২.১ সূর্য, চাঁদ এবং আগুনের সন্তান

দ্বিতীয় খণ্ড – সূর্য, চাঁদ এবং আগুনের সন্তান

০৬. সম্রাটের বিজয় অভিযান

এই মাত্র সূর্য ডুবেছে, আকাশে তখন হালকা গোলাপি আভা ছড়িয়ে পড়েছে, যে অনুষ্ঠান মঞ্চস্থ হতে চলেছে তার উপযুক্ত পটভূমিকা যেনো প্রকৃতি স্বয়ং রচনা করেছে, আকবর ভাবলেন। আগ্রার দূর্গের সম্মুখবর্তী কুচকাওয়াজের মাঠ বিভিন্ন রঙে রঞ্জিত পারসিক শতরঞ্জিতে ঢেকে ফেলা হয়েছে, দেখে মনে হচ্ছিলো যেনো একটি ফুল বাগান। মাঠের দুপাশে সারিবদ্ধভাবে সোনার পাত মোড়া কাঠের রেলিং-এর পিছনে আকবরের সেনাপতি এবং উচ্চপদস্থ সভাসদগণ দাঁড়িয়ে ছিলেন। আর সম্মুখে তৃতীয় দলটিতে উপস্থিত ছিলেন সেই সব শাসক যারা আকবরের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন। মধ্যবর্তী স্থানে সবুজ রেশমের শামিয়ানার নিচে মার্বেল পাথরের মঞ্চের উপর একটি বিশাল সোনার দাঁড়িপাল্লা স্থাপন করা হয়েছে। এর সোনার থালা দুটির এক একটি পাঁচ ফুট ব্যাপ্তি বিশিষ্ট এবং চারদিক হীরকাকার গোলাপ-সিলিকা এবং মুক্তা দ্বারা আবৃত। আট ফুট উঁচু ওক কাঠের কাঠামো থেকে মোটা শিকলে বাঁধা অবস্থায় পাল্লার থালাগুলি ঝুলছে।

দেহে সোনার কারুকাজখচিত সবুজ রঙের শক্ত আলখাল্লা, গলায় বাঁকা আকৃতির পান্না শোভিত মালা এবং মাথায় আলো বিচ্ছুরণকারী হীরকখচিত পাগড়ি পড়ে আকবর ঢাকের গম্ভীর শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দাঁড়িপাল্লাটির দিকে এগিয়ে গেলেন। জ্বেলে রাখা মশালের আলোতে দাঁড়িপাল্লার পাশে রাখা অনেকগুলি ঢাকনা খোলা সিন্দুক থেকে রাশি রাশি মণিমাণিক্য জ্বল জ্বল করছে। এই দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে আকবর সন্তুষ্ট হলেন। এছাড়াও মঞ্চের উপর বহু সোনা ও রূপার তৈরি শিকল কুণ্ডলী করে রাখা হয়েছে-যেনো এক একটি সাপ। সেইসাথে সোনা-রূপার কারুকাজ করা অনেকগুলি থলে ইচ্ছাকৃত ভাবে স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রায় উপচে ভরা হয়েছে সম্রাটের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের জন্য। মণিমাণিক্যের পাশে পিতলের তালায় থরে থরে সাজানো রয়েছে বিভিন্ন সুস্বাদু মশলা। এর পাশে জেড পাথরের পাত্রে রয়েছে দুপ্রাপ্য সুগন্ধী। আরো সাজানো রয়েছে কারুকার্যখচিত সূক্ষ্ম রেশমী কাপড়ের গাঁট।

 সেখানে আরেকটি জিনিস ছিলো-বিশটি বিশাল লৌহখন্ড। আকবর লক্ষ্য করলেন অনেকগুলি কৌতূহলী দৃষ্টি সেগুলি পর্যবেক্ষণ করছে। তিনি যখন মঞ্চের উপর উঠে দাঁড়িপাল্লার দিকে এগিয়ে গেলেন ঢাকের ছন্দবদ্ধ দামামা থেমে গেলো এবং শিঙ্গার একক ধ্বনি চারদিক প্রকম্পিত করলো। শিঙ্গার সংকেত লাভের সঙ্গে সঙ্গে পরিচারকগণ লৌহখণ্ড গুলি তুলে নিলো এবং দাঁড়িপাল্লার বিশাল একটি থালায় সেগুলি ভরতে লাগলো। লৌহখণ্ডের চাপে পাল্লার থালাটি মেঝে স্পর্শ করলো। আদম খানকে হত্যার পর দুই বছর পার হয়ে গেছে। এই দীর্ঘ সময়ের অধিকাংশ তিনি এই ভাবনায় ব্যয় করেছেন যে, কেনো তিনি আদম খানের বিশ্বাসঘাতকতার বিষয়টি পূর্বেই অনুমান করতে ব্যর্থ হয়েছেন এবং কীভাবে তিনি তার সভাসদগণের মধ্যে নতুন কোনো ষড়যন্ত্রের বিকাশ দমন করতে পারবেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন একটা কারণে তিনি আদম খানকে সন্দেহ করতে ব্যর্থ হয়ে ছিলেন, সেটা হলো আদম খান ও মাহাম আঙ্গা বাল্যকাল থেকে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত থাকার জন্য। বৈরাম খানের মৃত্যুর পর তাঁর কাছাকাছি এমন পর্যায়ে আর কেউ নেই। ভবিষ্যতে আর কাউকে তিনি এমন অবস্থানে আসতে দিবেন না এবং কাউকে এতোটা বিশ্বাসও করবেন না। তাকে তার নিজের অনুভূতির উপর নির্ভর করতে হবে। যদিও আদম খান ও মাহাম আঙ্গার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা আংশিকভাবে তাঁদের ষড়যন্ত্রের প্রতি তাঁর অন্ধত্বের কারণ কিন্তু তিনি নিজেও কম আত্মতুষ্ট ছিলেন না, নিজ ক্ষমতা ও মর্যাদা নিয়ে তিনি এততাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে, তিনি ভাবতে পারেননি কেউ তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে পারে।

 ভবিষ্যতে এ ধরনের গোলযোগ এড়ানোর জন্য একটি বুদ্ধি হঠাৎ করেই তার মাথায় আসে। একদিন তাঁর সেবক আকবরকে তাঁর পিতামহের স্মৃতি সম্বলিত বই পড়ে শোনাচ্ছিলো। বাবরের বিচক্ষণ মতামত গুলির মধ্যে দুটি বিষয় আকবরের মনোযোগ কাড়ে: যুদ্ধ এবং লুষ্ঠিত সম্পদ ব্যক্তিকে সৎ রাখে এবং তোমার অনুসারীদের প্রতি সদয় হও। তারা যদি অনুভব করে, যে অন্য কারো তুলনায় তোমার কাছ থেকেই তারা বেশি লাভবান হবে তাহলে তারা তোমার প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে। প্রকৃতপক্ষে কেউ যদি ষড়যন্ত্র থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে সফল হয়ে থাকেন তিনি হবেন বাবার এবং তাঁর কাছ থেকেই আকবরের শিক্ষা নেয়া উচিত। এ কারণেই তিনি সভাসদ, সেনাপতি এবং মিত্রদের আজ এখানে জমায়েত করেছেন তিনি তাদের বলবেন শীঘ্রই তিনি বিজয় অভিযান শুরু করতে চান যার ফলে রাজকীয় কোষাগারগুলি সোনা এবং রত্নে উপচে পড়বে এবং সেই অবশ্যম্ভাবী পুরষ্কারের সামান্য স্বাদ তিনি আজ তাদের প্রদান করতে চান। আকবর সংক্ষিপ্তভাবে হাসলেন তারপর হাত তুলে সবাইকে নীরব হতে বললেন।

পূর্বে আমার পিতা যেমনটা করেছেন অনুরূপভাবে হিন্দুস্তানের শাসকদের প্রথা অনুসারে আমি জনসম্মুখে মূল্যবান ধন-রত্নের সঙ্গে নিজেকে ওজন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি বছরে দুবার এই অনুষ্ঠান পালন করবো-একবার আমার চন্দ্র বছরের জন্মদিনে, যেটা আজকের দিন এবং আমার সৌর বছরের জন্মদিনে। ওজন করার পর ধন-সম্পদ গুলি আমন্ত্রিতদের মাঝে বিতরণ করা হবে। আজ এই কার্যক্রম আপনারা প্রত্যক্ষ করবেন। আপনাদের প্রতি আমার বিশেষ শুভেচ্ছা প্রদর্শনের জন্য আজকের এই প্রথম অনুষ্ঠানে আমি আপনাদেরকে আমার দেহের ওজনের তুলনায় বেশি ধন-সম্পদ প্রদান করবো। এই লৌহ খন্ডগুলির ওজন আমার ওজনের তুলনায় দ্বিগুণ। আকবর একমুহূর্ত সময় দিলেন তার কথাগুলি উপস্থিত সকলকে অনুধাবন করার জন্য। তারপর তিনি আসনসিঁড়ি হয়ে দাঁড়িপাল্লার খালি থালাটিতে বসলেন।

আকবরের পরিচারকগণ সঙ্গে সঙ্গে অপর থালাটি ভরা শুরু করলো এবং প্রথমে তারা সবচেয়ে মূল্যবান উপাদান গুলি তুলতে লাগলো। দশ সিন্দুক রত্ন উঁচু করে থালাটিতে জড়ো করার পর আকবরের বসে থাকা থালাটি ধীরে মেঝে থেকে উপরে উঠতে লাগলো। চারদিকে ভীষণ নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে এবং আকবর অনুভব করলেন সকলের দৃষ্টি তার উপর নিবদ্ধ, এবং প্রত্যেকে মনেমনে হিসাব করছে তাদের ভাগে লুটের মালের কতোটা অংশ আসবে। মোগল বংশ অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছে, তিনি চিন্তা করলেন, তখন রত্নগুলি সরিয়ে থালায় সোনা এবং রূপার শিকল ভরা হতে লাগলো এবং তারপর স্বর্ণমুদ্রার পোটলা। আগের সময়ে যুদ্ধ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রাপ্ত লুটের মাল পুরষ্কার হিসাবে প্রদান করা হতো, তখনো হয়তো শত্রুদের মৃতদেহ গুলিতে উষ্ণতা বজায় থাকতো। প্রত্যেক গোত্রপতি তার ভাগের লুষ্ঠিত সম্পদের উপর নিজের ঢাল রাখতে তারপর তা টেনে নিয়ে যেতো নিজের দলের লোকদের মধ্যে ভাগ করে দেয়ার জন্য। কিন্তু সেটা ছিলো এমন সময় যখন মোগলদের কোনো স্থায়ী আবাস ছিলো না। সেদিন এখন আর নেই। তিনি এখন হিন্দুস্তানের সম্রাট এবং তার উচিত অনুগামীদের অধিক পুরষ্কার প্রদান করা। সেটা কেবল যুদ্ধ অভিযানে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য নয় বরং সফলভাবে শাসনকার্য পরিচালনার জন্যেও।

 ওজন পর্ব শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মহামূল্যবান উপহার সমূহ বিতরণ করার কাজ শুরু হলো। গৃহস্থালির রসদ সংরক্ষক জওহর এর সহায়তায় আকবর হিসাব করেছেন প্রত্যেকে কতোটা সম্পদ পাবে এবং সে আকবরের নির্দেশে তা খাতায় লিপিবদ্ধ করেছে। আকবর দেখতে লাগলেন জওহর একে একে সকলের নাম ধরে ডাকছে এবং তার সভাসদ, সেনাপতি এবং মিত্ররা তাদের জন্য নির্ধারিত অর্থ, রত্ন এবং রেশমীকাপড় নিতে এগিয়ে আসছে। তাদের সন্তানদের জন্যেও উপহার ছিলো: সোনালী পতায় পেচানো খুবানি (বাদাম), খেলনা মোগল সৈন্য-অশ্বারোহী, তীরন্দাজ এবং বন্দুকধারী এবং কানে রূপার দুল পড়া মেয়ে পুতুল, গলার হার, বালা ইত্যাদি। দূরবর্তী প্রদেশগুলির রাজ্যপালদের পাঠানোর জন্যেও আকবর কিছু ধন-রত্ন সংরক্ষণ করার নির্দেশ দেন। এছাড়া সম্রাজ্যের শহরগুলিতে অবস্থিত শস্যভাণ্ডার গুলিতে পাঠানোর জন্যেও তিনি শস্য, চাল এবং তেল সংরক্ষণ করতে বলেন যাতে সাধারণ প্রজারাও তাঁর উদারতার ভাগ পায়। সেই দিন রাতে বিশাল উঠানের গোলাপজল প্রবাহিত ঝর্নাকে ঘিরে জমে উঠে রাজকীয় ভোজ সভা। সেখানে মখমল ঢাকা বেদির উপর সোনার আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে আকবর আমন্ত্রিতদের সঙ্গে ভোজে অংশ নেন। তাঁর দক্ষ বাবুর্চিদের তৈরি উপাদেয় খাবারে টেবিল ভরপুর। আস্ত ভেড়ার ঝলসানো মাংস, শুকনো ফল ও বাদামের উপর সাজানো রান্না করা হাঁস এবং তিতির জাতীয় পাখির মাংস, জাফরান ও উপাদেয় মসলা যুক্ত মাখনের আখনি, দৈ এবং মসলায় পাকানো মুরগি প্রভৃতি। প্রাচুর্যের আরেক মাত্রা যোগ করার জন্য আকবর নির্দেশ দেন থালায় রাখা বিনিয়ানির ঢিবির চারদিকে রত্ন ছড়িয়ে রাখার জন্য। ঘি দিয়ে পাকানো বিরিয়ানিতে কিসমিস, আলুবোখারা, খোবানি, পেস্তাবাদাম প্রভৃতি যোগ করা হয়েছে। কাবুল থেকে বিশেষ ভাবে বরফসহ মোড়কে বেঁধে তাজা আঙ্গুর এবং তরমুজও আনা হয়েছে।

আকবর অপেক্ষা করলেন যততক্ষণ পর্যন্ত না বেশিরভাগ অতিথি মুখ মুছে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। এখন সময় হয়েছে তাঁদের কাছে তাঁর পরিকল্পনার কথা বলার। তাঁদের উজ্জ্বল পরিতৃপ্ত মুখগুলি যখন আকবরের দিকে ফিরলো তখন তিনি এমন আত্মবিশ্বাস অনুভব করলেন যে তারা যেকোনো স্থানে তাকে অনুসরণ করতে রাজি হবে।

 এখন আমি আপনাদেরকে আমার ইচ্ছার কথা জানাতে চাই। আমার পিতামহ বাবর হিন্দুস্তান জয় করার পর চল্লিশ বছর পার হয়ে গেছে। অকালমৃত্যুর কারণে তিনি তাঁর রাজ্যের সীমা বাড়াতে পারেননি এবং একই কারণে আমার পিতাও একাজে অগ্রগতি সাধন করতে পারেননি। কিন্তু আমি তরুণ এবং আমার পূর্বপুরুষের যোদ্ধারক্ত আমার শিরায় সবলভাবে স্পন্দনরত। এর কাছ থেকে আমি নির্দেশনা পাই যে একটি টেকসই এবং দীর্ঘস্থায়ী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করাই আমার নিয়তি। এমন একটি সাম্রাজ্য যাকে কেবল একটি যুদ্ধের সাহায্যে পরাজিত করা সম্ভব হবে না বরং অনাগত শতাব্দীগুলিতে বিস্ময়কর মর্যাদায় মাথা উঁচু করে প্রতিষ্ঠিত থাকবে।

এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের একমাত্র উপায় রাজ্য জয় করা। আজ আমি আমাদের সাম্রাজ্যের কিছু ধন-সম্পদ আপনাদের প্রদান করেছি, কিন্তু আগামী বছর গুলিতে আমি আপনাদের যে সোনা ও মহিমা উপহার দেবো তার তুলনায় এই পরিমাণ খুবই সামান্য-আপনাদের সহায়তায় আমি যখন মোগল সাম্রাজ্যের পরিধি বৃদ্ধি করবে তখন আপনারা সেটা স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন। আমার রাজত্ব বিস্তৃত হবে পূর্ব থেকে পশ্চিমে, সাগর থেকে সাগরে। দক্ষিণ দিকে তা দাক্ষিণাত্যের বিশাল মালভূমি ছাড়িয়ে গোলকোন্দার হীরক খনি পর্যন্ত বিস্তৃত হবে এবং সেই উৎকৃষ্ট হীরা আমার সিংহাসনে এবং আপনাদের স্ত্রী ও রক্ষিতাঁদের দেহে দীপ্তি ছড়াবে। এসব অলস দম্ভোক্তি নয়। এখানে আপনাদের সকলের সামনে আমি শপথ করছি নতুন ভূখণ্ড পরাভূত করার কেবল আমাদের সীমান্ত বর্তী ছোট ছোট গোত্র গুলি নয় যারা মনে করে আমাদের বিরোধীতা করে তারা পার পেয়ে যাবে, বরং সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী রাজ্য গুলিও। যদি তারা তাদের গর্বিত মস্তক মোগল আধিপত্যের কাছে নত করে তাহলে তারা আমাদের ক্ষমা, সম্মান এবং মহত্ত্বের অংশিদার হতে পারবে। কিন্তু যদি তারা প্রতিরোধ করে তাহলে আমার সেনাবাহিনী তাদের যোদ্ধাদের হাড় চূর্ণ করে ধূলায় মিশিয়ে দেবে এবং তাঁদের প্রাসাদ ও দূর্গকে ধ্বংসতূপে পরিণত করবে।

তাই আমি আহ্বান করছি, আপনারা সকলে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হোন! প্রথমে যে আমাদের ক্ষমতার তেজ অনুভব করবে সে হলো মেওয়ার এর রানা উদয় সিং, রানা সাঙ্গার পুত্র। রানা সাঙ্গাকে আমার পিতামহ বাবর চল্লিশ বছর আগে যুদ্ধে পরাজিত করেছিলেন। মেওয়ার এর রানারা দাবি করে তারা রাজপুতদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। অন্যান্য রাজপুত রাজারা বহু দিন আগে থেকেই আমাদের বশ্যতা স্বীকার করে আসছে। কিন্তু উদয় সিং এখন আমাদের প্রতি প্রকাশ্যে বিদ্রোহী আচরণ প্রদর্শন করছে। তার যোদ্ধারা কয়েকদিন আগে মোগল বণিকদের গুজরাট উপকূলগামী একটি কাফেলায় আক্রমণ করে। আমি উদয় সিং এর কাছে এরজন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করলে সে আমাকে একটি অপমানজনক বার্তা পাঠায়: তুমি উত্তরের অসভ্য ঘোড়া চোরদের বংশধর। কিন্তু আমি ভগবান রামের উত্তরসূরি এবং সেই সূত্রে চন্দ্র, সূর্য এবং আগুনের সন্তান। কাজেই আমার উপর তোমার কোনো কর্তৃত্ব নেই।

 উদয় সিং টের পাবে তার উপর আমার কর্তৃত্ব আছে কি নেই। আগামী তিন মাসের মধ্যে আমরা আমাদের সামরিক প্রস্তুতি শেষ করে উদয় সিংকে উপযুক্ত শাস্তি প্রদানের জন্য অভিযান চালাবো। কিন্তু আজ আপনারা উপভোগ করুন আপনাদের জন্য যে আমোদের ব্যবস্থা আমি করেছি! উপস্থিত সকলে আকবরের সমর্থনে উল্লাসধ্বনি করে উঠলো, আকবর তাঁর পান্নাখচিত পান পাত্রটি উঁচিয়ে ধরে বললেন, মোগলদের জয় হোক।

*

আট সপ্তাহ পরের ঘটনা। আকবর ও আহমেদ খান আগ্রার দূর্গের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। সূর্যের তীব্র আলোর কারণে আকবরের চোখ গুলি কুচকে ছোট হয়ে আছে। তিনি সেখান থেকে যমুনা নদী পারের শুকনো মাটিতে প্রশিক্ষণরত একদল সৈন্যকে দেখছিলেন। সৈন্যরা সারিবদ্ধভাবে একজনের পিছনে আরেকজন ঘোড়ার পিঠে বসে ছিলো। তাদের সামনে মাটিতে একসারিতে পাঁচ গজের ব্যবধানে বিশটি বর্শা গাঁথা ছিলো। এক একজন সৈনিক গেঁথে রাখা বর্শাগুলির মধ্য দিয়ে তীব্র বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে আকাবাঁকা পথে এগিয়ে যাচ্ছিলো। শেষ বর্শাটির কাছে পৌঁছে তারা নিজেদের ভারসাম্য ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে রেকাবে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছিলো এবং সেখান থেকে প্রায় দশ গজ দূরে স্থাপিত একটি খড়ের মানবাকৃতিতে তাদের বর্শা ছুঁড়ে মারছিলো। প্রত্যেকে লক্ষভেদে সফল হচ্ছিলো।

 চমৎকার, আকবর বলে উঠলেন। সেনাবাহিনীর যাত্রা শুরু করতে আর কতোদিন লাগতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

আর এক মাস-এর আগেও হতে পারে। যদিও আমাদের গোলন্দাজদের নতুন নকশার বড় আকারের কামানে গোলার ভরার প্রশিক্ষণের জন্য আরো কিছু দিন সময় প্রয়োজন। এই নতুন ধরনের অধিক শক্ত নল বিশিষ্ট কামান গুলি তুর্কী কারিগরেরা আমাদের ঢালাই কারখানায় প্রস্তুত করেছে। এছাড়া লাহোরের দক্ষ বন্দুক কারিগরদের কাছে ফরমায়েশ করা অতিরিক্ত গাদাবন্দুক গুলিও, এসে পৌঁছায়নি। নিশানা দূরত্ব বাড়াতে এই নতুন বন্দুকগুলিতে বর্তমান বন্দুকের তুলনায় দ্বিগুণ বারুদ ভরা যাবে-একথা আমাকে জানানো হয়েছে এবং সেগুলি হাতে বিস্ফোরিত হওয়ার ভয়ও নেই। ওগুলি যখন আমাদের হাতে এসে পৌঁছাবে তখন আমাদের আশেপাশে হাজার মাইলের মধ্যে অমাদের মতো শক্তিশালী আর কোনো সেনাবাহিনী থাকবে না। এমনকি আমরা পারস্যের শাহ্দের চেয়েও অধিক ক্ষমতাধর বলে বিবেচিত হবে।

যমুনা পারে প্রশিক্ষণরত একজন সৈন্য যখন মাটিতে গেঁথে রাখা বর্শাগুলি তুলে নিল তখন সমগ্র দলটি নতুন করে সম্ভব হলো। এখন তারা সারিবদ্ধভাবে মাটিতে সাজানো মাটির পাত্র ছুটন্ত ঘোড়া থেকে বর্শায় গেঁথে তুলে নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু এবারে তাদের প্রচেষ্টা আগের মতো ভালো হলোনা। একজন ঘোড়সওয়ার লক্ষচ্যুত হয়ে তার বর্শাটি মাটিতে গেঁথে ফেলায় ডিগবাজী খেয়ে ঘোড়ার পিঠ থেকে উল্টে পড়লো এবং পিঠে প্রচণ্ড ব্যথা পেলো।

আকবর হাসলেন। তার নিজের দেহেও আঘাতের অনেক চিহ্ন আছে। তিনি এখন নিয়মিত প্রশিক্ষণ করছিলেন। গাদাবন্দুক, তলোয়ার এবং যুদ্ধকুঠার নিয়ে তিনি অনুশীলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন যততক্ষণ পর্যন্ত না সেগুলিকে তাঁর নিজের শরীরের অংশ মনে হচ্ছিলো। তিনি তাঁর সেনাকর্তাদের সঙ্গে কুস্তিও লড়ছিলেন। প্রথমে তারা আকবরকে সমীহ করার কারণে তাঁকে মাটিতে আছড়ে ফেলতে ইতস্তত করছিলো। কিন্তু আকবরের দক্ষতা, গতি এবং কৌশলের চাপে পড়ে শীঘ্রই তারা সব ব্যবধান ভুলে গেলো।

দ্রুত গাঢ়লাল বর্ণ ধারণ করতে থাকা আকাশের দিকে একপলক তাকালেন আকবর। আর মাত্র আধ ঘন্টা পরেই চারদিক অন্ধকার হয়ে আসবে। আদম খান আমি নদী তীরের ঐ সৈন্যগুলির সঙ্গে পোলো খেলতে চাই। কিন্তু এখনতো সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।

 একটু ধৈর্য্য ধরুন, তারপর বুঝতে পারবেন।

আধ ঘন্টা পর, সাধারণ জোব্বা এবং পাজামা পড়ে, একটি ছোট আকারের কিন্তু পেশীবহুল বাদামি রঙের ঘোড়ায় চড়ে আকবর দূর্গ থেকে বেরিয়ে এলেন। তিনি কুচকাওয়াজের মাঠ পার হয়ে নদী তীরের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। পোলো খেলার সরঞ্জাম নিয়ে তাঁকে অনুসরণ করছে পরিচারকরা। নদীর তীরে পৌঁছে আকবর ঘোড়ার পাঁজরে মৃদু গুতো দিয়ে সেটাকে অর্ধবল্পিত (দ্রুততম গতির তুলনায় কিছুটা কম গতি) গতিতে ছুটালেন এবং কিছুটা দূরে থাকা ঘোড়সওয়ারদের কাছে উপস্থিত হলেন। সম্রাটকে দেখে তারা ঘোড়া থেকে নেমে অভিবাদন জানানোর উদ্যোগ নিলো।

না। তোমরা জিনের উপরেই থাক। আমি একটা পরীক্ষা চালাতে চাই, আকবর বললেন।

আধারের কালচে নীল ছায়া যখন নদীটিকে ঢেকে দিলো তখন আকবর তাঁর পরিচারকদের আদেশ দিলেন তাঁর অভিনব পোলো খেলার আয়োজন সম্পন্ন করার জন্য। তারা উপস্থিত লোকগুলির মাঝে পোলো খেলার লাঠি বিতরণ করলো, গোলের লাঠিগুলি গেড়ে তার পাশে মশাল পুতে দিলো এবং অবশেষে কয়লা জ্বালা পায়াওয়ালা ধাতব ঝুড়ির মধ্যে পোলো খেলার কাঠের বলটি রাখল। বলটি রাখার প্রায় সাথে সাথেই সেটা ধিকি ধিকি করে জ্বলতে লাগলো, কিন্তু চার পাঁচ মিনিট পরেও সম্পূর্ণরূপে অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হলো না। আকবর হাসলেন। তাহলে তৈমুরের গল্পটি সত্যি! যুদ্ধযাত্রার ঘোষণা প্রদানের পর বেশ কিছুদিন সন্ধ্যায় আকবর তাঁর কোর্চিকে(ব্যক্তিগত সেবক) তৈমুরের বীরত্বপূর্ণ অভিযানের লিখিত উপাখ্যান পড়ে শোনাতে বলেন। উদ্দেশ্য, যদি কোনো ব্যতিক্রমী বিষয় তিনি তার মহান পূর্বপুরুষের অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে পারেন। সেখানে উল্লেখ ছিলো তৈমুর দৈবক্রমে আবিষ্কার করেন যে, সোমরাজ গাছের শক্ত কাঠে আগুন দেয়া হলে তা ধিকি ধিকি করে কয়েক ঘন্টা ধরে জ্বলে। তখন তৈমুর তার যোদ্ধাদের আদেশ দেন সোমরাজ গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি জ্বলন্ত বল নিয়ে সারারাত পোলো খেলার জন্য। এভাবে তিনি তাদেরকে যুদ্ধের জন্য সবল করে তুলতেন। এই কাহিনী শোনার পর থেকে নিজেই বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখার জন্য আকবর উদগ্রীব ছিলেন।

বলটি মাটিতে ছুঁড়ে ফেলো, আকবর আদেশ দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে একজন পরিচারক লম্বা সাঁড়াশি দিয়ে বলটি ঝুড়ি থেকে তুলে ছুঁড়ে দিলো। আগেই আকবর সেদিকে ঘোড়া ছুটিয়েছেন এবং কাছে পৌঁছে তিনি জ্বলন্ত গোলকটিকে পোলোর ডাণ্ডা দিয়ে আঘাত করলেন। খেলা শুরু, তিনি চিৎকার করলেন। শীঘ্রই আধার ঘেরা নদীর তীরটিতে ঘোড়ার খুরের শব্দ প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো এবং সেই সঙ্গে হাস্যরত মানুষের উল্লসিত চিৎকার। খেলা চললো ততক্ষণ পর্যন্ত যখন চাঁদ আকাশের অনেক উপরে পৌঁছে যমুনার কাদাজলকে তরল রূপায় পরিণত করলো।

সেদিন রাতে যখন হেকিম আকবরের আড়ষ্ট পেশীগুলি গরম তেল দিয়ে মালিশ করছিলো তখন আকবর চিন্তা করছিলেন কেনো তৈমুর একবারও যুদ্ধে পরাজিত হননি। তিনি অপ্রত্যাশিতভাবে আক্রমণ করতে পছন্দ করতেন- আঘাত এবং তারপর পলায়ন। এভাবেই তিনি সমগ্র এশিয়াতে তাঁর আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন, কোনো বস্তুগত বা মানুষের বাধা তা যতোই শক্তিশালী হোক, তার অগ্রগতিকে প্রতিহত করতে পারেনি। বরফে জমাট বাধা হিন্দুকুশ পর্বতের খাড়া ঢাল বেয়ে নামার সময় তিনি মানুষখেকো উপজাতিদের আক্রমণ এতো সহজে মোকাবেলা করেছেন যেনো তিনি তাঁর লোমশ পোষাকের গা থেকে মাছি তাড়িয়েছেন।

 তৈমুরের যুদ্ধ কৌশলগুলি হয়তো রানা উদয় সিং এর মতো আধুনিক শক্রদের মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না যারা কামান দ্বারা সুসজ্জিত এবং মরুভূমিতে গড়ে তোলা উঁচু দেয়াল বিশিষ্ট দূর্গে অবস্থান করছে, আকবর ভাবলেন। কিন্তু তৈমুরের আত্মবিশ্বাস এবং লক্ষ থেকে বিচ্যুত না হওয়ার চূড়ান্ত প্রত্যয় দুশ বছর আগে যেমন ছিলো, এখনো তেমনি ভাবে কার্যকরী। যোদ্ধা পূর্বপুরুষের সমকক্ষ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা এমন দুরন্ত শক্তিতে আকবরের রক্তের শিরায় চঞ্চলতা সৃষ্টি করছিলো যে তিনি হেকিমের মালিশরত হাতের নিচে স্থির থাকতে পারছিলেন না। কিন্তু সেই দিন আর বেশি দূরে নয় যখন আগ্রা দূর্গের সিংহদ্বার থেকে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠবে এবং মোগল সৈন্যরা দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত রাজস্থানের ফ্যাকাশে কমলা বর্ণের মরুভূমি দিয়ে মেওয়ার এর দিকে যাত্রা করবে উদ্ধত রানাকে শায়েস্তা করার জন্য। আকবরের মা হামিদা তাঁর কাছে রাজস্থানের মরুভূমির এতো পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন যে তিনি আগ্রায় বসেই সেখানকার শুষ্ক বালুময় বাতাস এবং সেখানে বিচরণকারী ময়ূরের কর্কশ ডাকের আবহ অনুভব করছেন। রাজস্থান সম্পর্কে হামিদার এই সুগভীর জ্ঞান অস্বাভাবিক কিছু নয়। তিনি সেখানকার একটি ছোট মরুশহরে আকবরকে জন্ম দিয়েছেন যখন তিনি এবং হুমায়ুন রাজপুত রাজার ধাওয়ার মুখে আত্মগোপন করেছিলেন। ঐ রাজা শপথ নিয়েছিলো সে আকবরকে হামিদার গর্ভ থেকে জীবন্ত কেটে বের করে অজাত (এখনো যার জন্ম হয়নি) শিশুটিকে শের শাহ্ এর কাছে উপহার হিসেবে পাঠাবে। শের শাহ্ সেসময় হুমায়ূনকে সিংহাসন চ্যুত করেছিলো।

সেই রাজপুত রাজা এখন মৃত। কিন্তু উদয় সিংকে দমন করা এবং মেওয়ার এর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করা তখন সময়ের দাবি। আগ্রা থেকে দক্ষিণ দিকে যাওয়ার একমাত্র পথে মেওয়ার এর অবস্থান হওয়ায় কৌশলগত ভাবে এর গুরুত্ব অপরিসীম। কল্পনার চোখে আকবর দেখতে পেলেন তাঁর সৈন্যরা উদয় সিং এর রাজধানী চিত্তরগড় দূর্গের দরজা আঘাত করে ভেঙ্গে ফেলছে, যেখানে তার পরিবার আটশ বছর ধরে বসবাস করছে। রাজপুতদের নেতা উদয় সিংকে পরাজিত করতে পারলে সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে তাঁকে সকলে ভয় পাবে এবং সম্মান করবে এবং আর কেউ তার বিরোধীতা করার সাহস পাবে না।

.

০৭. জাফরানী যোদ্ধা

ডিসেম্বরের এক মেঘশূন্য দিন। তখন ভোরবেলা, আকবর মেওয়ার এর রানার বিশাল দুর্গ-শহর চিত্তরগড়ের দিকে তাকিয়ে ছিলেন-তার পাশে আহমেদ খান দাঁড়িয়ে আছেন। দুর্গের বালুপাথরের দেয়াল তিন মাইলের বেশি দীর্ঘ। রাজস্থানের শুষ্ক মালভূমি থেকে খাড়া পাঁচশ ফুট উপরে পাথুরে দেয়াল নিয়ে বর্ধিত হয়ে আছে দুর্গের কাঠামো। দুর্গপ্রাচীরের ভিতর রয়েছে মন্দির, রাজপ্রাসাদ, বাড়িঘর, বাজার এবং সেনা শিবির।

ইতোমধ্যে ছয় সপ্তাহ ধরে দুর্গশহরটিকে অবরোধ করে রাখার পরও কোনো প্রতিক্রিয়া না হওয়ায় আকবর ভীষণ হতাশ হয়েছেন। প্রাথমিক ভাবে তিনি নিজেদের অগ্রগতিতে সন্তুষ্ট ছিলেন। তারা চিত্তরগড়কে সম্পূর্ণরূপে ঘিরে ফেলেছেন, শহরগামী খাদ্যসরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে এবং রাজপুতদের পাঠানো অনুসন্ধানী দলের সদস্যদের হয় বন্দী করা হয়েছে নয়তো হত্যা করা হয়েছে। বন্দীদের কাছ থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও পাওয়া গেছে। একটি দশ বছর বয়সি হাড্ডিসার বালক তার দুই বড়ভাই সহ ধরা পড়েছে। তারা মরিয়া হয়ে দূর্গের বাইরের দিকের দেয়াল বেয়ে নেমে এসেছিলো খাদ্যের সন্ধানে। আকবরের সৈন্যরা বালকটিকে তার ভাইদের কাছ থেকে পৃথক করে ফেলে এবং সদ্য ঝলসানো ভেড়ার মাংসের লোভ দেখায়। অনেক মিষ্টি কথায় প্ররোচিত করার পর সে বলে, উদয় সিং নিজে প্রতিরোধকারী সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব প্রদান করছে না। জয় মাল এবং পাট্টি নামের দুইজন সেনাপতিকে সে এ দায়িত্বে নিযুক্ত করেছে। বালকটি আরো বলে, উদয় সিং আরাভাল্লি নামক পার্বত্য এলাকায় নিজের নামানুসারে উদয়পুর নামের একটি নতুন রাজধানী নির্মাণে ব্যস্ত আছে।

বালকটির ভাইয়েরা যখন জানতে পারলো সে তথ্য প্রকাশ করে দিয়েছে তখন তারা তাদের ছোটভাই এর প্রতি যে প্রতিক্রিয়া দেখালো তাতে রাজপুতদের নৈতিকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটলো। তারা বালকটিকে আক্রমণ করে তার গলাটিপে মারার চেষ্টা করে কিন্তু রক্ষীরা বাধা দেয়ায় ব্যর্থ হয়। কিন্তু পরের দিন তারা আবারও আক্রমণ করে যখন তাদের তিনজনকে অন্যান্য বন্দীদের সঙ্গে অবরোধ তৈরির জন্য পাথর ভাঙ্গার কাজে নিয়োগ করা হয়। এবারে সবচেয়ে বড় ভাইটি বালকটির মাথায় পাথর দিয়ে আঘাত করে মারাত্মক ক্ষত সৃষ্টি করলো। যখন আক্রান্ত বালকটির কাছ থেকে তার ভাইকে সবলে টেনে সরানো হচ্ছিলো সে চিৎকার করে বলে, তুমি নাস্তিক আক্রমণকারীদের কাছে তথ্য ফাঁস করেছে। তুমি আর আমার ভাই নও। এমনকি তুমি এখন এক নজন রাজপুতও নও।

আকবর ঘটনাটি শুনে বালকটিকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে, ভালো কাপড় পড়িয়ে শিবিরের রান্নাঘরে কাজে নিয়োজিত করার আদেশ দেন। এসম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেন, খাবারের প্রতি দুর্বলতার কারণে চিত্তরগড়ের আক্রমণকারীদের রান্নাঘরে কাজ করা তার উপযুক্ত নিয়তি। কিন্তু বালকটির কাছ থেকে চিত্তরগড়ে প্রবেশ করার কোনো গোপন পথ সম্পর্কিত তথ্য উঘাটন করা গেলো না। বয়স্ক বন্দীদের বলপূর্বক জিজ্ঞাসাবাদ এবং নির্যাতন করেও এ জাতীয় কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। হয়তো সেখানে প্রবেশের কোনো গোপন পথ আদতে নেই।

আকবর এবং তাঁর সেনাপতিরা দুর্গে আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিলো, কিন্তু তার শুরুর দিকের সাফল্যের আশা ক্রমশ বিলীন হয়ে যাচ্ছিলো। তিনি আদেশ দিয়েছিলেন দুর্গ থেকে বর্ষণ করা কামানের গোলার বিপরীতে তার সৈন্যরা ঢেউ এর পরে ঢেউ এর মতো করে আক্রমণ চালাবে। উদ্দেশ্য মালভূমি থেকে শহরের প্রধান ফটক পর্যন্ত পাঁচশ গজ দীর্ঘ সর্পিলভাবে উপরের দিকে প্রসারিত পথটিকে আঘাত করা। প্রধান ফটকটি পাহাড়ের বর্ধিত অংশের শীর্ষে অবস্থিত। কিন্তু আকবরের আক্রমণকারী সৈন্যদের কেউ পথটির নিচ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছিলো না। যখনই তারা ঘোড়া ছুটিয়ে পথটির দিকে অগ্রসর হচ্ছিলো-আকবর অসহায়ভাবে দেখছিলেন, কমলা রঙের পাগড়ি পরিহিত রাজপুতরা মোগলদের ছোঁড়া কামান এবং গাদা বন্দুকের তোপ উপেক্ষা করে চিত্তরগড়ের প্রতিরক্ষা প্রাচীরের পেছন থেকে মোগল সৈন্যদের দিকে গাদাবন্দুকের গুলি এবং বৃষ্টির মতো তীর ছুঁড়ছিলো। এতে মোগল সৈন্য এবং তাঁদের ঘোড়াগুলি বিপুল সংখ্যায় মারা পড়ছিলো অথবা আহত হচ্ছিলো এবং অনেক আহত সৈন্য দুর্গের সামনের উন্মুক্ত স্থানে পড়ে থাকছিলো। হতাশ আকবর দেখছিলেন তাঁর আরো সৈন্য মারা পড়ছে যখন তারা তাদের আহত সঙ্গীদের নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে আসার চেষ্টা করছিলো।

উদ্ধার প্রচেষ্টা চালাতে গিয়ে ক্রমান্বয়ে এতো সৈন্যের মৃত্যু হলো যে আকবর অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাধ্য হলেন সেনা কর্তাদের আদেশ করতে যাতে তারা অন্ধকারের আড়াল ছাড়া উদ্ধার কার্য চালাতে না দেয়। রাজপুতরা এতো সফল ভাবে মোগল সৈন্যদের আহত বা হত্যা করছিলো যে মনে হচ্ছিলো চাঁদের আলোতেও তারা ভালো দেখতে ও শুনতে পাচ্ছে।

 পরবর্তী দিন গুলিতে মোগল সৈন্যদের আক্রমণ অব্যাহত থাকলো কিন্তু আহত সৈন্যদের সাহায্যের আবেদন, পানি খাওয়ার আকুতি এবং শেষ মুহূর্তে তাদের মা ও আল্লাহর কাছে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি লাভের প্রার্থনা আকবর এবং তাঁর সেনাকর্তাদের ভীষণ কষ্ট দিতে লাগলো। আহত ঘোড়াগুলির যন্ত্রণাক্লিষ্ট হেষাধ্বনিও একই রকম কষ্টদায়ক মনে হচ্ছিলো। ছড়িয়ে থাকা মৃতদেহগুলিকে মাছির ঝাক ঘিরে ধরছিলো এবং সেগুলি থেকে তীব্র দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিলো। এই দুর্গন্ধ আকবরের শিবিরের চারপাশের বাতাস বিষাক্ত করে তুললো এবং তা থেকে খানিকটা রেহাই পাওয়ার জন্য তিনি চন্দন কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালাতে আদেশ দিলেন।

 হার না মানার দৃঢ় সংকল্পে আকবর সকালে ও সন্ধ্যায় তাঁর শিবিরে ঘুরে ঘুরে টহল দিচ্ছিলেন সৈন্যদের উৎসাহ প্রদানের জন্য। তিনি রাতের বেলা পাথর এবং মাটি ছুঁড়ে ঢিবি বা অবরোধ তৈরির আদেশ দিয়েছিলেন যাতে দিনের আক্রমণের সময় সেগুলির আড়াল পাওয়া যায়। যদিও সৈন্যরা আহত বা নিহত হয়ে দুর্গগামী ঢালু পথটির গোড়ায় পৌঁছাতে পেরেছিলো কিন্তু তারা আর অগ্রসর হতে পারছিলো না, বরং প্রতি আক্রমণের চাপে তারা বাধ্য হচ্ছিলো পিছিয়ে এসে ঢিবির আড়ালে আশ্রয় নিতে এবং সম্ভব হলে আহতদের সাথে করে নিয়ে আসতে।

একদল দক্ষ মোগল যোদ্ধা দুর্গগামী পথটিতে পুনরায় আঘাত হানার জন্য সঙ্ঘবদ্ধ হচ্ছে। এবার আকবর এবং তাঁর সেনাপতিরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আক্রমণের অগ্রভাগে হাতি ব্যবহার করবেন। সৈন্যরা হাতির পিঠের হাওদার উপর উঠতে লাগলো। সাফল্যের সম্ভাবনা বৃদ্ধির জন্য হাতিগুলিকে সাধারণের তুলনায় অধিক পুরু ইস্পাতের বর্ম পড়ানো হয়েছে। হাওদাতেও ভারী কাঠের আস্তরণ যোগ করা হয়েছে এতে অবস্থানকারী বন্দুকধারী ও তীরন্দাজদের নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য। হাওদাগুলি সৈন্য দ্বারা পূর্ণ হওয়ার পর হাতিগুলির কানের পিছনে ঘাড়ের উপর বসে থাকা মাহুতেরা বিশেষ কায়দায় টোকা মেরে তাঁদের দাঁড়ানোর সংকেত দিলো। পিঠে ও শরীরে অতিরিক্ত বোঝা নিয়ে অনেক ধীরে গদাইলস্করি চালে হাতি গুলি উঠে দাঁড়াতে লাগলো। হাতির পেছনে পদাতিক এবং অশ্বারোহী যোদ্ধারাও সঙবদ্ধ হচ্ছিলো।

আকবর তার উঁচুপাটাতনের উপর থেকে দেখতে পেলেন চিত্তরগড়ের প্রতিরোধকারীরা দুর্গের রক্ষাপাচিলের কাছে বিপুল সংখ্যায় সঙ্ঘবদ্ধ হচ্ছে। তারা আঁচ করতে পেরেছে তাদের উপর আরেকটি আক্রমণ শুরু হতে যাচ্ছে। মোগলরা বন্দুকের সীমানার বাইরে থাকলেও রাজপুতরা দুর্গ থেকে তাঁদের দিকে তীর বর্ষন করলো। অনেক তীর গতি হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেলো এবং হাতি বা সৈন্যদের বর্ম ভেদ করতে পারলো না, বাকিগুলি ঢাল দিয়ে প্রতিরোধ করা হলো। কিন্তু কিছু তীর ঘোড়াগুলিকে এবং অপেক্ষাকৃত কম প্রতিরোধ বিশিষ্ট পদাতিক সৈন্যদের আহত করলো।

আহমেদ খান, আক্রমণে সফল হওয়ার জন্য আমাদের এখনই অগ্রসর হওয়া উচিত। হাতিগুলিকে সামনে আগানোর আদেশ দিন এবং তাদের রক্ষা করার জন্য কামান ও তীর ছুঁড়তে বলুন। আমি অশ্বারোহীদের প্রথম দলের সঙ্গে হাতিবাহিনীর পিছু পিছু অগ্রসর হবো।

আহমেদ খানের নির্দেশ পেয়ে অতিরিক্ত বোঝায় ভারাক্রান্ত হাতিগুলি ধীরে শুষ্ক পাথুরে মাটির উপর দিয়ে অগ্রসর হতে লাগলো। এবারও প্রতিরোধকারীদের তীরের আক্রমণ তেমন সফল হলোনা। তীরগুলি হাতির ইস্পাতের বর্মে বাড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলো কিম্বা কোনো ক্ষতি না করে হাওদার কাঠের আচ্ছাদনে বিধে থাকছিলো। কিন্তু মোগলরা যখন বন্দুকের গুলির আওতায় পৌঁছালো তখন একটি হাতি হঠাৎ থমকে গেলো, মনে হলো গুলি খেয়েছে। তারপর সেটি আবার তার সঙ্গীদের অনুসরণ করে শ্ৰান্তভাবে এগুতে শুরু করলো কিন্তু হাটার সময় পাথুরে মাটির উপর সৃষ্টি করলো রক্তের রেখা। মাঝে মধ্যে দুই এক জন সৈন্য আহত হয়ে হাওদার উপর থেকে মাটিতে পড়ে যাচ্ছিলো কিন্তু তীব্র উত্তেজনা নিয়ে আকবর প্রত্যক্ষ করলেন হাতিবাহিনী পূর্বের যেকোনো আক্রমণের তুলনায় অনেক বেশি অগ্রসর হতে পারছে। খুব শীঘ্রই তারা দূর্গগামী পথের পাদদেশে পৌঁছে যাবে। এখন সময় হয়েছে তাঁর নিজের অশ্ব বাহিনীকে প্রস্তুত করার।

 সকলে আমাকে অনুসরণ করো। চিত্তরগড় আমাদের হবে, নিজের ঘোড়াটি দুলকি চালে ছুটিয়ে আকবর চিৎকার করে উঠলেন। হাতিগুলি যদি দুর্গগামী পথের কাছে পৌঁছাতে পারে তাহলে তিনি তার অশ্ববাহিনী নিয়ে পরবর্তী আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত থাকতে চান। এ সময় তিনি দেখলেন কিছু আগুন ভরা মাটির পাত্র চিত্তরগড়ের দুর্গপ্রাচীর থেকে হাতিগুলির দিকে ছুঁড়ে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু সেগুলি হাতিরগুলির উপর পড়লো না বরং কোনো ক্ষতি না করে ছড়িয়ে থাকা পাথরের উপর বিস্ফোরিত হলো। হঠাৎ দুর্গের ধাতু নির্মিত প্রধান ফটকের মাঝে সংযুক্ত ছোট দড়জা দিয়ে কমলা-পাগড়ি পড়া কিছু রাজপুত বেরিয়ে এলো। প্রথম লোকটি জ্বলন্ত কাঠি দিয়ে তার হাতে থাকা বড় একটি মাটির পাত্রে আগুন ধরাল। তারপর পাত্রটিতে বাধা দড়ি ধরে সেটা মাথার উপর ঘুরাতে ঘুরাতে ঢালু পথ বেয়ে হাতিগুলির দিকে ছুটে আসতে লাগলো। তাকে অনুসরন করে আসা অন্য রাজপুতদের হাতেও অনুরূপ আগুনের হাড়ি দেখা যাচ্ছে। যুদ্ধের সরোগোল তখন তুঙ্গে উঠেছে, আকবর দেখলেন হাওদার উপর থাকা সৈন্যরা বন্দুক এবং তীর ছোঁড়া শুরু করেছে। গুলি খেয়ে অনেক রাজপুত আগুনের পাত্রসহ ঢালু পথের উপর গড়িয়ে পড়ল কিন্তু বাকিদের দৌড় অব্যাহত থাকলো। বন্দুকের গুলিতে হাড়ি ফেটে তাদের একজনের গায়ে আগুন লেগে গেলো। একসময় অগ্রসরমান মানব মশালটি অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়ে লুটিয়ে পড়লো কিন্তু তার আগে হাত তুলে সাথীদের এগিয়ে যাওয়ার উৎসাহ প্রদান করলো। কিছু রাজপুত আক্রমণকারী, গুলি বা তীর বিদ্ধ হয়ে পথের পার্শ্বস্থ নিচু দেয়াল টপকে নিচের মাটিতে আছড়ে পড়লো। বাকিরা তাঁদের সঙ্গীদের মৃত্যুদৃশ্য উপেক্ষা করে এবং তাঁদের দিকে ধাবিত গুলি বা তীরের তোয়াক্কা না করে এগিয়ে আসতে লাগলো।

 রাজপুতরা দূর্গ থেকে বের হয়ে আসার এক দুই মিনিট পরের ঘটনা। তাদের সর্ব সম্মুখে থাকা লোকটি তার হাতের জ্বলন্ত পাত্রটি আকবরের প্রথম হাতিটির দিকে ছুঁড়ে মারলো, হাতিটি তখন দুর্গগামী ঢালু পথটির উপর সবেমাত্র সেটার সামনের একটি পা রেখেছে। লোকটি এক মুহূর্ত পর কপালে গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়লো কিন্তু তার ছুঁড়ে দেয়া পাত্রটি প্রথম হাতিটির মাথায় বিস্ফোরিত হলো এবং আলকাতরার তরল আগুন সেটার বর্ম বেয়ে ছড়িয়ে পড়লো। আগুন সম্ভবত হাতিটির চোখ আক্রান্ত করলো অথবা বর্মের ভিতর ঢুকে গেলো কারণ, ব্যাথায় সেটি পাগলের মতো মাথা দুলিয়ে আর্তচিৎকার করতে লাগলো এবং হুড়মুড় করে ঘুরে পেছনের হাতিটিকে আঘাত করলো, একই সাথে পেছনের হাতিটির হাওদায় আগুন লাগিয়ে দিলো। ছুটে আসা রাজপুতদের মধ্যে যারা বেঁচে গিয়েছিলো তাঁদের ছোঁড়া পাত্রগুলিও তখন লক্ষ্যভেদ করলো।

আতঙ্কিত আকবর দেখলেন আগুন আক্রান্ত হাতিগুলির হাওদা থেকে তাঁর সৈন্যরা মাটিতে লাফিয়ে পড়ে পিছিয়ে আসতে লাগলো। কেউ কেউ মাটিতে গড়িয়ে গায়ের অগুন নেভানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলো। আরো হাতি ঘুরে যেতে শুরু করলো শরীরে জ্বলতে থাকা আগুন নিয়ে। আকবর দেখলেন একজন মাহুত তার হাতিটির মাথায় ইস্পাতের শলাকা গেথে দিলো। মাহুতরা আহত হাতিদের উন্মত্ততা রোধ করার জন্য এভাবে তাদের হত্যা করে। বিশাল হাতিটি সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে স্থির হয়ে রইলো। আরেকজন মাহুত মনে হলো ততোটা সাহসী নয়। সে তার হাতির ঘাড় থেকে লাফিয়ে নেমে দৌড়ে পালালো। চালক বিহীন হাতিটি হাওদায় জ্বলতে থাকা আগুন নিয়ে উন্মত্তের মতো মোগলদের তৈরি করা কৃত্রিম ঢিবির দিকে ছুটে এলো। একটি ঢিবির সাথে সংঘর্ষের পর সেটি গড়িয়ে পড়লো। পড়ার পর সেটার অরক্ষিত পেটটি আকবরের বন্দুকধারীদের নিশানার শিকার হলো। মৃত্যুবেদনায় সেটি জ্বলন্ত হাওদাসহ প্রচণ্ড শক্তিতে গড়ান মেরে তাতে আটকা পড়া সৈন্যদের পিষ্ট করে তাদেরও মরণ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিলো। মানুষ এবং পশুর মাংসপোড়া তীব্র গন্ধ তখন বারুদের গন্ধের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। আকবরের নাকে সেই গন্ধ পৌঁছালো এবং তিনি বুঝতে পারলেন এই আক্রমণটি পূর্বের সকল আক্রমণের মতোই ব্যর্থ হয়েছে। নিষ্ফল মৃত্যুর হাত থেকে সৈন্যদের বাঁচানোর জন্য তিনি হাত তুলে ইশারা করলেন পিছিয়ে আসার এবং নিজের ঘোড়াটিকেও ঘুরিয়ে নিলেন। তিনি এই অচল অবস্থা কীভাবে অতিক্রম করবেন?

*

সেই সন্ধ্যায় আকবর তার যুদ্ধকালীন প্রিয়বেশ সোনার পাত মোড়া বক্ষ বর্মের কাঁধে ডুবন্ত সূর্যের প্রতিফলন নিয়ে গাঢ় লাল বর্ণের যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণ তাবুতে প্রবেশ করলেন। তাঁর চেহারা বিষণ্ণ। তাবুটিতে যুদ্ধমন্ত্রণাসভা আহ্বান করা হয়েছে। কার্যকর হতে পারে এমন কোনো নতুন যুদ্ধ কৌশল আকবরের মাথায় খেলছে না। অর্ধবৃত্তাকারে আসনসিঁড়ি হয়ে বসে থাকা আহমেদ খান এবং অন্যান্য সেনাপতিদের মাঝখানে তার জন্য নির্ধারিত ছোট আকারের সিংহাসনে তিনি আসন গ্রহণ করলেন। এই মুহূর্তে এদের সহযোগিতা এবং উপদেশ তিনি যতোটা প্রয়োজন মনে করছেন তেমনটি আর কখনোও করেননি। তাঁর এটাও মনে হচ্ছে যে এই দলটি খুবই অসঙ্গতিপূর্ণ। যেমন এদের মধ্যে রয়েছে মোহাম্মদ বেগ, তিনি মোগল সেনাবাহিনীতে আহমেদ খানের চেয়েও পুরানো। যৌবনে তিনি পানি পথে বাবরের পক্ষে লড়েছে, পরে হুমায়ূনের পক্ষে। তারপর রয়েছে চৌকো কাধ বিশিষ্ট আলী গুল। সে অপেক্ষাকৃত তরুণ এবং তাজাকিস্তানের লোক। সে কেবল হুমায়ূনের শেষের দিকের কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। বাকিরা আরো নতুন অনুগামী। যেমন বিশাল এবং শক্ত গড়নের অধিকারী রাজা রবি সিং, এই মুহূর্তে সে সশব্দে কাঠবাদাম চিবুচ্ছে। সে একজন রাজপুত এবং হিমুকে পরাজিত করার পর পর সে আকবরের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে। আকবরের এই সেনাপতিদের পরিচয় বা বয়স যাই হোক না কেনো, তাঁদের প্রত্যেকের মুখে তখন লজ্জার ভাব বিরাজ করছিলো।

আজকের আক্রমণের সময় কতজন নিহত হয়েছে? আকবর জিজ্ঞাসা করলেন।

আহমেদ খান উত্তর দিলেন। আমরা আমাদের শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধ হাতিগুলিকে হারিয়েছি এবং তিনশোর উপরে সৈন্য মারা গেছে। আরো অনেকে মারাত্মকভাবে দগ্ধ হয়েছে, তারা হয়তো বাঁচবে না।

অনেক ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও এই আক্রমণের প্রয়োজন ছিলো, আকবর বললেন। আমাদের আরো অভিনব কৌশল উদ্ভাবন করতে হবে যেমনটা আমরা হাতির হাওদা গুলিকে তীর এবং গুলি রোধক করার ক্ষেত্রে করেছি। আমরা চিত্তরগড় দখল করার আগে রাজা উদয় সিং যাতে আরো সমন্বিত সেনাবাহিনী গঠন করতে না পারে বা অন্যান্য রাজপুতদের সঙ্গে মিত্রতার মাধ্যমে শক্তি বৃদ্ধির সুযোগ না পায় সেই উপায় বের করতে হবে।

 তার পক্ষে মিত্র যোগাড় করা সম্ভব হবে না, রবি সিং শান্ত স্বরে বললো।

সমগ্র রাজস্থানে একক আধিপত্য বিস্তারের জন্য দীর্ঘদিন ধরে মেওয়ার এর রানারা পরস্পরের প্রতি বৈরী মনোভাব সম্পন্ন।

 শুনে খুশি হলাম। কিন্তু কেউ কি বলতে পারেন, আগে কখনোও চিত্তরগড়কে দখল করা সম্ভব হয়েছিলো কিনা, বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া?

হ্যাঁ, মোহাম্মদ বেগ উত্তর দিলো, তার বন্ধুর ও ভাঙ্গা নাকটি চুলকাতে চুলকাতে। দুইশ বছরের বেশি সময় আগে আলাউদ্দিন খিলজি চিত্তরগড় জয় করেছিলো এবং ইদানিং কালে গুজরাটিরা।

 আমরা তাঁদের যুদ্ধ কৌশল থেকে কিছু শিখতে পারি কি?

আলাউদ্দিন খিলজি কীভাবে চিত্তরগড় দখল করেছিলেন আমি তা জানি না, সে কাহিনী ইতিহাসের গর্ভে অনেক আগে হারিয়ে গেছে। আপনার পিতা চাম্পনির অবরোধ করার পর আমি গুজরাটে ছিলাম এবং তখন এক বুড়ো গুজরাটের কাছে আমি চিত্তরগড় দখলের কাহিনী শুনি। সে বলে, তারা ঢিবির অবরোধ সামনে এগিয়ে নিয়ে-এখন আমরা যেমন করছি, সেভাবেই প্রথমে সামনে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে। এমনকি তারা করিডোরের মতো লম্বা আড়ালও তৈরি করেছিলো পশুর চামড়া মোটা ভাবে স্থাপন করে এবং সেটার সাহায্যে ঢালু দুর্গমুখী পথের বেশ খানিকটা অগ্রসরও হয়েছিলো। কিন্তু আমি জানতে পারি তাঁদের চূড়ান্ত জয় হয়েছিলো অবরুদ্ধ দুর্গবাসীদের মধ্যে দুর্ভিক্ষ এবং রোগ ছড়িয়ে পড়ার কারণে। আমি করিডোর এর মতো ঢাকনার কথা আগেই হয়তো বলতাম কিন্তু আমার মনে হয়েছে সেটার সাহায্যে তীরের আক্রমণ ঠেকানো গেলেও কামান বা বন্দুকের গুলি ঠেকানো সম্ভব হবে না।

কিন্তু ঢাকনাটির পাশে পাথর ও মাটি লাগিয়ে এবং ছাদে পুরু তক্তা লাগিয়ে আমরা কি সেটার সহ্যক্ষমতা বাড়াতে পারতাম না? আহমেদ খান জিজ্ঞাসা করলো।

 সেটা করতে অনেক সময় লাগবে এবং অনেক প্রাণহানিও ঘটবে, আলী গুল বলে উঠলো।

 কিন্তু এ পর্যন্ত করা নিষ্ফল আক্রমণগুলিতেও আমাদের অনেক প্রাণহানি ঘটেছে, আকবর যুক্তি দিলেন। আমার পিতামহ বাবর একবার বলেছিলেন যে কোনো সম্রাটের যুদ্ধ জয় বা রাজ্যের প্রসার ঘটানোর জন্য জীবন উৎসর্গ করার প্রস্তুতি থাকতে হবে-বিশেষ করে তার নিজের, নিজ পরিবারের এবং নিকটবর্তী অনুগামীদের জীবন। একমাত্র বিজয় অর্জন করার পরেই সে যুদ্ধে নিহতদের পরিবারকে সহানুভূতি প্রদর্শন করতে পারে এবং সাধ্য মতো ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে পারে। করিডোরের মতো ঢাকনার বুদ্ধিটি আকর্ষণীয়। আপনারা সেটা তৈরির খসড়া পরিকল্পনা অঙ্কন করুন। যথেষ্ট পাথর এবং কাঠ জোগাড় করার জন্য লোক পাঠান। যারা করিডোরটি নির্মাণ করবে তাদের নিরাপত্তার জন্য গুজরাটিদের মতো মোটা চামড়ার আবরণ তৈরি করুন। এর সাহায্যে তীরের আক্রমণ প্রতিহত করা সম্ভব হবে। তাছাড়া রাজপুতরা অনির্ধারিত লক্ষ্যের দিকে অহেতুক কামান বা বন্দুক ছুড়বে না, তাঁদের বারুদের মজুত শেষ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায়।

*

সদ্য তৈরি করা দুটি করিডোরের একটির প্রবেশ পথের সামনে ঘোড়ার পিঠে বসে আছেন আকবর। তিনি বেশ আশান্বিত বোধ করছেন। যা অনুমান করেছিলেন তার তুলনায় কম সময়ে সেগুলি তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। মাত্র কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত বন থেকে উত্তম মানের কাঠ যোগাড় করা গেছে। বন্দীদের পাথর জোগাড় করার কষ্টসাধ্য কাজে নিয়োজিত করা হয়েছিলো। আকবরের অনুমান অনুযায়ী চিত্তরগড়ের প্রতিরোধকারীরা কামান বা বন্দুক ছুঁড়ে তাদের বারুদের অপচয় করেনি। চামড়ার তৈরি পর্দা দিয়েও তীরের আক্রমণ অনেকটা প্রতিরোধ করা গেছে। তারপরও করিডোর তৈরির সময় প্রতিদিন প্রায় একশ মজুর নিহত হয়েছে। এই দরিদ্র লোক গুলিকে রৌপ্যমুদ্রার লোভ দেখিয়ে কাজে নিয়োজিত করা হয়েছিলো। আকবর তাঁর প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী জীবিত এবং মৃত মজুরদের নামের তালিকা প্রস্তুত করার আদেশ দেন, যাতে যুদ্ধ জয়ের পর জীবিতদের এবং মৃতদের পরিবারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করা যায়।

যে করিডোরটির ভিতর আকবর প্রবেশ করছিলেন সেটা বিশাল আকারে তৈরি করা হয়েছে। মোহাম্মদ বেগকে এ কাজের তদারকের দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছিলো। সে গর্বের সঙ্গে নিশ্চয়তা প্রদান করে বলেছে- এটি পাশাপাশি দশজন অশ্বারোহীর স্থান সংকুলানের মতো চওড়া এবং একদল ষাঁড় ছোট আকারের কামান সহ এর মধ্যে এটে যাবে। তাছাড়া সেটি একটি বড় আকারের যুদ্ধ হাতি হেঁটে যাওয়ার মতো উঁচু।

 মোহাম্মদ বেগ, করিডোরটি এখন পর্যন্ত কতোদূর প্রসারিত হয়েছে? আকবর জিজ্ঞাসা করলেন।

 এর শেষ মাথা দুর্গমুখী পথের গোড়া থেকে এখনো প্রায় একশ গজ দূরে আছে। তিনদিন আগে আমরা একটি বাধার সম্মুখীন হয়েছিলাম। এক রাজপুত যোদ্ধা করিডোরের ছাদের কয়েকটি তক্তায় আগুন ধরাতে সক্ষম হয়, কিন্তু আমাদের সাহসী মজুররা শিবিরের কুয়া থেকে বালতি করে পানি নিয়ে সেই আগুন নিভিয়ে ফেলে। ফলে করিডোরের সামনের অংশ ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা পায়।

 এমন লোকদের নাম আমাকে জানাবেন যারা বুদ্ধির জন্য বিশেষ পুরষ্কারের দাবিদার।

জ্বী জাহাপনা।

 এখন আমি নিজে ভিতরটা যাচাই করে দেখতে চাই। আকবর তার কালো ঘোড়াটির পাঁজরে আলতো গুতো মেরে করিডোরের প্রবেশ পথের ভিতর ঢুকে গেলেন, তাঁকে অনুসরণ করলেন মোহাম্মদ বেগ। পুরু কাঠের ছাদের জন্য ভেতরটা বেশ ঠাণ্ডা, কিন্তু ভেজা মাটি, ধোয়া, ঘাম, মানুষ এবং পশুর প্রস্রাব ও মলের সম্মিলিত গন্ধ আকবরের নাকে ধাক্কা দিলো। মাঝে মধ্যে দেয়ালে গোজা মশাল থেকে কিছুটা আলো পাওয়া যাচ্ছে। প্রতিটি মশালের সামনে একজন করে মজুর চামড়ার বালতিতে বালু এবং পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যাতে ছাদের রজন কাঠে আগুন লেগে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তা নেভাতে পারে। এই সব মজুররা কেবল ছিন্ন পিরান এবং নেংটি পরে আছে। আকবর তাঁদের সামনে দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময় তারা ঝুঁকে সম্মান জানালো। মাঝে মধ্যে তিনি ঘোড়া থেকে নেমে তাঁদের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত বাক্য বিনিময় করছিলেন। তারা কোথা থেকে এসেছে কিম্বা তাঁদের পরিবারে কতোজন সদস্য আছে, এই জাতীয় প্রশ্ন করছিলেন তিনি। আবার এগিয়ে যাওয়ার সময় তিনি তাদের একটি করে মুদ্রাও উপহার দিচ্ছিলেন। একজন কুচকে যাওয়া চামড়া বিশিষ্ট সাদা চুলের মশালধারী আকবরের পাশাপাশি হাটছিলো আর বর্ণনা করছিলো দিল্লীর কাছে গুরগাঁও নামের ছোট গ্রামে তার সর্দারীর গল্প। সেই মুহূর্তে একটি ভোতা শব্দের সঙ্গে করিডোরের দেয়াল কেঁপে উঠলো, ছোট ছোট বহু পাথর এবং বড় একটি দুটি দেয়াল থেকে খসে পড়লো। মশালধারীটি সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে উবু হয়ে শুয়ে পড়ল কিন্তু আকবরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কোনো রকমে আবার হাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠে দাঁড়ালো। আকবর তখন তাঁর পিছিয়ে যেতে চাওয়া ঘোড়াটিকে শক্তভাবে টেনে ধরে রেখেছেন। মশালধারীটি লজ্জিত ভাবে বললো, আমি দুঃখিত জাঁহাপনা। আপনার মতো দাঁড়িয়ে থেকে কামানের গোলার মোকাবেলা করার সাহস আমার নেই।

তুমি তোমার অবস্থানে স্থির থেকেই যথেষ্ট সাহস দেখিয়েছো, আকবর বললেন। আর একটা কথা মনে রাখবে। কথাটি আমার বাবা যুদ্ধ সম্পর্কে বলেছেন। তুমি যদি কোনো বিস্ফোরণ বা সংঘর্ষের শব্দ শুনতে পাও, বুঝে নেবে তুমি আঘাত থেকে রক্ষা পেয়েছ।

 মশালধারীটি সংক্ষেপে হাসলো। আমি মনে রাখবো জাঁহাপনা। আকবর লোকটিকে কয়েকটি মুদ্রা দিলেন এবং সে হিন্দু কেতায় দুহাত মাথার উপর তুলে তাকে অভিবাদন জানালো। আকবর ঘোড়া চালিয়ে করিডোরের সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। একটু পরেই তিনি এর আকাবাকা বাঁক সত্ত্বেও শেষ মাথার হালকা আলো দেখতে পেলেন। মাঝে মাঝে উভয় পক্ষের বন্দুক ছোঁড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছিলো। একবার তিনি একটি মরণ চিৎকার শুনতে পেলেন, বুঝা গেলো আরেকজন মজুর নিহত হয়েছে।

শীঘ্রই আকবর করিডোরের শেষ মাথায় পৌঁছালেন। সেখানে পাথর এবং কাঠ জড়ো করে রাখা ছিলো অগ্রভাগ বর্ধিত করার জন্য। সুরঙ্গের একটু ভেতরে মজুররা শুকনো মাটিতে পানি মেশাচ্ছিলো দেয়ালকে সুসংহত করার সিমেন্ট হিসেবে ব্যবহারের জন্য। আকবর এবং মোহাম্মদ বেগ ঘোড়া থেকে নামলেন। জাহাপনা আপনি এখানে এলে চিত্তরগড়ের প্রতিরক্ষা প্রাচীরটি ভালোভাবে দেখতে পাবেন, একজন সেনাকর্তা একটু দূরে খোলা জায়গায় অবস্থিত ঢিবির কাছ থেকে বললো।

সাবধান জাহাপনা। আপনি যদি তাঁদের দেখতে পান, তারাও আপনাকে দেখতে পাবে এবং আপনার সোনার বক্ষ-বর্ম দেখে আপনাকে চিনেও ফেলতে পারে, মোহাম্মদ বেগ বললো।

আমার সৈন্যরা প্রতিদিন এমন ঝুঁকি নিচ্ছে, কাজেই একই কাজে আমি পিছিয়ে যাওয়া উচিত নয়, আকবর বললেন। তিনি সেনাকর্তাটির দিকে এগিয়ে গেলেন। সেখান থেকে দুর্গের প্রতিরক্ষা প্রাচীরের কিনারা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো, সেখানে নজরদারীর জন্য কোনো ধরনের মঞ্চ স্থাপন করা হয়েছে। দুই এক মিনিট তাকিয়ে থাকার পর আকবর লক্ষ্য করলেন দুজন লোক প্রহরা মঞ্চে হাজির হয়ে সূক্ষ্মভাবে মোগলদের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করছে। তাদের একজন-লম্বা গড়নের এবং কালো দাড়ি বিশিষ্ট, সঙ্গীকে কিছু দেখাতে চাইছে। সূর্যের আলোয় তার আঙ্গুলের আংটির ঝলক এবং চালচলন প্রত্যক্ষ করে আকবর অনুমান করলেন নিশ্চয়ই সে গুরুত্বপূর্ণ কেউ হবে। আকবর তাঁর সেনাকর্তাটিকে আদেশ করলেন, আমার জন্য দুটি গুলি ভরা বন্দুক আর বন্দুক রাখার তেপায়া এনে দাও, আমি ঐ ভদ্রলোক গুলিকে গুলি করে নিচে ফেলতে চাই।

তৎক্ষণাৎ করিডোরের মুখে অবস্থানকারী দুইজন বন্দুকধারী তাদের বন্দুক এবং তেপায়া আকবরকে দিয়ে দিলো। উপরের দিকে, ছয়ফুট লম্বা বন্দুক তাক করতে হলে আকবরকে মাটিতে অর্ধশায়িত হতে হবে। নিঃশব্দে এবং সতর্কভাবে অত্যন্ত দ্রুত আকবর আংটি পরিহিত লোকটির দিকে বন্দুক তাক করলেন। নিজেকে যতোটা সম্ভব স্থির করার জন্য দম আটকালেন, তারপর গুলি করলেন। বন্দুকের বারুদের তীব্র ধোয়ায় কাশতে কাশতে আকবর দেখলেন লোকটি মঞ্চ থেকে সামনের দিকে ঝুঁকলো এবং তাঁর থেকে কয়েক গজ দূরে ধুপ শব্দে আছড়ে পড়লো। দ্বিতীয় বন্দুকটি নিয়ে প্রস্তুত হওয়ার আগেই তার সঙ্গীটি অদৃশ্য হলো।

 মৃতদেহটা নিয়ে এসো, দেখা যাক আমরা কাকে মারতে পেরেছি। আকবর আদেশ দিলেন। দুইজন সৈন্য ভগ্ন দেহটিকে হেচড়ে তাদের কাছে নিয়ে এলো, আকবরের মনে হলো তাঁর গুলিটি লোকটির ডান কানের উপর আঘাত করেছে। তবে তিনি এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হতে পারলেন না, কারণ উপর থেকে পতনের ফলে তার মাথার পেছনের অংশের পুরোটাই রক্তাক্ত হয়ে আছে।

 স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে সে একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলো কিন্তু আমি তাকে চিনতে পারছি না, মোহাম্মদ বেগ বললেন।

 আমিও চিনতে পারছি না, আকবর বললেন, কিন্তু রাজা রবি সিং একে চিনতে পারে যদিও এর চেহারা অক্ষত নেই, মেওয়ার এর বহু নেতা তার পরিচিত।

*

কয়েক মাস আগে কাদা এবং পাথর দিয়ে কৃত্রিম ভাবে তৈরি করা একটি ঢিবির উপর আকবর রাজা রবি সিংকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এখানে দাঁড়িয়ে চিত্তরগড়কে একটু ভালোভাবে দেখা যায়। রাজা রবি বলে উঠলো, জাহাপনা সেদিন আপনি আপনার দক্ষ লক্ষ্যভেদের মাধ্যমে জয় মালকে হত্যা করার পর থেকে দুর্গের মধ্যে ব্যাপক কর্মচাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছে। জয় মালের মৃতদেহ ফেরত দেয়ার সময় যদিও রাজপুতরা আপনার উত্থাপিত আত্মসমর্পণের শর্ত প্রত্যাখ্যান করেছে তবুও পরিষ্কারভাবে বুঝা যাচ্ছে তারা তার মৃত্যুতে এবং করিডোরের অগ্রগতিতে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তারা করিডোর এবং এর ভিতর দিয়ে টেনে নেয়া কামান ধ্বংসের জন্য আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে কিন্তু আমরা তাঁদের আক্রমণ সহজেই প্রতিহত করতে পারছি। তাছাড়া ইদানিং আমরা তাঁদের যতো সংখ্যক অন্বেষণকারী দলকে পরাস্ত করেছি তার থেকে অনুমান করা যায় তাদের খাদ্যের মজুতও শেষ হয়ে এসেছে।

এরপর তারা কি করতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

 সে বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না জাঁহাপনা। তারা দুইজন কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। এসময় হঠাৎ আকবর দেখলেন দুর্গের মধ্যে একই সঙ্গে কয়েক জায়গা থেকে কমলা বর্ণের আগুনের শিখা এবং কালো ধোয়া সর্পিল ভাবে আকাশে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। তিনি সেখানে এধরনের আগুন পূর্বেও দেখেছেন, তবে তা নির্গত হয়েছে এক জায়গা থেকে। রাজা রবি সিং বলেছিলো সেগুলি যুদ্ধে নিহত গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের চিতার আগুন। জয় মালের মৃতদেহ ফেরত দেয়ার পর যে আগুনটি জ্বালা হয়েছিলো সেটা ছিলো ভয়াবহ। কিন্তু এখন যে আগুনের লেলিহান শিখা দাউ দাউ করে জ্বলছে তার তুলনায় সেটি নিতান্তই তুচ্ছ।

 ওখানে কি হচ্ছে রবি সিং?

দুর্গ রক্ষাকারীরা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছে যে যুদ্ধে জয়ী হওয়া আর তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তারা নিজেরাই নিজেদের মৃত্যু নির্ধারণ করতে চায়। তারা জওহর সম্পাদন করছে। আপনি যে আগুন দেখতে পাচ্ছেন সেগুলি চিতার জন্য জ্বালা কাঠের স্থূপের আগুন। বিশেষ ভাবে তৈরি মঞ্চ থেকে রাজপুত মহিলা এবং তরুণীরা ঐ আগুনের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ছে জীবন্ত পুড়ে মরার জন্য। মায়েরা তাদের শিশুদের বুকে চেপে ধরে আগুনে ঝাঁপ দিচ্ছে। আকস্মিক যে কমলা এবং হলুদ বর্ণের আগুনের শিখা লাফিয়ে উঠতে দেখা যাচ্ছে, তার কারণ লোকেরা তখন চিতার মধ্যে বালতিতে করে তেল এবং ঘি ঢালছে, যাতে আগুনের তাপ বৃদ্ধি পায় এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যরা কষ্ট কম পেয়ে দ্রুত মৃত্যুবরণ করে। তাদের স্ত্রী এবং সন্তানেরা আগেই নিহত হলে তারা আর কষ্ট পাবে না এবং শত্রুর হাতে পড়ে লাঞ্ছিতও হবে না এই ধারণা তাদের মনে সাহস যোগাবে। এই সাহসে বলিয়ান হয়ে আগামী কাল সকাল বেলা ঐ রাজপুত পুরুষ এবং তরুণরা তাঁদের জাফরানী যুদ্ধ পোষাক পরিধান করবে। তারপর নিজেদের ভ্রাতৃত্ববোধ কে শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য এবং আঘাতের যন্ত্রণা লাঘবের জন্য সকলে ওপিয়াম মেশান পানি পান করবে। তারপর শেষবারের মতো আকস্মিক বেগে বীরত্বপূর্ণ আঘাত হেনে যতো বেশি সংখ্যক সম্ভব শত্রুকে হত্যা করে নিজেরা মৃত্যুবরণ করবে।

রাজা রবি সিং এর কন্ঠে একটি শান্তভাব এবং সম্মান সূচক প্রশংসার রেশ পাওয়া গেলো। বস্তুত রবি একজন রাজপুত, আকবর ভাবলেন। যদিও এমন আত্মবিসর্জনের ঘটনা আকবরের কাছে অপরিচিত এবং বিতৃষ্ণাজনক লাগছিলো তবুও তিনি ঐসব মহিলা ও তরুণীদের জন্য কিছুটা হলেও শ্রদ্ধা অনুভব করলেন। ওদের কষ্ট কমার জন্য ঐ আগুন সাদা হয়ে উঠুক, তিনি প্রার্থনা করলেন। তারপর রবিকে বললেন, আপনার কথা যদি সত্যি হয় তাহলে ওদের মরণ আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য আমাদের প্রস্তুতি নেয়া উচিত। আরো বেশি সংখ্যক কামান করিডোরের ভিতর দিয়ে পাঠানোর নির্দেশ দিন এবং সেগুলিকে যতোটা সম্ভব আড়াল করে দুর্গমুখী পথের দিকে মুখ করে স্থাপন করতে বলুন। আর বন্দুকধারী এবং তীরন্দাজেরা যেনো ভোরবেলায় সুরঙ্গ থেকে বেরিয়ে অবস্থান নেয়। যে মুহূর্তে দুর্গের প্রবেশ দ্বারের পিছনে তৎপরতা দেখা যাবে তখনই অশ্বারোহী এবং হস্তী বাহিনীকে করিডোরের সুরঙ্গে ঢোকার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলুন। কারণ হাতি এবং ঘোড়া সুরঙ্গের অন্ধকারে অবস্থান করতে থাকলে তাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে।

পরদিন ভোর বেলা চিত্তরগড়ের দুর্গগামী ঢালু পথের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া করিডোরের ঠিক বাইরে আকবর দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি যুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ বেশ পরিধান করে আছেন এবং তাঁর সেনাপতিরা তাঁকে ঘিরে রেখেছে। সোনার পাত মোড়া বক্ষ-বর্ম তাঁর শরীরে আট করে বাঁধা, মাথায় শিরোস্ত্রাণ এবং কোমরে ঝোলান রয়েছে পিতামহের তলোয়ার আলমগীর-এটি নতুন করে শান দিয়ে ধারালো করা হয়েছে। গতকাল রাতে মোগল সৈন্যরা যখন করিডোরের কাছে এবং ঢালের কাছাকাছি তাড়াহুড়া করে অতিরিক্ত প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছিলো তখন চিত্তরগড়ের প্রতিরোধকারীরা তাঁদের উপর বিক্ষিপ্তভাবে গুলি বর্ষণ করে। গুলিতে কামান টানতে থাকা তিনটি ষাড় নিহত হয়। বাকি ষাঁড়গুলি ভয়ে বিশৃঙ্খল হয়ে পড়লে কামানটি উল্টে পড়ে এবং কিছু তীরন্দাজ আহত হয়। কিন্তু বাকি কামানগুলি যথাযথ জায়গায় স্থাপন করার সময় রাজপুতরা চুপচাপ ছিলো, বোঝা যাচ্ছিলো পরের দিনের শেষ আক্রমণের জন্য তারা তাদের শক্তি এবং বারুদ মজুত রাখছিলো।

ভোর হওয়ার অনেক আগেই চিত্তরগড়ের পাহারা মিনারের ফাঁক দিয়ে যুদ্ধ ঢাকের উচ্চ শব্দ ভেসে আসতে থাকে। আকবর এতো প্রচণ্ড ঢাকের শব্দ আগে কখনোও শুনেননি। বেশ কয়েক ঘন্টা পেরিয়ে গেছে কিন্তু ঢাকের ছন্দ সম্মোহনের মতো অব্যাহত রয়েছে, তার সঙ্গে ক্ষণে ক্ষণে যুক্ত হচ্ছে শিঙ্গার আর্তনাদ। মাঝে মধ্যে একত্রে অনেক কণ্ঠের সম্মিলিত গর্জন ভেসে আসছিলো সব শব্দকে ছাপিয়ে। সেটা প্রতিরোধকারীদের হিন্দু দেবতার কাছে প্রার্থনার রব বলে রবি সিং ব্যাখ্যা করে।

 তারা কখনো আক্রমণ করবে রবি সিং?

 আর বেশি দেরি নেই। তারা ওপিয়ামের প্রভাবে এতোই উন্মত্ত হয়ে উঠেছে যে নিজেদের আর বিরত রাখতে পারবে না।

পনেরো মিনিট পর ধীরে ধীরে বিশাল লোহার গজাল বসানো এবং ধাতব বেষ্টনী যুক্ত দুর্গ দ্বারটি উপরে উঠে যেতে লাগলো এবং এর পেছনের কাঠের দরজাটি খুলে যেতে লাগলো। কাঠের দ্বারে পর্যাপ্ত ফাঁক সৃষ্টি হতেই জাফরানী পোষাক পরিহিত এক যোদ্ধা একটি সাদা ঘোড়া নিয়ে বাকা তলোয়ার উঁচিয়ে ঢালু পথের উপর দিয়ে ছুটে এলো। তার পিছু পিছু অসংখ্য ঘোড়সওয়ার বেরিয়ে এলো। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলো বয়স্ক এবং তরুণ পদাতিক যযাদ্ধারা। সকলে জাফরানী যুদ্ধ পোষাক পরিহিত এবং সকলের হাতে অস্ত্র ঝলকাচ্ছে। তারা যে রণহুঙ্কার দিচ্ছিলো আকবর তার অর্থ বুঝলেন না। রবি সিং এর অর্থ বুঝিয়ে দিলো, জীবন সস্তা কিন্তু সম্মান সস্তা নয়।

তোমরা সময় বুঝে আক্রমণ শুরু করো। আকবর গোলন্দাজ, বন্দুকধারী এবং তীরন্দাজদের আদেশ দিলেন। এর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নিক্ষিপ্ত কামানের গোলা একটি কালো ঘোড়ার পিঠে বসে থাকা যোদ্ধাকে আঘাত করলো। সে যখন পড়ে গেলো তার উপর আরেকটি ঘোড়া হোঁচট খেলো এবং পিঠের সওয়ারীকে নিয়ে ঢালু পথটির নিচু পাঁচিল অতিক্রম করে প্রায় একশ ফুট নিচের মাটিতে আছড়ে পড়লো। কিছু যোদ্ধা বন্দুকের গুলি বা তীর বিদ্ধ হলো, কিন্তু বাকিরা নিরবিচ্ছিন্ন গতিতে এগিয়ে এলো হতাহতদের ঠেলে, ঢাল থেকে নিচে ছিটকে পড়া কিম্বা বহমান জাফরানী স্রোতের নিচে পদদলিত হওয়ার দিকে তাদের খেয়াল নেই। আকবরের প্রথম গোলন্দাজ যখন কামানের স্পর্শরন্ধ্রে সবেমাত্র অগ্নিসংযোগ করতে যাচ্ছে ঠিক তখনই তার সামনে হাজির হলো সাদা ঘোড়ার পিঠে চড়া নেতৃত্বদানকারী যোদ্ধাটি। অগ্নিসংযোগের আগেই দুইজন গোলন্দাজকে তলোয়ার চালিয়ে কেটে ফেললো সে, তারপর দ্বিতীয় কামানটির গোলন্দাজের দিকে ধেয়ে গেলো। কিন্তু এই গোলন্দাজটি আক্রান্ত হওয়ার আগেই কামানে অগ্নিসংযোগ করতে সক্ষম হলো। কামানের গোলাটি একদম কাছ থেকে প্রচণ্ড শক্তিতে নেতাটির পেটে আঘাত করলো এবং তার দেহের উপরের অংশ নিচের অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিটকে পড়লো। আশ্চর্যজনকভাবে তার ঘোড়াটি অক্ষত রইলো এবং আকবরের সৈন্যদের অবস্থানের দিকে ছুটে গেলো। সেটার সাদা শরীর তখন কালচে রক্তে রঞ্জিত এবং সেটার রেকাবে তখনো সওয়ারীর পা আটকে আছে।

এই মুহূর্তে অন্যান্য রাজপুতরা ঢালু পথের নিচে পৌঁছে গেছে এবং মোগল সৈন্যদের আক্রমণ করার জন্য ছড়িয়ে পড়ছে। লড়াই এর আকাক্ষা তাঁদের মধ্যে এতো তীব্র যে, কোনো প্রকার সমর কৌশলের তোয়াক্কা না করে তারা যে দিকে নজর যায় আক্রমণ করতে লাগলো। তাদের এক একজনকে ঠেকাতে একধিক বন্দুকের গুলি বা তীর ছোঁড়ার প্রয়োজন হচ্ছিলো। যতো মারাত্মক ভাবেই জখম হোক না কেনো আকবরের সৈন্যদের কাছে পৌঁছাতে পারলে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে সেনাদের মাটিতে আছড়ে ফেলছিলো এবং সাথে থাকা ভারী দ্বিধার তলোয়ার বা খাঁজকাটা খঞ্জর দিয়ে কোপ মারছিলো। আকবর তাঁর একদল বন্দুকধারীকে আক্রান্ত হওয়ার আগেই বন্দুকে গুলি ভরার সময় নেয়ার জন্য তীরন্দাজদের কাছে পিছিয়ে আসার আদেশ দিলেন। দূর্গদ্বারের কাছ থেকে নীচ পর্যন্ত ঢালু পথটি তখন রক্ত এবং হতাহত যোদ্ধাদের দেহে ছয়লাব হয়ে গেছে।

সম্মুখ যুদ্ধে নিজের সৈন্যদের ধীরে ধীরে প্রভাব বিস্তার করতে দেখে আকবর স্বস্তি ও পুলক অনুভব করলেন। তাঁর সৈনিকরা রাজপুত যোদ্ধাদের ছোট ছোট দলকে ঘিরে ফেলছিলো। এখন চিত্তরগড়ের দুর্গদ্বার দিয়ে অনেক অল্প সংখ্যক যোদ্ধা বেরিয়ে আসছে। পথের নীচ পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই তারা গুলি বা তীর বিদ্ধ হয়ে হতাহত সাথীদের দেহের উপর লুটিয়ে পড়ছে। যদিওবা কেউ নিচে পৌঁছাচ্ছে সে আকবরের অশ্বারোহী বাহিনীর হাতে কচুকাটা হচ্ছে। রাজপুতদের ছোট ছোট প্রতিরোধগুলি আকবরের সৈন্যদের নিয়মতান্ত্রিক আক্রমণে বিধ্বস্ত হচ্ছিলো। আকবর অনুভব করলেন এই প্রথম বৈরাম খানের নির্দেশনা ছাড়া তাঁর বহুকক্ষিত বিজয় সন্দেহাতিতভাবে অর্জিত হতে যাচ্ছে। এটি সম্ভবত ভবিষ্যতে আরো অনেক বিজয়ের প্রথমটি। আপন অনুপ্রেরণার পাশাপাশি রাজপুতদের নগ্ন বীরত্ব তাঁকে অভিভূত করলো। এধরনের যোদ্ধারা শত্রুর চেয়ে মিত্র হিসেবেই বেশি কাম্য।

শীঘ্রই যুদ্ধক্ষেত্র স্থবির হয়ে পড়লো। আকবর রবি সিংকে কাছে ডাকলেন। এই সব বীর যোদ্ধাদের তাদের ধর্মমত অনুযায়ী সৎকারের ব্যবস্থা করুন। যেহেতু জয় মালের মৃত্যুর পর উচ্চ পদস্থ সেনাকর্তারা অমার দেয়া আত্মসমর্পণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে তাই তাঁদের কেউ এখনো বেঁচে থাকলে হত্যা করুন। মৃত্যুবরণ করা তাদের জন্য কঠিন হবে না কারণ বেঁচে থাকা তাঁদের জন্য নিজস্ব যুদ্ধনীতির লঙ্ঘন। তারপর দুর্গটি ধ্বংস করুন, যাতে দুর্গটিকে আর আমাদের বিরুদ্ধে কেউ ব্যবহার করতে না পারে এবং অন্যান্য রাজপুত নেতাদের জন্য এটা হবে একটি সতর্কবার্তা যারা আমার মিত্রতার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার সাহস দেখাতে চাইবে।

.

০৮. হীরা বাঈ

জাহাপনা, প্রভু রায় সূর্যন আপনার কাছে আত্মসমর্পণ করতে চায়। রাহুম্ভর দূর্গশহরের সীমার ভিতর অবস্থিত নাগরিকদের প্রাণ রক্ষার বিনিময়ে তিনি আপনার জায়গিরদার হওয়ার প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। লম্বা এবং তারের মতো পাকানো দেহের অধিকারী বয়স্ক রাজপুতটি মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকলেও তার গর্বিতভাব স্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছিলো। কথাগুলি বলতে তাকে নিজের সঙ্গে রীতিমত যুদ্ধ করতে হয়েছে।

আকবর বিজয়ীর হাসি গোপন করলেন। চিত্তরগড় বিজয়ের পর হত্যা করা যোদ্ধাদের কথা মাঝে মাঝে তার মনে এসেছে কিন্তু সে ব্যাপারে তাঁর কোনো অনুশোচনা নেই। চিত্তরগড় ধ্বংস করার আদেশ প্রদানের বিষয়েও তার মাঝে কোনো খেদ নেই-সে সময় রাজস্থানের বিস্তির্ণ মরুভূমি থেকে শহর ধ্বংসের লাল এবং কমলা রঙের আগুনের শিখা এবং সাথে ধূসর বোয়ার কুণ্ডলী কয়েক দিন পর্যন্ত দেখা গেছে। তাঁর নিষ্ঠুরতার প্রদর্শনী প্রত্যাশিত ফল প্রদান করেছে। আকবর রাহুম্ভর নামের আরেকটি রাজপুত দুর্গশহর অবরোধ করেছিলেন যেটা এর নিরেট ইটের দেয়াল এবং উঁচু মিনার বিশিষ্ট দুর্ভেদ্য গঠনের জন্য সমগ্র হিন্দুস্তানে সুপরিচিত ছিলো। কিন্তু হার মানতে সেটি এক সপ্তাহেরও কম সময় নিল। রায় সূর্যন যদি তার বশ্যতা স্বীকার করতে প্রস্তুত থাকে তাহলে ধরে নিতে হবে সকল নেতৃস্থানীয় রাজপুত যুবরাজ তাঁর আধিপত্য মেনে নিয়েছে। অবশ্য মেওয়ারের রানা উদয় সিং ছাড়া। চিত্তরগড় এবং এর আশেপাশের এলাকা হারিয়ে সে যদিও আরাভাল্লির পার্বত্য এলাকায় আত্মগোপন করে আছে কিন্তু তারপরেও পরাজয় মেনে না নিয়ে আকবরের সেনাবাহিনীর গতিবিধি সম্পর্কে সজাগ দৃষ্টি রেখেছে এবং চিত্তরগড়ের পতনের পর এখনো এক বছর অতিক্রান্ত হয়নি। উত্তর ভারতে সবচেয়ে শক্তিশালী রাজস্থানী যুবরাজগণ এবং তাদের জাফরানী যোদ্ধারা যদি পাশে থাকে তাহলে আকবরের কাছে কোনো কিছুই আর অজেয় থাকবে না।

তোমার প্রভুকে বলবে আমি তার প্রস্তাব গ্রহণ করেছি এবং রাহুম্ভরের সকল অধিবাসীকে পরিত্রাণ প্রদানের নিশ্চয়তা দিচ্ছি। আজ রাত পর্যন্ত সে সম্মানের সঙ্গে তার দুর্গে অবস্থান করতে পারে, কিন্তু আগামীকাল ভোরে যখন সূর্য দিগন্ত থেকে এক বর্শা উচ্চতায় অবস্থান করবে তখন আমি তাকে এবং তার সেনাপতিদের আমার শিবিরে অভ্যর্থনা জানাতে চাই এবং আমাদের মিত্রতার উৎসব উদযাপন করতে চাই।

ঐ দিন রাতে একজন অনুলেখককে আকবর তার তাবুতে ডাকলেন। কোনো কোনো বিশেষ মুহূর্তের শক্তিশালী আবেগ ঘন অনুভূতি তিনি নিজে লিখে রাখতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু এখনো লিখতে জানেন না বলে তিনি সত্যিকার অনুতাপ বোধ করলেন। আগ্রায় ফিরে তিনি একজন বা একাধিক সভা ঘটনাপঞ্জি লেখক নিয়োগ করবেন। তারা তার এবং তাঁর পিতা ও পিতামহের রাজত্বকালের কৃতিত্বসমূহ লিপিবদ্ধ করবে। কিন্তু এই মুহূর্তে একজন অনুলেখকই যথেষ্ট। আকবর অপেক্ষা করলেন যতোক্ষণ পর্যন্ত না তরুণ অনুলেখকটি তার গলায় ঝুলানো কালির দোয়াতটির মুখ খুলে এবং লেখার পালকে ধার দিয়ে প্রস্তুত হলো। আকবর তলিপি প্রদান শুরু করলেন।

 আমার শাসনকালের এই বছরটিতে যুদ্ধের আগুনের শিখা রাজস্থানের আকাশের বহু উচ্চে পৌঁছেছে। আমার সৈন্যদের দৃঢ়তা এবং শক্তি প্রত্যক্ষ করে শত্রুদের সাহস বালুতে শুষে যাওয়া বৃষ্টির মতো বিলুপ্ত হয়েছে। এখানে আমার বিজয় সম্পন্ন হয়েছে যা ভবিষ্যতের অনাগত গৌরব গুলির উপযুক্ত ভিত্তি প্রস্তর…

অনুলেখক চলে যাওয়ার অনেক পড়ে যখন সমগ্র শিবিরের কোলাহল থেমে গেছে, তখনো আকবরের ঘুম আসছিলো না। তাঁর শ্রুতলিখনের বাক্যগুলি হৃদয় থেকে স্বতস্ফূর্তভাবে উত্থিত হয়েছে। তার ভবিষ্যতও গৌরবময় হবে বলে তিনি নিশ্চয়তা অনুভব করছিলেন। রচিত ঘটনাপঞ্জির মাধ্যমে সমগ্র পৃথিবীর মানুষ তাঁর কীর্তি সম্পর্কে জানুক এটাই তার বাসনা। কিন্তু মানুষের জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই। যুদ্ধক্ষেত্রে একটি মাত্র তীর বা বন্দুকের গুলি অথবা আততায়ীর ছোরার আঘাতে যে কোনো মুহূর্তে তিনি মৃত্যুবরণ করতে পারেন। তখন তাঁর সাম্রাজ্যের কি হবে? তাঁর কোনো বংশধর না থাকায় এই বিশাল মোগল সাম্রাজ্য তখন টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। হিন্দুস্তানে মোগলদের অর্জনকে সম্মিলিতভাবে টিকিয়ে রাখার পরিবর্তে গোত্রপতিরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে নিজেদের মধ্যে কলহে লিপ্ত হবে। তাহলে তাঁর পরাজয় ঘটবে, যেমন পরাজয় ঘটতে পারে উদাসীনতা বা আত্মতুষ্টির কারণে তিনি যদি তার সেনাবাহিনীকে পতনের দিকে ঠেলে দেন, তাহলে।

এমন কিছু ঘটতে দেয়া ঠিক হবে না। তিনি এখন বিশ বছরে পদার্পন করেছেন, এখন তাঁর দায়িত্ব সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা ও গন্তব্য নিশ্চিত করা। তাই এখন তাকে বিয়ে করতে হবে এবং সন্তান জন্ম দিতে হবে। তিনি বিয়ে করলে তার মা এবং ফুফু নিঃসন্দেহে খুশি হবেন। তারা বেশ কিছুদিন ধরে তাকে এ বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়ে আসছেন, এমনকি সম্ভাব্য কনের ব্যাপারেও পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু রাজস্থান জয়ের পরিকল্পনায় ব্যস্ত থাকার কারণে আকবর এ বিষয়ে তেমন মনোযোগ দিতে পারেন নি এবং বাস্তবতা হলো বিয়ে করার জন্য তিনি তেমন আকাঙ্ক্ষাও অনুভব করেননি। কারণ হারেমে তিনি সীমাহীন যৌনতৃপ্তি লাভ করছিলেন। তাঁর পিতা মাতার মতো আন্তরিক সম্পর্ক তাঁর নিজের জীবনেও সৃষ্টি হোক এমন তাগিদ তিনি উপলব্ধি করছিলেন না। আদম খান এবং মাহাম আঙ্গার বিশ্বাসঘাতকতার পর ঘনিষ্ট কারো প্রতি নিজের বিশ্বাস অর্পণের বিষয়েও তিনি সন্দিহান রয়েছেন। কিন্তু এখন এখানে অস্থিরচিত্তে এবং একা বসে থেকে তার মনে হলো, বিয়ে করার সময় হয়েছে। এটা তাঁর নিজের জন্য না হলেও সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য প্রয়োজন। বিশেষভাবে যা কাম্য তা হলো স্বাস্থ্যবান ও সবল পুত্র সন্তান কিন্তু বিয়ের মাধ্যমে তিনি মিত্ৰতাও তৈরি করতে পারেন। কোর্চির পড়ে শোনানো বাবরের দিনলিপির কিছু কথা আকবরের মনে পড়লো: আমি এমনভাবে আমার স্ত্রীদের নির্বাচন করেছি যাতে আমার গোত্রপতি এবং শাসকেরা আমার প্রতি বিশ্বস্ত থাকে।

বাইরে থেকে হঠাৎ ভেসে আসা তীক্ষ্ম চি চি শব্দে বোঝা গেলো পেঁচা বা অন্যকোন নিশাচর শিকারী ছোট কোনো জীবকে আক্রমণ করেছে। সেই মুহূর্তে একটা সিদ্ধান্তে আসতে পেরে পরিতৃপ্ত আকবর দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙ্গলেন। তিনি তাঁর প্রথম স্ত্রী নির্বাচনে ততোটাই সতর্কভাবে চিন্তা করবেন যতোটা তিনি যুদ্ধ পরিকল্পনার ক্ষেত্রে করে থাকেন। হামিদা এবং গুলবদন যে মেয়েগুলির কথা বলেছেন তাঁদের একজন পুরানো মোগল রাজবংশের মেয়ে-একজন তার দূরসম্পর্কের খালাতো বোন এবং আরেকজন কাবুলের প্রশাসকের কন্যা-কিন্তু এই নারীগুলি সত্যিই কি হিন্দুস্তানের সম্রাটের জন্য উপযুক্ত? এদের সঙ্গে সম্পর্ক সৃষ্টি হলে সেইসব নেতারা কি তাঁর প্রতি বিশ্বস্ত হবেন যাদের তিনি মিত্র হিসেবে কামনা করেন?

*

আকবর যে উটটির পিঠে বসে ছিলেন সেটার পাঁজরের শেষাংশের মাংসল জায়গায় পায়ের গোড়ালি দাবিয়ে দিলেন। উটটি যমুনার চওড়া মেটে পারের উপর দিয়ে তীব্র বেগে সামনে ধাবিত হলো। উটের দৌড় প্রতিযোগীতা চলছে। নিরাপত্তা রক্ষাকারী সৈন্যদের বর্শার অগ্রভাগে অবস্থান করা জনতা উৎসাহ প্রদান করতে সম্মিলিত গর্জন তুললো। আকবর তার বাম পার্শ্বে অবস্থানকারী উজ্জল রঙের পোষাক পরিহিত রাজঅতিথিদের দিকে এক পলক তাকালেন-এদের মধ্যে লাল এবং কমলা পাগড়ি মাথায় রাজপুত রাজারা রয়েছেন যারা তার নতুন মিত্র-আগ্রার দুর্গপ্রাচীরের সম্মানিত স্থানে জড়ো হয়ে আছেন। কিন্তু এই মুহূর্তে প্রতিযোগীতায় জয় ছাড়া আর কোনো চিন্তা মাথায় আসা উচিত নয়। আকবরের বাম এবং ডান পা উটটির হাড় সর্বস্ব গলাকে পেচিয়ে একত্রিত হয়ে আছে। তার এক হাতে ধরা লাগামটি প্রাণীটির নাকে লাগানো পিতলের আংটার মধ্য দিয়ে টানা, আরেক হাতে একটি বাঁশের লাঠি। ঘোড়ার ছন্দবদ্ধ ও মসৃণ গতির তুলনায় উটের অসুবিধাজনক ভঙ্গির দৌড়ের বেগ বৃদ্ধি পাচ্ছিলো।

 তিনি নিজের উটটি ভালোই নির্বাচন করেছেন-পাকা শস্যের মতো রঙ বিশিষ্ট উটটি অল্প বয়সী পুরুষ, পিছনের পায়ের রান বলিষ্ঠ এবং দাঁতের বাড়ি খাওয়া শব্দ এবং থুতু ফেলার প্রবণতা দেখে এর সঞ্চিত শক্তির আভাস পাওয়া যায়। এক পলক দৃষ্টি বুলিয়ে আকবর বুঝতে পারলেন তিনি অন্য পাঁচজন প্রতিযোগীর তুলনায় এগিয়ে আছেন, কিন্তু দুই মাইল পথ পাড়ি দিতে হবে এবং এসময়ের মধ্যে যে কোনো ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তার নিচে মাটিকে ঝাপসা দেখা যাচ্ছিলো কিন্তু হঠাৎ আরেকটি উট আঁকি দিয়ে তার পাশে হাজির হলো এবং সেটার চালকের উরু তার পায়ের সঙ্গে বাড়ি খেলো। সে রাজা অম্বর এর চৌদ্দ বছর বয়সী পুত্র মানসিং, তার কালো চুল মাথার পেছনে উড়ছে। রাজপুতরা খ্যাতিমান চালক কিন্তু মোগলরাও তাদের চাইতে কম দক্ষ নয়…হট! হট! আকবর তার লাঠি উঁচিয়ে চিৎকার করলেন কিন্তু তাকে লাঠিটি ব্যবহার করতে হলো না। তাঁর উটটি ঘাড় ফিরিয়ে তার প্রতিদ্বন্দ্বীকে দেখে নিজে থেকেই দৌড়ের গতি বাড়িয়ে দিলো।

 কয়েক মুহূর্তের জন্য জানোয়ার দুটি সমপর্যায়ে রইলো, কিন্তু তারপর আকবর আবার এগিয়ে গেলেন। তাঁর চতুর্দিকে সবকিছু দ্রুত পিছিয়ে যাচ্ছে এবং মানুষ ও পশুর সম্মিলিত ঘামের গন্ধ নাকে আসছে। হট! হট! তিনি আবার চেঁচিয়ে উঠলেন, এর ফলে তাঁর উত্তেজনা যেমন প্রশমিত হলো, একই সাথে উটটিকেও তাগাদা দেয়া হলো। তাঁর গলা ধূলায় পূর্ণ এবং মুখ থেকে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে কিন্তু তাঁর একমাত্র মনোযোগ দুইশ গজ সামনে মাটিতে গাঁথা দৌড়ের শেষ সীমা নির্ধারণকারী দুটি বর্শার দিকে। ঘাড় ফিরিয়ে তিনি দেখলেন মানসিং এর কাছ থেকে তিনি প্রায় পাঁচ গজ সামনে এগিয়ে আছেন। তাঁর মনে হলো তিনি উড়ছেন এবং দ্রুতবেগে নিশ্চিত বিজয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।

কিন্তু হঠাৎ আকবরের উটটি হোঁচট খেলো, সেটির সামনের পা দুটি বেকায়দা ভাবে শুকনো কাঁটা ঝোঁপের মধ্যে জড়িয়ে গিয়ে, দৌড়ের শেষ সীমায় দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকায় আকবর ঝোঁপটি খেয়াল করেননি। উটটির সামনের পা দুটি যখন আটকে গেলো, তখন আকবর যতোটা সম্ভব পিছনে হেলে পড়লেন কুঁজের উপর- সেইসঙ্গে শক্তভাবে জানোয়ারটির পাজরের সঙ্গে বাম পা আটকে নিজের ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করলেন। একই সাথে আকবর লাগাম শিথিল করলেন উটটিকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার সুযোগ দেয়ার জন্য যদিও তার সহজাত প্রবৃত্তি বলছিলো সেটা শক্তভাবে টেনে রাখার জন্য। কিন্তু উটটির মাথা তখন প্রায় মাটি ছুঁয়েছে এবং সেটি মাটিতে আছড়ে পরার উপক্রম করলো। লাগাম সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়ে আকবর সামনের দিকে ছিটকে গেলেন এবং প্রাণীটির ঘাড়ের পিছনের মাংসল অংশে দৃঢ়ভাবে এঁটে থেকে অনুমান করার চেষ্টা করলেন সেটি কোনো পাশে পড়তে পারে, যাতে সেটার নিচে চাপা পড়তে না হয়। কিন্তু কোনোক্রমে উটটি আবার স্বাভাবিক হতে পারলো এবং ঝোঁপটিকে পেরিয়ে সামনে ধেয়ে গেলো। আকবর লাগাম আঁকড়ে ধরে সবলে নিজেকে সোজা করে ভারসাম্য রক্ষা করলেন। সম্পূর্ণ ঘটনাটির ব্যাপ্তি কয়েক মুহূর্ত কিন্তু তা মানসিংকে আকবরের কাছে পৌঁছে যাওয়ার সুযোগ দিলো। তারা আবার সমপর্যায়ে এসে পড়লো। হট, আকবর চিৎকার করলেন, হট! এবং উটটি আবার তার চিৎকারে সাড়া দিলো, সেটির গলা প্রায় সমান্তরাল এবং প্রবলভাবে নাক দিয়ে শ্বাস টানছে। পাঁচ কদম পেরিয়ে আকবর বর্শা দুটির মাঝ দিয়ে অতিক্রম করে গেলেন, তিনি তখন মানসিং এর কাছ থেকে এক ফুট সামনে। আকবর দৌড়ের সীমা অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তুত থাকা ঢুলিরা ঢোলের সম্মিলিত গর্জন তুলে তাঁর বিজয় ঘোষণা করলো। আকবর তার উত্তাপ ছড়াতে থাকা উটটির পিঠ থেকে লাফিয়ে নামলেন, বেঁচে যাওয়া এবং জয়ী হওয়ার জন্য প্রচণ্ড উল্লাস নিয়ে।

*

দুই ঘন্টা পরের ঘটনা। ঘনিয়ে আসতে থাকা আধারের পটভূমিতে ছায়ার আকারে বাদুরের দল তাদের নিশি অভিযানে যাত্রা করছে। আকবর আগ্রার দুর্গের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন, সদ্য গোসল করে সোনার কারুকাজখচিত জোব্বা আর পাজামা পড়েছেন। গলায় বক্র পান্না দিয়ে তৈরি সোনার মালা। উটের দৌড়ের প্রতিক্রিয়ায় তার শরীরের পেশীগুলি এখনো ব্যথা করছে কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। তাঁর রাজপুত অতিথিরা চারপশে জড়ো হয়ে আছেন উৎসবের পরবর্তী আয়োজন উপভোগ করার জন্য। রাজপুতদের অহমিকার কথা মনে রেখে আকবর এমন জমকালো উৎসবের আয়োজন করেছেন যে, তারা নিজেদের রাজ্যে ফিরে যাওয়ার আগেই তাদের প্রজারা জেনে যাবে মোগল সম্রাট তাদের শাসকদের কতোটা শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছেন।

আকবরের কাছ থেকে সংকেত পেয়ে আতশবাজী ছোঁড়া হলো, সেগুলি বন্দুকের চেয়েও উচ্চশব্দে সোনালী এবং সবুজ রঙ ধারণ করে আকাশে বিস্ফোরিত হলো এবং একে অনুসরণ করলো রূপালী এবং লাল আলোর ঝলকানি। এরপর বিস্ফোরিত হলো জাফরানী হলুদ, একে যে তীব্র শব্দ সঙ্গ দিলো-মনে হলো সেটা কোনো দানবাকৃতির ঈগলের চিৎকার। তারপর আকাশে সূক্ষ্ম কুয়াশার মতো গাঢ় লাল এবং গোলাপি আভার বিচ্ছুরণ হলো। নিজের চারপাশে এবং যমুনার পারে জড়ো হওয়া জনতার মাঝে ছড়িয়ে পড়া উত্তেজিত ধ্বনি আকবরের কানে এলো। কাশগড়ের জাদুকররা এই মনোমুগ্ধকর আতশবাজির প্রদর্শনীতে বিশেষ দক্ষ। আকবর তাঁদের আদেশ করেন তাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার জন্য এবং তারা তাকে নিরাশ করেনি। হঠাৎ হুশ হুশ শব্দের সাথে আকাশে দেখা দিলো বিশালদেহী একটি বাঘ, সেটি এতো বড় হা করে আছে যেনো পুরো জগতটা গিলে ফেলবে। কয়েক মুহূর্ত সেটি আকাশে স্থির থাকলো-চমৎকারিত্বপূর্ণ এবং হিংস্র, তারপর কমলা এবং কালো ডোরা গুলি ছোট ছোট উজ্জ্বল তারার আকারে বিলীন হয়ে গেলো।

 আমরা সবাই এখন বাঘের ছায়া দ্বারা আবৃত, অম্বরের রাজা ভগবান দাশ বললেন, তিনি বেটে আকারের পাকানো শরীরের অধিকারী একজন মানুষ বয়স ত্রিশের কোঠায়, নাকটি ঈগলের ঠোঁটের মতো বাঁকানো তার পুত্র মানসিং এর মতোই, কপালে হিন্দুরীতির সিদুরের তিলক রয়েছে।

বাঘ হলো আমার রাজবংশের ঐতিহ্য, আপনি ঠিকই বলেছেন, আকবর উত্তর দিলেন, কিন্তু আমরা সকলেই কি জানোয়ারটির সাহস এবং শক্তিকে সমীহ করি না? আমাদের মাঝে এমন কেউ কি আছেন যিনি প্রাণীটির শক্তি এবং চাতুর্যপূর্ণ শিকারের কৌশলের বিপরীতে অসহায় বোধ করেননি? আমার আশা একদিন সমগ্র হিন্দুস্তানের মানুষ এই বাঘকে আলিঙ্গন করবে তাঁদের সম্মিলিত শক্তির প্রতীক হিসেবে।

হয়তো তাই হবে জাঁহাপনা, ভগবান দাশ আর একবার আকাশের দিকে তাকাতে তাকাতে রহস্যময়ভাবে উত্তর দিলেন, সেখানে এখন কেবল রাতের তারারা ঝিকমিক করছে।

 আমি প্রার্থনা করি তা হোক এবং আপনি ও আমি সত্যিকার সহযোদ্ধা হিসেবে বহুবার যুদ্ধ এবং বিজয় অভিযানের উদ্দেশ্যে ঘোড়া ছুটাই, আকবর নিজের মনোভাব বজায় রেখে বললেন এবং লক্ষ্য করলেন ভগবান দাশ তাঁর দিকে দ্রুত একপলক তাকালো। তিনি যেসব রাজপুত নেতাকে আগ্রায় তলব করেছেন তাঁদের মধ্যে বিকানার, জয়সলমীর এবং গোয়ালিয়র এর শাসকরা রয়েছেন। কিন্তু এদের মধ্যে ভগবান দাশ সবচেয়ে শক্তিশালী এবং তুলনামূলকভাবে অধিক চৌকশ এবং উচ্চাভিলাষী এবং মেওয়ারের রানা উদয় সিং এর সঙ্গে তার মিত্রতা নেই। উদয় সিং যদি পাহাড়ী অঞ্চল থেকে বেরিয়ে এসে তার হারানো ভূ-খণ্ড পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে তাহলে তার মোকাবেলা করার জন্য আকবরের ইচ্ছা ভগবান দাসের সেনাবাহিনী মোগলদের পাশে থাকুক। তার আজ রাতের পরিকল্পনা যদি সফল হয় তাহলে ভগবান দাশ নিশ্চিতভাবেই সমগ্র জীবনের জন্য তাঁর মিত্র হবেন। আকবর তাঁর হাতটি ভগবান দাশের কাঁধে রেখে বললেন, আসুন ভগবান দাশ, আমরা একসঙ্গে ভোজ সভায় অংশ নেই যেমনটি সত্যিকার মিত্রদের করা উচিত।

আকবর, ভগবান দাশ এবং অন্যান্যদের পথ দেখিয়ে একটি চারকোণা উঠানে নিয়ে এলেন। তিনটি আট ফুট উঁচু ঝাড়বাতিদান উঠানটি আলোকিত করে রেখেছে। বাতিদান গুলির প্রত্যেকটিতে এক ডজন করে বার ফুট লম্বা জেসমিন এর ঘ্রাণযুক্ত মোমবাতি স্থাপন করা। এছাড়াও সমগ্র উঠান জুড়ে রত্নখচিত সোনালী ছোট ছোট বাতিদানে ছোট আকারের মোমবাতি এবং সুগন্ধী তেলের প্রদীপ জ্বলছে। মেঝেতে রেশমের শতরঞ্জি বিছানো। তিন দিকে স্থাপিত খাবারের নিচু টেবিল গুলিকে ঘিরে কিংখাব মোড়া তাকিয়া রাখা হয়েছে বসার জন্য। চতুর্থ দিকে সোনালী নকশা বিশিষ্ট সবুজ মখমলের শামিয়ানার নিচে চওড়া মঞ্চ স্থাপন করা হয়েছে। মঞ্চে রয়েছে একটি টেবিল, একটি সোনার ছোট সিংহাসন এবং সাথে সোনার পাত মোড়া একাধিক ডিভান।

 আকবর এবং তাঁর প্রধান রাজপুত অতিথিরা মঞ্চে আসন গ্রহণ করার পর অতিথিদের সভাসদরা তাঁদের জন্য নির্ধারিত জায়গায় আসন গ্রহণ করলেন। পরিচারকরা আকবরের রাজকীয় রান্নাঘরের সর্বোৎকৃষ্ট খাবার থালায় করে পরিবেশন করতে লাগলো। পাখি ও চতুষ্পদ জন্তুর ঝলসানো মাংস, মাখন এবং উপাদেয় মসলায় রান্না করা ঝোলযুক্ত খাবার; ঘি, শুকনো ফল এবং বাদাম দিয়ে রান্না করা বিরানী, টাটকা ভাজা রুটি-এর মধ্যে রাজপুত কেতায় ঘোল দিয়ে তৈরি করা বজরা এবং অন্যান্য শস্যের রুটিও রয়েছে। আরো রয়েছে আঙ্গুর, তরমুজ এবং বহু প্রকার মোগলাই মিষ্টান্ন। সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে আকবর সন্তুষ্টি বোধ করলেন। অতিথিদের মধ্যে সামান্য জড়তার ভাব বিরাজ করছিলো, কিন্তু তা খুবই স্বাভাবিক-কারণ মাত্র কয়েক মাস আগেই তিনি উপস্থিত বেশ কয়েকজন অতিথির বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। আবার তাদের নিজদের কারো কারো মধ্যেও বৈরিতা রয়েছে। এই ভোজসভার উদ্দেশ্য হলো-যে রাজপুত যুবরাজেরা সর্বোচ্চ গর্বিতদের চেয়েও বেশি অহঙ্কারী, যারা দাবি করে তারা সূর্য এবং চন্দ্রের উত্তরসূরি-তাঁদের বুঝানো যে, এই প্রীতিকর মিত্রতা তাদের এবং আকবরের উভয়ের স্বার্থের জন্যই মঙ্গলকর।

 ভোজন শেষে পরিচারকরা অতিথিদের হাত মুখ ধোয়ার ব্যবস্থা করলো বেসন এবং সুগন্ধী পানি দিয়ে। অতিথিরা হাতের তেল-চর্বি পরিষ্কার করে মুখ ধুয়ে আরাম করে তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসলেন। এবারে আকবর উঠে দাঁড়িয়ে হাত তুলে সবাইকে চুপ করতে অনুরোধ করলেন এবং নিজের বক্তব্য শুরু করলেন।

 আমার বংশের লোকেরা হিন্দুস্তানকে ধ্বংস করে এর ধন-সম্পদ লুট করে নিজেদের দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য আসেননি। তারা এসেছিলেন তাঁদের ন্যায্য অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য-যেমন করে কোনো বর তার বহু প্রতীক্ষিত স্ত্রীকে বরণ করার জন্য আসে। আমি কেনো বলছি যে হিন্দুস্তানের দাবিদার মোগলরা? কারণ প্রায় একশ ষাট বছরেরও বেশি সময় আগে আমার পূর্বপুরুষ তৈমুর হিন্দুস্তান জয় করেছিলেন। যদিও তিনি এখানে স্থায়ী হননি, তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে শাসক নিযুক্ত করে গিয়েছিলেন, কিন্তু পরবর্তীতে এই ভূ-খণ্ড অবৈধ দখলকারীদের হাতে চলে যায়। অন্যদিকে উত্তরে নিজেদের দ্বন্দ্ব মোকাবেলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ায় মোগলরা তখন এ বিষয়ে আর কিছুই করতে পারেনি। তারপর চল্লিশ বছর আগে আমার পিতামহ বাবর এখানে ফিরে আসেন এবং সাম্রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু আমি হিন্দুস্তানের অধিবাসীদের প্রজা হিসেবে গণ্য করিনা অথবা তাদেরকে মোগল গোত্রগুলির তুলনায় নিকৃষ্টও মনে করি না। আমার চোখে সকল জাতি সমান। যদিও বিশ্বাসঘাতকরা কোনো প্রকার ক্ষমা লাভ করবে না, কিন্তু যারা আমার প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে তারা উত্তম রূপে পুরস্কৃত হবে। তাদেরকে আমার রাজ সভায় উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন পদে অধিষ্ঠিত করা হবে, আমার সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বেশি ক্ষমতা সম্পন্ন পদ গুলিতে নিয়োগ দেয়া হবে বিশেষ করে আপনাদের, যারা আমার রাজপুত বন্ধুরা জন্মগতভাবে যুদ্ধে পারদর্শী। আপনাদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা প্রকাশের জন্য আজ থেকে আমি ঘোষণা করছি আপনারা আমার ঘরের লোক বলে বিবেচিত হবেন। আমি আরো ঘোষণা করছি আজ থেকে আপনারা আপনাদের রাজ্যগুলি শাসন করবেন আমার নিযুক্ত প্রতিনিধি হিসেবে নয় বরং ওয়াতান হিসেবে নিজস্ব বংশধারার সদস্যরা যেভাবে রাজ্য শাসন করে।

আকবর আসন গ্রহণ করার সময় ভগবান দাশের দিকে এক পলক তাকালেন যিনি তার ডান পাশে বসে ছিলেন। আপনি আমাদের সম্মানিত করলেন জাহাপনা, রাজপুতটি বললেন।

এবং এখানে উপস্থিত হয়ে আপনি আমাকে সম্মানিত করেছেন, ভগবান দাশ, আমি আপনাকে আরো কিছু বলতে চাই। আমি বিয়ে করতে চাই। আপনার সবচেয়ে ছোট বোন হীরা বাঈ এর সৌন্দর্য এবং মর্যাদা সম্পর্কে আমি অবগত হয়েছি। তাকে আমার স্ত্রী হিসেবে সমর্পণ করতে কি আপনি রাজি আছেন?

ভগবান দাশ যেনো বজ্রাহত হয়েছেন, উত্তর না দিয়ে তিনি এক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, হীরা বাঈকে কেনো বিয়ে করতে চাইছেন জাহাপনা? হিন্দুস্তানের এতে নারীর পরিবর্তে আপনি আমার বোনকে কেনো নির্বাচন করলেন?

রাজপুতদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্যে। হিন্দুস্তানের সকল মানুষের মধ্যে আপনাদের সঙ্গেই মোগলদের সবচেয়ে বেশি সামঞ্জস্য রয়েছে-যারা যুদ্ধের শ্বেত উত্তাপে বলিষ্ঠ, গর্বিত এবং শক্তিশালী। আর সমস্ত রাজপুতদের মধ্যে আপনি ভগবান দাশ, সবচেয়ে অগ্রবর্তী। ইতোমধ্যে উটের দৌড়ের সময় আমি আপনার পুত্রের সাহস প্রত্যক্ষ করেছি। আমি নিশ্চিত আপনার বোন একজন উপযুক্ত সম্রাজ্ঞী বলে বিবেচিত হবে। আর খোলামেলা ভাবে বলছি- আমি আমার মিত্রদের আমার সঙ্গে কঠিন বন্ধনে আবদ্ধ করতে চাই। এবং এ ক্ষেত্রে বিবাহ বন্ধনের চেয়ে উত্তম আর কি হতে পারে?

 তাহলে এটাই আপনার অভিপ্রায়-রক্তের বন্ধনে আমার বংশের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করা? ভগবান দাশ ধীরে ধীরে বললেন, যেনো তিনি আকবরের প্রস্তাবের গূঢ় অর্থ আত্মস্থ ও ওজন করার চেষ্টা করছেন।

হ্যাঁ।

 এবং পরবর্তীতে আপনি আরো বিবাহ করবেন?

 নিশ্চয়ই, আমার সাম্রাজ্যকে সুসংহত করার জন্য তা প্রয়োজন হবে। কিন্তু আমি আপনার কাছে শপথ করছি, ভগবান দাশ, আমি সর্বদা আপনার বোনকে আমার প্রথম স্ত্রী হিসেবে এবং একজন রাজপুত রাজকন্যা হিসেবে উপযুক্ত মর্যাদা প্রদান করবো।

ভগবান দাশ কপালে কুঞ্চন নিয়ে বললেন, কিন্তু ইতোপূর্বে কোনো রাজপুত নারী তার নিজের সমাজের বাইরের কাউকে বিবাহ করেনি…এবং আপনার নিজের পরিবারও পূর্বপুরুষের রক্তের ধারা বিঘ্নিত করেনি।

 আপনার কথা সত্যি। কিন্তু আমি হিন্দুস্তানে জন্মগ্রহণ করা প্রথম মোগল সম্রাট। হিন্দুস্তান একাধারে আমার দেশ ও জন্মভূমি। তাহলে কেনো আমি একজন হিন্দুস্তানী স্ত্রী গ্রহণ করবো না?

কিন্তু আমরা রাজপুতরা হিন্দু। আমার বোনের জন্য নিজের সমাজের বাইরে বিয়ে করার চেয়েও অধিক কঠিন নিজের ধর্মের বাইরে বিয়ে করা। সে আপনার মুসলিম ধর্মমত গ্রহণ করতে পারবে না।

আমি তাকে মুসলিম হতে বলবো না। আমি তার ধর্মকে শ্রদ্ধা করি যা আমার অন্যান্য বহু প্রজারও ধর্ম। আমি কখনোই আমার প্রজাদের ধর্মের উপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করিনি, তাহলে আমি হীরাবাঈ এর সেই স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করবো কেনো?

ভগবান দাশের ঈগল সদৃশ চেহারা বিষণ্ণই রয়ে গেলো, এবারে আকবর তার দিকে কিছুটা ঝুকলেন। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি যা একজন সম্রাটের জবান- আমি হীরা বাঈকে কখনোই তার ধর্ম পরিত্যাগের জন্য জোর করবো না এবং রাজকীয় হারেমের মধ্যে মন্দির বানিয়ে সে তার দেবতাদের পূজা করার অধিকার পাবে।

 কিন্তু হয়তো আপনার নিজের পরিবার-আপনার সভাসদরা এবং আপনার মোল্লারা- এর প্রতিবাদ করবে?

 সাদা পাগড়ি, কালো আলখাল্লা এবং লম্বা দাড়ি বিশিষ্ট মোল্লাগণ যেখানে বসে ছিলো আকবর সেদিকে তাকালেন। তারা উপলব্ধি করবেন যে সাম্রাজ্যের মঙ্গলের জন্য আমি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তিনি বললেন, তারপর কণ্ঠে ইস্পাত দৃঢ়তা নিয়ে যোগ করলেন: তারা এটাও বুঝতে পারবেন যে এটা আমার ইচ্ছা।

হয়তো বুঝবে, হয়তো নাও বুঝতে পারে…আর আমার বোন আমার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট-কিছুটা একগুঁয়ে এবং জেদি প্রকৃতির মেয়ে, সে হয়তো এ প্রস্তাবে…

আপনার বোন একজন সম্রাজ্ঞী হবে এবং হয়তো পরবর্তী মোগল সম্রাটের জননীও- আর আপনি হবেন তার মামা। ভগবান দাশ, আপনি আপনার মতামত দিন। দয়া করে আমাকে নিরাশ করবেন না।

ভগবান দাশ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন, গলায় পড়া তিন প্যাঁচের মুক্তার মালায় তার আঙ্গুলগুলি খেলা করছে। অবশেষে তিনি হাসলেন। জাহাপনা, আপনার এই প্রস্তাব আমার পরিবারের জন্য সম্মানজনক। হীরা বাঈ আপনারই হবে। প্রার্থনা করি এই ঐক্যের প্রতি আমাদের সকল ভগবানের আশীর্বাদ বর্ষিত হোক।

*

কমলা এবং সোনালী সুতার কারুকাজ করা ঘন লাল রঙ্গের ঘোমটায় ঢাকা মেয়েটি একদম স্থির হয়ে বসে ছিলো। মাথায় পড়া মুকুটটি মুক্তা এবং সোনার সুতায় তৈরি করা ফুল পাতায় অলংকৃত। এটি আকবরের দেয়া বিয়ের উপহার। সাদা পোষাক পরিহিত হিন্দু পুরোহিত বিয়েতে তার ভূমিকাটুকু সম্পন্ন করেছেন এবং এখন আকবরের পক্ষে একজন মাওলানা মুসলিম রীতি অনুযায়ী কোরান থেকে আয়াত পাঠ করবেন। মাওলানা যখন সুললিত ছন্দে তেলাওয়াৎ করছেন আকবর লক্ষ্য করলেন মেয়েটির একটি সরু পেলব চরণ পোষাকের নিচ থেকে বেরিয়ে এসেছে। সেটি মেহেদীর জটিল নকশায় কারুকাজ করা।

আকবর নিজের হাতের দিকে তাকালেন, তাঁর হাত দুটিতেও মেহেদীর কারুকাজ-মা ও ফুফু সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে তাকে মেহেদী পড়িয়ে দিয়েছেন। তারা এখন উইলো গাছের শাখা দিয়ে তৈরি আড়ালের পেছন থেকে বিবাহ উৎসব প্রত্যক্ষ করছেন।

এক সময় তেলাওয়াৎ শেষ হলো, মাওলানা তার হাতির দাঁতের মলাট বিশিষ্ট কোরানটি বন্ধ করে সেটি পরিচারকের হাতে দিয়ে দিলেন। এর পর মাওলানা একটি গোলাপজলের জগ নিয়ে আকবরের বাড়িয়ে দেয়া হাত দুটিতে গোলাপজল ঢাললেন প্রতীকি পবিত্রতা আনয়নের জন্য। তারপর সলোমানি পাথরে (আকিক পাথর) তৈরি পাত্র থেকে আকবরের হাতে তরল পানীয় ঢাললেন এবং বললেন, বিবাহ বন্ধন নিশ্চিত করার জন্য পান করুন জাহাপনা।

আকবর সামান্য পান করলেন, তারপর হীরা বাঈ এর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন তাকে নিয়ে বিবাহ ভোজে যোগ দেয়ার জন্য। হিন্দু রীতি অনুযায়ী এই ভোজের আয়োজন করেছে কনে পক্ষ। আকবর ভগবান দাশকে আগ্রা দূর্গে উত্তম সাজ-সজ্জা বিশিষ্ট কয়েকটি কক্ষ প্রদান করেছেন তার পরিবারের সদস্যবৃন্দ এবং অন্যান্য সফরসঙ্গী ও কর্মচারী-ভৃত্যদের নিয়ে থাকার জন্য। আজকের দিন থেকে একমাস ব্যাপী উৎসব অনুষ্ঠানের সূচনা হবে। উপহার প্রদান, শোভাযাত্রা, শিকার, হাতির লড়াই, যুদ্ধমহড়া প্রভৃতি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এই উৎসব মাস উদ্যাপিত হবে। কিন্তু ভোজসভা যতো অগ্রসর হচ্ছিলো ততোই আকবর আসন্ন রাত সম্পর্কে সামান্য অনিশ্চয়তা অনুভব করছিলেন। রক্ষিতাঁদের সঙ্গে আদান-প্রদানকৃত উপভোগের তৃপ্তি তার জন্য পরিচিত আনন্দপূর্ণ একটি বিষয় ছিলো। তাদের নরম পেলব হাত এবং সুগন্ধযুক্ত শরীর তাকে রাজকার্যের বোঝা থেকে সর্বদাই নিস্কৃতি দিয়ে এসেছে। কিন্তু একজন কুমারী রাজপুত রাজকন্যা শয্যাসঙ্গিনী হিসেবে তার জন্য অভিনব অভিজ্ঞতা হবে।

 পাশে বসে থাকা হীরা বাঈ এর দিকে আকবর এক পলক তাকালেন, এখনো ঝলমলে ঘোমটার আড়ালে তার মুখ ঢাকা। মেয়েটি কেমন হবে? এই প্রশ্ন শততম বারের মতো তাঁর মনে উদয় হলো। রাজপুত নারীরা তাঁদের চোখ ঝলসানো রূপের জন্য প্রসিদ্ধ, কিন্তু এই মেয়েটি যদি তেমন সুন্দর নাও হয় তাতে কোনো সমস্যা নেই, আকবর নিজেকে বললেন। যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, এই বিবাহের মাধ্যমে তিনি অম্বর রাজ্যটিকে নিজের সঙ্গে সুদৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করলেন। এ ধরনের আরো মিত্রতা ভবিষ্যতে সম্পাদিত হবে।

আকবর ভোজের পাশাপাশি আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দিকে মনোযোগ প্রদানের চেষ্টা করলেন। কমলা রঙের পাগড়ি পড়া সুঠামদেহী উন্মুক্ত বক্ষের দুলিদের উদ্দাম ঢাকের তালে তালে এবং মোহনীয় বাঁশির সুরে ময়ূরনীল ঘাগড়া পরিহিত অম্বরের নর্তকীরা তাঁর সামনে ঘুরে ঘুরে নাচছে। রাজপুত গায়করা যুদ্ধক্ষেত্রের বিক্রম প্রকাশক কোনো গান গাইছে উচ্চ স্বরে, বাজিকররা আগুন জ্বলা দড়ির ফাঁসের মধ্যদিয়ে ডিগবাজি খেয়ে পার হচ্ছে, আয়নার কাঁচ বসান জোব্বা পরিহিত এক বৃদ্ধ তার পোষাকে মোমর আলোর প্রতিফলন ঘটিয়ে ঝুড়ির মধ্য থাকা একটি অজগর সাপকে প্রলুব্ধ করে খেলা দেখাচ্ছে।

অবশেষে এলো সেই চূড়ান্ত মুহূর্ত যা আকবর নিজে পরিকল্পনা করেছেন। আকবরের প্রধান শিকারী উৎসব কক্ষে প্রবেশ করলো। তার পিছু পিছু এলো একটি বলিষ্ঠ দেহের অল্পবয়সী চিতাবাঘ। বাঘটির তামাটে গলায় চুনি ও হীরা খচিত গ্রীবাবন্ধনী সংযুক্ত। সেটার চোখের নিচের অশ্রুজলের দাগ পড়া অংশটি সোনা দিয়ে গিলটি করা, মনে হচ্ছে যেনো কোনো পৌরাণিক কল্পকাহিনী থেকে বেরিয়ে আসা একটি জানোয়ার। আচমকা সেটার লেজের ঝাঁপটায় একটি পানপাত্র মাটিতে আছড়ে পড়লো, সঙ্গে সঙ্গে শিকারীটি বাঘটির গলার সঙ্গে যুক্ত চামড়ার রঙ্কুটি গুটিয়ে সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করলো।

আকবর উঠে দাঁড়ালেন এবং ভগবান দাশকে লক্ষ্যকরে বললেন, এই বাঘটির নাম জালা, আমার প্রিয় শিকারী চিতাটির বাচ্চা। এই শুভ উৎসবে ওকে আমার পক্ষ থেকে আপনাকে উপহার হিসেবে প্রদান করতে চাই।

রাজার চোখ দুটি উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। আকবর জানতেন ভগবান দাশ তাঁর মতোই শিকার করতে পছন্দ করেন। এর থেকেও যেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো চিতাবাঘ অত্যন্ত বিরল এবং মূল্যবান, সত্যিকার রাজকীয় প্রাণী। এটা নিঃসন্দেহে একটি ব্যতিক্রমী উপহার। রাজা প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লেন। রাজার উচ্ছ্বসিত মুখভাব এক নজর প্রত্যক্ষ করে আকবর আবার বললেন, আমার শিকারীরা ওর প্রশিক্ষণ অব্যাহত রাখবে এবং যখন তার প্রশিক্ষণ শেষ হবে আমি তাকে আপনার কাছে পাঠিয়ে দেবো। আকবর জালার কাছে এগিয়ে গেলেন এবং তার নত মার্জিত মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন। তোর বাবা যেমন আমার শিকারের সময় তড়িৎ এবং নির্ভীক আচরণ করে তেমনি তুইও তোর নতুন মনিবের জন্য করিস।

বিয়ের অনুষ্ঠান যখন শেষ হলো চাঁদ তখন আকাশের অনেক উপরে, এর ঠাণ্ডা ফ্যাকাশে আলো যমুনার পানিকে তরল রূপায় পরিণত করেছে। যমুনার জল হীরা বাঈ এর জন্য নির্ধারিত হেরেম কক্ষের তিরিশ ফুট নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বাজিয়েদের অনুসরণ করে আকবর হীরাবাঈকে নিয়ে কক্ষটিতে পৌঁছেছেন। আকবরের পরিচারকরা যখন তার পোষাক খুলে দিচ্ছিলো তখন তিনি কক্ষের এক প্রান্তে স্থাপিত সোনার কারুকাজ করা এবং ফুল ও তারা খচিত পর্দার দিকে তাকালেন-গুজরাটের বিখ্যাত তাঁতীরা দক্ষ হাতে সেটি তৈরি করেছে-ওটার আড়ালে নববধূর বিয়ের পোষাক খুলে সুগন্ধী তেল মেখে বাসর শয্যার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। যখন শেষ পরিচারকটি বিদায় নিল, আকবর তার সবুজ ঢিলা আলখাল্লাটি খুলে রেখে পর্দার কাছে উপস্থিত হলেন এবং পর্দা সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন। হীরাবাঈ তাঁর দিকে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো, স্বচ্ছ জাম রঙের মসলিন পোষাকের মধ্যদিয়ে তার ছিপছিপে শরীরের আবয়ব স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো। তার গাঢ় লাল মেহেদী দেয়া চুল উজ্জ্বল ঢেউ এর মতো নিতম্ব পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। আড়ষ্ট কাঁধ দুটি দেখে আকবর অনুমান করতে পারলেন সে অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে আছে।

হীরাবাঈ…ভয় পেও না। আমাকে ভয় করার মতো কিছু নেই। আকবর তার কাঁধে দুহাত রেখে আলতোভাবে নিজের দিকে ঘুরালেন। হয়তো তার চোখের অভিব্যক্তি-চিতার মতোই বুনো-আকবরকে সতর্ক করলো। হীরাবাঈ মুচড়ে আকবরের হাত থেকে মুক্ত হয়ে যখন ডান হাতটি উপরে তুললো, আকবর তার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। যুদ্ধ ক্ষেত্রে যেমনটা করে থাকেন তেমনি তড়িৎ বেগে এগিয়ে গিয়ে তিনি বজ্রমুষ্ঠিতে তার কব্জি আকড়ে ধরলেন, ব্যথায় হীরাবাঈ চিৎকার করলো এবং একটি চওড়া ফলার ধারালো ছুরি তার হাত থেকে খসে পড়লো।

কেনো এমন করলে? আকবর চাপা স্বরে জানতে চাইলেন, এখনো তিনি শক্ত করে তার কব্জি ধরে আছেন। কেনো? আকবর আবার জিজ্ঞাসা করলেন, এবার তার গলার স্বর খানিকটা উচ্চে উঠলো, হীরাবাঈ এর মুখ আকবরের মুখ থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে। কিন্তু হীরাবাঈ চুপ করে রইলো।

তার চোখ দুটি তার ভাইয়ের মতোই ঘন কালো রঙের, সেখানে এক রাশ ঘৃণা জমে আছে। অবশেষে সে কথা বলে উঠলো। কারণ আপনি আমার স্বজাতীয়দের শত্রু-চিত্তরগড়ের অগণিত বীর রাজপুতের হত্যাকারী এবং তাদের নারীদের, যারা আপনার সৈন্যদের লাঞ্ছনা থেকে বাঁচার জন্য জওহর সম্পাদন (আগুনে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করা) করেছে। আমি নিজেও ওদের সঙ্গে মরতে পারলে ভালো হতো। আপনার কাছে নিজেকে সমর্পণের পরিবর্তে আমি খুশিমনে আগুনকে আলিঙ্গন করতে পারতাম।

আকবর হীরাবাঈকে ছেড়ে দিলেন, সে এলোমেলো ধাপে কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে নিজের ভারসাম্য ঠিক করলো, তারপর নিজের কব্জি ডলতে লাগলো। আকবর তাকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন, যদিবা আর কোনো অস্ত্র তার কাছে থাকে, কিন্তু তার প্রায় নগ্ন শরীরে তেমন কিছু দেখা গেলো না। তোমার বড়ভাই স্বেচ্ছায় তোমাকে আমার কাছে সোপর্দ করেছেন। তিনি কি তোমার মনোভাব সম্পর্কে জানেন? একটি নতুন ভাবনা আকবরের মাথায় এলো। হয়তো তিনি জানতেন তুমি আমাকে হত্যা করতে চাও। তিনিও কি তোমাকে এ বিষয়ে উস্কে দিয়েছেন?

 এই প্রথমবারের মতো হীরাবাঈকে শঙ্কিত মনে হলো। না, তিনি কিছুই জানেন না। নিজ পরিবারের নারীদের তিনি খুব একটা সময় দেন না। এমনকি আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে হতে যাচ্ছে এ খবরটিও আমি জানতে পেরেছি চিঠির মাধ্যমে।

আমার এখন উচিত রক্ষীদের তলব করা এবং সূর্যোদয়ের আগেই তোমার উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা।

 এখনই তা করুন।

তুমি কি সত্যিই মরতে চাও? সমগ্র জগত যখন জানবে তুমি কি করতে চেয়েছিলে, তখন তোমার বড়ভাইকে বাকি জীবনটা লজ্জা এবং অসম্মানের সঙ্গে কাটাতে হবে। এমন লোকের সঙ্গে কোনো রাজপুত নেতা সম্পর্ক রাখতে চাইবে যার বোন সকল সভ্য দায়িত্ববোধ এবং সম্মানকে বিসর্জন দিতে চেয়েছে। রাজপুতরা যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁদের বীরত্বের জন্য প্রসিদ্ধ, গোপন হত্যাকাণ্ড বা প্রতারণার জন্য নয়।

 হীরাবাঈ ফুঁসে উঠলো। প্রথম বারের মতো আকবরের চোখে তার অপরূপ সৌন্দর্য ধরা পড়লো, ডিম্বাকৃতি মুখটির হাড়ের গঠন বিড়ালের মতোই সুন্দৰ প্ৰা পুলভিশ্বকৃতি মুশুনি কমনীয় এবং কোমল ত্বক একদম নতুন মধুর রঙের মতো। কিন্তু তার এই সৌন্দর্য তখন আকবরের কাছে অর্থহীন হয়ে পড়েছে। লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে তিনি তার দুই কাঁধ আকড়ে ধরলেন।

শোনো। একটি বোকা মেয়ের নির্বুদ্ধিতার জন্য আমি রাজপুত রাজ্যগুলির সঙ্গে আমার বহু প্রত্যাশিত মিত্রতা নষ্ট করবো না। চিত্তরগড়ের পতনের পর যে সব যোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছে, সম্মানজনক মৃত্যুই তাঁদের প্রত্যাশা ছিলো। রাজপুত যুদ্ধরীতি অনুযায়ী বেঁচে থাকা তাঁদের জন্য লজ্জাকর হতো। তোমার নিশ্চয়ই এটা অজানা নয়? সে কিছু বললো না, কিন্তু আকবর অনুভব করলেন হীরাবাঈ এর শরীর থেকে যুদ্ধংদেহী তেজ ক্রমশঃ অপসারিত হয়ে যাচ্ছে। তিনি তার কাঁধে রাখা হাত দুটিও শিথিল করলেন। একটু আগে যা ঘটলো আমি সে সম্পর্কে কাউকে কিছু বলবো না এবং তুমি যদি তোমার পরিবারের মর্যাদাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে চাও তাহলে তুমিও কিছু বলবে না। তুমি আমার স্ত্রী এবং একজন স্ত্রীর কর্তব্য তোমাকে পালন করতে হবে। তুমি আমার কথা বুঝতে পেরেছো?

 হীরা বাঈ সম্মতিসূচক মাথা নাড়লো।

 তাহলে আমার স্ত্রী হিসেবে এখন তুমি তোমার প্রথম দায়িত্ব পালন করো। আকবর বিছানার দিকে তাকালেন। হীরাবাঈ একটু সরে গেলো এবং কোমরে বাধা মুক্তার বন্ধনটির বাধন খুলতেই তার মসলিনের অন্তর্বাসটি মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো। তার কমনীয় বাক বিশিষ্ট শরীরটি প্রলুব্ধকর দেখালো, কিন্তু আকবর যখন নিজের শরীরটি তার উপর স্থাপন করলেন তখন তাঁর মনে কামনার পরিবর্তে ক্রোধই বেশি প্রভাব বিস্তার করে আছে। আকবরের দেহ আন্দোলিত হতে লাগলো কিন্তু তার চোখ হীরাবাঈ এর মুখের উপর থেকে সরলো না। হীরাবাঈ এর চেহারায় ব্যথা বা অস্বস্তির কোনো অভিব্যক্তি ফুটে উঠলো না যখন তার শরীরে আকবরের প্রবেশের গতি দ্রুত থেকে দ্রুততর হলো। তৃপ্তিলাভের পরিবর্তে কাজটি সম্পন্ন করার জন্যই আকবর তখন উদ্গ্রীব। তার কুমারী স্ত্রীর সঙ্গে বাসর রাতটি এভাবে কাটবে বলে তিনি ভাবেননি। আদম খানের মতো তাঁর নবপরিণতা স্ত্রীও তার বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে। হীরাবাঈ, যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর মোকাবেলা করা যে কোনো শত্রুর মতোই বৈরী। কিন্তু আদম খানের মতো অন্য শক্ররাও তাঁদের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছে যে আকবরের সঙ্গে বিরোধিতা তাঁদের অনুকূলে যায়নি। হীরাবাঈ হয়তো জীবন থাকতেই তা বুঝতে পারবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *