২.৫ সশ্রম আর সংক্ষোভ

২৫. সশ্রম আর সংক্ষোভ

হুমায়ুন পাদিশাহ! সম্রাট হুমায়ুন দীর্ঘজীবি হোন! লাহোরের অধিবাসীদের সম্মিলিত চিৎকারে চারপাশ প্রকম্পিত হয়ে উঠে যখন ১৫৫৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহের কোনো এক উষ্ণ দিনে, হুমায়ুন আর আকবর একটা লম্বা হাতির পিঠে সোনার গিল্টি করা হাওদায় অধিষ্ঠিত হয়ে বিজয়ীর বেশে শহরে প্রবেশ করে, অতিকায় প্রাণীটার পর্যাণের জন্য ব্যবহৃত সোনার জরি দিয়ে কারুকাজ করা আর মাঝে মাঝে মুক্তাখচিত দীর্ঘ কাপড়টা এই মুহূর্তে শহরের প্রশস্ত সড়কের ধূলোয় লুটোপুটি খাচ্ছে। শোভাযাত্রাটার একেবারে সামনে রয়েছে হুমায়ুনের অশ্বারোহী বাহিনীর একটা চৌকষ দল, যাদের সবাই কালো ঘোড়ার পিঠে আসীন এবং প্রত্যেকের মাথায় রয়েছে সোনালী রঙের পাগড়ি। দলটা দুলকি চালে এগিয়ে যাবার সময় মধ্যাহ্নের সূর্যালোক তাদের হাতে সোজা অবস্থায় ধরে রাখা লম্বা বর্শার ইস্পাতের ফলায় প্রতিফলিত হয়ে চোখ ধাধিয়ে দেয়। তাদের পিছনে, হুমায়ুনের ঠিক সামনে, ছয়জন অশ্বারোহী তূর্যবাদক আর ছয়জন ঢুলী তাঁদের খিলানাকৃতি পর্যাণের উভয়পার্শ্বে স্থাপিত ছোট ছোট দুটো নাকাড়া দক্ষতা আর বলিষ্ঠতার সাথে বাজিয়ে চলেছে। সমবেত জনতার উন্মত্ত চিৎকারের সাথে তাদের সুর মিলেমিশে একাকার হয়ে এমন একটা পরিস্থিতির জন্ম দেয় যে আকবরের কথা শোনার জন্য হুমায়ুনকে বেশ বেগ পেতে হয়।

আব্বাজান আমরা কাবুল থেকে রওয়ানা দেবার পরে এখানে ওখানে কেবল খণ্ডযুদ্ধেরই সম্মুখীন হয়েছি। রোহতাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ সব দূর্গই আমরা উপস্থিত হওয়া মাত্র আত্মসমর্পণ করেছে আর এখন লাহোরের মতো বিশাল শহরও একই ভাগ্যবরণ করেছে। সত্যিকারের কোনো যুদ্ধের মুখোমুখি না হয়ে হিন্দুস্তানের ভেতরে এভাবে নির্বিঘ্নে আমরা আর কতদূর যাব?

আমার মনে হয়, খুব বেশী দূর না। আমরা খুব শীঘ্রই শেরশাহ আর ইসলাম শাহের রাজত্বের কেন্দ্রস্থলে প্রবেশ করতে চলেছি। সিংহাসনের জন্য তাঁদের যে তিনজন দাবীদার রয়েছে তারা সম্ভবত আমাদের অগ্রসর হবার সংবাদ পেয়ে থাকবে এবং নিশ্চয়ই জানে যে আমরা হিন্দুস্তানের সিংহাসনের ন্যায়সঙ্গত দাবীদাব তাঁদের অন্যান্য যেকোনো সাথী রাজ্যাভিযোগীদের চেয়ে অনেক বড় হুমকির কারণ। তাঁদের সবাই বা যেকোনো একজন নিজেদের ভিতরে বিদ্যমান ঝগড়া থেকে সরে দাঁড়িয়ে আমাদের আক্রমণ করবে।

আপনার কি মনে হয় আমাদের বিরুদ্ধে তারা সঙ্বদ্ধ হতে পারবে?

সম্ভবত, কিন্তু তারা একে অপরের যে পরিমাণ মৃত্যু আর ধ্বংসযজ্ঞ সাধন করেছে যে সেটা হয়ত আর সম্ভব হবে না। অবশ্য, তাদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ শক্তির নিরিখে দুর্দান্ত প্রতিপক্ষ হিসাবে আবির্ভূত হবে।

লাহোরে আমরা কতদিন অবস্থান করবো?

শহরের প্রধান ইমামসাহেব শুক্রবার জুম্মার নামাজের পরে মসজিদে আমার নামে খুৎবা- অনুশাসন- পাঠ করে আমাকে আরো একবার সম্রাট হিসাবে ঘোষণা করার পরেই আমরা আবার যাত্রা শুরু করবো। তালগাছের ভিতর দিয়ে তাকালে তুমি মসজিদের লম্বা মিনার দুটো দেখতে পাবে। আমাদের অগ্রযাত্রার প্রণোদনা যেভাবেই হোক বজায় রাখতে হবে। আমি প্রায়ই দেরী করে ফেলি আর আমার প্রতিপক্ষকে প্রত্যুপক্রমের সুযোগ করে দেই।

দুই সপ্তাহ পরে, প্রথম সকালের কুয়াশায় অবগুণ্ঠিত অবস্থায় তার সৈন্যরা নিজেদের জন্য দ্রুত কিছু একটা খাবার প্রস্তুতের লক্ষ্যে রান্নার করার জন্য আগুন জ্বালাচ্ছে, হুমায়ুন তখন তাঁর সেনাছাউনির একেবারে মধ্যেখানে তার জন্য স্থাপিত লাল রঙের নিয়ন্ত্রক তাবুতে চারপাশে নিজের সামরিক পরিষদমণ্ডলী পরিবেষ্টিত হয়ে বসে রয়েছে। আটদিন পূর্বে লাহোর ত্যাগ করার পরে, সে আর তার বাহিনী দক্ষিণপূর্ব দিকে প্রায় নব্বই মাইল পথ অতিক্রম করে, বৈচিত্র্যহীন, লাল মাটির উপর দিয়ে হিন্দুস্তানের আরও গভীবে প্রবেশ করেছে।

আহমেদ খান, তুমি নিশ্চিত যে আদিল শাহের বাহিনী আমাদের অগ্রসর হবার দিকের সাথে আড়াআড়িভাবে পূর্বদিকে এগিয়ে চলেছে?

হ্যাঁ। পাঁচ দিন পূর্বে, তাঁরা তাঁদের প্রতিপক্ষ সিকান্দার শাহের সৈন্যদের সাথে আরেকটা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে বাজেভাবে পরাস্ত হয়েছে এবং এখন তারা নিজেদের শক্তঘাঁটি সুন্দরনগরের দূর্গের দিকে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে পুনরায় নিজেদের সংঘটিত করতে।

তারা কতদূরে অবস্থান করছে?

 সুলতান, তারা সম্ভবত আমাদের থেকে আট মাইল সামনে রয়েছে।

সেখানে তাদের সাথে কত লোক রয়েছে?

তাদের সংখ্যা প্রায় দশ হাজারের কাছাকাছি হবে, প্রায় সবাই অশ্বারোহী। তাঁরা তাঁদের বেশীরভাগ কামান আর ভারী যুদ্ধ উপকরণ পথে কোথাও ফেলে এসেছে।

তারা কি অশ্বারোহী প্রহরী কিংবা পাহারা দেয়ার জন্য লোক মোতায়েন করেছে?

সুলতান, নিয়োগ করেছে তবে তাঁদের সংখ্যা খুবই অল্প; তাঁদের নিজেদের ভিতরে মাত্রাছাড়া বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। তারা রাতের বেলা কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে নেয়ার নিতে কয়েকঘন্টার জন্য কেবল যাত্রা বিরতি করে এবং যাত্রা শুরু করতে ভোর হবার আগেই ঘোড়ার পিঠে উঠে বসে। তাদের মাথায় কেবল যত দ্রুত সম্ভব সুন্দরনগর পৌঁছাবার ব্যাপারটাই ঘুরপাক খাচ্ছে।

আমরা তাহলে কালবিলম্ব না করে, কুয়াশার আড়াল যতক্ষণ রয়েছে এর সুবিধা নিয়ে আক্রমণ করবো। আমার লোকদের রান্না করার জন্য জ্বালান আগুন নিভিয়ে ফেলতে বলল। আহার করার মতো সময় হাতে নেই। আমরা অশ্বারোহী যোদ্ধা আর তীরন্দাজদের নিয়ে যাব। সেই সাথে, কিছু নির্বাচিত অশ্বারোহী যোদ্ধাদের আদেশ দেন তারা যেন তাদের ঘোড়ায় নিজেদের পেছনে তবকিদের উঠিয়ে নেয়। বৈরাম খান, আপনি, আকবরের সাথে সেনাছাউনির নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবেন। আপনি মজবুত প্রতিরক্ষা ব্যুহ মোতায়েনের বিষয়টা নিশ্চিত করবেন আর পাহারার ব্যবস্থা করবেন। আমি আসন্ন যুদ্ধে বিজয়ী হবার প্রত্যাশা করছি কিন্তু তারপরেও কোনো কারণে আদিল শাহ্ আমাদের কৌশলে এড়িয়ে গেলে বা কোনো কারণবশত সাময়িকভাবে সুবিধাজনক অবস্থান লাভ করলে তখনকার পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য এখানে সেনাছাউনির নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার রাখতে হবে।

দুই ঘন্টা পরে, কুয়াশা পুরোপুরি বাতাসে মিলিয়ে যায়। হুমায়ুন আহমেদ খান আর তাঁর গুপ্তদূতের একটা দল নিয়ে নিজে তার অগ্রসর হতে থাকা মূল বাহিনী থেকে মাইল খানেকের মতো সামনে অবস্থান করছে। সামনে অবস্থিত একটা গ্রামের মাটির দেয়ালের উপর দিয়ে তাকিয়ে থাকে গ্রামটায় মানুষ বলতে কয়েক ঘর দরিদ্র কৃষক পরিবার আর তাদের পোষা মুরগী আর ছাগল রয়েছে। সূর্যের অসহনীয় আলোর উত্তাপের হাত থেকে চোখ বাঁচাতে সে মাথার উপর হাত দিয়ে একটা আড়াল তৈরী করেছে, সে পৌনে একমাইল দূরে, ধূলোবালির তৈরী বিশালাকৃতি একটা মেঘকে জোয়ারের ঢেউয়ের মতো আন্দোলিত হতে দেখে, তার সামনে দিয়ে, ধূলিঝড়টা ডানদিক থেকে বামদিকে এগিয়ে যায়। ধূলিঝড়ের ভিতরে, হুমায়ুন কোনমতে একদল অশ্বারোহী আর কয়েকটা ছোট মালবাহী শকটের অবয়ব চিনতে পারে, খচ্চর বা ষাড় দিয়ে শকটগুলো টেনে নেয়া হচ্ছে। কাফেলাটার সামনে দুটো বিশালাকৃতি নিশান বাতাসে আন্দোলিত হচ্ছে। ধূলো ভিতর দিয়ে এবং এতদূর থেকে হুমায়ুন নিশানের রঙ বা নিশানের বুকে কিসের প্রতিকৃতি রয়েছে ঠিকমতো বুঝতে পারে না, কিন্তু এই প্রত্যন্ত প্রান্তরে এহেন ধূলিঝড়ের ভিতরে কেবল আদিল শাহের সৈন্যবাহিনীই এখন পথচলা অব্যাহত রাখবে। দলটা কোনো গুপ্তদূত মোতায়েন করেনি এবং তাঁদের দেখে মনে হয় কোনো ধরনের বিপদের সম্ভাবনা সম্পর্কে তারা একেবারেই উদাসীন।

নাদিম খাজাকে তার অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে পেছন দিক থেকে আক্রমণ করার নির্দেশ পাঠাও। জাহিদ বেগকে তার লোকজন নিয়ে এখানে উপস্থিত হতে বলো এবং সম্মুখভাগে আক্রমণ পরিচালনার সময় আমি নিজে তাদের নেতৃত্ব দেব। আর অশ্বারোহী যোদ্ধাদের যাদের সাথে তবকিরা রয়েছে তাদের বলো সরাসরি শত্রু সৈন্যসারির অগ্রসর হবার পথের একশ গজের ভিতরে অবস্থান নিতে এবং সেখান থেকে তবকিরা শত্রু সেনার বিপর্যয়ের মাত্রা বৃদ্ধি করবে।

হুমায়ুনের তবকিদের অচিরেই ঘোড়া থেকে নেমে এসে তেপায়ার উপরে তাঁদের লম্বা নলযুক্ত বন্দুকগুলোকে স্থাপন করতে দেখা যায় এবং হুমায়ুন আর তার নেতৃত্বাধীন সৈন্যরা ততক্ষনে প্রায় আদিল শাহের সৈন্যসারির সম্মুখভাগের যোদ্ধাদের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে। তাঁদের প্রতিপক্ষ একেবারে শেষমুহূর্তে সহসা শত্রুর উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হয় এবং ময়ান থেকে তরবারি বের করতে করতে ঘুরে দাঁড়ায় তাদের মুখোমুখি হতে। প্রতিপক্ষের আধিকারিকেরা সৈন্যদের কাছাকাছি অবস্থান করে আক্রমণের মুখোমুখি হবার জন্য প্রস্তুত হতে আদেশ দেয়। হুমায়ুনের তবকিরা প্রায় সেই সময়েই আদিল শাহের সৈন্যদের অবস্থান লক্ষ্য করে একযোগে প্রথমবার গুলি বর্ষণ করলে, বেশ কয়েকজন সৈন্য পর্যাণ থেকে মাটিতে ছিটকে যায় এবং তাঁদের অনেকের ঘোড়া আহত হয় আর আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।

হুমায়ুন তার অশ্বারোহী বাহিনীর সম্মুখে অবস্থান করে, মুহূর্ত পরেই, শত্রুপক্ষের সৈন্যসারির অগ্রদলের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সে প্রথমেই দুই নিশানাধারীর একজনের মাথার লক্ষ্য করে তরবারি চালিয়ে তাকে কবন্ধ করে ফেলে। লোকটা কাটা কলাগাছের মতো পেছনের দিকে উল্টে পড়ার সময়, তার হাত থেকে বিশাল নিশানাটা ছিটকে যায়, হুমায়ুন এবার স্পষ্ট দেখতে পায় নিশানায় কমলা রঙের প্রেক্ষাপটে সোনালী সূর্য খচিত রয়েছে। বিশাল কাপড়টা হুমায়ুনের কালো ঘোড়ার পেছনের পায়ে জড়িয়ে গেলে প্রাণীটা হোঁচট খায়। হুমায়ুন, দ্বিতীয় নিশানবাহককে তরবারি দিয়ে আঘাতের উদ্দেশ্যে পর্যাণের উপরে সামনে ঝুঁকে পড়ে নিশানা স্থির করার কারণে সে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে, মাটিতে পড়ে যায়। পাথুরে মাটিতে বেকায়দায় আছড়ে পড়ায়, তাঁর হাত থেকে তরবারি ছিটকে যায়।

আদিল শাহের অন্য একজন লোক, কমলা রঙের পালক শোভিত চূড়াকৃতি শিরোস্ত্ৰাণ পরিহিত গাট্টাগোট্টা দেহের অধিকারী এক আধিকারিক, হুমায়ুনের দেহরক্ষীদের চেয়ে দ্রুত সুযোগটা চিনতে পারে। সে হুমায়ুনের দিকে নিজের খয়েরী রঙের ঘোড়াটা নিয়ে এগিয়ে আসে এবং তার হাতের লম্বা বর্শাটা দিয়ে হুমায়ুনকে মাটিতেই গেঁথে ফেলতে চায়। হুমায়ুন দ্রুত একপাশে গড়িয়ে সরে যাবার ফাঁকে হাত থেকে দাস্তানা খুলে ফেলে কোমরের সাথে ঝোলান রত্নখচিত ময়ান থেকে তার খঞ্জরটা টেনে বের করতে চেষ্টা করে। তাঁর মনে হয় কয়েক যুগ পরে, সে খঞ্জরটা ময়ান থেকে মুক্ত করতে পেরেছে এবং ফুটখানেক লম্বা ফলাযুক্ত অস্ত্রটা সামুনের প্রতিপক্ষের ঘোড়ার গলা লক্ষ্য করে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ছুঁড়ে মারে, যে তখন আরেকবার নিজের ঘোড়র পায়ের নীচে তাঁকে পিষে ফেলতে চেষ্টা করছে। খঞ্জরের ফলাটা লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করে এবং গলা দিয়ে ফিনকে দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকা অবস্থায় জটা টলমল করে উঠে, তারপরে মাটিতে পড়ে যাবার সময় পিঠ থেকে তার আরোহীকে ছিটকে দেয়, লোকটা বিকট শব্দে মাটিতে আছড়ে পড়ে।

হুমায়ুন ইতিমধ্যে নিজের পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে এবং ত্বরিতগতিতে সে বাতাসের অভাবে হাঁসফাস করতে থাকা শত্রুপক্ষের লোকটার দিকে এগিয়ে যায়, মাটিতে আছড়ে পড়ার সময় মাথার লোকটার মাথা থেকে শিরোস্ত্রাণটা ছিটকে গিয়েছে। লোকটা উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করার সময় হুমায়ুন পেছন থেকে গিয়ে তাঁর বৃষস্কন্ধের ন্যায় গলাটা পেঁচিয়ে ধরে। হতভম্ব লোকটা আঁতকে উঠে নিজের মাথা ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে পরবর্তী কয়েক সেকেণ্ড তাঁরা দুজনে উন্মত্তের ন্যায় ধ্বস্তাধ্বস্তি করতে থাকে। সে তারপরে হুমায়ুনের কব্জি আর হাতের আবরণহীন মাংসপেশীতে প্রাণপনে কামড় দিয়ে রক্ত বের করে ফেলে। হুমায়ুনের তার হাতের বাঁধন খানিকটা শীথিল করলে আধিকারিক লোকটা এক মোচড়ে নিজের মাথা হুমায়ুনের হাতের প্যাঁচ থেকে ছাড়িয়ে নেয়। লোকটা হুমায়ুনের রক্তে রঞ্জিত দাঁত বের করে আধো হাসির একটা বীভৎস ভঙ্গি করে এবং কালক্ষেপন না করে সোজা হুমায়ুনের কুঁচকি লক্ষ্য করে লাথি বসিয়ে দিয়ে চেষ্টা করে। কিন্তু হুমায়ুন লাফিয়ে উঠে পেছনে সরে যেতে তাঁর প্রতিপক্ষের লাথি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে সে ভারসাম্য হারিয়ে টলমল করতে থাকে। হুমায়ুন এক লাথিতে লোকটার দেহের নীচে থেকে বাকি পাটাকেও শূন্যে তুলে দেয় এবং নোকটা মাটিতে পড়ে গেলে সে তাকে লক্ষ্য করে লাফ দেয় এবং দুই হাঁটু একসাথে লোকটার বুকের উপর নামিয়ে আনে। আধিকারিক লোকটা আবারও বাতাসের অভাবে খাবি খেতে থাকলেও সে কোনোমতে হাটু দিয়ে হুমায়ুনের পিঠে আঘাত করে এবং বুকের উপর থেকে ফেলে দেয়। তারা এবার জড়াজড়ি করে ধূলোতে গড়াতে থাকে যতক্ষণ না হুমায়ুন নিজের পেশী শক্তি আর ক্ষিপ্রতার শ্রেষ্ঠত্ব প্রয়োগ করে তার প্রতিপক্ষের গলা দুহাতে শক্ত করে আকড়ে ধরে। সে ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে লোকটার শ্বাসনালীতে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে চাপ দিয়ে তাঁর গলাটা হেচকা টানে মুচড়ে দেয়। একটা বীভৎস শব্দ শোনা যায় এবং আধিকারিক লোকটার পুরো মুখ ধীরে ধীরে বেগুনী হয়ে যায় এবং তার ঠিকরে বের হয়ে থাকা চোখের মণিতে দৃষ্টির স্বচ্ছতা মুছে গিয়ে সে ধীরে ধীরে নিথর হয়ে যায়। নিথর দেহটা একপাশে সরিয়ে দিয়ে হুমায়ুন কোনমতে নিজের পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায় এবং নিজের তরবারিটা খুঁজে বের করে হাতে তুলে নেয়। সে চোখমুখ কুঁচকে ভাবে বায়েজিদ খানের সাথে মল্লযুদ্ধের কসরতের প্রশিক্ষণ না নিলে আজ এখানেই তাঁর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্নের ইতি ঘটতো। যুদ্ধের ময়দানে সে একবার ঘোড়ার পিঠ থেকে ছিটকে মাটিতে পড়ে গেলে তাঁর দেহরক্ষীদের পক্ষে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করাটা তখন প্রায় অসম্ভব।

হুমায়ুনের সেই দেহরক্ষীরাই এবার তার চারপাশে জড়ো হতে শুরু করে এবং সে এবার সুস্থির ভঙ্গিতে চারপাশে তাকিয়ে দেখে আদিল শাহের অনেকেই ইতিমধ্যে দৌড়ে পালাতে শুরু করেছে। বাকিরা আত্মসমর্পন করে অস্ত্র নামিয়ে রাখছে। কৃষিজীবি গ্রামটার আশ্রয়স্থল থেকে ধূলিঝড়ের মাঝে অশরীরি কোনো কাফেলার মতো আদিল শাহের বাহিনীকে প্রথমবার দেখার পরে এক ঘন্টা সময়ও এখনও অতিক্রান্ত হয়নি। পুরো বাহিনীটা এখন পুরোপুরি বিভ্রান্ত আর ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছে, সেই সাথে হিন্দুস্তানের সিংহাসনের উপরে আদিল শাহের নিজের দাবী জোরদার করার সুযোগও একেবারে শেষ হয়ে গিয়েছে।

আমাদের শত্রুসেনাদের পিছু ধাওয়া কর। তোমাদের পক্ষে যতগুলো প্রাণী আর যুদ্ধের উপকরণ দখল করা সম্ভব দখল কর। উপকরণগুলো সামনে আরও কঠিন যুদ্ধের সময় কাজে লাগবে নিশ্চিতভাবেই যা ভবিষ্যতের গর্ভে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। তোমাদের হাতে যদি আদিল শাহ বন্দি হয় তবে তাকে বিন্দুমাত্র করুণা প্রদর্শন করবে না কারণ নিজের শিশু ভাস্তেকে সে কোনো প্রকার করুণা করেনি।

খণ্ডযুদ্ধের তিনঘন্টা পরে, পরাজিত শত্রুকে ধাওয়া করার জন্য হুমায়ুন প্রেরিত সৈন্যদের একটা দল ফিরে আসে। হুমায়ুন তাকিয়ে দেখে যে তাদের একজন একটা ঘোড়ার লাগাম ধরে টেনে আনছে, যার পিঠে একটা দেহ আড়াআড়িভাবে শুইয়ে রেখে দেহটার হাত-পাগুলো ঘোড়াটার পেটের নীচে একত্রে বেঁধে রাখা হয়েছে। দলটার নেতৃত্বদানকারী যোদ্ধা ঘোড়া থেকে নেমে এসে হুমায়ুনকে নতজানু হয়ে অভিবাদন জানায়। সুলতান, আদিল শাহের মৃতদেহ আমরা নিয়ে এসেছি। তাঁর দেহরক্ষী দলের যেসব সদস্যদের এখান থেকে মাত্র দুই কি তিন মাইল দূরে আমরা পেছন থেকে ধাওয়া করে গিয়ে বন্দি করেছিলাম তারাই দেহটা আমাদের কাছে সমর্পন করেছে। তারা বলেছে যে আমাদের অতর্কিত আক্রমণের শুরুতে গাদাবন্দুকের একটা গুলিতে বুকে সৃষ্ট ক্ষতস্থান থেকে রক্তপাতের ফলে সে মারা গিয়েছে।

হুমায়ুন ধীরে ধীরে মৃতদেহটার কাছে এগিয়ে যায় এবং মাথাটা পেছনে টেনে এনে তাঁর প্রতিপক্ষের মুখের দিকে তাকায়। ধূলো আর রক্তের পুরু আস্তরণের নীচে আদিল শাহকে সাধারণ দেখায়। হুমায়ুন তাঁর চোখে মুখে লোকটা উচ্চাশার ধূর্ত গভীরতার কোনো বাহ্যিক লক্ষণ দেখতে পায় না, যার কারণে সে আপন বোনের সন্তানকেও হত্যা করতে কুণ্ঠিত হয়নি। আদিল শাহের মাথাটা ছেড়ে দিয়ে, নিজের শত্রুর প্রতি তাঁর ক্রোধের বহিপ্রকাশের প্রমাণস্বরূপ মৃতদেহটা সমাধিস্থ না করে কুকুর শেয়ালের খাবার হিসাবে ফেলে রাখার জন্য ক্রমশ তার ভিতরে জোরাল হতে থাকা একটা প্রবণতা সে বহু কষ্টে দমন করে। সে বরং ঘুরে দাঁড়াবার কাঠখোট্টা ভঙ্গিতে আদেশ দেয়, তাকে নামহীন একটা কবরে দাফন করবে।

সেইদিন রাতের বেলা, হুমায়ুন তার তাবুর নিরবতার মাঝে, আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে শোকরানা নামাজ আদায় করে। হিন্দুস্তানের সিংহাসনের প্রবল তিন দাবীদারের একজনকে সে তাঁর পথ থেকে সরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সে খুব ভালো করেই জানে এখনও নিরুদ্বিগ্ন হবার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। নিজের বিজয়ের প্রণোদনা আর উদ্যম তাকে অবশ্যই বজায় রাখতে হবে এবং চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য নিজেকে আর তার বাহিনীকে উৎসাহিত করতে হবে। অন্যথায়, তার সিংহাসন পুনরুদ্ধার এবং ব্যর্থতা থেকে নিজেকে সাফল্যে অভিষিক্ত করার সুযোগ সে হারাবে এবং কখনও হয়তো আর সুযোগ পাবে না।

আহমেদ খানের গুপ্তদূতেরা পরের দিন সকালে আরেকটা সম্ভাবনার সন্ধান নিয়ে আসে। দক্ষিণ দিক থেকে আগত ভ্রমণকারীদের কাছ থেকে তাঁরা জানতে পারে যে পাঁচদিন আগে আসবার পথে তারা তার্তার খানের দুইজন সেনাপতির অধীনে একটা মাঝারি মাপের সৈন্যবাহিনীকে অতিক্রম করেছিল, দলটা উত্তরে তাদের অবস্থানের অভিমুখে এগিয়ে আসছে। আদিল শাহের মুখোমুখি হওয়াই তাদের আপাত অভিপ্রায় যার পরাজিত হবার সংবাদ সম্বন্ধে তারা এখনও অন্ধকারে রয়েছে। তার সামনে হিন্দুস্তানের সিংহাসনের দ্বিতীয় দাবীদারকে মারাত্মকভাবে আঘাত করার একটা সুবর্ণ সুযোগ উন্মোচিত হয়েছে এবং তাঁকে চিরতরে পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরে সরিয়ে দেয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে অনুধাবন করে হুমায়ুন তখনই তার্তার খানের বাহিনীকে আক্রমণের উদ্দেশ্যে দক্ষিণে যাত্রা করার জন্য তার বাহিনীকে আদেশ দেয়।

এক সপ্তাহ পরে, হুমায়ুন আরেকটা যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকিয়ে দেখে। সেদিনই সকালের দিকে তাঁর বাহিনী নিজেদের ঘোড়াগুলোকে সহ্যের প্রায় শেষ সীমায় দিয়ে, পেছন থেকে ধাওয়া করে এসে তাদের শত্রুদের আক্রমণ করতে গিয়ে আবিষ্কার করে যে তাঁদের প্রতিপক্ষ দুটো পৃথক বাহিনীতে বিভক্ত হয়ে নিজেদের ভিতরে এক মাইল দূরত্ব বজায় রেখে অগ্রসর হচ্ছে। দুটো দলের কোনটাতেই চার হাজারের বেশী সৈন্য হবে না। হুমায়ুন কালক্ষেপন না করে সামনের বাহিনীকে আক্রমণ করার আদেশ দেয়, প্রথম দলটা আক্রমণের তীব্রতা সহ্য করতে না পেরে দ্রুত সমভূমির উপরে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। অতর্কিত হামলায় বিপর্যস্ত সাথী যোদ্ধাদের সহায়তায় এগিয়ে না এসে দ্বিতীয় দলটা পিছু হটে গিয়ে একটা ছোট টিলার মাথায় অবস্থান গ্রহণ করে রক্ষণাত্মক ব্যুহ রচনা করে, হুমায়ুনের অনুগত যোদ্ধারা সময় নষ্ট না করে পুরো টিলাটা ঘিরে ফেলে।

হুমায়ুন ঠিক তখনই টিলার মাথায় একদল আধিকারিককে সমবেত হতে দেখে। তাঁর পাশে অবস্থানরত আহমেদ খানের দিকে তাকিয়ে সে জিজ্ঞেস করে, আমরা কি ঐ দলটার নেতৃত্বদানকারী সেনাপতির নাম জানি?

সুলতান, সাম্প্রতিক যুদ্ধের সময় প্রতিপক্ষের অশ্বারোহী বাহিনীর একজন দলপতি যুদ্ধ করার কোনো চেষ্টা না করেই আত্মসমর্পন করে আমাদের জানায় যে সে আর তার লোকেরা আপনার অধীনে যুদ্ধ করতে আগ্রহী। আমরা তাঁর লোকদের পাহারা দিয়ে রেখেছি এবং তাঁকে আমাদের একটা তাবুতে অন্তরীণ রেখেছি যেখানে সে স্বেচ্ছায় আমাদের শত্রুপক্ষের সেনাবাহিনীর গঠনতন্ত্র আর তাদের মনোবল সম্বন্ধে অনেক তথ্য জানিয়েছে। সে নিশ্চয়ই তাকে চিনবে।

লোকটাকে আমার সামনে হাজির করো।

কয়েক মিনিটের ভিতরে আহমেদ খানের দুইজন সৈন্য নিখুঁতভাবে কামান কালো দাড়ির অধিকারী প্রায় ত্রিশ বছর বয়সের দীর্ঘদেহী একজন লোককে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে। তাঁর পক্ষে হুমায়ুনকে আক্রমণের ন্যূনতম সম্ভাবনাও নাকচ করতে তারা লোকটার দুপায়ে এমনভাবে শিকল পরিয়ে রেখেছে যে সে কোনোমতে পা টেনে টেনে হাঁটতে পারে। সে যখন হুমায়ুনের কাছ থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে রয়েছে সে অভিবাদন জানাবার ভঙ্গিতে মাটিতে শুয়ে পড়ে।

হুমায়ুন কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে কিছু একটা ভাবে তারপরে কথা বলে। তাকে তুলে দাঁড় করিয়ে দাও। তারপরে সে জিজ্ঞেস করে, কে তুমি?

মুস্তাফা আর্গুন, তার্তার খানের বাহিনীতে কর্মরত একজন তূর্কী সেনাপতি।

আমাকে বলা হয়েছে যে তুমি আমার প্রতি নিজের আনুগত্য পরিবর্তনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছে।

আমার অধীনস্ত একশ লোকেরও একই অভিপ্রায়।

কেন?

আমরা তার্তার খানের বাহিনীতে যোগ দিয়েছিলাম ধনসম্পদের এবং সে যদি হিন্দুস্তানের পাদিশাহ্ হয় তাহলে পদবী পাবার আশায়। কিন্তু আমরা দেখেছি এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সে মোটেই উৎসাহী নয়। গুজরাতে সীমান্ত এলাকায় নিজের উপপত্নীর কণ্ঠলগ্ন হয়ে সে যখন অলস সময় অতিবাহিত করছে, তখন তাঁর মতোই সিংহাসনের দাবীদারদের ভিতরে সবচেয়ে দূর্বল, আদিল শাহের বিরুদ্ধে এই আপাত অর্থহীন অভিযানে সে আমাদের প্রেরণ করেছে। আমাদের কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করার জন্য সে আমাদের সাথে পর্যাপ্ত সংখ্যক লোকবল, যুদ্ধের উপকরণ কিংবা অস্ত্র প্রেরণ করেনি এবং গত তিনমাস আমরা কোনো বেতনও পাইনি। আমাদের ধারণা রাজসিংহাসন পুনরুদ্ধারের বিষয়ে একনিষ্ঠ এবং আপনি যখন সেই লক্ষ্য অর্জনে সফল হবেন তখন আমাদের পুরস্কৃত করতে কোনো রকম কার্পণ্য দেখাবেন না।

আমার স্পষ্ট মনে আছে আমার আব্বাজান তার অধীনস্ত তূর্কী তোপচিদের সম্বন্ধে কতখানি উচ্চধারণা পোষণ করতেন। আমিও অন্য সম্প্রদায় থেকে আগত যোদ্ধাদের দ্বারা দারুণভাবে উপকৃত হয়েছি। পারস্যের শাহের সৈন্যবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দিয়ে বৈরাম খান আমার সাথে যোগ দিয়েছে। কিন্তু তোমার অভিপ্রায়ের আন্তরিকতার বিষয়ে আমি কিভাবে নিশ্চিত হবো?

আমরা পবিত্র কোরান শরীফ ছুঁয়ে আপনার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের শপথ নিতে প্রস্তুত বা আপনার পরবর্তী আক্রমণের সময় নিজেদের যোগ্যতা প্রদর্শনের জন্য আপনি আমাদের আক্রমণ শুরু করার দায়িত্ব দিতে পারেন।

আমি দুটো প্রস্তাবই বিবেচনা করে দেখবো কিন্তু তার আগে তোমার জন্য প্রাথমিক একটা পরীক্ষা রয়েছে। তোমাদের বাহিনীর অন্য অংশের যেসব সৈন্যরা ঐ টিলার মাথায় আমাদের দ্বারা পরিবেষ্টিত অবস্থায় রয়েছে তাদের নিকটে গিয়ে, আত্মসমর্পণের জন্য তাঁদের প্ররোচিত করো। তাদের আত্মসমর্পনের সিদ্ধান্ত ত্বরান্বিত করতে আমার শর্তগুলো হল- ভারী যুদ্ধাস্ত্র রেখে তাঁরা তাঁদের ব্যক্তিগত অস্ত্র সাথে নিয়ে কোনোভাবে নিগৃহীত না হয়ে এখান থেকে বিদায় নিতে পারে বা তোমার মতো স্বেচ্ছায় আমার বাহিনীতে যোগ দিতে পারে। তারা যদি আত্মসমর্পন না করে, পরবর্তী আক্রমণের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য তোমার প্রস্তাব আমি হয়তো বিবেচনা করবো, যা তাদের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হবে। তুমি কি আমার প্রস্তাব গ্রহণ করতে রাজি আছো?

জ্বী, সুলতান।

তার পায়ের শেকল খুলে দাও।

মুস্তাফা আর্গুনকে, সোয়া ঘন্টা পরে নিজের দশজন লোককে নিয়ে হুমায়ুনের শিবির থেকে ঘোড়ায় চেপে বের হয়ে আসতে দেখা যায়। তাঁর সহযোদ্ধারা যেখানে সমবেত হয়েছে সেই টিলার কাছে সে পৌঁছালে তারা নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যুহে একটা ফাটলের জন্ম দিয়ে তাঁকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়। হুমায়ুন দূর থেকে মুস্তাফা আর তার লোকদের গাছপালা শূন্য টিলার উপরে উঠতে দেখে সেখানে সমবেত হওয়া আধিকারিকদের সাথে আলোচনা করতে। অচিরেই সমবেত মানুষের জটলায় ভাঙ্গণের সৃষ্টি হয় এবং প্রত্যেক আধিকারিককে নিজেদের লোকদের সাথে আলোচনা করতে দেখা যায়। প্রতিপক্ষের প্রতিরক্ষা ব্যুহের সম্মুখ সারির মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থান পুনরায় উন্মোচিত হয়ে সেখান দিয়ে মুস্তাফা আর্গুন তার দশজন লোককে পেছনে নিয়ে বের হয়ে এসে হুমায়ুনের অবস্থানের দিকে এগিয়ে আগে টিলার উপর থেকে মাঝেমাঝেই উৎফুল্ল চিৎকারের শব্দ ভেসে আসে।

বৈরাম খান আর আকবরকে পাশে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হুমায়ুনের দিকে সে হাসি মুখে এগিয়ে যেতে শুরু করলে হুমায়ুনের দুজন দেহরক্ষী তার দুপাশে নিজেদের স্থান করে নেয়। কেমন সাফল্য তুমি লাভ করেছে বলে মনে হয়?

সুলতান, আজ এখানে আর কোনো রক্তপাত হবে না। টিলার উপরে অবস্থানরত বাহিনীটার নেতৃত্বে রয়েছে সেলিম নামে এক গুজরাতি যুবরাজ এবং তার বাহিনীর দুই তৃতীয়াংশ গুজরাতি সৈন্য তার্তার খান রাজসিংহাসন অধিকার করার জন্য প্রথম যখন সিদ্ধান্ত নেন তখন সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। তাঁরা এই অভিযানের ব্যাপারে ক্লান্ত হয়ে উঠেছে এবং বাড়ি ফিরে যেতে আগ্রহী আর সেজন্য আপনার শর্ত গ্রহণ করতে রাজি আছে।

ভালো কথা। আর বাকি এক তৃতীয়াংশের কি মতামত?

বিভিন্ন স্থান থেকে সমবেত হওয়া যোদ্ধাদের একটা দল। অনেকে একেবারেই কিশোর আমরা যাত্রাপথে তাঁদের গ্রামের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় অভিযানের নেশায় তারা আমাদের দলে যোগ দিয়েছিল কিন্তু এই মুহূর্তে তারা নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে বেশী আগ্রহী। বাকিরা আমাদের মতোই পোড়খাওয়া ভাগ্যান্বেষী যোদ্ধা, যাদের ভিতরে কেমিল আত্তাক নামে একজন সেনাপতির অধীনে আমার দেশ থেকে আগত একশ বকি, এবং প্রায় সমান সংখ্যক পার্সী তোপচি, আমাদের সাথে সামান্য সংখ্যক যে কামান রয়েছে সেগুলোর দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে। দুটো দলই আমাদের মতো তাদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আপনার বাহিনীর সাথে যোগ দিতে আগ্রহী।

তুমি তোমার উপর অর্পিত দায়িত্ব ভালোমতো পালন করেছে। তোমার আর তোমার লোকদের আমার অধীনে চাকরি করার প্রস্তাব আমি গ্রহণ করছি এবং আমার বাহিনীতে স্বেচ্ছায় যোগ দিতে আগ্রহী অন্যদের আমি গ্রহণ করবো যদি তাঁদের আধিকারিকেরা তাদের আন্তরিকতার ব্যাপারে তোমার মতো করে আমাকে বোঝাতে পারে। তারপরে হুমায়ুন, বৈরাম খানের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলে, প্রতিটা বিজয় আমাদের লক্ষ্যের কাছাকাছি নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের হোঁচট খাওয়া চলবে না নতুবা আমরা এখন পর্যন্ত যা কিছু অর্জন করেছি সব হারিয়ে ফেলবো। আজ রাতে আমরা আমাদের বিজয় উদযাপন এবং আমাদের সাথে যোগ দেয়া নতুন সহযোদ্ধাদের স্বাগত জানাতে ভোজসভার আয়োজন করবো কিন্তু আগামীকাল সকালেই আমার সিংহাসনের শেষ দাবীদার, সিকান্দার শাহকে পরাস্ত করতে যাত্রা শুরু করবো। সে একজন চৌকষ সেনাপতি এবং তিন দাবীদারের ভিতরে তার সেনাবাহিনীই সবচেয়ে বড়। দিল্লী তার নিয়োজিত শাসনকর্তার অধিকারে রয়েছে এবং সে তার সেনাবাহিনী নিয়ে রাজধানী অভিমুখী সড়কের পাশে অবস্থান করছে। আমাদের সবচেয়ে বড় যুদ্ধের মুখোমুখি আমরা দাঁড়িয়ে রয়েছি।

সেদিন গভীর রাতে, কর্কশ কণ্ঠের গান আর আমোদ-ফুর্তির শব্দ অস্থায়ী ছাউনির চারপাশে প্রতিধ্বনিত হতে থাকলে, হুমায়ুন উৎসবের অনুষ্ঠান ত্যাগ করে। সে ক্ষণিকের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে রাতের মখমল কালো আকাশের বুকে মিটমিট করতে থাকা তারকারাজির দিকে তাকিয়ে থাকে কিন্তু তারপরে মন্থর পায়ে হেঁটে নিজের তাবুতে ফিরে যায়। তাবুর সামনে অপেক্ষমান একজন প্রহরী পর্দা তুলে ধরতে হুমায়ুন ভেতরে প্রবেশ করে নীচু একটা টেবিলের সামনে আসন গ্রহণ করে। সে লেখার জন্য একটা লেখনী তুলে নিয়ে সেটা জেড পাথরের তৈরী কালির দোয়াতে ডুবিয়ে তুলে নিয়ে তেলের প্রদীপের মিটমিট করতে থাকা আলোয়, পরের দিন সকালে কাবুলের উদ্দেশ্যে ফিরতি পথে ডাকবাহক দীর্ঘ যাত্রা শুরু করার পূর্বে তাঁর হাতে পৌঁছে দেয়ার জন্য, হামিদাকে চিঠি লিখতে আরম্ভ করে। সে লিখে যে সে আর আকবর নিরাপদে রয়েছে, হামিদার প্রতি নিজের ভালোবাসার কথা আরো একবার কবুল করে এবং সেই সাথে আরো জানায় যে সে নিশ্চিতভাবেই হিন্দুস্তানের সিংহাসনে আরো একবার সে অধিষ্ঠিত হতে চলেছে।

*

বাতাস উষ্ণ আর নিশ্চল, এবং হুমায়ুন নীচু বেলেপাথরের পাহাড়ের উপরে তাঁর সুবিধাজনক অবস্থান থেকে চারপাশে তাকালে সে দেখে যে দূরে দিগন্তের কোণে কালো মেঘ জমতে শুরু করেছে যেমনটা বর্ষাকাল আসন্ন হওয়ায় গ্রীষ্মের শুরুর দিকের দুপুরবেলা প্রায়ই জমে থাকে। তার্তার খানের সেনাপতিদের পরাস্ত করার ঘটনা এখন প্রায় একমাসের পুরাতন একটা ব্যাপার। এই সময়ে সে নিজের যাত্রাপথ পূর্বদিকে ঘুরিয়ে দিয়ে সেকান্দার শাহের বাহিনীর পিছু ধাওয়া করেছে, লোকটার বাহিনীতে, গুপ্তদূতদের ধারণা অনুসারে প্রায় সোয়া লক্ষ সৈন্য রয়েছে সংখ্যাটা হেসেখেলে হুমায়ুনের বাহিনীর চেয়ে অনেক বেশী যদিও তাঁর নিজের বাহিনীর সংখ্যা এই মুহূর্তে এক লাখের কাছাকাছি।

হুমায়ুন দ্রুত অনুধাবন করে যে বিজয়ের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে হলে সংখ্যার কারণে শত্রুর সুবিধাজনক স্থানে অবস্থানের ব্যাপারটাকে ক্ষয়িষ্ণু করতে হবে, উন্মুক্ত ভোলামাঠে তাঁদের মোকাবেলা করার আগে। হুমায়ুন সেজন্য, পক্ষকাল পূর্বে বৈরাম খানের অধীনে একদল হানাদার প্রেরণ করেছে এই আদেশ দিয়ে যে যতটা অল্প সংখ্যক জিনিষপত্র নিয়ে দ্রুত ঘোড়া দাবড়ে গিয়ে হাজির হয়ে তার শত্রুদের পর্যবেক্ষণ-ফাঁড়ি তছনচ করতে এবং দিল্লীর সাথে তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটাতে। সে এখন রুক্ষ প্রান্তরের উপর দিয়ে বৈরাম খানের বাহিনী ফিরে আসছে। দেখতে পায়। বার্তাবাহক তাঁকে ইতিমধ্যে জানিয়েছে যে তারা সামান্য সাফল্য লাভ করেছে, কিন্তু বৈরাম খানের নিজের মুখ থেকে সে এই সাফল্যের মাত্রা জানতে চায় এবং সে আর তার লোকেরা তাদের শত্রুর শক্তিমাত্রা আর ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্বন্ধে আর কি জানতে পেরেছে।

সংবাদের জন্য বড়বেশী উদগ্রীব থাকায় বৈরাম খান তাঁর সামনে উপস্থিত হওয়ার জন্য অপেক্ষা না করে হুমায়ুন দেহরক্ষীদের তাঁর কাছে ডেকে পাঠায় এবং তার বিশাল কালো ঘোড়ার পাঁজরে গুতো দিয়ে আস্কন্দিত বেগে পাহাড়ের উপর থেকে বৈরাম খানের সৈন্যসারি অভিমুখে নামতে আরম্ভ করে। হুমায়ুন আর বৈরাম খানকে একটা নিঃসঙ্গ গাছের সীমিত ছায়ার নীচে এক ঘন্টা পরে, লাল আর নীলের নক্সা করা একটা গালিচার উপরে ছড়িয়ে রাখা তাকিয়ার মাঝে বসে থাকতে দেখা যায়।

সুলতান, অতর্কিত হামলায় আমাদের সাফল্য বহু কষ্টার্জিত বিজয়। সিকান্দার শাহের সৈন্যরা আমাদের অন্যান্য প্রতিপক্ষের মতো না তারা যথেষ্ট শৃঙ্খলাবদ্ধ। অতর্কিত হামলায় তারা যখন চমকে যায় এবং সংখ্যায় প্রতিপক্ষের চেয়ে অনেক কম তখনও তারা আতঙ্কিত হয় না বা পলায়ন করে না বরং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে আরও প্রবলভাবে লড়াই করতে থাকে, কখনও কখনও আমরা চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগে তারা আমাদের প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি সাধন করেছে।

আমরা যেমন আশঙ্কা করেছিলাম, তারা আসলেই তবে শক্তিশালী প্রতিপক্ষ। সিকান্দার শাহের সৈন্য সমাবেশ সম্বন্ধে কি কিছু জানতে পেরেছেন?

সে তার পরবর্তী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পূর্বে তাঁর প্রধান বাহিনীকে শদ্র নদীর একটা শাখানদীর দক্ষিণ তীরে শিরহিন্দ বলে একটা শহরের কাছাকাছি জড়ো করছে। তিনদিন পূর্বে সিকান্দার শাহের বার্তাবাহকদের একটা দলের কাছে আমাদের লোকেরা কিছু চিঠিপত্র জব্দ করেছিল সেগুলো থেকে জানা যায়, দিল্লী থেকে তিনি আরও অতিরিক্ত সৈন্য আসতে বলেছেন এবং আগামী দশদিনের ভিতরে তাদের একটা বিশাল বাহিনী তার অন্য সৈন্যদের বেতনের জন্য অতিরিক্ত অর্থ আর সেই সাথে আরো যুদ্ধ উপকরণ নিয়ে পৌঁছাবে বলে তিনি আশা করছেন।

আপনি নিশ্চিত সংবাদটার ভিতরে কোনো ঝামেলা নেই, একেবারে খাঁটি?

বার্তাটার উপরে সিকান্দার শাহের সিলমোহর করা ছিল, এই দেখেন…

বৈরাম খান তার বুকের সাথে ফিতা দিয়ে বেঁধে রাখা বহু ব্যবহারে জীর্ণ চামড়ার একটা বটুয়া খুলে ভেতর থেকে ভাঁজ করা কাগজের বিশাল একটা গোছা বের করে যার উপরে লাল মোম গলিয়ে সিল করা রয়েছে এবং সেটা হুমায়ুনের দিকে এগিয়ে দেয়।

চিঠিটা দেখে আসলই মনে হচ্ছে কিন্তু পুরো ব্যাপারটা কি কোনো কূটচালের অংশ হিসাবে সাজানও হতে পারে না?

সুলতান, আমার সেটা মনে হয় না। বার্তাবাহকদের আমাদের লোকদের যে দলটা বন্দি করেছিল তারা আমাদের মূল বাহিনী থেকে অনেক দূরে প্রায় চল্লিশ মাইল পূর্বদিকে রেকি করছিল। তারা বলেছে যে বার্তাবাহকদের তারা যখন পেছন থেকে ধাওয়া করেছিল তখন ইতস্তত বিচরণ করার বদলে, যেমনটা তাঁদের কাছে প্রত্যাশিত যদি তাঁরা ধরা দিতে আগ্রহী হতো, লোকগুলো প্রাণপনে ঘোড়া হাকিয়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছিল। আমি যখন বার্তাবাহকদের সাথে কথা বলি, সিকান্দার শাহের লোকেদের চোখে মুখে বিস্ময়ের অভিব্যক্তি আর ধরা পড়ার জন্য তারা লজ্জিত সেটা স্পষ্ট ফুটে ছিল। তারা যদি অভিনয় করে থাকে তাহলে বলতেই হবে ব্যাটারা জাত অভিনেতা।

ঘটনা যদি তাই হয়ে থাকে, তাহলে শক্তিবৃদ্ধির জন্য প্রেরিত অতিরিক্ত বাহিনীর অভিগ্রহণের জন্য আমরা তাহলে দেহের প্রতিটা পেশী ব্যবহার করবো এবং অর্থ আর যুদ্ধ উপকরণ বাজেয়াপ্ত করবো। সম্ভাব্য সব যাত্রাপথের উপর নজর রাখতে অবিলম্বে গুপ্তদূতদের পথে নামার আদেশ দেন।

*

সুলতান, আমাদের উপস্থিতি সম্বন্ধে তাঁদের নিয়োজিত প্রহরীরা সতর্ক করে দিয়েছে, আহমেদ খান সামান্য হাঁপাতে হাঁপাতে হুমায়ুনকে বলে। তারা সামনে অগ্রসর হওয়া বন্ধ করে এখান থেকে দুই মাইল দূরে ঐ উচ্চভূমিরেখার শীর্ষদেশের ওপাশে অবস্থিত একটা ছোট গ্রামের চারপাশে নিজেদের সরিয়ে নিয়ে এসে একটা রক্ষণাত্মক অবস্থান গ্রহণ করেছে আর এদিকে গ্রামটার বাসিন্দারা তাদের আসতে দেখে আগেই ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছে। তারা গ্রামটার মাটির দেয়ালের পেছনে নিজেদের লোকদের মোতায়েন করছে এবং বাড়তি অবরোধক সৃষ্টির জন্য নিজেদের মালবাহী শকটগুলো উল্টো করে এলোপাথাড়ি ফেলে রাখছে।

তারা সেখানে কতজন লোক রয়েছে?

 প্রায় পাঁচ হাজার হবে, বেশীরভাগই অশ্বারোহী যোদ্ধা যাদের ভিতরে, একটা অতিকায় মালবাহী শকটকে পাহারা দেবার জন্য, কিছু তবকিও রয়েছে। তাঁদের সাথে বেশ কিছু সংখ্যক ছোট কামানও রয়েছে।

তাদের চমকে দেয়ার আর কোনো সুযোগ এখন আমরা পাব না, তাঁরা নিজেদের যুদ্ধ প্রস্তুতি শেষ করার আগে এখন আমাদের জন্য সবচেয়ে ভালো বুদ্ধি হলো আক্রমণ করা। বৈরাম খান আপনার লোকদের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেন।

হুমায়ুনকে ঘন্টা দেড়েক পরে গ্রামটার উপরে উচ্চভূমিরেখার শীর্ষদেশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় এবং তাকিয়ে দেখে তার লোকদের আক্রমণের প্রথম ঝাপটা বৈরাম খানের নেতৃত্বে অস্থায়ী অবরোধকের পেছনে অবস্থান গ্রহণকারী সেকান্দার শাহের সৈন্যদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। সেকান্দার শাহের কামান গোলাবর্ষণ শুরু করতে বিকট একটা শব্দ ভেসে আসে। বৈরাম খানের বেশ কয়েকজন লোক ভূমিশয্যা গ্রহণ করে। তবকির চাপা শব্দ এর ঠিক পরেই ভেসে এসে আরো কয়েকটা পর্যাণ আরোহী শূন্য করে। অবরোধকের কাছে পৌঁছাবার পূর্বে দ্বিতীয়বারের মতো কামান গোলাবর্ষণ করলে আরো বেশী সৈন্য হত হয় কিন্তু তারপরেও নাছোড়বান্দার মতো বৈরাম খানের লোকেরা সামনে এগিয়ে যেতে থাকে।

আব্বাজান ওদিকে দেখেন ওখানে কি মুস্তাফা আর্গুন সৈন্যসারির সামনে অবস্থান করছে? আকবর উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠে।

হুমায়ুন তাঁর সন্তানের নির্দেশক আঙ্গুলের গতিপথ অনুসরণ করে এবং গ্রামের ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া কামানের সাদা ধোয়ার ভিতরে তাঁর নতুন নিযুক্ত সেনাপতিকে নিজের মাদি ঘোড়া নিয়ে একটা মাটির দেয়ালে লাফিয়ে অতিক্রম করতে দেখে, তার বেশ কয়েকজন লোককে ঠিক পেছনেই অবস্থান করতে দেখা যায়। হুমায়ুন অন্যত্র দৃষ্টি ফিরিয়ে দেখে যে তাঁর অশ্বারোহী যোদ্ধাদের একটা বিশাল অংশ এমন জোরাল কামানের গোলার সম্মুখীন হয়েছে যে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে তারা পিছু হটে আসছে, সিকান্দার শাহের লোকদের তৈরী করা অস্থায়ী প্রতিরক্ষা কাঠামোর ঠিক সামনের এলাকায় মানুষ আর ঘোড়ার হত-আহত দেহ বিছিয়ে রয়েছে।

হুমায়ুন তারপরেই বৈরাম খানকে তাঁর একদল লোকের দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিত করতে দেখে, ইতিপূর্বে যাদের জরুরী প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করে কামানের আওতা থেকে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। মুস্তাফা আর্গুন আর তার লোকেরা অবরোধকের যে অঞ্চল অতিক্রম করেছে তারা আস্কন্দিত বেগে সেদিকে এগিয়ে যায় এবং তাঁদের অনুসরণ করে দ্রুত শত্রু শিবিরের ভেতরে প্রবেশ করে। তারা গ্রামের ভেতরে প্রবেশ করেই পেছন থেকে প্রতিপক্ষের অবস্থানের উপরে হামলা শুরু করে। অশ্বারোহী যযাদ্ধারা বেশ কিছুক্ষণ মরীয়া হয়ে লড়াই করতে থাকে, কখনও আক্রমণ করতে করতে সামনে এগিয়ে যায়, কখনও আবার আক্রমণ প্রতিরোধ করতে করতে পিছিয়ে যায় কিন্তু সিকান্দার শাহের তবকিদের দৃঢ়তার কারণে ক্রমাগত ক্ষয়ক্ষতির স্বীকার হওয়া সত্ত্বেও অবরোধক অতিক্রম করে আরো বেশী সংখ্যক সৈন্য ভিতরে প্রবেশ করলে ধীরে ধীরে হুমায়ুনের সৈন্যরা প্রতিপক্ষের উপরে প্রাধান্য বিস্তার করতে শুরু করে। এক পা, এক পা করে আক্রমণ প্রতিহতকারীদের তাদের মূল অবস্থান থেকে। অপেক্ষাকৃত ছোট একটা জায়গায় পশুর পালের মতো তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সিকান্দার শাহের একদল অশ্বারোহী সহসা নিজেদের সহযোদ্ধাদের জটলার ভিতর থেকে ছিটকে বের হয়ে এসে অবরোধকের একটা শূন্যস্থানের ভিতর দিয়ে লড়াই করে নিজেদের জায়গা করে নিয়ে তারপরে সেকান্দার শাহের মূল বাহিনীর অবস্থানের অভিমুখে দৃঢ়সংকল্প নিয়ে ঘোড়ার খুরে তুফানের বোল তুলে ছুটতে শুরু করে।

তাদের আমাদের থামাতেই হবে, হুমায়ুন চিৎকার করে বলে। আমাকে অনুসরণ কর!

আকবরকে পাশে নিয়ে, হুমায়ুন তার ঘোড়ার গলার কাছে মাথা নীচু করে রেখে প্রতিপক্ষের অশ্বারোহীদের পেছনে ধাওয়া করতে শুরু করে। ইস্পাতের বক্ষস্থল আবৃতকারী বর্ম পরিহিত, গাট্টাগোট্টা দেহের একজন সেনাপতির নেতৃত্বে, দলটা পরস্পরের সাথে দৃঢ়ভাবে একত্রিত থেকে আর প্রতিরক্ষা বিন্যাস বজায় রেখে এগিয়ে যেতে থাকে, তারা স্পষ্টতই নিজের জীবনের পরোয়া না করে তাদের সহযোদ্ধাদের ভাগ্য বিপর্যয় সম্বন্ধে যত দ্রুত সম্ভব সিকান্দার শাহকে সতর্ক করাই আপাতভাবে তাদের একমাত্র লক্ষ্য।

হুমায়ুন আর তার লোকেরা ধীরে ধীরে সামনের দলটার সাথে দূরত্ব কমিয়ে আনে। তারা যখন তীর নিক্ষেপের দূরত্বে অবস্থান করছে তখন হুমায়ুন পিঠ থেকে তাঁর ধনুক আলগা করে নিয়ে তীরের তূণীরের উদ্দেশ্যে হাত বাড়ায়। দাঁত দিয়ে লাগাম কামড়ে ধরে সে রেকাবের উপরে দাঁড়িয়ে গিয়ে প্রতিপক্ষের সেনাপতিকে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করে। তাঁর তীর ইঞ্চিখানেকের জন্য লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়, তার নিক্ষিপ্ত তীর লোকটার পর্যাণে বিদ্ধ হয়। সে ধনুকে দ্বিতীয় তীর জোড়ার আগেই শত্রু সেনাপতি গলায় তীরবিদ্ধ অবস্থায় ঘোড়া থেকে ছিটকে পড়ে। তার পা রেকাবে আটকে গিয়ে সেভাবেই সে তাঁর আতঙ্কিত ঘোড়ার পেছন পেছন বেশ কিছুদূর ছেচড়ে যায়- পাথুরে মাটিতে তার মাথা লাফাতে থাকে- যতক্ষণ না রেকাব ভেঙে যায়। সে তারপরে মাটিতে দুবার গড়িয়ে গিয়ে নিথর হয়ে পড়ে থাকে। হুমায়ুন বুঝতে পারে প্রাণঘাতি তীরটা আর কেউ না, আকবর নিক্ষেপ করেছিল। সেকান্দার শাহের অন্যান্য লোকেরাও নিজেদের ঘোড়া থেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে।

শাবাস, দারুণ নিশানা ভেদ! হুমায়ুন নিজের ছেলেকে চিৎকার করে বাহবা দেয়, কিন্তু এখন আমার পেছনে থাকো।

হুমায়ুন তার ঘোড়ার পাঁজরে গুঁতো দিয়ে আবারও জন্তুটাকে প্রতিপক্ষের ডজনখানেক অবশিষ্ট যোদ্ধাদের লক্ষ্য করে পুতবেগে ছোটায়। সে অচিরেই দলটার একেবারে পেছনের আরোহীর পাশে চলে আসে, বেচারা তাঁর ঘামে ভেজা, হাঁপাতে থাকা টাটু ঘোড়াটাকে বেপরোয়া ভাবে সামনের দিকে দাবড়াতে চেষ্টা করছে। হুমায়ুনকে দেখতে পেয়ে সে তার গোলাকৃতি ঢালটা কোনমতে অর্ধেক তুলে কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে। হুমায়ুনের তরবারির মৃত্যুদায়ী ফলা লোকটার শিরোস্ত্রাণের নীচে তাঁর গলার পেছনের দিকে আড়াআড়ি ছোবল বসায়। তার গোলাপী রক্ত ছিটকে আসে এবং শক্ত মাটির উপরে সে আছড়ে পড়ে।

হুমায়ুন পিছনে তাকিয়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করে না বরং পলাতক অশ্বারোহীদের একজনকে যাকে এখনও কেউ ধরতে পারেনি এবং তার একজন লোক তাঁকে ধাওয়া করছে কিন্তু সে এখনও প্রাণপনে ঘোড়া দাবড়ে চলেছে তার দিকে নিজের ঘোড়া ছোটায়। একটা দ্রুতগামী কালো ঘোড়ায় উপবিষ্ট লোকটা দুর্দান্ত, সাবলীল অশ্বারোহী তার ঘোড়ার খুর মাটিতে আঘাত করতে সেখান থেকে পাথরের টুকরো ছিটকে উঠে। হুমায়ুনের ঘোড়াটা অনেক তাজা হলেও সে প্রাণপনে দাবড়েও তাঁকে খুব একটা কাবু করতে পারে না। হুমায়ুন অবশেষে তাঁর আরও তিনজন দেহরক্ষীসহ লোকটার পাশে পৌঁছালে লোকটা তার একজন দেহরক্ষীকে হাতের বাকান তরবারি দিয়ে আঘাত করতে চেষ্টা করে। লোকটা হাত তুলে নিজের মাথা কোনমতে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়া থেকে বাঁচায় কিন্তু কলাচীতে একটা গভীর ক্ষত প্রাপ্ত হয়ে লড়াই থেকে পিছিয়ে আসে। দেহরক্ষীকে আঘাত করতে গিয়ে অবশ্য প্রতিপক্ষের অশ্বারোহী নিজেকে হুমায়ুনের তরবারির ধাক্কার সামনে নিজেকে অরক্ষিত করে ফেলে যা তাঁর উরুর গভীরে কেটে বসে যায় এবং সেও ঘোড়া থেকে মাটিতে পড়ে গেলে তার ঘোড়াটা একাকী ছুটে দূরে চলে যায়।

হুমায়ুন নিজের ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে এবং পর্যাণের উপর ঘুরে গিয়ে, সে পেছনে তাকিয়ে দেখে অবরোধের ভিতর থেকে পালিয়ে আসা সবাইকেই পরাভূত করা হয়েছে আর তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার আকবর নিরাপদ রয়েছে। তাঁরা সবাই যখন একত্রে আবার গ্রামের চারপাশের মূল যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে ফিরে যায় হুমায়ুন দেখে বেশীর ভাগ স্থানেই যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছে। কয়েকটা মাটির ঘরের চারপাশে কেবল যা একটু যুদ্ধ চলছে। সেখানে একটা ঘরের খড়ের চালায় আগুন জ্বলছে, সম্ভবত মাস্কেট বা কামানের গোলাবর্ষণের সময় কোনো ফুলিঙ্গ এসে পড়েছিল বা তাঁর নিজের লোকেরাই ইচ্ছাকৃতভাবে ভেতরে আশ্রয় নেয়া লোকদের বাইরে বের করে আনবার জন্য আগুন ধরিয়েছে। হুমায়ুন কাছাকাছি এগিয়ে আসবার পরে দেখে যে সেখানের লড়াইও শেষ হয়েছে এবং প্রতিপক্ষ তাদের অস্ত্র সমর্পণ করছে।

চার ঘন্টা পরে, কালো প্রায় গাঢ় বেগুনী বর্ণের মেঘে আকাশ ছেয়ে যায় এবং একটা উষ্ণ বাতাস বইতে থাকে- হুমায়ুন ভাবে, যেকোনো দিন বর্ষাকাল শুরু হয়ে যাবে, সম্ভবত আজ দুপুরবেলায়ও ব্যাপারটা ঘটতে পারে। তাঁর টকটকে লাল রঙের নিয়ন্ত্রক তাবুর চাঁদোয়ার নীচে হুমায়ুনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আকবরের দিকে ঘুরে তাকিয়ে, সে তার সন্তানের কাধ একটা হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরে। আমি সবসময়ে নিজের তীরন্দাজির দক্ষতার জন্য গর্ববোধ করতাম কিন্তু আজ প্রতিপক্ষের সেনাপতিকে লক্ষ্য করে তোমার ছোঁড়া তীরটা অসাধারণ ছিল।

আপনাকে ধন্যবাদ, কিন্তু ব্যাপারটা সম্ভবত হঠাৎ ঘটে গিয়েছে।

আমার সেটা মনে হয় না- তোমাকে আমি তীর ছোঁড়া চর্চা করতে দেখেছি… হুমায়ুন চুপ করে থাকে, কোনো কথা না বলে কেবল তার কাঁধে জোরে একটা চাপ দেয়। নিশানা ভেদের চমৎকার নিদর্শন এবং আমি খুশী যে তুমি সেটা করেছে, প্রতিপক্ষের পলায়নরত অশ্বারোহীদের ধাওয়া করার সময় আমার উচিত ছিল তোমাকে আমার সঙ্গ নেয়া থেকে বিরত রাখা। কপালগুণে ছোঁড়া কোনো তীরের আঘাতে আমাদের দুজনেরই মৃত্যু ঘটে, আমাদের পরিবারের নিয়তি সম্পর্কে আমার সমস্ত আশা ধবংস হবার সাথে সাথে ঘটনাটা তোমার আম্মিজানকেও চরম বিষাদে আপুত করতো। আমরা ভবিষ্যতে যুদ্ধক্ষেত্রে আলাদাভাবে অবস্থান করবো এবং আমি চাই তুমি সবসময়ে পশ্চাদে অবস্থান করবে।

কিন্তু আব্বাজান… আকবর প্রতিবাদের ভঙ্গিতে শুরু করে কিন্তু তার আব্বাজানের চোখে দৃঢ়সংকল্পের ইঙ্গিত দেখে সে কথা খুঁজে পায় না এবং তাঁর কথার যুক্তি সে তখন অনুধাবন করতে পারে।

যুদ্ধ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। বৈরাম খানের নেতৃত্বে আমাদের সেনাপতিরা আসছে, যুদ্ধের পরবর্তী পদক্ষেপ সম্বন্ধে আলোচনা করতে। হুমায়ুন ঘুরে দাঁড়িয়ে তাবুর ভিতরে প্রবেশ করে যেখানে তার সিংহাসনের সামনে অর্ধবৃত্তাকারে তাকিয়া বিছিয়ে রাখা হয়েছে আর তার সিংহাসনের ঠিক ডানপাশে আকবরের জন্য একটা গিল্টি করা তেপায়া পাতা হয়েছে। সবাই নিজ নিজ আসন গ্রহণ করার পরে, হুমায়ুন জানতে চায়, আমাদের কতজন লোক হতাহত হয়েছে?

আমাদের কমপক্ষে দুইশজন সৈন্য নিহত হয়েছে, এবং ছয়শর বেশী আহত হয়েছে, বেশীর ভাগেরই আঘাত মারাত্মক যাদের ভিতরে মুস্তাফা আগুনের বেশ কয়েকজন তূর্কী যোদ্ধা রয়েছে যারা প্রথমে অবরোধকের পেছনে পৌঁছেছিল।

মুস্তাফা আর্গুন আর তাঁর লোকেরা দারুণ সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। আমরা যখন লুটের মাল বিলি বণ্টন করবো তখন তাদের অংশ দ্বিগুন করার কথাটা মনে রাখতে হবে, কিন্তু সেটা করার আগে আমাদের জানতে হবে আমরা ঠিক কতখানি সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে পেরেছি।

সোনার মোহর ভর্তি দুটো অতিকায় সিন্দুক, বৈরাম খান জানায়, এবং পাঁচটা রূপার মোহর ভর্তি যেগুলো সিকান্দার শাহের সৈন্যদের বেতন হিসাবে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তাঁর লোকেরা তাঁদের এই ক্ষতির কারণে আশাহত হবে এবং এর ফলে হয়তো তাঁদের লড়াই করার প্রবৃত্তিরও পরিবর্তন হতে পারে।

আমরা সেটা কেবল আশা করতে পারি। আমরা যুদ্ধের উপকরণ কেমন দখল করেছি?

দুটো গরুর গাড়ি বোঝাই করা নতুন মাস্কেট ভর্তি কাঠের বাক্স এবং তাঁদের জন্য প্রয়োজনীয় বারুদ আর সীসার বল। দুটো একেবারে নতুন ব্রোঞ্জের কামান আর দশটা ছোটমাপের কামান। সেকান্দার শাহের লোকেরা ছয়টা কামানের নলে অতিরিক্ত বারুদ ভরে সেগুলো ধবংস করতে সক্ষম হয়েছে। তরবারি আর রণকুঠার ভর্তি অসংখ্য বাক্স ছাড়াও প্রায় সাড়ে তিন হাজার ঘোড়া আর বেশ কিছু সংখ্যক ষাড় আর মালবাহী খচ্চরও আমরা দখল করেছি। মোটামুটি বলা যায় আমাদের যুদ্ধের রসদের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য আর সন্তোষজনক পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে আর সেই সাথে সেকান্দার শাহের রসদ ঠিক একই পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে।

তার মোট কতজন লোক আমাদের হাতে বন্দি হয়েছে?

প্রায় হাজার চারেক হবে। বাকিরা সবাই যুদ্ধে নিহত হয়েছে। সুলতান আমরা বন্দিদের নিয়ে কি করবো?

তাদের আটচল্লিশ ঘন্টা বন্দি করে রাখো এবং তারপরে যারা পবিত্র কোরানশরীফ স্পর্শ করে শপথ করে বলবে যে তারা আর আমাদের বিপক্ষে যুদ্ধ করবে না, তাদের কোনো অস্ত্র ছাড়া পায়ে হেঁটে দক্ষিণে যাবার অনুমতি দেবে। সিকান্দার শাহের বিরুদ্ধে আমাদের চূড়ান্ত বিজয়ের ব্যাপারে আমরা এবার আমাদের আলোচনা শুরু করতে পারি। জাহিদ বেগ, আপনার কি মনে হয় আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কি হওয়া উচিত?

বর্ষাকাল প্রায় শুরু হয়ে গিয়েছে। আমাদের পক্ষে এসময় সন্তোষজনকভাবে অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হবে না- আমাদের কামান আর মালবাহী শকটগুলো এসময়ে খুব সামান্যই চলাফেরা করতে পারবে। আমাদের সাময়িকভাবে কোথায় শিবির স্থাপন করে দক্ষিণে গুপ্তদূতদের প্রেরণ করে সেকান্দার শাহ আর দিল্লীর মধ্যবর্তী প্রধান সংযোগ সড়কের উপর নজর রাখা উচিত, এবং তারপরে বর্ষাকাল সমাপ্ত হলে…।

না, হুমায়ুন তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বলে, আমি চাই না বর্ষাকালের কারণে আমরা থেমে থাকি। সেকান্দার শাহও সেটাই প্রত্যাশা করবে। হিন্দুস্তানের সিংহাসন কল্পনাতীত রকমের মূল্যবান। আমি সেটা বহুদিন আগে হারিয়েছি। সেটা ফিরে পাবার সময় এখন হয়েছে। আমরা যদি এখনই তাঁকে আক্রমণ করার জন্য জোর দেই তাহলে আমরা তাকে চমকে দেবার একটা সুযোগ লাভ করবো। অতীতে আমি প্রায়ই দেরী করে ফেলতাম আর সুযোগ হারাতাম। এইবার সেটা আর হবে না। আহমেদ খান, সেকান্দার শাহের মূল বাহিনী এখান থেকে কতদূরে অবস্থান করছে? আমাদের কতদিন পথে থাকতে হবে তাঁর কাছাকাছি পৌঁছাতে হলে?

তারা শতদ্রুর তীরে শিরহিন্দে এখনও অবস্থান করছে, জায়গাটা এখান থেকে প্রায় একশ মাইল পূর্বদিকে অবস্থিত, আমাদের বাহিনীকে তার সমস্ত উপকরণসহ সেখানে পৌঁছাতে খুব সম্ভবত দশদিন সময় লাগবে। আমাদের গুপ্তচরেরা জানিয়েছে তারা সেখানে বেশভাবে শিবির স্থাপন করেছে এবং পরবর্তী পদক্ষেপ নেবার আগে সেখানেই এবারের বর্ষাকালটা আরামে অতিবাহিত করার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে।

বেশ, তাঁদের জন্য দারুণ একটা চমক অপেক্ষা করছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *