৩.৬ কাবুল

২০. কাবুল

সুলতান, কুয়ার পানিতে তাঁর বিষ দিয়েছে। আহমেদ খানের এক গুপ্তদূত কথাগুলো বলে, কাবুলের দিকে নেমে যাওয়া এক পাহাড়ী ঢলের শীর্ষদেশে হুমায়ুন যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেখানে আসার পূর্বে তুষারাবৃত এক প্রান্তরের উপর দিয়ে সে ঘোড়া ছুটিয়ে এসেছে বলে শীতের বাতাসে তার খয়েরী রঙের ঘোটকীর গা থেকে বাস্পের মতো ঘাম নির্গত হয়। বরফ যদিও এখনও গলতে শুরু করেনি কিন্তু গত কয়েকদিনে নতুন করে তুষারপাতও হয়নি। পশ্চিমে যেখান থেকে তারা ফিরে গিয়েছিল সেখানে ফিরে আসবার পথে তার আর তার অনুগত বাহিনীর এতো দ্রুত অগ্রসর হবার পেছনে এটা একটা কারণ। অভীষ্ট লক্ষ্য সম্বন্ধে সচেতনতা আর সংক্ষিপ্ত বিশ্রামের ফলে অর্জিত প্রাণশক্তি আরেকটা কারণ। নিজের লোকদের ভিতরে সে এটা বেশ টের পায় এবং নিজের গভীরেও একই আর্তি অনুভব করে।

আমাকে খুলে বল, সে আদেশ দেয়।

দূর্গপ্রাসাদের প্রতিরক্ষা প্রাচীরের কাছাকাছি অবস্থিত কুয়া আর নহরগুলোর চারপাশে আমরা মৃত আর মৃতপ্রায় বন্য প্রাণী দেখতে পেয়েছি। শহর আর দূর্গপ্রাসাদে প্রবেশের তোরণদ্বার আমাদের দেখে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এবং উভয়ের প্রতিরক্ষা প্রাচীরের উপরে সৈন্য গিজগিজ করছে। আমাদের একজন প্রাচীরের খুব কাছাকাছি চলে যাওয়ায় তারা তাকে গুলি করে হত্যা করেছে।

দূরের কুয়া আর নহরগুলো পরীক্ষা করে দেখো। আমাদের শিবিরের সীমানার বাইরে জঞ্জালের স্তূপে ঘুরে বেড়ান বেওয়ারিশ কুকুরগুলোর কয়েকটাকে সেই পানি পান করতে দাও। আমরা যতক্ষণ ভালো পানি খুঁজে না পাই ততক্ষণ শিবিরের অগ্নিকুণ্ডে বরফ গলিয়ে পান করতে পারব।

সেদিন সন্ধ্যাবেলা প্রায় আটটা নাগাদ, আরো একবার কাবুলের পাদদেশে অবস্থিত সমভূমিতে হুমায়ুনের শিবির স্থাপিত হয় এবং তার লোকেরা নিজেদের জন্য রাতের খাবার তৈরীর প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করতে অন্ধকারে কয়েকশ অগ্নিকুণ্ড জ্বলজ্বল করতে থাকে। কামরানের সৈন্যরা তাদের কাজ সুচারুভাবে সম্পন্ন করেনি। কাবুলের প্রতিরক্ষা প্রাচীর থেকে মাত্র মাইলখানেক দূরেই হুমায়ুনের লোকেরা বিশুদ্ধ পানির উৎস খুঁজে পায়। হুমায়ুন তার নিয়ন্ত্রক তাবুর বাইরে দাঁড়িয়ে দূর্গপ্রাসাদের বুরুজের প্রাকারবেষ্টিত ছাদের উপরে এখানে সেখানে বিরক্তিকর আলোর উৎস দেখতে পায়। তার মতো, কামরানও হয়ত এই মুহূর্তে প্রাকারের উপরে দাঁড়িয়ে, এদিকেই তাকিয়ে রয়েছে এবং মনে মনে চিন্তা করছে। আর যদি তাই হয়, তাহলে কাবুলের প্রধান তোরণদ্বারের বাইরে আরো একবার হুমায়ুনের বাহিনীর আবির্ভাবের ফলে তার মনে কি ভাবনার উদ্রেক ঘটেছে? কামরান যেভাবে অন্যদের সাথে প্রায়শই প্রতারণা করে, ঠিক সেভাবেই প্রতারিত হয়ে তাঁর কেমন অনুভূতি হচ্ছে? তার প্রতিরক্ষা কবচ বন্দি শিশুটিকে হারিয়ে, প্রতিশোধপরায়ন হুমায়ুনকে কিভাবে সে মোকাবেলা করবে বলে চিন্তা করছে? নিজের সহজাত উৎকর্ষতার মানে এটা নিশ্চিতভাবেই নিয়তি নির্ধারিত বিশ্বাস করে কোনো চিন্তাভাবনা না করেই সে হিন্দালকে একজন অনুগত মিত্র হিসাবে মেনে নেয়ার জন্য নিজের উদ্ধত আত্মবিশ্বাসের কারণে সে কি এখন অনুতপ্ত?

হুমায়ুন মুখাবয়ব সহসা কুঁচকে যায়। অতীতে হিন্দালের প্রশ্নাতীত আনুগত্য, যেন তার প্রাপ্য, এমনটা আশা করে সে নিজেকে কি কামরানের চেয়ে খুব একটা আলাদা বলে দাবী করতে পারে? সম্ভবত না। সে আশা করে যে উৎকণ্ঠা আর ভয়ে কামরান এখন ঘামছে, কিন্তু এটা প্রতিশোধের খেলায় ব্যক্তিগত হিসাবের জের টানার সময় না। বিজয় অর্জনের দ্রুততম পথ খুঁজে পাওয়াটাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং যা মোটেই সহজ কাজ না। দূর্গপ্রাসাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যথেষ্ট শক্তিশালী এবং সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণে রসদ মজুদ রয়েছে। কামরান আর তার অনুগত লোকেরা ভালো করেই জানে যে পরাজিত হলে তাঁদের প্রতি সামান্য অনুকম্পাও প্রদর্শন করা হবে না তাই দূর্গপ্রাসাদে জীবন বাজি রেখে তারা প্রতিরোধ গড়ে তুলবে।

হামিদার প্রায়োগিক প্রজ্ঞা আর সান্ত্বনাদায়ক অনুত্তেজিত উপস্থিতির জন্য ব্যাকুল হয়ে হুমায়ুনের মনে হয়, সে যদি এই মুহূর্তে তার পাশে থাকতো। হুমায়ুন যদিও ভালো করেই জানে যে সে ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে যে আকবর, গুলবদন আর অন্যান্য অভিজাত রমণীদের সাথে হামিদা মূল বাহিনীর পেছনে সুসজ্জিত দেহরক্ষীদের দ্বারা নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যুহের ভিতরে অবস্থান করে তাঁদের অনুসরন করবে এবং কাবুল থেকে নিরাপদ দূরত্বে তাদের জন্য অপেক্ষা করবে। সে চায় না তাঁর স্ত্রী আর পুত্রের জীবন আবারও ঝুঁকির সম্মুখীন হোক। কিন্তু যত দ্রুত শহরটা আরো একবার তার আয়ত্বে আসবে, সে দ্রুত তাকে সেখানে নিয়ে আসতে পারবে। অন্তত, এতো কষ্ট আর অন্তর্জালা সহ্য করার পরে তাঁর রাণীর প্রাপ্য সম্মানের গুরুত্ব কেমন সেটা জানা উচিত আর শীঘই, সে নিজেকে নিজের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করে যে, সম্রাজ্ঞীর মহিমা সে লাভ করবে।

*

সহসা হুমায়ুনের ঠিক পেছনে প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণের শব্দ তাকে বধির করে দেয় এবং গরম বাতাসের একটা হলকা তাঁকে মাটিতে ছিটকে ফেলে, সে ভূপাতিত হবার সময়ে পাথরের সাথে মাথা ধাক্কা খেলে হাজার আলোর ঝলকানি দেখে। তার চোখে মুখে কাদা আর বরফে কিচকিচ করতে থাকে কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে তার চোখ খুলতে সক্ষম হয়। সে ধীরে ধীরে অনুধাবন করে যে তার চারপাশে খোলামকুচির মতো পিতলের টুকরো ছড়িয়ে রয়েছে আর বরফাবৃত মাটিতে গেঁথে থাকা তাজা মাংসের টুকরো চুমকির মতো দেখায়। একটা চিল কোথা থেকে উড়ে আসে এবং তার বাঁকান ঠোঁট দিয়ে একটা টুকরো ঠোকরাতে আরম্ভ করে। তাঁর মাথার ভিতরে জমাট বাধা স্তব্ধতা পুরো দৃশ্যটাকে আরো বেশী দুঃস্বপ্নময়তা দান করতে হুমায়ুন দুহাতে তার কান চেপে ধরে। সে কান চেপে ধরলে, কপালের ডান দিকের একটা ক্ষতস্থান থেকে তার ডান হাতের আঙ্গুলে টপটপ করে রক্ত ঝরতে শুরু করে।

তার কানের ভেতরে সহসা আবার পটকা ফোঁটার মতো শব্দ বাজতে আরম্ভ করে- তার শ্রবণশক্তি ফিরে আসতে শুরু করেছে… সে বুঝতে পারে দূর্গপ্রাসাদের প্রাচীরের উপর থেকে প্রাসাদ রক্ষীদের উন্মত্ত উল্লাসের মতো একটা শব্দ ভেসে আসছে, যার সাথে বিদ্রুপাত্মক চিৎকার মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছে। হুমায়ুন পায়ের উপর ভর দিয়ে নিজেকে টেনে তুলে এবং চারপাশে তাকায়, সে এখনও স্তম্ভিত হয়ে রয়েছে এবং প্রাণপনে চেষ্টা করছে নিজের অবোধ্য চিন্তাগুলোকে পুনরায় সন্নিবেশিত করতে। আদতে কি ঘটেছে সে ধীরে ধীরে সেটা বুঝতে পারে। তার বড় কামানগুলোর একটা নিজেই বিস্ফোরিত হয়েছে। কামানটা একপাশে কাত হয়ে পড়ে এর গোলন্দাজদের একজনকে চাপা দিয়েছে, বেচারার কামানের নীচে আটকে গিয়েছে, ব্যাথায় লোকটা চিৎকার করছে আর মোচড় খাচ্ছে। কমপক্ষে দুজন লোকের ছিন্নভিন্ন দেহখণ্ড চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে, এখানে একটা কাটা পা, ওখানে একটা কাটা হাত, কামানের পাশে একটা রক্তাক্ত কবন্ধ শরীর এবং হুমায়ুনের পায়ের কাছ থেকে মাত্র একগজ দূরে ঝলসে যাওয়া হীনাঙ্গ মস্তক পড়ে রয়েছে, বাতাসে মাথাটিতে ঝলসানোর হাত থেকে বেঁচে যাওয়া কয়েক গাছি চুল এলোমেলো উড়ছে। হুমায়ুন বুঝতে পারে, কামানের নলে নিশ্চয়ই ফাটল সৃষ্টি হয়েছিল। তার লোকেরা নতুন করে তিন সপ্তাহ পূর্বে শহর আর দূর্গপ্রাসাদ অবরোধ শুরু করার পর থেকে কামানটা নিয়মিত ব্যবহৃত হয়ে আসছিলো। সে পূর্বের মতোই, দূর্গপ্রাসাদকে তাঁর প্রধান লক্ষ্যবস্তু হিসাবে বেছে নিয়েছে এবং দূর্গপ্রাসাদ অভিমুখী রাস্তাটা যেখানে বাঁক নিয়েছে সেখানে তার সৈন্যরা তাদের কামানগুলো মাটির উপর দৃশ্যমান শিলাস্তর দ্বারা সুরক্ষিত পূর্ববর্তী স্থানেই মোতায়েন করেছে।

সুলতান, আপনি সুস্থ আছেন? ধুসর ধূলার ছোপছোপ দাগ নিয়ে জওহর পাশে এসে দাঁড়াতে তাকে মানুষের চেয়ে প্রেতাত্মাই বেশী মনে হয়।

মাথায় কেবল একটা আচড় লেগেছে। হুমায়ুন যখন কথা বলছে, বিবমিষার একটা ঢেউ তার শরীরে এসে আছড়ে পড়ে এবং সে মাতালের মতো টলতে থাকলে জওহর দৌড়ে এসে তাকে ধরে।

সুলতান, আপনাকে আমরা হেকিমের কাছে নিয়ে যাচ্ছি। জওহর তাঁকে প্রায় পাজকোলা করে তুলে যেখানে কয়েকটা ঘোড়া দড়ি বাঁধা অবস্থায় রাখা আছে সেখানে নিয়ে আসে। সে ঘোড়ায় চেপে ধীরে ধীরে যখন শিবিরে ফিরে আসছে তখন, জওহর নিজের ঘোড়ার পাশাপাশি হুমায়ুনের ঘোড়ার লাগামও ধরে থাকে, হুমায়ুনের দপদপ করতে থাকা মাথার ভিতরের চিন্তাগুলো বিষণ্ণতার রূপ নিয়েছে। এই সাম্প্রতিক বিপর্যয় বিবেচনা না করেও, বাস্তবতা হল এই যে অবরোধের দ্বারা সামান্যই অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। তার গোলন্দাজদের নিশানা, যদিও তারা হাড় কাঁপান শীতে চামড়ার আটসাট পোষাক পরিহিত অবস্থায় ঘামতে ঘামতে যখন তাঁদের কামানের ব্রোঞ্জের নলের ভিতরে বারুদ আর গোলা ঠেসে ঢুকিয়ে দিয়ে স্পর্শক গহ্বরে গনগনে সলতে রাখে, নিখুঁত এবং প্রায় প্রতিটা গোলাই তাঁদের প্রধান লক্ষ্যস্থল- তোরণদ্বারের অবকাঠামো এবং এর চারপাশের মেরামত করা আর শক্তিবর্ধন করা প্রাচীর থেকে পাথর আর মাটির আস্তর ছিটকে উঠে এবং ধূলোর মেঘ তরঙ্গের মতো আকাশে ভাসে- কিন্তু তারা এখনও সেখানে কোনো ধরনের ফাটল সৃষ্টি করতে পারেনি। হুমায়ুন তোরণের বামপাশের দেয়ালের প্রতিরোধ ক্ষমতা পরীক্ষা করার জন্য গোলন্দাজদের দুটো দলকে দিয়ে গোলাবর্ষণের আদেশ দিয়ে চেষ্টা করেছেন কিন্তু গোলাবর্ষণের নতি দুরূহ হবার কারণে দেয়ালের বিস্তার বরাবর নিখুঁতভাবে গোলাবর্ষণের একমাত্র উপায় হল শৈলস্তরের পেছন থেকে কামানগুলোকে সরিয়ে উন্মুক্ত স্থানে নিয়ে আসা যেখানে তাঁর গোলন্দাজেরা দূর্গপ্রাকারের ছাদে অবস্থানরত তীরন্দাজ কিংবা তবকিদের সহজ নিশানায় পরিণত হবে। এই চেষ্টা করতে গিয়ে তার কয়েকজন গোলন্দাজ মারাও গিয়েছে এবং তাদের মতো দক্ষতাবিশিষ্ট লোকদের প্রতিস্থাপণ করাও কঠিন কাজ। তাঁর বারুদের সরবরাহও সীমিত।

হুমায়ুন পর্যাণের উপরে সামান্য দুলতে দুলতে মনে মনে ভাবে, তাকে অবশ্যই ধৈর্য ধারণ করতে হবে, ঠিক যেমন হিন্দালের কাছ থেকে আকবরের উদ্ধার সংক্রান্ত সংবাদের জন্য সে নিজেকে বাধ্য করেছিল অপেক্ষা করতে। একটাই সমস্যা কামরান এতো কাছে রয়েছে জানবার পরে ধৈর্য ধারণ করা কঠিন। দূর্গপ্রাসাদ অভিমুখে উঠে যাওয়া ঢালু পথটা দিয়ে ঘোড়া হাকিয়ে গিয়ে নিজের ভাইকে দ্বৈরথে আহবান করার ইচ্ছা অনেক সময়েই হুমায়ুনের মনে প্রবল হয়ে উঠে। ব্যাপারটা এমন নয় যে কামরান আহ্বানে সাড়া দিতে আগ্রহী- গলা এফোঁড়ওফোঁড় করে দেয়া একটা তীরই বড় জোর হুমায়ুনের কপালে জুটতে পারে।

তার পেছনে অবস্থিত কামানগুলো থেকে পুনরায় গোলাবর্ষণের গমগম শব্দ ভেসে আসে। হুমায়ুন বহুকষ্টে মাথা ঘুরিয়ে পেছনে দূর্গপ্রাসাদের দিকে তাকায়। একটা ভয় যে কামরান আর সেখানে নেই আরো একবার তাকে পেয়ে বসে। ধরা যাক দূর্গপ্রাসাদ থেকে পাথরের ভিতর দিয়ে অবস্থিত একটা গোপন পথ দিয়ে অন্যত্র যাওয়া যায়। সে তাঁর কৈশোরে এমন কোনো পথ আছে বলে শোনেনি কিন্তু এমনটা অসম্ভব না যে কামরান সেরকম একটা পথ খুঁজে পেয়েছে এবং তার পক্ষ থেকে দূর্গ রক্ষার দায়িত্ব অন্যদের উপরে অর্পণ করে সে পালিয়েছে।

তার পক্ষে আর অপেক্ষা করা সম্ভব না। দুর্গপ্রাসাদে প্রচণ্ড আর আকস্মিক আক্রমণের বিষয় নিয়ে সে তার সেনাপতিদের সাথে আলোচনা করবে। এরফলে ব্যাপক প্রাণহানির সম্ভাবনা রয়েছে কিন্তু তাঁদের বিপুল সংখ্যাধিক্যের কারণে আক্রমণের ফলাফল নিয়ে নিশ্চিতভাবেই সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। সে মাথা নীচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করে যে বরফ গলতে শুরু করায় তার ঘোড়ার খুরের নীচের মাটি আদ্রতার কারণে নরম হয়ে রয়েছে। প্রতিদিনই বরফের নীচ থেকে বের হওয়া বিরান মাঠের আকৃতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্তত ঋতু তার পক্ষে রয়েছে…

*

নাদিম খাজা আহত হয়েছেন। প্রাচীরের গায়ে তারা আরোহণী মই স্থাপণ করা আগেই দূর্গপ্রাকারের ছাদ থেকে তীরন্দাজ আর তবকির দল তাকে আর তাঁর লোকদের লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো গুলি করেছে, বৈরাম খান চিৎকার করে যখন হুমায়ুনকে একথা জানায় তাঁর আধঘন্টা আগেই দূর্গপ্রাসাদ অভিমুখে আক্রমণ শুরু হয়েছে। আমাদের লোকদের লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ার সময় দূর্গরক্ষীরা নিজেদের অবস্থান প্রকাশ করলে গুলি করে তাদের নিষ্ক্রিয় করতে আমাদের যতজন তবকিকে সেখানে পাঠান সম্ভব আমি পাঠাতে চেষ্টা করবো।

গোলন্দাজদের গোলাবর্ষণের মাত্রা দ্বিগুণ করার আদেশ দাও। তাঁদের কামান থেকে নির্গত ধোয়া তাদের জন্য কিছুটা হলেও আড়াল তৈরী করবে, হুমায়ুন আদেশ দেয়। পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য তাকিয়ে থাকতে সে দেখে দূর্গরক্ষীদের কয়েকজন আপাতদৃষ্টিতে আহত হয়েই, কামানের গোলা নিক্ষেপের জন্য দূর্গের ছাদে অবস্থিত ছিদ্রের পেছনে অবস্থিত দেয়ালের উপর থেকে নীচে আছড়ে পড়েছে। কমপক্ষে আরো দুইজন গুলির আঘাতে পিছনের দিকে উল্টে পরার সময়ে নীচের পাথরের উপরে তাদের মাথা গিয়ে প্রথমে আঘাত করে, কিন্তু এতোকিছুর পরেও দূর্গরক্ষীদের গুলি ছোেড়ার বেগ মোটেই শ্লথ হয় না বরং হুমায়ুনের লোকেরা আর বেশী মাত্রায় আহত হতে শুরু করে। বৈরাম খান, পশ্চাদপসারণের সংকেত ঘোষণা করেন, হুমায়ুন বাধ্য হয়ে আদেশ দেয়। আমাদের আক্রমণ খুব একটা ফলপ্রসু হচ্ছে না এবং এতো বেশী মাত্রায় হতাহতের সংখ্যা আমাদের পক্ষে বহন করা সম্ভব না।

হুমায়ুনের সৈন্যদের ভিতরে যারা আক্রমণের ঝাপটা সামলে নিতে পেরেছে শীঘ্রই তাঁরা তাঁর নিয়ন্ত্রক অবস্থানের পাশ দিয়ে শিবিরের দিকে ফিরতে শুরু করে, কেউ খুঁড়িয়ে হাঁটছে, অন্যদের ক্ষতস্থানে বাঁধা পট্টি থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। দুইজন লোক তার পাশ দিয়ে একটা খাঁটিয়া বয়ে নিয়ে যায়, হুমায়ুন খাঁটিয়ায় শুয়ে থাকা লোকটাকে যন্ত্রণায় পশুর মতো চিৎকার করতে শোনে এবং খেয়াল করে দেখে দূর্গপ্রাকারের ছাদ থেকে আক্রমণকারীদের উপরে ঢেলে দেয়া গরম আলকাতরায় লোকটার ডান হাত আর কাঁধ ঝলসে গিয়েছে। হুমায়ুনের চোখের সামনেই লোকটার দেহটা আচমকা মোচড় দেয় এবং লাথি ছুঁড়ে, আর সহসাই যন্ত্রণার হাত থেকে সে চিরতরে মুক্তি লাভ করে। নাদিম খাজা চট আর ডালপালা দিয়ে কোনমতে তৈরী করা একটা খাঁটিয়ায় শুয়ে সবার শেষে শিবির অভিমুখে বৈরাম খান আর হুমায়ুনকে অতিক্রম করেন, তাঁর উরু থেকে একটা ভাঙা শরযষ্টি বের হয়ে রয়েছে। কিন্তু নাদিম খাজা প্রাণবন্ত কণ্ঠে বলেন, সুলতান, চিন্তা করবেন না আমি ঠিক আছি, ব্যাটাদের গায়ে জোর নেই তীরটা কেবল মাংসে ক্ষত সৃষ্টি করেছে। আবারও আপনার খেদমত করতে আমি বেঁচে থাকবো।

তার এমন বিশ্বস্ত সমর্থক রয়েছে এটা ভালো লক্ষণ, কিন্তু আরো বেশী সংখ্যক প্রাণহানির সম্ভাবনা মোকাবেলা করতে প্রস্তুত ভেবে নিয়ে সে কি তাঁর বাকি সৈন্যদের উপরে ভরসা করতে পারে? বিজয় অর্জিত হলে সে তাঁদের পুরস্কৃত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কিন্তু তাঁর প্রতিশ্রুতি তখনই তাঁদের কাছে অর্থবহ হবে যদি তাঁরা বিশ্বাস করে যে শেষ পর্যন্ত তারাই বিজয়ী হবে। সে কিভাবে কাবুল দখল করবে? কামরানকে কিভাবে বন্দি করবে? সে জীবনে প্রথমবারের মতো সত্যিই অসহায় বোধ করে।

বৈরাম খান, আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কি হওয়া উচিত? আমি জানি আমি বিশ্বাস করতে পারি আমি সত্যি কথাটাই বলবেন।

আমার মনে হয় আমরা দুজনেই জানি সামনাসামনি আক্রমণের সিদ্ধান্তটা একটা ভুল ছিল- হতাশার গর্ভে জন্ম নেয়া একটা ভুল। আমাদের অবশ্যই কঠোর অবরোধ বজায় রেখে আরো একবার ধৈর্য ধারণ করতে হবে। অতিরিক্ত রসদ সংগ্রহের জন্য আমরা আমাদের লোকদের অন্যত্র প্রেরণ করতে পারি এবং সেটা আমরা করবোও কিন্তু কামরান আর তার বাহিনীর পক্ষে সেটা সম্ভব না। তাঁদের সামনে পরিত্রাণ লাভের কোনো আশাই নেই। আমরা যদি আমাদের স্নায়ুচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারি তাহলে আমাদের অনেক আগেই তাদের মনোবলে ভাঙ্গনের খেলা শুরু হবে।

বিচক্ষণ পরামর্শ। অবরোধ জোরদার করতে সবাইকে প্রয়োজনীয় আদেশ জানিয়ে দেন।

হুমায়ুন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে বের হয়ে তাঁর শিবিরের সীমানার চারপাশে পাহারা দেবার জন্য প্রহরীদের এক অবস্থানের দিকে এগিয়ে যাবার সময় কয়েকটা ক্রুদ্ধ কণ্ঠস্বর সে শুনতে পায়। ছাগল বা ভেড়ার মালিকানা নিয়ে সম্ভবত আরেকটা বচসা। সে খুব গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টা চিন্তা করে না। সে আরেকটু এগিয়ে গেলে বচসার কারণ প্রত্যক্ষ করে। হুমায়ুনের ছয়জন সৈন্যের মাঝে, যাদের প্রত্যেকের হাতে উদ্ধত তরবারি রয়েছে, খঞ্জর হাতে খোঁচা খোঁচা ভাবে কামান এক মাথা চুল নিয়ে একটা লোক অকুতোভয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

হুমায়ুন তাঁর ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে। এখানে এসব কি হচ্ছে?

তাকে চিনতে পারার সাথে সাথে, সৈন্যরা নিজেদের বুক হাত দিয়ে স্পর্শ করে। হুমায়ুন দেখে লোকটার চঞ্চল চোখ তার ঘোড়ার সোনার কলাই করা লাগাম আর তার পরনের ভেড়ার চামড়ার আলখাল্লার কারুকার্যখচিত বকলেসের উপর ঘুরে বেড়ায়, সে কে হতে পারে সেটা বোঝার চেষ্টা করছে।

আমি তোমাদের সম্রাট। কে তুমি আর কেন এখানে ঝামেলা করছো?

লোকটাকে হতবাক দেখায় কিন্তু সে নিজেকে সামলে নেয়। আমার নাম জাভেদ, ঘিলজাই গোত্রের লোক আমি। আমি এসব শুরু করিনি। আপনার সৈন্যরা আমাকে একজন গুপ্তচর মনে করেছে…

সত্যিই কি তুমি?

না। আমি প্রকাশ্যে আপনার শিবিরে এসেছি। আমার কাছে তথ্য আছে।

কি সম্বন্ধে?

সেটা নির্ভর করবে মূল্যের উপর।

জাভেদের উদ্ধত কথাবার্তায় ক্ষিপ্ত হয়ে, সৈন্যদের একজন সামনে এগিয়ে এসে বর্শার বাঁট দিয়ে তার পিঠের কৃশতম অংশে আঘাত করে তাঁকে মাটিতে ফেলে দেয়। সম্রাটের সামনে নতজানু হয়ে বসা দস্তুর। শ্রদ্ধা প্রদর্শনের রীতি কি দেশ থেকে উঠে গিয়েছে…

হুমায়ুন কোনো কথা বলার আগে লোকটাকে কিছুক্ষণ সেঁতসেঁতে মাটিতে পড়ে থাকতে দেয়। উঠে দাঁড়াও। জাভেদ টলমল করতে করতে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়ায় এবং প্রথমবারের মতো তাঁকে সামান্য বিচলিত দেখায়।

আমি আমার প্রশ্নটা আবার করছি। তোমার কাছে কি তথ্য রয়েছে? আমি তুমি না ঠিক করবো সেটার জন্য মূল্যপ্রদান করা সঙ্গত হবে কিনা। আমাকে যদি তুমি না বলো, আমার লোকেরা তাহলে তোমাকে বাধ্য করবে সেটা বলতে।

জাভেদ ইতস্তত করে। হুমায়ুন মনে মনে ভাবে, লোকটা কি আসলেই অপরিশীলিত সরলমনা? একজন আহাম্মকের পক্ষেই কেবল সম্ভব সরাসরি কোনো সেনাছাউনিতে এসে সম্রাটের সাথে কোনো কিছু নিয়ে দর কষাকষি করার ধৃষ্টতা দেখান। কিন্তু জাভেদকে দেখে মনে হয় সে মনস্থির করে ফেলেছে। শহরে মহামারী দেখা দিয়েছে। দুই কি তিনশ লোক ইতিমধ্যে মারা গিয়েছে এবং প্রতি মুহূর্তে বাজারে আরো মৃতদেহ এসে জমা হচ্ছে…

কবে থেকে এটা শুরু হয়েছে?

কয়েকদিন আগে প্রথম প্রকোপটা দেখা দেয়।

তুমি কিভাবে জানতে পেরেছো?

আমার ভাইয়ের কাছ থেকে সে শহরের ভিতরে রয়েছে। আমি আর আমার ভাই, আমরা খচ্চর আর ঘোড়ার ব্যাপারী। প্রতিবছরের ন্যায় এবছরও আমরা কাবুলের বণিকদের কাছে আমাদের জন্তুগুলো বিক্রির জন্য নিয়ে এসেছিলাম বরফ গলতে শুরু করার সাথে সাথে কাফেলার বহর যাতায়াত আরম্ভ করলে মালামাল পরিবহণের জন্য যাদের ভারবাহী প্রাণী প্রয়োজন হবে। পাহাড়ে আমি আমাদের জন্তুগুলোকে চরাতে নিয়ে গিয়েছিলাম এমন সময় আপনার আগুয়ান বাহিনীর খবর শুনতে পেয়ে কাবুল সেনানিবাসের অধিনায়ক তোরণদ্বার বন্ধ করার আদেশ দেন। আমার ভাই- যে শহরের সরাইখানাগুলোর একটায় ব্যবসায়িক লেনদেনের তদারকি করছিল- শহরের ভেতরে আটকা পড়ে। অবরোধ শুরু হবার পরবর্তী সপ্তাহগুলোকে আমি অবশ্য তার কাছ থেকে কিছুই জানতে পারিনি। কিন্তু আমার শিকারী কুকুরটা তাঁর কাছে ছিল। তিন রাত্রি আগের কথা, পাহাড়ের পাদদেশে আমার ছাউনিতে কুকুরটা ফিরে এসেছে জন্তুটার গলার বকলেসে একটা চিঠি আটকান ছিল। আমার ভাই নিশ্চয়ই শহরের প্রতিরক্ষা প্রাচীরের উপর দিয়ে কুকুরটাকে নীচে নামাবার একটা পথ খুঁজে বের করেছিল, যদিও জন্তুটা মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিল বেচারার পেটের একপাশ দারুণভাবে ছড়ে গিয়েছে এবং রক্তক্ষরণ হয়েছে আর একটা পা খোঁড়া হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তারপরেও জটা আমাকে ঠিকই খুঁজে বের করেছে।

বার্তায় আর কি বলা হয়েছে? তোমার কাছে কেন মনে হয়েছে যে খবরটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হবে?

জাভেদের চোখে মুখে আবার সেই ধূর্ততা ফিরে আসে। আমার ভাই শহরে বিদ্যমান ভয় আর আতঙ্কের কথা লিখেছে। সে বলেছে শহরবাসীরা অবরোধের অবসান চায় যাতে তারা শহর আর সেখানে বিদ্যমান মহামারীর প্রকোপ থেকে দূরে যেতে পারে। সে বিশ্বাস করে পরিস্থিতি আরও খারাপ হলে শহরবাসীরা সেনাছাউনির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে শহরের মূল তোরণদ্বার আপনার জন্য খুলে দিতে পারে।

আমাকে বার্তাটা দেখাও।

জাভেদ ঝুঁকে নীচু হয়ে তার পায়ের নাগরার ভিতর থেকে বহুবার ভাঁজ করা হয়েছে এমন একটা কাগজের টুকরো বের করে সেটা হুমায়ুনের হাতে তুলে দেয়। হুমায়ুন কাগজের ভাঁজ খুলে এবং বাজে হস্তাক্ষরে তুর্কী ভাষায় লেখা ঘন পংক্তিগুলোর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। জাভেদ যা বলেছে সবই চিঠিটা নিশ্চিত করে। শেষ বাক্যগুলো অনেকটা এমন: আগাম কোনো পূর্বাভাষ না দিয়েই রোগটার প্রাদুর্ভাব ঘটে এবং তরুন আর স্বাস্থ্যবানরাও এর প্রকোপ থেকে রেহাই পায়নি। প্রথমে শুরু হয় প্রচণ্ড জ্বর আর সেই সাথে বমি, তারপরে নিয়ন্ত্রণের অতীত উদারাময়, শেষে চিত্তবৈকল্য আর মৃত্যু। প্রতিদিনই দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকা মৃতদেহের স্তূপ বেড়েই চলেছে। আমরা এমন একটা ফাঁদে আটকা পড়েছি যাঁর কবল থেকে কারও রেহাই নেই। আমাদের দেহে শক্তি থাকা অবস্থায় সেনাছাউনির সৈন্যদের হত্যা করে তোরণদ্বার খুলে দেবার বিষয়ে আমরা সবসময়েই আলোচনা করছি কিন্তু আমাদের সম্ভবত সেটা করার প্রয়োজন পড়বে না। সৈন্যরাও মরতে শুরু করেছে। তারাও ভালো করেই জানে যে হয় অবরোধ তুলে নিতে হবে কিংবা আল্লাহতালা আমাদের প্রতি তাঁর করুণা প্রদর্শন করবেন অন্যথায় আরো অনেকেই মারা যাবে। কিন্তু আল্লাহতালা আমাদের উপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন। তাঁকে ক্রোধান্বিত করার মতো কি এমন কাজ আমরা করেছি? ভাই আমার, আমি আশা করি এই বার্তা তোমার কাছে পৌঁছাবে কারণ আমাদের হয়ত আর দেখা হবে না।

শব্দগুলোর মর্মার্থ হুমায়ুন যখন পুরোপুরি অনুধাবন করতে পারে তখন তার নাড়ীর স্পন্দন দ্রুততর হয়। সে যে সুযোগের অপেক্ষায় ছিল সম্ভবত এটাই সেটা কিন্তু তারপরেও জাভেদকে বিশ্বাস করাটা কি ঠিক হবে? সে হয়ত কামরানের একজন অনুচর। হুমায়ুন তার কণ্ঠস্বর শীতল আর সংযত রাখে। তুমি দেখছি তোমার ভাইয়ের সুস্বাস্থ্যের চেয়ে নিজের ব্যক্তিগত লাভের প্রতি বেশী আগ্রহী, যাই হোক তোমার এই তথ্য সত্যি হলে তুমি এজন্য পুরস্কৃত হবে। কিন্তু এটা যদি মিথ্যা হয় তাহলে আমি তোমার মৃত্যুর নিশ্চয়তা দিচ্ছি। হুমায়ুন তাঁর দেহরক্ষীদের দিকে ঘুরে তাকায়। একে চোখে চোখে রাখবে।

জাভেদকে নিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে হুমায়ুন তার ঘোড়ার পাঁজরে একটা গুতো দিয়ে অস্থায়ী শিবিরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত নিয়ন্ত্রক তাবুর দিকে অগ্রসর হয়, তার মুখে একটা চওড়া হাসি ফুটে উঠেছে। বার্তাটায় যা বলা হয়েছে তা যদি আদতেই সত্যি হয়ে থাকে তাহলে কাবুল অচিরেই তাঁর পদানত হবে, কিন্তু তার আগে তাকে জানতে হবে কিভাবে তথ্যটা থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা লাভ করা সম্ভব।

*

সুলতান, কাবুলের অধিবাসীরা একজন প্রতিনিধি পাঠিয়েছে। আধ ঘন্টা আগে, শহরের মূল তোরণদ্বার খুলে যায় এবং একটা গরুর গাড়ি একজন বৃদ্ধলোককে নিয়ে আমাদের শিবিরের দিকে হেলতে দুলতে এগিয়ে আসতে থাকে। সে আমাদের সাথে কথা বলতে আগ্রহী এটা বোঝাবার জন্য সে ছেঁড়া একটা কাপড়ের টুকরো আন্দোলিত করছিল।

ব্যাপারটা ঘটতে তাহলে মাত্র তিনদিন সময় লাগল। জাভেদের কাছ থেকে শহরের পরিস্থিতি সম্পর্কিত সমাচার লাভের সাথে সাথে হুমায়ুন শহরের চারপাশে ফাঁসের ন্যায় মোতায়েন করা সৈন্যের ব্যুহ আরো জোরদার করে। দূর্গপ্রাসাদে আক্রমণের জন্য নিয়োজিত কয়েকটা কামানও সে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে আসে এবং, নিরাপত্তার জন্য সেগুলোকে তড়িঘড়ি করে তৈরী করা নিরাপত্তা আড়ালের পিছনে স্থাপন করে, তার গোলন্দাজদের আদেশ দেয় শহরের অধিবাসীদের আর সেনাছাউনির সৈন্যদের মনোবল দূর্বল করতে শহরের প্রতিরক্ষা প্রাচীর লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ করতে। প্রথমদিন হত্যোদম ভঙ্গিতে কয়েকদফা পাল্টা গোলাবর্ষণ ছাড়া দূর্গপ্রাকারের ছাদের কামানগুলো নিরবই থাকে এবং শহরের প্রতিরক্ষা প্রাচীরের উপরে রক্ষীসেনাদের উপস্থিতি তারচেয়েও কম চোখে পড়ে।

প্রতিনিধি লোকটাকে আমার কাছে নিয়ে এসো।

হুমায়ুন তার তাবুর বাইরে যখন অপেক্ষা করছে, সে মুখের উপরে সদ্য আগত বসন্তের সকালের সূর্যের ওম উপভোগ করে। চমৎকার একটা অনুভূতি। সেই সাথে তাঁর আত্মবিশ্বাসও শনৈ শনৈ বাড়তে থাকে যে বিজয় এখন তাদের স্পর্শের ভিতরে নাগালের মধ্যে এসে পড়েছে। এটাকে তার নাগালের ভিতর থেকে ফসকে যেতে দেয়াটা মোটেই উচিত হবে না।

প্রতিনিধি লোকটা বাস্তবিকই বৃদ্ধ- বস্তুতপক্ষে এতোটাই বয়োবৃদ্ধ যে একটা লম্বা, তেল চকচকে লাঠির সাহায্য ছাড়া বেচারা হাঁটতেই পারে না। হুমায়ুনের সামনে এসে সে ঝুঁকে নীচু হয়ে তাঁকে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে চায় কিন্তু পারে না। সুলতান আমাকে মার্জনা করবেন, শ্ৰদ্ধার কমতি না বরং আমার বুড়ো হাড়ই আমাকে বাধা দিচ্ছে… কিন্তু আমি অসুস্থতার কবল এড়িয়ে যেতে পেরেছি। শহরের বার্তাবাহক হিসাবে আমাকে মনোনীত করার সেটাই অন্যতম কারণ।

তাকে বসার জন্য একটা তেপায়া এনে দাও। বৃদ্ধ লোকটা কষ্টকর ভঙ্গিতে নীচু হয়ে বসা পর্যন্ত হুমায়ুন অপেক্ষা করে, তারপরে জিজ্ঞেস করে। আপনি আমার জন্য কি বার্তা নিয়ে এসেছেন?

আমাদের শহরে প্রতিদিনই অসংখ্য লোক মৃত্যুমুখে পতিত হচ্ছে। আমরা এর কোনো কারণই বুঝতে পারছি না- সম্ভবত সেনাছাউনির সৈন্যরা যখন শহরের বাইরের কূপ আর ঝর্ণাগুলোয় বিষ দিয়েছিল তখনই কোনভাবে আমাদের নিজেদের পানি সরবরাহ ব্যবস্থাও দূষিত হয়েছিল। কিন্তু এর ফলে যুবকরাই সবচেয়ে বেশী ভুগছে। কাবুল শহরের অনেক মায়েরই বুক খালি হয়েছে। এই অহেতুক যুদ্ধের কারণে আমরা সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছি- এমনকি সেনাছাউনিতেও অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে, আমাকে তাদের পক্ষেও আলোচনা করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আমরা এই অবরোধের একটা অবসান চাই যাতে করে যারা শহর ত্যাগ করতে চায় চলে যেতে পারে।

পুরোপুরি আত্মসমর্পণ ভিন্ন আর কোনো কিছুতেই আমি সন্তুষ্ট হব না।

আপনি ঠিক এই কথাটাই বলবেন, আমি শহরের লোকদের সেটা আগেই বলেছি। সুলতান, আপনি কি আমাকে চিনতে পারেননি…

লোকটার সূর্যের আলোয় শুকিয়ে যাওয়া আখরোটের মতো কুচকানো মুখাবয়বের দিকে হুমায়ুন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কেমন যেন চেনা মনে হয় মুখটা।

আমি ইউসুফ, আপনার মরহুম আব্বাজানের একসময়ের কোষাধক্ষ্য ওয়ালি গুলের সবচেয়ে বয়োজ্যষ্ঠ ভ্রাতুস্পুত্র। আপনাকে এবং আপনার সৎ-ভাই কামরানকে আমি একেবারে ছোটকালে দেখেছি… এটা সত্যিই দুঃখজনক যে আপনাদের দুজনের ভিতরে সম্পর্কের এতোখানি অবনতি হয়েছে… যুবরাজদের উচ্চাশার কারণে সাধারণ লোকদের দুর্ভোগ পোহাতে হবে এটাও ঠিক মেনে নেয়া কঠিন। আমি সবসময়েই বিশ্বাস করেছি যে আপনি সম্রাট বাবরের সবচেয়ে প্রিয়পুত্র- কাবুলের ন্যায়সঙ্গত অধিপতি। কিন্তু মানুষের মনোভাব পরিবর্তনশীল এবং আজকাল সম্মানের চেয়ে নিজের স্বার্থই বোধহয় তাঁদের কাছে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। কামরান আপনাকে পরাজিত করতে পারবে বলে তারা যখন বিশ্বাস করেছিল, তারা তখন তার প্রতি নিজেদের আনুগত্য প্রদর্শন করেছিল।

শহরের নাগরিকদের এই জন্যই আমার কাছে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পন করতে হবে। আপনি এখন ফিরে যান এবং তাঁদের বলেন যে, যদি প্রতিটা লোক শহরের সাধারণ লোকদের সাথে সাথে সেনাছাউনির সৈন্য সবাই- যদি অস্ত্র সমর্পন করে আমি তাঁদের জান বখশ দেব। আমি চাই কামান থেকে শুরু করে সব যুদ্ধাস্ত্র এবং গাদাবন্দুক থেকে শুরু করে তরবারি আর তীরধনুক সবকিছু নিয়ে এসে শহরের প্রধান তোরণদ্বারের বাইরে স্তূপ করে রাখা হোক। শহরের লোকেরা মহামারীর প্রাদুর্ভাব শেষ না হওয়া পর্যন্ত শহর ত্যাগ করতে পারবে না। আমি আমার নিজের লোকদের বিপদে ফেলতে চাই না। কিন্তু আমি আমার হেকিমকে পাঠাবো আর সেই সাথে বিশুদ্ধ পানীয় জল আর টাটকা খাবার… তাদের জবাব কি হতে পারে?

ইউসুফের গাঢ় বাদামী চোখ প্রায় অশ্রু সজল হয়ে উঠে। সুলতান, আপনার এই করুণা প্রদর্শনের জন্য তাঁরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাবে।

ইউসুফ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় এবং তার হাতের লাঠির উপরে পুরোপুরি ভর দিয়ে সে যে গরুর গাড়িতে করে এখানে এসেছে, সেদিকে এগিয়ে যায় আর তাতে উঠে বসে। অচিরেই দেখা যায় গাড়িটা তাকে নিয়ে ফিরতি পথে শহরের দিকে ফিরে চলেছে এবং তাকে গ্রহণ করার জন্য প্রধান তোরণদ্বারে পাল্লা দুটো খুলে দেয়া হয়। হুমায়ুন তার তাবুর সামনে পায়চারি করতে করতে ভাবে তাঁর বেধে দেয়া শর্তের প্রত্যুত্তরে পাল্লা দুটো কি এত সহজেই তার সামনে খুলে যাবে, নিজের ভাবনায় সে এতোই বিভোর ছিল যে দুপুরের খাবারের জন্য জওহর তাঁকে ডাকতে আসলে উত্তর দেবার কথা তার খেয়াল থাকে না। এক ঘন্টা অতিক্রান্ত হয় এবং তারপরে আরও এক ঘন্টা। তারপরে শহরের প্রতিরক্ষা প্রাচীরের ভেতর থেকে একটা শোরগোলের শব্দ ভেসে আসে, প্রথমে খুবই ক্ষীণ কিন্তু অচিরেই সেটা জোরাল হতে আরম্ভ করে… সহস্র কণ্ঠের উল্লসিত আওয়াজ। এর একটাই অর্থ হতে পারে যে শহরের অধিবাসীরা আত্মসমর্পনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

পলকের ভিতরে, তোরণদ্বারের পাল্লাগুলো হা করে খুলে দেয়া হয় এবং ভেতর থেকে বেশ কয়েকটা গরুর গাড়ি দ্রুত গতিতে বাইরে বের হয়ে আসে। শহরের প্রতিরক্ষা প্রাচীর আর শহরের চারপাশে চক্রব্যুহ তৈরী করে অবস্থানরত হুমায়ুনের সৈন্যদের মধ্যবর্তী ভূমির মাঝামাঝি স্থানে তারা যখন পৌঁছায়, সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ে এবং গাড়ির সারথি আর তার পেছনে বসে থাকা লোকেরা গাড়ির পেছনে থাকা মালামাল কোনো ধরনের ভণিতা না করে বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধাস্ত্র, ধনুক আর গাদাবন্দুকগুলো সূর্যের আলোয় চকচক করে ছুঁড়ে ফেলতে শুরু করলে মাটিতে একটা স্তূপের সৃষ্টি হয়।

হুমায়ুন হাসে। আত্মসমর্পনের শর্ত নির্ধারণে তাঁর কোনো ধরনের ভুল হয়নি। শহরটা এখন তার কিন্তু আসল কাজ এখনও কিছুই হয়নি। দৃর্গপ্রাসাদে এখনও বহাল তবিয়তে কামরানের অনুগত সৈন্যরা অবস্থান করছে। হুমায়ুন ভালো করেই জানে যে তার সৎ-ভাই যদি এখনও সেখানে অবস্থান করে থাকে, তাহলে শহরের আত্মসমর্পনের এই দৃশ্য সেও দেখছে। এখন তাঁর প্রতিক্রিয়া কি হবে?

উত্তরটা জানতে খুব বেশী সময় অপেক্ষা করতে হয় না। দূর্গপ্রাসাদের প্রাকারবেষ্টিত ছাদ থেকে কামরানের অনুগত সৈন্যরা হুমায়ুনের কামানের অবস্থান লক্ষ্য করে এক ঝাঁক তীর নিক্ষেপ করে। তারা সেই সাথে দূর্গ প্রাচীরের বিভিন্ন কৌশলগত স্থানে স্থাপিত ক্ষুদ্রাকৃতি কামান থেকে গোলা বর্ষণও করে। তারপরে হুমায়ুন দূর্গপ্রাসাদের প্রধান তোরণদ্বারের উপরে স্থাপিত নহবতখানা থেকে ঢাকের গমগমে শব্দ আর সেই সাথে তূর্যবাদন শুনতে পায় এবং তাকিয়ে দেখে তোরণদ্বারের পাল্লা ধীরে ধীরে খুলে যাচ্ছে। কামরান কি তাহলে আত্মসমর্পন করবে বলে মনস্থির করেছে? না। সহসা হুমায়ুন তাকিয়ে দেখে দূর্গে অবস্থানরত সৈন্যরা বাতাসে লম্বা চাবুক আন্দোলিত করে ডজনখানেক অস্থিচর্মসার ষাড় তাড়িয়ে নিয়ে এসে পশুগুলোকে তোরণদ্বার দিয়ে বের করে এবং দূর্গ থেকে নেমে আসা ঢালু পথ দিয়ে হুমায়ুনের অবস্থানের দিকে তাদের দাবড়ে দেয়, জম্ভগুলোর পিঠে শুকনো খড়ের আটি বেঁধে দিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে।

আতঙ্কিত জম্ভগুলো জীবন্ত মশালের ন্যায় সামনের দিকে ছুটতে থাকে। গোলন্দাজদের তাবু কিংবা তাঁদের বারুদের মজুদ জ্বালিয়ে দেয়ার আগেই জন্তুগুলোকে তীর মেরে ধরাশায়ী করো, হুমায়ুন চিৎকার করে বলে।

শীঘ্রই এগারটা ষাড়কে নীচের দিকে নেমে আসা ঢালু পথের উপরে নিথর হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়, তাদের মৃতদেহ থেকে অগণিত তীরযষ্টি বের হয়ে আছে। কেবল একটা ষাড় ব্যাথায় উন্মত্ত হয়ে হুমায়ুনের অবস্থানের দিকে ধেয়ে আসে এবং কোনো ধরনের মারাত্মক ক্ষতি করার আগেই অবশ্য তার ভবলীলা সাঙ্গ হয়। অবশ্য, হুমায়ুনের তিনজন তীরন্দাজ ষাড়গুলোকে লক্ষ্য করে তীর ছোঁড়ার সময় যখন নিজেদের নিরাপত্তা আড়াল থেকে বের হয়ে এসেছিল, তখন দূর্গপ্রাসাদের ছাদ থেকে তাদের লক্ষ্য করে ছোঁড়া গুলির আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হয়।

পাল্টা আক্রমণের এই প্রয়াসে হুমায়ুনের মনে প্রত্যয় জন্মায় যে সে যেমনটা ভয় করেছিল সেটাকে সত্যি করে কামরান পালিয়ে যায়নি বরং সে দূর্গপ্রাসাদেই অবস্থান করছে কারণ এমন বুদ্ধি কেবল তার সৎ-ভাইয়ের মাথা থেকেই বের হওয়া সম্ভব। তাঁর চরিত্রের সাথে বিষয়টা দারুণভাবে মিলে যায়। তারা যখন উঠতি কিশোর তখন কামরান খেলা বা অন্য কোনো বিষয়ে পরাজিত হওয়াটা মেনে নিতে পারতো না, হেরে গেলেই বাচ্চাছেলেদের মতো জীহ্বা বের করে হুমায়ুনকে ভেংচি কাতো আর মুষ্ঠিবদ্ধ হাতে আস্ফালন করতো এবং তারা যখন যুবক তখন এসব কিছুর সাথে যোগ হয় উচ্চকণ্ঠে অপরের উপর দোষ চাপান আর তাদের পরবর্তী মোকাবেলায় পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন হবে বলে নিজেকেই প্রবোধ দেয়া। সেই সময়ে, হুমায়ুন হেসে কামরানকে আর তার এসব আচরণকে উপেক্ষা করতে যা তাঁর সৎ-ভাইয়ের ক্রোধ আরও বাড়িয়ে দিত। সে এখন অবশ্য কামরান আর তাঁর চেয়েও যেটা এই মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ কামরানের সঙ্গীসাথীদের, মনোবল পরখ করতে বদ্ধপরিকর। নিবিষ্ট মনে কয়েক মিনিট চিন্তা করে, হুমায়ুন কামরানের উদ্দেশ্যে একটা চিঠির মুসাবিদা শুরু করে তারপরে জওহরকে ডেকে পাঠায়।

আমি চাই দূর্গপ্রাসাদে গিয়ে তুমি নিজে আমার ভাইকে এই চরমপত্রটা পৌঁছে দেবে। আমি এটা তোমাকে পড়ে শোনাব, যাতে করে তোমার জানা থাকে তুমি কি বার্তা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। খুবই সংক্ষিপ্ত একটা বার্তা আর এর বক্তব্যও চাচাছোলা। আমাদের ভগিনী গুলবদন চেষ্টা করেছিল দায়িত্ববোধ আর পারিবারিক সম্মানের প্রতি তোমার মনোযোগ আকর্ষণ করতে। তুমি তাতে কর্ণপাত করনি। তুমি এর বদলে একটা শিশুর জীবনকে তোমার আপন ভাস্তে, তাকে ঝুঁকির মধ্যে আপতিত করে নিজের কপালে চুড়ান্ত কলঙ্কের কালিমা লেপন করেছে। আমার হাতে শহর কাবুলের পতন হয়েছে, সেইসাথে তোমার নিজের ভবিষ্যতও নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে, তোমার প্রতি আমার বিন্দুমাত্র সহানুভূতি অবশিষ্ট নেই কিন্তু তোমার অনুসারীদের কথা বিবেচনা করে আমি তোমাকে এই একটা সুযোগ দিচ্ছি। দূর্গপ্রাসাদ আমার হাতে সমর্পণ কর এবং আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে তোমার লোকদের জীবন বখশ দেব। তোমার বিষয়ে অবশ্য আমি সিদ্ধান্ত নেব আর আমি তোমাকে কোনো প্রতিশ্রুতি দিতে পারছি না। তুমি যদি এরপরেও আত্মসমর্পণ না কর, তাহলে আমি আমার সর্বশক্তি তোমার বিরুদ্ধে নিয়োজিত করবো। আমি তোমাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, যত সময়ই প্রয়োজন হোক, আমার লোকেরা তোমার দূর্গপ্রাসাদের প্রাচীর গুঁড়িয়েই তবে থামবে এবং একবার ভেতরে প্রবেশ করতে পারলে দূর্গপ্রাসাদের সবাইকে কোনো ধরনের সহানুভূতি না দেখিয়ে হত্যা করা হবে। তোমার অভিপ্রায় আমাকে জানাবার জন্য আজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত তুমি সময় পাবে। তোমার উত্তর যদি না হয়, আমি আমার তীরন্দাজদের নির্দেশ দেব রাতের আঁধারে তোমার প্রতিরক্ষা প্রাচীরের অভ্যন্তরে এই একই বার্তা সম্বলিত তীর ছুঁড়তে, যাতে করে তোমার অনুসারীরা বুঝতে পারে তোমার কাছে তাঁদের জীবন কতটা মূল্যহীন।

বস্তুতপক্ষে, জওহর দূর্গপ্রাসাদে চরমপত্রটা পৌঁছে দিয়ে আসবার পরে একঘন্টাও অতিক্রান্ত হয়নি এবং সূর্য তখনও দিগন্তের এক বর্শা উপরে অবস্থান করছে যখন, হুমায়ুন তার অস্থায়ী সেনাছাউনির সীমানার কাছে দাঁড়িয়ে আহমেদ খানের সাথে অন্য একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা করার সময়, সে নিঃসঙ্গ এক অশ্বারোহীকে দূর্গপ্রাসাদ থেকে নীচের দিকে খাড়া হয়ে নেমে আসা ঢালু পথটা দিয়ে ধীরে ধীরে নামতে দেখে এবং তারপরে সমভূমির উপর দিয়ে আড়াআড়িভাবে দুলকি চালে ঘোড়া ছুটিয়ে তাঁদের দিকে এগিয়ে আসতে আরম্ভ করে। নিঃসঙ্গ অশ্বারোহী আরেকটু নিকটবর্তী হতে হুমায়ুন লক্ষ্য করে তাঁর বর্শার অগ্রভাগে যুদ্ধবিরতির নিশান উড়ছে। অপেক্ষা করার সময় হুমায়ুনের কাছে মনে হয় ঘড়ির কাঁটা বুঝি অসম্ভব ধীরে অগ্রসর হচ্ছে কিন্তু অবশেষে আগন্তুক অশ্বারোহী তাঁর কাছ থেকে কয়েকগজ দূরে এসে উপস্থিত হয়- এক তরুণ যোদ্ধা, ধাতব শিকলের তৈরী বর্ম পরিহিত, মাথার শিয়োস্ত্রাণে ঈগলের পালকশোভিত এবং চোখে মুখে গম্ভীর একটা অভিব্যক্তি। সে তার ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে, মাটিতে নেমে দাঁড়ায় এবং সে যে নিরস্ত্র সেটা বোঝাতে দুহাত দেহের দুপাশে তুলে ধরে।

কাছে এসো, হুমায়ুন তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে।

হুমায়ুনের কাছ থেকে লোকটা যখন দশ গজ দূরে, সে প্রথাগত অভিবাদনের ভঙ্গি কুর্ণিশের রীতিতে মাটিতে পুরোপুরি আনত হয়। তারপরে সে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের বক্তব্য পেশ করে। মহামান্য সুলতান। আমি খুবই সংক্ষিপ্ত একটা বার্তা নিয়ে এসেছি। কাবুলের দূর্গপ্রাসাদ আপনার আগমনের জন্য প্রতীক্ষা করছে।

একটা তীব্র আনন্দের অনুভূতি হুমায়ুনকে একেবারে আপ্লুত করে ফেলে। একই সাথে একটা চিন্তাও তার মনের কোণে উঁকি দেয়। সে অন্য কোনকিছু করার আগে পাহাড়ের উপর থেকে কাবুল দেখা যায় এমন স্থানে তার মরহুম আব্বাজানের গড়ে তোলা উদ্যানে সে যাবে- যেখানে রোদ, বৃষ্টি, তুষারপাত আর বায়ুপ্রবাহের মাঝে বাবরের সমাধিস্থল উন্মুক্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। সেখানে, মার্বেলের পাটাতনের পাশে হাঁটু ভেঙে বসে সে নিজের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে। বাবর যা করেছিলেন ঠিক সেভাবেই সে কাবুলকে ব্যবহার করবে তার হিন্দুস্তান পুনরুদ্ধারের সূচনাস্থল হিসাবে।

*

ঝকঝকে নীলাকাশের নীচে হুমায়ুন যখন বাছাই করা লোকদের একটা দলের একেবারে অগ্রভাগে অবস্থান করে, তূর্যনিনাদের মাঝে অগ্রসর হতে শুরু করে, যেখানে তাঁর কাবুল অভিযানে অংশগ্রহণকারী সকল গোত্রের প্রতিনিধি রয়েছে, উপরের দূর্গপ্রাসাদের দিকে অগ্রসর হবার সময়ে প্রথমে সে তার মোতায়েন করা কামানগুলোকে অতিক্রম করে, তারপরে সেই স্থান যেখান থেকে সে দূর্গপ্রাকারের ছাদে শিশু আকবরকে মানব বর্ম হিসাবে প্রদর্শিত হতে দেখে ক্ষোভে ফেটে পরেছিল, সবশেষে পিঠে জ্বলন্ত আগুন নিয়ে অস্থিচর্মসার ষাড়ের দল যে উঁচু তোরণদ্বারের নীচে দিয়ে ধেয়ে এসেছিল সেটা অতিক্রম করে সে দূর্গপ্রাসাদের অভ্যন্তরে সূর্যালোকিত আঙ্গিনায় এসে উপস্থিত হয়। সে যখন তাঁর বিশাল কালো ঘোড়াটার পিঠ থেকে নীচে নামছে তখন পারস্য ত্যাগ করে আসবার পর থেকে সে যা অর্জন করেছে সেজন্য দারুণ একটা গর্ববোধ তাঁকে জারিত করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, অবশ্য, সে আকবরকে উদ্ধার করেছে, কিন্তু সেই সাথে সে কামরান আর আসকারির উপরে পুনরায় নিজের কর্তৃত্ব অর্জন করেছে এবং কাবুলের সালতানাত পুনরায় করায়ত্ত করেছে।

বৈরাম খান, নাদিম খাজা এবং তার পেছনে অনুসরণরত অন্যান্য সেনাপতিরা নিজেদের উল্লাস চেপে রাখবার কোনো চেষ্টাই করে না, তার রাস্তার দুপাশে সমবেত শহরবাসীর উদ্দেশ্যে হাত নাড়ে এবং নিজেদের এই কষ্টার্জিত বিজয় উপভোগ করে। কিন্তু হুমায়ুনের মনের ভিতরে এই আনন্দের মাঝেও বিষণ্ণ সব চিন্তা উঁকি দেয়। গতরাতে আব্বাজানের কবরের পাশে হাঁটু ভেঙে বসে সে শপথ করেছে আর কখনও সাম্রাজ্যহীন সম্রাটের ভাগ্য সে বরণ করবে না। বাবরের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আরো একবার হিন্দুস্তান দখল করার পূর্বে, সে কাবুল এবং এই রাজ্যের পুরো এলাকায় তার শাসনকে অনাক্রম্য করে তুলবে। সে পাশ্ববর্তী অঞ্চলসমূহের প্রতিটা জমিদার, যারা তাঁর অনুগত হিসাবে শাসনকার্য পরিচালনা করে তাদের বাধ্য করবে তার অধিরাজত্বের প্রতি একনিষ্ঠ আনুগত্য প্রদর্শন করতে। এইসব জমিদারদের অনেকেই কামরানকে সমর্থণ করেছিল এবং বাবরের সাথে হিন্দুস্তান অভিযানে যখন হুমায়ুন তার সঙ্গী হয় তখন সদ্যযুবা কামরান কাবুলে অবস্থান করে, সেই সময় থেকেই জমিদারদের অনেকের সাথে তার বন্ধুত্ব আর মৈত্রীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। এদের বিষয়ে অনেক সতর্কতার সাথে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শক্তির দম্ভ দেখিয়ে সাময়িকভাবে হয়ত তাদের আনুগত্য অর্জন করা সম্ভব কিন্তু সে যখন হিন্দুস্তান অভিযানে রওয়ানা হবে তখন কি হবে? তারা তখন নিশ্চিতভাবেই বিদ্রোহ করবে।

প্রথমে, অবশ্য তাঁকে তাঁর সৎ-ভাইয়ের ব্যাপারটার একটা ফয়সালা করতে হবে যাকে সে দুই বছর আগে শেষবারের মতো সামনা সামনি দেখেছিল যখন এক তুষারঝড়ের রাতে নিজের তাবুতে ঘুম থেকে জেগে উঠে নিজের গলায় তার খঞ্জরের ফলা দেখতে পেয়েছিল। কামরান কোথায়? সে জওহরের কাছে জানতে চায়, যে বরাবরের মতোই এখনও তার পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছে।

আমাকে বলা হয়েছে দূর্গপ্রাসাদের নীচে ভূগর্ভস্থ কুঠরিতে তাঁকে বন্দি করে রাখা হয়েছে।

তাকে এখনই এই প্রাঙ্গণে আমার সামনে নিয়ে এসো।

জ্বী, সুলতান।

কয়েক মিনিট পরে, হুমায়ুন তাকিয়ে দেখে একটা নীচু দরজা দিয়ে, যার পেছনের সিঁড়ি নীচের ভূগর্ভস্থ কামরার দিকে নেমে গিয়েছে, কামরান বের হয়ে আসছে, সহসা সূর্যালোকসম্পাতের কারণে সে চোখ পিটপিট করছে। তার দুই পায়ে ভারী শিকলের বোঝা এবং দুজন সশস্ত্র প্রহরী তাঁকে অনুসরণ করছে। অবশ্য, তার দুই হাত ভোলাই রয়েছে এবং শহরে প্রবেশের আনুষ্ঠানিকতা শেষে হুমায়ুনের সেনাপতিদের ঘোড়াগুলোকে আস্তাবলে ফিরিয়ে নিতে ব্যস্ত তিনজন সহিসকে অতিক্রম করার সময়, সে সহসা তাঁদের একজনের কাছ থেকে অশ্বচালনায় ব্যবহৃত একটা লম্বা চাবুক ছিনিয়ে নেয়। তাঁকে অনুসরণরত প্রহরীরা কিছু বুঝে উঠার আগেই ছিঁচকে অপরাধীদের কড়িকাঠে ঝুলিয়ে চাবকানোর জন্য নিয়ে যাবার সময় যেমন তাদের গলায় চাবুকটা ঝুলিয়ে রাখা হয় ঠিক সেভাবে সে চাবুকটা নিজের গলায় ঝুলিয়ে দেয়।

হুমায়ুন মনে মনে ভাবে, কামরান কি বোঝাতে চাইছে সে তাঁকে যে শাস্তি দেবে সেটা সে মাথা পেতে নিতে প্রস্তুত? সে প্রহরীদের ইঙ্গিতে চাবুকটা যেখানে রয়েছে সেখানেই রাখতে বলে নিজেই তাঁর সৎ-ভাইয়ের দিকে এগিয়ে যায়। সে কামরানের কাছাকাছি পৌঁছালে লক্ষ্য করে যে কামরানের মাথার চুল উস্কখুস্ক এবং চোখের নীচের কালিতে চরম পরিশ্রান্তির ছাপ ফুটে রয়েছে, কিন্তু তার সবুজ চোখের দৃষ্টি সরাসরি হুমায়ুনের দিকে নিবদ্ধ এবং সেখানে আনুগত্য কিংবা অনুতাপের ছায়া নেই কেবলই ঔদ্ধত্য আর তাচ্ছিল্যের চোরাস্রোত। তাঁর ঠোঁটের কোণে এমনকি উৎসিক্ত হাসির একটা আবছা ছায়া যেন খেলা করে।

সে কিভাবে আমার সাথে ধৃষ্টতা প্রদর্শনের সাহস করে? সে যা কিছু করেছে তারপরেও কিভাবে সে এতোটুকুও অনুতপ্ত না হয়ে থাকতে পারে? হুমায়ুন ভাবে, এতোগুলো বছর আমরা পরস্পরের সাথে যুদ্ধ না করলে এতোদিনে হিন্দুস্তান পুনরুদ্ধার করতে পারতাম, তার কারণে এতো প্রাণহানি ঘটেছে এতোকিছুর পরেও কিভাবে সামান্যতম অনুশোচনাবোধ তার মাঝে কাজ করে না? হুমায়ুন একদৃষ্টিতে তাঁর সৎ-ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকার সময়ে, তাবুতে আকবরকে ছিনিয়ে নেয়ার সময় কামরান যখন ধাক্কা দিয়ে হামিদাকে মাটিতে ফেলে দিয়েছিল তার সেই ছবিটা তার মানসপটে অনাদিষ্টভাবে ফুটে উঠে, এরপরেই সে দেখে কামানের অবিশ্রান্ত গর্জনের মাঝে কাবুলের প্রতিরক্ষা প্রাচীরের উপরে অরক্ষিত অসহায় আকবরকে প্রদর্শিত করা হচ্ছে। তার মাঝে সহসা আবেগের একটা আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরিত হয় এবং সে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। সে তার গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে কামরানের মুখে একটা ঘুষি বসিয়ে দেয়। কামরানের একটা দাঁত ভেঙে যায়, ঠোঁট দ্বিখণ্ডিত করে দিয়ে সে চেঁচিয়ে উঠে বলে, হামিদাকে অসম্মান করার জন্য এটা। সে আবারও চিৎকার করে উঠে, তার দুই চোখ অক্ষিকোটরে ধকধক করে, আর আকবরকে অপহরণের কারণে এটা! হুমায়ুন এরপরে দুহাতে কামরানের গলা টিপে ধরলে, সে মাটিতে শুয়ে পড়ে সেখানেই প্রাণপণে নিজের কুঁচকি চেপে ধরে দেহটা দুভাঁজ করে ফেলে এবং মুখ থেকে রক্ত মিশ্রিত ভাঙা দাঁতের টুকরো থু করে ফেলে কিন্তু একটা শব্দও উচ্চারণ করে না, এমনকি একটা আর্তনাদও শোনা যায় না।

হুমায়ুন ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে কাঁপতে কাঁপতে এবার পা তুলে, নিজের ধূর্ত আর অবাধ্য সৎ-ভাইয়ের পেটে সপাটে লাথি মারবে বলে, তখনই তার পেছন থেকে আতঙ্কিত কান্নার একটা শব্দ ভেসে আসলে সে নিজেকে সংবরণ করে। সে কাঁধ ঘুরিয়ে তাকিয়ে ভগ্নস্বাস্থ্য বৃদ্ধ কাশিমকে দুহাতে হাতির দাঁতের হাতলযুক্ত দুটো ছড়িতে ভর দিয়ে, যার উপরে সে অনেকদিন ধরেই নির্ভরশীল, পা টেনে টেনে তাঁর পক্ষে যত দ্রুত সম্ভব তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে।

সুলতান, একটু সুস্থির হোন। তাকে যদি হত্যা করতেই হয় তাহলে তৈমুরের উত্তরপুরুষের পক্ষে উপযুক্ত সম্মানের সাথেই তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করার ব্যবস্থা করেন। আপনার মরহুম আব্বাজান কি মনে করবেন?

তার কথাগুলো শুনে হুমায়ুনের মনে হয় কেউ যেন এক বালতি ঠাণ্ডা পানি তার উপরে ঢেলে দিয়েছে, তাঁর ক্রোধ প্রশমিত হয়। সে নিজের ভূপাতিত সৎ-ভাইয়ের কাছ থেকে দুরে সরে আসে। কামরান, আমি আত্মবিস্মৃত হয়েছিলাম। আমি অবিবেচকের ন্যায় নিজেকে তোমার স্তরে নামিয়ে এনেছিলাম। আমি তোমার ভাগ্য সম্বন্ধে পরে সিদ্ধান্ত নেব এবং সেটা কেবল আমার ক্রোধ প্রশমিত হবার পরেই হবে। প্রহরী! তাঁকে দাঁড় করাও। তাঁকে তাঁর কুঠরিতেই আবার নিয়ে যাও, কিন্তু সাবধান কেউ যেন তাঁর সাথে খারাপ আচরণ না করে।

হুমায়ুন সন্তুষ্টির সাথে দরবার কক্ষে সমবেত লোকদের দিকে তাকিয়ে থাকে। সুগন্ধি তেলের দিয়ায় জ্বলতে থাকা সলতে আর শত শত মোমবাতির আলোয় মোগলদের ঐতিহ্যবাহী সবুজ ঝালর ঝলমল করে। আজ সত্যিকার একটা বিজয় উদযাপন করতে তারা সমবেত হয়েছে। একজন মোগল শাসক হিসাবে তাঁর যোদ্ধাদের যেভাবে পুরস্কৃত করা উচিত বহুদিন হয়ে গিয়েছে। আসলে বলা উচিত বছর- সে সেভাবে করতে পারেনি। কাবুলের কোষাগার আর অস্ত্রাগার থেকে যথেষ্ট পরিমাণ কারুকার্যখচিত তরবারি আর খঞ্জর, ধাতব শিকলের তৈরী বর্ম, নিখুঁতভাবে আচ্ছাদিত, কলাই করা আর রত্ন শোভিত পানপাত্র এবং স্বর্ণ আর রৌপ্য মুদ্রা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। যদিও তার আব্বাজানের আমলে এর পরিমাণ আরো বেশী ছিল- সে এবার তাঁর প্রত্যেক সেনাপতি, আধিকারিক আর অনুগত লোকদের পুরস্কৃত করতে পারবে। কামরান যে কাবুলের ঐশ্বর্যের ব্যাপারে এমন বিচক্ষণতার পরিচয় দেবে হুমায়ুন কল্পনাও করেনি।

তার সেনাপতি আর আধিকারিকেরা এই মুহূর্তে পানাহারে ব্যস্ত- মাখন দিয়ে রোস্ট করা ভেড়ার বাচ্চা আর মুরগীর রসাল, মিষ্টি মাংস, আস্ত কোয়েল আর লম্বা লেজবিশিষ্ট ফিজ্যান্ট শুকনো ফলের ঝোলে মাখান, তাঁদের লেজের পালক এখনও রয়েছে তবে সেটার রঙ এখন সোনালী, এবং সুগন্ধি চাপাতি ইটের উপরে সেঁকার কারণে এখনও গরম আছে। এই বিলাসবহুল প্রাচুর্য- খাদ্য পরিবেশনের জন্য ব্যবহৃত অপরূপ বারকোশগুলো- এতোগুলো বছর বিপদ আর কষ্ট, বিশ্বাসঘাতকতা আর শঠতার মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করার পরে কেমন স্বপ্নের মতো মনে হয়। জাহিদ বেগ আর আহমেদ খানের রণক্ষেত্রের ক্ষতচিহ্নে জর্জরিত মুখাবয়ব আর কাশিম আর সারাফের বলিরেখা পূর্ণ মুখের দিকে, যারা তাঁকে অনুসরণ করে নিদাঘতপ্ত মরুভূমি আর তুষারাবৃত পর্বত অতিক্রম করেছে। যেখানে শীত এত প্রবল যে মনে হয় মানুষের হৃৎপিণ্ড থামিয়ে দিতে পারবে, হুমায়ুনের চোখ সত্যিকারের আন্তরিকতার নিয়ে তাকায়। তার সঙ্গের যোদ্ধার সংখ্যা যখন শদুয়েকে নেমে এসেছিল এবং আজ রাতে এখানে উপস্থিত কোনো গোত্রপতির সাথে এত কম সৈন্য থাকে- এইসব বিশ্বস্ত লোকগুলো তাঁর সঙ্গ পরিত্যাগ করেনি।

সেদিন রাতে, ভোজসভার শেষের দিকে, যখন শেষপদ পরিবেশন করা শুরু হয়েছে নানারকম মিষ্টান্ন যার ভেতরে রয়েছে আখরোটের পুর দেয়া শুকনো খুবানি, পেস্তাবাদাম আর কিশমিশ দেয়া দই পনির- সবকিছুই রূপার বারকোশে সাজিয়ে আনা হয়েছে, হুমায়ুন তার সেনাপতিদের দিকে তাকায়, সবাই খাবার উপভোগ করছে আর হিন্দুস্তান পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা আর ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনা করছে। সন্তুষ্টির একটা অনুভূতি তাকে আপুত করে বহুবছর সে এমনটা বোধ করেনি। যুদ্ধক্ষেত্রে নিজের সাহস আর দক্ষতা সম্বন্ধে তাঁর মনে কখনও কোনো সংশয় ছিল না; কিংবা নিজের অনুগত লোকদের প্রতি কোনপ্রকার দ্বিধাবোধ। কিন্তু সে জানে সে এখন হয়ত অন্য সম্ভবত আরও গুরুত্বপূর্ণ কোনো শক্তির অধিকারী হয়েছে। সে ক্রমশ একজন প্রকৃত শাসক আর নেতার মতো নিজের কর্তৃত্বের ব্যাপারে আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠছে এবং বৈরাম খানের মতো লোকদের, যাদের সাথে তাঁর পূর্ব-স্বীকৃত কোনো সম্পর্ক নেই, আনুগত্য লাভের ক্ষমতাও সে অর্জন করেছে।

কিন্তু তাঁদের কি হবে যাদের সাথে তাঁর কোনো না কোনো ধরনের সম্পর্ক রয়েছে কিন্তু যারা আনুগত্যহীন যাদের ভেতরে রয়েছে কামরান আর আসকারিকে সমর্থন করেছিল, এমনসব সেনাপতি আর অভিজাত লোকজন আর অবশ্যই এই একই দোষে দুষ্ট তার নিজের সৎ-ভাইয়েরা? হুমায়ুনের মনটা বিষণ্ণ হয়ে উঠে। সে দূর্গপ্রাসাদের প্রবেশ করার পরে থেকে গত ষাট ঘন্টা সে কেবলই এদের বিশেষ করে কামরানের ভবিতব্য নিয়ে চিন্তা করছে। নিজের সন্তানের জীবন হুমকির মুখে ফেলার জন্য খালি হাতে নিজের সৎ-ভাইয়ের উপর প্রতিশোধ নেয়ার আন্ত্রিক আকাঙ্খর কাছে সে আরেকটু হলেই পরাভব মানতো।

কিন্তু তাঁর ক্রোধ প্রশমিত হবার পরে সে এখন অনেক সংযত হয়ে চিন্তা করতে শুরু করেছে। সে কামরানকে কখনও মন থেকে ক্ষমা করতে পারবে না। কিন্তু তাঁর রাজবংশের মাঝে বিদ্যমান মতবিরোধ গভীর করার চেয়ে উপশমের চেষ্টা করলে সে এই বংশের ভবিষ্যতের জন্য এই প্রয়াসের প্রতি ঋণী থাকবে। তার মরহুম আব্বাজানের পবিত্র মুখাবয়ব- সেই সাথে কামরানের উজ্জ্বল সবুজ চোখ দুটো- তাঁর মানসপটে ভাসতে থাকে। সহসা আত্মবিশ্বাস আর সন্তুষ্টিবোধের একটা যুগপৎ ফরুধারা তাকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। হুমায়ুন উঠে দাঁড়িয়ে জওহরকে তাঁর কাছে ডেকে আনে। কামরান আর আসকারিকে এখনই আমার সামনে উপস্থিত করো, সেই সাথে আমরা যাদের বন্দি করেছি তাদের ভিতরে যারা শীর্ষস্থানীয় সেনাপতি।

সোয়া ঘন্টা পরে, জওহর ফিসফিস করে হুমায়ুনকে জানায় যে দরবার কক্ষের দরজার পুরু পাল্লার বাইরে বন্দিরা অপেক্ষমান। হুমায়ুন উঠে দাঁড়ায় এবং হাততালি দিয়ে সবাইকে নিরবতা পালন করতে বলে। তার আধিকারিকেরা তাঁদের হাতের পানপাত্র ও আহারের অনুষঙ্গ নামিয়ে রাখতে গমগম করতে থাকা কক্ষের ভেতরে প্রায় সাথে সাথে একটা অপার্থিব নিরবতা বিরাজমান হয়, তারা মিষ্টান্নের কারণে চটচটে হয়ে উঠা ঠোঁট মুছে নিয়ে এবং তাঁদের সম্রাটের প্রতি তাঁদের অখণ্ড মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে।

আমার অনুগত সেনাপতিবৃন্দ, আমাদের বিজয় আমরা উদযাপন করেছি এবং আমাদের শত্রুকে পরাস্ত করায় আমাদের উল্লসিত হওয়াটা ন্যায়সঙ্গত, কিন্তু আমাদের আরাধ্য কেবল অর্ধেক অর্জিত হয়েছে। আমাদের এখন অবশ্যই ভবিষ্যতের দিকে আর হিন্দুস্তানের উপর পুনরায় প্রভুত্ব স্থাপণের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হবে। আমাকে অবশ্য প্রথমে সেইসব লোকদের ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যারা তোমাদের থেকে আলাদা, আমার প্রতি কোনোরকম আনুগত্য তারা প্রদর্শন করেনি এবং রক্তের সম্পর্ক আর পুরুষানুক্রমিক দায়িত্ববোধ অবহেলা করেছে। বন্দিদের ভেতরে নিয়ে এসো।

দরবার কক্ষের দরজার দুপাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন পরিচারক পাল্লা দুটো খুলে দিতে কামরান পায়ে হেঁটে দরবারে প্রবেশ করে। তাঁর দুহাত পিছমোড়া করে বাঁধা কিন্তু তাঁর পায়ে কোনরকম বেড়ি পরানো হয়নি। মাথা উঁচু, পিঠ টানটান সোজা করা এবং কালশিটে পড়া, বাজপাখির মতো নাকযুক্ত মুখাবয়বে আবেগের লেশমাত্র নেই, সে ডানে বামে কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা সামনের দিকে হাঁটতে থাকে যতক্ষণ না তাঁকে পাহারা দিয়ে নিয়ে আসা প্রহরীরা হুমায়ুনের দশ ফিট সামনে তাঁকে থামতে ইঙ্গিত করে। তার ঠিক পেছনেই রয়েছে আসকারি, যাকে দূর্গপ্রাসাদে নিয়ে আসার পরে আরামদায়ক ব্যক্তিগত আবাসন কক্ষে অন্তরীণ রাখা হয়েছে কিন্তু তারও হাত অবশ্য পিছমোড়া করে বাঁধা। সে যদিও নিশ্চিতভাবেই জানে যে তাঁর ভাইয়ের চেয়ে তার ভয় কম, কারণ হুমায়ুন নিজে তাঁকে তাঁর প্রাণ বখশ দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, কামরানের চেয়ে তার অভিব্যক্তি অনেক বেশী আড়ষ্ট। তাঁর কপালে হাল্কা স্বেদবিন্দু ফুটে রয়েছে, এবং চারপাশে তাকিয়ে সে হুমায়ুনের লোকদের ভিতরে যাদের চিনতে পারে তাদের উদ্দেশ্যে সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে হাসতে চেষ্টা করে। কামরান আর আসকারির দশজন বয়োজ্যেষ্ঠ সেনাপতি তার ঠিক পেছনেই রয়েছে। দশজন সেনাপতির ভেতরে রয়েছে ঝাকড়া চুলের মোটাসোটা এক উজবেক যোদ্ধা যার নাম হাসান খলিল, এবং শাহি বেগ নামে আরেকজন, ছোটখাট দেখতে কিন্তু দুর্দান্ত সাহসী এক তাজিক, যার বাম গালে একটা সাদা সীসা-রঙের একটা ক্ষতচিহ্ন রয়েছে। সে ছিল কাবুলে কামরানের প্রধান সেনাপতি এবং বস্তুত পক্ষে হুমায়ুনের নিজের সেনাপতি জাহিদ বেগের আত্মীয় সম্পর্কিত ভাই। শাহি বেগ দরবার কক্ষে যখন প্রবেশ করে, হুমায়ুন লক্ষ্য করে দুই যোদ্ধার দৃষ্টি এক পলকের জন্য পরস্পরের সাথে মিলিত হয় কিন্তু তারপরে দুজনেই সাথে সাথে অন্যদিকে তাকায়।

কামরান আর আসকারির পেছনে তাঁদের নিজ নিজ সেনাপতিরা সারিবদ্ধভাবে অবস্থান গ্রহণের পরে, হুমায়ুন তাঁর নিজের সৈন্যদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য শুরু করে। তোমরা দেখো তোমাদের সামনের এই লোকগুলোকেই আমরা পরাস্ত করেছি। তারা সেই লোক যারা আমাদের রক্তপাতের কারণ এবং আমাদের বন্ধুদের হত্যাকারী। কিন্তু আমাদের লড়াই করা এই যুদ্ধটা ছিল আত্মীয় আর ভাইয়ের ভেতরে একটা সংগ্রাম। এটা আমি যেমন খুব ভালো করে জানি তোমাদের ভেতরে আরো অনেকেই সেটা হাড়ে হাড়ে জানে। আমাদের সেই সব লোকদের সাথে লড়াই করতে হয়েছে যাদের সাথে আমাদের উচিত ছিল একত্রে দলবদ্ধ হয়ে হিন্দুস্তানে আমাদের ভূমি জবরদখলকারী সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করা। আমাদের মাঝে বিভেদ সৃষ্টিকারী ঈর্ষা আর প্রতিদ্বন্দ্বিতার চেয়ে অনেক বড় ব্যাপার লক্ষ্য এবং উত্তরাধিকার আর ঐতিহ্য এসব কিছুর উচিত ছিল আমাদের একত্রিত রাখা। আমাদের নিজেদের ভিতরের এই বিভক্তি থাকলে আমরা আর কখনও হিন্দুস্তানের আমাদের প্রভুত্ব অর্জন করতে পারবো না। আমরা একতাবদ্ধ হলে ঠিক এতটাই শক্তিশালী হব যে আমাদের কাউকে ভয় পাবার নেই। আমাদের শত্রুর কেবল তখন ভয় পাওয়া উচিত- আমাদের বিজয় আর উচ্চাশা তখন হবে মাত্রা ছাড়া।

এই একটা কারণের জন্য আমি শাস্তি দেবার চেয়ে, যদিও সেটাই তাঁদের প্রাপ্য, আমি পুনর্মিত্রতার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার প্রাক্তন শত্রুদের ভেতরে তোমাদের সামনে তোমরা যাদের দেখতে পাচ্ছো, আমি তাদের ক্ষমা করে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কেবল একটাই শর্ত তারা হিন্দুস্তানে আমাদের সাম্রাজ্য অর্জন আর প্রসারণের জন্য আমাদের সাথে যোগ দেবে।

হুমাযন কথাটা বলেই আসকারির দিকে এগিয়ে যায় এবং একটা ছোট খঞ্জর বের করে তাঁর হাতের বাঁধন কেটে দিয়ে তাঁকে আলিঙ্গন করে। আসকারিকে আলিঙ্গণ করার সময় সে টের পায় যে আসকারি শমিত হয়েছে এবং তাঁর চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া অশ্রুবিন্দু তার সৎ-ভাইয়ের কান্নাভেজা গালের সাথে ঘষা খায়। তারপরে সে কামরানের দিকে এগিয়ে যায় এবং তারও হাতের বাঁধন কেটে দিয়ে তাকে বুকে টেনে নেয়। কামরানের দেহ আড়ষ্ট মনে হয় কিন্তু সে নিজেকে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে না। হুমায়ুন যখন তার আর আসকারির হাত শূন্যে তুলে ধরে দরবারে উপস্থিত সবার উল্লাস ধ্বনির সাথে সুর মিলিয়ে চিৎকার করে উঠে বলে, আগামী হিন্দুস্তান পুনরায় আমাদের হবে, তখনও সে কোনো রকম বাধা দেয় না।

এক ঘন্টা পরে, রাজমহিষীদের নির্ধারিত আবাসস্থলে অবস্থিত হামিদার আবাসন কক্ষের দিকে হুমায়ুনকে যেতে দেখা যায়। গতকাল সন্ধ্যাবেলা গুলবদন আর আকবরকে নিয়ে সে এসেছে এবং পরিবারের সবার একসাথে পুনরায় মিলিত হবার আনন্দে তারা কামরান কিংবা তার পরিণতি নিয়ে কোনো আলাপ করেনি। সে যখন কক্ষের ভিতরে প্রবেশ করছে, তখনই হামিদার অভিব্যক্তি দেখে সে বুঝতে পারে যে তার সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে হামিদা আগেই জেনেছে।

আপনি কিভাবে এটা করতে পারলেন! হামিদা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। আপনি কামরানকে ক্ষমা করে দিয়েছেন- যে আপনার সন্তানকে অপহরণ করেছিল এবং কাবুলের প্রতিরক্ষা প্রাচীরের উপরে মানব বর্ম হিসাবে তাঁকে প্রদর্শিত করেছিল। আপনি কি পাগল হয়ে গিয়েছেন? আমার অনুভূতি আর আমাদের সন্তানের প্রতি কি আপনার কোনো দায়িত্ব নেই?

তুমি ভালো করেই জান আমি তোমাদের কতটা ভালোবাসি। এটা একটা কঠিন সিদ্ধান্ত ছিল। একজন শাসককে তাঁর ব্যক্তিগত অনুভূতির চেয়ে আরো অনেককিছু বিবেচনা করতে হয়। তাঁর সাম্রাজ্যের জন্য কি ভালো হবে তাকে সেটা অবশ্যই চিন্তা করতে হবে। আমি যদি কামরানকে মৃত্যুদণ্ড দিতাম তাহলে তাঁর সবচেয়ে বিশ্বস্ত অনুসারী আর আত্মীয়স্বজনের অনেকেই আমার অপ্রশম্য শত্রুতে পরিণত হতো, আসকারির কথা বাদই দিলাম, কান্দাহার আমার কাছে সমর্পণের কারণে যাকে আমি আগেই জান বখশের প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। আমি যদি কামরানকে বন্দি করতাম, তাহলে সে ষড়যন্ত্র আর অসন্তোষের একটা কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হতো। তাঁর সেনাপতিদের শাস্তি দিলেও ফলাফল একই। দাঁড়াতো। বিদ্রোহের কারণে আমাদের পরিবারই কেবল বিপর্যস্ত হয়নি। আমার শত্রুদের সাথে একটা আপোষ করার চেয়ে তাঁদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের জন্য উসকে দেয়াটা বোকামী হবে। আমি যদি আবারও হিন্দুস্তান নিজের করায়ত্ত্ব করতে চাই, আমাদের এই পর্যন্ত আসতে যারা আমাদের সমর্থন করেছে তারা ছাড়াও, আমার অধীনস্ত সব জায়গিরদার আর অভিজাতদের স্বতস্ফূর্ত সমর্থন আমার প্রয়োজন হবে।

আমি অবশ্যই পারি অন্যদের আমার সাথে যুদ্ধযাত্রায় বাধ্য করতে কিংবা খাজনা দিতে, কিন্তু তারা তখন ষড়যন্ত্র শুরু করবে কিংবা পক্ষত্যাগ করার সুযোগ খুঁজবে নিদেনপক্ষে দেশে ফিরে যাবার অজুহাত খুঁজবে। আমি এসব করে আমার হারান রাজ্য পুনরুদ্ধার করতে পারবো না। সবচেয়ে নিকটজনের কাছ থেকে পাওয়া আঘাতের ক্ষত নিরাময়ে সবচেয়ে বেশী সময় লাগে। কিন্তু আমি যদি আমার ভাইদের কাছ থেকে আঘাত নিরাময় করতে পারি তাহলে আমার সাম্রাজ্য শক্তিশালী হয়ে উঠবে এবং ভবিষ্যতে আকবরের অবস্থান তাহলে আরও নিরাপদ হবে।

আকবরের কথার উল্লেখে, হামিদার মুখাবয়ব খানিকটা কোমল দেখায়, কিন্তু তখনও সেখান থেকে অনিশ্চয়তা আর সন্দিগ্ধচিত্ততর রেশ পুরোপুরি মিলিয়ে যায় না। হামিদার জন্য বিষয়টা মেনে নেয়াটা খুব কঠিন। কামরানের উপরে নিজের ক্রোধান্বিত আক্রমণের কথা হুমায়ুন ভাবে। সে নিজের অনুভূতিগুলোকে প্রকাশ করার সুযোগ অন্তত পেয়েছিল…

আমি কামরানকে ঘৃণা করি। আমি তাঁকে কখনও ক্ষমা করতে পারবো না।

হামিদা, কামরানকে ক্ষমা করার কথা আমি তোমাকে বলছি না। আমি খুব ভালো করেই জানি সেটা তুমি কখনও পারবে না। আমি তোমাকে কেবল বলছি যে আমার উপরে…আমার বিচার-বিবেচনায় ভরসা রাখো। কামরানকে মাফ করে দেয়ার পেছনে আমার আরো ব্যক্তিগত একটা কারণ আছে…আমার মরহুম আব্বাজানের প্রতি আমার আনুগত্য এবং সর্বোপরি মৃত্যুশয্যায় শায়িত অবস্থায় তাঁর ব্যক্ত করা অভিপ্রায় এবং আমার সৎ-ভাইদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের প্রতিশোধপরায়ন আচরণ না করা, তাঁরা যতই এর যোগ্য হোক না কেন, অনুসরণ করা। তার সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা যে তার পরে আমিই সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হবো, সেটা মেনে নিতে তাঁদের ব্যর্থতা, আমি তাঁকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম সেটা পালন করতে আমাকে বিরত রাখতে পারবে না।

হুমায়ুন সরাসরি হামিদার চোখের দিকে তাকায়। আমার সিদ্ধান্তে যদি তুমি আঘাত পেয়ে থাকো তাহলে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত কিন্তু তুমি নিশ্চিতভাবে জেনো কোনো কিছুই তোমার জন্য আর আমাদের সন্তানের জন্য আমার ভালোবাসাকে বদলাতে পারবে না এবং আমার মৃত্যুর সময়ে, আল্লাহর ইচ্ছা থাকলে যার এখনও অনেক দেরী আছে, আমায় আমার আব্বাজান যেমন অধিষ্ঠিত করেছিলেন তেমনি হিন্দুস্তানের সিংহাসনে আমি আকবরকে নিরাপদে অধিষ্ঠিত করে যাবো।

আপনি যদি আমাকে বলেন যে কামরানকে বেঁচে থাকতে দিলে আকবরের ভবিষ্যত অনেকবেশী নিরাপদ হবে, তাহলে সেটা আমি অবশ্যই মেনে নিতে রাজি আছি। আমাদের সন্তানের ভবিষ্যত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমি আপনাকে মিথ্যা বলতে পারবো না। আমি সর্বান্তকরণে চাই যে কামরান মারা যাক। আমি অনেক শান্তিতে ঘুমাতে পারতাম যদি সেটা জানতে পারতাম।

আকবরের জন্য এটাই সবচেয়ে ভালো হবে।

হামিদার মুখে অবশেষে হাসি ফুটে উঠে এবং সে হুমায়ুনের দিকে দুহাত বাড়িয়ে দেয়। ঘুমাতে আসুন। অনেক রাত হল।

*

হুমায়ুন পরেরদিন সকালবেলা প্রায় দশটার সময় যখন জেনানাদের আবাসস্থল থেকে বের হয়ে আসলে দেখে মুখে আকৰ্ণবিস্তৃত হাসি নিয়ে জওহর তার জন্য বাইরে অপেক্ষা করছে। সুলতান, সুসংবাদ… দারুণ সংবাদ। আমাদের গুপ্তচরেরা সংবাদ নিয়ে এসেছে যে শেরশাহ মারা গিয়েছে। রাজস্থানে তিনি একটা দূর্গ আক্রমণ করেছিলেন যখন আলকাতরা ভর্তি জ্বলন্ত একটা গোলক যা তার অবরোধে পারদর্শী প্রকৌশলীদের নিক্ষিপ্ত দূর্গের দেয়ালে আঘাত করে ঠিকরে এসে বারুদের গুদামে পড়ে। পুরো গুদাম বিস্ফোরিত হয়ে শেরশাহ আর তার দুজন বয়োজ্যেষ্ঠ সেনাপতিকে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। তারা বলেছে শেরশাহের দেহের টুকরো কয়েকশ গজ দূরে ছিটকে গিয়েছে।

এই সংবাদ কি নির্ভরযোগ্য?

গুপ্তচরেরা বলেছে বেশ কয়েকটা সূত্র থেকে সংবাদটা তারা জেনেছে। তাঁদের সন্দেহ করার কোনো কারণ নেই।

সংবাদটা বিশ্বাস করতে হুমায়ুনের বেশ কষ্ট হয়। এটা যেন তাঁর নিজের সৎ-ভাইদের ক্ষমা করা আর প্রজাদের একত্রিত করার সিদ্ধান্তের যথার্থতা প্রমাণ করছে। সুযোগের সদ্ব্যবহার করে হিন্দুস্তানের সিংহাসন পুনরায় করতে তাঁদের খুব দ্রুত এবং সম্মিলিতভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে।

আমার সেনাপতিদের আমার কাছে ডেকে নিয়ে এসো। আমার সৎ-ভাইদেরও আমাদের সাথে যোগ দিতে দাও। আমাদের পরিবারের নিয়তি পরিপূর্ণ করতে আমরা একত্রে যাত্রা করবো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *