২.৬ আকবর জননী, হামিদাবানু

১১. আকবর জননী, হামিদাবানু

হুমায়ুন নিজে সর্বাগ্রে অবস্থান করে প্রধান তোরণদ্বারের নীচ দিয়ে, যার চূড়া থেকে মোগলদের সবুজ নিশান নামিয়ে নেয়া হয়েছে, অতিক্রম করার চার ঘন্টা পরে দূর্গ প্রাসাদ সরকার অবশেষে তাঁদের দৃশ্যপট থেকে মিলিয়ে যায়। উত্তরপশ্চিম দিকে মন্থর গতিতে ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে চলার সময় হুমায়ুন নিজের ভাবনায় বিভোর হয়ে পড়ে। মির্জা হুসেনের বাড়াবাড়ি রকমের আতিথিয়তার মাত্রা যদিও অব্যাহত ছিল কিন্তু সিন্ধে শুধু শুধু বসে থেকে সময়ক্ষেপনের কোনো মানে হয়না। তাঁকে সমর্থন করার লোকের সংখ্যা যখন প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে, তাকে সাহায্য করার জন্য মির্জা হুসেনের উপরে চাপ প্রয়োগের ক্ষমতা এখন হুমায়ুনের নেই এবং প্রতিটা দিন মনে হয় যেন তার জন্য অভিভব বয়ে আনছে।

পুনরায় যাত্রা শুরু কায়, সে একদিক দিয়ে স্বস্তি লাভ করে আর তাঁর অগ্রসর হবার গতি শ্লথ করে দেবে বলে যে চারটা কামান সে রেখে আসবে বলে মনস্থির করেছিল তার বদলে সে মির্জা হুসেনের কাছ থেকে বেশ ভালো রকমের মূল্যই উসুল করে নিয়েছে। নিজের অনাকাঙ্খিত অতিথির হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্য ব্যগ্র সুলতান দুই হাতে অর্থ ব্যয় করেছেন। নিজের বাহিনীর আহারের জন্য হুমায়ুনকে রসদ ও অন্যান্য উপকরণ সরবরাহ করা ছাড়াও তার বাহিনীকে বহন করার জন্য তিনি তাজা ঘোড়াও দিয়েছেন। সবকিছু যদি ঠিক থাকে তাহলে দুই মাসের ভিতরে সে মারওয়ারের মরুরাজ্যে উপস্থিত হবে সেখানের রাজপুত অধিপতি মালদেও তাঁকে সহায়তা করার জন্য মনে হয় যেন তার ভাইয়ের চেয়ে অনেক বেশী উদগ্রীব হয়ে আছে। রাজার প্রেরিত দূত, উজ্জ্বল রঙের আলখাল্লা পরিহিত দীর্ঘকায়, রোগা দেখতে এক লোক, তাঁর মাথার লম্বা চুল রাজপুত রীতিতে বেণী করে বাঁধা, সপ্তাহ দুয়েক পূর্বে সরকার এসেছিল। শেরশাহ সম্বন্ধে রাজা মালদেওয়ের ক্ষোভের কথা এবং তাঁর প্রতি রাজার শত্রতার কথা হুমায়ুনের কাছে সে বিস্তারিত বর্ণনা করেছে।

মোগলদের বিরুদ্ধে নিজের যুদ্ধে পরাধিকারপ্রবেশক শেরশাহ রাজার সহযোগিতা দাবী করেছেন। আমার প্রভু যদি তার সাথে যোগ দিতে অনীহা প্রকাশ করেন তাহলে মারওয়ার রাজ্যকে হুমকি দেবার ধৃষ্টতা দেখিয়ে সে আমার প্রভুকে অপমান করেছে। কিন্তু বাংলার জলাভূমি থেকে আগত একটা বর্ণসংকর কুকুরের সাথে আমার প্রভু কখনও মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হবে না। সুলতান, তিনি এর পরিবর্তে তার হাত বরং আপনার দিকে বাড়িয়ে ধরেছেন। মারওয়ারে তার সম্মানিত অতিথি হিসাবে তিনি আপনাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, যাতে করে আপনি আর আমার প্রভু আলোচনা করতে পারেন ভূঁইফোড়টার বিরুদ্ধে কিভাবে একত্রিত হওয়া যায়। আপনার সম্মতি নিয়ে তিনি অন্যান্য রাজপুত রাজাদের ডেকে পাঠাতে চান, শেরশাহের ধৃষ্টতায় যারা তার মতোই অপমানিতবোধ করেছে।

মাথার উপর দিয়ে নীচু হয়ে উড়ে যাওয়া এক ঝাঁক সবুজ টিয়াপাখির তীক্ষ্ণ কলরব হুমায়ুনকে বর্তমানে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। সে তারপাশে, সিন্ধে এক আরব ঘোড়া-ব্যবসায়ীর কাছ থেকে কেনা বাদামী রঙের দীর্ঘ গ্রীবার শক্তসমর্থ গড়নের স্ট্যালিয়নে উপবিষ্ট হিন্দালের দিকে আড়চোখে তাকায়।

আর দশ মাইল পরে আজ রাতের মতো আমরা ছাউনি ফেলবো, হুমায়ুন বলে।

আমাদের সেটাই করা উচিত। মেয়েরা ক্লান্ত হয়ে পড়বে…

কয়েকটা ভেড়া জবাই করে আমি বলবো রোস্ট করতে। আজ রাতে তুমি, আমি আর আমাদের পরিবারের মেয়েরা আমার তাবুতে আমাদের প্রধান সেনাপতি আর অমাত্যদের সাথে একসাথে আহার করবো। আমাদের সৈন্যদের জন্য আমি তাবুর বাইরে টেবিলের বন্দোবস্ত করতে বলবো। এটা আমাদের সবার মনোবল চাঙ্গা করবে…

আপনি কি সত্যিই মনে করেন যে মারওয়ারের রাজা আমাদের সাহায্য করবে?

কেন করবে না? আমি আমাদের মরহুম আব্বাজানকে প্রায়ই রাজপুত গর্বের কথা বলতে শুনেছি। মালদেও যদি সত্যিই বিশ্বাস করে যে শেরশাহ তাকে অপমান করেছে, সে সেই অপমানের প্রতিশোধ না নেয়া পর্যন্ত বিশ্রাম নেবে না এবং শেরশাহকে পরাভূত করতে নিজের রাজপুত যোদ্ধাদের সাথে করে আমাদের সঙ্গে যুদ্ধযাত্রা করার চেয়ে আর উত্তম পন্থা কি হতে পারে? অবশ্য রাজা এর প্রতিদান প্রত্যাশা করেন কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না রাজপুতদের সাহসিকতা কিংবদন্তীতুল্য। মালদেও একজন উপযুক্ত মিত্র বলে প্রতিপন্ন হতে পারে এবং আমি আগ্রায় নিজের সিংহাসনে যখন পুনরায় আরোহন করবো আমি তাকে এজন্য উপযুক্তভাবে পুরস্কৃত করব।

আপনি এখনও আমাদের রাজবংশ আর এর নিয়তিতে বিশ্বাস করেন, এতসব কিছু ঘটে যাবার পরেও…?

হ্যাঁ। কামরান আর আসকারির বিশ্বাসঘাতকতা আর এতো রক্তপাতের পরেও যখন আমি আমার সবচেয়ে হতাশাব্যঞ্জক মুহূর্তে এসব চিন্তা করি তখনও আমি এটা নিয়ে কোনো রকমের সন্দেহের দোলাচালে ভুগি না। আমি বিশ্বাস করি নিয়তি মোগলদের হিন্দুস্তানে নিয়ে এসেছে। তুমিও কি সেটা বিশ্বাস করো না?

হিন্দাল অবশ্য কোনো মন্তব্য করে না।

আমাদের মরহুম আব্বাজান তাঁর জীবনে বহু বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছেন এবং কখনও হতাশ হননি, হুমায়ুন জোর দিয়ে বলে। তোমার যদি আমার কথা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় তবে তাঁর লেখা রোজনামচাগুলো পড়ে দেখতে কিংবা ফুপুজানের সাথে কথা বলতে পার। খানজাদার বয়স হয়েছে কিন্তু আমাদের আব্বাজানের, আবেগ আমাদের পূর্বপুরুষদের আবেগ, তার মাঝে এখন সমুজ্জ্বল রয়েছে। তিনিই আমার আফিমের নেশা থেকে আমাকে মুক্ত করেছেন এবং আমাকে অনুধাবন করতে সাহায্য করেছেন যে মহত্বের বোধই কেবল যথেষ্ট না- যা ন্যায্যত আমাদের তাঁর জন্য ঘাম রক্ত ঝরাতে, এবং যুদ্ধ আর সংগ্রাম করতে আমাদের অবশ্যই প্রস্তুত থাকতে হবে।

আমাদের?

অবশ্যই। আমাদের মরহুম আব্বাজান যদিও আমাকে সম্রাট বলে ঘোষণা করেছেন, কিন্তু আমরা সবাই বাবরের সন্তান, সবাই মোগল নিয়তির অংশীদার তুমি, আমি এবং এমনকি কামরান আর আসকারিও। আমাদের সবার দায়িত্বও একই। আমাদের রাজবংশ বয়সে নবীন, ভিনদেশী এই মাটিতে এর শেকড় এখনও ভালোমতো প্রোথিত হয়নি, কিন্তু আমরা পারবো- আমরা হবও মহান যতক্ষণ না আমরা নিজেদের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে না ফেলবো বা একে অপরের সাথে লড়াই করে নিজেদের রাজবংশকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলবো।

আপনি সম্ভবত ঠিকই বলেছেন। মাঝেমাঝে, যদিও পুরো ব্যাপারটাই একটা বোঝার মতো মনে হয় যে আমার তখন কাবুলে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে, যে আমাদের মরহুম আব্বাজান হিন্দুস্তানের কথা কখনও শোনেননি… হিন্দালের তামাটে চোখের দৃষ্টিতে কেমন একটা অপ্রত্যয়ী অভিব্যক্তি এবং তাঁর দীর্ঘ, চওড়া দেহের কাঠামোটা মনে হয় যেন হতাশ হয়ে ঘোড়ার পর্যানে নুইয়ে পড়েছে।

হুমায়ুন হাত বাড়িয়ে ভাইয়ের পেষল কাঁধ স্পর্শ করে। আমি বুঝি, সে মৃদুকণ্ঠে বলে, কিন্তু জন্মগত কারণে আমরা যা পরিচয় সেখানে আমাদের আমাদের পছন্দের কোনো অবকাশ ছিল না।

তিনঘন্টা পরে, একটা নীচু, পাথুরে পাহাড়ের বায়ু আচ্ছাদিত দিকে রাতের মতো অস্থায়ী ছাউনির আগুন প্রজ্জ্বলিত করা হয় যা আহমেদ খান- নিজের গুপ্তদূতদের সাথে পুরো বহরের অগ্রে গমন করে- যা খুঁজে পেয়েছেন। হিন্দালের তাবুর ঠিক পাশে হুমায়ুনের টকটকে লাল রঙের বিশাল তাবুটা অস্থায়ী শিবিরের ঠিক কেন্দ্রে স্থাপন করা হয়। পঞ্চাশ গজ দূরে খানজাদা এবং গুলবদন আর তাঁদের পরিচারিকা এবং হিন্দালের সফরসঙ্গী হিসাবে যে গুটিকয়েক মহিলা রয়েছে তাদের জন্য তাবুর বন্দোবস্ত করা হয়েছে, পুরো এলাকাটার চারপাশে বৃত্তাকারে মালবাহী শকটের ঘোড়ার গায়ের দড়িগুলো পরস্পরের সাথে গিট বাঁধা অবস্থায় নিরাপত্তা ব্যুহ তৈরা করে রয়েছে।

মাটিতে আসনসিঁড়ি হয়ে বসে লোকেরা, তন্দুরের আগুনে সেঁকার জন্য ময়দা আর পানি দিয়ে মণ্ড তৈরী করছে। কাঠের ধোয়ার গন্ধের সাথে অচিরেই ভেড়ার মাংসের সুগন্ধ মিলেমিশে যেতে থাকে যখন রাঁধুনির সহকারীরা সদ্য জবাই করা ভেড়ার মাংসের টুকরোয় নুন মসলা মাখিয়ে সূক্ষপ্রান্তযুক্ত দণ্ডে বিদ্ধ করে আগুনের উপরে ঘোরাতে শুরু করে। আগুনের লকলক করতে থাকা শিখায় চর্বি গলে পরতে একটা হিসহিস শব্দ ভেসে আসে। তাবুর ভিতরে হুমায়ুন যখন হাতের দস্তানা খুলছে আর জওহর তার কোমর থেকে তরবারির পরিকর আলগা করছে তখন তার পাকস্থলী এই গন্ধে মোচড় দিয়ে উঠে।

জওহর লাহোর ত্যাগ করার পরে আমি এই প্রথম কোনো ভোজের আয়োজন করলাম। আমি নিজের প্রাসাদে একসময়ে যেমন ভোজসভার আয়োজন করেছি তার তুলনায় আজকের আয়োজনটা বেশ গরীবি হালে করা হয়েছে, চমৎকার একটা প্রদর্শনী করে আমাদের অবশ্যই সেটা পুষিয়ে নিতে হবে। প্রত্যেকে অবশ্যই তাদের পেট ভরে পানাহার করবে…আমার তাবুতে যারা আহার করবে তাদের জন্য সোনা আর রূপার পাত্র বের কর…এবং আমি চাই আজ তুমি আমাদের বাঁশি বাজিয়ে শোনাবে। আমি অনেক দিন তোমার বাঁশি বাজান শুনিনি।

সেদিন রাতে, হরিণের চামড়ার নরম পাতলুনের উপরে গাঢ় সবুজ রঙের জোব্বা পরিহিত হয়ে এবং কোমড়ের হলুদ পরিকরে রত্নখচিত খঞ্জর খুঁজে নিয়ে হুমায়ুন নিজের চারপাশে সন্তুষ্টির সাথে তাকায়। তার বামপাশে, হিন্দাল আর অন্যান্য বয়োজ্যোষ্ঠ আধিকারিকেরা অর্ধবৃত্তাকারে মাটিতে উপবিষ্ঠ অবস্থায় গল্পগুজবে মত্ত। জাহিদ বেগ ভেড়ার একটা হাড় নিয়ে মনের সুখে কামড়াচ্ছে। লোকটা দেখতে হ্যাংলা পাতলা হলে কি হবে, হুমায়ুনের যেকোনো সেনাপতিকে সে অনায়াসে খাবার প্রতিযোগিতায় হারাতে সক্ষম এবং সে নিজের এই দানবিক খাদ্যরুচির জন্য যারপরনাই গর্বিত। হুমায়ুন হাসিমুখে তাকিয়ে দেখে সে হাড়টা ফেলে দিয়ে নিজের ছুরির সাহায্যে রোস্ট করা মাংসের আরেকটা বড় টুকরো কেটে নেয়।

তাবুর দূরবর্তী প্রান্তে উঁচু পর্দার একটা ঘেরাটোপ যা তাঁদের অন্যদের দৃষ্টির আড়ালে রেখেছে, মহিলাদের ছোট দলটা আহারে বসেছে যেখানে গুলবদন আর খানজাদাও রয়েছে। তাঁদের কথোপকথনের ধ্বনি প্রায় নম্র নিঃশব্দ এবং তাঁদের হাসি পুরুষদের চেয়েও বেশী চাপা যদিও প্রায় একই রকম নিয়মিত। হুমায়ুন আশা করে যে তারা তাদের চাহিদামতো সবকিছু পেয়েছে এবং নিজে গিয়ে সেটা দেখবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। ঘেরাটোপের কিনারা থেকে ঘুরে তাকিয়ে সে গুলবদনকে পা নিজের দেহের নীচে মার্জিত ভঙ্গিতে ভাঁজ করে রেখে, তাঁর পাশেই বসা এক অল্পবয়সী মেয়ের সাথে কথা বলতে দেখে। মেয়েটার মুখের উপরে আলো আধারি খেলা করছে কিন্তু একটা পাত্র থেকে মিষ্টান্ন তুলতে সে যখন সামনে ঝুঁকে আসে, মোমের আলো তার মুখাবয়ব আলোকিত করে তুলে।

মেয়েটার মরাল গ্রীবার উপরে মার্জিত ভঙ্গিতে স্থাপিত তাঁর ছোট মাথা, তাঁর মুখমণ্ডলের ধুসর উপবৃত্তাকৃতি, মাথার ঝলমলে কালো চুল পেছন দিকে টেনে নিয়ে কারুকার্যখচিত চিরুনি দিয়ে আটকানো, আর তাঁর উজ্জ্বল দুটো চোখ, তাকিয়ে দেখতে গিয়ে হুমায়ুন টের পায় তার তলপেটে হাজার প্রজাপতির ডানা ঝাপটাতে শুরু করেছে, সহসা তাঁর দৃষ্টির আবেক্ষণ সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠতে, সে ঘুরে তাঁর দিকে তাকায়। তার চাহনীতে একাধারে বিস্ময় এবং বাস্তবতা- সম্রাটের দিকে তাকিয়ে রয়েছে বলে সেখানে কোনো প্রকার উত্তেজনা ছাপ পড়েনি- এবং এটা প্রায় আন্ত্রিক বিহ্বলতার একটা ঝাপটার মতো তাঁকে আপুত করে। হুমায়ুন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে মেয়েটা তাঁর চোখ নীচু করে এবং পুনরায় গুলবদনের দিকে তাকায়। তাঁর মুখপার্শ্বে- তার হাসির ভঙ্গি দেখে মনে হয় দুজনে কোনো একটা রসিকতা উপভোগ করছে- নিখুঁত চিবুক আর ক্ষুদে একটা নাক ফুটে আছে। তারপরে, পেছনে হেলান দিতে সে পুনরায় অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।

হুমায়ুন পুরুষদের মাঝে নিজের অবস্থানে ফিরে আসে, সৌজন্যতাবশত মেয়েদের ভালোমন্দের খোঁজ খবর নিতে গিয়ে সে নিজের হালহকিকত বিপর্যস্ত করে ফিরে এসেছে। এক ঝলক দেখা সেই অচেনা মুখটা তাঁকে এতোটাই তাড়িত করে যে খাবারের প্রতি মনোযোগ দেয়াটা তার কাছে অসম্ভব মনে হয়। সে অগত্যা তাঁর ভাইয়ের কাঁধে আলতো টোকা দেয়।

হিন্দাল, তোমার বোনের পাশে একজন অল্পবয়সী মেয়ে বসে রয়েছে, তাঁকে আমি ঠিক চিনতে পারলাম না। একটু গিয়ে দেখে আসবে, যদি তুমি তাকে চেনো তাহলে আমাকে জানাবে। হিন্দাল উঠে দাঁড়িয়ে ঘেরাটোপের দিকে এগিয়ে গিয়ে উঁকি দিয়ে ভেতরে তাকায়। তারপরে ধীরপায়ে ফিরে এসে হুমায়ুনের পাশে বসে।

চিনেছো?

হুমায়ুনের কাছে মনে হয় যে হিন্দাল উত্তর দেবার আগে একটু যেন ইতস্তত করে। মেয়েটার নাম হামিদা। আমার উজির, শেখ আলি আকবরের, কন্যা…

মেয়েটার বয়স কত?

 চৌদ্দ কি পনের বছর হবে…

 শেখ আলি আকবর কোনো গোত্রের লোক?

তার পরিবার পারস্য বংশোদ্ভূত, কিন্তু আমাদের আব্বাজানের সময়ে, উজবেকরা তাদের বিতাড়িত করার আগে, বহু যুগ ধরে তারা সমরকন্দের স্থায়ী অধিবাসী হিসাবে বসবাস করছিল। শেখ আলি আকবর যখন তরুণ তখন সেখান থেকে পালিয়ে আসেন এবং শেষ পর্যন্ত আমার আলওয়ার প্রদেশে এসে থিতু হন। সেখানে আমি তাকে আমার প্রধান পরামর্শদাতা হিসাবে নিয়োগ করি।

তাকে কি একজন ভালো পরামর্শদাতা বলা যাবে?

হ্যাঁ। এবং সম্ভবত তারচেয়েও বেশী কিছু। খ্যাতনামা এক সুফী সাধকের রক্ত তার ধমনীতে বইছে- জাম নগরের আহমেদ, যার ভবিষ্যতের ঘটনা আগাম বলতে পারার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় নিজের এই ক্ষমতার কারণে জিনদা-ফিল, সংহারক হস্তি নামে পরিচিত ছিলেন।

আগামীকাল সকালে আমরা রওয়ানা হবার পূর্বে শেখ আকবর আলিতে আমার কাছে পাঠিয়ে দেবে। আমি তার সাথে কথা বলতে চাই।

সেই রাতে হুমায়ুন দুচোখের পাতা এক মুহূর্তের জন্যও বন্ধ করতে পারে না। সরকারে অবস্থানকালে মির্জা হুসেনকে যদিও সে বলেছিল নিজের সিংহাসন পুনরুদ্ধার না করে সে দার পরিগ্রহ করবে না, নিজের মনে সে খুব ভালো করেই জানে যে হামিদাকে সে অবশ্যই বিয়ে করবে। যুক্তি কিংবা ভাবনার কোনো স্থান নেই এখানে, তার পূর্বেকার কোনো প্রেমিকার জন্য সে নিজের এতো তীব্র আবেগ কখনও অনুভব করেনি, এমনকি সালিমাকেও সে এতোটা পছন্দ করতো না। এটা হামিদাকে একান্তভাবে নিজের করে পাবার আকাঙ্খ কেবল না- যদিও এটা নিশ্চিতভাবে এর একটা অংশ। সহজাত প্রবৃত্তির বশে সে বুঝতে পেরেছে মেয়েটার একটা সুন্দর মন আছে, সেখান থেকে তাঁর দিকে আধ্যাত্মিক শক্তির একটা বিকিরণ ঘটছে। সে জানে যে হামিদা কেবল তাকে সুখীই করবে না, সেই সাথে সে তার পাশে থাকলে হুমায়ুন নিজেকে প্রজাপ্রিয় একজন শাসক হিসাবে গড়ে তুলতে পারবে, নিজের আকাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনে আরও যোগ্য হয়ে উঠবে। সে যতই এসব ভাবনাকে অযৌক্তিক বলে বাতিল করতে এবং এসব বয়ঃসন্ধিকালের লাজুক নম্রতার সাথে বেশী মানানসই বলে নিজেকে যতই বোঝাতে চেষ্টা করে, ভাবনাগুলো নতুন করে প্রবলভাবে ফিরে ফিরে আসতে চায়। চারণকবির দল একেই কি প্রেমে পড়া বলেছেন?

পরের দিন সকালে দিনের আলো ফোঁটার অনেক আগে হুমায়ুন শয্যা ত্যাগ করে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে রাজোচিত আলখাল্লা পরিহিত অবস্থায় পরিচারকদের সবাইকে বিদায় করে দিয়ে অসহিষ্ণুচিত্তে অপেক্ষা করতে থাকে। তাঁর লোকদের মাঝে অনেকক্ষণ পরে প্রাণচাঞ্চল্য দেখা দিতে শুরু করে, গতরাতের আগুনকুণ্ডের গনগনে কয়লায় তারা লাথি মেরে আগুন উসকে দিয়ে নিজেদের তাবু আর অন্যান্য সরঞ্জামাদি গুছিয়ে নিতে শুরু করে যাত্রা আরম্ভ করার জন্য নিজের প্রস্তুত করতে থাকে। হুমায়ুন এবার তার তাবুর বাইরে থেকে পায়ের শব্দ ভেসে আসতে শুনে এবং জওহর তাবুতে প্রবেশপথের পর্দা তুলে ধরতে শেখ আলি আকবর মাথা নীচু করে ভেতরে প্রবেশ করে।

সুলতান, আপনি আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছেন। শেখ সাহেব দেখতে বেশ লম্বা এবং নিজের মেয়ের মতোই চমৎকার দেহ সৌষ্ঠবের অধিকারী। তিনি মার্জিত ভঙ্গিতে হুমায়ুনকে কুর্নিশ করে এবং অপেক্ষা করতে থাকে।

গতরাতে আয়োজিত ভোজসভায়, আমি আপনার মেয়ে হামিদাকে দেখেছি। আমি তাকে আমার স্ত্রী রূপে গ্রহণ করতে চাই। সে হবে আমার সম্রাজ্ঞী এবং ভবিষ্যত সম্রাটের জননী… হুমায়ুন গড়গড় করে বলতে শুরু করে।

শেখ আলি আকবর বিস্মিত দৃষ্টিতে কেবল তাকিয়ে থাকে।

শেখ আলি আকবর, আসলে ব্যাপারটা হল? হুমায়ুন নাছোড়বান্দার মতো বলতে থাকে।

মেয়েটা এখনও কিশোরী…

তাঁর বয়সী অনেক মেয়েরই বিয়ে হয়ে গিয়েছে। আমি আপনাকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, তার কোনো রকমের অযত্ন আমি হতে দেবো না…

কিন্তু আমাদের পরিবার এই সম্মানের উপযুক্ত না…।

আপনারা সমরকন্দ থেকে আগত সম্ভ্রান্তজন…আমার নিজের আম্মিজানের সাথে আমার আব্বাজান যে আচরণ করেছিলেন আমি যদি আপনার কন্যাকে সেভাবে আরও সম্মানিত করতে চাই তাহলে কেন এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করছেন? আমার আম্মিজানের পিতা- আমার নানাজী বাইসানগার- আপনার মতোই সমরকন্দের একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন।

শেখ আলি আকবর চুপ করে থাকে, কোনো কথা বলে না। বিমূঢ় হুমায়ুন এবার তাঁর দিকে এগিয়ে যায়। লোকটার চোখে মুখে ফুটে উঠা অস্বস্তি দেখে বোঝা যায় কোনো একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। কি ব্যাপার বলেনতো? এমন প্রস্তাবে বেশীর ভাগ পিতারই উল্লসিতবোধ করার কথা।

সুলতান, আমার জন্য এটা একটা অকল্পনীয় সম্মান। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি…না ভুল বললাম, আমি জানি… আপনার সৎ-ভাই হিলাল হামিদার প্রতি দুর্বল। হিন্দাল তাঁকে খুব অল্প বয়স থেকেই চেনে। আমি তার নুন খেয়েছি এবং সুলতান, আপনাকে এসব বিষয়ে অবহিত না করে তাঁকে যদি আমি অন্যকারো হাতে তুলে দেই, এমনকি সেটা যদি আপনিও হন, ব্যাপারটা আমার জন্য অবাধ্যতারই পরিচায়ক হবে।

তাঁদের বাগদান কি হয়ে গিয়েছে?

না, সুলতান।

 আর হামিদা। তার কি অভিপ্রায়?

সুলতান, এটা আমি ঠিক বলতে পারবো না। এসব বিষয়ে আমি কখনও তাঁর সাথে আলোচনা করিনি এবং আমার স্ত্রী বেঁচে থাকলে তিনি এসব বিষয়ে তাঁর সাথে আলোচনা করতে পারতো… হামিদার জন্মের ঠিক পরপরই তাঁর মা একটা অজানা জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করে।

আপনি নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণ করেছেন। আমি এটা সম্মান করি কিন্তু সেই সাথে আমি আপনার মেয়ের সাথে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হতে চাই। আজ থেকে এক সপ্তাহের ভিতরে আশা করি আমি আপনার মনোভাব জানতে পারবো। আর শেখ আলী…আমার ভাই আমাকে বলেছে যে এক মহান ভবিষ্যদর্শীর রক্ত আপনার ধমনীতে বহমান, যিনি ভবিষ্যতের ঘটনাবলী আগাম বলে দিতে পারতেন…আপনি যদি তার বিন্দুমাত্র গুণ লাভ করে থাকেন তবে ভবিষ্যত দেখতে পাবার সেই ক্ষমতা আপনি এবার কাজে লাগাতে পারেন। আপনি দেখতে পাবেন যে আপনার কন্যা মহীয়সী আর সুখী হবে যদি আপনি তাকে আমার হাতে তুলে দেন।

সুলতান। কিন্তু শেখ আকবর আলি বিদায় নেবার জন্য যখন ঘুরে দাঁড়ায় তাঁর মুখাবয়বে তখনও উদ্বেগ আর অশান্তি খেলা করে। শেখ আলি আকবর যখন বাইরে বের হবার জন্য প্রবেশপথের পর্দা একপাশে সরিয়ে দিতে, তাবুর ভিতরটা দিনের প্রথম সূর্যালোক উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে, একমুহূর্তের জন্য হুমায়ুনের চোখ ধাঁধিয়ে যায়।

সেদিনই দুপুরের দিকে, হুমায়ুন কিছুক্ষণ একাকী থাকবার অভিপ্রায়ে মূলসৈন্যসারি ত্যাগ করে এবং দুলকীচালে একাকী ঘোড়া দাবড়াতে আরম্ভ করে। ঘোড়ার খুরের ছন্দোবদ্ধ আওয়াজ তাঁর কানে তালা লাগিয়ে দেয়, সে এখনও এতো আকষ্মিক, এতো প্রবল, আর এতো অপ্রত্যাশিত অনুভূতির সাথে খাপ নিতে চেষ্টা করছে। অন্য আর কোনো মেয়ে তার মাঝে এমন চাঞ্চল্য সৃষ্টি করতে পারেনি। তাঁর হৃদয়ের ভিতরে অবশ্য একটা অশুভ ভাবনা ঘাপটি মেরে থাকে একটা অপরাধবোধ যে নিজের সৎ-ভাইয়ের ভালোবাসার নারীকে সে নিজের স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করতে চাইছে। কিন্তু সে কিছুতেই হামিদার অপরূপ মুখশ্রী, তার ঝকঝকে ব্যক্তিত্ব নিজের মন থেকে মুছে ফেলতে পারে না। সে হামিদাকে তাঁর সম্রাজ্ঞী করবে আর সে হিন্দালের অনুভূতিকে তার যতই আঘাত করতে হোক।

সেদিন সন্ধ্যাবেলা, একটা পিতলের গামলায় জওহরের নিয়ে আসা ঠাণ্ডা পানি দিয়ে হুমায়ুন যখন তার চোখেমুখে ঝাপটা দিচ্ছে তখন সে তার তাবুর বাইরে বেশ কয়েকজনকে উচ্চকণ্ঠে আলাপ করতে শোনে। তারপরেই ঝড়ের বেগে হিন্দাল তাবুর ভিতরে প্রবেশ করে, তার পরনে তখনও সারাদিনের যাত্রার পরে ধূলো আর ঘামে ভেজা অশ্বারোহীর পোষাক।

এটা কি সত্যি? হিন্দালের কণ্ঠস্বর সংযত কিন্তু চোখে দাবানলের পূর্বাভাষ।

কোনটা কি সত্যি? হুমায়ুন জওহরকে ইঙ্গিতে বাইরে যেতে বলে।

শেখ আলি আকবর আমাকে বলেছে আপনি নাকি হামিদাকে বিয়ে করবেন বলে মনস্থির করেছেন।

হ্যাঁ। তাকে আমি আমার স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করতে চাই।

সে… সে আমার উজিরের কন্যা। আমি তাকে ছোট থেকে বড় হতে দেখেছি… তার প্রতি আপনার চেয়ে আমার দাবী অনেকবেশী জোরাল… হিন্দালকে স্নায়ুবিকারগ্রস্থ একজন মানুষের মতো দেখায়।

তোমাকে আঘাত দেয়াটা আমার অভিপ্রায় না কিন্তু একটা সময় এটা প্রশমিত হবে। তুমি আরেকজন রমণীকে খুঁজে পাবে যে তোমাকে প্রীত করবে…

গত কয়েকমাস একসাথে কাটাবার পরে আমি মনে করেছিলাম আমরা বোধহয় পরস্পরকে খানিকটা হলেও চিনতে পেরেছি। আপনাকে আমি বিশ্বাস করতাম। আমি আপনাকে সমর্থন করেছি যখন কামরান আর আসকারির মতো আমিও অন্য কোথাও নিজের ভাগ্য অন্বেষণ করতে পারতাম আর তার ফলাফল হয়ত ভালোই হত। আপনাকে অনুসরণ করে এটা আমি কি পুরষ্কার পেলাম? কিস্যু না! লাহোর থেকে আমরা বলতে গেলে প্রায় দুপায়ের ফাঁকে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে বেঁচেছি। সিন্ধে আমাদের ভাগ্য বলতে হবে প্রসন্নই ছিল- নিজেদের মানসম্মান নিয়ে সরে আসবার পূর্বে মির্জা হুসেন আমাদের সাথে পোষা কুকুরের মতো আচরন করেছে। কিন্তু আমি তারপরেও বিশ্বস্ত থেকেছি আর আমার অধীনস্ত যোদ্ধাদের মনোবল চাঙ্গা রাখতে চেষ্টা করেছি, এই আশায় যে শীঘ্রই শেরশাহের বিরুদ্ধে আমি আর আপনি কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হব। আপনি এর পরিবর্তে, নিশিকুটুম্বের মতো, তিলেকমাত্র চিন্তা ভাবনা না করে, আমাদের পরিবারের প্রধান হিসাবে নিজের অবস্থানের অপব্যবহার করে আমি যে মেয়েকে ভালোবাসি তাকে আমার কাছ থেকে চুরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন…

বিশ্বাস কর, তাঁর বাবার সাথে কথা বলার আগ পর্যন্ত আমি জানতাম না যে তুমি তাকে পছন্দ কর।

কিন্তু আপনি যখন বিষয়টা জানতে পেরেছেন তখনও আপনি নিজেকে সংযত করেননি, তাই না? হিন্দাল তার দিকে এগিয়ে আসে। কামরান আর আসকারি

ন ৩২.পণ ও এ এম এম ঠিকই বলতো। আপনি হলেন আপনার নিজের ব্রহ্মাণ্ডের স্বনিয়োজিত কেন্দ্র। বছরের পর বছর আপনি আমাদের কেবল অবহেলাই করেছেন, আমাদের প্রত্যেককে নিজ নিজ প্রদেশে পড়ে পড়ে পচার জন্য ফেলে রেখে পুরোটা সময় আপনি মহান সম্রাটের নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। শেরশাহের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হবার পরে আমাদের সাহায্য যখন আপনার প্রয়োজন হয়েছে। কেবল তখনই আপনি আমাদের সবার অলিখিত শত্রুর বিরুদ্ধে একতা আনয়ন, ভ্রাতৃসুলভ দায়িত্ব নিয়ে বড় বড় কথা বলতে আরম্ভ করেছেন।

হিন্দালের কণ্ঠস্বর এখন প্রায় চিল্কারের পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং অবদমিত ক্রোধের কারণে সে প্রায় থরথর করে কাঁপছে। সহজাত প্রবৃত্তির বশে, হুমায়ুন সিন্দুকের দিকে তাকায় যার উপরে জওহর কিছুক্ষণ আগে কারুকার্যময় ময়ানে রক্ষিত আলমগীর রেখে গিয়েছে। তাঁর খঞ্জর অবশ্য এখনও তার সাথেই রয়েছে এবং তার কোমরের পরিকরের নীচে পাঁজরের কাছে সে এর শক্ত ধাতব বাটের অস্তি ত্ব বেশ অনুভব করতে পারে।

ছোট ভাই, যা বলছো একটু ভেবেচিন্তে বল…

কেবল সৎ-ভাই।

তুমি এখন ভুলে গেছো কেন অন্যদের সাথে তোমাকেও আমি আগ্রা থেকে সরিয়ে দিয়েছিলাম। তোমরা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলে। তোমাদের কৃতকর্মের জন্য আমি মৃত্যুদণ্ড দিতে পারতাম… আমি তোমাদের সবার জান বখশ দিয়েছিলাম।

আমি তখন মাত্র কৈশোর অতিক্রম করেছি, বয়সটাই ছিল সহজে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হবার। আপনি যদি আমার প্রতি সামান্যতম আগ্রহ প্রদর্শন করতেন, আমার দ্বারা এমন ঘটনা কখনও সংঘটিত হতো না। কিন্তু আপনি তখন কেবলই নক্ষত্রের দিকে নির্নিমেষ চোখে তাকিয়ে থাকতেন… আমি ছেলেটা আসলেই কেমন, আমার আশা এবং আকাঙ্খগুলোর রং কেমন, আপনি কখনও এসব জানবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেননি। আমার কাছ থেকে আপনি কেবল প্রশ্নতীত আনুগত্য এবং আজ্ঞানুবর্তিতা কামনা করেছেন যাতে করে আপনি নিজের উচ্চাকাঙ্খ বাস্তবায়িত করতে পারেন…

হুমায়ুন তার এই সৎ-ভাইটিকে এতো প্রাণবন্ত ভঙ্গিতে কথা বলতে বা চোখে দেখেনি। সে ঘনঘন শ্বাস নেয়। তার পুরো মুখটা টকটকে লাল হয়ে আছে এবং নাসারন্ধ্র প্রসারিত আর কপালের পাশে রক্তবাহী একটা শিরা দপদপ করছে।

হিন্দাল, এই বিষয়টা নিয়ে তর্ক করাটা আমাদের উচিত হবে না। বিশ্বাস কর, নতুন মেয়ে মানুষের জন্য এটা কোনো খেয়াল বা ক্ষনিকের মোহ নয়। আমি এই ব্যাপারটা নিয়ে কোনো প্রকার পরিকল্পনা করিনি- ব্যাপার কেমন করে যেন ঘটে গিয়েছে। ভোজসভায় তাকে আমি যখন দেখেছি তখনই আমি জানি…

কিন্তু হিন্দালকে দেখে মনে হয় এসব কিছুই শুনছে না। কোনো ধরনের আগাম পূর্বাভাষ না দিয়ে সে সহসা হুমায়ুনকে লক্ষ্য করে ঝাঁপিয়ে পড়ে, অপ্রস্তুত থাকার কারণে সে দ্রুত সরে যেতে পারে না। হিন্দালের পেষল হাতের মুঠি হুমায়ুনের কাঁধে চেপে বসে এবং পরমুহূর্তে হুমায়ুন নিজেকে ঢালাই লোহার লম্বা ধূপদানের উপরে। আছড়ে পড়তে দেখে।

তাবুর ভেতরে ধ্বস্তাধ্বস্তির শব্দ শুনে হুমায়ুনের দেহরক্ষীরা দ্রুত ভেতরে প্রবেশ করে। না! সে চিৎকার করে উঠে, ইঙ্গিতে তাঁদের হস্তক্ষেপ করতে মানা করে। হিন্দাল আবারও তাকে লক্ষ্য করে এগিয়ে আসতে শুরু করে এবং হুমায়ুন টের পায় তাঁর পাঁজরে সৎ-ভাইয়ের নাগড়া পরা পা এসে সজোরে আঘাত করেছে, তার বুক থেকে সব বাতাস বের হয়ে গেলে সে নিঃশ্বাসের অভাবে হাঁসফাঁস করতে শুরু করে। কিন্তু যৌবনের উদ্যম দিনগুলোতেই হুমায়ুন নিজেকে একজন তুখোড় কুস্তিগীর হিসাবে গড়ে তুলেছে- শক্তিধর এবং দ্রুতগতিসম্পন্ন এবং নিজের সেই নৈপূণ্য সে এখনও বিস্মৃত হয়নি। হিন্দাল তাকে আবারও লাথি মারতে চেষ্টা করতে সহজাত প্রবৃত্তির বশে সে তার পা আকড়ে ধরে এবং গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে সেটা মুচড়ে দেয়। দেহের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যেতে, হিন্দালের ভারী দেহটা একপাশে কাত হয়ে যায় এবং হুমায়ুন যেখানে তাঁর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ গচ্ছিত রাখে কোহ-ই-নূর আর তার আব্বাজানের নিজের হাতে লেখা রোজনামচার খাতাগুলো লোহা দিয়ে মোড়া সেই সিন্দুকের কিনারায় সে নিজের মাথা দিয়ে সজোরে আঘাত করে।

কপাল থেকে টপটপ করে গড়িয়ে পড়া রক্ত আর চোখেমুখে একটা বিমূঢ় অভিব্যক্তি নিয়ে হিন্দাল টলমল করতে করতে নিজের পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। সে নিজেকে সুস্থির করার আগেই হুমায়ুন মাথা নীচু করে সামনে এগিয়ে আসে এবং নিজের গতি আর ভরবেগ ব্যবহার করে হিন্দালের ভারী দেহ মোকাবেলা করে। হিন্দালের বাম পা পেছন থেকে নিজের ডান পা দিয়ে আকড়ে ধরে, সে তাঁকে পেছনের দিকে ঠেলে দিতে সক্ষম হয় এবং নিজের দেহের ভর তার উপরে চাপিয়ে দিয়ে দুজনে একসাথে মাটিতে আছড়ে পড়ে, হুমায়ুন তার উপরে থাকে। হিন্দালের মোষের মতো মাথাটা সে দুহাত দিয়ে আকড়ে ধরে টেনে তুলে এবং তারপরে সেটা সজোরে মাটিতে ঠুকে দেয়। হিন্দাল তার দেহের নীচে যন্ত্রণায় মোচড়াতে শুরু করে, চেষ্টা করে তাকে সরিয়ে দিতে কিন্তু হুমায়ুনের আঙ্গুলগুলো ততক্ষণে মৃত্যুর বারতা নিয়ে তার শ্বাসনালীতে চেপে বসতে শুরু করেছে। হিন্দালের শ্বাসপ্রশ্বাসের বেগ ঘ্যঁসঘেঁসে ফোপানির সাথে দ্রুততর হতে থাকে, পাগলের মতো তার দেহ মোচড়াতে শুরু করলে আরেকটু হলেই হুমায়ুন ছিটকে পড়তো। অবশ্য নিজের দুই উরু দিয়ে যত জোরে সম্ভব হিন্দালকে আকড়ে ধরে থাকায় হুমায়ুন তার উপরেই অবস্থান করে এবং তার হাত আরো জোরে ভাইয়ের গলায় চেপে বসতে থাকে।

নিজের দেহের নীচে হিন্দালের দেহ নিস্তেজ হয়ে পড়ছে টের পেয়ে, সে চোখ নামিয়ে তার মুখের দিকে তাকায়। পুরো ব্যাপারটা ভাওতা হতে পারে, মল্লযুদ্ধে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সে নিজেও বহুবার এই কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু হিন্দালের চোখ বন্ধ এবং রক্ত জমে তার মুখ বেগুনী বর্ণ ধারণ করেছে। হুমায়ুন নিজের মুঠি শীথিল করে এবং ভাইয়ের উপুড় হয়ে থাকা দেহের কাছ থেকে সাবধানে উঠে দাঁড়ায়, পুরোটা সময় এক মুহূর্তের জন্যও তার উপর থেকে চোখ সরায় না।

বাতাসের জন্য হাঁসফাঁস করতে থাকা হিন্দাল হাপড়ের মতো মুখ করে জোরে জোরে শ্বাস নিতে চেষ্টা করে এবং হাত দিয়ে নিজের গলা আকড়ে ধরে, হুমায়ুন সেদিকে তাকিয়ে দেখে ইতিমধ্যে সেখানে কালসিটে পড়তে আরম্ভ করেছে। কিছুক্ষণ পরে, সদ্য লড়াইয়ে পরাভূত হওয়া বিশাল একটা ভালোকের মতো টলোমলো পায়ে সে উঠে দাঁড়ায়। তার কপালের ক্ষতস্থান থেকে এবার প্রবলভাবে রক্তপাত শুরু হতে তাঁর পরনের জোব্বার সামনের অংশ নিমেষে রক্তে লাল হয়ে উঠে। কিন্তু সে ঘুরে হুমায়ুনের দিকে পরিষ্কার, উজ্জ্বল আর অবজ্ঞাপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়।

বেশ তাহলে আপনিই তাকে গ্রহণ করেন। আপনি আমাদের সম্রাট আর এই একটা বিষয় আমাকে স্মরণ করিয়ে দিতে আপনি কখনও ক্লান্তিবোধ করেন না। কিন্তু ভবিষ্যতে আবারও আপনার সাথে আমার দেখা হতে পারে এমন আশা পোষণ করবেন না। আজ এখানে আমাদের মৈত্রীর সমাপ্তি ঘটল। আজ রাতেই আমি আমার লোকজন নিয়ে এখান থেকে বিদায় নেব।

আমি তোমাকে আঘাত করতে চাইনি। তুমি আমাকে বাধ্য করেছে। মাথা গরম করে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে যেও না…হামিদাকে তোমার কাছ থেকে কেড়ে নেবার কোনো পরিকল্পনা আমার মাথায় ছিল না… কিন্তু তাঁকে যখন আমি দেখি আমি সেই মুহূর্তে বুঝতে পারি এটাই নিয়তির লিখন…।

হিন্দালের রক্তাক্ত মুখে বিদ্রুপাত্মক একটা হাসি ফুটে উঠে। নিয়তির লিখন…? মানুষের অভিব্যক্তি আপনি এখনও বুঝতে পারেন না, তাই না, এমনকি আপনার নিজের ভাইদেরও না। আপনি সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা জগতের বাসিন্দা যেখানে আপনি নিজের আকাঙ্খাকে ভুল করে নিয়তি ভেবে বসেছেন এবং কামনা করছি এটা আপনার জন্য সৌভাগ্যই বয়ে আনবে। ভাইজান, বিদায়। হিন্দাল এবার দেহের শেষ শক্তিটুকু ব্যয় করে সোজাভাবে দণ্ডায়মান হয় এবং ধীরে কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে মেঝের গালিচার উপরে থুতু ফেলে, আর রক্তাক্ত শ্লেষ্মার একটা দলা গিয়ে হুমায়ুনের ডান পায়ের নাগড়ার ঠিক সামনে পড়ে। তারপরে, পিছন দিকে একবারও না তাকিয়ে তাবুর প্রবেশ পথের দিকে ধীরে, যন্ত্রণাক্লিষ্ট ভঙ্গিতে হেঁটে যায় কিন্তু পুরোটা পথ তাঁর পিঠ টানটান সোজা হয়ে থাকে, হুমায়ুনের দেহরক্ষীর দল দুপাশে সরে গিয়ে তাকে যাবার স্থান করে দিতে সে ডানেবামে কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা তাবু থেকে বের হয়ে যায়।

হুমায়ুন মুহূর্তের জন্য আবেগআপ্লুত হয়ে তাকে আটকাবার জন্য যেতে চায় কিন্তু কি লাভ হবে গিয়ে? রাগের বশবর্তী হয়ে তারা পরস্পরকে যা বলেছে এরপরে সম্পর্ক আর কখনও পূর্বাবস্থায় ফিরে যাবে না। জওহর, সে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠে। জওহর তাঁর পাশে এসে দাঁড়ান মাত্র, হুমায়ুন অন্য কেউ যাতে আড়ি পেতে শুনতে না পায় সেজন্য নীচুকণ্ঠে দ্রুত আদেশ দিতে শুরু করে। আমার দেহরক্ষী বাহিনীকে কালক্ষেপন না করে দ্রুত আমার ভাইয়ের সফরসঙ্গী হিসাবে আগত মহিলাদের নির্ধারিত তাবুতে প্রেরণ কর। আমার ভাইয়ের উজির, শেখ আলি আকবরের কন্যা, হামিদাবানুকে তাঁরা খুঁজে বের করবে, এবং যথাযথ সম্মান প্রদর্শনপূর্বক তাকে আমার ফুপুজানের কাছে পৌঁছে দেবে। আমার আদেশটা দ্রুত তাঁদের কাছে পৌঁছে দাও এবং আদেশটা পালিত হওয়া মাত্র আমি যেন খবরটা পাই…

আধঘন্টা পরে, জওহর এসে হুমায়ুনকে জানায় যে হামিদাবানুকে তাঁর ফুপুজান খানজাদার হেফাজতে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। হুমায়ুন তাবুর বাইরে থেকে লোকজনের ইতস্তত দৌড়াদৌড়ি আর চিৎকারের শব্দ, ষাড়ের হাম্বা ডাক, লাগামের রিনিঝিনি শব্দ আর ঘোড়ার চিহি রব ভেসে আসতে শুনে। তাবুর পর্দার ফাঁক দিয়ে। উঁকি দিয়ে পাত্রে রক্ষিত জ্বলন্ত কয়লার কমলা আগুনে সে দেখে যে হিন্দালের লোকেরা শিবিরের মাঝে সহসা একটা বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে। তার সৎ-ভাইয়ের তাবু এর ভিতরে গুটিয়ে নেয়া হয়েছে এবং সেটা এখন একটা মালবাহী শকটে তোলা হচ্ছে। হুমায়ুন বাইরের দিকে আনমনে তাকিয়ে থাকার মাঝেই হঠাৎ একটা পরিচিত অবয়বকে হট্টগোলের ভিতরে দ্রুত তার তাবুর দিকে এগিয়ে আসতে দেখে।

হুমায়ুন, তুমি এটা কি করেছো? …শেষ পর্যন্ত কি তোমার বুদ্ধিনাশ হল? হুমায়ুনের তাবুর ভেতরে প্রবেশ করার আগেই খানজাদা বাইরে থেকেই চিৎকার জুড়ে দেন। হিন্দাল এইসময়ে চলে গেলে তুমি কিভাবে সফলতা আশা করতে পার? এবং এসবের পেছনে রয়েছে এক পলকের জন্য তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে এমন একটা মেয়ে, সেই মেয়ে যার সাথে তুমি এমনকি কখনও কথাও বলনি এবং আমাকে কিছু না জানিয়ে যাকে তুমি আমার হেফাজতে প্রেরণ করেছে। সে তার ফুপুজানকে এর আগেও বহুবার ক্রুদ্ধ হতে দেখেছে কিন্তু কখনও তাঁর চোখের তারায় এমন হতবুদ্ধি করা নির্মমতা ভাসতে দেখেনি। এসব পাগলামি বন্ধ কর। দেরী হয়ে যাবার আগেই এখনই হিন্দালের সাথে দেখা কর এবং তাঁকে বলল যে মেয়েটার উপর থেকে তুমি তোমার দাবী প্রত্যাহার করে নিচ্ছো।

ফুপুজান, আমি এটা পারবো না। ব্যাপারটা এমন একটা পর্যায়ে গিয়েছে যে আমার আর কিছুই করার নেই…

যত্তসব ফালতু কথা! অব্যাহত গতিতে কাছে এগিয়ে এসে, তিনি তার চোখের দিকে তাকান। তুমি কি আবার আফিম সেবন শুরু করেছো? দৃষ্টিবিভ্রম ঘটছে? সেজন্যই কি তুমি এমন পাগলের মতো আচরণ করছো? আমি হিন্দালের রক্তাক্ত মুখ আর গলার কালসিটে দাগ দেখেছি… সেটা কি কোনো সম্রাটের মতো আচরণ হয়েছে, ঠ্যাঙারে মার দিয়ে তাঁকে ধরাশায়ী করে তারপরে তাঁকে নিজের শিবির থেকে বিতাড়িত করা?

সে আমাকে আক্রমণ করেছিল…

সেটা কোনো কাজের কথা না। হিন্দুস্তানে তোমার সাম্রাজ্যের ভবিষ্যত যখন সবচেয়ে বেশী অনিশ্চিত, যখন তোমার মিত্রের সংখ্যা হাতে গোনা যায় তখন সে তোমার প্রতি বিশ্বস্ত থেকেছে। তোমার এই সর্বশেষ পাগলামি আমাদের ভীষণ বিপদের মধ্যে ফেলেছে- লাহোর থেকে তোমার সাথে যারা এসেছিল তাঁদের ভিতরে কতজন এখনও তোমার সাথে রয়েছে? মাত্র আট কি নয় হাজার হবে। সংখ্যাটা আমি জানি কারণ কাশিম আমাকে বলেছে। এখন যদি হিন্দালও চলে যায় তাহলে তোমার সাথে আর কতজন লোক থাকবে? খুব বেশী হলে পাঁচ কি ছয় হাজার। আর তারা যদি একবার তোমার সিদ্ধান্তের প্রতি সন্দিহান হয়ে উঠে তাহলে তাদের ভেতরে কতজন লোক শেষ পর্যন্ত তোমার সাথে থাকবে? শীঘ্রই ডাকাতি আর রাহাজানির হাত থেকে আমাদের রক্ষা করার মতো পর্যাপ্ত লোকই তোমার সাথে থাকবে না, সিংহাসন পুনরুদ্ধারের কথা না হয় বাদই দিলাম। আর এসব ঘটবে স্বার্থপর, অসংযত, বল্গাহীন কামনার বশবর্তী…।

না। হামিদার প্রতি যখনই আমার দৃষ্টি আকর্ষিত হয়েছে, কেবল শারীরিক কামনা ছাড়াও আমার একেবারে ভিন্ন একটা অনুভূতি হয়েছে, এমন একটা অনুভূতি যার অভিজ্ঞতা আগে কখনও আমার হয়নি…আমি বুঝতে পেরেছি যে ভালোবাসা আমাকে আপুত করে ফেলেছে এবং তাকে আমি আমার স্ত্রী হিসাবে চাই। আমি কখনও কল্পনাও করিনি যে এমন কিছু একটা আমার জীবনে ঘটতে পারে কিন্তু তারপরেও সেটাই ঘটেছে। আমি শপথ করছি সুরা আর আফিম আমার মাথা ঘুলিয়ে দিয়ে আমাকে বিভ্রান্ত করেনি। আমার মন পরিষ্কার আর আমি জানি আমি যা করছি ঠিক করছি। ফুপুজান … সে তার কাঁধে আলতো করে একটা হাত রাখে, আমার প্রতি একটু ভরসা রাখেন এবং এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরনে আমাকে সাহায্য করেন…আমি আপনার কাছে মিনতি করছি…।

আমি পারবোনা। হুমায়ুন, আমার বয়স হয়েছে। এই জীবনে অনেক কিছু আমি দেখেছি, অনেক কষ্ট সহ্য করেছি, নতুন করে কোনো ঝামেলা কাঁধে নেবার মতো শক্তি আমার আর নেই। বাবর মারা যাবার সময় থেকে তাকে দেয়া আমার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আমি চেষ্টা করেছি তোমাকে সাহায্য করতে। নির্ভীক যোদ্ধা হিসাবে তুমি নিজেকে প্রমাণ করেছে কিন্তু সত্যিকারের একজন সম্রাট হতে হলে তোমাকে এখনও অনেক কিছু শিখতে হবে আর আমার মনে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে তুমি সেটা আদৌ শিখতে পারবে। তোমার আব্বাজানের থেকে তুমি একেবারেই আলাদা। বাবর সবসময়ে মাথা খাঁটিয়ে চলতো। তাঁর বিয়েগুলো- এমনকি তোমার আম্মিজান যাকে সে ভালোবাসতো তার সাথে বিয়েটাও ছিল বিবেচনাপ্রসুত পদক্ষেপ। সে কখনও একজন স্বার্থপর ছেলের মতো আচরণ করতে না যে পরিণতি বিচার না করেই সবসময়ে নিজের কামনা আর লালসাকে প্রাধান্য দেয়। প্রথমে আফিম। আর এখন এটা।

কিন্তু ফুপিজান, আমি আপনাকে বারবার একটা কথা বোঝাতে চাইছি যে হামিদার প্রতি আমার অনুভূতি মামুলি কামনার চেয়ে অনেক বেশী গভীর…

আর বাবাকে ছাড়া অসহায় অবস্থায় এখানে আটকে থাকার পরে হামিদার অনুভূতির বিষয়ে কি বলবে। তুমি অবশ্যই জানো যে শেখ আলি আকবর হিন্দালের সাথেই থাকবেন? তিনি একটু আগেই নিজের মেয়েকে বিদায় জানিয়ে গিয়েছেন।

আমি এটা জানতাম না।

গুলবদন চেষ্টা করছে হাদিমাকে শান্ত করতে কিন্তু বেচারী একদম হতবিহ্বল হয়ে আছে। সত্যি কথা বলতে কি, গুলবদন নিজেও মর্মপীড়ায় ভুগছে যদিও সে নিজের আপন ভাইকে সঙ্গ দেবার চেয়ে আমার সাথে থাকাকেই বেছে নিয়েছে।

আমার কখনও এসব অভিপ্রায় ছিল না…আমি…

হুমায়ুন অনেক হয়েছে।

খানজাদা ঘুরে দাঁড়ায় এবং আর একটা কথাও না বলে সোজা তাবু থেকে বের হয়ে যায়। হুমায়ুন অপেক্ষা করে, আশা করে তিনি বোধহয় নরম হবেন এবং ফিরে আসবেন কিন্তু তিনি ফিরে আসেন না। সে স্থবির হয়ে নিজের তাবুতে বসে থাকে এবং তেলের প্রদীপের হলুদাভ জ্বলন্ত শিখার দিকে সময়ের হিসাব ভুলে গিয়ে আনমনে তাকিয়ে থাকে। বরাবরের মতো তার ফুপিজান কি এবারও ঠিক কথাই বলছেন? একটা বিষয়ে সে নিশ্চিত, ঝোঁকের বশে কাজটা করা হয়েছে- বোধহয় হঠকারীও হয়েছে এবং সবচেয়ে বড় কথা সে হামিদার অনুভূতিতে আঘাত দিয়েছে। হিন্দাল আর তার ভিতরে যে ভঙ্গুর কিন্তু সম্ভাবনাময় বন্ধন গড়ে উঠছিল সে সেটাকেও ছিন্ন করেছে।

সুলতান। জওহর ভিতরে প্রবেশ করে এবং হুমায়ুনের দিকে সে তার হাতে ধরা কাগজের টুকরোটা এগিয়ে দেয়। শেখ আলি আকবর আপনাকে এটা দেবার জন্য আমাকে অনুরোধ করেছে।

আপনি আমাদের সম্রাট, হুমায়ুন পড়তে শুরু করে, আমার কন্যাকে আপনি যদি চান আমি আপনাকে না বলতে পারবো না। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আমি তাঁকে এখানে রেখে যাচ্ছি কিন্তু আপনার ভাইয়ের সাথে আমাকে অবশ্যই যেতে হবে বহুবছর আগে যাঁর কাছে আমি বিশ্বস্ত থাকার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিলাম। আশা করি আপনি হামিদার সাথে ভালো ব্যবহার করবেন। তাঁকে রক্ষা করার কোনো ক্ষমতা আমার নেই এবং আপনি আপনার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন এটা বিশ্বাস করা ছাড়া আমার আর কোনো পথ নেই। শেখ আলি আকবর।

হিন্দালের প্রতি নিজের আচরণ সম্বন্ধে যত অপরাধবোধ আর দ্বিধাকে ছাপিয়ে তীব্র আনন্দের একটা রেশ হুমায়ুনকে জারিত করে। শেখ আলি আকবর, নিজের জীবন দিয়ে হলেও আমি তাকে আগলে রাখবো। আমি তাকে দারুণ সুখী করবো। আপনার ভীত হবার কোনো কারণ নেই, সে নিজেকে ফিসফিস করে বলে।

পরের দিন, সূর্যের দাবদাহে শুষ্ক হয়ে উঠা একটা ধুসর প্রান্তরের উপর দিয়ে নিজের হীনবল হয়ে পড়া সৈন্যবাহিনীর সামনে ঘোড়ায় চড়ে যাবার সময়েও, হুমায়ুন নিজের ভিতরে তীব্র আনন্দের একটা শিহরন টের পায়। হিন্দালের সাথে তাঁর সম্পর্কে ফাটলের জন্য যদি কেবল এই মূল্যটা তাকে দিতে না হত। কয়েক ঘন্টা আগে, তার সামনে প্রসারিত রাস্তায় ধূলো উড়তে দেখে তাঁর হৃৎপিণ্ডের গতি দ্রুততর হয়ে উঠে। নিজের মতো পরিবর্তন করে হিন্দাল ফিরে আসছে এই আশার দ্বারা তাড়িত হয়ে, সে তার গুপ্তদূতদের একটা দলকে বিষয়টা অনুসন্ধান করতে পাঠায় কিন্তু তারা গিয়ে কেবল খচ্চরের একটা বহরের সাথে একদল রেশম ব্যবসায়ীকে দেখতে পায়। হিন্দাল এতক্ষণে সম্ভবত হুমায়ুনের সৈন্যসারির উত্তরশ্চিমে বেশ কয়েক মাইল এগিয়ে গিয়েছে। কাশিমের ভাষ্য অনুযায়ী, হিন্দালের এক সেনাপতির সাথে তার সংক্ষিপ্ত আলাপচারিতার ভিত্তিতে, তাঁর সৎ-ভাই সিন্ধু নদী অতিক্রম করে উত্তরের দিকে এগিয়ে যাবার পরিকল্পনা করেছে।

হিন্দাল কি কামরান আর আসকারিকে খুঁজে বের করতে চায়? তাঁর বিরুদ্ধে তাঁর সৎ-ভাইদের তিনই যদি আবারও মৈত্রীর বন্ধনে একত্রিত হয় তাহলে তার নিজের অবস্থান আরও বিপজ্জনক হয়ে পড়বে। হিন্দাল খুব ভালো করেই জানে হুমায়ুন তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে কোথায় যাচ্ছে এবং কি তার ভবিষ্যত পরিকল্পনা। কামরান আর আসকারির কাছে এহেন তথ্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রতিয়মান হতে পারে এমনকি শেরশাহের কাছেও। হুমায়ুন নিজের ভাগ্যের এই সাম্প্রতিক বিড়ম্বনা নিয়ে আপনমনে ভাবতে ভাবতে চারপাশের রৌদ্র ঝলসিত প্রেক্ষাপট সম্বন্ধে একেবারে বেখেয়াল হয়ে এগিয়ে যায়। হিন্দাল ফিরে না আসায় সে একজন পরীক্ষিত মিত্র হারিয়েছে এবং একজন তৎপর শক্ত লাভ করেছে এই কারণেই যে সে আশাহত হয়েছে তা না, বিগত কয়েক মাসে তার এই ছোট ভাইটির সাথে, হোক সৎ-ভাই, তাঁর বেশ একটা আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল এবং কখন জানি সঙ্গী হিসাবে সে তাকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেছিল।

সেই দিনই রাতের মতো অস্থায়ী ছাউনি আর রান্নার জন্য আগুন জ্বালান হতে, মেয়েদের তাবু যেখানে স্থাপন করা হয়েছে সে তৃষিতের মতো সেদিকে তাকিয়ে থাকে। হামিদা এখন কি করছে এবং তার মনে কি ভাবনা খেলা করছে? তাঁকে একবার দেখার আকাঙ্খর সাথে সে তাঁকে যে মর্মপীড়ার মধ্যে ফেলেছে সেজন্য তার ভেতরে জমে উঠা অপরাধবোধের সাথে কেমন যেন মিশে যেতে থাকে এবং সে ইতস্তত করে, একজন তরুণ প্রেমিক হিসাবে নিজের কর্তব্যকর্ম সম্বন্ধে একেবারেই অনিশ্চিত। তারপরে তাঁর বোধোদয় হয়। জওহরকে ডেকে এনে, খানজাদাকে তাঁর সাথে দেখা করার জন্য তাঁকে আদেশ দেয়। হুমায়ুন প্রতিটা ক্ষণ অতিক্রান্ত হবার সাথে সাথে শঙ্কাকুল মনে অপেক্ষা করতে থাকে। তার ফুপিজান যদি তার সাথে দেখা করতে অস্বীকৃতি প্রকাশ করে তাহলে সে মোটেই অবাক হবে না, কিন্তু জওহর অবশেষে খানজাদাকে সাথে নিয়েই ফিরে আসে।

বেশ আমার প্রিয় ভাস্তে, তুমি কেন আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছে আমি জানি।

ফুপিজান, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ… যথাযথ শব্দ খুঁজতে খুঁজতে, হুমায়ুন ইতস্তত ভঙ্গিতে বলে। গতরাতে রাগারাগি করে আমরা বিদায় নিয়েছিলাম। আপনি যা বলেছিলেন তাঁর অধিকাংশই ন্যায্য। কিন্তু যা ঘটে গিয়েছে আমার পক্ষে সেটা পূর্বাবস্তায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। সত্যি কথা বলতে কি আমার পক্ষে যদি সেটা সম্ভবও হত আমি সেটা করতাম না। তবে আপনার কথাগুলো নিয়ে আমি আজ সারাদিন চিন্তা করেছি। আমি আপনাকে আমার সব বিপদে পাশে পেয়েছি, বরাভয় লাভ করেছি। এই বিপদের মুহূর্তে আমি আশা করবো আপনি আমাকে ছেড়ে যাবেন না।

খানজাদার চোখমুখের অভিব্যক্তি এখনও কঠোর এবং তিনি একটা কথাও বলেন না কিন্তু তাঁর খয়েরী চোখের দৃষ্টি কোমল হয়ে উঠে তাঁকে নিজের বক্তব্য প্রকাশ করতে সাহস জোগায়।

হামিদা আপনি অনুগ্রহ করে বলবেন যে আমি আমার কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজের জন্য দুঃখিত এবং তাকে কষ্ট দেয়াটা কখনওই আমার উদ্দেশ্য ছিল না। সে কয়েক পা সামনে এগিয়ে আসে। আমার মানসিক অবস্থার কথা তাকে বলেন। তাঁকে বলেন প্রেমের বশবর্তী হয়েই আমি সবকিছু করেছি। আমার বিষয়টা তাকে একটু বোঝন… সে আপনার কথা নিশ্চয়ই শুনবে। আর তাকে আরও বলবেন যে রাতের আহারের পরে আমি আপনাদের সবার সাথে দেখা করতে যাব- অবশ্য যদি সে সম্মতি জানায় তবেই।

দুঘন্টা পরে, খানজাদার কয়েকজন পরিচারিকাকে অনুসরণ করে হুমায়ুনকে অস্থায়ী ছাউনির মাঝ দিয়ে এগিয়ে যেতে দেখা যায়, জলন্ত মশালের আলোয় তারা তাঁকে মেয়েদের তাবুর দিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে। খানজাদার তাবুর অভ্যন্তরে নীচু হয়ে প্রবেশ করতে, প্রদীপের কমলা রঙের কোমল আলোয় এবং দিয়ার জ্বলন্ত শলতের দ্বারা উদ্ভাসিত তাবুর কেন্দ্রস্থলে নীচু আসনে সে গুলবদন আর খানজাদাকে উপবিষ্ট অবস্থায় দেখতে পায়। তাঁকে স্বাগত জানাতে তারা উঠে দাঁড়ায় এবং সে যখন তাদের দিকে এগিয়ে যায় অবগুণ্ঠিত একটা অবয়ব- সে জানে হামিদা ছাড়া সেটা আর কেউ না আলো আঁধারির ভেতর থেকে বের হয়ে এসে খানজাদার পাশে দাঁড়ায়। কেউ কিছু বলার আগেই অনাদিষ্ট ভঙ্গিতে, হামিদা তাঁর মুখের নিম্নাংশ আবৃতকারী নেকাব সরিয়ে দেয় এবং তাঁর সামনে এসে দাঁড়ায়। হুমায়ুন আগে বুঝতে পারেনি যে হামিদা এত দীর্ঘকায়- গুলবদন কিংবা খানজাদার চেয়ে কমপক্ষে তিন কি চার ইঞ্চি সে লম্বা। নীল আলখাল্লা আর একই রঙের কাচুলির সাথে কোমরে সবুজাভ-হলুদ রঙের ফিরোজা পাথরখচিত পরিকর পরিহিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে বোঝা সে সেই সাথে হাল্কা পাতলা গড়নের।

হামিদা। আমার সাথে এখানে দেখা করার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ। তুমি কি জানো আমি কেন এসেছি। আমি তোমাকে আমার স্ত্রী করতে চাই…

হামিদা কোনো কথা বলে না কিন্তু পলকহীন চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকে, তার কালো, দীর্ঘ অক্ষি-পযুক্ত চোখ কান্নার স্মৃতিতে লাল হয়ে আছে এবং সেই দৃষ্টির সামনে হুমায়ুনই প্রথম নিজের দৃষ্টি আনত করে।

তুমি আমাকে কি উত্তর দেবে?

 আব্বাজান আমাকে আদেশ পালন করতে বলেছেন…

আমি ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাউকে স্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করতে চাই না… তুমি একেবারে তোমার মন থেকে আমাকে বল তোমার কি ইচ্ছা?

আমি জানি না। আমি আপনাকে উত্তর দিতে পারবো না। আমার আব্বাজানের কাছ থেকে মাত্র গতকালই আমি আলাদা হয়েছি। তাকে আমি আর হয়ত কখনও দেখতে পাব না…

আমার ভাইয়ের সাথে গমন করার সিদ্ধান্ত একেবারেই তোমার আব্বাজানের নিজস্ব। শেখ আলি আকবর একজন ভালোমানুষ, সৎ আর বিশ্বস্ত এবং তার সাথে আমার কোনো বিরোধ নেই। আমি আমার সামর্থ্যের ভিতরে আছে, এমন সবকিছু করতো- এটা নিশ্চিত করতে যে একদিন- আল্লাহর যদি মর্জি হয়- তার সাথে তুমি পুনরায় মিলিত হবে। এবং আমি তোমাকে আরও প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি যে আমি তোমার খুব ভালো স্বামী হব। আমি তোমাকে ভালোবাসবো আবার সম্মানও করবো। এবং বর্তমানে যদিও আমার ভাগ্য বিরূপ কিন্তু আমার প্রত্যাশা অনেক উঁচু এবং একদিন আমি তোমাকে মহান একজন সম্রাজ্ঞীর মর্যাদায় অভিষিক্ত করব… নিজের জীবন দিয়ে হলেও আমি শপথ করে বলছি।

হামিদা সোজা টানটান হয়ে দাঁড়ায় কিন্তু কথা বলে না। হুমায়ুন ভাবে, মেয়েটার এখনও নিতান্তই অল্পবয়স। নিজের আব্বাজানের এবং পরিচিত পারিপার্শ্বিকের কাছ থেকে সহসা বিচ্যুত হবার শোকে সে এখনও কাতর। গত কয়েকদিনে অনেক কিছু ঘটেছে, হুমায়ুন কোমল কণ্ঠে বলে, এবং তুমিও ক্লান্ত। আমি তোমাকে এখন আর বিব্রত করবো না কিন্তু আমি যা বলেছি সেসব নিয়ে একটু ভেবে দেখবে।

আমি বিষয়টা ভেবে দেখবো। হামিদা এখনও ব্যগ্রভাবে তাঁকে আবেক্ষণ করছে, যেন চেষ্টা করছে ভবিষ্যতের গর্ভে কি অপেক্ষা করছে সেটা জানতে। হুমায়ুন বুঝতে পারে সে পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছে এবং জীবনে এই তাঁর আত্মবিশ্বাস মাতাল হয়ে উঠে। সে অনুধাবন করে যে তার স্ত্রী হিসাবে সে যদি কাউকে নির্বাচিত করে তাহলে যেকোনো মেয়েরই মাথা ঘুরে যাবে বিশ্বাস করে, নিজের সাফল্যের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েই সে আজ রাতে হামিদার সাথে দেখা করতে এসেছিল।

*

হুমায়ুন নিজের অস্থিরতাকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং এই ক্ষেত্রে সে যা আশা করেছিল তার চেয়েও বেশীদিন তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়। হামিদাকে একপলক দেখার জন্য প্রতিরাতে খানজাদার তাবুতে যাওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখতে সে হিমশিম খেয়ে যায় কিন্তু সে জোর করে নিজেকে নিরস্ত করে। তার প্রস্তাব বিবেচনা করার জন্য সে হামিদাকে সময় দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং সে অবশ্যই নিজের দেয়া প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ করবে না। অবশেষে, প্রায় মাসাধিক কাল অতিবাহিত হবার পরে এক জেলো সন্ধ্যাবেলা সেনাছাউনির অস্থায়ী শিবিরের চারপাশের অন্ধকারে সেদিন জোনাকির ঝাঁক হীরককুচির মতো জ্বলজ্বল করছিল, খানজাদা শেষ পর্যন্ত তার জন্য সংবাদ নিয়ে হাজির হয়।

হুমায়ুন, হামিদা সম্মতি জানিয়েছে। তুমি যখন চাইবে সে তোমার স্ত্রী হতে রাজি আছে।

প্রবল আনন্দের একটা জোয়ার এসে তাঁকে ভাসিয়ে নেয় এবং সে তাঁর ফুপিজানকে জড়িয়ে ধরে। তাকে রাজি করাতে শেষ পর্যন্ত তাঁকে আপনি কি বলেছিলেন?

তাকে আমার শরণে নেয়ার পর থেকেই আমি তাকে যা বলে আসছি সেই একই কথা- তাকে যদি কাউকে বিয়ে করতেই হয় তবে রাজার চেয়ে ভালো পাত্র আর কে হতে পারে- বস্তুতপক্ষে একজন সম্রাট? তাকে আমি স্মরণ করিয়ে দেই যে সম্ভ্রান্ত পরিবারের অনেক মেয়েই বাধ্য হয় বুড়ো অথর্বকে বিয়ে করতে কিন্তু সেই তুলনায় তুমি নিজের যৌবনে পা দেয়া সুদর্শন এক যোদ্ধা মেয়েদের ভিতরে যার বিশেষ একটা সুনাম আছে… খানজাদা চোখ মটকে বলে।

আপনি নিশ্চিত এই বিয়েতে সে আগ্রহী?

হ্যাঁ। আমার প্রতিশ্রুতি তাঁকে সবচেয়ে বেশী প্রভাবিত করেছে যে তুমি তাকে সত্যিই ভালোবাস।

আমি তাকে সত্যিই ভালোবাসি।

আমি জানি। তাঁর সম্পর্কে তুমি যতবারই কিছু বল তোমার চোখেমুখে প্রতিবারই আমি সেই ভালোবাসা ঝলসে উঠতে দেখি, নয়তো এই ক্ষেত্রে আমি তোমাকে কখনও সাহায্য করতাম না।

হিন্দালের ব্যাপারটা? তার কথা কি সে কখনও জানতে চেয়েছে?

না। হিন্দাল সত্যিই হয়তো হামিদাকে ভালোবাসতো কিন্তু মেয়েটা এ বিষয়ে কিছুই জানতো না। তুমি যদি হামিদার অন্তরে প্রবেশের পথ খুঁজে পাও, সেখানে তুমি কোনো প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হবে না…

ফুপিজান, আপনাকে ধন্যবাদ। বরাবরের মতোই, এবারও আপনি আমার ত্রাণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।

আর বরাবরের মতোই, হুমায়ুন তোমার সুখই আমার কাম্য।

একটু অপেক্ষা করেন। আমি চাই হামিদার জন্য আমার তরফ থেকে একটা উপহার আপনি নিয়ে যান। লোহা দিয়ে বাধান তাঁর সিন্দুকের দিকে সে এগিয়ে গিয়ে ভেতর থেকে ফুল ভোলা রেশমের একটা কাপড় বের করে এবং সেটার ভাঁজ খুলতে দেখা যায় ভেতরে রয়েছে সোনার উপরে আগুনের শিখারমতো দেখতে রুবি আর গাঢ় সবুজ রঙের আকাটা পান্নার একটা দু-লহরী হার যা গুজরাতে দখল করা ধনসম্পদের ভিতরে সে পেয়েছিল। মোমবাতির আলোতে পাথরগুলো দারুণভাবে জ্বলজ্বল করতে থাকে এবং কালো চোখের অধিকারিণী হামিদার সৌন্দর্যের সাথে দারুণ মানাবে। আপনি আমাকে একবার বলেছিলেন, আমার স্ত্রীকে দেয়ার জন্য আমি যেন হারটা নিজের কাছে সামলে রাখি… সেই মুহূর্ত এখন এসেছে…

পরের দিন সকাল বেলা, হুমায়ুন সেদিনের জন্য অগ্রযাত্রা বাতিল করে এবং তার ব্যক্তিগত জ্যোতিষী সারাফকে তার তাবুতে ডেকে পাঠায়। রাজকীয় বিয়ের জন্য সবচেয়ে শুভদিনের সন্ধানে তারা একসাথে গ্রহ-নক্ষত্রের মানচিত্র পর্যবেক্ষণ করে, রাহু-কেতুর অবস্থান পর্যালোচনা করে। শারাফ তার হাতের অ্যাস্ট্রোলেইব নামিয়ে রেখে অবশেষে বলে, অতি সত্ত্বর আয়োজন করতে হবে- আমাদের হাতে মাত্র তিন সপ্তাহ সময় আছে। হুমায়ুনও সেটা মেনে নেয়। বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে রাজস্থান অভিমুখে তাঁদের অগ্রযাত্রা স্থগিত রাখবে যাতে করে প্রস্তুতির জন্য সময় পাওয়া যায়। সে এখন যদিও ভূমিহীন আর সিংহাসনহীন, তথাপি হামিদার সাথে তার বিয়েটা কোনো মামুলি ঘটনা নয়। সৈন্যবাহিনীর সাথে আগত নগন্য কোনো অনুসারীদের বিয়ে আর বাসরের অনুষ্ঠান এটা নয় বরং সম্রাট আর সম্রাজ্ঞীর বিবাহ।

*

সোনালী রেশমের ঝলমল করতে থাকা কয়েক পরতের নীচে হামিদা নিশ্চল ভঙ্গিতে বসে আছে, মুক্তার সাথে ফারগানার প্রতীক হিসাবে হলুদ বৈদুর্যমণি আর সমরকন্দের স্মারকসম সবুজ পান্না একত্রে পাকিয়ে তৈরী করা শিরোমালা, যা গুলবদন বিশেষভাবে তার জন্য তৈরী করেছে, অবগুণ্ঠন আটকে রেখেছে। মাওলানারা সুর করে তাঁদের মোনাজাত শেষ করার পরে, হামিদার মেহেদী রাঙা হাত হুমায়ুন স্পর্শ করে এবং অনুকূল একটা স্পন্দন অপরপক্ষের মাঝে অনুভব করে। তার উজির কাশিম পাদিশাহ জিন্দাবাদ শ্লোগান শুরু করতে হুমায়ুন আর হামিদা উঠে দাঁড়ায় এবং বিয়ের মঞ্চ থেকে নিজের তাবুর দিকে তাঁকে নিয়ে এগিয়ে যায় যেখানে বিয়ের ভোজসভার আয়োজন করা হয়েছে।

ভোজসভায় আমন্ত্রিত মেহমানের সংখ্যা অবশ্য সামান্য কয়েকজনই কাশিম,জাহিদ বেগ, আহমেদ খান আর অন্য কয়েকজন আধিকারিক এবং সেই সাথে খানজাদা, গুলবদন আর তাদের স্ত্রীরা। আগ্রায় যদি এখনও সে সম্রাট হিসাবে অধিষ্ঠিত থাকতো, সেখানে তাহলে হাজার লোকের জমায়েত হত। ট্রে ভর্তি বিয়ের উপঢৌকন বিরল মশলা, রেশম আর রত্নপাথর- তার সামনে ছড়িয়ে পড়ে থাকতো। দূর্গের প্রাঙ্গণে এসে জমা হত জীবন্ত সব উপঢৌকন- মূল্যবান পাথরে সজ্জিত হাতি যার দাঁতগুলো সোনা দিয়ে গিল্টি করা এবং প্রাণবন্ত আর তরতাজা ঘোড়ার পাল। আজ্ঞাবাহী, আর বশংবদ রাজারা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকতো অভিবাদন জানাতে এবং রাত ঘনিয়ে আসবার সাথে সাথে দূর্গের সুবাসিত আঙ্গিনা সঙ্গীতের কোমল মূৰ্ছনায় মাতোয়ারা হয়ে উঠতো এবং আতশবাজির আলোকচ্ছটায় রাতের আকাশ দিনের দ্যোতনা লাভ করতো।

কিন্তু তার পাশে মখমলের লাল একটা তাকিয়ার উপরে বসে থাকা হামিদার দিকে আড়চোখে তাকাতে এবং সে যেন তার নিখুঁত অবয়ব দেখতে পায় তারজন্য একটা ছাড়া তাঁর বাকি সব নেকাব পেছনে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। তাঁর গালের কোমল বাঁক, তার আলখাল্লার মসৃণ কাপড়ের নীচে স্তনযুগলের ভীরু উঠা নামা হুমায়ুন অনুভব করে সত্যিকারের সুখের খুব কাছাকাছি সে অবস্থান করছে। সে অনেক রমণীর সাথেই সঙ্গম করেছে, নিজের দক্ষতা আর বীর্যের পরাভব প্রেমিকের মতো উপভোগ করেছে, কিন্তু এই মুহূর্তে সে নিজের ভেতরে যে আবেগের ক্ষরণ টের পাচ্ছে সেটা তার কাছে একেবারেই নতুন। এমনকি সে সালিমার জন্যও এমন ভালোবাসা তার মাঝে সৃষ্টি হয়নি।

ভোজসভা শেষ হবার পরে, খাবারের পাত্রগুলো সরিয়ে নেয়া হয় এবং তাঁদের ব্যক্তিগত পরিচারকের দল ছাড়া আর সবাই এবার বিদায় নিতে, জীবনে প্রথমবারের মতো কোনো রমণীর সংস্পর্শে আসা বালকের মতো হুমায়ুন লাজুক হয়ে উঠে। তার নিজের পরিচারকেরা তাঁকে যখন নিরাভরণ করে রেশমের একটা আলখাল্লায় তাকে জড়িয়ে দেয়, হামিদার সহচরীরা তাঁকে লাল চামড়া দিয়ে মোড়ান কাঠের অন্তঃপটের সাহায্যে তৈরী কনের শয়নকক্ষে নিয়ে যায়, চামড়ার ফিতার সাহায্যে পরস্পরের সাথে যুক্ত অন্তঃপটগুলো তাবুর একেবারে শেষপ্রান্ত পর্যন্ত বিন্যস্ত। হুমায়ুন একটু থামে তারপরে দুটো অন্তঃপটের মধ্যের ফাঁকাস্থানের উপর টানটান অবস্থায় ঝুলন্ত ব্রোকেডের নীচ দিয়ে মাথা নীচু করে প্রবেশ করে।

হামিদা তখনও প্রস্তুত হয়নি। সে টের পায় হামিদার হাস্যমুখরিত পরিচারিকার দল তাঁকে নিরাবরণ করে, তার মাথার লম্বা কালো ঝলমলে চুল পরিপাটি আঁচড়ে দিয়ে গোলাপজলে সিক্ত বিছানায় তাকে নিয়ে এসে পাতলা একটা চাদরের নীচে তাঁকে যত্ন করে শুইয়ে দেয়ার সময়, সারাক্ষণ সে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়ার ছলে আড়চোখে তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। পরিচারিকার দল বিদায় নেবার সময় সে তাদের মৃদু হাসির আওয়াজ ভেসে আসছে শুনতে পায়। সে কেমন যেন একটু বিভ্রান্ত আর অস্বস্তি বোধ করে। হামিদাকে নিজের করে পাবার জন্য সে এতোটাই স্থিরপ্রতিজ্ঞ ছিল, এতোটাই নিশ্চিত ছিল যে এই মেয়েটার সাথেই তার ভবিষ্যত জড়িত কিন্তু আদতে সেই মেয়েটা তার কাছে একজন অপরিচিত আগন্তুক। তারা আজকের পূর্বে কখনও একসাথে নিভৃতে কখনও সময় অতিবাহিত করেনি। তাদের ভিতরে সামান্য যতটুকু কথা হয়েছে তার পুরোটাই হয়েছে অন্যদের উপস্থিতিতে। অনাহুত অতিথির ন্যয়, ভাবনাটা পুনরায় তার মাঝে ফিরে আসে যে হামিদার সামনে অন্য আর কোনো পথ না থাকায় সে তাঁকে স্বামী হিসাবে গ্রহণ করতে সম্মত হয়েছে। হামিদার কাছে যাবার সময় এই ভাবনাটার কারণে সে একটু অস্বস্তিবোধ করতে থাকে।

হুমায়ুন… হামিদার কোমল কণ্ঠস্বর অবশেষে চেপে বসা নিরবতার অবসান ঘটায়। হুমায়ুন ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখে বাম কনুইয়ের উপরে ভর দিয়ে হামিদা আধশোয়া অবস্থায় বিছানায় উঠে বসেছে। তার ডান হাত হুমায়ুনের উদ্দেশ্যে প্রসারিত। সে ধীরে ধীরে কাছে এগিয়ে আসে এবং বিছানার পাশে হাঁটু ভেঙে বসে হামিদার বাড়িয়ে ধরা হাতটা স্পর্শ করে এবং ঠোঁট দিয়ে আলতো করে তার আঙ্গুলে চুমু খায়। হামিদা শুজনিটা তুলে ধরলে, সে উঠে দাঁড়ায় এবং তাঁর পাশে পিছলে শুয়ে পড়ে। হামিদার দেহ আবেগের মন্থনে উষ্ণ অনুভূত হয় এবং ধীরে, প্রায় পূজার ভঙ্গিতে সে তার মুখাবয়ব স্পর্শ করে তারপরে তার আঙ্গুল হামিদার খোলা চুলের গোছা আকড়ে ধরে। তার চোখ চমকে উঠে হুমায়ুনের দিকে তাকায়, সেখানে বিস্ময়ের পাশাপাশি বিশ্বাসের সহাবস্থান। হামিদাকে আলতো করে নিজের দিকে টেনে এনে, সে তার নিখুঁত কাঁধের ঢাল থেকে কোমরের পেলব বাকের ভয়াবহতার মাঝে আবিষ্কারের নেশায় মেতে উঠে। জীহ্বা দিয়ে তাঁর স্তনযুগলে প্রেমময় সোহাগ করার সময় তাঁর ছোট গোলাপী স্তনবৃন্ত শক্ত হয়ে উঠেছে সে বুঝতে পারে আর এটা তাকে আরও সাহসী করে তুলে। হুমায়ুনের হাত প্রেমিকের নমনীয়তায় অনুসন্ধান অব্যাহত রাখলে, হামিদার দেহত্বকে ফিনফিনে ঘামের একটা স্তর ভেসে উঠে। হামিদার চোখ এখন বন্ধ কিন্তু তার ওষ্ঠদ্বয় আলতো ফাঁক হয়ে রয়েছে এবং তাঁদের ভিতর দিয়ে আঁতকে ওঠা শীকার ধ্বনি ভেসে আসে।

নিজের অসহিষ্ণুতাকে সংযত করে হুমায়ুন অপেক্ষা করে যতক্ষণ না তার মনে হয় হামিদা তাকে গ্রহণ করার জন্য তৈরী হয়েছে, তারপরেই কেবল সে উপগত হয়ে তার মাঝে নিজেকে আমূল প্রোথিত করে প্রেমিকের বিশ্বস্ততায়। রমণের মাত্রা জোরাল হতে সে টের পায় হামিদার টানটান হয়ে থাকা দেহ বাঁকতে শুরু করেছে এবং উদ্বিগ্ন চোখে নিচের দিকে তাকিয়ে মেয়েটার আধখোলা চোখে ব্যাথার বদলে উদ্বেল আনন্দ দেখতে পায়। নিজেকে আরও গভীরে নিবিষ্ট করার মাঝে এই মেয়েটার প্রতি সে আবেগসিক্ত প্রেমময় একটা অনুভূতিতে জারিত হয়, যেকোনো মূল্যে তাকে আগলে রাখার একটা বাসনায় তাঁর অন্তর আপুত হয়ে উঠে। হামিদা এখন কেবলই তার একান্ত আপনার এবং যতদিন তারা জীবিত থাকবে এখন থেকে এটাই হবে বাস্তবতা।

ঈষদুষ্ণু পানিপূর্ণ পাত্র নিয়ে তাঁদের পরিচারকেরা তাবুর আলো আধারিতে প্রবেশ করে তাদের জাগিয়ে তুলতে তারা আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায় ঘুম ভেঙে জেগে উঠে। হামিদাই প্রথমে হাতের ইশারায় তাঁদের বিদায় করে কিন্তু তারা যখন পুনরায় পরস্পরকে একান্ত করে পায়, সে তখন নিরবে স্থির হয়ে বসে থাকে।

হামিদা কি হয়েছে? আমি কি তোমাকে আঘাত দিয়েছি…?

লাজুকভঙ্গিতে সে হুমায়ুনের দিকে তাকায় এবং মাথা নাড়ে।

তাহলে কি হয়েছে?

বিগত দিনগুলোতে আমি আতঙ্কিত ছিলাম…

কি জন্য?

আপনার স্ত্রী হিসাবে আপনি আমাকে চান এটা জানতে পেরে আমি হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম। আমার ভয় ছিল যে আমি বোধহয় আপনাকে প্রীত করতে পারবো না… আপনাকে আশাহত করবো। কিন্তু গতরাতে আপনার নমনীয়তা, আমার জন্য যে আনন্দ আপনি সৃষ্টি করেছেন, সবকিছু আমার উদ্বেগকে প্রশমিত করেছে… চোখের তারায় আন্তরিকতার সতেজতা নিয়ে হামিদা এখন তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। হুমায়ুন কিছু বলার চেষ্টা করতে সে আঙ্গুলের অগ্রভাগ দিয়ে তাঁর ঠোঁট চেপে ধরে। আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে একজন বিশিষ্ট ভবিষ্যদর্শীর রক্ত আমার ধমনীতে বইছে। কিন্তু আরো কিছু আছে যা আপনি জানেন না। ভবিষ্যতের গর্ভে সঞ্চিত অভিজ্ঞতার আদল কখনও কখনও আমিও দেখতে পাই। গতরাতে আমি স্বপ্ন দেখেছি যে অচিরেই আমি গর্ভবতী হব… একটা পুত্রসন্তান। আপনি জিজ্ঞেস করবেন না আমি কিভাবে জেনেছি কেবল আমাতে বিশ্বাস রাখেন যে ঘটনাটা সত্যি। হুমায়ুন তাকে দুহাতে আকড়ে ধরে। মোগল সাম্রাজ্য আমি আবার গড়ে তুলবো এবং তুমি, আমি আর আমার পুত্রসন্তান আমরা সবাই মহান সম্রাটের গৌরব অর্জন করবো, রমণের রমণীয়তায় হারিয়ে যাবার সূচনালগ্নে সে ফিসফিস করে কথাগুলো হামিদাকে বলে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *