১.২ উপহার হিসেবে প্রাপ্ত রক্ষিতা

০৪. উপহার হিসেবে প্রাপ্ত রক্ষিতা

বৈরাম খানের সাথে কীভাবে এতো অকৃতজ্ঞের মতো আচরণ করলে! হামিদা আকবরের কাঁধ আকড়ে ধরলেন। কে তোমাকে এই বুদ্ধি দিলো? কেউ না। আকবর এবিষয়ে মাহাম আঙ্গার ভূমিকা প্রকাশ করতে চাইলেন না। তিনি তাঁর ইচ্ছাকেই রূপ দিয়েছেন এবং আগে পরে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা তার নিজেরই ছিলো। সেই মুহূর্তে আকবরের মনে হলো হামিদা তার গালে একটা চড় বসিয়ে দেবেন। তিনি তাকে কখনোই এতো ক্রুদ্ধ হতে দেখেননি।

তিনি দিল্লী থেকে ফিরে আসলে তাঁকে কথাটা বলতে পারতে, তাঁর ফেরার সময়তো প্রায় হয়ে এসেছিলো। তারচেয়েও খারাপ যেটা হয়েছে, কথাটা আমাকে সরাসরি বলার মতো সাহস না পেয়ে তুমি শিকার করতে চলে গেলে এবং আমি সবকিছু জানতে পারলাম স্বয়ং বৈরাম খানের পাঠানো চিঠি থেকে!

মায়ের বক্তেব্যের সত্যতায় আকবরের মুখমণ্ডল আরক্ত হয়ে উঠলো। চিঠিটিতে নিজের সীলমোহর প্রদান করে সেটা তাঁর দূতের হাতে দিল্লীতে রওনা করিয়ে দিয়েই তিনি চার দিনের জন্য বাঘ শিকারে চলে যান। তাঁর এই সিদ্ধান্ত যদি সৎ হতো তাহলে মায়ের মুখোমুখী হওয়ার ক্ষেত্রে তিনি ইতস্তত করতেননা অথবা শিকারের নামে বাস্তবতা এড়াতে চাইতেন না। তবুও শিকার থেকে ফিরেই তিনি মাকে বলতে চেয়েছেন…কি বলবেন তা মনে মনে চর্চাও করেছেন। আসলে আগ্রা থেকে দিল্লী যাতায়াত করতে একজন দূতের যতোটা সময় লাগে সে সম্পর্কে তার হিসাব ভুল ছিলো। তাই শিকার থেকে ফিরে দেখেন হামিদা তাঁর কক্ষেই তার জন্য অপেক্ষা করছেন।

বৈরাম খান কি লিখেছেন?

লিখেছেন কোনো রকম পূর্ব সতর্কবাণী বা ব্যাখ্যা ছাড়াই তুমি তাঁকে হজ্জ্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছে এবং স্বয়ং আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিতে না পারার জন্য তিনি অনুতপ্ত। চিঠিটা পাওয়ার সাথে সাথে আমি তাঁকে অনুরোধ করে উত্তর পাঠাই তিনি যেনো রাজধানীতে চলে আসেন। আমার পত্রবাহক তার নাগাল পায় যখন তিনি দিল্লী থেকে কয়েক দিনের পথ দূরে। তিনি কি উত্তর দিয়েছেন শোন। আবেগ কম্পিত কণ্ঠে তিনি পড়তে শুরু করলেন: ফিরে আসতে বলে আপনি আমার প্রতি অসীম উদারতা প্রদর্শন করেছেন সম্রাজ্ঞী, কিন্তু তা সম্ভব নয়। আপনার পুত্র মহামান্য সম্রাট আমাকে হজ্জ্ব পালনের নির্দেশ দিয়েছেন। আমি আপনার স্বামীর প্রতি সর্বদা বিশ্বস্ত ছিলাম যিনি যুদ্ধে আমার জীবন বাঁচিয়েছিলেন, আমি বর্তমান সম্রাটের প্রতিও অনুরূপ বিশ্বস্ত থাকতে চাই। আপনার পরিবারের উপর স্রষ্টার আশীর্বাদ বর্ষিত হোক এবং হিন্দুস্তানের বুকে তা আরো মহান হয়ে উঠুক এই কামনা করছি। বৈরাম খান একাধারে তোমার শ্রেষ্ঠ বন্ধু এবং উপদেষ্টা ছিলেন আকবর। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হওয়ার পরিবর্তে তুমি তাকে অসম্মানজনকভাবে প্রত্যাখ্যান করলে?

 আমি সর্বদাই তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো, কিন্তু তিনি বুঝতে পারছিলেন না যে শাসনকার্য পরিচালনার জন্য আমি প্রস্তুত-এবং তুমিও তাই। তিনি ফিরে এসে আমার সাফল্য দেখতে পাবেন এবং আমি তাকে আমার সভায় কোনো সম্মানিত পদে নিযুক্ত করবো। আকবর দৃঢ়কণ্ঠে বললেন। কিন্তু বৈরাম খানকে তিনি যেভাবে চাকরিচ্যুত করেছেন সে ব্যাপারে তার মন এখন দ্বিধাবিভক্ত। তিনি কিছুতেই তার এই অনুভূতিকে উপেক্ষা করতে পারছেন না। তিনি কি ভুল করেছেন? সম্ভবত জীবনে এই প্রথম তিনি তাঁর গ্রহণ করা কোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে নিজের মনের কাছেই প্রশ্নবিদ্ধ হলেন। এখনো তার মা তাকে তিরস্কার করে চলেছেন।

তোমার এখনো অনেক কিছু শেখার বাকি আছে। তুমি কীভাবে ভাবছো যে বৈরাম খানের মতো একজন আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মানুষ তোমার হাতে আবারো নাজেহাল হওয়ার ঝুঁকি নেবেন? তিনি আর আমাদের কাছে ফিরে আসবেন না এবং সেটা তোমার জন্য ক্ষতি ছাড়া আর কিছু নয়।

 তখনো হামিদা কথা বলে যাচ্ছেন, কিন্তু আকবর কল্পনায় মাহাম আঙ্গার মুখ দেখতে পেলেন। তিনি তাঁর একজন অত্যন্ত বিশ্বস্ত আস্থাভাজন এবং বৈরাম খানকে অব্যাহতি প্রদানের ক্ষেত্রে তিনি তাঁর সঙ্গে একমত হয়েছেন…মা তার নেয়া সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তাকে দুর্বল করে ফেলছেন। মাকে এটা করতে দেয়া ঠিক হচ্ছেনা। বৈরাম খানকে আবার ফিরিয়ে আনলে শাসন ক্ষমতা নিজের হাতে নেয়া তাঁর জন্য আরো কঠিন হয়ে পড়বে। তাছাড়া গুরুজনদের উপদেশের প্রভাবে দ্বিধান্বিত হওয়া বা নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করা একজন সম্রাটের জন্য মোটেই সমীচিন নয়।

আকবর অন্যদিকে তাকালেন। হামিদা একমুহূর্ত ইতস্তত করলেন। তারপর ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, তুমি একটা নির্বোধ।

*

একমাস পরের ঘটনা। আকবর ঘুমের মধ্যে পাশ ফিরে মায়ালার আরো নিকটবর্তী হলেন, তার উষ্ণ নগ্ন শরীর তার দেহের পাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে। তারা দীর্ঘসময় ধরে তেজস্বী রতিকর্ম সম্পাদন করেছেন, এখন তার অচেতন দেহকে সেই তৃপ্তিই যেনো আচ্ছাদিত করে রেখেছে।

 জাঁহাপনা …জাহাপনা, উঠুন। কাঁধে কারো হাতের ছোঁয়া পেয়ে আকবর নিদ্রা আচ্ছন্ন চোখ মেলে হেরেম তদারককারিণীর কুঁচকান শুষ্ক মুখ দেখতে পেলেন।

কি হয়েছে? আকবরের হাত সহজাতভাবেই তার ছোরার খোঁজ করলো। সম্রাটকে হেরেমেও অপ্রত্যাশিত আক্রমণের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়।

 একজন দূত এসেছে, সে আহমেদ খানের লোক। সে বলছে সে যে সংবাদ এনেছে তা এই মুহূর্তে আপনার জানা প্রয়োজন।

ঠিক আছে। আকবর উঠলেন, তারপর তার শয়নকালীন ঢোলা জামা গায়ে জড়িয়ে নিয়ে চামড়ার চটি জোড়ায় পা গলালেন এবং বৃদ্ধাটিকে অনুসরণ করে হেরেমের দরজার দিকে অগ্রসর হলেন। বাইরের প্রবেশ দ্বারের ভিতরে রক্ষীদের কাছ থেকে খানিকটা এগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দূতটিকে তিনি চিনতে পারলেন। তাকে নোংরা এবং পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছিলো কিন্তু আকবর বিচলিত হলেন তার মুখভাব দেখে।

কি ব্যাপার?

 খারাপ খবর জাঁহাপনা। প্রায় চার সপ্তাহ আগে শিকার করতে বের হয়ে বৈরাম খান এবং তাঁর দশজন অনুচর আক্রান্ত হোন-তাঁর শিবির থেকে অল্প দূরে চম্বল নদীর তীরে।

 বৈরাম খান কেমন আছেন? আকবরের মুখ থেকে রক্ত সরে যাচ্ছিলো। তিনি উত্তরটা অনুমান করতে পারছিলেন।

 তিনি এবং তার শিকারের সঙ্গীরা সকলেই নিহত হয়েছেন জাঁহাপনা।

 তুমি নিশ্চিত?

জ্বী। তাঁর শিবিরের রক্ষীরা নদীর পাশে নলখাগড়ার বোনে আধা লুকানো অবস্থায় তাদের মৃতদেহগুলি আবিষ্কার করে।

 আমি নিজে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে চাই। কি ঘটেছিলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আমাকে জানতে হবে।

শেষকৃত্যানুষ্ঠানে অংশ নেয়ার পর তারা এখন আগ্রার পথে রয়েছে জাহাপনা। তারা যে বার্তাবাহককে তাঁদের সম্মুখে প্রেরণ করেছিলো তার সঙ্গে আমার ধলপুরের অবকাশযাপন কেন্দ্রে দেখা হয়। আমার পরিচয় পেয়ে, যা ঘটেছে সবকিছু সে আমাকে বলে এবং আপনাকে দেয়ার জন্য এই চিঠিটা আমাকে দেয় যেটা বৈরাম খানের একজন কর্মকর্তা লিখেছে। দূতটি তার ধূলাময়লা যুক্ত সবুজ রঙের থলে থেকে একটি ভাজকরা কাগজ বের করলো।

 আকবর যখন কাগজটির ভাঁজ খুললেন তখন ভেতরে থাকা রক্তের দাগযুক্ত আরেকটি ভাঁজ করা কাগজ মাটিতে পড়লো। আকবর সেটা তুললেন, তারপর প্রথম চিঠিটি দূতের হাতে দিয়ে বললেন, আমাকে পড়ে শোনাও। দূতটি পড়া শুরু করলো, মাননীয় সম্রাট, অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে জানাচ্ছি যে বৈরাম খানকে হত্যা করা হয়েছে। আমরা চম্বল নদীর তীরে তার এবং আমাদের অন্যান্য সাথীদের মৃতদেহ খুঁজে পেয়েছি। সবাইকে তীর ছুঁড়ে হত্যা করা হয়েছে, অনেকে পিঠে তীরবিদ্ধ হয়েছে। তবে বৈরাম খানের দেহ থেকে মাথা আলাদা করে ফেলা হয়েছে। আমরা মাথাটি খানিক দূরে পানির ধারে পাই। তাদের সকলের কাছ থেকে অলঙ্কার, অর্থ এবং অস্ত্র কেড়ে নেয়া হয়েছে। আক্রমণকারীরা কোনো দিকে গেছে জানার জন্য আমরা চিহ্ন ও আলামতো খোঁজার চেষ্টা করি কিন্তু তেমন কিছু আবিষ্কার করতে পারিনি। হয়তো তারা নৌকায় করে পালিয়েছে। আমি যে সংবাদ দিলাম তার সত্যতার প্রমাণস্বরূপ আরেকটি কাগজ পাঠাচ্ছি যেটা বৈরাম খানের দেহে পাওয়া গেছে।

আকবর ধীরে দ্বিতীয় চিঠিটা খুললেন। অন্য কারো তাকে এটা পড়ে শোনানোর দরকার ছিলো না। তিনি চিঠিটা চিনতে পেরেছেন-এটা তারই আদেশ যাতে মাহাম আঙ্গা বৈরাম খানের হজ্জ্বে যাওয়ার নির্দেশ লিখেছিলেন।

*

তিন ঘন্টা পর আকবর তার কক্ষের বারান্দা থেকে আগ্রার দূর্গের নিরাপত্তা প্রাচীরকে উষ্ণ করা সূর্যের প্রথম রশ্মি ছড়িয়ে পড়তে দেখলেন। দৃশ্যটি তার মাঝে কোনো অনুভূতি সৃষ্টি করলো না। বরং তিনি এমনভাবে কাঁপছিলেন যেনো তার চারপাশের জগতটা বরফাবৃত। তিনি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না বৈরাম খান মৃত। তিনি হত্যাকারীদের উপযুক্ত নৃশংস শাস্তি নিশ্চিত করবেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু তিনি নিজেও কি দোষী নন? তিনি যদি বৈরাম খানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন না করতেন তাহলে হয়তো তিনি এখনো বেঁচে থাকতেন। আর তার মা কি বলবেন?

আকবর বৈরাম খানকে চাকরিচ্যুত করেছেন জেনে তিনি যতোটা রেগে গিয়েছিলেন তেমনটা আর কখনোও দেখা যায়নি। বৈরাম খানকে হত্যা করা হয়েছে এই ঘটনা শুনে তাঁর প্রতিক্রিয়া কি হবে? নিচের উঠানে পিতলের ঘন্টা বাজিয়ে রক্ষী তার পালা শেষ হওয়ার সংকেত দিলো। শীঘ্রই সূর্যটা দিগন্তের অনেক উপরে উঠে যাবে। হামিদা অন্য কারো কাছ থেকে খবরটা জানতে পারেন এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা ঠিক হবে না। যেমনটা বৈরাম খানের চাকরিচ্যুতির ক্ষেত্রে ঘটেছে। তার এখনি মায়ের কাছে যাওয়া উচিত। তিনি দ্রুত মুখে পানি ছিটিয়ে পরিচারকদের সাহায্য ছাড়াই পোষাক পড়ে নিলেন, তারপর হামিদার কক্ষের দিকে যাত্রা করলেন। যদিও তখন সবে মাত্র ভোর হয়েছে, হামিদা উঠে পড়েছেন। তার অশ্রুসিক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আকবর বুঝতে পারলেন তিনি দেরি করে ফেলেছেন।

 আমাকে ক্ষমা করো মা। তুমি ঠিকই বলেছিলে। আমার বৈরাম খানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা উচিত হয়নি। সেজন্য আল্লাহ আমাকে শাস্তি দিয়েছেন। আকবর তার মায়ের রাগে ফেটে পড়ার অপেক্ষায় থাকলেন। কিন্তু তিনি নিশ্চুপ রইলেন, তাঁর দৃষ্টি মেঝের দিকে নিবদ্ধ।

বৈরাম খান আমাদের পরিবারের একজন সদস্যের মতো ছিলেন। অবশেষে তিনি বললেন। তার মৃত্যুতে আমার হৃদয়ে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু তিনি খুন হওয়ার জন্য আমি তোমাকে দায়ি করছি না এবং তোমারও উচিত নয় নিজেকে দোষী ভাবা। তুমি তার: প্রভাব থেকে মুক্ত হতে চেয়েছিলে কিন্তু তাঁর কোনো ক্ষতি হোক সেটা তুমি চাওনি, আমি তা জানি। আকবর… তিনি সরাসরি তাকালেন। হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে যতোটা সম্ভব সবকিছু জানার চেষ্টা করো। হত্যাকারীদের খুঁজে বের করো-তারা সাধারণ ডাকাত, ভাড়াটে খুনী যেনো হোক-তাদের রক্তের বিনিময়েই তাদের অপরাধের ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করো।

 আমি তা করবো মা, শপথ করে বলছি। আকবর ছেলেমানুষের মতো আশা করলেন হামিদা হয়তো তাকে আলিঙ্গন করবেন, কিন্তু তার হাতগুলি দুপাশে স্থবির হয়ে রইলো। আকবর বুঝতে পারলেন তার চলে যাওয়ার সময় হয়েছে। আকবর তখনই তার কক্ষে ফিরলেন না। তিনি মুক্ত বাতাস এবং খোলা পরিবেশের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে দুর্গের নিরাপত্তা পাঁচিলের উপর উঠে গেলেন। সকালের সূর্যের আলো পড়ে যমুনার জল স্বচ্ছ হলুদাভ বাদামি বর্ণ ধারণ করেছে কিন্তু আকবরের মনের দৃশ্যপটে তখন সম্পূর্ণ অন্য ধরনের ছবি ফুটে উঠেছে- তিনি বৈরাম খান এবং পিতার সঙ্গে বিজয়ীর বেশে দিল্লীতে প্রবেশ করছেন; পিতার সমাধির পাশে বৈরাম খান তার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন; ইস্পাতের ধারালো ফলা ঝলসে উঠছে যখন বৈরাম খান তাঁকে চাতুর্যপূর্ণ পারসিক তলোয়ার চালনার কৌশল শিখাচ্ছেন, আকবরকে বার বার চেষ্টা করতে বলছেন যতোক্ষণ পর্যন্ত না তিনি তা সম্পূর্ণ আয়ত্ত করতে পারছেন; বৈরাম খানের নীলচে চোখে সন্তুষ্টির দৃষ্টি, যখন তিনি বন্দুক ছোঁড়া অনুশীলন করছেন।

কীভাবে তিনি তাদের মধ্যকার বিশ্বাসের বন্ধন উপেক্ষা করলেন এবং তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেন? তিনি মাহাম আঙ্গাকে বৈরাম খানের বিরুদ্ধে তাঁর উপর প্রভাব বিস্তারের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন স্বার্থপরতা, ধৈর্যহীনতা এবং চিন্তাহীনতার বশবর্তী হয়ে কারণ তিনি শাসন ক্ষমতা হস্তগত করার জন্য বৈরাম খানের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করছিলেন। এটাই বাস্তবতা।

সূর্য তখন পশ্চিম থেকে ভেসে আসা মেঘ ছড়ানো ফ্যাকাশে নীল আকাশের অনেক উপরে উঠে গেছে যখন আকবর তার কক্ষে ফিরলেন। ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বুঝতে পারলেন একটা জিনিস তার ঘরে কেউ রেখে গেছে যেটা তিনি কক্ষ ত্যাগ করার সময় ছিলো না। হাতির দাঁত আর ঝিনুকের সমন্বয়ে নির্মিত তাঁর অলঙ্কার রাখার বাক্সটির উপর একটি কাপড়ের ফালি জাতীয় বস্তু দেখা যাচ্ছে। বিশেষ সাবধানতায় সেটি একটি কাগজ চাপা দেবার হাতির দাঁতে তৈরি ভারবস্তু দিয়ে চাপা দেয়া রয়েছে। তিনি ফালিটি হাতে নিয়ে দেখলেন সেটা একটি ফ্যাকাশে সবুজ রঙের রেশমের কাপড়ের টুকরো যাতে কিছু লেখা রয়েছে। সেটার এখানে ওখানে কয়েকটি নীল কালির ছোপ ফেলা হয়েছে। দেখে মনে হলো কোনো শিশু এটা করেছে। এবং আকবর সেটা ছুঁড়ে ফেলতে নিয়েও ফেললেন না, কারণ এক অজানা অনুভূতি তাকে বাধা দিলো। তিনি সেটা নিয়ে বারন্দায় গেলেন যেখানে উজ্জ্বল আলো রয়েছে। লেখক কাগজের পরিবর্তে কাপড়ের উপর কেনো লিখলো? সে কি তার হাতের লেখার পরিচিতি গোপন করতে চেয়েছে? যদিও তার দৃষ্টিতে সবই সমান, কারণ তিনি পড়তে পারেন না। যতোই মনোযোগ দিয়ে তিনি লেখাগুলি দেখলেন ততোই কালির আচড় গুলি তাঁর চোখের সামনে নাচতে লাগলো। আকবর তাঁর পরিচারককে ডাকলেন। এটাতে কি লেখা রয়েছে?

 সেবকটি এক মুহূর্ত সেটা পড়ল তারপর মুখ তুলে তাকালো, তার চোখে বিস্ময়।

এটা একটা সাবধানবাণী জাহাপনা, এখানে লেখা আছে, যদিও একই স্তন থেকে নির্গত এক নদী দুধের বন্ধনে তোমরা আবদ্ধ, তোমার দুধ-ভাই তোমার বন্ধু নয়। আদম খানকে জিজ্ঞাসা করো বৈরাম খানের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে সে কি জানে।

তুমি নিশ্চিত একথাই লেখা রয়েছে? সেবকটি মাথা নাড়লো। ওটা আমাকে দাও। আকবর রেশমের টুকরাটি তার জোব্বার ভিতরে ঢুকিয়ে রাখলেন। এ বিষয়ে কাউকে কিছু বলোনা। এটা আদম খানের কোনো শত্রুর লেখা বিদ্বেষসূচক চিরকুট ছাড়া কিছু নয়।

 জ্বী জাহাপনা।

আকবর বার্তাটি মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইলেন, কিন্তু পারলেন না। যেই বার্তাটি লিখে থাকুক প্রকাশ্যে আদম খানকে অভিযুক্ত করার সাহস তার নেই। কেনো? সে কি শাস্তির ভয় পাচ্ছে নাকি নিছক গোলযোগ সৃষ্টি করতে চাইছে? ঢেলে দেয়া বিষকে আবার পাত্রে ফিরিয়ে নেয়া কঠিন কিছু ফোঁটা অজ্ঞাতই থেকে যায়। বিষয় যাই হোক না কেনো, এর প্রভাবে তার মনের শান্তি বিনষ্ট হয়ে গেছে। তিনি যে তরুণটির সঙ্গে একত্রে বেড়ে উঠেছেন এবং যাকে তিনি নিজের ভাইয়ের মতো ভালোবেসেছেন সেকি সত্যিই তার শত্রু হতে পারে? তাছাড়া আদম খানের মাতাই তাঁকে বৈরাম খানের বিষয়ে সতর্ক করেছেন। তিনি তার সিদ্ধান্ত গ্রহণে একটি মারাত্মক ভুল করেছেন যার ফলে তাঁর একজন বিশ্বস্ত বন্ধুকে বিসর্জন দিতে হলো। এখন অধৈর্য হয়ে আরেকটি ভুল করা উচিত হবে না।

*

আকবর দেখ! আমি তোমাকে আগেই বলেছিলাম যে আমার বাজপাখিটাই শ্রেষ্ঠ, আদম খান চিৎকার করে উঠলো। তাদের মাথার অনেক উপরে পাখিটা ধাওয়া করতে থাকা একটি কবুতরের উপর তীর বেগে ঝাঁপিয়ে পড়লো। আমি জিতেছি!

কিছু সময় পরে আদম খানের প্রসারিত হাতের কনুই পর্যন্ত লম্বিত ধাতব আবরণ যুক্ত চামড়ার দস্তানার উপর বাজ পাখিটি উড়ে এসে বসলো। সেটার বাঁকা ঠোঁটে রক্ত লেগে আছে, পায়েও রক্ত। বিজয়ীর হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে আদম খান পাখিটাকে মাটিতে গেঁথে রাখা একটি মাচার সাথে চামড়ার ফিতায় বেঁধে দিয়ে সেটার মাথায় ঠুলি পড়িয়ে দিলো। আমি স্বীকার করছি তোমার বাজপাখি তড়িৎ গতিতে শিকার করতে পারে, আকবর বললেন।

 অমি তোমাকে বলেছিলাম তোমার নতুন তত্ত্বাবধানকারীটি তোমার পাখিগুলিকে ঠিকমতো প্রশিক্ষণ দিচ্ছে না। আমারটা যদি কয়েকদিনের জন্য তার হাতে পড়ে তাহলে সেটার অবস্থাও খারাপ হয়ে যাবে। আদম খানের চওড়া চোয়াল বিশিষ্ট বলিষ্ঠ মুখে আকৰ্ণবিস্তৃত হাসি ফুটে রইলো।

তাই হয়তো। আকবর পাল্টা হাসলেন। আদম খান তার মনের কথা বুঝতে পারছে না ভেবে আকবর সন্তুষ্টি বোধ করলেন। তিনি এটাও ভেবে খুশি হলেন যে তাঁর আস্ফালনরত দুধভাই উচ্ছ্বাসে বিভোর থাকায় এ ব্যাপারে বিন্দু মাত্র চিন্তা করছে না যে আকবর হঠাৎ কেনো তার সঙ্গ কামনা করেছেন। হিমুকে পরাজিত করার পর হিন্দুস্তান পরিভ্রমণ শেষ হলে তাদের মধ্যে আর তেমন দেখা সাক্ষাৎ হচ্ছিলো না। কিন্তু বৈরাম খানের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আদম খানের জড়িত থাকার বিষয়ে তার মনে সন্দেহ। দেখা দিলে তিনি আদম খানকে তাঁর সঙ্গে শিকার করা এবং বাজপাখি উড়ানোর আমন্ত্রণ জানান। পুরো সময়টা আপাতদৃষ্টিতে খেলার প্রতি মনোযোগী মনে হলেও আকবর সতর্কতার সঙ্গে তার দুধ-ভাইকে পর্যবেক্ষণ করে চলেছেন। কিন্তু আদম খান এমন কিছু বলেনি বা করেনি যার ফলে আকবরের মনে সন্দেহের উদ্রেক হতে পারে। সে তার চিরাচরিত অহঙ্কারী এবং উচ্ছ্বাসপ্রবণ আচরণই প্রদর্শন করছিলো।

কিন্তু সেক্ষেত্রে আদম খান কার এতো ক্ষতি করেছে যার ফলে সে চিরকুট পাঠিয়ে তাকে আকবরের চোখে বৈরাম খানের হত্যাকান্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়? যদিও তিনি বিশাল অঙ্কের পুরষ্কার ঘোষণা করেছেন তবুও গত তিন মাসে বৈরাম খানের হত্যাকারীদের সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

 যতোই দুর্বল বা অস্পষ্ট হোক ষড়যন্ত্রের আভাস আকবর উপেক্ষা করতে পারছিলেন না, কিন্তু তাঁকে ধৈর্যধারণ করতে হবে। হিন্দুস্তানের বিপুল বিস্তৃত ভূ-খণ্ডের নিয়ন্ত্রিত এবং নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত রাজ্য সমূহের মধ্যে তথ্য চলাচলে বহু সময় লেগে যাচ্ছিলো। হয়তো আহমেদ খান এবং তার গুপ্তচরেরা শীঘ্রই কোনো সূত্র পেয়ে যাবে। হত্যাকরীদের খুঁজে বের করে শাস্তি না দেয়া পর্যন্ত তিনি বিশ্রাম নেবেন না বলে মাকে কথা দিয়েছেন এবং তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন। মাকে রেশম কাপড়ে লেখা সতর্কবাণীটির কথা কি জানানো উচিত ছিলো? তিনি ভাবলেন। তিনি কয়েক বার তাঁকে জানাতে চেয়েছেন কিন্তু শেষপর্যন্ত বিরত হয়েছেন। তাঁর মনে হয়েছে এর ফলে তিনি আরো বিপর্যস্ত ও শঙ্কিত হবেন। তাছাড়া স্বভাবিক কারণেই এ বিষয়ে মাহাম আঙ্গাকেও তিনি কিছু বলতে পারেননি…

*

মন্ত্রীসভার বৈঠক ভীষণ দীর্ঘ এবং ক্লান্তিকর মনে হচ্ছিলো। আকবরের মাথা ব্যাথা করছিলো এবং তিনি অবকাশযাপনকেন্দ্র নির্মাণ বা রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত বিষয়ে আর কিছু শুনতে চাইছিলেন না। কিন্তু যখন তিনি সভাকক্ষ ত্যাগ করে হেরেমের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন তখন তাঁর মন উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো। কয়েকদিন আগে ঝিলাম নদী পরবর্তী পাহাড়ী রাজ্য থেকে তাঁর এক নতুন মিত্র তাঁর হেরেম খানার জন্য কয়েকজন রক্ষিতা পাঠিয়েছে। দলটি তিন রাত আগে আগ্রায় পৌঁছেছে এবং এখন নিজের চোখে মেয়েগুলিকে দেখার জন্য তিনি উদগ্রীব হয়ে উঠেছেন। মায়ালার সঙ্গে তার প্রথম সলজ্জ ও আবেগতাড়িত মিলনের ঘটনাটি যেনো অন্য এক জীবনের কাহিনী। মায়ালা এখনো তাঁর প্রিয় কিন্তু তাকে পরিতৃপ্ত করতে পারে এমন আরো নারীর সন্ধান তিনি পেয়েছেন। হেরেমে পৌঁছে তিনি দরবারের দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি পেলেন। সম্মুখের সতেজ আনন্দ উপভোগের চিন্তায় তার চলার গতি দ্রুত হলো।

 বৃদ্ধা হেরেম তদারককারিণী আকবরের জন্য অপেক্ষা করছিলো, তাঁকে পথ দেখিয়ে সে একটি কক্ষে নিয়ে এলো। কক্ষটি আকর্ষণীয় রেশম কাপড় এবং রঙ্গিন কাঁচের অলঙ্করণে সাজানো। এসব সাজসজ্জাও তাঁর নতুন মিত্র পাঠিয়েছে। মেয়েগুলিকে আপনার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে এবং তাঁরা আপনার সেবা করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে জাঁহাপনা। আপনাকে শুধু কষ্ট করে আপনার পছন্দের মেয়েটিকে বেছে নিতে হবে। বৃদ্ধাটি তালি বাজানোর সাথে সাথে পার্শ্ববর্তী গুপ্তকুঠরির দরজা খুলে গেলো। বুকে একইরকম আটসাট কাঁচুলি এবং কোমরে মুক্তার ঝালর বাঁধা ঢোলা সালোয়ার পরিহিত তিনজন তরুণী কক্ষে প্রবেশ করলো। তাঁদের কালো চুলে মেহেদীর দীপ্তি, রত্নখচিত ক্লিপ দিয়ে তা মাথার পিছনে বাঁধা। তাঁদের মধ্যে দুজন লম্বা গড়নের এবং আকর্ষণীয় চেহারা বিশিষ্ট। তৃতীয় জন একটু খাট তবে কমনীয় গড়নের অধিকারী, তার চেহারায় রয়েছে নিখুঁত চমৎকারিত্ব। কিন্তু তার সৌন্দর্যের চেয়েও বেশি কিছু আকবরের দৃষ্টি কাড়লো। সে ভীষণ স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে ছিলো এবং শিকারীর উপস্থিতি টের পাওয়া হরিণের মতো দ্রুত শ্বাস ফেলছিলো। তার অসহায়ত্ব আকবরকে নাড়া দিলো এবং তাঁকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই-একথা মেয়েটিকে বোঝানোর জন্য আকবর তীব্র আকাঙ্ক্ষা বোধ করলেন।

এই মেয়েটি। আকবর বলে উঠলেন।

 ওর নাম শায়জাদা। আপনি উত্তম পছন্দ করেছেন জাঁহাপনা। হেরেম তত্ত্বাবধানকারিণী মন্তব্য করলো।

অন্য সকলে দয়া করে কক্ষ ত্যাগ করো, আকবর বললেন। তত্ত্বাবধানকারিণী যখন অন্য মেয়েগুলিকে নিয়ে চলে গেলো, আকবর দেখলেন শায়জাদার চোখে অশ্রু জ্বল জ্বল করছে। ভয় পেও না। তোমার যদি ইচ্ছা না থাকে, আমাকে বলো। আমি কোনো নারীর উপর বল প্রয়োগ করি না।

আমি আপনাকে ভয় পাচ্ছি না জাহাপনা। মেয়েটি মোগলদের পুরানো ভাষা তুর্কীতে কথা বললো এবং তার উচ্চারণ আকবরের কাছে অপরিচিত লাগলো।

তাহলে কি হয়েছে? আকবর তার কাছে গেলেন, তার মুখের কমনীয় ডিম্বাকৃতি এবং চোখের দুস্পাপ্য নীলচে দ্যুতি তাঁকে একমুহূর্তের জন্য বৈরাম খানের কথা মনে করিয়ে দিলো। তাকে এতো বেদনাদায়ক সুন্দরী দেখাচ্ছিলো যে আকবরের তাকে ছুতে ইচ্ছা করলো।

 মেয়েটি একটু ইতস্তত করলো, তারপর কথা বলে উঠলো। আমি যখন জানতে পারি আমাকে আপনার দরবারে পাঠান হবে তখন আমি অত্যন্ত সম্মানিত বোধ করি এবং খুশি হই। আমার বড় দুই বোনও।

 একটু আগে তোমার সঙ্গে যে দুটি মেয়ে ছিলো তারা?

না, তারা আমার বোন নয়।

 তাহলে তোমার বোনেরা কোথায়?

 মেয়েটির মুখ শক্ত হয়ে এলো। আমাদের দলটি যখন আগ্রা থেকে দুই দিনের পথ দূরে ছিলো, একদল মোগল সৈন্য আমাদের পথ আটকায়। তারা বলে তারা আপনার পাঠানো অগ্রবর্তী রক্ষী, তাঁদের আপনি পাঠিয়েছে আমাদেরু পরিদর্শন করার জন্য এবং সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটিকে তখনই আপনার কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আপনি অধৈর্য হয়ে পড়েছেন বলে আমার দুই বোনকে তারা নিয়ে যায়। আমি আগ্রায় পৌঁছে আপনার হেরেম তত্ত্বাবধায়কের কাছে আমার বোনদের খোঁজ করি। কিন্তু তিনি বলেন তিনি অন্য কোনো মেয়ের খোঁজ জানেন না। দয়া করুন জাঁহাপনা, আমি আমার বোনদের জন্য ভীষণ দুশ্চিন্তায় আছি…

 আমি কোনো অগ্রবর্তী রক্ষী পাঠাইনি। তাঁদের হুকুমকর্তা কে ছিলো?

আমি নিশ্চিত নই, কিন্তু আমার মনে হয় আমি শুনেছি একজন তাকে আদম খান নামে ডেকেছে।

 আকবরের মাথাটি বিস্ময়ের ধাক্কায় পিছিয়ে গেলো। তুমি কি তাদের কারো মুখ দেখেছো?

তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিলো, এবং তাঁদের চোখের নিচের অংশ কাপড়ে ঢাকা ছিলো।

মেয়েটির গাল বেয়ে তখন অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে এবং সে তা মোছার কোনো চেষ্টাই করছে না। কিন্তু ক্রোধ উন্মত্ত আকবর তখন আর মেয়েটিকে লক্ষ্য করছিলেন না। তুমি এখানেই অপেক্ষা করো। তিনি বললেন। কয়েক মিনিট পরে আকবরকে লম্বা লম্বা পা ফেলে তাঁর দুধমার কক্ষের দিকে যেতে দেখা গেলো। ইশারায় মাহামের সেবিকাদের সরে যেতে বলে তিনি তীব্র ধাক্কায় দরজা খুলে তার কক্ষে প্রবেশ করলেন। মাহাম আঙ্গা একটি খাতায় কিছু লিখছিলেন। আকবরের অগ্নিমূর্তি দেখে তিনি দ্রুত সেটা রেখে উঠে দাঁড়ালেন।

 কি হয়েছে আকবর?

আপনার ছেলে কোথায়?

 ওতো শিকারে গেছে। গত এক সপ্তাহ ওর সাথে আমার দেখা হয়নি।

 তাকে খুঁজে বের করুন-সে যেখানেই থাকুক-এবং তাকে বলবেন সে যেনো এই মুহূর্তে দরবারে ফিরে আসে?

 নিশ্চয়ই বলবো। তোমার আদেশ তার জন্য শিরোধার্য। কিন্তু কেনো?

 একটি মেয়ে, সে আমার হেরেমে নতুন এসেছে-আমার একজন নতুন মিত্র তাকে সম্মান এবং বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে পাঠিয়েছো-মেয়েটি অভিযোগ করেছে আদম খান তার দুই বোনকে অপহরণ করেছে।

 মাহাম আঙ্গার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। তার পুত্র যদি এই অপরাধ করেও থাকে তিনি সে সম্পর্কে কিছুই জানেন না।

 অভিযোগটি অত্যন্ত ভয়াবহ, এবার আকবর অপেক্ষাকৃত ভদ্র ভাবে বললো। আমার দুধভাই অভিযোগের জবাব দিক। সে যদি নিরপরাধ হয় তাহলে তার ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

নিশ্চয়ই। মাহাম আঙ্গা আকবরের হাত ধরলেন। কিন্তু আকবর, হয়তো কোথাও ভুল হয়েছে। আমার ছেলে কখনোই…. তার কণ্ঠস্বর কেঁপে গেলো।

 আমি আশা করছি আপনার ধারণাই যেনো সঠিক হয়। প্র

কৃতপক্ষে আদম খান এবং তার শিকারের সঙ্গীরা আকবরের আদেশ পেয়ে আগ্রায় ফেরার তিন দিন আগেই আকবর নিখোঁজ মেয়ে দুটির ভাগ্যে কি ঘটেছে তা জানতে পেরেছিলেন। এক উট চালক তার পশুকে যমুনা নদীতে পানি খাওয়াতে নিয়ে গেলে সে মৃতদেহ গুলিকে দেখতে পায়। দেহগুলি নগ্ন ছিলো এবং গলা কাটা ছিলো।

*

কি হয়েছে আকবর? তুমি এতো রাতে আমাকে ডেকেছো কেনো? এখনো আমি আমার সফরের কারণে ক্লান্ত এবং অপরিচ্ছন্ন।

 আদম খান তোমার মনে আছে কীভাবে আমরা কাবুলের দুর্গের সম্মুখের তৃণভূমিতে তীর বেগে আমাদের টাটুঘোড়া ছুটাতাম?

নিশ্চয়ই মনে আছে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না তুমি…।

সেটা ছিলো এক চমৎকার সময়। আমরা পরস্পরের কাছ থেকে কদাচিৎ বিচ্ছিন্ন হতাম। আকবর আদম খানকে থামিয়ে দিয়ে বললেন।

 সেটাই তো একজন দুধভাইয়ের ভূমিকা হওয়া উচিত। আদম খান বললো।

 সেটা তার চেয়েও বেশি। আমার নিজের কোনো ভাই বোন ছিলো না। তুমি না থাকলে আমি ভীষণ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়তাম। আর যখন আমার চাচারা আমাকে বাবা-মার কাছ থেকে অপহরণ করেছিলো, তখন তোমার মাই আমার একমাত্র রক্ষাকারিণী ছিলেন এবং তুমি নিজেও আমার সঙ্গে বন্দীত্ব বরণ করেছিলে। একই রকম কষ্ট ভোগ করেছে, একই বিপদ মোকাবেলা করেছো…এসব কারণেই আমি তোমাকে যা জিজ্ঞেস করতে চাই তা করা আমার জন্য কঠিন হয়ে পড়ছে। কিন্তু আমরা আর অল্প বয়সী বালক নই এবং আমি এখন সম্রাট, তাই আমাকে প্রশ্নটা করতেই হবে।

 তুমি কি বলতে চাও আকবর? আদম খানের হালকা বাদামি চোখ গুলি তার মায়ের মতোই-আকবরের মুখের উপর নিবদ্ধ হলো এবং সেগুলিতে তখন আর হালকা ভাব বজায় ছিলো না।

 তিন দিন আগে এক বৃদ্ধ উট চালক যমুনা নদীতে ভেসে থাকা দুটি তরুণীর লাশ আবিষ্কার করে। সে মৃতদেহগুলিকে একটি লম্বা লাঠি দিয়ে টেনে পড়ে তোলে এবং কর্তৃপক্ষকে অবগত করে। মৃতদেহগুলি তখন বিকৃত হয়ে গিয়েছিলো।

আকবর জোর করে মৃতদেহগুলি দেখেছিলেন, চামড়া সরে যাওয়া দেহগুলি মাটিতে মাখামাখি হয়েছিলো। ইতোমধ্যে সেগুলিতে মাছি ভন ভন করছিলো। তাঁদের চোখ গুলি খোলা ছিলো যা শায়জাদার চোখের তুলনায় অনেক বেশি ফ্যাকাশে নীল। কাটা গলা রক্তে মাখামাখি হয়ে ছিলো। আকবরের মনে হচ্ছিলো যুদ্ধ ক্ষেত্রেও তিনি এতো ভয়াবহ দৃশ্য দেখেননি। আদম খান সামান্য মাথা নেড়ে বললো, শুনে আমার খারাপ লাগছে, কিন্তু এর সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক?

ধৈর্য ধরো। আমি আমার হেকিমকে দেহ দুটি পরীক্ষা করতে বলি। সে আমাকে বলে গলা গুলি দক্ষভাবে গভীর করে কাটা হয়েছে–সম্ভবত ধারালো ছোরার সাহায্যে এবং তারা মারা গেছে দুই-তিন দিনের বেশি হয়নি। হেকিম আরো বলেছে তাদের ধর্ষণ করা হয়েছে। আদম খান, তুমি কি জানো এই তরুণী গুলি কারা ছিলো?

 আমি কীভাবে জানবো?

আকবর তার দুধভাই এর রুষ্ট চেহারা পর্যবেক্ষণ করলেন। তুমি নিশ্চিত যে তুমি জানো না?

 অবশ্যই। ওদের হত্যাকাণ্ডের জন্য তুমি কি আমাকে দায়ি করছো?

না। আমি কেবল জানতে চেয়েছি ওদের তুমি চিনতে কি না।

কিন্তু কেনো? কেউ হয়তো ষড়যন্ত্র করে আমাকে এর সঙ্গে জড়িয়েছে।

মৃত মেয়ে গুলির বোন শায়জাদা বলেছে আগ্রায় আসার পথে তাদের কাফেলাকে একদল মোগল সৈন্য থামায়। তারা তার বোনদের তুলে নিয়ে যায়। শায়জাদা শুনেছে তাদের একজন তাদের হুকুমকর্তাকে আদম খান নামে ডেকেছে।

 এটা মিথ্যা কথা! কেউ হয়তো তাকে ঘুষ দিয়েছে আমাকে লাঞ্ছিত করার জন্য।

তাহলে তুমি কি আমার কাছে শপথ করছো যে তুমি বা তোমার লোকেরা ওদের অপহরণ বা খুনের সঙ্গে জড়িত নয়?

আমি তোমার দুধভাই হিসেবে শপথ করে বলছি। আদম খানের শক্ত হাত আকবরের হাত আঁকড়ে ধরলো। আমি কখনোই আমাদের মাঝের বন্ধনকে অবমাননা করিনি।

 আমি তোমার কথা বিশ্বাস করলাম।

শায়জাদা নামের মেয়েটি এখন কোথায়?

এখানে আমার হেরেমে। আমি তাকে তার বাড়িতে ফেরত পাঠানোর প্রস্তাব করেছিলাম কিন্তু সে যেতে চায়নি। আমার ফুফু তার ঘটনা শুনে তার প্রতি সদয় হোন এবং নিজের কাছে রাখার প্রস্তাব করেন।

আদম খান কিছু বললো না কিন্তু আকবর লক্ষ্য করলেন তার বুক দ্রুত উঠানামা করছে। তোমার ওকে দোষী ভাবা ঠিক হবে না আদম খান। যখন সে তোমার নাম বলেছে তখন সে জানতো না তুমি কে এবং তার শোনায় ভুলও হতে পারে। এছাড়া তখন সে প্রচণ্ড ভীতি এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিলো। তবে আমি নিশ্চিত তাকে কেউ জোরপূর্বক বা ঘুষ দিয়ে অভিযোগের কথা বলায়নি। এখন এসো আমরা কোনো ভালো বিষয় নিয়ে কথা বলি। আমি একটি শংকর স্ট্যালিয়ন ঘোড়া দেখেছি যেটার ব্যাপারে তোমার মতামত প্রয়োজন…

সাধারণ বিষয়ের অবতাড়না করতে পেরে আকবর যেনো স্বস্তি বোধ করলেন। তাঁর দুধ-ভাইকে প্রশ্ন করে তিনি বিব্রত বোধ করছেন, কিন্তু এছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিলো না। আদম খান যেমন ক্ষুব্ধ ভাবে মরিয়া হয়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করেছে সেটাও আকবরের জন্য স্বস্তিকর ছিলো। তবে আকবর অনুভব করছিলেন তাঁদের সম্পর্কের মধ্যে একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে। আদম খানকে তার নির্দোষ হওয়া না হওয়া নিয়ে প্রশ্ন করার মাধ্যমে তাদের বাল্যকালের অন্তরঙ্গতার সমাপ্তি হয়েছে। কিন্তু এর ব্যতিক্রম করার উপায়ও ছিলো না কারণ তিনি এখন সম্রাট।

.

০৫. দুধ এবং রক্ত

মে মাসের এক আর্দ্র দুপুর। আকবর শুয়ে আছেন মায়ালার আকর্ষণীয় কোমল পেটের উপর মাথা রেখে। তাঁর মাথার উপর ময়ূরপুচ্ছ দিয়ে তৈরি টানা পাখা বাতাস দিয়ে যাচ্ছে। এই মাত্র তারা অভিনব এক রতিকর্মের পালা উপভোগ করেছেন, যাতে শরীরের সব শক্তি প্রায় নিঃশেষিত হয়েছে। আকবরের চিন্তায় তখন কেবল আনন্দময় উপাদান থাকার কথা। কিন্তু পক্ষান্তরে অস্বাভাবিক কিছু দৃশ্য তাঁর মনের প্রেক্ষাপট দখল করে রেখেছিলো। তিনি কষ্টে প্রকম্পিত হচ্ছিলেন এবং মৃদু আর্তনাদও করছিলেন। কপালে একটি হাতের স্পর্শ পেয়ে তিনি চমকে উঠে বসলেন। সেটা ছিলো মায়ালার হাত, সে আকবরকে আরাম দিতে চেষ্টা করছিলো। সেই দুই তরুণীর মৃতদেহ আবিষ্কারের পর থেকেই তাঁর এমন অনুভূতি হচ্ছে, যদিও তারপর আট সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। প্রতিদিন তিনি আরো বেশি চিন্তাক্লিষ্ট ও সতর্ক হয়ে উঠছিলেন এক অজানা হুমকির আশংঙ্কায়। এই বোধ আরো ভয়াবহ হয়ে উঠছিলো কারণ তিনি বুঝতে পারছিলেন না আক্রমণটা কোনো দিক থেকে আসবে।

 আকবর নিজের গরম হয়ে ওঠা কপালের উপর থেকে কালো চুলগুলি পেছনে ঠেলে দিলেন। তিনি তাঁর পিঠের উপর মায়ালার নগ্ন স্তনযুগলের স্পর্শ পেলেন, সে পেছন থেকে তাঁর গলা জড়িয়ে ধরেছে। সে আকবরের কানে ফিসফিস করে কিছু বলছিলো-একটি নতুন রতিভঙ্গিমার কথা-সিংহের মিলন রীতি- হয়তো তাকে সন্তুষ্টি প্রদান করতে পারবে। কিন্তু প্রস্তাবটি প্রলুব্ধকর হওয়া সত্ত্বেও তিনি মায়ালার আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করে উঠে দাঁড়ালেন। তিনি তাঁর মন্ত্রী এবং উপদেষ্টাদের নিয়ে সভা আহ্বান করেছেন আজই বিকালে এবং সভার আগে তাঁকে অনেক চিন্তাভাবনা করতে হবে।

বৈরাম খান নির্বাসিত এবং নিহত হওয়ার পর তাঁর প্রধানসেনাপতির পদটি শূন্য রয়েছে। এখন সময় হয়েছে এই পদে নতুন একজনকে নিয়োগ দেয়ার এবং একই সঙ্গে আরো কয়েকটি নিয়োগ দিতে হবে যাতে তিনি তাঁর গতানুগতিক কিছু দায়িত্ব নিজের কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেন। তাছাড়া উজিরের পদটিও পূরণ করা দরকার-যদিও বৈরাম খান থাকতে এ পদে কাউকে নিয়োজিত করার প্রয়োজন ছিলো না। তবে উজির নিয়ে খুব একটা তাড়াহুড়া নেই। এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেয়ার আগে সভাসদদের সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। একজন দুর্নীতিপরায়ণ এবং আত্মকেন্দ্রীক উজিরের চেয়ে কোনো উজির না থাকাই উত্তম। কিন্তু জরুরি ভিত্তিতে তার সেনাবাহিনীর জন্য একজন প্রধান ভাণ্ডার সংরক্ষক (চিফ কোয়ার্টার মাস্টার) প্রয়োজন। বর্তমানে যে এই পদে কর্মরত সে অত্যন্ত অল্পবয়সে আকবরের পিতামহ বাবরের অধীনে চাকরিতে যোগ দেয়। সে এখন এতো বুড়ো হয়েছে যে ঠিকমতো দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। সে সর্বদা আকবরকে বাবর বলে সম্বোধন করে এবং এই মর্মে বিড়বিড় করে যে তিনি অনেক বদলে গেছেন। প্রধান অশ্ব বিশেষজ্ঞের (মাস্টার অফ হর্স) পদটিও তিনি পুনঃপ্রচলন করতে চান, এর দায়িত্ব হবে বিপুল সংখ্যক ঘোড়া ক্রয় করা, তার পরিকল্পনাধীন বিজয় অভিযান পরিচালনার জন্য।

আকবর জানতেন অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে তাঁকে যোগ্য লোক নির্বাচন করতে হবে। ঐ সকল পদের অধিকারীদের বিশেষ সুবিধা এবং মর্যাদা রয়েছে, আরো রয়েছে নানা প্রকার প্রলোভন। তিনি যাকে প্রধান সেনাপতি হিসেবে নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তার ব্যাপারে আকবরের মনে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিলো না। হুমায়ূনের শাসন কালের প্রথম থেকেই মোগল পরিবারের প্রতি আহমেদ খান অকুণ্ঠ বিশ্বস্ততা প্রদর্শন করেছে। এছাড়াও তিনি একজন বিচক্ষণ যুদ্ধ বিশেষজ্ঞ। তিনি ভয়াবহ সকল লড়াই এবং নির্বাসনের বছর গুলিতে আকবরের পিতার অধীনে কাজ করেছেন এবং হিন্দুস্তান পুনঃবিজয়ের সময় কাবুল থেকে হুমায়ূনের সঙ্গে এক কাতারে ঘোড়া ছুটিয়ে এসেছেন। পরবর্তীতে আকবরের পক্ষে হিমুর বিরুদ্ধেও লড়াই করেছেন। আহমেদ খানকে প্রধান সেনাপতির পদে নির্বাচন করা হলে আকবরের অন্যান্য সেনাপতিরা হয়তো হতাশ হবে কিন্তু কেউই তার যোগ্যতাকে অস্বীকার করবে না।

 কিন্তু প্রধান ভাণ্ডার সংরক্ষক এর পদটি জটিলতা পূর্ণ। যে এ পদের জন্য নির্বাচিত হবে তার দায়িত্ব হবে মোগল সৈন্যদের জন্য সব ধরনের রসদ সরবরাহ করা-ঘোড়াকে খাওয়ানোর জন্য শস্য থেকে শুরু করে গোলন্দাজ বাহিনীর জন্য বারুদ এবং কামানের গোলা পর্যন্ত সবকিছু। সে সময় গৃহস্থালীর রসদ সরবরাহ করার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলো হুমায়ূনের এক সময়কার পরিচারক জওহর। তার বহু বছরের বিশ্বস্ত সেবার প্রতিদান হিসেবে তাকে এ পদে নিয়োগ করা হয়। মা হামিদার সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করলে তিনি প্রধান ভাণ্ডার সংরক্ষক এর পদটির জন্য আতগা খানের নাম সুপারিশ করেন। আতগা খান একজন সেনাকর্তা এবং সে কাবুলের লোক। হুমায়ূন যখন হিন্দুস্তানে হামিদাকে ডেকে পাঠান তখন আতগা খান তাঁকে নিরাপত্তা প্রদান করে দিল্লীতে নিয়ে আসে। সে একজন বুদ্ধিমান এবং মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি এবং তার দুই কন্যা আমার সেবায় নিয়োজিত। সে দীর্ঘ যাত্রায় আমার নিরাপত্তা রক্ষা করেছে এবং আমি নিশ্চিত সে প্রধান ভাণ্ডার সংরক্ষক হিসেবে তোমার স্বার্থ রক্ষা করবে, হামিদা পরামর্শ দেন। আকবর নিজেও আগা খানের ব্যাপারে গোপনে খোঁজখবর করে সিদ্ধান্ত নেন যে মায়ের উপদেশই তিনি বাস্তবায়ন করবেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন এতে হামিদা তার উপর সন্তুষ্ট হবেন।

 অশ্ব বিশেষজ্ঞের পদটির ব্যাপারে আকবর কারো সঙ্গে আলোচনা করেননি এবং সিদ্ধান্ত নেন এ পদটিতে তিনি তার দুধভাই আদম খানকে নিয়োগ করবেন। আদম খান ঘোড়ার মান নির্ণয় সম্পর্কে অত্যন্ত বিজ্ঞ ছিলো। তাছাড়া এর ফলে সকলে বুঝতে পারবে তার উপর এখনো আকবর আস্থাশীল যদিও তার বিশ্বস্ততা সম্পর্কে তখন সভায় অনেক গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। আকবর তাঁর পরিচারকের কাছে জানতে পেরেছিলেন দুই তরুণী হত্যার বিষয়ে আদম খানকে তার জিজ্ঞাসাবাদের কথা কারো কাছে গোপন ছিলো না।

 দুই ঘন্টা পর প্রথাগত শিঙ্গা ধ্বনির সাথে আকবর তাঁর দরবার কক্ষে প্রবেশ করলেন সিংহাসনের বাম পাশের উঁচু খিলান বিশিষ্ট দরজা দিয়ে-হিমুর ধনভাণ্ডারের সোনা গলিয়ে বানান সেই সিংহাসটিকে এখন এর স্থায়ী অবস্থানে বসানো হয়েছে। ইতোমধ্যে আকবর প্রতিজ্ঞা করেছেন তিনি সিংহাসনটিকে অলংকৃত করবেন ভবিষ্যতে যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে বাজেয়াপ্ত করা রত্ন দিয়ে। এটা হবে তার গৌরব এবং সাফল্যের প্রতীক। সিংহাসনের সবুজ মখমলের গদিতে আসন গ্রহণ করে আকবর ইশারায় তার সভাসদ এবং উপদেষ্টাদের বসতে বললেন।

 বক্তব্য শুরু করার আগে আকবর তার পেছনে দেয়ালের উপরের দিকে অবস্থিত ছোট ছোট ফোকর বিশিষ্ট জাফরির দিকে তাকালেন। তিনি নিশ্চিত ছিলেন ঐ আড়ালের পেছনে মহিলাদের জন্য নির্ধারিত আসনে হামিদা বসে আছেন তাঁর কার্যক্রম প্রত্যক্ষ করার জন্য। আমি আপনাদের আজকের সভায় উপস্থিত হওয়ার নির্দেশ দিয়েছি এই জন্য যে আমি কিছু পদে নিয়োগ প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আহমেদ খান, আতগা খান এবং তুমি আমার দুধভাই আদম খান, এগিয়ে এসো। তারা তিনজন আকবরে সম্মুখে হাজির হওয়ার পর তিনি আবার শুরু করলেন, আহমেদ খান, প্রথমে আমার পিতার অধীনে এবং পরে আমার অধীনে আপনার বহু বছরের বিশ্বস্ত সেবা মূল্যায়ন করে আমি আপনাকে আমার প্রধান সেনাপতির পদে নিয়োগ দান করছি।

 আহমেদ খানের লম্বা দাড়ি গুচ্ছের উপরে প্রসারিত হাসিতে তার আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটলো। জাহাপনা আমি আমার সম্পূর্ণ সামর্থ প্রয়োগ করে অপনার সেবা করবো।

 আমি জানি আপনি তা করবেন। শত্রুদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা এবং সম্রাটের চোখ এবং কান হিসেবে ভূমিকা পালন করার দায়িত্বও আপনার উপর অর্পিত হলো। আকবরের কাছ থেকে সংকেত পেয়ে তাঁর অনুচরেরা আহমেদ খানকে সম্মানের প্রতীক স্বরূপ সোনার কারুকার্যখচিত সবুজ রঙের রেশমি আলখাল্লা এবং রত্নখচিত খাপ বিশিষ্ট তলোয়ার প্রদান করতে এগিয়ে এলো।

এবার আকবর তার দুধভাই এর দিকে ফিরলেন। আদম খান, বাল্যকাল থেকেই তুমি আমার বন্ধু এবং সঙ্গী। আমি তোমাকে এমন একটি পদ প্রদান করতে চাই যার জন্য প্রয়োজনীয় মেধায় তুমি সমৃদ্ধ। আশা করি তুমি এ পদটির দায়িত্ব সম্মানের সঙ্গে পালন করবে। আদম খানের বাদামি চোখ গুলি জ্বল জ্বল করছিলো।

 এগিয়ে এসো আমার দুধভাই, আমার নতুন অশ্ববিশেষজ্ঞ হিসেবে আমি তোমাকে আলিঙ্গন করতে চাই। আকবর উঠে দাঁড়ালেন এবং যে মার্বেল পাথরের মঞ্চে তার সিংহাসন স্থাপিত ছিলো সেখান থেকে নেমে এলেন। তিনি আদম খানের কাঁধ জড়িয়ে ধরে তার গালে চুমু খেলেন। কিন্তু আকবর যদি তার কৃতজ্ঞতা আশা করে থাকেন তাহলে তাকে হতাশ হতে হলো।

 আপনার অশ্ববিশেষজ্ঞ? কথাটি বলে আদম খান এক সেকেণ্ডের জন্য দেয়ালের উপরের জাফরির দিকে তাকালো। তার মা মাহাম আঙ্গা কি সেখানে রয়েছে?

 হ্যাঁ আমার অশ্ববিশেষজ্ঞ, আকবর পুনরাবৃত্তি করলেন, তাঁর মুখের হাসি ধীরে অপসারিত হলো যখন তিনি আদম খানের বিভ্রান্ত ক্রুদ্ধ মুখভাব প্রত্যক্ষ করলেন। তাঁর দুধভাই কি আশা করছিলো?

আকবর তাকে পর্যবেক্ষণ করছেন বুঝতে পেরে হঠাৎ আদম খান নিজেকে সংযত করলো। ধন্যবাদ জাঁহাপনা, সে আস্তে করে বললো। তার পদের জন্য নির্ধারিত ঐতিহ্যবাহী উপহার রত্নখচিত ঘোড়ার লাগাম এবং জিন গ্রহণ করলো আকবরের পরিচারকদের কাছ থেকে এবং তারপর মাথা নত রেখে পিছিয়ে গেলো।

আকবর তার সিংহাসনে ফিরে গেলেন। এবার তুমি আতগা খান। তোমার বহু সেবা মূল্যায়ন করে আমি তোমাকে আমার প্রধান ভাণ্ডার সংরক্ষকের পদে নিযুক্ত করলাম।

আতগা খান, একজন লম্বা গড়নের চওড়া কাঁধ বিশিষ্ট লোক। একটি চিকন সাদা ক্ষত তার বাম চোখের ভ্রু থেকে অক্ষিকোটরের নীচ পর্যন্ত বিস্তৃত। বহু বছর আগে খাইবার গিরিপথের পাসাই উপজাতীয়দের এক গুপ্ত আক্রমণের স্মৃতিচিহ্ন। সে তার ডান হাতটি বুকের উপর রেখে ঝুঁকে কুর্ণিশ করলো। ধন্যবাদ জাঁহাপনা। আপনি আমাকে মহা সম্মানে ভূষিত করলেন। তাকেও আনুষ্ঠানিকভাবে কারুকাজ করা জোব্বা উপহার দেয়া হলো এবং জেড পাথরের সিলমোহর যা তার পরিচয়সূচক চিহ্ন বহন করে। এবারে আকবর উঠে দাঁড়ালেন এবং দরবার ত্যাগ করলেন।

সম্মুখে এবং পিছনে দেহরক্ষী নিয়ে আকবর যখন প্রায় তাঁর বিশ্রাম কক্ষের সামনে পৌঁছলেন ঠিক তখনই আদম খান পাশের একটি করিডোর দিয়ে তড়িৎ বেগে এগিয়ে এলো। সে ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে- সন্দেহ নেই আকবরের নাগাল পাওয়ার জন্য সে দরবার থেকে দৌড়ে এসেছে। সে কে চিনতে পারলেও আকবরের দেহরক্ষীরা আড়াআড়িভাবে বর্শা ধরে তার পথরোধ করলো। তাদের উপর হুকুম ছিলো অনুমতি ছাড়া কেউ যেনো সম্রাটের নিকটবর্তী হতে না পারে এবং একাজে অবহেলার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। ঠিক আছে, আসতে দাও। আকবর রক্ষীদের আদেশ দিলে তারা বর্শা সরিয়ে পথ করে দিলো। কি ব্যাপার আদম খান?

 দরবারের সকলের সামনে তুমি আমাকে অপমান করেছে। সে এতো ক্রুদ্ধ ছিলো যে আকবর লক্ষ করলেন তার কপালের শিরা দপ দপ করে লাফাচ্ছে।

 তোমাকে অপমান করেছি? সতর্ক হয়ে কথা বলো আদম খান, আকবর নিচু স্বরে বললেন কিন্তু আদম খান নিজেকে নিয়ন্ত্রণের কোনো চেষ্টাই করলো না।

তুমি সকলের সামনে আমাকে বোকা প্রতিপন্ন করেছো! এবার মনে হলো তার গলার স্বর আরো একধাপ উপরে উঠেছে। তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে কুস্তির কৌশলে মাটিতে শুইয়ে ফেলার তীব্র আকাক্ষা অনুভব করলেন আকবর, যেমনটা বাল্যকালে বহুবার করেছেন। আদম খান সর্বদাই রাগী ছিলো কিন্তু আকবর ছিলেন তার চেয়ে দক্ষ লড়িয়ে। কিন্তু অতীতে সেটা ছিলো শিশুসুলভ বৈরিতা এবং তাদের মাঝে তখন অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব ছিলো। হয়তো এখন তাঁদের মধ্যে আর সেই বন্ধুত্ব বজায় নেই…তার উদ্ধত আচরণ প্রত্যক্ষ করে আকবর ভাবলেন তিনি সত্যিকার অর্থে তাকে কতোটা চিনেন। এতোদিন তাঁর মনে হয়েছে তিনি তাকে ভালোই চিনেন কিন্তু হঠাৎ আজ মনে হচ্ছে তিনি এ ব্যাপারে আর নিশ্চিত নন।

 দেহরক্ষী এবং অনুচরদের কৌতূহলী দৃষ্টির ব্যাপারে সচেতন হয়ে তিনি খপ করে আদম খানের হাত ধরলেন। তুমি যাই আমাকে বলতে চাও তার জন্য উপযুক্ত জায়গা এটা নয়। আমার সঙ্গে এসো। তাকে নিয়ে আকবর নিজ কক্ষে প্রবেশ করলেন। যখন তাদের পেছনে দরজা বন্ধ হয়ে গেলো, তিনি আদম খানের হাত ছেড়ে দিয়ে তার মুখোমুখী হলেন। তুমি কি নিজের অবস্থান ভুলে গেছো, তিনি বললেন ঠাণ্ডা গলায়।

 না, বরং তুমিই ভুলে গেছো আমি কে।

 একটু আগে আমি তোমাকে আমার প্রধান অশ্ববিশেষজ্ঞের পদে নির্বাচন করেছি। ভেবেছিলাম এই পদ লাভ করে তুমি আনন্দিত হবে।

তোমার আস্তাবল রক্ষক হয়ে আমি আনন্দিত হবো? এর থেকে উন্নত পদ আমার জন্য প্রযোজ্য। হিমুর সঙ্গে যুদ্ধের পর থেকে আমার প্রতি তোমার আচরণ বদলে গেছে…আমরা এমন সাথী ছিলাম যারা সবকিছু এক সাথে করতো কিন্তু তুমি আমাকে বর্জন করেছো। তুমি আর এখন আমাকে জিজ্ঞাসা করো না আমি কি ভাবি। আমার শিরায়ও রাজকীয় মোগল রক্ত প্রবাহিত। আমার পিতা তোমার বাবার ফুফাতভাই ছিলেন…

কোনো পদটি তুমি আশা করেছিলে? আমার প্রধান ভাণ্ডার সংরক্ষকের পদটি, নাকি প্রধান সেনাপতির? আমি ঐ পদ গুলির জন্য এমন ব্যক্তি নির্বাচন করেছি যারা তাদের যোগ্যতা এবং বিশ্বস্ততা প্রমাণ করেছে…এমন ব্যক্তি যাদের আমি বিশ্বাস করতে পারি।

 তোমার দুধভাই ছাড়া আর কাকে তুমি বেশি বিশ্বাস করতে পারো?

 সেটা দুধ-ভাই এর উপরই নির্ভর করে। কথাগুলি আকবরের মুখ থেকে সহজাতভাবে বের হয়ে এলো, তিনি নিজেকে দমাতে পারলেন না।

 তুমি কি বোঝাতে চাইছো? যখন আকবর, আদম খানের প্রশ্নের উত্তর দিলেন না সে বলে চললো, তুমি সেই অপহৃত রক্ষিতাঁদের ঘটনা বোঝাতে চাইছো তাই না? আমি তোমাকে বলেছি, সে বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। সেটা একটা ষড়যন্ত্র ছিলো। কেউ ঐ ঘটনার সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে আমাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলো।

কেনো কেউ এমনটা করবে? তুমি এমন গুরুত্বপূর্ণ কেউ নও যাকে কেউ ধ্বংস করতে চাইবে…বৈরাম খান আমাকে সতর্ক করেছিলেন যে তুমি নিজের সম্পর্কে অনেক উচ্চ ধারণা পোষণ করো।

 হ্যাঁ সেই মহান বৈরাম খান। তার উপদেশ যদি এতোই মূল্যবান ছিলো তোমার কাছে তাহলে তুমি তাকে নির্বাসিত করেছিলে কেনো?

আমদ খানের মুখে ফুটে উঠা বিদ্রুপের হাসি সহ্য করা আকবরের পক্ষে আর সম্ভব হলো না। নিজের অজান্তেই তিনি তার মুখের উপর প্রচন্ড এক ঘুষি বসিয়ে দিলেন এবং আদম খান মেঝেতে চিৎ হয়ে পড়লো। আকবর দুপা পিছিয়ে এসে প্রস্তুত হয়ে রইলেন যদি তার দুধভাই আচমকা তাঁকে আক্রমণ করে এই কথা ভেবে। কিন্তু আদম খান তেমন কিছু করলো না। সে উঠে দাঁড়িয়ে স্থির হয়ে রইলো এবং তার রক্তাক্ত নাক দিয়ে ঘন ঘন শ্বাস নিতে নিতে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে আকবরের দিকে তাকিয়ে রইলো।

 আকবর এখন নিজের ক্রোধ দমন করার জন্য লড়ে যাচ্ছেন। তাঁর উচিত আদম খানের মাঝে বোধের উদয় ঘটানো। ভাই আমার, আমরা একত্রে অনেক কিছু করেছি এবং আমি তোমার মায়ের ঋণ কোনোদিন ভুলবো না। আমি ভেবেছিলাম অশ্ব বিশেষজ্ঞের পদটি তোমার পছন্দ হবে। আমি আমার সাম্রাজ্যের বৃদ্ধি ঘটাতে চাই। কিন্তু তা করতে হলে প্রথমে আমাকে নিশ্চিত হতে হবে যে আমার সেনাবাহিনী এর জন্য প্রস্তুত। দ্রুতগতি সর্বদাই মোগলদের একটি প্রধান শক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। আমাদের অশ্বারোহী যোদ্ধাদের জন্য, আমাদের অশ্বারোহী তিরন্দাজ এবং বন্দুকধারীদের জন্য শক্তিশালী এবং দ্রুতগামী ঘোড়া প্রয়োজন। হিমুর বিরুদ্ধে অভিযানের পর আমাদের আস্তাবলে নতুন সরবরাহের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। তোমাকে সমগ্র সাম্রাজ্য ভ্রমণ করতে হবে প্রয়োজন হলে তুমি তুরস্ক, পারস্য আরব দেশে যাবে। কিন্তু তোমাকে জোগাড় করে আনতে হবে শ্রেষ্ঠ জানোয়ার গুলি।

 আকবর তার দুধ-ভাই আদম খানের দিকে এগিয়ে গেলেন। এই মুহূর্তে যা ঘটলো এসো আমরা তা ভুলে যাই। আকবর তার হালকা সবুজ জোব্বায় নাক থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত উপেক্ষা করে তাকে আলিঙ্গন করলেন। কিন্তু আদম খানের আড়ষ্ট শরীর সাড়া দিলো না। আকবর তাকে ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে এলেন। আমি এ বিষয়ে মাহাম আঙ্গাকে কিছু বলবো না, এই ঘটনা শুনলে তিনি ভীষণ আহত হবেন।

 কিন্তু আমি কি বলবো; এই, যে ঘোড়া থেকে পড়ে আমার নাক ভেঙ্গে গেছে? আদম খানের কন্ঠে এখনো বিদ্রুপের ছোঁয়া।

 তোমার যা খুশি বলতে পারো। ঐখানে গামলায় পানি আছে, নিজেকে পরিষ্কার করে নাও। আকবর ভাবলেন এভাবে রাগে উন্মত্ত হওয়া তার ঠিক হয়নি। এটা কিছুতেই তাঁর উপযুক্ত আচরণ নয়। তিনি এখন আদম খানের সম্রাট, তার সমপর্যায়ের নন। তাদের উভয়েরই সেটা মনে রাখা উচিত ছিলো।

*

এবারের বর্ষাকালটা বেশ আগেই শুরু হয়েছে, ধূসর মেঘে ঢাকা আকাশ থেকে ঝরা অবিরাম বৃষ্টি নিচের সিক্ত জগতটাকে যেনো গ্রাস করতে চাইছে। যমুনার ফেঁপে ওঠা জল দুই সপ্তাহ আগে এর পাড় প্লাবিত করেছে এবং তখন থেকে অস্বাস্থ্যকর জলজ প্রাণী, উদ্ভিদ এবং পলি দুর্গের ভিতর প্রবেশ করছে-ভেড়া এবং কুকুর গুলিকে ডুবিয়ে দিয়েছে, এমনকি একটি উটকেও। হিন্দুস্তানের এই ঋতুটিকে আকবর সবচেয়ে অপছন্দ করতেন, যখন সবকিছুই আর্দ্রতার আক্রমণে পঁচে যাওয়ার উপক্রম হয়। গ্রীষ্মের উষ্ণতার বিকল্প হিসেবে প্রতিদিন গুরুত্বপূর্ণ কক্ষ গুলিতে এবং হেরেমে কয়েক ঘন্টার জন্য কর্পূরকাঠ জ্বালা হয়। যাতে মহামূল্য রেশম, কিংখাব এবং মখমল গুলি রক্ষা পায় পোকামাকড় এবং আর্দ্রতার আক্রমণ থেকে।

মায়ালার কক্ষে লাল চাদর ঢাকা বিছানায় নগ্ন অবস্থায় শুয়ে থাকা আকবর কর্পূরের হালকা ঝাঁঝালো ঘ্রাণ পাচ্ছিলেন। আকবরের শরীরকে আরাম দেয়ার জন্য এবং তার মাথা ব্যাথা দূর করার জন্য মায়ালা তাঁর পিঠ এবং কাঁধ মালিশ করে দিচ্ছিল খুবানির(বাদাম) তেল দিয়ে। প্রতি বর্ষাতেই তিনি এই মাথাব্যাথা দ্বারা আক্রান্ত হোন এবং সারাদিন অস্বস্তি বোধ করেন। তাঁর পিতারও একই সমস্যা ছিলো। তরুণ অবস্থায় এর জন্য হুমায়ুনের প্রিয় উপসম ছিলো মদের মধ্যে ওপিয়াম গুলে পান করা। কিন্তু তার এই আসক্তির জন্য তিনি প্রায় সিংহাসন হারাতে বসেছিলেন এবং আকবরকে তিনি এ বিষয়ে সতর্ক করেছেন।

 মালিশ করে দেয়ার জন্য হুমায়ুনের যদি মায়ালার মতো কেউ থাকতো তাহলে হয়তো তাঁর ওপিয়ামের প্রয়োজন হতো না, আকবর ভাবলেন। তিনি তৃপ্তিতে ঘড় ঘড় শব্দ করছেন যখন মায়ালার নরম হাতের তালুগুলি দক্ষ ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে তার পেশী সমূহের উপর কর্মরত। মায়ালা তাঁকে হাসাতেও পারে। একজন সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষক হিসেবে সে আকবরের দরবারের সকল সদস্যের অনুকরণ করতে পারতো। গৃহস্থালীর রসদ সংরক্ষক জওহর থেকে শুরু করে প্রধান সেনাপতি আহমেদ খান পর্যন্ত সকলেই তার নির্দয় অনুকরণের শিকার হতেন।

আকবর তাঁর বলিষ্ঠ শরীরটি টানটান করলেন-যা দৃঢ় এবং প্রস্তুত যুদ্ধের জন্য, তার অধীনস্থ যে কোনো সৈন্যের মতোই। মায়ালার দক্ষ মালিশের প্রভাবে তাঁর মাথাব্যাথা প্রায় বিলুপ্ত হয়েছে। উপুর অবস্থায় হাতের উল্টোপিঠে মাথা রেখে তিনি চোখ বন্ধ করলেন এবং ঘুমের দেশে হারিয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু ঠিক তখনই উচ্চ স্বরে গোলযোগের শব্দ তার কানে এলো। ভীষণ ক্রুদ্ধ চিৎকার ছাপিয়ে একটি পরিচিত শব্দ ভেসে এলো ইস্পাতের সঙ্গে ইস্পাতের সংঘর্ষের শব্দ। কেউ লড়াই করছে। তিনি নারীকন্ঠের চিৎকার শুনলেন এবং তার পাশাপাশি তাঁর বহু পরিচিত গভীর একটি কণ্ঠস্বর চিৎকার করছে, আকবর! কাপুরুষ, সাহস থাকলে বের হয়ে এসে আমার মুখোমুখি হও…

আকবরের নিদ্রাচ্ছন্নতা উবে গেলো, তিনি ঝট করে উঠে পড়লেন, একটু থামলেন শুধু তাঁর ছোরাটা নেয়ার জন্য, তারপর নিজের নগ্নতার প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করে মায়ালার কক্ষ থেকে খোলা উঠানে বেরিয়ে এলেন। বৃষ্টি থেমে গেছে, সাধারণত উঠানের মধ্যবর্তী ঝর্নাটাকে ঘিরে মেয়েরা নাচে, গান গায় অথবা নিজেদের মধ্যে গল্প করে। কিন্তু এখন সেখানে একটি মাত্র লোক দাঁড়িয়ে আছে-আদম খান, হেরেমের প্রবেশ দ্বারের একটু ভিতরে। তার একহাতে একটি তলোয়ার এবং আরেক হাতে একটি ছোরা। তার পেছনে দুজন হেরেমরক্ষীর রক্তাক্ত দেহ পড়ে আছে। আকবর আদম খানের দিকে তাকালেন।

 তুমি এসব কি করেছো?

আদম খান দুলছিলো। আমি ঐ কুকুর আতগা খানকে খুন করেছি… তার কথা বলার ভঙ্গি প্রত্যক্ষ করে আকবর নিশ্চিত হলেন যা তিনি অনুমান করেছেন। সে আকণ্ঠ কড়া মদ পান করেছে।

 কেনো? আতগা খান তো তোমার শত্রু ছিলেন না!

 সে নিজেকে অনেক উৎকৃষ্ট ভাবতো, জমকালো জোব্বাটা পড়ে বসে ছিলো যেটা আমার হওয়ার কথা এবং অনুলেখক কে তার করণীয় বিষয়ের বর্ণনা দিচ্ছিলো। নির্বোধটা আমার দিকে তাকিয়ে হেসেও ছিলো যখন আমি তার কক্ষে প্রবেশ করি। কিন্তু যখন আমি তলোয়ার দিয়ে তার হৃৎপিণ্ড ভেদ করি তখন সে আর হাসছিলো না…বরং তার চেহারায় ছিলো বিস্ময়, যেমনটা এখন তোমার মুখে দেখা যাচ্ছে।

আকবর শুনলেন মায়ালা তার পেছনে আর্তচিৎকার দিয়ে উঠলো কিন্তু তিনি আদম খানের উপর থেকে দৃষ্টি সরালেন না। মাথা না ঘুরিয়েই বললেন, ঘরের ভিতর যাও মায়ালা এবং আমি বের হতে না বলা পর্যন্ত সেখানেই থাকো। একটা কুকুর পাগল হয়ে গেছে।

প্রায় তখনই রক্ষীদের চিৎকার এবং হেরেমের দিকে ছুটে আসতে থাকা পদশব্দ শোনা গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই আদম খানের আচমকা আক্রমণে

পালিয়ে যাওয়া রক্ষীরা দলে ভারী হয়ে এসে হেরেমের সামনের উঠান ঘিরে ফেললো। তাঁদের মধ্যে বয়স্ক ভৃত্য রফিকও ছিলো। সে এক সময় হুমায়ূনের সেবা করেছে এবং এখন হামিদার সেবায় নিয়োজিত। বৃদ্ধটি কোথা থেকে যেনো জোগাড় করা একটি তলোয়ার ঝাঁকাচ্ছিলো। আকবর ইশারা করলেই রক্ষীরা ঝাঁপিয়ে পড়ে আদম খানকে কেটে ফেলবে। কিন্তু আকবর অন্য কারো হাতে তার দুধভাই এর মৃত্যু ঘটাতে চাইলেন না, যে এই পবিত্র বন্ধন ছিন্ন করেছে। এটা তাঁর দায়িত্ব। তিনি হাত নেড়ে রক্ষীদের পিছিয়ে যেতে বললেন।

একটু আগে তুমি আমাকে লড়াই এর আহ্বান জানাচ্ছিলে। তাই হবে। রফিক তোমার তলোয়ারটা আমাকে দাও। টলমল করতে থাকা আদম খানের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে রফিক পড়ো পড়ো অবস্থায় আকবরের কাছে গেলো। আকবর তার হাত থেকে তলোয়ারটা নিয়ে শূন্যে কয়েকবার চালালেন। সেটার পুরানো ধাচের বাটটি আকবরের কাছে কিছুটা অসুবিধা জনক লাগলো কিন্তু সেটার বাঁকা ফলাটি ছিলো ধারাল এবং চকচকে। তিনি রফিকের বাড়িয়ে দেয়া একটুকরো কাপড় তার নগ্ন কোমরে পেচিয়ে নিলেন।

 ঠিক আছে আদম খান, আমাদের উভয়ের কাছেই এখন একটি করে ছোরা এবং তলোয়ার রয়েছে, কাজেই আমরা সমান সমান। দেখা যাক কি হয়, কি বলো?

আকবর আদম খানের দিকে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে স্থির হলেন, তাঁকে আক্রমণ করার জন্য আদম খানকে প্রলুব্ধ করতে চাইলেন। কিন্তু যদিও মদের প্রভাবে তার বুদ্ধি কিছুটা ভোতা হয়ে গিয়েছিলো, তখনো তার নিজের উপর যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ ছিলো। সে শুরুতেই ভুল করতে প্রলুব্ধ হলো না। যখন তারা পরস্পর চক্রাকারে ঘুরতে লাগলো তখন আকবর তার শিকারের কথা মনে করলেন- যখন তিনি অনুমান করার চেষ্টা করেন শিকারের প্রাণীটির পরবর্তী আচরণ কি হবে। হঠাৎ সুযোগ বুঝে তিনি ঝট করে সামনে বাড়লেন এবং আদম খানের তলোয়ারের বাটের উপরের অংশে যুক্ত আচ্ছাদনটিতে তলোয়ারের অগ্রভাগ ঢুকিয়ে দ্রুত মোচড় দিলেন। আদম খানের তলোয়ার তার হাত থেকে ছুটে পাথুরে মেঝেতে পড়লো। এটা একটা পারসিক কৌশল যা বৈরাম খান অনেক আগে আকবরকে শিখিয়েছিলেন। আকবর তাকে আঘাত করার আগেই আদম খান ঝট করে পিছিয়ে গেলো। তারপর তার ছোরাটা তুলে আকবরের দিকে সজোরে নিক্ষেপ করলো। আকবর একপাশে সরে গেলেন কিন্তু যথেষ্ট দ্রুততার সাথে নয়। ছোরাটির অগ্রভাগ তার চোখের নিচে আচড় কেটে গেলো। আকবরের গলা বেয়ে তখন উষ্ণ রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। তিনি তাঁর ছোরা এবং তলোয়ার ছুঁড়ে ফেললেন, তারপর তিনটি লম্বা লাফে এগিয়ে গিয়ে আদম খানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তারা উভয়ে যখন মেঝের উপর আছড়ে পড়লো আকবর অনুভব করলেন আদম খান তার দেহের নিচ থেকে মুচড়ে বের হওয়ার জন্য ধস্তাধস্তি করছে। আকবর তার চুলের মুঠি ধরে সজোরে মাথাটা পাথুরে মেঝেতে ঠুকে দিলেন-একবার, দুবার, তিনবার। তারপর উঠে বসে ডান মুষ্ঠি দিয়ে তার মুখের উপর এতো জোরে ঘুষি বসালেন যে তার চোয়ালের হাড়ে মট করে শব্দ হলো। কুত্তার বাচ্চা…. তিনি চিৎকার করে উঠলেন।

 আদম খানের মুখ দিয়ে তখন একটি যন্ত্রণাকাতর ঘড় ঘড় শব্দ বেরিয়ে আসছিলো। আকবর তাকে সজোরে টেনে দাঁড় করালেন, তাঁর মুখে তখন নিজের রক্তের লোনা স্বাদ। আদম খানের আহত অসাড় দেহটাকে উপর্যুপরি আঘাতের মাধ্যমে নিষ্প্রাণ করে ফেলার তীব্র আকাঙ্ক্ষা অনুভব করলেন আকবর। কিন্তু একজন সম্রাটের আচরণ নিয়ন্ত্রণের বইরে চলে যাওয়া উচিত নয়। তিনি আদম খানের শিথিল দেহটাকে ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে গেলেন এবং সেটা ভাঁজ হয়ে লুটিয়ে পড়লো মেঝেতে।

 তোমাকে হত্যার নির্দেশ প্রদানের আগে তোমার কি কিছু বলার আছে?

আদম খান অনেক কষ্টে তার মাথা তুললো। তুমি হয়তো এখন আমাকে পরাজিত করতে পেরেছে কিন্তু আমি বহু মাস ধরে তোমাকে বোকা বানিয়ে আসছি। ঐ নির্বোধ কুকুরী গুলি, অবশ্যই আমি তাদের অপহরণ করেছিলাম- তুমিই কেনো সবসময় উত্তম জিনিসগুলি পাবে? আমি তাদের হত্যা করেছিলাম যাতে তারা ঘটনাটা কাউকে বলতে না পারে।

 আর বৈরাম খান?

 তুমি কি মনে করো? আদম খানের বিধ্বস্ত মুখে এই মুহূর্তেও যেনো বিদ্রূপপূর্ণ বিজয়ীর হাসি ফুটে উঠলো।

এটাই ওর জীবনের শেষ হাসি, আকবর নিজের অজ্ঞতা এবং বোকামীর জন্য নিজের উপরই তীব্র ক্রোধ অনুভব করে ভাবলেন।

 রক্ষী ওকে নিয়ে প্রাচীরের উপর থেকে নিচে নিক্ষেপ করো।

আকবরের সামনে দিয়ে দুজন রক্ষী আদম খানের পা টেনে উঠানের অপরপ্রান্তে ছেচড়ে নিয়ে গেলো, পাথরের মেঝেতে তার রক্তের লম্বা দাগ ফুটে উঠল। পাঁচিলের প্রান্তে পৌঁছে রক্ষীরা আদম খানের পা ছেড়ে দিয়ে তার বগলের নিচে হাত ঢুকিয়ে তাকে উপুর করলো, তারপর মাথা নিচের দিকে দিয়ে ঠেলে বিশ ফুট নিচের চত্বরে ফেলে দিলো। রক্ষীরা ঝুঁকে নিচে পড়ে থাকা আদম খানকে পর্যবেক্ষণ করলো, তারপর আকবরের দিকে ফিরে বললো, জাঁহাপনা সে এখনো নড়ছে।

 তাহলে ওর চুল ধরে টেনে আবার উপরে নিয়ে এসো এবং আবার নিচে নিক্ষেপ করো।

রক্ষীরা সিঁড়ি বেয়ে চত্বরে নেমে গেলো এবং কয়েক মিনিট পরে আবার আবির্ভূত হলো আদম খানের খিচতে থাকা শরীরটার চুল ধরে টেনে। এবার আকবরও রক্ষীদের অনুসরণ করে পাঁচিলের ধারে উপস্থিত হলেন এবং আদম খানের দ্বিতীয় পতন প্রত্যক্ষ করলেন। এ যাত্রায় আদম খানের মাথার খুলির সঙ্গে পাথরের সরাসরি সংঘর্ষে তা বাদামের মতো ফেঁটে গেলো এবং মাথার গোলাপি-ধূসর মগজ ছিটকে পড়লো। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আকাশ থেকে চিল নেমে এলো মৃতদেহটাকে ঠুকরে খাওয়ার জন্য। শীঘ্রই প্রায় একডজন চিল জুটে গেলো আকবরের বাল্যকালের সঙ্গীটির মৃতদেহ ভক্ষণ করার জন্য।

আকবর আর সেখানে দাঁড়ালেন না। সম্পূর্ণ ঘটনাটি তাঁর মনের উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছে। তিনি এতো বোকামী করলেন কীভাবে? আবহাওয়া উষ্ণ হলেও তিনি ঠাণ্ডা অনুভব করলেন এবং কাঁপতে লাগলেন। একটা প্রশ্ন তাঁর মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে যে প্রশ্নটি তিনি আদম খানকে করতে চেয়েও করেননি-হয়তো তিনি এর উত্তর কি হবে সে বিষয়ে শঙ্কিত ছিলেন। মাহাম আঙ্গা তার পুত্রের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কতটা জানেন? উঠানটিতে তখন ভিড় জমে গেছে। মেয়েরা তাদের ঘরং থেকে বেরিয়ে এসেছে এবং হেরেম রক্ষীদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া অভাবিত ঘটনা নিয়ে আলোচনা করছে। আমার জোব্বাটা এনে দাও, আকবর একজন পরিচারককে আদেশ দিলেন।

পনেরো মিনিট পর মনের মধ্যে একরাশ বিশৃঙ্খল ভাবনা নিয়ে আকবর। মাহাম আঙ্গার কক্ষের দিকে অগ্রসর হলেন। ইতোমধ্যে তিনি তাঁর ব্যক্তিগত দেহরক্ষীদের তাঁর ঘর তল্লাশি করে ঘরের বাইরে পাহারায় থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। আদম খানের অর্ধমাতাল অবস্থা বিবেচনা করে অনুমান করা যায় সে একাই নিজস্ব আবেগের তাড়নায় উন্মত্ত আচরণ করেছে, যদিও তার ক্ষোভ এবং ঈর্ষা দীর্ঘদিন ধরে তার মাঝে পুঞ্জিভূত ছিলো। তা সত্ত্বেও আর কোনো বিশ্বাসঘাতক নিজের ঘরের মাঝে ওৎ পেতে আছে কিনা সেটা অনুসন্ধান করে দেখার এখনই উপযুক্ত সময় আকবরের জন্য। মাহাম আঙ্গার কক্ষের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা আকবরের দেহরক্ষীদের অধিনায়ক তাকে সংক্ষিপ্ত অভিবাদন জানালো।

 আমরা কক্ষটি তল্লাশি করেছি। এখানে প্রবেশ করা আপনার জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ জাহাপনা।

কি ঘটেছে সে সম্পর্কে দুধমাকে তোমরা কিছু বলেছে?

না জাহাপনা।

তিনি কি তার পুত্রের বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করেছেন?

না জাহাপনা।

আকবরের প্রবেশের জন্য যখন রক্ষীরা কক্ষের দরজা খুলে দিলো তিনি অনুভব করলেন, যে কাজ তিনি করতে যাচ্ছেন তা যে কোনো যুদ্ধের চেয়েও অধিক তিক্ততাপূর্ণ। রক্ষীদের অধিনায়কের বক্তব্য অনুযায়ী তার সঙ্গে আদম খানের লড়াই অথবা তার মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে মাহাম আঙ্গা কিছুই জানেন না, যদিও একজন ক্ষিপ্রগতির পরিচারকের মাত্র পাঁচ মিনিট সময় লাগার কথা বার্তাটি মাহাম আঙ্গার কাছে পৌঁছানোর জন্য। মাহাম আঙ্গা তার কক্ষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তার চেহারা উদ্বিগ্ন।

 আকবর, এসব কি হচ্ছে? হঠাৎ করে কেনো আমার সঙ্গে কয়েদির মতো আচরণ করা হচ্ছে? আকবরের মুখের উপর নিবদ্ধ তাঁর বাদামি চোখ গুলিতে নির্ভেজাল বিস্ময়। নিজেকে শক্ত করার জন্য আকবর কয়েক মুহূর্ত আগা খানের রক্তাক্ত মৃতদেহটির কথা ভাবলেন, যা তিনি কয়েক মিনিট আগে পর্যবেক্ষণ করেছেন। এখন তার দেহটি কর্পূর দিয়ে ধুয়ে সামাহিত করার প্রস্তুতি চলছে।

মাহাম আঙ্গা, সারা জীবন আমি আপনাকে আমার মায়ের মতো মনে করেছি। আমি যা বলতে যাচ্ছি তা বলা আমার জন্য মোটেই সহজ হবে, তাই আমি সরাসরি বলতে চাই। এক ঘন্টা আগে আপনার ছেলে আমার প্রধান ভাণ্ডার সংরক্ষক আতগা খানকে হত্যা করেছে এবং সে সশস্ত্র অবস্থায় বলপূর্বক হেরেমে ঢুকে পড়ে আমাকে হত্যা করার জন্য।

 না! মাহাম আঙ্গা এমন কোমলভাবে শব্দটি উচ্চারণ করলেন যে তা প্রায় শুনাই গেলো না। নিজের অসার হয়ে আসা দেহের পতন ঠেকানোর জন্য তিনি অন্ধের মতো কিছু আকড়ে ধরতে চাইলেন অবলম্বন হিসেবে কিন্তু তার হাতে একটি মিষ্টির থালা ব্যতীত আর কিছু ঠেকলো না, থালাটি সশব্দে মেঝেতে পড়ে গেলো।

এখানেই শেষ নয়। আদম খান আমাকে দ্বন্দ্ব-যুদ্ধের আহ্বান জানায় এবং আমি তাকে ন্যায্যভাবে লড়াই-এ পরাজিত করি। তারপর আমি আদেশ করি তাকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে মৃত্যুদন্ড প্রদানের জন্য।

 মাহাম আঙ্গা ধীরে তার মাথাটি দুপাশে নাড়ছিলেন এবং ফোঁপান ও বিলাপের মধ্যবর্তী একটি বেদনাদায়ক শব্দ করছিলেন। আমাকে বলল সে এখনো বেঁচে আছে, অবশেষে তিনি কান্না জড়িত স্বরে বলে উঠলেন।

আকবর তার কাছে এগিয়ে গেলেন। আমার আর কোনো উপায় ছিলো না। আমার নির্দেশে তাকে মাথা নিচের দিকে দিয়ে প্রাচীরের উপর থেকে নিচে ফেলা হয়। আমার কাছে তার অপরাধের যে কেবল চাক্ষুশ প্রমাণ ছিলো তাই নয়, দম্ভের সঙ্গে সে তার অন্যান্য অপরাধের কথাও স্বীকার করেছে-আমাকে পাঠানো মেয়ে গুলিকে সে আক্রোশ এবং ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে অপহরণ ও হত্যা করে। তার চেয়েও জঘন্য বিষয় হলো সে বিদ্রূপ করে আমাকে বলে বৈরাম খানের হত্যাকাণ্ড সেই পরিচালনা করেছে। এমন ঔদ্ধত্য এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া জরুরি ছিলো…তাকে হত্যার নির্দেশ দেয়া ছাড়া আমি আর কি করতে পারতাম?

না! এবার শব্দটি আর্তচিৎকারের মতো উচ্চারিত হলো। আমি তোমাকে আমার স্তনের দুধ পান করিয়েছি যখন তুমি শিশু ছিলে। আমি আমার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তোমাকে বাঁচিয়েছি যখন তোমার চাচা তোমাকে কামান দেগে মারতে চেয়েছিলো এবং কাবুলে তোমাকে বন্দুকের গুলি থেকে রক্ষা করেছি। আর সেই তুমিই আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলে আমার একমাত্র ছেলেকে হত্যা করে-তোমার আপন দুধভাইকে! আমি আমার কোলে একটা বিষাক্ত সাপ পুশেছি, একটা শয়তানকে পুশেছি।

মাহাম আঙ্গা মেঝের উপর গড়িয়ে পড়লেন, প্রথমে বিকারগ্রস্তের মতো নখ দিয়ে শতরঞ্জিতে আচড় কাটলেন এবং তারপর আকবরের হাঁটুর নিচের মাংসে নখ বসিয়ে আঁচড় দিলেন। আকবরের পা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ে শতরঞ্জির লাল রঙের সঙ্গে মিশে যেতে লাগলো।

রক্ষী! আকবর নিজে তার গায়ে হাত দেয়ার কথা ভাবতে পারলেন না। তার সঙ্গে ভদ্র আচরণ করো। উনি শোকের আঘাতে বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। দুজন রক্ষী টেনে মাহাম আঙ্গাকে আকবরের কাছ থেকে সরিয়ে নিলো। এক মুহূর্ত পর তিনি মুক্ত হলেন কিন্তু পুনরায় আক্রমণের কোনো চেষ্ট করলেন না। শতরঞ্জির উপর বসে সামনে পিছনে দুলতে লাগলেন।

 মাহাম আঙ্গা, আমি আপনার কাছে জানতে চাচ্ছি, আপনার ছেলে যা করেছে সে সম্পর্কে কি আপনি জানতেন, আমাকে হত্যার চেষ্টা সম্পর্কে? তিনি তার অবিন্যাস্ত চুলের মধ্য দিয়ে আকবরের দিকে তাকালেন। না।

 আর আপনি যে বৈরাম খানকে তীর্থ যাত্রায় পাঠানোর বিষয়ে আমাকে পরামর্শ দিয়ে ছিলেন, সেটা কি এই জন্য যে আমার উপর তার প্রভাবের জন্য আপনি এবং আদম খান তাঁর প্রতি ঈর্ষান্বিত ছিলেন? এবারে মাহাম আঙ্গা নীরব রইলেন। আপনাকে উত্তর দিতেই হবে এবং দিতে হবে সভাবে। এটাই সম্ভবত আপনার সঙ্গে আমার শেষ দেখা।

আমি ভেবেছিলাম বৈরাম খান না থাকলে তুমি অন্যদের কাছ থেকে উপদেশ নেবে।

যেমন আপনার কাছ থেকে এবং আপনার ছেলের কাছ থেকে?

হ্যাঁ। আদম খান আমাকে জানায় সে তোমার অবহেলার শিকার এবং আমি তার সঙ্গে একমত পোষণ করি।

আর আপনি কি বৈরাম খানকে হত্যার বিষয়েও তার সঙ্গে একমত হোন, যাতে আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী আর ফিরে আসতে না পারে? মাহাম আঙ্গার প্রতি তার কোমল অনুভূতি থাকা সত্ত্বেও আকবর আবারও ক্রোধান্বিত হয়ে উঠছিলেন। এই জিজ্ঞাসাবাদ যতো তাড়াতাড়ি শেষ হয় ততোই সকলের জন্য মঙ্গল।

আকবরের কণ্ঠস্বরে তিক্ততার আভাস পেয়ে তাঁর দুধমা কিছুটা শঙ্কিত হলেন। আমি কখনোও চাইনি বৈরাম খান নিহত হোক….এবং আমি নিশ্চিত তার হত্যাকাণ্ডের জন্য আমার ছেলে দায়ি নয়, তোমাকে দম্ভ করে সে যাই বলে থাকুক না কেনো।

মায়ের ভালোবাসার মতো অন্ধ আর কিছুই নয়, আকবর ভাবলেন।

আমি সর্বদাই তোমাকে ভালোবেসেছি আকবর, মাহাম আঙ্গা নিপ্রভাবে বললেন, যেনো তিনি তার মনের কথা বুঝতে পেরেছেন।

 তা সত্যি, কিন্তু আপনি আপনার নিজের ছেলেকে তারচেয়েও বেশি ভালোবেসেছেন। মাহাম আঙ্গা, আমি এখন যা করতে যাচ্ছি তা এই রকম। আগামীকাল আপনাকে দিল্লীর দূর্গে নিয়ে যাওয়া হবে, সেখানে জীবনের বাকি দিন গুলি আপনি নির্বাসনে কাটাবেন। আপনার ছেলের জন্য একটি জাঁকজমকপূর্ণ সমাধি নির্মাণের জন্য আপনাকে আমি অর্থ প্রদান করবো। কিন্তু আপনার সঙ্গে আমার এবং আমার পরিবারের সদস্যদের আর কোনো রকম সম্পর্ক থাকবে না। আকবর যখন মাহাম আঙ্গার কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসছেন তিনি শুনতে পেলেন সে পুনরায় বিলাপ শুরু করেছে। তাঁর অসংলগ্ন হাহাকার তখন আর শোক বাক্যের মাঝে সীমাবদ্ধ নেই। তিনি তখন আকবরের উপর ঈশ্বরের অভিশাপ বর্ষিত হওয়ার জন্য প্রার্থনা করছেন এবং নিজ মৃত পুত্রের উপর ঈশ্বরের আশীর্বাদ। সেই সব যন্ত্রণাক্লিষ্ট শাপ শাপান্তের প্রতিধ্বনি পেছনে ফেলে আকবর ঘোর লাগা মানুষের মতো তার আপন মায়ের কক্ষের দিকে রওনা হলেন। গুলবদন হামিদার সঙ্গে ছিলেন এবং তাঁদের চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছিল ঘটনা সম্পর্কে তারা সবকিছু জানেন।

হামিদা আকবরকে বুকে জরিয়ে ধরে থাকলেন। আল্লাহকে অসংখ্য ধন্যবাদ যে তুমি নিরাপদে আছো। ঐ অকৃতজ্ঞ শয়তানটা কি করার চেষ্টা করেছিলো আমি শুনেছি…।

 পাচিলের উপর থেকে নিচে ফেলে তাকে আমি হত্যা করেছি। আর মাহাম আঙ্গাকে দিল্লীর দূর্গে নির্বাসনে পাঠাচ্ছি।

 মাহামকেও মৃত্যুদণ্ড দেয়া উচিত। তোমার দুধমা হিসেবে সে তার পবিত্র বন্ধনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। হামিদা রুঢ় কণ্ঠে বললেন।

না। তার ছেলের মৃত্যুই তার জন্য যথেষ্ট শাস্তি। তাছাড়া আমার পক্ষে ভোলা সম্ভব নয় যে তিনি শৈশবে আমার জীবন বাঁচিয়েছেন।

 আমার মনে হয় মাহামকে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে তুমি সঠিক কাজ করেছে, গুলবদন কোমল স্বরে বললেন। যে আসল হুমকি ছিলো তার উপযুক্ত ব্যবস্থা তুমি করেছে এবং একজন মহিলার উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করা নিপ্রয়োজন। হিন্দুস্তানের এক পরাজিত শাসকের মা যখন তোমার পিতামহকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করতে চেয়েছিলো, তিনি তাকে ক্ষমা করেছিলেন এবং সে জন্য অধিক শ্রদ্ধাও অর্জন করেছিলেন। তিনি হামিদার দিকে ফিরলেন। আমি বুঝতে পারছি তোমার অনুভূতি কেমন, কিন্তু তুমি যখন তোমার ক্রোধ এবং আঘাতকে অতিক্রম করে যাবে তখন তুমি বুঝতে পারবে যে আমি ঠিক কথাই বলছি।

হয়তো, হামিদা আস্তে করে বললেন। কিন্তু গুলবদন, আমার মতো তুমিও জানো অতিরিক্ত ক্ষমা প্রদর্শনের পরিণতি কি। তোমার ভাই এবং আমার স্বামী বার বার তাদের ক্ষমা করেছেন যাদের তার হত্যা করা উচিত ছিলো এবং এর ফলে আমরা অনেক ভোগান্তির শিকার হয়েছি।

হুমায়ূন তাই করেছেন যা তিনি সঠিক বলে বিশ্বাস করেছেন এবং সেজন্য নিশ্চিতভাবেই তিনি নিজেকে অধিক মহৎ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন।

 মা এবং ফুফুর কথাবার্তা আকবর তেমন মনোযোগের সঙ্গে আর শুনছিলেন না। আদম খানের বিশ্বাসঘাতকতা তার প্রতি আকবরের ভালোবাসাকে সম্পূর্ণ মুছে দিতে পারেনি। তিনি যদি তাকে আরো ভালোভাবে বুঝতে পারতেন তাহলে হয়তো তাকে গুরুতর অপরাধগুলি সংঘটন করা থেকে বিরত করতে পারতেন। আদম খানের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পরিতৃপ্ত করার কোনো উপায় কি তার জানা ছিলো?

 হঠাৎ আকবর অনুভব করলেন তার মা ও ফুফু কথা বন্ধ করে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমার বোঝা উচিত ছিলো কি ঘটতে যাচ্ছে, তিনি বললেন। বৈরাম খানের ব্যাপারে মাহাম আঙ্গার পরামর্শ গ্রহণ করা আমার উচিত হয়নি বরং নিজের কাছেই প্রশ্ন করা উচিত ছিলো এতে তার কি লাভ ছিলো। শায়জাদা যখন তার বোনের অপহরণকারী হিসেবে আদম খানের নাম উল্লেখ করলো তখন আমার উচিত ছিলো আদম খানকে আরো কঠোরভাবে প্রশ্ন করা। এমনকি আমি এই মর্মে একটি সতর্কবাণী পেয়েছিলাম যে বৈরাম খানের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার সম্পর্ক রয়েছে- কেউ একটি চিরকুট আমার কক্ষে রেখে গিয়েছিলো।

 আমি জানি। আমার পরিচারকই তা করেছিলো। সে একটু আগে আমাকে এ কথা বলেছে। বয়স্ক হওয়া সত্ত্বেও রফিক অনেক কিছু দেখতে ও শুনতে পায় যা অন্যরা বুঝতে পারে না। সে আড়িপেতে শুনে যে আদম খান বৈরাম খানের মৃত্যুর জন্য আত্মতৃপ্তি প্রকাশ করছে এবং ধারণা করে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার সম্পর্ক রয়েছে। যদিও তার কাছে কোনো প্রমাণ ছিলো না তবুও সে তোমাকে সতর্ক করতে চেয়েছিলো। নিজের জামার হাতা ছিঁড়ে সে চিরকুট বানায় কারণ কাগজ যোগাড় করা তার পক্ষে সম্ভব ছিলো না এবং সুযোগ বুঝে তোমার ঘরে রেখে আসে। আকবর, রফিক ভয় পাচ্ছে তার সন্দেহের কথা সাহস করে সরাসরি তোমাকে না বলায় তুমি হয়তো তাকে শাস্তি দেবে।

না। আমি তার কাছে দ্বিগুণ ঋণী। একটু আগে আমি যখন হেরেমে নিরস্ত্র ছিলাম তখন সে আমাকে একটি তলোয়ার দিয়েছিলো। তাকে জানিও আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ এবং তার বিশ্বস্ততার উপযুক্ত পুরষ্কার আমি তাকে দেবো। যে অঘটন ঘটে গেছে তার সকল দায় আমার। রফিকের সতর্কবাণী সত্ত্বেও আমি আদম খানকে তেমন ভাবে চাপ দেইনি। আমি বোকার মতো কাজ করেছি। আমি আদম খান এবং মাহাম আঙ্গাকে ভালোবাসতাম এবং তারা সেই ভালোবাসা আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। এখন থেকে আমার চারপাশের সকলের উদ্দেশ্যের বিষয়ে আমাকে সন্দেহ ও প্রশ্ন করতে হবে- এমনকি যারা আমার সবচেয়ে নিকটবর্তী তাঁদের ক্ষেত্রেও এই নীতি প্রযোজ্য হবে। একজন সম্রাটের ভূমিকা অত্যন্ত নিঃসঙ্গ এই বাস্তবতা মেনে নেয়া ছাড়া উপায় নেই। একজন শাসকের কারো উপর সম্পূর্ণ আস্থা রাখা উচিত নয়।

 তুমি যদি এই দুঃখ জনক বাস্তবতা থেকে কিছু শিখে থাক তাহলে আজকের ঘটে যাওয়া ঘটনার ব্যাপক তাৎপর্য রয়েছে, হামিদা বললেন, তার চেহারা বিষণ্ণ। আজ থেকে বহু বছর পরে তুমি যখন আজকের দিনটির কথা মনে করবে তখন তুমি উপলব্ধি করবে এটা ছিলো সেই সময় যখন তুমি কৈশোরকে অতিক্রম করে বয়ঃপ্রাপ্ত পুরুষে এবং একজন ম্রাটে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীতে আমাদের মর্যাদা যাই হোক না কেনো, সকলের জীবনই বহু তিক্ত উপাদানে পূর্ণ। আজ তুমি এর কিছুটা স্বাদ পেয়েছে, দোয়া করি ভবিষ্যতে তুমি আরো বলিষ্ঠ হয়ে উঠবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *