২.১ সংঘাতময় বিক্ষুব্ধতার কেন্দ্রে অবস্থান – দ্বিতীয় পর্ব

দ্বিতীয় পর্ব – সংঘাতময় বিক্ষুব্ধতার কেন্দ্রে অবস্থান

০৬. নিজাম ভিস্তি

ভোরের আলো ফোঁটার এক ঘন্টা পরে, হুমায়ুন তাঁর ব্যক্তিগত শয়ন কক্ষ থেকে বের হয়ে এসে, লাল বেলেপাথরে তৈরী আগ্রা দূর্গের অভ্যন্তরে মার্বেল পাথরে বাধান হলাধার আর পানি ছিটাতে থাকা ঝর্ণার সারির ভিতর দিয়ে হেঁটে গিয়ে সুউচ্চ তোরণদ্বার অতিক্রম করে এবং কুচকাওয়াজ ময়দানের দিকে এগিয়ে যায় যেখানে তার সেনাবাহিনী সমবেত হয়েছে। রুবিখচিত একটা রূপার বক্ষাবরণের উপরে রূপার সূক্ষ শিকলের তৈরী আলখাল্লায় সে পুরোদস্তুর যুদ্ধের সাজে সজ্জিত। তার দেহের একপাশে পান্নাখচিত ময়ানের শোভা পাচ্ছে তার মরহুম আব্বাজান বাবরের ঈগলের মাথাযুক্ত বাঁটের তরবারি আলমগীর। তাঁর মাথায় শোভা পায় রুবি দিয়ে অলঙ্কৃত একটা শিরস্ত্রাণ এবং স্বর্ণখচিত একটা লম্বা ময়ূরের পালক শিরস্ত্রাণের শীর্ষে মৃদু দুলছে।

লোহার গজালশোভিত দূর্গের মূল দরজার আড়াল থেকে সে যখন বের হয়ে আসে এবং কুচকাওয়াজ ময়দানের কেন্দ্রে স্থাপিত মঞ্চের দিকে এগিয়ে যায় যেখানে তাঁর রাজকীয় হাতি- আনুষ্ঠানিক শোভাযাত্রায় সম্রাট আর তাঁর সেনাপতিদের যাতায়াতের জন্য সচরাচর ব্যবহৃত অপেক্ষা করছে, সে দেখে যে তাঁর সেনাবাহিনীর অগ্রবর্তী দল সারিবদ্ধভাবে সামনে এগিয়ে যাবার সময় এতোই গোলাপি-ধুসর বর্ণের ধূলো উড়িয়েছে যে সূর্য তাঁর আলোর তীব্রতা হারিয়ে একটা ধুসর, হলুদ বর্ণের চাকতিতে পরিণত হয়েছে। ধুসর বর্ণের অতিকায় হাতিটা তাঁর পিঠে গিল্টি করা লাল-দোয়ার মতো হাওদা নিয়ে হাটু ভেঙে বসে আছে এবং দুই মাহুত তার মাথার দুপাশে দাঁড়িয়ে। হাতির দুপাশে মর্যাদা অনুসারে তাঁর বয়োজ্যোষ্ঠ আধিকারিকেরা দলবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে। তার প্রত্যেক সেনাপতির নতজানু হয়ে জানান অভিবাদন গ্রহণ করে হুমায়ুন তাদের উদ্দেশ্যে কিছু কথা বলার জন্য দাঁড়ায়।

আমার কাছ থেকে তোমাদের লোকদের কাছে এই বার্তাটা বয়ে নিয়ে যাবে। আমরা ন্যায়ের পক্ষে রয়েছি। এই অশিক্ষিত, উঁইফোড়, জবরদখলকারীর কাছ থেকে যা আমাদের আমরা সেটাই উদ্ধার করতে চলেছি। আমাদের সেনাবাহিনী দেখার পরে এটা যে ইতিহাসের বৃহত্তম আর অজেয় সে বিষয়ে কেউ কিভাবে সন্দেহ প্রকাশ করবে? যোদ্ধাদের খুশী মনে বিদায় দাও। বিজয় আর তাঁর সঙ্গী, খ্যাতি আর পুরষ্কার আমাদের সাথী হবে।

আধিকারিকেরা আরও একবার মাথা নত করে এবং গুঁড়ি মেরে বসে থাকা হাতির হাটুতে পা রেখে হুমায়ুন এর পিঠে স্থাপিত হাওদায় সোনার গিল্টি করা ছোট যে সিংহাসনটা রয়েছে সেটায় গিয়ে বসে। জওহর আর দুজন দেহরক্ষী খুব কাছ। থেকে তাঁকে অনুসরণ করে। হুমায়ুনের কাছ থেকে ইশারা পেতে মাহুতেরাও আরোহন করে এবং হাতির ঘাড়ের উপরে একজন আরেকজনের পেছনে নিজেদের নির্ধারিত অবস্থানে বসে জন্তুটার বিশাল কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে আদেশ দিতে থাকে। অতিকায়, অনুগত জন্তুটা আলতোভঙ্গিতে ধীরে ধীরে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াতে হুমায়ুন তাঁর হাতি আর তাঁর অন্যান্য সেনাপতিদের বহনকারী হাতির বহরকে এগিয়ে যাবার সংকেত বিঘোষিত করতে তূর্যবাদকদের ইঙ্গিত করে। সৈন্যবহরে নিজেদের নির্ধারিত স্থান গ্রহনের জন্য অগ্রসর হবার সময় তারা গোলন্দাজ বাহিনীর চার চাকার উপরে স্থাপিত প্রায় বিশ ফুট লম্বা ব্রোঞ্জের নলযুক্ত কামানগুলো, যার কোনটা টানছে পঞ্চাশটা পর্যন্ত ষাড়ের দল আর কোনটা টানছে ছয়টা থেকে আটটা হাতি- পাশ দিয়ে অতিক্রম করে। অপেক্ষাকৃত ছোট কামানগুলো ষাড়ে টানা গাড়িতে রাখা হয়েছে।

হুমায়ুন এরপরে ঘন সন্নিবেশিত অশ্বারোহী বাহিনীর পাশ দিয়ে এগিয়ে যায় প্রথমেই রয়েছে তার বাবার মাতৃভূমি থেকে আগত অশ্বারূঢ় যোদ্ধার দল, তাজিক, বাদশান, কিরঘিজ পর্বত আর ফারগানার উপত্যকা আর সেই সাথে আফগানিস্তান থেকে আগত যোদ্ধারা। সে বিশ্বাস করে, মোগল রাজবংশের প্রতি এরাই সবচেয়ে বিশ্বস্ত। মধ্য এশিয়ার তৃণাঞ্চল থেকে তাঁদের নিয়ে আসা ঘোড়ার পাল থেকে এখনও প্রজনন করার তাঁদের ঘোড়াগুলোই সবচেয়ে শক্তিশালী। এদের পরে সে তার অনুগত রাজপুত জায়গীরদারদের একটা অংশকে কমলা রঙে সজ্জিত দেখতে পায়। যুদ্ধের জন্য সব রাজপুতের মতোই উদগ্রীব বিশালদেহী, কাল-শুশ্রুমণ্ডিত এই লোকগুলো হুমায়ুন যখন পাশ দিয়ে অতিক্রম করে তখন নিজেদের ছোট, বৃত্তাকার আর কারুকার্যময় ঢালে নিজেদের তরবারি দিয়ে আঘাত করে সামরিক ভঙ্গিতে অভিবাদন জানায়।

হুমায়ুন পর্যায়ক্রমে যখন প্রতিটা বাহিনীকে অভিবাদন জানায়, সে মনে মনে ভাবে যে নিশ্চিতভাবেই বিজয়তিলক তার ললাটেই শোভা পাবে। তার সাথে আছে প্রায় সোয়া লক্ষ সৈন্যের একটা বাহিনী- শেরশাহের বাহিনীর চেয়ে কয়েক গুণ বড়। তাঁর সাথে অন্তত দশ গুণ বেশী কামান রয়েছে এবং গুজরাত অভিযানের সময় সে যেমন প্রমাণ করেছে- সে সৌভাগ্যের আশীর্বাদপুষ্ট একজন যোগ্য সেনাপতি। আগুয়ান সেনাবাহিনীর সাথে সঙ্গী হবার আর তার সৎ-বোন চঞ্চল প্রাণবন্ত গুলবদনকে সাথে নিয়ে আসবার জন্য সে তাই তার ফুপু খানজাদার অনুরোধ মঞ্জুর করেছে। প্রতিরক্ষার এহেন বন্দোবস্তের মাঝে তারা আগ্রার চেয়ে খুব একটা বেশী বিপদের সম্মুখীন হবে না, যার প্রতিরক্ষার ভার সে তার নানাজান বাইসানগার আর কাশিমের যোগ্য এবং বিশ্বস্ত হাতে অর্পন করে এসেছে। ফুপুজানের অভিজ্ঞতাঋদ্ধ পরামর্শের সাথে সাথে আবারও কখনও আফিমের আসক্তির মাঝে নিজেকে বিলীন করে দেবার মতো প্ররোচনা অনুভব করলে সে তার মানসিক সমর্থন লাভ করবে এটা ভেবেই সে কৃতজ্ঞ। তিনি কখনও এর অনুমতি দেবেন না।

সে অবশ্য সালিমা আর তাঁর প্রিয় আরো তিনজন উপপত্নীকে সাথে করে নিয়ে আসবার বিলাসিতা করার অনুমতি নিজেকে দিয়েছে। তাঁর সুরা আর আফিম বর্জন যেন হারেমের কোমল আর ইন্দ্রিয়পরবশ সুখের প্রতি তার আকাঙ্খকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সে তিনজন তরুণীকে পছন্দ করেছে- গুজরাত থেকে আগত খেয়ালি আর নমনীয় দেহের অধিকারিনী মেলিতা, লাহোর থেকে আগত ভারী বুক আর পুরু ওষ্ঠের অধিকারিনী পৃথুলা মেহেরুন্নিসা আর খোদ আগ্রার মেয়ে রসিক, কামকলায় পটু, কলহপ্রিয় মীরা- যারা প্রত্যেকেই, সালিমার মতো তাঁদের নমনীয় দেহ, ব্যগ্র ওষ্ঠ আর উৎসুক জীহ্বা নিয়ে, রতিক্রিয়ার ভিন্ন ভিন্ন আসনে পারদর্শী। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতির ক্লান্তিকর পরিস্থিতির মাঝে কি প্রশান্তি, তাঁর বিজয়ে কি আনন্দই না তারা তার জন্য বয়ে আনবে। অক্ষুব্ধ হাতির পিঠে পর্দা ঘেরা হাওদার অন্তরালে মেয়ের দল ভ্রমণ করছে আর তাঁদের পাহারায় নিয়োজিত আছে তাঁর সবচেয়ে বিশ্বস্ত দেহরক্ষীদের একটা দল।

*

ছয় সপ্তাহ পরে মধ্যাহ্নের আহারের ঠিক পরপরই, শত্রুর সংবাদ সংগ্রহে প্রেরিত হুমায়ুনের প্রধান গুপ্তদূত আহমেদ খানকে, চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী সেনাছাউনির ঠিক কেন্দ্রে স্থাপিত, তার লাল রঙের নেতৃত্ব দানকারী তাবুর দিকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। হুমায়ুন সেখানে লালচে খয়েরী রঙের তাকিয়া যুক্ত সোনার কারুকাজ করা জাজিমে শুয়ে বিশ্রাম করছে, প্রশান্তিদায়ক শরবতের পানপাত্র হাতে সে জওহরের বাঁশির কোমল ছন্দোলয়ে বিভোর। আহমেদ খান তাবুর ভিতরে প্রবেশ করতে, হুমায়ুন ইশারায় জওহরকে বাজান বন্ধ করতে বলে।

আহমেদ খান, কি ব্যাপার?

সুলতান, আমাদের ছাউনির চারদিকে পঞ্চাশ মাইল দূর অবধি অনুসন্ধান করেও আমরা শেরশাহের সেনাবাহিনীর কোনো হদিশই খুঁজে পাইনি। অবশ্য এখান থেকে দক্ষিণপূর্ব দিকে প্রায় পয়তাল্লিশ মাইল দূরে আমরা সহসাই এক ক্ষুদ্র জায়গীরদারকে তার মাটির দূর্গে অবস্থানরত অবস্থায় আবিষ্কার করি। সে শেরশাহের অনুগত জায়গীরদার বলে দাবী করে কিন্তু এমন একজন যে ভীত যে তাঁর প্রভু নিজের অত্যধিক উচ্চাকাঙ্খর বশবর্তী হয়ে আপনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে সবাইকে বিপদের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। শেরশাহের সেনাবাহিনীর সাথে যোগ দেবার জন্য তাই সে কোনো ধরনের ব্যস্ততা প্রদর্শন করেনি। সে আমাদের বলেছে যে তার জানা মতে এলাহাবাদের যেখানে গঙ্গা আর যমুনার স্রোত এসে মিলিত হয়েছে সেখান থেকে অন্তত আরও পঞ্চাশ মাইল দূরে শেরশাহ তাঁর বাহিনী নিয়ে অবস্থান করছে। আমাদের বলেছে সে যা জানে আপনাকে বলার জন্য খুশী মনে সে আমাদের সাথে এখানে আসতে রাজি আছে। আমরা তার কথায় গুরুত্ব দিয়ে তাঁকে এখানে নিয়ে এসেছি অবশ্য চোখ বেঁধে, যাতে সে আমাদের ছাউনির অবস্থান বা আমাদের সেনাবাহিনীর শক্তি সম্বন্ধে কিছু আঁচ করতে না পারে। আমরা এক ঘন্টা আগেই এসে পৌঁছেছি এবং আমি তার খাবারের বন্দোবস্ত করে তার সাথে কথা বলার ব্যাপারে আপনার আগ্রহ জানতে এসেছি।

তুমি দারুন কাজ করেছে। আধ ঘন্টা পরে তাকে আমার কাছে নিয়ে আসবে।

কাঁটায় কাঁটায় ঠিক ত্রিশ মিনিট পরে, আহমেদ খান- নিয়মনিষ্ঠার ব্যাপারে বাবরের ঝোঁক সম্পর্কে ভালোমতোই ওয়াকিবহাল- ফিরে আসে। তার পেছনে, দুজন সশস্ত্র প্রহরীর মাঝে, গাঢ় সবুজ রঙের আলখাল্লা আর একই রঙের পাগড়ি পরিহিত খর্বকায়, স্থূলদেহী, কৃষ্ণ বর্ণের বছর চল্লিশের একজন মানুষকে দেখা যায়।

হুমায়ুনের সামনে স্বতঃস্ফূর্ত ভঙ্গিতে সে নতজানু হয়ে অভিবাদন জানায়।

 কে তুমি?

তারিক খান, ফিরোজপুরের তাকহালদার।

আর সেই সাথে তুমি শেরশাহের অনুগত।

হ্যাঁ- এবং আমার প্রতি সে সবসময়ে একজন ভালো প্রভুর মতো আচরণ করেছে…কিন্তু সবকিছুর পরেও সুলতান, আমার পরম অধিরাজ, আমি আপনার একজন বিশ্বস্ত প্রজা। বিদ্রোহ করে শেরশাহ বেকুবি করেছে।

তুমি বোধহয় বলতে চাইছে ন্যায়সঙ্গত অধিকারকে উদ্ধত আর অশ্রদ্ধাপূর্ণ ভঙ্গিতে অপমান করেছে… কিন্তু তার অভিসন্ধি আর অবস্থান সম্পর্কে তুমি কি জান?

তার সেনাবাহিনী আমার এলাকার ভিতর দিয়ে সরাসরি যাতায়াত করে না কিন্তু আমার এলাকার উত্তরে বিশ মাইল দূরে আমার আত্মীয়সম্পর্কিত ভাইয়ের এলাকার ভিতর দিয়ে তারা যাতায়াত করে। সে বলেছে শেরশাহের সেনাবাহিনীর আকার ছোট- লোকবল আশি হাজারের বেশী হবে না। আমার সেই ভাই শেরশাহের সেনাছাউনিতে গিয়েছিল তাঁকে তাঁর শ্রদ্ধা জানাতে। সে আমাকে বলেছে শেরশাহকে রীতিমতো বিহ্বল মনে হয়েছে যে সে আপনাকে এতো বিশাল এক বাহিনী নিয়ে অভিযানে অগ্রসর হতে প্ররোচিত করেছে। সে আমার ভাইকে বলেছে সে যুদ্ধ করবে না যদি আরো একবার আপনার অধীনে জায়গীরদার থেকে নিজের এলাকা নিজের আয়ত্ত্বে রাখতে পারার শর্তে সে আপনার সাথে কোনো ধরনের শান্তিচুক্তির রফা করতে পারে।

তার ভবিষ্যৎ গতিবিধি সম্বন্ধে তোমার সেই ভাই কিছু জানতে পেরেছে?

শেরশাহের এক গুপ্তদূত অসাবধানতাবশত আমার সেই ভাইয়ের উজিরকে বলেছে যে তারা বাংলার নীচু জলাভূমি আর জঙ্গল অভিমুখে এগিয়ে যাচ্ছে যেখানে যুদ্ধ যদি তাদের করতেই হয়- আপনার পরাক্রমকে তারা হয়তো ভালোভাবে মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে।

তুমি এতক্ষণ যা বলেছে আমার উপদেষ্টামণ্ডলীর সাথে সে বিষয়ে আমি আলোচনা করবার আগে তুমি কি আর কিছু বলতে চাও?

কেবল এতোটুকুই যে মহামান্য সুলতানের যদি শান্তি চুক্তির প্রস্তাব দিয়ে শেরশাহের দৃঢ়তা পরীক্ষা করার কোনো অভিপ্রায় থেকে থাকে, আপনার প্রেরিত যেকোনো দূতের সঙ্গী হতে আমি প্রস্তুত এবং তাকে শেরশাহের শিবিরে তাঁর সামনে হাজির করার পরে নিরাপদে ফিরিয়ে আনবার দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত।

আমি প্রস্তাবটা বিবেচনা করবো। এখন, আহমেদ খান, আরেকবার তার চোখ বাঁধো এবং তোমার দপ্তরে তাঁকে বদ্ধ কিন্তু আরামদায়ক অবস্থায় অবরুদ্ধ করে রাখো। জওহর, সূর্যাস্তের এক ঘন্টা পূর্বে এখানে আমার সাথে মিলিত হবার জন্য আমার উপদেষ্টামণ্ডলীদের তলব কর। ইত্যবসরে সালিমাকে বল আমার কাছে আসতে। হুমায়ুন ভাবে, উষ্ণ আবহাওয়ায় তার কামনার পারদ দ্রুত বেড়ে যায়, এবং প্রায়শই শীতকালের তুলনায় দ্বিগুণ। মেয়েটা জানে কিভাবে এই কামনা প্রশমিত করতে আর আসন্ন আলোচনায় মনোনিবেশের জন্য তার মনকে প্রশান্ত করতে হয়।

সালিমা, বরাবরের মতোই, নিজের দায়িত্ব নিপূণভাবে পালন করে। তার উপদেষ্টামণ্ডলী যখন সমবেত হয়, হুমায়ুন শমিত বোধ করে, তার পরামর্শদাতাদের সম্বোধন করার সময় অতিকায় একটা ব্যাঘ্রের মতো হুঙ্কার দিতে প্রস্তুত। আপনার তারিক খানের কথা শুনেছেন এবং তাঁর বয়ান যে শেরশাহ আমাদের সাথে সংঘর্ষ এড়িয়ে যাবার অভিপ্রায়ে বাংলার জঙ্গলের গভীরে প্রবেশ করতে চলেছে এবং সেই সাথে তার অনুমানের জন্য দুঃখবোধ করছি- সে শান্তির জন্য আমাদের আপোষ করতে বাধ্য করবে। আপনারা কি মনে করেন?

আমাদের সাথে শক্তিশালী একটা সেনাবাহিনী রয়েছে এবিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। আমরা তাকে খুঁজে বের করে স্রেফ পিষে ফেলি না কেন, বাবা ইয়াসভালো নিজের চারপাশে সাথী সেনাপতিদের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলার সময় তার কামান মাথা থেকে ধুসর চুলের বেনীটা দুলতে থাকে।

কিন্তু একটু ধৈর্য্য ধরেন, হুমায়ুনের চাচাত ভাই সুলেমান মির্জা বলে। আমাদের সাথে যদি শক্তিশালী সেনাবাহিনী থাকে এবং নিজেদের লোকদের আনুগত্যের প্রতি আমাদের বিশ্বাস থাকে তাহলে একজন দূত প্রেরণ করে কিছুটা বিলম্ব করলে আমাদের কি এমন ক্ষতি বৃদ্ধি হবে? তারা ফিরে আসবার পরেও যদি প্রয়োজন হয়- দুমাস পরে বর্ষা মরসুমের আগে অগ্রসর হবার জন্য আমাদের হাতে প্রচুর সময় থাকবে।

তাকে এখনই শেষ করে দেয়াটাই অধিক বাঞ্ছনীয়। বাবা ইয়াসভালো তবুও অনড়। তাঁকে দিয়ে একটা উদাহরণ সৃষ্টি করলে অন্য বিদ্রোহীরা সমঝে যাবে।

কিন্তু আমাদের লোক ক্ষয় হবে আর সময়ও যা আমরা আমাদের সাম্রাজ্য বর্ধিত করার জন্য নিয়োজিত করতে পারি। আমি সবসময়েই দক্ষিণে দাক্ষিণাত্যের মালভূমি অতিক্রম করে গোলকুণ্ডার হীরকখনিতে অভিযান পরিচালনায় আগ্রহী, সুলেমান মির্জা বলে।

আমি একমত, হুমায়ুনের দক্ষ সেনাপতিদের একজন, ইউসুফ পাঠান ভাবলেশহীন কণ্ঠে মন্তব্য করে। শেরশাহকে একজন দক্ষ শাসক বলা হয়ে থাকে আর বাংলা উর্বর, সমৃদ্ধ একটা প্রদেশ। আমরা যদি তাকে আর তার প্রধান অমাত্যদের হত্যা করি তাহলে নতুন কাঠামো তৈরী আর নতুন আধিকারিকদের নিয়োগ করতে গিয়ে আমাদের প্রচুর সময় নষ্ট হবে। আমাদের শক্তিমত্তার অবস্থান থেকে তার সাথে কোনো ধরনের সমঝোতায় পৌঁছাতে পারলে আমরা তাঁকে আর তাঁর প্রশাসনকে কর আদায়ের জন্য ব্যবহার করে দ্রুত আমাদের বাহিনীর বকেয়া বেতন পরিশোধ আর তাঁদের পুরস্কৃত করতে পারি আর তারপরে গোলকুণ্ডার অভিযানের জন্য অগ্রসর হই।

হুমায়ুন সবার বক্তব্য বিবেচনা করে। ইউসুফ পাঠানের বক্তব্যের ভিতরে একটা প্রত্যয়বোধ রয়েছে। তাছাড়া, মহানুভবতা মহান শাসকদের একটা বৈশিষ্ট্য। হুমায়ুন উঠে দাঁড়ায়। সুলেমান মির্জা, একটা ছোট রক্ষী বাহিনী নিয়ে আপনি তারিক খানের সাথে যাবেন, শেরশাহের অবস্থান সনাক্ত করে তাঁর কাছে শান্তি চুক্তির প্রস্তাব পৌঁছে দিতে তবে শর্ত এই যে তাঁকে এখানে এসে আনুষ্ঠানিক অভিবাদন জানাতে হবে এবং আমাদের মূল্যবান সময় আর রসদ অপচয় আর সর্বোপরি আমাদের প্রতি সে যে অমার্জিত অবমাননা প্রদর্শন করেছে সেজন্য আমাদের সে উত্তমরূপে ক্ষতিপূরণ দেবে।

*

কিন্তু শেরশাহ তাৎক্ষণিকভাবে কোনো প্রকার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ থেকে বিরত থাকে। সপ্তাহের পর সপ্তাহ অতিক্রান্ত হয় সে কেবলই কালক্ষেপন করে চলে, বিলম্বের জন্য ভূরি ভূরি দুঃখপ্রকাশ করে আর কোনো ধরনের শর্তে চুড়ান্তভাবে সম্মতি হবার পূর্বে মিত্রদের সাথে আলোচনার করতে বার্তাবাহক প্রেরণের অনুমতির জন্য বারংবার অনুরোধ করে। ১৫৩৯ সালের গ্রীষ্মকালের মাঝামাঝি একটা সময় সেটা, হুমায়ুন নৈশভোজের পর, বাংলার চৌসা বসতির কাছেই চার বর্গমাইলের চেয়ে বেশী এলাকা জুড়ে অবস্থিত তার সেনাছাউনির ঠিক মধ্যভাগে অবস্থিত তার তাবুর পাশেই খানজাদার তাবুতে অবস্থান করছিল। নীচু পাহাড়ের উপরে হুমায়ুন তার শিবির স্থাপন করেছে যেখান থেকে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের কর্দমাক্ত প্লাবিত সমভূমি দেখা যায়। তাবুর বাইরে, রাতের আবহাওয়া বেশ উষ্ণ এবং নিথর বাতাসে তাবুর আগুনের থোয়া সরাসরি উপরের দিকে উঠে যায়। তাবুর ভিতরে, কৌতূহলী দৃষ্টি থেকে জেনানাদের রক্ষা করতে যার পার্শ্বদেশ নামিয়ে দেয়া হয়েছে, গুমোট বাতাসে শ্বাস নেয়া কষ্টকর। চিনিগোলা পানির পাত্র দিয়ে তাদের ফাঁদে ফেলার চেষ্টা বা তরাসচামর দিয়ে তাঁদের পিষে ফেলার জন্য খানজাদার পরিচারকদের সর্বাত্মক প্রয়াস সত্ত্বেও মশার ঝক বিরামহীনভাবে ভনভন করতে থাকে। হুমায়ুন দরদর করে ঘামতে থাকে, মাঝে মাঝে সে নিজের উন্মুক্ত ত্বকে তাঁদের তীব্র দংশন অনুভব করে এবং বৃথাই নিজের ক্ষুদ্র আক্রমণকারীদের উদ্দেশ্যে চড় হাকায়।

হুমায়ুন কি হয়েছে? আজ খাবারের সময় তুমি প্রায় চুপচাপই ছিলে, খানজাদা জানতে চান।

আমি উদ্বিগ্ন যে আমি এত সময় বৃথা অপচয় করেছি, যে শেরশাহ আমাকে আহাম্মক মনে করে হেলাফেলা করছে। সুলেমান মির্জা আর তারিক খান আমাকে আশ্বস্ত করেছে যে প্রতিবার সাক্ষাতের সময় সে সজ্জনসুলভ আর ভদ্র আচরণ করেছে এবং তাঁকে আন্তরিকই মনে হয়েছে কিন্তু আমি এখন আর সে সম্বন্ধে নিশ্চিত নই। তারিক খানকে এতোটা বিশ্বাস করে আমি কি ভুল করেছি? নিজের জন্য সময় লাভের প্রয়াসে যদি শেরশাহই তাঁকে রোপন করে থাকে?

খানজাদা উঠে দাঁড়ায় এবং দুই এক মুহূর্তের জন্য পায়চারি করে, তশতরী আকৃতির পিতলের দিয়া ভর্তি তেলে জ্বলতে থাকা সলতের সোনালী আভায় তার মুখ গম্ভীর দেখায়।

আমার মনে হয় তোমার সন্দিগ্ধ হওয়াটা যুক্তিসঙ্গত। শক্তিমানই সবসময় বিজয়ী হয় না মাঝে মাঝে ধূর্তও বিজয়ের বরাভয় লাভ করে। বিগত নয় সপ্তাহ ধরে যুদ্ধক্ষেত্রে কিংবা সম্মেলনে শেরশাহের সাথে মিলিত হবার জন্য গঙ্গার তীর বরাবর নিম্নাভিমুখে তুমি বিশাল একটা দূরত্ব অতিক্রম করেছে কিন্তু প্রতিবারই তুচ্ছ অজুহাত ব্যবহার করে যে সে এলাকার সব খাদ্যশস্য নিঃশেষ করে ফেলেছে বা মহামারীর আকারে জ্বরের প্রাদুর্ভাব হওয়ায় তাঁকে অবশ্যই সেটা এড়িয়ে যেতে হবে সে আরও সামনে এগিয়ে গিয়েছে।

সত্যি। সর্বশেষ তথ্য অনুসারে গঙ্গার তীর থেকে ত্রিশ মাইল দূরে তাঁর মূল বাহিনী এখনও অপেক্ষা করছে।

তুমি কি করতে চাও?

আর কোনো অজুহাত গ্রহণ করবো না, শেরশাহের জন্য একটা সময়সীমা নির্ধারণ করবো এবং সে যদি সেটা অমান্য করে আমি তাকে আক্রমণ করবো। কিন্তু অন্য কারণে উদ্বিগ্ন যে বিশাল অশ্বারোহী বাহিনী আর আমার কামানের সহজ যাতায়াতের জন্য এসব জঙ্গল আর জলাভূমি একেবারেই অনুপযুক্ত।

তাহলে উপযুক্ত ভূখণ্ডে পশ্চাদপসারণের জন্য সাহস সঞ্চয় কর। বা শেরশাহের বাহিনীকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে তাঁর শহরগুলো দখল করে নাও… একটা নিঃসঙ্গ বজ্রপাত খানজাদার কথার মাঝে বিঘ্ন ঘটায়। তাবুর ছাদে মুষলধারে বৃষ্টির আওয়াজ একে অনুসরণ করে।

এখনই বর্ষাকাল শুরু হবার কথা না- এখনও সময় হয়নি।

 প্রকৃতির ছন্দ সবসময়ে মানুষের তৈরী পঞ্জিকা অনুসরণ করে না।

এটা যদি বর্ষার আগমনী বৃষ্টি হয় তাহলে আমাদের অবশ্যই উপযুক্ত ভূমি সন্ধান করা উচিত। কিন্তু এখন অনেক রাত হয়েছে, সকালে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য আমরা অনেক সময় পাব যখন আমরা জানতে পারব যে আসলেই অবিরাম বৃষ্টিপাতের সূচনা হয়েছে। আমাদের শিবির নদীর উপরিভাগ থেকে অনেক উঁচুতে অবস্থিত ইত্যবসরে তাই বন্যায় ভেসে যাবার কোনো ভয় নেই।

কয়েকঘন্টা পরের কথা, হুমায়ুন তখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তাঁর বাহুদ্বয় দুপাশে প্রসারিত, তার ঘর্মাক্ত পেশল দেহ পাতলা সুতির চাদরের নীচে নগ্ন। বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে, যা মন্থর হবার বদলে যেন আরও জোরে শুরু হয়েছে, আজকে তাঁর ঘুমাতে অনেক রাত হয়েছে। সে এখন স্বপ্ন দেখছে সে আগ্রা দূর্গে ফিরে এসেছে, তার উপপত্নীদের কক্ষের দিকে এগিয়ে চলেছে যেখানে কোনো বিচিত্র কারণে সে জানে তারা গোলাপজলের ঝর্ণার নীচে এখন স্নান করছে। সে টের পায় তাঁর দেহ কামনায় টানটান হয়ে উঠেছে এবং সে দ্রুত পা ফেলতে শুরু করতে চাদরের নীচে তার পা ছটফট করে উঠে, তাঁর রমণীদের কাছে পৌঁছাবার ব্যগ্রতায়। সহসা একটা মেয়েলী আর্তনাদ তাঁর স্বপ্নের গভীরে অনুপ্রবেশ করে। নারী আর পুরুষ কণ্ঠের একটা সম্মিলিত যুগলবন্দি ঠিক এর পরপরই ভেসে আসে। কেউ একজন চিৎকার করে, হাতিয়ার সামলে! জলদি- বর্ম পরার সময় নেই। ছাউনির সীমানায় জনবল বৃদ্ধি কর।

প্রাণপন চেষ্টায় ঘুমের রেশ কাটিয়ে হুমায়ুন বুঝতে পারে কণ্ঠগুলো বাস্তব। হামলাকারীরা জেনানাদের তাবু পর্যন্ত সম্ভবত অনুপ্রবেশ করেছে। একটা আলখাল্লায় কোনমতে নিজেকে জড়িয়ে নিয়ে সে হাত বাড়িয়ে তাঁর আব্বাজানের তরবারির তুলে নিয়ে নিজের তাবু থেকে টলতে টলতে কোনোমতে বের হয়ে আসে। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে এবং তাঁর খালি পা ভেজা কাদায় পিছলে যেতে চায়। তির্যকভাবে নেমে আসা বৃষ্টির ভারী ফোঁটার মাঝ দিয়ে উঁকি দিয়ে এবং অন্ধকারে মরীয়া হয়ে নিজের চোখ সইয়ে নেয়ার চেষ্টা করতে করতে, সে খানজাদার তাবুর দিকে দৌড়ে যায়।

তাবুর কাছাকাছি পৌঁছাতে, চরাচর ঝলসে দেয়া উজ্জ্বল পাতের মতো বিস্তৃত বিদ্যুচ্চমকের ধাতব ঝলকানির মাঝে সে দীর্ঘকায় এক মহিলার অবয়বকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে- খানজাদা। তাঁর মাথার উপরে উত্তোলিত ডান হাতে একটা বাঁকান তরবারি রয়েছে। হুমায়ুন তাকিয়ে থাকতে থাকতেই খানজাদা তরবারিটা এক আক্রমণকারীর মুখ বরাবর নামিয়ে আনে, যে তাঁকে পরাস্ত করার চেষ্টা করছিল। লোকটা কাটা কলাগাছের মতো মাটিতে আছড়ে পড়ে সেখানেই ব্যাথায় কাতরাতে থাকে। বিদ্যুচ্চমকের পরবর্তী আলোর ঝলসানিতে হুমায়ুন দেখে যে তার ফুপুজানের তরবারির আঘাতে মাটিতে পড়ে থাকা লোকটার মুখের একপাশ উপর থেকে নীচ পর্যন্ত ফেঁড়ে ফেলায়, লোকটার রক্তাক্ত চোয়াল আর দাঁত বের হয়ে এসেছে। সে আর দেখে যে- খানজাদার অজান্তে- আরেকজন আক্রমণকারী তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটার হাতে তরবারির বদলে একটা বিশাল গামছা সেটাকে সে তার মাথার উপর দিয়ে ছুঁড়ে দিয়ে খানজাদার গলা শক্ত করে পেচিয়ে ধরবে। হুমায়ুন হুশিয়ারি উচ্চারণ করে।

সহসাই বিপদ টের পেয়ে, খানজাদা হাতটা পেছনে নিয়ে গিয়ে কনুই দিয়ে লোকটার গলায় আঘাত করে কিন্তু লোকটা কোনোমতে আঘাতটা সামলে নিয়ে গামছাটা শক্ত করে ধরার চেষ্টা করতে থাকে। হুমায়ুন ততক্ষণে তাঁদের অনেকটা কাছে চলে আসায় সে ফুপুজানের আক্রমণকারীর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং সবলে তাঁকে মাটিতে আছড়ে ফেলার অভিপ্রায়ে তাঁর সাথে ধ্বস্তাধ্বস্তি আরম্ভ করে। চকচকে, পিচ্ছিল কাদায় তারা কিছুক্ষণ ধ্বস্তাধ্বস্তি করে, দুজনেই সুবিধা আদায়ের জন্য হাঁসফাঁস করে। তারপরে হুমায়ুন তাঁর প্রতিপক্ষের বাম চোখে নিজের ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠিপ্রবিষ্ট করাতে সমর্থ হয় এবং জোরে চাপ দিতে সে টের পায়। অক্ষিগোলক বিদীর্ণ হয়ে ভেতরের তরল পদার্থ বের হয়ে আসছে। ব্যাথার তীব্রতায় অধীর হয়ে সহজাত প্রবৃত্তির কারণেই লোকটার মুষ্ঠিবদ্ধ হাত শীথিল হয়, এবং সেই সুযোগে হুমায়ুন আলমগীর বের করে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে সেটা প্রতিপক্ষের কুঁচকির গভীরে গেঁথে দিয়ে তাঁকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে লোকটা আর্তনাদ করতে থাকে এবং তাদের পায়ের চাপে সৃষ্ট কর্দমাক্ত ডোবায় রক্তাক্ত অবস্থায় মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে সে।

হুমায়ুন তখনও তার শিবিরের দূরবর্তী সীমানা থেকে যুদ্ধের হট্টগোল যদিও ভেসে আসতে শুনে, কিন্তু তাঁর দেহরক্ষীর দল ইতিমধ্যে রাজমহিষীদের তাবু আক্রমণ করতে আসা বাকি লোকদের মনে হয় কাবু করতে পেরেছে। তারা সংখ্যায় বিশজনের মতো হবে। লোকগুলোর প্রত্যেকের পরণে কালো পোষাক এবং শিবিরের সীমানায় জোরাল আক্রমণের সুযোগ নিয়ে বোধহয় তারা গোপনে সেনাছাউনির একেবারে কেন্দ্রস্থলে এসে হাজির হয়েছিল। আক্রমণকারীদের কেবল একজন জীবিত রয়েছে।

দুজন প্রহরী দুদিক থেকে লোকটার দুহাত ধরে এবং হাঁটু ভেঙে তাঁকে যেখানে বসিয়ে রেখেছে সেদিকে ক্রোধে বিকৃত হয়ে উঠা মুখ নিয়ে হুমায়ুন দৌড়ে গিয়ে তার গলা চেপে ধরে এক ঝটকায় লোকটাকে তার পায়ের উপরে দাঁড় করায় এবং তার মুখের কাছে নিজের মুখ প্রায় ঠেকিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বলে, তোমরা কেন এটা করেছে? ন্যূনতম মর্যাদাবোধ রয়েছে এমন শত্রুও মেয়েদের আক্রমণ করবে না। পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, সবাই তাদের রক্ষা করবে। আমাদের ধর্মেও একথা বলা হয়েছে, এটাই নৈতিক শিষ্টাচারের মোদ্দাকথা। তোমার মৃত্যু নিশ্চিত কিন্তু তুমি যদি কথা বল তাহলে সেটা দ্রুত হবে- যদি না বল তাহলে মৃত্যুটা হবে একটা দীর্ঘ আর বিলম্বিত প্রক্রিয়া এবং এত তীব্র যন্ত্রণাদায়ক যে তিলে তিলে সেই যন্ত্রণা ভোগ করার চাইতে তুমি মৃত্যু ভিক্ষা চাইবে।

রাজমহিষীদের হত্যা করার কোনো অভিপ্রায় আমাদের ছিল না আমরা কেবল তাঁদের অপহরণ করতে চেয়েছিলাম বিশেষ করে আপনার ফুপুজানকে। তারিক খান আমাদের বলেছে তিনি আপনার সাথে রয়েছে এবং সাইবানি খানের হাতে তার বন্দী হবার গল্পটা সবাই ভালো করেই জানে। শেরশাহ বলেছে যে আমরা যদি তাকে বন্দি করতে পারি আপনি তাকে দ্বিতীয়বারের মতো অগ্নিপরীক্ষার হাত থেকে রেহাই দিতে যেকোনো শর্তে আপোষ করতে রাজি হবেন।

তারিক খান তাহলে সত্যিই তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য ক্রুদ্ধ আর হতাশ হুমায়ুন বন্দির গলা আরও শক্ত করে চেপে ধরে এবং নিজের বৃদ্ধাঙ্গুলি লোকটার কণ্ঠমণির উপরে স্থাপন করে তার গলাটা মোচরাতে থাকে যতক্ষণ না ঘাড় ভাঙার আওয়াজ শুনতে পায় এবং তাঁর গলা চিরে মৃত্যুর আর্তনাদ বুদ্বুদের মতো উঠে আসে। নিথর দেহটা একপাশে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সে আবারও খালি পায়ে কাদায় পিছলাতে পিছলাতে খানজাদার কাছে দৌড়ে যায়। বৃষ্টির অঝোর ধারায় সিক্ত হয়ে তরবারি হাতে তিনি তখনও দাঁড়িয়ে রয়েছেন অবাক করা এক শান্ত অভিব্যক্তি তার চোখে মুখে এবং ঘুমাবার জন্য খুলে রাখা তার লম্বা ধুসর চুলের গোছা বৃষ্টিতে ভিজে অগণিত ইঁদুরের লেজে পরিণত হয়েছে।

আপনাকে ভালোভাবে রক্ষা করতে ব্যর্থ হওয়ায় আমি লজ্জিত- আপনি কি আহত হয়েছেন?

একেবারেই না। আমার মনে হয় আমি প্রমাণ করতে পেরেছি যে তোমার আর তোমার আব্বাজানের মতো আমার ধমনীতেও তৈমূরের রক্ত বইছে। আক্রমণ যখন শুরু হয়, তখন আমি ভয় পাইনি কেবল ক্রুদ্ধ হয়েছি। আমি জানতাম আমাকে অবশ্যই গুলবদন আর তোমার যুবতী উপপত্নীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তাবুর খুটিগুলো আমি তাদের ভেঙে ফেলতে বলি এবং তাবুর কাপড়ের নীচে তাঁদের লুকিয়ে থাকতে বলি যতক্ষণ তাঁরা বিপদ কেটে গেছে বলে নিশ্চিত হয়। ওদিকে তাকিয়ে দেখো। তাঁরা কেবল মাত্র বাইরে বের হয়ে আসছে।

মুষলধারে হতে থাকা বৃষ্টির মাঝে হুমায়ুন নিশ্চিতভাবেই তাবুর অতিকায়, আবৃত করা ভাজের নীচ থেকে সালিমাকে হামাগুড়ি দিয়ে বের হতে দেখে, তার ঠিক পেছনেই রয়েছে গুলবদন আর অন্যান্য মেয়েরা। হুমায়ুন খানজাদাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে এবং জড়িয়ে ধরেই সে বুঝতে পারে যে এখন উপস্থায়ী বিপদের রেশ কেটে যেতে এবং তার মাঝে যুদ্ধের রক্ত গরম করা উন্মাদনা থিতিয়ে আসতে ফুপুজান এতক্ষণে কাঁপতে শুরু করেছেন।

জওহর, আহমেদ খানকে আমার সাথে দেখা করতে বল, এবং খোঁজ নাও যদি আমরা এখনও গঙ্গার বুকে নৌকা ভাসাতে পারি। যদি সেটা বাস্তবসম্মত হয়, মাঝি মাল্লাদের পক্ষে যতটা দ্রুত সম্ভব কয়েকটা নৌকা প্রস্তুত করতে আদেশ দাও যাতে করে আমার ফুপুজান, ভগ্নি, আর উপপত্নীদের নৌকা করে উজানে নিরাপদ আশ্রয়ে রেখে আসা যায়।

জওহর নৌকার সন্ধানে যাবার প্রায় সাথে সাথে আহমেদ খান দৌড়ে আসে।

আমাদের ছাউনির সীমানা এসব আক্রমণ কিভাবে ঠেকিয়েছে? হুমায়ুন জানতে চায়।

বেশ ভালোভাবেই মোকাবেলা করেছে, সুলতান। তাঁদের প্রবল প্রারম্ভিক আক্রমণের পরে যখন তাদের আক্রমণের তীব্রতা ছিল ভয়াবহ, শত্রুসেনা কিছুক্ষণের জন্য মনে হয় আক্রমণের মাত্রা হ্রাস করে যেন কিছু একটা ঘটার জন্য তাঁরা অপেক্ষা করছে।

রাজমহিষীদের তাবুতে তাঁদের হামলার সাফল্য জানবার জন্য… হুমায়ুন আপনমনে বিড়বিড় করে। তারা খুব বেশীক্ষণ আক্রমণ করা থেকে বিরত থাকবে না। কিন্তু এর ফলে আমরা হয়তো নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গুছিয়ে নেয়ার সুযোগ পাব।

সুলতান। উজানের নদীপথ নিরাপদ। আমাদের নৌকা প্রস্তুত এবং প্রতিটা নৌকার জন্য দ্বিগুণ মাঝিমাল্লার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, জওহর ফিরে এসে দম নিতে নিতে সব খুলে বলে। অশ্বারোহী বাহিনীর একটা চৌকষ দলকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে এবং তারা নদীর উত্তর দিকের তীর বরাবর নৌকার সাথে সাথে যাবে।

হুমায়ুন এবার খানজাদার দিকে তাকায়। ফুপুজান, আপনার এবার যাওয়া উচিত। আপনি নিজেকে এবং অন্য মহিলাদের রক্ষা করতে পারবেন আমি বিশ্বাস করি। আমি আপনাকে নৌকা বহরের নেত্রী হিসাবে নিয়োগ করছি। জওহর, মাঝিমাল্লা আর সৈন্যদের জানিয়ে দাও যে একজন মহিলার নির্দেশ পালন করাটা তাদের কাছে যতই বিচিত্র বলে মনে হোক, তারা নির্দ্বিধায় সেটা পালন করবে নতুবা আমার রোষের মুখে পড়বে।

তাদেরকে জওহরের কিছুই বলার দরকার নেই, দৃঢ় কণ্ঠে খানজাদা বলেন। বাবরের বোনের আদেশ তারা অবশ্যই পালন করবে। তুমি বিজয়ী হবার পরে আবার আমাদের দেখা হবে। নীতি বিবর্জিত বিশ্বাসঘাতক তারিক খানের কর্তিত মস্তক আমি দেখতে চাই আর আমার পায়খানার মেথর হওয়া থেকে শেরশাহকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না। কথাটা শেষ করেই তিনি ঘুরে দাঁড়িয়ে কাদার উপর দিয়ে দ্রুত পায়ে গুলবদন আর অন্যান্য মেয়েরা যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেদিকে হেঁটে যায় তারপরে তাঁদের সাথে নিয়ে নদীর তীরের দিকে এগোতে থাকে, শীঘ্রই আলোআধারি আর বৃষ্টির মাঝে হারিয়ে যায়।

হুমায়ুন ভাবে, কি সাহসী এক মহিলা। তাঁর হাল্কা পাতলা আর যৌবন অতিক্রান্ত দেহে তৈমূরের রক্ত কত প্রবলভাবে উপস্থিত। তারিক খানের উপরে আস্থা রেখে এবং শেরশাহের বিলম্বিত উত্তরের কুশলতায় বিশ্বাস করে সে বোকামী করেছে, মারাত্মক বোকামী। সে কেন তাদের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে আরও জোরালভাবে প্রশ্ন করেনি? হারেমের আনন্দের মাঝে গা এলিয়ে দিতেই কি সে বেশী আগ্রহী ছিল? তার মানসিক একাগ্রতার এই ঘাটতি তাকে অবশ্যই শারীরিক বীরত্ব দিয়ে পুষিয়ে দিতে হবে এবং তার লোকদের বিজয়ী হতে অনুপ্রাণিত করতে এটাকে ব্যবহার করবে।

আহমেদ খান আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্বন্ধে আরও বিশদ বিবরণী সংগ্রহ কর। জওহর আমার বর্ম এনে দিয়ে আমার ঘোড়া প্রস্তুত কর।

পনের মিনিটের ভিতরে হুমায়ুন নিজেকে যুদ্ধের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত করে ফেলে, এদিকে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। বাবা ইয়াসভালের নেতৃত্বে বেশ কয়েকজন সেনাপতি তার সাথে এসে যোগ দেয়। সুলতান, পরিস্থিতি মারাত্মক। শেরশাহ নতুন বাহিনী নিয়ে আক্রমণ শুরু করেছে। আমরা কামানগুলোকে গুলি বর্ষণের অবস্থানে নিয়ে যেতে পারছি না। ওদিকে তাকিয়ে দেখেন। তাঁর আধিকারিকের হাতের নির্দেশের দিক অনুসরণ করে তাকিয়ে হুমায়ুন দেখে, গোলন্দাজবাহিনীর বেশ কয়েকজন সৈন্য তাঁর সবচেয়ে বড় ব্রোঞ্জের কামানটার সাথে বাঁধা ষাড়ের দুটো দলকে অবিশ্রান্তভাবে চাবুকাঘাত করছে এর মুখটাকে ঘুরিয়ে শত্রুর হুমকির মুখোমুখি করার প্রয়াসে। কিন্তু বিশালদেহী ষাড়গুলোকে যত জোরেই আঘাত করা হোক বা যতই তাদের তোয়াজ করা হোক, অতিকায় জম্ভগুলো কাদায় হোঁচট খেয়ে পিছলে গিয়ে থকথকে কাদার আরো গভীরে ডুবে যায়। দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলো এবার ষাড়ের সাথে নিজেরাও পুরো শক্তি দিয়ে ঠেলতে চেষ্টা করে কিন্তু পরিস্থিতির বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয় না, মসৃণ বাদামী কাদায় অনেকেই কেবল খাড়া আছাড় খায়।

সুলতান, সবগুলো কামানের একই অবস্থা, বাবা ইয়াসভালো জানায়।

আমি আপনার কথা বিশ্বাস করছি। আর তাছাড়া এই বৃষ্টির ভিতরে তবকি বা গোলন্দাজ উভয়ের পক্ষেই বারুদ শুকনো রাখা বা পলিতায় আগুন দেয়া একটা কঠিন কাজ হত। আমাদের উচিত শীতল ইস্পাতের সনাতন অস্ত্র নিয়ে সম্মুখ সমরে নিজেদের সাহসিকতার উপরে নির্ভর করা। শত্রুর চেয়ে এখনও আমাদের লোকবল বেশী। আধিকারিকদের আদেশ দাও, তাৎক্ষণিকভাবে যতটা তাঁদের পক্ষে সম্ভব সর্বোচ্চ রক্ষণাত্মক অবস্থানে পদাতিক সৈন্যদের বিন্যস্ত করা শুরু করতে। অবরোধক হিসাবে মালগাড়ি, তাবু ব্যবহার কর…হুমায়ুন কথা শেষ করে না এবং তারপরে- তার ফুপুজান আর অন্যান্য রাজমহিষীদের বিপজ্জনক অবস্থান আর এর কারণ যে তাঁর নিজের আত্মতুষ্টি এবং অর্বাচীনসুলভ সরলতা সে সম্বন্ধে পুরোপুরি সচেতন সে যা তাঁদের বিপদের দিকে ঠেলে দিয়েছে- আদেশ দেয়, অশ্বারোহী বাহিনীর আরেকটা শক্তিশালী বাহিনী- দশ হাজার সৈন্য যার অর্ধেক আমার নিজস্ব দেহরক্ষী বাহিনীর- রাজমহিষীদের নিরাপত্তা জোরদার করতে নদীর তীর বরাবর প্রেরণ কর।

কিন্তু সুলতান, এখানে তাদের আমাদের প্রয়োজন।

আমার আদেশের বিরুদ্ধে কোনো প্রশ্ন করবে না। তাদের রক্ষা করার সাথে সম্মানের প্রশ্ন জড়িত।

বাবা ইয়াসভালো আর তর্ক না করে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে একজন বার্তাবাহক প্রেরণ করে।

বাবা ইয়াসভালো, এবার আমাকে বলেন আমার উপস্থিতি কোথায় সবচেয়ে কার্যকর প্রতিপন্ন হবে?

সুলতান, উত্তরপশ্চিম দিকে ওখানে। শক্রর অশ্বারোহী বাহিনী আমাদের সীমানা বেষ্টনী ভেদ করে ভিতরে ঢুকে পড়ে আমাদের পদাতিক সৈন্যদের আক্রমণ করেছিল যখন তারা তাদের তাবু ঘুমিয়ে ছিল এবং নিজেদের রক্ষা করার জন্য প্রতিরোধ গড়ে তোলার আগেই নির্বিচারে অনেককে হত্যা করে। অনেকেই প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে যায়। বাদশানি আর তাজিক সৈন্যরা দ্রুত এগিয়ে এসে জনবল বৃদ্ধি করার পরেই কেবল আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছি এবং সেটাও আমাদের মূল সীমানা থেকে বেশ খানিকটা পিছিয়ে আসবার পরেই কেবল সম্ভব হয়েছে।

বেশ উত্তরপশ্চিম দিকেই যাওয়া যাক তাহলে। হুমায়ুন তার বিশাল কালো স্ট্যালিয়নে আরোহন করে এবং দেহরক্ষী বাহিনীর অর্ধেককে সাথে নিয়ে, যাদের সে রাজমহিষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রেরণ করেনি, সে যত দ্রুত সম্ভব উত্তরপশ্চিম প্রান্তের প্রতিরক্ষায় এগিয়ে যায়। থকথকে কাদার কারণে মাঝে মাঝেই তাদের ঘোড়ার পেট পর্যন্ত কাদায় ডুবে যায়। এক অশ্বারোহী তাঁর বাহনকে যখন দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে, জন্তুটা হোঁচট খায় এবং উল্টে যায়, কাদায় আটকে যাবার কারণে সামনের পায়ে চিড় ধরে।

হুমায়ুনের সেনাছাউনির রণক্ষেত্রে পরিণত হওয়া এলাকাটার কাছাকাছি পৌঁছাতে, সে লক্ষ্য করে যে তার সেনাপতিরা প্রায় ডজনখানেক রণহস্তিতে হাওদাযুক্ত করেছে এবং তাঁদের সামনে নিয়ে এসেছে। হাওদার চাদোয়ার কারণে আপাতদৃষ্টিতে অবিরাম বৃষ্টির হাত থেকে তার তবকিরা সামান্য হলেও রক্ষা পেয়েছে এবং তাদের লম্বা নলের বন্দুক ইন্ধন-বারুদ দিয়ে পূর্ণ করে গুলি করতে সক্ষম হয়েছে আর শেরশাহের আক্রমণকারীদের বেশ কয়েকজনকে ধরাশায়ী করেছে। তবকিদের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে, হুমায়ুনের পদাতিক বাহিনী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে উল্টে রাখা মালবাহী গাড়ির আড়াল ব্যবহার করে সেখান থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে তীর নিক্ষেপ করছে এবং শেরশাহের লোকদের পর্যায়ক্রমে বাধ্য করছে হুমায়ুনের বিশালাকৃতি পাঁচটা কামানের পিছনে আশ্রয় নিতে যেগুলো তারা তাঁদের প্রথম আক্রমণের সময়ে বিধ্বস্ত করেছিল।

হুমায়ুন সম্মুখবর্তী অবস্থানে যখন উপস্থিত হয় সে তার লোকদের সাহস যোগাতে চিৎকার করে উঠে। আমার অসীম সাহসী যোদ্ধার দল, তোমাদের প্রত্যেককে ধন্যবাদ। শত্রুর আক্রমণ তোমরা প্রতিহত করেছে। এখন সময় হয়েছে আমাদের পরাক্রান্ত কামানগুলোকে পুনরায় দখল করার। শেরশাহের উদ্ধৃঙ্খল লোকজনদের সেগুলো বয়ে নিয়ে যাবার সুযোগ দিলে সেটা আমাদের জন্য চরম অপমানের বিষয় হবে। আমি নিজে তোমাদের নেতৃত্ব দেব। মাহুতের দল নিজ নিজ হাতি নিয়ে এগিয়ে যাও। বীর তকির দল, আমার জন্য ঐসব উদ্ধত উচ্ছল দস্যুদের আরও বেশী বেশী ধরাশায়ী কর।

হুমায়ুন রণহস্তীর সম্মুখে অগ্রসর হওয়া আরম্ভের জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষা করে। অবশেষে হাতীর দল, কাদার ভিতর দিয়ে টলমল করতে করতে অগ্রসর হতে আরম্ভ করে এবং তাঁদের পিঠে স্থাপিত হাওদাগুলো এতোবেশী আন্দোলিত হয় যে তবকিদের ভীষণ অসুবিধা হয় লক্ষভেদের জন্য নিজেদের অস্ত্রগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে। হুমায়ুন হাত নেড়ে অশ্বারোহী বাহিনীকেও অগ্রসর হতে বলে। বেদখল হওয়া কামানগুলোর দিকে অগ্রসর হবার সময়ে হুমায়ুন লক্ষ্য করে ব্রোঞ্জের সবচেয়ে বড় কামানগুলোর একটার আড়াল থেকে শেরশাহের গোলন্দাজ বাহিনীর কিছু সদস্য তাঁর পদাতিক বাহিনীর বাদামি-ধুসর বর্ণের একটা তাবুর ভেতর দৌড়ে প্রবেশ করে, যা আপাতদৃষ্টিতে তাঁর সৈন্যরা পিছু হটে আসার পরেও অক্ষত রয়েছে। গোলন্দাজ বাহিনীর সেই লোকগুলো সহসা তাবুর সামনের অংশটা টেনে সরিয়ে ফেলতে দেখা যায় তাঁদের দখলকৃত ষষ্ঠ কামানটা সেখানে অবস্থান করছে যা তারাই ভালো বলতে পারবে কিভাবে তারা সেটাকে তাবুর ভেতরে টেনে নিয়ে গিয়েছে এবং গোলাবর্ষণের উপযুক্ত করে ফেলেছে। কালক্ষেপন না করে, গোলন্দাজ বাহিনীর এক সৈন্য, বেজন্মাটা এতোক্ষণ তাবুর ভেতরেই লুকিয়ে ছিল, কামানের পলিতায় অগ্নি সংযোগ করে।

বিকট একটা শব্দ আর বেলাভূমিতে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের মতো সাদা ধোয়া উদগীরন করে কামানের মুখের ভেতর থেকে ধাতব গোলাটা ছিটকে বের হয়ে এসে, হুমায়ুনের আগুয়ান হস্তিবাহিনীর একেবারে সামনের হাতিটার গম্বুজাকৃতি কপালের ঠিক মধ্যেখানে মোক্ষমভাবে আঘাত করে। মারাত্মকভাবে আহত হাতিটা, সাথে সাথে পথের একপাশে উল্টে পড়ে, জন্তুটার পিঠের হাওদা স্থানচ্যুত হয় আর ভেতরে অবস্থানরত তবকির দল মাটিতে আছড়ে পড়ে, তাঁদের হাত-পায়ের অবস্থা সঙ্গীন। বহরের পেছনের হাতিগুলো এবার আতঙ্কিত হয়ে উঠে এবং মাটিতে আছড়ে পড়া তবকিদের একজনকে পায়ের নীচে কাদায় পিষে দিয়ে, সোজা সামনের দিকে দৌড়াতে আরম্ভ করে। হাতির সম্মুখগতির উপরে নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে সে যখন আপ্রাণ চেষ্টা করছে, জন্তুটা ভয়ে মাথা পেছনে হেলিয়ে রেখে, শুড় আকাশের দিকে তুলে, ভয়ে বিকট ডাক ছাড়ছে এবং হাতিটার দুইজন মাহুতের একজন জন্তুটার গলা থেকে ছিটকে যায় কিন্তু অপরজন কোনোমতে আকড়ে থাকে এবং মনে হয় যেন সে তার আরোহন করা হাতিকে সংযত করতে সক্ষম হয়েছে।

হুমায়ুনের সমস্ত মনোযোগ অবশ্য যে কামানটা থেকে গোলাবর্ষণ করা হয়েছে। সেটার প্রতি নিবদ্ধ। গোলন্দাজের দল পাগলের মতো সেটাকে পুনরায় গোলাবর্ষণের জন্য প্রস্তুত করতে চেষ্টা করছে। গুড়ো পদার্থ ভর্তি একটা কাপড়ের ব্যাগ তারা লোহার সিন্দুক থেকে বের করেছে যা ব্যাগটাকে শুষ্ক রেখেছে এবং কামানের নল বরাবর তারা সাফল্যের সাথে গুড়ো পদার্থটা ঠেসে ঢুকিয়ে দেয়। গুড়ো পদার্থটা ব্যারেলে ঠেসে দেয়ার পর তাদের দুজন এবার কামানের একটা ধাতব গোলা নিয়ে সেটা ব্যারেল বরাবর গড়িয়ে দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয় ঠিক এমননি সময় হুমায়ুন তাঁদের সেই জটলার কাছে পৌঁছে। তার বিশাল কালো ঘোড়ার পর্যানের পিঠে ঝুঁকে নীচু হয়ে বসে, হুমায়ুন আলমগীরের প্রথম আঘাতেই কামানের গোলা ধরে থাকা লোকটা হাত প্রায় দ্বিখণ্ডিত করে দেয়। কামানের গোলাটা নিয়ে সে মাটিতে আছাড় খেয়েছে, তার ক্ষতস্থানসমূহ থেকে পুনরায় রক্তপাত শুরু হয়েছে। হুমায়ুন অপর লোকটা মুখমণ্ডল লক্ষ্য করে তরবারি চালায় কিন্তু গোলন্দাজ বাহিনীর লোকটা নিচের মাথার উপরে হাত দিয়ে আঘাতটা প্রতিহত করে। সে যাই হোক, মারাত্মকভাবে জখম হাত নিয়ে লোকটা ঘুরে দাঁড়ায় এবং দৌড়াতে শুরু করে। লোকটা কয়েক কদমও যেতে পারে না তার আগে হুমায়ুনের হাতের তরবারি তার গায়ের শেকলের তৈরী বর্মের ঠিক উপরে আর মাথার চূড়াকৃতি শিরোম্রাণের ঠিক নীচে উন্মুক্ত ঘাড়ের মাংসে কোপ বসায়, এবং সে মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ইত্যবসরে হুমায়ুনের দেহরক্ষীর দল শত্রুপক্ষের অন্য গোলন্দাজদের হয় হত্যা করেছে কিংবা পালিয়ে যেতে বাধ্য করেছে আর তার তবকিরা হাতির পিঠ থেকে নামতে শুরু করেছে।

দারুন দেখিয়েছে। পদাতিক বাহিনীর অবশিষ্ট সৈন্যদের অগ্রসর হয়ে কামারগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করার আদেশ দাও। আমাদের সাফল্য তাঁদের নতুন করে আত্মবিশ্বাসী করে তুলবে। সেনাছাউনির কেন্দ্রে এবার আমাকে ফিরে যেতে হবে।

কথা শেষ করে, হুমায়ুন তাঁর ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে, চিটচিটে কাদার ভিতর দিয়ে আক্রমণ করার ধকলে বেচারার নাক দিয়ে হাপরের মতো বাতাস বের হয়, তাঁর লাল নিয়ন্ত্রক তাবুর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। সে যখন কামানগুলো আক্রমণ করতে ব্যস্ত সেই ফাঁকে বৃষ্টির বেগ কখন যেন থিতিয়ে এসেছে ফলে দৃষ্টিগ্রাহ্যতা অনেক পরিষ্কার হয়েছে, এখন বৃষ্টি প্রায় নেই বললেই চলে। হুমায়ুন মনে মনে ভাবে, সেনাছাউনির কেন্দ্র থেকে সে তাঁর অবস্থান আরও জোরাল করার জন্য পরবর্তী আদেশ প্রদানে সক্ষম হবে।

সে অবশ্য তার তাবুর উদ্দেশ্যে অর্ধেকটা পথও অতিক্রম করেছে কি করেনি এমন সময় জওহর দ্রুত ঘোড়া দাবড়ে এসে উপস্থিত হয়। সুলতান, সে রুদ্ধশ্বাসে বলে, বাবা ইয়াসভালো আমাকে বলে পাঠিয়েছেন যে আপনি যদি অনুগ্রহ করে দক্ষিণপশ্চিম সীমানার দূরবর্তী অংশ একবার দর্শন করেন। গঙ্গার তীর বরাবর শেরশাহের বিশাল অশ্বারোহী বাহিনী আক্রমণ শুরু করেছে। তারা ইতিমধ্যে আমাদের সম্মুখের প্রতিরক্ষা ফাঁড়ি ভেদ করে ভিতরে প্রবেশ করেছে এবং সেনাপুরঃসর অগ্রদল আমাদের তড়িঘড়ি করে বিন্যস্ত দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা বুহ্যের কাছে অবস্থান করছে।

হুমায়ুন সাথে সাথে তাঁর কালো ঘোড়ার মাথা ঘুরিয়ে নেয় এবং উৎসুক জন্তুটা তাঁর প্রয়োজনীয়তা বুঝতে সম্ভবত পশ্চিম দিক বরাবর নিখুঁত সারিতে বিন্যস্ত তাবুর মাঝ দিয়ে দুলকি চালে ছুটতে শুরু করে, হুমায়ুনের লোকেরা অপ্রত্যাশিত আক্রমণকারীদের প্রতিহত করতে এই তাবুগুলো থেকেই ছুটে গিয়েছিল। জওহর আর তার দেহরক্ষীর দল তাকে অনুসরণ করে।

হুমায়ুন খুব শীঘ্রই যুদ্ধের শোরগোল আর আর্তনাদ বৃদ্ধি পেতে শুনে এবং তারপরে একটা নীচু ঢাল বেয়ে উঠে এসে নীচের দিকে গঙ্গার প্রশস্ত কর্দমাক্ত পাড়ে একটা বিশৃঙ্খল দৃশ্যপটের দিকে তাকায়। শেরশাহের অশ্বারোহী বাহিনীর বেশ কয়েকটা দল তাদের প্রথম প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করে ভেতরে চলে এসেছে এবং তাঁর অশ্বারোহী বাহিনী প্রাণপনে এখন চেষ্টা করছে তাদের ঘিরে ফেলতে বা প্রতিরক্ষা ব্যুহের বাইরে তাদের তাড়িয়ে দিতে। অশ্বারূঢ় অন্যান্য আধিকারিকেরা তাদের হাতের উত্তোলিত তরবারি আন্দোলিত করে চেষ্টা করছে তার পদাতিক সৈন্যদের নিরাপত্তা বেষ্টনীতে সৃষ্ট ফাঁকগুলোকে পূরণ করতে উৎসাহিত করতে কিন্তু তাঁদের প্রয়াস খুব একটা সফল হচ্ছে বলে মনে হয় না। বস্তুতপক্ষে পদাতিক সেনাদের কেউ কেউ তাদের হাতের গোলাকার ঢাল আর লম্বা বর্শা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, যা দিয়ে তারা সজ্জিত, পিছনের দিকে পালিয়ে আসতে শুরু করেছে।

এসবের চেয়েও ভয়ঙ্কর ব্যাপার হল, তাঁর টলমল করতে থাকা প্রতিরক্ষা ব্যুহের মাইলখানেক দূরে শেরশাহের বিশাল আরেকটা অশ্বারোহী বাহিনী প্রস্তুত হচ্ছে আক্রমণ করার অভিপ্রায়ে। এই বাহিনীটার কেন্দ্রস্থলে উজ্জ্বল নিশান আর পতাকার একটা জটলা দেখা যায় এবং হুমায়ুনের কাছে এটা নিশ্চিত প্রতিয়মান হয় যে স্বয়ং শেরশাহ সেখানে রয়েছেন এবং নিজের শক্রদের শেষপর্যন্ত পরাভূত করতে নিজেই এই আক্রমণের নেতৃত্ব দেবেন।

জওহর, ব্যাটাদের মোকাবেলা করার জন্য আমরা নিজেদের প্রস্তুত করতে খুবই অল্প সময় পেয়েছিলাম। বাবা ইয়াসভালো আর আমার অন্যসব সেনাপতিরা কোথায়?

সুলতান আপনার খোঁজে আমি যখন এখান থেকে যাই, বাবা ইয়াসভালো তার কয়েকজন তরুণ আধিকারিকের সাথে এই ঢালের একটু সামনে অবস্থান করছিলেন। কিন্তু তিনি আমাকে বলেছিলেন পরিস্থিতি এতটাই মারাত্মক যে তিনি আপনার আগমনের জন্য হয়ত অপেক্ষা করতে পারবেন না তার আগেই প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করা শত্রুপক্ষের অশ্বারোহী বাহিনীকে আক্রমণ করবেন। দূরে ওখানে ঐ ঘোড়সওয়ার বাহিনীর অগ্রভাগে ওটা কি তারই হলুদ নিশান, আমাদের শত্রুদের একটা দলকে দাবড়ে নিয়ে যাচ্ছে?

জওহর তোমার দৃষ্টিশক্তি অসাধারণ। তাঁকে গিয়ে বল ওখানে ঐ ধুসর তাবুর জটলার কাছে আমার সাথে যত বেশী সংখ্যক সৈন্য নিয়ে সম্ভব আমার সাথে দেখা করতে। আমার অন্য সেনাপতিদের তলব করে বার্তাবাহক প্রেরণ কর যারা তাদের অধীনস্ত সৈন্য নিয়ে আপাতত আক্রমণ বন্ধ করে এখানে আমার সাথে এসে যোগ দিতে পারবে। আমরা শেরশাহের অগ্রাভিযান সরাসরি মোকাবেলা করবো। তাবুর চারপাশের মাটি এখান থেকে বেশ শক্তই মনে হচ্ছে আমাদের প্রারম্ভিক আক্রমণ জোরদার করে শত্রুর ক্ষতিসাধন করতে আমরা আমাদের ঘোড়াগুলোকে ওখান। থেকে প্রয়োজনীয় গতিতে ছোটাতে পারব।

পরবর্তী দশ মিনিটের ভিতরে হুমায়ুন নিজের চারপাশে তার বেশ কয়েকজন সেনাপতিকে সমবেত দেখে। বাবা ইয়াসভালের মতো- যিনি যুদ্ধে তার শিরোস্ত্রাণ হারিয়েছেন এবং তার মাথার ক্ষতস্থানে একটা হলুদ বর্ণের রক্তরঞ্জিত কাপড় জড়ান- আরও কতজন আহত হয়েছেন কিংবা নিখোঁজ রয়েছেন চিন্তা করে তাঁর মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে। সুলেমান মির্জা কোথায়?

শত্রুর অশ্বারোহী বাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরে লিপ্ত অবস্থায় একটা বর্শার আঘাতে তিনি শহীদ হয়েছেন, সুলতান।

আর আহমেদ খান?

মারাত্মকভাবে আহত। শেরশাহের আক্রমণের প্রথম প্রহরে তিনি যখন শিবিরের বেষ্টনী পরিদর্শন করছিলেন তখন দুটো তীর এসে তার উরুতে বিদ্ধ হয়। রক্তক্ষরণের কারণে দুর্বল অবস্থায় তার কয়েকজন সৈন্য তাঁকে খুঁজে পায় এবং আরও অন্যান্য আহতদের সাথে তাঁকে গঙ্গার অপর পাড়ে নিয়ে যায়। সেখানে আপনি যাদের মোতায়েন রেখেছেন আপাতত তারাই তাঁর যত্ন নিচ্ছে।

নিজেদের নিয়তি আর সাহসের উপর ভরসা করে, এসব সাহসী যোদ্ধাদের উপস্থিতি ছাড়াই আমাদের যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে।

হুমায়ুন নিজের চারপাশে তাকিয়ে দেখে যে তার সেনাপতিরা শেরশাহের পরবর্তী আক্রমণ প্রতিহত করতে, হাজার পাঁচেক অশ্বারোহীর একটা মোটামুটি বাহিনী প্রস্তুত করেছে, তার প্রতিপক্ষের সৈন্যসারিতে সহসা ব্যস্ততা বৃদ্ধি পাওয়ায় বোঝা যাচ্ছে আক্রমণ শুরু হতে বেশী দেরী নেই।

শেরশাহের বাহিনী অগ্রসর হবার সাথে সাথে আমরাও এগিয়ে যাব। আমাদের তাঁদের সমাবেশের ঠিক মাঝামাঝি আক্রমণের লক্ষ্য স্থির করবো, আমার বিশ্বাস তিনি সেখানেই অবস্থান করবেন। আমরা যদি তাঁকে হত্যা বা বন্দি করতে পারি তাহলে তার লোকেরা মনোবল হারিয়ে ফেলবে। আমাদের চরম ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও দিনের শেষে তাহলে আমরাই বিজয়ী হব…

মুহূর্ত পরে, শেরশাহ তার অশ্বারোহী বাহিনীর মাঝে গতির সঞ্চার করে, দুলকি চালে গতিবেগ বৃদ্ধি করতে করতে তাঁরা হুমায়ুনের প্রতিরক্ষা ব্যুহের দিকে ধেয়ে আসে। হুমায়ুন অলঙ্কারখচিত ময়ান থেকে আলমগীর বের করে আনে এবং মাথার উপরে সেটা আন্দোলিত করে চিৎকার করে বলে, আক্রমণ কর! মনে রাখবে পশ্চাদপসারণের চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়।

শীঘ্রই কাদা আর উঁচু নীচু জমির উপর দিয়ে যতটা দ্রুত সম্ভব তার বাহিনী ছুটতে শুরু করে। হুমায়ুনকে বহনকারী লম্বা, কালো ঘোড়াটা, সমস্ত সকালের পরিশ্রমের পরেও তাঁকে তাঁর বাহিনীর একেবারে সামনে রেখে, প্রতি মুহূর্তে প্রতিপক্ষের নিকটবর্তী করে তুলে, যারা নিজেরাও উদ্যত সঙ্গীন হাতে ছুটে আসছে নিজেদের সেনাপতির মহিমা কীর্তনে শের, শের রব তুলে।

হুমায়ুনের সব ভাবনা চিন্তা এই মুহূর্তে আসন্ন যুদ্ধের নিরীখে কেন্দ্রীভূত, সে তার কালো স্ট্যালিয়নের ঘাড় বরাবর নীচু হয়ে আসে, আর তার দৃষ্টি স্থির হয়ে থাকে শেরশাহের আস্কন্দিত বেগে আগুয়ান বাহিনীর একেবারে কেন্দ্রস্থলে যেখানে ইস্পাতের উজ্জ্বল বর্ম পরিহিত একজন কালো শ্মশ্রুমণ্ডিত লোক সাদা একটা ঘোড়ায় চেপে বিচরণ করছে আর চিৎকার করে সবাইকে উৎসাহিত করছে। লোকটা শেরশাহ ছাড়া আর কেউ নয়। হুমায়ুন তাঁর ঘোড়ার লাগাম আরও একবার টেনে ধরে নিজেকে শেরশাহ বরাবর ধাবিত করে। কয়েক মিনিটের ভিতরে দুটো সরলরেখা আপতিত হয়। হুমায়ুন শেরশাহকে লক্ষ্য করে আলমগীর দিয়ে কোপ বসায় কিন্তু তরবারির ধারাল ফলা শত্রুর ইস্পাতের বর্মে পানিতে উড়ন্ত চাকতির মতো পিছলে যায় আর পর মুহূর্তে তার নিজ নিজ ভরবেগের কারণে পৃথক হয়ে যায়।

সহসা, হুমায়ুনের মনে হয় একটা বাদামী ঘোড়ায় সে বোধহয় বিশ্বাসঘাতক তারিক খানকে এক ঝলকের জন্য দেখতে পেয়েছে, এখনও বর্মের নীচে তাঁর চিরাচরিত গাঢ় সবুজ বর্ণের আলখাল্লা রয়েছে। হুমায়ুন তাঁর ঘোড়া নিয়ে তারিক খানের দিকে ধেয়ে যায়। যদিও সামনে পেছনে চক্রাকারে ঘুরতে থাকা একদল বিশৃঙ্খল ঘোড়া আর তরবারির ফলায় মৃত্যু নিয়ে পরস্পরকে আঘাতরত তাদের আরোহীদের কারণে তাঁর গতি বিঘ্নিত হলেও, হুমায়ুন ঠিকই সবুজ আলখাল্লা পরিহিত লোকটার কাছে পৌঁছে। তারিক খানই বটে লোকটা।

তারিক খান, তুমি বাঁচার অধিকার হারিয়েছে। আমাকে মোকাবেলা কর এবং মানুষের মতো মৃত্যুবরণ কর, যেমন পিচ্ছিল সাপের মতো তোমার চরিত্র সেভাবে নয়। কথাটা শেষ করেই হুমায়ুন আঘাত করে কিন্তু তারিক খান একেবারে শেষ মুহূর্তে ঢালটা তুলে আঘাতটা এড়িয়ে যায় আর একই সাথে নিজের দোধারি রণকুঠার দিয়ে হুমায়ুনকে লক্ষ্য করে পাগলের মতো কোপ বসায়। হুমায়ুন চিৎ হয়ে তার পর্যানে শুয়ে পড়তে কুঠারের ফলা বাতাসে মৃত্যুর শিস তুলে তার উপর দিয়ে পার হয়ে যায় কিন্তু সেই ফাঁকে হুমায়ুন কুঠার দিয়ে বেপরোয়া আঘাত করতে গিয়ে অরক্ষিত হয়ে পড়া তারিক খানের বাহুমূলে আলমগীরের ফলা আমূল ঢুকিয়ে দেয়। ব্যাথায় চিৎকার করে উঠে তারিক খান হাত থেকে কুঠারটা ফেলে দেয় এবং বাহুমূল থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে এসে তার গাঢ় সবুজ আলখাল্লাকে ভিজিয়ে দেয়, সে বোধহয় তার ঘোড়র উপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে যা তাঁকে নিয়ে ভীড়ের মাঝে হারিয়ে যায়। মুহূর্ত পরেই হুমায়ুন তাঁকে তাঁর ঘোড়ার পর্যান থেকে পিছলে পেছনের দিকে পড়ে গিয়ে কাদায় অন্য ঘোড়ার খুরের নীচে পিষে যেতে দেখে। হুমায়ুন ভাবে, সব বিশ্বাসঘাতকদের এই পরিণতিই হওয়া উচিত।

নিজের চারপাশে তাকিয়ে সে টের পায় যে তার বেশীর ভাগ দেহরক্ষী তাঁর কাছ থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছে, কিন্তু মুষ্টিমেয় যে কয়জন তখনও রয়েছে কর্কশ কণ্ঠে চিৎকার করে তাঁদের অনুসরণ করতে বলে সে তার কালো ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে নেয়, বিশাল জন্তুটার সারা দেহ এখন সাদা, ফেনার মতো ঘামে চুপচুপ করছে, শেরশাহের ঘোড়া তাঁকে যেদিকে নিয়ে যেতে পারে বলে তার ধারণা সেই অভিমুখে সে এবার ঘোড়া ছোটায়। সে যখন ঘোড়া নিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন আরোহীবিহীন একটা ঘোড়া, পেছনের পায়ে তরবারির আঘাতে সৃষ্ট ক্ষতস্থান থেকে অঝোরে রক্ত ঝরছে, তার নিজের ঘোড়ার ডানপাশে এসে ধাক্কা দিতে জন্তুটার গতিপথ বদলে যায় এবং এক মুহূর্তের জন্য হুমায়ুনের বর্ম আবৃত উরু পর্যানের সাথে চাপা খেলে সে ব্যাথায় চোখে মুখে অন্ধকার দেখে। তারপরে, আর্তস্বরে চিহি করে উঠে আরেকদিকে ঘুরে গিয়ে হুমায়ুনের অবশিষ্ট দেহরক্ষীদের একজনের দিকে এগিয়ে যায়। দেহরক্ষীর ঘোড়াটা হুমড়ি খেয়ে মাটিতে আছড়ে পরার সময়ে পিঠের আরোহীকে মাটিতে আছড়ে ফেললে বেচারা ঘাড়ের উপরে ভর দিয়ে মাটিতে পড়ে। আঘাতের ফলে তার মাথার চূড়াকৃতি শিয়োস্ত্রান খুলে গিয়ে মাটিতে দুতিন গড়ান দিয়ে একপাশে কাত হয়ে পড়ে থাকে।

হুমায়ুন তার ঘোড়র উপরে পুনরায় নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে, সে বিশাল জটাকে লড়াই যেদিকে ভীষণ রূপ ধারণ করেছে, সেদিকে এগিয়ে যাবার জন্য পা দিয়ে গুতো দেয়। সহসা মাথার উপরের আকাশ বজ্রপাতের শব্দে বিদীর্ণ হয় এবং সেইসাথে আবারও অঝোর ধারায় বৃষ্টি শুরু হয়, বৃষ্টির ভারী ফোঁটা মাটির খানাখন্দে জমে থাকা পানিতে আছড়ে পড়ে এবং হুমায়ুনের শিরোস্ত্রানের কিনারা বেয়ে নেমে এসে তাঁর চোখ ভাসিয়ে দেয়। সে তার হাতের চামড়ার দস্তানা খুলে এবং ডান হাত তুলে বৃষ্টির ঝাপটা সরিয়ে দিয়ে চোখ মুছে। কিন্তু চোখ মোছায় ব্যস্ত থাকার কারণে সে তার দিকে ধেয়ে আসা কালো আলখাল্লা পরিহিত দুই অশ্বারোহীকে সময় মতো লক্ষ্য করতে ব্যর্থ হয় যতক্ষণ না তারা তার উপরে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ার উপক্রম করে। সে আক্রমণকারীদের দেখতে পেলে দ্রুত একপাশে সরে গিয়ে প্রথমজনের আক্রমণ এড়িয়ে যায় কিন্তু তার অরক্ষিত কব্জি আর হাতের পেশীকে দ্বিতীয়জনের তরবারির আঘাত থেকে রক্ষা করতে পারে না, এবং তরবারিটা তার বর্মের নীচে দিয়ে পিছলে গিয়ে তার কনুইয়ে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে। কালো ঘোড়াটা তাঁকে তাঁর আততায়ীদের কাছ থেকে দ্রুত সরিয়ে নিয়ে আসে, যাঁরা কাদামাটির কারণে তাকে খুব একটা দ্রুত অনুসরণ করতে ব্যর্থ হয়।

হুমায়ুনের আহত ডান হাত থেকে অঝোরে রক্ত ঝরতে থাকে এবং তাঁর আঙ্গুল বেয়ে নেমে এসে তৈমূরের আংটি ঢেকে ফেলে। সে তার বাম হাত দিয়ে গলায় জড়ান দুধ সাদা রঙের গলবস্ত্রটা খুলতে চেষ্টা করে, সেটা দিয়ে রক্তপাত বন্ধ করবে বলে কিন্তু সে গলবস্ত্রটা খুলতে পারে না। তার ডান হাতের অবশ আঙ্গুলগুলো কোনমতে তার ঘোড়ার লাগাম ধরে রাখে। তাঁর মাথার ভেতরটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগতে থাকে এবং চোখের সামনে সাদা আলোর ঝলসানি ভেসে উঠে। নিজের এই উদভ্রান্ত অবস্থার ভিতরে সে কোনোমতে নিজের চারপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারে যে তার আশেপাশে কোনো দেহরক্ষী উপস্থিত নেই। পরিস্থিতি নিশ্চয়ই খুব খারাপ কিন্তু এভাবে মৃত্যুবরণ করাটা অবশ্যই তার নিয়তি হতে পারে না। পরাজয় অনিবার্য নয়। নিজের লোকদের পুনরায় একত্রিত করার জন্য তাকে অবশ্যই তাদের কাছে ফিরে যেতে হবে। হুমায়ুন শরীরের শেষ শক্তিটুকু একত্রিত করে লাগামটা টেনে ধরে হাঁপাতে থাকা, পরিশ্রান্ত ঘোড়ার মুখ তার অবশিষ্ট লোকেরা যেদিকে অবস্থান করছে বলে চেতন অচেতনের মাঝে ভাসতে ভাসতে তার মনে হয় সেদিকে ঘুরিয়ে দিতে চেষ্টা করে। সে ঘোড়াটার পাঁজরে গুঁতো দিয়ে তাঁকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে ইঙ্গিত করে, সামনের দিকে ঝুঁকে গিয়ে জটার প্রশস্ত কালো গলার উপরে এলিয়ে পড়ে, বাম হাতে জন্তুটার পেষল গলার কেশর আকরে ধরতে তার চোখের মণি থেকে চেতনার শেষ রেশটুকুও উধাও হয়ে যায়।

*

সুলতান।

উজ্জ্বল আলোয় হুমায়ুনের চোখ খোলার চেষ্টা করতে ধবধবানি বেড়ে যায় এবং সে পুনরায় তাদের অর্ধনিমীলিত করে ফেলে। সে যখন পুনরায় চেষ্টা করে তখনও একই দীপ্তি বিরাজ করে। অবশেষে সে বুঝতে পারে যে চিৎ হয়ে শুয়ে সে মধ্যাহ্নের সূর্যের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

সুলতান। সেই একই কণ্ঠস্বর আবার ভেসে আসে এবং অনিশ্চিত ভঙ্গিতে একজোড়া হাত তার কাঁধ ধরে মৃদুভাবে ঝাঁকায়। তাঁর পরণে এখন আর কোনো রকমের বর্ম নেই। সেসব কোথায় গেল? সে কি তবে ধরা পড়েছে? সে ক্রমশ ধাতস্থ হয়ে উঠার মাঝেই মাথা ঘুরিয়ে কণ্ঠস্বরটার কার খুঁজে দেখতে চেষ্টা করে এবং ধীরে ধীরে একটা বাদামী রঙের মুখাবয়ব তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠে, যেখানে তার জন্য উদ্বেগের একটা অভিব্যক্তি ফুটে রয়েছে।

আপনি কে?

 হুজুর আমার নাম নিজাম। আমি আপনার সেনাবাহিনীর একজন নগন্য ভিত্তি।

আমি এখন কোথায়?

সুলতান, আপনি গঙ্গার তীরে শুয়ে আছেন। চামড়ার মশকে নদী থেকে যখন পানি সংগ্রহ করছিলাম আপনার সৈন্যদের কাছে নিয়ে যাবার জন্য তখন আমি আপনার বিশাল কালো ঘোড়াটাকে এখান থেকে মাইলখানেকের দূরত্বে অবস্থিত যুদ্ধক্ষেত্রের দিক থেকে ধীরে ধীরে আমার দিকে এগিয়ে আসতে দেখি, আপনি ঘোড়ার গলা জড়িয়ে অচেতন হয়ে আছেন। ঘোড়াটা যখন আরো নিকটে আসে এর হাটু নিজে থেকেই ভাঁজ হয়ে যায় আর জন্তুটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। ঘোড়াটা যখন ভূপতিত হতে যাচ্ছে তখন আপনি এর পিঠ থেকে পিছলে মাটিতে পড়ে যান।

ঘোড়াটা এখন কোথায়? আমার লোকেরাই বা কোথায়?

ঘোড়াটা দূরে ওখানে পড়ে রয়েছে। মৃত অবস্থায়। সুলতান আমার মনে হয় জন্তুটা ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল যদিও বেচারার সারা গায়ে অসংখ্য ছোটখাট ক্ষত রয়েছে আর পশ্চাদভাগে একটা গভীর ক্ষতস্থান।

হুমায়ুনের নিজেকে খানিকটা সুস্থ মনে হতে সে বাম কনুইয়ের উপরে ভর দিয়ে নিজেকে একটু উঁচু করে এবং দেখে যে সত্যিই তার কালো স্ট্যালিয়নটা বিশ গজ দূরে জীহ্বা বের করা অবস্থায় গলা সামনের দিকে প্রসারিত করে মাটিতে পড়ে রয়েছে। কালচে-সবুজ রঙের ডুমো মাছির একটা ঝাক ইতিমধ্যে জন্তুটার মুখ, নাসারন্ধ্র আর অন্যান্য ক্ষতস্থানের কাছে ভীড় করতে শুরু করেছে।

আর আমার লোকেরা?

শেরশাহের বাহিনী পেছন থেকে ধাওয়া করতে যারা অনেককেই তাদের পর্যান থেকে মাটিতে আছড়ে ফেলেছে, আপনার বেশীর ভাগ লোক নদীর তীর বরাবর পূর্ব দিকে পালিয়েছে। নদী এখান থেকে সিকিমাইল দূরত্বে যেখানে অগভীর অনেকে সেখান দিয়ে নদী পার হয়ে অপর পাড়ে চলে গিয়েছে যেখানে এখনও আপনার কিছু সংখ্যক সৈন্য অবস্থান করছে।

আমাকে কি কেউ অনুসরণ করেনি?

না। আর বিশেষ করে এই স্থানটা কর্দমাক্ত আর ঢালু হবার কারণে সহজে দেখা যায় না, তাই এখন পর্যন্ত কেউ এখানে আসেনি। সুলতান, আপনি কি একটু পানি পান করবেন?

আছে, একটু দাও। সহজাত প্রবৃত্তির বশে মশকের জন্য হুমায়ুন হাত বাড়িয়ে দেয়। হাতটা আড়ষ্ট আর বোধহীন হয়ে আছে। খণ্ডযুদ্ধ আর নিজের আহত হবার ঘটনা তার মনে পড়ে। তার বামহাতের ক্ষতস্থানে পটি বাঁধা। পটির দিকে তাকিয়ে সে দেখে- যে গলবটা সে খুলতে ব্যর্থ হয়েছিল সেটা দিয়েই সাদা কাপড়টা দিয়েই পটিটা বাঁধা হয়েছে; আর ক্ষতটা যেখানে গভীর সেখানে মনে হয় যেন একটা চ্যাপ্টা পাথরজাতীয় কিছু রয়েছে।

আমাকে পান করতে সাহায্য কর।

নিজাম তাঁর সবচেয়ে বড় মশকের মুখ থেকে ছিপি খুলে, মশকটার আকার আর আকৃতি দেখে মনে হয় ছোট একটা ছাগলের পুরো চামড়া দিয়ে সেটা তৈরী করা হয়েছে। হুমায়ুনের মাথার নীচে হাত দিয়ে, নিজাম তাঁর মুখে একটু একটু করে পানি ঢালতে থাকে। হুমায়ুন দ্রুত পান করে এবং আরেকটু দিতে বলে। প্রতিটা চুমুকে যেন সে নবজীবন লাভ করে।

ক্ষতস্থানে কি তুমি পটি বেঁধেছো?

জ্বী, সুলতান। যুদ্ধের শেষে আমি হেকিমদের কাজ করতে দেখেছি এবং একজন আমাকে বলেছিল যে গভীর ক্ষতস্থান চেপে রেখে রক্তপাত বন্ধ করার জন্য চ্যাপ্টা পাথর বেশ কাজে দেয়।

পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে বুদ্ধিটা কাজে দিয়েছে। তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে।

তুমি কিভাবে জানো যে আমিই তোমাদের সম্রাট?

আপনার আঙ্গুলের ব্যাঘখচিত অঙ্গুরীয় আর আপনার কোমরের রত্নখচিত তরবারি দেখে। সেনাছাউনিতে ঐ দুটো জিনিষের গল্প আমি প্রচুর শুনেছি।

হুমায়ুনের মাথা এখন পুরোদমে কাজ করছে এবং উঠে বসতে গিয়ে সে টের পায় সে অঙ্গুরীয় কিংবা তার আব্বাজানের তরবারি আলমগীর, যা সে অথবা নিজাম অবশ্যই পুনরায় কোষবদ্ধ করেছে, দুটোই তাঁর সাথে আছে।

আকাশে মধ্যাহ্নের সূর্য দোর্দণ্ডপ্রতাপে বিরাজমান হবার কারণে ভেজা মাটি থেকে নির্গত বাষ্পের সাথে সকালের কুয়াশার একটা অদ্ভুত মিল রয়েছে। নিজের ত্রাণকর্তার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখতে হুমায়ুন লক্ষ্য করে যে নিজাম লোকটা আসলে, যার পরণে কেবল একটা কালো জোব্বা রয়েছে, কৃশকায় আর ছোটখাট এবং সারা গায়ে শুকিয়ে যাওয়া কাদা লেগে রয়েছে, তের কি চৌদ্দ বছরের একটা কিশোর। সে ইচ্ছা করলেই হুমায়ুনের সর্বস্ব হরণ করে পালিয়ে যেতে পারতো কিন্তু সেটা না করে সে নিছক আনুগত্যের খাতিরে তার সাথে রয়েছে। হুমায়ুন পরিষ্কার বুঝতে পারে যে- যদিও যুদ্ধে পরাজিত হয়েছে যে বিষয়ে সে মোটামুটি নিশ্চিত- তাঁর আব্বাজানের দেয়া সৌভাগ্যবান নামের মহিমা সে এখনও ধারণ করছে। একটা পরাজয়ে কিছুই নির্ধারিত হবে না। বাবর অনেক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়েছিলেন। তাঁর মনে আছে বাবর প্রায়ই বলতেন বিপর্যয়ের সাথে তোমাকে এভাবেই মানিয়ে নিতে হবে। হুমায়ুনের মাথাটা আবার হঠাৎ করে ঝিমঝিম করে উঠে। নিজেকে সে বর্তমানে ফিরিয়ে আনে, সে খুব ভালো করেই জানে যে তার প্রথম কাজ এখন নিজের সেনাবাহিনীর সাথে পুনরায় মিলিত হওয়া।

নিজাম, সবচেয়ে কাছে কোথায় আমার সৈন্যরা আছে?

আপনাকে আগেই আমি বলেছি, নদীর এই পাড়ে যারা ছিল তাঁরা সবাই পালিয়েছে। কিন্তু অপর তীরে এখনও বিপুল সংখ্যায় তারা অবস্থান করছে- ঐ যে দেখেন। ধোয়া উঠতে থাকা কর্দমাক্ত তীর আর নদীর মাঝে বিদ্যমান চরের অপর পাশে নিজাম আঙ্গুল দিয়ে দেখায়। হুমায়ুন সেখানে অশ্বারোহী লোকদের বিশাল একটা দলকে দেখতে পায়।

তুমি নিশ্চিত তারা আমার লোক?

জ্বী, সুলতান। এপাড় থেকে অনেকেই সাতরে ওপাড়ের ঐ দলটার সাথে যোগ দিয়েছে।

হুমায়ুন ভাবে, নিজাম নিশ্চয় ঠিকই বলছে। শেরশাহ তাঁর সৈন্যদের পাশ কাটিয়ে গিয়ে, নদী অতিক্রম করে পেছন থেকে যাতে তাঁকে অতর্কিতে আক্রমণ করতে না পারে সেজন্য অপর পাড়ে একদল সৈন্য মোতায়েন করে সে বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছে।

আমাকে অবশ্যই তাদের সাথে মিলিত হতে হবে। হুমায়ুন কথার মাঝে টলমল করতে করতে উঠে দাঁড়ায় কিন্তু তার পা দেহের ভার নিতে গিয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকে এবং আবার তার মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠে।

সুলতান, আমার উপরে ভর দিয়ে দাঁড়ান।

নিজামের হাড়সর্বস্ব কাঁধে হুমায়ুন খুশী মনে নিজের বাম হাত রাখে। আমাকে নীচে পানির কাছে যেতে সাহায্য কর যাতে আমি সাঁতরে নদী পার হতে পারি।

কিন্তু আপনি ভীষণ দুর্বল। আপনি ডুবে যেতে পারেন।

আমার চেষ্টাটা করতেই হবে। শত্রুর হাতে ধরা পড়াটা আমার জন্য দারুণ অসম্মানের একটা ব্যাপার হবে।

নিজাম চারপাশে তাকায় এবং নিজের সবচেয়ে বড় দুটো ছাগলের চামড়ার মশকের দিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষিত হয় আর সে হুমায়ুনের দিকে তাকায়। সুলতান আপনি কি কিছুক্ষণ একা দাঁড়িয়ে থাকতে পারবেন? মনে হয় আমি একটা বুদ্ধি পেয়েছি।

হুমায়ুনের কাছ থেকে সম্মতি লাভ করতে, সে দৌড়ে মশকের কাছে যায় এবং ছিপি খুলে মশক দুটো খালি করে। তারপরে, হুমায়ুনকে বিস্মিত করে, সে বড় মশকটা তুলে নিয়ে সেটার মুখে নিজের ঠোঁট রাখে এবং ফুঁ দিতে শুরু করতে, তার চোখ দুটো ঠিকরে কপাল থেকে বের হয়ে আসতে চায় এবং গালের চামড়া ফুলে উঠে। কিছুক্ষণ পরে হুমায়ুন দেখে যে মশকটা ফুলতে শুরু করেছে এবং অচিরেই মশকটার চামড়া বাতাসে টানটান হয়ে উঠে। নিজাম ছিপি দিয়ে মুখটা বন্ধ করে এবং মশকটা হুমায়ুনের কাছে নিয়ে এসে, দ্রুত অপর মশকটাকেও একইভাবে ফুলিয়ে তোলে এবং খেলাচ্ছলে সেটার গায়ে একটা টোকা দিয়ে আপন মনেই হেসে উঠে। এটা দিয়েই কাজ হবে। সুলতান যা করার আমাদের দ্রুত করতে হবে। শেরশাহের লোকেরা খুব শীঘই লুটপাট করতে তাদের শত্রুদের মৃতদেহের খোঁজে চারপাশে ছড়িয়ে পড়বে। আমি আপনার বর্ম লুকিয়ে রেখেছি ফলে আলো পড়ে সেটা চকচক করবে না কিন্তু তারা নদীর পাড় তন্নতন্ন করে খুঁজবে।

আমি জানি কিন্তু আমাকে প্রথমে তুমি আমার সাহসী ঘোড়াটার কাছে নিয়ে চল। আমি নিশ্চিত হতে চাই যে সে মারা গেছে নতুবা তার দুর্দশা থেকে আমি তাকে মুক্তি দিতে চাই। সে আমার অনেক যুদ্ধের সাথী আর নিজের দায়িত্ব সে দারুনভাবে পালন করেছে। ঘোড়াটার কাছে গিয়ে এক ঝলক তাকিয়েই হুমায়ুন বুঝতে পারে যে কালো স্ট্যালিয়নটা আসলেই মারা গেছে। তারপরে নিজামের কাঁধে ভর দিয়ে সে নদীর উঁচু নীচু পাড়ের ভিতর দিয়ে নদী অববাহিকার দিকে এগিয়ে যায়। সে ক্লান্তিতে দুবার বসে পড়ে কিন্তু প্রতিবারই নিজাম- বাতাস ভর্তি মশক দুটো নিয়েই বেচারা হিমশিম খাচ্ছে- তাঁকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করে। দশ মিনিট প্রাণান্তকর পরিশ্রমের পরে এই অসম জুড়ি গঙ্গার তীরে এসে পৌঁছে। নিজাম বাতাস ভর্তি মশক দুটো হুমায়ুনের দিকে এগিয়ে দেয়।

নিজাম, তোমাকে ধন্যবাদ। এবার দ্রুত পালাও আর নিজের প্রাণ বাঁচাও।

না, সুলতান, আমি আপনার সাথে থাকবো নতুবা আপনি পানিতে ডুবে যাবেন।

বেশ মরার যখন এতোই শখ, তাহলে আগে আমার পায়ের নাগরা দুটো খুলে দাও, হুমায়ুন নদীর তীরে শোয়া আর বসার মাঝামাঝি বিচিত্র এক ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে। নিজাম দ্রুত মোটা চামড়ার তৈরী ভারী নাগরা জোড়া টেনে খুলে দেয়, তার নিজের জন্য চিন্তা নেই কারণ সে আজীবনই খালি পায়ে হেঁটেই অভ্যস্ত এবং হুমায়ুনকে ধরে হাঁটুপানিতে নিয়ে আসে।

সুলতান, আপনার ভালো হাত আর পা দিয়ে সাঁতার কাঁতে চেষ্টা করবেন। আপনার ডান হাতের নীচে বাতাস ভর্তি একটা মশক রাখতে চেষ্টা করবেন আর দ্বিতীয়টা রাখবেন আপনার থুতনির নীচে। আমি আপনাকে সাতারের দিক ঠিক রাখতে সাহায্য করবো।

তারা ধীরে ধীরে সাঁতার কাঁতে থাকে, একটা সময়ে হুমায়ুনের মনে হয় তারা বোধহয় মাঝ নদীতে এসে পৌঁছেছে। পানিতে ভিজে যাওয়াও তাঁর আহত ডান হাতে আবারও তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয় কিন্তু ব্যাথার ঝাপটায় তার মাথা পরিষ্কার কাজ করতে শুরু করে। সে কোনোভাবেই মারা যাবে না- এটা তার নিয়তি না- আর সে। আরও দ্রুত নিজের শেষ শক্তিটুকু দিয়ে প্রাণপনে পা ঝাপটাতে শুরু করে। পানিতে নামার পরে খুব ভালো করেই নিজামের গুরুত্ব টের পাওয়া যায় এবং হুমায়ুনকে টেনে কখনও ধাক্কা দিয়ে অপর তীড়ের দিকে তাঁকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। কয়েক মিনিট পরে, নদীর দক্ষিণ তীর থেকে তাঁরা যখন মাত্র পাঁচ গজ দূরে নিজাম হঠাৎ করে আতঙ্কিত হয়ে উঠে পা দিয়ে পাগলের মতো পানিতে আঘাত করে আর হাত দিয়ে হুমায়ুনকে টানতে থাকে। সুলতান, একটা কুমীর- ব্যাটা নির্ঘাত আপনার ক্ষতস্থান থেকে বের হওয়া রক্তের গন্ধ পেয়েছে। বদমাশটার সুচালো মাথা আমাদের ঠিক পেছনেই রয়েছে। জলদি!

হুমায়ুন দ্রুত দুবার হাত ঝাপটায় এবং সে পায়ের নীচে মাটি খুঁজে পায়, নরম কাদা তার পায়ের পাতার নীচে পিছলে যেতে থাকে। নিজামকে পাশে নিয়ে নিজের শেষটুকু একত্রিত করে সে পানিতে জবজবে হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে টলমল করে পানি থেকে উঠে আসে।

সুলতান, আমাদের পাড়ের আরেকটু ভিতরে যেতে হবে।

নিজামের সাহায্যে হোঁচট খেতে খেতে হুমায়ুন আরও দশ গজ হেঁটে যায়। আপাত নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছে, সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে কুমীরটার হলুদাভ চোখ আর তীরে একেবারে নিকটে সুচালো মাথাটা পানিতে ভেসে রয়েছে দেখতে পায়। তার চোখের সামনেই সরীসৃপটা মাথা ঘুরিয়ে নেয় এবং একটা মোচড় খেয়ে গভীর পানিতে তলিয়ে যায়। কুমীরটা বেশ ছোট তাঁকে হয়তো ধরাশায়ী করতে পারতো না কিন্তু ব্যাপারটা সে পর্যন্ত গড়ায়নি বলে সে ভাগ্যকে ধন্যবাদ জানায়।

সুলতান, আমি গিয়ে আপনার সেনাপতিদের খুঁজে বের করি এবং আপনার আহত হবার সংবাদ তাদের জানাই আর আপনাকে নিয়ে যাবার জন্য তাদের লোক পাঠাতে বলি। আমি আমার বাবাকে খুঁজতে- তারপরে আবার সাঁতরে নদী পার হব। সেনাছাউনির অস্থায়ী রন্ধনশালায় সে রাঁধুনির কাজ করে এবং শেরশাহের প্রথম আক্রমণের পর থেকে আমি আর তাকে দেখিনি।

কিন্তু এতোক্ষণ তুমি আমাকে এসব কিছুই বলনি।

আমি জানি প্রথমে আপনাকে সাহায্য করা আমার দায়িত্ব।

তোমার সাহসিকতা আর আনুগত্যের উপযুক্ত পুরষ্কার আমি যেন তোমাকে দিতে পারি সেজন্য আমার সাথে তোমাকে যেতে হবে।

না, সুলতান- আমার বাবাকে আমায় খুঁজে পেতেই হবে। নিজাম উত্তর দেয়, তাঁর কচি মুখে একটা অটল সংকল্প ফুটে আছে।

হুমায়ুনের মাথায় একটা অদ্ভুত চিন্তা খেলে যায়। আবেগতাড়িত হয়ে সে নিজের অজান্তে ভাবনাটা বলে যায়। ভিস্তিদের মাঝে প্রতিপালিত হলেও তুমি স্বভাবে একজন যুবরাজ। আমি আমার রাজধানীতে যখন ফিরে যাব, আমার সাথে দেখা করবে এবং সেখানে আমার সিংহাসনে উপবেশন করে সত্যিকারের সম্রাটের মতো এক কি দুই ঘন্টার জন্য রাজত্ব পরিচালনা করবে। তুমি যে আদেশ দেবে সেটাই পালন করা হবে।

নিজামকে বিভ্রান্ত দেখায় এবং তারপরে সে ফিক করে হেসে উঠে আর খুশীতে তোতলাতে তোতলাতে, জ্বী সুলতান, বলে সে দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়ে গঙ্গার তীরের কর্দমাক্ত আর উঁচুনীচু পাড়ের উপর দিয়ে হুমায়ুনের অবশিষ্ট সেনাবাহিনীর খোঁজে দৌড়ে যায়।

2 Comments
Collapse Comments
রাইয়ান কবির January 21, 2022 at 8:08 pm

আসসালামু আলাইকুম ভাই,
আরও কিছু বই রাখার অনুরোধ রাখছি। বিশেষত, হিটলারের মাইন ক্যাম্পফ ও বাবুরের লেখা বাবুরনামা একইসাথে গুল বদনের লেখা হুমায়ূননামা এর মতো ইতিহাসের বইগুলো বেশ সুবিধাজনক হত।

Bangla Library (Administrator) January 23, 2022 at 11:49 pm

মাইন ক্যাম্প আছে লাইব্রেরিতে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *