1 of 2

৩০. লাল পাগড়িওয়ালারা

ক্যা গো, লাল পাগড়িওয়ালারা তোমাক তো ধরলো না? মাঝিপাড়ার জুম্মাঘরত তুমি কি শোলোক না শাস্তর কছো আর ডাইঙার পয়দাগুলা জাল লিয়া দৌড় মারলো কালাহার মুখে। মাঝিপাড়ার জুম্মাঘরেত তুমি নামাজও পড়িছো, ছি! ছিক্কা! গিরিরডাঙায় মাঝিদের জামাতে জুম্মার নামাজ পড়ে কেরামত আলি তার শ্বশুরের তো বটেই, শ্বশুরের বেটিরও ইজ্জতে ফাটল ধরিয়ে দিয়েছে। একদিকে এই বেইজ্জতি এবং একই সঙ্গে কেরামত আলির উস্কানিতেই মাঝিরা ঝাপিয়ে পড়েছে কাৎলাহার বিল দখলে,-স্বামীর এই অপরাধে ফুলজান বড়ই বিচলিত। কেরামত আলির কথায় মেতে উঠে তমিজ এখন জেলের ভাত খাচ্ছে বলে স্বামীর দিকে আড় চোখে হলেও সে তাকায় কটমট করে, আবার মাঝিদের জামাতে নামাজ পড়েছে বলেও তার দিকে যে দৃষ্টি সে বর্ষণ করে সে দুটোর মধ্যে ফারাক করা কঠিন।

ফুলজানের বেটা ঘরের ভেতর বিছানায় হঠাৎ করে কেঁদে ওঠায় ফুলজানের দমবন্ধ-করা কটমটে ভাবটা গলে এবং সেটাকে আরো তরল করতে ছেলেকে কোলে নিয়ে তার দুই গালে দুটো চড় মারে ঠাস ঠাস করে। রোগে রোগে কাবু শিশুটি চেঁচিয়ে কাঁদতে গিয়ে হাঁপায়, কান্না তার হঠাৎ খাদে নেমে গেলে হেঁচকি তুলতে শুরু করে।

মারিস কিসক? হামার বেটাক তুই মারিস কোন সাহসে রে মাগী, কয়েকদিনের নিশ্চলতার অবসান ঘটিয়ে কেরামত আলি তার বৌয়ের চুল ধরে টান দেয় এবং তার পিঠে দুটো কিল লাগিয়ে দেয় দুমদাম করে। মায়ের কোলে দোলা লাগায় ছেলেটা ফের কাঁদার শক্তি পায় এবং ওদিকে নবিতন চেঁচিয়ে ওঠে রান্নাঘর থেকে ও মা, বুবুক মারিচ্ছে গো! ও মা!

নবিতনের ডাকে কেউ আসে না। তার ছোটোবোন গোয়ালঘরের পেছনে মাচা থেকে লাউশাক ছিড়ছে আর মা ব্যস্ত ঐ মেয়েকে নির্দেশ দেওয়ার কাজে। আর হুরমতুল্লা তো জমিতে চলে গেছে ভোর না হতেই।

বেটাকে বুকে চেপে ধরে ফুলজান কাঁদে আর বলে, ইস! বেটার জন্যে সোয়াগ উথলাচ্ছে? দুনিয়া চষ্যা বেড়াও, ব্যারামি বেটাটার কথা কুনোদিন মনে করিছো? এক দানা ওষুধ লিয়া আসিছো? এক ঢোক পানিপড়া দিছো? হামার বেটাক ডাক্তোরের কাছে লিয়া যাবার চাইছিলো মাঝি, তাক তুমি ফুসল্যা ফুসল্যা তুল্যা দিলা পুলিসের হাতে। তাই এখন জৈন্তু খাটে আর তুমি এটি ঠ্যাঙের উপরে ঠ্যাঙ তুল্যা তিন সন্ধ্যা সানকি সানকি ভাত গেলো। তোমার শরম করে না? এংকা মরদের মুখোত আগুন।

লাল পাগড়িওয়ালা এসে তমিজকে ধরে নিয়ে যাবার পর থেকে মাঝির বেটা বিলের এপার ওপার জুড়ে মানুষের কাছে একটা বাপের বেটা হয়ে যাওয়ায় কেরামতের বুকে যে কাঁটা বিঁধেছে, ফুলজানের কথায় তাই এখন খোঁচাতে থাকে তার সর্বাঙ্গে। তবে ফুলজানকে ঘায়েল করার সুযোগও একটা সে পায়, আরে ঐ মাঝিই তো তোর লাঙ রে মাগী। মাঝির গায়ের আঁশটা গন্ধ না পালে তোর ঘ্যাগখান খালি চুলকায়। মাঝির জামাতে নামাজ পড়লে হামার বলে জাত যায়, আর মাঝির চ্যাটটা ঘ্যাগর মধ্যে সান্দায়া লিয়া নিন্দ পাড়লে দোষ হয় না, না? জাউরা মাগী, হামি খবর রাখি না, না?

হঠাৎ চুপসে যেতে যেতে ফুলজানের ঘ্যাগটা ফের ফুলে ওঠে, এতোটাই ফোলে যে, সেটা ঠেকে তার বেটার বেঢপ মাথার সঙ্গে। বেটার জরের তাপে তার ঘ্যাগ একটু একটু কাঁপে; প্রশান্ত কম্পাউনডারের কাছে ছছালটাক বুঝি আর লেওয়া হলো না। নবিতন এসেবেটাকে তার কোল থেকে জোর করে নিয়ে গেলে ফুলজানের কান্নার বেগ দ্বিগুণ হয়। না বুঝেও কিংবা না বুঝেই তমিজের জন্যে কষ্ট প্রকাশের সুযোগটির সে চমক্কার সদ্ব্যবহার করে। উঠানে ফুলজানের মা ও দুই বোনের নীরবতা, ফুলজানের হাউমাউ কান্না ও তার বেটার হাঁপানো ফোঁপানিতে তাকে নিয়ে চক্রান্তের আয়োজন দেখতে না পেয়ে কেরামত হাঁসফাস করে। এই ঢঙের ব্যারাম তো তার আগে কখনো ছিলো না। তেভাগার চাষাদের মধ্যে গান করে বেড়াবার সময় কি চাঙাটই না ছিলো। সেখান থেকে খামাখা চলে এলো। তা এখানে এসেও তো সে ভালোই ছিলো। মাঝিদের নিয়ে মেতে উঠলো, তখনো তো এমন গা ম্যাজম্যাজ ছিলো না তার। মুশকিল হলো এই শ্বশুরবাড়িতে আসার পর থেকে। হুরমতুল্লার কারুবারু আর কাদেরের দয়ায় শরাফত তাকে পুলিসের হাত থেকে না বাঁচালেই পারতো। মাঝিদের বীরত্ব নিয়ে একটা পদ্য তার মাথায় আসি আসি করছিলো, অনেকটা এসেও গিয়েছিলো। কিন্তু ফুলজানের মুখে মাঝির বেটার বেয়াড়াপনা আর বেয়াদবির কথা শুনতে শুনতে পদ্যটার কুঁড়ি বার হতে হতে ছিড়ে গেলো। এই বাড়িতে তার থাকার দরকারটা কী?

ও ফকির। পেছন থেকে বৈকুণ্ঠ কেরামতকে ডেকেই আবার নিজের ভুল সংশোধন করে, আরে দূর! আবার ফকির কলাম! তা তোমার খবরবার্তা নাই। আলিম মাস্টার উদিনকা কলো, তুমি বলে তমিজেক লিয়া গান বান্দিচ্ছো? বান্দা হছে?

গান বাঁধার তো বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে এরাই, এদের মুখে তমিজ ছাড়া আর কথা নাই। আরো কিছুক্ষণ হাঁটলে সঙ্গে জোটে যুধিষ্ঠির। সে শালাও কম নয়, সে-ও এক খবর ছাড়ে। কী?-না, কামারপাড়ার মানুষ শরাফত মণ্ডলের ওপর মহা খেপে আছে। তমিজের মতো মানুষকে জেল খাটায়, তার ভালো হতে পারে না। শরাফতের। জমি বর্গা করে তমিজ তো ঠকলোই, মণ্ডল যুধিষ্ঠিরকেও ফসল দিলো কতো কম। পশ্চিমে চাষারা ফসল চায় তিন ভাগের দুই ভাগ, এখানে মণ্ডল অর্ধেক ফসলও দিলো না। এ-বাহানা সে-সাহানা করে কতো ধানই যে বুড়া রেখে দিলো। খিয়ারের মতো এদিকে সবাই একত্তর হলে সে কি এসব করতে পারে?

কেরামত কপাল কোঁচকায়, ওদিককার কথা আলাদা। ওদিকে চাষারা একজোট হয়া কোমর বান্দে। তাদের সাথে শিক্ষিত মানুষ আছে। আর তোমাগোরে এটি মাঝিরা যায় মাছ চুরি করবার। চুরি করলে পুলিস ধরবি না তো কি সোয়াগ করবি?

কেরামতের এই কথায় তো এদের থ মেরে যাবার কথা। কিন্তু সে যে এমন। ভাবতেও পারে তাই এদের মাথায় ঢোকে না বলেই হোক কিংবা বৈকুণ্ঠের কথার তোড়ে হোক, ঐ মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া হয় না। বৈকুণ্ঠ বলে, তমিজের বাপ ফকির মানুষ। তার। হিরদয়ে আঘাত দিলো। চেরাগ আলি ফকির থাকলে তার একোটা শোলোকে মণ্ডলের গুষ্টির হাগা আরম্ভ হলোনি। ফকিরের গানের ক্ষমতা আছিলো গো। এখনো নাই তা কবার পারি না। তার গানের তেজ এখনো সমান।

গানের ফল আবার হাতে হাতে পাওয়া মানে কী? কেরামত বলে, তোমরা চেরাগ আলির কথা কও। ভালো, মানুষটা ভালো মানুষ আছিলো, কও। কিন্তু তার শোলোকের মধ্যে তোমরা মাঝির কথা সান্দায়া দিবার পারো? খিয়ারের চাষার কথা ফকির পাবি কুটি? তার গান তো লিজৈর বান্দা লয়, না-কি?

কেরামত হনহন করে হেঁটে চলে যায় ওদের পিছে রেখে। চেরাগ আলির পাওনা-গানের কথা শুনতে শুনতে সে অতিষ্ঠ। আরে, জোতদারের পক্ষে পুলিসের হামলা হলে চাষারা কি আর চেরাগ আলির ঐসব আসমানি শোলোকে কান দিয়েছে কখনন? পুলিসের গুলি খেয়েও বর্মণী মা তো পাগল হয়ে উঠিছিলো কেরামতের গান শুনতেই। চাষাভুষা থেকে শুরু করে নাসির মণ্ডল বলো আর চিত্তবাবু বলো আর পূর্ণ বোস আর সুনীলদা—সবাই শুনতে কেরামতের গান। এমন কি এতো বড়ো মানুষ হাজি দানেশ তিনি পর্যন্ত চিত্তবাবুকে নাকি বলেছেন, ঐ কেরামত ছোঁড়াটাকে হাতছাড়া করো না, ওকে আমাদের চাই। পুলিসের ধরপাকড় শুরু হলে চিত্তবাবু খবর পাঠালো, কেরামত যেন এখন সরে সরে থাকে। পুবের দিকে গিয়ে এসব গান করুক; সেখানে কাজে লাগবে। তা এই এলাকার মানুষ তো সব মজনু না মুনসি না কি কোনো জিনই হবে আর ভবানী সন্ন্যাসী–কি তার ভূত—তাদের গান নিয়েই মত্ত। চেরাগ আলি ফকির কী সব গায়েবি শোলোক পেয়েছে কোথেকে,—সেসব ছাড়া আর কিছু এদের মাথায় ঢোকে না।-কেরামত আলি এদের কী গান শোনাবে?

হাটবার নয়, খড়ের ছোটো ছোটো চালে ঢাকা মাটির একটু-উঁচু জায়গাগুলো শূন্য পড়ে আছে। তবে মুকুন্দ সাহা আর কালাম মাঝির দোকান খোলা। আর কাদেরের দোকান তো এখন আর দোকান নয়, পুরোপুরি ভোটের অফিস। টিনের বেড়ায় পোস্টার আড়াআড়িভাবে, বড়ো কড়ড়া করে লেখা ইসমাইল হোসেনের নাম। দোকানের দরজা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বেশ কয়েকজন ছাত্র কর্মী, তারা চোঙা, পোস্টার, বিড়ি গুছিয়ে নিচ্ছে, কাদের কথা বলছে তাদের সঙ্গে। কেরামতকে দেখে সে তাড়াতাড়ি তার কাছে এগিয়ে। আসে। তাকে একটু তফাতে নিয়ে বলে, তোমাক না কয়টা দিন বাড়ি থাকা বারাবার মানা করিছি। তার চাপা উত্তেজনায় উদ্বেগ বা সুখ সনাক্ত করা কঠিন, বিল ডাকাতির মামলায় তো নায়েব তোমার নামও ঢুকায়া দিছে। বাপজান যে কী করে না করে কিছু বুঝি না। ইসমাইল ভাইকে দিয়া পুলিসকে করা তোমার নাম কাটাবার ব্যবস্থা করা। হচ্ছে। তা তুমি এখন কয়টা দিন শ্বশুরবাড়িতই থাকো না! কেরামত চুপ করে থাকলে কাদের ফের বলে, তোমার মনে হয় জেলের ভাত খাবার সখ আছে, না?

জেলে যাবার সখ কেরামতের এখন হয় বৈ কী? জয়পুর থেকে তখন সরে না পড়লে সে হয়তো ধরা পড়তো। পুলিস ধরে নিয়ে গিয়ে ভদ্দরলোক নেতাদের পর্যন্ত যে মারটা দিয়েছে, মেয়েদের পর্যন্ত রেয়াত দেয় নি। সেই মারের খবরেই তো কেরামত নুয়ে। পড়লো। বুকে আর বল পায় না। বুকে বল না থাকলে তার মাথাও ঘোরে বনবন করে। মাথা ঘুরলে তার হাতে শোলোক আর আসে না। এ কি চেরাগ আলির গান যে টুংটাং করলো আর দোতারার তার বেয়ে কথা চলে এলো আসমান থেকে? না, না। জেলে গেলে তার পদ্য লেখা বন্ধ হয়ে যাবে চিরকালের জন্যে।

আসিছো যখন একটু বসেই যাও। কী ভেবে কাদের তাকে নিয়ে ঘরে ঢোকে, এরা সব লীগের ওয়ার্কার। কেরামতকে আস্তে করে জিগ্যেস করে, পাকিস্তানের গান লেখা হছে?

একটি ছেলে বলে, মাঝিপাড়ায় তো আমরা ঢুকতেই পাচ্ছি না। তাদের নামে আপনারা বিল ডাকাতির কেস দিয়ে রেখেছেন,–

এই তো মুশকিল। আবদুল কাদের বক্তার ভঙ্গিতে কথা বলার সময় ভাষাটা ঠিক করে নেয়, বিল তো আমাদের পত্তন নেওয়া। সেখানে আমার বাবার অনুমতি ছাড়া কেউ মাছ ধরতে গেলে বাবা তো বাধা দেবেনই। কিন্তু মাঝিদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বহুদিনের, তাদের মেলা লোক আমাদের জমিতে বর্গা খাটে। তাদের বিরুদ্ধে আমরা মামলা করার কথা ভাবতেই পারি না। মামলা করালো নায়েব, বাবাকে ধরে, ভয় দেখিয়ে মামলা ঠুকে দিয়েছে। আরে, বাবা, এ তো ওদের পুরনো ফন্দি, মুসলমানে মুসলমানে ভেদ সৃষ্টি করেই তো ওরা দাপটটা টিকিয়ে রাখে। সে এবার হাজির করে কেরামতের দৃষ্টান্ত, এই যে কেরামত, কবি কেরামত আলি, মাঝি না হলেও মাঝিপাড়ার মানুষ একে খুব মানে। সেদিন বিল ডাকাতির সময়- বলতে বলতে কাদের থামে, একটু টোক গিলে বলে, এ তো আছে আমাদেরই শেলটারে। গুণী মানুষ, গান লেখে, গরিবের ঘরের মুসলমান ছেলে, ইসমাইল ভাই বলেন, একে যে করে হোক বাঁচাতেই হবে। তারপর সে তাকে তুলে দেয় তাদের হাতে, তোমরা না হয় একে নিয়ে যাও কালাম মিয়ার কাছে। আরে যাও না একবার!

কেরামত অবশ্য থাকে সবার পেছনে। কালাম মাঝি লীগের কর্মীদের সঙ্গে ভালো করে কথাও বলে না। তার দোকানে কৃষক প্রজা পার্টির ভোটের অফিস। টিনের বেড়ায় ঐ দলের পোস্টার। লোকজন তেমন না থাকলেও যারা আছে বেশিরভাগই পাকা চুলওয়ালা, প্রায় সবারই দাড়িও পাকা, মাথায় টুপি। দুজন কি তিনজন যুবকের হাতে চোঙা। আর আর ছেলেছোকরা যে কয়েকজন আছে সবই গিরিরডাঙার মাঝিপাড়ার।।

টাউন থেকে আসা লীগের এক তরুণ কর্মী বলে, আসসালামোআলায়কুম। মুসলিম লীগের খাদেম হিসাবে আমরা আপনাদের কাছে এসেছি। ইনডিয়ার মুসলমানদের দল বলেন, জামাত বলেন এখন একটাই, অল ইনডিয়া মুসলিম লীগ। এই যে ভোট আসছে, এই ভোট হলো মুসলমানদের–

মুসলমান তো হামরাও বাপু। কালাম মাঝি তাকে থামিয়ে বলে, তা হামরা হলাম মাঝি আর আপনেরা সব ভদ্দনোক। হামাগোরে ছোলপোলেক ধর্যা আপনেরা পুলিসের হাতে দেন, হামাগোরে ডাকাত ধানান।

তরুণ কর্মী মামলার ব্যাপারটি এড়িয়ে যায়, গোটা ইনডিয়ার মুসলমান আজ কায়েদে আজমের লিডারশিপে এক হয়ে গেছে। এখন আপনারা যদি মাঝি আর চাষী, ভদ্দরলোক আর গরিবের ফারাক করেন তো ফায়দা লুটবে কারা? ওদিকে তেভাগা। মুভমেন্টের চাষীরা পর্যন্ত সংঘর্ষের রাস্তা ছেড়ে আজ লীগের পতাকার নিচে জমায়েত। হয়েছে, আর–

কেরামত একটু ধন্দে পড়ে। ওদিককার খবর সে অনেকদিন পায় না। কিন্তু চাষীরা কি ইচ্ছা করলেই সংঘর্ষ এড়াতে পারে? তাদের ওপর যে জুলুমটা চলছিলো, তাতে তাদের সরে পড়ার কোনো পথই আর খোলা নাই। তা হলে?—কিন্তু ছেলেটি বেশ জোর দিয়েই বলে, নবাব নাইটদের মুসলিম লীগ আর নেই। চাষী আর জেলে আর মজুরের হক আদায় হবে পাকিস্তানে। কেরামত ভাবে, তা হলে আর খুনাখুনি করার দরকার কী?

ছেলেটি এরপর বলে চাকরির কথা। পাকিস্তানে মুসলমানের চাকরির কোনো অসুবিধাই হবে না। কেবল মুসলমান হওয়ার অপরাধে সরকারি চাকরি থেকে তাদের বঞ্চিত হতে হবে না। তারপর হিন্দু শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা মুসলমানদের ধর্ম নিয়ে, তাদের তাহজির তমদুন নিয়ে ব্যঙ্গ করে, বিদ্রুপ করে, তাদের বইপুস্তকে মুসলমানদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। তাদের সঙ্গে আমরা থাকতে পারি না। পাকিস্তানে শাসন চলবে কোরান আর সুন্না অনুসারে, শাসকদের জীবনযাপন হবে ইসলামের খলিফাদের মতো। তারা টুপি সেলাই করে আর কোরান নকল করে যা রোজগার করবে, তাতেই তাদের খাওয়াদাওয়া চালাতে হবে।

শুনতে শুনতে কেরামত অভিভূত, অভিভূত এমন কি মাঝিপাড়ার ছেলেরাও। কিন্তু শিমুলতলার তালুকদারদের খাদেম মিয়া বারবার কপাল কোঁচকায়, লোকটা ছেলেটাকে থামাতে চেষ্টা করে, চ্যাংড়াপ্যাংড়া কারো কোনো কথা শোনে না। খালি নিজেরাই প্যাচাল পাড়ে।

লীগের অনুপ্রাণিত কর্মী চোখ ছোটো করে হাসে, আপনি মুরুব্বি মানুষ, আপনার লেবাস ইসলামী। কিন্তু আপনি করেন হিন্দুর পায়রাবি। আপনার কথা আর কী শুনবো? হক সাহেব মুসলমানদের সঙ্গে, ইসলামের সঙ্গে মীরজাফরি করে—

বুড়ো তালুকদার তার রামপুরি টুপি খুলে ফের মাথায় চড়িয়ে বলে, তোমরা ইসলামের সোল এজেনসি নিয়েছো? ইসলামের তোমরা বোঝো কী? তোমাদের জিন্না নামাজের নিয়ত বাঁধতে জানে? জিন্না কও আর লিয়াকত আলি কও আর সোহরোওয়ার্দি কও, এরা পশ্চিমদিকে, আল্লার ঘরের দিকে কখনো আছাড় খেয়েও পড়েছে কোনোদিন? আর এরাই আজ ইসলামের জিম্মাদার।

তালুকদারের প্রৌঢ় সঙ্গী সায় দেয়, আরে, চাচা, এরা থাকে বোতল আর গেলাস লিয়া, নামাজ বন্দেগির টাইম কোথায় এদের?

লীগের কর্মীদের চোখমুখ লাল হতে থাকে, কেবল ঐ ছেলেটি একই স্বরে বলে, শোনেন, মোল্লাদের ইসলাম আর কায়েদে আজমের ইসলাম এক নয়। মোল্লারা। ইসলামের নামে মুসলমানদের ব্যাকওয়ার্ড করে রাখতে চায়, তাদের গোঁড়ামির জন্যেই মুসলমানদের আজ এই অবস্থা–।

তা হলে বাপু খালি হিন্দুদের দোষ দাও কেন?

অনেক মওলানাও তো হিন্দুদের পায়রাবিই করে যাচ্ছে। মওলানা আজাদ, শো বয় অফ কংগ্রেস, এইসব মোল্লা মওলানাদের হাত থেকে ইসলামকে, মুসলমানকে বাঁচাতেই আমরা পাকিস্তান চাই।

তার বক্তব্য শেষ করার আগেই পাকিস্তান জিন্দাবাদ কায়েদে আজম জিন্দাবাদ ইসমাইল হোসেনকে ভোট দিন স্লোগানের সঙ্গে বেজে ওঠে মোটরগাড়ির আওয়াজ, ছেলেরা দৌড় দেয় ঐ গাড়ির দিকে। ক্যানভাসের ছাদওয়ালা গাড়ি করেই ভোটের ক্যানভাস চলছে। ঐ জিপগাড়ি থেকে নেমে ইসমাইল হোসেন হাসি হাসি মুখে সবাইকে হাত তুলে সালাম করতে করতে এগিয়ে যায় কাদেরের দোকানের দিকে। দোকানের বাইরে থেকেই সে ডাকে, কাদের, চলো তো একবার মাঝিপাড়ায় চলো।

আবদুল কাদের তাকে দেখে অবাক। ইসমাইলের তো আরো তিনটে দিন থাকার কথা পুবে, যমুনার চরে চরে। এখানে আসার প্রোগ্রাম ভোটের একদিন আগে, সোহরোওয়ার্দি সাহেবও সেদিন আসবে মিটিং করতে। তা হলে যমুনার ওদিকে কি ক্যানভাস তার শেষ হয়ে গেলো?

কাদেরের দোকানে ঢুকে ইসমাইল বলে, তোমরা কি সবসময় এই হাটের মধ্যেই পড়ে থাকো? তোমার গ্রাম গিরিরডাঙার খবর রাখো? শুনি তো, মাঝিপাড়ার পজিশনটা কী? কালাম মাঝিকে ডাকো, তার মুখেই শুনবো।

কাদের আমতা আমতা করে, কালাম মাঝির দোকানে তো দেখতেই পাচ্ছেন মালেক তালুকদারের ভোটের ক্যাম্প। তাকে ডাকলে কি আর আসবে?

আঃ। যা বুলি শোনো। ডাকো, আমার কথা শুনলেই আসবে।

কিন্তু গফুর কলু ফিরে এসে বলে, এক মিনিট আগে সে চলে গেছে। কাদের বোঝে, লোকটা কেটে পড়েছে ইসমাইল হোসেনকে এড়াতেই। ইসমাইল তখন কাদেরের কানের কাছে মুখ নেয়, কাদের, তোমরা এটা করেছো কী? মাঝিদের নামে মামলা করার আর সময় পেলে না? কাদের কিছু বলবে বলবে করলেও ইসমাইল হোসেন তাকে সুযোগ দেয় না, আরে ঐ যে কী নাম?–হা হা, তমিজ। তমিজ কি তমিজের বাপের ভোট না থাকলেও ছয় আনা ট্যাকস দেওয়ার লোক মাঝিপাড়ায় কম নেই। এটা বড়ো কথা নয়। মাঝিপাড়ার ভোট মালেক সাহেবের বাকসে পড়লে তার এফেক্ট পড়বে এই এন্টায়ার এরিয়ার। ওদিকে যমুনার মাঝির তো মহা খাপ্পা, তাদের নাকি ডাকাত বলে থানায় চালান দিয়েছি আমরা মুসলিম লীগের লোকেরা। চর এলাকায় কৃষক প্রজার ওয়ার্কার তো ছিলোই না। এখন তমিজকে ধরে পুলিসে দেওয়ার কথা শুনে মালেক সাহেবের লোকজন ধুমসে প্রোপাগান্ডা করে বেড়াচ্ছে। ঐ নিরীহ লোকগুলোকে তোমরা ডাকাত বানিয়ে ছাড়লে?

মামলাটা ঠিক এভাবে দেওয়ার ইচ্ছা ছিলো না। বাপজানকে নায়েব কী করে কী বোঝালো–।

আরে বাবা, আমি তো সব শুনলাম। চলো, গিরিরডাঙা চলো। মাঝিদের সঙ্গে বসি গিয়ে।

কিন্তু মাঝিপাড়ায় তো মালেক সাহেবের ওয়ার্কাররা এখন ক্যানভাস চালাচ্ছে। এখন গেলে কী –।

কাদেরের কথা শেষ হতে না হতে তাকে সমর্থন করে গফুর কলু, মাঝিগোরে কথা বাদ দেন। বড়ো লটখট্যা জাত। আর সোগলি একদিকে গেলে অরা হেলবি উল্টামুখে। জামাতও তো ভিন্ন।

আলাদা জামাত মানে? ইসমাইল হোসেন গম্ভীর হয়ে জানতে চাইলে জবাব দেয় কাদের, এই কয়েক গাঁয়ের মধ্যে মোহাম্মদি হলো চোদ্দ আনা। আর মাঝিরা সব হানাফি জামাতের মধ্যে। ইউনিয়নের মধ্যে এক গিরিরডাঙার মাঝিপাড়াতেই হানাফি মসজিদ।

ব্যাখ্যা শুনে ইসমাইল হোসেনের রাগ চড়ে যায় কয়েক গুণ, ইস। এই করেই তো মুসলমান গেলো। এখনো তোমরা হানাফি আর মোহাম্মদি নিয়ে বাহাস করো। এসব ভুলে যাও কাদের, ভুলে যাও। ভোটের সময়টা অন্তত এসব কথা মুখেও এনো না। আজ আমি ঐ হানাফি মাঝিদের মসজিদে নামাজ পড়বো। মুসলমানের আবার এসব কী? কায়েদে আজম তো সুন্নি মুসলমানও নন, শিয়াদের মধ্যে তারা আলাদা খোঁজা কমিউনিটির লোক। জেলা স্কুলের হেড মাস্টার বরাক আলি সাহেব আমাদের কী সার্ভিসটাই না দিচ্ছেন। তিনি তো কাদিয়ানি, তাকে কি আমরা বাদ দেবো?

শুনে কাদেরের ভয় আরো বাড়ে। কায়েদে আজম সম্বন্ধে এসব কথা গাঁয়ের মানুষ জানলে তো মুশকিল। ইসমাইল হোসেনের কাণ্ডজ্ঞান মাঝে মাঝে লোপ পায়, কোথায় যে কী বলে বসে ঠিক নাই। নিজে তো নামাজ পড়েই না, মৌলবি মুনসি নিয়ে সুযোগ পেলেই ঠাট্টা ইয়ার্কি করে। বাড়িতে তার সবার মেলামেশা হিন্দু ভদ্রলোকদের সঙ্গে। পাকিস্তান হলে কাদেরও হয়তো বামুনকায়েতের সঙ্গে সমানে সমানে মেশার সুযোগ পাবে। তা হিন্দুদের সঙ্গে ওঠাবসা করা আর খাতির রাখা এক কথা আর মাঝিদের জামাতে নামাজ পড়া সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। ইসমাইল হোসেন নামাজই পড়ে না, আর আজ মাঝিদের মসজিদে নামাজ পড়তে পাগলা হয়ে উঠেছে।

গাড়ি থাকে গোলাবড়ি হাটে। পায়ে হেঁটে হেঁটে ইসমাইল গোটা গিরিরডাঙা ঘোরে আর কাদেরের ওপর তার রাগ বাড়ে। তমিজের গ্রেফতারে মাঝিরা ক্ষুব্ধ, এদের ভোট নিশ্চিত পড়বে মালেক সাহেবের বাকসে। কালাম মাঝির বাড়ির সামনে এসে ইসমাইল হাঁক দেয়, কালাম মিয়া, আপনার বাড়ির বাইরে থেকেই কি আমরা ফিরে যাবো?

কালাম মাঝি বাড়ি থেকে বেরোবার তালে ছিলো, কিন্তু ইসমাইল একবারে বাড়িতে এসে পড়ায় তার আর উপায় থাকে না। বাড়ির একমাত্র হাতলওয়ালা চেয়ারটা খুব ভারি, সেটা দুই হাতে তুলে সে এনে রাখে ইসমাইলের সামনে। তার ইশারায় বুধা একটা পাখা নিয়ে ইসমাইলকে শোঁ শোঁ করে হাওয়া করতে থাকে। ইসমাইল আবদার করে, কালাম মিয়ার বাড়িতে আজ আমাদের দাওয়াৎ। আপনে তো করলেন না, আমরা নিজেরাই জেয়াফত নিলাম।

এতে কাজ হয়। জোহরের আজান দেওয়া একটু স্থগিত রেখে কুদুস মৌলবিকে জবাই করতে হয় বড়ো দুটো খাসি মোরগ। বাড়ির ভেতর থেকে রান্নাবান্নার আয়োজনের আওয়াজ ও খসরু আসে।

আবদুল কাদের এতোক্ষণ সবই মেনে নিয়েছে। মাঝিদের বাড়ি বাড়ি গেলো, তাকে দেখে সবাই ভয়ই পায়, তাতে তার রাগ চড়ে যায় বাবার ওপর। আবার আবিতনের বাপের মতো কেউ কেউ বাঁকাচোরা কথাও শোনায়, তখন সে বাপের পক্ষে নানা অজুহাত তোলে, দোষ চাপায় নায়েবের ওপর। এখানে ভোটের অবস্থা তাদের ভালো নয়। ছোটোলোকগুলি সুযোগ একটা পেয়েছে, এখন তাদের তোয়াজ না করে উপায় কী? তা ভোটের জন্যে সবই না হয় করা গেলো, কিন্তু গিরিরডাঙা গ্রামে এসে তার বাড়ি বাদ দিয়ে ইসমাইল ভাত খাবে মাঝিদের বাড়িতে,-এটা কি হতে পারে? গোলাবাড়ি থেকে রওয়ানা দেওয়ার আগেই কাদের বাড়িতে খবর দিয়েছে, সেখানে খাসি জবাই করা, বড়ো মাছ জোগাড় করা সব কমপ্লিট। এখন তো তার ইজ্জতের বারোটা বাজলো। এর ওপর তাকেও যদি আজ মাঝিবাড়িতে ভাত খেতে হয় তো নিজের বাড়িতে ঢোকার মুখ থাকবে? অসহায় চেহারা করে সে ইসমাইল হোসেনের দিকে তাকায়, ভাই, বাড়িতে যে সংবাদ পাঠালাম। খাওয়া দাওয়া সব রেডি।

রাত্রে খাববা তোমার বাড়িতে। এখানে খেয়ে কালাম মিয়ার সঙ্গে গ্রামটা ঘুরবো। তারপর তোমার বাবাকে নিয়ে যাবো বিলের ওপারে। তোমার বাড়িতে ফিরে রাত্রে খাবো, ওয়ার্কারদের সঙ্গে বুধবারের প্রোগ্রামটা ফাইনাল করবে, সোহরোওয়ার্দি সাহেবের মিটিং করতে হবে এই এরিয়ায় অন্তত তিনটে।

হাল ছেড়ে কাদের মাঝিদের কোলাহল দেখে। তাকে কেউ তেমন আমল দিচ্ছে না, তাকে ডিঙিয়ে কথা বলে ইসমাইল হোসেনের সঙ্গে। গফুরটা তো আসেই নি, মাঝিপাড়ায় আসাটা তার জন্যে বিপজ্জনকও বটে। কেরামত আলি পর্যন্ত গুজরগাজুর করে, একবার ইসমাইলের সঙ্গে, কখনো তমিজের বাপের পাশে দাঁড়িয়ে। শালা কাকে যে কী শোলোক ফুঁ দিয়ে দিচ্ছে আল্লা মালুম।

এর মধ্যে এই ভর দুপুরবেলা গামলাভরা পায়েস, এলোকেশি পিঠা আর ধামাভরা তেল পিঠা চলে এলে কাদের আর না বলে পারলো না, ভাই, আমি একটু বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। আপনারা নাশতা খেয়ে পরে ভাত খাওয়া সারেন, আমি চারটে খেয়ে আসি।

ইসমাইল বলে, তুমি নাশতা খেয়ে যাও। কেবল নাশতা এলো, খেতে দিতে এদের এখনো ঢের দেরি। তুমি ফিরে এসে আমাদের সঙ্গে খাবে।

না ভাইজান, এই অবেলায় নাশতা আর খাবো না, খিদা নষ্ট হবে। বাড়ি থেকে আমি বরং ভাত খেয়েই আসি।

স্বাস্থ্যরক্ষার শহুরে নিয়ম পালনে কাদেরের উৎকণ্ঠা দেখে বুধা মাঝি চোখ টেপে আফসারের দিকে। আফসার বলে, কাদের ভাই কি আর হামাগোরে বাড়িত খাবি?

বিপদে ফেলে কালাম মাঝি। ইসমাইলকে আপ্যায়ন করার সুযোগ পেয়ে বিগলিত হয়ে সে চেপে ধরে কাদেরের হাত, খায়া যান গো। হামরা আপনাগোরে বাড়িত কতো খাছি। হামার ঘরত খালেই কি আপনের জাত যাবি?

আর জাতঃ আবদুল কাদের দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, জাত কি আর আছে গো? বেচারা সইতেও পারে না, কইতেও পারে না। মাঝিরা তো তাদের খেয়েই মানুষ। তাই বলে কি তাকেও মাঝিদের বাড়িতে খেতে হবে? তা পিঠা না হয় একটু চেখে দেখা যায়। তাই বলে ভাত খাবে? ইসমাইলের পাল্লায় পড়ে আজ কি তাকে সমাজ, জাত সব নষ্ট করতে হবে? আবার ইসমাইলের দিকে আড়চোখে তাকিয়েই তাদের ব্যাপারে তার মন্তব্যটি একটু সংশোধন করে, আরে মোসলমানের আবার জাত কী? ইসলাম হলো সাম্যের ধর্ম।

ঠিক তার প্রতি করুণায় নয়, অন্য কোনো বিবেচনায় ইসমাইল তাকে রেহাই দেয়, ঠিক আছে, তুমি বরং বাড়ি গিয়ে খেয়ে এসো, তোমার বাবাকে আমার সালাম দিয়ে বলো, বিকালে, না সন্ধ্যার পর আমাদের সঙ্গে বিলের ওপারে একটু কষ্ট করে যেতে হবে।

আবদুল কাদের যেতেই মাঝিপাড়ার মানুষে ভরে গেলো কালাম মাঝির বাইরের উঠান। ইসমাইল হোসেন বসেছিলো ঘরের ভেতরে, বাইরের বারান্দায় বসে কর্মীরা এলোকেশি পিঠা খায়, তেলপিঠা, মুড়ি দিয়ে পায়েস খায়; মাঝিরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। নাশতা সেরে বারান্দায় সেই হাতলওয়ালা চেয়ারে বসে ইসমাইল হোসেন মাঝিদের সঙ্গে এটা সেটা গল্প করে। মুসলমানদের মধ্যে সে সকল ভেদাভেদ দূর করার আহ্বান জানায়। নায়েববাবুর চক্রান্তেই তমিজের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। সে নিশ্চিত, কাৎলাহার বিল মাঝিদের হাতছাড়া হয়েছে হিন্দু জমিদারের লোভে এবং চক্রান্তে। ইসমাইল ভোটে জিতলে এই বিলের ইজারা পাবে মাঝিরা, এটা হবে তার এক নম্বর কাজ। পাকিস্তানে তো আর জঘন্য ও বর্বর বর্ণপ্রথা থাকবে না, যার যা হক তাকে। তাই দেওয়া হবে।

মাঝিরা হাঁ করে তার কথা শোনে। এদের মধ্যে তমিজেরও বাপও একজন। বুধা। মাঝি তাকে ঠেলে দেয় ইসমাইলের সামনে, বলে, তমিজের বাপ।

ইসমাইল চেয়ার থেকে উঠে হাত রাখে তার পিঠে, চেনাতে হবে না। তমিজ বিল ডাকাতির মোকদ্দমায় ফেঁসে গেলো। কঠিন মামলা। আমরা উকিল দেবো, আমাদের সাদেক সাহেব এখন ফৌজদারির সবচেয়ে ভালো উকিল। তমিজকে বের করে আনবো ইনশাল্লাহ। তারপর সবাইকে লক্ষ করে জানায়, বিল আপনারা ফেরত পাবেন। আইনের কিছু ফাঁকড়া আছে, জমিদারের হাতে এখন সম্পত্তি। আমরা জমিদারিই উচ্ছেদ করবো। তখন এই বিল আপনারা ছাড়া আর ভোগ করবে কে?

ইসমাইল হোসেনের কথায় মাঝিপাড়ায় এমনি সাড়া জাগে যে, তমিজের মুক্তির সম্ভাবনার খুশিও চাপা পড়ে তার নিচে। বিকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঁশের বেড়ায়। বেড়ায়, গাছে গাছে সাঁটা হয়ে যায় মুসলিম লীগের পোস্টার। ভাত খেয়েই কয়েকজন তরুণ মাঝি ছোটে গোলাবাড়ির দিকে। অফিস থেকে মুসলিম লীগের পোস্টার নিয়ে লাগাতে হবে কালাম মাঝির দোকানে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *