায়…এমনকি রাজপুত মর্যাদাও। আমি আমার ভাই এবং ভাতিজার আচরণের জন্য লজ্জিত। হীরাবাঈ এর কণ্ঠস্বর ঠাণ্ডা শোনাল এবং সেলিম অনুভব করলো সে বোকার মতো তার মায়ের অহমিকায় আঘাত করেছে। তুমি এখন যেতে পার, কিন্তু আমি যে কথাগুলি বললোম সে বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করবে।

হীরাবাঈ সেলিমের দিক থেকে পিছন ফিরে পুনরায় পূজা করার জন্য তার মন্দিরের দিকে এগিয়ে গেলো। সেলিম এক মুহূর্ত ইতস্তত করলো, তারপর ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে নিচের উঠানের দিকে অগ্রসর হতে লাগলো। তার পিতা এবং মোগলদের সম্পর্কে মায়ের ঘৃণাপূর্ণ কথাগুলি তার কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। সে তার কিছু প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য মায়ের কাছে এসেছিলো কিন্তু উল্টো নিজের পরিচয় সম্পর্কে নতুন কিছু প্রশ্ন তার মনে যোগ হলো। প্রকৃতপক্ষে সে কোনো রাজবংশের উত্তরাধিকারী? ভবিষ্যতে সে কোনো ধরনের শাসকে পরিণত হবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *