১.৩ লুট করা সমৃদ্ধি

০৩. লুট করা সমৃদ্ধি

জওহর, আমার জন্য লেবুর রস দেয়া সেই পানিটা নিয়ে এসো- হিন্দুরা এটাকে কি বলে? লিম্বু পানি? এই গরমে সেটা বেশ সতেজ করে তুলে। হুমায়ুন চম্পনীর দূর্গের বাইরে তাঁর সুরক্ষিত সৈন্য শিবিরের ঠিক মাঝে তার লাল রঙের বিশাল তাবুতে দাঁড়িয়ে যেখান থেকেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তাবুর গুটিয়ে রাখা নিম্নপ্রান্তের ভিতর দিয়ে, সে দুই-মাইল-দীর্ঘ পাথুরে শিলাস্তরের এক প্রান্তে দূৰ্গটার পাথরের তৈরী অতিকায় অবয়ব দেখতে পায় যা জঙ্গলের করকটে গাছগাছালির মাথার উপরে ভেসে রয়েছে গ্রীষ্মের দাবদাহে সবগুলো গাছের পাতা শুকিয়ে বাদামী আর সোনালী বর্ণ ধারণ করেছে।

আজ থেকে ছয় সপ্তাহ পূর্বে হুমায়ুন অবরোধ-যজ্ঞে এসে শামিল হয়েছে। নিজের পরিষদমণ্ডলীর সাথে সে প্রথমে যেমন আলোচনা করেছিল, তার আধিকারিকেরা নিজেদের অবস্থান অবরোধক আর উভয়পার্শ্বে কামান স্থাপন করে সুরক্ষিত করেছে যাতে করে তারা অবরুদ্ধদের দ্বারা অবরোধকারীদের উপরে পরিচালিত যে কোনো আক্রমণ প্রতিরোধ করতে পারে আর সেই সাথে অবরুদ্ধদের স্বস্তি দিতে আগত বাহিনীকে সাফল্যের সাথে প্রতিহত করতে পারবে তারা এই বাহিনীর আগমনের ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত। সেই বাহিনী এখনও এসে পৌঁছায়নি আর গুপ্তদূতেরা তাঁদের আগমনের কোনো লক্ষণ এখনও পর্যন্ত বিবরণীতে উল্লেখ করেনি। শোনা যায় যে বাহাদুর শাহ তাঁর ভূখণ্ডের দক্ষিণের সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত উচ্চভূমিতে অবস্থান করছেন। তিনি সম্ভবত দূর্গের শক্তিমত্তায় বিশ্বাস করেন, এবং এখানে অবস্থিত সৈন্যদের ব্যারাক হুমায়ুন আর তাঁর দলবলকে বিদায় জানাবার জন্য যথেষ্ট।

হুমায়ুন তন্ময় হয়ে ভাবে, যদি সেটা হয়ে থাকে তবে এখনও পর্যন্ত তার ধারণাই সঠিক বলে প্রতিপন্ন হয়েছে। সে আর তার ঝানু পোড় খাওয়া সেনাপতিরা সম্ভাব্য সব উপায়ে চেষ্টা করে দেখেছে কিন্তু সাফল্য তাঁদের ধরা দেয়নি। দূর্গের চওড়া পাথরের দেয়ালে তাঁদের কামান থেকে গোলাবর্ষণ করা হয়েছে, কিন্তু গোলন্দাজ বাহিনীর অনেক সদস্য দূর্গের প্রকারবেষ্টিত সমতল ছাদ থেকে নিক্ষিপ্ত গুলির লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে যখন তাঁরা কামানগুলোকে কার্যকর রাখতে প্রযত্ন হয়েছে। গোলন্দাজেরা একবার যখন দূর্গের দেয়ালের একটা ক্ষুদ্র অংশ ভেঙে ফেলতে সফল হয় তখন হুমায়ুনের লোকেরা যখন পাথরে ভাঙা টুকরো টপকে এবং তার ভিতর দিয়ে সামনে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করলে, গুজরাতিরা তাদের মাস্কেট দিয়ে হুমায়ুনের লোকদের দিকে গুলি করে পাখির মতো তাদের ধরাশায়ী করেছে। তাঁর লোকদের ভেতরে যারা প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে পেরেছিল, তারা পরবর্তীতে নিজেদের অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছে দূর্গ অভ্যন্তরে আরেকটা দেয়াল রয়েছে, গুজরাতিরা যার আড়াল ব্যবহার করে তাঁদের উপরে বুলেট আর তীর নিক্ষেপ করেছে এবং সাফল্যের সাথে তাদের আক্রমণ প্রতিরোধ করেছে। অন্য আরেকবার, পাথরের দূর্গ প্রাচীরের উন্মুক্ত পরিসরে খুব ভালোভাবে সুরক্ষিত গুজরাতি কামানগুলো, সামনাসামনি আক্রমণের একটা ধাক্কা ছত্রভঙ্গ করে দিতে সক্ষম হয় মোগলরা তখনও তাদের দেয়াল বেয়ে উঠবার মইগুলো স্থাপণ করার জন্য দূর্গ প্রাচীরের কাছাকাছিও পৌঁছাতে পারেনি।

মৃত মোগল যযাদ্ধাদের কালো হয়ে যাওয়া এবং পচে ফুলে উঠা দেহগুলো দূর্গ প্রাচীরের সামনে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে থেকে পচনক্রিয়া শুরু হতে গা-গুলিয়ে উঠা মিষ্টি একটা গন্ধে চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে উঠে এবং সেই গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে কালচে-বেগুনী রঙের ডুমো মাছির ঝাঁক এসে উপস্থিত হয় যার সংখ্যা এখন কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তাঁর পুরো শিবিরে এখন ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বেড়াচ্ছে। আহত সহযোদ্ধাদের উদ্ধার করতে বা মৃতদের লাশগুলো ফিরিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করতে গিয়ে এতো বেশী লোক প্রাণ হারায় যে রাতের আঁধার ব্যাতীত এমন প্রয়াসের প্রতি হুমায়ুন কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে বাধ্য হয় এবং তারপরেও হতাহতের সংখ্যা প্রচুর।

জওহর তাঁর প্রিয় পানীয় নিয়ে পুনরায় হাজির হলে ভাবনায় তখনকার মতো ছেদ পড়ে হুমায়ুনের। সে যখন শীতল উপভোগ্য তরল পান করছে তখন আরেকবার বাইরের দিকে তাকায় এবং মধ্যাহ্নের আকাশে কালো মেঘ জমতে দেখে। মেঘের রঙ আরো কালো হবে এবং আসন্ন বর্ষাকালের কারণে এখন আরো ঘন ঘন এমন বৃষ্টি হবে। বৃষ্টির কারণে দূর্গের অভ্যন্তরে অবস্থানরত প্রতিরোধকারীদের পানীয় জলের সমস্যা আপাতত মিটে যাবে আর হুমায়ুনের আক্রমণ প্রয়াসকে আরো বেশী কঠিন করে তুলবে। বর্ষাকাল তাঁর শিবিরে রোগের প্রাদুর্ভাব বয়ে আনতে পারে।

জওহর, স্থানীয় লোকেরা কি বলে আশেপাশের এলাকায় কখন বৃষ্টি হয়?

সুলতান, জুলাই মাসের মাঝামাঝি।

 হুমায়ুন উঠে দাঁড়ায়, সে মনঃস্থির করে ফেলেছে। আমাদের অবশ্যই তার আগে এখানে আসবার উদ্দেশ্য হাসিল করতে হবে। আমাদের সামনাসামনি আক্রমণ একেবারেই ফলপ্রসু হচ্ছে না। আমাদের বিকল্প কিছু একটা খুঁজে বের করতে হবে এবং সেটা অচিরেই করতে হবে। আগামীকাল আমি নিজে আমাদের গুপ্তদূত সর্দারদের সাথে বের হব দেখতে যে তাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থায় গুজরাতিদের চোখ এড়িয়ে গিয়েছে এমন কোনো দুর্বলতা আমরা যদি সনাক্ত করতে পারি।

*

উন্মুক্ত পাথুরে শিলাস্তর, যার একেবারে পূর্বপ্রান্তে আপাতদৃষ্টিতে দুর্ভেদ্য চম্পনীর দূর্গ দাঁড়িয়ে আছে, দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে সে যখন তাঁর ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে চলেছে তখন হুমায়ুন তাঁর ধাতব শৃঙ্খল নির্মিত বর্মের নীচে কুলকুল করে ঘামতে থাকে। হতাশার একটা তীব্র অনুভূতি তার শারীরিক অস্বস্তিকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সে এবং তার গুপ্তদূতের দল শিলাস্তরের উত্তর দিকে এক নিষ্ফল তথ্যানুসন্ধান অভিযানে ইতিমধ্যে পাঁচটি উষ্ণ ঘন্টা অতিবাহিত করছে এবং দক্ষিণদিকের অর্ধেকটা ইতিমধ্যে অতিক্রম করে ফেলেছে তারা। সে নিজে বা তার কোনো গুপ্তদূত যখনই ভেবেছে তারা একটা অরক্ষিত স্থান সনাক্ত করতে পেরেছে, যেখান দিয়ে তাঁর লোকেরা হয়ত উপরে উঠবার প্রয়াস পাবে, প্রতিবারই আরোহনকারী সৈনিকের পক্ষে দুরুত্তর কোনো ঝুলে থাকা পাথরে আছড়ে পড়ে সেই সম্ভাবনার সমাপ্তি ঘটেছে। একবার এক গুপ্তদূত বাহুদ্বয় শস্য মাড়ানোর কস্তনীর মতো আন্দোলিত করে, পেছনের দিকে আছড়ে পড়ার আগে পাথুরে দেয়ালের একটা ফাটল দিয়ে উপরের দিকে প্রায় তিন-চতুর্থাংশ পথ বেয়ে উঠে গেলে, মাস্কেটের একটা গুলির শব্দে যখন চারপাশের স্তব্ধতা খানখান হয়ে যায়, তখন সবাই বাস্তবিকই বুঝতে পারে যে পাহাড়ের কিনারে কোনো একটা বলির আড়ালে একটা গুপ্ত প্রতিরক্ষামূলক ফাঁড়ি রয়েছে।

জওহর, আমাকে একটু পানি দাও, একটা সুতির কাপড় দিয়ে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে হুমায়ুন আদেশ দেয়। বাছা জলদি করো, জওহর তাঁর পর্যানের দুপাশে ঝোলান থলির ভিতরে পানির খোঁজে হাতড়াতে থাকলে সে গলা চড়ায়।

মার্জনা করবেন, সুলতান, দড়িগুলো সব জড়িয়ে গিয়েছে।

বেশ তাহলে যত দ্রুত তোমার পক্ষে সম্ভব, হুমায়ুন এবার আগের চেয়ে অনেক মোলায়েম কণ্ঠে বলে, সে বুঝতে পারে বালকের আনাড়িপনা তাঁর ক্রোধের কারণ না, আক্রমণের পথ চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হওয়ায় তাঁর নিজের হতাশাই তাকে ক্ষেপিয়ে তুলেছে। আমরা ওখানে ঐ ছোট্ট টিলার উপরে গাছের ছায়ায় ঘোড়া থেকে নেমে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেব।

হুমায়ুন ক্লান্ত ভঙ্গিতে পাঁচশ গজ দূরে অবস্থিত গাছপালাবেষ্টিত ক্ষুদ্র এলাকাটার দিকে ঘোড়া নিয়ে এগিয়ে যায়। কিন্তু ঢাল বেয়ে উপরে উঠে এসে ঘোড়া থেকে নামতে নামতে সে টের পায় যে পাহাড়ের উচ্চতা আর নতুন দিক থেকে অবলোকন একেবারে ভিন্ন একটা দৃষ্টিরূপ সৃষ্টি করেছে। সে দেখতে পায় গাছপালার উপরে পাথরের গায়ে একটা গভীর ফাটল রয়েছে যা একেবারে উপর পর্যন্ত বিস্তৃত। বর্ষার মৌসুমে সম্ভবত এর ভিতর দিয়ে একটা জলপ্রপাত প্রবাহিত হয় কিন্তু এই মুহূর্তে সেটা শুকনো দেখাচ্ছে। নিমেষে তৃষ্ণা আর হতাশা ভুলে গিয়ে হুমায়ুন গুপ্তদূত প্রধান আহমেন খানকে ডেকে পাঠায় তার কাছে।

তুমি কি ওখানে ঐ ফাটলটা দেখতে পাচ্ছ? তোমার কি মনে হয়? ওটা দিয়ে কি উপরে বেয়ে ওঠা সম্ভব?

সুলতান, আমি ঠিক বলতে পারছি না, কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে সম্ভব। আমি নিজে গিয়ে ফাটলটা পর্যবেক্ষণ করছি।

 তুমি যাবার আগে আমাদের বাকি লোকেরা যেন গাছপালার আড়ালে থাকে সেটা নিশ্চিত কর। আমরা চাইনা কেউ তাদের দেখতে পাক…এবং আল্লাহ্ ভরসা।

শুকরিয়া, সুলতান আহমেদ খান তার পর্যান থেকে একজোড়া চামড়ার জুতো বের করে। পাথরের গায়ে ভালো করে আকড়ে ধরার জন্য জুতোর তলিতে চামড়ার অতিরিক্ত পটি সেলাই করা হয়েছে। জুতো জোড়া পরিধান করে আধ মাইল বা তার কাছাকাছি দূরত্বে অবস্থিত উঁচু খাড়া পাহাড়ের দিকে রওয়ানা দেয় সে। পাঁচ কি দশ মিনিট পরেই করকটে ঝোপঝাড় আর বিক্ষিপ্ত গাছপালার আড়ালে দৃশ্যপটের অন্তরালে চলে যায় সে। হুমায়ুন তারপরে উঁচু পাহাড়ের গা বেয়ে একটা অবয়বকে উপরে উঠে যেতে দেখে। অবয়বটা কখনও হারিয়ে যায় কিন্তু পুনরায় দৃশ্যমান হতে মনে হয় অনেকটা যেন উপরে উঠে গিয়েছে। তারপরে অবয়বটা কিছুক্ষণের জন্য একেবারেই দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়। হুমায়ুন তার গুপ্তদূতকে এর পরে যখন দেখতে পায় তখন সে অনেকটা নীচে নেমে এসেছে। হুমায়ুন পায়চারি করে, তার ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে, আশঙ্কিত যে শেষ কয়েক গজ হয়তো অনতিক্রম্য প্রমাণিত হয়েছে কিন্তু আশা করে যে তার ধারণা হয়তো ভুল। আধঘন্টা পরে আহমেদ খানকে গাছপালাবেষ্টিত সেই পাহাড়ের চূড়ায় দেখা যায়। তার হাত বেশ কয়েক স্থানে ঘষা খেয়ে ছড়ে গিয়েছে এবং পরনের ঢোলা প্যান্টটা হাঁটুর কাছে ছিঁড়ে গিয়েছে। বন্ধুর পথে সে হেঁটেছিল বলে বাম পায়ের জুতোর তলি অনেকটাই খয়ে গিয়েছে কিন্তু তাঁর মুখে কান পর্যন্ত বিস্তৃত একটা হাসি।

সেখানে কোনো প্রতিরক্ষাকারীকে দেখা যায়নি। চূড়ো থেকে চল্লিশ ফিট নীচ পর্যন্ত বেয়ে উঠতে খুব একটা কষ্ট করতে হয় না কিন্তু পা রাখবার জায়গা খুব কম থাকার জন্য শেষের ফিটগুলো বেয়ে উঠা বেশ কষ্টকর। আমার মতো পাহাড়ী লোকদের পক্ষে সংকীর্ণ ফাটলের কোনো একটার দেয়ালে পিঠ দিয়ে আর অন্য দেয়ালে পা দিয়ে উপরে উঠে যাওয়া সম্ভব। অনেকের পক্ষেই সেটা অসম্ভব প্রতিপন্ন হবে বিশেষ করে যখন অস্ত্রশস্ত্র বহন করতে হবে। অবশ্য এবং সে পুনরায় হাসতে শুরু করে- পাথরে ফাটল রয়েছে এবং বেশ নমনীয়ও বটে, যারা প্রথমে বেয়ে উঠবে তারা সহজেই ধাতব কিল পাথরের গায়ে গেথে দিতে পারবে ফলে কম দক্ষদের বেয়ে উঠবার ক্ষেত্রে এক ধরনের মই তৈরী হয়ে যাবে।

আমি আল্লাহতালার কাছে শুকরিয়া আদায় করছি আর তোমার সাহসিকতা আর দক্ষতার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। পাঁচশো বাছাই করা লোক নিয়ে আগামীকাল রাতে আমরা ফিরে আসবো। আমাদের মূল বাহিনী যখন সামনে থেকে আক্রমণ করে দূর্গ প্রতিরক্ষায় নিয়োজিতদের ব্যস্ত রাখবে তখন দেয়াল বেয়ে উঠে পেছন থেকে দূর্গে প্রবেশ করবো আমরা।

*

চাঁদের ধুসর আলোয়, আহমেদ খানকে পাশে নিয়ে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত গাছগুলোর ভিতর দিয়ে পাহাড়ের সেই ফাটলটার দিকে বেয়ে উঠতে থাকে হুমায়ুন। তাঁদের পায়ের নীচে মসৃণ আর আলগা নুড়ি পাথর নিশ্চিত করে যে এটা একটা শুকিয়ে যাওয়া জলস্রোত এবং বর্ষার সময় বাস্তবিকই উপর থেকে পতিত একটা জলপ্রপাত এখান দিয়ে প্রবাহিত হয়।

যুদ্ধের কেন্দ্রে অবস্থানের জন্য বরাবরের মতোই অসহিষ্ণু হুমায়ুন, বাবা ইয়াসভালের পরামর্শ, যে তার কেন্দ্রে অবস্থান করা উচিত আক্রমণ পরিচালনার স্বার্থে, এবং পাথরের গায়ে কীলক স্থাপনের অভিযানে আহমেদ খান আর তার দেহরক্ষীদের ভিতরে দশজন সেরা পর্বতারোহীদের সাথে থাকবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে জানে তাঁদের মতো সেও ক্ষিপ্র, চটপটে এবং প্রথম দলের সাথে গমন করলে সে তার পাঁচশ লোকের বাকিদের মনোবল বৃদ্ধি করতে পারবে। তাদের সম্রাট নিজেই ইতিমধ্যে দেয়াল বেয়ে উপরে উঠে গিয়েছেন এটা জানতে পারলে নিজেদের সম্মানের খাতিরে তারা অনুসরণ করতে ব্যর্থ হবে না।

সবকিছু এখন পর্যন্ত ভালোই চলছে। তাঁরা তাঁদের ঘোড়াগুলোকে বেশ খানিকটা দূরে বেঁধে রেখে এসেছে এবং কারো চোখে ধরা না পড়ে এই পর্যন্ত আসতে তাই চাঁদ প্রতিবার মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়তে এবং সেই সময়ে সামান্যতম আড়াল ব্যবহারের সুযোগ তাঁরা নিয়েছে। তাঁদের মাথার উপরে ঝুলে থাকা ডালপালার ভিতর দিয়ে, ঠিক সামনেই হুমায়ুন শুল্ক স্রোতস্বিনীর শুরুটা দেখতে পায়, ঠিক তার উপর থেকে পাহাড়ের কালো দেয়াল উঠে গিয়েছে। আহমেদ খান আর যে দশজন তার সাথে পাহাড় বেয়ে উপরে উঠবে তাঁদের তাঁর চারপাশে জড়ো হতে ইঙ্গিত করে সে।

আমার নিয়তি এবং সেই সাথে সাম্রাজ্য আর আমাদের সবার জীবন এই প্রয়াসের কারণে ঝুঁকির সম্মুখীন হবে। মারাত্মক বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে কিন্তু আমরা যদি সফল হই তাহলে পুরষ্কারের সম্ভাবনাও ব্যাপক, আল্লাহতালা আমাদের সহায় আছেন, আমরা সফল হবই। এখন, সবাই শেষবারের মতো দেখে নাও যে তোমাদের থলেতে তোমাদের উপকরণসমূহ নিরাপদে রয়েছে আর তোমাদের পছন্দসই যে কোনো অস্ত্র বহনের নিমিত্তে ভালোমতো গোঁজা রয়েছে। আমরা চাই না যে কিছু পড়ে গিয়ে আমাদের অবস্থান প্রকাশ হয়ে যায় বা পেছনে যারা অনুসরণ করছে তাদের কোনো ক্ষতি হোক।

হুমায়ুন তাঁর তরবারি আলমগীর জওহরের কাছে রেখে এসেছে, যে বাহিনীর বাকি সদস্য সাথে তাঁকে অনুসরণ করবে। সে তার বাকি লোকদের মতোই সাধারণ কালো কাপড় পরিধান করেছে কেবল তৈমূরের অঙ্গুরীয় একটা সরু চামড়ার ফালি দিয়ে তার গলায় বাঁধা রয়েছে। পাহাড়ের গা বেয়ে উঠতে শুরু করবার ঠিক আগে সেটা বের করে এবং তাতে চুমু খায় সে। তারপরে তাঁরা উঠতে আরম্ভ করে, আহমেদ খান সামনে আগের দিন হাত এবং পা রাখার জন্য যেসব স্থান ব্যবহার করেছিল তাদের খুঁজতে খুঁজতে এবং ইশারায় ঠিক তার পেছনেই অবস্থানরত হুমায়ুনকে অনুসরণ করতে বলে। কয়েকটা ছোট পাথর মাঝে মাঝে যদিও তাদের কারণে স্থানচ্যুত হয়ে, নীচে মাটির দিকে সেগুলো ঠোকর খেতে খেতে গড়িয়ে গেলে, হুমায়ুন আশা করে তাদের গড়িয়ে যাবার শব্দ বিস্ফোরণের ফলে চাপা পড়ে যাবে যা তাঁর সেনাছাউনির দিক থেকে ভেসে আসছে শত্রুদের মনোযোগ আকৃষ্ট করার জন্য তার কামানগুলো সম্মুখ আক্রমণের বারতা ঘোষণা করছে।

বিশ মিনিটের ভিতরে, শেষ ফাটলের পাদদেশে পৌঁছে যায় দুজনে। হুমায়ুন উপরের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে এই অংশটা বেয়ে উঠা কতটা কষ্টসাধ্য বলে প্রতিপন্ন হবে। জলপ্রপাতের প্রাথমিক তোড়ের কারণে এই অংশের পাথর একেবারে মসৃণ দেখায় এবং একপাশের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে আর অন্যপাশের দেয়ালে পা দিয়ে স্বচ্ছন্দে উপরে বেয়ে উঠে যাবার জন্য যথেষ্ট চওড়া ফাটলটা। আহমেদ খান যে কীলকগুলো- পাহাড়ের গা থেকে বের হয়ে থাকা দুফিট চওড়া একটা পার্শ্বদেশের উপরে অবস্থান করে তার দেহের সাথে আড়াআড়িভাবে ঝোলান একটা বগলি থেকে বের করে দরকার হবে বলে তার কোমরের চারপাশে জড়ান একটা কালো পরিকর গুঁজে রাখে। হুমায়ুনও তাঁর নিজের হাতুড়ি কোমর থেকে খুলে হাতে নেয়।

সুলতান, গতকাল প্রথম দশ ফিটই সবচেয়ে মসৃণ বলে মনে হয়েছিল। আমি নিজেকে ফাটলের ভিতরে আটকে রাখবো আর আপনি আমার দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলিকে সিঁড়ির মতো ব্যবহার করে প্রথম কীলকটা দেয়ালে স্থাপনের মতো স্থানে পৌঁছাবেন।

হুমায়ুন মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতে আহমেদ খান পাথুরে ফাটলের ভেতরে নিজেকে আটকে ফেলে। আহমেদ খানের টানটান হয়ে থাকা উরুতে হুমায়ুন তখন এক পা রাখে এবং নিজেকে ঠেলে উপরের দিকে তুলতে থাকে যতক্ষণ না সে আহমেদ খানের কাঁধে চড়ে বসে। মাথার উপরে হাত দিয়ে সে এবার পাথরের উপরিতলে অনুসন্ধান করতে থাকে যতক্ষণ না একটা ছোট্ট ফাটল খুঁজে পায় সে। হাতুড়ি বের করে এবং পরিকর থেকে একটা ফুটখানেক লম্বা কীলক বের করে, পাথরের ভিতরে কীলকটা ঢুকিয়ে দেয়, হাতুড়ির প্রতিটা ধাতব শব্দ উদ্বিগ্ন, ঘামতে থাকা হুমায়ুনের কাছে মনে হয় ফাটলের ভিতরে ভয়ঙ্কর প্রতিধ্বনির সৃষ্টি করছে। অবশ্য, উপর থেকে কোনো নড়াচড়া চোখে পড়ে না এবং শীঘই কীলকটা যথাস্থানে ঢুকে যায়। হুমায়ুন কীলকটা টেনে পরীক্ষা করে এবং সেটাকে দৃঢ়ভাবে প্রবিষ্ট দেখে সেটায় ভর দিয়ে পরবর্তী কীলক প্রবিষ্ট করাবার স্থান নির্বাচন করতে আহমেদ খানের কাঁধ থেকে আধাআধি উপরে উঠে।

এটাও দেয়ালের গায়ে ভালোমতোই প্রবিষ্ট হয় এবং কীলকের উপরেই নিজেকে মূলত স্থাপিত করে আর মাঝে মধ্যে পিঠের সাহায্যে পাথরের গায়ে নিজেকে ঠেসে ধরে, পা রাখবার আরেকটা জায়গার খোঁজে হুমায়ুন উপরে উঠতে থাকে। এবং এভাবেই পুরো বিষয়টা এগিয়ে চলে, ঘামতে ঘামতে এবং জোরে শ্বাস নিতে নিতে, দুজনে শীর্ষদেশের দশ ফিটের ভিতরে পৌঁছে যায় যেখানে একটা পাথুরে শিলাস্তর তাদের আতঙ্কের উদ্রেক করে পথ আটকে রয়েছে। অবশ্য আহমেদ খান, হুমায়ুনের আলখাল্লার প্রান্তদেশ ধরে আধো-অন্ধকারের ভিতরে দেয়ালের শীর্ষদেশ থেকে ঝুলে থাকা পাহাড়ী লতাগুল্মের একটা মোটা ঝাড়ের দিকে ইঙ্গিত করে, সেটা এমন এক দিকে যেদিকে স্বাভাবিক অবস্থায় সে লক্ষ্যই করতো না এবং সেটা তাদের ডানদিকে ছয়ফিট দূরে ঝুলছে।

সুলতান, আমার মনে হয় আমি ওটা ধরতে পারবো এবং শেষ দূরত্বটুকু ওটা ব্যবহার করে বেয়ে উঠে যাব আর ওঠার সময়ে আমি কীলক গাঁথতে গাঁথতে যাব, আর আপনার চেয়ে আমার ওজন কম বলে আমাকেই চেষ্টাটা করতে হবে, এবং আমাকে মার্জনা করবেন, সুলতান- সেটা করতে হলে আমার সিঁড়ি হিসাবে আপনাকে আমার সাহায্য করতে হবে।

হুমায়ুন মাথা নাড়ে এবং শেষ কীলকগুলো ধরে নিজের দেহকে ডানপাশে কাত করে। সে অচিরেই আহমেদ খানের পায়ের ওজন নিজের বাম কাঁধে অনুভব করে, তারপরে তার গলার পাশে সেটা যন্ত্রণাদায়ক ভঙ্গিতে একবার পিছলে যায় এবং হঠাৎ ভরটা গায়েব হয়ে যায়। আহমেদ খান লতাগুল্মের ঝাড় ধরে ঝুলতে ঝুলতে, পাথরের গায়ে সজোরে কীলক ঢুকিয়ে দিচ্ছে ঝুলে থাকা শিলাস্তর ঘুরে উপরে পৌঁছাবার একটা রাস্তা তৈরী করতে। তারপরে সে ফাটলের শীর্ষে পৌঁছে যায়, হুমায়ুনের দিকে হাত নেড়ে সে যেভাবে এসেছে সেটা অনুসরণ করতে বলে, সে ঝুলে থাকা বাধা ঘুরে এবং দড়াবাজের ভঙ্গিমায় উপরে ওঠার সময়ে বহু কষ্টে চোখ বন্ধ করে রাখার প্রবণতা দমন করে। তারপরে সে হঠাৎ নিজেকে উপরে আবিষ্কার করে। জোরে জোরে হাঁফাতে থাকার কারণে সে ঠিকমতো কথাই বলতে পারে না, হুমায়ুন কোনোমতে ফিসফিস করে বলে, আহমেদ খান, তোমাকে ধন্যবাদ। তোমার সাহসিকতা আমার মনে থাকবে।

পরবর্তী আধঘন্টার ভিতরে যথেষ্ট সংখ্যক লোক ফাটলের দেয়াল বেয়ে উপরে উঠে আসে, আসবার সময়ে তারা আরও বেশী সংখ্যক কীলক দেয়ালে প্রবিষ্ট করায় এবং দড়ির সাহায্যে চলনসই মই তৈরী করে, দূর্গ অভিমুখে অগ্রসর হবার জন্য অগ্রগামী দল গঠন করতে যারা পরবর্তীতে অনুসরণ করবে, তাদের জন্য উপরে ওঠাটা সহজ করতে। হুমায়ুন তাঁর পাশে সমবেত হওয়া প্রথম একশ জনের মতো লোকের উদ্দেশ্যে একটা ভাষণ দেয়। মনে রাখবে আমরা কোনো প্রকার শব্দ করবো না, এবং সেজন্য আমাদের পুরাতন নিরব আয়ুধের উপরে নির্ভর করবো তীর, ধনুক আর তরবারি- কোনো শত্রুকে খুঁজে পেলে খালি হাতে আমরা তাদের বধ করবো। একবার ভেতরে প্রবেশ করলে, তোমাদের ভিতরে যাঁরা তূর্য আর ঢাক বহন করছে, তাঁদের চারজনকে বাইরে থেকে আক্রমণরত আমাদের বাহিনীকে সতর্ক করতে পূর্বনির্ধারিত সংকেত ধ্বনি করতে আমি নির্দেশ দেব যার অর্থ আমরা ভেতরে প্রবেশ করেছি আর তাই এবার তারা তাদের আক্রমণ উদ্যোগ দ্বিগুন করতে পারে। আর এখন আমরা সবাই সামনে অগ্রসর হব।

ঝোপঝাড়ের আড়ালে অগ্রসর হয়ে, আঁধারের গা বেয়ে উঠে আসা লোকগুলো সন্তপনে আরও আধ মাইল এগিয়ে যাবার পরে ঝোপঝাড়ের আড়াল হাল্কা হয়ে আসে এবং সম্মুখে প্রায় এক হাজার গজ দূরত্বে দূর্গের পেছনের দেয়ালের দিকে তাদের অগ্রসর হতে আর কোনো বাধা থাকে না। সামনের আর পাশের দেয়ালের চেয়ে পেছনের দেয়ালটা অনেকটাই নীচু আর প্রহরীর কোনো চিহ্ন দৃশ্যমান হয় না। নীচু হয়ে বসে এবং অবশিষ্ট গুটিকয়েক ঝোপঝাড়ের আড়ালের সুযোগ নিয়ে আর চাঁদকে ঢেকে দিয়ে উড়ে যাওয়া মেঘের ফলে সৃষ্ট অন্ধকারে, আগন্তুক লোকগুলো মধ্যবর্তী খালি জমি দৌড়ে অতিক্রম করে নিজেদের দূর্গের দেয়ালের সাথে মিশিয়ে দেয়, তাঁদের নড়াচড়ার ফলে যদি কোনো শব্দ হয়েও থাকে তবে দূর্গের সামনের অংশ থেকে আগত যুদ্ধের হৈ-হট্টগোলে সেটা চাপা পড়ে যায়। আগন্তুক লোকগুলোর অনেকেই সাথে করে দড়ি নিয়ে এসেছে, এবং হুমায়ুনের একটা আদেশে, আহমেদ খান একটা দড়ির গোছা আকড়ে ধরে আর এক কোণে দেয়াল বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করে যেখানে ভূমির বাক বরাবর দেয়ালটা প্রায় সমকোণে বেঁকে গিয়েছে। কয়েক সেকেন্ডের ভিতরে, ফাটলের ভিতরে অনুসৃত কৌশল ব্যবহার করে সে দেয়ালের শীর্ষে পৌঁছে যায় এবং অন্যদের অনুসরণের জন্য নিজের হাতের দড়িটা নীচের দিকে ছুঁড়ে ফেলে। অচিরেই আরও কয়েকজন দড়ি নিয়ে উপরে উঠে আসে আর আরও বেশী সংখ্যক দড়ি ঝুলতে দেখা যায়।

হুমায়ুন নিজে দ্রুত সমতল দূর্গপ্রাকারে উঠে আসে এবং অন্যদের সাথে উঁকি দিয়ে দেখে পেছনে প্রহরীদের কোনো চৌকি আছে কিনা। হ্যাঁ, প্রহরীদের একটা চৌকি দেখা যায়- প্রায় একশ গজ দূরে অবস্থিত। সহসা সেটার দরজা খুলে যায় এবং মশাল হাতে সেখানে ছয়জন লোকের আবির্ভাব ঘটে- সম্ভবত ন্যূনতম সংখ্যক প্রহরী পেছনে রেখে বাকিরা সামনের দেয়ালে যোদ্ধার সংখ্যা বৃদ্ধি করতে ছুটে গিয়েছে। হৈচৈ আর উত্তেজনার শব্দ শুনে বলা যায় যে সেখানে পূর্ণোদমে আক্রমণ করা হয়েছে। প্রহরীর দল নীচের দিকে দেখার জন্য দেয়ালের দিকে এগিয়ে আসে এবং, তারা যখন এগিয়ে আসছে হুমায়ুন তখন তাঁর তীরন্দাজদের আদেশ দেয় প্রহরীরা কোনো ধরনের হুশিয়ারী উচ্চারণ করার পূর্বেই যত দ্রুত সম্ভব তীর ছুঁড়তে। ফলায় মৃত্যুর শীষ বাজিয়ে প্রায় সাথে সাথে তীরের ঝাক বাতাসে ভাসে এবং হতভাগ্য ছয় প্রহরীকে বিদ্ধ করে, যে দেয়ালের উপর দিয়ে তাঁরা তাকিয়েছিল দুজন সেখান থেকে মাথা নীচের দিকে দিয়ে শূন্যে ভাসে, প্রাকারবেষ্টিত দূর্গের সমতল পাথরের ছাদে আরেকজনের পা যন্ত্রণায় মৃত্যুর বোল তুলে আছড়াতে থাকে, বাকি তিনজন কিছু বুঝে উঠার আগেই নিথর হয়ে যায়।

প্রহরীচৌকির দিকে হুমায়ুন আক্রমণ পরিচালনা করে। সে যখন সেখানে পৌঁছে, ভিতরে লুকিয়ে থাকা আরেক গুজরাতি ছিটকে বের হয়ে এসে মাত্র দশ গজ দূরে ছাদ দেয়া একটা সিঁড়ির দিকে দৌড়ে যায় যেটা নীচের আঙ্গিনার দিকে নেমে গিয়েছে। সে সিঁড়িটার এতত নিকটে যে তীর নিক্ষেপের আগেই সে এর রক্ষাকারী ছাদের নীচের নির্ভরতায় পৌঁছে যাবে। হুমায়ুন তাঁর সর্বশক্তি দিয়ে লোকটার পিছু ধাওয়া করে, তার হাত পা দপদপ করতে থাকে, এবং প্রথম ধাপের কাছে পৌঁছে দেখে প্রহরীটা সিঁড়ির বিশটা বা কিছু কম বেশী হতে পারে- পাথুরে ধাপের বেশীরভাগই অতিক্রম করে নীচে নেমে গিয়েছে। চিন্তা করার জন্য সময় ক্ষেপন না করে, হুমায়ুন উপরের ধাপ থেকে প্রহরীকে লক্ষ্য করে লাফ দেয়, আর তাকে নীচের চাতালে আছড়ে ফেলে। পতনের কারণে দুজনেরই ফুসফুসের সব বাতাস বের হয়ে যায় কিন্তু প্রহরী লোকটাই প্রথমে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়ায় আর পালাবার পায়তারা করে। হুমায়ুন শোয়া অবস্থা থেকে হামাগুড়ি দিয়ে তাঁকে ধরতে যায় এবং পায়ের গোড়ালি ধরে তাকে আবারও মাটিতে পেড়ে ফেলে। কুস্তিগীর হিসাবে নিজের সমস্ত নৈপুণ্য প্রয়োগ করে সে পাগলের মতো হাত-পা ছুঁড়তে থাকা লোকটাকে নিজের নীচে এমন করে আটকায় যাতে বেচারা নড়তে না পারে, হুমায়ুন এবার লোকটার গলা আঙ্গুল দিয়ে আকড়ে ধরতে সমর্থ হয় এবং তার দেহ থেকে প্রাণবায়ু নিংড়ে বের করতে শুরু করে যতক্ষণ না সে লোকটার নিঃশ্বাস তার গলার কাছে এসে ঘড়ঘড় করতে না শোনে এবং তারপর অসাড় দেহটা একপাশে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। হুমায়ুনের লোকেরা পুনরায় তাকে ঘিরে অবস্থান গ্রহণ করে।

আমাদের সাথে এখন কম করে হলেও চারশ লোক রয়েছে, আহমেদ খান হাঁপাতে হাঁপাতে বলে। এখন কি করবো?

আমাদের কেউ দেখে ফেলার আগে আমরা চেষ্টা করবো যতটা সম্ভব দূর্গের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে।

লোকগুলো সামনে কামানের ঝলসানি দেখতে পায় এবং তাঁদের বুম শব্দ আর মাস্কেটের কড়াৎ আওয়াজের সাথে সাথে যুদ্ধের তীক্ষ্ণ আর্তনাদ আর চিৎকারও তাঁদের কানে আসে। আঙ্গিনাটার উপর দিয়ে ধোয়া ভেসে যায় বিশেষ করে বিপরীত দিকে দেয়ালে অবস্থিত একটা বিশাল তোরণদ্বার দিয়ে ধোয়া প্রবেশ করছে। হুমায়ুন ভাবে এর মানে এই যে এই তোরণটা দিয়ে সরাসরি দূর্গের মূল অংশে প্রবেশ করা সম্ভব যেখানে দূর্গের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত সৈন্যরা সমবেত হয়েছে। আমাদের লোকদের দুভাগে বিভক্ত হয়ে তোরণটার দুপাশে দাঁড়াতে বল এবং তারপরে শত্রুকে পেছন থেকে আক্রমণ করার পূর্বে আমরা তূর্যনিনাদ আর ঢাকের বোলে দূর্গের সামনের দেয়াল আক্রমণকারী আমাদের সাথী যোদ্ধাদের হুশিয়ার করে দেব, সে আদেশ দেয়। তার আদেশ দ্রুত ছড়িয়ে দেয়া হয় এবং হুমায়ুন সংকেত দিতে তার লোকেরা তোরণদ্বারের দিকে ধেয়ে যায়। তোরণের এক কোণ থেকে চারপাশে উঁকি দিয়ে, হুমায়ুন ধোয়ার কুণ্ডলীর ভিতরেও সামনের দেয়ালে অবস্থিত কামানের অবস্থান দেখতে পায় এবং প্রতিরোধকারীরা সেই সাথে গুলিবর্ষণ করছে এবং ফুটন্ত আলকাতরা এবং তেল নীচে আক্রমণরত তার লোকদের উপরে ঢালছে।

তূর্যবাদক আর ঢাকির দল, সংকেত দিতে শুরু কর এবং আমি আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত দিতে থাকো। তোমাদের ভেতর বাকীরা, আমাকে অনুসরণ কর! বাদ্যযন্ত্র থেকে সংকেত প্রদান শুরু হবার সাথে সাথে হুমায়ুন তোরণ অতিক্রম করে ভেতরের দিকে ধেয়ে যায়। ভেতরে প্রবেশের সাথে সাথে, তাঁর তীরন্দাজদের বর্ষিত প্রথম পশলা তীর বেশীরভাগ গুজরাতির পিঠে বিদ্ধ হয়, একটা কামানের সব গোলন্দাজ একসাথে ভূপাতিত হয়। বিস্ময় আর বিভ্রান্তি নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে কেউ কেউ প্রত্যাঘাতের চেষ্টা করে। অন্যদের দেখে মনে হয় তারা মনোবল হারিয়ে ফেলেছে এবং ছত্রভঙ্গ হয়ে আশ্রয়ের জন্য ভবনের উদ্দেশ্যে দৌড়াতে শুরু করে।

মূল তোরণদ্বারের দিকে এগিয়ে চল। প্রতিরোধকারীদের হত্যা করে সেটা আমাদের সৈন্যদের জন্য খুলে দাও।

হুমায়ুনের লোকেরা তাঁর আদেশ পালন করতে ধেয়ে যায়, তাদের সামনে থাকে তার এক তূর্যবাদক, তখনও সে তাঁর আদেশ বাজিয়ে চলেছে। অবশ্য নিজের মৃত সাথীদের লাশের স্তূপের আড়াল থেকে এক গুজরাতি তীর নিক্ষেপ করলে সেটা তূর্যবাদকের কণ্ঠনালীতে বিদ্ধ হয় এবং সে মাটিতে পড়ে গেলে তাঁর শেষ নিঃশ্বাসের সাথে রক্তের বুদ্বুদ মিশে গিয়ে তাঁর প্রিয় বাদ্যযন্ত্র থেকে এক বিকট আর্তনাদ বের হয়ে আসে। সে যাই হোক, হুমায়ুন সাথে আহমেদ খান এবং কমপক্ষে পঞ্চাশজন লোক নিয়ে তোরণদ্বারে হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠে বা এর প্রতিরোধকারীদের পলায়নপর মনোবৃত্তিকে চাঙ্গা করে তুলে। তারা শীঘ্রই কপিকলের সাহায্যে মূল তোরণ খুলে দেয়। তোরণ-দ্বারের সিকি অংশ খোলা হতেই স্রোতের মতো মোগল সেনারা ভিতরে প্রবেশ করতে শুরু করে। মোগলদের প্রবেশ করতে দেখে অবশিষ্ট প্রতিরোধকারীরা হাতের অস্ত্র ছুঁড়ে ফেলে পালাতে শুরু করে কিন্তু কয়েকজন দূর্গের অভ্যন্তরে আশ্রয় নিয়ে হুমায়ুনের লোকদের উপরে নিয়মিত বিরতিতে গুলিবর্ষণ করতে থাকে, তাঁদের অনেকেই মারাত্মকভাবে আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।

আমাদের লোকদের নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে এসো। আমাদের আর প্রাণহানির ঝুঁকি নেয়ার প্রয়োজন নেই। দূর্গ এখন আমাদের দখলে। আমাদের হাতে ধৃত সবচেয়ে বরিষ্ঠ গুজরাতিকে আমার সামনে এনে হাজির কর।

অচিরেই, দীর্ঘদেহী, বিরলকেশ এক আধিকারিককে, যার হাত এবং পা থেকে তরবারির আঘাতজনিত ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরছে, টানতে টানতে হুমায়ুনের সামনে হাজির করে জোর করে নতজানু করা হয়। আমি বর্বর নই, হুমায়ুন তাঁকে বলে। আমি অনর্থক রক্তপাত করবো না। দূর্গের ভিতরে যারা অবস্থান করছে আপনি তাঁদের কাছে গিয়ে বলবেন তাঁদের এই প্রতিরোধ মূল্যহীন। তারা যদি এই মুহূর্তে আত্মসমর্থন করে তবে আমি পবিত্র কোরআন শরীফের নামে শপথ করে বলছি তাঁদের আমি প্রাণ ভিক্ষা দেব। যদি তাঁরা বাঁধা দেয়, সবাই মারা পড়বে, সেই সাথে আমি ইতিমধ্যে যাদের বন্দি করেছি তারাও বেঘোরো প্রাণ হারাবে।

হুমায়ুন বৃদ্ধ লোকটার চোখে একসাথে ভয় আর আশঙ্কা খেলা করতে দেখে। সে তাঁর কথা বিশ্বাস করেছে এবং তার অনুসারীদের বোঝাতে চেষ্টা করবে।

আপনি এবার যেতে পারেন। আপনাকে দশ মিনিট সময় দিলাম এর ভিতরে আপনাকে একটা উত্তর আনতে হবে।

হুমায়ুন তার লোকদের গুলিবর্ষণ বন্ধ করতে বলে যখন বৃদ্ধ আধিকারিক খোঁড়াতে খোঁড়াতে প্রতিরোধকারীদের সুরক্ষিত অবস্থানের দিকে গমন করে। আধিকারিককে চিনতে পেরে, প্রতিরোধকারীরা ঘুন্টি শোভিত ওক কাঠের ভারী দরজাটা খুলে দেয় এবং সে ভিতরে হারিয়ে যায়। পাঁচ মিনিট পরে সে পুনরায় দরজার কাছে হাজির হয় এবং স্থান পরিবর্তন করে হুমায়ুনের অবস্থানের দিকে আসে। তারা আত্মসমর্পন করতে রাজি আছে যদি তাদের ব্যক্তিগত অস্ত্র সাথে রাখতে দেয়া হয়।

ঠিক আছে, হুমায়ুন বলে এবং সাথে সাথে স্বস্তির একটা জোয়ার তাঁকে আপুত করে ফেলে। সম্রাট হিসাবে সে তাঁর প্রথম অভিযানে বিজয়ী হয়েছে। আমরা একটা দারুণ বিজয় ছিনিয়ে এনেছি। আমাদের আহত যোদ্ধাদের যথাযথ শুশ্রূষার বন্দোবস্ত করা হোক। তারপরে রাজকোষের সিন্দুকগুলো খোঁজা শুরু কর।

*

সুলতান, রাজকোষের ভূগর্ভস্থ ভাণ্ডারের প্রবেশ পথ আমরা এখনও খুঁজে পাইনি, ছত্রিশ ঘন্টা পরে হুমায়ুনের এক আধিকারিক তাঁকে জানায়। আমরা কি যারা বাকি ছিল সেইসব বন্দি গুজরাতিদের কাউকে নির্যাতন করে দেখবো?

না, পবিত্র কোরআন শরীফের নামে আমি শপথ করেছি কোনো প্রকার ক্ষতির সম্মুখীন না হয়ে নিরাপদে তাঁরা প্রস্থান করতে পারবে। রাজকোষ নিরাপদ করা আমাদের দরকার। কিন্তু নির্যাতন ছাড়া মানুষের কাছ থেকে তথ্য আদায়ের আরও অনেক পথ আছে। বাবা ইয়াসভালোকে বল বন্দি বলিষ্ঠ গুজরাতি আধিকারিকদের জন্য একটা ভোজসভার আয়োজন করতে যার উদ্দেশ্য হবে তাদের সাহসিকতাকে সম্মান জানান। তারপরে যখন অসংখ্য শুভকামনায় পানপাত্র উজাড় হবে এবং সুরা তাঁদের জীহ্বার জড়তা আলগা করবে তখন আলোচনার বিষয়বস্তু ঘুরিয়ে রাজকোষে নিয়ে এসো আর তখন দেখো এভাবে তাঁদের কাছ থেকে তুমি কি জানতে পার।

সেদিনই মধ্যরাত্রি নাগাদ, হুমায়ুনের অস্থায়ী বাসস্থানের দরজায় টলতে টলতে বাবা ইয়াসভালো এসে উপস্থিত হয়। তাঁর হাঁটায় যদিও জড়তা রয়েছে এবং চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে, একটা চওড়া হাসি তার এক কান থেকে আরেক কান পর্যন্ত লেপ্টে রয়েছে। মহামান্য সুলতানের সাথে আমি কি কথা বলতে পারি?

কয়েক মুহূর্ত পরে তাঁকে হুমায়ুনের সামনে উপস্থিত করা হয়। সুলতান আমি নিশ্চিত আমি উত্তরটা জানি। আজ রাতের বেশীর ভাগ সময় আমি আঙ্গিনায় গুজরাতি আধিকারিকদের সাথে আহার আর সুরাপানে অতিবাহিত করেছি। তাঁদের একজন- আলুম খান তার নাম- গজনীর উত্তম লাল মদিরা আকণ্ঠ পান করতে তার দেহমন প্রশমিত হয় এবং সে আরও বেশী বাঁচাল হয়ে উঠে, গুজরাতি রাজপরিবার এবং তাঁর সাথী আধিকারিকদের সম্বন্ধে প্রচলিত রটন্তির রসালো অংশ বলতে শুরু করে। আমার যখন মনে হয় যে সময় হয়েছে তখন আমি রাজকোষ সম্পর্কে একটা প্রশ্ন আলতো করে উপস্থাপন করি। সে চমকে উঠে, রাজকোষের অবস্থান কথায় প্রকাশ করে সে বিশ্বাসভঙ্গের কাজ করেনি কিন্তু আমি লক্ষ্য করেছি তার চোখ এক মুহূর্তের জন্য মার্বেলের জলাধারের একটার দিকে স্থির তাকিয়ে ছিল এবং সে বিচলিত বোধ করতে থাকে।

সহজাত প্রবৃত্তির বশে আমি বুঝতে পারি যে জলাশয়ের রাজকোষের সাথে একটা সম্পর্ক না থেকেই যায় না তাই আমি তাকে এ বিষয়ে আরও প্রশ্ন করতে আরম্ভ করি। আপনি বুঝতেই পারছেন- জলাশয়টা কতদিনের পুরাতন, এর গভীরতা কত, এর নির্মাণশৈলী, কতদিন পর পর একে জলশূন্য করে পুনরায় জলপূর্ণ করা হয়। প্রতিটা প্রশ্নের সাথে সাথে সে উত্তরোত্তর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে থাকে সেই সাথে সে অপ্রত্যয়জনকভাবে তোতলাতে থাকে এবং পরস্পরবিরোধী উত্তর দেয়। আমি নিশ্চিত রাজকোষে প্রবেশের পথ জলাশয়ের নীচে লুকান রয়েছে। বাবা ইয়াসভালো কথা শেষ করে, তার ব্যাপক পানাহারের পরে এতো প্রাঞ্জলভাবে কথা বলতে নিজেকে বাধ্য করার প্রয়াস তাঁকে আপাতদৃষ্টিতে ক্লান্ত করে দিয়েছে।

আপনি আপনার যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। দিনের আলো ফোঁটার সাথে সাথে আমরা জলাশয়ের পানি নিষ্কাশন করে এর তলদেশ খনন করবো। এখন যান এবং পড়ে যাবার আগে একটু বিশ্রাম করে নিন।

পরের দিন খুব সকালে, দূর্গের চারপাশের জঙ্গল থেকে সবুজ তোতাপাখির পাখির কর্কশ ডাকের মাঝে, হুমায়ুন কিছুটা বিপর্যস্ত আর নোংরা বাবা ইয়াসভালোকে পাশে নিয়ে, তাকিয়ে দেখে কেবল সাদা নেংটি পরিহিত মজুরদের একটা দল তাদের চামড়ার থলে নিয়ে জলাশয় পানিশূন্য করতে একটা মানবশেকল তৈরী করেছে। তারপরে জলাশয় পানিশূন্য হতে তাঁরা হামাগুড়ি দিয়ে তলদেশে নেমে এর তলদেশের আস্তরণ গঠনকারী মার্বেলের টুকরো একটা একটা করে চাপ দিয়ে খুলতে শুরু করে। সেগুলো জলাশয়ের পাশেই স্তূপাকারে রাখতে থাকে যেখান থেকে অন্যেরা সেগুলো যত্নের সাথে আঙ্গিনায় নিয়ে গিয়ে সতর্কতার সাথে একটার উপরে একটা সাজিয়ে রাখে।

প্রথম পাথরের খণ্ডগুলো সরিয়ে নেয়ার পরে, বাবা ইয়াসভালো নিশ্চিতভাবেই বিমর্ষ হয়ে পড়ে, নীচে লালচে রঙের বেলেমাটি দেখে। তারপরে, হুমায়ুন যখন অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে জলাশয়ের পাশে পায়চারি করছে, বাবা ইয়াসভালো আচমকা চেঁচিয়ে উঠে, সুলতান, দেখেন! মাঝের ঐ চারটে খণ্ডে খাঁজ রয়েছে এবং তাঁদের চারপাশে পাথরের কুচি পড়ে রয়েছে। পাথরের টুকরোগুলো আগেও ওঠান হয়েছে।

আপনি ঠিক বলেছেন, হুমায়ুন জবাব দেয়। টুকরোগুলো সরাবার ব্যবস্থা করেন।

বাঁকা প্রান্তবিশিষ্ট লৌহদণ্ড পাথরের খণ্ডগুলোর নীচে প্রবিষ্ট করাবার সাথে সাথে সেগুলো দ্রুত উঠে আসে এবং দরদর করে ঘামতে থাকা মজুরদের দল সেগুলো তুলতে, হুমায়ুন কাঠের একজোড়া ঝুলন্ত দরজার একাংশ তাঁদের নীচ থেকে বের হতে দেখে।

পাওয়া গেছে! বাবা ইয়াসভালো আপনার সহজাত প্রবৃত্তি আপনার সাথে প্রতারণা করেনি, আমি নিশ্চিত। আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না আপনার এই মাথা ব্যাথার জন্য আমি আপনাকে কি পুরষ্কার দেব।

লাফিয়ে জলাশয়ের তলদেশে নেমে, হুমায়ুন নিজে ঝুলন্ত দরজা ধরে টানতে শুরু করে। দরজাটার পাল্লা সহজেই উঠে আসলে এর নীচে চেটালো সিঁড়ির বেশ কয়েকটা ধাপ দেখা যায় যা একটা নীচু, লোহার গজালশোভিত দরজার কাছে গিয়ে শেষ হয়েছে একটা বিশাল ধাতব তালা দিয়ে দরজাটা বন্ধ করা।

আমাকে একটা বাঁকান প্রান্তযুক্ত লৌহদণ্ড দিন, সে আদেশ করে। দণ্ডটা নিয়ে সে এর প্রান্তদেশ তালার ভিতরে প্রবেশ করিয়ে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে চাপ প্রয়োগ করে দ্বিখণ্ডিত করে। ধাক্কা দিয়ে দরজার পাল্লা খুলে সে মাথা নীচু করে ভিতরে প্রবেশ করে। আধো আলোতে সোনার জ্বলজ্বলে আভা তার চোখে ধরা দেয়। তার চোখ আলোতে সয়ে আসতে সে দেখে যে মেঝেতে পুরু সোনার পিণ্ড সাজিয়ে রাখা আছে এবং খোলা সিন্দুক দেখে মনে হয় রত্নপাথরে ভর্তি। প্রথম কক্ষের ন্যায় আলো বিকিরণকারী আরো কয়েকটা প্রকোষ্ঠ আছে বলে মনে হয়। হুমায়ুন চেঁচিয়ে মশাল নিয়ে আসতে বলে এবং ভৃত্যের দল মশাল আনতে সে দেখে যে সিন্দুকে আসলেই পান্না, রুবি, পোখরাজ আর অন্যান্য দীপ্তিময় পাথর রয়েছে এবং অন্য প্রকোষ্ঠগুলোতে আরও ধনসম্পদ রয়েছে যার ভিতরে আছে রূপার বাসনকোসন আর পানপাত্র এবং কারুকার্যখচিত অস্ত্রশস্ত্র আর বর্ম। তাঁর বিশ্বস্ত আর সাহসী যোদ্ধাদের পুরস্কৃত করার জন্য প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ সে এখানে পেয়েছে।

সব স্বর্ণপিণ্ড, রত্নপাথর আর অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্য সরিয়ে নাও। সেগুলো ভালো করে পাহারার ব্যবস্থা কর আর সবকিছু নথীভুক্ত কর। আজ রাতে আমরা উৎসব পালন করবো এবং লুটের মাল ভাগ করে নেব।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতে, পরিচারক আর সৈন্যরা একসাথে কঠোর পরিশ্রম করে। তাঁদের প্রথম কাজ দূর্গ প্রাঙ্গণের কেন্দ্রে একটা নীচু কাঠের পাটাতন নির্মাণ করা যেখান থেকে হুমায়ুন তার সৈন্যদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে পারবে এবং লুটের মালে তাঁদের প্রত্যেকের অংশ বিতরণ করবে যা পাটাতনের পেছনে প্রহরাধীন অবস্থায় স্তূপীকৃত করে রাখা হয়েছে। এরপরে দূর্গপ্রাঙ্গণে তারা যেখানে যে কাপড় খুঁজে পেয়েছে, হোক সেটা পশমের, সুতার বা কেবল পাটের তৈরী, হোক সেটা উজ্জ্বল লাল বা বেগুনী রঙের বা কেবল ধুসর পিঙ্গল এবং সবুজ বর্ণের, সুন্দর কারুকার্যখচিত কিংবা সাদামাটা, সব ব্যবহার করে অতিরিক্ত চাদোয়া লাগাতে ব্যস্ত হয়ে উঠে। চাঁদোয়ার নীচে তারা কোনোমতে নীচু কাঠের টেবিল পাতে এবং তার চারপাশে ভোজসভায় আগত অতিথিদের হেলান দেবার জন্য যেখানে যা গদি, তোষক বা তাকিয়া খুঁজে পায় সব এনে বিছিয়ে রাখে। মশালের জন্য তারা কোনমতে মশালদানি তৈরী করে এবং সেগুলো এমন জায়গায় স্থাপন করে যেসব জায়গায়, ভোজসভার আনন্দ আয়োজন বুনো উদ্দামতায় রূপান্তরিত হলে যা অভ্যাগতরা নিশ্চিতভাবেই পরিণত হবে, সুগুলোর উল্টে পরার সম্ভাবনা কম।

তারা যখন তাদের কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে, তখন কাছাকাছি মাঠে স্থাপিত রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা খাবারের গন্ধে তাঁদের রসনা তীব্র হয়ে উঠে। লম্বা সরু ধাতব শলাকায় বিধিয়ে আস্ত ভেড়া ঝলসানো হচ্ছে, ভোজসভা উপলক্ষ্যে রাধুনির দায়িত্বপ্রাপ্ত অনেকে বিশাল তামার পাত্রে ফুটন্ত সজির ভিতরে মশলা দিয়ে নাড়ছে, বেশী অভিজ্ঞ রাধুনির দল ছোট ছোট তামার পাত্রে মিষ্টি তৈরী করতে দই, চিনি, গোলাপজল আর নানা পদের মশলা মিশাচ্ছে। অনেক সৈনিকরা মনে, হুমায়ুন এবং তাঁর বেশীর ভাগ অমাত্যদের মতোই, ভালো মুসলমান কিন্তু সুরাপান একেবারে নিষিদ্ধ এই বিষয়টা পুরোপুরি মেনে নিতে অপারগ, দূর্গ থেকে প্রাপ্ত এবং হুমায়ুনের নিজস্ব ভাড়ার থেকে যোগান দেয়া সুরার- যার ভিতরে গজনীর লাল মদিরাও রয়েছে যা আলুম খানের বেঁফাস কথাবার্তার জন্য দায়ী ভাগ নিতে যেখানে যে পাত্র পেয়েছে সেটা নিয়ে সমবেত হয়েছে, সম্ভবত তাঁদের কাছে পানের মোহ বেশী গুরুত্বপূর্ণ।

সূর্যাস্তের একঘন্টা পরে, বাদুরের দল যখন উষ্ণ নিকষ অন্ধকারের মাঝে বিচরণ করতে আরম্ভ করেছে এবং ঝি ঝি পোকার ডাক সপ্তমে পৌঁছেছে, হুমায়ুনের দুই খাস তূর্যবাদক ছয়-ফুট-লম্বা পিতলের বাদ্যযন্ত্রে নিজেদের ঠোঁট স্থাপন করে। তাঁদের বাজনার প্রতিধ্বনি শুনে যখন সেনাপতি আর সাধারণ সৈনিকের গলার স্বর একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায় তখন সোনালী রঙের কাপড়ে তৈরী চোগা ও আচকান পরিহিত উপরে রাজকোষের গোপন ভাণ্ডারে প্রাপ্ত একটা সোনার শৃঙ্খলে নির্মিত বর্ম পরিধান করে হুমায়ুন দূর্গের মূল তোরণ-দ্বারে এসে দাঁড়ায়। সূর্যের অবিরাম আওয়াজ এবং উপরে দূর্গপ্রাকারে স্থাপিত যুদ্ধের দামামার গম্ভীর ধ্বনির মাঝে হুমায়ুন তাঁর সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সৈনিকদের ভিতর দিয়ে নীচু পাটাতনের দিকে এগিয়ে গিয়ে সেটায় আরোহন করে, তার সবচেয়ে বলিষ্ঠ আধিকারিকেরা তাকে অনুসরণ করে এবং স্তূপীকৃত ধনরাশির সামনে দাঁড়ায়। তূর্যবাদক আর ঢালিদের ইঙ্গিতে থামতে বলে সে তার লোকদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়।

 আজ রাতে আমরা গুজরাতে আমাদের অভিযানের সাফল্য উদযাপন করতে সমবেত হয়েছি। আমাদের শত্রুরা যেখানেই আমাদের মুখোমুখি হবার সাহস দেখিয়েছে সেখানেই আমরা তাদের পরাস্ত করেছি। সুলতান বাহাদুর শাহ এমনকি সে সাহসটুকুও না দেখিয়ে, ভীরু ইঁদুরেব মতো আদতেই তিনি যা তাঁর রাজ্যের দুর্গম প্রান্তে গিয়ে লুকিয়েছেন। আমরা তাঁর ভূখণ্ড দখল করেছি এবং আমার পেছনে তোমরা যে ধনরাশির স্তূপ দেখছো সেটা আমরা আমাদের করে নিয়েছি। আমাদের এই বিজয়ের জন্য এসে প্রথমে আমরা আল্লাহ্তালাকে কৃতজ্ঞতা জানাই।

আল্লাহু আকবর, আল্লাহ্ মহান, সমবেত কাতার থেকে সাথে সাথে প্রতিধ্বনি শোনা যায়।

ভোজসভা শুরু করার আগে এই সম্পদের কিছু অংশ আমি তোমাদের সাথে ভাগ করে নিতে চাই। আজকের এই সমাবেশে প্রত্যেক বরিষ্ঠ আধিকারিককে তাঁর ঢাল নিয়ে আসতে বলা হয়েছে। কেন সেটা তোমরা শীঘ্রই দেখতে পাবে। আকষ্মিক আক্রমণের ভয়ে সেটা বলা হয়নি। আমাদের শত্রুরা হতোদ্যম আর ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছে। বলা হয়েছে নিজের এবং তার লোকদের জন্য উপহার বহনের উদ্দেশ্যে। আধিকারিকেরা নিজ বর্ম নিয়ে সামনে এগিয়ে এসো। বাবা ইয়াসভালো, প্রথমে আপনি!

মুণ্ডিত-মস্তক বাবা ইয়াসভালো সামনে এগিয়ে যায় এবং হুমায়ুনের সামনে নতজানু হয়।

পিঠ থেকে আপনার বর্মটা নামিয়ে সেটা উল্টো করে মাটিতে রাখুন।

বাবা ইয়াসভালো আদেশ পালন করে।

পরিচারকের দল। সোনা আর রূপার পিণ্ড ঢালের উপরে স্তূপ করে সেটার উপরে মূল্যবান পাথর স্থাপন কর।

পরিচারকের দল মশালের আলোয় দীপ্তিময় আর ঝলমল করতে থাকা মূল্যবান ধাতবপিণ্ড আর রত্নপাথর নিয়ে এসে সেগুলো বর্মের উপরে স্তূপ করে রাখে। বাবা ইয়াসভালো আমার আন্তরিক শুভেচ্ছার সাথে এবার বর্মটা নিয়ে যান এবং গতরাতের সুরাপানের কারণে যদি আপনি এখনও দুর্বল বোধ করেন তাহলে আপনার লোকদের ডাকে সাহায্য করতে।

যুবক কিংবা বৃদ্ধ, খোয়ারি আক্রান্ত হোক বা না হোক, যেকোনো মানুষের বহনের পক্ষে বোঝাটা অনেক বেশী, এবং মুখে মৃদু হাসি নিয়ে বাবা ইয়াসভালো আবারও মাথা নত করে, একহাত মুষ্ঠিবদ্ধ অবস্থায় নিজের হৃৎপিণ্ডের উপরে স্থাপিত এবং নিজের লোকদের ইশারায় সাহায্য করতে বলে। তারা তাদের অর্জিত ধনরাশি একত্রে বয়ে নিয়ে যেতে, হুমায়ুন পরবর্তী আধিকারিক, দীর্ঘদেহী, ক্লান্ত এক আফগানিকে ইঙ্গিত করে পাটাতনে উঠতে এবং পুরো প্রক্রিয়াটা পুনরাবৃত্তি করে। পুরোটা সময় আমাদের সুলতান, আমাদের পাদিশাহ, হুমায়ুন মহান, এই রব শনৈ শনৈ বৃদ্ধি পেতে থাকে। দুহাত মাথার উপরে তুলে, হাসিমুখে তাঁদের এই ধ্বনিকে স্বাগত জানায় হুমায়ুন। সম্রাট হিসাবে নিজের প্রথম অভিযানে সফল হয়েছে সে। তার পূর্বে তার মরহুম আব্বাজানের মতো তাঁর নিজের এবং লোকদের জন্য গৌরব আর ধনরাশি অর্জন করেছে সে। জীবন বেশ মধুময়- সৌভাগ্যের এই ধারা দীর্ঘস্থায়ী হোক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *