২.৭ মরু-পথের দুঃখ-দুর্দৈব

১২. মরু-পথের দুঃখ-দুর্দৈব

সুলতান, আমার গুপ্তদূতেরা এখান থেকে কয়েক মাইল দক্ষিণে মাটির দেয়াল দিয়ে ঘেরা একটা ছোট্ট শহরে নিঃসঙ্গ এক পথিককে আটক করেছে। তার পোষাক দেখে আর বাচনভঙ্গি শুনে পরিষ্কার বোঝা যায় যে সে এখানে একজন আগন্তুক, শহরের দোকানীদের এবং আশেপাশে কে শুনছে সে বিষয়ে তোয়াক্কা না করে সে বারবার জিজ্ঞেস করেছে যে, আপনি আর আপনার সৈন্যবাহিনী কি এই পথ দিয়ে অগ্রসর হয়েছে। লোকটা গুপ্তচর হতে পারে ভেবে আমি তাকে সোজা আমার কাছে নিয়ে আসতে বলি, আহমেদ খান বলে।

লোকটা যদি সত্যিই গুপ্তচর হয়, তবে বলতেই হবে সে খুব একটা কৌশলী না। নিজের কর্তব্যকর্ম গোপন রাখার বিষয়ে আপাত দৃষ্টিতে সে খুব একটা প্রয়াস নেয়নি।

আহমেদ খানের মাঝে হুমায়ুনের হাসি সঞ্চরিত হয় না। সুলতান, লোকটা দাবী করছে যে সে সরাসরি কাবুল থেকে এসেছে এবং বলেছে যে আপনার সাথে তার দেখা করাটা জরুরী। লোকটার উদ্দেশ্য যদি যথার্থ হয়, তাহলে তার মুখ দেখে আমার মনে হয়নি খুব একটা ভালো কোনো সংবাদ সে নিয়ে এসেছে।

এক্ষুনি তাকে আমার সামনে নিয়ে এসো।

জ্বী, সুলতান।

শঙ্কার ছায়ারা গুঁড়ি মেরে হুমায়ুনের মনের প্রান্তরে বিচরণ শুরু করে। কয়েক মিনিট পরে, পরিপাটিভাবে বিন্যস্ত তাবুর সারির মাঝে সে আহমেদ খানকে ফিরে আসতে দেখে এবং তাঁর পেছনে, তারই দুজন গুপ্তদূত লম্বা এক যুবককে পাহারা দিয়ে নিয়ে আসছে। দলটা নিকটবর্তী হলে, হুমায়ুন খেয়াল করে দেখে যে সদ্য আগত লোকটার কাপড়চোপড়ে ভ্রমণের ছাপ স্পষ্ট ফুটে রয়েছে। লোকটা দেখতে কৃশকায় এবং তাঁর চোখের নীচের বেগুনী ছায়া তার ভ্রমণের শ্রান্তি প্রশমিত করেছে।

সুলতান। কুনীশের প্রথাগত অভিবাদনের রীতিতে সে মাটিতে অধোমুখে নিজেকে প্রণত করে।

উঠে দাঁড়াও। কে তুমি এবং আমাকে তুমি কি বলতে চাও?

নবাগত লোকটা ধীরে ধীরে নিজের পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। আমার নাম দারইয়া, কাবুলে আপনার সেনাছাউনির এক সেনাপতি নাসিরের পুত্র।

নাসিরকে হুমায়ুনের ভালোই মনে আছে- পোড় খাওয়া, ঝানু এক তাজিক গোত্রপতি, বহু বছর বিশ্বস্ততার সাথে যে তার অধীনে চাকরি করেছে। যৌনতার প্রতি তাঁর উদগ্র বাসনার কারণে লোকটা সেনাছাউনিতে বেশ পরিচিত ছিল আর সেই সাথে তার চার স্ত্রীর গর্ভে তারই ঔরসে জন্ম নেয়া সন্তানের সংখ্যার কারণে আঠারজন ছেলে আর ষোলজন মেয়ে এবং সেই সাথে তার অগণিত উপপত্নীর গর্ভে জন্ম নেয়া সন্তানতো রয়েইছে। হুমায়ুন বহুবছর নাসিরকে দেখেনি এবং তাঁর সন্তানদের ভিতরে সে কেবল তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা জনকেই দেখেছে।

তুমি নিজেকে যাঁর সন্তান বলে দাবী করেছে আমি হয়তো তাকে চিনি কিন্তু তার আগে আমাকে বলল তোমার বাবা মোট কতজন সন্তানসন্ততির জনক?

দারইয়ার ঠোঁটের কোণে বিষন্নামিশ্ৰিত মৃদু হাসির আভাস ফুটে উঠে। কেউ নিশ্চিত করে সেটা বলতে পারবে না কিন্তু তাঁর প্রথম চার স্ত্রীর গর্ভে আমরা মোট চৌত্রিশ ভাইবোন এবং তাঁদের একজন গতবছর ইন্তেকাল করলে- আমি কৃতজ্ঞ তিনি আমার জন্মদাত্রী নন- সে পঞ্চমবারের মতো বিয়ের করতে এই স্ত্রীর গর্ভে তার পঁয়ত্রিশতম সন্তানের জন্ম হয়। অবশ্য আমার পরিচয়ের স্মারক হিসাবে আমার পোষাকের নীচে একটা থলেতে আমার বাবার গলায় শোভা পাওয়া নেকড়ের দাঁতের একটা মালা রয়েছে। সে তাঁর ধূলিধূসরিত আলখাল্লার নীচে হাত দিয়ে থলেটা বের করতে যায়।

সেটার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি বিশ্বাস করেছি তুমি নাসিরের ছেলে। কাবুলের কি খবরাখবর? এবার বল…।

খবর খুবই খারাপ, সুলতান, আমি যে খবর নিয়ে এসেছি তারচেয়ে বোধহয় খারাপ আর কিছুই হতে পারে না। আপনার নানাজান কাবুলের পৌঁছাবার কয়েকদিনের ভেতরেই তিনি হৃদরোগের আক্রমণের শিকার হন। তিনি প্রায় বাকরহিত হয়ে পড়েন এবং তার সারা শরীর প্রায় অসার হয়ে যায়। তিনি ধীরে ধীরে পুনরায় হাঁটাচলার মতো সুস্থ হয়ে উঠছিলেন কিন্তু…

কি হয়েছে? দারইয়াকে কথা শেষ করতে না দিয়েই হুমায়ুন জিজ্ঞেস করে কিন্তু সে ততক্ষণে উত্তরটা মনে মনে জেনে ফেলেছে।

সুলতান, প্রায় চারমাস আগে, ঘুমের ভিতরেই তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর পরিচারকেরা সকালবেলায় বিষয়টা টের পায়, তার চোখেমুখে প্রশান্তির একটা অভিব্যক্তি ফুটে রয়েছে।

হুমায়ুন কোনো কথা না বলে নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে, বাইসানগার আর নেই এই বিষয়টার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করে।

সুলতান, আমার আরো কিছু বলার আছে…আপনার সৎ-ভাই কামরান আর আসকারি, খাইবার গিরিপথের পাদদেশে যারা আধিপত্য বিস্তার করে অবস্থান করছিল, যখন বাইসানগারের অসুস্থতার কথা জানতে পারে তারা তখন এই বিষয়টা থেকে লাভবান হবার চেষ্টা করে। তারা নিজেদের বাহিনী নিয়ে গিরিপথ অতিক্রম করে কাবুলে এসে উপস্থিত হয়। তারা যখন কাবুলে পৌঁছে ততদিনে আপনার নানাজান ইন্তেকাল করেছেন। কোনো ধরনের আগাম হুশিয়ারি না দিয়েই তারা কাবুলের প্রাসাদদূর্গ আক্রমণ করে এবং সহজেই আমার আব্বাজান আর অন্যানদের প্রতিরোধ প্রচেষ্টা গুঁড়িয়ে দেয়।

হুমায়ুনের নিমেষের জন্য বাইসানগারের মৃত্যুশোক বিস্মৃত হয়। কামরান আর আসকারি কাবুল দখল করেছে?

জ্বী, সুলতান।

অসম্ভব! আমার সৎ-ভাইয়েরা এতো দ্রুত এমন একটা আক্রমণ উপযোগী সেনাবাহিনী কিভাবে একত্রিত করবে?

সুলতান, গিরিপথে আগত বণিকদের কাফেলা লুট করে সংগৃহীত সোনা তাঁদের কাছে রয়েছে। আমরা শুনেছি পারস্যের ধনবান বণিকদের একটা কাফেলা তারা আটক করেছিল এবং তাঁদের কাছ থেকে জব্দ করা স্বর্ণমুদ্রা তারা উৎকোচ হিসাবে ব্যবহার করে পাহাড়ী গোত্রগুলোকে হাত করেছে। ফাশাইস, বারাকিশ, হাজারা আর অন্যান্য বর্বর গোত্রগুলো তাদের পক্ষে লড়াই করার জন্য তাই বিপুল সংখ্যায় সমবেত হয়েছিল। কিন্তু কাবুলে বস্তুতপক্ষে কোনো লড়াই হয়নি। আপনার সৎ-ভাইয়েরা আমাদের দূর্গপ্রাসাদের এক সেনাপতিকে স্বর্ণমুদ্রার প্রলোভন দেখিয়ে হাত করে যে তাঁদের দূর্গের প্রধান ফটক খুলে দেয়।

পুরো সেনাশিবিরে যদিও সূর্যের আলো ঝলমল করছে কিন্তু হুমায়ুনের মনে হয় সহসা পৃথিবীতে যেন অন্ধকার নেমে এসেছে এবং কেমন শীত শীত একটা অনুভূতিতে সে আক্রান্ত হয়।

আমার আব্বাজান… দারইয়ার কণ্ঠস্বর এই প্রথমবারের মতো একটু কেঁপে উঠে, আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে এবং শত্রুসেনা দূর্গের প্রধান তোরণদ্বার দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করেছে- দূর্গের প্রতিরক্ষায় দূর্গের অভ্যন্তরে অবস্থানরত সৈন্যদের সর্তক করতে তিনি যখন প্রধান তোরণদ্বার থেকে দৌড়ে ভেতরের দিকে আসছিলেন তখন একটা ফাশাইস রণকুঠার তার পিঠের ঠিক মধ্যভাগে আঘাত করে। তিনি কোনোমতে একটা দেওড়ির অভ্যন্তরে লুকিয়ে যান যেখানে আমি তাকে খুঁজে পাই। আমাকে অবশ্যই কাবুল থেকে পালাতে হবে…নিজের পরিচয়ের স্মারক হিসাবে তাঁর গলার মালাটা যেন অবশ্যই আমি সাথে রাখি আর আপনার সন্ধান করি এবং আপনাকে জানাই যে এখানে কি ঘটেছে…এবং তিনি আন্তরিকভাবে দুঃখিত যে তিনি আপনার বিশ্বাসের মর্যাদা রাখতে পারেননি… মারা যাবার আগে আমাকে বলা আব্বাজানের এই ছিল শেষ কথা। আপনার সন্ধানে আমি প্রথমে সরকারে যাই কিন্তু আপনি ততদিনে সেখান থেকে চলে গিয়েছেন। তারপর থেকে আমি ক্রমাগত আপনাকে খুঁজছি। আমি ভেবেছিলাম আমি বোধহয় অনেক দেরী করে ফেলেছি, আপনি হয়তো ইতিমধ্যে লোকমুখে কাবুল বিপর্যয়ের কথা জানতে পেরেছেন…

না। আমি এসবের কিছুই জানতাম না। হুমায়ুন নিজেকে সুস্থির করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে। তোমার আব্বাজান মোটেই আমার বিশ্বাসের অমর্যাদা করেননি- আমার জন্য তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন এবং আমি এটা কখনও ভুলবো না। তুমি অনেকদূরের পথ অতিক্রম করে আসছে, তোমার এখন বিশ্রামের প্রয়োজন এবং এ বিষয়ে আমরা পরে বিস্তারিত আলোচনা করবো। সেখানে ঠিক কি ঘটেছিল সে সম্বন্ধে আমাকে যতটা সম্ভব অবশ্যই জানতে হবে।

আহমেদ খানের লোকেরা দারইয়াকে হুমায়ুনের সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে, সে একটু একা থাকতে চায় ইঙ্গিতে জওহরকে সেটা বুঝিয়ে দিয়ে সে তাবুর ভেতরে প্রবেশ করে। ঠাণ্ডা পানি দিয়ে চোখে মুখে ঝাপটা দেয়ার সময় সে নিজের মুখে তাঁদের শীতল পরশ খুব একটা টের পায় না। পরস্পরবিরোধী আবেগ- যার কোনটা ব্যক্তিগত, কোনটা রাজনৈতিক, কিন্তু এসবের একটাও সুখকর না- তার মনের ভিতরে হুড়োহুড়ি করছে। তার নানাজানকে সে আর কখনও দেখতে পাবে না এটা জানার পরে শুরুতে এই শোকই ছিল সবচেয়ে প্রবল। তাঁর আব্বাজানের মুখে বাইসানগারের যৌবনের প্রাঞ্জল গল্পগুলো স্মরণ করতে গিয়ে হুমায়ুন চোখ বন্ধ করে ফেলে, অশ্বারোহী বাহিনীর একজন তরুণ যোদ্ধা হিসাবে কিভাবে তিনি তৈমূরের আঙ্গুরীয় বাবরের কাছে নিয়ে এসেছিলেন, আংটিটা তখনও পূর্ববর্তী ধারকের রক্তে সিক্ত; বাবরের প্রতি নিজের বিশ্বস্ততার কারণে বাইসানগার কিভাবে নিজের ডানহাতকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছিলেন এবং তাঁর জন্য সমরকন্দের তোরণদ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। হুমায়ুনের আম্মিজান মাহামও নিজের আব্বাজানের অনেক গল্প জানতো- সেগুলো অবশ্য কম সংঘাতময় কিন্তু অনেকবেশী আবেগময়। বাইসানগার এখন মৃত এবং হুমায়ুনের বিয়ের কথা না জেনেই তিনি মারা গেছেন। কামরান আর আসকারি কাবুল আক্রমণের পূর্বেই তিনি মারা গেছেন এই একটা যা বাঁচোয়া।

ভাবনাটা মনের ভিতরে উঁকি দিতেই, শোকের চেয়ে রূঢ় একটা আবেগ তাঁকে আচ্ছন্ন করে- সৎ-ভাইদের প্রতি নির্মম ক্রোধ। ঠিক এই মুহূর্তে যদি তার সামনে হাজির করা হত তাহলে তাদের বিশ্বাসঘাতক মাথাগুলোকে দেহের বরাভয় থেকে বিচ্ছিন্ন করে লাথি মেরে ধূলোতে সেগুলো গড়িয়ে দেয়া থেকে সহমর্মিতা প্রদর্শনের জন্য বাবরের শত অনুরোধও তাঁকে বিরত রাখতে পারতো না। সহজাত প্রবৃত্তির বশে হুমায়ুন তার কোমরের পরিকর থেকে খঞ্জরটা টেনে বের করে আনে এবং তাবুর অন্যপ্রান্তে লাল গোলাকার একটা তাকিয়া লক্ষ্য করে- সেটা ছুঁড়ে দিতে খঞ্জরটা গিয়ে তাকিয়ার ঠিক মধ্যস্থলে বাঁট পর্যন্ত গেঁথে যায়, সে মনে মনে ভাবে তাকিয়াটা যদি কামরানের কণ্ঠনালী হত।

কামরান নিজের জন্য সিংহাসনের একটা সম্ভাবনা আঁচ করতে পেরে এবং তাঁর আগ্রহী সহযোগী হিসাবে আসকারীকে সাথে নিয়ে সে সুযোগটা গ্রহণ করেছে। তারা যতদিন কাবুল দখল করে রাখবে, ততদিন হুমায়ুনের পক্ষে হিন্দুস্তানে নিজের কর্তৃত্ব। পুনরায় ফিরে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। একটা বিষয় বহুদিন আগেই প্রমাণিত হয়েছে। যে পারিবারিক একতা, মোগল রাজবংশের জন্য গর্ব এসব বিষয়ের চেয়ে তাঁদের কাছে নিজেদের ধনবান, লাভবান করার সুযোগ, এবং যেনতেন প্রকারে তার ক্ষতিসাধন করাটাই যেন আপাত দৃষ্টিতে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। তাদের এই প্রতিহিংসাপরায়ন ঈর্ষা কতটা ভয়ঙ্কর, তাঁদের সবাইকে এটা কি বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে এই বিষয়টা তারা কেন কখনও বুঝতে চেষ্টা করেনা?

নিজের মনের ভাবনাগুলোকে গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে করতে হুমায়ুন পায়চারি করতে থাকে। তাকে অবশ্যই চিন্তাভাবনা করে যুক্তিযুক্ত আচরণ করতে হবে কারণ তার সাথে এখন তার স্ত্রী আর তাঁদের অনাগত সন্তানের ভবিষ্যতও জড়িয়ে রয়েছে। হামিদার কথা মনে হতে ক্ষণিকের জন্য তার মেজাজ প্রসন্ন হয়ে উঠে। চারপাশের বিপদসঙ্কুল পারিপার্শ্বিকতা সত্ত্বেও, গত কয়েক সপ্তাহ ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় সময়, বিশেষ করে একমাস আগে, চোখের তারায় দারুণ প্রভা নিয়ে হামিদা যখন তাঁকে জানায় যে তাঁর স্বপ্ন সফল হয়েছে। সে আদতেই গর্ভবতী হয়েছে। সে অচিরেই একজন উত্তরাধিকারী লাভ করতে চলেছে সম্ভবত এই কথাটা জানা থাকার কারণেই হুমায়ুনের পক্ষে কামরান আর আসকারির সাম্প্রতিক এই বিশ্বাসঘাতকতা মেনে নিতে আরও বেশী কষ্ট হচ্ছে। তাকে আঘাত করার চেষ্টা করে তাঁরা তাঁর স্ত্রী আর ভাবী সন্তানকে- যারা এই পৃথিবীতে হুমায়ুনের কাছে সবচেয়ে প্রিয়- তাদেরও আঘাত করতে চেষ্টা করেছে।

আর সে যদি সত্যিই পুত্রসন্তান গর্ভে ধারণ করে থাকে, যা হামিদা নিজেও বিশ্বাস করে, তবে কাবুল হাতছাড়া হওয়াটা তার সন্তানের ভবিষ্যতকে আরো বেশী বিপদসঙ্কুল করে তুলবে। ছেলেটা যদি হুমায়ুনের শঙ্কা অনুযায়ী দ্রুত এগিয়ে আসা বিপদসঙ্কুল সময়টা কাটিয়ে উঠতে পারে তাহলেও একটা বিশাল সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হবার বদলে সে হয়ত- যখন অন্য রাজবংশ হিন্দুস্তান শাসন করছে, তার কোনো কোনো পূর্বপুরুষের মতো যুদ্ধবাজ মামুলি গোত্রপতির জীবন লাভ করবে এবং মাটির দেয়াল দেয়া কয়েকটা গ্রাম আর ভেড়ার পালের মালিকানা নিয়ে নিজের আত্মীয়দের সাথে লড়াই করবে- নগণ্য এমন কিছু একটার উত্তরাধিকারী হবে।

এটাকে কোনোমতেই ঘটতে দেয়া যাবে না, একে কোনোধরনের প্রশয় দেয়ার প্রশ্নই উঠে না। সে এটা ঘটতে দিতে পারে না। হুমায়ুন হাটু ভেঙে বসে পড়ে এবং উঁচু স্বরে একটা প্রতিশ্রুতি উচ্চারণ করে।

যত পরিশ্রমই সহ্য করতে হোক, যতদীর্ঘই হোক আমাদের সগ্রাম, আমি অবশ্যই আবারও হিন্দুস্তানের সম্রাট হব। আর এটা করার জন্য আমি আমার দেহের শেষ রক্ত বিন্দুটুকুও আমি বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। আমার আব্বাজানের কল্পনার চেয়েও বিশাল একটা সাম্রাজ্য উত্তরাধিকার সূত্রে আমার সন্তান এবং তাঁদের সন্তানদের জন্য রেখে যাব। আমি, হুমায়ুন এটা শপথ করে বলছি।

*

হুমায়ুন আর তার সৈন্যবাহিনী মারওয়ারের নিকটবর্তী হতে মরুভূমির উষ্ণতা প্রায় অসহনীয় মাত্রায় পৌঁছে। প্রতিটা দিন যেন আগের দিনের চেয়ে উষ্ণতর এবং প্রাণান্তকর বলে মনে হয়। চওড়া, চ্যাপ্টা পায়ের অধিকারী খিটখিটে মেজাজের উটের পাল পরিস্থিতি কোনোমতে সামাল দেয় কিন্তু ঘোড়া আর মালবাহী খচ্চরগুলো কোমর পর্যন্ত বহমান গনগনে বালিতে ডুবে যায়। প্রতি দিনই, নিস্তেজ ভঙ্গিতে পা নেড়ে আর ফাটা ঠোঁটের মাঝ দিয়ে বের হয়ে থাকা খটখটে শুকনো জীহ্বা নিয়ে, ক্লান্তি আর পানি শূন্যতায় আক্রান্ত পশুগুলো মুখ থুবড়ে পড়ছে। হুমায়ুন তার লোকদের আদেশ দিয়েছে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে যাওয়া হাঁটতে অক্ষম পশুগুলোকে জবাই করে সেগুলোর মাংস রান্না দিয়েছে, কিন্তু সেই সাথে সে জম্ভগুলোর রক্ত সংগ্রহ করারও নির্দেশ দিয়েছে। তৈমূরের আমলে, আদিগন্ত বিস্তৃত তৃণভূমিতে নিজেদের ভারবাহী জম্ভর রক্ত পান করে যোদ্ধারা অনেক বিপর্যয় সামাল দিয়েছে।

হুমায়ুন, কাঁধের উপর দিয়ে পেছনে তাকিয়ে, হামিদাকে বহনকারী চারদিকে আবদ্ধ পালকিটাকে চোখ ঝলসানো রূপালি অস্পষ্টতার ভেতর থেকে তাঁর শক্তিশালী ছয়জন লোকের কাঁধে স্থাপিত অবস্থায় বের হয়ে আসতে দেখে। খানজাদা, গুলবদন এবং বহরের সাথে ভ্রমণকারী অন্যান্য সম্ভ্রান্ত মহিলারা টাট্ট ঘোড়ায় ভ্রমণ করলেও, গর্ভবতী হামিদার পথের কষ্ট দূর করতে হুমায়ুন সম্ভাব্য সবকিছু করতে চেষ্টা করছে। পালকিটার বাঁশের তৈরী কাঠামোর দুপাশে ঘাস আর সুগন্ধি লতাপাতা দিয়ে একটা আচ্ছাদনের মতো তৈরী করা হয়েছে এবং কয়েক ঘন্টা পরপর পরিচারকেরা মরুভূমির প্রেক্ষাপটে সোনার চেয়েও মূল্যবান পানি দিয়ে সেটা ভিজিয়ে দিচ্ছে, দাবদাহের কবল থেকে হামিদাকে খানিকটা হলেও সুবাসিত প্রশান্তি দিতে। এতসব প্রয়াসের পরেও, তাঁর মুখ খুবই রুগ্ন দেখায় এবং তাঁর চোখের নীচের প্রায় স্বচ্ছ ত্বকের চারপাশে সৃষ্ট কালো দাগ স্পষ্টই জানিয়ে দেয় যে গর্ভাবস্থা তার জন্য মোটেই কোনো সুখকর অভিজ্ঞতা নয়। হামিদা প্রায়শই বিবমিষা বোধ করে এবং খাবারের প্রতি প্রচণ্ড অরুচি দেখা দেয়।

হামিদাকে বহনকারী পালকিটা নিকটবর্তী হতে দেখে, হামিদাকে হারাবার ভয়টা নতুন করে হুমায়ুনকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। তাকে রক্ষা করতে এবং নিরাপদ স্থানে নিয়ে যেতে, হুমায়ুন তাঁর সামর্থ্যের ভিতরে রয়েছে এমন কোনো কিছু করতে দ্বিধা করছে না, কিন্তু তারপরেও বিপদ চারপাশে ওঁত পেতে রয়েছে। সাপ আর বিছে ছোবল দেয়ার জন্য ফণা তুলে রয়েছে। মরুভূমিতে গিজগিজ করতে থাকা দস্যুবাহিনীও তাঁদের জন্য বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে, যেহেতু তার খুব অল্প সংখ্যক সৈন্যই এখন অবশিষ্ট আছে- খুব বেশী হলে হাজারখানেক হবে। কাবুল তাঁর হাতছাড়া হয়েছে জানতে পেরে, তার বাহিনীর একটা বিশাল অংশ ভোজবাজির মতো শূন্যে মিলিয়ে গেছে।

আল্লাহ সহায় থাকলে তারা শীঘ্রই মারওয়ার রাজ্যের কাছাকাছি পৌঁছে যাবে এবং সেখানে আশ্রয় লাভ করবে। রাজা মালদেওয়ের সমর্থনজ্ঞাপক বার্তা হুমায়ুনকে যে রাজদূত সরকার ত্যাগ করতে রাজি করিয়েছিল সেই একই রাজদূত সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বার্তাবাহকের দায়িত্ব পালন করছেন- হুমায়ুন তার বাহিনী নিয়ে রাজ্যের নিকটবর্তী হবার সাথে সাথে পাল্লা বেড়ে চলেছে। সে অবশ্য আশা করেছিল মালদেও ব্যবহার উপযোগী সাহায্য করবেন- রসদ, পানি এবং তাজা ঘোড়ার পাল প্রতিশ্রুতির সুললিত বাণীর চেয়ে এই মুহূর্তে তার কাছে অনেকবেশী কাম্য। কিন্তু হুমায়ুন এইসব সাহায্যের জন্য অনুরোধ জানাতে ইতস্তত বোধ করে। সে মহারাজের অতিথি এবং মিত্র হিসাবে মারওয়ার যাচ্ছে, ভিক্ষুকের মতো সাহায্যপ্রার্থী হিসাবে না।

চামড়া দিয়ে বাঁধান লাল খেরো খাতাটা যেখানে কাশিম দায়িত্বের সাথে প্রতিদিন তাদের রসদ খরচ হবার পরিমাণ লিপিবদ্ধ করেন, ঠিক যেমনটা তিনি রাখতেন বাবর যখন সমরকন্দে অবরুদ্ধ ছিল তখন, সেটায় লিপিবদ্ধ নথি থেকে দেখা যায় বেঁচে থাকার মতো এখনও যথেষ্ট পরিমাণ খেজুর, শস্য আর অন্যান্য শুকনো ফল তাঁদের সংগ্রহে রয়েছে। অবশ্য, রোগাক্রান্ত অথবা ক্লান্ত হাড় জিরজিরে পশুর মাংস, যদি আদৌ সেটাকে তাজা বলা যায় ছাড়া, শেষ কবে তাঁরা তাজা মাংস খেয়েছে মনেই করতে পারবে না। তাদের চলার পথে যেসব গ্রাম পড়ত প্রথম দিকে তারা সেখান থেকেই প্রয়োজনীয় রসদ সংগ্রহ করতো। এখন আমের মৌসুম চলছে। এবং চকচকে সবুজ পাতার মাঝে থোকায় থোকায় ঝুলে থাকা মিষ্টি গন্ধযুক্ত, কমলা রঙের, কোমল ফলটার রসাল অংশই হামিদা একটু আগ্রহ করে খায়। কিন্তু ছয়দিন আগে তারা শেষ বসতিটা অতিক্রম করেছে- একটা কুয়ার চারপাশে মাটির তৈরী ঘরবাড়ির একটা জটলা আর তারপরে মরুভূমি তাদের গ্রাস করে ফেলেছে। আহমেদ খানের গুপ্তদূতেরা, চন্দ্রালোকিত রাতের আঁধারে সামনে বহুদূর পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েও কোনো বসতির সন্ধান খুঁজে পায়নি।

এই মুহূর্তে অবশ্য তাঁদের সবচেয়ে বড় সমস্যার নাম পানির স্বল্পতা, তাঁর আধিকারিকেরা এখন সতর্কতার সাথে পানির সংবিভাগ তদারক করছে। তিন রাত্রি আগে, তাঁর দুজন লোক পানির বদলে কড়া মদ পান করেছিল। তারপরে, তাঁদের তৃষ্ণা মাত্রা ছাড়াতে এবং নিজেদের অনুভূতি ভোঁতা হয়ে পড়লে, পুতিগন্ধময় কয়েক টোক পানি অবশিষ্ট আছে এমন একটা মশকের দখল নিয়ে নিজেদের ভিতরে লড়াই শুরু করে, যার ফলে একজনের মৃত্যু হয় অপর মাতালের খঞ্জরের আঘাত নিজের গলায় ধারণ করায়। হুমায়ুন বেঁচে যাওয়া অপর সৌভাগ্যবানকে তখনই কবন্ধ করার আদেশ দেয় কিন্তু দণ্ডাদেশ প্রত্যক্ষ করতে সমবেত হওয়া সৈন্যদের চোখে সে চাপাক্রোধ ধিকিধিকি করে জ্বলতে দেখে। মরুভূমির হানাদারদের যেকোনো আক্রমণের মতোই বিশৃঙ্খলা আর অবাধ্যতাও সমান বিপজ্জনক…

তার নিজের ঘোড়াও রীতিমতো ধুকছে। বেচারীর গায়ে একটা সময় ছিল যখন সেটা চকচক করতো, এখন কেবল শুকনো ঘামের দাগ আর বালি জমে রয়েছে এবং ঘনঘন হোঁচট খাচ্ছে। হুমায়ুন ভ্রূ কুচকে ঘোড়াটার চারপাশে পায়চারি করে। সূর্যের কমলা রঙের গোলকটা থেকে বিচ্ছুরিত অসহনীয় আলোর তীব্রতা চারপাশের ভূপ্রকৃতিকে মৃতবৎ করে রেখেছে, বালিয়াড়ির সারিগুলোকে চেটালো করে তুলেছে এবং সবকিছুকে চোখে জ্বলুনি ধরান একঘেয়েমী আর হতোদ্যম করে তুলেছে যে কিছুই আগ্রহী সৃষ্টি করা বা মনোবল তাজা করে না। ঘোড়াটাকে কিছুক্ষণের জন্য একটু বিশ্রাম দিতে হুমায়ুন মাটিতে নেমে পড়ে এবং বামহাতে ঘোড়ার লাগামটা ধরে বিশ্বস্ত প্রাণীটার পাশে পাশে হাঁটতে থাকে।

হুমায়ুন সহসা সামনে কোথাও থেকে ভেসে আসা একটা বিশৃঙ্খলার শব্দ শুনতে পায়। তিন কি চারশ গজ দূরে সৈন্যসারির সম্মুখভাগে কি ঘটেছে দেখতে চোখের উপরে হাত দিয়ে একটা আড়াল তৈরী করে কিন্তু সূর্যের দাবদাহের কারণে কিছুই বোঝা যায় না। ওখানে কি ঘটেছে দেখে এসো, সে চিৎকার করে জওহরকে আদেশ দেয়। কিন্তু জওহর তাঁর বাহন নিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার আগেই তাদের চারপাশে মানুষ আর প্রাণীর একটা সম্মিলিত ঊর্ধ্বশ্বাস ধাবন শুরু হয়। ভারবাহী প্রাণীগুলো এতক্ষণ যারা নির্জীবভঙ্গিতে পেছন পেছন অনুসরণ করে আসছিলো, সহসা তারা উন্মত্তের মতো তাদের পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যায়,নাক বরাবর দাবড়ে যাবার সময় তারা বালুকে কোনোরকম প্রতিবন্ধক হিসাবে গ্রাহ্য করে না। হুমায়ুন বুঝতে পারে, প্রাণীগুলো নিশ্চিতভাবে পানির গন্ধ পেয়েছে এবং তাঁর আত্মা ধক করে উঠে।

সে তার ঘোড়ার পিঠে পুনরায় আরোহন করে, প্রাণীটা উত্তেজনায় এখন চিহি রব করছে, সামনের দিকে এগিয়ে যায়। সে নিজের হাতে হামিদার জন্য এক পেয়ালা শীতল পানি নিয়ে আসবে। কিন্তু সে যতই কাছাকাছি পৌঁছে, তার চোখে বিশৃঙ্খলা ধরা পড়তে থাকে। প্রথমেতো উন্মত্তের মতো হুড়োহুড়ি করতে থাকা এতগুলো দেহের ভীড়ে- মানুষ আর প্রাণী নির্বিশেষে বোঝাই যায় না ধুলো মলিন কয়েকটা গাট্টাগোট্টা খেজুর গাছের আড়ালে আসলে ঠিক কি ঘটেছে। তারপরে সে কয়েকটা উঁচু হয়ে থাকা মাটির দেয়ালের পার্শ্বভাগ দেখতে পায় যা দেখতে অনেকটা ছোটখাট একটা কুয়োর সমষ্টি বলে প্রতিয়মান হয় এবং একপাশে একটা ঝর্ণা থেকে পানির ধারা নুড়িপাথরের উপর দিয়ে একটা ছোট স্রোতধারা হয়ে গড়িয়ে এসে বালিতে মিলিয়ে যাচ্ছে। কুয়ো থেকে ভোলা পানি ভর্তি মশকের দখল নিতে তার লোকেরা ইতিমধ্যে হুড়োহুড়ি শুরু করে মূল্যবান পানি অপচয় করছে।

ভারবাহী প্রাণীগুলো যাদের যত্ন নেয়া তাদের উচিত ছিলো সেগুলোও এখন কেমন খাপছাড়া আচরণ করছে। উটের বহর থুতু ছিটাচ্ছে এবং উন্মত্তের ন্যায় পা। দিয়ে লাথি ছুড়ছে। একটা লোকের পেটে এতো জোরে লাথি লাগে যে বেচারা বালিতে ছিটকে পড়ে এবং নিমেষের ভিতরে ধাবমান পায়ের নীচে পদদলিত হয়ে থেঁতলে যায়। হুমায়ুন তাঁর মাথাটা গুঁড়িয়ে যেতে দেখে, গা গুলিয়ে উঠা একটা দৃশ্যের অবতারণা করে মগজ আর রক্ত মরুভূমির বালুতে ছিটকে গেলে সাথে সাথে তার বাহিনীর সাথে আগত কুকুরের পাল হামলে পড়ে সেটা চাটতে আরম্ভ করে। ভারবাহী খচ্চরের পাল ঝর্ণার কাছে দ্রুত পৌঁছাতে, তাঁদের পিঠের বোঝার কথা ধর্তব্যে ভিতরে না এনে, সবাই তাঁদের বীভৎস হলুদ দাঁত বের করে এবং একে অপরকে কামড়াতে চেষ্টা করে, সবাই একসাথে ধ্বস্তাধ্বস্তি করতে থাকে।

হুমায়ুন ক্রোধে আত্মহারা হয়ে পড়ে। তাঁর আধিকারিকেরা কি ভেবেছে…? শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবার সংকল্প নিয়ে সে যখন ঘোড়ার পাঁজরে গুতো দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে গিয়ে, সে দেখে উন্মত্ত, বিশৃঙ্খল মানুষের ভীড়ের ভিতরে সাধারণ লোকদের সাথে তাঁর আধিকারিকেরাও রয়েছে। সে চিৎকার করে তাঁদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চেষ্টা করে কিন্তু তাঁরা পাত্তাও দেয় না। মাথার উপরে আলমগীর আন্দোলিত করতে করতে সে বল প্রয়োগ করে জটলার আরো ভিতরে প্রবেশ করে এবং চিৎকার করে তিরস্কারের তুবড়ি ফোঁটাতে থাকলে অবশেষে সে নিজের উপস্থিতি সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করতে সক্ষম হয়। লজ্জিত-মুখে তার আধিকারিকেরা পানির জন্য নিজেদের ভিতরে লড়াই বন্ধ করে এবং নিজেদের লোকদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা শুরু করে।

হুমায়ুন এখন সৈন্যসারির পেছনে অবস্থানরত হামিদা এবং অন্যান্য মহিলাদের কথা ভেবে শঙ্কিত হয়ে উঠে। সে তার ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে, গরম বালুর উপর দিয়ে দুলকি চালে ঘোড়া ছোটায় কিন্তু তার নিয়োজিত প্রহরীদের দ্বারা সুরক্ষিত অবস্থায় তারা তখনও শ্লথ কিন্তু সুশৃঙ্খল ভঙ্গিতে এগিয়ে আসছে দেখে স্বস্তির শ্বাস নেয়। সৈন্যসারির অনেক পেছনে তারা অবস্থান করার কারণে আকষ্মিক বিশৃঙ্খলা এড়িয়ে যেতে পেরেছে। হামিদার পালকির দিকে এগিয়ে গিয়ে পর্দা সরিয়ে সে ভিতরে উঁকি দেয়। পালকির ভিতরের আলো-আধারিতে তাঁর দীপ্তিমান হাসি দেখে হুমায়ুন বুঝতে পারে চিন্তার কিছু নেই এবং সে অনেক স্বাভাবিক হয়ে উঠে।

শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে প্রায় ঘন্টাখানেক সময় লাগে কিন্তু ততক্ষণে পানির কাছে অন্যদের আগে পৌঁছাবার তাগিদের কাছে পরাস্ত হয়ে কিংবা হুড়োহুড়ির ভিতরে থেঁতলে গিয়ে ছয়জন লোক মারা গিয়েছে। অন্যেরা পানি খেয়ে পেট ঢোল করে এখন মাটিতে শুয়ে কাতরাচ্ছে আর পরিত্রাণ পাবার জন্য চিৎকার করছে। কয়েকজনের বমির সাথে পানি আর পিত্ত উঠছে আর তারা প্রলাপ বকতে শুরু করেছে। নরকের কোনো দৃশ্য যেন পৃথিবীর বুকে অভিনীত হচ্ছে এবং হুমায়ুন মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকায়। হুমায়ুন আর তার সাথের ছোট বাহিনীটা বিপর্যয়ের কোনো অতলে পতিত হয়েছে জানার জন্য তার শত্রু শেরশাহ অনেক দূরে অবস্থান করায় সে মনে মনে ভাগ্যের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।

তিনদিন পরে ধুসর দিগন্তের আড়াল ছিন্ন করে একটা উঁচু, পাথুরে শিলাস্তরের এবড়ো থেবড়ো অবয়ব দৃশ্যমান হলে তাঁর মনোবল পুনরায় চাঙ্গা হয়ে উঠে। শিলাস্তরের চূড়ায়, ঈগলের বাসার মতো একটা দূর্গ শোভা পাচ্ছে- মারওয়ারের রাজার দুর্ভেদ্য দূর্গ। দূর্গটা এখনও অবশ্য পনের কি বিশ মাইল দূরে রয়েছে। হুমায়ুন মনে মনে ভাবে, শীঘ্রই সে হামিদা, খানজাদা আর গুলবদনকে দূর্গপ্রাকারের নিরাপত্তার ভিতরে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে। মরুভূমির উপর দিয়ে তাদের বিপদসঙ্কুল যাত্রা শেষে পুনরায় নিরাপত্তা আর স্থিরতার মাঝে প্রীতিকর প্রত্যাবর্তন। মালদেওকে তার শুভেচ্ছা জানিয়ে সে তখনই একজন গুপ্তদূতকে প্রেরণ করে।

গুপ্তদূত পরের দিনই কমলা রঙের আলখাল্লা আর ইস্পাতের বর্ম পরিহিত অবস্থায়, তাদের সাজসজ্জার সাথে মাননসই কালো স্ট্যালিয়নে দর্শনীয়ভঙ্গিতে উপবিষ্ট রাজার চৌকষ প্রহরীদের একটা দলকে নিয়ে ফিরে আসলে দেখা যায়, হুমায়ুন যা আন্দাজ করেছিল কার্যত দূরত্ব তারচেয়ে অনেক কম। যোদ্ধাদের মাথার ঢেউ খেলান লম্বা চুল অনেকটা মেয়েদের মতো করে তাদের মাথার উপরে খোঁপা করে বাঁধা বটে কিন্তু চকচকে ফলার বর্শা বহনকারী বাজপাখির মতো নাকবিশিষ্ট, ছিপছিপে, পেষল দেহের এই লোকগুলোর মাঝে মেয়েলী কোনো বৈশিষ্ট্য নেই।

কাশিম আর জাহিদ বেগকে দুপাশে নিয়ে হুমায়ুন ঘোড়ায় উপবিষ্ট অবস্থায় সামনের দিকে এগিয়ে যায়। রাজপূত দলপতি ছোঁড়া নেমে নেমে এসে হুমায়ুনের সামনে নতজানু হয়ে গরম বালুতে অল্পক্ষণের জন্য নিজের কপাল স্থাপন করে। সুলতান, মারওয়ারের রাজা, মহামান্য মালদেও আপনাকে তাঁর শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। তিনি অনেকদিন থেকেই আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন এবং আপনার যাত্রাপথের শেষ কিছু মাইলগুলোতে রক্ষীবাহিনী হিসাবে আপনার সঙ্গী হতে আমাকে আর আমার অধীনস্থ লোকদের পাঠিয়েছেন।

রাজা মালদেওর এই আন্তরিকতার জন্য আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ। আমরা যত দ্রুত মারওয়ার পৌঁছাতে পারব ততই মঙ্গল- আমার লোকেরা পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে।

অবশ্যই, সুলতান। আমরা যদি এখনই যাত্রা করি তবে সূর্যাস্ত নাগাদ আমরা দূর্গে পৌঁছে যাব সেখানে আমার প্রভু আপনি আর আপনার সহযাত্রীদের জন্য বিশ্রামের বন্দোবস্ত করেছেন।

রাজপুত যোদ্ধারা তাঁদের লোকদের কাছে ফিরে যাবার সময় হুমায়ুন তাদের দিকে তাকিয়ে থেকে, সে মনে মনে ভাবে তার সঙ্গের এই হতশ্রী সেনাবাহিনী কেমন ছাপ ফেলতে পেরেছে। তাঁদের সম্পর্কে অজ্ঞ এমন একজন লোক তার বাহিনীকে এই অবস্থায় দেখলে মোটেই তাদের গর্বিত মোগল বাহিনী বলে ভাববে না বরং পরিশ্রান্ত ঘোড়ায় উপবিষ্ট অপরিচ্ছন্ন একদল লোক, তাঁদের পর্যাণে একটা সময় যেসব উজ্জ্বল ফলাবিশিষ্ট শস্ত্র শোভা পেত তরবারি আর দো-ধারি রণকুঠার- সেগুলো এখন বহুব্যবহারে কার্যকারিতা হারিয়েছে। মরুভূমির গরমে তার লোকদের ভেতরে অনেকেই বৃত্তাকার ধাতব আস্তরণযুক্ত ঢাল ফেলে দিয়েছে বহন না করে এবং তাদের তূণের তীর প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। মরুভূমির ভিতর দিয়ে অতিক্রম করার কারণে ভালো কাঠ খুঁজে বের করে তীর তৈরী করার কোনো সুযোগ বা সময় তারা পায়নি। হুমায়ুনের তবকিদের দেখে কেবল মনে হয়- জাহিদ বেগের দ্বারা নিপূণভাবে প্রশিক্ষিত- যে তারা কিছুটা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে। কিন্তু সে যদি একবার কেবল মারওয়ার পৌঁছাতে পারে তাহলে এসব কিছুই বদলে যাবে। তার কাছে এখন বেশ কিছু অর্থসম্পদ রয়েছে যা দিয়ে সে তার সঙ্গের লোকদের পুনরায় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করতে এমনকি নতুন লোক নিয়োগ করতেও পারবে, এবং মারওয়ারের রাজা স্বয়ং তাঁকে লোক সরবরাহ করবে।

সেই রাতে, সূর্যাস্তের পরে আকাশের কমলাভ-গোলাপী আভার নীচে, হুমায়ুন তাঁর অবশিষ্ট সৈন্যদলের অগ্রভাগে অবস্থান করে মারওয়ারের আঁকাবাঁকা সড়ক দিয়ে শহরের বসতির পেছনের খাড়াভাবে উঠে যাওয়া উচ্চভূমির শীর্ষে অবস্থিত রাজা মালদেও-এর বিশাল দূর্গপ্রাসাদের দিকে এগিয়ে যায়। বনের শেষভাগ, মাটির বাড়ি আর শিলাস্তরের মধ্যবর্তীস্থানে- যা দেখে মনে হয় সেটা সম্ভবত দেড়শ ফিট উঁচু হবে একটা উন্মুক্ত প্রান্তর রয়েছে যার ডানপাশ দিয়ে একটা শীর্ণকায়া ঝর্ণা বয়ে চলেছে। ঝর্ণা অতিক্রম করে খানিকটা দূরে সারি সারি তাবু আর জ্বালাবার জন্য তৈরী অবস্থায় কাঠ স্তূপ করে রাখা।

সুলতান, আপনার লোকদের বিশ্রামের জন্য নির্মিত ছাউনি, রাজপুত সেনাপতি বিনয়ের সাথে বলে।

হুমায়ুন ঘোড়া নিয়ে না থামিয়ে শিলাস্তরের পাদদেশে অবস্থিত একটা তোরণাকৃতি প্রবেশপথের দিকে এগিয়ে যায়। হুমায়ুন তাঁর দেহরক্ষী, বয়োজ্যেষ্ঠ সেনাপতি, অমাত্যবৃন্দ আর রাজ পরিবারের মহিলাদের নিয়ে তোরণদ্বারের নীচ দিয়ে অতিক্রম করার সময় অন্তরাল থেকে অদৃশ্য হাতের কারসাজিতে জয়ঢাকের গুরুগম্ভীর আওয়াজ তাঁদের স্বাগত জানায়। তোরণের অপর পার্শ্বে, খাড়া কিন্তু প্রশস্ত একটা পথ বামদিকে তীক্ষ্ণ একটা বাঁক নিয়ে উপরের দিকে উঠে গিয়েছে এবং পাথরের প্রাকৃতিক বাঁক অনুসরণ করে শিলাস্তরের উপরের দিকে উঠে যায়। হুমায়ুনের ক্লান্ত ঘোড়াটা, নাক দিয়ে ফেস-ফোঁস শব্দ করে, ঢালু পথ বেয়ে মন্থর গতিতে উপরের দিকে উঠতে আরম্ভ করে একটা প্রশস্ত পাথুরে মালভূমির শীর্ষভাগে এসে হাজির হয়। তাঁর সামনে এখন কামানের গোলা নিক্ষেপের জন্য ছিদ্র বিশিষ্ট প্রাকারের একটা বেষ্টনী যা শিলাস্তরের উপরিভাগের প্রায় পুরোটাই ঘিরে রেখেছে। একটা দ্বিতল তোরণগৃহের ভিতর দিয়েই অভ্যন্তরে প্রবেশ করা যায় হুমায়ুন দেখে প্রাকারের সারি পেছনদিকেও প্রসারিত।

তোরণগৃহটা, সরদলের উপরে পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠা ঘোড়ায় উপবিষ্ট এক রাজপুত যোদ্ধার অবয়ব খোদাই করা রয়েছে, দেখতে বেশ প্রাচীন উত্তোলিত ধাতব নিরাপত্তা বেষ্টনীর নিচ দিয়ে অভ্যন্তরে প্রবেশ করার সময় হুমায়ুন ভাবে, আগ্রা দূর্গ বা এমনকি কাবুলের দূর্গপ্রাসাদের চেয়েও অনেক প্রাচীন। এই তোরণের নীচে দিয়ে রাজপুত যোদ্ধাদের কতগুলো প্রজন্ম ঘোড়া নিয়ে দুলকি চালে ছুটে বের হয়েছে এবং নিজেদের যোদ্ধা সংহিতার প্রবর্ধনে পাহাড়ের ঢালু পথ দিয়ে নীচের দিকে ছুটে গিয়েছে যুদ্ধের তুলিতে ধ্বংসের চিত্রকল্প নির্মাণে? হিন্দুস্তানের তাবদ অধিবাসীদের ভিতরে এই রাজপুত গোত্রগুলো সত্যিই মোগলদের সাথে অনেক বেশী ঘনিষ্ঠ একটা যোদ্ধা জাতি যাদের কাছে মায়ের বুকের উষ্ণ দুধে শিশুর অধিকারের মতোই যুদ্ধ, সম্মান, গৌরব, বিজয় তাদের একটা স্বতসিদ্ধ অধিকার। কিন্তু তার কৌতূহলী চোখে তখনই এমন কিছু একটা ধরা পড়ে যা সে ঠিক পুরোপুরি অনুধাবন করতে পারে না। তোরণগৃহের দুপাশে ভেতরের দিকে প্রসারিত দেয়ালের উপরে রক্ত-রঞ্জিত ছোট ছোট হাতের পাঞ্জার ধারাবাহিক ছাপ রয়েছে।

ঔই ছাপগুলো কি?

রাজপুত সেনাপতির উত্তর শুনে হুমায়ুনের মনে হয় পরানের গহীন থেকে উঠে আসা গর্ব তার কণ্ঠে খেলা করছে। মারওয়ারের রাজপরিবারের মহিলারা নিজের মৃত্যুকে স্বেচ্ছায় বরণ করতে এগিয়ে যাবার সময় হাতের এই ছাপগুলো রেখে গিয়েছে। একজন রাজপূত রমণীর স্বামী যখন যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হয় বা অন্য কোনো কারণে মৃত্যুবরণ করে তখন সেই রমণীর দায়িত্ব জীবনের স্পন্দনে নিজের অধিকার পরিত্যাগ করা এবং স্বামীর অন্তেষ্টিক্রিয়ার চিতায় তার সাথে মিলিত হওয়া। আগুনের সর্বগ্রাসী শিখার চাদরে নিজেকে আবৃত করার পূর্বে সেইসব রমণীদের জীবিত অবস্থায় শেষ কর্মকাণ্ড এই চিহ্নগুলো যা আপনি এখানে দেখছেন।

হুমায়ুন এরকম গল্প আগেও শুনেছে। বাবর তাকে বলেছিলেন যে তাঁর হিন্দু প্রজারা এই লোকাঁচারকে সতী বলে এবং অনেকক্ষেত্রেই দেখা যায় যে মেয়েরা মোটেই ব্যাপারটায় উৎসাহী নয়। বাবর এক কিশোরী বিধবাকে বড়জোর যযাল বছর বয়স হবে মেয়েটার দেখেছিল, তেলে চুপচুপে করে ভিজিয়ে আক্ষরিক অর্থেই তাকে আগুনের ভিতরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার আগে মরীয়া হয়ে ধ্বস্তাধ্বস্তি করতে। মেয়েটার মরণ চিৎকারের ভয়াবহতা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না এবং বাবরের লোকেরা ব্যাপারটায় হস্তক্ষেপ করার আগেই বেচারী আগুনে পুড়ে মারা যায়।

হুমায়ুনের মনের ভাবনা যেন লোকটা বুঝতে পারছে এমন ভঙ্গিতে রাজপুত সেনাপতি কথা বলতে থাকে, আমাদের মেয়েদের জন্য এটা অতীব সম্মানের বিষয়…এবং আমরা যদি কখনও যুদ্ধক্ষেত্রে এমন শোচনীয় পরাজয়বরণ করি যে শত্রুর হাতে আমাদের মেয়েদের নিগৃহিত হবার সম্ভাবনা রয়েছে, সবচেয়ে বয়স্ক। রাজপুত রাজকুমারী পুরোভাগে থেকে অন্যান্য সম্ভ্রান্ত মহিলাদের সাথে নিয়ে তারা প্রত্যেকে তখন বিয়ের অনুষ্ঠানের উপযোগী জাঁকালো পোষাক আর সেরা অলঙ্কার সজ্জিত-জহরের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যায়। বিশাল একটা অগ্নিকুণ্ড প্রজ্জ্বলিত করা হয় এবং মর্যাদাহানির মুখোমুখি হবার চেয়ে তারা হাসিমুখে আগুনের কুণ্ডে লাফিয়ে পড়ে। চমকপ্রদ একটা দৃশ্যকল্প যেন তাঁর চোখের সামনে মূর্ত হয়ে উঠেছে এমন ভঙ্গিতে লোকটা হাসতে থাকে।

পরমানন্দ বা হতাশায় নেয়া লাল ছাপচিত্রের উপর থেকে হুমায়ুন তার দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। সহজাত প্রবৃত্তির বশে, সে অনুভব করে যে একজন স্ত্রী তার স্বামীর প্রতি যতই নিবেদিত প্রাণ কিংবা পরিস্থিতি যতই ভয়াবহ হোক, একটা মেয়ের স্বাধীনভাবে চিন্তা করার মতো আপন অস্তিত্ব রয়েছে, তার নিজস্ব কিছু বাধ্যবাধকতাও রয়েছে নিজের প্রতি, যদি সে মা হয় তবে তাঁর সন্তানের প্রতি, এবং তার চারপাশে যারা রয়েছে। খানজাদার অভিজ্ঞতা থেকেই দেখা যায় যে এমন পরিস্থিতিতে একটা অদম্য সত্ত্বা টিকে থাকতে এবং সেই পরিস্থিতি থেকে, হয়তো। অক্ষত অবস্থায় না কিন্তু আত্মার বলে আরো বলীয়ান হয়ে, বের হয়ে আসতে পারে। তার যদি এখন মৃত্যু হয় তাহলে হামিদা আগুনে জীবন্ত দগ্ধ হচ্ছে এমন ভাবনাই তার রক্তকে শীতল করে তোলে। রাজপুতরা হিন্দু হিসাবে পুনরুত্থানে বিশ্বাস করে এবং সম্মানের সাথে মৃত্যুবরণ করার অর্থই হল আরো উঁচু মর্যাদা নিয়ে পুনরায় ভূমিষ্ঠ হওয়া, যেখানে সে বিশ্বাস করে যে প্রত্যেক মানুষ একবারই জন্ম। গ্রহণ করবে, তাই প্রত্যেকের উচিত সেই জীবনের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা, এটাই সম্ভবত আচরনগদ ভিন্নতার মূল কারণ।

তাদের ঠিক সামনে নাক বরাবর, নতুন পর্দা দিয়ে আবৃত দেয়ালের ঠিক মধ্যেখানে ছয়ফুট প্রশস্ত একটা গলি দেখা যায় যার ঠিক মাঝবরাবর প্রায় সমকোণী একটা বাঁক রয়েছে বিপুল সংখ্যায় শত্রুপক্ষের সৈন্যদের ধেয়ে আসা প্রতিরোধ করতেই এমনটা করা হয়েছে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। গলিটা গিয়ে কুচকাওয়াজের জন্য ব্যবহৃত একটা বিশাল মাঠে গিয়ে শেষ হয়, যেখানে এখন একদল রণহস্তী অনুশীলন করছে। মাঠের বিপরীত দিকেও আরেকপ্রস্থ দেয়াল দেখা যায়, এরও ঠিক মধ্যে একটা সরু গলিপথ আছে। মোগল দূর্গের নক্সা থেকে একেবারে আলাদা এইসব সমকেন্দ্রিক দেয়াল, হুমায়ুনকে কাবুলের বাজারে কাশগর থেকে আগত ঢুলু ঢুলু চোখের বণিকদের বিক্রি করা জটিল বাক্সের ভিতরে অবস্থিত বাক্সের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

দেয়ালের এই তৃতীয় সারিটাই কিন্তু শেষ বাঁধা। আগের মতো একই ধরনের গলিপথ দিয়ে এগিয়ে যেতে হুমায়ুন চতুষ্কোণাকৃতি একটা বিশাল প্রাঙ্গণে উপস্থিত হয়- এটাই মালদেও দূর্গের কেন্দ্রস্থল। প্রাঙ্গণের ঠিক মাঝখানে একটা বিশাল প্রাসাদ দাঁড়িয়ে রয়েছে, সৌন্দর্যের চেয়ে যার দুর্ভেদ্যতার দিকেই বেশী লক্ষ্য করা হয়েছে। প্রাসাদটার বর্হিভাগের দেয়ালে খিলানযুক্ত ছোট ছোট জানালা যত্রতত্র ইচ্ছামতো যেন কেউ বসিয়ে দিয়েছে, ফলে বাইরে থেকে দেখে কারো পক্ষে অনুমান করাটা অসম্ভব ভবনটা কত তলা। প্রাসাদের একদিকে একটা চওড়া, মজবুত দর্শন মিনার রয়েছে- যার শীর্ষভাগে রয়েছে পাথরের তৈরী একটা অভিজাত রুচিশীল কক্ষ।

হুমায়ুন তার ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে এবং অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে নিজের চারপাশে তাকিয়ে দেখে। তাঁকে স্বাগত জানাবার জন্য এখানে তার নিমন্ত্রাতার অবস্থান করার কথা ছিল। কিন্তু ঠিক তখনই উচ্চনাদে অদৃশ্য এক তূর্যবাদকের তৃর্যধ্বনি ভেসে আসে এবং প্রাসাদের কারুকার্যময় সিংহদ্বার দিয়ে কমলা আলখাল্লা পরিহিত রাজপুত যোদ্ধারা সারিবদ্ধভাবে বের হয়ে আসে এবং হুমায়ুনের দুই পাশে দুটো সারিতে সাবলীল দক্ষতায় বিন্যস্ত হয়। যোদ্ধাদলের ঠিক পেছনেই দীর্ঘদেহী, শক্তিশালী দর্শন একটা লোককে দেখা যায়, পরনে পরিকরযুক্ত কমলা আলখাল্লা যার প্রান্তদেশ রাজকীয় মহিমায় মাটি ছুঁয়ে রয়েছে, মাথার হীরকশোভিত সোনার জরির কারুকাজ করা কাপড়ের পাগড়ির নীচে কালো চুল টানটান করে বাঁধা, রাজা মালদেও। দুহাত বুকের উপরে স্থাপন করে, তিনি হুমায়ুনের দিকে এগিয়ে আসেন এবং মাথা নত করে অভিবাদন। জানান।

সম্রাটের জয় হোক। মারওয়ারে আপনাকে স্বাগত জানাই।

রাজা মালদেও, আপনার আতিথিয়তার জন্য আমার ধন্যবাদ গ্রহণ করুন।

আমাদের রাজপুত প্রথা অনুযায়ী আমার পরিবারের রাজমহিষীদের আবাসন কক্ষের পাশেই আপনার সাথে আগত মোগল রাজবংশের রমণীদের আবাসন কক্ষের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। আপনি আর আপনার সাথে আগত অমাত্যবৃন্দ এবং সেনাপতিদের জন্য হাওয়া মহলে কক্ষ প্রস্তুত করা হয়েছে। মালদেও মিনারের দিকে ইশারা করে। আপনার কক্ষটা মিনারের একেবারে শীর্ষদেশে অবস্থিত যেখানে চারপাশ থেকে বাতাস প্রবাহিত হতে পারে।

আমি আবার একবার আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। আর মালদেও আগামীকাল আমরা আলোচনায় বসবো।

অবশ্যই।

*

পরের দিন নরম গদিঅলা বিছানার চারপাশে মিহি তাঁর দিয়ে তৈরী পর্দার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত উষ্ণ বাতাসের একটা আমেজ অনুভব করতে হুমায়ুন ঘুম থেকে জেগে উঠে, গত রাতে পরিশ্রান্ত অবস্থায় যেখানে স্বপ্নহীন এক দীর্ঘ সুপ্তিতে তাঁর দেহ ভেঙে পড়েছিল। কয়েক মুহূর্ত সে নিথর হয়ে সেখানেই শুয়ে থাকে, নিজের পরিবার আর তার অনুগত লোকদের নিরাপদ আশ্রয়ে আনতে পারার কারণে স্বস্তি আর সন্তুষ্টিবোধের কাছে নিজেকে সমর্পিত করে। তারা সবাই কিছুক্ষণের জন্য হলেও অন্তত বিশ্রাম নিতে পারবে, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল হামিদা তার প্রয়োজনীয় সেবা আর বিশ্রাম পাবে। হুমায়ুন উঠে বসে এবং বাইরের প্রশস্ত বারান্দায় বের হয়ে এসে পাহাড়ের খাড়া ঢাল বরাবর যা নীচের বালুকাময় সমভূমিতে নিজের আপন বোনর সাথে বিশ্বাসঘাতকও, একেবারে সরাসরি নেমে গিয়েছে নিজের তাকিয়ে থাকতে থাকতে, সূর্য আকাশে অবশ্য অনেকটা উঁচুতে নেমে আসতে এবং ভবনগুলো মেখগুলো নিথর দাঁড়িয়ে থাকে। সূর্যকে, ইতিমধ্যে বেশ অনেকটা উপরে উঠে গিয়েছে, দেখে মনে হয় প্রান্তের দিকটা লাল রঙে রঞ্জিত হয়ে রয়েছে, অনেকটা রক্তাক্ত কমলার আঁশের মতো দেখায়।

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে নাগাড়ে ভ্রমণ করার ধকলের পরে, হুমায়ুনের কাছে মরুভূমি আর বিন্দুমাত্র আকর্ষণীয় মনে হয় না। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে জওহরকে আদেশ দেয়- কাশিম, জাহিদ বেগ আর অন্যান্য সেনাপতিদের ডেকে আনতে। খবরটা নিশ্চয়ই মালদেও এর কাছেও পৌঁছেছিল কারণ হুমায়ুনের লোকেরা এসে পৌঁছাবার আগেই, রাজার ভূত্যরা নানা ধরনের ফল, বাদাম আর সোনা এবং রূপার তবক দিয়ে মোড়া মিষ্টি বোঝাই পিতলের অতিকায় ট্রে এবং সোনালী জগে শীতল সরবত নিয়ে উপস্থিত হয়। মালদেও নিজে যখন ব্যক্তিগতভাবে সেখানে এসে উপস্থিত হন তাদের পানাহার তখনও শেষ হয়নি। পাতলুন আর গাঢ় বেগুনী রঙের জোব্বা পরিহিত অবস্থায় আজ তাঁকে গতকালের চেয়ে অনেকবেশী মার্জিত দেখায় এবং তাঁর মেদহীন কোমরে একটা সরু ধাতব শিকল থেকে চামড়ার তৈরী সাধারণ কোষের ভেতরে বাঁকান একটা খঞ্জর ঝুলছে।

সুলতান, আমার বিশ্বাস রাতে আপনার ঘুম ভালোই হয়েছে।

গত কয়েক সপ্তাহের চেয়ে অনেক আরামে ঘুমিয়েছি। আসুন, অনুগ্রহ করে আমাদের সাথে কিছু একটা মুখে দেন। হুমায়ুন তাঁর পাশে রেশমের কমলা রঙের তাকিয়ার দিকে তাঁকে ইঙ্গিত করে।

মালদেও আরাম করে বসে এবং তবক মোড়ান একটা খুবানি তুলে মুখে দেয়। শিষ্টতার খাতিরে, হুমায়ুন সিদ্ধান্ত নেয় যে শের শাহের প্রসঙ্গ উত্থাপনের পূর্বে তার কিছুক্ষণ অপেক্ষা করাই সঙ্গত হবে, কিন্তু তাঁর নিমন্ত্ৰাতা দেখা যায় ঠিক অতটা বিনয়ী নন।

আপনি নিশ্চয়ই এই দীর্ঘ আর কষ্টকর সফর আমার সাথে শীতল শরবত পান করার অভিপ্রায়ে করেননি। মালদেও সামনের দিকে ঝুঁকে আসে। আমাদের বোধহয় রাখঢাক না করে কথা বলা উচিত। আমাদের উভয়েই একই শত্রুর মোকাবেলা করছি। শের শাহকে যদি অবাধে বিচরণের সুযোগ দেয়া হয় তাহলে সে আমাদের দুজনকেই ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে। আপনি ইতিমধ্যেই জেনেছেন যে মারওয়ার আক্রমণের হুমকি দিয়ে সে আমাকে চূড়ান্ত অপমান করেছে, কিন্তু তার ছিন্ন মস্তক ধূলোয় পড়ে রয়েছে দেখার অভিপ্রায় আমার মাঝে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে আরো জোরাল হয়েছে তারই আরো অধিকতর ঔদ্ধত্যের কারণে।

তা কী করে হয়?

আমার মেয়েকে বিয়ে করার জন্য প্রস্তাব পাঠাবার ধৃষ্টতা সে প্রদর্শন করেছে। রাজস্থানের ত্রিশজন নৃপতির রক্ত আমার মেয়ের ধমনীতে বইছে- সাধারণ এক ঘোড়ার দালালের চৌর্যবৃত্তিতে সিদ্ধহস্ত সন্তানের হাতে আমার মেয়েকে আমি তুলে দিতে পারি না। মালদেও এর চোখ দুটো সংকীর্ণ হয়ে এসেছে এবং তার কণ্ঠস্বরে বিষ ঝরে পড়ছে।

আমার সাথে খুব অল্প সংখ্যক লোক রয়েছে কিন্তু আপনি যদি আমাকে একটা বাহিনী সংগ্রহ করে দিয়ে, আমার সাথে যুদ্ধে অংশ নেন, অন্যেরা তাহলে অনুসরণ করার জন্য উৎসাহবোধ করবে। মোগলদের মতো আপনার লোকেরাও যোদ্ধার জাত। শেরশাহ আর তাঁর নিকৃষ্টতম সঙ্গীসাথীদের আমরা একসাথে নর্দমায় নিক্ষেপ করতে পারবো। মালদেও, আমি আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি- আগ্রায় যখন আমি আবারও সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হব, আপনিই হবেন সর্বাগ্রে পুরষ্কার লাভের অধিকারী।

আমার সাধ্যের ভিতরে রয়েছে এমন সবকিছু আমি করবো- পুরষ্কারের জন্য না বরং আপনার আর আমার নিজের ঐতিহ্যের প্রতি আমার বিশ্বাস আর সম্মান আছে বলে।

মালদেও, আমি জানি সেটা। হুমায়ুন রাজার কাঁধ আকড়ে ধরে এবং তাঁকে বুকে টেনে নেয়।

*

আট সপ্তাহ পরে, হুমায়ুন, রাজা আর তাঁকে নিরাপত্তা দানকারী দেহরক্ষী বাহিনীকে দূর্গের তোরণদ্বার দিয়ে বের হয়ে, রুক্ষ প্রান্তরের উপর দিয়ে জয়সলমীরের মরুশহর অভিমুখে হারিয়ে যেতে দেখে যেখানে পৌঁছে মালদেও শের শাহের বিরুদ্ধে অভিযানের জন্য আরো সৈন্য সংগ্রহের পরিকল্পনা করেছে। সন্ধ্যার অন্ধকার চারপাশ থেকে ঘিরে ধরতে, রাতের মতো দূর্গপ্রাকারে একটা আশ্রয়স্থল খুঁজতে ব্যস্ত রাজার পোষা ময়ুরের কর্কশ ডাকে শীতল বাতাস খানখান হয়ে যায়। ভবিষ্যত সম্পর্কে নিবিষ্ট মনে চিন্তা ভাবনা করার সময় হুমায়ুন অনেক দিন পরে অনেকটাই প্রশান্তি অনুভব করে। মালদেও একজন মনোযোগী আতিথ্যকর্তা। শুভেচ্ছা স্মারক হিসাবে উপঢৌকন প্রদান বা কোনো ধরনের বিনোদনের আয়োজন- উটের দৌড়, হাতির লড়াই বা অগ্নি-ভক্ষণের প্রদর্শনী এবং রাজপুত সামরিক কসরত- ব্যাতীত খুব কম দিনই অতিবাহিত হয়। গতকালই যেমন, তার জন্য একটা কারুকার্যখচিত ঘোড়ার মাথার সাজ আর হামিদার জন্য স্বচ্ছ হলুদাভ বাদামী রঙের অ্যাম্বার পাথরের পুতির একটা হার মালদেও পাঠিয়ে দিয়েছে। মালদেও এর বন্ধুত্বের স্মারক হিসাবে এটা যদিও বেশ স্বস্তিদায়ক কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল শের শাহের বিরুদ্ধে অভিযানের চূড়ান্ত পরিকল্পনা রাজা আর সে মিলে প্রায় শেষ করে ফেলেছে। হুমায়ুন শীঘ্রই একটা সেনাবাহিনীর প্রধান হিসাবে পুনরায় নিজেকে অধিষ্ঠিত দেখবে।

সুলতান… সে ঘুরে তাকিয়ে দেখে হামিদার এক পরিচারিকা, জয়নব, তার সামনে নতজানু হয়ে রয়েছে। মেয়েটার ছোটখাট মুখাবয়বের ডান পাশটা একটা জরুলের মতো জন্মদাগের কারণে মারাত্মকভাবে কুৎসিত দেখায় এবং মারওয়ার অভিমুখে প্রাণান্তকর যাত্রার সময়ে বেচারীর মা জ্বরে মারা গেলে, মেয়েটার পদাতিক সৈন্য বাবা অন্যান্য সন্তানদের ভরণপোষনের নিমিত্তে মেয়েটাকে নিজের সংস্থান নিজেই করার জন্য পরিত্যাগ করে। হামিদা মেয়েটার দুর্ভাগ্যের কথা শুনে আবেগপ্রবন হয়ে উঠে এবং জয়নবকে নিজের পরিচারকা করে নেয়।

কি ব্যাপার?

জয়নব তখনও নতজানু অবস্থায়, দ্রুত কথা বলতে থাকে। সুলতান, মহামান্য রাজমহিষী যত দ্রুত সম্ভব আপনাকে তার সাথে দেখা করতে অনুরোধ জানিয়েছেন।

হুমায়ুন হাসে। আজরাতে সে হামিদার কাছে যাবার কথা চিন্তা করছিলো। তারা এখন যখন নিরাপদ আর আরামে রয়েছে এবং হামিদাও পুনরায় সুস্থবোধ করতে শুরু করায়, তার মন আজকাল প্রায়ই শারীরিক আনন্দের জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠে যদিও হামিদার উদর মাতৃত্বের লক্ষণ নিয়ে দ্রুত বেড়ে উঠতে শুরু করায় তাকে শীঘই হামিদার জন্য নিজের আবেগ সংযত করতে অভ্যস্ত হতে হবে। কোনো কারণে যেন অনাগত সন্তানের কোনো ক্ষতি না হয়। কিন্তু এই মুহূর্তে জয়নাব যখন কথা শেষ করে তার দিকে চোখ তুলে তাকায় সেখানে সমস্যার সম্ভাবনা ফুটে থাকতে দেখা যায় এবং সে সাথে সাথে বুঝতে পারে কোনো একটা ঝামেলা হয়েছে।

জয়নবকে অযথা প্রশ্ন করার জন্য সময় নষ্ট না করে, হুমায়ুন দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে দুই তলা নীচে হাওয়া মহলের সাথে সংযোগকারী দরদালানের দিকে এগিয়ে যায় যেখানে মালদেও এর রাজপুত রমণীদের আবাসন কক্ষের সংলগ্ন কক্ষগুলোতে হামিদা আর অন্যান্যদের থাকবার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। হামিদার কক্ষের চন্দনকাঠের দরজার সামনে অবস্থানরত তাঁর নিজস্ব দেহরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের তোয়াক্কা না করে, হুমায়ুন নিজেই দরজার পাল্লা ধাক্কা দিয়ে খুলে এবং ভিতরে প্রবেশ করে।

হুমায়ুন… হামিদা দৌড়ে তাঁর দিকে এগিয়ে আসে এবং দুই হাতে তাঁর গলা জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ গুঁজে। হামিদার সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে এবং হুমায়ুন তার পরনের ফিনফিনে রেশমের জোব্বার নীচে উত্তেজনায় অস্বাভাবিক গতিতে স্পন্দিত হতে থাকা হামিদার হৃৎপিণ্ডের কম্পন অনুভব করে।

কি ব্যাপার? তোমার বাচ্চার…

 হামিদা কোনো কথা না বলে দরজার পাল্লা বন্ধ হয়ে কক্ষে তারা কেবল দুজন না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে। হুমায়ুনের কাছ থেকে কয়েক পা পেছনে সরে গিয়ে আলগে রাখার ভঙ্গিতে সে দুহাত দিয়ে নিজের স্ফীত উদর আড়াল করে। আমাদের সন্তান নিরাপদেই আমার কাছে রয়েছে…অন্তত এই মুহূর্তের জন্য হলেও। কিন্তু আমরা যদি সতর্ক না হই তাহলে আমরা সবাই হয়ত শীঘই মারা পড়ব। হামিদার গলার স্বর এতোই নীচু যে প্রায় শোনাই যায় না এবং কথা বলার সময় সে কক্ষের চারদিকে এমন ভঙ্গিতে খুটিয়ে দেখতে থাকে যেন দেয়ালের ঝুলন্ত ঝালরের পেছনে কেউ আঁড়িপেতে রয়েছে তাঁদের কথোপকথন শুনতে।

কি সব আবোল-তাবোল কথা বলছো?

হামিদা পুনরায় হুমায়ুনের দিকে এগিয়ে আসে। আমি জানতে পেরেছি যে আমাদের আশ্রয়দানকারী এই রাজা মোটেই আমাদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন নয়। তিনি সবসময়ে আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার ফন্দি করছেন। এমনকি তিনি এখনও মরুভূমির দুর্গম অঞ্চলে অবস্থিত একটা দূর্গে আগ্রা থেকে শের শাহের প্রেরিত দূতের সাথে গোপন আলোচনায় মিলিত হতে চলেছেন। সৈন্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর জয়সলমীর যাবার গল্পটা আর কিছুই না আমাদের কাছ থেকে নিজের আসল অভিপ্রায় আড়াল করার একটা ফন্দি।

কিন্তু সে আমার মিত্র এবং আমার নিমন্ত্রাতা এবং যথাযথ সম্মানের সাথেই আমাদের আচরণ করা হয়েছে। গত দুই মাস ধরে আমরা তার মুঠোর ভিতরেই রয়েছি। সে যদি ইচ্ছা করতো তাহলে অসংখ্যবার সে আমাদের হত্যা করতে পারতো… হুমায়ুন এক দৃষ্টিতে হামিদার দিকে তাকিয়ে থাকে চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকে যে গর্ভধারণের কারণে মেয়েটার বিবেচনাবোধ একেবারে তালগোল পাকিয়ে গিয়েছে।

রাজার লোভই আমাদের এতোদিন পর্যন্ত বাঁচিয়ে রেখেছে- নিজের পারিশ্রমিকের বিষয়ে তিনি দর কষাকষি করছিলেন। নিজেকে সন্তুষ্ট করতেই যে তার সব দাবী পূরণ করা হবে, তিনি শের শাহের প্রেরিত দূতের সাথে এ বিষয়ে মুখোমুখি আলোচনার জন্য এবার তিনি নিজেই গিয়েছেন। সেখান থেকে ফিরে আসা মাত্রই…নিজে পৌঁছাবার আগে যদি তিনি কোনো বার্তা প্রেরণ করেন তাহলে আরো আগেই…তিনি আমাদের সবাইকে হত্যা করবেনই।

হামিদার মুখ ভয়ে টানটান হয়ে আছে যদিও তার কণ্ঠস্বর সংযত। হুমায়ুন তার হাত ধরে, সেগুলোর মর্মর শীতলতা অনুভব করে।

তুমি এতোসব কি করে জানতে পারলে?

একটা মেয়ে তার নাম সুলতানা রাজার হারেম থেকে আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল। মেয়েটা আমাদের গোত্রের একজন- কাবুলের পার্বত্য অঞ্চলে বসবাসকারী একজন আফ্রিদি। পানিপথের যুদ্ধে তার আব্বাজান শহীদ হলে, সে তাঁর মায়ের সাথে কাবুলগামী একটা কাফেলায় যোগ দেয় কিন্তু সিন্ধু নদী অতিক্রম করার সময়ে দস্যুরা তাদের আক্রমণ করে। বাজারে ক্রীতদাস হিসাবে বিক্রি করার জন্য সুলতানাকে অন্যান আরো সব যুবতী মেয়েদের সাথে বন্দি করা হয়। মেয়েটা দেখতে অসাধারণ সুন্দরী। রাজার অনুগত এক অভিজাত ব্যক্তি তাকে কিনে নেয় এবং ভেট হিসাবে মালদেও এর কাছে পাঠিয়ে দেয়।

এই মেয়েটা তোমাকে আর ঠিক কি কি বলেছে?

বলেছে যে মোগলদের প্রতি সে তার অন্তরে বিদ্বেষ পুষে রেখেছে। সে আমাদের একদল বর্বর হানাদার ছাড়া আর কিছুই মনে করে না যাদের হিন্দুস্তানের উপরে কোনো অধিকারই নেই। রাজার মেয়েকে শের শাহর বিয়ে করতে চাওয়ার গল্পটা পুরোপুরি মিথ্যা। আমরা নিশ্চিতভাবেই এখানে আসার জন্য রাস্তায় রয়েছি এই খবরটা পাবার সাথে সাথে, সে আত্মতৃপ্তিতে ঢেকুর তুলতে তুলতে শের শাহকে লিখে পাঠায় যে অচিরেই সে আমাদের তার কর্তৃত্বের বলয়ের ভেতরে পাবে এবং শের শাহর কাছে জানতে চায় আমাদের বিনিময়ে সে তাকে কি দিবে। কিছুদিনের জন্য দুপক্ষের মাঝে কথা চালাচালি বন্ধ ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত- সুলতানার ভাষ্য অনুযায়ী দুই দিন আগে মারওয়ার রাজ্যের সীমান্তের নিকটে শের শাহের প্রেরিত প্রতিনিধি এসে উপস্থিত হয় এবং মালদেও এর উদ্দেশ্যে একটা বার্তা প্রেরণ করে শের শাহের প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে তাকে অবহিত করে। শের শাহ যা বলেছে… ভয়ঙ্কর সব কথাবার্তা…এই প্রথমবারের মতো হামিদার কণ্ঠস্বর কেমন যেন ভাঙা ভাঙা শোনায়।

হুমায়ুন তাঁকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে আসে এবং তাঁকে অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে বুকের কাছে ধরে রাখে। হামিদা, পুরোটা আমায় বল। আমাকে সবকিছু তোমায় অবশ্যই বলতে হবে…।

নিজেকে সামলে নিয়ে হামিদা এবার হুমায়ুনের বুকে মুখ রেখে চাপা স্বরে পুনরায় বলতে থাকে। মালদেওকে শেরশাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে রাজা যদি আপনার ছিন্ন মস্তক…এবং আমার গর্ভের অজাত সন্তানকে…তার কাছে। পাঠায়…অর্থ আর ধনসম্পদ দিয়েই সে তাঁকে পুরস্কৃত করবে না সেই সাথে তাঁকে নতুন শহর আর ভূখণ্ড দান করবে যা সে শেরশাহের সাম্রাজ্যের বাইরে স্বাধীনভাবে নিজের দখলে রাখতে পারবে। সুলতানা যখন আমাকে এই কথাগুলো জানায় আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি…কিছুক্ষণের জন্য আমি ঠিকমতো চিন্তাভাবনাও করতে পারছিলাম, কিন্তু আমি মনে মনে জানতাম যে আমাকে শক্ত থাকতে হবে…আমাদের জন্য এবং আমার গর্ভে আমি যাকে বহন করছি তার জন্য…

মালদেও এর হাস্যোজ্জ্বল মুখ, তাঁর কপটতাপূর্ণ মিথ্যাচারের কথা হুমায়ুন যখন চিন্তা করে, তার ভেতরে ক্রোধ আর বিরক্তির মাত্রা এতোই প্রবল হয়ে উঠে যে তাঁর মনে হয় উন্মত্ততায় বুঝি সে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পড়বে। শেরশাহের প্রস্তাব গ্রহণের অভিপ্রায় কি মালদেওর রয়েছে? সে কোনোমতে জিজ্ঞেস করে।

সুলতানা বলেছে রাজা ভীষণ সতর্ক। শের শাহের প্রতিনিধিকে এ কারণেই সে মরুভূমির অভ্যন্তরে অবস্থিত দূর্গে ডেকে পাঠিয়েছে তাঁর সাথে দেখা করার জন্য যাতে সে নিজে তাঁকে প্রশ্ন করতে পারে। কিন্তু সে যদি একবার বিশ্বাস করে যে শেরশাহ যা বলেছে সেটাই বোঝাতে চেয়েছে, আমাদের হত্যা করতে মালদেও ইতস্তত করবে না। আজ সন্ধ্যাবেলা মালদেও দূর্গ ত্যাগ করার সাথে সাথে, সুলতানা আমার সাথে দেখা করার জন্য একটা অজুহাত তৈরী করে…

তোমার এই সুলতানা বিশ্বস্ত তুমি কি এই বিষয়ে নিশ্চিত? আমাদের জন্য সে এতো বড় ঝুঁকি কেন নেবে?

মেয়েটার প্রতি মালদেও উদাসীন বলে সে তাকে ঘৃণা করে… মালদেও তাকে তৃণভূমি থেকে আগত বর্বর প্রেয়সী বলে সম্বোধন করে। কিন্তু রাজার প্রতি তাঁর বিদ্বেষের কারণ এরচেয়েও গভীরে প্রোথিত। আমার উদরে মেয়েটা যখন হাত রেখেছিল তখন আমি তার ভেতরে নিদারুণ একটা যন্ত্রণা লক্ষ্য করেছি…মেয়েটা আমাকে বলেছে যে মালদেওর একটা পুত্রসন্তানকে যখন সে গর্ভে ধারণ করে তখন সে বলেছিল ছেলেটা প্রাসাদে মানুষ হবার যোগ্য না এবং সে তাকে অন্যত্র পাঠিয়ে দেয়। ছেলেটা বেঁচে আছে না মারা গেছে এটাও মা হিসাবে মেয়েটা জানতে পারেনি। আমাদের ভাবী সন্তান এবং আমাকে একজন মা হিসাবে খাতির করার কারণে সে আমার সাথে দেখা করতে এসেছে, এই বিষয়ে আমি নিশ্চিত। সে নিজেকে আমার রক্ত-সম্বন্ধীয় বোন বলে ঘোষণা করেছে এবং আমি তাকে বিশ্বাস করি।

হুমায়ুন আলতো করে হামিদাকে ছেড়ে দেয়। হুমায়ুনের দিকে হামিদা উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে থাকলে, রাজপুত ঐতিহ্যের মূল দ্যোতনা আতিথিয়তা আর সম্মানের সমস্ত রীতিনীতির মর্যাদাহানি এবং মালদেওর কপটতার কারণে তাঁর ক্রোধের উন্মত্ততা ধীরে ধীরে একটা শীতল সংকল্পে পর্যবসিত হয়। সে যদি তার নিজের পরিবার আর লোকদের জীবন বাঁচাতে চায় তাহলে তাকে অবশ্যই আবেগকে প্রাধান্য না দিয়ে কেবল একটা বিষয়ের প্রতি তাঁর সমস্ত কেন্দ্রীভূত করতে হবে- যে কোনো মূল্যে বেঁচে থাকা।

তোমাকে আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি- তোমার বা তোমার অনাগত সন্তানের কোনো ক্ষতি হবে না। আমার সম্রাজ্ঞী করবো বলে আমি তোমায় বিয়ে করেছি এবং সম্রাজ্ঞীই তুমি হবে। আর আমাদের সন্তান আমার পরে ম্রাট হবে। মালদেওর নীতিবিগর্হিত ষড়যন্ত্র এসব পরিবর্তিত করতে পারবে না।

হুমায়ুনের এই কথায়, হামিদা সোজা হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের এখন কি করা উচিত?

এই বিষয়ে তুমি কি আর কারো সাথে আলাপ করেছো? গুলবদন কিংবা খানজাদা?

কারো সাথে আলাপ করিনি।

তোমার খেদমতকারী জয়নব এসব সম্বন্ধে কি জানে?

সে কেবল এটুকু জানে যে সুলতানার সাথে কথা বলে আমার মেজাজ খারাপ হয়েছে…

তুমি কি সুলতানাকে আরেকবার ডেকে আনতে পারবে?

হ্যাঁ। তাঁর কক্ষ কাছেই অবস্থিত এবং প্রাসাদের ভিতরে সে অবাধে চলাফেরা করতে পারে।

নিজের চেহারা দেখাবার খাতিরে আমাকে অবশ্যই কিছুক্ষণের জন্য তোমায় একলা রেখে যেতে হচ্ছে। মালদেওর কতিপয় সেনাপতির আমার এবং আমার আধিকারিকদের সাথে আহার করার কথা রয়েছে সেখানে শেরশাহের বিরুদ্ধে আসন্ন অভিযান নিয়ে আলোচনা হবে। সন্দেহের উদ্রেক হতে পারে এমন কিছুই আমি এখন করবো না। কিন্তু এখন থেকে ঠিক দুই ঘন্টা পরে সুলতানাকে এখানে আসতে বলো এবং আমার পক্ষে যত শীঘ্রি সম্ভব আমি তোমার সাথে মিলিত হবো। এই মেয়েটাকে আমি নিজে একবার ভালো করে দেখতে চাই। সে ঝুঁকে এসে, হামিদার কোমল অধরে আলতো করে চুমু দেয়। ভয় পেয়ো না, সে ফিসফিস করে বলে, আমি বলছি সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে…

তার পক্ষে যত দ্রুত সম্ভব বটে কিন্তু হুমায়ুন যেমনটা আশা করেছিল তার চেয়ে বেশ কিছুক্ষণ পরে, তাঁকে হন্তদন্ত ভঙ্গিতে হামিদার আবাসন কক্ষে পুনরায় প্রবেশ করতে দেখা যায়। কয়েকশ পিতলের দিয়ায় জ্বলন্ত শলতে এবং দেয়ালের কুলঙ্গিতে রক্ষিত মশালের আলোয় হুমায়ুন যাকে আশ্রয়স্থল ভেবেছিল সেই স্থানের রুক্ষ পাথুরে দেয়ালের উপরিভাগ নমনীয় দেখায় কিন্তু সুলতানা যদি সত্যি কথা বলে থাকে- এটা কেবল বন্দিশালাই নয় হত্যাকাণ্ডের সম্ভাব্য স্থান। ভোজসভায় অবস্থান করার সময় সারাক্ষণ- যদিও হাবেভাবে মালদেওর লোকদের প্রতি মনোযোগী আর বিনয়ী ছিল- সে নিজের ভেতরে বারবার কেবল একটা বিষয় নিয়ে চিন্তা করছিলো তার কি করা উচিত এবং অবশেষে একটা সাহসী আর বেপরোয়া পরিকল্পনা ধীরে ধীরে তার মাথায় পূর্ণাঙ্গতা প্রাপ্ত হতে থাকে…

সুলতান। হামিদার আবাসন কক্ষে প্রবেশ করতেই একটা মেয়ে তার সামনে নতজানু হয়।

উঠে দাঁড়াও। মেয়েটা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, হাত ভাজ করে অপেক্ষা করার মাঝে হুমায়ুন তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। সুলতানার বয়স প্রায় ত্রিশ বছর হবে কিন্তু তাঁর মুখ ফ্যাকাশে, চোখের নিম্নাংশ প্রশস্ত, যা আফ্রিদি লোকদের বৈশিষ্ট্য এখনও রীতিমতো সুন্দরী এবং মাথার কালো চুলে এখনও রূপালি ক্ষত সৃষ্টি হয়নি। মেয়েটা স্বচ্ছ, লালচে-বাদামি রঙের চোখে উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে হুমায়ুনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে যেন ভাবছে সম্রাটের আবেক্ষণ উতরানোর মতো যোগ্যতা কি তার রয়েছে।

সম্রাজ্ঞী তোমার কথা আমাকে বলেছে। সেটা যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে আমরা তোমার কাছে চিরঋণী হয়ে থাকবো…

সুলতান, আমি সত্যি কথাই বলেছি। আমি শপথ করে বলছি।

রাজা তার গোপন পরিকল্পনার কথা হঠাৎ তোমায় কেন বলতে গেলেন?

তিনি হারেমে- নিজের সম্বন্ধে মাত্রাতিরিক্ত আত্মগর্ব আর আত্মতুষ্টির আকাঙ্খয়- এসব বিষয় নিয়ে প্রকাশ্যে আলোচনা করে থাকেন। সুলতান,এমনকি মরুভূমির উপর দিয়ে আপনার এদিকে আসবার সময়, সে যখন জানতে পারে যে আপনার সাথে খুব সামান্য পরিমাণ রসদ রয়েছে, সে বলেছিল আপনাকে আক্রমণ করতে তাঁর ভীষণ ইচ্ছে করছে। কিন্তু মিষ্টি কথা আর প্রতিশ্রুতির ছলনায় আপনাকে প্রলুব্ধ করাটা তাকে বেশী প্রীত করেছে। লোকটা একজন ওস্তাদ কৈতব আর ষড়যন্ত্রের জটিল পরিকল্পনা করতে পছন্দ করে…আপনাকে সে পুরোপুরি নিজের আয়ত্তের ভেতরে এই বিষয়ে সে একেবারে নিশ্চিত হতে চেয়েছে। সুলতানার কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠে, সুলতান, লোকটা একটা সাক্ষাৎ পিশাচ…

সুলতানার চোখে ফুটে উঠা আতঙ্ক আর মানসিক সংক্ষোভ হুমায়ুন যা সহজেই পড়তে পারে, তাকে বলে দেয় যে মেয়েটা আর যাই হোক মিথ্যা কথা বলছে না।

আমাদের রক্ষা করতে আল্লাহ্তালাই তোমায় এখানে পাঠিয়েছেন, সুলতানা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লে সে বলে।

সুলতান, আমি আশা করি যেন সেটাই হয়। আপনাকে সাহায্য করতে আমার পক্ষে যা সম্ভব সবকিছু আমি করবো।

বেশ, আমার পরিকল্পনার কথা আমাকে তোমায় বলতে দাও… মালদেবের আতিথ্য গ্রহণ করার পরে আমি বাজপাখি নিয়ে বেশ কয়েকবার শিকার করতে গিয়েছি। আমি যদি আবারও শিকারে যেতে চাই তাহলে এর চেয়ে স্বাভাবিক আর কিছুই হতে পারে না? আগামীকাল, ভোরের প্রথম আলো ফুটতে শুরু করার সাথে সাথে, আমি এবং আমার সব অমাত্য আর সেনাপতি যারা এখানে এই প্রাসাদে অবস্থান করছে, সবাই এমনভাবে সজ্জিত হবে যেন আমরা সারাদিনের জন্য শিকারে যাচ্ছি। আমাদের মেয়েদের জন্য আমি পালকি প্রস্তুত রাখার আদেশ দেব, বলবো যে আমি চাই সারা দিনব্যাপী আমোদ-প্রমোদ তারাও উপভোগ করুক। আমার সাথে তারা আগেও শিকারে গিয়েছে, তাই তাদের এবারের যাত্রার ভেতরে কেউ বিচিত্র কিছু খুঁজে পাবে না। দূর্গ থেকে আমরা নীচের সমতলে নেমে যাওয়া মাত্র আমরা পূর্বদিকে মরুভূমি অভিমুখে রওয়ানা দেব।

অবশ্য সেই সাথে আমার বাহিনীকেও আমি সরিয়ে দিতে চাই। আমার ব্যক্তিগত পরিচারক জওহরকে আজ রাতেই আমি জাহিদ বেগের কাছে পাঠাব, সে পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত শহরের বাইরে আমাদের অস্থায়ী সেনাছাউনির নেতৃত্বে রয়েছে। জওহর প্রায়শই আমার কাছ থেকে জাহিদ বেগের কাছে বার্তা নিয়ে যায়, তাই এবারও কারও মনে সন্দেহের উদ্রেক হওয়ার কথা না। সে জাহিদ বেগকে গিয়ে তখনই লোকদের কিছু বলতে নিষেধ করবে কিন্তু আগামী কাল খুব সকালে সে যেন তাদের নিয়ে পশ্চিম দিকে যাত্রা করে, পুরো ব্যাপারটা যেন এমনভাবে সাজান হয় যে দেখে মনে হয় তারা সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য যাচ্ছে। অস্থায়ী ছাউনি স্থাপনের বেশীর ভাগ সরঞ্জাম তাদের ফেলে আসতে হবে। সেই সাথে আমাদের কামানগুলোও- কিন্তু এছাড়া আর কোনো পথ নেই। মারওয়ারের দৃষ্টি সীমার বাইরে একবার পৌঁছে গেলে, তাদের বৃত্তাকারে ঘুরে এসে আমাদের বাকি লোকদের সাথে যোগ দিতে হবে। হুমায়ুন চুপ করে থেকে কিছু ভাবে। সুলতানা, তোমার কি মনে হয়? মালদেবের অনুপস্থিতিতে প্রহরীরা কি আমাকে আমার সঙ্গীসাথীদের নিয়ে দূর্গ ত্যাগ করার অনুমতি দেবে?

আপনি শিকারে যাবেন পুরো ব্যাপারটা যদি এমন দেখায়, তাহলে আপনাকে বাধা দেবার কোনো কারণ তাদের নেই। আমি যত দূর জানি, মালদেব দূর্গের অভ্যন্তরে আপনাকে আটকে রাখার কোনো আদেশ দেয়নি- আপনার সন্দেহ হতে পারে এমন কিছুই করার কোনো অভিপ্রায় তার নেই।

কিন্তু সুলতানা তুমি? হামিদা মেয়েটার বাহু স্পর্শ করে। আমাদের সাথে তোমারও আসা উচিত…এখানে থেকে যাওয়াটা তোমার জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। তুমি কি করেছে মালদেব এটা ঠিকই অনুমান করবে…

হুমায়ুনকে বিস্মিত করে দিয়ে সুলতানা অসম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ে।

কিন্তু নিজের লোকদের সাথে তোমার পুনরায় মিলিত হবার এটা একটা সুযোগ…

মালদেবের হাতে এখানে আমার সাথে যা কিছু হয়েছে তারপরে আমার পক্ষে আর ফিরে যাওয়া সম্ভব না…আমার জীবনের ঐ অংশটার সমাপ্তি ঘটেছে। কিন্তু আমি যখন দেখবো তার লোভ, উচ্চাকাঙ্খ বাধা প্রাপ্ত হয়েছে, ব্যর্থ হয়েছে সেটাই হবে আমার পুরষ্কার, পরম প্রাপ্তি… একটা দুখী কিন্তু একই সাথে সাফল্যে উদ্ভাসিত হাসিতে ক্ষনিকের জন্য তার মুখটা জ্বলজ্বল করে উঠে। আর আমার মনে হয় না আমাকে সে সন্দেহ করবে… আমি যা করেছি সেটা করার মতো বুদ্ধি বা সাহস কোনোটা আমার আছে বলে সে মনেই করে না…

আমার রক্ত-সম্পর্কিত বোন, তোমায় আমি কখনও ভুলতে পারবো না। আর আগ্রায় আমি যখন সম্রাজ্ঞী হব, তোমায় সেখানে নিয়ে যাবার জন্য আমি লোক পাঠাব… এবং তখন যদি তোমার যাবার ইচ্ছা হয় তাহলে তোমার সাথে সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শনপূর্বক আচরণ করা হবে। হামিদা সুলতানার গালে আলতো করে একটা চুমু দেয়। আল্লাহ তোমার সহায় হন।

*

আকাশের পূর্বদিকে মাত্র ভোরের লালচে আভা ফুটতে আরম্ভ করেছে, তখনই পুরোদস্তুর শিকারের পোষাকে সজ্জিত হুমায়ুনকে সমকেন্দ্রিক দেয়ালের ভিতর দিয়ে সঙ্গীসাথী পরিবেষ্টিত অবস্থায় তাদের পরনেও শিকারের পোষাক, প্রধান তোরণগৃহের দিকে ধীরে ধীরে ঘোড়া চেপে এগিয়ে যেতে দেখা যায়, দূর্গ থেকে সেটাই একমাত্র বের হবার রাস্তা। মালদেবের দেয়া একটা চমৎকার কালো রঙের বাজপাখি তাঁর কব্জিতে বসে রয়েছে, হলুদ চামড়ার তৈরী পাথরখচিত গোছা বাঁধা টোপরের নীচে পাখিটার উজ্জ্বল চোখ ঢাকা রয়েছে। তার পেছনে, হামিদা, খানজাদা, গুলবদন আর অন্যান্য মেয়েদের বহনকারী পালকিগুলো কাশিম আর তার অন্যান্য অমাত্য এবং সেনাপতিরা ঘিরে রেখেছে। গতরাতে হামিদার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সে সোজা তার ফুপিজান এবং গুলবদনের সাথে দেখা করে এই বিপদ সম্পর্কে এবং তাদের এখন কি করা উচিত সে সম্পর্কে অবহিত করে। মোগল রাজকুমারীর সহজাত প্রবৃত্তির অধিকারী হবার কারণে, তারা সাথে সাথে পরিস্থিতি অনুধাবন করতে পারে এবং কোনো প্রশ্ন না করে আর সংযত হয়ে তাঁর কথামতো কাজ করে।

হুমায়ুন তার দলবল নিয়ে তোরণগৃহের নিকটবর্তী হবার সাথে সাথে যুদ্ধের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ার মতো সমান দ্রুততায় তার শরীরে রক্ত প্রবাহিত হতে থাকে। ভোরের কোমল আলোয় দূর থেকেই সে দেখতে পায় যে ধাতব বেষ্টনী তখনও নামান রয়েছে। তার চোখ সম্ভাব্য অতর্কিত আক্রমণের হুমকি চিহ্নিত করতে দ্রুত ডানে বায়ে তাকাতে থাকে। সুলতানার প্রতিটা কথা সে যদিও বিশ্বাস করেছে কিন্তু এই স্থানে সে আগেও প্রতারিত হয়েছে। সুলতানা নিজেও সম্ভবত হারেমের ভিতরে কোনো শত্রুর দ্বারা বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হতে পারে, মোগল সম্রাজ্ঞীর সাথে তাঁর সাক্ষাৎকার যাকে কৌতূহলী করে তুলেছিল। কিন্তু সবকিছু যেমনটা আশা করা হয়েছিল দেখে তেমনই মনে হয়। তোরণগুহের কোনো আড়াল থেকে তবকির গাঁদা বন্দুক গর্জে উঠে না বা মৃত্যু মুখে নিয়ে তীরের ফলা বাতাসে শিহরন তোলে না। সচরাচর যেমন থাকে তেমনই প্রহরী মোতায়েন রয়েছে। আপাত অমনোযোগী ভঙ্গিতে হুমায়ুন জওহরকে ইশারা করতে সে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠে, ধাতব বেষ্টনী তুলে দাও। মহামান্য সম্রাট বাজপাখি নিয়ে শিকারে যেতে আগ্রহী। কমলা রঙের জোব্বা আর পাগড়ি পরিহিত এক দীর্ঘদেহী যোদ্ধা, সম্ভবত প্রহরীদের দলনেতা ইতস্তত করে। হুমায়ুন টের পায় তার শিরদাঁড়া দিয়ে টপটপ করে ঘাম গড়িয়ে নামছে এবং আড়চোখে বামপাশে ঝুলন্ত আলমগীরের দিকে তাকায়। তার পিঠে আড়াআড়িভাবে ঝুলছে তীর ভর্তি তূণীর। কিন্তু শক্তি প্রদর্শনের কোনো দরকার হয় না। দুই কি এক সেকেণ্ড পরেই রাজপুত দলনেতা চিৎকার করে আদেশ দেয়, বেষ্টনী উত্তোলন কর।

তোরণের উপরে অবস্থানরত লোকেরা কপিকলের চাকা ঘোরাতে শুরু করে মোটা কালো শিকল গুটিয়ে নিতে, যেটার সাথে ধাতব বেষ্টনী ঝুলে আছে। যন্ত্রণাদায়ক ধীরগতিতে বা হুমায়ুনের তেমনই মনে হয়- কাঁচকাঁচ, ঘড়ঘড় শব্দ তুলে ভারী ধাতব বেষ্টনী শূন্যে উঠে যায়। কপিকলের চাকা প্রতিবার ঘোরার সাথে সাথে হুমায়ুনের আশাও বৃদ্ধি পেতে শুরু করে যদিও সে অনেক কষ্টে চোখে মুখে সামান্য বিরক্তিমিশ্রিত অমনোযোগী একটা অভিব্যক্তি ফুটিয়ে রাখে।

ধাতব বেষ্টনী পুরোপুরি উত্তোলিত হবার পরেও হুমায়ুন কোনো ধরনের তাড়াহুড়ো প্রদর্শন করে না বরং সে তার বাজপাখির টোপর ঠিক করতে হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তারপরে, তার হাতের এক ঝটিকা ইঙ্গিতে, সে তার গুটিকয়েক সফরসঙ্গীদের নিয়ে দুলকি চালে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। ধীর গতিতে, শিলাস্তরের ধার দিয়ে খাড়া ভাবে নেমে যাওয়া ঢালু রাস্তা দিয়ে, মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে এই ঢালু পথ দিয়েই তারা বিপরীত দিকে আশায় বুক বেধে উঠে গিয়েছিল, তারা নীচের দিকে নামতে থাকে, যাতে এখনও কেউ সন্দিগ্ধ না হয়, এবং পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত খিলানাকৃতি আনুষ্ঠানিক তোরণের নীচে দিয়ে বের হয়ে তখনও ঘুমিয়ে থাকা শহরের নিরব জনমানবহীন সড়ক দিয়ে এগিয়ে যায়। ছোট দলটা অচিরেই পূর্বদিকে যাত্রা করে, তাদের সামনের এলাকা উদীয়মান সূর্যের সোনালী আলোয় উদ্ভাসিত, এবং বালুকাবৃত এই পতিত প্রান্তর যা যদিও মানব অস্তিত্বে পক্ষে বিরূপ এখন তাদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য রক্ষাকবচ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *