৪.১ মোগলদের প্রত্যাবর্তন – চতুর্থ পর্ব

চতুর্থ পর্ব – মোগলদের প্রত্যাবর্তন

২১. এক ভাইয়ের মর্মবেদনা

সুলতান, আপনাকে এখনই একবার আসতে হবে।

হুমায়ুন বুটি দ্বারা খচিত করা কালো চামড়ার ময়ানে ইস্পাতের উপরে হাতির দাঁতের কারুকাজ করা তরবারির ফলাটা- অধীনস্ত এক জায়গীরদার সম্প্রতি উপহারটা পাঠিয়েছে পুনরায় ঢুকিয়ে দেয় যা সে মনোযোগ দিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিল। জওহর, কি ব্যাপার?

জওহর দুহাত প্রসারিত করে অসহায় একটা ভঙ্গি করে এবং হুমায়ুন তার মুখাবয়বে ভীষণ বিপর্যস্ত একটা অভিব্যক্তি প্রত্যক্ষ করলে সে আর কোনো প্রশ্ন না করে তাকে অনুসরণ করে। সন্ধ্যা দ্রুত ঘনিয়ে আসছে এবং হুমায়ুন যখন দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে নিচের প্রাঙ্গণে নামতে থাকে, ইট পাথরের কঠিন অবয়ব তখন বেগুনী ছায়ার আড়ালে মসৃণ হতে শুরু করেছে। তোরণদ্বারের ঠিক ভেতরেই আহমেদ খানের চারজন লোক একটা বাদামী রঙের লম্বা ঘোড়ার চারপাশে জটলা করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হুমায়ুন ঘোড়াটার কাছাকাছি যেতে লক্ষ্য করে যে প্রাণীটার গলা আর কাঁধে গাঢ় একটা কিছুর দাগ রয়েছে যা মাছি আকৃষ্ট করছে, এবং তাঁকে অভিবাদন জানাতে তার লোকেরা ঘোড়াটার কাছ থেকে সরে দাঁড়াতে, সে দেখে পর্যানের উপরে মুখ নীচের দিকে করা অবস্থায় একটা দেহ বাধা রয়েছে, দেহটা মৃত হরিণের মতোই নিথর। ঘোড়াটার গায়ের চামড়ায় রঙের তারতম্য জমাট রক্তের ফলে সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু মৃতদেহটাই কেবল তার অখণ্ড মনোযোগ আকর্ষণ করে। সে যদিও চোখের সামনের দৃশ্যটা বিশ্বাস করতে চায় না কিন্তু পেষল দেহটা সে বোধহয় চিনতে পেরেছে, যার নির্জীব হাত আর পা এতোই লম্বা যে ঘোড়র পেটের নীচে অব্দি সেগুলো ঝুলে রয়েছে।

হুমায়ুন ক্রমশ প্রবল হতে থাকা অমঙ্গলের পুর্বানুভব নিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় এবং ঝুঁকে গিয়ে মৃতলোকটার মাথাটা উঁচু করে তুলে ধরে। তার দিকে তাকিয়ে থাকা হিন্দালের তামাটে চোখের মণিতে কোনো ভাষা নেই। ভাইয়ের পলকহীন চোখের দৃষ্টি সহ্য করতে না পেরে হুমায়ুন চোখের পাতাগুলো বন্ধ করে দেয়। সে চোখের পাতা বন্ধ করার সময় ভাইয়ের মৃতদেহের উষ্ণতা অনুভব করে চমকে উঠে, তারপরে সে বুঝতে পারে যে হিন্দালের মুখটা ঘোড়ার পাজরের সাথে ঝুলছিল। সে পরিকর থেকে নিজের খঞ্জর বের করে আনে এবং দেহরক্ষীদের দূরে দাঁড়িয়ে থাকার ইঙ্গিত করে দড়ি কাঁতে শুরু করে যা দিয়ে হিন্দালের মৃতদেহটা কেউ একজন ঘোড়ার সাথে বেঁধে দিয়েছিল। সে তারপরে পরম মমতায় ভাইয়ের মৃতদেহটা আলতো করে তুলে নিয়ে, মুখটা উপরের দিকে রেখে, প্রাঙ্গণের চ্যাপ্টা, বর্গাকার পাথরের উপরে নামিয়ে রাখে। মৃতদেহটার পাশে হাটু মুড়ে বসে থাকা অবস্থায়, ঘনায়মান অন্ধকারের ভেতরে আহমেদ খানের একজন লোকের উঁচু করে ধরে রাখা একটা মশালের দপদপ করতে থাকা হলুদাভ আলোয় সে হিন্দালের গলায় একটা তাজা ক্ষতচিহ্ন দেখতে পায়- যা কেবল তীরের অগ্রভাগ দ্বারাই হওয়া সম্ভব।

শোকের বেনোজলে তার অস্তিত্ব ধুয়ে যেতে থাকে। তাঁর সৎ-ভাইদের ভিতরে সে হিন্দালকেই সবচেয়ে বেশী পছন্দ করতো। সৎ, সাহসী আর নৈতিকতাসম্পন্ন, এবং তাঁর অন্যান্য ভাইদের চেয়ে অনেক কম উচ্চাভিলাষী, সম্ভবত বাবরের সব সন্তানের ভিতরে হিন্দালই ছিল অন্তরের দিক থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ। ভাই আমার, আমি দোয়া করি তোমার বেহেশত নসীব হোক এবং বেঁচে থাকা অবস্থায় আমি তোমাকে যে কষ্ট দিয়েছি মৃত্যুতে তুমি আমায় সেজন্য মার্জনা করবে, হুমায়ুন ফিসফিস করে বলে। তারুণ্যে ভরপুর হিন্দালের অবয়ব এবং গর্বিত ভঙ্গিতে তাঁর আকবরকে উদ্ধার করার কাহিনী বর্ণনা করার দৃশ্য হুমায়ুনের মানসপটে ভাসতে থাকে, তার দুচোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠে। হাতের উল্টো পাশ দিয়ে চোখের পাতা মুছে, পুনরায় উঠে দাঁড়াবার আগে হুমায়ুন বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে তারপরে উঠে দাঁড়িয়ে জানতে চায়, মৃতদেহটা কে খুঁজে পেয়েছে?

সুলতান, আমিই প্রথম দেখেছি, মশালধারী সৈন্যটা বলে, হুমায়ুন তাকিয়ে দেখে, সদ্য যৌবনে পা দেয়া একটা ছেলে।

কোথায়?

শহর থেকে আধমাইল দূরে সবুজ রঙের কয়েকটা জুনিপার ঝোপের পাশে শাহজাদার ঘোড়াটা দড়ি বাঁধা অবস্থায় ঘাস খাচ্ছিল।

কেউ একজন তারমানে প্রাণ সংহারক তীরটা বের করে, হিন্দালকে তার ঘোড়ার সাথে বেঁধে তারপরে তাকে এমন স্থানে রেখে গিয়েছে যেখানে তাঁকে কেউ খুঁজে পাবে। হুমায়ুন অবসন্ন মনে ভাবে, পুরো ব্যাপারটার ভিতরে কামরানের কাজের ধারা স্পষ্টভাবে ফুটে রয়েছে। কামরান আর আসকারিকে ক্ষমা করার দুই মাসের ভিতরে, ক্ষমাপ্রদর্শনের জন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ দূরে থাক, দুজনেই কাবুল থেকে পালিয়ে যায়। তাঁর বিরুদ্ধে পুনরায় সবদ্ধ হয়ে, তারা হানাদারে পরিণত হয়, দুর্গম অঞ্চলে অবস্থিত শক্তঘাঁটি থেকে উপজাতীয় লোকদের একটা দলকে নেতৃত্ব দিয়ে তারা ধেয়ে আসত- বেশীরভাগ সময়েই অরাজক কাফ্রি বা চরখা গোত্রের লোকেরা তাদের সাথে থাকতো, কিন্তু দুই ভাইয়ের কোনো বাছবিচার ছিল না, তারা যাদের খুঁজে পেতো তাদেরই ব্যবহার করতো- হুমায়ুনের সীমান্তচৌকি এবং কাবুলের সমৃদ্ধির উৎস- এর প্রাণশক্তি বণিকদের মালবাহী কাফেলা আক্রমণ করতে। আকবরকে উদ্ধারের সময় হিন্দালের বিশ্বাসঘাতকতাকে কামরান কখনও ক্ষমা করেনি এবং হিন্দালকে হত্যা করে তাঁর মৃতদেহটা একটা বার্তা হিসাবে হুমায়ুনকে পাঠাবার মতো বিদ্বেষী মনোভাব নিশ্চিতভাবেই কামরানের রয়েছে।

কিন্তু আসলেই ঠিক কি ঘটেছিল? কামরানই যদি হত্যাকারী হয়ে থাকে, হিন্দালের মৃত্যু কি তাহলে ভাগ্যচক্রে দেখা হয়ে যাবার ফলে সংঘটিত কোনো ঘটনা নাকি উত্তরের পাহাড়ী এলাকায় কামরান তাঁকে হত্যা করার জন্যই খুঁজে বের করে খুন করেছে, যেখানে আকবরকে উদ্ধার করার পরবর্তী বছরগুলোতে সে নিজের জন্য একটা আশ্রয়স্থল তৈরী করেছিল? আমার ভাইয়ের মৃতদেহ আর তাঁর ঘোড়ার পর্যাণে ঝোলান থলি খুঁজে দেখো। তাঁকে কিভাবে বা কেন এমন পরিণতি বরণ করতে হয়েছে, সে সম্বন্ধে আমাদের জানাতে পারে এমন যেকোনো কিছুর সন্ধান করো। হুমায়ুন আদেশ দিয়ে চলে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়ায়, সে দাঁড়িয়ে থেকে এই কাজটা দেখতে পারবে না।

সে অন্ধকারে যেখানে দাঁড়িয়ে, আপন ভাবনা আর স্মৃতি রোমন্থনে বিভোর হয়েছিল, কয়েক মিনিট পরে একজন সৈন্য সেখানে তাঁর সামনে এসে দাঁড়ায়। সুলতান, তার ঘোড়ার পর্যাণে এই চিরকুটটা ছাড়া আমরা গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই খুঁজে পাইনি। হুমায়ুন কাগজের টুকরোটা নিয়ে মশালের আলোয় সেটা পড়ে। নির্দিষ্ট কাউকে উদ্দেশ্য না করে সংক্ষিপ্ত কয়েকটা বাক্যে হিন্দাল জানিয়েছে, যদি তাঁর কিছু হয় তাহলে তাঁকে যেন তাঁর আব্বাজানের পাশে সমাধিস্থ করা হয়। সে আরও লিখেছে যে তাঁর চুনি বসান খঞ্জরটা তাঁর ইচ্ছা যেন আকবরকে দেয়া হয় যা একসময় বাবরের কোমরে শোভা পেত। সুলতান, খঞ্জরটা এখনও তার পরিকরে গোঁজা রয়েছে। সৈন্যটা এবার একটা রূপালী ময়ান এগিয়ে দিতে, এটাও চুনির কারুকাজ করা, মশালের আলোয় সেটা দ্যুতি ছড়াতে থাকে। হিন্দালকে তাহলে যেই হত্যা করে থাকুক সে চোর নয়, হুমায়ুন ভাবে। এটা থেকে সে আরও একটা বিষয়ে নিশ্চিত হয় যে হিন্দাল সম্ভবত অপ্রত্যাশিতভাবে আর সহসাই মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে, নিজের খঞ্জর ময়ান থেকে বের করার সময়ও সে পায়নি। সে আবারও কামরানের সবুজ চোখ, অবজ্ঞাপূর্ণ চাহনি দেখতে পায়…

*

অনেকেই এখন মোগলদের সবুজ নিশানের নীচে ফিরে আসতে প্রস্তুত।

এইসব না করে, কামরান আর আসকারির এই হুমকি দীর্ঘায়িত কোনো অভিযান সূচনা করা তার জন্য অসম্ভব করে তুলেছে। শেরশাহের প্রধান আধিকারিকেরা একত্রিত হয়ে নতুন সম্রাট পছন্দের সময় পেয়েছে। শেরশাহের বড় ছেলেকে প্রত্যাখ্যান করে সামরিক দক্ষতার চেয়ে যিনি তাঁর বিলাসিতার কারণে বেশী পরিচিত। তারা তাঁর ছোট ছেলে ইসলাম শাহকে নির্বাচিত করে, যার প্রথম কাজই ছিল বড় ভাইকে হত্যার আদেশ দেয়া। হুমায়ুন বিষয়টার তাৎপর্য ঠিকই বুঝতে পেরেছে। কামরান আর আসকারিকে মার্জনা করার পরিবর্তে সে যদি প্রাণদণ্ড দিত, তাহলে ইসলাম শাহের পরিবর্তে আগ্রার তখতে সে অধিষ্ঠিত থাকতো।

তার সৎ-ভাইয়েরা যে এতোদিন তাঁর পরিকল্পনাকে বিলম্বিত করবে, এটা হুমায়ুনকে একাধারে ক্রুদ্ধ এবং ব্যথিত করে তুলে। তাঁর ক্ষমা প্রদর্শনের প্রতি তাঁদের কৃতজ্ঞতাবোধ কোথায়? কামরানের ব্যাপারে তাঁর বোধকরি বিস্মিত হওয়াটা মানায় না, তাঁর প্রতি কামরানের ঈর্ষা আর ঘৃণা আপাতভাবেই অপ্রশম্য, কিন্তু আসকারি কিভাবে এমন শঠতার সাথে তাঁর উদারতার প্রতিদান দেয়? কান্দাহারে আসকারি যখন তার কাছে আত্মসমর্পন করে, তাকে দেখে মনে হয়েছিল সে অনুশোচনা বোধ করছে, এমনকি নিজের কৃতকর্মের জন্য সে লজ্জিত। সেই অনুভূতিগুলো হয়ত যথার্থই ছিল কিন্তু কামরানের প্রভাবে প্ররোচনায় সেগুলো বেশীদিন স্থায়ী হয়নি। আসকারি তাঁর পুরোটা জীবন কামরানের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এসেছে…

আপেল গাছের নীচে জন্মান মিষ্টি ঘাসের উপর তার ঘোড়াটাকে দিয়ে চরতে দিয়ে জওহর যেখানে প্রাণীটার লাগাম ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেদিকে মন্থর পায়ে হেঁটে যাবার সময়েও হুমায়ুনের মনের ভিতরে নানা ধরনের চিন্তা খেলা করতে থাকে। ঘোড়ার পর্যাণে উঠে বসেই দূর্গপ্রাসাদে দ্রুত ফিরে যাবার অভিপ্রায়ে হুমায়ুন প্রাণীটার পাজরে গুঁতো দেয়। সে মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হিন্দালের মৃত্যু একটা ইশারা যে আর অপেক্ষা করাটা সমীচিন হবে না, সত্যের অপলাপ আর না, আবেগপূর্ণ আশায় বুক বাধার দিন শেষ যে তার সৎ-ভাইয়েরা হয়ত এখনও কোনো মীমাংসায় পৌঁছাতে পারবে। তাদেরকে নিজেদের পাহাড়ী আড্ডাখানা থেকে দাবড়ে বের করার প্রচেষ্টা তাঁর এখন পর্যন্ত সফল হয়নি। আরো দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হয়ে কিছু একটা করতে হবে…

সেদিন রাতের বেলা, হুমায়ুন তার দরবার কক্ষে যখন প্রবেশ করছে, সে দেখে তাঁর সেনাপতি এবং পরামর্শদাতারা ইতিমধ্যেই সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছে। তাঁদের মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে থাকার সময়ে সে এখনও নিজের অজান্তে একজন লোককে খুঁজতে থাকে কাশিম, যার শান্ত বিবেচনাবোধ এবং নিরঙ্কুশ আনুগত্য তাঁর ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ শাসনামলের গুটিকয়েক অপরিবর্তনীয় বৈশিষ্ট্যের অন্যতম ছিল। কিন্তু গত শীতে, বরফাবৃত আঙ্গিনা অতিক্রম করার সময়ে কশিম পা পিছলে পড়ে গিয়ে নিজের ডান উরুর হাড় ভেঙে ফেলেন। তাঁর হাকিমেরা আফিম দিয়ে তাঁকে ঘুম পাড়িয়ে রাখলেও তাঁর বৃদ্ধ শরীরের জন্য আঘাতটা বড্ড বেশী মারাত্মক ছিল। তিনি সংজ্ঞাহীনতার অতলে ডুবে যান এবং দুইদিন পরে সারাজীবন সবকিছু যেভাবে সম্পন্ন করেছেন ঠিক সেভাবেই নিরবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ফারগানার বালক-রাজা হিসাবে তার রাজত্বকালের শুরুর দিকের অনিশ্চিত দিনগুলোতে তিনি বাবরের সাথে ছিলেন, ঠিক যেমন তিনি সবসময়ে হুমায়ুনের পাশে থেকেছেন। হুমায়ুন তার শান্ত, আশ্বাসদায়ক উপস্থিতি আর তাঁর মৃদু কণ্ঠে ক্রমাগত মূল্যবান উপদেশ শুনতে ভীষণভাবে অভ্যস্ত। তাঁর মৃত্যু মানে আক্ষরিক অর্থেই অতীতের সাথে সম্পর্কছেদ।

কিন্তু হুমায়ুনকে এখন ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা করতে হবে। নিজের সিংহাসনে পিঠ সোজা করে উপবিষ্ঠ হয়ে সে শুরু করে। আমার সৎ-ভাইদের ব্যাপারে আমার ধৈৰ্য শেষ হয়ে গিয়েছে। তাদের সেনাবাহিনী যতক্ষণ না ধ্বংস করা হচ্ছে এবং তাঁদের বন্দি করা হচ্ছে তারা সবসময়ে একটা হুমকি হিসাবে বিরাজ করবে।

আমাদের সেনাবাহিনীর বরাত মন্দ…একদিন আমরা নিশ্চয়ই তাদের বন্দি করতে পারবো, জাহিদ বেগ বলে। কামরান আর আসকারিকে পরাজিত করতে ব্যর্থ হওয়াকে সে নিজের সম্মানের জন্য হানিকর বলে গন্য করে।

আমরা এখন যেভাবে চেষ্টা করছি সেভাবে করতে থাকলে আমরা সন্দেহ আছে- যদি আমাদের কপাল খুব ভালো না হয়। আমার অনেক দিন থেকেই সন্দেহ যে আমাদের সেনাবাহিনীতে আর শহরেও তাদের গুপ্তচর রয়েছে। সেজন্যই তারা সবসময়ে আমাদের ফাঁকি দিতে পারছে, আমাদের শক্তি আর সময় অপচয়ে বাধ্য করছে যা অন্যত্র আরো কার্যকরী উপায়ে ব্যবহৃত হতে পারতো।

কিন্তু আমরা আর কিভাবে চেষ্টা করতে পারি? জাহিদ বেগ।

আমি সেজন্যই আপনাকে এখানে ডেকে পাঠিয়েছি। কামরান, আসকারি আর তাঁদের পাহাড়ি হানাদারদের পরাস্ত করা কোনোমতেই আমাদের সাধ্যাতীত কোনো ব্যাপার নয়। কাবুল প্রাচুর্যময় একটা রাজ্য। বণিকের দল যারা ব্যবসার কাছে এখানে আসে এবং আমাদের সরাইখানায় অবস্থান করে তাদের সংখ্যা প্রচুর। তাদের দেয়া খাজনায় আমাদের কোষাগার সমৃদ্ধ করে। আমি এই সম্পদ আমার দীর্ঘ দিন যাবত স্থগিত অবস্থায় থাকা হিন্দুস্তান অভিযানের জন্য সঞ্চিত রাখছিলাম কিন্তু আমি এখন এই সম্পদের কিয়দংশ পরিমাণ আমার সৎ-ভাইদের সমস্যা চিরতরে দূর করার জন্য ব্যয় করছে আগ্রহী…

কিভাবে, সেটা করতে চান, সুলতান? জাহিদ বেগ জানতে চায়।

যে ব্যক্তি আমার সৎ-ভাইদের যে কোনজনকে বন্দি করতে পারবে তাঁকে আমি আমার দেহের ওজনের সমপরিমাণ স্বর্ণ দান করবো। আমরা সেই সাথে আমাদের নিজেদের প্রয়াসও দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেবো- তাদের বন্দি করার জন্য আমরা আমাদের পুরো সেনাবাহিনী নিয়োজিত করবো। আমি নিজে তাদের নেতৃত্ব দেবো। আমি সেই সাথে আমাদের সঙ্গে এই অভিযানে অংশ নেবার জন্য উপজাতীয় লোকদের বিশাল অংকের পারিশ্রমিক প্রদান করবো। পাহাড়ের প্রতিটা বলি আর চড়াই উতরাই তাদের চেনা। আশি শপথ করছি আমার সৎ-ভাইদের বন্দি করে তবেই আমি বিশ্রাম নেব।

*

সুলতান, আমাদের একটা পর্যবেক্ষক দল কারাবাগের দিক থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখেছে, আহমেদ বেগ বলে, আস্কন্দিত বেগে ঘোড়া ছুটিয়ে হুমায়ুনের কাছে এসে সে তার সাদা ঘোড়ার লাগাম এত জোরে টেনে ধরে যে প্রাণীটা ফোঁসফোঁস শব্দে প্রতিবাদ করে উঠে।

তোমার মনে হয় সেখানের বসতি কেউ আক্রমণ করেছে?

সুলতান, আমি একদম নিশ্চিত ভাবে সেটা বলতে পারি।

তাহলে দেরী কেন, চলো এগিয়ে যাই। গনগনে কমলা রঙের সূর্যের নীচে নিদাঘ-তপ্ত শক্ত মাটির বুকে তাঁর ঘোড়ার খুর যখন ঢাকের বোল তুলে, হুমায়ুন নিজেকে এই আকাঁকু অন্তত দেয় যে শেষ পর্যন্ত কামরান আর আসকারির কাছাকাছি সে পৌঁছাতে পেরেছে। গত তিন সপ্তাহ ধরে কাবুলের উত্তরের পাহাড়ী উপত্যকায় সে আর তার লোকেরা বিশাল এক হানাদার বাহিনীকে ক্রমাগত ধাওয়া করে চলেছে, প্রতিবারই তারা পৌঁছে কেবল পোড়া বসতি, তছনছ হওয়া ফলের বাগান আর প্রচণ্ড গরমে পচতে শুরু করা মৃতদেহ দেখতে পেয়েছে। কিন্তু কারাবাগ থেকে তারা মাত্র চার মাইল দূরে রয়েছে। হুমায়ুন তার যৌবনে বহুবার এখানে শিকারে এসেছে বলে এলাকাটা সে ভালো করেই চেনে- বিশাল, সমৃদ্ধ একটা এলাকা যেখানে আখরোট আর খুবানির বাগান রয়েছে, বাগানের মাটির দেয়ালের পাশে উইলো বনের ধারে দিয়ে বয়ে যাওয়া নহরের পানি দিয়ে, যেখানে চাষাবাদ করা হয়।

তাকে অনুসরণ করছে পাঁচশ সুসজ্জিত সৈন্যের একটা দল- অশ্বারোহী তীরন্দাজ এবং উজ্জ্বল, ইস্পাতের ফলাযুক্ত বর্শা সজ্জিত অশ্বারোহী যোদ্ধা- সে ভাবে কারাবাগ যারাই আক্রমণ করে থাকুক, তাঁদের মোকাবেলা করার জন্য প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট সৈন্য তাঁর সাথে রয়েছে। চূড়ায় কয়েকটা অল্পবয়সী ওকগাছ সমৃদ্ধ একটা পাহাড়ের পাশ দিয়ে বাঁক নিতেই তাদের সামনে কারাবাগ এবং এর সমৃদ্ধ ফলের বাগান দৃশ্যমান হয়। হুমায়ুনের যেমনটা মনে আছে সামনের দৃশ্যপট মোটেই তেমন সুখকর নয়। ফসলের মাঠ আর ফলের বাগানে আগুন জ্বলছে এবং মাঠের উপর ভাসতে থাকা ঝাঝালো গন্ধযুক্ত ধোঁয়ার ভিতর দিয়ে সে দেখে যে বসতির প্রবেশদ্বার ভাঙা। তাঁর মনে হয় ঘোড়ার খুরের বজ্রগম্ভীর শব্দ ছাপিয়ে সে আর্তনাদের আওয়াজ শুনতে পেয়েছে।

ন্যায়ের তরে! হুমায়ুন মাথার উপরে আলমগীর বৃত্তাকারে ঘোরাতে ঘোরাতে চিৎকার করে উঠে এবং নিজের দেহরক্ষীদের পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাবার জন্য সে তার ঘোড়ার পাঁজরে নির্মমভাবে গুতো দিতে থাকে। সেই প্রথম ভাঙা প্রবেশদ্বারের নীচে দিয়ে বসতিতে প্রবেশ করে, বৃদ্ধ এক লোকের মৃতদেহের চারপাশে নিজের ঘোড়া নিয়ে বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকে যার রক্তাক্ত পৃষ্টদেশে একটা রণকুঠার গেঁথে রয়েছে। তাঁর ডান দিকে, বিশ গজ দূরে, হুমায়ুন দুজন লোককে দেখে তাদের মাথার ভেড়ার পশমের তৈরী অপরিপাটি, গোলকাকার টুপি দেখে বোঝা যায় লোকগুলো চকরা গোত্রের আতঙ্কিত একটা মেয়েকে বাসার ভেতর থেকে টেনে বের করে আনছে। তাঁদের একজন ইতিমধ্যেই নিজের ঢোলা পাজামার দড়ি খুলে ফেলেছে। হুমায়ুনকে দেখে তাদের চোয়াল ঝুলে পড়ে। মেয়েটাকে ছেড়ে দিয়ে, সে হাচড়পাঁচড় করে সামনে থেকে সরে যায়, তারা দুজনেই নিজেদের ধনুকের উদ্দেশ্যে হাত বাড়ায় কিন্তু হুমায়ুন তাঁদের কাছে পৌঁছে গিয়েছে। সে তার তরবারির এক মোক্ষম কোপে প্রথমজনের দেহ কবন্ধ করে দেয়, লোকটার ছিন্নমুণ্ড উষ্ণ বাতাসে ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে পাথরের সরদলে আছড়ে পড়ে। তারপরে, পিছনের দিকে ঝুঁকে গিয়ে ঘোড়ার লাগাম শক্ত করে টেনে সে তার ঘোড়াকে পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড় করিয়ে ফেলে এবং নিমেষ পরেই প্রাণীটাকে সামনের দিকে এগোতে বলে, যাতে এর সামনের পায়ের খুর দ্বিতীয় চকরার খুলিতে হাড় ভাঙার সন্তোষজনক শব্দ সৃষ্টি করে।

তার লোকেরা যারা তাকে অনুসরণ করে বসতিতে প্রবেশ করেছিল চারপাশে এখন প্রাণ খুলে লড়াই উপভোগ করছে। লুটেরার দল, ধর্ষণ আর লুট করার অভিপ্রায়ে আগত, পুরোপুরি অপ্রস্তুত অবস্থায় ধরা পড়েছে। যে যেখানে পারে আড়ালের সন্ধানে দৌড়াতে শুরু করে। কিন্তু হুমায়ুনের পুরো ভাবনা জুড়ে এখন কেবল তার সৎ-ভাইয়েরা বিরাজ করছে। সে তার ঘোড়া চক্রাকারে ঘুরিয়ে, চারপাশে ধ্বস্তাধ্বস্তি, চিৎকার করতে থাকা বিশৃঙ্খল মানুষের ভীড়ে তাদের খুঁজতে চেষ্টা করে। সুলতান, মাথা নীচু করেন! আর্তনাদ, চিৎকার আর অস্ত্রের ঝনঝনানি ছাপিয়ে সে আহমেদ খানের হুশিয়ারি শুনতে পায় এবং ঠিক সময়ে মাথা নীচু করে পাশের একটা বাড়ির সমতল ছাদের উপরে দাঁড়িয়ে থাকা ঝাকড়া চুলের দানবাকৃতি একটা মানুষের তাঁকে লক্ষ্য করে নিক্ষিপ্ত বর্শার ফলা এড়িয়ে যায়। হুমায়ুন তার ঘোড়ার পর্যানের সাথে যুক্ত দড়ি থেকে ঝুলন্ত রণকুঠারটা তুলে নেয় এবং বাতাসের ভিতর দিয়ে প্রচণ্ড বেগে সেটাকে ছুঁড়ে মারে। কুঠারটা ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার বুকে এতো জোরে আঘাত করে যে সে উপর থেকে সোজা পেছনের দিকে উল্টে পড়ে, যেন গাদাবন্দুকের গুলি আঘাত করেছে।

হুমায়ুনের কানে তাঁর রক্ত ধপধপ শব্দে বাড়ি মারতে থাকে। লড়াইয়ের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করতে পেরে তার বেশ ভালোই লাগে। সে তার মুখ মোছার সবুজ কাপড়টা দিয়ে মুখের ঘাম মুছে, সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে বেঁচে থাকা অবশিষ্ট গুটিকয়েক লুটেরা কুয়ার উপরের কাঠের কাঠামোর সাথে দড়ি দিয়ে বাঁধা কয়েকটা ঘোড়ার দিকে ছুটে যাচ্ছে। একজনও যেন পালাতে না পারে। নিজের ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে পালাতে থাকা লোকগুলোর দিকে দৌড়াতে শুরু করার আগে সে চিৎকার করে বলে। হানাদারদের একজন মাত্র লাফিয়ে নিজের ঘোড়ায় উঠতে যাবে, এমন সময় সে সামনের দিকে ঝুঁকে এসে তাঁর কাঁধ চেপে ধরে এবং প্রচণ্ড এক ধাক্কায় তাকে মাটিতে ছিটকে ফেলে দেয়। হুমায়ুন তার ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে মাটিতে পড়ে থাকা লোকটার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে উঠে, তুমি কার লোক? এই মুহূর্তে আমার প্রশ্নের জবাব দাও নতুবা আমার তরবারির ফলা তোমার কণ্ঠনালি ছিন্ন করবে। লোকটা বাতাসের অভাবে হাঁসফাস করে এবং কথা বলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করার মাঝেই হুমায়ুন পেছন থেকে একটা পরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে আসতে শুনে।

তারা সবাই আমার লোক। আমি আত্মসমর্পণ করছি। আসেন এসব বিরোধের একেবারে অবসান ঘটাই।

হুমায়ুন ঘুরে তাকিয়ে তাঁর কাছ থেকে মাত্র চারগজ দূরে আসকারিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, কৃশকায় মুখটা তার ডান ভ্রর উপরের ক্ষতস্থান থেকে গড়িয়ে পড়া রক্তে ভেজা। তাঁর পায়ের কাছে নিজের বাঁকান তরবারি এবং নিক্ষেপক খঞ্জর পড়ে রয়েছে। আসকারির লোকেরা যখন দেখে তাদের দলপতি কি করেছে, বাকি লোকেরা তখন নিজেদের অস্ত্র ত্যাগ করে।

হুমায়ুনের লোকেরা ইতিমধ্যে চারপাশ থেকে তাঁদের ঘিরে ফেলেছে। সবকটাকে বেঁধে ফেল, সে আদেশ দেয়। তারপরে, ঘোড়া থেকে নেমে সে মন্থর পায়ে আসকারির দিকে এগিয়ে যায়। নিজের ভাইয়ের এহেন আচরণের কারণে খানিকটা বিভ্রান্ত এবং আসকারি যদি নিজের অস্ত্র ফেলে না দিয়ে ব্যবহার করলে সে তার হাতে মৃত্যুর কত কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল সেটা বুঝতে পেরে, দুটো অনুভূতির সম্মিলন তাকে একটা সহজাত আবেগের শরণ নিতে বাধ্য করে- ক্রোধ।

আমার লোকদের আমাদের লোকদের এমন ক্ষতি আর ধ্বংস সাধনের সাহস তোমার কিভাবে হলো?

আসকারি কোনো উত্তর দেয় না।

একাকি কোনো কিছু করার সাহস তোমার কখনও ছিল না। কামরান নিশ্চয়ই আশেপাশেই কোথাও রয়েছে। কোথায় সে?

আসকারি তাঁর মুখের ক্ষতস্থান থেকে তখনও গড়াতে থাকা রক্ত হাত দিয়ে মুছে নেয়। আপনি ভুল করছেন। গত পাঁচমাস কামরানের সাথে আমার দেখা হয়নি। আমি জানি না সে কোথায়। তাঁর চোখের কালো মণি হুমায়ুনের দিকে সরাসরি তাকায়।

হুমায়ুন তাঁর কাছে এগিয়ে আসে এবং কেউ যাতে তাদের কথোপকথন শুনতে পায় সেজন্য গলার স্বর নামিয়ে নেয়। আমি তোমার কথা বুঝতে পারলাম না। তুমি এখানে উপস্থিত রয়েছে সেটা বোঝার আগেই তুমি পেছন থেকে আমাকে আক্রমণ করতে পারতে।

হ্যাঁ।

কি মনে করে তুমি নিজেকে বিরত রাখলে?

আসকারি কাঁধ ঝাঁকায় এবং দৃষ্টি সরিয়ে অন্যত্র তাকিয়ে থাকে। হুমায়ুন শক্ত করে তাঁর কাঁধ চেপে ধরে। নির্দোষ লোকদের আক্রমণ করতে, এইসব দুবৃত্তদের- সে চাপা ক্রোধে যুঁসতে থাকা কয়েকজন চকরার দিকে ইঙ্গিত করে তার লোকেরা দড়ি দিয়ে মুরগীর মতো যাদের দুহাত পিছনে বেঁধেছে- খুন আর ধর্ষণ করার অনুমতি দিতে তুমি দ্বিধা করনা, তাহলে নিজের আপন রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়কে আক্রমণ করতে কেন ইতস্তত করলে…?

হুমায়ুন…

না, আমি বিষয়টা নিয়ে ভেবে দেখেছি, আমি আসলে জানতে আগ্রহী নই। ব্যাপারটা সম্ভবত কাপুরুষোচিত। তুমি জানতে যে আমায় আক্রমণ করলে আমার লোকেরা তোমায় খুন করে ফেলবে। তুমি কত অনুতপ্ত আর কিভাবে যা কিছু ঘটেছ সবকিছুর জন্য কামরান দায়ী- সে সম্বন্ধে আমি আর নতুন করে কোনো মিথ্যা কথা শুনতে চাই না। হুমায়ুন ঘুরে দাঁড়িয়ে তার দেহরক্ষীদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে উঠে, একে আমার সামনে থেকে নিয়ে যার এবং কাবুলে পৌঁছান পর্যন্ত আমি যেন এর চেহারা আর না দেখি। তার চেহারা দেখলে আমি নিজেই লজ্জিত হয়ে উঠি।

*

হুমায়ুন কাবুলে ফিরে আসবার পরে দশদিন অতিবাহিত হয়, হেমন্তের আগমনে যখন গাছেরা লাল আর সোনালী রঙে সাজতে শুরু করে, সে অবশেষে আসকারিকে তাঁর সামনে পুনরায় উপস্থিত করার আদেশ দেয়। নিজের লোকদের কাছে সে নির্জলা সত্যি কথাটাই বলে তাঁর সৎ-ভাইয়ের এহেন অধঃপতন আর তাঁদের পরিবারের প্রতি যে অসম্মান সে বয়ে এনেছে সেজন্য নিজের সৎ-ভাইয়ের কারণে সে লজ্জিত। ভূগর্ভস্থ অন্ধকার কারাপ্রকোষ্ঠে বন্দি থাকার কারণে পূর্বের চেয়ে মলিন আর কৃশকায় হয়ে উঠা আসকারি হাত বাঁধা, পায়ে শেকল পরিহিত আর প্রহরী পরিবেষ্টিত অবস্থায় পা টেনে টেনে হুমায়ুনের ব্যক্তিগত কক্ষে প্রবেশ করে। আমাদের একা থাকতে দাও, হুমায়ুন তাঁদের আদেশ দেয়, কিন্তু আমি ডাকলেই শুনতে পাবে এমন জায়গায় থাকো। তাদের পেছনে উঁত কাঠের তৈরী দুই পাল্লার দরজাটা বন্ধ হতে হুমায়ুন তার গিল্টি করা চেয়ারের দিকে হেঁটে গিয়ে, বসে এবং চোয়ালে হাত রেখে চিন্তিত ভঙ্গিতে আসকারির মুখের দিকে তাকায়।

একটা জিনিষ আমি কোনোদিনই বুঝতে পারিনি। তুমি আমার জন্য হুমকির কারণ হবার পরেও আমি দুই দুইবার তোমার জান বখশ দিয়েছি। তার চেয়েও বড় কথা, আমার হিন্দুস্তান অভিযানে আমি কেবল আমার ভাই হিসাবে তোমায় অংশ নেয়ার আমন্ত্রণ জানাইনি বরং আমার একজন মিত্র হিসাবে তোমাকে পাশে চেয়েছিলাম… আমি তোমায় সবকিছু দেবার প্রতিশ্রুতি দেয়া সত্ত্বেও তুমি নিশ্চয়ই ভেবেছো যে আমি তোমার সাথে অন্যায় করেছি…

আসকারি ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে। আপনি কোনো অন্যায় করেননি, নীচু কণ্ঠে সে অবশেষে বলে।

আপনি যা কিছু আমাকে আর কামরানকে দিতে চেয়েছেন সেসবই ছিল আপনার প্রতিভাত গৌরবের একটা ক্ষুদ্রতম অংশ- আমাদের নিজস্ব ভূখণ্ড কিংবা ক্ষমতা নয়। আমি আপনার মুখের অভিব্যক্তি দেখে বুঝতে পারছি আপনি আমার কথা বুঝতে পারেননি, কিন্তু আপনার কাছে জীবন সবসময়েই আপনার তথাকথিত মহান নিয়তি।

এটা কেবল আমার একার নিয়তি নয়- আমাদের সবারই এতে অধিকার আছে।

তাই কি? আমাদের লোকদের মাঝে যে প্রবচন প্রচলিত রয়েছে, তখত, তক্তা, সিংহাসন বা শবাধার সে সম্বন্ধে কি বলবেন? সেটা কিন্তু মোটেই বাটোয়ারা করা নিয়তি না- প্রবচনটার অর্থ একটাই সবকিছুর অধিকার বিজয়ীর। হুমায়ুন, আমরা বরং খোলাখুলি আলোচনা করি- বিগত বছরগুলোতে আমরা যেমন আলোচনা করেছি সম্ভব হলে তার চেয়ে বেশী সতোর সাথে কথা বলি। আমি আপনাকে পছন্দ করি না সত্যি কিন্তু আমি আপনাকে ঘৃণাও করি না…আমি কখনও সেটা করিনি। আমি কেবল আমার নিজের জন্য কিছু একটা অর্জন করতে চাইছিলাম আমার স্থানে থাকলে আপনিও একই কাজ করতেন।

তুমি লোভ আর প্রতিহত উচ্চাশার পক্ষে সাফাই দিতে চেষ্টা করছে।

আসকারি মাথা নীচু করে নিজের হাতের বাঁধনের দিকে তাকায়। আপনি বিষয়টাকে এভাবে ব্যাখ্যা করতেই পারেন। আমি এটাকে স্বাধীন, স্বাবলম্বী হবার আকাঙ্খ হিসাবে দেখি- আমাদের মরহুম আব্বাজান যদি নিজের সাম্রাজ্য তাঁর সন্তানদের মাঝে যথাযথভাবে ভাগ করে দিতেন যেমনটা আমাদের পূর্বপুরুষেরা করেছিলেন তাহলে আমি যেমন স্বাধীনতা ভোগ করতাম। সে কথা শেষ করে।

কিন্তু আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার কোনো দরকার ছিল না। হিন্দাল করেনি।

হিন্দালের উল্লেখ করায় আসকারির সাধুম্নন্য অভিব্যক্তি বদলে যায়। হিন্দাল আমাদের সবার থেকে আলাদা। সে যেমন ভদ্র ছিল তেমনি বিশাল ছিল তাঁর দৈহিক আর মানসিক গুণাবলী। সে ছলনা জানতো না এবং এতটাই অকপট ছিল যে, সে আশা করতে সবাই তার মতো এক কথার মানুষ। হামিদাকে তাঁর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আপনি আপনার একজন বিশ্বস্ত মিত্র খুইয়েছিলেন… সহসা আসকারির চোখে অশ্রু ছলছল করে উঠে। আমি যদি…কিন্তু কি লাভ…।

তুমি পারলে কি করতে? হুমায়ুন তাঁর আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় এবং আসকারির কাছে এগিয়ে আসতে বহুদিন বন্দিদশায় কাটাবার কারণে তাঁর কাপড় এবং ত্বক থেকে সেঁতসেঁতে তীব্র কটুগন্ধ হুমায়ুনের নাকে ভেসে আসে।

হিন্দালকে আমি হত্যা না করলেও পারতাম।

 তুমি? আমি ভেবেছিলাম কামরান কাজটা করেছে…।

 সে নয়। কাজটা আমি করেছি।

 কিন্তু কেন? সে কিভাবে তোমার ক্ষতি করেছিল?

আমি তাঁকে হত্যা করতে চাইনি। পুরো ব্যাপারটা একটা দুর্ঘটনা। নিয়তির নিষ্ঠুর এক সমস্থানিকতা। এক অমাবস্যার রাতে আমি আমার লোকদের নিয়ে ডাকাতির উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলাম। অন্ধকারে দ্রুতগামী একদল অশ্বারোহীর সাথে আমাদের দেখা হয়, যারা নিজেদের পরিচয় দিতে বা থামতে রাজি হয় না। আমি তাদের দলপতিকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়তে সে তার পর্যান থেকে ঢলে পড়লে তার বাকি লোকেরা আতঙ্কিত হয়ে পালিয়ে যায়। আমি যখন দলপতির দেহের দিকে তাকাই… আমি দেখি সেটা হিন্দালের মৃতদেহ… হুমায়ুনের চোখের দিকে তাকান থেকে বিরত থেকে আসকারি বোকাটে একঘেয়ে সুরে কথাগুলো বলে। আমি আমার লোকদের আদেশ দেই কাবুলের প্রতিরক্ষা প্রাচীরের বাইরে তাঁর মৃতদেহটা রেখে আসতে, যাতে বন্য পশুপাখি তাঁর দেহটাকে ক্ষতবিক্ষত করার আগেই কেউ সেটা খুঁজে পায়, যাতে আপনি তাঁকে যথাযোগ্য মর্যাদায় সমাধিস্থ করতে পারেন।

আমি সেটা করেছি। তার ইচ্ছা অনুসারেই তাঁকে আমাদের আব্বাজানের পাশেই কবর দেয়া হয়েছে। হুমায়ুন তখনও তার সৎ-ভাইয়ের চোখে মুখে ফুটে থাকা অনুশোচনাটা মেনে নিতে চেষ্টা করছে এমন সময় হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো একটা ভাবনা তার মাথায় খেলে যেতে সহসা একটা অন্ধকার এলাকা আলোকিত হয়ে উঠে।

আমাকে আক্রমণ না করে তুমি আত্মসমর্পণ করেছিলে হিন্দালের কারণেই, তাই না? তুমি অনায়াসে আমাকে খুন করে ফেলতে পারতে…

হ্যাঁ। আমার অপরাধবোধ আমি আর বহন করতে পারছিলাম না। সবকিছুই এত নশ্বর। অনুশোচনার যে বোঝা আমি ইতিমধ্যে বহন করে চলেছি তার সাথে আরেক ভাইয়ের হত্যার দায় যোগ করতে চাইনি।

হুমায়ুন আসকারির বয়ান নিয়ে চিন্তা করার সময় টের পায় তার নিজের চোখের কোণেও অশ্রু টলটল করছে। অল্প কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে হিন্দাল দক্ষিণে এসে নিজেকে কেন বিপদের মাঝে ঠেলে দিয়েছিল, যেখানে সে জানে কামরান আর আসকারির ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর সাথে তার হয়ত দেখা হতে পারে? হিন্দাল তাঁর সাথে একটা সমঝোতার উদ্দেশ্যে কাবুলের দিকে আসছিলো এমনটা চিন্তা করা কি স্বপ্নচারিতা হবে? সে এখন আর সেটা কখনও জানতে পারবে না…

দুই ভাই কিছুক্ষণ মৌব্রত পালন করে। আসকারি তারপরে মন্থর পায়ে কক্ষের ভিতর দিয়ে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ায় এবং নীচের আঙ্গিনার দিকে তাকায়। জানালা দিয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে থাকার সময়ে তার ঠোঁটের কোণে একটা আধো হাসির রেশ ফুটে উঠে। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন নীচের আঙ্গিনায় দেহরক্ষীদের প্রশিক্ষণের সময় আমি আর হিন্দাল মাঝেমাঝে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতাম। অন্যসময় আমরা আপনাকে আর কামরানকে তরবারি আর খঞ্জর নিয়ে যুদ্ধবিদ্যা রপ্ত করতে দেখতাম। আমাদের ভিতরে একটা মুগ্ধতা কাজ করতো- আমাদের তুলনায় আপনাকে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ, একজন যোদ্ধা মনে হত… আমরা এখানে দাঁড়িয়েই আমাদের আব্বাজানকে তার হিন্দুস্তান অভিযানে রওয়ানা হতে দেখেছিলাম। আমরা আর কখনও সেরকম কিছু দেখিনি। দূর্গপ্রাসাদের নীচের উপত্যকায় সমবেত হওয়া হাজার হাজার যোদ্ধা, অগণিত রসদবাহী শকট, ভোরের প্রথম আলোয় চরাচর ছাপিয়ে জেগে ওঠা সেই কোলাহল আর উত্তেজনা। হিন্দাল উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠেছিল যদিও কি ঘটছে সেটা সে ঠিকমতো বোঝার বয়স তখনও তার হয়নি… হুমায়ুন…

কি?

আপনি কি আমায় মৃত্যুদণ্ড দিতে চান?

সম্ভবত না।

আসকারি এক মুহূর্তের জন্য চোখ বন্ধ করে। তাই যদি হয়, আমাকে তাহলে আমার নিজের সাথে আর অতীতের সাথে একটা বোঝাঁপড়া করার উপায় খুঁজে বের করতে সাহায্য করেন…

আমি সেটা কিভাবে করতে পারি?

আমাকে মক্কায়, হজ্জ্ব করতে যাবার অনুমতি দেন। হিন্দালের ভাগ্যে যা ঘটেছে সেজন্য আমি প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই…

তুমি মক্কায় তীর্থযাত্রা করতে আগ্রহী? হুমায়ুন দুই এক মুহূর্ত চিন্তা করে, ক্ষতি কি। হজ্জ্বের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলে আসকারিকে কাবুল থেকে প্রায় হাজারখানেক মাইল পথ অতিক্রম করতে হবে এবং কয়েক মাস- এমনকি বছরও হতে পারে, কামরানের কাছ থেকে সে দূরে থাকবে। এটা নির্বাসন কিংবা কারারুদ্ধ করার চেয়ে অনেক উত্তম সমাধান এবং আসকারি এরফলে হয়ত মানসিক প্রশান্তি লাভ করবে, এই মুহূর্তে যা তার ভীষণ প্রয়োজন বলে আপাতদৃষ্টিতে প্রতিয়মান। তুমি কি নিশ্চিত যে তুমি ঠিক এটাই চাইছো?

আসকারি মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।

আমি তাহলে তোমার সাথে একদল দেহরক্ষী প্রেরণ করবো যাদের নেতৃত্বে থাকবে আমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ তরুন সেনাপতি, মোহাম্মদ আজরুদ্দিন।

আমার উপরে গুপ্তচরবৃত্তি করতে? আসকারি বিষণ্ণ ভঙ্গিতে হেসে বলে।

না। তোমার নিরাপত্তার খাতিরে সমুদ্র আর স্থলপথে এটা একটা দীর্ঘ এবং ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রা… তুমি হয়ত আমার কথা বিশ্বাস করবে না কিন্তু আমি ভীষণভাবে কামনা করতাম যে আমাদের ভিতরে সম্পর্কটা একটু ভিন্ন হোক। সেজন্য এখন বড্ড দেরী হয়ে গিয়েছে- অতীত সবসময়েই আমাদের ভিতরে মুখব্যাদান করে থাকবে- কিন্তু আমি দোয়া করি তুমি যে শান্তির সন্ধান করছে তার দেখা যেন তুমি পাও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *