২.৩ রক্ত আর ঘামের গন্ধ

০৮. রক্ত আর ঘামের গন্ধ

রাতের বেলা আক্রমণের দ্বারা তাঁকে পুনরায় চমকে দেবার ব্যাপারে, যেমনটা সে চৌসায় করেছিল, হুমায়ুন কোনো প্রকার ঝুঁকি নেয় না। সে তাদের জাগিয়ে রাখে এবং সূর্য উঠার তিনঘন্টা আগে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত রাখে। কিন্তু কোনো আক্রমণ হয় না এবং অনেক আগেই সকালের নাস্তার পর্ব শেষ হয়েছে আর রাধুনি আগুন নিভিয়ে দিয়েছে। আজকের সকালটা বেশ পরিষ্কার এবং যুদ্ধের সাজে সজ্জিত হয়ে সরু চূড়া বরাবর আরো একবার হেঁটে আসবার সময় হুমায়ুন এমনকি নয়টার সময়েও টের পায় এরই মধ্যে বেশ গরম পড়েছে। তাঁর গুপ্তদূতেরা খবর দিয়েছে যে প্রায় এক ঘন্টা আগেই শেরশাহ তাঁর বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হতে শুরু করেছে এবং শীঘ্রই বিপরীতপার্শ্বের চূড়ায় তাঁর পৌঁছে যাবার কথা।

তাঁরা ঠিকই অনুমান করেছিল। কয়েক মিনিট পরেই হুমায়ুন চূড়ায় প্রথম বেগুনী নিশান দেখতে পায়। তারপরে সে বর্ম পরিহিত একজন অশ্বারোহীকে দেখতে পায়, তারপরে আরেকজনকে, তারপরে শতশত। দীর্ঘদেহী এক অবয়বের, যার বর্মের সম্মুখভাগ আর শিয়োস্ত্রাণে সকালের সূর্য ঝিলিক তোলে, আদেশ অনুযায়ী শেরশাহের সবচেয়ে চৌকষ অশ্বারোহী বাহিনীর একটা অগ্রবর্তী দল হুমায়ুনের প্রত্যাশিত স্থানেই অবস্থান গ্রহণ করতে আরম্ভ করে। দুই চূড়ার মধ্যবর্তী দূরত্ব অনেক বেশী হবার কারণে ঠিকমতো চেনা যায় না ওখানে কে রয়েছে কিন্তু হুমায়ুন ধারণা করে কিছুটা আশাও- যে ওটা স্বয়ং শেরশাহ। শেরশাহের সাথে ব্যক্তিগত দ্বৈরথে সে আরো একবার অবতীর্ণ হয়ে নিজেকে দুজনের ভিতরে সেরা যোদ্ধা হিসাবে প্রমাণ করতে এবং তার শত্রু রক্তাক্ত অবস্থায় ধূলোয় লুটিয়ে রয়েছে দেখতে চায়। কিন্তু সে এটাও ভালো করে জানে যে তার লোকদের মতো তাকেও অবশ্যই সহসা সর্বশক্তি নিয়ে এক বেপরোয়া আক্রমণের ঝুঁকি নেয়ার প্ররোচনা জয় করতে হবে।

প্রায় সোয়া ঘন্টা পরে, হুমায়ুন দীর্ঘদেহী সেই অবয়বকে নিজের তরবারি আন্দোলিত করে তার অশ্বারোহী বাহিনীর প্রথম সারির মাঝে চলৎশক্তি সঞ্চারিত করতে দেখে। অশ্বারোহী বাহিনীর প্রথম সারিটা চূড়া থেকে সম্মিলিত কণ্ঠে রণহুঙ্কার দিয়ে পুতগতিতে নেমে আসতে শুরু করতে হুমায়ুনের কাছে মনে হয় তারা সংখ্যায় প্রায় হাজার পাঁচেক হবে, তাদের বেগুনী নিশানগুলো তাদের পেছনে বিরতিহীনভাবে আন্দোলিত হয়। তাঁদের ভঙ্গি দেখে মনে হয়, হুমায়ুন যেমন প্রত্যাশা করেছিল, তারা সরু চূড়ার মাঝামাঝি বরাবর তার তৈরী অস্থায়ী বাঁধের, যেটার উপরে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে, উপরে হামলা করতে এগিয়ে আসছে।

বাবা ইয়াসভালো ইতিমধ্যে হুমায়ুনের গোলন্দাজদের গোলা বর্ষণ আরম্ভ করার আদেশ দিয়েছেন এবং আক্রমণ শুরু করা শেরশাহের অশ্বারোহী বাহিনীর প্রথম দলটা গোলার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। নীচের উপত্যকায় ঘুরপাক খেতে থাকা কামানের সাদা ধোয়ার মাঝে হুমায়ুন দেখে গাদাবন্দুকের ছররা বা তীরের আঘাতে পেছনের যোদ্ধারা তাদের ঘোড়া থেকে ছিটকে পড়েছে। মাটিতে ধরাশায়ী হওয়া লোকগুলোর ভিতরে একজন নিশান-বাহক ছিল, যে মাটিতে আছড়ে পরার সময় যার হাত থেকে নিশানের দণ্ডটা ছুটে যায়। তাঁর বেগুনী নিশানটা উড়ে গিয়ে আরেক আগুয়ান অশ্বারোহীর সামনে পড়ে তার ঘোড়ার পায়ের সাথে পেচিয়ে যায় এবং ঘোড়াটা তার আরোহীসহ মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। কয়েক মুহূর্ত পরে হুমায়ুন চোখেমুখে রুদ্ধশ্বাস বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে দেখে তার অবস্থানের দিকে আক্রমণ অভিপ্রায়ে সর্বোচ্চ বেগে ধাতি হবার বদলে অশ্বারোহী যোদ্ধারা ভাগ হয়ে যাচ্ছে। একদল তর মাটির বাধের দূরবর্তী প্রান্তের দিকে ছুটতে শুরু করেছে এবং আরেকদল বিপরীত প্রান্তের দিকে। তাঁরা বৃত্তাবদ্ধ করার এক তৎপরতায় প্রবৃত্ত হয়েছে, হুমায়ুনের মূল প্রতিরক্ষা ব্যুহের সামনে দিয়ে হঠাৎ গতি পরিবর্তন করে একপাশে সরে যাবার সময় তাঁর তবকি আর তীরন্দাজদের কারণে জানমালের অবশ্যম্ভাবী ক্ষয়ক্ষতি আপাতদৃষ্টিতে তারা মেনে নিয়েছে।

নিমেষ পরে, হুমায়ুন তাঁর চোখের কোণ দিয়ে শেরশাহের বিশাল আরেকটা অশ্বারোহী বাহিনীকে দুলকিচালে ঢালু শৈলশিরার নীচু অংশ দিয়ে উঠে এসে দুটো চূড়ার উত্তরপ্রান্তের সংযোগকারী অংশের দিকে এগিয়ে যেতে দেখে এবং তার প্রতিরক্ষা ব্যুহের অপেক্ষাকৃত কম সুরক্ষিত প্রান্তে তারা স্পষ্টতই হামলা করতে চলেছে।

জওহর, একজন বার্তাবাহককে পাঠিয়ে বাবা ইয়াসভালোকে এখনই বল উত্তরদিক থেকে শৈলশিরায় হতে যাওয়া আক্রমণ প্রতিহত করতে, এখনই আমাদের অশ্বারোহীদের কয়েকটা দলকে সেখানে সরিয়ে নেয়। তাদের নেতৃত্ব দিতে আমি নিজে সেখানে যাচ্ছি। জওহর আদেশটা ঠিকমতো শুনেছে কিনা সে বিষয়ে নিশ্চিত হবার জন্য অপেক্ষা না করেই, হুমায়ুন তার কব্জি পর্যন্ত ঢাকা চামড়ার শক্ত দস্তানাযুক্ত হাত নেড়ে তাঁর দেহরক্ষীদের তাঁকে অনুসরণ করতে বলে এবং তার বাদামী ঘোড়ার পাজরে গুতো দিয়ে পর্বতশীর্ষের সংকীর্ণ ভূমিরেখা বরাবর জন্তুটাকে পুতগতিতে ধাবিত করে। কয়েক গজ যাবার পরেই শৈলশিরার দিকে মাটি ঢালু হয়ে নামতে শুরু করে এবং হুমায়ুন দূর থেকেই লক্ষ্য করে যে শেরশাহের অশ্বারোহী বাহিনীর একটা ভালো অংশ ইতিমধ্যে তাঁর অস্থায়ী বাঁধের উত্তরের প্রান্তসীমার পেছনে পৌঁছাতে সফল হয়েছে। তাঁর তবকি আর তীরন্দাজেরা পাথরের আড়াল থেকে তাদের দিকে গুলিবর্ষণ করছে। তারপরে সে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই তীরন্দাজদের একটা দল ঘুরে দাঁড়ায় এবং ধনুক ফেলে দিয়ে পেছনের দিকে দৌড়াতে শুরু করে, নিজেদের শেরশাহের অশ্বারোহীদের সহজ নিশানায় পরিণত করে। নিজেদের পর্যানে উঠে দাঁড়িয়ে তারা তীরন্দাজদের পিঠ বরাবর তরবারি দিয়ে আঘাত করে, তাদের অধিকাংশকেই আক্ষরিক অর্থে কচুকাটা করে।

হুমায়ুন ভাবে, পদাতিক সৈন্যরা অভিজ্ঞতা থেকে কেবল যদি শিক্ষা নিত যে অশ্বারোহী যোদ্ধাদের কবল থেকে দৌড়ে পালানটা অসম্ভব। পাথরের আড়ালে অবস্থান করা এবং সেখান থেকে শেষ পর্যন্ত লড়াই করাটা কেবল অনেকবেশী সম্মানজনকই না, সেই সাথে নিরাপদও। তার পেছন থেকে ঘোড়ার খুরের শব্দ ভেসে আসতে, সে পর্যানে বসা অবস্থায় পেছনে তাকিয়ে তার অনুরোধে বাবা ইয়াসভালের কাছ থেকে আগত অশ্বারোহী যোদ্ধার দলটাকে দেখতে পায়। দলটা তাঁর নিজের সাথে একটা সমকেন্দ্রিক পথে রয়েছে এবং মিনিটখানেকের মধ্যে আর নিজেদের অগ্রসর হবার গতি লক্ষণীয়ভাবে না কমিয়ে, দলটা হুমায়ুনের দেহরক্ষীদের সাথে এসে যোগ দেয় এবং একটা সঘবদ্ধ দলের মতো তারা সবাই সামনের দিকে পুতবেগে এগিয়ে যায়।

আক্রমণ কর! আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহের পার্শ্বদেশে নিজের পদাতিক বাহিনীকে নিয়ে এসে সে তার অবস্থান মজবুত করার আগেই শত্রুকে আমাদের অবশ্যই তাড়িয়ে দিতে হবে। আক্রমণকারীদের ছোট ছোট দলে পৃথক করতে চেষ্টা কর। তাঁদের তাহলে সহজে ঘিরে ফেলে হত্যা করা যাবে।

হুমায়ুনের অশ্বারোহী দলটা যখন ঢাল বেয়ে নীচের রণক্ষেত্রের দিকে দুলকি চালে এগোচ্ছে, শেরশাহের অশ্বারোহীদের ভেতর থেকে অশ্বারূঢ় একদল তীরন্দাজ বের হয়ে আসে। হুমায়ুনের অশ্বারোহীদের লক্ষ্য করে তারা এক পশলা তীর নিক্ষেপ করেই দ্রুত পিছু হটে তাঁদের সহযোদ্ধাদের নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভিতরে ফিরে যায়। সকালের বাতাসে মৃত্যুর শীষ তুলে তীরগুলো ছুটে আসে এবং হুমায়ুনের অশ্বারোহীদের কেউ কেউ তাদের সঙ্গে থাকা ঢাল তুলে নিজেদের রক্ষা করতে ঘোড়ার গতি হ্রাস করে। অনেকগুলো ঘোড়া তাদের আরোহীদের ছিটকে ফেলে দিয়ে ভূপাতিত হয় প্রকারান্তরে যা আরো অন্যদের পতনের কারণ হয়ে পুরো আক্রমণের প্রণোদনা ভঙ্গ করে বা ছন্দপতন ঘটায়। হুমায়ুন অবশ্য তার লোকদের এগিয়ে যাওয়া বজায় রাখতে অনুরোধ করে, তার চারপাশে যারা রয়েছে তাদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠে, এসব বিরক্তিকর উৎপাত অগ্রাহ্য কর, তারা আবারও তীর ছোঁড়ার আগেই আমরা তাঁদের কাছে পৌঁছে যাব। সে তখন তাঁর বামদিক থেকে আরেকটা শব্দ ভেসে আসতে শুনে- শিলা আর প্রস্তরখণ্ডের একটা স্তূপের পেছন থেকে গাদাবন্দুকের গুলিবর্ষনের পটপট শব্দ। শেরশাহ তাঁর অশ্বারোহী বাহিনীর সাথে কিছু তবকিদেরও যে পাঠিয়েছিলেন বোঝা যায়।

হাসসান বাট্ট, তরুণ সেনাপতি হুমায়ুন আগের দিনই যাকে পদোন্নতি দিয়েছে, আক্রমণের একেবারে পুরোভাগের যোদ্ধাদের ভিতরে সে তার সাদা ঘোড়া আর ধুসর নীল পাগড়ির কারণে সহজেই চোখে পড়ে। গাদাবন্দুক থেকে নিক্ষিপ্ত একটা ধাতব বল তার ঘোড়ার মাথায় এসে আঘাত করতে ঘোড়াটা ভিত নড়ে যাওয়া ইমারতের ন্যায় হুড়মুড় করে আছড়ে পড়ে এবং হাস্সান বাট্ট পর্যান থেকে বিকট শব্দে মাটিতে পতিত হয়, হাতগুলো কস্তনীরমতো দুলছে, এবং শক্ত পাথুরে মাটিতে বেশ কয়েকবার গড়িয়ে যায়। সে প্রায় অবিশ্বাস্যভাবে এরপরেও টলমল করে উঠে দাঁড়ায়। আক্রমণের জন্য ধেয়ে আসা তার অশ্বারোহী বাহিনীর মূল দলটার মাঝে হারিয়ে যাবার আগে হুমায়ুন শেষবারের মতো তাকে, উত্তোলিত তরবারি দুলিয়ে তাঁর সহযোদ্ধাদের এগিয়ে যেতে উৎসাহ দিতে দেখে।

হুমায়ুন তাঁর সাহসিকতা নিয়ে খুব বেশী কিছু চিন্তা করার সুযোগ পায় না কারণ সে নিজে ততক্ষণে শেরশাহের অশ্বারোহীদের মাঝে পৌঁছে গেছে। কালো ঘোড়ায় উপবিষ্ট এক যোদ্ধার আন্দোলিত কস্তনীর ছোবল এড়াতে একপাশে সরে গিয়ে, সে লালচে হলুদ ঘোড়ায় আরূঢ় এবং ইস্পাতের বর্ম পরিহিত এক লম্বা লোকের দিকে এগিয়ে যায় নিশ্চিতভাবেই কোনো গুরুত্বপূর্ণ আধিকারিক। লোকটাকে ঘিরে থাকা দুজন অশ্বারোহী সাথে সাথে নিজেদের বাহনের মুখ হুমায়ুনের দিকে ঘোরায়, সে তখন তাদের তরবারির আঘাত এড়াতে নীচু হয়ে রয়েছে এবং সেই অবস্থায় দুজনের একজনের মুখে বসন্তের দাগ ভর্তি শ্মশ্রুমণ্ডিত, খর্বকায় দেখতে- কাঁধে চোখের পলকে তরবারির কোপ বসিয়ে দিলে সে বাধ্য হয় হাত থেকে অস্ত্র ফেলে দিতে।

হুমায়ুন দ্রুত আধিকারিকের পাশে যাবার জন্য নিজের ঘোড়াকে তাড়া দেয়। লোকটা হুমায়ুনকে আঘাত করার নিমিত্তে তার হাতের লম্বা বাঁকান তরবারি তাক করে কিন্তু খুব কাছাকাছি অবস্থান করার ফলে হুমায়ুনের বর্ম ভেদ করার মতো। পর্যাপ্ত শক্তিতে সে তার তরবারি ঘোরাতে পারে না। আঘাতে প্রচণ্ডতা সত্ত্বেও হুমায়ুনকে একপাশে কাত করে ফেলে আর তার ঘোড়াও তাঁকে নিয়ে দূরে সরে আসে। দ্রুত টাল সামলে নিয়ে হুমায়ুন তাঁর বাহনের মুখ ঘোরাবার জন্য লাগাম টেনে ধরে এবং আক্রমণ করতে আধিকারিকের মুখোমুখি হয়। হুমায়ুনের তরবারির প্রথম আঘাত লোকটা তার সাথের ধাতব ঢাল তুলে ঠেকায় কিন্তু ভারী ঢালটা নামিয়ে হুমায়ুনের দ্বিতীয় আঘাত প্রতিহত করতে বড্ড দেরী করে ফেলে, আঘাতটা পাশ থেকে তাকে স্পর্শ করে, বক্ষস্থল আবৃতকারী বর্মটার কারণে সেই জায়গাটা অরক্ষিত ছিল। লোকটার গায়ে শেকলের তৈরী সূক্ষ বর্ম না থাকায় তরবারিটা মাংসপেশী এবং পাঁজরের উপস্থির গভীরে প্রবেশ করে। আধিকারিক লোকটা সহজাত প্রবৃত্তির কারণে হাত থেকে ঢাল ফেলে দেয় এবং নিজের দেহের ক্ষতস্থানের দিকে তাকিয়ে আতকে উঠে। হুমায়ুন পুররায় তরবারি চালায় এইদফা লোকটার গলা লক্ষ্য করে আড়াআড়িভাবে, আরেকটু হলেই লোকটাকে সে কবন্ধ করে ফেলেছিল এবং আধিকারিক লোকটা তার ঘোড়ার পর্যান থেকে পিছলে পড়ে যায়।

প্রতিশোধ নিতে মরিয়া হয়ে উঠে, আধিকারিকের আরেকজন দেহরক্ষী এরপরে দুই মাথাযুক্ত রণকুঠার নিয়ে হুমায়ুনকে আক্রমণ করে। তার সাথে শীঘ্রই আরেকজন এসে যোগ দেয় এবং তারপরে আরেকজন তৃতীয়জন, দুজনের কাছেই লম্বা তরবারি, যার ফলার দুদিকই ধারাল। আক্রমণকারীদের হুমায়ুন কাছে আসতে দেয় না, তাঁর বাদামী রঙের ক্ষিপ্রগামী ঘোড়াটা চক্রাকারে ঘোরাতে থাকে এবং তাদের আঘাত ঠেকাতে থাকে, যদিও কারও একটা ধারাল তরবারি তার গালে হাল্কা আচড় দিয়েছে, যতক্ষণ না তার নিজস্ব দেহরক্ষীদের কয়েকজন দ্রুত তাঁকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। তার দুই আক্রমণকারীকে অচিরেই পাথুরে মাটিতে, বুকে মাথায় হুমায়ুনের তরবারির মৃত্যু স্মারক নিয়ে টানটান হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়। তৃতীয়জন হাত থেকে তরবারি ফেলে দিয়ে এবং পালাতে থাকে, হুমায়ুনের দেহরক্ষীদের একজন তার উরুতে বর্শা দিয়ে বেমক্কা আঘাত করায় রক্ত সেখানের ক্ষতস্থান থেকে তার পর্যাণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে এবং তাঁর হাল্কা রঙের ঘোড়াকে রক্তরঞ্জিত করে তুলেছে।

আমরা শেরশাহের অশ্বারোহী বাহিনীর একটা বিশাল অংশকে তাড়িয়ে দিয়েছি। তার তবকি আর তীরন্দাজেরাও পিছু হটেছে, রুদ্ধশ্বাসে একজন আধিকারিক তাঁকে জানায়।

দারুণ। আমাদের তবকি আর তীরন্দাজদের শেরশাহের লোকেরা পাথরের। আড়ালে যেখানে অবস্থান করছিল সেখানে মোতায়েন কর। ওখানে যেসব মালবাহী শকট রয়েছে তাঁদের কয়েকটাকে উল্টে দিয়ে অতিরিক্ত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি কর এবং শেরশাহ যদি আবারও আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহের পার্শ্বদেশে আক্রমণ করতে চেষ্টা করে তাঁদের হুশিয়ার করতে কয়েকটা কামানকে গোলাবর্ষণের জন্য প্রস্তুত রাখা।

তার লোকেরা কাজে লেগে পড়ে, কাঠের অতিকায় মালবাহী শকটগুলোকে ধাক্কা দিয়ে এবং টেনে নিয়ে এসে সেগুলোকে উল্টে দেয় এবং কামান স্থানান্তরের জন্য ষাড়ের পাল নিয়ে আসলে, হুমায়ুন ঘোড়ায় চড়ে কয়েকশ গজ দূরে চূড়ার উপরে একটা নির্দিষ্ট স্থানের দিকে এগিয়ে যায়, যেখান থেকে পুরো রণক্ষেত্রটা ভালো করে অবলোকন করতে এবং তার পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে ভাবার অবকাশ পাবে। সেখানে পৌঁছাতে, সে দেখে তাঁর সিদ্ধান্ত তাঁর পক্ষে গৃহীত হয়ে গিয়েছে। শেরশাহের অশ্বারোহী যোদ্ধারা প্রায় পৌনে এক মাইল দূরে তাঁর তৈরী মাটির অস্থায়ী বাঁধের প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করেছে এবং তাঁদের আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে তার লোকেরা পিছু হটছে।

কি ব্যাপার? হুমায়ুন খয়েরী আর সাদার মিশেল দেয়া একটা ঘোড়ায় উপবিষ্ট শ্যাম বর্ণের খর্বকায় এক আধিকারিকের কাছে জানতে চায়, যে প্রায় পঞ্চাশজন পোড় খাওয়া চেহারার বাদশানি তীরন্দাজের একটা দলকে নেতৃত্ব দিয়ে সামনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

সুলতান, আমি নিশ্চিত বলতে পারছি না, কিন্তু আমাকে বলা হয়েছে শেরশাহের প্রথম আক্রমণ দুইভাগে বিভক্ত হয়ে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ উভয় প্রান্ত দিয়ে বৃত্তাকারে ঘিরে ফেলার মাধ্যমে আমাদের অপ্রস্তুত করার পরে, সে অশ্বারোহী যোদ্ধার দ্বিতীয় একটা দলকে চূড়া থেকে আস্কন্দিত বেগে ধেয়ে এসে আমাদের প্রতিরক্ষা বাঁধের ঠিক মাঝ বরাবর নিচ্ছিদ্র বিন্যাসে আক্রমণের আদেশ দেয়, প্রতিরক্ষা ব্যুহের প্রান্তদেশের সুরক্ষায় আমরা সেখান থেকে সৈন্য সরিয়ে নিয়েছি বলে- এমনটা যে ঘটবে, আমি নিশ্চিত, সে আগেই জানতো। এই স্থানের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়বে। তাদের আক্রমণ এত তীব্র ছিল যে তারা প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত আমাদের অবশিষ্ট সৈন্যদের প্রতিরোধ একেবারে গুঁড়িয়ে দেয় এবং আমাদের সেনাছাউনির একেবারে কেন্দ্রস্থলে এসে হাজির হয়। বাবা ইয়াসভালো শিলাস্তরের পাদদেশে ওখানে একটা প্রতিরক্ষা অবস্থান গড়ে তুলে আমাদের সবাইকে আদেশ করেছেন, সেই অবস্থানের দিকে অগ্রসর হয়ে সেখানকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।

আধিকারিকের বাহুর নির্দেশিত দিকে তাকিয়ে, হুমায়ুন বিশৃঙ্খল অশ্বারোহী যোদ্ধাদের একটা বিশাল ভীড় দেখতে পায় এবং কোননামতে বাবা ইয়াসভালের হলুদ নিশান খুঁজে পায়। তুমি আর তোমার লোকদের সাহসিকতার প্রতি আমার পূর্ণ আস্থা আছে। আমরা নিশ্চয়ই শেরশাহকে তাড়িয়ে দেব। আমি আমার অশ্বারূঢ় দেহরক্ষীদের ডেকে পাঠিয়েছি এবং যুদ্ধক্ষেত্রে তোমাদের পুরোভাগে অবস্থান করবো।

সুলতান।

হুমায়ুন ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নেয় এবং তাঁর দেহরক্ষীদের ইশারায় অনুসরণ করতে বলে, শিলাস্তর অভিমুখে পুতবেগে চূড়ার ঢাল বরাবর ফিরতি পথে এগিয়ে যায় যেখানে মূল লড়াই কেন্দ্রীভূত হয়েছে। সে ঘোড়া দাবড়ে এগিয়ে যেতে যেতে, শেরশাহের আরো বেশী বেশী সংখ্যক যোদ্ধাদের তার তৈরী অস্থায়ী মাটির বাঁধের প্রতিরক্ষাহীন ফাটল দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে, শিলাস্তরের চারপাশে চলমান যুদ্ধে যোগ দিতে দেখে। সে শিলাস্তরের কাছাকাছি পৌঁছে তারপক্ষের পদাতিক সৈন্যের একটা ছোট দলের মুখোমুখি হয়, যারা নিজেদের অবস্থান ত্যাগ করে পালিয়ে আসছে যা এখনও সরাসরি আক্রমণের সম্মুখীন হয়নি। ঘোড়ার লাগাম টেনে ধরে সে চিৎকার করে তাদের ফিরে আসতে বলে যে, এখনও সব আশা শেষ হয়ে যায়নি। কিন্তু পলকহীন আর আতঙ্কিত চোখে, তাঁরা কনৌজের এবং নিকটবর্তী গঙ্গায় সেখানের পারাপারের স্থানের উদ্দেশ্যে দৌড়াতে থাকে।

এক কি দুই মিনিট পরেই, শিলাস্তরের চারপাশে মানুষ আর ঘোড়ার একটা জীবন্ত জটলার প্রান্তদেশে হুমায়ুন নিজেকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। সে আরোহীবিহীন একটা ঘোড়াকে পাশ দিয়ে দৌড়ে যেতে দেখে জন্তুটার পেটে একটা বিশাল কাটা স্থান থেকে অবলা প্রাণীটার পরিপাকতন্ত্রের একটা কিংদয়শ বের হয়ে আছে। মাটিতে অনেকগুলো দেহ হাত পা ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে, মৃত্যুর কারণে আক্রমণকারী আর প্রতিরোধকারীদের এখন আর পৃথক করা যায় না। বাবা ইয়াসভালের সৈন্যরা মনে হয় যেন ধীরে ধীরে জমির অধিকার ত্যাগ করছে এবং তাঁদের শিলাস্তরের পার্শ্বদেশে দুরারোহভাবে খাড়া জমিতে ফিরে যেতে বাধ্য করা হয় কিন্তু হুমায়ুন এখনও যুদ্ধক্ষেত্রে মাঝে বাবা ইয়াসভালের হলুদ নিশান উডডীন অবস্থায় দেখতে পায়। তাঁর দেহরক্ষী দলের পক্ষে যতটা সম্ভব অনুসরণের দায়িত্ব দিয়ে, সে কালবিলম্ব না করে সেদিকে আক্রমণ করতে ছুটে যায়।

হুমায়ুনের বাদামী ঘোড়াটা মাথায় মুখব্যাদান করা এক রক্তাক্ত ফাটল নিয়ে পড়ে থাকা অশ্বারোহীর ক্ষতবিক্ষত দেহে হোঁচট খায় কিন্তু হুমায়ুন নিজে একজন দক্ষ ঘোড়সওয়ার হবার কারণে আর তাঁর ঘোড়াটাও ক্ষিপ্রগামী বলে তারা দ্রুত ভারসাম্য ফিরে পায় এবং হুমায়ুনকে নিয়ে জন্তুটা আক্রমণের উদ্দেশ্যে হুমায়ুনকে শত্রুর আরও কাছাকাছি নিয়ে যায়। সে পর্যানে বসেই শেরশাহের এক অশ্বারোহীকে তার তরবারি আলমগীর দিয়ে একবার আঘাত করে, তার দ্বিতীয় আঘাতে ঘোড়াটার গলায় একটা ক্ষতচিহ্নের জন্ম দেয়, জন্তুটা দ্বিখণ্ডিত শ্বাসনালী নিয়ে মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ার আগে তার আরোহীকে শূন্যে ছুঁড়ে দেয়, জন্তুটা পেছন থেকে হুমায়ুনকে আক্রমণের পায়তারা করতে থাকা আরেক অশ্বারোহীকেও ধরাশায়ী করে। বাবা ইয়াসভালের কাছ থেকে হুমায়ুন এখন কেবল বিশ গজের মতো দূরে রয়েছে। রণক্ষেত্রের জটলার মাঝে একটা ফাঁক দেখতে পেয়ে, হুমায়ুন পরস্পরের সাথে ভীষণভাবে যুদ্ধমান অশ্বারোহীদের ভিতর দিয়ে তাকে লক্ষ্য করার আগেই তার সেনাপতির দিকে এগিয়ে যায়।

সে এগিয়ে যাবার ফাঁকে লক্ষ্য করে যে বস্তুত পক্ষে বাবা ইয়াসভালের চারপাশে কেবল ডজনখানেকের মতো তাঁর যোদ্ধারা রয়েছে। তাঁদের ভিতরে তিন কি চারজন আবার নিজেদের ঘোড়া খুইয়েছে এবং বাবা ইয়াসভালো আর তার সহযোদ্ধারা শেরশাহের অসংখ্য আক্রমণকারীকে আটকে রেখে তাদের রক্ষা করতে চেষ্টা করছে। তার চোখের সামনে অবশ্য ঠিক সেই মুহূর্তে তাঁদের আক্রমণকারীদের একজন- লম্বা একটা বর্শা নিয়ে বেগুনী পাগড়ি পরিহিত বিশালদেহী এক যোদ্ধা, যার মুখ ভর্তি কালো চাপ দাড়ি- মাটিতে বাহনহীন অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর একজনকে দলছুট হতে দেখে নিজের ঘোড়ার পাজরে গুতো দিয়ে তার দিকে এগিয়ে যায়। মাটিতে দাঁড়ান লোকটা তার ঢাল নিজের সামনে এনে বর্শার সূচাল অগ্রভাগ প্রতিহত করলেও আঘাতের প্রচণ্ডতায় সে মাটিতে ছিটকে যায়। লোকটা তার আক্রমণকারীর ঘোড়ার খুরের নীচে থেকে মরীয়া হয়ে গড়িয়ে সরে গিয়ে নিজের সহযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছাতে চেষ্টা করে কিন্তু সে যখন এসবে ব্যস্ত তখন বেগুনী পাগড়ি পরিহিত অশ্বারোহী পুনরায় নিজের বর্শা তুলে নিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে নিশানা স্থির করে, লোকটার পেট বর্শা দিয়ে এফেঁড়ওফোঁড় করে দেয় বাবা ইয়াসভালের অন্যান্য যোদ্ধারা তাকে বাধা দেয়ার সময়ই পায় না। বেগুনী পাগড়ি পরিহিত মৃত্যুদূত রক্ত রঞ্জিত বর্শার অগ্রভাগ আহত লোকটার দেহ থেকে দ্রুত মোচড় দিয়ে বের করে নিশ্চিতভাবেই সে একজন আধিকারিক পিছিয়ে গিয়ে নিজের লোকদের ভীড়ের ভিতরে হারিয়ে যায়। হুমায়ুন যখন বাবা ইয়াসভালের কাছে যাবার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে তখনই এক মিনিটেরও কম সময়ে মর্মান্তিক ঘটনাটা ঘটে যায়।

সুলতান, আপনার দেহরক্ষীরা সব কোথায়? বাবা ইয়াসভালো হাত নেড়ে তার নিজের লোকদের পুনরায় নিচ্ছিদ্র ব্যুহে বিন্যস্ত করার অবসরে জিজ্ঞেস করেন। হুমায়ুন সহসা বুঝতে পারে যে তাঁদের একজনও শত্রুর আক্রমণ মোকাবেলা করে তাকে অনুসরণ করতে সফল হয়নি এবং যে পথ দিয়ে সে এখানে এসেছে সেই করিডোরটা এখন শেরশাহের যোদ্ধারা পুরোপুরি দখল করে নিয়েছে। তাঁরা তাঁকে এবং বাবা ইয়াসভালো আর তার সঙ্গীদের প্রায় ঘিরে ফেলেছে এবং পশ্চাদপসারণ বা সাহায্য আসবার যেকোনো সম্ভাবনা থেকে তাঁদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে।

বাবা ইয়াসভালো, যতক্ষণ আমাদের আরও যোদ্ধারা এসে পৌঁছে বা এখান থেকে পালাবার কোনো রাস্তা আমরা খুঁজে পাই ততক্ষণ নিজেদের আর পরস্পরকে রক্ষা করার জন্য আমাদের উচিত হবে ঘনবদ্ধ হয়ে অবস্থান করা। আমরা যদি শৈলশিরার দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে অবস্থান করি তাহলে অন্তত আমাদের পিঠ সুরক্ষিত থাকবে।

হুমায়ুন আর বাবা ইয়াসভালো একত্রে তাঁদের অন্য সৈন্যদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়ে, কিন্তু তারা যখন তাঁদের আদেশ পালন করার প্রয়াস নেয়, সেই মুহূর্তে শেরশাহের তিনজন অশ্বারোহী এক ঘোড়সওয়ারকে ঘিরে ফেলে এবং তাঁদের একজন লোকটাকে তার বাহন থেকে কস্তনীর এক বেকায়দা আঘাতে মাটিতে ফেলে দেয়। মাটিতে অসহায় অবস্থায় পড়ে থাকা লোকটার এক সঙ্গী তাঁকে বাঁচাবার উদ্দেশ্যে নিজের ঘোড়ার পাঁজরে গুতো দিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করতে গেলে, দুই মাথাবিশিষ্ট রণকুঠারের মোক্ষম আঘাতে সাথে সাথে মারা যায়, কুঠারটা তার কণ্ঠমণিতে আঘাত করে তাকে কবন্ধ করে দেয়। শেরশাহের অন্য আরেকজন যোদ্ধা মাটিতে পরে যাওয়া লোকটার ভবলীলা কস্তনীর এক ঘায়ে নিভিয়ে দেয়। সেই সময়েই বেগুনী পাগড়ি পরিহিত সেই আধিকারিক বাবা ইয়াসভালের ঘোড়া খোয়ান লোকদের একজনকে তার রক্ষাকারীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে এবং বর্শা দিয়ে তার কুচকিতে আঘাত করে। আহত সৈন্যটার পা আর গোড়ালি জবাই করা পশুর মতো কয়েক মিনিট মাটিতে আছড়াতে থাকে এবং তারপরে সে নিথর হয়ে মাটিতে পড়ে থাকে।

বাবা ইয়াসভালো আর হুমায়ুনের সাথের মাত্র নয়জন তোক এখন বেঁচে আছে এবং তাঁদের মধ্যে দুইজনের আবার কোনো ঘোড়া নেই এবং আরেকজন মাথায় মারাত্মক আঘাত পেয়েছে। হুমায়ুন আর তাঁর সৈন্যরা যখন শৈলশিরার পার্শ্বদেশ থেকে মাত্র কয়েকগজ দূরে অবস্থান করছে, বেগুনী পাগড়ি পরিহিত আধিকারিক তখন শেরশাহের অশ্বারোহী যোদ্ধাদের চূড়ান্ত আক্রমণ শুরু করার জন্য ইশারা করে। শৈলশিরার এই স্থানটা প্রায় বিশ ফিট উঁচু এবং প্রায় খাড়াভাবে উপরের দিকে উঠে গিয়েছে, স্পষ্টতই ঘোড়া নিয়ে সেখানে আরোহন করাটা অসম্ভব এবং খালি হাতে দেয়াল বেয়ে উঠার মতো কোনো রাস্তা চোখে পড়ে না।

বাবা ইয়াসভালের সঙ্গের নয়জন লোকের মধ্যে সদ্য কৈশোর অতিক্রম করা একজন তূর্যবাদক রয়েছে, যার মসৃণ গালে এখনও নাপিতের ক্ষুর পড়েনি। তাঁর বাদ্যযন্ত্র এখনও তার পিঠের সঙ্গে বাঁধা রয়েছে। বাবা ইয়াসভালো তার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে তোমার সঙ্গে থাকা তূর্য এবার বাজাও যাতে আমরা বাইরে থেকে সাহায্য পেতে পারি। সে যখন তূর্যধ্বনি করবে তোমরা বাকিরা তখন তাঁকে আগলে রাখবে। তূর্যবাদক ছেলেটা তাঁর পিঠ থেকে তিন ফিট লম্বা তূর্যটা খুলে হাতে নেয় এবং সেটা তার ঠোঁটের কাছে ধরে। প্রথমে অবশ্য কোনো শব্দ হয় না সদ্য যুবা ছেলেটা তখন চোখে মুখে উদ্বেগ আর আতঙ্ক নিয়ে বাবা ইয়াসভালের দিকে তাকায়।

বাছা, শান্ত হও, বাবা ইয়াসভালো অভয় দেয়ার সুরে বলে। যুদ্ধের উত্তেজনা আর ভয়ে তোমার মুখ শুকিয়ে গেছে। কেশে গলাটা একটু খাকরে নিয়ে জীহ্বা দিয়ে ঠোঁটটা একটু ভিজিয়ে নাও।

যুবক ছেলেটা অনুগত ভঙ্গিতে কাশে এবং পুনরায় চেষ্টা করার আগে জীহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়। এইবার ভূর্যের পিতলের তৈরী মুখ থেকে উচ্চনাদে শব্দ ধ্বনিত হয়- হুমায়ুনের যোদ্ধাদের পুনরায় একত্রিত হবার আহ্বান।

আবার বাজাও বাছা, এবং তারপরে আবার।

তরুণ তূর্যবাদককে রক্ষা করতে গিয়ে হুমায়ুনের তিনজন অশ্বারোহী বীরের মতো মৃত্যুবরণ করার পরে, বেগুনী পাগড়ি পরিহিত মূর্তিমান ব্রাস হয়ে উঠা সেই আধিকারিক সবাইকে পাস কাটিয়ে সহসা নিজের কালো ঘোড়াটা নিয়ে তূর্যবাদকের দিকে এগিয়ে আসে এবং তার হাতের লম্বা বর্শাটা দিয়ে ছেলেটার ডান বাহুমূলে, ঠোঁটের কাছে পিতলের তৈরী ভারী তূর্যটা ধরে থাকার কারণে অরক্ষিত, আঘাত করে তাকে ঘোড়ার পিঠ থেকে ফেলে দেয়। সে মাটিতে পড়ে থাকা অবস্থায় তার হন্তারকের বর্শার আরেকটা আঘাতে মারা যায়।

হুমায়ুন, শেরশাহের আরেকজন অশ্বারোহী যোদ্ধাকে অবশিষ্ট দুজন লোকের একজনের দিকে, যারা মাটিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে, এগিয়ে যেতে দেখে তার নিজের ঘোড়া নিয়ে হন্তারকের আক্রমণ প্রতিহত করতে এগিয়ে যায়, শত্রুর নিশানা লক্ষ্য করে এগিয়ে যাওয়া আটকে দেয়। শত্রুপক্ষের লোকটা তার ঘোড়ার লাগাম শক্ত করে টেনে ধরে হুমায়ুনকে পাশ কাটিয়ে যাবার জন্য নিজের বাহনকে পরিচালিত করতে চেষ্টা করতে, হুমায়ুন তাঁর কব্জিতে এক কোপ দিয়ে একটা হাত দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে লোকটা ঘোড়ার উপর নিয়ন্ত্রণ হারায় এবং বিশৃঙ্খলার ভিতরে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। হুমায়ুন হাত বাড়িয়ে দিয়ে মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটাকে নিজের ঘোড়ার উপরে টেনে তুলে নিজের পিছনে বসিয়ে দেয়। কিন্তু সে যখন লোকটাকে টেনে তুলতে ব্যস্ত তখন অজ্ঞাতনামা হন্তারকের নিক্ষিপ্ত বর্শা হতভাগ্য সেই সৈনিকের বুক ভেদ করে যায় এবং আরেকটা বর্শা এসে হুমায়ুনের ঘোড়ার গলায় বিদ্ধ হয়। বিশাল ঘোড়াটা একবার টলমল করে উঠে তারপরে হুড়মুড় করে মাটিতে আছড়ে পড়ে, ক্ষতস্থান থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়ছে।

হুমায়ুন তার পর্যান থেক পিছলে নেমে আসে এবং বেগুনী পাগড়ি তাকে আক্রমণ করার জন্য পাগলের মতো ঘোড়ার পাজরে গুতো দেয়া শুরু করলে সে শৈলশিলার খাড়া দেয়ালের দিকে দৌড়াতে শুরু করে এবং অশ্বারোহীর মারাত্মক নিশানা ব্যর্থ করতে ডানে-বামে আকস্মিক বাকা-চোরা পথে দৌড়াতে থাকে। শৈলশিরার পাথুরে দেয়ালের কাছাকাছি পৌঁছাবার পরে, হুমায়ুন বুঝতে পারে আসলেই দেয়ালটা বেয়ে উপরে উঠা সম্ভব না, বিশেষ করে পেছনে খুব কাছে থেকে যদি লম্বা একটা বর্শা নিয়ে কোনো হন্তারক ধাওয়া করতে থাকে। উপায়ন্তর না দেখে হুমায়ুন এবার আক্রমণকারীর মুখোমুখি হয়, তাঁর ডানহাতে আলমগীর আর বামহাতে কোমরের পরিকর থেকে বের করে আনা প্রায় ফুটখানেক লম্বা করাতের মতো খাজকাটা ফলাবিশিষ্ট একটা খঞ্জর। সে তার পায়ের গোড়ালীর উপরে ভর দিয়ে আবর্তিত হতে থাকে যাতে করে সে এই পথ দিয়ে দ্রুতগতিতে সামনের দিকে দৌড়াতে পারে, এবং হুমায়ুন তাঁকে ধাওয়া করা আধিকারিক কখন আক্রমণ করবে সেজন্য অপেক্ষা করতে থাকে।

আধিকারিক লোকটা কয়েক সেকেণ্ড পরেই আক্রমণ করে, তার হাতের বর্শার সূচালো অগ্রভাগ হুমায়ুনের দিকে তাক করা সে একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করে তারপরে লাফ দিয়ে একপাশে সরে এসে বর্শার ফলাটা এড়িয়ে যায়। আক্রমণ ব্যর্থ হতে লোকটা একপাশে সরে গিয়ে তারপর পুনরায় আক্রমণ করার জন্য ঘুরে দাঁড়ায়। আক্রমণকারী যখন প্রস্তুত হচ্ছে, বাবা ইয়াসভালো- এখন তারও ঘোড়া নেই এবং মুখে তরবারির আঘাতে সৃষ্ট একটা গভীর ক্ষত থেকে অনবরত রক্ত ঝরছে- দৌড়ে হুমায়ুনের সামনে আসে এবং আধিকারিক আক্রমণ করতে ছুটে আসতে তার ঘোড়াকে আঘাত করে। সে অতিকায় জন্তুটাকে ভূপাতিত করতে সফল হয় বটে কিন্তু তলপেটে অশ্বারোহীর বর্শার পুরো ফলাটা গ্রহণ করে তাঁকে এর মূল্য পরিশোধ করতে হয়। হুমায়ুন বেগুনী পাগড়ি পরিহিত লোকটার উদ্দেশ্যে সামনের দিকে দৌড়ে যায় সে, ঘোড়ার পিঠ থেকে আছড়ে পরার কারণে যদিও তাঁর বুকের সব বাতাস বের হয়ে গিয়েছে, অবশ্য দ্রুতই তরবারি বের করে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়ায় আলমগীর দিয়ে হুমায়ুনের প্রথম আঘাত মোকাবেলা করতে। সে তার দ্বিতীয় আঘাত কোনোমতে প্রতিহত করে কিন্তু লোকটা যখন সেটা ঠেকাতে যায় হুমায়ুন তাঁর বাম হাতের খঞ্জর দিয়ে লোকটার গলায় আঘাত করে এবং খঞ্জরের খাঁজকাটা ফলাটা গলায় ঢুকিয়ে দেবার সময়ে মোচড় দেয় যাতে প্রাণসংহারক ক্ষতি হয়। আধিকারিকের উষ্ণ রক্ত ছিটকে উঠে হুমায়ুনের হাত ভিজিয়ে দেয়।

সুলতান, আমরা তূর্যবাদন শুনেছি, শিলাস্তরের উল্লম্ব উপরিতল থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। হুমায়ুন উপরের দিকে তাকায়। তার লোকদের কয়েকজন তাঁদের মুখাবয়বের বৈশিষ্ট্য, এবং তাদের পরণের কমলা রঙের পোষাকের রঙ আর ছাট দেখে বোঝা যায় তাঁরা তাঁর অনুগত রাজপুত রাজার সৈন্য- শিলাস্তরের উপরিভাগে পৌঁছাতে সফল হয়েছে এবং কিনারা দিয়ে এখন নীচের দিকে উঁকি দিচ্ছে। হুমায়ুন যখন পুনরায় তাঁর আক্রমণকারীর মুখোমুখি হবার জন্য ঘুরে দাঁড়ায়। তার মনে হয় শিলাস্তরের নিম্নভাগে যারা আটকা পড়েছিল তাঁদের ভিতরে কেবল সে একাই বেঁচে আছে- রাজপুত বাহিনীর একজন সৈন্য কালো শরযষ্টিযুক্ত একটা বাণ ছুঁড়ে মারতে শেরশাহের একজন্য অশ্বারোহীর ঘোড়া মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পরবর্তী তীরটা আরেকজন যোদ্ধার পায়ে বিদ্ধ হয়। হুমায়ুনকে আক্রমণকারী লোকগুলো এবার নিজেদের গুটিয়ে নেয় যেন তারা তাদের পরবর্তী করণীয় সম্বন্ধে নিজেদের ভিতরে আলোচনা করবে। তারা যখন নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত সেই কয়েক সেকেণ্ডের ভিতরে রাজপূত তীরন্দাজ নিজের মাথার কমলা রঙের পাগড়ি খুলে ফেলে। সে কাপড়ের টুকরোটার একটা প্রান্ত কাপড়টা প্রায় দশফিট লম্বা হবে শিলাস্তরের কিনারা থেকে নীচের দিকে ছুঁড়ে দেয়, কাপড়টা হুমায়ুনের মাথার ফিট খানেক উপরে এসে শেষ হয়, যেখানে এটা বাতাসে মৃদুমন্দ দুলতে থাক।

সুলতান আমার পাগড়ির কাপড়টা শক্ত করে আকড়ে ধরেন। আমি আপনাকে নিরাপদ স্থানে টেনে তুলে আনব।

হুমায়ুন নিজের চারপাশে একবার তাকিয়ে দেখে এবং ইতস্তত করে। বাবা ইয়াসভালো এখনও খাড়া শিলাস্তরের যেখানে আহত হয়েছিলেন সেখানেই শুয়ে আছেন। খোঁচা খোঁচা ধুসর চুলযুক্ত তার শিরোস্ত্রাণবিহীন মাথা এই মুহূর্তে বুকের উপরে ঝুঁকে আছে এবং এখনও তার নাক আর ঠোঁটের কিনারা দিয়ে টপটপ করে রক্ত তার বুকের কাছে বর্মে চুঁইয়ে পড়ছে। তাঁর হাত দুটো দেহের দুপাশে পড়ে আছে কিন্তু তার দুই পা দুদিকে ছড়ান এবং তলপেট থেকে এখনও বর্শার ফলাটা বের হয়ে আসে। তিনি নিশ্চিতভাবেই মারা গেছেন এবং হুমায়ুন তার অন্য কোনো লোকদের ভিতরে প্রাণের স্পন্দন দেখতে পায় না।

হুমায়ুন বুঝতে পারে, তার আক্রমণকারীরা যেকোনো মুহূর্তে আবার কাছে এগিয়ে আসতে চেষ্টা করবে তাকে শেষ করে দেবার জন্য। রাজবংশ এবং নিয়তি উভয়ের প্রতি তাঁর দায়িত্ব হল যেকোনো মূল্যে নিজেকে রক্ষা করা। হাতবদল করে সে আলমগীর বামহাতে ধরে এবং ডানহাত উপরে তুলে কমলা রঙের পাগড়ির কাপড়টা শক্ত করে আকড়ে ধরে। সে সাথে সাথে টের পায় যে কাপড়টা টানটান হয়ে উঠেছে এবং সে যখন পাহাড়ী শিলার খাড়া উপরিভাগ বেয়ে আরোহন থাকে তখন বাড়তি প্রণোদনা আনয়নের জন্য সে নিজেও উঠতে আরম্ভ করে। তাঁর আক্রমণকারীরা, এতোক্ষণে বুঝতে পারে যে সে এখনই পালিয়ে যাবে, তাঁর দিকে হুড়মুড় করে ছুটে আসে।

হুমায়ুন বেকায়দা ভঙ্গিতে তাঁদের একেবারে সামনের জনকে দেখে এবং পুনরায় উঠে বসার জন্য পায়তারা শুরু করে। তাকে বিস্মিত হতে দেখে সে চমকে উঠে।

আলমগীরের বা বামহাতে ধরে হুমায়ুন বেকায়দা ভঙ্গিকে তাদের একেবারে সামনে আঘাত করে কিন্তু আঘাতটা করার উদ্দেশ্যে সফল হয়। সে উপরে দিকে তাকিয়ে থাকার সময় সে আরেকটু হলেই তাঁদের সৈন্যরা দুদলে ভাগ হয়ে গিয়েছে এবং নিজের বাসায় ধারাল অস্ত্র দিয়ে কিছু করার আগে সবকিছু ভালো করে ধুয়ে নেয়া উচিত। সহসা তার আক্রমণকারীরা বুঝতে পারে সে একটু পরেই পালিয়ে যাবে, তারা তাঁর দিকে মরিয়া হয়ে ছুটে আসে।

হুমায়ুন বামহাতে ধরা আলমগীর দিয়ে বেকায়দা ভঙ্গিতে আন্দোলিত করতে থাকে এবং ধারাল ফলা দিয়ে মানুষটার কপালে হয়ত কিছু আঁকা যাবে এবং হুমায়ুন উপরের দিকে তাকালে সে নির্বিকার ভাবে ত্বকের প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া একটা অংশ দেখতে পায়, যেখান থেকে তার চোখে রক্ত গড়িয়ে পড়েছে। একই সাথে রাজপূত লোকটা নিজের রণকুঠার পরবর্তী আক্রমণকারীকে ছুঁড়ে মারলে হুমায়ুন টের পায় তার আশেপাশের বাতাস নড়ে উঠেছে এবং কুঠারটা লোকটার বাহুর উপরিভাড়ে গেঁথে যায় এবং সেও পিছনের দিকে উল্টে পড়ে যায়। তৃতীয় আক্রমণকারী মুহূর্তের জন্য ইতস্তত করে এবং ইতস্তত করার কারণে হুমায়ুন সুযোগ পেয়ে দ্রুত দেয়াল বেয়ে উঠতে থাকে এবং কিনারা থেকে নিজেকে টেনে উপরে তুলে এবং শিলাস্তরে উপরে উঠে আসে। সে উত্তেজনার কারণে খেয়ালই করে না তার ডানহাতের উপরিভাগ আর কব্জির ক্ষতস্থানের মুখ খুলে গেছে যখন সে নিজেকে টেনে টেনে উপরে তুলে এনেছে এবং এখন তুমূল বৃষ্টি হচ্ছে।

সুলতান। রাজপুত যে লোকটা পাগড়ির কাপড় নীচে ছুঁড়ে দিয়েছিল সে হুমায়ুনকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করার ফাঁকে সনির্বন্ধ কণ্ঠে কথা বলতে থাকে। আমরা আপনার জন্য একটা নতুন ঘোড়া নিয়ে এসেছি। আপনার সৈন্যরা সবজায়গা থেকে পিছু হটছে। আপনি যদি এখনই এখান থেকে চলে না যান তাহলে শক্রর হাতে ধরা পড়বেন বা মারা যাবেন।

চারপাশে তাকিয়ে হুমায়ুন বুঝতে পারে যে তার সামনে আসলেই দুটো পথ খোলা আছে- আরেকদিন লড়াই করার জন্য এখন পশ্চাদপসারণ করা বা যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুবরণ করা। তার যোদ্ধার মানসিকতার কাছে শেষের পথটা যতই আবেদনপূর্ণ মনে হয়, সে অনুভব করে যে আকাঙ্খ আর বেঁচে থাকার অভিলাষ এখনও তার ভিতরে তীব্রভাবে প্রজ্জ্বলিত রয়েছে এবং নিয়তি তাঁর সৌভাগ্যবান সন্তানের জন্য ভবিষ্যতের গর্ভে ভালো কিছু জমিয়ে রেখেছেন সাহসী কিন্তু নিষ্ফল মৃত্যুর বদলে। তাঁকে অবশ্যই বেঁচে থাকতে হবে।

আমরা তাহলে ঘোড়া নিয়ে বের হই এবং আমাদের পক্ষে আমাদের সৈন্যবাহিনীর যতবেশী জনকে সম্ভব পুনরায় নতুন করে দলভুক্ত করি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *