২.২ একটি প্রতিশ্রুতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন

০৭. একটি প্রতিশ্রুতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন

চৌসার দুই দিন আগের রণক্ষেত্র থেকে গঙ্গার বিশ মাইল উজানে হুমায়ুন নিজের অস্থায়ী সেনাশিবিরে তাঁর সেনাপতিদের ভিতরে যারা তার চারপাশে উপস্থিত রয়েছে তাদের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকে। সুলেমান মির্জার মৃত্যুর খবর সে আগেই শুনেছে এবং সেদিন তার সাথে আরও যারা মৃত্যুবরণ করেছে তাদের সবার রুহের মাগফেরাত কামনায় গভীর শ্রদ্ধাভরে সে মোনাজাতে অংশ নেয়। বাবা ইয়াসভালো এখানে উপস্থিত রয়েছে যদিও হুমায়ুনের চেয়েও মারাত্মকভাবে তিনি আহত। তার চেয়েও বিস্ময়কর, ফ্যাকাশে মুখ আর দড়িরমতো বাদামী শ্মশ্রুমণ্ডিত আহমেদ খানের উপস্থিতি। তার আহত উরুতে ভারী পটি বাঁধা এবং কাঠের শক্তপোক্ত দেখতে একটা ক্রাচে ভর দিয়ে তিনি ভীড়ের ভিতরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।

নিজাম গঙ্গার তীরে হুমায়ুনকে রেখে যাবার কয়েক মিনিটের ভিতরেই তাঁর অশ্বারোহী বাহিনীর একটা দল তাঁর কাছে উপস্থিত হয়। হাকিমেরা তাঁর হাতের ফাঁক হয়ে থাকা লম্বা আর গভীর ক্ষতস্থানের মুখ ধুয়ে সেলাই করে তারপরে ঔষধি লাগিয়ে সেটার উপরে স্বচ্ছ মসলিনের পটি বেঁধে দিয়েছে কিন্তু ব্যাথানাশক হিসাবে সে আফিম গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে। এই মুহূর্তে পরিষ্কারভাবে চিন্তা করা তার জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সে নিজের আঙ্গুল নাড়াতে পারছে দেখে ভাগ্যের কাছে কৃতজ্ঞবোধ করে কিন্তু ক্ষতস্থানটা প্রায়ই আগুনের মতো উত্তপ্ত হয়ে উঠে, কখনও সেখানে কোনো বোধ থাকে না আর যতবারই আহত হাতটা কোনো কিছু স্পর্শ করে ততবারই অবর্ণনীয় একটা ব্যাথায় তার সারা শরীর আপ্লুত হয়ে উঠে। কিন্তু এসব সত্ত্বে এযাত্রায় প্রাণে বেঁচে যাবার জন্য সে মনে মনে সুষ্ঠাকে ধন্যবাদ জানায়। যুদ্ধে সে ভীষণভাবে পরাজিত হয়েছে কিন্তু নিজের হারান ভূখণ্ড পুনরুদ্ধারে সে বদ্ধ প্রতিজ্ঞ ঠিক যেমন তাঁর আব্বাজান বাবর বিরুদ্ধতার মুখোমুখি হয়ে যেভাবে তা মোকাবেলা করতেন।

আহমেদ খান, শেরশাহের সর্বশেষ গতিবিধির কি খবর? সে জানতে চায়।

সে চৌসার পরে আর অগ্রসর হয়নি। সে আর তার লোকেরা এই মুহূর্তে আমাদের ফেলে আসা সিন্দুকের ধনসম্পদ ভাগাভাগি আর গঙ্গার কর্দমাক্ত তীরে কাদায় ডুবে থাকা কামানগুলো পানির আরো গভীরে তলিয়ে যাবার আগে সেগুলো উদ্ধার করতেই ব্যস্ত। তারও আমাদের মতে, প্রচুর সৈন্য নিহত হয়েছে। অন্যেরা লুটের মালের বখরা বুঝে নিয়েই হয়ত দেশের দিকে সটকে পড়বে।

আহমেদ খান, তুমি এসব বিষয়ে একদম নিশ্চিত? গতবার শেরশাহের হতবাক করে দেয়া আক্রমণ সম্বন্ধে তুমি আমাদের আগাম অবহিত করতে ব্যর্থ হয়েছিলে।

জ্বী, সুলতান, আহমেদ খান মাথা নীচু করে এবং পুনরায় কথা বলার পূর্বে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। শেরশাহ শান্তি চায়, আমাদের অনেকের মতো, আমাকেও এই ধারণাটা বিভ্রান্ত করেছিল। আমি তারপরেও গুপ্তদূত প্রেরণ করেছিলাম কিন্তু যতটা তৎপর হওয়া উচিত ছিল আমি সেটা প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হয়েছি। আর আমি যাদের প্রেরণ করেছিলাম সম্ভবত তারাও খুব একটা সতর্ক ছিল না…আর তারপরে আবহাওয়ার এই অবস্থায়…এবং শেরশাহের বাহিনীর দ্রুতগতি

হুমায়ুন হাত তুলে আহমেদ খানের আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রয়াস থামিয়ে দেয়। হুমায়ুন, যা ঘটে গিয়েছে তার দায়দায়িত্ব বিচার বিবেচনা না করেই খানিকটা হলেও অনুগত আর মারাত্মকভাবে আহত আহমেদ খানের উপরে চাপিয়ে দিতে চায়। কিন্তু সেটা করা অনুচিত হবে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতার অধিকারী, প্রধান সেনাপতি আর সম্রাট সে নিজে। ব্যাথা আর ক্ষতস্থান শুকাতে শুরু করায় আরম্ভ হওয়া চুলকানির কারণে ঘুমাতে না পেরে, বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে নিজেকে অনবরত প্রশ্ন করতে থাকে, কেন তাকে এভাবে পরাজয় বরণ করতে হল। মানুষের উদ্দেশ্য খতিয়ে দেখতে খানজাদা তাঁকে যেমন বারবার অনুরোধ করেছে সে কি সেসবের তোয়াক্কা না করে বড় বেশী অহঙ্কারী হয়ে পড়েছিল, সে যা শুনতে চায় কেবল সেটাই শোনার জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠেছিল। সে জানে যে সে আত্মতুষ্টিতে আপ্লুত হয়ে পড়েছিল কিন্তু তাঁর রণনীতিতেও কি কোনো খুঁত ছিল? অবশ্য, অতীত রোমন্থন করে সে নিজেকে বিষণ্ণ করে তুলতে চায় না বরং পরাজয়ের এই তিক্ততা কাটিয়ে এহেন পরিস্থিতির যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেটাই নিশ্চিত করতে চায়। এই বিষয়ে সে স্থিরপ্রতিজ্ঞ। বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে রাজ্য শাসনের অভিপ্রায় তার মাঝে আরও তীব্র হয়ে উঠে।

আহমেদ খান, আমি তোমাকে দোষারোপ করছি না কিন্তু ভবিষ্যতে নদীর উভয় তীরে যেন আমাদের যতবেশী সম্ভব গুপ্তদূত মোতায়েন থাকে। আমার ফুপুজান এবং অন্যান্য রাজমহিষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তাদের সঙ্গে অবস্থানকারী সেনাবাহিনীর কি খবর?

এতে বিপর্যয়ের ভিতরে একমাত্র সুসংবাদ কেবল তাদের কাছ থেকেই এসেছে। অবিশ্রান্ত বৃষ্টিপাতের ভিতরেও তারা বেশ দ্রুত গতিতেই এগিয়ে চলেছে এবং আশা করছে সাত কি আট সপ্তাহের ভিতরে তাঁরা আগ্রা পৌঁছে যাবে।

বেশ। বাবা ইয়াসভালের দিকে ঘুরে এবার হুমায়ুন জিজ্ঞেস করে, আমাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কে আমাকে বলেন।

সুলতান, আমাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছে। আমাদের পঞ্চাশ হাজারেরও বেশী সৈন্য হয় মৃত নতুবা মারাত্মকভাবে আহত হয়েছে বা পালিয়ে গেছে, এবং আমরা সেইসাথে নিদেনপক্ষে প্রায় সমসংখ্যক ঘোড়া, হাতি আর বারবাহী পশুও হারিয়েছি। আমরা আমাদের কয়েকটা মাত্র কামান নিয়ে আসতে পেরেছি এবং সেগুলোর বেশীরভাগই আবার ছোট। যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহের জন্য গচ্ছিত অর্থ আর অন্যান্য যুদ্ধ উপকরণের সিংহভাগও আমরা খুইয়েছি।

আমি এমনটাই আশঙ্কা করছিলাম। নিজেদের সংগঠিত আর সুসজ্জিত করতে আমাদের সময় দরকার। আমাদের মিত্রদের মনে বিদ্রোহ বা স্বপক্ষ ত্যাগের মতো কোনো প্রকার হঠকারী ভাবনা সৃষ্টি হবার আগেই তাদের আশ্বস্ত করতে আমাদের দূত প্রেরণ করা উচিত। শেরশাহের মতো, আমরাও ঠিক এই মুহূর্তে নতুন করে যুদ্ধ শুরু করার মতো অবস্থায় নেই। আমাদের উচিত হবে, গঙ্গার তীর বরাবর আমাদের অগ্রযাত্রা বজায় রাখা। এই ধরনের পশ্চাদপসারণে কোনো লজ্জা নেই যদি সেটা বিজয়ের পূর্বাভাস ঘোষণা করে, আর আমাদের কর্তব্য হবে সেটাই নিশ্চিত করা।

*

বৃষ্টিপাত যদিও থেমে গেছে এবং সূর্য এখন আকাশে স্বমহিমায় বিরাজমান থাকায়, হুমায়ুনের দরবার কক্ষের সামনের প্রাঙ্গণের ফোয়ারাগুলোর বুদ্বুদে রঙধনুর মাত্রা সৃষ্টি হয়েছে, আগ্রা দূর্গে তাঁর দর্শনার্থী কক্ষ এখনও জলীয় বাষ্পের কারণে ভেজা আর চিকচিক করছে। চৌসার সেই ভাগ্যবিড়ম্বিত যুদ্ধের পরে প্রায় চারমাস অতিক্রান্ত হয়েছে। হুমায়ুন আগ্রার দক্ষিণে প্রায় একশ বিশ মাইল দূরে শেরশাহের যেকোনো অপ্রত্যাশিত অগ্রযাত্রাকে প্রতিহত করতে নিজের মূল বাহিনীকে মোতায়েন রেখে, সে নিজে রাজধানী আগ্রায় ফিরে এসেছে আরও সৈন্য সংগ্রহ করতে।

আগ্রা পৌঁছাবার পরে সেখানে তার জন্য আরও দুঃসংবাদ অপেক্ষা করেছিল। বাংলায় শেরশাহজনিত কারণে তার ব্যস্ততার সুযোগ নিয়ে গুজরাতের সুলতান বাহাদুর শাহ আর তার মিত্র লোদীদের রাজ্যাভিযোগী পাহাড়ের গোপন আশ্রয় ছেড়ে নেমে এসে গুজরাতের শক্তঘাঁটি থেকে সেখানে হুমায়ুনের রেখে আসা শাসক আর তাদের সামান্য সংখ্যক সৈন্যদের বিতাড়িত করেছে। হুমায়ুন বুঝতে পারে যে তাঁর পক্ষে দুটো রণক্ষেত্রে যুদ্ধ করা অসম্ভব, সে তাঁর উজির এবং তাঁর মরহুম আব্বাজানের সময়ে অসংখ্য ঝুঁকিপূর্ণ দৌত্য অভিযানে অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ কাশিমকে গুজরাতে প্রেরণ করে একটা শান্তি চুক্তির ব্যাপারে আলোচনা করতে। গুজরাত যদি তাকে তাদের নামেমাত্র অধিরাজ হিসাবে স্বীকার করে নেয় তাহলে সে গুজরাতের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার ফিরিয়ে দিতে রাজি আছে।

এক সপ্তাহ পূর্বে ক্লান্ত, ধূলায় ধুসরিত কিন্তু কান পর্যন্ত বিস্তৃত হাসি নিয়ে কাশিম তাঁর ঘোড়া থেকে নেমে হুমায়ুনকে বলে যে গুজরাতের সুলতান তার প্রস্তাব মেনে নিতে রাজি হয়েছেন। দরবারে অপেক্ষমান অমাত্য আর সেনাপতিদের সাথে মিলিত হতে দূর্গ প্রাঙ্গন অতিক্রম করার সময় হুমায়ুন অন্যান্য আরও উৎসাহব্যঞ্জক অগ্রগতির কথা বিবেচনা করে। তাঁর সৎ-ভাইয়েরা তাদের নিজ নিজ প্রদেশ থেকে আপাতত অল্প সংখ্যক সৈন্যের দল প্রেরণ করেছে ভবিষ্যতে আরও বেশী সংখ্যক সৈন্য প্রেরণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে। কামরান আর তাঁর অন্যান্য সৎ-ভাইদের ভিতরে অন্তত এখনও পর্যন্ত তার দুর্ভাগ্যকে তারই বিরুদ্ধে বিদ্রোহের উসিলা হিসাবে ব্যবহারের কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি বরং শেরশাহের বিদ্রোহ যেন তাদের ভাইদের আরও কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। হুমায়ুন নিজেকে আশ্বস্ত করতে চায়, সবকিছু আবার আগের মতো হবে এবং তার মুখে হাল্কা হাসির একটা আভাস ফুটে উঠে।

হঠ যাও। মহামান্য সুলতানের কাছাকাছি যাবার কথা কল্পনাও করতে যেও না।

হুমায়ুন ঘুরে দাঁড়িয়ে তার পেছনে যেখান থেকে চিৎকারটা এসেছে সেদিকে তাকায়। দীর্ঘকায়, কালো পাগড়ি পরিহিত এক প্রহরী তার সাথে ধ্বস্তাধ্বস্তি করতে থাকা একটা ছোটখাট অবয়বের কব্জি শক্ত করে ধরে রেখেছে।

তিনি আমাকে আসতে বলেছেন- দুই এক ঘন্টার জন্য তাঁর সিংহাসনে আমাকে বসতে দেবেন।

বাছা রোদে কি তোমার মাথা ঘুরে গিয়েছে? তাঁকে অসম্মান করলে- কপাল যদি ভালো হয় তাহলে তোমাকে কেবল চাবকে ছেড়ে দেয়া হবে আর খারাপ হলে হাত আর পা বেঁধে হাতির পায়ের নীচে ফেলে দেয়া হবে।

হুমায়ুন প্রহরীর হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করতে মোচড়াতে থাকা দৃঢ় কণ্ঠের অধিকারী অবয়বের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। অবয়বটা আর কারও না, তার প্রাণ রক্ষাকারী ভিস্তি নিজামের।

ওকে আসতে দাও। প্রহরী সাথে সাথে আদেশ পালন করে এবং নিজাম হুমায়ুনের সামনে মাথা নত করে হাটু ভেঙে বসে পড়ে।

নিজাম, তুমি উঠে দাঁড়াতে পার। গঙ্গা অতিক্রম করতে আর চৌসার রণক্ষেত্রে তুমি আমাকে কিভাবে সাহায্য করেছিলে আমার সেটা ভালোই মনে আছে। আমার এটাও মনে আছে কোনো পুরষ্কারের জন্য তুমি কিভাবে নিষেধ করেছিলে এবং আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য আমি বলেছিলাম যে সামান্য সময়ের জন্য তুমি আমার সিংহাসনে উপবেশন করতে পারবে আর সে সময়ে তোমার যেকোনো আদেশ পালন করা হবে। হুমায়ুনের দেহরক্ষী আর সেখানে উপস্থিত অমাত্যবৃন্দ যাদের ভিতরে কাশিম আর বাইসানগারও রয়েছেন যারা দরবার কক্ষে যাবার তাঁকে সঙ্গ দিচ্ছিলেন সবাই নিজেদের ভিতরে বিস্মিত দৃষ্টি বিনিময় করে কিন্তু হুমায়ুন তাঁদের সবার বিস্মিত দৃষ্টি উপেক্ষা করে। আমাদের অস্থায়ী সম্রাটের পক্ষে মানানসই একটা আলখাল্লা নিয়ে এসো, হুমায়ুন জওহরকে আদেশ দিতে, কয়েক মিনিটের ভিতরে সে লাল মখমলের তৈরী একটা আলখাল্লা এবং একই উপকরণ দিয়ে তৈরী সোনার জরি দিয়ে কারুকাজ করা পরিকর এনে হাজির করে।

নিজাম তার চারপাশে গোলাপজলের বুদ্বুদ উঠতে থাকা ঝর্ণা আর দূর্গ প্রাঙ্গণের ফুলের বাগানের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। তাকে এখন আর আগের মতো আত্মবিশ্বাসী দেখায় না এবং জওহর আলখাল্লা হাতে তাঁর দিকে এগিয়ে আসতে সে গুটিয়ে যায়।

নিজাম, ভয় পেয়ো না। হুমায়ুন কিশোর ছেলেটার কাঁধ চাপড়ে দেয়। অনায়াসে নিজের সবচেয়ে প্রিয় অভিপ্রায় সবসময়ে সিদ্ধ হয় না। জওহরের হাত থেকে আলখাল্লাটা নিয়ে সে নিজে সেটা নিজামকে পরিয়ে দেয় এবং কোমর আর ডান কাঁধের রূপার বকলেস এঁটে দিয়ে পরিকরটা নিজামের ছোটখাট দেখতে অবয়বের চারপাশে জড়িয়ে দেয়। মখমলের আলখাল্লায় ঝাঁকড়া মাথার কিশোর ভিস্তিকে হয়ত খানিকটা হাস্যকর দেখায় কিন্তু নিজাম সোজাভাবে উঠে দাঁড়ালে তাঁর মস্তকবাহী দেহখাঁচায় উপযুক্ত মর্যাদা ফুটে উঠে।

চল, এবার এগোন যাক। হুমায়ুন দরবার হলের বাইরে অবস্থানরত ঢাকির দিকে তাকিয়ে ঈষৎ মাথা নোয়াতে, সম্রাটের আগমন বার্তা ঘোষণা করে, তারা সাথে সাথে সোনার উপরে নীলকান্তমণির কারুকাজ করা কাঠামোতে রক্ষিত মোষের চামড়া দিয়ে মোড়ান লম্বা ঢাকে হাতের তালু দিয়ে বোল তুলতে আরম্ভ করে।

নিজাম এসো, আমরা দুজন একসাথে যাই- তুমি এক ঘন্টার সম্রাট, আমি কবর পর্যন্ত নেতৃত্বের বোঝা বহনের জন্য জন্ম নেয়া সম্রাট।

হুমায়ুনের অমাত্য আর সেনাপতিরা যেখানে অপেক্ষা করছে সেই দরবার হলের দিকে হুমায়ুন আর নিজাম শোভাযাত্রা সহকারে এগিয়ে যায়। সিংহাসনের দিকে তারা এগিয়ে যাবার সময়, হুমায়ুন থমকে থেমে নিজামকে আলতো করে সামনের দিকে এগিয়ে দেয়। বিস্ময়ের একটা তুমুল শব্দের ভিতরে, নিজাম ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে সিংহাসনে আরোহন করে, ঘুরে দাঁড়ায় এবং সবশেষে উপবেশন করে।

হুমায়ুন হাত তুলে নিরবতা বজায় রাখতে বলে। চৌসার বিপর্যয়ের পরে আমার জীবন বাঁচাবার জন্য, এই কিশোর নিজাম ভিস্তির আনুগত্য আর সাহসিকতার কথা আমি পুরো দরবারের সামনে কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার করছি। আমি নিজামকে সেদিন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম যে আমার সিংহাসনে কিছুক্ষণের জন্য আরোহন করে সে তার ইচ্ছামতো যেকোনো ঘোষণা করতে পারবে। সে ইতিমধ্যে নিজেকে এর যোগ্য হিসাবে প্রতিপন্ন করেছে এবং আমি জানি, তাঁর হাতে আমি যে ক্ষমতা তুলে দিয়েছি সেই ক্ষমতার সে অপব্যবহার করবে না। নিজাম- কি তোমার অভিপ্রায়?

হুমায়ুন কৌতূহলী হয়ে উঠে। নিজাম নিজের জন্য কি চাইবে? অর্থসম্পদ, জমিদারী নাকি ধনরত্ন? সে অবশ্যই জানে যে তাঁর জীবন এবং তার পরিবারের সবার জীবন আর কখনও আগের মতো থাকবে না। নিজামের অভিপ্রায় মঞ্জুর করতে পেরে তাঁর ভালো লাগে।

সুলতান… সিংহাসনের উপর থেকে নিজামের কণ্ঠস্বর ক্ষীণ আর কীচকী শোনায়। নিজামও বোধহয় সেটা বুঝতে পারে, সে আবার চেষ্টা করে। সুলতান। তার কিশোর কণ্ঠ এইবার স্পষ্ট আর যথার্থভাবে ধ্বনিত হয়। আমি কেবল দুটো আদেশ করতে চাই। গঙ্গার তীরে আমি যেন অনুদান হিসাবে একখণ্ড জমি লাভ করি যেখানে আমি শস্য উৎপাদন করতে পারবো এবং এক বছরের জন্য সব ভিস্তিদের কর মুওকুফ করা হোক।

হুমায়ুন চাপা হাসির একটা গুঞ্জন শুনতে পায়। এমনকি কাশিমের সচরাচর গম্ভীর, আত্মনিরোধী মুখেও যেন একটা ক্ষীণ হাসির রেশ ফুটে ওঠার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, কিন্তু নিজামের অনুদ্ধত অনুরোধ হুমায়ুনকে আবেগপ্রবন করে তুলে। দরবারের অনেকের মতো সে নিজেকে মাত্রাতিরিক্ত রকমের সম্পদশালী করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেনি।

আপনার আদেশ যথাযথভাবে পালিত হবে।

আমিও তাহলে সিংহাসন থেকে নেমে আসতে প্রস্তুত। নিজাম লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়, তাঁর ক্ষুদ্র অবয়বে স্বস্তির একটা রেশ ফুটে উঠে, এবং হোঁচট খাওয়া থেকে বিরত থাকতে দুহাতে আলখাল্লাটা গোড়ালীর উপরে তুলে ধরে আলতো পায়ে নেমে আসে। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে হুমায়ুন অনুধাবন করে সত্যিকারের সাহস কাকে বলে সে এই প্রত্যক্ষ করেছে। দরবারে এসে হুমায়ুনকে নিজের প্রতিশ্রুতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করার কথা বলার জন্য নিজামকে কি বিশাল একটা ঝুঁকি নিতে হয়েছিল? সে ভালো করেই জানতো, তাঁর কথা হয়ত হুমায়ুন ভুলেই গেছেন বা তার ঔদ্ধত্যের কারণে তিনি কুদ্ধও হতে পারেন। ধ্বস্তাধ্বস্তি করতে থাকা ছেলেটার প্রতি সেই প্রহরী যদি চিৎকার না করতো তাহলে চেঁচিয়ে সম্রাটকে জবাবদিহি করতে বলার ধৃষ্টতা চাবুকের মূল্যে পরিশোধ করার কিংবা নিজের হঠকারীতার জন্য তাঁর মৃত্যুদণ্ড হবারও একটা সমূহ সম্ভাবনা ছিল।

হুমায়ুন এবার সিংহাসনে আরোহন করে। পুনরায় সম্রাটের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে আমিও এবার কিছু আদেশ করতে চাই। আদেশগুলো হল নিজাম ভিস্তিকে এমনভাবে জমির অনুদান দেয়া হোক যাতে সে নিজে এবং তার পুরো পরিবার স্বাচ্ছন্দে জীবন যাপন করতে পারে এবং সেই সাথে তাকে পাঁচশ স্বর্ণমুদ্রাও যেন প্রদান করা হয়। হুমায়ুন দেখে প্রহরীবেষ্টিত অবস্থায় দরবার হল থেকে যাবার আগে ক্ষুদে অবয়বটা, তার দিকে মাত্র একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়।

সেদিন অপরাহ্নে, সব দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন শেষে, ফ্যাকাশে চাঁদ আকাশে যখন মাত্র উঠতে শুরু করেছে এবং রাতের রান্নার জন্য নতুন করে আগুন জ্বালাবার পরে, হুমায়ুন আগ্রা দূর্গের প্রাকারবেষ্টিত ছাদে উঠে আসে। কিছুক্ষণের জন্য নিজের ভাবনায় বিভোর হয়ে থাকবার অভিপ্রায়ে সে তার সব প্রহরীদের চলে যাবার অনুমতি দিয়েছে। তার নির্জনতা প্রীতি বাবর একজন শাসকের জন্য যা মারাত্মক দোষ হিসাবে বিবেচনা করতেন কখনই হুমায়ুনকে পুরোপুরি পরিত্যাগ করেনি। নক্ষত্রের আবর্তনের প্রতি তাঁর এখনও আগের মতোই কৌতূহল রয়েছে। যদিও এসব অনুভূতি সে নিয়ন্ত্রণ করেছে, সে জানে যে তাঁর সেটাই করা উচিত, অনুভূতিগুলো এখনও আগের মতোই প্রবল- যার আসক্তি গুলরুখের তৈরী আফিম আর সুরার মিশ্রণের চেয়ে অনেকবেশী শক্তিশালী।

রাজত্বের নিপীড়ন নিয়ে তার আব্বাজান একবার তার সাথে আলোচনা করেছিলেন এবং তিনি ঠিকই বলেছিলেন। একজন শাসকের চেয়ে একজন দরিদ্র মানুষ হওয়াটা অনেক দিক দিয়েই উত্তম প্রস্তাবনা। নিজাম অন্তত, একজন স্বাধীন মানুষের মতো, গঙ্গার পানিতে তাঁর মশক ডুবিয়ে বেঁচে থাকতে পারে। একটা সাম্রাজ্যের ভবিষ্যতের বোঝা বহন করা মোটেই সহজ নয়, যদিও সে ভালো করেই জানে তাঁর কখনও এই পবিত্র দায়িত্ব পরিত্যাগ করার অভিপ্রায় হবে না।

সে যখন নিজের ভাবনা নিয়ে তন্ময় চারপাশ অন্ধকার করে তখন রাত নামছে। নিজের আবাসন কক্ষে ফিরে যাবার সময় হয়েছে যেখানে জওহর আর তাঁর অন্যান্য পরিচারকেরা রাতের খাবার পরিবেশন শুরু করবে- পাত্র ভর্তি ভেড়ার মাংস, মাখন দেয়া ভাত আর মোগলদের স্বদেশের কন্দজাতীয় সজি এবং জাফরান ও হলুদ দিয়ে রান্না করা হিন্দুস্তানের মশলাযুক্ত নানা পদ, তাঁর নতুন সাম্রাজ্যের সমভূমি দিনে যে সূর্যের প্রতাপে দগ্ধ হয় স্বাদে গন্ধে ঠিক সেরকমই প্রখর। দেয়ালের কুলুঙ্গিতে রাখা জ্বলন্ত মশালের আলোয় নিজের আবাসন কক্ষে ফিরে যাবার জন্য হুমায়ুন তিন অংশে বিভক্ত ঢালু পাথুরে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায়। নিজের ভাবনায় বিভোর হয়ে সে সিঁড়ির প্রথম অংশ অতিক্রম করে তারপরে বাঁক ঘুরে সিঁড়ির দ্বিতীয় অংশ অতিক্রম করার ঠিক আগ মুহূর্তে সে কয়েকটা কণ্ঠস্বর শুনে দাঁড়িয়ে যায়।

আমি ভেবেছিলাম সম্রাট নিজের পাগলামি থেকে পুরোপুরি আরোগ্য লাভ করেছেন। মাসের পর মাস বিনা প্রতিবাদে আমরা তাঁর পাগলামি সহ্য করেছি…গ্রহের প্রভাবযুক্ত দিন সম্বন্ধে আর সৌরমণ্ডল অঙ্কিত সেই আহাম্মকের সতরঞ্জি যতসব ফালতু ধারণা। আমাদের নিজের ইচ্ছামতো মূত্র বিসর্জনের অনুমতি ছিল বলে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম…।

সেই ঘামের গন্ধঅলা ক্ষুদে চাষার ব্যাটার দরবার হলের কাছাকাছি কখনও পৌঁছাতে পারারই কথা না, রাজকীয় সিংহাসনে উপবেশনের কথা না হয় বাদই দিলাম, কিছুক্ষণ বিরতির পরে আরেকটা কণ্ঠস্বর মন্তব্য করে। সম্রাট যদি তাঁকে একান্তই পুরস্কৃত করতে চাইতেন, একটা তামার মুদ্রা দিয়ে পাছায় কষে একটা লাথি দিয়ে বিদায় দিলেও চলতো। আমি আশা করি এটা কোনো নতুন পাগলামি সূচনা নয়। ঘাড়ের উপরে শেরশাহের যোদ্ধারা যখন নিঃশ্বাস ফেলছে তখন স্বপ্নদর্শীর চেয়ে আমাদের একজন যোদ্ধার বেশী প্রয়োজন।

আমাদের সম্রাট একজন দুর্দান্ত যোদ্ধা- যুদ্ধক্ষেত্রে তারমতো সাহসী আর কেউ নেই… তৃতীয় একজন মন্তব্য করে। তাঁর কণ্ঠস্বর মন্দ্র এবং বয়সের ছাপ স্পষ্ট কিন্তু কিন্তু অন্যদের মতো- হুমায়ুন একেও চিনতে পারে না।

আমরা অবশ্য আশা করতে পারি যে তিনি মনে রাখবেন যে কি জন্য তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। বাবর ছিলেন একজন সত্যিকারের পুরুষ- সেজন্যই কাবুল থেকে তাঁর অভিযাত্রী দলের সাথে আমি এখানে এসেছিলাম। আমি বিশ্বাস করতে পারিনা কল্পনাপ্রবণ এক জ্যোতিষীর জন্য আমি সবকিছু ত্যাগ করিনি…

কিন্তু তিনি কি ইতিমধ্যে অসাধারণ বিজয় অর্জন করেননি… গুজরাতের কথা একবার স্মরণ কর এবং কিভাবে আমরা… মন্দ্র কণ্ঠের অধিকারী বলতে থাকে, কিন্তু লোকগুলো হাঁটতে আরম্ভ করায় হুমায়ুন তাঁদের আলোচনার অবশিষ্টাংশ শুনতে পায় না।

তাদের কথাবার্তা তাঁকে ক্রুদ্ধ করে তোলে। ছুটে গিয়ে তাঁদের মুখোমুখি হবার অভিপ্রায় তাঁকে বেশ প্রলুব্ধ করতে থাকে কিন্তু তারা যা বলেছে সেগুলো খানিকটা হলেও সত্যি। আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে গোধূলির আলোয় দিনের সূচনা করে সে তাঁর সেনাপতি আর অমাত্যদের সাথে নিজের সম্পর্ক নষ্ট করেছে আর তার প্রজাদের হতাশ করেছে। কিন্তু নিজামের ব্যাপারে তাঁদের ধারণা ভুল। নিজামকে সে কথা দিয়েছিল এবং সে কথা রেখেছে। যা একজন সম্মানিত ব্যক্তির উপযুক্ত আচরণ। অন্য কিছু করলে, ইহকালে না হোক পরকালে তাকে অবশ্যই সেজন্য শাস্তি পেতে হতো…

*

আহমেদ খান, প্রথমে আমাকে বল, আমাদের শত্রু সম্বন্ধে আমরা কি জানি?

হুমায়ুন নিজের চারপাশে তার সামরিক উপদেষ্টাদের সাথে সম্রাটের লাল নিয়ন্ত্রিত তাবুতে আবারও একবার বৈঠকে বসেছে। শেরশাহের বিরুদ্ধে নতুন করে যুদ্ধ শুরু করতে গত সন্ধ্যায় আগ্রা থেকে একশ বিশ মাইল দক্ষিণে সে তার সেনাবাহিনীর শিবিরে এসে হাজির হয়েছে।

সুলতান, সংবাদ খুব একটা ভালো না। শেরশাহ যুদ্ধে নিহত যোদ্ধাদের সমাধিস্থ করে খুব মন্থর গতিতে কাকরি ফিরে গেছে, এই শহরটাকে সে তার নেতৃত্বের অগ্রবর্তী কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহার করে থাকে। দশ সপ্তাহ আগে, সেখানেই তার বিজয় উদযাপন উপলক্ষ্যে একটা বিশাল কুচকাওয়াজের আয়োজন করেছিল। ঢাকের তালে তালে তাঁর সবচেয়ে চৌকষ অশ্বারোহীদের একটা দল নিজেদের বেগুনী নিশান বহন করে কুচকাওয়াজের নেতৃত্ব দেয়। তারা উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে হাত নাড়তে তাঁরা গলার স্বর সপ্তমে তুলে তাঁদের উৎসাহিত করে। শেরশাহ আমাদের কাছ থেকে ব্রোঞ্জের যে কামানগুলো জব্দ করেছিল গঙ্গার তীরের কাদা থেকে তাঁদের বেশীর ভাগই টেনে তুলতে সফল হয়েছে এবং পুনরায় তাদের কার্যক্ষম করে তুলেছে। কুচকাওয়াজে এর পরেই ছিল কামানগুলো, রাস্তা দিয়ে সেগুলোকে টেনে নিয়ে যায় আমাদেরই কিছু হাতি যা সে তাড়া করে ধরেছে। কামানের ঠিক পেছনেই ছিল আমাদের যুদ্ধবন্দিদের সারি, শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় তাদের হাঁটতে বাধ্য করা হয়েছিল। আমাদের এক গুপ্তচরের বয়ান অনুসারে, মিষ্টি বিক্রেতার ছদ্মবেশে সে খুব কাছ থেকে তাঁদের দেখেছে, বন্দিদের অনেকেই খুঁড়িয়ে হাঁটছিলো বা তাদের ক্ষতস্থানসমূহে নোংরা কাপড় দিয়ে পটি বাঁধা ছিল। বাকিদের দেহের যেখানে শেকল দংশন করেছে সেখানেই রয়েছে দগদগে যন্ত্রণাদায়ক ক্ষত। বন্দিদের সবাইকে ক্ষুধার্ত আর রোগা দেখাচ্ছিল আর তাদের চোখ মাটির দিকে নিবদ্ধ ছিল। গুপ্তচর আরও বলেছে যে দর্শকরা তাদের অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে, ধাক্কা দেয় আর তাঁদের দিকে পচা আবর্জনা ছুঁড়ে মারে এমনকি কেউ কেউ তাদের লাঠি দিয়েও আঘাত করে।

শেরশাহের উল্লসিত বাহিনীর আরও অনেকগুলো দল পর্যায়ক্রমে তাদের অনুসরণ করে এবং সবশেষে শেরশাহ নিজে লম্বা একটা হাতির পিঠে স্থাপিত গিল্টি করা হাওদায় আরোহন করে এগিয়ে আসে, হাতিটার লম্বা দাঁতগুলো সোনার পাতা দিয়ে মোড়ান এবং এর পর্যানের ঢাউস কাপড়টায়, যা মাটি পর্যন্ত বিস্তৃত, মুক্তা আর মূল্যবান পাথর দিয়ে কারুকাজ করা। শোভাযাত্রাটা যখন শহরের মূল চত্বরে পৌঁছায় শেরশাহ হাতির পিঠ থেকে নেমে আসে বেগুনী কাপড় দিয়ে আবৃত একটা অতিকায় মঞ্চে নিজের নির্ধারিত স্থান গ্রহণ করতে।

সে এখানে আমাদের কাছ থেকে অধিকৃত সম্পদ তাঁর প্রধান সমর্থকদের মাঝে উপহার হিসাবে বিলিয়ে দেয় এবং আমাদের কাছ থেকে দখল করা জমি তাদের ভিতরে বিলিবণ্টন করে, এবং তাদের মাঠে আর খনিতে কৃতদাস হিসাবে কাজ করার জন্য আমাদের ভাগ্যপ্রপীড়িত বন্দিদের কয়েকটা দলকে দান করে। তারপরে, যা বলা আরো লজ্জাজনক, আমাদের অনেক প্রাক্তন মিত্র এবং অনুগত জায়গীরদার নিজেদের আনুষ্ঠানিক পোষাকে সজ্জিত হয়ে সামনে এগিয়ে আসে। শেরশাহের সামনে নোংরায় তারা খুশীমনে নিজেদের অধধামুখে প্রণত হয়ে মার্জনা ভিক্ষা করে এবং সে তার সেনাবাহিনীতে তাদের বিভিন্ন পদ দিয়ে পুরস্কৃত করে এবং আপনি যখন পরাজিত হবেন তখন আরও পরিমাণে দান করার প্রতিশ্রুতি দেয়। তাদের অনুসরণ করে দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলোর শাসকদের প্রেরিত রাজদূতেরা যেমন হীরক-সমৃদ্ধ গোলকুণ্ডা, যিনি আমাদের দুর্বলতা থেকে নিজেদের আরও শক্তিশালী করার সুযোগ দেখতে পেয়ে, শেরশাহকে সবধরনের সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয় এবং বিনিময়ে তাদের খুশী করতে আমাদের ভূখণ্ডের কিয়দংশ তাঁদের অধিকারে ছেড়ে দেবার সাড়ম্বর প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়।

সবশেষে, উচ্চনাদের আরেকদফা তূর্যবাদনের মাধ্যমে, আপনার প্রাক্তন অনুগত রাজাদের ভিতরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যাঁরা তাঁদের একজন- গোলপুরের রাজা- এগিয়ে আসে এবং শেরশাহের সেনাপতিদের অনেককে সাথে নিয়ে সে শেরশাহের সামনে হাঁটু ভেঙে বসে। শেরশাহকে সম্রাটের পদবী- পাদিশাহ গ্রহণের জন্য তারা একসাথে তাকে অনুরোধ করে, তাকে বশংবদ আর বিশ্বাসঘাতকের মতো আশ্বাস দেয় যে এই পদবীর জন্য সে সবসময়েই আপনার চেয়ে অনেকবেশী যোগ্য। শেরশাহ দুইবার নিজের বিরুদ্ধে যুক্তি প্রদর্শন পূর্বক বক্তব্য প্রদান করে বলেন যে তিনি কেবল আপনার দ্বারা অত্যাচারিতদের সাহায্য করতে চান। নিজের জন্য পুরষ্কার কিংবা ক্ষমতা কিছুই চান না। অবশ্য তৃতীয়দফা দর্পোদ্ধত আর আরো বেশী চাটুকারী বিশেষণ প্রয়োগ করে সনির্বন্ধ প্রার্থনা করা হলে তাঁদের অতিরঞ্জিত বাক্য ব্যবহার ততক্ষণে মাত্রা ছাড়িয়েছে। তিনি রাজি হয়ে বলেন, যদি এটাই তোমাদের অনড় আকাঙ্খ হয়, আমি কেবল সম্মতি জানাতে পারি। বিচক্ষণতার সাথে শাসনকার্য পরিচালনা আর সবাইকে ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি আমি দিলাম। তারপরে সোনার উপরে রুবি দিয়ে কারুকাজ করা একটা মুকুট- সবসময়ে যা প্রস্তুত ছিল; পুরো ব্যাপারটাই মঞ্চে অভিনীত একটা প্রহসন, তাঁর প্রাথমিক প্রত্যাখ্যান কেবলই লোক দেখান- শেরশাহের তিনজন উচ্চপদস্থ আধিকারিক আর গোলপুরের রাজা তাঁর মাথায় স্থাপন করে। উপস্থিত সবাই নিজেদের তার সামনে প্রণত করে, মাটিতে নিজেদের বিশ্বাসঘাতক নাক চেপে ধরে।

পরে সেই রাতে, শেরশাহ বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রাপূর্ণ এক গণউৎসব মঞ্চস্থ করে। মশালের ধকধক করে জ্বলতে থাকা আলোতে প্রতিটা রাজ্য এবং গোত্রের একজন তরুণ যোদ্ধা যারা এখন তার সাথে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ শেরশাহের সামনে সামরিক কসরত প্রদর্শন করে, এসময়ে সে সোনার কারুকাজ করা চাঁদোয়ার নীচে একটা লম্বা, খাড়া পৃষ্ঠদেশযুক্ত সোনার গিল্টি করা একটা সিংহাসনে উপবিষ্ট ছিল। সিংহাসনে শেরশাহের মাথার ঠিক উপরে গর্জনরত একটা ক্রুদ্ধ ব্যাঘ খোদাই করা রয়েছে। বাঘটার চোখের স্থানে দুটো প্রকাণ্ড রুবি শোভা পাচ্ছে যেগুলো আমাকে বলা হয়েছে- আধারেও তীব্রভাবে জ্বলজ্বল করে। প্রদর্শনী শেষ হবার পরে সবাই তথাকথিত সম্রাটের সামনে পর্যায়ক্রমে মাথা নত করে এবং তিনি তাদের ঘামে ভেজা কামান মাথায় তাদের আর তারা যে অংশের প্রতিনিধিত্ব করছে সবাইকে তিনি যে সাফল্য আর সমৃদ্ধির অংশীদার করবেন তার লক্ষণস্বরূপ জাফরান, মুক্তা চূর্ণ, কস্তরীমৃগ আর তিমি মাছের অন্ত্রে প্রাপ্ত মোমসদৃশ গন্ধদ্রব্য ছিটিয়ে দেন।

পরের দিনটা ছিল শুক্রবার, শহরের প্রধান মসজিদে- শেরশাহের সেনাপতিদের উপস্থিতির কারণে জনাকীর্ণ- ইমাম সাহেবও শেরশাহের নামে খোতবা পাঠ করে শেরশাহকে সম্রাট হিসাবে ঘোষণা করে এবং বিশ্বাসঘাতকসুলভ আর তীব্র কটাক্ষপূর্ণ ভঙ্গিতে আপনার সমুদয় ভূখণ্ড হোক সেটা বাংলায় তার দ্বারা ইতিমধ্যে জবরদখলকৃত বা তার নাগালের বাইরে পাঞ্জাব আর আফগানিস্তান, শেরশাহকে বরাদ্দ দেয়া হয়। পরের দিন, শেরশাহ আমাদের বিরুদ্ধে নতুন করে তার অগ্রাভিযান শুরুর অভিপ্রায়ে কুচকাওয়াজের সাথে রওয়ানা দেয়। তার নতুন মিত্রদের কল্যাণে, এখন তার বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা প্রায় দুই লাখের কাছাকাছি।

সে এই মুহূর্তে কোথায় অবস্থান করছে?

এখান থেকে প্রায় একশ মাইল দূরে, আগ্রা অভিমুখে ধীর গতিতে অগ্রসর হচ্ছে।

বাবা ইয়াসভালো, আমাদের নিজেদের সেনাবাহিনীর কি অবস্থা? নতুন করে সমর-সজ্জার অগ্রগতি কি ভালোমতো চলছে?

হ্যাঁ, অস্ত্র আর বর্ম নির্মাতারা দারুণ কাজ দেখিয়েছে। আমাদের লোকেরা সবাই নতুন অস্ত্র পেয়েছে। আরো বেশী সংখ্যক কামান উৎপাদনের লক্ষ্যে আমাদের ঢালাইখানার চুল্লী দিনরাত জ্বলছে। আমাদের অশ্বারোহী বাহিনীকে পুনরায় সচল করতে ঘোড়ার দালালেরা আমাদের যথেষ্ট পরিমাণে ঘোড়া সরবরাহ করেছে। যদিও অনেকগুলোই আমাদের পিতৃপুরুষের স্বদেশের তৃণভূমিতে জন্ম নেয়া ঘোড়ার মতো বিশাল আর শক্তিশালী না।

আর আমাদের মিত্র এবং আমার সৎ-ভাইদের দ্বারা আরও সৈন্য প্রেরণের প্রতিশ্রুতির কি খবর?

এই বিষয়ে খবর খুব একটা ভালো না। আমাদের অনেক মিত্রই গড়িমসি করছে, সৈন্য প্রেরণে বিলম্বের কারণ হিসাবে তারা বর্ষাকাল বা স্থানীয় বিদ্রোহের অজুহাত দিচ্ছে বা পাঠালেও খুব ছোট বাহিনী প্রেরণ করছে। হিন্দাল আর আসকারি অবশ্য প্রতিশ্রুতি পালন করেছে বিশেষ করে হিন্দাল প্রতিশ্রুত সংখ্যার চেয়েও বেশী সংখ্যক সৈন্য প্রেরণ করেছে কিন্তু আপনার সৎ-ভাইদের ভিতরে সবচেয়ে বড় যে কামরান সে পাঞ্জাব থেকে মাত্র আড়াইশ অশ্বারোহীর একটা নিতান্ত ক্ষুদ্র বাহিনী প্রেরণ করেছে যাদের ঘোড়াগুলো দারুণ। আমরা অধিকতর সহযোগিতার কথা তাকে স্মরণ করিয়ে দিতে সে প্রত্যুত্তরে স্পষ্ট করে কোনো সময়সীমা উল্লেখ করেনি এবং আপনি আরও ব্যাপক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারেন এমন ইঙ্গিত দিয়ে কিছু সৈন্য সে নিজের কাছে রাখতে চেয়েছে।

কিন্তু আমরা যাতে আরও পরাজয়ের সম্মুখীন হই, সেটা নিশ্চিত করার জন্য এটা একটা অনিবার্য পন্থা, হুমায়ুন তীক্ষ্ণ কণ্ঠে গর্জে উঠে কিন্তু তারপরে বেশী কিছু বলা থেকে নিজেকে বিরত রাখে। প্রকাশ্যে নিজের সৎ-ভাইদের সমালোচনা করাটা মোটেই সমীচিন হবে না। কামরানের সাথে তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আদানপ্রদানের সাথে তার সেনাপতির বক্তব্য প্রতিধ্বনিত হয়। তার সৎ-ভাই চিঠির উত্তর দিতে দেরী করে এবং যখন সে উত্তর পাঠায় শেরশাহের প্রতি নিজের বৈরিতা যদিও সে যথার্থ মারমুখো ভঙ্গিতে প্রকাশ করে, কিন্তু হুমায়ুনের নেতৃত্বের অধীনে যুদ্ধের জন্য সৈন্য প্রেরণের ক্ষেত্রে সে সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দেয় না। কামরান তার সব সৈন্য নিয়ে বরং নিজে যুদ্ধে যোগদানের প্রস্তাব দিয়েছে। সে খুব ভালো করেই জানে হুমায়ুন ইহা প্রত্যাখ্যান করবে, কারণ তার প্রস্তাবে রাজি হওয়া মানে পাঞ্জাবকে শাসকহীন করা এবং সেই সাথে আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য সৈন্যহীন করা। কামরান মনে হয় প্রতীক্ষা করার খেলা শুরু করেছে, সে নিজের ব্যক্তিগত অবস্থান সংরক্ষণের বিষয়ে বেশী উদগ্রীব তাঁদের আব্বাজানের সাম্রাজ্যের হাতছাড়া হওয়া প্রদেশগুলো পুনরুদ্ধারের চেয়ে যদি এর মানে হয় তাঁর নিজস্ব গৌরব বৃদ্ধির চেয়ে হুমায়ুনের গৌরব বৃদ্ধি করা।

আমি আমার সৎ-ভাইদের সাথে যোগাযোগ করবো। কিন্তু আমাদের সেনাপতিরা এই মুহূর্তে ঠিক কতজন সৈন্য মোতায়েন করতে সক্ষম?

সুলতান, এক লক্ষ সত্তর হাজার।

তার মানে বর্তমান পরিস্থিতিতে শেরশাহের সৈন্য সংখ্যা আমাদের চেয়ে বেশী।

জ্বী, সুলতান। আপনার ভাই কামরান আর অন্যান্যদের কাছ থেকে যতক্ষণ না বাড়তি লোকবল এসে পৌঁছায়।

*

হুমায়ুন নিজের গালে সন্ধ্যার উষ্ণ, কোমল বাতাসের স্পর্শ অনুভব করে যখন, স্থানটা গঙ্গার তীরে কনৌজের বসতি থেকে খুব একটা দূরে অবস্থিত না, সে বিক্ষিপ্তভাবে জন্মান ঝোপঝাড় আর ইতস্ততভাবে বেড়ে উঠা বামনাকৃতি গাছপালা শোভিত বেলেপাথরের একটা সরু চূড়ায় নিজের আদেশপ্রদানকারী অবস্থান থেকে বিপরীতপার্শ্বের শৈলচূড়া অভিমুখে তাকায় যেখানে, যদি তার গুপ্তচরদের বিবরণী নির্ভুল হয়, আগামীকাল সকালে শেরশাহের বাহিনী এসে উপস্থিত হবে। মৃদুমন্দ এই বায়ু প্রবাহটা কিছুক্ষণের জন্য হুমায়ুনকে তাঁর জন্মস্থান, আফগানিস্তানে গ্রীষ্মকালে প্রবাহিত শীতল বাতাসের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। অতীতের স্মৃতি মনে পড়তে তার মুখে ফুটে উঠা আধো হাসির আভাস তার মাথার পেছনে সতত বর্তমান জ্ঞানের কারণে নিমেষে বিতাড়িত হয়, যে গত দুইমাস কাল ধরে তার সামরিক পরিষদমণ্ডলী দুঃসংবাদব্যাতীত আর কিছুই বয়ে আনেনি।

শেরশাহের ধীর কিন্তু অবিশ্রান্ত অগ্রগতি বজায় আছে। যা সম্ভবত একেবারে অপ্রত্যাশিত না কিন্তু হুমায়ুন যেটা একেবারেই আঁচ করতে পারেনি সেটা হল মুরাদাবাদের রাজা, হানিফ খানের স্বপক্ষত্যাগ করে শেরশাহের সাথে যোগ দেবার বিষয়টা, সুলেমান মির্জা মৃত্যুবরণ করার পরে যিনি এখন হুমায়ুনের অশ্বারোহী বাহিনীর সবচেয়ে বয়োজ্যোষ্ঠ অধিনায়ক, তার সাথে রয়েছে পনের হাজার অশ্বারোহীর একটা বিশাল বাহিনী, দিল্লীর পূর্বে হানিফ খানের জমিদারী এলাকা থেকে যাদের নিয়ে আসা হয়েছে। তাঁর কাপুরুষোচিত পলায়নের ঠিক পরপরই, শেরশাহ নিশ্চিতভাবেই পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা অনুসারে- গঙ্গার তীরবর্তী সুরক্ষিত একটা শহরে আক্রমণ চালায় যা ইতিপূর্বে হানিফ খানের অধীনস্ত ছিল। হানিফ খানের স্বপক্ষত্যাগের কারণ হতোদ্যম হয়ে পড়ায়, হুমায়ুনের কয়েক হাজার সৈন্য যাঁরা তখনও তাঁর প্রতি অনুগত ছিল সামান্যই প্রতিরোধ গড়ে তুলে এবং অচিরেই শহরটা আত্মসমর্পন করলে শেরশাহের অগ্রযাত্রার পথ পরিষ্কার হয়ে যায়। হুমায়ুন কোনোভাবেই সেইসব সৈন্যদের কোনো দোষ দিতে পারে না। সে বরং নিজেকেই ভৎর্সনা করে যে যাঁরা তাঁকে চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে তাঁদের উচ্চাকাঙ্খ আর চরিত্র অনুধাবনে সে মোটেই সময় দেয়নি ভবিষ্যতে এ ধরনের ভুল সে পরিহার করতে চেষ্টা করবে।

হুমায়ুনের পেছনে যা ঘটছে সে সবের বিবরণও তাঁকে সমানভাবে বিব্রত করে। হিন্দালের শাসনাধীন প্রদেশ আলওয়ারে শেরশাহের সমর্থনে একটা সশস্ত্র বিদ্রোহ দানা বেঁধেছিল যা হিন্দাল চিঠিতে জানায়, বহু কষ্টে সে এই বিদ্রোহ দমন করেছে। দিল্লীর কাছে অবস্থিত পার্বত্য এলাকায় হানিফ খানের অনুগত জায়গীরদারদের ভিতরেও বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়েছে এবং হুমায়ুন বাধ্য হয় একদল সৈন্য প্রেরণ করে বিদ্রোহীদের দমন করতে, যাদের তার সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেবার প্রস্তুতি স্বরূপ প্রশিক্ষিত করাটা গুরুত্বপূর্ণ।

কামরানের কাছ থেকে প্রেরণ করা চিঠিটা সবকিছুর ভিতরে নিকৃষ্টতম। হুমায়ুনের প্রতি এবং রাজবংশের প্রতি আর শেরশাহের সাথে তার বিরোধিতার প্রতি সে নিজের আনুগত্য স্বীকার করে নিয়ে একই সাথে তাঁর ভাইয়ের আগ্রা ছাড়িয়ে আরও দুইশ মাইল পূর্বে গিয়ে শেরশাহকে মোকাবেলা করার সামরিক কৌশলকে সে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। সে এর পরিবর্তে প্রস্তাব দিয়েছে হয় দিল্লী নতুবা আগ্রাকে অবরোধের জন্য প্রস্তুত করতে আর তাঁদের উঁচু দেয়ালে ফাটল সৃষ্টির অভিপ্রায়ে বৃথা উদযোগ গ্রহণ করে শেরশাহকে নিজ শক্তি ক্ষয়ের একটা সুযোগ দেয়া। কামরান আরও সৈন্য প্রেরণের বিষয়টা প্রত্যাখ্যান করতে অজুহাত হিসাবে নিজের উদ্বেগকে ব্যবহার করে সেই সাথে দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেছে যে হুমায়ুনের ক্রুটিযুক্ত কৌশল যদি ব্যর্থ হয়, কামরান মনে করে যে পরিকল্পনাটার ব্যর্থ হবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে, তখন তাঁর নেতৃত্বে প্রতিরক্ষার দ্বিতীয় ব্যুহ কার্যকর করতে সে প্রতিশ্রুত বাহিনীকে না পাঠিয়ে আটকে রাখছে।

সুলতান, বাবা ইয়াসভালো আপনার সেনাবাহিনী পরিদর্শনের সময় আপনাকে সঙ্গ দেবার জন্য অপেক্ষা করছেন। জওহর হুমায়ুনের স্বপ্ন-কল্পনায় বিঘ্ন ঘটায়। সে হুমায়ুনের খয়েরী রঙের উঁচু ঘোড়াটার লাগাম ধরে রয়েছে।

উত্তম প্রস্তাব। হুমায়ুন ঘুরে দাঁড়ায় এবং ঘোড়ায় চড়ে সরু চূড়া বরাবর খানিকটা এগিয়ে যায় বাবা ইয়াসভালের সাথে মিলিত হতে। দুজনে সামনে এগোন শুরু করতে, হুমায়ুন জানতে চায়, আমাদের গুপ্তদূতদের সর্বশেষ বিবরণীর কি বক্তব্য? কোনো পরিবর্তন কি হয়েছে?

না, সুলতান। বিপরীত পার্শ্বের চূড়া থেকে প্রায় দুই মাইল ভিতরে শেরশাহ তার তাবু ফেলেছে এবং আজরাতে তাঁর শিবির থেকে প্রস্তুতির যে দৃশ্য আর শব্দ শোনা গেছে, তাতে মনে হয় আগামীকাল সকালে সে সত্যিই আক্রমণ শুরু করবে।

আমি এই সরু চূড়ার মাঝামাঝি মাটি দিয়ে যে রক্ষণাত্মক বাঁধ নির্মাণ করতে বলেছিলাম সেটা কি শেষ হয়েছে?

হ্যাঁ, সুলতান- আমরা যখন আমাদের প্রস্তুতি পরিদর্শন করবো তখন আপনি দেখতে পাবেন।

ভালো। বাঁধের আড়ালে সুরক্ষিত থেকে আমরা শেরশাহের হামলা অথধামুখে ছুটে গিয়ে আক্রমণ করে লোকবলক্ষয়কারী হাতাহাতি যুদ্ধে লিপ্ত হবার বদলে, কামান আর তবকিদের গুলিবর্ষণ আর সেই সাথে আমাদের তীরন্দাজদের নিক্ষিপ্ত তীরের সাহায্যে প্রতিহত করতে পারবো।

কিন্তু সুলতান কেবল পরাস্ত হওয়া এড়িয়ে যাবার চেয়ে আমরা যদি তাদের পরাভূত করতে চাই তাহলে তাদের কাছাকাছি আমাদের পৌঁছাতে হবে।

অবশ্যই। আমরা যখন শেরশাহের সংখ্যাধিক্যের সুবিধা নাকচ করতে পারবো এবং তাঁর লোকেরা যখন পরিশ্রান্ত হয়ে উঠবে আমরা তখন আকষ্মিক বেগে আক্রমণ করে তাদের ধবংস করবো। আমি সেই সাথে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে কোনো অপর্যাপ্ত উপায় গ্রহণ করতে চাই না। আমাদের আক্রমণ শুরুর সময়টা কেবল আমি সতর্কতার সাথে নিয়ন্ত্রণ করতে চাই।

তারা ততক্ষণে ঘোড়ায় চড়ে বাঁধের লাল মাটি বরাবর এগিয়ে চলেছে। তারা এখানে, গঙ্গা আর কনৌজের রাস্তায় আড়াআড়িভাবে, অস্থায়ী শিবির স্থাপনের পর তাঁর লোকেরা এই গরমের ভিতরে গাঁইতি আর শাবল দিয়ে চারদিনে দারুণ কাজ করেছে। মাটি আর পাথরের স্তূপটা সব জায়গায় ছয় ফিট উঁচু এবং বেশীর ভাগ স্থানে এর উচ্চতা দশ ফিট। সরু চূড়ার মধ্যবর্তী অংশের, যা মোটামুটিভাবে উত্তর দক্ষিণে বিস্তৃত, পুরো এলাকাটা জুড়ে বাঁধটা বিস্তৃত।

বাবা ইয়াসভালো, এই পর্যবেক্ষণের সময়ে আমি কাকে পুরস্কৃত বা পদোন্নতি প্রদান করবো?

সুলতান, আমরা তিনজনকে বাছাই করেছি। ওয়াজিম পাঠান নামে কাবুলের দক্ষিণ থেকে আগত এক আহত আফগানি শেরশাহের অগ্রাভিযানের সময়ে সংগঠিত এক খণ্ডযুদ্ধে সে দারুণ লড়াই করেছে। সে তাঁর আধিকারিকদের একজনকে নিজের ডান হাত আর তাঁর কনুইয়ের নীচের অংশ বিসর্জন দিয়ে রক্ষা করেছে। তাঁর জন্য আমরা এক ব্যাগ রৌপ্য মুদ্রা নিয়ে এসেছি, সে নিজের গ্রামে ফিরে যাবার উদ্দেশ্যে দীর্ঘ যাত্রা শুরু করার সময় ব্যাগটা সাথে করে নিয়ে যাবে। দ্বিতীয়জন লাহোর থেকে আগত বয়ঃকনিষ্ঠ এক আধিকারিক, যে আমাদের যুদ্ধের উপকরণ বহনকারী সরবরাহ যানবাহনের একটা বহরে শেরশাহের লোকেরা অতর্কিতে আক্রমণ করলে সে দারুন সাহসিকতা প্রদর্শন পূর্বক তাঁদের যুদ্ধ করে তাড়িয়ে দেয়। আপনার পক্ষ থেকে তাঁকে পুরষ্কার হিসাবে দেবার জন্য আমাদের সাথে একটা রত্নখচিত তরবারি আছে। আমাদের মনোনীত তৃতীয়জনকে আপনি ভালোমতো চেনেন- গজনীর তরুণ হাসান বাট্ট। আপনার অনুরোধ অনুযায়ী, অশ্বারোহী বাহিনীতে তাঁকে উচ্চতর অবস্থান প্রদান করা হবে।

হুমায়ুনের পরিদর্শনের জন্য সৈন্যদের যে দলটাকে পছন্দ করা হয়েছিল তারা বাঁধ থেকে খানিকটা দূরে ষাড় আর হাতির দল যার কাছে তাঁর কামানগুলোকে নির্ধারিত স্থানে স্থাপনের জন্য পরিশ্রম করছে সেখানে শ্ৰেণীবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান রয়েছে। হুমায়ুন অশ্বারোহী সৈন্যদের সারির এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে দেখে, যাদের কারো কারো ঘোড়া গরমে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অস্থির হয়ে উঠে, নিজেদের মাথা ঝাঁকাচ্ছে বা মাটিতে পা ঠুকছে, এবং তারপরে গোলন্দাজ, পদাতিক সৈন্য আর তীরন্দাজদের অপেক্ষাকৃত সোজা সারি অতিক্রম করে কেন্দ্রে যেখানে একটা মঞ্চ স্থাপন করা হয়েছে সেইদিকে এগিয়ে যায়। যাদের পুরস্কৃত বা পদোন্নতি দেয়া হবে তাদের সামনে এগিয়ে আসতে বলা হয়। ধুসর চুলের আহত ওয়াজিম খানের চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠে, যাকে হুমায়ুনের অনেক সৈন্যদের চেয়ে বয়স্ক দেখায়। রৌপ্যমুদ্রা ভর্তি লাল মখমলের ব্যাগটা সে যখন নিজের ভালো হাতটা দিয়ে গ্রহণ করে, সে থেমে থেমে কোনোমতে কেবল বলে, পাদিশাহ, আপনাকে ধন্যবাদ। আমার গ্রামে আমি নিজের মাথা উঁচু করে রাখতে পারবো আর সেই সাথে আমার মেয়েদের বিয়েতে যৌতুকও দিতে পারবো।

তোমার অর্জিত সম্মানের পুরোটাই তোমার প্রাপ্য, হুমায়ুন বলে। লাহোর থেকে আগত আধিকারিকের হাতে কারুকাজ করা তরবারিটা হুমায়ুন যখন তুলে দেয় গর্বে তার সারা মুখ হেসে উঠে। বয়ঃকনিষ্ঠ হাসান বাউ, বরাবরের মতোই ধুসর নীল রঙের পাগড়ি পরিহিত রয়েছে, হুমায়ুন যখন পুরো সেনাবাহিনীর সামনে অশ্বারোহী বাহিনীর একটা চৌকষ দলের অধিনায়ক হিসাবে তার নিয়োগ ঘোষণা করে তার মুখেও একই অভিব্যক্তি ফুটে উঠে।

পুরস্কৃত তিনজন নিজ নিজ কাতারে ফিরে যাবার পরে, হুমায়ুন তার সামনে সমবেত সৈন্যদের উদ্দেশ্যে একটা ভাষণ দেয়। আগামীকাল শেরশাহ আর তার বাহিনীর সাথে আমরা যুদ্ধ করার প্রত্যাশা রাখি। তার সেনাবাহিনী যদিও শক্তিশালী কিন্তু তার যুদ্ধে অবতীর্ণ হবার উদ্দেশ্য দুর্বল। তৈমূরের বংশধর আর বাবরের সন্তান হিসাবে হিন্দুস্তানের সিংহাসন সত্যিকার অর্থে আমার। শেরশাহ একজন অশ্ববিক্রেতার সন্তান এবং নামগোত্রহীন অজ্ঞাত জারজের বংশধর। এসো আমরা এমন একটা লড়াই করি যে আগামীকাল সন্ধ্যে নাগাদ বিশ্বাসঘাতকের কবরে তাঁর ঠাঁই হয় এবং তখনও তার যতটুকু প্রাপ্য তারচেয়ে বেশী ভূখণ্ড দখল করে রাখবে। আমাদের উদ্দেশ্যে ন্যায্যতা সম্পর্কে কখনও বিস্মৃত হয়ো না। মনে রাখবে যে আমি এই মাত্র যে লোকগুলো পুরস্কৃত করলাম তাঁদের মতো নির্ভীকভাবে তোমরা লড়াই করবে, তোমাদের কাছে আমি এটুকুই কেবল বলতে চাই। আমি তোমাদের হলফ করে বলছি, আমি নিজে তাঁদের চেয়েও নির্ভীকতা প্রদর্শনের প্রয়াস নেব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *