৩. দ্য ক্লাব

দ্য ক্লাব

সবসময়ের মতোই স্টিভেন্স আমাদেরকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য এগিয়ে দিয়ে গেল। বরাবরের মতোই সে সবার কোট পরিয়ে দিচ্ছিল, ক্রিসমাস যেন ভাল কাটে-সেই আশা প্রকাশ করছিল এবং প্রত্যেককে তাদের বদান্যতার জন্য মন থেকে ধন্যবাদ দিচ্ছিল। সবার শেষে বেরনোর জন্য আমি রয়ে গিয়েছিলাম।

‘কিছু মনে না করলে, আমি একটা জিনিস জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিলাম।‘

আমার প্রশ্ন শুনে সে আমার দিকে ফিরে তাকাল। মনে হলো যেন একটুও অবাক হয়নি। মৃদু হেসে বলল, ‘করে ফেলতে পারেন। কিছু জানতে চাওয়ার জন্য ক্রিসমাস বেশ ভাল সময়।‘

হলওয়ের ভেতরে-ওখানটায় আমি কখনো যাইনি-বাঁ-দিকের কোথাও একটা গ্র্যান্ডফাদার ঘড়ি উচ্চস্বরে ডেকে উঠল। সময় জানান দিচ্ছে-যেন বলতে চাইছে, নদীর স্রোতের মতো সময় বয়ে যাচ্ছে অবিরাম। পুরনো চামড়া আর তেল দেওয়া কাঠের গন্ধ পাচ্ছিলাম। সেই সঙ্গে অনেক মৃদুভাবে স্টিভেন্সের আফটার শেভের গন্ধও পাচ্ছিলাম।

‘কিন্তু আপনাকে আগেই সাবধান করে দেই,’ স্টিভেন্সের কথার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাইরে বাতাসের প্রবাহ যেন হঠাৎ করেই বেড়ে গেল, ‘এখানে যদি নিয়মিত আসতে চান, তাহলে মনে হয় খুব বেশি কিছু জিজ্ঞেস না করাই ভালো।‘

‘মানে, প্রশ্ন করার জন্যেও মানুষকে আসতে নিষেধ করে দেওয়া হয়?’ নিষেধ করে দেওয়া হয়-কথাটা ঠিক মানানসই হলো না। আমি আসলে এমনটা বলতেও চাইনি, কিন্তু এরচেয়ে ভালো কিছু খুঁজে পেলাম না।

‘না,’ ওর গলার স্বর অসম্ভব দ্র শোনাল, ‘ওরা নিজে থেকেই দূরে থাকতে শুরু করে।

ওর চোখের দিকে তাকালাম। টের পেলাম, মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল একটা সোত উঠে যাচ্ছে-মনে হচ্ছিল বুঝি শীতল, বিশাল সাঁড়াশির মতো কোনো হাত আমার মেরুদণ্ড চেপে ধরেছে। কিছুদিন আগে শোনা কেমন পিচ্ছিল, থপথপে শব্দটার কথা মনে পড়ে গেল। ভাবলাম (আগেও অনেকবার ভেবেছি), এখানে ঠিক কয়টা রুম আছে?

‘মি. অ্যাডলি, আপনি যদি এখনো কিছু জিজ্ঞেস করতে চান, করে ফেলুন। রাত গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে—’

‘আর, তোমার এখন দৌড়ে গিয়ে দীর্ঘযাত্রার জন্য ট্রেন ধরতে হবে, নাকি?’ উল্টো প্রশ্ন করলাম। জবাবে স্টিভেন্স কেবল আমার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকাল। ‘ঠিক আছে,’ বললাম। ‘এখানকার লাইব্রেরিতে এমনসব বই আছে, যেগুলি আমি বাইরে কোথাও খুঁজে পাইনি-এমনকি নিউ ইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরিতেও নেই। পুরাতন বই সংগ্রহকারী এবং বিক্রেতাদের কোনো ক্যাটালগেও খুঁজে পেলাম না। আর ছাপায় তো নেই-ই। পেছনের ছোট্ট ঘরের বিলিয়ার্ড টেবিলটা নর্ড নামে একটা ব্র্যান্ডের। এ রকম কোনো ব্র্যান্ডের নাম আমি জীবনেও শুনিনি। শেষ পর্যন্ত আমি ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডমার্ক কমিশনকে ফোন দিয়েছি। ওদের জানামতে নর্ড নামে দুটো কোম্পানি আছে-একটা ক্রসকান্ট্রি স্কি বানায়, আরেকটা রান্নাঘরের জন্য কাঠের বিভিন্ন তৈজসপত্র বানায়। আবার, সামনের বড় ঘরে সিফ্রন্ট নামে একটা জুকবক্স আছে। ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডমার্ক কমিশনের ভাষ্যমতে, ওদের তালিকায় সি-বার্গ নামে একটা কোম্পানি আছে, কিন্তু সিফ্রন্ট নামে কোনো কোম্পানি নেই।’

‘আপনার প্রশ্নটা কী, মি. অ্যাডলি?’

যথেষ্ট কোমল শোনাল ওর গলার স্বর, কিন্তু হঠাৎ করেই চোখদুটোয় ভয়ংকর কিছু একটা এসে ভর করল। সত্যি বলতে, শুধু চোখ না, মনে হচ্ছে আমার চারপাশের সবকিছুর মাঝে তীব্র একটা আতংক জেঁকে বসেছে। সেই আতংকের মাঝে আমি ডুবে যাচ্ছি…একঘেয়ে সুরে বাঁ দিকের সেই ঘরটা থেকে গ্র্যান্ডফাদার ঘড়ির ঠক ঠক শব্দ এখনো ভেসে আসছে। কিন্তু এটা এখন আর কেবল ঘড়ির শব্দ মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে যেন ফাঁসিকাঠের দিকে অপরাধীকে হাঁটিয়ে নেওয়ার সময় জল্লাদ পা দিয়ে শব্দ করছে। চামড়া এবং কাঠে মাখা তেলের গন্ধ কেমন তিতকুটে, বিষাক্ত লাগছে। বাইরে বাতাসের উন্মত্ততা যখন আরেকধাপ চড়ে গেল, মুহূর্তখানেকের জন্য মনে হলো বুঝি সামনের দরজাটা এক্ষুনি বিস্ফোরিত হবে। ফলে দরজার ফাঁকা দিয়ে ৩৫ নম্বর রাস্তার বদলে দেখা যাবে ক্লার্ক অ্যাশটন স্মিথের আঁকা ভয়ংকর কোনো জায়গা যেখানে গাছেদের প্যাঁচানো বীভৎস আকৃতি আলোর মাঝে অন্ধকারের এক বিচিত্র জগত তৈরি করেছে। আকাশের গায়ে উন্মত্ত রাগে ফুঁসছে দু-দুটো সূর্য-চারপাশের সবকিছু গাঢ় রক্তের মাঝে ডুবে যেতে যেতে অসহায়ের মতো আত্মসমর্পন করতে চাইছে।

হ্যাঁ, ও জানত, আমি কী জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিলাম : ওর ধূসর চোখের তারায় সেটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল।

এসব জিনিস কোত্থেকে এলো? জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিলাম। তুমি কোত্থেকে এসেছে, সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি, স্টিভেন্স। তোমার কথার ওই টান মোটেও ডাইমেনশন এক্স-এর না। ওটা খাঁটি ব্রুকলিনের টান। কিন্তু তুমি কোথায় যাবে, বলতো? এই যে, তোমার চোখের তারায় সময়হীন অসীমের ছাপ, ভাবলেশহীন মুখ-এসব কেমন করে তোমার মাঝে গেঁথে গেছে? আর স্টিভেন্স–আমরা এই মুহূর্তে ঠিক কোথায় আছি?

কিন্তু সে চুপচাপ আমার প্রশ্নের জন্য অপেক্ষা করছিল।

অথচ মুখ খোলার পর যে প্রশ্নটা বেরিয়ে এলো, সেটা হলো, ‘উপরে। কি আরো অনেক রুম আছে?’

‘হ্যাঁ, স্যার।‘ ও বলল, আমার একেবারে চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। ‘অনেকগুলি। চাইলে কেউ এর মাঝে হারিয়েও যেতে পারে। আসলে, কখনো কখনো আমি মানুষকে আসলেই হারিয়ে যেতে দেখেছি। মনে হচ্ছিল ওরা বুঝি মাইলের পর মাইল রুম আর করিডর ধরে হেঁটেই যাচ্ছে।‘

‘আর, ঢোকা বা বের হওয়ার জায়গা?’

ওর ভ্রু দুটো একটু উঠে গেল, ‘হ্যাঁ, এগুলির সংখ্যাও অনেক।’ এটুকু বলেই সে চুপ হয়ে গেল, অপেক্ষা করছে। কিন্তু আমি ভাবলাম, যথেষ্ট জিজ্ঞাসা করে ফেলেছি। এটুকুতেই মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। আর কিছু জানতে চাইলে যে উত্তর পাব, সেটা হয়তো আমাক আসলেই পাগল বানিয়ে দেবে।

‘ধন্যবাদ স্টিভেন্স।’

‘অবশ্যই, স্যার।‘ ও কোটটা বাড়িয়ে ধরতে, সেটা পরে নিলাম।

‘আরো গল্প হবে নাকি পরে?’

‘এখানে স্যার সবসময়ই গল্প হবে।‘

এসব-ই অনেক দিন আগের কথা। আর তখন থেকে আমার স্মৃতিশক্তি তো আর বাড়েনি (বরং আমার বয়সি যে কারো জন্য উল্টোটাই স্বাভাবিক। কিন্তু স্টিভেন্স সেদিন ওক কাঠের ভারি দরজাটা মেলে ধরার পর যে তীব্র ভয় ছুরির মতো আমাকে বিদ্ধ করেছিল, সে কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। শীতল এক নিশ্চয়তা মনে করিয়ে দিচ্ছিল, আসলেই সেই এলিয়েন বীভৎস জায়গাটা চোখের সামনে দেখতে পাব। দু-দুটো সূর্যের উত্তাপে যেখানে মাটি ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। চারপাশে নগ্ন নারকীয়তা। কিছুক্ষণ পরেই হয়তো দুটো সূর্যই ডুবে যাবে। চারপাশ ছাপিয়ে নেমে আসবে অব্যক্ত বীভৎস আঁধার। সে আঁধার হয়তো এক ঘন্টা স্থায়ী হবে, হয়তো দশ ঘন্টা। কিংবা হাজার বছর ধরে ওভাবেই গিলে খাবে সমস্তকিছু। আমি ঠিক ব্যাখ্যা করে বোঝাতে পারবো না, কিন্তু আমি নিশ্চিত জানি-ওই ভয়ংকর জগতটার বাস্তব অস্তিত্ব আছে। এমলিন ম্যাকক্যারন যেমন নিশ্চিত ছিল যে, স্যান্ড্রা স্ট্যান্সফিল্ডের বিচ্ছিন্ন মাথাটা শ্বাস নিয়েই যাচ্ছে-আমিও এ ব্যাপারে তেমনি নিশ্চিত। সেই অসীম-সম মুহূর্তের মাঝে মনে হচ্ছিল, দরজা খোলার পর স্টিভেন্স আমাকে ধাক্কা দিয়ে ওই ভয়াবহ জগতটায় ফেলে দেবে, এবং পেছনে দরজাটা ধাম করে বন্ধ হয়ে যাবে…চিরদিনের জন্য।

কিন্তু দরজা খোলার পর ওসবের বদলে ৩৫ নম্বর রাস্তাটাই চোখে পড়ল। সামনেই একটা রেডিও ক্যাব দাঁড়িয়ে ছিল। ড্রাইভার অপেক্ষায় অপেক্ষায় ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলছে। নিজের সমস্ত অস্তিত্বের মাঝে প্রবল স্বস্তি টের পেলাম।

‘হ্যাঁ স্যার, এখানে সবসময়ই আরো গল্প হবে, স্টিভেন্স নিজের কথার পুণরাবৃত্তি করল। ‘শুভরাত্রি, স্যার।‘

আরো গল্প হবে।

হ্যাঁ, অবশ্যই হবে। হয়তো শিগগিরই কোনোদিন আমি আপনাদেরকে আবারো গল্প শোনাবো। অন্য কোনো গল্প।

2 Comments
Collapse Comments
কাওসারুল আলম July 27, 2022 at 12:37 pm

IT গল্পের অনুবাদ দিলে খুব খূসি হব

দারাশিকো.কম January 7, 2023 at 2:22 pm

একটু স্লো কিন্তু পড়ে ভালো লাগলো। অবশ্য স্টেভেন্সের রহস্যের কিনারা পাওয়া গেল না।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *