৪.৬ চুড়ান্ত বিজয়

২৬. চুড়ান্ত বিজয়

হুমায়ুনের নিয়ন্ত্রক তাবুর বাইরে ইতিমধ্যে সৃষ্ট জলভর্তি পানির বড়বড় সব ডোবায় আবারও সীসার মতো আকাশের বুক থেকে বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা অঝোরধারায় ঝরতে শুরু করে। যুদ্ধের জন্য আহবান করা পরামর্শ সভায় তার সাথে যোগ দেবার জন্য সে যখন তাঁর সেনাপতিদের আগমনের জন্য অপেক্ষা করছে তখন সে তাবুর কানাতের উপর অঝোরে ঝরতে থাকা বৃষ্টির পানির নীচে দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখে তাঁর শিবিরের নীচু আর কর্দমাক্ত কিছু এলাকায় পানি জমে সৃষ্ট এইসব ডোবাগুলো পরস্পরের সাথে মিলিত হয়ে জলাশয়ের আকার ধারণ করেছে। পাহারার দায়িত্বে নিয়োজিত তার সৈন্যদের পায়ের পাতা পানিতে পুরোপুরি ডুবে রয়েছে যারা তাদের কাঁধের মাঝে মাথা কুঁজো করে রেখে পায়চারি করার সময় অনবরত পানি ছিটিয়ে চলেছে। সে যেদিকেই তাকিয়ে দেখুক না কেন আকাশের কোথাও বৃষ্টি থামবার কোনো লক্ষণ তার চোখে পড়ে না।

হুমায়ুন ঘুরে দাঁড়িয়ে তাবুতে ফিরে আসে, যেখানে তাঁর সেনাপতিরা ইতিমধ্যে অর্ধবৃত্তাকারে সমবেত হয়েছে, তাঁদের অনেকেই তাঁর তাবুর উল্টোপাশে অবস্থিত নিজেদের তাবু থেকে সামান্য এই দূরত্বটুকু দৌড়ে অতিক্রম করার সময় বৃষ্টিতে একদম কাকভেজা করে ভিজে গিয়ে তখনও কাপড় থেকে বৃষ্টির পানি ঝেরে ফেলার জন্য চেষ্টা করছে। হুমায়ুন আকবরকে পাশে নিয়ে কেন্দ্রে তাঁর নির্ধারিত স্থানে আসন গ্রহণ করে।

আহমেদ খান, সেকান্দার শাহের সেনাবাহিনীর সর্বশেষ অবস্থান সম্পর্কে। আমরা নতুন আর কি জানতে পেরেছি?

শিরহিন্দে নিজের সুরক্ষিত অবস্থানের প্রায় ছয় মাইল ভেতরে সে রয়েছে, আমরা এখানে এসে শিবির স্থাপন করার পূর্বে তাঁর অবস্থান অভিমুখে অগ্রসর হবার সময়ে পক্ষকালব্যাপী সে ঠিক যা করে আসছিল। তাঁর গুপ্তদূত যাদের আমরা সাথে আমাদের মোকাবেলা হয়েছে বা যাদের আমরা বন্দি করেছি তাদের সংখ্যা থেকে আমরা জানতে পেরেছি যে তিনি আমাদের অগ্রসর হবার বিষয়ে অনেক পূর্বে থেকেই অবগত ছিলেন কিন্তু তারপরেও আমাদের মোকাবেলা করার কোনো প্রয়াসই তিনি গ্রহণ করেননি। সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে তিনি এখনও দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন যে চারদিকে কাদা থাকায় আমাদের চলাফেরার গতি শ্লথ হয়ে গিয়ে তার তবকি আর তীরন্দাজদের আর সেই সাথে তার নিখুঁতভাবে সুরক্ষিত কামানের সহজ নিশানায় পরিণত হবার ভয়ে আমরা বর্ষাকালে আক্রমণ করার মতো হঠকারিতা দেখাব না।

আমি আমাদের আক্রমণ গত সপ্তাহ পর্যন্ত বিলম্বিত করেছি, এই ভ্রান্ত বিশ্বাসটা সিকান্দার শাহকে বিশ্বাস করার জন্য উৎসাহিত করতে, তাঁকে নিশ্চিত করতে চেষ্টা করেছি যে তাঁর মতোই আমরাও সনাতনধারায় বিশ্বাসী এবং আমরা সতর্ক থাকবে এবং সেই সাথে তাঁর অবস্থানের কাছাকাছি পৌঁছাবার পরে বৃষ্টি বন্ধ হয়ে মাটি আবারও শক্ত হয়ে উঠা পর্যন্ত আমরা যেকোনো যুদ্ধের সম্ভাবনা নাকচ করে দেব।

কিন্তু সুলতান, তাঁর বিশ্বাসটাও একেবারে উড়িয়ে দেয়া যাবে না, জাহিদ বেগ জানতে চায়, তাঁর কৃশকায় মুখাবয়বে স্পষ্টতই গভীর উদ্বেগের চিহ্ন প্রকাশিত। আমরা আমাদের কামানগুলো একেবারে স্থানান্তরিক করতে পারছি না আর আমাদের মাস্কেটের বারুদ সবসময়ে স্যাঁতসেঁতে হয়ে পড়ছে। আমাদের লোকেরা অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে আগুনের কাছে বারুদ নিয়ে গিয়ে শুকাবার চেষ্টা করায় ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার তাঁরা দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে।

আমরা আক্রমণ যখন করবো তখন অবশ্যই কিছু সমস্যার সম্মুখীন হবো, হুমায়ুন বলে, কিন্তু বিহ্বল করে দেয়ার ফলে আমরা যেসব সুবিধা লাভ করবো তার সাথে তুলনায় অসুবিধাগুলো ধর্তব্যের ভিতরেই পড়বে না।

বৈরাম খান সম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে কিন্তু অন্যান্যদের তখনও সন্দিহান দেখায়। আকবর সহসা, এতক্ষণ সে যেখানে বসে ছিল সেখান থেকে উঠে দাঁড়ায়, সে সাধারণত মনোযোগ দিয়ে আলোচনা শুনে থাকে কদাচিৎ কথা বলে, এবং সংযত আর সংকল্পবদ্ধ স্বরে বলতে শুরু করে, আব্বাজান আমার বিশ্বাস আপনি ঠিকই বলেছেন। নিজেদের নিয়তিকে হাসিল করার আর আরও অধিক সংখ্যক সৈন্য সংগ্রহে সফল হবার পূর্বেই সিকান্দার শাহকে চমকে দেয়ার এটাই উপযুক্ত সময়। আমাদের চেয়ে সৈন্য সংগ্রহের জন্য তার অনেক বিশাল ক্ষেত্র রয়েছে।

আকবর, দারুণ কথা বলেছো, হুমায়ুন বলে। আমি আহমেদ খানকে বলবো গুপ্তদূত প্রেরণ করে এই মুহূর্তে সিকান্দার শাহের শিবিরে পৌঁছাবার সবচেয়ে শক্ত পথটা খুঁজে বের করতে। আমার মনে হয় এখান থেকে উত্তরপূর্ব দিকে সামান্য উঁচু জমিটার উপরে কোথাও আমরা সেটা খুঁজে পাব। আমরা যদি ঐ দিকে যাই তাহলে আমাদের হয়ত মাইলখানেকের মতো ঘুরে যেতে হবে কিন্তু সেটা করলে আখেরে আমাদের লাভই হবে। আমরা আমাদের কামানগুলোকে সামনে স্থানান্তরিত করার চেষ্টা করবো না কিন্তু আমাদের সাথে অশ্বারোহী তবকিদের একটা বাহিনী থাকবে। ভেজা আবহাওয়ার কারণে যদি তাদের সামান্য সংখ্যক বন্দুকই হয়ত গুলিবর্ষণের উপযোগী প্রতিয়মান হবে কিন্তু সেটাই আমাদের সাহায্য করবে।

কিন্তু আমরা যদি ঐ পথ দিয়ে যাই তাহলে দূর থেকে আমাদের দেখা যাবে আর সিকান্দার শাহ যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়ার পর্যাপ্ত সময় পাবে, নাদিম খাজা হঠাৎ কথা বলে উঠে।

আমি সেটা নিয়েও চিন্তা ভাবনা করেছি। আমাদের গতিবিধি লুকিয়ে রাখতে আর চমকের মাত্রা বৃদ্ধি করতে, আমার ইচ্ছা আগামীকাল ভোর হবার ঠিক আগ মুহূর্তে অন্ধকারের আড়াল ব্যবহার করে আক্রমণ করা। আমরা আজ যতটা নিভৃতে সম্ভব আমাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করবো এবং আগামীকাল সকাল ঠিক তিনটায় সৈন্যদের ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে ভোর হবার ঠিক এক ঘন্টা আগে আমরা অগ্রসর হতে শুরু করবো। আমরা পাঁচশত লোকের পৃথক দলে বিভক্ত হয়ে অগ্রসর হব, অন্ধকারে যেকোনো ধরনের বিভ্রান্তির সম্ভাবনা হ্রাস করতে প্রত্যেকের বাহুতে উজ্জ্বল রঙের একখণ্ড কাপড় বাঁধা থাকবে।

সুলতান, বৈরাম খান বলে, আমি আপনার পরিকল্পনা বুঝতে পেরেছি। আমার মনে হয় আমাদের সৈন্যরা এই পরিকল্পনা সফল করার মতো শৃঙ্খলাবোধের পরিচয় দেবে, তাদের নেতাদের উপর তারা ভরসা রাখবে।

আমি সন্ধ্যার দিকে আকবরকে সাথে নিয়ে সৈন্যদের মাঝে উপস্থিত হতে চাই তাঁদের উৎসাহিত করতে এবং আমার পরিকল্পনার কথা তাদের জানাতে আর সেটাকে সফল করতে পরিকল্পনা আর সেই সাথে তাদের উপর আমার যথাযথ আস্থা রয়েছে।

দিনের বেলা বৃষ্টির বেগ সামান্য হ্রাস পায় কিন্তু আকবর, আহমেদ খান আর বৈরাম খানকে পাশে নিয়ে হুমায়ুন যখন ঘোড়ায় চেপে বৈরাম খানের অশ্বারোহী যোদ্ধাদের যাদের বেশীরভাগই বাদখশানের লোক- অবস্থানের জন্য নির্ধারিত তাবুর দিকে এগিয়ে যায় তখন দিগন্তের উপরের আকাশে আবারও কালো মেঘের আনাগোনা শুরু হয়েছে। হুমায়ুন এই দলটার উদ্দেশ্যে ইচ্ছাকৃতভাবেই সবার শেষে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে তার বিশাল কালো ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে দাঁড়ায় এবং বাদশানিরা তার চারপাশে সমবেত হলে সে শুরু করে।

আমার আব্বাজানকে তোমাদের পিতারা দারুণ সহায়তা করেছিল তিনি যখন তাঁর সাম্রাজ্য জয় করেছিলেন। লোভী ভুইফোড়দের কারণে হাতছাড়া হয়ে যাওয়া ভূখণ্ড উদ্ধারের এই অভিযানে তোমরাও আমাকে দারুন সহায়তা করেছে। আগামীকাল তোমরা আমার সাথে সম্মুখের কাতারে অবস্থান করবে। আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এখন পর্যন্ত আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হব। আমরা যখন বিজয়ী হব, আমার বিশ্বাস আমরা হবই, আমরা আবার হিন্দুস্তানের অধিকারী হব এবং আমাদের সন্তানের জন্য এর উর্বর জমি নিশঙ্ক করবো।

হুমায়ুন চুপ করে থেকে পুনরায় কথা শুরু করার আগে এক হাতে আকবরের কাঁধ জড়িয়ে ধরে। আমি জানি যে তোমাদের সন্তানেরা এখানে যেমন কিশোর আকবর দাঁড়িয়ে রয়েছে। আমরা তাদের জন্য যে সম্পত্তি অর্জন করবে তারা সেটার যোগ্য হয়ে উঠবে। একটা কথা মনে রেখে আগামীকাল আমরা তাদের ভবিষ্যতের সাথে সাথে আমাদের নিজেদের ভবিষ্যতের জন্যও লড়াইয়ে অবতীর্ণ হব। এসো আমরা আমাদের নিয়তিকে অধিগ্রহণ করি। এসো আমরা এমন বীরত্ব প্রদর্শন করি আর এর বরাভয়ে এমন বিজয় অর্জন করি যেন আমাদের নাতিরা এবং তাঁদের সন্তানেরা আমাদের অর্জন সম্বন্ধে কথা বলার সময় তাঁদের কণ্ঠে সম্ভ্রম আর কৃতজ্ঞতা ফুটে উঠে, ঠিক যেভাবে আমরা তৈমূর আর তার লোকদের রূপকথার মতো অর্জন সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করি।

হুমায়ুনের কথা শেষ হবার সাথে সাথে বাদশানিদের ভিতর থেকে একটা উৎফুল্ল চিৎকার ভেসে আসে। শিবিরে তাঁর এই ঘুরে বেড়াবার সময় অন্য লোকদের উদ্দেশ্যে তার বাক্যচয়ন যেমন কাজ করেছে ঠিক সেভাবেই, তার কথাগুলো একেবারে ঠিক তন্ত্রীতে সুর তুলতে সক্ষম হয়েছে।

*

জওহর সকাল দুইটার দিকে সন্তর্পণে হুমায়ুনের তাবুতে প্রবেশ করে তাঁকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলতে কিন্তু সে এসে দেখে যে হুমায়ুন ইতিমধ্যেই জেগে গিয়েছে। বেশ কিছুক্ষণ আগেই তার ঘুম ভেঙেছে। তাঁর তাবুর উপরে একঘেয়ে সুরে পড়তে থাকা বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে সে মনে মনে যুদ্ধের পরিকল্পনাটা বার বার খুটিয়ে দেখে আগে যদি কিছু তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়ে থাকে সেটা খুঁজে দেখতে। একটা সময় সে নিজেকে নিশ্চিত করে যে কোনো কিছুই তার দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি।

তার ভাবনার গতিপথ এরপরে অনিচ্ছাকৃতভাবেই সতের বছর পূর্বে শেরশাহকে মোকাবেলার জন্য প্রথমবারের মতো আগ্রা ত্যাগ করার পরে তাঁর জীবনের ঘটনাবলীর দিকে ধাবিত হয়। সেই সময়ে- সে এখন অনুধাবন করে- সে অনেক অপরিণত ছিল, বিশ্বাস করতে মুখিয়ে ছিল যে সাফল্যে তার ন্যায়সঙ্গত অধিকার এবং সেই কারণে সাফল্য অর্জনের জন্য নিজের ভিতরের সবশক্তি প্রয়োগে যথেষ্ট প্রণোদনা ছিল না। সে অবশ্য কখনও নিজের এবং নিজের নিয়তির উপর বিশ্বাস হারায়নি এবং কোনো বিপর্যয় যতই ভয়ঙ্কর হোক তাঁর মাত্রা কখনও বিশ্বাস করেনি যে তার চূড়ান্ত পরাজয় ঘটেছে। সে ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ যে দ্বিতীয় একটা সুযোগ পেয়েছে এবং এজন্য সে জানে জন্মে সময় তাঁর নাম হুমায়ুন সৌভাগ্যবান রাখা হয়েছিল। অসংখ্য মানুষ। এমনকি রাজারাও একবারই মাত্র সুযোগ লাভ করে এবং তারা যদি সেটা গ্রহণ না করে তাহলে ইতিহাসের গর্ভে তারা এমনভাবে হারিয়ে যায় যেন তাদের কোনো অস্তিত্বই ছিল না, তাঁদের সমস্ত প্রতিশ্রুতি, তাঁদের সমস্ত আশা আর আকাঙ্খা সবই অনন্ত বিস্মরণের আবর্তে হারিয়ে যায়। সে তার রাজত্বকালে একটা বিষয় ভালোভাবে শিখেছে যে যুদ্ধক্ষেত্রে সাহসিকতার ন্যায় সবসময়ে একটা অদম্য মনোভাব পোষণ করাটা শাসকের জন্য অতীব জরুরী। আজ, অবশ্য যুদ্ধের দিন এবং সে জানে তাকে আরো একবার নিজের সাহসিকতার পরীক্ষা দিতে হবে।

ভাবনাটা মাথায় আসবার সাথে সাথে, সে যুদ্ধের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে শুরু করে, এই কাজটা যেটায় জওহর এখন তাকে সাহায্য করছে তাকে তার হাঁটু পর্যন্ত লম্বা হলুদ বুট জুতা পরতে এবং সেই সাথে হুমায়ুনের রত্নখচিত, কারুকার্যময় ইস্পাতের বর্মস্থল আবরণকারী বর্মের বাঁধনগুলো আটকে দেয়- এই কাজগুলো তাঁরা তাঁদের অল্প বয়স থেকে একত্রে করে আসছে। জওহর অবশেষে যখন তার আব্বাজানের মহান তরবারি আলমগীর তার হাতে তুলে দেয়, হুমায়ুন তার দিকে তাকিয়ে হাসে এবং তার বাহু স্পর্শ করে বলে, আমার বিপদের সময়ে তোমার অনুগত সেবার জন্য তোমায় ধন্যবাদ। আমরা শীঘ্রই আগ্রায় আমাদের মনোরম আবাসন কক্ষে ফিরে যাব।

সুলতান, সেটা নিয়ে আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই, জওহর, তাবুর পর্দা তুলে ধরে হুমায়ুনকে বাইরে রাতের ভেজা বাতাসে বের হবার পথ করে দেয়ার ফাঁকে, কথাটা বলে।

আকবর বাইরে তার আব্বাজানের জন্য অপেক্ষা করছিল এবং তারা পরস্পরকে আলিঙ্গণ করে। আকবর তারপরে জানতে চায়, আমি কি আক্রমণে যোগ দিতে পারি না? আমার দুধ-ভাই আধম খানের সৌভাগ্য দেখে আমি ঈর্ষান্বিত যে আক্রমণকারী দলের পুরোভাগে অবস্থান করবে। প্রশিক্ষকের নিকটর যখন আবার আমাদের দেখা হবে যে যুদ্ধে নিজের অংশগ্রহণের বিষয়ে বড়াই করবে যখন আমি…

না, তুমি আমাদের রাজবংশের ভবিষ্যত, হুমায়ুন কথার মাঝে তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলে। আল্লাহ না করুন, যুদ্ধক্ষেত্রে আধম খানের মৃত্যু হলে মাহাম আগা তাঁর জন্য কাঁদবে কিন্তু তাঁর মৃত্যুটা হবে একান্তভাবে তাঁর পরিবারের ব্যাপার। আমি আর তুমি যদি একসাথে যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হই তাহলে আমাদের বংশই নির্বংশ হয়ে যাবে। আমি সেটা ঘটতে দেবার ঝুঁকি নিতে পারি না তাই তুমি অবশ্যই পেছনে অবস্থান করবে।

হুমায়ুন বুঝতে পারে আকবরের যুদ্ধক্ষেত্রে যাবার অনুমতি চাওয়া সময়ে তাঁর কণ্ঠে প্রত্যাশার চেয়ে আশার আধিক্য ছিল আর ব্যাপারটা সে মনে মনে প্রশংসা না করে পারে না। আকবরের কাছ থেকে সে খানিকটা দূরে বৈরাম খান আর তার অন্যান্য সেনাপতিরা যে নিম গাছের নীচে দাঁড়িয়ে তার প্রতীক্ষা করছে সেদিকে হেঁটে এগিয়ে যাবার সময় আকাশ ক্রমাগত আলোকিত করতে থাকা বিদ্যুচ্চমকের ফলে চারপাশ আলোকিত করা অশরীরি আলোয় সে দেখে যে কয়েক গজ দূরে বৈরাম খানের তরুণ কৰ্চি- তাঁর সহকারী বৃষ্টিতে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার কারণে নিজের আর তার প্রভুর ঘোড়ার লাগাম ধরে দাঁড়িয়ে থাকার সময়ে নুয়ে রয়েছে। হুমায়ুন ঘুরে গিয়ে তাঁর দিকে এগিয়ে যায়। তাঁকে এগিয়ে আসতে দেখে তরুণ সহকারী প্রাণপন চেষ্টায় সোজা হয়ে দাঁড়ায় এবং একটা রুমাল দিয়ে মুখটা মোছে।

তুমি কি সন্ত্রস্ত, .. বা সামান্য ভীত? হুমায়ুন জিজ্ঞেস করে।

সুলতান, বোধ হয় দুটোই, তরুণ সহকারী, যার মুখের মসৃণ ত্বক দেখে বোঝা যায় তার বয়স আকবরের সামনই হবে, অপ্রস্তুত হয়ে বলে।

সেটাই স্বাভাবিক, হুমায়ুন তাকে আশ্বস্ত করে। কিন্তু পানিপথের যুদ্ধের আগে আমার আব্বাজান আমাকে একটা কথা বলেছিলেন, সেটা সবসময়ে মনে রাখতে চেষ্টা করবে। ভয় পাওয়া সত্ত্বেও ঘোড়া নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করাই সত্যিকারের সাহসিকতার পরিচায়ক।

জ্বী, সুলতান। আমি আপনাকে বা বৈরাম খানকে আশাহত করবো না।

 আমি জানি সেটা তুমি করবে না।

এক ঘন্টা পরে- ইতিমধ্যে নাটকীয়ভাবে আবহাওয়া আরো খারাপ হয়ে উঠেছে- হুমায়ুন আর তাঁর বাদশানি অশ্বারোহীদের প্রথম দলটা যাত্রাবিরতি করে। সিকান্দার শাহের ছাউনিতে তাদের চূড়ান্ত আক্রমণ শুরু করার জন্য আহমেদ খান সাফল্যের সাথে যে উত্তরপূর্বমুখী বৃত্তাকার কিন্তু আপাত কঠিন মাটির পথটা খুঁজে বের করেছেন সেটা অনুসরণ করার জন্য নির্ধারিত স্থানে তারা পৌঁছে গিয়েছে। বৃষ্টি এখন আগের চেয়েও জোরাল আর মুষলধারে পড়তে থাকায় অন্ধকারে যতটুকুও দেখা যাচ্ছিল এখন সেটা আরও হ্রাস পেয়েছে। এমনকি বিদ্যুৎ চমকের ফলে সৃষ্ট আলোকছটায় হুমায়ুন আর তাঁর লোকদের বৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা দৃষ্টির সামনে বৃষ্টির ফোঁটাগুলিকে রূপালি আর ইস্পাতের মতো দেখায়। মাথার উপরে দূরাগত বজ্রপাতের শব্দ প্রায় অবিরতভাবে ভেসে আসতে থাকে। হিমশীতল সন্তুষ্টির সাথে হুমায়ুন ভাবে যে প্রকৃতির উপাদানগুলিও তাঁর উদ্দেশ্যের সাথে সংহতি প্রকাশ করছে। তার দৃষ্টিকোণ থেকে আবহাওয়ার পরিবর্তন পরিস্থিতি মোটেই খারাপ না করে বরং উন্নতই করেছে। তারা যখন সিকান্দার শাহের বাহিনীর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে তখন সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে শত্রুপক্ষ আগে থেকে তাঁদের অগ্রগতির কোনো শব্দ শুনতে বা তাঁদের চোখে দেখতে পাবে।

কয়েক মিনিট পূর্বে, অঝোর বৃষ্টির ভিতরে আহমেদ খান তাঁর সাথে দেখা করতে এসেছিল। তার শিরোস্ত্রাণের নীচে দিয়ে ইঁদুরের লেজের মতো ভেজা চুল বের হয়ে রয়েছে যেখানে এখন মাঝে মাঝেই ধুসরের আভা দৃশ্যমান এবং মুখ অসংখ্য বলীরেখায় বিদীর্ণ কিন্তু তাঁর মুখের হাসি আগের মতো প্রশস্ত আর প্রাণবন্ত ঠিক যেমন ছিল চম্পনীরের গুজরাতি দূর্গে আক্রমণের উদ্দেশ্যে তারা যখন একত্রে উঁচু পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উপরে উঠছিল।

সুলতান, আমরা দিনের আলোয় সিকান্দার শাহের শিবিরে এই পথ দিয়ে অগ্রসর হবার ক্ষেত্রে অবস্থিত একমাত্র যে পাহারাচৌকি সনাক্ত করেছিলাম সেটা আমরা দখল করে নিয়েছি। আমার ত্রিশজন যোদ্ধা নিরবে গুঁড়ি মেরে চৌকির চারপাশে অবস্থিত নীচু দেয়াল যা বৃষ্টির তোড়ে ভেঙে পড়ছিল সেটার এক অংশ দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। তারা ভিতরে প্রবেশ করেই সময়ক্ষেপন না করে দ্রুত ছাউনির দিকে দৌড়ে যায়, যেখানে জনা বারো সৈন্য অবস্থান করছিল সবাই ঘুমন্ত, এবং দ্রুত আর নিরবে তাঁদের গলা দ্বিখণ্ডিত করা হয় বা পাতলা দড়ি দিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করা হয়। মূল শিবিরকে হুশিয়ার করার জন্য একজনও পালাতে পারেনি। এমনকি কেউ কোনো শব্দও করতে পারেনি।

আহমেদ খান বরাবরের মতোই আপনি দারুণ কাজ করেছেন, হুমায়ুন বলে এবং আহমেদ খান সেকান্দার শাহের শিবির অভিমুখে নিরবে আরো অধিক সংখ্যক গুপ্তদূত প্রেরণ করার অভিপ্রায়ে বিদায় নেয়। তাদের একমাত্র কাজ এখন এই পরিস্থিতিতে হুমায়ুনের বর্তমান অবস্থান আর সিকান্দার শাহের শিবিরের মধ্যবর্তী ভয়ঙ্কর কাদার অবস্থানগুলো এড়িয়ে যাওয়ার পথ খুঁজে বের করা যা অন্ধকারের ভিতরে মুখ ব্যাদান করে সামনের এক মাইলের ভিতরে রয়েছে যাতে করে হুমায়ুনের আক্রমণকারী বাহিনী সেগুলোয় আটকে না গিয়ে এড়িয়ে যেতে পারে।

হুমায়ুন নিজের নিয়তি নির্ধারক যুদ্ধ শুরু করতে অধীর হয়ে উঠে, সে জানে গুপ্তদূতদের কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং তাদের কাজ থেকে পুরো বিবরণ না পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। সে যাই হোক, দূরতুটা অনেক কম বলে আশা করা যায় তারা অচিরেই ফিরে আসবে। অপেক্ষার সময়টা হুমায়ুনের কাছে এক যুগের সমতুল্য মনে হলেও আসলে সোয়া এক ঘন্টা মাত্র অতিক্রান্ত হয়েছে- এমন সময় আহমেদ খান তার ছয়জন গুপ্তদুতদের নিয়ে আবার হাজির হয়, সবাই তাঁর মতোই বৃষ্টিতে ভেজা আর কাদায় মাখামাখি অবস্থা। আহমেদ খান কথা শুরু করে।

আমাদের অভিযানের গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে আমি এইসব সাহসী লোকদের সাথে নিজেই সামনে এগিয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের কেউ দেখতে পায়নি। আমরা বর্শা দিয়ে মাটি কতখানি শক্ত আর কাদার গভীরতা পরখ করেছি। আমরা দেখেছি যে আমরা যদি এখান থেকে সরাসরি সোজা এগিয়ে যাই তাহলে বিশাল কর্দমাক্ত এলাকায় ভিতরে গিয়ে উপস্থিত হব, যা আমাদের অগ্রসর হবার গতি শ্লথ করে দিতে পারে, এমনকি আমাদের বেশ কিছু ঘোড়া কাদায় পুরোপুরি আটকে যাওয়ায় বিচিত্র হবে না। অবশ্য আমরা যদি অর্ধবৃত্তাকারে ডানদিক দিয়ে এগিয়ে যাই তাহলেও আমাদের ভীষণ কর্দমাক্ত এলাকার উপর দিয়ে যেতে হবে কিন্তু সরাসরি এগিয়ে যাবার চেয়ে সেটা অনেক ভালো। আমরা মাটির অবরোধকের কাছে পৌঁছে যাব যা সিকান্দার শাহ তাঁর শিবিরের উত্তরপার্শ্বে নির্মাণ করেছেন। অবরোধকটা এখানে এক মানুষের চেয়ে বেশী উঁচু। আমাদের হয়ত মই ব্যবহার করতে হতে পারে যা আপনি আগেই সাথে করে নিয়ে আসবার আদেশ দিয়েছেন।

আহমেদ খান, আপনাকে ধন্যবাদ। জওহর, বৈরাম খানকে তাঁর অগ্রবর্তী সেনাদের ভেতর থেকে কয়েক জোড়া অশ্বারোহীকে মনোনীত করতে বলে দাও, যাঁরা প্রত্যেকে নিজেদের ঘোড়ার মাঝে মই ঝুলিয়ে নিয়ে বহন করবে যেগুলো আমরা এতদূর মালবাহী প্রাণীর পিঠে করে এতোদূর বয়ে নিয়ে এসেছি। তিনি প্রস্তুত হওয়া মাত্র তাঁকে বলবে আমাকে জানাতে এবং আমি নিজে তার সাথে অগ্রবর্তী বাহিনীর সাথে যোগ দেব।

জওহর আদেশ নিয়ে রওয়ানা দেয় এবং হুমায়ুন বিদ্যুৎচমকের ভিতরে কোনমতে বৈরাম খানের যযাদ্ধাদের যুদ্ধের বিন্যাসে বিন্যস্ত হতে দেখে। যুদ্ধ এখন আসন্ন হয়ে উঠায়, হুমায়ুন অনুভব করে তার ভিতরে কোনো ভয় কাজ করছে না কেবল তার অনুভূতিগুলো যেন অতিমাত্রায় সজাগ হয়ে উঠেছে যা প্রতিটা মুহূর্তকে একটা মিনিটের, একেকটা মিনিটকে এক ঘন্টার দ্যোতনা দান করেছে এবং তার দৃষ্টিশক্তিও যেন প্রখর হয়ে উঠেছে যার ফলে জওহর তাঁর কাছে এসে বৈরাম খানের প্রস্তুতির কথা তাঁকে বলার পূর্বেই যেন গাঢ় অন্ধকারের ভিতরে সে দেখতে পায় বৈরাম খান তার উদ্দেশ্যে ইশারা করছে।

হুমায়ুন তার হাতের চামড়ার দাস্তানা আরেকবার ভালোকরে টেনে নেয় এবং সহজাত প্রবৃত্তির বশে তার পাশে রত্নখচিত ময়ানে আবদ্ধ অবস্থায় ঝুলন্ত তার আব্বাজানের তরবারি আলমগীর স্পর্শ করে। সে তারপরে রেকাবে তার পদযুগল ভালোকরে পুনরায় ভালো করে স্থাপন করে যাতে সেগুলো পিছলে না যায় এবং অবশেষে নিজের বিশাল কালো ঘোড়ার পাজরে গুঁতো দিয়ে আহমেদ খানের সাথে যেখানে বৈরাম খান অপেক্ষা করছে সেদিকে এগিয়ে যায়। আহমেদ খান তাঁর ছয়জন গুপ্তদূতের সাথে নিজে আক্রমণের নেতৃত্ব দেবেন যারা আগেই তথ্যানুসন্ধানী অভিযানে অংশ নিয়েছিল। পথ প্রদর্শক দলের প্রত্যেকের সাদা সুতির কাপড় জড়ান রয়েছে যাতে করে আলো আধারির মাঝে তাদের সহজেই অনুসরণ করা যায়।

আল্লাহ আমাদের সহায় হোন, হুমায়ুন বলে। আহমেদ খান, আল্লাহর নামে যাত্রা শুরু করেন।

আহমেদ খান কেবল মাথা নাড়ে এবং সামনে এগিয়ে যায়। অন্য ছয়জন গুপ্তদূত দ্রুত তাকে অনুসরণ করে তারপরেই থাকে বৈরাম খান আর তার তরুণ সহকারী কর্চি তাঁর অল্পবয়সী মুখে আগের চেয়ে এখন দৃঢ় আর প্রতিজ্ঞবদ্ধ অভিব্যক্তি ফুটে থাকায় তাকে এখন পুরোপুরি প্রস্তুত দেখায়। হুমায়ুনও ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে তাঁদের সাথে গাঢ় অন্ধকার আর বৃষ্টির ভিতর দিয়ে সিকান্দার শাহের শিবিরের দিকে এগিয়ে যায়।

পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে তারা অর্ধবল্পিত বেগের চেয়ে দ্রুত গতিতে ঘোড়া ছোটাতে পারে না। ঘোড়ার খুরের সাথে এরপরেও কাদামাটির বিশাল চাই আর পানি শূন্যে নিক্ষিপ্ত হতে থাকে এবং পেছনের অনুসরণকারীদের মাখামাখি করে দেয়। তারা রওয়ানা দেবার পরে দুই কি তিন মিনিটও অতিবাহিত হয়নি এমন সময় আহমেদ খান নীচু বোল্ডারের একটা জটলার পাশে নিজের ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরলে হুমায়ুন তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।

সুলতান, আহমেদ খান মৃদু কণ্ঠে কথা বলতে শুরু করে, এই পাথরগুলো শেষ গুরুত্বপূর্ণ নিশানা। আমাদের ঠিক সামনে এখান থেকে প্রায় ছয়শ গজ দূরে সিকান্দার শাহের শিবিরের দেয়াল অবস্থিত।

মই বহনকারী জোড়া অশ্বারোহীদের ডেকে পাঠাও।

যূথবদ্ধ অবস্থায় অশ্বারোহীরা এগিয়ে আসলে দেখা যায় তাঁদের দুই ঘোড়ার মধ্যবর্তী স্থানে চামড়র ফালি দিয়ে বাঁধা রুক্ষ মইগুলো ঝুলছে, বৃষ্টির বেগ ধরে আসে এবং প্রায় অলৌকিক একটা ব্যাপারের মতো আকাশে মেঘের দলের মাঝে তৈরী ফাঁকে ধুসর আর পানি পানি আবহ নিয়ে চাঁদ উঠে। কয়েক মুহূর্ত পরে পুনরায় মেঘের আড়ালে চাঁদটা হারিয়ে যাবার আগে হুমায়ুন সিকান্দার শাহের শিবিরের বিরোধক দেয়ালের একটা ঝলক দেখতে পায়। আহমেদ খানের কথা অনুযায়ী দেয়ালটা প্রায় আট ফিট উঁচু হবে এবং মাটির তৈরী যা কয়েক জায়গায় মনে হয় ধ্বসে গিয়ে সেখানটায় মাটির একটা টিলার মতো রূপ নিয়েছে।

তার লোকেরা কিছুক্ষণ পরেই দেয়ালের দিকে এগিয়ে গিয়ে দ্রুত ঘোড়া থেকে নেমে মইগুলো জায়গামতো স্থাপণ করে এবং সেগুলো বেয়ে তড়বড় করে। দেয়ালের উপরে উঠে যাওয়া পর্যন্ত প্রহরীদের কোনো চিহ্ন দেখা যায় না। মাটির দেয়ালের উপর উঠেই তার লোকেরা কেউ কেউ খালি পায়ে মাটির উপর লাথি মেরে কেউবা পিঠে বেঁধে নিয়ে নিয়ে আসা কোদাল দিয়ে মাটি আলগা করতে শুরু করে। শীঘ্রই দেয়ালের প্রায় ত্রিশ ফিটের মতো জায়গা ধ্বসে গিয়ে নীচু একটা ঢিবিতে পরিণত হয় আর বৈরাম খান পেছনে অনুগত কর্চিদের নিয়ে নিরবে অশ্বারোহী যোদ্ধাদের নেতৃত্ব দিয়ে শিবিরের ভিতরে প্রবেশ করে। বৃষ্টি আবার মুষলধারে শুরু হয়েছে এবং হুমায়ুন আর তাঁর দেহরক্ষীরা দেয়ালের অবশিষ্টাংশ অতিক্রম করে ভেতরে প্রবেশ করার পরেও কোথাও কোনো হুশিয়ারির সংকেত দেখতে পায় না।

সহসা হুমায়ুনের সামনে কোথাও থেকে অবশ্য বিস্মিত চিল্কারের একটা আওয়াজ ভেসে আসে। শত্রু, হুশিয়ার! আরেকটা ক্ষীণ চিৎকারের শব্দ সামনে মাটির দেয়ালের কাছ থেকে ভেসে আসে, তারপরেই একই দিক থেকে উচ্চনাদে শিঙ্গার শব্দ শোনা যায়। প্রহরীকক্ষের কোনো তন্দ্রাচ্ছন্ন সৈন্য সম্ভবত তাঁদের চারপাশে ঘটতে থাকা বিপর্যয়ের মাঝে হয়ত জেগে উঠেছিল এবং সেই হুশিয়ারি ধ্বনিত করেছে। শিবিরের কেন্দ্রস্থল থেকে তূর্যনাদের মাধ্যমে প্রত্যুত্তর ভেসে আসতে শুরু করে।

বিস্ময়ের মেয়াদ উত্তীর্ণ হবার পরে হুমায়ুন এখন অনুভব করে যে তার এবং তার লোকদের এবার দ্রুত অগ্রসর হয়ে যদ্রুত সম্ভব শত্রুদের নিশ্চিহ্ন করতে হবে যাতে তারা অস্ত্র সজ্জিত হয়ে প্রতিরক্ষা ব্যুহ বিন্যাস করার সময় না পায়। হুমায়ুন শিবিরের কেন্দ্রস্থলের দিকে অগ্রসর হবার আদেশ দেবার জন্য বৈরাম খানের দিকে ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করতেই প্রহরীদের অবস্থানের দিক থেকে বৃষ্টির ফোঁটার সাথে তীর্যকভাবে তীরের বিশৃঙ্খলভাবে নিক্ষিপ্ত একটা ঝাঁক এসে তাঁদের অবস্থানের উপরে আছড়ে পড়ে। একটা তীর হুমায়ুনের পর্যানে বিদ্ধ হয়। আরেকটা বৈরাম খানের বক্ষস্থল রক্ষাকারী বর্মে নিরীহ ভঙ্গিতে ঠিকরে যায় কিন্তু তৃতীয় আরেকটা তীর বৈরাম খানের তরুর কচির উরুতে বিদ্ধ হয়। ছেলেটা মরীয়া ভঙ্গিতে নিজের পা খামচে ধরে এবং তার আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়তে শুরু করলে তার গলা চিরে একটা চাপা কান্নার শব্দ ভেসে আসে।

ছেলেটার ক্ষতস্থানটা শক্ত করে বেঁধে দাও, হুমায়ুন চিৎকার করে বলে। তাকে দ্রুত আমাদের শিবিরের হেকিমের কাছে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা কর। সে অল্পবয়সী আর দারুণ সাহসী। তার বেঁচে থাকার একটা সুযোগ পাওয়া উচিত। হুমায়ুনের দেহরক্ষীদের একজন দ্রুত এগিয়ে যায় তাঁর আদেশ পালন করতে।

আরেক পশলা তীর এসে আছড়ে পড়ে কিন্তু এবার সংখ্যায় অনেক কম। এই দফা হতাহতের ভিতরে রয়েছে কেবল একজন অশ্বারোহীর মাদী ঘোড়া যা গলায় দুটো কালো পালকযুক্ত তীর বিদ্ধ অবস্থায় মাটিতে আছড়ে পড়ে। ঘোড়ার আরোহী, গাট্টাগোট্টা দেখতে এক তাজিক, ঘোড়াটা মাটিতে পড়ার সময় লাফিয়ে উঠে সরে যায় ঠিকই কিন্তু ভারী দেহ নিয়ে মাটিতে পরার সময় সে পিছলে গেলে তার বুকের সব বাতাস বের হয়ে যাওয়া কিছুক্ষণ মাটিতে শুয়ে থেকে তারপরে টলমল করতে করতে উঠে দাঁড়ায়।

বৈরাম খান চল্লিশজন যোদ্ধার একটা দল পাঠান এইসব তীর নিক্ষেপের অবস্থান সনাক্ত করতে এবং শত্রুপক্ষের তীরন্দাজদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে। আর বাকী যারা এখানে রয়েছে আমাকে বিজয়ের পথে অনুসরণ কর।

বৈরাম খান দ্রুত প্রহরী অবস্থানের দফারফা করতে যখন তোক বাছাই করছে হুমায়ুন সেই ফাঁকে আলমগীর ময়ান থেকে আজ রাতে প্রথমবারের মতো বের করে আনে। তরবারিটা নিজের সামনে টানটান করে ধরে রেখে আর দেহরক্ষী পরিবেষ্টিত অবস্থায় এবং মুস্তাফা আর্গুন আর তাঁর ভাড়াটে যোদ্ধাদের পেছনে নিয়ে সে তার কালো ঘোড়ার পাঁজরে গুঁতো দিয়ে কাদার উপরে যতটা জোরে তাঁকে ছোটান সম্ভব সেই গতিতে সামনের দিকে ছুটতে শুরু করে শিবিরের অভ্যন্তরভাগ তার লক্ষ্য। ইতিমধ্যে পূর্বাকাশে ভোরের পূর্বাভাষ হয়ে আলো কিঞ্চিত ফুটতে শুরু করেছে কিন্তু ঘোড়ার কাঁধের কাছে মাথা নীচু করে রেখে ধেয়ে যাবার সময়ে বৃষ্টির কারণে এখনও হুমায়ুন খুব ভালো করে চারপাশের কিছুই দেখতে পায় না। তারপরে, মিনিটখানে পরে সে তার সামনে ঘন সন্নিবদ্ধ কালো কালো তাবুর সারি দেখতে পায় এবং একই সময়ে সিকান্দার শাহর লোকেরা তাবুর ভেতর থেকে বের হয়ে এসে ময়ান থেকে অস্ত্র বের করতে শুরু করলে তাদের সম্মিলিত চিৎকারের শব্দ তার কানে ভেসে আসে।

তাবুগুলো উপরে ফেলো শত্রুদের ভেতরেই আটকে রাখতে। যারা ইতিমধ্যে বের হয়েছে তাঁদের ঘোড়ার পায়ের নীচে পিষ্ট করে দাও। নিজেই নিজের আদেশ অনুসরণ করে হুমায়ুন তার পর্যাণ থেকে সামনের দিকে ঝুঁকে আসে এবং একটা বিশালাকৃতি তাবুকে টানটান করে ধরে রাখা দড়ি লক্ষ্য করে তরবারি চালায়, যা তাসের ঘরের মতো মাটিতে দুমড়ে পড়ে যায়। তারপরে সে দ্বিতীয় আরেকটা আবছা অবয়ব লক্ষ্য করে তরবারি চালায় যে পরের তাবু থেকে বের হয়ে এসেই নিজের দুই মাথাযুক্ত ধনুকে তীর জুড়তে আরম্ভ করেছিল। হুমায়ুন টের পায় আলমগীর লোকটার অরক্ষিত বুকের মাংসের গভীরে কেটে বসে গিয়ে বেচারার হাড়ে কামড় দেয়। তীরন্দাজ লোকটা ছটফট করে উঠে এবং হুমায়ুনের আগুয়ান এক অশ্বারোহীর ঘোড়ার খুরের নীচে পিষে যায় আর ছিটকে শূন্যে ভাসে।

হুমায়ুনের অন্য সৈন্যরা তার চারপাশে ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নামতে শুরু করে আরও ভালো করে তাবু বিধ্বস্ত করে শত্রুর সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে অবতীর্ণ হতে। হুমায়ুন অচিরেই লোকদের মাটিতে গড়াতে গড়াতে কেবল একে অন্যের সাথে লড়তে আর আঘাত করা দেখতে পায়। সে তার এক যোদ্ধাকে চিনতে পারে, কোকড়ানো দাড়ির পেষলদেহী এক বাদখশানি যে প্রতিপক্ষের কাঁধের উপরে বসে মুখে একটা চওড়া হাসি নিয়ে তার মাথাটা গায়ের জোরে পেছনের দিকে টানছে। হুমায়ুন তাকিয়ে রয়েছে দেখে, সে লোকটার মাথাটা এবার সজোরে সামনে দিকে ঠেলে দিয়ে জলকাদায় ভর্তি একটা গর্তে ঠেসে ধরে। সে সেখানেই মাথাটা কয়েক মিনিট ঠেসে ধরে থাকে তারপরে প্রাণহীন দেহটা একপাশে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।

তার আরেকজন জন পায়ে দড়ি বাধা একপাল ঘোড়ার দিকে দৌড়ে গিয়ে সেগুলোর পায়ের দড়ি কাতে শুরু করে। সে তাদের পায়ের দড়ি কাটার সময়ে প্রত্যেকের পাছায় সজোরে একটা করে থাপ্পড় দিতে থাকলে ঘোড়াগুলো আবছা আলোর ভিতরে সামনের দিকে দৌড়ে হারিয়ে যায়। বেশ বেশ, হুমায়ুন মনে মনে ভাবে ঘোড়াগুলো সদ্য ঘুম ভেঙে জেগে উঠা শত্রুদের ভিতরে কেবল বিভ্রান্তি আর আতঙ্কই বাড়িয়ে তুলবে। তার সৈন্যদের আরেকজন একটা বিধ্বস্ত তাবুর বাইরে বর্শা রাখার স্থান থেকে একটা বর্শা তুলে নিয়ে সেই তাবুর ভাঁজের নীচে ধ্বস্তাধ্বস্তি করতে থাকা দুটো অবয়বকে বর্শার ফলা দিয়ে খোঁচাতে আরম্ভ করে। কাতরাতে থাকা দেহ দুটো শীঘ্রই শান্ত হয়ে যায় এবং তাবুর কাপড়ের গায়ে একটা গাঢ় দাগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।

এদিকে এসো, হুমায়ুন মুস্তাফা আর্গুনকে চিৎকার করে ডাকে, আলো ফুটতে আরম্ভ করেছে। আমরা এখন অনেক ভালোমতো দেখতে পাব এবার সিকান্দার শাহের ব্যক্তিগত আবাসন স্থান খুঁজে দেখা যেতে পারে। বৈরাম খান আপনিও আপনার লোকদের নিয়ে আমায় অনুসরণ করুন।

দ্রুত জোরাল হতে থাকা আলোর মাঝে প্রায় আধ মাইল দূরে হুমায়ুন অচিরেই একটা নীচু ঢালের উপরে একটা ফাঁকা আয়তাকার স্থানের চারপাশে বিশাল কিছু তাবুর জটলা সনাক্ত করে যেখানে- আয়তাকার স্থানের কেন্দ্রে একটা বিশাল তাবুর বাইরে একটা বিশাল নিশান ঝাণ্ডার মাথায় ভেজা আর ভারী অবস্থান ঝুলছে নিঃসন্দেহে সিকান্দার শাহর নিজস্ব তাবু। হুমায়ুন ঘোড়া নিয়ে কাছাকাছি পৌঁছাতে দেখে বেশ কিছু সংখ্যক লোক তাবুর চারপাশে জটলা করছে। তাদের অনেকেই ইতিমধ্যে বক্ষস্থল রক্ষাকারী বর্ম আর শিরোস্ত্রাণ ধারণ করেছে, অন্যেরা তাদের ঘোড়ার পিঠে পৰ্যান ছুঁড়ে দিয়ে হাত পায়ের সাহায্যে অরক্ষিত অবস্থায় কোনোমতে সেগুলোর পিঠে চড়ে বসে নিজেদের রক্ষা করতে প্রস্তুতি গ্রহণ করছে।

নিমেষ পরেই, হুমায়ুন তাবুগুলোর কোনো একটার চাঁদোয়ার নীচে থেকে মাস্কেটের কর্কশ শব্দ ভেসে আসতে শুনে- সিকান্দার শাহর অন্তত কিছু লোক নিজেদের বারুদ শুকনো রেখেছে। সে তার চোখের কোণে দেখতে পায় মুস্তাফা আগুনের একজন তূর্কী সৈন্য কপালের পাশে বুলেটের একটা ক্ষতচিহ্ন নিয়ে কোনো শব্দ না করে নিরবে পর্যান থেকে পিছলে যায়। তাঁর আতঙ্কিত ঘোড়াটা হুমায়ুনের ঘোড়ার গতিপথ রুদ্ধ করে দেয়। হুমায়ুন দ্রুত নিজের ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরলেও আতঙ্কিত জন্তুটা পেছনের দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। হুমায়ুনের তাঁর দক্ষতার পুরোটা দরকার হয় নিজেকে তাঁর বাহনের পিঠে অধিষ্ঠিত রাখতে, যখন তাঁর ঘোড়াটা পুনরায় চারপা মাটিতে রেখে দাঁড়িয়ে, একপাশে পিছলে গিয়ে অন্য অশ্বারোহীদের অগ্রগতি রুদ্ধ করলে। হুমায়ুনের বেকায়দা অবস্থা দেখে তারাও সহজাত প্রবৃত্তির বশে নিজেরাই পালাক্রমে লাগাম টেনে ধরতে শুরু করে, নিজেদের সিকান্দার শাহের লোকদের কাছে একটা লোভনীয় লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। মাস্কেটের সাদা ধধায়ায় আচ্ছাদিত একটা তাবু থেকে এক ঝাঁক তীর শূন্যে ভাসে। হুমায়ুনের বেশ কয়েকজন লোক আহত হয়। একজন হাতের তরবারি ফেলে দিয়ে কাদায় সটান আছড়ে পড়ে সেখানেই স্থির হয়ে থাকে। অন্যেরা ঘোড়ায় টিকে থাকলেও ক্ষতস্থান পরিচর্যায় সহযোদ্ধাদের কাতার থেকে পিছিয়ে পড়ে।

হুমায়ুনের সৈন্যসারির পার্শ্বদেশ থেকে প্রায় একই সাথে দুটো বিকট বিস্ফোরণের শব্দ ভেসে আসে। সে শব্দের উৎসের দিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে হুমায়ুন বুঝতে পারে যে সিকান্দার শাহের তোপচিরা তাঁদের দুটো বিশাল কামানকে কর্মক্ষম করে তুলেছে, যেখান থেকে তারা কাঠের রুক্ষ তক্তার ছাদের নীচে অবস্থান করে বৃষ্টির ছাট থেকে সুরক্ষিত অবস্থায় নিজেদের কাজ শুরু করেছে। কামানের দুটো গোলাই লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। একটা গোলা একটা কালো ঘোড়ার উদরে আঘাত করে সেটাকে মাটিতে আছড়ে ফেলে। জন্তুটা উন্মুক্ত ক্ষতস্থান থেকে নাড়িভূড়ি বের হয়ে আসা অবস্থায় টলমল করে চেষ্টা করে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াতে কিন্তু তারপরে কাদায় পিছলে গিয়ে করুণস্বরে চিহি শব্দ করতে থাকে। দ্বিতীয় কামানের গোলা আরেকটা ঘোড়ার সামনের পা উড়িয়ে নিয়ে গেলে তাগড়া জন্তুটা কুকড়ে গিয়ে মাটিতে পড়ে যায় এবং পিঠের আরোহীকে মুস্তাফা আগুনের আরেকজন যোদ্ধাকে নিজের মাথার উপর দিয়ে সামনের দিকে ছুঁড়ে ফেলে।

পুরো ব্যাপারটাই খুব দ্রুত সংঘটিত হয় এবং হুমায়ুন তাঁর নৃত্যরত ঘোড়ার উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাবার মাঝে সহসা একটা চিন্তা তাঁকে একেবারে জমিয়ে দেয়। সে হয়ত সযত্নে রচিত একটা ফাঁদে এসে নিজে ধরা দিয়েছে। সিকান্দার শাহর লোকেরা হয়ত ঘুরে এসে তাদের পিছনের রাস্তা এতক্ষণে আটকে দিয়েছে। তার নাগাল থেকে হিন্দুস্তানের সিংহাসন নিশ্চয়ই আরো একবার কেড়ে নেওয়া হবে না? না, এটা হতে পারে না… তার নিয়তি নির্ধারিতক্ষণে সে নিশ্চয়ই বিচ্যুত হবে, এই ক্ষণিকের বিশৃঙ্খলা থেকে উত্তরণের পথে সন্দেহ কোনমতেই বাধার সৃষ্টি করতে পারবে না।

দলবদ্ধ হও, জড়ো হও সবাই! আমাদের কোনমতেই আক্রমণের বেগ শ্লথ করা চলবে না, সে চিৎকার করে বলে। গাদাবন্দুকধারীরা যে তাবু থেকে গুলি বর্ষণ করছে সে তাঁর হাতের আলমগীর আন্দোলিত করে সরাসরি সেদিকে ঘোড়ার মুখ ঘোরায় এবং পুরু, পিচ্ছিল কাদার উপর দিয়ে যত দ্রুত ছোটা যায় সেজন্য প্রাণীটার পাঁচরে গুঁতো দেয়। তার দেহরক্ষীরা সাথে সাথে তাকে অনুসরণ শুরু করে। আরো কয়েকবার গাদাবন্দুকের আওয়াজ শোনা যায় এবং আরেকজন যোদ্ধা ভূপাতিত হয় কিন্তু তারপরেই হুমায়ুন শত্রু তবকিদের মাঝে গিয়ে হাজির হতে তারা তখন নিজের লম্বা নলের অস্ত্র আর সেটা ধারণকারী তেপায়া একপাশে সরিয়ে ফেলে দিয়ে পালাবার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে উঠে। হুমায়ুন আলমগীরের এককোপে একজনকে ধরাশায়ী করে কিন্তু তারপরেই সে আর তাঁর দেহরক্ষীরা শত্রুপক্ষের একদল অশ্বারোহীদের আক্রমণের মুখে পড়ে, যাদের তারা আগেই অশ্বারূঢ় হতে দেখেছিল। শক্তপোক্ত দেখতে একজন সেনাপতি বাদামী রঙের একটা ঘোড়ায় চেপে জল্লুটার মুখে হীরক দীপ্তি সরাসরি হুমায়ুনের দিকে এগিয়ে আসে, তাঁর বামহাতে ধরা বর্শার ফলা সরাসরি হুমায়ুনের বুক লক্ষ্য করে স্থির রয়েছে।

হুমায়ুন তার ঘোড়ার মুখটা মোচড় দিয়ে সরিয়ে নেয় এবং বর্শার ফলাটা তাঁর বক্ষস্থল রক্ষাকারী বর্মে আঘাত করে পিছলে গেলে সে নিজেও খানিকটা ভারসাম্য হারায়, ফলে তাঁর তরবারির ফলাও নিশানায় আঘাত হানতে ব্যর্থ হয়। উভয়েই নিজেদের ঘোড়ার লাগাম টানটান করে টেনে ধরে রেখে বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকে এবং শত্রুপক্ষের লোকটা এবার বর্শা ফেলে দিয়ে নিজের কোমর থেকে তরবারি বের করে তার দিকে এগিয়ে আসে। হুমায়ুন মাথা নীচু করে তার তরবারির বৃত্তাকার গতি এড়িয়ে যায়, তরবারির ফলা তার মাথার উপর দিয়ে বাতাস কেটে নিষ্ফল ভঙ্গিতে বের হয়ে যেতে একটা হুশ শব্দ সে শুনতে পায়। সে এবার আলমগীর নিয়ে তাঁর প্রতিপক্ষের বক্ষস্থল লক্ষ্য করে ঝাঁপিয়ে পড়ে, যা শিকলের বক্ষাবরণী দ্বারা আবৃত নেই। তরবারির ক্ষুরধার ফলা অনায়াসে নরম, চর্বিযুক্ত পেশীর গভীরে কেটে বসে যায় এবং শত্রুপক্ষের সেনাপতি তার বাদামী ঘোড়ার গলার উপরে নুয়ে পড়ে, ক্ষতস্থান থেকে অঝোরে রক্তপাত হচ্ছে, যা তাকে পিঠে নিয়ে ভিড়ের ভিতরে হারিয়ে যায়।

হুমায়ুন এবার লাল পাগড়ি পরিহিত এক যোদ্ধার দিকে মনোনিবেশ করে যাকে সে খানিকটা দূরে থেকে লড়াই পরিচালনা করতে দেখে। সে ঘোড়া নিয়ে তার দিকে এগিয়ে যেতে লোকটাকে তাঁর পর্যাণের সাথে সংযুক্ত ময়ান থেকে একটা দোধারি রণকুঠার বের করতে দেখে। সে হাতটা পেছনে নিয়ে রণকুঠারটা সরাসরি হুমায়ুনের অবস্থান লক্ষ্য করে ছুঁড়ে মারে। হুমায়ুন তাঁর বর্মাবৃত বাহু উঁচু করে নিজের মাথা বাঁচায় কিন্তু রণকুঠারের ধারাল ফলা তার বাহুতে প্রচণ্ড বেগে আঘাত হেনে পিছলে যায়। আঘাতটা এতটাই মারাত্মক যে তাঁর বর্ম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং বহুবছর আগে চসারের যুদ্ধে প্রাপ্ত আঘাতের স্থান পুনরায় উন্মুক্ত হয়ে পড়ে। উজ্জ্বল বর্ণের লাল-কমলাভ রক্ত তাঁর বাহু বেয়ে হাতে পরিহিত দাস্তানা ভিজিয়ে দেয়। হুমায়ুন বিষয়টা অগ্রাহ্য করে এবং আলমগীর তখনও শক্ত করে আকড়ে ধরে থাকে এবং প্রতিপক্ষের একজনের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় তাঁকে লক্ষ্য করে সজোরে তরবারি হাকায়, তারা এতো কাছ দিয়ে পরস্পরকে অতিক্রম করে যে দুজনে পায়ে পায়ে ধাক্কা খায়। হুমায়ুনের তরবারির আঘাত প্রতিপক্ষের লোকটার কণ্ঠার হাড়ের ঠিক উপরে সজোরে আঘাত হেনে, তাঁর কণ্ঠনালী ছিন্ন করে দেয় এবং পর্যাণ থেকে মাটিতে আছড়ে পরার আগে যতটুকু সময় তার দেহটা স্থির হয়ে ঘোড়ায় বসে থাকে ততক্ষণ ফিনকি দিয়ে তাঁর দেহের ভেতর থেকে রক্ত বাতাসে ছিটকে যেতে থাকে।

সজোরে শ্বাস নিয়ে, হুমায়ুন তার ঘোড়ার লাগাম জোরে টেনে ধরে এবং চারপাশে তাকায়। নিয়ন্ত্রক তাবুর চারপাশের সংঘটিত যুদ্ধে সে আর তার লোকেরা জয়ী হয়েছে। সে তার বামপাশে তাকিয়ে দেখে মুস্তাফা আর্গুন আর তার সাদা পাগড়ি পরিহিত যোদ্ধারা সিকান্দার শাহের একদল অশ্বারোহীকে পেছন থেকে ধাওয়া করছে, অন্যদিকে তাঁর ডানপাশে বৈরাম খানের লোকেরা যাদের ভিতরে হুমায়ুন লক্ষ্য করে আকবরের দুধ-ভাই আধম খানও রয়েছে বিশাল একটা দলকে ঘিরে ফেলেছে যারা ইতিমধ্যেই অস্ত্র নামিয়ে রাখতে শুরু করেছে।

বৈরাম খান ঘোড়া নিয়ে হুমায়ুনের কাছে এগিয়ে আসে। সুলতান, আমার অধীনস্ত সেনাপতিরা আমাকে জানিয়েছে যে আমাদের অশ্বারোহীদের বিশটা বহর সিকান্দার শাহের শিবিরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে এবং প্রতি মিনিটে আরো অধিক সংখ্যক সৈন্যদল ভিতরে অনবরত প্রবেশ করছে। আমরা আমাদের প্রতিপক্ষের যোদ্ধাদের একটা বিশাল সংখ্যাকে অস্ত্র ধারণের পূর্বেই হত্যা করেছি এবং আরো বেশী সংখ্যককে বন্দি করেছি যদিও আতঙ্কে তাঁদের অনেকেই ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে পালিয়েও গিয়েছে। আমরা ইতিমধ্যে শিবিরের তিন-চতুর্থাংশ অংশ দখল করে নিয়েছি। শত্রু সৈন্যদের একটা বিশাল অংশ অবশ্য এখনও শিবিরের দক্ষিণপশ্চিম অংশে বিপুল বিক্রমের সাথে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। আমার কিছু যোদ্ধা দাবী করেছে যে আমরা যখন প্রথম নিয়ন্ত্রক তাবু আক্রমণ করি তখন দেহরক্ষী পরিবেষ্টিত অবস্থায় একজন গুরুত্বপূর্ণ সেনাপতিকে, তাদের ধারণা লোকটা সম্ভবত সিকান্দার শাহ স্বয়ং, ঐ দিকে পালিয়ে যেতে দেখেছে।

আমরা তাহলে নিজেদের সংগঠিত করে নিয়ে সেই দিকে আক্রমণ জোরদার করি এবং সিকান্দার শাহ যদি সেখানেই আদতেই অবস্থান করে থাকে তাহলে তাঁকে বন্দি করার চেষ্টা করি। কিন্তু তার আগে আমার এই ক্ষতস্থানটা আমার গলার উত্তরীয় দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দাও, হুমায়ুন তার হাতের চামড়ার দাস্তানা খুলে রক্তাক্ত হাতটা বৈরাম খানের দিকে বাড়িয়ে দেয়। বৈরাম খান কয়েক মিনিটের ভিতরে হুমায়ুনের হাতের ক্ষতস্থান শক্ত করে কাপড় দিয়ে বেঁধে দেয়, ক্ষতস্থানটা খুব একটা গভীর না হওয়ায় রক্তপাত ইতিমধ্যে মোটামুটি বন্ধ হয়ে গিয়েছে।

হুমায়ুন আর বৈরাম খান বৃষ্টির ভিতর দিয়ে শিবিরের দক্ষিণপশ্চিম কোণে খানিকটা উঁচুনীচু ভূমির দিকে এগিয়ে যায়। কাদার ভিতরে উপড়ানো তাবু, উল্টানো হাড়িকুড়ি আর মানুষ এবং প্রাণীর মৃত, অর্ধমৃত দেহের মাঝ দিয়ে যেগুলো এখন লালবর্ণ ধারণ করেছে তারা এগিয়ে যায়। তারা ঘটনাস্থলের নিকটবর্তী হতে যুদ্ধে হৈচৈ আর চিৎকারের আওয়াজ বেড়ে যায়, মাঝে মাঝেই বন্দুকের আওয়াজ ভেসে আসে যখনই দুপক্ষের কোনো সৈন্য বৃষ্টির ভিতরে বারুদ শুকনো রাখার মতো কোনো উপযুক্ত আড়ালের পেছন থেকে বারুদের থলে খুলে বন্দুকে দ্রুততার বারুদ পূর্ণ করতে পারে।

নতুন দিনের সীসার মতো বিষণ্ণ আলো ফুটতে শুরু করায় হুমায়ুন দেখে যে সিকান্দার শাহের লোকেরা দৃঢ়সংকল্পের সাথে যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছে। তারা কয়েকটা উঁচু ঢিবির চারপাশে বেশ কিছু মালবাহী শকট উল্টে দিয়েছে, এবং তীরন্দাজ আর তবকিরা সেগুলোর সৃষ্ট আড়াল ব্যবহার করে তার পেছন থেকে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। অশ্বারোহীদের বেশ কয়েকটা দল অবরোধকের মাঝে একত্রিত হয়েছে যারা বেশ কয়েকশ গজ ব্যাপী একটা সীমানা অটুট রেখেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যে শত্রুপক্ষের বেশ কয়েক হাজার সৈন্য এখানে সমবেত হয়েছে। তার নিজের সৈন্যরা অবশ্য এদের পুরোপুরি ঘিরে রেখেছে।

বৈরাম খান আমার লোকদের সামান্য পিছিয়ে আসতে বলেন কিন্তু সিকান্দার শাহের সৈন্যরা যেন নিচ্ছিদ্রভাবে পরিবেষ্টিত থাকে। তারা যদি অস্ত্র সমর্পণ করে সিকান্দার শাহের অবস্থান আমাদের জানায় তাহলে আমরা তাদের প্রাণ বখশের একটা সুযোগ দেব।

সোয়া ঘন্টা পরে, সিকান্দার শাহের অবরোধকের ভিতরে একটা শূন্যস্থানের সৃষ্টি হয় এবং হুমায়ুনের প্রতিনিধি বাহাদুর খান নামে এক তরুণ যোদ্ধাকে সেখানে পুনরায় আবির্ভূত হয়ে হুমায়ুন তার কালো ঘোড়ায় চেপে যেখানে অপেক্ষা করছে। সেদিকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়।

সুলতনি তারা আত্মসমর্পণ করতে সম্মত হয়েছে। তারা জোর কণ্ঠে জানিয়েছে যে তাঁদের মাঝে সিকান্দার শাহ নেই এবং তিনি সত্যিই আমরা আক্রমণ শুরু করা মাত্রই দেহরক্ষী পরিবেষ্টিত অবস্থায় নিয়ন্ত্রক তাবু ত্যাগ করেছে বটে কিন্তু তিনি পলায়নের উদ্দেশ্যেই তাবু ত্যাগ করেছিলেন। নিজেকে রক্ষা করতে গিয়ে তিনি তাঁদের পরিত্যাগ করেছেন বলে তারা অভিযোগ জানিয়েছে আর এই কারণেই তারা আত্মসমর্পণের জন্য রাজি হয়েছে। তাঁর বেশ কয়েকজন সেনাপতি আমাদের সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেবার ইচ্ছা পর্যন্ত ব্যক্ত করেছে।

স্বস্তি আর আনন্দের একটা যুগপৎ ধারায় হুমায়ুন জারিত হয়। তাঁর বিজয় হয়েছে। হিন্দুস্তান পুনর্দখলের পথে শেষ বাধাটাও সে অপসারিত করেছে। অবস্থাদৃষ্টে যদি মনে হয় যে সে সিকান্দার শাহকে বন্দি করতে ব্যর্থ হয়েছে কিন্তু তারপরেও তাঁর বিজয় অভিযান সমাপ্ত হয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে সিকান্দার শাহের বিশাল বাহিনী দুই ঘন্টারও কম সময়ের ব্যবধানে পর্যদস্ত হয়েছে। যারা এখনও অক্ষত রয়েছে তারা হয় আত্মসমর্পন করেছে নতুবা পালিয়েছে। হুমায়ুন আবেগআপ্লুত ভঙ্গিতে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে কথা শুরু করে।

আমার সকল সেনাপতিকে আমি ধন্যবাদ জানাই। আমি একটা মহান বিজয় অর্জন করেছি। হিন্দুস্তান এখন রীতিমতো আমাদের আয়ত্ত্বে হলেও সময় নষ্ট করার কোনো অবকাশ নেই। প্রথমেই আমরা আমাদের আহত যোদ্ধাদের যত্ন নেব এবং তারপরে আমাদের মৃত সঙ্গীদের সমাধিস্থ করবো কিন্তু তারপরেই আর কোনভাবে কালক্ষেপন না করে আমরা বিশাল দিল্লী শহর সুরক্ষিত করার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবো।

*

দিল্লী শহরের বেলেপাথরের তৈরী বিশাল প্রতিরক্ষা দেয়ালের ঠিক বাইরে, নিজের শিবিরের কেন্দ্রে অবস্থিত তার লাল তাবুর ভিতরে পাখির কিচিরমিচির শব্দে হুমায়ুনের ঘুম ভেঙে যায়। তাকে হিন্দুস্তানের পাদিশাহ্ ঘোষণা করে, শুক্রবার জুম্মার নামাযের শেষে তাঁর নামে পঠিত খুতবা শোনার জন্য সেদিন দুপুরের পরে শহরের উঁচু তোরণদ্বারের নীচে দিয়ে তাঁর আনুষ্ঠানিকভাবে শহরে প্রবেশের কথা রয়েছে। শিরহিন্দের যুদ্ধে সে জয়লাভ করার পর বর্ষার অঝোর বৃষ্টির ভিতর দিয়ে তার বাহিনী নিয়ে যখন দ্রুত দিল্লীর দিকে অগ্রসর হয়েছে, তখন থেকে দিনগুলি দারুণ ব্যস্ততায় কেটেছে। পথে স্থানীয় শাসকেরা তড়িঘড়ি নিজেদের আনুগত্য প্রকাশের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল এবং সিংহাসনের অন্য দাবীদারদের অনুগত সৈন্যরা দল বেধে এসে আত্মসমর্পন করেছে এবং স্বেচ্ছায় হুমায়ুনের বাহিনীতে যোগ দিয়েছে।

হুমায়ুন চারদিন আগে পানিপথের যুদ্ধ সংঘটিত হবার স্থান অতিক্রম করেছে। যেখানে সে তাঁর আব্বাজানের সাথে প্রথমবারের মতো হিন্দুস্তান জয় করেছিল। উনত্রিশ বছর পরে এখনও সমভূমির উপরে বাবরের তবকিদের বন্দুকের গুলিতে মারা যাওয়া সুলতান ইব্রাহিমের অতিকায় রণহস্তীর কিছু কিছু সাদা হাড় ইতস্তত ছড়িয়ে রয়েছে।

গত সন্ধ্যায়, হুমায়ুন নিজের তাবুতে শুয়ে নিজের জীবনের সাথে তার আব্বাজানের জীবনের সাদৃশ্য আর ভিন্নতা নিয়ে চিন্তা করছিল। বর্ষাকালে রাতের বেলা এক অতর্কিত আক্রমণে সে তাঁর জীবনের প্রথম বড় যুদ্ধে শেরশাহের কাছে পরাস্ত হয়েছিল এবং সেই একই কৌশল অবলম্বন করে সে সিকান্দার শাহের বিরুদ্ধে তাঁর শেষ বড় যুদ্ধে জয়লাভ করেছে। উভয় যুদ্ধেই সে তার ডান হাতের উধ্বাংশে আঘাত পেয়েছে। সিকান্দার শাহের এবং অন্যান্য দাবীদারদের পক্ষত্যাগকারী সৈন্যদের যোগদানের কারণে তাঁর শেষ অভিযানের পরে নিজ বাহিনীর সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে ঠিক তেমনিভাবে শেরশাহের সাথে পরাজিত হবার পরে তাঁর সৈন্যরা হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল। তার সৎ-ভাইয়েরা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল এবং তার পরিবারকে হুমকি দিয়েছিল কিন্তু শেরশাহের পরিবার এই বিষয়ে তাঁকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। আদিল শাহ তাঁর পরিবারের সাথে লড়াই করেই ক্ষান্ত হয়নি নিজেকে দুগ্ধপোষ্য ভাস্তেকে, সিংহাসনের ন্যায়সঙ্গত উত্তরাধিকারীকে নিজের মায়ের সামনে, তাঁর নিজের বোনের সামনে হত্যা করেছে, যা করার পূর্বে কামরানও দ্বিতীয়বার চিন্তা করতো।

পানিপথে মোগলদের মহান বিজয়ের পরে হুমায়ুন কোহ-ই-নূর অর্জন করেছিল যা সে তার নিজের এবং তার বংশের দুর্বলতম সময়ে এর পুনরুত্থানের নিমিত্তে ব্যবহার করেছে। তার আব্বাজানের মতো সে তারুণ্যদীপ্ত বিজয়ের স্বাদ পেয়েছে কিন্তু তারপরেই বিপুল বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছে যা তার মনোবলের পরীক্ষা নিয়েছে। তার এবং তার পরিবারের জন্য পারস্যের সমর্থণ আর সেই সমর্থনের জন্য প্রয়োজনীয় ধর্মীয় আপোষ কাঙ্খিত সহযোগিতা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। বাবরের মতোই, হিন্দুস্তান দখলের পূর্বে সে কাবুলে যতটা সময় অতিবাহিত করতে চেয়েছিল তারচেয়ে বেশী সময় অতিবাহিত করতে বাধ্য হয়েছে।

তারকারাজির আবর্তনের মাঝে এসব কি আসলেই সত্যিকারের ভবিতব্য? আর যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে এসব কিভাবে সত্যি হল? ঘটনা পরম্পরা কি আসলেই অনিবার্য, পূর্বনির্ধারিত এবং কোনো মহান শক্তি কর্তৃক পরিকল্পিত, যা অর্ন্তজ্ঞানসম্পন্ন কারো জন্য তারকারাজির মাঝে পূর্বেই লিপিবদ্ধ থাকে, যেমনটা সে একদা বিশ্বাস করতো? নাকি, বিপরীতক্রমে সে তার কল্পনায় মানুষের জীবনের যে ঘটনাবলী দেখতে পায় বলে মনে করতো এবং পরিবর্তিত পৃথিবীতে এসবের একটা ছক খুঁজতে চেষ্টা করতো এবং সেই ঘটনাগুলো কি প্রেক্ষাপটের বোধগম্য সাদৃশ্য বা কোনো সমকালীনতার কারণে সংঘটিত হয়? পারিবারিক দ্বন্দ্ব কি শাসক রাজবংশগুলোর জন্য আনুষঙ্গিক হুমকি বহন করে না? বাবরের আপন সৎ-ভাই কি তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেনি এবং তৈমূরের সন্তানেরা কি তাদের পিতার উত্তরাধিকার নিয়ে বিবাদগ্রস্থ আর বিভক্ত হয়নি? স্বপক্ষ ত্যাগ কি সবসময়ে পরাজয়ের অনুবর্তী নয় এবং মহান বিজয়ের পরে চাটুকার নতুন মিত্র? তার আব্বাজানের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা লাভ এবং নিজের সংকল্পকে দৃঢ় করতে সেই শিক্ষার ব্যবহার কি তাদের দুজনের জীবনের ভিতরে সাদৃশ্যের জন্ম দেয়নি?

সে তার যৌবনে, নিয়তি নির্ধারিত ছকে বিশ্বাস করতে পছন্দ করতো। সে এমন বিশ্বাসের কারণে যেন নিজের কৃতকর্ম এবং তার ফলাফলের পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ থেকে কেমন বিরত থাকতো। তাঁর আলস্যকে এসব ধারণা প্রশ্রয় দিয়েছিল এবং তার সর্বোচ্চ অবস্থান তার ন্যায়সঙ্গত আর অলঙ্ঘনীয় এমন বালখিল্যসুলভ বিশ্বাসকে যুক্তিসঙ্গত করেছিল। কিন্তু অভিজ্ঞতা তাঁকে পরিবর্তিত করেছে এবং এখন, পরিণত বয়সে এসে সে এমন বাহ্যিক ব্যাখ্যা সাধারণত বর্জন করে এমনকি ব্যর্থতার কারণ হিসাবেও সে একে গন্য করে থাকে। একটা মানুষের জন্মের বিষয়টা যদিও ঈশ্বরের অভিপ্রায় কিন্তু সেখান থেকে নিজের জীবনকে গড়ে তোলার দায়িত্ব তাঁর নিজের উপর এবং তার দক্ষতার যথাযথ প্রয়োগের উপর নির্ভরশীল। নিয়তি নির্ধারিত থাকার কারণে সে তাঁর সাম্রাজ্য পুনরায় অর্জন করেনি বরং এটা অর্জনের জন্য সে চেষ্টা করেছে, নিজের দুর্বলতাকে জয় করেছে আর সবধরনের বিলাসিতা পরিহার করে কেবল একটা লক্ষ্যে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছে। নিজের এই ভাবনার কারণে নিজেই গর্বিত হয়ে হিন্দুস্তান বিজয়ের পরে বাবরের সংক্ষিপ্ত শাসনকালের সাথে তুলনায় নিজের শাসনকালের বিকাশ কেমন ভাবে তুলনীয় হবে ভাবতে ভাবতে হুমায়ুন ঘুমিয়ে পড়ে।

ঘুম ভেঙে উঠে সে জওহরকে ডাকার প্রস্তুতি নেবার সময় পূর্বদিনের সন্ধ্যাবেলার ভাবনাগুলো আরেকবার চিন্তা করে। সে যখন এসব ভাবছে তখন তারকারাজির একটা বইয়ের দিকে তাঁর মনোযোগ আকৃষ্ট হয়। সে মুচকি হাসে। সে এখন যদিও বিশ্বাস করে না যে তারকারাজি জীবনের সব গোপন রহস্য ধারণ করে রয়েছে, কিন্তু তাঁদের আবর্তন এবং তাঁর পেছনের কারণ আজও তার বুদ্ধিকে উদ্দীপ্ত করে। জ্যোতিষবিদ্যার আকর্ষণ তার কাছে কখনও ম্লান হবে না।

দুই ঘন্টা পরে, জওহর হুমায়ুনকে সেদিনের জন্য পরিপূর্ণভাবে সজ্জিত করার পরে তার সামনে একটা লম্বা বার্ণিশ করা আয়না ধরে যাতে হুমায়ুন নিজের রাজকীয় পরিচ্ছদ খুটিয়ে দেখতে পারে। সে আয়নায় প্রথমবার যখন সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিল ঠিক তখনকার মতোই সাতচল্লিশ বছরের একজন পুরুষের ঋজু, পেষল অবয়ব দেখতে পায় যদিও তাঁর কপালের দুপাশের চুলে হাল্কা রূপালি ঝোপ দেখা দিয়েছে এবং চোখের চারপাশে আর হাসির সময় ঠোঁটের কোণে হাল্কা বলিরেখা পড়েছে।

তার পরণে সোনার জরির কারুকার্য করা সূর্য আর নক্ষত্রখচিত আজানুলম্বিত আলখাল্লা এবং কিনারায় মূল্যবান মুক্তোখচিত একটা দুধ সাদা রঙের টিউনিক এবং একই রঙের পাতলুন। খাঁটি স্বর্ণের তৈরী একটা পরিকর তাঁর কোমরে এবং সেখানে রত্নখচিত ময়ানে ঝুলছে আলমগীর। তাঁর পায়ের রয়েছে বাদামী বর্ণের সামনের দিকটা বাঁকানো এবং তীক্ষ্ণ একটা নাগড়া এবং যার গোড়ালীর পেছনের দিকে রয়েছে সোনার জরি দিয়ে কারুকাজ করা অতিকায় তারকা। তার মাথায় রয়েছে সোনার জরি দিয়ে বোনা একটা কাপড়ের পাগড়ি যার চূড়ায় একটা ময়ূরের পালক যুক্ত রয়েছে এবং গলার সোনার উপর রুবিখচিত ভারী মালার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রুবির বলয় রয়েছে পাগড়ির মাঝামাঝি স্থানে। তৈমূরের সোনার অঙ্গুরীয় রয়েছে তাঁর তর্জনীতে এবং অন্য আঙ্গুলে পান্না আর নীলা ঝলসাচ্ছে।

জওহর, তোমাকে ধন্যবাদ; তুমি আমাকে একজন সম্রাটের তুল্য পোষাকেই সজ্জিত করেছে। আমি একটা জিনিষ শিখেছি যে শক্তিশালী আর কর্তৃত্বপরায়ণ হবার সাথে সাথে মানুষের সামনে নিজেকে সেভাবে উপস্থাপন করাটাও গুরুত্বপূর্ণ। তাদের আনুগত্য আর আত্মবিশ্বাস এর ফলে বৃদ্ধি পায়… কিন্তু এসব সাজসজ্জা এখন অনেক হয়েছে। আমার চোখেরমণি কোথায়?

বাইরে অপেক্ষা করছে।

তাকে ভেতরে আসতে বল।

আকবর কিছুক্ষণ পরেই পুরোপুরি সবুজ রঙের পোষাক পরিহিত দুজন দেহরক্ষী তাবুর সামনের পর্দা তুলে ধরলে ভেতরে প্রবেশ করে। আকবরের বয়স এখনও পুরোপুরি তের বছরও হয়নি কিন্তু এরই ভিতরে সে তাঁর আব্বাজানের মতোই লম্বা আর চওড়া কাঁধের অধিকারী হয়ে উঠেছে। তার পরণেও বেগুনী আর গোলাপী রঙের রাজকীয় সাজসজ্জা যা তার তারুণ্যদীপ্ত পেষল অভিব্যক্তিই যেন ঘোষণা করছে।

আব্বাজান, মুখে চওড়া হাসি নিয়ে আকবর জীবনে প্রথম হুমায়ুনের আগে কথা বলে, সোয়া ঘন্টা আগে কাবুল থেকে হিন্দুস্তানের ডাকবহনকারী এক বার্তাবাহক এসেছে। সে আমাদের জন্য আমার আম্মাজানের দুটো চিঠি নিয়ে এসেছে। শিরহিন্দের যুদ্ধের পরে আপনি যেমন নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেই অনুযায়ী তিনি ইতিমধ্যে আমাদের সাথে মিলিত হবার জন্য কাবুল থেকে রওয়ানা দিয়েছেন। বর্ষার কারণে বিলম্ব না হলে আগামী ছয় থেকে আট সপ্তাহের ভিতরে তিনি দিল্লী এসে পৌঁছাবেন।

হুমায়ুন তার মনের ভেতরে একটা হাফ ছাড়া অনুভূতি টের পায়। হামিদার উপস্থিতি তার আনন্দের মাত্রাকে পূর্ণতা দেবে। চৌদ্দবছর আগে তাঁদের বিয়ের সময়ে দেয়া প্রতিশ্রুতি, দিল্লী আর আগ্রার ম্রাজ্ঞীর মর্যাদা সে তাঁকে দেবে, যত দ্রুত পূরণ করা যায় ততই মঙ্গল। আকবর এটা একটা দারুণ সুসংবাদ। আমাদের অবিলম্বে তার সাথে মিলিত হয়ে তাঁকে দ্রুত এখানে নিয়ে আসবার জন্য একদল সুসজ্জিত সৈন্য প্রেরণের আদেশ দেয়া উচিত।

হুমায়ুন তারপরে আকবরকে সাথে নিয়ে আড়াইশ গজ দূরে যেখানে দুটো রাজকীয় হাতি হাঁটু মুড়ে বসে অপেক্ষা করছে সেদিকে ধীর পায়ে এগিয়ে যায়। জওহর আর আধম খান যারা তাদের সাথে হাতির পিঠে আরোহন করবে কয়েক পা পেছনে থেকে ভক্তিভরে অনুসরণ করে। বৃষ্টি কয়েকদিন বন্ধ থাকায় তারা যখন হাঁটছে তখন পরিচারকেরা তাঁদের মাথায় যেন রোদ না লাগে সেজন্য রেশমের চাঁদোয়া ধরে থাকে। অন্যেরা ময়ূরের পালকগুচ্ছ আন্দোলিত করে তাদের বাতাস করতে এবং গুনগুন করতে থাকা মশা তাড়াতে, যা শিবিরের চারপাশে এখনও জমে থাকা কাদার কারণে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

তারা হাতির কাছে পৌঁছালে, হুমায়ুন সোনার একটা সিঁড়ি দিয়ে দুটোর ভিতরে যেটা বড় সেটার পিঠে উঠে যায়। তাঁকে অনুসরণ করে জওহর আর সবুজ আলখাল্লা পরিহিত দীর্ঘদেহী একজন দেহরক্ষী যারা দুজনেই তার পেছনে অবস্থান গ্রহণ করে। হাওদায় খচিত রত্নসমূহ- যার বেশীরভাগই লাল রঙের তামড়ি আর নীলকান্তমণি- প্রথম হাতিটা নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াতে সূর্যের আলোয় ঝকঝক করতে থাকে, সামান্য ছোট দ্বিতীয় হাতিটা আকবর, আধম খান আর আরেকজন দেহরক্ষীকে নিয়ে এরপরেই উঠে দাঁড়ায়। আকবর তার দুধ-ভাইয়ের সাথে এমন ভাবে গল্প করছে যেন তারা শিকার করতে যাচ্ছে।

হাতি দুটো একসাথে তাদের অন্যান্য সহযাত্রীদের দাঁড়িয়ে থাকা একটা সারির দিকে ধীরে এগিয়ে যায়। হুমায়ুন একটা হাওদায় বৈরাম খানকে দেখতে পায়, পার্সী দরবারের রীতিতে উপবিষ্ট। তার পাশেই রয়েছে তাঁর সেই তরুণ কৰ্চি বেচারার উরুর ক্ষত যদিও সেরে গিয়েছে কিন্তু সেটা সম্ভব হয়েছে রক্তপাত বন্ধের জন্য ক্ষতস্থান পোড়াবার যন্ত্রণাদায়ক পদ্ধতি প্রয়োগের পরেই এবং এখন থেকে তাঁকে আজীবন খুড়িয়েই হাঁটতে হবে। বৈরাম খানের ঠিক পেছনের হাতিতেই রয়েছে জাহিদ খান এবং হুমায়ুনের আদেশে একেবারে সামনের হাতিতে রয়েছে আহমেদ খান। এই সম্মান আপনার প্রাপ্য যখন চারিদিকে কেবল বিপদ আর মর্যাদার কোনো অবকাশ ছিল না তখনও আপনি সবসময়ে পথ দেখিয়েছেন, সে তাকে বলে।

হাতির ঠিক পরেই রয়েছে মুস্তাফা আগুনের অশ্বারোহী বাহিনী। হুমায়ুন কিছুক্ষণের জন্য তাঁর পুরো অভিযানে আরো যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সেইসব সাধারণ মানুষদের কথা চিন্তা করে। সে একহাতবিশিষ্ট ওয়াজিম পাঠানের কথা ভাবে এমনকি ভিস্তি নিজামের কথাও তার মনে পড়ে কিন্তু কামরান পরাজিত হবার পরে ওয়াজিম খান তার গ্রামেই মোড়ল হিসাবে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন এবং নিজামকে খোঁজার সময় হয়নি। হুমায়ুন তারপরে জোর করে নিজেকে বর্তমানে ফিরিয়ে এনে আদেশ দেয়। অগ্রসর হওয়া যাক।

হুমায়ুনের আদেশ রাজকীয় শোভাযাত্রার শুরুতে অবস্থানকারী হুমায়ুন আর মোগল রাজবংশের সাথে সাথে তৈমূরের অতিকায় নিশানবাহকদের পৌঁছে দেয়া হয়। তাঁরা আধ মাইল দূরে অবস্থিত বেলে পাথরের তৈরী অতিকায় তোরণদ্বারের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করলে তাদের ঠিক পেছনেই অবস্থানরত তূর্য আর দামামাবাদকের দল বাজনা শুরু করে, প্রথমে ধীর লয়ে তারপরে প্রবল উদ্দামে যখন তারা তোরণদ্বারের কাছে সমবেত জনতার নিকটবর্তী হয় যাদের হুমায়ুনের সৈন্যরা শিবির থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল কিন্তু এখন তারা রাজকীয় শোভাযাত্রার খেজুর পাতা এবং ফুলের পাপড়ি দিয়ে তৈরী দড়ির দুপাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হুমায়ুন সামনে এগিয়ে যাবার সময় সূর্যের আলোয় সামনের অশ্বারোহীদের বুকের বর্ম আর ঘোড়ার সাজ আর সামনের হাওদাগুলোকে চকচক করতে দেখে এবং লাগামের সাথে যুক্ত ক্ষুদ্র ঘন্টার ধ্বনি আর ঘোড়ার চিঁহি শব্দ মন দিয়ে শোনে- যা সমবেত জনতার উল্লসিক চিৎকারে প্রায় চাপা পড়ে গিয়েছে। তারপরে, আবেগ আপুত হৃদয়ে সে মুখ তুলে উপরের নীল নির্মেঘ আকাশের দিকে তাকায় এবং দেখে বা তাঁর মনে হয় সে দেখেছে- মোগল মহত্বের প্রতীক দুটো ঈগল আকাশে ডানা মেলে উড়ছে। হিন্দুস্তান এখন তার। মোগল সিংহাসন সে পুনরুদ্ধার করেছে। তাঁদের রাজবংশ আজকের পরে কেবলই শক্তিশালী হবে। সে আর আকবর- বিষয়টা নিশ্চিত করবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *