১. দ্য ক্লাব

দ্য ব্রিদিং মেথড – স্টিফেন কিং
অনুবাদ : উচ্ছ্বাস তৌসিফ
প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারি ২০২০

উৎসর্গ : আবুল বাসার
বিজ্ঞানপ্রেমী এই মানুষটির প্রেরণা এবং সাহায্য ছাড়া আস্ত একটা বই অনুবাদের কথা ভাবার সাহস আমার কোনোদিনই হতো না।

অনুবাদকের কথা

বেশিরভাগ মানুষেরই ধারণা, স্টিফেন কিং হলেন হররের রাজা। দ্য শাইনিং লেখার পরই তার নামের পাশে এই তকমাটি বসে যায়। সত্যি বলতে, তিনি নিজেকে নির্দিষ্ট ঘরানায় বেঁধে রাখেননি। লিখেছেন ইচ্ছেমতো। অল্প যে কয়টি থৃলার লিখেছেন, প্রতিটিই অসম্ভব ভালো। তিনি গৃলার ভালো লেখেন নাকি হরর-এ নিয়ে জমজমাট তর্ক হতে পারে।

হরর এবং খৃলার ছাড়া হাতে গোণা অল্প কিছু ভিন্ন ঘরানার গল্পও তিনি লিখেছেন, এবং নিজের জাত চিনিয়েছেন। অথচ এ ধরণের গল্প তার প্রকাশক প্রকাশ করতেই চাচ্ছিলেন না। গল্পগুলোর প্রতিটিই পাঠককে। আতংকিত করবে, দীর্ঘশ্বাস ফেলতে বাধ্য করবে, সবচেয়ে বড় কথা, ভাবাবে। এ রকম চারটি উপন্যাসিকার একটি সংকলন হলো ডিফারেন্ট সিজনস। এখানে আছে তার চারটি ক্লাসিক নভেলা : রিটা হেওয়ার্থ অ্যান্ড শশাংক রিডেম্পশন, অ্যাপ্ট পিউপিল, দ্য বডি এবং ব্রিদিং মেথড। এর মধ্যে প্রথম নভেলাটি থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে। সেই চলচ্চিত্র এরই মাঝে ইতিহাসের সেরা ক্লাসিকগুলোর একটি হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের হাত ধরে নভেলাটি কয়েক বছর আগে বাংলায় অনুদিতও হয়েছে। ভিন্ন ধাঁচের হলেও বইটির প্রতিটি নভেলাই দারুণ।

আবারো বলি, ব্রিদিং মেথড মোটেও হরর বা গৃলার গল্প নয় কিন্তু কিংয়ের সিগনেচার সাইন হিসেবে অতিলৌকিকতার ছোঁয়া এখানেও আছে, আছে দমবন্ধ করা আতংক। কিন্তু বইটি কেবল-ই একটি গল্প। নিশ্চিত করে বলতে পারি, এ রকম গল্প আপনি আর পড়েননি। তবে, ভূমিকায় মূল গল্প নিয়ে কিছু বলে পাঠের আনন্দ নষ্ট করতে চাই না।

অন্য দিকে ডোলান’স ক্যাডিলাক একেবারেই নিখাদ রিভেঞ্জ খৃলার-চমৎকার একটি গল্প, যেখানে কিং-এর লেখনি আর ধরণ বিদ্যমান। এই নভেলাটি নিয়েও দারুণ উপভোগ্য একটি চলচ্চিত্র আছে।

মূল গল্পের আবহ যথাসম্ভব ঠিক রেখে অনুবাদের চেষ্টা করেছি। কতটুকু পেরেছি, আমি জানি না। সে বিচারের ভার পাঠক-পাঠিকাদের হাতে তুলে দিচ্ছি। কিংয়ের গল্পের একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো রেফারেন্স। মূল গল্পে এক-দুই শব্দে আমেরিকান কোনো ঘটনা বা ব্যক্তির উদাহরণ চট করে চলে এসেছে। আমি চেষ্টা করেছি সেগুলো গল্পের মধ্যেই ব্যাখ্যা করে দিতে। তবে কিছু ক্ষেত্রে গল্পের মেজাজ নষ্ট হবে বলে বিরত থেকেছি আমি।

মাঈন উদ্দিন শরীফ বইটার কিছু অংশ পড়ে বিভিন্ন মতামত এবং পরামর্শ দিয়ে আমাকে সাহায্য করেছে। বাসার ভাই, রনি ভাই অনুবাদের কাজে অনেক অণুপ্রেরণা দিয়েছেন। বিশেষ করে নাজিমদার কথা বলতে হয়। উনি যেভাবে কাজ এগিয়ে নিতে সাহস দিয়েছেন, সেজন্যে আমি যারপরনাই কৃতজ্ঞ। আরেকজন মানুষের কথা না বললেই নয়। নাম উল্লেখ না করেই বলি, সে না-হলে এতো বিশাল কাজের শেষপ্রান্তে পৌঁছানো আমার পক্ষে কোনভাবেই সম্ভব হতো না। তারজন্যেও রইল অনেক কৃতজ্ঞতা।

সুখপাঠ্য হোক এই গল্পদুটো।

উচ্ছ্বাস তৌসিফ
ঢাকা, ২০১৯

.

দ্য ক্লাব

সে রাতে আমি অন্য সময়ের চেয়ে দ্রুত কাপড় পরে প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলাম। বাইরে তুষারপাতের সাথে পাল্লা দিয়ে বাতাস বইছে। ভয়াবহ। অবস্থা। তারিখটা ছিল ২৩ ডিসেম্বর, ১৯৭০। সম্ভবত ক্লাবের অন্যান্য সদস্যরাও সে রাতে একই কাজ করেছে। এ রকম ঝড়ের রাতে নিউ ইয়র্কে ট্যাক্সি পাওয়া আর অমাবস্যার চাঁদ হাতে পাওয়া একই কথা। সেজন্য রেডিও-ক্যাব ডেকে রেখেছিলাম আগে থেকেই। আটটায় গাড়িতে ওঠার কথা, অথচ সাড়ে পাঁচটা বাজেই ক্যাবকে বলে রাখছি দেখে আমার স্ত্রী জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে একটা ক্ৰ উঁচু করল। কিছু বলেনি অবশ্য। পৌনে আটটার দিকে বাড়ির সামনের ছাউনি মতোন জায়গাটায় এসে দাঁড়িয়েছিলাম। সেই ১৯৪৬ থেকে পূর্ব ৫৮ নম্বর রোডের এই বাড়িতে থাকি আমি আর অ্যালেন। পাঁচ মিনিট দেরি হয়ে গেছে, এখনো ট্যাক্সির দেখা নেই। টের পেলাম, অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করতে শুরু করে দিয়েছি।

ট্যাক্সি এলো ৮:১০ এ। ডাইভারের উপর রাগ ঝাড়ার বদলে ট্যাক্সিতে ঢুকে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। এই ভয়াবহ ঠান্ডা বাতাসের হাত থেকে তো অন্তত বাঁচা গেল! ধেয়ে আসা ঠান্ডার নমুনা হিসেবে গত পরশু কানাডা থেকে এদিকে সরে আসতে শুরু করেছে বাতাস। ক্যাবের জানালার পাশে ঘুরে ফিরে শিষ দিচ্ছে, গোঙাচ্ছে। এমনকি মাঝে মাঝে ড্রাইভারের রেডিওতে বাজতে থাকা সালসা মিউজিকও ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে কী অপেক্ষা করছে, সেটা বেশ ভালোই বোঝা যাচ্ছে। বেশ কিছু দোকান এখনো ভোলা। তবে দোকান বন্ধ করার আগ মুহূর্তে ফুটপাথে যেরকম ভিড় জমে উঠতে দেখা যায়, তেমন কিছু চোখে পড়ছে না। এক দুজন যাওবা আছে, দেখে মনে হচ্ছে, আসলেই খুব কষ্ট পাচ্ছে বেচারারা।

সারাদিনই টুকটাক শিলা পড়েছে। এখন আবারও শুরু হয়েছে তুষারপাত। প্রথমে পাতলা আবরণের মতো করে পড়তে শুরু করে। কিছুক্ষণ পরেই দেখা যায়, সাইক্লোনের মতো ঝরছে, ঢেকে ফেলেছে পুরো রাস্তা। সেদিন রাতে বাসায় ফেরার পথে আমি যে তুষারপাত, ট্যাক্সি এবং নিউ ইয়র্কের রাস্তার কথা একসাথে ভাবতে গিয়ে ভয়াবহ অস্বস্তি বোধ করব, সে কথা তখনো একদমই জানতাম না।

৩ নম্বর এবং চল্লিশ নম্বর রাস্তা যেখানে মিলেছে, রাংতা দিয়ে বানানো একটা বড় ক্রিসমাস ঘন্টি দেখলাম সেখান দিয়ে প্রেতাত্মার মতো উড়ে যাচ্ছে।

ড্রাইভার বলল, খারাপ অবস্থা। কালকে দেখা যাবে আরো অন্তত দুই ডজন লাশ মর্গে পড়ে আছে। ভবঘুরে মাতালের দল। সাথে কিছু মহিলাও থাকবে নিশ্চিত।

‘তাই মনে হয়।’

কী এক চিন্তায় ডুবে গেল সে। অবশেষে বলল, ‘যাক, ভালোই হবে। কিছু মাতাল অন্তত কমবে। নাকি?’

‘তোমার ক্রিসমাস স্পিরিট তো দেখি ব্যাপক গভীর!’

এ কথা শুনে আবারো চিন্তায় ডুবে গেল সে। কিছুক্ষণ পর জানতে চাইলো, ‘আপনিও বামপন্থী নাকি?’

‘এই প্রশ্নের উত্তর দিতে চাই না। দেখা যাবে, শেষে নিজেই ফেঁসে গেছি।’

বিরক্তিতে ঘোঁত করে উঠল ক্যাব-ড্রাইভার। যেন বলতে চাচ্ছে, শালার, আমার কাছেই এসব লোক এসে পড়ে কেন! তবে, চুপ করে গেল সে। বাকি পথটা নিঃশব্দেই কাটল।

২ নম্বর আর পঁয়ত্রিশের মাথায় আমাকে নামিয়ে দিল সে। আধা-ব্লক হেঁটে ক্লাবে পৌঁছালাম। প্রবল বাতাসের শীষ উপেক্ষা করে, পুরো রাস্তাটা মাথা নিচু করে হেঁটে আসতে হয়েছে। সেই সাথে পুরোটা সময় মোজা পরা একহাতে মাথার হ্যাটটা ধরে রাখতে হয়েছে আমাকে। যাওবা কিছু জীবনীশক্তি বাকি ছিল, দেখা গেল মুহূর্তে মাঝে শরীরের একেবারে গহীণে গিয়ে লুকিয়েছে সব। একটা উদাহরণ মনে পড়ে গেল। বিশাল কোনো গ্যাস-ওভেনে ছোট্ট একটা নিভুনিভু নীল শিখা জ্বলতে থাকলে যেরকম হয়, সেই দশা হয়েছে আমার। তিয়াত্তর বছর বয়সি যে কোনো মানুষই এ রকম পরিস্থিতিতে পড়লে বুঝতে পারবে, শরীরের একদম ভেতরে ঠান্ডা ঢুকে পড়ছে। এ বয়সি যে কারো থাকা উচিত বাসার ভেতরে, ফায়ারপ্লেসের সামনে। না-হয় অন্তত ইলেকট্রিক হিটারের সামনে তো অবশ্যই। তিয়াত্তর বছর বয়সি কারো কাছে ‘উষ্ণ রক্ত’ কথাটা আর স্মৃতি বলে মনে হয় না, বরং বইপত্রের তাত্ত্বিক কিছু একটা বলে মনে হয়।

বাতাসের তোড় একটু কমে এসেছে। তবে বালির মতো শুষ্ক তুষার ঝরেই যাচ্ছে অবিরাম। মুখে এসে পড়ছে। ২৪৯ নম্বরের দরজার দিকে যে সিঁড়িটা উঠে গেছে, সেটায় দেখি বালু পড়ে আছে। নিশ্চিত স্টিভেন্সের কাজ। প্রাচীন যুগে অ্যালকেমি নিয়ে যেসব কাজ হয়েছে, স্টিভেন্স সে ব্যাপারে ভালোই জ্ঞান রাখে। সীসাকে স্বর্ণ বানিয়ে ফেলতে না পারলেও হাড়গোড় থেকে কাঁচ বানানোর ক্ষমতা ওর আছে। এসব কথা ভাবলে মনে হয়, স্রষ্টাও সম্ভবত গ্রোচো মার্ক্সের মতো কেবল ভেবে ভেবেই দিন কাটিয়ে দেন।

দরজার সামনেই স্টিভেন্স দাঁড়িয়ে আছে। এক হাতে দরজা মেলে ধরল সে। মুহূর্তখানেক পরে ভেতরে চলে এলাম। মেহগনির কাজ করা কাঠের প্যানেল লাগানো হলওয়ে। এক-তৃতীয়াংশ দূরত্ব পরপর অবস্থিত দুটো দরজা পেরোলেই একটা বিশাল ঘর। এটা একই সাথে লাইব্রেরি, রিডিং রুম এবং বার। ঘরটা এমনিতে অন্ধকার। জায়গায় জায়গায় ছোট ছোট আলোর ছটা চোখে পড়ছে। রিডিং ল্যাম্পের কারসাজি আরকি। নকশার ছাঁচে বিস্তৃত একটা আলোর ধারা দেখা যাচ্ছে ওক কাঠের নকশা করা মেঝেতে। ফায়ারপ্লেস থেকে বার্চের ডাল পোড়ার কট কট শব্দ শোনা যাচ্ছে স্পষ্ট। ঘরের ওমাথা থেকে চারপাশে তাপ ছড়িয়ে পড়ছে। এ রকম শীতের রাতে যে কারো জন্যেই ‘স্বাগতম’ হিসেবে ফায়ারপ্লেসের আগুনের চেয়ে দারুণ আর কিছু হতেই পারে না। কাগজের মর্মর শব্দ হলো-শুকনো, কেমন অস্থির একটা শব্দ। আমি নিশ্চিত, এটা জোহানসনের কাজ। ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল পড়ছে নিশ্চিত। দশ বছরের অভিজ্ঞতা বলে কথা! সে যেভাবে হাতের জিনিস পড়তে থাকে-তা থেকেই জোহানসনের উপস্থিতি বুঝে ফেলা সম্ভব। হাস্যকর…আবার অন্যদিক থেকে ভাবলে বিস্ময়করও!

স্টিভেন্স আমাকে কোট খুলতে সাহায্য করল। বিড়বিড় করে বলছে, রাতটা ভালো না। ওর কাছ থেকে জানা গেল, ডব্লিউসিবিএস আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলছে, সকালের আগে ভারি তুষারপাত হবে।

ওর সাথে একমত হলাম, রাতটা আসলেই খারাপ। তারপর বড়, উঁচু ছাদের ঘরটার দিকে আবারো ফিরে তাকালাম। একটা খারাপ রাত, গর্জনরত আগুন…আর একটা ভূতের গল্প। কী বলেছিলাম যেন একটু আগে? তিয়াত্তর বছর বয়সি কারো জন্য উষ্ণ রক্ত কেবলই অতীতস্মৃতি? হয়তো। কিন্তু কথাটা ভাবতে ভাবতেই বুকের ভেতর উষ্ণ, চমৎকার এক অনুভূতি হলো। এই অনুভূতির জন্ম অন্য কোথাও। স্টিভেলের উষ্ণ, সাদর অভ্যর্থনার কোনো ভূমিকা সেখানে নেই।

আমার ধারণা, এর পেছনের কারণ, আজকে ম্যাকক্যারনের গল্প বলার পালা।

পূর্ব ৩৫ নম্বর সড়কের ২৪৯ নম্বর ব্রাউনস্টোনের এখানে গত দশ বছর ধরে নিয়মিত আসা-যাওয়া করি। আমার নিজের হিসেবে এটাকে মনে হয় ‘দ্রলোকের ক্লাব’। জায়গায় জায়গায় এখনো পুরনো দিনের ছোঁয়া অনুভব করা যায়। মার্জিত একটা কিছু মনে হয় ক্লাবটাকে। তবে এই ভাবনা আসলেই কতটা সঠিক, সে ব্যাপারে আমি নিজেও ঠিক নিশ্চিত নই। কিংবা এর শুরু যে কিভাবে হয়েছে, এ নিয়েও কোনো ধারণা নেই আমার।

যে রাতে এমলিন ম্যাকক্যারন তার গল্পটা শুনিয়েছিল-দ্য স্টোরি অব দ্য ব্রিদিং মেথড-সে সময় যথাসম্ভব তেরোজনের মতো সদস্য উপস্থিত ছিল। কিন্তু সেই দুঃসহ ভয়াবহ রাতের পর মাত্র ছয়জন ফিরে এসেছিল। তবে এমন কিছু বছরের কথাও মনে আছে, যখন আমাদের আট জন নিয়মিত সদস্য ছিল। কখনো সেটা বিশেও পরিণত হয়েছে, কখনোবা তারও বেশি।

কেমন করে এই ক্লাবের শুরু হয়েছে, সেটা আমার ধারণা, স্টিভেন্সের জানার কথা। একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। সে এখানে শুরু থেকেই আছে। সেটা যত আগেই হোক, সে তখনও ছিল। আর দেখে যতটুকু মনে হয়, ওর বয়স নিশ্চিত তারচেয়ে অনেক বেশি। অনেক অনেক বেশি। ওর কথায় ব্রুকলিনের মৃদু টান আছে। তারপরেও, তৃতীয় প্রজন্মের ইংরেজ বাটলার হিসেবে ওর কথাবার্তা বেশ নিখুঁত। দারুণ আকর্ষণীয় ওর ব্যবহার। বোঝা যায়, জিনিসটা ওর স্বভাবেরই অংশ। তবে, ওর ছোট্ট হাসিটা বুঝিয়ে দেয়, ভেতরের মানুষটা এসব থেকে আলাদা। সেই মানুষটাকে দেখার অধিকার আর কারো নেই। এই ক্লাবে আদৌ হিসাব রাখা হয় কি না, আমি জানি না। রাখলেও আজ পর্যন্ত কোনো ক্লাব রেকর্ড দেখিনি। বাকির কোনো : রশিদও পাইনি কখনো। আসলে এখানে বাকি চলে না। কখনো আমাকে ক্লাবের সভাপতি ডেকে পাঠায়নি। কোনো সভাপতিই নেই আসলে। আর পূর্ব ৩৫ নম্বর সড়কের ২৪৯ নম্বর এই জায়গাটায় কোনো ফোনও নেই। নেই কোনো সাদা মার্বেলের বাক্স, কালো বল। এই ক্লাবের-মানে, আদৌ যদি এটা কোনো ক্লাব হয়ে থাকে-কোনো নাম নেই।

এই ক্লাবে (ক্লাব বলেই ডাকি আপাতত) আমি প্রথম জর্জ ওয়াটারহাউজের অতিথি হিসেবে এসেছিলাম। যে ল’ ফার্মে ১৯৫১ সাল থেকে কাজ করি, সে ওটার প্রধান। ফার্মটি নিউ ইয়র্কের তিনটি সর্ববৃহৎ ফার্মের একটি। ফার্মে আমার নিয়মিত পদোন্নতি হলেও সেটার গতি ছিল শামুকের চেয়েও ধীর। আমি নিজে কাজ পাগল মানুষ, দীর্ঘসময় কাজের পেছনে ব্যয় করতে আমার কোনো আপত্তি ছিল না। তবে জিনিয়াস ছিলাম না। একসাথে কাজে যোগ দিয়েও বিশাল সব পদোন্নতি পেয়ে যেতে দেখেছি কাউকে কাউকে। আমি তখন সবে একধাপ পদোন্নতি পেয়েছি। স্বীকার করি, এ অবস্থা দেখে নিজেও অবাক হইনি।

ওয়াটারহাউজের সাথে সময়ে সময়ে সম্ভাষণ বিনিময় হয়েছে। একসাথে প্রতিবছর অক্টোবরে ফার্মের বাধ্যতামূলক ডিনারেও গেছি। এছাড়া ১৯৬৬ সালের আগে ওর সঙ্গে সামান্যই কথা হয়েছে আমার। কিন্তু সে বছর নভেম্বরের শুরুতে হঠাৎ একদিন সে আমার অফিসে চলে এল।

ব্যাপারটা এমনিতেই যথেষ্ট অস্বাভাবিক। মাথায় উল্টাপাল্টা চিন্তা ভর করছিল সেজন্য (হয়তো চাকরি চলে যাবে)। পাল্লা সমান করে দেয়ার জন্য একই সাথে উঁকি মারছিল লোভ (একটা অপ্রত্যাশিত প্রমোশন কি হয়ে যেতে পারে?)। গোলমেলে লাগছিল সবকিছু। ওয়াটারহাউজ ঢুকে পড়ল অফিসে। ওর ‘ফাই বেটা কাপ্পা চিহ্নখচিত চাবির রিংটা ভেস্টের কাছে ঝুলছে। ঝিলিক দিচ্ছে থেকে থেকে। সাধারণ সব বিষয় নিয়ে কী কী যেন বলছিল সে। এগুলোর আদৌ কোনো গুরুত্ব আছে বলে মনে হচ্ছিল না। মনের মধ্যে আশা উঁকি দিয়ে যাচ্ছে বারবার। এই বুঝি সম্ভাষণ শেষ করে কাজের কথা বলবে। হয়তো বলবে, ‘তো, কেসির যে ব্যাপারটা আছে, সেটা-’ কিংবা আমাদেরকে সলকোভিটজের মেয়র নিয়োগের ব্যাপারে রিসার্চ করতে বলা হয়েছে। দেখা গেল, সেরকম কিছু আসলে নেই। কথাবার্তার এক পর্যায়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে জানালো, আমাদের কথাবার্তা সে দারুণ উপভোগ করেছে। কিন্তু এখন যেতে হবে।

আমি তখনো হতভম্বের মতো চোখ পিটপিট করছি। ঠিক সেই মুহূর্তে সে পেছনে ঘুরে স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘প্রায় বৃহস্পতিবার রাতেই আমি এক জায়গায় যাই। ক্লাবের মতো আরকি। বেশির ভাগই বুড়ো। তবে কেউ কেউ আবার আড্ডা দেওয়ার জন্য দারুণ। আর চেখে দেখতে জানলে, ওদের মদের সংগ্রহও বেশ। তাছাড়া মাঝে মাঝে কেউ কেউ চমৎকার গল্পও শোনায়। কোন একদিন রাতে আসতে পারো তুমি চাইলে, ডেভিড। আমার অতিথি হিসেবে আরকি।’

উত্তরে কিছু একটা বলেছিলাম। আমি এখনো ঠিক নিশ্চিত নই, কী বলেছি। হতভম্বের উপরে কিছু থাকলে আমার তখন সেই অবস্থা। ওর গলায় হঠাৎ করে বলে ফেলার মতো একটা ভাব ছিল। কিন্তু চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল, পুরো ব্যাপারটাই বেশ পরিকল্পিত। ঘন সাদা র নিচে বরফের মতো শীতল, এংলো-স্যাক্সন নীলচে চোখ। কী বলেছিলাম, সেটা মনে না থাকার পেছনের কারণ একটাই। হতভম্বের মতো ঠিক সেই মুহূর্তে আমি আবিষ্কার করেছি, এতোক্ষণ ধরে যে প্রস্তাবের আশায় বসেছিলাম, এটাই সেটা!

সেদিন বিকেলে সব শুনে অ্যালেন যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল, সেটা ঠিক ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এক কথায় ‘খাবি খাওয়ার মতো কিছু একটা বলা যেতে পারে। ওয়াটারহাউজ, গার্ডেন, লটন, ফ্রেইজার এবং এফিংহ্যামদের সাথে আমি প্রায় বিশ বছর ধরে আছি। বর্তমানে যে মাঝারি পদে কাজ করছি, এরচেয়ে খুব বেশি উপরে যে উঠতে পারব না, সেটা আমার একরকম জানাই ছিল। অ্যালেনের ভাষ্যমতে, ফার্মের কাছে আমি হলাম স্বর্ণের ঘড়ির বদলে ব্যবহার করা এমিটেশনের মতো সস্তা কিছু। কাজও চলে, টাকাও বাঁচে।

বুড়ারা পোকার খেলতে খেলতে পুরনো দিনের যুদ্ধের গল্প করবে, অ্যালেন বলছিল। আর, ওদের হিসেবে, একরাত সেই গল্প শুনতে পারলেই হলো, তোমার জীবন ধন্য! খুশি খুশি বাকি জীবন রিসার্চ লাইব্রেরিতে বসে কাজ করবে তুমি। আর অবসরের সময় হলে পেনশন নিয়ে বাসায় চলে আসবে, এই তো। আচ্ছা শোন, বলতে ভুলেই গেছি, তোমার জন্য দুটো বিয়ারে বরফ দিয়ে রেখেছিলাম। উষ্ণ চুমু খেল সে আমাকে। সম্ভবত আমার চেহারায় কিছু একটা দেখেছিল, সেজন্যেই আর কিছু বলেনি। এতো বছর একসঙ্গে থাকার ফলে ও এখন আমার দিকে এক পলক তাকালেই সবকিছু বুঝে যায়।

তারপর অনেক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে, উল্লেখযোগ্য আর কিছুই হয়নি। তারপর একদিন হুট করে আবার ওয়াটারহাউজ তার অদ্ভুত প্রস্তাবটা নিয়ে এলো। বিশেষ করে যার সঙ্গে বছরে এক ডজনবারও দেখা হয় না; সামাজিক কাজকর্মের হিসেবে বলতে গেলে, কোম্পানির অক্টোবরের বাধ্যতামূলক পার্টিসহ তিনটার বেশি অনুষ্ঠানে একসঙ্গে যাওয়াও হয় না। কোথাও, সেরকম কারো থেকে এমন প্রস্তাব আসলে সেটাকে অদ্ভুত না বলে। আর উপায় কী? ততদিনে মনে হচ্ছিল, আমি হয়তো ওর চোখের ভাষার ভুল ব্যাখ্যা করেছি। হয়তো সে আসলেই হুট করে বলে ফেলেছিল। হয়তো এতোদিনে ভুলেও গেছে। কিংবা বলার পরে হয়তো আফসোস করে ভেবেছে, হায় হায় কী করলাম! কিন্তু অনেকদিন পরের এক সন্ধ্যায় সে আবারো আমাকে সেই একই প্রস্তাব দিল। ওর বয়স সত্তরের কাছাকাছি হলেও পেটা শরীর দেখে ব্যায়ামবীর বলেই মনে হয়। আমার ব্রিফকেসটা তখন দুই পায়ের মাঝখানে রাখা। কোটটা গায়ে দিচ্ছিলাম। এমন সময় সে বলল, তোমার যদি ক্লাবে গিয়ে একটা ড্রিংক নিতে কোনো আপত্তি না থাকে, তাহলে…তুমি চাইলে আজকেই যাওয়া যায়। যাবে?’

‘ওয়েল, যাওয়া—’

‘গুড।’ বলেই আমার হাতে একটুকরো কাগজ গুঁজে দিল সে। ‘ঠিকানাটা রাখো।’ সেদিন রাতে সিঁড়ির মাথায় আমার জন্য দাঁড়িয়েছিল ওয়াটারহাউজ। স্টিভেন্স আমাদের জন্য দরজা খুলে ধরেছিল। ওয়াটারহাউজ যেমন বলেছিল, দেখা গেল ওদের ওয়াইন আসলেই বেশ ভালো। তবে সে আমাকে ক্লাবের আর কারো সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়নি। প্রথমে ভেবেছিলাম, উন্নাসিকতা। নিজেকে বড় হিসেবে দেখানোর জন্যে করছে। পরে অবশ্য এই চিন্তা মাথা থেকে দূর হয়েছে। তবে, দুই-তিনজন নিজে থেকেই আমার সাথে এসে পরিচিত হয়েছিল। এদের একজন হলো

এমলিন ম্যাকক্যারন। সে সময়ই ওর বয়স ছিল সত্তরের বেশি। হাত ধরে একটুখানি ঝাঁকিয়ে দিয়েছিল। ওর ত্বক ছিল শুষ্ক, রুক্ষ-যাকে বলে, খাঁটি পুরুষের হাত। জিজ্ঞাসা করল, ব্রিজ খেলি কি না। বললাম, খেলি না।

‘ব্রিজ যে কী দারুণ জিনিস! গত এক শতকের মধ্যেই, খাওয়া দাওয়ার পরে একসঙ্গে বসে জ্ঞানগর্ভ আড্ডার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে এই খেলা।’ ঘোষণা দিয়েই সে লাইব্রেরির দিকে পা বাড়াল। ওর মাঝে যতদূর চোখ যায়, শুধু বই আর বই। দেখে মনে হয়, কেবল বুক শেলফের সারিই বুঝি অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত।

চারপাশে তাকিয়ে ওয়াটারহাউজকে খুঁজছিলাম। কিন্তু সে কোথায় যেন গায়েব হয়ে গেছে। অস্বস্তি জেঁকে বসছে। মনে হচ্ছে, ভুল কোথাও চলে এসেছি। এই জায়গা আর যাই হোক, আমার জন্য না। ফায়ারপ্লেসের সামনে দাঁড়িয়ে এসব কথাই ভাবছিলাম। একটু আগেও অবশ্য এটার কথা বলেছি। বিশাল জিনিস-বিশেষ করে নিউ ইয়র্কবাসীদের জন্য তো অবশ্যই। এখানে যারা থাকে, বিশেষ করে যারা আমার মতো অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দা, তাদের জন্য এ রকম বিশাল ফায়ারপ্লেসের কথা কল্পনা করাও কঠিন। ফায়ারপ্লেসে পপকর্ন ভাজা আর পাউরুটি টোস্ট করা ছাড়া আর কিছু যে করা যায়, তা আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। পূর্ব ৩৫ নম্বর সড়কের ২৪৯ নম্বরের এই ফায়ারপ্লেসে চাইলে আস্ত একটা ষাঁড়কে ঝলসে নেওয়া যাবে। এটার সেরকম কোনো ঢাকনাও নেই। বরং পাথর দিয়ে বানানো পুরু একটা বাঁকানো শেড আছে উপরে। মাঝখানে একটা কি-স্টোন ভেঙে গেছে, মাথা বেরিয়ে আছে কিছুটা। শেডটার উচ্চতা আমার চোখ বরাবর পড়েছে। আলো নিষ্প্রভ হলেও পাথরে খোদাই করা লেখাটা পড়তে একদমই কষ্ট হচ্ছিল না আমার। গল্পটাই আসল। কে বলছে, তাতে কিছু যায় আসে না। এই নাও ডেভিড, ওয়াটারহাউজের গলাটা আমার, কনুইয়ের পাশ থেকে ভেসে এল। চমকে গিয়ে আক্ষরিক অর্থেই লাফিয়ে উঠেছিলাম। যাক বাবা! আমাকে রেখে কেটে পড়েনি তাহলে। ড্রিংক আনার সময় সদস্যদের একজনের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ায় নাকি দেরি হয়ে গেছে একটুখানি। তুমি তো বোম্বে মার্টিনিই খাও, নাকি?

‘হ্যাঁ, মি. ওয়াটারহাউজ। অনেক ধন্যবাদ।’

‘জর্জ। এখানে আমাকে শুধু জর্জ বললেই চলবে।’

‘আচ্ছা, জর্জ। বললাম ঠিকই, কিন্তু নামের প্রথমাংশ ব্যবহার করে ডাকতে কেমন যেন অস্বস্তি লাগছিল আমার কাছে। এগুলি কী—’

কথার মাঝখানেই আমাকে থামিয়ে দিল সে। ‘চিয়ার্স।’

একসঙ্গে পান করলাম আমরা। মার্টিনিটা ছিল, যাকে বলে একদম পার্ফেক্ট। কাজেই, প্রশ্ন শেষ করার বদলে এটাই বললাম ওকে।

উত্তরে সে বলল, ‘বারটা সামলায় স্টিভেন্স। দারুণ ড্রিংক বানায় সে। আর এটাকে সে ছোট হলেও দারুণ গুরুত্বপূর্ণ এক স্কিল বলে দাবি করতে পছন্দ করে।’

আমার যে এলোমেলো আর অস্বস্তি লাগছিল, মার্টিনি খেয়ে সেটা কিছুটা কমল। (কিছুটা কমলেও, সেই অনুভুতি এখনো রয়ে গেছে। কী পরব, তাই নিয়ে ভাবতে গিয়ে প্রায় আধাঘন্টা ধরে ক্লজেটের দিকে তাকিয়ে ছিলাম সেদিন। শেষ পর্যন্ত গাঢ় বাদামি পাজামা, আর একটা টুইড জ্যাকেট বেছে নিয়েছিলাম। কাপড় ম্যাচিং করেই পরেছি। তবে মনে মনে খুব চাইছিলাম, আমাকে যেন টাক্সিডো স্যুট কিংবা নীল জিন্স আর এল, এল, বিনের লাম্বারজ্যাক শার্ট পরা একদল লোকের সামনে গিয়ে পড়তে না হয়। পরে অবশ্য দেখা গেল, কাপড় বেছে নেওয়ায় খুব একটা ভুল হয়নি।) যত ছোটই হোক, নতুন জায়গায়, নতুন কোনো পরিস্থিতে পড়লে মানুষ এমনিতেই সামাজিক প্রথা-পর্ব নিয়ে খুবই সচেতন বোধ করতে থাকে। চাইলেও এটা সে ঝেড়ে ফেলতে পারে না। সেই মুহূর্তে, হাতে ড্রিংক নিয়ে বাধ্যতামূলক টোস্ট সেরে ফেলার পর, আর কোনো দায়িত্ব বাদ পড়ে গেল কি না-সেটা পুরোপুরি নিশ্চিত হতে চাচ্ছিলাম আমি।

জানতে চাইলাম, ‘কোনো গেস্ট বুক বা এ রকম কিছু কি সাইন করা লাগবে?’

কিছুটা অবাক হয়েছে বলে মনে হলো ওকে। যতটুকু জানি, ওরকম কিছু আমাদের এখানে নেই। বলতে বলতে মৃদু আলোকিত, নিস্তব্ধ ঘরটার উপর থেকে ঘুরে এলো ওর দৃষ্টি। জোহানসন খস খস করে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের পাতা উল্টাচ্ছে। ঘরের একেবারে শেষ মাথার একটা দরজা দিয়ে ভূতের মতো নিঃশব্দে ঢুকে যেতে দেখলাম স্টিভেন্সকে। সাদা রঙের মেসজ্যাকেট পরে আছে। জর্জ ওর ড্রিংক একটা টেবিলে নামিয়ে রাখল। তারপর ফায়ারপ্লেসে ঠেলে দিল নতুন কাঠের টুকরো। আগুনের শিখা খাবার পেয়ে লাফিয়ে উঠল। চিমনির কালো মুখে আলতো করে ছুঁয়ে দিল একবার।

‘মানে কী জিনিসটার?’ কি-স্টোনে খোদাই করে লেখাটা দেখিয়ে বললাম, ‘জানো কিছু?

ভালো করে লেখাটা পড়ল ওয়াটারহাউজ। দেখে মনে হলো বুঝি প্রথমবারের মতো পড়ছে। গল্পটাই আসল। কে বলছে, তাতে কিছু যায় আসে না।

‘মনে হয়, জানি। তুমিও হয়তো জেনে যাবে। তবে সেজন্য ফিরে আসতে হবে তোমাকে। হ্যাঁ, এটাই বলা উচিত আমার। সময় হলে, তোমারও এক-আধটু ধারণা চলে আসবে। সমস্যা নেই। যাই হোক, উপভোগ কর, ডেভিড।’

এইটুকু বলে, সে চলে গেল। এ রকম অপরিচিত জায়গায় কাউকে এভাবে হুট করে ছেড়ে দেওয়াটা কিছুটা অস্বাভাবিক। তবে আমি আসলেই উপভোগ করেছিলাম। জনমভর বই ভালোবেসে এসেছি। আর এখানে এসে দেখি, চমৎকার সব বই চারপাশে। চাইলেই হাতে নিয়ে ঘেঁটে দেখা যায়। বুক শেলফের পাশ ঘেঁসে ধীরে ধীরে হাঁটছি, আর মৃদু আলোয় যতটুকু সম্ভব, বইয়ের স্পাইনগুলো পড়ে দেখছি। ইচ্ছে হলে হাতে নিচ্ছি এক-দুটো বই। ২ নম্বর অ্যাভিনিউয়ের সংযোগস্থল বরাবর একটা ছোট্ট জানালা আছে। এখানে। জানালায় দাঁড়িয়ে, হাতে নেওয়া বইগুলো মৃদু আলোয় টুকটাক নেড়ে চেড়ে দেখছিলাম। জানালার কাঁচে তুষারের মৃদু আস্তরন পড়েছে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে, রাস্তাগুলোর সংযোগস্থলে ট্রাফিক বাতির পরিবর্তন দেখছি। লাল-সবুজ-হলুদ-লালচক্রাকারে বদলে যাচ্ছে আলোর রঙ। দেখতে দেখতেই হঠাৎ করে অদ্ভুত, কিন্তু শান্তি শান্তি একটা অনুভূতি এসে ভর করল। বন্যার পানির মতো প্রবল বেগে ঝাঁপিয়ে আসেনি অনুভূতিটা। কিন্তু কিভাবে যেন বুকের ভেতরের সবটুকু দখল করে নিয়েছে। বুঝতে পারছি, আপনি মনে মনে বলছেন, ভালো বলেছ! ব্যাপক তাৎপর্যপূর্ণ কথাবার্তা! ট্রাফিক বাতির থামতে বলা আর চলতে বলা দেখে তো দুনিয়ার সবার মধ্যেই শান্তি শান্তি ভাব এসে ভর করে।

ঠিক আছে, ঠিক আছে। স্বীকার করি, কথাটা অনেকটা অর্থহীন শোনাচ্ছে। কিন্তু আমি তখন এ রকমই অনুভব করছিলাম। অনেক বছর পর প্রথমবারের মতো পুরনো কিছু স্মৃতি মনে পড়ে গেল। উইসকনসিনের যে ফার্মহাউজে আমি বেড়ে উঠেছি, সেসময়ের শীতের রাতগুলোর কথা ফুঁ দিয়ে গেল মনের আকাশে। উপর তলার শীতল, অস্বস্তিকর এক ঘরের বিছানায় শুয়ে বাইরে বইতে থাকা জানুয়ারির প্রবল বাতাসের শীষ, মাইলের পর মাইল জুড়ে বালুর মতো শুষ্ক তুষারপাত আর দুটো কম্বলের নিচে আমার দেহে উৎপন্ন উষ্ণতার মধ্যেকার বৈপরীত্য নিয়ে ভাবা। কী সব দিন যে গেছে!

আইন বিষয়ক কিছু উদ্ভট ধরনের বইও ছিল। যতটুকু মনে পড়ে, একটা বইয়ের নাম ছিল: টুয়েন্টি কেইসেস অব ডিসমেম্বারমেন্ট অ্যান্ড দেয়ার আউটকামস আন্ডার ব্রিটিশ ল’। ব্রিটিশ আইনানুসারে, বিশটি অঙ্গচ্ছেদের কেস এবং তার ফলাফল। আরেকটার নাম ছিল, পেট কেইসেস। খুলে দেখেছিলাম বইটা। পোষা প্রাণীদের সঙ্গে সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ সব কেস নিয়ে আইনের কাজ-কারবার, দৃষ্টিভঙ্গি ইত্যাদি নিয়ে ব্যাপক পান্ডিত্যপূর্ণ কথাবার্তা দিয়ে ভর্তি। এটার আলোচ্য বিষয় অবশ্য আমেরিকান আইন। উত্তরাধিকার সূত্রে বিশাল টাকা-পয়সার মালিক বনে যাওয়া গৃহপালিত ছোট্ট বিড়াল থেকে শুরু করে, চেইন ভেঙে ডাকপিয়নকে ভয়াবহ আহত করা বনবিড়াল পর্যন্ত সবকিছু উঠে এসেছে এই বইতে।

এক সেট চার্লস ডিকেন্স, এক সেট ডিফো আর ট্রলাপের অনেকগুলো সেট ছিল। এতোগুলো যে, দেখে মনে হয়, এর বুঝি কোনো শেষ নেই। সেইসঙ্গে এডওয়ার্ড গ্যারি সেভিল নামে একজনের এগারোটা উপন্যাসের একটা সেট ছিল। সবুজ রঙের চামড়ার বাঁধাই। বইয়ের স্পাইনে স্বর্ণালী ছাপে প্রকাশনীর নাম লেখা: স্টেডহ্যাম এন্ড সন। জীবনেও এই সেভিল বা ওর প্রকাশকের নাম শুনিনি। ভদ্রলোকের প্রথম উপন্যাসের নাম দিজ ওয়্যার আওয়ার ব্রাদার্স। কপিরাইটের তারিখ দেয়া ১৯১১। আর শেষ বইটার নাম ব্রেকার্স। সাল, ১৯৩৫।

সেভিলের উপন্যাসগুলোর দুই তাক নিচে ছিল একটা বিশাল ভলিউম। ইরেক্টর সেট (এক ধরনের ধাতব খেলনা। জোড়া দিয়ে দিয়ে নানা ধরনের জিনিস বানানো যায়। বর্তমানে প্লাস্টিকের যেসব খেলনা দেখা যায় পিচ্চিদের হাতে, অনেকটা সেরকম) বানানোর কাজে আগ্রহীদের জন্য সবকিছু ধাপে ধাপে বিস্তারিত বর্ণনা করা আছে এতে। তার পাশেই আরেকটা বিশাল ভলিউমে বিখ্যাত সব চলচ্চিত্রের বিখ্যাত দৃশ্যগুলোর একটা সংগ্রহ ছিল। পাশাপাশি দুই পৃষ্ঠার একপৃষ্ঠা পুরোটা জুড়ে একটা ছবি। পাশের পৃষ্ঠায় কিছু কবিতার পঙক্তি। এর মাঝে কিছু আছে। দৃশ্যগুলোর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত, আর কিছু এসব দৃশ্য থেকে অনুপ্রাণিত। এমনিতে কনসেপ্ট হিসেবে আহামরি কিছু না অবশ্যই। তবে যে কবিদেরকে এখানে তুলে আনা হয়েছে, তাদের প্রত্যেকেই অসাধারণ। যেমন, রবার্ট ফ্রস্ট, ম্যারিয়েন মুর, উইলিয়াম কার্লস উইলিয়ামস, ওয়ালেস স্টিভেন্স, লুইস জুকোস্কি এবং এরিকা জং। বইয়ের মাঝ পর্যায়ে দিকে গিয়ে দেখি, ম্যারিলিন মনরোর সেই বিখ্যাত ছবিটার পাশে আর্চিবল্ড ম্যাকলেইশের একটা কবিতা লেখা। ছবিতে মনরো একটা সাবওয়ে স্টেশনে দারুণ আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। একহাতে স্কার্টটা ধরে নিচে টেনে রেখেছেন। ‘দ্য টোল’ নামের কবিতাটি এভাবে শুরু হয়েছে :

স্কার্টের আকৃতিটুকু
দেখে মনে হয়—
ঘন্টির মতো
পা দুটো বেরিয়ে আছে, যেন
ঘন্টার দোলক–

এ রকম আরো কিছু পঙক্তি। জঘন্য না হলেও ম্যাকলেইশের সবচেয়ে ভালো কাজ বা এর ধারেকাছেও নেই। বছরের পর বছর ধরে আর্চিবল্ড ম্যাকলেইশের প্রচুর কবিতা পড়েছি। মনে হচ্ছিল, আমার এটুকু মতামত থাকতেই পারে। এটা ভুল কিছু না। তবে ম্যারিলিন মনরোকে নিয়ে এই কবিতাটা কখনো পড়েছি বলে ঠিক মনে করতে পারছি না (ছবি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও, কবিতাটা যে মনরোকে নিয়েই, সেটা স্পষ্ট বোঝা যাবে। কবিতাটা নিজেই সদর্পে সেই ঘোষণা দিচ্ছে। শেষে এসে ম্যাকলেইশ লিখেছেন, ‘পা-দুটো মোর, করতালি দেয় মোর নামে : মেরিলিন, সুন্দরিতমা)। তারপর থেকে কবিতাটা আমি বহু খুঁজেছি। পাইনি। তবে, এতে তেমন কিছুই প্রমাণিত হয় না। কবিতা আসলে উপন্যাস বা আইনি মতামতের মতো কিছু না। বরং গাছের পাতার মতো। হুট করেই হারিয়ে যেতে পারে কালের গর্ভে, ইতিহাসের আড়ালে। যে কোনো কবিতা সংকলনে যদি পূর্ণাঙ্গ সমগ্র’ বা এমন কিছু লেখা থাকে, নিঃসন্দেহে সেটা ডাহা মিথ্যে কথা। কবিতারা হারিয়ে যাবে, এটাই তাদের বৈশিষ্ট্য। এটাই তাদেরকে এতো আকর্ষণীয়, এতোটা আরাধ্য করে তুলেছে। কিন্তু

কিছুক্ষণের মধ্যেই স্টিভেন্স দ্বিতীয় মার্টিনিটা নিয়ে এলো। ততক্ষণে আমি এজরা পাউন্ড সমগ্রের একখন্ড হাতে নিয়ে একটা চেয়ার বসে পড়েছি। প্রথমটার মতোই এবারেও সবকিছু একেবারে পার্ফেক্ট হয়েছে। চুমুক দিতে দিতে খেয়াল করলাম, উপস্থিত দুজন-জর্জ গ্রেগসন এবং হ্যারি স্টেইন (যে রাতে এমলিন ম্যাকক্যারন আমাদেরকে ব্রিদিং মেথডের গল্পটা শুনিয়েছিল, তার ছয় বছর আগেই হ্যারি ওপারে পাড়ি জমিয়েছে)-তিন ফিটের চেয়েও ছোট একটা দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’ গল্পে অ্যালিস যেমন খরগোশের গর্ত দিয়ে ঢুকে যায়, দরজাটা ঠিক সেরকম! দরজাটা অবশ্য ভোলা ছিল। কিছুক্ষণ পরে শুনলাম, ওদিক থেকে বিলিয়ার্ড বল খেলার শব্দ ভেসে আসছে।

স্টিভেন্স কোথায় যেন যাচ্ছিল। জিজ্ঞাসা করল, আরেক গ্লাস মার্টিনি নিতে চাই কি না। না করলাম, আসলেই আর নিতে চাই না। মাথা ঝাঁকিয়ে নড করল সে, ভেরি গুড, স্যার। মুখভঙ্গি একবিন্দুও বদলায়নি, অথচ কেন যেন মনে হলো, আমার কথা শুনে দারুন সন্তুষ্ট হয়েছে।

কিছুক্ষণ পর, হাসির শব্দ শুনে বই থেকে মুখ তুলে তাকালাম। কেউ একজন ফায়ারপ্লেসের আগুনে বিচিত্র কোনো রাসায়নিকের প্যাকেট ছুঁড়ে মেরেছে। মুহূর্তখানেকের জন্য আগুনের রঙ পরিণত হয়েছে নানা রঙের উৎসবমুখর ঝলমলে অগ্নিশিখায়। আবারো বাচ্চাকালের কথা মনে পড়ে গেল। কেন যেন মনে হচ্ছে, একটা কথা জোর দিয়ে বলা দরকার। নস্টালজিয়া বা মন খারাপ করা কোনো অনুভূতি ছিল না এটা। কেমন অন্যরকম! বাচ্চাকালে আমি নিজেও অনেক সময় এসব করেছি তো। সেই সময়গুলোর কথা মনের আকাশে উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল। কোনো আফসোস বা হাহাকার জাগেনি। বরং শক্তিশালী এই স্মৃতিগুলো দারুণ উষ্ণ, আরামদায়ক একটা অনুভূতি ছড়িয়ে দিয়ে গেল মনে।

খেয়াল করলাম, উপস্থিত বেশিরভাগ মানুষ ফায়ারপ্লেসটাকে ঘিরে অর্ধবৃত্তাকার পথে চেয়ার টেনে বসেছে। গরম গরম সসেজ পরিবেশন করছে স্টিভেন্স। রাতারাতি ধোঁয়া উড়ছে প্লেট থেকে। খরগোশের গর্ত মতোন দরজাটা দিয়ে হ্যারি স্টেইনকে বেরিয়ে আসতে দখা গেল। দ্রভাবে, কিন্তু একরকম তাড়াহুড়ো করেই আমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিল সে। গ্রেগসন বিলিয়ার্ড রুমেই রয়ে গেল। শব্দ শুনে বুঝতে পারছিলাম, শট নেয়া প্র্যাক্টিস করছে।

মুহূর্তখানেক ইতস্তত করে বাকিদের সঙ্গে গিয়ে যোগ দিলাম। নরম্যান স্টেট একটা গল্প শোনালো। অত ভালো কিছু না। আর, এই গল্পটা শোনানো আমার উদ্দেশ্যও না। তবু, ভালো না বলে কী বোঝাচ্ছি-সেটা যাতে বুঝতে পারেন, তাই বলছি। একটা লোক টেলিফোন বুথের মধ্যে ডুবে গেছে-এই হচ্ছে গল্পের বিষয়বস্তু।

স্টেট-সেও ওপারে পাড়ি জমিয়েছে-যেখন গল্পটা বলে শেষ করেছে, কেউ একজন বলে উঠল, ‘গল্পটা তোমার ক্রিসমাসের জন্যে জমিয়ে রাখা উচিত ছিল, নরম্যান। সবাই হাসছিল এ কথা শুনে। এসব কথাবার্তার আগা-মাথা কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। অন্তত তখন বুঝিনি।

এবারে ওয়াটারহাউজ একটা গল্প বলা শুরু করল। হাজার বছর ধরে স্বপ্ন আর কল্পনার যুগে ঘুরে বেড়ালেও এই ওয়াটারহাউজের কথা আমি ভাবতে পারতাম না, নিশ্চিত। মানুষটা ইয়েল থেকে মাস্টার্স করেছে। সেইসঙ্গে সে ফাঁই বেটা কাপ্পার একজন সদস্য। এমন এক ল’ ফার্মের মালিক, যেটাকে কোম্পানি না বলে বরং এন্টারপ্রাইজ বলা উচিত-আকারে, কাজে-কর্মে যেটা গাদাখানেক কোম্পানিকে গিলে নিতে পারবে। স্যুট পরে ফিটফাট হয়ে যে লোক প্রতিদিন অফিসে আসে, সেই ওয়াটারহাউজ এক শিক্ষিকার গল্প শোনাল, যে কি না মেয়েদের ‘অস্থায়ী বাথরুমে গিয়ে আটকা পড়ে গেছে। অস্থায়ী মানে, ইট-সিমেন্ট দিয়ে স্থায়ীভাবে বানানো হয়নি জিনিসটা। কাঠ ইত্যাদি দিয়ে বানিয়ে শুধু এনে রাখা হয়েছে। মহিলা যে স্কুলে পড়াত, সেটা ছিল এক রুমের স্কুল। স্কুলের পেছনের খালি জায়গায় ছিল সেই অস্থায়ী বাথরুমটা। ওতে দুটো স্টল আছে, মানে, দুজন একসঙ্গে যেতে পারে। মহিলা সেদিন একটা স্টলে ঢুকে আটকে গিয়েছিল। এদিকে, সেদিনই আবার বাথরুমটাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা হয়ে আছে। অ্যানিস্টন কাউন্টি এই অস্থায়ী বাথরুমটা কাদেরকে যেন একেবারে দিয়ে দিচ্ছে। বোস্টনের প্রুডেনশিয়াল সেন্টারে যেমন সবসময় নিউ ইংল্যান্ডের এক্সিবিশন অনুষ্ঠিত হয়, খানিকটা সেরকম। তো, বাথরুমটা একটা ফ্ল্যাটবেড ট্রাকের পেছনে উঠিয়ে, পেরেক দিয়ে ট্রাকের মেঝের সঙ্গে লাগিয়ে নেওয়ার পুরো সময়টায় মহিলা টু শব্দটাও করেনি। বিব্রতবোধ আর আতঙ্ক মিলে জায়গায় জমে গিয়েছিল বেচারি। সামারভিলের ১২৮ নম্বর রাস্তায় তখন প্রচন্ড ভিড়। ট্রাকটা কেবল রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। এমন সময়, এক্কেবারে বিস্ফোরিত হলে দরজাটা–

যাই হোক, সে গল্পের কথা এখন থাক। গল্পে পরবর্তীতে কী হয়েছে, তার সঙ্গে আমার আজকের মূল গল্পের কোনো সম্পর্ক নেই। এসবের মধ্যেই স্টিভেন্স এক বোতল ব্র্যান্ডি দিয়ে গেল। জিনিসটা যাকে বলে, চমৎকার! শুধু ভালো বললে খুবই কম বলা হয় আসলে। বোতলটা হাতে হাতে ঘুরতে লাগল। জোহানসনকে দেখলাম, একটা টোস্ট করার জন্য গ্লাস তুলে ধরেছে। একটা না বলে একে আসলে বলা উচিত একমাত্র’। গ্লাসটা তুলে ধরে সে বলল, গল্পটাই আসল। কে বলছে, তাতে কিছু যায় আসে না।

সবাই মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতিসূচক চুমুক দিল গ্লাসে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই একে একে বেরিয়ে যেতে শুরু করল সবাই। রাত যে খুব বেশি হয়েছে, তা নয়। কিন্তু আমি নিজেই খেয়াল করেছি, পঞ্চাশ পেরিয়ে বয়স যখন ষাটের ঘরের দিকে এগোতে থাকে, তখন অল্পতেই মনে হয়, অনেক রাত হয়ে গেছে। স্টিভেন্সকে দেখলাম, ওয়াটারহাউজের কোট মেলে ধরেছে, আর সেও পরে নিচ্ছে কোটটা। দেখে বুঝলাম, আমারও বেরোনোর সময় হয়ে গেছে। আমাকে কিছু না বলে ওয়াটারহাউজ এভাবে বেরিয়ে যাচ্ছিল দেখে একটু অদ্ভুত লাগল (বেরিয়ে যে যাচ্ছিল, সেটা নিশ্চিত। শেলফে বই রেখে আর চল্লিশটা সেকেন্ড পরে এলেও আমি আর ওকে পেতাম না)। কিন্তু সেদিন বিকেলে এতোসব অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে যে, এটাকে আর আলাদা কিছু মনে হচ্ছিল না।

ওর পেছনে পেছনেই বেরিয়ে এলাম। ওয়াটারহাউজকে দেখে মনে হলো, চারপাশে চোখ বুলাতে গিয়ে আমাকে হঠাৎ চোখে পড়ে গেছে। মনে হচ্ছিল, খুব অবাক হয়েছে। ‘ট্যাক্সি শেয়ার করতে চাও?’ কথাটা এমনভাবে জিজ্ঞাসা করল যেন, আগে থেকে আমাদের মধ্যে কোনোরকম পরিচয়-ই ছিল না। এই জনমানবহীন রাস্তায়, প্রবল ঝড়ের রাতে আমাদের যেন এইমাত্র হুট করে দেখা হয়ে গেছে।

‘ধন্যবাদ।’ শুধু ট্যাক্সি শেয়ারের আমন্ত্রণ জানানোর জন্য ধন্যবাদ দেইনি ওকে। সবকিছু মিলে বেশ কৃতজ্ঞ বোধ করছিলাম। ভেবেছিলাম, আমার গলার স্বরেই সেটা বুঝতে পারবে ও, কিন্তু মাথা নাড়ানো দেখে মনে হলো, ট্যাক্সির আমন্ত্রণের বাইরে আর কিছুর কথা বোঝেইনি। একটা ট্যাক্সিকে ধীরেসুস্থে এগিয়ে আসতে দেখা গেল, ভাড়ার জন্য সাইনটা জ্বালিয়ে রেখেছে। এমন অসহ্য শীত বা তুষারপাতের রাতে, নিউ ইয়র্কের মতো শহরে সহসা ট্যাক্সি পাওয়া যায় না। এমনকি, কসম খেয়ে বলা যায়, পুরো ম্যানহাটন জুড়ে ভাড়া নেওয়ার জন্য একটা ট্যাক্সি খুঁজে পাওয়াও কঠিন হয়ে যাবে। অথচ জর্জ ওয়াটারহাউজ এসে দাঁড়াতেই ট্যাক্সি পেয়ে গেল! ভাবছিলাম, ভাগ্য সম্ভবত নিজের ভান্ডারটা ওর জন্য একটু বেশিই খুলে রেখেছে। হাত নেড়ে সংকেত দিতেই ট্যাক্সিটা এসে দাঁড়াল।

ভেতরে ঢুকে বসলাম। উষ্ণতাটুকু উপভোগ করছি। ট্যাক্সি মিটারে এখান থেকে নিয়ে আমাদের গন্তব্যস্থল পর্যন্ত যাত্রাপথ, ভাড়া ইত্যাদি বিস্তারিত দেখা যাচ্ছে। ওকে বললাম, গল্পটা শুনে দারুণ মজা পেয়েছি। বয়স আঠারো পেরোনোর পর, এতো স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রাণ খুলে আর কখনো হেসেছি বলে মনে পড়ে না। কথাটা শুধু বলার জন্যে বলিনি। ব্যাপারটা আসলেই সত্য, এবং সেটাই বলেছিলাম ওকে।

‘তাই নাকি?’ গলার স্বরে শীতল ভদ্রতা।

একটু সরে বসলাম। টের পাচ্ছি, আমার গাল কিছুটা হলেও লাল হয়ে গেছে। মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, এটা বোঝার জন্য সবসময় ‘ধাম করে শব্দ হওয়া দরকার হয় না।

আমার বাসার সামনে এসে ট্যাক্সি ব্রেক কষল। নামার সময় আরেকবার ধন্যবাদ দিলাম। তবে এবারে ওর ব্যবহারে কিছুটা উষ্ণতা লক্ষ্য করা গেল। ‘এতো অল্প সময়ের কথায় রাজি হয়ে চলে এসেছে দেখে খুশি হয়েছি। তুমি চাইলে কিন্তু আবার আসতে পার। আমন্ত্রণের জন্য অপেক্ষা কোরো না। ২৪৯ এর ওখানে আমাদের মধ্যে এ রকম কিছুর ঠিক প্রচলন নেই। আর, উৎসব ধরণের তেমন কিছু হয়ও না, বোঝই তো। বৃহস্পতিবারটা অবশ্য গল্পের জন্য সেরা। তবে, অন্যদিনেও ক্লাব কিন্তু ক্লাবের জায়গাতেই থাকবে! যখন ইচ্ছে হয়, চলে এসো।’

আমি কি তাহলে সদস্য হয়ে গিয়েছি?

প্রশ্নটা ঠোঁটে চলে এসেছিল। জিজ্ঞেস করতে চাচ্ছিলাম, কারণ, মনে হচ্ছিল, জিজ্ঞেস করা দরকার। সেটা করার আগে মাথায় একটুখানি নেড়েচেড়ে দেখছিলাম কথাটা (আইনজীবী হওয়ার ফল, পেশাগত অভ্যাস যাকে বলে)। বুঝে নিতে চাইছিলাম, ঠিকঠাক বলছি কি না সব-একটু বেশি কাঠখোট্টা হয়ে যাচ্ছে না তো?-ভাবতে ভাবতেই দেখি, ওয়াটারহাউজ ড্রাইভারকে এগোতে বলছে। পরমুহূর্তেই ট্যাক্সিটা ম্যাডিসনের দিকে চলতে শুরু করল। এক মুহূর্তের জন্য স্থির দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। টপকোটের কিনারা হাঁটুর নিচে বারবার বাড়ি মারছে। আর, মাথায় কেবল একটা চিন্তাই ঘুরছে: ও জানতো, আমি এই প্রশ্নটা জিজ্ঞাসা করবো। জানতো-জেনেশুনে ইচ্ছে করেই, আমি প্রশ্ন করার আগেই ড্রাইভারকে গাড়ি টান দিতে বলেছে। নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম, এটা খুবই বাজে ধরণের চিন্তা। আমি সম্ভবত প্যারানয়েড হয়ে পড়েছি। কিন্তু এও মনে হচ্ছিল যে, প্যারানয়েড মনে হলেও কথাটা আসলে সত্যি। নিজেকে যত যা-ই বলি, যেভাবেই বোঝাই, সত্যিটা তো আর বদলাবে না।

ধীর পায়ে বিল্ডিংয়ের দরজা দিয়ে ঢুকে পড়লাম।

বিছানায় বসে যখন জুতো খুলছি, অ্যালেন ততক্ষণে ষাট পার্সেন্ট ঘুমে। এর মধ্যেই একটু ঘুরে অস্পষ্টভাবে কিছু একটা জিজ্ঞাসা করল। গলার ভেতরটা ভারি শোনাল, কিন্তু কিছু বোঝা গেল না, কী বলছে। ওকে বললাম, তুমি ঘুমাও।

ঘুমের ঘোরে আবারো অস্পষ্টভাবে কিছু একটা জিজ্ঞাসা করল সে। আধো ইংরেজিতে কিছুটা বুঝতে পারলাম, বলছে, ‘কেমন লাগল?

শার্টের অর্ধেক বোম কেবল খুলেছি। মুহূর্তখানেকের জন্য ইতস্তত বোধ করলাম। কিন্তু সেই মুহূর্তখানেকের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেল। যদি ওকে সব খুলে বলি, ওই ক্লাবের দরজা দিয়ে আমার আর জীবনে ঢোকা হবে না।

‘ঠিকঠাকই ছিল। বুড়োদের যুদ্ধের স্মৃতিচারণ শুনে এলাম আরকি।‘

‘বলেছিলাম না? দেখেছ?’

‘নাহ, অতটাও খারাপ লাগেনি। আমি হয়তো আবারো যেতে পারি। হয়তো ফার্মের কাজে কিছুটা সুবিধা হলেও হতে পারে।’

‘ফার্ম!’ গলার স্বরে বিদ্রুপের ছোঁয়া টের পেলাম। ‘বুড়ো বয়সে তোমার মাথাটা গেছে, বুঝলে?’

‘মোগলের সাথে কাজে নামলে মোগলাই না খেয়ে উপায় কী, বলো? বলতে বলতেই দেখলাম, ঘুমে তলিয়ে গেছে অ্যালেন। জামা-কাপড় খুলে গোসল সেরে নিলাম। পায়জামা পরে নিয়ে বিছানায় যাওয়ার পরিবর্তে (বিছানায় যাওয়াই আসলে উচিত ছিল। ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটা একটার ঘর পেরিয়ে যাচ্ছে), রোব পরে নিয়ে এক বোতল বেকস নিয়ে কিচেন টেবিলে এসে বসলাম। জানালা পেরিয়ে ম্যাডিসন অ্যাভিনিউয়ের শীতল গিরিখাতের দিকে তাকিয়ে আছি। আস্তে আস্তে চুমুক দিচ্ছি আর ভাবছি বিকেলের কথা। অ্যালকোহল খাওয়ার ফলাফল হাতেনাতে পাওয়া যাচ্ছে। মাথার ভেতওে মৃদু এক ধরণের ভোঁ ভোঁ শব্দ হচ্ছে। আসলে, এমনিতে অল্প হলেও আমার জন্য পরিমাণটা একটু বেশিই ছিল। কিন্তু কেন যেন মোটেও খারাপ লাগছে না। অনুভূতিটাকে হ্যাংওভার বলে মনে হচ্ছে না।

এলেন যখন আমাকে আজকে বিকেলের কথা জিজ্ঞাসা করল, তখনও মাথায় ফালতুসব ভাবনা এসে ভিড় করেছে। ওয়াটারহাউজ যখন ক্যাব নিয়ে চলে যাচ্ছিল, তখন যেমন কিছু বাজে ভাবনা এসে ভিড় করেছিল, তেমন। আমার বসের একদল বুড়ো হাবড়া বন্ধুর সঙ্গে নিরীহ এক বিকেল কাটিয়ে এসেছি, এই কথা আমার স্ত্রীকে বললে কী এমন ক্ষতি হয়ে যেত? আর, ক্ষতি হলেও যে আমি স্ত্রীকে মিথ্যা কথা বলব, সেটা কে জানত! পুরো জিনিসটাই ফালতু এবং প্যারানয়েড আচরণ…অথচ মন বলছিল, অনুভূতির প্রতিটা বিন্দু-বিসর্গ পর্যন্ত সত্যি।

পরদিন অফিসের অ্যাকাউন্টস আর লাইব্রেরির মধ্যেকার হলওয়েতে জর্জ ওয়াটারহাউজের সাথে দেখা। দেখা না বলে, বরং পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া বললে ভালো বোঝা যাবে। বছরের পর বছর ধরে যেমন হয়ে আসছে, মাথা ঝাঁকিয়ে নড করে সোজা চলে গেল লোকটা, কিছু বলল না।

তারপর থেকে সারাটাদিন ধরে পেটের পেশীগুলো কেমন মোচড়াতে লাগল, সাথে তীব্র ব্যথা। এই ব্যথাটাই বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিল, গতকালকের বিকেলটা আমার কল্পনা ছিল না।

তিন সপ্তাহ চলে গেল। চার…পাঁচ। ওয়াটারহাউজের কাছ থেকে আর কোনো আমন্ত্রণ এলো না। বারবার মনে হচ্ছিল, আমি ঠিক উপযুক্ত ছিলাম না ওদের। খাপ খাইনি। নিজের উপরেই হতাশ, বিরক্ত বোধ করছিলাম। সব হতাশার মতোই, সময়ের সাথে সাথে ধীরে ধীরে যন্ত্রণাটা কমে আসছিল অবশ্য। কিন্তু অদ্ভুত সব সময়ে সেই বিকেলের কথা মনে পড়ে যেত আমার। লাইব্রেরির ল্যাম্পলাইটের বিচ্ছিন্ন আলো-স্থির-নিশ্চল, অথচ কী দারুণ মার্জিত! ওয়াটারহাউজের অদ্ভুত কিন্তু মজার সেই বাথরুমে আটকা পড়া স্কুলটিচারের গল্প। সরু বুকশেলফের মধ্যে সাজানো, চামড়ায় বাঁধাই করা সমগ্রগুলির গন্ধ। সব থেকে বেশি মিস করতাম সেই সরু জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা। বিন্দু বিন্দু তুষার জমা কাঁচের মধ্যে দিয়ে সবুজ-হলুদ-লাল ট্রাফিক বাতির পরিবর্তন দেখা। অদ্ভুত এক শান্তি অনুভব করেছিলাম সেদিন। সেই অনুভূতিটার কথা খুব মনে পড়ত।

সেই পাঁচ সপ্তাহে লাইব্রেরিতে গিয়ে আর্চিবল্ড ম্যাক্লেইশের কবিতা সমগ্রের চারটা খন্ড খুঁজে দেখেছি আমি। আমার কাছে আরো তিনটা খন্ড ছিল, সেগুলোও খুঁজে দেখেছি। এর মধ্যে একটার গায়ে লেখা ছিল, ‘পূর্ণাঙ্গ কবিতা সংগ্রহ’। এই সুযোগে পুরনো বেশ কিছু পছন্দের কবিতা আবারো পড়া হয়ে গেল। আমার সবচেয়ে পছন্দের কবিতাটাও ছিল ওর মাঝে ‘এপিস্টল টু বি লেফট ইন দ্য আর্থ’। কিন্তু ‘দ্য টোল’ নামের কোনো কবিতা আমি ওর মধ্যে খুঁজে পাইনি।

একইসঙ্গে এডওয়ার্ড গ্রে সেভিলের লেখার খোঁজে সেদিন আমি নিউ ইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরির কার্ড ক্যাটালগটাও খুঁজে দেখেছিলাম। সবচেয়ে কাছাকাছি যেটা পেলাম, সেটা হলো, রুথ সেভিল নামের এক মহিলার লেখা রহস্যোপন্যাস।

ওয়াটারহাউজ সেদিন বলেছিল, ইচ্ছে হলে চলে এসো। আমন্ত্রণের জন্য অপেক্ষা করো না…

তারপরেও আমি আসলে আমন্ত্রণের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। অনেক বছর আগে মা শিখিয়েছিলেন, যারা হুট করে হাসিমুখে ‘যেকোনো সময় চলে এসো’ বা ‘আমার দরজা তোমার জন্য সবসময় ভোলা’-টাইপের কথা বলে, তাদের কথা যেন চট করে বিশ্বাস না করে ফেলি। এমন না যে, আমন্ত্রণ জানিয়ে, কাউকে দিয়ে বাসায় কার্ড পাঠানোর অপেক্ষা করছিলাম। উঁহু, অমন কিছু না। কিন্তু কিছু একটার অপেক্ষা করছিলাম। হয়তো হালকা চালে একবার বলা যে, ‘ডেভিড, আজকে রাতে ফ্রি থাকলে চলে আসো? আমাদের সাথে সময় কাটাতে বিরক্তি না লাগলে আরকি!’ বা এ রকম কিছু।

কিন্তু সেটাও যখন এলো না, একবার অন্তত গিয়ে দেখার কথা সিরিয়াসলি ভাবতে শুরু করলাম আমি। নিজেকে বুঝালাম, যত যাই হোক, কখনো কখনো মানুষ নিশ্চয়ই আসলেই চায় যে, যেকোনো সময় ফ্রি থাকলে চলে আসবেন আপনি। হয়তো কোনো কোনো জায়গার দরজা আসলেই সবসময় খোলা থাকে। এমন তো না যে, মায়েরা সবক্ষেত্রেই শতভাগ সঠিক হন, তাই না?

…আমন্ত্রণের জন্য অপেক্ষা করো না…

যাই হোক, এভাবেই একদিন ব্যাপারটা ঘটল। সেই বছরের ১০ই ডিসেম্বর আমি আবিষ্কার করলাম, টুইডের খসখসে জ্যাকেট আর গাঢ় বাদামি প্যান্টটা পরে-টরে গাঢ় লাল টাইটা খুঁজছি পরার জন্য। মনে আছে, হৃদপিন্ডের ঢাকঢাক শব্দটা অন্যদিনের চেয়ে বেশি করে কানে লাগছিল।

‘জর্জ ওয়াটারহাউজ তাহলে শেষ পর্যন্ত তোমাকে আবার বুড়ো হাবড়াদের খোঁয়াড়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছে?’ অ্যালেন জানতে চাইল।

‘হুম,’ বলতে বলতে ভাবছিলাম, অন্তত ডজনখানেক বছর পরে আবার ওকে মিথ্যে বললাম…তারপর মনে পড়ে গেল, প্রথমবার যেদিন বিকেলে ওখানে গিয়েছিলাম, সেদিন ফেরার পরে ওর প্রশ্নের জবাবেও মিথ্যে বলেছিলাম। বলেছিলাম, বুড়োদেও যুদ্ধের স্মৃতি শুনে যেমন লাগার কথা, সেরকমই লেগেছে।

এলেন বলল, ‘হয়তো এর ফলে আসলেই একটা প্রমোশন হয়ে যেতে পারে তোমার।’ অবশ্য ওর গলায় খুব একটা আশা ছিল না। কিন্তু খুব একটা হতাশাও যে ছিল না, সেটাই বেশি।

‘এরচেয়ে কত অদ্ভুত জিনিসও তো ঘটে,’ বলে, কপালে চুমু দিয়ে বিদায় জানালাম ওকে। দরজা দিয়ে বের হওয়ার সময় শুনলাম বলছে, ‘ঘোঁত ঘোঁত!’

সে রাতে ট্যাক্সি করে যেতে যেতে মনে হচ্ছিল, পথ বুঝি আর শেষ হবে না। ভীষন শীত পড়ছে। আকাশ জুড়ে তারার মেলা বসেছে। চেকার কোম্পানির বিশাল ক্যাবে করে যাচ্ছি। নিজেকে খুবই ক্ষুদ্র মনে হচ্ছিল, যেন, একটা বাচ্চা প্রথমবারের মতো শহর দেখতে বেরিয়েছে। ব্রাউনস্টোনের ওখানে, ক্লাবের সামনে এসে ক্যাব দাঁড়িয়ে পড়ল। রক্তের মাঝে প্রবল উত্তেজনা টের পাচ্ছিলাম। কী সহজ-সরল, অথচ পূর্ণাঙ্গ এক অনুভূতি! অথচ এসব ছোটখাটো, মূল্যবান জিনিসগুলোই অজান্তে কখন যেন হারিয়ে যায় জীবন থেকে। টের পাওয়া যায় না। কিন্তু বয়স্ক হাড়ে, রক্তের গভীরে আবার নতুন করে যখন এমনটা অনুভূত হয়, অবাক লাগে। হঠাৎ চুল আঁচড়াতে গিয়ে অনেক বছর পরে কালো চুল পাওয়া গেলে যেমন হয়। ছোটখাটো জিনিস, অথচ হারিয়ে গেলে জীবনটা যে কী নিদারুন মূল্যহীন হয়ে পড়ে!

ড্রাইভারকে ভাড়া দিয়ে বেরিয়ে এলাম। দরজার আগে যে চারটা সিঁড়ি আছে, সেদিকে পা বাড়ালাম। যত এগোচ্ছি, টের পেলাম, উত্তেজনা বদলে গিয়ে আশংকায় পরিণত হচ্ছে (বুড়োরা অবশ্য এই অনুভূতির সাথে ভালোই পরিচিত)। ঠিক কী করছি আমি এখানে?

মোটা ওক কাঠের দরজা। এই মুহূর্তে দেখে মনে হচ্ছে যেন, দূর্গ সুরক্ষার জন্যে বানানো হয়েছে। কোনো ডোরবেল বা নক করার জন্য ‘নকার নেই। ছায়ার মাঝ থেকে তাকিয়ে নেই কোনো ক্লোজড সার্কিট টিভি ক্যামেরা। এবারে আর কোনো ওয়াটারহাউজ আমাকে ভেতরে নিয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করে নেই। সিঁড়ির গোড়ায় থেমে দাঁড়িয়ে চারপাশে চোখ বুলালাম। ৩৫ নম্বর রাস্তাটাকে এখন হঠাৎ করে আরো অন্ধকার, শীতল এবং ভয়ংকর লাগছে। ব্রাউনস্টোন দিয়ে বানানো বাড়িগুলোকে মনে হচ্ছে, কী যেন লুকোতে চাইছে। এমন কিছু, যেটা খুঁজে বের করার চেষ্টা না করাই ভালো। জানালাগুলোকে মনে হচ্ছে অশরীরীর পলকহীন চোখ।

এই জানালাগুলোর পেছনে, কোথাও না কোথাও, কেউ না কেউ নিশ্চয়ই বসে বসে খুনের ছক কাটছে। ভাবতে ভাবতেই শীতল একটা স্রোত শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল। ছক কাটছে…অথবা খুন করছে।

তারপর হঠাৎ করেই দরজাটা খুলে গেল। স্টিভেন্স দাঁড়িয়ে আছে ওপাশে।

মনে হলো, কাঁধ থেকে বিশাল কোনো বোঝা নেমে গেছে। নিজেকে যতটুকু চিনি, অতটা কল্পনাপ্রবণ মানুষ নই আমি। অন্তত সাধারণ কোনো পরিস্থিতিতে এসব উল্টোপাল্টা চিন্তা কখনোই মাথায় আসতো না। কিন্তু এই পরিবেশে, শেষ চিন্তাটাকে খুব একটা অসম্ভব মনে হচ্ছিল না। স্টিভেন্সের সাথে চোখাচোখি না হয়ে গেলে হয়তো স্বস্তির কথাটা মুখ দিয়ে বেরিয়েই যেত। কিন্তু ওর চোখে চোখ পড়তেই থমকে গেলাম। ওই চোখ দুটো আমাকে চেনে না। একদমই চেনে না।

পরমুহূর্তে আরেকটা চিন্তা আছড়ে পড়ল মাথায়। সন্ধ্যার বাকি সময়টা কিভাবে কাটবে, সেটা চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। একটা নিরব বারে ঘন্টা তিনেক চুপচাপ কাটিয়ে দেওয়া-অনাহুত আগম্ভক হিসেবে ওখানে গিয়ে হাজির হওয়ার মতো বোকামি করার মাশুল। সাথে, তিন চারটা মার্টিনি গলায় ঢেলে হতাশা ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা। এই অপমান

এড়ানোর জন্যেই মা সেই উপদেশ দিয়েছিলেন। অথচ, জেনেশুনে বিষ পান। করেছি। বোকার মতো নিজের সামর্থ্যের বাইরে পা দিয়ে ফেলেছি।

হালকা মাতাল হয়ে বাসায় ফেরার দৃশ্যটা ফুটে উঠল কল্পনায়। ক্যাবে করে পুরোটা পথ অসাড় বসে থাকা। বাচ্চাদের চোখ দিয়ে শহর দেখার সেই আনন্দ, উত্তেজনার লেশমাত্রও নেই। আজ নিশ্চয়ই অ্যালেনকে গিয়ে বলব, কিছুক্ষণ থেকে বিরক্ত হয়ে গেছি একেবারে। পোকার খেলায়, থার্ড ব্যাটেলিয়নে টি-বোন বাজি জেতার সেই একই গল্প বলছিল ওয়াটারহাউজ। আর, হার্ট খেলায় প্রতি পয়েন্টের বাজি ১ ডলার! মানে, বিশ্বাস হয়, বলো? আর যাব কি না? যেতে পারি…কিন্তু মনে হয় না আর যাব। এটুকু বললেই হবে। কেচ্ছা খতম। কিন্তু অপমান? আদৌ এই জীবনে শেষ হবে কি না, আমি জানি না।

স্টিভেন্সের শূন্য দৃষ্টির মাঝে এই সব কিছু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম আমি। তারপর, চোখ দুটো উষ্ণ হয়ে উঠল। মৃদু হেসে বলল, ‘মি. অ্যাডলি! আসুন, আসুন। কোটটা আমাকে দিন, আমি নিচ্ছি।’

সিঁড়ি পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। পেছনে সে দরজাটা লাগিয়ে দিল। দরজার উষ্ণ পাশে থাকলে একই দরজাকে যে কী আলাদা লাগে! কোট নিয়ে স্টিভেন্স চলে গেল। মুহূর্তখানেকের জন্য হলেই দাঁড়িয়ে রইলাম। লম্বা আয়নাটায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখছি। তেষট্টি বছরের একটা মানুষকে দেখা যাচ্ছে। কেমন রোগাটে হয়ে যাচ্ছে মুখটা। মধ্যবয়সি বলে চালানোর উপায় নেই। অথচ, দেখে শান্তি শান্তি লাগছিল।

লাইব্রেরির দিকে পা বাড়ালাম।

জোহানসন ওর ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল পড়ছে। আরেক পাশে, আলোর মাঝে দেখা যাচ্ছে এমলিন ম্যাকক্যারন আর পিটার অ্যান্ড্রস দাবাবোর্ড নিয়ে বসেছে। ম্যাকক্যারন শীর্নদেহী মানুষ। নাকটা ব্লেডের মতো সরু। অ্যান্ড্রুস আবার দশাসই, বদরাগী ধরণের। চওড়া কাঁধ। আদা রঙের লম্বা দাঁড়ি গলা পেরিয়ে বুক পর্যন্ত চলে এসেছে। সামনের দাবাবোর্ড আর গুটিগুলো আবলুস কাঠ আর গজদন্ত কুঁদে বানানো। এসব সামনে নিয়ে ওরা দুজন যেভাবে বসেছে, দেখে মনে হচ্ছে ভারতীয় দুই টোটেম : ঈগল আর ভালুক।

দেখলাম, ওয়াটারহাউজও এসেছে। সেদিনের টাইমস পত্রিকার উপর ঝুঁকে আছে, পড়ছে। হঠাৎ চোখ তুলে তাকাল। আমাকে দেখে ছোট্ট করে নড করল, যেন মোটেই অবাক হয়নি। পরমুহূর্তেই আবারো হারিয়ে গেল পত্রিকার মাঝে।

স্টিভেন্স দেখি না চাইতেই গ্লাসভর্তি বোম্বাই মার্টিনি নিয়ে এসেছে।

গ্লাসটা নিয়ে বুকশেলফগুলোর দিকে এগিয়ে গেলাম। সবুজ রঙের সেই ভলিউমটা খুঁজে পেলাম, আগের মতোই আছে। সেই রাতে আমি প্রথমবারের মতো এডওয়ার্ড গ্রে সেভিলের লেখা পড়তে শুরু করি। শুরু থেকেই শুরু করলাম, দিজ ওয়্যার আওয়ার ব্রাদার্স-বইটা দিয়ে। তারপর একে একে সবগুলো বই-ই আমি পড়েছি। আমার কাছে মনে হয়েছে, এই এগারোটা উপন্যাস-ই এই শতকের শ্রেষ্ট উপন্যাসের তালিকায় থাকার মতো।

সন্ধ্যা কার্যক্রমের শেষ দিকে একটা গল্প বলা হলো। একটাই-এ সময় স্টিভেন্স ব্র্যান্ডি নিয়ে এলো সবার জন্য। গল্প শেষে সবাই উঠে পড়তে লাগল, বেরিয়ে যাবে। এমন সময় দরজার কাছ থেকে কথা বলে উঠল স্টিভেন্স। ওর নিচু, ভদ্র গলার স্বর হলওয়ে পেরিয়ে ভেসে এল, ‘আমাদেরকে এবারের ক্রিসমাসের গল্পটা তাহলে কে শোনাচ্ছে?

যে যা করছিল, সব কাজ থেমে গেল মুহূর্তের মাঝে। সবাই চারপাশে ইতি-উতি তাকাচ্ছে। নিচু স্বরে কিছু কথা বার্তা আর হাসির আওয়াজও শোনা গেল।

স্টিভেন্স নিজেও হাসছে, কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যাছে, সে সিরিয়াস। গ্রামার স্কুলের শিক্ষকের মতো দুইবার হাত তালি দিল, যেন এলোমেলো ক্লাসটাকে স্থির হতে বলছে। ‘জেন্টেলম্যান, কে শোনাবে এবারের গল্প?’

পিটার অ্যান্ড্রস, চওড়া কাঁধ আর দাড়িওয়ালা সেই লোকটা, গলা খাঁকারি দিল। ‘একটা গল্প নিয়ে ভাবছিলাম আমি, কিন্তু সেটা কতটা মানানসই হবে বা আদৌ-’

‘সমস্যা নেই।’ স্টিভেন্স ওকে থামিয়ে দিল। হাসির শব্দ শোনা গেল বেশ কিছু। কয়েকজন ভদ্রভাবে অ্যান্ড্রসের পিঠ চাপড়ে দিল। টের পেলাম, লোজন বেরিয়ে যাওয়ার সময় ঠান্ডা বাতাসে ভরে উঠছে হলওয়েটা।

হঠাৎ দেখি, স্টিভেন্স আমার কোটটা মেলে ধরে আছে। যেন, জাদুমন্ত্র বলে চট করে নিয়ে এসেছে। শুভসন্ধ্যা, মি. অ্যাডলি। আপনাকে পেয়ে ভালো লাগল।

‘তোমরা আসলেই ক্রিসমাসের রাতে এখানে আসো?’ কোটের বোম লাগাতে লাগাতে জানতে চাইলাম। অ্যান্ড্রসের গল্পটা মিস হয়ে যাবে, এজন্য কিছুটা হতাশ বোধ করছি। ছুটি কাটানোর জন্য শেনেকট্যাডিতে, অ্যালেনের বোনের বাসায় যাওয়ার কথা আমাদের।

স্টিভেন্সকে দেখে মনে হলো, একইসঙ্গে বিস্মিত এবং হতভম্ব হয়ে গেছে। কোনোভাবেই না। অন্য কোনো রাত না হলেও, ক্রিসমাসের রাতটা সবার অবশ্যই পরিবারের সঙ্গে কাটানো উচিত। আপনার কী মনে হয়, স্যার?

‘হ্যাঁ, তা তো অবশ্যই।’

‘তবে, ক্রিসমাসের আগের বৃহস্পতিবার রাতে আমরা সবাই এখানে একসঙ্গে হই। বছরে এই একটা রাতে এখানে যে সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষ একসাথে হবে, সেটা চোখ বুজে বলে দেওয়া যায়।’

খেয়াল করলাম, সে একবারও ‘সদস্য শব্দটা উচ্চারণ করেনি। এটা কি হয়ে গেছে’, নাকি ইচ্ছেকৃত এড়িয়ে যাচ্ছে সে শব্দটাকে?

‘বুঝলেন মি. অ্যাডলি, এই মেইন রুমে অনেক অনেক গল্প ঘুরে ফিরেছে। সব ধরণের গল্পই আছে এর মধ্যে। হাসির গল্প থেকে শুরু করে। বিয়োগান্তক কষ্টের গল্প, বিদ্রুপাত্মক গল্প এমনকি প্রচন্ড আবেগের গল্পও বলা হয়েছে এখানে। কিন্তু ক্রিসমাসের আগের বৃহস্পতিবার রাতটা বরাবরই ‘অস্বাভাবিক’ গল্পের জন্য বরাদ্ধ ছিল। অন্তত আমি যতদূর মনে করতে পারি, সবসময় এমনটাই হয়ে এসেছে।’

প্রথম দিন নরম্যান স্টেটের গল্প শেষ হওয়ার পর যে কথাটা শুনেছিলাম, সেটার অন্তত ব্যাখ্যা পাওয়া গেল। গল্পটা ক্রিসমাসের জন্য জমিয়ে রাখা উচিত ছিল। আরো বেশ কিছু প্রশ্ন ঠোঁটের আগায় ঘুরছিল, কিন্তু স্টিভেন্সের চোখে অদ্ভুত এক সতর্কবাণী দেখতে পাচ্ছিলাম। আমি প্রশ্ন করলে উত্তর দিবে না–এমন ছিল না সতর্কবাণীটা। বরং সে যেন আমাকে দৃষ্টি দিয়ে বলতে চাচ্ছিল, সাবধান, প্রশ্ন কোরো না! আমি কী বলতে চাইছি, আপনারা বুঝতে পারছেন তো?

‘আর কিছু জানতে চান, মি. অ্যাডলি?’

পুরো হলওয়েতে আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ নেই। সবাই বেরিয়ে গেছে। হঠাৎ করে হলওয়েটাকে আরো অন্ধকার মনে হতে লাগল। স্টিভেন্সের লম্বা মুখটা যেন হঠাৎই ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। ঠোঁটগুলো লালচে হয়ে উঠেছে। ফায়ারপ্লেসে খুঁজে দেওয়া কাঠ বা গাছের একটা গিট সম্ভবত এ সময় বিস্ফোরিত হলো। মুহূর্তখানেকের জন্য নকশা করা কাঠের পুরো মেঝেটা লালচে আলোয় ভরে উঠলো। পেছনের যে রুমগুলোতে এখনো যাইনি, ওর কোনোটা থেকে ‘পিচ্ছিল কিছু মাটিতে পড়লে যেমন শোনায়’-সেরকম একটা বিচ্ছিরি থপথপে আওয়াজ শুনলাম বলে মনে হলো। শব্দটা আমার একদমই পছন্দ হয়নি।

‘না,’ কাঁপাকাঁপা গলায় বললাম, ‘জানতে চাই না।’

স্টিভেন্সের গলায় বিদায়ের সুর, তাহলে, শুভরাত্রি। দরজা পেরিয়ে এলাম। শুনতে পেলাম, পেছনে ভারি দরজাটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তালা ঘুরছে। দুই নম্বর অ্যাভিনিউতে আলো দেখা যাচ্ছে। সোজা সেদিকে পা বাড়ালাম, ভুলেও ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে দেখার চেষ্টা করছি না। আসলে, তাকাতে ভয় পাচ্ছি। বিচিত্র কোনো কারণে মনে হচ্ছে, ফিরে তাকালেই দেখব, ভয়ংকর কেউ একজন পায়ে পা ফেলে তাল মিলিয়ে অনুসরণ করছে আমাকে। কিংবা গুপ্ত কিছু একটা, যেটা না জানাই ভালো। কোণায় পৌঁছুতেই একটা ক্যাব দেখতে পেলাম। ইশারায় ডাক দিলাম।

‘আরো একগাদা যুদ্ধের গল্প শুনে এলে নাকি?’ অ্যালেন সে রাতে জানতে চেয়েছিল। ফিলিপ মারলোর একটা বই নিয়ে বিছানায় শুয়ে ছিল ও। কল্পনার এই চরিত্র হচ্ছে এখন পর্যন্ত ওর একমাত্র প্রেমিক পুরুষ।

‘এক-দুটো যুদ্ধের গল্প শুনেছি অবশ্য, ওভারকোটটা ঝুলিয়ে রাখতে রাখতে বললাম, কিন্তু বেশিরভাগ সময় আমি বই পড়েই কাটিয়েছি।’

‘বলো, যখন বুড়ো হাবড়াদের সঙ্গে ঘোঁত ঘোঁত করছিলে না, তখন।‘

‘তা অবশ্য ঠিকই বলেছ! যখন ঘোঁত ঘোঁত করছিলাম না, তখন।’

‘এই পরিচ্ছদটা পড়ি, শোন। “আমি যখন প্রথম টেরি লেনক্সকে দেখি, সে তখন আকণ্ঠ মাতাল। দ্য ড্যান্সারস-এর বাইরের আঙ্গিনায় রাখা রোলস রয়েসে বসে ছিল সে। তরুণদের মতো চেহারা, অথচ চুল সব পেকে সাদা হয়ে গেছে। চোখ দেখেই বোঝা যায়, পাঁড় মাতাল। এছাড়া আর সব কিছু দেখে মনে হবে, টাকা উড়াতে আসা এক তরুণ। ডিনার জ্যাকেট পরে আছে, দেদারসে টাকা উড়াচ্ছে, এইটুকুই।” সুন্দর না লেখাটা? এটা—’

‘দ্য লং গুডবাই বইয়ের অংশবিশেষ,’ কথা টেনে নিয়ে বললাম, জুতো খুলছি। প্রতি তিন বছরে তুমি একবার করে আমাকে এই পরিচ্ছদটা পড়ে শোনাও। এটা তোমার জীবন-চক্রের অংশ হয়ে গেছে।’

আমার দিকে তাকিয়ে নাক কুঁচকালো সে। দুষ্টুমির সুরে বলল, ‘ঘোঁত ঘোঁত।’

‘ধন্যবাদ।’

আবার বইয়ে ফিরে গেল সে। বেকের একটা বোতল আনা দরকার। আমি রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালাম। ফিরে এসে দেখি, দ্য লং গুডবাই বইটা বিছানার চাদরের উপর খোলা পড়ে আছে। অ্যালেন আমার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ‘ডেভিড, ক্লাবটায় যোগ দেবে তুমি?’

‘দিতে পারি হয়তো…যদি আমাকে আমন্ত্রণ জানায় আরকি।’ অস্বস্তি বোধ করছিলাম। হয়তো এইমাত্র আরেকটা মিথ্যে বললাম ওকে। পূর্ব ৩৫ নম্বর রাস্তার ২৪৯ নম্বরের ওদের যদি ‘সদস্যপদ বলে কিছু থেকে থাকে, তাহলে আমি এরই মধ্যে সদস্য হয়ে গেছি।

‘শুনে খুশি হলাম,’ সে বলল। দীর্ঘদিন ধরেই তোমার কিছু একটা খুব দরকার। আমার মনে হয়, তুমি নিজেও জানো না, কিন্তু দরকার আসলে। আমার যেমন রিলিফ কমিটি, কমিশন অন উইমেনস রাইটস আর থিয়েটার সোসাইটি আছে। তোমারও সময় কাটানোর জন্য এ রকম কিছু দরকার। মানুষ দরকার, যাদের সাথে একসঙ্গে বুড়ো হতে পারবে। মানে, আমার মনে হয় আরকি।’

বিছানায় উঠে ওর পাশে বসে, দ্য লং গুডবাই-টা তুলে নিলাম। নতুন প্যাকেট খোলা পেপারব্যাক, আলোতে চকচক করছে। মনে আছে, অরিজিনাল হার্ডব্যাক বইটা অ্যালেনের জন্মদিনে ওকে উপহার দিয়েছিলাম। সেই ১৯৫৩ সালের ঘটনা। কতদিন হলো? ‘আমরা কি বুড়ো হয়ে গেছি?’ ওকে জিজ্ঞাসা করলাম।

‘তাই তো মনে হয়,’ অ্যালেন হাসছে। প্রাণ খোলা হাসি।

বইটা রেখে ওর বুকে আলতো করে স্পর্শ করলাম। মৃদু গলায় বললাম, ‘এক-আধটু এসব করা যাবে তো? নাকি বেশি বুড়ো হয়ে গেছি?’

নারীসুলভ লজ্জা থেকেই সম্ভবত চাদরটা প্রথমে গায়ে টেনে দিল অ্যালেন। হাসছে। পরমুহূর্তেই পা ঝাড়া দিয়ে চাদরটা মেঝেতে ফেলে দিল। ‘বিট মি, ড্যাডি, এইট টু দ্য বার।

‘ঘোঁত ঘোঁত,’ নাক দিয়ে শব্দ করে উঠলাম, হাসছি দুজনেই।

ক্রিসমাসের আগের বৃহস্পতিবার চলে এলো। এমনিতে অন্যান্য দিনের মতোই ছিল বিকেলটা। তবে, দুটো পার্থক্য ছিল। অন্যদিনের চেয়ে অনেক বেশি মানুষ এসেছিল সেদিন, সম্ভবত সংখ্যাটা আঠারো মতন হবে। সেইসাথে বাতাসে একটা তীব্র উত্তেজনার অনুভূতি ভেসে বেড়াচ্ছিল। ব্যাখ্যা করার মতো না, কিন্তু অনুভব করা যায়-এমন। জোহানসন ওর জার্নালে একপাক চোখ বুলিয়ে নিয়ে ম্যাকক্যারন, হিউ বিগলম্যান আর আমার সঙ্গে এসে যোগ দিল। জানালার কাছে বসেছিলাম আমরা। এটা সেটা নিয়ে কথাবার্তা বলছিলাম। কথা ঘুরে ফিরে কেমন করে যেন ‘যুদ্ধের আগের গাড়িগুলি কেমন ছিল’-এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেল। টের পেলাম, আলোচনার গভীরে ঢুকে গেছি। কথা বলে দারুণ মজা পাচ্ছিলাম।

এখন ভাবতে গিয়ে মনে হচ্ছে, তৃতীয় আরেকটা পার্থক্য ছিল সেদিন। স্টিভেন্স দারুণ সুস্বাদু এগনগ পাঞ্চ বানিয়ে নিয়ে এসেছিল। মসৃণ হলেও, রাম আর মসলা মিলে জিনিসটা বেশ কড়া হয়েছে। কাঁচের যে ওয়াটারফোর্ড বোলটা থেকে সবাইকে এগনগ পাঞ্চ পরিবেশন করা হচ্ছে, সেটা দেখে মনে হচ্ছে, বরফ দিয়ে তৈরি ভাস্কর্য। বোলে পাঞ্চের পরিমাণ যত কমছে, পাল্লা দিয়ে উপস্থিত মানুষদের গলার স্বরও সমানতালে চড়ছে।

কোণার সেই ছোট্ট দরজাটার দিকে তাকালাম, যেটা দিয়ে বিলিয়ার্ড রুমে যাওয়া যায়। অবাক হয়ে দেখি, ওয়াটারহাউজ আর নরম্যান স্টেট মিলে একটা বীভারের চামড়া দিয়ে বানানো হ্যাঁটের মধ্যে বেইসবল কার্ড ছুঁড়ে মারছে। দুজনেই বেশ চড়া গলায় হাসছে, এবং সম্ভবত কেউই সেটা টের পাচ্ছে না।

একেক জায়গায় মানুষ জমে গিয়ে একেকটা দল তৈরি হচ্ছে, আবার ভেঙে যাচ্ছে একটু পরেই। রাত বাড়ছে…সাধারণত অন্যান্য দিন সবাই যখন সামনের দরজা দিয়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে যাওয়া শুরু করে, সে সময় দেখি পিটার অ্যান্ডস আগুনের সামনে একটা চেয়ার নিয়ে বসে পড়ল। ওর একহাতে খামের মতো একটা প্যাকেট, গায়ে কিছু লেখা নেই। জিনিসটা না খুলেই আগুনে ছুঁড়ে দিল সে। মুহূর্তখানেক পরেই, বর্ণালীর সমস্ত রঙ গায়ে নিয়ে নাচতে শুরু করল আগুনের শিখাটা। এমনকি কিছু কিছু রঙ দেখে মনে হলো, এসব রঙ আমি আগে কখনো দেখিনি। এসব রঙের উৎপত্তি যেন পৃথিবীর বাইরের অন্য কোনো জগতে। একটু পরেই অবশ্য আবার আগের হলুদ রঙ ফিরে এল। এরমাঝে সবাই চেয়ার এনে গোল হয়ে বসে পড়েছে। অ্যান্ড্রসের কাঁধের উপর দিয়ে কি-স্টোনের সেই লেখাটা স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে। গল্পটাই আসল। কে বলছে, তাতে কিছু যায় আসে না।

চেয়ারগুলোর মাঝ দিয়ে বিড়ালের মতো নিঃশব্দে হাঁটছে স্টিভেন্স। এগনগের খালি গ্লাস নিয়ে হাতে ধরিয়ে দিচ্ছে ব্র্যান্ডির গ্লাস। ফিসফিস শোনা যাচ্ছে। কেউবা স্টিভেন্সকে ‘ম্যারি ক্রিসমাস’ বলছে, কেউবা বলছে, ‘টপ অফ দ্য সিজন, স্টিভেন্স!’ প্রথমবারের মতো দেখতে পেলাম, টাকা হাত বদল হচ্ছে। কেউ ১০ ডলার, কেউবা ৫০, এমনকি ১০০ ডলারের। নোটও দেখলাম নিঃশব্দে চলে আসছে স্টিভেন্সের হাতে।

জবাবে বিনয়ী গলায় ফিসফিস করে ধন্যবাদ দিচ্ছে স্টিভেন্স। ‘থ্যাংক ইউ, মি. ম্যাকক্যারন…মি. জোহানসন…মি.বিগলম্যান…’

নিউ ইয়র্কে এতোদিন ধরে আছি, ভালো করেই জানি, ক্রিসমাসের এই সময় সবাই টিপস দেয়। কসাই, বেকারি শ্রমিক, এমনকি যারা মোমবাতি বানায়, তারাও টিপস পায়। আর, দারোয়ান, বিল্ডিং সুপার কিংবা সপ্তাহের মঙ্গলবার-শুক্রবারে এসে ঘর ঝাড়-মোছ করে দিয়ে যাওয়া কাজের লোককে টিপস দেওয়ার কথা তো আলাদা করে বলার দরকার-ই হয় না। আর্থিক দিক থেকে আমার মতো মানুষজনকে বরাবরই দেখেছি, আবশ্যক অপচয় ছাড়া আর কিছু ভাবে না তারা এটাকে। কিন্তু সে রাতে সেখানে অমন একজনকেও দেখিনি আমি। সবাই স্বেচ্ছায় টাকা দিচ্ছে, এমনকি কেউ কেউ দেওয়ার জন্য আগে থেকেই আগ্রহ নিয়ে বসেও আছে! এবং হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়াই লন্ডনে ক্রিসমাসের এক ‘অসম্ভব সকালের কথা মনে হতে লাগল (২৪৯ এর এখানে কেউ আসলে, তার এ রকম-ই হতে থাকে)। প্রচন্ড শীত। এর মাঝে এক ছেলে কৃপণ এক লোকের বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। অবাক হয়ে বলছে, ‘কী? আমার মতো বিশাল এই হাঁসটা আমাকে দিয়ে দিচ্ছেন?’ কৃপণ লোকটাও প্রচন্ড আনন্দ নিয়ে হাসতে হাসতে বলছে, ‘ভালো ছেলে! গুড বয়!

ওয়ালেটটা বের করে নিলাম। একদম পেছনের খোপে, অ্যালেনের ছবির পেছনে, জরুরি প্রয়োজনের জন্য সবসময় একটা ৫০ ডলারের নোট রাখি আমি। যদিও আমি অত ধনী কেউ না, তারপরও স্টিভেন্স যখন আমাকে ব্র্যান্ডি দিতে এলো, দ্বিতীয়বার না ভেবে ওর হাতে আস্তে করে খুঁজে দিলাম নোটটা।

বললাম, ‘শুভ ক্রিসমাস, স্টিভেন্স।’

‘ধন্যবাদ, স্যার। আপনাকেও, শুভ ক্রিসমাস।’

সবাইকে ব্র্যান্ডির গ্লাস দেওয়া শেষে, নিজের সম্মানীটুকু সংগ্রহ করে নিয়ে স্টিভেন্স সরে গেল। পিটার অ্যান্ড্রসের গল্পের মাঝে একবার তাকিয়েছিলাম। দেখি, সেই সামনের দরজার ওখানে স্থির দাঁড়িয়ে আছে ও। আবছা ছায়ার মতো মনে হচ্ছিল দেখে।

গ্লাসে ছোট্ট একটা চুমুক দিল অ্যান্ড্রুস। একটুখানি গলা খাঁকারি দিয়ে, আবার চুমুক দিল। তারপর বলতে শুরু করল, অনেকেই হয়তো জানেন, বর্তমানে আমি একজন আইনজীবী। আমার অফিস পার্ক অ্যাভিনিউতে। গত বাইশ বছর ধরে আমি সেখানেই অফিস করছি। তার আগে আইনজীবীদের একটা ফার্মে লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করতাম। ওদের অফিস ছিল মূলত ওয়াশিংটন, ডিসিতে। সে সময়, জুলাইয়ের একরাতে আমাকে অনেক রাত পর্যন্ত অফিসে থাকতে হয়েছিল। বিভিন্ন কেইসের তালিকা, রেফারেন্স ইত্যাদি ক্রমান্বয়ে সাজিয়ে একটা ফাইল বানানো লাগবে। সেটা নিয়েই কাজ করছিলাম। যাই হোক, এর সঙ্গে এই গল্পের কোনো সম্পর্ক নেই। এ রকম সময় এক লোক আসল-ক্যাপিটল হিলের সিনেটরদের মধ্যে উনি তখন বেশ জনপ্রিয়। প্রায় সবাই তাকে এক নামে চেনে। যে মানুষটা কিছুদিন পর আরেকটু হলে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট-ই হয়ে যেতো, সেই মানুষটা আমার সামনে রক্ত-ভেজা শার্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দুটো কোটর ছেড়ে বেরিয়ে পড়বে, এমন অবস্থা।

“‘আমার জো’র সাথে কথা বলা দরকার,” উনি বললেন। ‘জো’ মানে, জোসেফ উডস। আমার ফার্মের প্রধান। ওয়াশিংটনের প্রাইভেট সেক্টরে যেসব আইনজীবীরা কাজ করেছেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে অণুপ্রেরণাদায়ক ব্যক্তিত্বদের একজন। আর আমার সামনে দাঁড়ানো সিনেটরের খুবই ভালো বন্ধু।’

‘“উনি তো অনেক আগেই বাড়ি চলে গেছেন,” বললাম। ভড়কে গেছি। কারণ, দেখে মনে হচ্ছিল, মানুষটা বুঝি এইমাত্র ভয়াবহ কোনো গাড়ি দুর্ঘটনা থেকে একটুর জন্য বেঁচে ফিরেছে। কিংবা কেউ হয়তো ছুরি দিয়ে আক্রমণ করেছিল। কোনোমতে জান নিয়ে পালিয়ে এসেছে সেখান থেকে। মুখের জায়গায় জায়গায় রক্ত লেগে আছে। উন্মত্ত এক চোখের নিচে, গালের চামড়া থেকে থেকে লাফিয়ে উঠছে, কুঁচকে যাচ্ছে অদ্ভুতভাবে। এতোদিন পত্রিকার পাতায়, টেলিভিশনে যার হাসিখুশি ছবি দেখেছি, সামনা-সামনি তার এ রকম বিধ্বস্ত চেহারা দেখে ভয়টা আরো জাঁকিয়ে উঠছে। “আমি ওনাকে এখনই কল দিচ্ছি–” বলতে বলতেই পাগলের মতো ফোনের বাটন টিপছিলাম। যদ্রুত সম্ভব কারো কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে পারলেই হলো। লোকটার পেছনে তাকালে, কার্পেটের উপরে ফেলে আসা রক্তমাখা পায়ের ছাপ স্পষ্ট চোখে পড়ছে।’

‘“আমার এখনই জো’র সাথে কথা বলা দরকার,” লোকটা যেন আমার কথা শুনতেই পায়নি। ‘আমার গাড়ির ট্রাংকে একটা জিনিস আছে…জিনিসটাকে আমি ভার্জিনিয়া প্লেসে পেয়েছি। ছুরি মেরেছি আমি ওটাকে, এমনকি গুলিও করেছি, কিন্তু মারতে পারিনি। মানুষ না ওটা। আমি অনেকভাবে চেষ্টা করলাম। কিছুতেই মারতে পারিনি ওটাকে।”

‘কথার শেষ দিকে এসে হালকাভাবে হাসতে শুরু করল মানুষটা। কিছুক্ষণ পরেই সেটা অট্টহাসিতে পরিণত হলো…তারপর শুরু হলো চিৎকার। মি. উডসকে যখন ফোনে পেলাম, লোকটা তখনো চিৎকার করেই যাচ্ছে। মি. উডসকে স্রষ্টার দোহাই দিয়ে বললাম, উনি যেন যতদ্রুত সম্ভব এসে পৌঁছায়…’

পিটার অ্যাভুসের গল্প বলাটাও আসলে আমার উদ্দেশ্য না। সত্যি বলতে, আমি এখন ওটা বলতে চাইও না। ভয়ংকর এই গল্পটা আমাকে দিনের পর দিন তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। রাতের পর রাত, সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে এ নিয়ে দুঃস্বপ্ন দেখেছি। একদিন সকালে, নাস্তার সময় অ্যালেন আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, রাতদুপুরে ঘুমের মধ্যে আমি হঠাৎ করেই ‘ওর মাথা! ওই মাথাটা এখনো কথা বলছে!’ বলে কাঁদছিলাম কেন?

জবাবে বলেছিলাম, ‘দুঃস্বপ্ন দেখেছি মনে হয়। এসব আর পরে মনে থাকে নাকি?’

বলতে গিয়ে কফিকাপের দিকে চোখ নামিয়ে নিলাম। আমি যে মিথ্যা বলছি, যথাসম্ভব অ্যালেন নিজেও সেটা বুঝতে পেরেছিল।

পরের বছরের আগস্টের কথা। আমি সেদিন রিডার’স লাইব্রেরিতে বসে কাজ করছিলাম। জর্জ ওয়াটারহাউজ আমাকে অফিস-টেলিফোনে কল দিল। জানতে চাইল, ওর অফিসে একটু যেতে পারবে কি না। গিয়ে দেখি রবার্ট গার্ডেন, হেনরি এফিংহ্যামও ওখানে আছে। মুহূর্তখানেকের জন্য একরকম নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে, আমার বারোটা বাজতে যাচ্ছে। ভয়াবহ কোনো অপরাধ বা বোকামির দায়ে অভিযুক্ত করা হবে আমাকে।

ঠিক এই সময়ে গার্ডেন আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল, জর্জের বিশ্বাস, তোমাকে আমাদের জুনিয়র পার্টনার করে নেওয়ার সময় এসেছে, ডেভিড। আমরা সবাই ওর সঙ্গে পুরোপুরি একমত।

‘জিনিসটা কিছুটা পৃথিবীর সবচেয়ে বয়ষ্ক জায়কি সদস্য হওয়ার মতো, এফিংহ্যাম বলল, হাসছে। কিন্তু এই রাস্তা ধরেই তোমাকে সামনে এগোতে হবে, ডেভিড। আর, ভাগ্য ভালো হলে এই ক্রিসমাসের মধ্যেই আমরা তোমাকে আমাদের ফুল পার্টনার করে নিতে পারব।’

সে রাতে, ঘুমের ভেতরে কোনো দুঃস্বপ্ন হানা দেয়নি। অ্যালেন আর আমি ডিনার করতে গিয়েছিলাম। অনেক পান করেছি। তারপর, জ্যাজ শোনার জন্য এক জায়গায় গেলাম। আগে প্রায়ই যেতাম, প্রায় ছয় বছর পরে গেলাম জায়গাটায়। রাত ২টা পর্যন্ত ডেক্সটার গর্ডনের জ্যাজ শুনলাম। মানুষটা কৃষ্ণাঙ্গ, চোখ দুটো নীল। অসম্ভব সুন্দর জ্যাজ করে। পরদিন সকালে উঠে দেখি, মাথা ভয়াবহরকম ভার হয়ে আছে। পেটের ভেতরে মোচড় দিচ্ছে। গতকাল যা যা হয়েছে, সেসব এখন কেমন যেন অবিশ্বাস্য লাগছে। এরমধ্যে একটা হলো, আমার বাৎসরিক বেতন একদিনের মধ্যেই আট হাজার ডলার বেড়ে গেছে। অনেক আগে ‘বেতন বাড়বে’-এমন একটা আশা ছিল। সেই আশা ছেড়ে দিয়েছি, তাও অনেক অনেকদিন হয়ে গেল।

সে বছর শরৎকালে, ফার্ম থেকে আমাকে ছয় সপ্তাহের জন্য কোপেনহেগেন পাঠানো হলো। ফিরে এসে জানতে পারলাম, জন হ্যাঁনরাহান ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। ২৪৯ এ নিয়মিত যেত লোকটা। সবার কাছ থেকে টাকা উঠানো হলো লোকটার স্ত্রীর জন্য। বেচারি একেবারে অকুল পাথারে পড়ে গেছে। সব টাকার মোট হিসেব করার দায়িত্ব এসে পড়ল আমার আমার উপর। সবাই ক্যাশ টাকা দিয়েছে। সেটাকে চেকে রুপান্তর করতে হবে। হিসেব করে দেখি, প্রায় দশ হাজার ডলার উঠেছে! চেক বানিয়ে স্টিভেন্সকে দিলাম। সে সম্ভবত কুরিয়ার করে দিয়েছে ওটা।

ঘটনাক্রমে আরলিন হ্যাঁনরাহান আবার অ্যালেনের থিয়েটার সোসাইটির একজন সদস্য। কিছুদিন পর অ্যালেন আমাকে জানাল, আরলিন দশ হাজার চারশ ডলারের একটা বেনামী চেক পেয়েছে। খামের গায়ে ছোট্ট করে। একটা লাইন লেখা ছিল, যেটা থেকে প্রেরকের পরিচয় উদ্ধার করা যায়নি। লেখা ছিল, আপনার স্বামী জনের বন্ধুদের পক্ষ থেকে।

অ্যালেন জানতে চাইল, ‘এক জীবনে এরচেয়ে দারুণ কিছু শুনেছ তুমি, বলো?’

‘সেরা দশে থাকলেও তালিকার একেবারে মাথায় থাকবে না আরকি। এটুকু বলেই প্রসঙ্গান্তরে চলে গেলাম। আচ্ছা অ্যালেন, আর স্ট্রবেরি আছে কি না একটু দেখবে?

বছর গড়াতে লাগল। এর মধ্যে ২৪৯ এর উপরের তলায় বেশ কিছু রুম আবিষ্কার করেছি আমি। লেখালেখির জন্যে একটা রুম আছে, অতিথিদের মাঝে সাঝে রাতে থেকে যাওয়ার জন্যেও রুম আছে (যদিও সেদিন যে থপথপে আওয়াজ শুনেছি-কিংবা শুনেছি বলে মনে। হয়েছে-তাতে করে এখানে থাকার চেয়ে, আমি বরং ভালো কোনো হোটেলেই রাত কাটাতে চাইব)। আছে ছোট হলেও দারুণ সমৃদ্ধ এক ব্যায়ামাগার এবং স্টিম বাথ নেওয়ার ব্যবস্থা। বেশ লম্বা এবং সরু একটা রুম আছে সাথে-দৈর্ঘ্যে যেটার আকার পুরো বিল্ডিংয়ের দৈর্ঘ্যের সমান হবে। ওর মাঝে আছে দুটো বোলিং অ্যালি।

সেই বছরগুলোতে আমি এডওয়ার্ড গ্রে স্যাভিলের উপন্যাসগুলো আবারো পড়েছি। সেইসঙ্গে আবিষ্কার করেছি ‘নরবার্ট রোসেন নামের দারুণ এক কবিকে। চোখ বুজে যাকে এজরা পাউন্ড এবং ওয়ালেস স্টিভেন্সের সঙ্গে তুলনা করা যায়। তিনখন্ডের সমগ্রের মধ্যে একটার। মলাটের পেছনে লেখা পেলাম, রোসেনের জন্ম ১৯২৪ সালে। অ্যানজিওর যুদ্ধে মারা গেছে মানুষটা। সবগুলো খন্ডই নিউ ইয়র্ক এবং বোস্টনের স্টেডহ্যাম অ্যান্ড সন প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত।

মনে আছে, সে সময় কোনো এক বছর (কোন বছর, সেটা ঠিক করে মনে পড়ছে না), এক বসন্ত-বিকেলে আমি আবারো নিউ ইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরিতে ফিরে গিয়েছিলাম। ওদেরকে বলেছিলাম, গত বিশ বছরের লিটারেরি মার্কেট প্লেস-সংক্ষেপে এলএমপি-ক্যাটালগটা দিতে। এলএমপি হচ্ছে একটা বাৎসরিক ক্যাটালগ প্রকাশনা। আকারে সেটা বিশাল কোনো শহরের ইয়েলো পেইজের সমান হবে। ইয়েলো পেইজ মানে, শহরের পূর্ণাঙ্গ টেলিফোন ডিরেক্টরি, সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের তালিকা ইত্যাদির সমাহার। লাইব্রেরির রেফারেন্স রুমের কর্মী পারলে আমাকে মারতে তেড়ে আসে আর কি! তারপরও জোর দিয়ে বলেছিলাম, জিনিসটা আমার আসলেই খুব দরকার। শেষ পর্যন্ত এনে দেওয়া হলো ক্যাটালগটা। প্রত্যেকটা খন্ড, প্রতিটা বছরের সকল প্রকাশনার তালিকা আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছি। এলএমপির তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রের ছোট-বড় সব প্রকাশনীর নাম-ফোন নম্বর ইত্যাদি থাকার কথা (সেইসঙ্গে এজেন্ট, সম্পাদক এবং বুকক্লাবগুলোর কর্মীদের নাম-ফোন নম্বরও থাকার কথা)। অথচ স্টেডহ্যাম অ্যান্ড সন নামের কোনো প্রকাশনীর নাম খুঁজে পেলাম না সেখানে। বছরখানেক পরে অবশ্য দুই বছরও হতে পারে-একজন অ্যান্টিক বুক ডিলারের সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। তাকে আমি এই প্রকাশনীর কথা জিজ্ঞাসা করলে সে উত্তর দিল, এই নামে কোনো প্রকাশনীর কথা জীবনে শোনেনি।

স্টিভেন্সকে জিজ্ঞাসা করার কথাও ভেবেছি অনেকবার। কিন্তু জিজ্ঞেস করতে গেলেই দেখেছি, ওর চোখে সেই সতর্কবাণী ফুটে উঠেছে। ফলে প্রশ্নটা আজো প্রশ্নই রয়ে গেছে, ওকে আর জিজ্ঞাসা করা হয়নি।

সেই বছরগুলোতে অনেকরকম গল্প শুনেছি ওখানে। এর কোনোটা মজার, কোনোটা ভালোবাসা খুঁজে পাওয়ার এবং কোনোটা ভালোবাসা হারিয়ে ফেলার গল্প। কিছু অস্বস্তিকর গল্পও শুনেছি। আর হ্যাঁ, এসবের সাথে কিছু যুদ্ধের গল্পও শুনেছি। তবে অ্যালেন যুদ্ধের গল্প বলতে যা বুঝিয়েছে, এসব গল্প মোটেও সেরকম না। আমি নিশ্চিত, মজা করে অ্যালেন যুদ্ধের গল্পের কথা যখন বলেছে, ওর দূর কল্পনাতেও এসব গল্প উঁকি দিয়ে যায়নি।

একটা উদাহরণ দেই। জেরার্ড টোম্যানের গল্পটা আমার সবচেয়ে স্পষ্টভাবে মনে আছে। আমেরিকান এক যুদ্ধঘাঁটির গল্প। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার চারমাস আগে জার্মানদের কামানের গোলা সরাসরি আঘাত হেনেছিল এই ঘাঁটিতে। আঘাতের ফলে টোম্যান ছাড়া উপস্থিত আর সবাই মারা যায়।

ল্যাথর্প ক্যারাথার্স নামে এক আমেরিকান জেনারেল ছিল। সবাই। নিশ্চিত ছিল যে, এই লোক পুরো বদ্ধ পাগল (ততদিনে আঠারো হাজারের বেশি মানুষকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছে সে। গান শোনার জন্য মানুষ যেভাবে জুকবক্সে পয়সা ফেলে, সেভাবেই কারো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, কারোবা আস্ত জীবনটাই ঝরে গেছে ওই জেনারেলের আদেশে)। গোলাটা যখন আঘাত করে, ক্যারাথার্স তখন ঘাঁটিতে একটা মানচিত্রের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। শত্রুদের অবস্থান দেখেশুনে আরেকটা উন্মত্ত অপারেশনের পরিকল্পনা বাতলে দিচ্ছিল সে। তার মতোই একদল উন্মাদ সরাসরি অপারেশনে নামলেই কেবল এই অপারেশন সফল হতে পারত, বিধবা হয়ে যেত আরো অনেক স্ত্রী।

যখন ধুলোবালি কিছুটা পরিস্কার হয়ে এলো, জেরার্ড টোম্যান তখন দুচোখে সর্ষে দেখছে। নাক-কান, চোখের কোণ বেয়ে রক্ত ঝরছে। কান ঝাঁ ঝাঁ করছে, কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। টোম্যানের ভাষ্যমতে, গোলার ধাক্কায় অণ্ডকোষ ফুলে নাকি ঢোল হয়ে গিয়েছিল, এ রকম অবস্থা। একটু আগের প্রধান যুদ্ধঘাঁটি এতোক্ষণে গণকবরে পরিণত হয়েছে। সেখান থেকে কোনোমতে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছিল সে। বেরিয়ে আসার সময় ক্যারাথার্সের দেহে হোঁচট খেল। তারপর পাগলের মতো হাসতে শুরু করল, সেইসঙ্গে সমানতালে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে। সেই চিৎকারের শব্দ অবশ্য সে নিজে শুনতে পায়নি। কান দুটো তখনো ঝাঁ ঝাঁ করছিল। তবে, উদ্ধারকর্মীরা এর ফলে বুঝতে পেরেছিল যে, জ্বলন্ত কবরের মাঝে একজন এখনো বেঁচে আছে।

গোলার আঘাতে ক্যারাথার্সের কোনো অঙ্গহানি হয়নি…টোম্যান বলছিল, অন্তত অনেক আগেকার সেই সময়ের মানুষজন অঙ্গহানি বলে ভাবত, এমন কিছু হয়নি। হাত ছিঁড়ে যাওয়া, পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া কিংবা চোখ গলে যাওয়া বা গ্যাসের কারণে ফুসফুস নষ্ট হয়ে যাওয়া-এ রকম কিছুই হয়নি ওর। ওর মা ওকে একপলক দেখলে চিনতে পারবে না, এমন কিছুই হয়নি। কিন্তু মানচিত্রটা…

…গোলা আঘাত করার সময় ক্যারাথার্স ওর কসাইগিরির পরিকল্পনার কাজে ব্যবহৃত পয়েন্টারটা নিয়ে যে মানচিত্রের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল…

জিনিসটা কিভাবে যেন ওর মুখের জায়গায় জায়গায় গেঁথে গেছে। টোযম্যান আবিষ্কার করল, একটা বীভৎস, ট্যাটু করা মৃত্যু-মুখোশের দিকে তাকিয়ে আছে সে। ল্যাথৰ্প ক্যারাথার্সের ভ্রুর হাড়ের মধ্যে ব্রিটানির পাথুরে উপকুল দেখা যাচ্ছে। বাম গাল থেকে নীলচে ক্ষতর মতো বয়ে যাচ্ছে রাইন নদী। থুতনির মধ্যে গেঁথে গেছে পৃথিবীর সর্বোকৃষ্ট ওয়াইন-ফলন হয়, এমন বেশ কিছু অঞ্চল। কেমন যেন বিকৃত হয়ে গেছে জায়গাটা। গলার কাছে দেখা যাচ্ছে সার গিরিখাত…এমনভাবে জিনিসটা গেঁথে গেছে যে, মনে হচ্ছে, গলায় কেউ ফাঁসির দড়ি পরিয়ে দিয়েছে। ভীষণভাবে ফুলে গেছে একটা চোখ, অনেকটা বেরিয়ে এসেছে কোটর থেকে। ওর মাঝে কেউ যেন একটা শব্দ প্রিন্ট করে দিয়েছে : VERSAILLES।

গল্পটা যখন বলা হয়েছিল, তখন সাল ১৯৭-

আরো অনেকগুলো গল্পই আমার মনে আছে। তবে, সেগুলো এখানে বলার জন্য না। ঠিক করে বললে, টোম্যানের গল্পটাও এখানে বলার মতো না…কিন্তু এই গল্পটাকে বলা যায়, ২৪৯ এর ওখানে আমার শোনা প্রথম ‘সত্যিকারের ক্রিসমাস-কাহিনী। সেজন্যই বলার লোভ সামলাতে পারলাম না। যাই হোক, এ বছর থ্যাংকসগিভিংয়ের পরের বৃহস্পতিবার স্টিভেন্স যখন হাত তালি দিয়ে সবার মনোযোগ আকর্ষণ করে জানতে চাইল, এবারের ক্রিসমাস-কাহিনীটা কে বলতে চায়, এমলিন ম্যাকক্যারন জোর গলায় বলল, ‘সম্ভবত, বলার মতো একটা গল্প জানি আমি। এখনই না বললে আর কখনো হয়তো বলাই হবে না। ভাব দেখে মনে হচ্ছে, স্রষ্টা শিগগিরই আমার মুখ চিরতরে বন্ধ করে দেবেন।

এতো বছর ধরে ২৪৯ নম্বরের এখানে আসছি, কিন্তু ম্যাকক্যারনকে কখনো গল্প বলতে শুনিনি। সেজন্যই সম্ভবত এতো দ্রুত ট্যাক্সি ডেকে নিয়েছিলাম। সেজন্যই সে রাতে স্টিভেন্স যখন এতোসব ঝামেলা পেরিয়ে হাজির হয়ে যাওয়া আমাদের ছয়জনকে এগনগ পরিবেশন করছিল, অসম্ভব উত্তেজিত বোধ করছিলাম। আমি একাই যে এমনটা বোধ করছিলাম, তাও না। অনেকের চেহারাতেই প্রবল উত্তেজনার ছাপ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম।

ম্যাকক্যারনের বয়স হয়ে গেছে। শরীর ভর্তি পশম চোখে পড়ে। অথচ শুকিয়ে গেছে লোকটা। এই মুহূর্তে সে ফায়ারপ্লেসের আগুনের পাশে, বিশাল এক চেয়ারে বসে আছে। শুকিয়ে একসার হয়ে যাওয়া একহাতে পাউডারের প্যাকেট। প্যাকেটটা আগুনে ছুঁড়ে দিতেই রং-বেরঙের শিখায় রঙিন হয়ে উঠলো জায়গাটা। তারপর আবারো সেটা হলুদ হয়ে এলো। স্টিভেন্স ব্র্যান্ডি পরিবেশন করল আমাদেরকে। সেইসঙ্গে আমরাও ওকে ক্রিসমাসের সম্মানী দিলাম। বাৎসরিক এই দেওয়া-নেওয়ার সময় একবার টাকা খুচরো করার যন্ত্রের শব্দ যেমন শুনেছি, তেমনি মুহূর্তখানেকের জন্য আগুনের আলোয় হাজার ডলারের নোটও হাতবদল হতে দেখেছি আমি। দুই সময়েই স্টিভেন্সের গলার ফিসফিসানি একইরকম ছিল। নিচু, ভদ্র এবং বিনয়ী। জর্জ ওয়াটারহাউজের সাথে ২৪৯ নম্বরের এখানে প্রথম যখন আসি, তারপর কম-বেশি দশ বছরের মতো পেরিয়ে গেছে। বাইরের পৃথিবীতে অনেক কিছু বদলে গেছে, কিন্তু এই চার দেয়ালের ভেতরে কিচ্ছুটি বদলায়নি। আর, স্টিভেন্সকে দেখে মনে হয়, বছর তো দূরের কথা, মানুষটার বয়স বুঝি একদিনও বাড়েনি।

কাজ শেষে আবার ছায়ার মাঝে গিয়ে দাঁড়ালো স্টিভেন্স। মুহূর্তখানেকের জন্য এতো নিখুঁত নিস্তব্ধতা ভর করল যে, কাঠ আগুনে পোড়ার মৃদু শব্দটুকুও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল। এমলিন ম্যাকক্যারন আগুনের দিকে তাকিয়ে ছিল। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে আমরাও তাকিয়েছিলাম। কেন যেন সে রাতে আগুনের শিখাটাকে দেখে মনে হচ্ছিল, একটু বেশিই নাচানাচি করছে। যেন শিখাটার নিজস্ব প্রাণ আছে, নাচছে, নিজের মতো করে। আগুন দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, সম্মোহিত হয়ে গেছি। সম্ভবত আমাদের গুহাবাসী পূর্বপুরুষরাও আগুনের নাচ দেখতে দেখতে এমনই সম্মোহিত বোধ করত। তাদের শীতল উত্তরে গুহার বাইরে তখন প্রবল বাতাসের দৌরাত্ম। ক্ষ্যাপা বাতাস চারপাশে হাঁটছে, কথা বলছে আপনমনে। এরমাঝে উষ্ণতার উৎস কিংবা আশ্রয় বলতে তো এক আগুনই।

চোখ দুটো তখনো আগুনের দিকে, ওভাবেই একটুখানি সামনে ঝুঁকে এলো এমলিন ম্যাকক্যারন। ফলে হাত দুটো উরুর উপর জায়গা করে নিল। আঙুলগুলো একে অন্যকে জাপটে ধরে আছে, ওভাবেই ঝুলে রইলো হাঁটুদুটোর মাঝে। আর ম্যাকক্যারন গল্প বলতে শুরু করল-দ্য ব্রিদিং মেথড।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *