৩.২ কান্দাহার

১৬. কান্দাহার

আপনার এই দুর্দশার ভিতরেও যে আপনি আমার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন, সেটা আমার হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছে। সারা পৃথিবী সাক্ষী যে মোগল সম্রাট যখন আমার সাহায্য কামনা করেছেন, আমি তার আহ্বানে সাড়া দিয়েছি। আমি আপনাকে সুসজ্জিত একটা সেনাবাহিনী এবং আমার শ্রেষ্ঠ সেনাপতিদের একজন তাদের নেতৃত্ব দেবে যাতে করে আপনার কাছ থেকে যা কেড়ে নেয়া হয়েছে- সেটা আপনি পুনরুদ্ধার করতে পারেন। শাহ্ তামাস্প হুমায়ুনের কাঁধ আঁকড়ে ধরেন। আমাদের আব্বাজানেরা যেমন একদা মিত্র ছিলেন, তেমনি আমরাও তাই হবো… শাহের ব্যক্তিগত উদ্যানে উত্তর দক্ষিণ এবং পূর্ব পশ্চিমে প্রবাহিত দুটো নহরের সংযোগ স্থলে নির্মিত মর্মরের বেদীর উপরে রেশমের তাকিয়ার উপরে তাঁরা এই মুহূর্তে বসে রয়েছে। নহরের প্রবাহের ফলে সৃষ্ট উদ্যানের চারভাগে ফলজ বৃক্ষ রোপন করা হয়েছে- আপেল, নাশপাতি, খুবানি, জাম, আর চেরী এবং সেই সাথে বিশেষভাবে রয়েছে শাহের প্রিয় আপেল গাছ- যার ডালে ইতিমধ্যেই সোনালী ফলের আকৃতি দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। রত্নখচিত গলবন্ধনী পরিহিত গায়ক পাখিরা ইতিমধ্যে তাদের ডালে ডালে বিচরন করছে।

শাহ্ তামাস্প যাকে নিজের বাগে জান্নাত বলে অভিহিত করেন সেখানে যখন তিনি হুমায়ুনকে সাক্ষাতের জন্য ডেকে পাঠান, হুমায়ুন তখন আশায় বুক বাঁধে। কিন্তু শাহের প্রস্তাব তাঁর অবাস্তবতম কল্পনাকেও ছাপিয়ে যায়। কোহ-ই-নূর বির্সজন বৃথা যায়নি এবং হুমায়ুন বহু কষ্ট করে নিজের উচ্ছ্বাস নিয়ন্ত্রণে রাখে। আপনি অতিশয় উদার, সে প্রত্যুত্তরে কোনমতে বলে। আমার পাশে দাঁড়িয়ে যদি আপনার যোদ্ধারা লড়াই করে, বিজয়ের ব্যাপারে আমার ভেতরে কোনো সন্দেহ থাকবে না…

আপনি হয়ত ভাবছেন আপনাকে সহায়তা করার জন্য কেন আমি এত ব্যগ্র হয়ে রয়েছি। আবেগের বশবর্তী হয়ে আমি এমন সিদ্ধান্ত নেইনি। এর পেছনে বহুবিধ কারণ রয়েছে। আমাদের মতো রাজবংশগুলোর ভেতরে বিশ্বাসঘাতকতা একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার। সাহায্য প্রার্থনা করে আমার কাছে বার্তা প্রেরণকারী আপনিই একমাত্র মোগল নন। আপনার সৎ-ভাই কামরানও আমার কাছে একটা সন্দেশ পাঠিয়েছে- যার বিষয়বস্তু হল আপনি পারস্য অভিমুখে পালিয়ে গিয়েছেন, আমি যদি আপনাকে বন্দি করি সে প্রতিদানে আমাকে অনেককিছু দেবে- স্বর্ণমুদ্রা, মূল্যবান রত্নপাথর এমনকি কান্দাহার শহরটা পর্যন্ত সে আমাকে দিতে চেয়েছে। তামাস্পের কালো চোখের মণি জ্বলজ্বল করতে থাকে। সে আমার সাথে এমনভাবে দরকষাকষি করতে চেষ্টা করেছে যেন আমি বাজারের একজন মামুলি বেনিয়া। আমি তার এই ঔদ্ধত্য দেখে ক্রুদ্ধ হয়েছি। কিন্তু তারচেয়েও বড় কথা হল, আমি নিজেকে প্রশ্ন করি, আপন ভাইয়ের রক্তপাতে কুণ্ঠিত নয় এমন একজন যুবরাজকে আমি কিভাবে বিশ্বাস করতে পারি? আমি ইচ্ছা করলে তাঁকে মাছির মতো পিষে মারতে পারি কিন্তু সেই কাজে আমি আপনাকে সাহায্য করতে বেশী ইচ্ছুক।

সে সামনের দিকে ঝুঁকে আসে। পূর্বদিকে আমি আমার সাম্রাজ্য বিস্তারে আগ্রহী নই। আপনার মরহুম আব্বাজানের সময়ে পরিস্থিতি যেমন ছিল, আমার সীমান্তে আমি ঠিক তেমনই সুস্থিত অবস্থা কামনা করি। যখন বাবর- আল্লাহতালা তার আত্মাকে বেহেশত নসীব করুন- ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন, উপজাতিদের ফাশাইস, কাফির আর অন্যান্য যারা রয়েছে। তিনি নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন। পারস্যের বণিকেরা মেশহেদ, ইস্ফাহান, এবং সিরাজ থেকে ফারগানা পর্বতমালার অন্যপাশে কাশগড়ে কোনো ধরনের বাধা বিপত্তি ছাড়াই যাতায়াত করেছে। কিন্তু আপনার সৎ-ভাই যেদিন থেকে কাবুল দখল করেছে সেখানে অরাজকতা সৃষ্টি হয়েছে আর আমার লোকদের দুর্ভোগ সহ্য করতে হচ্ছে। আমার সহায়তায় আপনি সেখানে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন।

শাহ্ যখন এসব কথা বলছিলেন, হুমায়ুনের কেবল দারয়ার ভাষ্য মনে পড়ছিল কিভাবে কাবুল দখলের জন্য সেনাবাহিনী গঠনে আর তাঁদের বেতন দিতে কামরান পারস্যের বণিকদের কাছ থেকে লুঠ করা সোনা ব্যবহার করেছে এবং ভাবে যে এসব বিষয়ে শাহ্ তাসাম্প আদৌ কিছু জানেন কিনা।

আমার মাতৃভূমিতে শীতকাল একটু আগেই আসে এবং আপনার আতিথিয়তার মতোই প্রবল সেই শীতের আগমনের যত পূর্বে সম্ভব আমি আমার অভিযান শুরু করতে চাই। প্রথমে আমি কান্দাহার অভিমুখে রওয়ানা হতে চাই এবং তারপরে প্রথম তুষারপাতের আগেই আমি কাবুলে পৌঁছাতে চাই। আমার সাথে রওয়ানা দেবার জন্য আপনার সৈন্যবাহিনী কখন প্রস্তুত হবে বলে আপনি মনে করেন?

আপনি কাঝভিনে পৌঁছাবার এক সপ্তাহ পূর্বেই আমি সৈন্যবাহিনী সংগঠিত করার কাজ শুরু করেছিলাম। আমি আপনাকে দশহাজার সৈন্যের একটা বাহিনী দিতে পারবো, যাদের ভেতরে থাকবে অশ্বারোহী তীরন্দাজ, তবকি আর গোলন্দাজ বাহিনী আর সেই সাথে অশ্বারোহী যোদ্ধা। তারা এবং তাঁদের সেনাপতি রুস্তম বেগ- দুই সপ্তাহের ভিতরে তাঁদের কামারসমূহ, অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র আর রসদের সরবরাহ নিয়ে প্রস্তুত হতে পারবে। আপনার পরিবারের জেনানারা কি কাঝভিনে অবস্থান করতে আগ্রহবোধ করবেন? আমার ভগিনীর তত্ত্বাবধায়নে তারা স্বাচ্ছন্দেই থাকবেন।

হুমায়ুন মাথা নেড়ে অসম্মতি জানায়। বিপদ আর পথের কষ্ট তাদের কাছে কিছু না। তারা আমার সাথে যেতেই পছন্দ করবেন। আমাদের সন্তানের ভাগ্যে কি ঘটেছে সেই দুশ্চিন্তা আমার স্ত্রীকে প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খাচ্ছে। তাঁর সাধ্যের ভিতরে সবকিছু থাকলে আমরা হয়তো আজই রওয়ানা দিতাম।

একজন সম্রাজ্ঞী আর মা হিসাবে তার অনুভূতিগুলো তাকে আরও সম্মানিত করে তুলেছে। মোগল রমণীদের সাহসিকতার গল্প আমি অনেক শুনেছি। আপনার ফুপুজান খানজাদা বেগম সম্পর্কে আমার আব্বাজান ভীষণ উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন।

শাহ ইসমাইলের প্রতি তাঁর কৃতজ্ঞ থাকার বহুবিধ কারণ রয়েছে…

তামাস্প তাঁর অলঙ্কারশোভিত হাতের এক অমায়িক ভঙ্গির সাহায্যে প্রশংসাটা গ্রহণ করে। কিন্তু যুদ্ধযাত্রার বিষয়ে আমরা আরো আলোচনা করার পূর্বে, আমার অবশ্যই একটা বিষয়ে আপনাকে জিজ্ঞেস করতেই হবে। আপনি একজন সত্যিকারের আল্লাহর বান্দা কিন্তু আমি যখন আপনাকে আমার মতো শিয়া মতাবলম্বীদের অনুসারী না দেখে, সুন্নী মতাবলম্বীদের অনুসারী দেখি ব্যাপারটা আমাকে ভীষণ কষ্ট দেয়। আপনি যে সত্যিই আমার ভাই সেটা আমার কাছে প্রকাশ করুন, দেখিয়ে দিন যে আমাদের ভিতরের রক্তের বন্ধনের চেয়েও শক্তিশালী। শিয়া ধর্মমত আপন করে নিন যাতে করে আমি আর আপনি পাশাপাশি নামাজে দাঁড়িয়ে আল্লাহ্তালার কাছে আমাদের অভিযানের জন্য আশীর্বাদ কামনা করতে পারি। হুমায়ুনের মুখের দিকে তামাস্পের কালো চোখের মণি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, হৃদয়ের সমস্ত উত্তাপ যেন সেখানে এসে জমা হয়েছে।

হুমায়ুন নিজের বিস্ময় আর হতাশা গোপন করতে আপ্রাণ প্রয়াস নেয়। সময়টা তামাস্প ভালোই পছন্দ করেছে- হুমায়ুনের কাঙ্খিত সবকিছু দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে নিজের দাবী সামনে নিয়ে এসেছে। জাগতিক বিষয়বস্তু- জমিজায়গা কিংবা সোনারূপার প্রতি লালায়িত একজন মানুষকে অনেক সহজে মোকাবেলা করা সম্ভব, হুমায়ুন মনে মনে ভাবে। আপোষ করার জন্য এমন মানুষগুলো তৈরীই থাকে। আরেকজন মানুষের আত্মাকে করায়ত্ত্ব করতে যে আগ্রহী তার সাথে আপোষ করা অসম্ভব। তামাস্পের প্রশ্নের উত্তর তাঁকে ভীষণ কুশলতার সাথে দিতে হবে।

আপনি কেবল আমার কাছ থেকেই এটা প্রত্যাশা করেন, আমার সেনাপতি কিংবা আমার লোকেরা এর বাইরে? সে এক মুহূর্ত পরে পাল্টা প্রশ্ন করে।

কেবল আপনি, কিন্তু একজন সম্রাট যেখানে পথপ্রদর্শন সেখানে অবশ্য প্রায়শই অনেকেই তাকে অনুসরণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করে থাকে।

আপনি এইমাত্র যা বললেন সেটা নিয়ে আমাকে একটু চিন্তা করার সময় দিতে হবে।

চিন্তা করতে আমার ভাই আশা করি খুব বেশী সময় নেবেন না। আপনি যেমনটা বলেছেন শীতের তুষার আরেক অতিরিক্ত শত্রুতে পরিণত হবার পূর্বেই আপনি আপনার অভিযান শুরু করতে আগ্রহী… শাহ তামাম্প রেশমের তাকিয়া থেকে উঠে দাঁড়ায় এবং দুই নৃপতির আলাপচারিতার সময় সতর্কতার সাথে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা দেহরক্ষীদের ইশারায় অনুসরণ করতে বলে, উঁচু পাটাতন থেকে নেমে এসে বাগানের ভিতর দিয়ে হেঁটে যাবার সময় একটা গোলাপঝাড়ে ফুটন্ত রক্তলাল গোলাপফুল তারিফ করার জন্য কেবল একটু দাঁড়ায়।

হুমায়ুন সরাসরি হামিদার কাছে যায়। হামিদার আবাসনকক্ষে প্রবেশের সময় তাঁর মুখের উদগ্রীব, আশান্বিত মুখাবয়বের দিকে তাকিয়ে সে নিজের বিড়ম্বনা যেন আরো ভালো করে অনুভব করতে পারে।

উনি কি বললেন? তিনি কি আমাদের সাহায্য করতে রাজি হয়েছেন? পরিচারকের দল বিদায় নেয়ার সাথে সাথে হামিদা হুমায়ুনের কাছে জানতে চায়।

কামরানের সাথে শাহের কোনো ধরনের বন্ধুত্বের সম্পর্ক নেই এবং তাঁকে পরাজিত করার জন্য আমাকে একদল সৈন্য দিয়ে সহায়তা করবেন বলে কথা দিয়েছেন কিন্তু সেজন্য আমাকে একটা মূল্য পরিশোধ করতে হবে…

কি মূল্য? তাকে কোহ-ই-নূরতো দেয়া হয়েছে। আমাদের আরও কত কিছু তাঁকে দিতে হবে?

সে আমাকে শিয়া মতাবলম্বী হিসাবে দেখতে চায়…।

ব্যস এই কথা? হামিদা হুমায়ুনে দিকে এগিয়ে এসে দুহাতে তাঁর মুখটা তুলে ধরে।

ব্যাপারটা মোটেই সাধারণ নয়। শাহ্ ইসমাইল চেষ্টা করেছিলেন আমার মরহুম আব্বাজান বাবরকে শিয়া মতাবলম্বী করতে তাঁকে আরেকটু হলে সে যাত্রা প্রাণ হারাতে হত এবং সমরকন্দের বিনিময়ে তিনি সেবার প্রাণে বেঁচে যান। আমাদের গোত্রের লোকের এই একটা কারণে তাকে ঘৃণা করতে শুরু করে তারা তৈমূরের বংশে জন্ম নেয়া যুবরাজ শিয়া মতাবলম্বীদের অনুসারীতে পরিণত হয়েছে বলে সন্দেহ করায় তার চেয়ে খুনী উজবেক কিন্তু সুন্নী মুসলমান সাইবানি খানের শাসন মেনে নিয়ে তার দিকে মৈত্রীর হাত বাড়িয়ে দিতে কুণ্ঠিত হয় না…

হামিদা তার মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে দুচোখে অবিশ্বাস নিয়ে এবার তার দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু তখনকার কথা ছিল আলাদা। আমরা এখন সমরকন্দে অবস্থান করছি না। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল, আমাদের সন্তানকে আমরা হারিয়েছি। তাকে রক্ষা করার জন্য আমাদের সাধ্যের ভেতরে আছে এমন সবকিছুই আমাদের করা উচিত…সেটা আমাদের কর্তব্য…যেকোনো কিছুর চেয়ে এটাই আমাদের পবিত্রতম দায়িত্ব। আপনার উচিত বিষয়টা মেনে নেয়া ঠিক আমি যেমন কামরান আকবরকে যখন আমাদের কাছ থেকে জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিয়েছিল তখন তাকে ধাওয়া না করার ব্যাপারে আপনার যুক্তি মেনে নিয়েছিলাম।

কিন্তু এরফলে আরও একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে যায় কেন শাহ তামাস্প এত খাতির যত্ন করেছিলেন… তিনি আসলে ঠিক এই উদ্দেশ্যটা হাসিল করতে চাইছিলেন…মোগলদের শিয়া মতাবলম্বী করবেন। আমার সাথে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করার সময় আমি স্পষ্ট সেটা তাঁর চোখে মুখে দেখতে পেয়েছি…

তার কর্তৃত্বের প্রতি একধরনের স্মারক সম্মতি হিসাবে তিনি আপনাকে যে শিয়া মতাবলম্বীদের অনুসারী করতে চাইছেন না সে ব্যাপারে আপনি কি নিশ্চিত?

আমার মনে হয় না যে সে এমন সূক্ষ চিন্তাভাবনার যোগ্য মানসিকতার অধিকারী। আর তুমি কি দেখছো না বিষয়টা? এমনটা যদি হয় তাহলে তো সেটা হবে আরও বিরক্তিকর। আমার সেনাবাহিনীর উপর এর কেমন প্রভাব পড়তে পারে তুমি সেটা একেবারেই বুঝতে পারছে না।

না, আপনিই বরং বিষয়টা বুঝতে চাইছেন না। আমার জন্য না হলেও আমাদের সন্তানের জন্য অন্তত নিজের গর্বকে গলা টিপে হত্যা করুন!

আমার কেবল এই গর্বটুকুই বেঁচে রয়েছে আর তুমি বলছো একেও জলাঞ্জলি দিতে?

আপনার সামনে দ্বিতীয় কোনো পথ নেই। আমাদের পরিস্থিতি এখন এতোটাই বিপজ্জনক যে নৈতিকতা নিয়ে বেশী বাড়াবাড়ি করাটা আমাদের মানায় না। বাহ্যিক আনুষ্ঠানিকতা নম নম করে পালন করুন। নিজের অন্তরে আপনি কি বিশ্বাস করেন সেটা কেবল স্মরণ রাখুন। সত্যিকারের গর্ব লোক দেখান কিছু না সেটা অন্তরে ধারণ করতে হয়। সাইবানি খানের হাতে খানজাদাকে সমর্পন করার সময় আপনার আব্বাজানের বাহ্যিক গর্ব কতটা খর্ব হয়েছিল একবার স্মরণ করুন কিন্তু তিনি নিজের অন্তরের সত্ত্বাকে ঠিকই সমুন্নত রেখেছিলেন।

হুমায়ুন কোনো কথা বলে না এবং হামিদা মৃদু কণ্ঠে বলতে থাকে, ব্যাপারটা যাই হোক না কেন, শিয়া আর সুন্নীরা কি একই আল্লাহ্র

উদ্দেশ্যে সিজদা দেয় না? তাঁদের এই বিভক্তি মানুষের সৃষ্টি কোনো ঐশ্বরিক অভিপ্রায় নয়। মহানবির পারিবারিক বিবাদ থেকে এই বিভেদের সূত্রপাত, ঠিক অনেকটাই আপনার নিজের পরিবারকে বিভক্তকারী বিরোধের ন্যায়…

হুমায়ুন মাথা নীচু করে চুপ করে বসে থাকে। নিজের সন্তানকে এবং সেই সাথে হারানো সিংহাসন পুনরুদ্ধার করতে চাইলে তার সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই, হামিদা এই বিষয়ে ঠিকই বলেছে। তার সৈন্য এবং সেনাপতিরা যাই ভাবুক না কেন, সাময়িকভাবে হলেও লাল রেশমের রাজকীয় শিয়া তাজ তাঁকে পরিধান করতেই হবে এবং মসজিদে তার অভিযানের সাফল্য কামনা করে শাহ্ তামাস্পের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে সেজদা দিতেই হবে। শিয়া হোক কিংবা সুন্নী, তাঁর উদ্দেশ্য ন্যায়সঙ্গত এবং আল্লাহ্তালা- সর্বশক্তিমান স্রষ্ঠা- নিশ্চয় তার পাশেই থাকবেন…

*

কয়েকদিন পরের কথা, হুমায়ুন একটা আত্মতুষ্টির ভাব নিয়ে মনে মনে ভাবে, তাঁরা বেশ দ্রুতই অগ্রসর হচ্ছে- নিদেন পক্ষে শাহের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত কাঝভিন অভিমুখী যাত্রার চেয়ে অনেক দ্রুততো বটেই। হুমায়ুনের ঠিক সামনেই রয়েছে পার্সী তিরন্দাজ আর তবকির দল আর তার ঠিক পেছনেই রয়েছে হামিদা আর গুলবদন এবং তাঁর দেহরক্ষীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত অবস্থায় তাঁদের সাথের পরিচারিকার দল নিজ নিজ গরুর গাড়িতে অবস্থান করছে। তার অবশিষ্ট সৈন্যরা এর ঠিক পেছনেই রয়েছে, তারপরে রয়েছে মালবাহী শকটের বহর যার ভেতরে গরুর গাড়ির উপরে বয়ে নেয়া কামানগুলোও রয়েছে এবং বহরের সবশেষে রয়েছে পার্সী অশ্বারোহীর দল, তাঁদের বর্শার ফলা- মোগলদের বর্শার ফলার চেয়ে চওড়া এবং কোনো অংশেই কম কার্যকরী নয়- ভোরের প্রথম সূর্যের আলোয় চকচক করছে।

জাহিদ বেগ হুমায়ুনের বাম পাশে অবস্থান কিন্তু তার ডান পাশে রয়েছে পার্সী সেনাপতি রহিম বেগ। লম্বাটে, নিখুঁত মুখাবয়বের অধিকারী বয়স্ক এক লোক, তিনি শাহের আত্মীয়-সম্পর্কিত ভাই যিনি হুমায়ুনের যুদ্ধকালীন মন্ত্রণাসভায় পার্সী কবিদের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করতে পছন্দ করেন কিন্তু নিজের বাহিনীর দৈনন্দিন কর্ম-তৎপরতা দেখাশোনার দায়িত্ব বৈরাম খান নামে এক সহকারীর উপরে ন্যস্ত করেছেন। শেষোক্ত এই যোদ্ধাটিকে এখনও তরুণই বলা চলে- চৌত্রিশ কি পঁয়ত্রিশের বেশী তাঁর বয়স হয়নি। কিন্তু দৈহিক কাঠামোয় স্কুলত্বের একটা ধাঁচ থাকায় এবং মুখের ডানপাশে একটা পুরাতন ক্ষতচিহ্নের কারণে তাঁকে অনেক বেশী বয়স্ক বলে মনে হয়। একজন পার্সীর তুলনায় তাঁর চোখের মণির রঙ একটু বিচিত্রই বলতে হবে- গাঢ় প্রায় ধূম্রনীল- এবং চূড়াকৃতি শীর্ষদেশ বিশিষ্ট ইস্পাতের শিরোম্রাণের নীচ দিয়ে তার লম্বা কালো চুলের বেনী উঁকি দিচ্ছে, শিরোস্ত্রাণের সাথে ধাতব শৃঙ্খল নির্মিত বর্মের একটা ঝালর রয়েছে গলা এবং মুখাবয়বের উভয়পার্শ্বকে সুরক্ষিত রাখতে আর শিরোস্ত্রাণের উপরে একটা সুদৃশ্য ময়ূরের পালক শোভা পাচ্ছে।

কাঝভিন ত্যাগ করার পরে শুরুর দিকে হুমায়ুন কোনো প্রশ্ন করা ছাড়া বৈরাম খানকে কদাচিৎ কথা বলতে দেখা যেত। অবশ্য যতই দিন যাচ্ছে ততই তাঁর মিশুক স্বভাব বিকশিত হচ্ছে। যথেষ্ট চিন্তা ভাবনা করেই সে কোনো বিষয়ে মন্তব্য করে এবং হুমায়ুনের সেনাপতিদের বক্তব্য সে একই সৌজন্য আর বিচক্ষনতার সাথে শ্রবন করে। যার ফল আখেরে ভালো হয়। রুস্তম বেগ যদি নিজেকে বেশী মাত্রায় সক্রিয় করার প্রয়াস নিতেন এবং বৈরাম খান মাত্রাতিরিক্ত ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতেন তাহলে সেটা হুমায়ুনের মুষ্ঠিমেয় সৈন্য আর তাঁদের চেয়ে সংখ্যা অনেকবেশী পার্সীদের মাঝে নিশ্চিতভাবেই একটা মতবিরোধের জন্ম দিত। অবশ্য সে রকম কিছুই হয় না, দুটো দলই শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করে। হুমায়ুনের শিয়া মতাবলম্বী হবার বিষয়টা- যা ছিল সময়ের দাবী অনুযায়ী একটা বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত, তার লোকেরা আপাত নিস্পৃহ ভঙ্গিতে গ্রহণ করেছে দেখে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তারা কোনো ধরনের প্রতিবাদ না করে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকে যেখানে স্বয়ং শাহ্ নিজে তাঁর মাথায় রক্তলাল রঙের তাজ পরিয়ে দেয়, হুমায়ুনের মতো তারা অনুধাবন করতে পেরেছে যে তাঁদের সবার ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য এটা জরুরী।

হুমায়ুন সামনের দিকে তাকিয়ে অশ্বারোহীদের একটা ছোট দলকে আস্কন্দিত বেগে তাঁর দিকে এগিয়ে আসতে দেখে, তাঁদের চারপাশের বাতাসে একটা ধূলিঝড় জন্ম নিয়েছে। দলটায় দুজন গুপ্তদূতসহ আহমেদ খান এবং রুস্তম বেগের মনোনীত দুজন পার্সী অশ্বারোহী রয়েছে যাদের পথপ্রদর্শক হিসাবে পাঠান হয়েছে।

সুলতান, আমরা হেলমান্দ নদী থেকে পনের মাইল দূরে অবস্থান করছি।

চমৎকার। হুমায়ুনের ঠোঁটের কোণে হাসির একটা হাল্কা রেখা ফুটে উঠে। আর দুইদিন- খুব সম্ভবত আগামীকালই- সে পুনরায় হেলমান্দের বরফশীতল পানি আরো একবার পার হবে এবং এবার তাকে অনুসরণ করে অমিত শক্তিশালী একটা সেনাবাহিনীও নদী অতিক্রম করবে।

*

খয়েরী-বেগুনী পর্বতমালার তীক্ষ্ণ অভিক্ষিপ্ত অংশের প্রেক্ষাপটে কান্দাহার দূর্গের চওড়া পাথুরে দেয়াল এবং সরু জানালাযুক্ত গম্বুজকে ভয়ানক দূর্ভেদ্য মনে হয়। এখন যদিও কেবল সেপ্টেম্বর মাস চলছে, দূর্গ থেকে আধ মাইল দূরে একটা জঙ্গলাকীর্ণ পাথুরে টিলার উপরে একটা নিম্নমুখী ঢালের কাছে হুমায়ুন আর তাঁর সেনাপতির দল তাদের রোকের অবস্থান থেকে দূর্গ পর্যবেক্ষণের কালে হিম শীতল বাতাসে তারা রীতিমতো কাঁপতে থাকে।

আকবর ঐ দূর্গের অভ্যন্তরে কোথায় রয়েছে? হুমায়ুন খুব ভালো করেই জানে আর কিছুক্ষণের ভিতরে সে যে সিদ্ধান্ত নেবে, তার উপরেই তাঁর সন্তানের বাঁচামরা নির্ভর করছে। কামরানকে মূর্খ ভাবার কোনো কারণ নেই। হুমায়ুনের অগ্রাভিযান নিশ্চয়ই তার গুপ্তচরদের নজরে এসেছে এবং সে ইতিমধ্যে অবশ্যই জেনে গিয়েছে যে- হুমায়ুনকে পোড় খাওয়া পার্সী সৈন্যদের একটা বিশাল দল সহায়তা করায় শক্তির পাল্লা এবার তার দিকেই ঝুঁকে আছে। আক্রমণ কিংবা অবরোধ করে যেভাবেই হোক কান্দাহারের পতন এখন কেবল সময়ের ব্যাপার। এমন পরিস্থিতিতে কামরানের কাছ থেকে কি আশা করা যায়? হুমায়ুন যদি অবরোধ তুলে না নেয় তাহলে সে আকবরের ক্ষতি করার হুমকি দিতে পারে? কামরানের দ্বারা এটা সম্ভব। অন্যদিকে হুমায়ুন নিজেকেই আবার নিজকে প্ৰবোধ দিতে চেষ্টা করে যে তার সৎ-ভাই খুব ভালো করেই জানে যে আকবরকে হত্যা করলে- সে দরকষাকষি করার টেবিলে তাঁর সবচেয়ে কার্যকরী সস্তার কাউন্টারের সুবিধা সে হারাবে…

বৈরাম খান এবং রুস্তম বেগ দূর্গের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে এবং আক্রমণের জন্য সম্ভাব্য দুর্বল স্থান আর দূর্গের আক্রমণ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা নিয়ে নিবিষ্ট মনে আলোচনা করছে। নাদিম খাজাও দূর্গের বহিরঙ্গের দিকে একাগ্রচিত্তে তাকিয়ে রয়েছে। কান্দাহারের মাথার উপরের পর্বতমালা থেকে আগত একজন গোত্রপতি কারণে তার কাছে দূর্গটা একটা পরিচিত দৃশ্যপট কিন্তু হুমায়ুনের মতো তার ভাবনারও একটা বিরাঠ অংশ জুড়ে রয়েছে নিজের পরিবারের জন্য তাঁর উৎকণ্ঠা। তাঁর স্ত্রী মাহাম আগা এবং তাদের আপন সন্তান, আকবরের মতোই, দূর্গের দেয়ালের অভ্যন্তরে বন্দি অবস্থায় রয়েছে। নাদিম খাজার কাঁধে হুমায়ুন কিছুক্ষণের জন্য নিজের হাত রাখে এবং পরস্পরের চোখের দিকে তাকিয়ে তাঁরা দুজনেই বুঝতে পারে যে তাঁদের মনের ভিতর একই আবেগ মথিত হচ্ছে। তাঁরা দুজনেই চৌকষ যোদ্ধা, যাদের সহজাত প্রবর্তনাই হল ঝড়ের প্রচণ্ডতা নিয়ে দূর্গের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজেদের প্রিয়জনকে বিপদ থেকে উদ্ধার করা। কিন্তু এসব হঠকারী প্রণোদনায় যে কার্যসিদ্ধি হবে না সেটাও তারা বুঝতে পারে…

হুমায়ুনের মাথায় ধীরে ধীরে একটা পরিকল্পনা অবয়ব লাভ করতে শুরু করে। কামরানের সাথে আলোচনা শুরুর জন্য একটা উপায় তাঁকে খুঁজে বের করতেই হবে। সমঝোতার ধারণা যদিও তার মাঝে বিবমিষার উদ্রেক ঘটায়, সে ভালো করেই জানে তার জায়গায় তার মরহুম আব্বাজান থাকলে এই একই সিদ্ধান্ত নিতেন। বাবর কি নিজের অহঙ্কার জলাঞ্জলি দেননি এবং সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য সাইবানি খানের সাথে সমঝোতা করেননি? খানজাদাও তাঁকে ঠিক এই পরামর্শই দিত। ধৈর্য ধারণের, চুড়ান্ত বিজয় অর্জনের জন্য সাময়িক ত্যাগ স্বিকারের গুরুত্ব সম্বন্ধে তার ধারণা যে কারো চেয়ে অনেক পরিশীলিত ছিল।

কিন্তু তার পক্ষে কথা বলার মতো যোগ্য কে আছে? তাঁর নিজের পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। কামরান যদি তার সাথে দেখা করতে রাজিও হয়, তাঁরা যদি মুখোমুখি হতে পারে, তাদের ভেতরে পরস্পরের প্রতি ঘৃণার মাত্রা এতই প্রবল যে সেখানে হাত থাকতে মুখ নিপ্রয়োজন পরিস্থিতি অচিরেই সৃষ্টি হবে। কিন্তু কাশিম বা তার সেনাপতিদের একজনকে সে পাঠাতে পারবে না। পুরো বিষয়টার ভিতরে একটা পারিবারিক আবহ রয়েছে। মোগল রীতিতে বিদ্যমান আনুগত্য আর সম্মানের প্রতিটা মূলনীতি কামরান কিভাবে লঙ্ন করেছে, কিভাবে তাঁর উচ্চাশা বাবরের উত্তরাধিকারকে দুর্বল আর বিভক্ত করেছে, তাকে সেটা অবশ্যই বোঝাতে হবে।

হুমায়ুনের সফরসঙ্গীদের ভিতরে কেবল একজনই রয়েছে যিনি এসব বিষয় কামরানের সাথে উপস্থাপন করতে পারবেন, যার ধমনীতে তাঁর এবং আকবর উভয়ের রক্তই বইছে। মোগল রমনীরা প্রায়শই গোত্রের ভেতরে শান্তি স্থাপনকারীর ভূমিকা পালন করে থাকে এবং সে তার যেকোনো পরামর্শদাতার সমান ক্ষুরধার বুদ্ধিমত্তার অধিকারী।

নিজেকে এভাবে জাহির করাটা যদিও অসম্মানজনক, তার সৎ-বোনের কোনো ক্ষতি করার কথা কামরান চিন্তাও করবে না এবং সে এমনকি শুনতেও রাজি হতে পারে এবং সে এমনকি শুনতেও রাজি হতে পারে- যদি তার ব্যত্তিগত অনুরোধে কাজ না হয়, হুমায়ুনের কাছ থেকে সে কি বার্তা বয়ে এনেছে সেটা নিদেনপক্ষে তারা উপস্থাপন করতে পারবে। আকবরের কোনো ক্ষতি না করে কামরান যদি তাকে ফিরিয়ে দেয়, সে তাহলে আসকারি এবং তাঁদের সাথের লোকজন আর তাঁদের অস্ত্র নিয়ে কোনো ধরনের বিধিনিষেধ ছাড়াই বিদায় নিতে পারবে এবং সেই সাথে হুমায়ুনও তাদের আনুষ্ঠানিক প্রতিশ্রুতি দেবে- তাদের আব্বাজান বাবরের নামে সে শপথ করছে তাদের পিছু ধাওয়া সে করবে না।

এখন কেবল একটা প্রশ্নই বাকি আছে। এমন ঝুঁকিপূর্ণ অভিযান গুলবদন কি আদৌ স্বেচ্ছায় আরম্ভ করবেন। কিন্তু হুমায়ুন যখন ইশারায় তার সেনাপতিদের নিজ নিজ ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে ঢাল বেয়ে পাহাড়ের উপরের দিকে উঠে নিজ নিজ বাহিনীর সাথে মিলিত হতে আদেশ দেয়, সে নিশ্চিত প্রশ্নের উত্তর সে ইতিমধ্যে জেনে ফেলেছে।

*

সুলতান, গুলবদন বেগম ফিরে আসছেন।

হুমায়ুন তার নিয়ন্ত্রক তাবুর বাইরে চিৎকারের শব্দ শুনতে পেয়ে, সে যে টুলের উপরে বসে ছিল সেটা থেকে তড়াক করে উঠে এবং তাবুর আচ্ছাদন একপাশে সরিয়ে বাইরে দ্রুত ঘনিয়ে আসা সন্ধ্যার আলো আধারির মাঝে এসে দাঁড়ায়। হুমায়ুনের সেনাছাউনি আর দূর্গের মাঝে অবস্থিত উপত্যকার বুকের উপর দিয়ে মিটমিট করে জ্বলতে থাকা একসারি আলো ধীরে ধীরে তাঁদের দিকে এগিয়ে আসছে- গুলবদনের প্রতিরক্ষা সহচর হিসাবে জওহরের সাথে সে প্রহরীদের যে দলটা পাঠিয়েছিল মশালগুলো তারাই বহন করছে, তারা গুলবদনকে বহনকারী শকটের সামনে আর পেছনে রয়েছে।

সাময়িক যুদ্ধবিরতির নিশান বহন করে সাত ঘন্টা আগে সে যাত্রা করেছিল। অন্ধকারের ভিতরে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে থাকার সময়, হুমায়ুনের ক্ষণিকের জন্য মনে হয় যে গুলবদনের কোলে সে হয়ত আকবরকে দেখতে পাবে কিন্তু এমন অভিলাষী ভাবনা অচিরেই কাণ্ডজ্ঞানের কাছে পরাভব মানে। কামরানের মতো পাষণ্ডের কাছে আবেগের কোনো স্থান নেই। সে একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আকবরকে আটকে রাখতে চেষ্টা করবে, যখন সে নিশ্চিত জানে হুমায়ুনের কথার বরখেলাপ হবে না।

সে যাই হোক, নিজের অস্থিরতাকে বশে রাখতে ব্যর্থ হয়ে, হুমায়ুন দড়ি দিয়ে ঘিরে রাখা স্থানটার দিকে দৌড়ে যায়, যেখানে ঘাস খাবার জন্য তার ঘোড়াকে বেঁধে রাখা হয়েছে। পর্যানের জন্য অপেক্ষা না করে, সে ঘোড়ার গলার দড়িকেই লাগাম হিসাবে ব্যবহার করে, প্রাণীটার কানে ফিসফিস করে আদেশ দেয়, দড়ি টপকে গিয়ে উপত্যকার মাঝ দিয়ে দৌড়ে যেতে। তাঁর হৃৎপিণ্ড এত জোরে স্পন্দিত হতে থাকে যে ক্ষণিকের জন্য তার মনে হয় নরম ঘাসের বুকে ধাবমান খুরের ধুপধুপ শব্দ বুঝি সেটার শব্দ। নিজের লোকদের সামনে নিজেকে পক্ষপাতহীন আর নিরুত্তাপ নেতা হিসাবে প্রমাণ করতে, হামিদার দিকে আত্মবিশ্বাসী, নিরুদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকাতে গিয়ে নিজের অনুভূতিকে কতবার তাঁকে এভাবে চেপে রাখতে হবে। কিন্তু চারদিক থেকে ধেয়ে আসা অন্ধকারের মাঝে নিজের কাছে তার স্বীকার করতে লজ্জা নেই যে যে কোনো সাধারণ মানুষের মতোই সে উৎকণ্ঠা আর ভয়ে আক্রান্ত হয়, বিশেষ করে যখন তার প্রিয়জনদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় এবং সেটা নিশ্চিত করা তাঁর দায়িত্বের ভেতর পড়ে।

সুলতান আসছেন! জওহর চিৎকার করে বলছে, সে শুনতে পায়। সে গুলবদনকে বহনকারী শকট থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে ঘোড়ার মুখটা একপাশে সরিয়ে এনে প্রাণীটাকে দাঁড় করিয়ে পিছলে তার পিঠ থেকে মাটিতে নামে। জওহরও ইতিমধ্যে তাঁর বাহন থেকে নেমে এসেছে এবং বিনা বাক্য ব্যয়ে হুমায়ুনকে গুলবদনের গাড়ির দিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে। জওহরের হাতে ধরা মশালটা নিয়ে হুমায়ুন গাড়ির ঝালর একপাশে সরিয়ে ভেতরে অবস্থানরত নিজের সৎ-বোনের দিকে তাকায়।

তুমি নিরাপদে ফিরে এসেছে দেখে আমি ভাগ্যের কাছে কৃতজ্ঞ। কামরান কি বলেছে? আমার শর্ত কি সে মানতে প্রস্তুত?

গুলবদন আলোর দিকে খানিকটা ঝুঁকে আসে তার কিশোরী মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট বোঝা যায়। হুমায়ুন, আমি দুঃখিত। কামরান সেখানে ছিল না। কেবল আসকারির সাথে দেখা হয়েছে। আপনার অগ্রযাত্রার খবর শুনে কয়েক সপ্তাহ আগেই সে সদলবলে কাবুল রওয়ানা হয়েছে যার মানে আপনার কবল থেকে সে শহরটাকে রক্ষা করতে চায়।

আর আকবর?

কাবুল যাবার সময় কামরান তাকেও সাথে নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু হুমায়ুন এখনও সব আশা শেষ হয়ে যায়নি। আসকারি আমাকে নিশ্চিত করেছে, যে আকবর সুস্থ আছে এবং মাহাম আগা তার সাথেই রয়েছে…

আমি কিভাবে আসকারির কথা বিশ্বাস করি, যখন সে এমন একজন মানুষের প্রতি অনুগত যে একটা শিশুকে আমার বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে প্রস্তুত?

আমার মনে হয়, এই ব্যাপারটা নিয়ে আসকারিও মনে মনে লজ্জিত। সেই সাথে তাঁর কথা শুনে আমার মনে স্থির বিশ্বাস জন্মেছে যে, সে মনে করে কামরান তাকে এখানে কান্দাহারে অবস্থানের আদেশ দিয়ে রেখে গিয়েছে আপনার ক্রোধের অনলে দগ্ধ হতে।

আসকারি কি কান্দাহার আমার কাছে সমর্পন করতে রাজি আছে?

সে সমর্পন করবে। আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে যে তার এবং তাঁর লোকদের জীবন আপনি বখশ দিবেন।

হুমায়ুনের ঠোঁটের কোণে বিষণ্ণ একটা হাসির রেখা ফুটে উঠে। তার এবং তার লোকদের প্রাণ সংশয় হবার কোনো কারণ এখন ঘটেনি কিন্তু আকবরের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের শর্তেই আমি তাঁদের এখান থেকে যেতে দেব। আমার সন্তানকে খুঁজে পাওয়া এবং কামরানের সাথে আমার বোঝাঁপড়া না হওয়া পর্যন্ত অন্তত আসকারিকে আমার জিম্মায় থাকতে হবে। হিন্দালের কি খবর? তার ভাগ্য সম্পর্কে কি তুমি কিছু জানতে পেরেছো?

আমার ভাবনায় সবসময়েই আমার ভাইজান উপস্থিত আছে এবং তার ভাগ্যে কি ঘটেছে- সেটা জানার জন্য আমি আসকারিকে রীতিমতো চাপ দিয়েছি… সে আমাকে বলেছে যে কামরান আদেশ দিয়েছিল তাঁকে জালালাবাদের দূর্গে নিয়ে গিয়ে সেখানে তাঁকে বন্দি করে রাখতে। কিন্তু সেখানে যাবার পথে সে কোনোভাবে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। সেটাও প্রায় বেশ কয়েকমাস আগের কথা এবং আসকারি জানে না সে পালিয়ে কোথায় আশ্রয় নিয়েছে… আশা করি আমার ভাই নিরাপদেই আছে।

আমিও সেটাই চাই। আমাদের ভিতরের মতবিরোধের জন্য আমার উপরেও খানিকটা দায় বর্তায় এবং অন্যদের চেয়ে তাকেই আমার নিজের ভাই বলে বেশী। মনে হয়। কিন্তু গুলবদন, তুমিই হলে আমার সত্যিকারের আপন বোন এবং হামিদার বিশ্বস্ত বন্ধু। তুমি আজ খুব কঠিন একটা কাজ করেছে এবং সেজন্য আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ।

বাবরের সন্তানদের মাঝে এমন রক্তক্ষয়ী বিভেদের বিষয়টা মেনে নেয়া খুবই কষ্টকর। ধীর পদক্ষেপে নিজের ঘোড়র কাছে ফিরে যাবার সময় বিষণ্ণতা আর হতাশার একটা শেকল হুমায়ুনকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রাখে। অস্থায়ী শিবিরে ফিরেই সে সরাসরি হামিদার সাথে দেখা করতে যায়। সে জেনানাদের জন্য স্থাপিত তাবুর ভেতর অপেক্ষা করেছিল এবং হুমায়ুনের চোখে মুখে বিষণ্ণতার গাঢ় দেখে তাঁর কালো চোখের মণি থেকে আশার শেষ রশ্মিটুকুও ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। কামরান তাহলে আপনার প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছে?

সেটা করলেই বোধহয় ভালো হত। সে এখানেই নেই। হামিদা- সে আকবরকে কাবুলে নিয়ে গিয়েছে…

হামিদার চোখে ধীরে কান্নার বারিধারা জমে উঠতে, হুমায়ুন তাকে নিজের কাছে টেনে আনে। আমার কথা শোন। আমাদের হতাশ হলে চলবে না। আসকারি এখনও কান্দাহারেই আছে এবং গুলবদনকে সে আশ্বস্ত করে বলেছে যে আকবর সুস্থ আছে। এটা অন্তত একটা সুখবর।

কিন্তু এখান থেকে কাবুল অনেক দূরে…।

এখান থেকে কাবুলের দূরত্ব তিনশ মাইল এবং আমাদের সন্তানকে উদ্ধারের জন্য আমি তিন হাজার মাইল পথ পাড়ি দিতে প্রস্তুত। তুমি জান সেটা…

আমি জানি কিন্তু কাজটা কঠিন। আমি সারাটা দিন কেবল আকবরের কথাই ভাবি এবং তার ভাগ্যে কি ঘটতে পারে, এমনকি আমি যখন ঘুমাতে চেষ্টা করি তখনও আমার স্বপ্নে কেবল এসব ফিরে ফিরে আসে। আমি যখন গর্ভবতী ছিলাম এবং মালদেবের নাগাল থেকে আমার পালাচ্ছিলাম, আমার গর্ভ থেকে জীবন্ত অবস্থায় তাকে আলাদা করার অনুভূতি কেমন হবে, আমি চেষ্টা করেও নিজেকে সেই কল্পনা করা থেকে বিরত রাখতে পারিনি। নিজের দেহে আমি ইস্পাতের ফলার শীতল স্পর্শ যেন অনুভব করতে পারতাম। দুশ্চিন্তাটা এতোই প্রবল ছিল…ঠিক অনেকটা শারীরিক যন্ত্রণার মতো। আমি জানি না আর কতদিন আমি এই যন্ত্রণা সহ্য করতে পারবো।

আর কিছুদিন মনটাকে শক্ত রাখো… আমাদের সন্তানের স্বার্থেই তোমাকে শক্ত হতে হবে, মালদেব যখন আমাদের বিনাশের পরিকল্পনা করেছিল তখন তুমি যেমন শক্ত ছিলে। আসকারি কান্দাহার আমার কাছে সমর্পনের প্রস্তাব করেছে। আমি যত শীঘ্রি সম্ভব এখানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবো, তত দ্রুত আমরা কাবুলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হব। হামিদার দেহের আড়ষ্ঠতা সামান্য শীথিল হয়েছে, সে টের পায় এবং হুমায়ুনের কাছ থেকে সে এবার এক পা পেছনে সরে আসে।

আপনি ঠিকই বলেছেন- আমি আসলে হতাশা থেকে এসব আবোলতাবোল কথা বলেছি। আমি নিজের মনকে বুঝিয়েছিলাম যে দুই কি একদিনের ভিতরে আমি আকবরকে নিজের কাছে পাবো। আমারই বোকামি হয়েছে এভাবে আশা করা।

সেটাই স্বাভাবিক। আমিও নিজেকে সেইরকম প্রবোধই দিয়েছিলাম। আমাকে এখন অবশ্যই ধৈর্য আর একাগ্রতার পাঠ নিতে হবে। আমরা পরস্পরকে মানসিক শক্তি যুগিয়েই টিকে থাকবে এবং সফল হব।

কয়েক মিনিট পরে, হুমায়ুন নিজের নিয়ন্ত্রক তাবুতে ফিরে এসে, একটা নীচু টুলের উপরে বসে, এক টুকরো কাগজ নিয়ে তার উপরে কয়েকটা বাক্য লিখে। তারপরে, যদিও তখন অনেক রাত হয়েছিল সে তার যুদ্ধকালীন মন্ত্রণা পরিষদকে সমবেত হবার আদেশ দেয়।

আহমেদ খান, আমি চাই কান্দাহারে আমার সৎ-ভাই আসকারির কাছে আজ রাতেই এই চিঠিটা পৌঁছে দেবার জন্য আপনি একদল সৈন্য পাঠাবেন। তাঁর প্রতি আমার বক্তব্য একেবারেই সাদামাটা। আগামীকাল সকালে আমার সৈন্যবাহিনীর পুরোভাগে অবস্থান করে আমি তোমার তোরণদ্বারের সামনে উপস্থিত হব। আমাদের বোনের কাছে তুমি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সেই মোতাবেক তুমি যদি আমার জন্য তোরণদ্বার খুলে দাও, তোমার প্রাণ সংশয় হবে না, যদিও তুমি আমার বন্দি হিসাবে থাকবে। আমার সাথে প্রতারণা করার সামান্যতম প্রয়াসও যদি তুমি নাও, তোমার এবং সেই সাথে তোমার লোকদের জীবনের নিরাপত্তা আমি দিতে পারবো না। পছন্দ করার এক্তিয়ার এখন তোমার।

আহমেদ খান চিঠিটা নিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে তাবু থেকে বের হয়ে যাবার পরে হুমায়ুন তার অন্যান্য সেনাপতিদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়।

আগামীকাল, আমার সৎ-ভাই যদি তাঁর কথা রাখে তাহলে কান্দাহার আমাদের করায়ত্ত হবে। বৈরাম খান, আমি আপনাকে অনুরোধ করবো দূর্গে রক্ষীসেনা হিসাবে মোতায়েন করার জন্য, আপনার লোকদের ভেতর থেকে দুই হাজার জনকে নির্বাচিত করতে- যাদের নেতৃত্বে থাকবে আপনার সবচেয়ে বয়োজ্যোষ্ঠ আর বিশ্বস্ত সেনাপতিরা।

বৈরাম খান মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। আমি আমার তীরন্দাজ আর তবকিদের ভেতর থেকে সৈন্য বাছাই করবো এবং আপনি যদি রাজি থাকেন তাহলে দূর্গের আশেপাশের এলাকায় টহল দেবার জন্য আমি এদের সাথে একটা অশ্বারোহী বাহিনীও সন্নিবেশিত করবো।

বৈরাম খান, দারুন একটা পরামর্শ দিয়েছেন। কান্দাহার রক্ষার জন্য আমাদের রক্ষীসেনা মোতায়েন করার কাজ শেষ হলেই আমরা কাবুলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবো। কষ্টকর পাহাড়ী এলাকার ভিতর দিয়ে যদিও এটা একটা দীর্ঘ যাত্রা হবে, আমাদের অবশ্যই দ্রুত এবং অনমনীয় ভঙ্গিতে ভ্রমণ করতে হবে। অতিক্রান্ত প্রতিটা দিন আমার সৎ-ভাইকে অন্যদের সাথে মৈত্রীর বন্ধন গড়ে তোলার এবং সেখানে নিজের অবস্থান সুসংহত করার জন্য অতিরিক্ত সময় দান করবে।

আমাদের রসদবাহী বহরের কি হবে? এটা আমাদের অগ্রযাত্রার গতি শ্লথ করে দেবে, জাহিদ বেগ জানতে চায়।

আমাদের সাথে আমরা কেবল সেটাই রাখবো যা আমরা বহন করতে পারবো এবং আমাদের মালবাহী আর রসদের বহর যার ভিতরে আমাদের কামানগুলোও রয়েছে রক্ষার জন্য একটা ছোট কিন্তু চৌকষ দলকে দায়িত্ব দেয়া হবে, তারা তাঁদের পক্ষে যতটা দ্রুত গতিতে সম্ভব আমাদের অনুসরণ করবে। কিন্তু এখন অনেক রাত হয়েছে। সুবেহ সাদিকের এক ঘন্টা পূর্বে আমরা আবার মিলিত হব, কাবুলের উদ্দেশ্যে আমাদের যাত্রার প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে।

*

উত্তর দক্ষিণে বিস্তৃত ধুসর পাহাড়ের প্রেক্ষাপটে অবস্থিত, চওড়া উপত্যকা, যেখানে হুমায়ুনের টকটকে লাল নিয়ন্ত্রক তাবু সূর্যকেন্দ্রে রেখে রশ্মির ন্যায় অস্থায়ী তাবুর সারি চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। নিয়ন্ত্রক তাবুর ডানপাশে তাঁর বয়োজ্যেষ্ঠ আধিকারিকদের তাবুগুলো অবস্থিত, সেখানে বৈরাম খানের তাবুর উপরে উজ্জ্বল লাল রঙের একটা নিশান বাতাসে সগৌরবে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। বামপাশে চামড়ার ফালি দিয়ে বাঁধা কাঠের তিরস্করণীর মাঝে রয়েছে হারাম তাবুগুলো যেখানে মেয়েরা তাদের নিভৃত বাসস্থানের বন্দোবস্ত করে নিয়েছে। হামিদা আর গুলবদন মালামাল বহনকারী শ্লথ বহরের চেয়ে হুমায়ুনের সাথেই ভ্রমণের বিষয়ে বেশী আগ্রহী ছিল এবং দুজনের একজনও দিনে চৌদ্দ ঘন্টার আবশ্যিক অগ্রগমন নিয়ে একবারের জন্যও অভিযোগ জানায়নি।

কিন্তু তাঁদের সবার আন্তরিক প্রয়াস সত্ত্বেও এখনও তারা কাবুল থেকে দেড়শ মাইল উত্তরপূর্বে অবস্থান করছে এবং তাঁদের অগ্রগমনের গতি বৃদ্ধির ব্যাপারে হুমায়ুনের আর খুব বেশী কিছু একটা করণীয় নেই। যাত্রাপথের পুরোটা সময় জুড়েই শীতের তীব্রতা বেড়েই চলেছে। এখন যদিও অক্টোবর মাসের গোড়ার দিক, ইতিমধ্যেই দমকা বাতাসের সাথে তুষারকণার দেখা পাওয়া যাচ্ছে। কিছুদিনের ভিতরেই পুরোদস্তুর শীত পড়বে।

একটা কেবল আশার কথা যে সে কাবুল অভিমুখে যাত্রা শুরু করার পর থেকে তাঁর সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা নতুন সৈন্যের আগমনে ফুলেফেঁপে উঠেছে। আহমেদ খান তাঁকে এইমাত্র জানিয়ে গেল যে কামরানের বাহিনী থেকে আরেকদল স্বপক্ষত্যাগী তাঁর অস্থায়ী শিবিরে উপস্থিত হয়ে তাঁর প্রতি নিজেদের আনুগত্যের কথা প্রকাশ করেছে। হুমায়ুন জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের দলনেতাকে তার সামনে হাজির করার আদেশ দিয়েছে।

আধঘন্টা পরের কথা, হুমায়ুনকে তাঁর পায়ের সামনে, কুর্নিশ আনুষ্ঠানিক অভিবাদনজ্ঞাপনের রীতি অনুযায়ী, দুহাত প্রসারিত অবস্থায় শুয়ে থাকা লোকটার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে থাকতে দেখা যায়। লোকটার পায়ের কালো নাগরার উপরে লাল তারকার নকশা দেখে, যা তার গোত্রের স্মারকচিহ্ন, হুমায়ুন আন্দাজ করে লোকটা কাফিরদের একজন গোত্রপতি, যাঁরা কাবুলের চারপাশে অবস্থিত কোটালে, সুউচ্চ, সংকীর্ণ গিরিপথগুলোতে বসবাস করে। কাফিররা স্বার্থের খাতিরে পক্ষত্যাগের জন্য কুখ্যাত। হুমায়ুন যখন ছোট ছিল তখন, তাঁর আব্বাজান কাফিরদের কোনো এক গ্রামের কিছু লোককে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়েছিল যারা তাঁর প্রতিনিধিকে খুন করেছিল, তিনি তাঁদের কাবুলের প্রতিরক্ষা দেয়ালের সামনে শূলবিদ্ধ করেছিলেন, যাতে করে তাদের রক্তে মাটি লাল হয়ে যায়।

উঠে দাঁড়াও। তুমি একজন কাফির, তাই না?

জ্বী, সুলতান। আবহাওয়ার কারণে পর্যুদস্ত, পা ভাঁজ করে উবু হয়ে বসে থাকা লোকটা দেখতে কৃশকায় এবং তাঁর পরণের ভেড়ার চামড়ার তৈরী আঁটসাট পোষাকটারও বেহাল অবস্থা।

তুমি আর তোমার লোকজন এখানে কেন এসেছো?

সুলতান, আমরা এসেছি আপনাকে সহায়তা করার প্রস্তাব নিয়ে।

কিন্তু তোমরা আমার সৎ-ভাই কামরানকে সহায়তা করতে, তাই না?

কাপিল লোকটা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।

তোমরা কেন তার পক্ষ ত্যাগ করেছো?

তিনি তার কথার বরখেলাপ করেছেন। তিনি আমাদের স্বর্ণমুদ্রার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কিন্তু তিনি কিছুই দেননি। আমার দুইজন লোক এবিষয়ে অভিযোগ জানালে কাবুলের দূর্গপ্রাসাদের দেয়ালের উপর থেকে তিনি তাদের নীচে ছুঁড়ে ফেলার আদেশ দেন।

এটা কবেকার ঘটনা?

তিন সপ্তাহ পূর্বের। এই ঘটনার কয়েকদিন পরে, আপনার ভাই ঘোড়ার বিচালির খোঁজে আমাদের যখন পাহাড়ে পাঠান, আমরা তখন আর কাবুলে ফিরে না গিয়ে আপনার খোঁজে রওয়ানা হই।

তোমরা কাবুল থেকে আসবার আগে সেখানের পরিস্থিতি কেমন ছিল?

আপনার ভাই দূর্গপ্রাসাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করছিলেন এবং অবরোধ মোকাবেলার জন্য রসদ মজুদে ব্যস্ত ছিলেন- সে কারণেই তিনি অনেকের মতো আমাদেরও ঘোড়ার বিচালির খোঁজে পাহাড়ে প্রেরণ করেছিলেন। সুলতান, তিনি আপনাকে ভয় পান। পুরো কাবুলের অধিবাসীদের ন্যায়, তিনি নিজেও জানেন যে বিশাল এক সৈন্যবাহিনী নিয়ে আপনি এগিয়ে আসছেন…যে আপনার অধীনে পারস্যের সৈন্যরাও রয়েছে এবং দুনিয়ার কাছে সে নয়, আপনিই হলেন পাদিশাহ…

হুমায়ুন লোকটার মুখের মোসাহেবি অভিব্যক্তি উপেক্ষা করে। আমার নবজাতক সন্তানের কথা কি তুমি কিছু জানো? কাবুলে কি তুমি তাঁকে কখনও দেখেছো?

লোকটার চোখে মুখে একটা অনিশ্চিত ভাব ফুটে উঠে। না, সুলতান। আমি জানতামই না যে তিনি সেখানে রয়েছেন…

তুমি নিশ্চিত- কান্দাহার থেকে রাজপরিবারের এক সন্তান আর তাঁর দুধ-মাকে নিয়ে আসবার ব্যাপারে তুমি কিছুই শোননি?

না, সুলতান, এমন কিছুই আমার কানে আসেনি।

হুমায়ুন কাফির গোত্রপতির দিকে আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। কারও প্রতি বা কোনো কিছুর প্রতি এই লোকটার বিন্দুমাত্র আনুগত্য নেই। কার কাছে ধনসম্পদপূর্ণ সিন্দুক রয়েছে কেবল সেটা তাঁর কাছে বিবেচ্য বিষয়। আর সে কামরানের বাহিনীতে কাজ করেছে। হুমায়ুনের সহজাত প্রবৃত্তি তাকে বলে যে এই মুহূর্তে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই লোকটাকে তার সঙ্গীসাথীসহ শিবির থেকে তাড়িয়ে দেয়া উচিত। কিন্তু তাহলে অন্য যেসব গোত্রের লোকেরা তাঁর সাথে যোগ দেবার কথা ভাবছে, তারা হয়ত এরফলে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে। একটা কঠিন আর দীর্ঘ লড়াইয়ের জন্য তাঁকে প্রস্তুতি নিতে হবে এবং এই সময় সম্ভাব্য প্রতিটা সৈন্যের সহায়তা লাভ করাটা তার জন্য জরুরী। তাঁর নিজের আব্বাজানও বর্বর পাহাড়ী গোত্রগুলোর ভয়ঙ্কর লড়াকু ক্ষমতা খুব ভালোমতো যুদ্ধে ব্যবহার করেছিলেন, যদিও তিনি তাদের সবসময়ে কঠোর হাতে শাসন করেছেন।

তুমি আর তোমার লোকেরা আমার বাহিনীতে যোগ দিতে পারো, কিন্তু তাঁর আগে একটা বিষয় ভালোমতো শুনে রাখে। কিন্তু কোনো ধরনের অবাধ্যতা আর বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তোমরা যদি আমার অধীনে একজন খাঁটি যোদ্ধার ন্যায় আচরণ কর তাহলে কাবুলের পতন হবার পরে সেজন্য তোমাদের যথোচিতভাবে পুরস্কৃত করা হবে। আমার এই শর্ত তোমরা মানতে রাজি আছো?

জ্বী, সুলতান।

হুমায়ুন তাঁর প্রহরীদের দিকে তাকায়। এই লোকটাকে জাহিদ বেগের কাছে নিয়ে যাঁর যাতে তিনি একে আর এর সঙ্গীসাথীদের কি দায়িত্ব দেয়া যায় সেবিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

অস্তগামী সূর্যের কিরণে পুরো উপত্যকায় একটা বেগুনী ছায়া ছড়িয়ে যেতে এবং সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতে, আরো একবার নির্জনতার জন্য হুমায়ুনের ভেতরে একটা আর্তি জেগে উঠে, নিজের উপরে চেপে বসা দায়িত্বের বোঝা থেকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও তার একটু মুক্তি প্রয়োজন। দেহরক্ষীদের বিদায় করে সে তার গায়ের আলখাল্লাটায় নিজেকে ভালোমতো ঢেকে নিয়ে, সারিবদ্ধ তাবুর ভিতর দিয়ে উত্তর দিকে হাঁটতে শুরু করে, সেখানে সেনাছাউনির সীমানা বরাবর সে কিছুক্ষণ একলা পায়চারি করতে চায়। কিন্তু সেনাছাউনির সীমানার কাছে পৌঁছাবার পরেও সে সেখানে না থেমে বেষ্টনী অতিক্রম করে হাঁটতেই থাকে অন্ধকারের মাঝে ক্রমশ মিশে যাওয়া দূরের পাহাড়ের আবছা অবয়বের দিকে সে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় এগিয়ে যেতে থাকে।

সে কিছুক্ষণের জন্য ছাগলের পাল ব্যবহার করে এমন খাড়া হয়ে উপরের দিকে উঠে যাওয়া একটা পথ ধরে হাঁটতে থাকে। সে নীচের দিকে তাকাতে কয়েকশ অগ্নিকুণ্ডের কমলা আলো দেখতে পায় তার লোকেরা তাদের রাতের খাবার রান্না করছে। কয়েক মিনিটের ভিতরে হামিদার এবং গুলবদনের সাথে হারামের তাবুতে রাতের খাবারের পালা শেষ করার জন্য তাকেও ফিরে যেতে হবে, কিন্তু পাহাড়ের পাদদেশের এই পরম স্তব্ধতার মাঝে এমন কিছু একটা রয়েছে যা তাঁকে অমোঘ আকর্ষণে টানছে। হুমায়ুন আকাশের দিকে তাকিয়ে তারকারাজি পর্যবেক্ষণ করে। দিগন্তের কাছে খুব নীচুতে ভেসে রয়েছে ক্যানোপস- তার আব্বাজান কাবুল যাবার পথে যে উজ্জ্বল আর মাঙ্গলিক তারাটা দেখেছিলেন এবং যে তারাটা তাকে ভরসা যুগিয়েছিল। এখন সে আশা করে তারাটা বুঝি তার জন্যও জ্বলজ্বল করছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *