২.৯ আকবর

১৪. আকবর

আমি তোমার নাম রাখলাম আকবর- যার মানে মহান এবং মহান তুমি হবেই। হুমায়ুন কথা বলার মাঝেই দুর্লভ ঘিয়ে রঙের জেড পাথরের একটা পেয়ালা তুলে নেয়- অমরকোটের রানার তরফ থেকে প্রেরিত উপহার এবং আকবরের মাথায় পাত্রে রক্ষিত অনুষঙ্গগুলো, শাহরুখি- ছোট ছোট সোনার মোহর- পরম মমতায় বর্ষিত করে, সদ্যোজাত সন্তানের ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধির স্মারক হিসাবে। কাশিমের কোলের উপরে একটা মখমলের তাকিয়ায় দিগম্বর অবস্থায় শায়িত আকবর এহেন উৎপাতে চমকে গিয়ে হাত পা আন্দোলিত করে কিন্তু কাঁদে না। হুমায়ুন তাকে পরম মমতায় তাকিয়া থেকে তুলে নিয়ে দুহাতে শূন্যে উঁচু করে ধরে যাতে করে সমবেত হওয়া তার সব সেনাপতি আকবরকে দেখতে পায় এবং বজ্রকণ্ঠে চিৎকার করে উঠে, মহান তৈমূরের অধস্তন সপ্তম পুরুষ, আমার সন্তানকে আমি আনুষ্ঠানিকভাবে তোমাদের সামনে উপস্থাপন করছি। আমার প্রতি তোমরা যেমন বিশ্বস্ত ছিলে তাঁর প্রতিও ঠিক তেমনই বিশ্বস্ত থাকবে। তৈমূরের রক্তের উত্তরাধিকারী নতুন যুবরাজের উদ্দেশ্যে হুমায়ুনের সেনাপতিরা সবাই নিজেদের ঢালের উপরে নিজ নিজ তরবারি ঠুকে উদাত্তস্বরে ঐতিহ্যবাহী সম্ভাষণ জ্ঞাপন করতে থাকে, মির্জা আকবর! মির্জা আকবর! হুমায়ুন হাত তুলে যতক্ষণ না তাদের শান্ত হতে ইঙ্গিত করে।

এই বিশেষ অনুষ্ঠানে এবার হামিদার অংশ গ্রহণের সময় হয়েছে। একটা নীচু ডিভানে ঠেস দিয়ে শায়িত অবস্থায় তাকে এখনও পরিশ্রান্ত দেখায়- ত্বক গজদন্তের ন্যায় ফ্যাকাশে এবং তাঁর কালো উজ্জ্বল চোখের নীচে গাঢ় কালি পড়েছে। হুমায়ুন যদিও তাকে সুস্থ হয়ে উঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পরামর্শ দিয়েছিল, হামিদাই বরং তাঁর প্রস্তাবে সম্মত হয়নি। আপনার জন্য আপনার লোকেরা অনেক দুঃখ কষ্ট সহ্য করেছে। যত শীঘ্রি সম্ভব আপনার উত্তরাধিকারীকে তাঁদের সম্মুখে উপস্থিত করা তাদের প্রতি আপনার কর্তব্য। এটা আপনাকে তাদের সাথে আরও নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ করবে। হুমায়ুন অস্বস্তিতে ছটফট করতে থাকা আকবরকে হামিদার কাছে নিয়ে যায় এবং তাঁর বাহুর নিরাপত্তায় তাঁকে সমর্পণ করে। নিজের সদ্যোজাত সন্তানকে স্তন্যপান করাবার ভান করে সে সেই শব্দগুলো উচ্চারণ যা তৈমূরের সময়ের পূর্বে থেকে মহাসাগরবৎ শাসক স্বয়ং চেঙ্গিস খানের সময়কাল থেকে মোগলদের সময়কাল পর্যন্ত প্রচলিত রয়েছে: পুত্র আমার পান করো। তোমার মধুর ওষ্ঠদ্বয় আমার মঙ্গলময়ী স্তনে আরোপ করো এবং জীবনদায়ী সুধায় তোমার মুখে মাধুর্য আনয়ন করো।

আকবর যখন আবিষ্কার করে যে আসলে এখনই তাকে স্তন্যদানের কোনো অভিপ্রায় তাঁর মমতাময়ী মায়ের নেই সে গলার স্বর সপ্তমে তুলে চিৎকার শুরু করে। হামিদা যখন তাঁকে শান্ত করতে চেষ্টা করছে, তখন হুমায়ুন আরো একবার নিজের লোকদের উদ্দেশ্যে গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলে। আমার জ্যোতিষী শারাফের সহায়তায় আমি আমার সন্তানের কোষ্ঠী বিচার করেছি। তার জন্ম তারিখের চেয়ে ১৫ অক্টোবর, ১৫৪২, চন্দ্রের প্রভাবযুক্ত সিংহ জাতক- মাঙ্গলিক আর কিছুই হতে পারে না। এই দিনে জন্মগ্রহণকারী সন্তান সৌভাগ্যবান আর দীর্ঘ জীবনের অধিকারী। আমরা অনেক বিপর্যয় আর কষ্ট সহ্য করেছি। ন্যায়সঙ্গত যা আমাদের সেটা আমরা পুনরুদ্ধার করতে পারার আগে সম্ভবত আরো অনেক অন্ধকারাচ্ছন্ন সময় আমাদের অতিক্রম করতে হতে পারে কিন্তু একটা মহিমান্বিত ভবিষ্যত আকবর আর আমাদের দিকে হাতছানি দিচ্ছে। আজ রাতে অর্জিত হয়নি এমন অনেক বিজয় আমরা উদযাপন করবো এবং তাঁর স্মরণে ভোজে অংশগ্রহণ করবো। তার লোকেরা আরও একবার নিজেদের আয়ুধ ঠুকে সম্মতি জানায়। তাঁদের এবারের পুনরাবৃত্ত শব্দগুচ্ছ ছিল মির্জা হুমায়ুন কিন্তু সে আর একটা কথাও না বলে ঘুরে দাঁড়ায়, আর কোনো বাক্য বলার জন্য তার হৃদয় বড্ড বেশী বেদনাবিধূর।

সেদিন পরবর্তী কোনো এক সময়ে, তারা যখন পুনরায় একাকী হয়, হুমায়ুন দেখে হামিদা তার আলখাল্লার গলা নিচে নামিয়ে এনে আকবরকে স্তন্য দান করে, খুদে শাহজাদা যখন প্রাণপনে নিজের উদরপূর্তি করছে তখন সে তার মাথার কোঁকড়া কালো চুলের দিকে পরম মমতায় তাকিয়ে থাকে। সে এখন এক পুত্র সন্তানের পিতা এই বোধটাই তার ভিতরে অবর্ণনীয় একটা গর্বের জন্ম দেয়। হামিদার পূর্বের দিনগুলোতে, সে যত দূর জানে তার কোনো উপপত্নী তার কোনো সন্তান গর্ভে ধারণ করেনি। এখন, চৌত্রিশ বছরের বৃদ্ধ জীবনে, সে উপলব্ধি করছে একটা পুত্র সন্তান তাঁর জীবনের গূঢ়তর উদ্দেশ্যের প্রতি তাঁর ব্যগ্রতাকে কিভাবে পরিতৃপ্ত করতে পারে।

হামিদা… নিজের অনুভূতি প্রকাশ করার জন্য উপযুক্ত শব্দের খোঁজে সে কথার মাঝে ছেদ টানে। জীবনে প্রথমবারের মতো আমার মনে হচ্ছে আমি একজন পিতার ভালোবাসার গভীরতা অনুধাবন করতে পারছি… পিতামাতার প্রতি সন্তানের ভালোবাসার চেয়েও কত ব্যাপক এর বিস্তৃতি। আমাকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করে আমার আব্বাজান যে বিশ্বাস আর ভালোবাসার দেখিয়েছিলেন, আমি সবসময়ে তাঁর প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু এখন যখন আমি নিজে একজন পিতা হিসাবে আমি তোমাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি আমার সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করে আমি একে বর্ধিত করবো- যাতে আমি আমার সন্তানের যোগ্য একটা উত্তরাধিকার রেখে যেতে পারি।

হামিদা মাথা নাড়ে কিন্তু কোনো কথা বলে না। কিন্তু এসব ছাড়াও আরো কিছু বিষয় রয়েছে যা নিয়ে হামিদার সাথে আলোচনা না করলেই নয়- বিষয়টা আকবরের ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। হামিদাকে তাঁর জানাতেই হবে যে অচিরেই আরেকজন মহিলা তার সন্তানকে স্তন্যদান করবেন। তাঁদের নিশ্চয়ই একজন দুধ-মা নিয়োগ করতে হবে। মোগল রাজদরবারে কোনো মহিলার জন্য এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ। এই মনোনীত মহিলা শাহজাদার দুধ-মা হবেন, তিনি তাঁর সাথে এমন একটা বন্ধনে আবদ্ধ হবেন যা সারা জীবন তার সাথেই টিকে থাকবে। তার নিজের সব সন্তানই স্বয়ংক্রিয়ভাবে শাহজাদার কুকালদাশে পরিণত হবে, তাঁর দুধ-ভাই, তাকে রক্ষা করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এবং এর বদলে তারা নানা সুবিধা। ভোগ করবে। তার স্বামীও বিপুল সম্মানের অধিকারী হবে। বয়োজ্যোষ্ঠ অমাত্য আর সেনাপতিরা নিজেদের জন্য কোনো রাজনৈতিক বা সামরিক পদ লাভে যতটা আগ্রহী ঠিক একই ভাবে তারা নিজেদের স্ত্রীর জন্য এই অবস্থানটা দারুণভাবে কামনা করেন। ব্যাপারটা যদি ঠিকমতো সমাধান করা না যায় তবে এই পরিস্থিতি থেকে হিংসা আর ঈর্ষার স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠতে পারে।

হামিদা, আমাদের অবশ্যই একটা বিষয়ে একমত হতে হবে। এই কঠিন পরিস্থিতিতে, আমার সেনাপতিদের পুরস্কৃত করার জন্য আমার সামনে খুব সামান্য সুযোগই আছে কিন্তু একটা জিনিষ আমি তাঁদের অনায়াসে দিতে পারি। তৈমূরীয় রীতি অনুসারে, আকবরের জন্য আমাদের অবশ্যই একজন দুধ-মা নির্বাচিত করতে হবে, তিনি এমন একজন মহিলা হবেন যিনি এই দায়িত্বের উপযুক্ত এবং যাকে আমরা বিশ্বাস করতে পারবো কিন্তু একই সাথে তাকে এমন একজন মহিলা হতে হবে যার স্বামী কৃপা লাভের উপযুক্ত এবং আমাদের পছন্দের কারণে নিজেকে যে সম্মানিত মনে করবে।

হামিদা মাথা তুলে এবং তাঁর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। রাজপরিবারের একজন সদস্য হিসাবে অবশ্যই সে বড় হয়নি। পুরাতন রাজকীয় রীতির সবকিছু তার পক্ষে জানা সম্ভব না। সম্ভ্রান্তমহিলারা যদিও প্রায়শই তাদের সন্তানদের স্তন্যদানের জন্য আয়া নিয়োগ করে থাকেন, তারা কেবলই পরিচারিকা যাদের অনায়াসে বরখাস্ত করা যায় এবং সন্তানদের জীবনে তাদের কোনো প্রভাবই পরিলক্ষিত হয় না। হামিদার কাছে হুমায়ুন একেবারেই ভিন্ন একটা কিছু অনুরোধ করেছে- আরেকজন মহিলার সাথে নিজের সন্তানকে ভাগ করে নেয়া।

হামিদা এক মুহূর্ত চুপ করে থাকে তারপরে সে কথা বলতে শুরু করে। আপনার এতোটা উদ্বিগ্ন হবার কোনো কারণ নেই। এই রীতির বিষয়ে আমি অনেক আগে থেকে অবহিত আছি- খানজাদা আমাকে বলেছিলেন। আমার মনে হয় তিনি আমাকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে চেয়েছিলেন, কেবল সন্তান জন্ম দেয়াই না বরং একজন ভবিষ্যত সম্রাটের মাতা হিসাবেও তিনি আমাকে প্রস্তুত করতে চেয়েছিলেন। প্রথমদিকে আমি ভীষণ মুষড়ে পড়েছিলাম। কিন্তু খানজাদা মারা যাবার পরে আমি তার কথাগুলো সম্বন্ধে কেবলই ভেবেছি- যে একজন উপযুক্ত দুধ-মা নির্বাচিত করে আমি আমার সন্তানকে তার হাতে তুলে দিচ্ছি না বরং তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাহায্য করছি। বিষয়টা যদিও আমায় এখনও বিষণ্ণ করে তুলে, তারপরেও আমি জানি তিনি ঠিক কথাই বলেছিলেন… আমাদের বোধহয় প্রয়োগপ্রবণ হওয়া উচিত। আমরা কাকে নির্বাচিত করবো? আমাদের সাথে এখন গুটিকয়েক রমণী রয়েছে আর তাঁদের ভিতরে আরও কম সংখ্যকের শিশুসন্তান রয়েছে।

জাহিদ বেগের স্ত্রীর অনেক বয়স তাঁর স্তন শুষ্ক হতে বাধ্য নতুবা আমি তার সাহসিকতা আর আনুগত্যের স্বীকৃতি হিসাবে তাকেই নির্বাচিত করতাম। কিন্তু আরো একজন সেনাপতি রয়েছে যাকে আমি পুরস্কৃত করতে চাই- নাদিম খাজা, কান্দাহারের নিকটবর্তী স্থান থেকে আগত এক গোত্রপতি যাঁর স্ত্রী তার সাথেই রয়েছে। মারওয়ার থেকে আমরা পালিয়ে আসবার কিছুদিন পরেই তার একটা পুত্র সন্তান হয়েছে।

অবশ্যই, আমি চিনি তাকে। মাহাম আগা নামে দীর্ঘদেহী, আর সুদর্শন এক রমণী। তার ছেলের নাম আদম খান।

মাহাম আগাকে তুমি মেনে নেবে? তোমার যদি অন্য কাউকে পছন্দ…

আমি সন্তুষ্ট। মাহাম স্বাস্থ্যবান এবং শক্তিশালী আর সেই সাথে সৎ এবং কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন। তার ছেলেটাও হয়েছে প্রাণবন্ত আর শক্তপোক্ত। আমি যদি কাউকে পছন্দ করি তবে তাকেই করবো। আকবরকে এক স্তন থেকে পরম মমতায় সরিয়ে এনে হামিদা তাকে আরেক স্তনের দিকে নিয়ে আসে। হুমায়ুন ভাবে সন্তান জন্মদানের সময়ে কষ্ট সহিষ্ণুতার পরীক্ষা বা সাম্প্রতিক সময়ের দুর্ভোগ সত্ত্বেও হামিদা এখনও দেখতে কত সুন্দর। এবং এখনও যদিও তাঁর বয়স অল্প, হুমায়ুনের নিজের চেয়ে প্রায় বিশ বছরের ছোট কিন্তু তারপরেও কত শক্ত। আকবরকে আরেকজন রমণীর বাহুতে কল্পনা করাটা তাঁর জন্য নিশ্চয়ই খুব কঠিন কিন্তু তারপরেও একজন যোদ্ধার মতো সাহসিকতার সাথে নিজের ভয় লুকিয়ে রাখার মতো ঠিক একইভাবে সে তার কষ্ট গোপন করেছে। ভালোবাসার দোহাই দিয়ে হুমায়ুন তাকে পছন্দ করেছিল কিন্তু এই মাটির দেয়াল দেয়া, প্রত্যন্ত মরুদ্যানে নিজের বাড়ি আর তার নিরাপত্তা থেকে অনেক দূরে এখানেও তার মাঝে একজন সম্রাজ্ঞীর সব লক্ষণই বিদ্যমান। নীচু ডিভানটার দিকে এগিয়ে গিয়ে, সে ঝুঁকে এবং হামিদার ওষ্ঠে চুমু দেয় আর তারপরে স্বীয় পুত্রের মাথায় দবদব করতে থাকা কোমল তুলতুলে শীর্ষদেশে চুম্বন করে।

রাণার সাথে আপনার আলোচনার ফলাফল কি হয়েছে? আপনার কি মনে হয় যে আমরা এখানে নিরাপদ? হামিদা জানতে চায়।

আমার তো তাই মনে হয়। রাণা যদিও নিজে একজন রাজপুত, মালদেব আর সে বোধহয় পরস্পরকে অপছন্দই করে। গতবছর, মালদেবের লোকেরা রাজস্থানী মরুভূমি অতিক্রম করার সময় অমরকোটের কাফেলায় হামলা করেছিল। কাফেলায় গমনকারী বণিকেরা যেহেতু আনুষ্ঠানিকভাবে রাণার তত্ত্বাবধানে ছিল সে আক্রমণটাকে তাঁর প্রতি চুড়ান্ত অপমান হিসাবে গন্য করেছে। মালদেব অবশ্য রাণার চেয়ে অনেক বেশী শক্তিধর বিধায় প্রতিশোধের চিন্তা বাতুলতা আর এ কারণেই মালদেবের সাথে কোনো ধরনের সম্পর্ক রাখারও তার ইচ্ছে নেই। সে মালদেবের জন্য আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত, যদিও আমাদের পক্ষে বেশীদিন এখানে অবস্থান করাটাও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। অমরকে দুর্গম এলাকায় অবস্থিত হলেও, একটা সময়ে আমাদের ধরার জন্য এখানে ঠিকই অনুসরণ করে এসে হাজির হবে। আমাদের পক্ষে যত দ্রুত সম্ভব- যত দ্রুত তুমি হারানো শক্তি ফিরে পাবে- আমরা এখান থেকে বিদায় নেব।

কিন্তু এখান থেকে আমরা কোথায় যাবো?

উত্তরপশ্চিমে কেবলমাত্র কাবুল অভিমুখে গমন করাটাই আমাদের জন্য অর্থবহ বলে প্রতীয়মান হবে। আমি যতক্ষণ না শহরটা পুনরায় দখল করে কামরান আর আসকারিকে তাদের শঠতার জন্য শাস্তি দিচ্ছি ততক্ষণ পর্যন্ত হিন্দুস্তানের বুক থেকে শের শাহকে উৎখাত করার কোনো সুযোগ আমি পাবো না… হুমায়ুন ইতস্তত করে। এটা হবে একটা বিপজ্জনক, কষ্টকর যাত্রা। আমি কি একটা নিরাপদ স্থান খুঁজে বের করে আমার সাথে তোমাদের মিলিত হওয়াটা যতক্ষণ নিরাপদ বলে প্রতিপন্ন না হয় সেখানে তোমাদের অবস্থানের বন্দোবস্ত করবো…?

না। আপনি ইতিমধ্যে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে আপনি যদি আমার সঙ্গে থাকেন তাহলে অনেক রুক্ষ পরিবেশেও আমি মানিয়ে নিতে পারি। আমি আপনাকে বলেছি যে খানজাদা আমাকে উপযুক্ত দীক্ষাই দিয়েছেন। পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে তিনি কখনও রাজি হতেন না এবং আমিও রাজি হতে পারছি না…

*

এক সপ্তাহ পরের কথা, আবারও একবার হুমায়ুন তার অবশিষ্ট লোকদের পুরোভাগে অবস্থান করে মরুভূমির বিরান প্রান্তরের দিকে এগিয়ে যায় তাদের পেছনে অমরকোটের ধূলিমলিন দেয়াল ভোরের লালচে ধূসর অনিশ্চয়তার মাঝে বিলীন হয়ে যায়। ভাক্কারের দূর্গ, তার আত্মীয় সম্পর্কিত ভাই, সিন্ধের শাসক, মির্জা হুসেনের স্বত্বাধীন একটা পর্যবেক্ষণ-ফড়ি, আপাতত তাঁদের গন্তব্যস্থল। এলাকাটা এখান থেকে প্রায় দুইশ মাইল দূরে সিন্ধের উত্তর সীমান্তে সিন্ধু নদীর তীরে অবস্থিত। তাঁরা দুজনে একটা আপাত লোক দেখান হার্দ্য সম্পর্কের ইঙ্গিত দিয়ে পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিল বলে হুমায়ুন আশা করছে, সেখানে সে সাময়িকভাবে আশ্রয় নিতে পারবে। আর ভাক্কার যদিও প্রত্যন্ত এলাকা, বাইরের দুনিয়ায় কি ঘটছে সে হয়তো অবশেষে সে সম্বন্ধে অবগত হতে পারবে।

অতিক্রান্ত পথের প্রতি মাইল তাঁদের আক্রান্ত হবার ঝুঁকির কবল থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকায়, হুমায়ুন ঘোড়ার গতি দ্রুততর করতে থাকে। প্রতিদিন ভোরে সূর্যের প্রথম কিরণ দিগন্তের কোণে ব্ৰীড়া নম্র ভঙ্গিতে উঁকি দিতেই সৈন্যসারি যাত্রা শুরু করে এবং মধ্যাহ্নে ক্লান্ত প্রাণীগুলোকে খানিকটা বিশ্রাম দিতে আর রুটি, শুকনো মাংস ও কয়েক টুকরো কিশমিশ দিয়ে আহারের সময়টুকু বাদে তাঁদের বহরটা বিরতিহীন ভাবে সামনে এগিয়ে চলে। দুই সপ্তাহেরও কম সময়ের ভিতরে, মরুভূমির উপর দিয়ে দীর্ঘ যাত্রা শেষে, চোখে পড়ার মতো প্রাণবন্ত সবুজের অবারিত সমারোহে মাতোয়ারা ফসলের মাঠ আর গ্রামের মাঝে তাঁরা প্রবেশ করে যে সেখান থেকে সিন্ধু নদীর অববাহিকা খুব একটা দূরে না। অচিরেই ভাক্কারের বেলেপাথরের তৈরী শক্তপোক্ত দেয়াল তারা দেখতে পায় আর পশ্চিমদিকে সিন্ধু নদীর অপর তীরে হুমায়ুন বেগুনী রঙের একটা আবছা অবয়ব দেখতে পায় বেলুচিস্তানের পার্বত্য অঞ্চল। কাবুলের পার্বত্য অঞ্চলের সাথে তাদের এতোটাই মিল যে সে টের পায় তার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠেছে।

জওহর, ভাঙ্কারের দিকে এগিয়ে যেতে বলো। হিন্দুস্তানের মোগল সম্রাট এবং সিন্ধের মির্জা হুসেনের রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয়, হুমায়ুনের নামে প্রবেশের অনুমতি চাইবে।

এক ঘন্টা পরে হুমায়ুন তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে দূর্গের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে সেখানে তাকে স্বাগত জানাবার জন্য দূর্গের সর্বাধিকারীকে অপেক্ষমান অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। স্বাগতম, সুলতান, আমার প্রভুর পক্ষ থেকে আমি আপনাকে স্বাগত জানাই। অধমের নাম সাঈয়েদ আলী। দূর্গের সর্বাধিকারী নিজের বুকে হাত রেখে কথাগুলো বলার সময় হুমায়ুন লক্ষ্য করে যে বাম কপালে একটা পুরাতন সাদা ক্ষতচিহ্ন আর ফিনফিন সাদা দাড়ির অধিকারী বেশ বয়স্ক একটা লোক তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

সেই দিন রাতের বেলা, ধিকিধিকি জ্বলতে থাকা আপেল কাঠের টুকরো ভর্তি একটা ধাতব পাত্র যার ওমে নদীর বুক থেকে বাতাসের সাথে ভেসে আসা শীতের প্রকোপ নাকচ হয়ে যায়, হুমায়ুন সাঈয়েদ আলীর সাথে জাহিদ বেগ আর কাশিমকে নিয়ে আলোচনায় বসে। আমার সৎ-ভাই কামরান আর আসকারির হাতে কাবুলের পতন হয়েছে একজন বার্তাবাহকের কাছে এই সংবাদ জানার পরে এই অঞ্চলে নতুন করে আর কি ঘটেছে সে সম্বন্ধে আমার কোনো ধারণাই নেই। আপনি কি আমাকে সাম্প্রতিক ঘটনাবলী সম্বন্ধে কিছু বলতে পারবেন?

সাঈয়েদ আলী কেমন বিভ্রান্ত একটা দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে। মাননীয় সুলতান, সত্যি বলতে কি, আপনার জানা উচিত এমন অনেক খবরই আছে, এমনকি সেটা জেনে আপনি হয়তো অসন্তুষ্টও হতে পারেন। কান্দাহার থেকে আগত পর্যটকেরা যারা ভাটি অঞ্চলের দিকে যাবার আগে এখানে যাত্রা বিরতি করেছিল, তাদের কাছে আমরা জানতে পেরেছি যে আপনার সৎ-ভাই হিন্দাল শহরটা দখল করে নিয়েছে।

হুমায়ুন এতো দ্রুত উঠে দাঁড়ায় যে সে কাঠের যে টুলটায় সে বসে ছিল সেটা উল্টে গিয়ে জ্বলন্ত কাঠের টুকরো ভর্তি ধাতব পাত্রের গায়ে গিয়ে ধাক্কা খায়। কিভাবে এটা সম্ভব হলো?

আমি যতদূর শুনেছি কোনো ধরনের সংঘর্ষ ছাড়াই সে শহরটা দখল করেছে। শহরের গভর্নর তাকে আপনার মিত্র বলে ভেবেছিল এবং তাকে আর তার সৈন্যবাহিনীকে সাদরে স্বাগত জানিয়েছিল।

হিন্দাল তাহলে এসব অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে। হুমায়ুন যেমন সন্দেহ করেছিল যে সে কাবুল গিয়ে কামরান আর আসকারির সাথে মৈত্রী সম্পর্ক স্থাপন না করে সে পশ্চিমে দিকে এগিয়ে গিয়ে কান্দাহারে নিজের স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করেছে। জ্বলন্ত কয়লার আগুনের দিকে তাকিয়ে হুমায়ুন শেষবার যখন হিন্দালকে দেখেছিল সেই কথা ভাবে, রক্তাক্ত আর চোখে-মুখে ঔদ্ধত্য কারণ হুমায়ুন হামিদাকে বিয়ে করতে চায় আর তাকে নিষেধ করা অসম্ভব।

হিন্দাল তাহলে কান্দাহার শাসন করছে… সে অবশেষে মন্তব্য করে।

না, সুলতান। কিন্তু আপনি বললেন…

সুলতান আরো কিছু ঘটনা ঘটেছে। হিন্দাল কান্দাহারে অবস্থান করছে জানতে পেরে আপনার সৎ-ভাই কামরান হিন্দালকে আদেশ করে নিজের অধিরাজ হিসাবে তাঁকে নিতে এবং তার অধীনস্ত একজন মামুলি শাসক হিসাবে কান্দাহারে অবস্থান করতে। হিন্দাল যখন অস্বীকৃতি জানালে কামরান আর আসকারি বিশাল একটা বাহিনী নিয়ে গিয়ে শহরটা দখল করে এবং হিন্দালকে বন্দি করে। তার ভাগ্যে কি ঘটেছে কেউ জানেনা…।

হুমায়ুনের হৃৎপিণ্ড দ্রুত লয়ে আন্দোলিত হতে থাকে। সে যা ধারণা করেছিল কামরান আর আসকারি তার চেয়েও নিকটে অবস্থান করছে… কাবুল থেকে অনেক নিকটে, কান্দাহারের দূরত্ব এখান থেকে তিনশ মাইলের বেশী হবে না। নিয়তিই হয়তো তাঁকে ভাক্কারে নিয়ে এসেছে। তার সাথে যদিও খুব অল্প সংখ্যক লোক রয়েছে প্রায় দুইশ হবে তাঁদের সংখ্যা- তারা সবাই মোগল বংশোদ্ভুত, তাঁর সবচেয়ে বিশ্বস্ত যোদ্ধা- তার ইচকির দল। আর তাদের সাথে আরও অনেকেই যোগ দিবে যদি তারা লুটের মালের বখরা পাওয়া যাবে বলে মনে করে। স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে নিজেদের তরবারির নৈপূণ্য বিক্রির জন্য বেলুচিস্তানের পাহাড়ী অধিবাসীদের বেশ সুনাম আছে। সে যদি দ্রুত সব ব্যবস্থা করতে পারে তাহলে তার সৎ-ভাইয়েরা সর্তক হবার আগেই সে কান্দাহার গিয়ে শহরটা দখল করে তাদের বন্দি করতে পারবে। অবশ্য এহেন সিদ্ধান্ত নেবার আগে আরো কিছু বিষয় আছে যা তাকে জানতে হবে।

সাঈয়েদ আলী, শের শাহের কি খবর? এই মুহূর্তে সে কোথায় অবস্থান করছে?

সে এই মুহূর্তে বাংলায় রয়েছে, সেখানে তার বিরুদ্ধে একটা বিদ্রোহ হয়েছে। কিন্তু আমি এর চেয়ে বেশী আর কিছু জানি না… কেবল এটাই শুনেছি যে সবাই বলাবলি করছে হিন্দুস্তানে তার শাসন লোহার মতো মজবুত আর শক্তিশালী।

চমৎকার, হুমায়ুন মনে মনে ভাবে। শের শাহ বহুদূরে আর ব্যস্ত থাকার মানে, তার পক্ষ থেকে কোনো ধরনের বিপদের আশঙ্কা সে করলেও পারবে।

সাঈয়েদ আলী আপনার আতিথিয়তার জন্য আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ কিন্তু আপনি আমাকে যা বলেছেন সে জন্য তারচেয়েও বেশী কৃতজ্ঞ। আমি আমার লোকদের নিয়ে যত দ্রুত সম্ভব সিন্ধু নদ অতিক্রম করতে চাই… নদীতে খুব তীব্র স্রোত আর সে কারণে বিপজ্জনক কিন্তু আপনি নিশ্চয়ই পার হবার জন্য আমাদের একটা নিরাপদ স্থান দেখাতে পারবেন…

*

বাতাসে শীতের প্রকোপ নতুন করে উদ্যমী হয়ে উঠায় হুমায়ুন ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে এবং তাঁর চারপাশে তুষারকণা এলোমেলো উড়তে থাকে। তার মাথা জমে শক্ত হয়ে গিয়েছে বলে মনে হয় এবং সে পরণের ভেড়ার চামড়ার তৈরী লম্বা আলখাল্লাটায় শক্ত করে নিজেকে মুড়িয়ে নেয়। হুমায়ুনের লোকদের পথ দেখাবার জন্য আহমেদ খানের ভাড়া করা দুই বালুচি উপজাতি তার সামনে রয়েছে, যারা একটু আগেই তাকে আশ্বস্ত করেছে যে যাত্রা পথের অর্ধেক দূরত্ব তারা প্রায় অতিক্রম করে এসেছে এবং বরফাবৃত বোলান গিরিপথ দিয়ে নীচের দিকে নামছে, কান্দাহার থেকে খুব বেশী হলে একশ ত্রিশ মাইল দূরে। পথ প্রদর্শক দুজন সম্ভবত প্রশংসা শুনবে বলে আশা করেছিল কিন্তু তুষারপাত এবং পায়ের নীচের বরফের স্তর পুরু হবার সাথে সাথে হুমায়ুনের মনে হয়েছে অগ্রসর হবার গতি যন্ত্রণাদায়কভাবে শ্লথ হয়ে পড়েছে। কিন্তু নিদেনপক্ষে তার অভীষ্ট লক্ষ্য- বিশ বছর পূর্বে মোগলদের জন্য স্বয়ং বাবরের দখল করা সেই বিশেষ শহর- কিছুক্ষণের ভিতরেই দৃষ্টিপটে ভেসে উঠবে।

হামিদা আর গুলবদন, তাঁদের পরণের পুরু উলের গাউনের উপরে ফারের আবরণ দেয়া বিপুলাকৃতি মস্তকাবরনীযুক্ত আলখাল্লা পরিহিত, টাটু ঘোড়ায় উপবিষ্ট অবস্থায় তার ঠিক পেছনেই রয়েছে। সংকীর্ণ, পিচ্ছিল পথে ষাড়ের দল চলাচলে একেবারেই অনুপযোগী হওয়ায় অনেকদিন আগেই তাদের জবাই করা হয়েছে এবং তাঁদের টানা মালবাহী শকটগুলোকে টুকরো করে জ্বালানী কাঠ হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। মাহাম আগা- আকবর আর তাঁর নিজের পুত্র সন্তানকে নিয়ে, দুজনই শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচার জন্য.গরম কাপড়ের ফালি দিয়ে বেশ পুরু করে জড়ান- উটের পিঠের দুপাশে ঝুলন্ত ঝুরির একটায় রয়েছে ভারসাম্য রক্ষার জন্য অন্য ঝুরিটায় জয়নাব রান্না করার সামান্য কিছু সরঞ্জাম নিয়ে ঝুলে আছে। বরফাবৃত পথ এতোটাই বিপদসঙ্কুল যে তিনটা প্রাণীকে নিরাপদে পথ দেখিয়ে আনতে হুমায়ুন তার লোকদের পায়ে হাঁটতে আদেশ দিয়েছে। কিন্তু এই তাপমাত্রায় উটকেও কেমন যেন কাবু মনে হয়, মাথা নীচু করে পা টেনে টেনে হাঁটছে, তাঁর দেহের পুরু পশমের উপরে সূচাগ্র বরফের স্ফটিক জমতে শুরু করেছে।

তাদের পেছনেই দেহরক্ষীর দল রয়েছে তারপরেই গুটিকয়েক ভারবাহী প্রাণীর একটা দল- পিঠে চাপান বোঝার ভাবে হাঁসফাঁস করতে থাকা কয়েকটা উট এবং খচ্চর- এবং একেবারে শেষে তার বাকী লোকেরা, প্রত্যেকের ঘোড়ার পিঠের দুপাশে পেটমোটা ব্যাগ ঝুলছে, ঢাল পিঠের সাথে শক্ত করে আটকানো আর রণকুঠার এবং গাদাবন্দুকগুলো পর্যাণের সাথে শক্ত করে বাঁধা। তার মতো, তাঁদের মুখের নিম্নাংশ মুখ ঢাকার কাপড় দিয়ে ঢাকা এবং হাড় কাঁপান তুষারের চাবুক মুখে হন্যে হয়ে উঠা বাতাসের প্রকোপ থেকে বাঁচতে তাঁদের ঘাড়ের উপরে মাথাগুলো নীচু করে রাখা। আজ রাতে, তাঁর মতো তারাও, একটা বুড়ো খচ্চরের মাংস দিয়ে আহার করবে বেচারা তাঁর পিঠের বোঝর নীচে লুটিয়ে পড়েছিল, যা খামির-বিহীন রুটি, বার্লি বা চালের তৈরী জাউয়ের একঘেয়ে খাবারের তালিকায় তাদের জন্য কিছুটা হলেও বৈচিত্র্য নিয়ে আসবে।

হুমায়ুন ভেবে দেখে- একজন সম্রাটের সেনাবাহিনীর চেয়ে তার আব্বাজানের আক্রমণকারী দলের সাথেই তাঁদের মিল বেশী- বর্ণিল পোষাক পরিহিত একটা বিচিত্র কাফেলা। এই বরফাচ্ছন্ন বিরান প্রান্তরের ভিতর দিয়ে নিজের খুদে বাহিনীটাকে পা টেনে টেনে হাঁটতে দেখার দৃশ্যটা চাবুকের তীব্র কশাঘাতের মতো তাঁর কতটা অধঃপতন হয়েছে তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেয়। একই রকম যন্ত্রণাদগ্ধ ব্যাপার যে সে এখন সিন্ধুনদ অতিক্রম করেছে, বেলুচিস্ত স্থানের পাহাড়ে আরোহনের জন্য তারমানে এই মুহূর্তে হিন্দুস্তানে বাবরের চারপুত্রের একজনও নেই। ব্যাপারটা এমন যেন বাবরের অভিযান কখনও ঘটেনি এবং সম্ভবত সে, যদিও আগে কখনও সে বিষয়টা স্বীকার করেনি। বাবরের প্রিয়তম এবং প্রশ্রয়প্রাপ্ত সন্তান নিশ্চয়ই এজন্য কিছুটা হলেও দোষী। নিজের পরিবারের ভিতরে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে সৃষ্ট বিপদের মাত্রা কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে সেটা সে আগে বুঝতে পারেনি। বিশেষ করে কামরানের বৈরীতার গভীরতাকে সে ছোট করে দেখেছিল। অনেক দেরী হয়ে যাবার পরে সে বুঝতে পেরেছে যে কামরান নিজের উচ্চাকাঙ্খ ত্যাগ করে তাঁকে মোগল সিংহাসনে উপবিষ্ট দেখার চেয়ে মোগলদের পতন দেখতেই পছন্দ করবে।

হুমায়ুনের ঘোড়াটা বরফে পিছলে গিয়ে হোঁচট খেতে কল্পলোক থেকে এক ঝটকায় তাকে বাস্তবে নিয়ে আসে। সে পর্যাণের উপরে নিজের পুরো ওজন পিছনের দিকে দিয়ে চেষ্টা জন্তুটাকে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে সাহায্য করতে এবং ফিসফিস করে অভয়বাণী বলতে থাকলে, নাক দিয়ে সজোরে নিঃশ্বাসের সাথে কুয়াশার কুণ্ডলী নির্গত করে, বেচারা কোনোমতে চারপায়ের উপরে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। সে মনে মনে ভাবে এইসব পাহাড়ের আড়াল থেকে বের হতে পারলে তার চেয়ে খুশী আর কেউ হবে না, এবং কনকনে বাতাসের ঢেউ তাঁর দিকে ধেয়ে আসলে কাঁধের উপরে মাথাটা আরো ঝুঁকিয়ে আনে। তাঁর ভাবনায় কিছুক্ষণের ভিতরেই তাঁর সৎ-ভাইয়েরা এসে উঁকি দেয় তুষারের মাঝে অবিশ্রান্ত পথ চলার এই দিনগুলোতে যা তারা প্রায়ই করে থাকে, এইবার এসেছে হিন্দাল। সে এখন যখন বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করার অবকাশ পায়, অনুধাবন করে দারুণ কৌশলে কান্দাহার দখল করায় সে তাঁর সবচেয়ে ছোট এই সৎ-ভাইটির প্রতি ক্রুদ্ধ হবার চেয়ে বরং কামরান আর আসকারির হাতে তার নিরাপত্তা নিয়েই বেশী উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। সে যদিও উৎকণ্ঠিত গুলবদনকে আশ্বস্ত করেছে যে তাঁরা তাঁর ভাইয়ের কোনো ক্ষতি করবে না, সে নিজে ততটা নিশ্চিত নয়। একজন প্রতিদ্বন্দ্বিকে ক্ষমতার পথ থেকে সরিয়ে দেবার এমন সুযোগ কামরান অন্তত খুশী মনে গ্রহণ করবে।

দূর থেকে একটা ভৌতিক, বিষণ্ণ গর্জন, যা একে বয়ে আনা বাতাসের মতোই হাড় কাঁপানো, আতঙ্কে হুমায়ুনের ঘোড়াটাকে অস্থির করে তুলে। এইসব বিরান, জনমানবহীন পাহাড়গুলোয় নেকড়ের পাল গিজগিজ করছে। রাতের বেলা তারা কখনও কখনও তাদের শিবিরের এতটাই কাছে চলে আসে যে অন্ধকারে হুমায়ুন তাদের হলুদ সরু চোখ জ্বলজ্বল করতে এবং সকালবেলা তাদের তাবুর চারপাশে পায়ের ছাপের একটা আল্পনা আঁকা থাকতে দেখেছে। তুষারপাত এখন আরও প্রবল হয়েছে এবং সামনের খাড়া পথটা উড়ন্ত তুষারকণায় অবগুণ্ঠিত হয়ে আছে।

আহমেদ খান, হুমায়ুন তার কাঁধের উপর দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে ডাকে।

জ্বি, সুলতান?

এখনই তুষারঝড় শুরু হবে। আজ রাতের মতো আমরা এখানেই শিবির। স্থাপন করবো। পাহাড়ের গায়ের ঐ পাথুরে অভিক্ষেপটার নীচে আমরা খানিকটা হলেও আড়াল পাবো। হুমায়ুন বায়ু প্রবাহের বিপরীত দিকে মুখ করে থাকা ধুসর রঙের পাথরের একটা অতিকায় খণ্ডের দিকে ইঙ্গিত করে যা বাতাসের আর তুষারের যুগলবন্দি অনেকটাই সেটা ঠেকিয়ে রাখতে পারবে, এবং তাদের তাবুর জন্য অভিক্ষেপের নীচে যথেষ্ট জায়গা রয়েছে বলে মনে হয়।

হুমায়ুনের লোকেরা ঘোড়ার পেছনের পায়ে ফাঁস বেধে দেয় এবং তাবুর সাজসরঞ্জাম বের করে, অভিক্ষেপের নীচে তাবু টাঙানো শুরু করে। এখনও যদিও দিনের আলো রয়েছে, ধুসর আন্তরিকতায় তুষারপাত শুরু হওয়ায় প্রতি মুহূর্তে আলোর রেশ কমে আসছে। দুজন লোক বাতাসের দিকে পিঠ দিয়ে কুঁজো হয়ে বসে এবং তাঁদের সাথের চকমকি পাথর আর ইস্পাতের বাক্স থেকে শীতে অসাড় হয়ে থাকা আঙ্গুলের সাহায্যে একটা খচ্চরের পিঠে বয়ে আনা শুকনো লতাগুল্মের খানিকটা নিয়ে আগুনের স্ফুলিঙ্গ জ্বালাতে চেষ্টা করে। লতাগুল্মে ভালোমতো আগুন জ্বলে উঠার সাথে সাথে, তাঁরা তেলে ভেজান কাপড় দিয়ে বিশাল একটা মশাল জ্বেলে নিয়ে সেটাকে একটা লম্বা লাঠির অগ্রভাগে ভালোমতো জড়ায় এবং হুমায়ুনের তাবুর বাইরে লাঠিটা এনে পুতে দেয়।

তাঁরা কাছেই একটা ধাতব পাত্র রেখে সেটাতে ভাক্কার থেকে নিয়ে আসা এই মুহূর্তে সোনার চেয়েও দামী কাঠকয়লা দিয়ে ভর্তি করে এবং আগুন ধরিয়ে দেয়- হুমায়ুন বা হামিদার জন্য না বরং আকবরের জন্য সেই রাতে তাবুতে সেও তাঁদের সাথে থাকবে। হামিদা চারপাশের বুনো প্রান্তরের কারণে অনুরোধ করেছে যে তাঁর সন্তান রাতে যেন তাঁর কাছেই ঘুমায়। মাহাম আগা যাত্রাকালীন পূর্ববর্তী রাতগুলোর মতোই তাঁর ছেলের সাথে ঘোড়ার পিঠে বিছাবার কম্বল দিয়ে তাবুর একাংশ পরিবেষ্টিত করে সেখানেই ঘুমাবে। হুমায়ুন তাঁর শিবিরের বাকি অংশ পরিদর্শনের সময় লক্ষ্য করে যে তার লোকেরা স্বাভাবিকের চেয়ে কম তাবু স্থাপন করেছে। তাঁরা গাদাগাদি করে ঘুমাবে, নিজেদের শরীর উষ্ণ রাখতে অন্যের দেহের উষ্ণতা ব্যবহার করবে।

সুলতান, একটা ভারী কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। আহমেদ খান এসেছে, মাথার মস্তকাবরনী বরফে সাদা হয়ে রয়েছে। জাহিদ বেগ আর আমি শিবিরের চারপাশে প্রহরী মোতায়েন করছি। আপনার দেহরক্ষীদের ভিতর থেকে চারজন আপনার তাবুর বাইরে পাহারায় থাকবে।

হুমায়ুন নিজের চারপাশে ভালো করে তাকিয়ে দেখে। ক্রমশ জোরাল হতে থাকা বাতাসের প্রকোপে ঘুরপাক খেতে থাকা তুষার এখন এতোই ঘন যে সে তাঁর সেনাপতির মুখই ঠিকমতো দেখতে পায় না। গত রাতে পাহারায় নিয়োজিত লোকদের একজন হিম-দংশের শিকার হয়েছে এবং হেকিম আশঙ্কা করছেন লোকটার কালো হয়ে থাকা পায়ের আঙ্গুলগুলো শেষ পর্যন্ত হয়তো কেটে ফেলতে হবে। আহমেদ খান নিজেও গতকাল মাঝরাতে প্রহরীদের পরিদর্শন করতে গিয়ে সর্দি-কাঁপুনির সংক্রমনের ফলে আজ সারাদিন কাশির দমকে অস্থির ছিলেন। আপনাকে ধন্যবাদ, আহমেদ খান কিন্তু আমার মনে হয়

এই বুনো প্রান্তরে আমাদের চিন্তিত হবার কোনো কারণ রয়েছে। পথের ধকলে সবাই ক্লান্ত আর শীতও বেশ জাকিয়ে পড়েছে। আজ রাতে সবাইকে বিশ্রাম নিতে দেন। আপনিও বাদ যাবেন না। আপনার কাশি হয়তো তাহলে খানিকটা প্রশমিত হতে পারে।

শিবিরের চারপাশে দমকা বাতাসের গর্জন আর তার তাবুর গায়ে এসে হামলে পড়া সত্ত্বেও, সেই রাতে হামিদাকে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে শোয়ার সাথে সাথে হুমায়ুন ঘুমিয়ে যায়, তাদের দুজনকে ভেড়ার যে চামড়াটা ঢেকে রেখেছে সেটার উপরে হামিদার ফারের আবরন দেয়া আলখাল্লাটা বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। আকবরের চকিত কান্নার শব্দ তাঁর স্বপ্নে আলোড়ন তুলেই আবার হারিয়ে যায়। হুমায়ুন হামিদার কাছে সরে আসে, নিজের দেহের কাছে তার উষ্ণ পেলব দেহটা টেনে এনে সে নিদ্রার অতলে আবার তলিয়ে যায়। তারপরে সহসাই সে নিজের গলায় শীতল, ধারাল ইস্পাতের স্পর্শ অনুভব করে। সে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখে পরিচিত একজোড়া চোখ, কাপড়ের টুকরো দিয়ে তৈরী মশালের আলোয় জ্বলজ্বল করছে, আরেকজন লোক মশালটা ধরে রয়েছে। এটা হতে পারে না- বরফাবৃত গিরিপথের শেষে অনেক দূরে অবস্থিত কান্দাহারে তাঁর থাকার কথা। কিন্তু বাজপাখির মতো সরু নাকের উপরে অবস্থিত- তাঁদের আব্বাজানের চোখের মতোই সবুজ- বিজয়োন্মত্ত ঐ চোখ কোনভাবেই আর কারো হতে পারে না। কামরান!

হুমায়ুন সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে মুখটা মাত্র খুলতে যাবে কিন্তু কামরানের খঞ্জরের অগ্রভাগ তাঁর গলায় খোঁচা দিচ্ছে টের পায় এবং এক ফোঁটা রক্ত ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ছে। বিছানার পাশেই ছায়ার ভিতরে সে আরো কয়েকটি অবয়বকে আবছাভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, সম্ভবত কামরানের হুকুমবরদার, উদ্যত অস্ত্র হাতে নিরবে তাকিয়ে রয়েছে।

একটা শব্দ করো আমি তাহলে খুশী মনে তোমার গলাটা দুভাগ করে দেবো, কামরান বলে। তুমি জানো কাজটা করতে আমার হাত একটুও কাঁপবে না।

কামরান ফিসফিস করে কথা বলার সময়, তার আওয়াজে হামিদা জেগে উঠে, সে ঘুমঘুম চোখে মুখের উপর থেকে নিজের কালো চুল সরিয়ে দেয়। সে পুরোপুরি চোখ খুলতে, হুমায়ুন তাকে আশ্বস্ত করতে তাঁর বাহুর উপরে আলতো করে একটা হাত রাখে। চারপাশে কি ঘটছে বুঝতে পেরে হামিদা চিৎকার করে না বা কাঁদে না কিন্তু তার পাশেই একটা দোলনায় শুয়ে থাকা আকবরের দিকে তাকায়।

ভাইজান, তুমি অসতর্ক ছিলে। এতো সহজে আমি তোমার তাবুতে প্রবেশ করতে পারবো কখনও চিন্তা করিনি, কামরান বলে। গত কয়েকদিন ধরেই আমার লোকেরা তোমার গতিবিধির উপরে নজর রাখছিলো। তুষারঝড় আমাকে সুযোগটা করে দিয়েছে। কাবুলের চারপাশে অবস্থিত পার্বত্য এলাকায় আমাদের আব্বাজান কি শিখিয়েছিলেন, তুমি নিশ্চয়ই সেটা ভুলে গিয়েছো- তুষার কিভাবে হানাদারের বন্ধু, কিভাবে সে শব্দের কণ্ঠরোধ করে। তোমার লোকেরা কোনো শব্দই টের পায়নি। আমরা তাদের তাবুর ভিতরে অবোধ পশুর মতো গাদাগাদি করে শুয়ে থাকা অবস্থায় খুঁজে পেয়েছি।

তাদের আর মেয়েদের সাথে তুমি কি করেছো?

কামরান কোনো উত্তর দেয় না, কেবল হাসে।

আমি এই পথ দিয়ে আসছি, তুমি কিভাবে জানতে পারলে?

আমি ধারণা করেছিলাম যে একটা সময়ে তুমি উত্তরে আসতে চেষ্টা করবে। আমি গত কয়েকমাস হিন্দুস্তান থেকে বের হবার সবগুলো পথের দিকে নজর রেখে আসছি।

আসকারি কোথায়?

সে কাবুলে রয়েছে।

আর হিন্দাল, তাঁর সাথে তুমি কি করেছো?

আমি তাঁকে হত্যা করিনি, যদি এটাই তুমি বোঝাতে চাও। আমাকে অসম্মান করার জন্য জালালাবাদে তাঁকে বন্দি করে রাখা হয়েছে।

আমার সাথে তুমি যেভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। নিজের রক্তের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য শেরশাহের সাথে মৈত্রীর প্রস্তাব দিয়ে তারপরে অসম্মান নিয়ে কথা বলতে তোমার রুচিতে বাধে না? কাবুলে চোরের মতো নিঃশব্দে এসে হাজির হয়েছে?

কাউকে সমালোচনা করার মতো অবস্থানে তুমি নেই। তোমার পাশে যে সুন্দরী শুয়ে রয়েছে- আমি যতদূর শুনেছি তাকে তুমি হিন্দালের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে। কামরান বিপজ্জনক ভঙ্গিতে হামিদার দিকে ঝুঁকে আসে। কিন্তু তাঁকে দেখে এখন আমি বুঝতে পারছি ছিনিয়ে নেয়ার মতোই একটা মেয়ে বটে। আমিও চাই না ভ্রাতৃপ্রতিম প্রেম, কিংবা আনুগত্য আমার পথরোধ করে দাঁড়াক।

হুমায়ুন টের পায় উত্তেজনায় হামিদার স্নায়ু টানটান হয়ে আছে এবং সে আরো জোরে তাঁর বাহু চেপে ধরে। কামরান, তুমি কি চাও? তুমি যদি আমাকে হত্যা করতে চাইতে এতক্ষণে তাহলে আমার কবন্ধ দেহটা মাটিতে পড়ে থাকতো।

সত্যি বলেছো। রক্তের বন্ধন আর ভ্রাতৃপ্রতিম ভালোবাসা নিয়ে আমার ভিতরে তোমার মতো কোনো আবেগ কাজ করে না। আমার কাছে, বিষয়টা সবসময়েই ছিল তকতা তখত- সিংহাসন কিংবা শবাধার।

তাই যদি হয় তাহলে তুমি কালক্ষেপন করছো কেন?

আমার তরবারির ফলায় তোমার শ্বাসনালী কেবল একটা কারণেই আমি দ্বিখণ্ডিত করিনি- যদিও আমার হাত নিশপিশ করছিল- সেটা হল তোমায় হত্যা করলে আমাদের বংশে একটা রক্তাক্ত সংঘাত শুরু হবে। কিন্তু তোমাকে পরাজিত করতে এবং তোমার সাথে ক্ষমাসুলভ আচরণ করতে যদি আমায় দেখে, তোমার প্রতি অনুগত গোত্ৰপতিরা তাহলে আমাকে তাদের সমর্থন জানাবে। মৃত্যুর চেয়ে বরং নিগৃহীত অবস্থায় বেঁচে থেকেই তুমি আমার অনেকবেশী উপকার করবে।

তাহলে তোমার অভিপ্রায় এখন কি?

তোমাকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে আমাদের পিতৃপুরুষের জন্মভূমি এবং হিন্দুস্তান তুমি ত্যাগ করবে এবং এতোটাই দূরে যাবে যে আমি যেন ভুলে যেতে পারি যে তোমার কখনও অস্তিত্ব ছিল।

কোথায় যাবো?

পারস্যের আবহাওয়া শুনেছি চমৎকার এবং সেখানকার বিলাসবহুল জীবনযাপন পদ্ধতি তোমার পছন্দই হবে- সুন্দরী রমণী আর আফিমের অফুরান জোগান।

এবং আমি যদি যেতে অস্বীকার করি?

আমি তাহলে এখানে এখনই তোমায় হত্যা করবো এবং একাই গোত্রপতিদের ঝামেলার মুখোমুখি হব। আমার হাতে তোমার উষ্ণ রক্তের অনুভূতি আমি উপভোগই করবো।

আমি একটা বিষয় এখনও বুঝতে পারিনা তুমি আমায় কেন এতো ঘৃণা করো। আমাদের আব্বাজান আমাকে উত্তরসূরী নির্বাচিত করেছেন এটা আমার দোষ না।

সেটা তোমার দোষ না? তোমার কারণেই তিনি কদাচিৎ আমাকে নিয়ে চিন্তা করেছেন। একজন পূর্ণাঙ্গ যোদ্ধার ভূমিকায়, তিনি যা অর্জন করার আশা করেছিলেন তাঁর উজ্জ্বল স্মারক হিসাবে, তুমি দারুণ অভিনয় করেছে। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন থেকেই আমি নিজের সম্বন্ধে তোমার দর্পোদ্ধত আত্মগর্ব ঘৃণা করেছি এবং তুমি ধরেই নিয়েছিল আমি মুগ্ধ চিত্তে তোমায় খুশী মনে অনুসরণ করছি। আমরা যখন প্রাপ্তবয়স্ক হলাম, তুমি ধরে নিলে তখনও তুমি আমায় তোমার অধস্তনের মতো পৃষ্ঠপোষকতা করবে…কিন্তু আমারও যে তোমার মতোই প্রবল উচ্চাশা… রক্ত আর ঘাম ঝরিয়ে আমাদের আব্বাজানের প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্য আমার চাই এবং বাবরের যে কোনো সন্তানের চেয়ে আমি অনেকবেশী যোগ্য। আসকারি ইতিমধ্যে সেটা মেনেও নিয়েছে এবং আমি যা বলবো সেটাই করবে। হিন্দালের ঘটে যদি বুদ্ধি থাকে তাহলে সেও দ্রুত আদেশ পালনে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। আমি যখন প্রস্তুত হব তখন আমি শের শাহের মুখোমুখি হবে আর তাকে আমাদের সাম্রাজ্য থেকে বিতাড়িত করবো। আগ্রা আর দিল্লীতে আমার নামে খুতবা পাঠ করা হবে এবং আমি আর আমার সন্তানেরা- তোমার সন্তানেরা নয়- মোগল সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হবে। তুমি তোমার সুযোগ পেয়েছিলে এবং ব্যর্থ হয়েছে।

তোমার স্বভাব সম্বন্ধে আমাদের আব্বাজান ভালোই অবহিত ছিলেন যে তুমি একাধারে আত্মকেন্দ্রিক, শঠ, এবং সেইসাথে আমার শত্রু… যে তুমি একটা বিশ্বাসঘাতক… তিনি আমাকে সতর্ক করতে চেষ্টা করেছিলেন।

খামোশ শয়তান, কামরানের কণ্ঠস্বর সপ্তমে চড়ে যায় এবং আকবর কাঁদতে শুরু করে।

তোমার ছেলের গলা দেখছি জোরাল এবং প্রাণবন্ত, হামিদার পাশে রাখা দোলনার দিকে তাকিয়ে কামরানের চোখের সবুজ মণি জুলজুল করে উঠে। আমার ভান্তেকে আমায় দেখতে দাও, হামিদার দিকে তাকিয়ে সে আদেশের সুরে বলে।

হুমায়ুনের দিকে বেচারী উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকালে, সে মাথা নাড়ে। হামিদা পরণের আলখাল্লাটা ভালোমতো জড়িয়ে নিয়ে, বিছানা থেকে নামে এবং দোলনা থেকে আকবরকে কোলে তুলে নিয়ে ধীর পায়ে তাঁকে কামরানের কাছে নিয়ে যায়।

আমার ভাইয়ের দিকে লক্ষ্য রাখো। সে যদি চোখের পলকও ফেলে তাঁকে খুন করবে, কামরান তার লোকদের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলতে, আঁধারের ভিতর থেকে তিনজন বের হয়ে এসে হুমায়ুনের দিকে এগিয়ে যায়। কামরান ইতিমধ্যে হুমায়ুনের গলা থেকে খঞ্জরের ফলা সরিয়ে নিয়ে, সেটাকে খাপের ভিতর ঢুকিয়ে রাখে এবং হামিদার দিকে এগিয়ে যায়।

হুমায়ুন তার ভাই এবং তার লোকজনের সাথে নিজের দূরত্ব বিবেচনা করে আর ভাবে, আকবর আর হামিদা যদি এই মুহূর্তে তার সাথে কেবল না থাকতো সে তাহলে অনায়াসে কামরানকে ধরাশায়ী করতে পারতো। হুমায়ুন খুব ভালো করেই জানে কামরানের লোকেরা তীর কিংবা খঞ্জর নিক্ষেপ করার আগেই সে লাফিয়ে উঠে তাকে জাপটে ধরে বর্ম হিসাবে ব্যবহার করতে পারবে। কিন্তু সে যেভাবে শুয়ে ছিল সেভাবেই থাকে কিছুই করতে পারে না কেবল তাকিয়ে দেখে, আকবরকে ভেড়ার পুরু যে চামড়াটা দিয়ে জড়িয়ে রাখা হয়েছিল কামরান সেটা সরিয়ে ভিতরে উঁকি দেয় এবং তার্তস্বরে কাঁদতে থাকা খুদে মুখটার দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকায়।

বেটাকে আমার কোলে দাও।

হামিদা আবারও হুমায়ুনের দিকে তাকায় এবং আবার সে মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।

আকবরকে কামরান কোলে নিতে, সে বোধহয় পরিবর্তনটা পছন্দই করে এবং সহসা কান্না থামিয়ে শান্ত হয়ে যায়। কামরান খুব দ্রুত আকবরকে খুঁটিয়ে দেখে। বেশ, হুমায়ুন, আমার প্রস্তাব মেনে নিতে কি তুমি রাজি? কামরান কথা বলার মাঝেই আকবরের ছোট ছোট হাতগুলোর একটা আলতো করে ধরে, কিন্তু বিছানার অপরপাশে শুয়ে থাকা হুমায়ুনের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা চোখের তারায় কোনো ভাব খেলা করে না যেন সে মাংসের একটা দলা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে।

আমি তোমার প্রস্তাব মেনে নিচ্ছি, কারণ মেনে নেয়া ছাড়া আমার সামনে আর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু একটা কথা শুনে রাখো। একদিন আমি তোমাকে তোমার আজকের এই কৃতকর্মের জন্য চরম শাস্তি দেবো।

তোমার উত্তরাধিকারী আমার হাতে খেলা করছে, মনে রেখো। আমাকে যদি আরো প্ররোচিত করো, আমি তাহলে আমার লোকদের আদেশ দেবো একে বাইরে নিয়ে গিয়ে খালি গায়ে বরফের উপরে যেন শুইয়ে দেয়। নেকড়ে বা শীতের কবল থেকে তোমার কি মনে হয় কতক্ষণ সে বেঁচে থাকতে পারবে?

হামিদা আতঁকে উঠে জোরে শ্বাস নেয় এবং হুমায়ুন অসহায়ভাবে তাকিয়ে দেখে হাস্যরত আকবরের থুতনির নীচে কামরান খেলাছলে নেড়ে দেয়।

শেষ কোনো কথা, আমার সুবক্তা সৎ-ভাই, এমনকি কোনো বিদায় সম্ভাষণ উচ্চারিত হবে না। তোমার মতো একজন মহান সম্রাটের পক্ষে এটা মানানসই না, এতটা সৌজন্যহীনতা। দুই ভাই পরস্পরের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিন্তু হুমায়ুন দাঁতে দাঁত চেপে রেখে নিজেকে নির্বাক রাখে। কামরান উদ্ধত ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকিয়ে তাবুর প্রবেশ পথের দিকে এগিয়ে যায়, আকবর তখনও তার কোলেই রয়েছে।

আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দাও! হামিদা এবার চিৎকার করে উঠে।

কামরান তার দিকে ঘুরে তাকায়। হুমায়ুনকে আমি এক কানা কড়ি দিয়েও বিশ্বাস করি না, যতই সে বুক ফুলিয়ে বড়াই করুক না কেন যে সে কথা দিয়ে কথা রাখে। সে যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সেইমতো সে কাজ করবে এবং পারস্যে যাবে, সেজন্য জামিন হিসাবে আমার একটা কিছু প্রয়োজন। আমার প্রিয় ভাস্তে হবে সেই জামিন…।

কামরান তার কথা শেষ করার আগেই হামিদা বাঘিনীর দ্রুততায় তাঁকে লক্ষ্য করে ঝাঁপিয়ে পড়ে আকবরকে টেনে সরিয়ে আনতে চেষ্টা করে। আকরব পুনরায় তার্তস্বরে কাঁদতে শুরু করলে, কামরান জোরে একটা ধাক্কা দেয় হামিদাকে। হামিদা ছিটকে পেছনের দিকে উল্টে পরার সময় একটা কাঠের সিন্দুকের কোণের সাথে তাঁর মাথা ধাক্কা খায়। কারমরা তাঁর এক লোকের হাতে আকবরকে তুলে দেয়। আমার ভান্তেকে বাইরে নিয়ে যাও, সে তাকে আদেশ দেয়।

কিন্তু হামিদার তখনও কামরানের সাথে বোঝাঁপড়া শেষ হয়নি। মাথায় বেমক্কা আঘাত পাওয়ায় খানিকটা বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে সে হাচড়পাঁচড় করে উঠে দাঁড়ায় এবং নিজেকে পুনরায় কামরানের উপরে আছড়ে ফেলে, তার হাতের নখ বেচারার মুখে আচড় কেটে বসে যায় এবং রক্ত বের হয়ে আসে। কামরান হামিদার দুকাঁধ শক্ত করে ধরে এবং এক ধাক্কায় তাঁকে নিজের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। কি লজ্জার কথা। তোমার এই লড়াকু মনোভাবের জন্য তোমার স্বামীর মতো অপদার্থ সম্রাটের চেয়ে তুমি অনেক দক্ষ একজন সম্রাজ্ঞী হতে পারতে।

এইসব হট্টগোলের মাঝে তাবুর পর্দা-বেষ্টিত অংশের পেছনে একটা আলোড়নের সৃষ্টি হয় এবং দীর্ঘকায়া মাহাম আগা পর্দার পেছন থেকে বের হয়ে আসে। ঘটনার আকষ্মিকতা আর বিভ্রান্তির কারণে মাহামের কথা হুমায়ুনের মনেই ছিল না। কামরানও একই রকম চমকে গিয়ে, হামিদাকে ছেড়ে দেয় এবং কোমর থেকে ছোরা বের করে। তুমি আবার কে? কামরানের গালে হামিদা যেখানে আচড় দিয়েছে সেখান থেকে গলগল করে রক্ত ঝরছে।

মাহাম আগা কামরানকে পাত্তাই দেয় না, সে সরাসরি হামিদার দিকে তাকিয়ে কথা বলে। রাজমাতা, আমি সবকিছু শুনেছি। আকবরের দুধ-মা হবার কারণে আমাকে অবশ্যই তার সাথে থাকতে হবে। আমি আল্লাহর নামে শপথ করে আপনাকে বলছি যে নিজের জীবন দিয়ে হলেও আমি তাকে রক্ষা করবো। তাঁর চোখের নিম্নাংশের চওড়া হাড়যুক্ত, সুদর্শন মুখাবয়বে একটা একগুয়ে অভিব্যক্তি ফুটে উঠে।

হামিদার চোখের অশ্রু টলটল করে কিন্তু কামরানের দিকে ঘুরে দাঁড়াবার অবসরে সে নিজেকে সংযত করে। আমার ছেলের দুধ-মা, ওর নাম মাহাম আগা। আমি তোমাকে অনুরোধ করছি আমার সন্তানের যত্ন নেবার জন্য তুমি তাঁকে সাথে করে নিয়ে যাবে।

সে চাইলে আসতে পারে। কামরান আবার হুমায়ুনের দিকে তাকায়। তোমার যোদ্ধাদের চেয়ে দেখছি তোমার রমণীরা অনেক বেশী সাহসী। ঘুমন্ত অবস্থায় তোমার লোকদের আমরা বন্দি করেছি। বাজারে বিক্রি করার জন্য মুরগী যেভাবে বেঁধে রাখা হয় তাবুর ভিতরে তাঁদের সেভাবেই বেধে রাখা হয়েছে। আজ রাতে রক্তপাত যা হয়েছে, সেটা তোমার স্ত্রীর কারণেই হয়েছে। মাহাম আগা কিছু নেবার থাকলে দ্রুত গুছিয়ে নাও। আমরা পাঁচ মিনিটের ভিতরে রওয়ানা হব। আর একটা কথা না বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে সে তাবু থেকে বের হয়ে যায়।

দুই রমণী শেষবারের মতো আলিঙ্গণ করার সময়ে, হুমায়ুন দেখে মাহাম আগা হামিদার কানে কিছু একটা বলছে। তারপরে, কামরানে যোদ্ধাদের কড়া দৃষ্টির সামনে দুধ-মা দ্রুত তার সন্তানকে কোলে তুলে নেয় এবং আকবর আর তার নিজের যৎসামান্য জিনিষপত্র আরেক হাতে নিয়ে প্রহরাধীন অবস্থায় তাবু। থেকে বের হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরেই হুমায়ুন আর হামিদা বাইরে থেকে তুষারের উপরে ঘোড়ার খুরের চাপা আওয়াজ ভেসে আসতে শুনে এবং তারপরে সব আবার আগের মতো স্তব্ধ হয়ে যায়। হুমায়ুন এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে দৌড়ে বাইরে যায়। তুষার ঝড় শেষ হয়েছে এবং বাইরের রুক্ষ ভূ-প্রকৃতি অনেকটাই মোলায়েম হয়ে উঠেছে বরফাবৃত হয়ে। এতোটাই স্থির আর অকপট যে প্রায় নিখুঁত সৌন্দর্যমণ্ডিত একটা দৃশ্যপট।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *