১.১ ভ্রাতৃপ্রতিম প্রেম – প্রথম পর্ব

অ্যাম্পেয়ার অব দ্য মোগল – ব্রাদার্স অ্যাট ওয়ার
মূল : অ্যালেক্স রাদারফোর্ড
অনুবাদ
: সাদেকুল আহসান কল্লোল

‘ভ্রাতৃসম আবেগ বিসর্জন দাও,
যদি তুমি সম্রাট হিসাবে অভিষিক্ত হওয়ার আকাঙ্খা পোষণ কর…
কেউ কারো ভাই নয়!
 ওরা সবাই তোমার সাম্রাজ্যের শত্রু!’
—-হুমায়ুনের সৎ-বোন গুলবদন লিখিত হুমায়ুননামা থেকে সংকলিত

প্রধান চরিত্রসমূহ

হমায়ুনের পরিবারবর্গ :

বাবর, হুমায়ুনের আব্বাজান এবং প্রথম মোগল সম্রাট

মাহাম, হুমায়ুনের আম্মিজান এবং বাবরের প্রিয়তমা স্ত্রী

খানজাদা, হুমায়ুনের ফুপিজান এবং বাবরের ভগিনী

 বাইসানগার, হুমায়ুনের নানাজান

 কামরান, হুমায়ুনের সৎভাইদের ভিতরে বয়োজ্যেষ্ঠ

 আসকারি, হুমায়ুনের সৎ-ভাইদের ভিতরে মধ্যম এবং কামরানের আপন ভাই

হিন্দাল, হুমায়ুনের সৎ-ভাইদের ভিতরে কনিষ্ঠতম

গুলবদন, হুমায়ুনের সৎ-বোন এবং হিন্দালের আপন ভগিনী

আকবর, হুমায়ুনের প্রাণপ্রিয় পুত্র

হমায়ুনের বিশ্বস্ত পারিষদবর্গ :

কাশিম, হুমায়ুনের বিশ্বস্ত উজির

জওহর, হুমায়ুনের ব্যক্তিগত পরিচারক এবং পরবর্তীতে তার রাজপ্রাসাদের খরচের নিয়ন্ত্রক

বাবা ইয়াসভালো, হুমায়ুনের অশ্বশালার প্রধান

আহমেদ খান, হুমায়ুনের গুপ্তদূতদের প্রধান এবং পরবর্তীতে আগ্রার শাসনকর্তা

 শারাফ, হুমায়ুনের জ্যোতিষী

 জাহিদ বেগ, একজন বয়োজ্যেষ্ঠ সেনাপতি

সালিমা, হুমায়ুনের প্রিয়তম উপপত্নী

সুলেয়মান মির্জা, হুমায়ুনের আত্মীয় সম্পর্কিত ভাই এবং তাঁর অশ্বারোহী বাহিনীর সেনাপতি

মাহাম আগা, আকবরের দুধ-মা

আধম খান, আকবরের দুধ-ভাই

নাদিম খাজা, হুমায়ুনের অন্যতম সেনাপতি এবং মাহাম আগার স্বামী

অন্যান্য :

 গুলরুখ, বাবরের স্ত্রী এবং কামরান আর আসকারির আম্মিজান

দিলদার, বাবরের স্ত্রী এবং হিন্দাল এবং গুলবদনের আম্মিজান

 নিজাম, একজন ভিস্তিঅলা

জয়নব, হামিদার প্রধান পরিচারিকা

সুলতানা, রাজা মালদেবের মোগল উপপত্নী

 ওয়াজিম পাঠান, একজন অবসরপ্রাপ্ত সৈন্য সাহসিকতার জন্য হুমায়ুন যাকে পুরস্কৃত করেছিল

শেখ আলি আকবর, হিন্দালের উজির এবং হামিদার আব্বাজান

দারয়া, নাসিরের পুত্র, কাবুলে হুমায়ুনের সেনাছাউনির আধিকারিক

 মুস্তাফা আরগুন, তূর্কী অশ্বারোহী যোদ্ধা

হিন্দুস্তান :

সুলতান বাহাদুর শাহ, গুজরাতের শাসনকর্তা

 তার্তার খান, হুমায়ুনের আব্বাজান বাবরের কাছে পরাস্ত হওয়া পূর্ববর্তী শাসক বংশ, লোধিদের, একজন সদস্য এবং হিন্দুস্তানের তখতের একজন দাবীদার

শেরশাহ, ছোটজাতে জন্ম নেয়া বাংলার এক উচ্চাভিলাষী শাসক

ইসলাম খান, শেরশাহের পুত্র

 মির্জা হুসেন, সিন্ধের সুলতান

রাজা মালদেব, মারওয়ারের শাসক

 তারিক খান, ফিরোজপুরের শাসক এবং শেরশাহের অনুগত জায়গিরদার

আদিল শাহ, ইসলাম শাহের ভগ্নিপতি এবং হিন্দুস্তানের তখতের একজন দাবীদার সেকুন্দার শাহ, ইসলাম শাহের আত্মীয় সম্পর্কিত ভাই এবং হিন্দুস্তানের তখতের একজন দাবীদার

পারস্য :

শাহ তামান্স

 রুস্তম বেগ, বয়োজ্যেষ্ঠ সেনাপতি এবং শাহ তামাস্পের আত্মীয় সম্পর্কিত ভাই

 বৈরাম খান, অভিজাত ব্যক্তি, দক্ষ সেনাপতি এবং পরবর্তীতে হুমায়ুনের খান-ই-খানান, প্রধান সেনাপতি

হমায়ুনের পূর্ব-পুরুষ :

 চেঙ্গিস খান

 তৈমূর পশ্চিমে যাকে তৈমূর লঙ বলা হয়

 উলুঘ বেগ, তৈমূরের প্রপৌত্র এবং একজন খ্যাতনামা জ্যোতিষী

.

প্রথম পর্ব – ভ্রাতৃপ্রতিম প্রেম

০১. বাঘের পিঠে সওয়ারী

কয়েকদিন ধরেই বাতাসে প্রচণ্ড হিমের প্রকোপ। হুমায়ুন যদি চোখ বন্ধ করে তাহলে অনায়াসে আগ্রার এই দূর্গ প্রকারের পরিবর্তে নিজেকে শৈশবের সঙ্গী কাবুলের পাহাড় আর তৃণভূমির প্রেক্ষাপটে কল্পনা করতে পারে। কিন্তু সংক্ষিপ্ত শীতকাল শেষ হয়ে আসছে। আগামী কয়েক সপ্তাহের ভিতরেই হিন্দুস্তানের সমভূমি আবারও ধূলিকণা আর উষ্ণতায় দগ্ধ হবে।

পশমের পরত দেয়া লাল রঙের আলখাল্লাটায় নিজেকে ভালো করে মুড়ে নিয়ে, মন্থর পায়ে দেয়ালের উপরে পায়চারি করে হুমায়ুন। তার দেহরক্ষীদের আদেশ দিয়েছে তাঁকে একা থাকতে দিতে কারণ একাকী নিজের ভাবনায় বিভোর হয়ে থাকতে চায় সে। মাথা উঁচু করে, তারার ফুলঝুরি নিয়ে জ্বলজ্বল করতে থাকা পরিষ্কার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। তাদের তীব্র, রত্ন-তুল্য উজ্জ্বলতা সবসময়েই মোহিত করে তাকে। এটা প্রায়শই তার মনে হয় যে সেখানে সবকিছু লেখা রয়েছে, কেবল তোমাকে জানতে হবে সেটা কোথায় আর কিভাবেই বা সেই লিখনের পাঠোদ্ধার করতে…।

পেছনে কোথাও থেকে একটা লঘু, সাবলীল পায়ের শব্দ ভেসে এসে ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটায় তার। হুমায়ুন ক্রু কুচতে ঘুরে তাকায়, ভাবে কোনো অমাত্য বা প্রহরী এতটাই হঠকারী যে নির্জনতার জন্য সম্রাটের অভিপ্রায়ের প্রত্যক্ষ আদেশ অমান্য করার স্পর্ধা দেখাতে পারে। বেগুনী আলখাল্লায় মোড়া একটা লম্বা, ক্ষীণদর্শন অবয়বের উপরে ক্রুদ্ধ নজর আপতিত হয় তার, মুখের নিম্নাংশ একটা মিহি পর্দার অবগুণ্ঠনে ঢাকা, এর উপরে তাঁর ফুপু খানজাদার কিশমিশ রঙের চোখ জ্বলজ্বল করছে। হুমায়ুনের ক্রুদ্ধ অভিব্যক্তি নিমেষে মিলিয়ে গিয়ে সেখানে একটা হাসি ফুটে উঠে।

 ‘জেনানা মহলে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি আমরা। তুমি বলেছিলে আজ রাতের খাবারটা আমাদের সাথেই খাবে। তোমার মা অভিযোগ করছিল আজকাল বড্ড বেশী একাকী থাকছো তুমি, আমিও তার সাথে একমত।’

খানজাদা অবগুণ্ঠন সরিয়ে দেয়। দেয়ালে ঝোলান জ্বলন্ত মশাল থেকে তামাটে বর্ণের আলো এসে একটা কাটা কাটা মুখাবয়বের উপরে পড়ে যা এখন আর তার যৌবনকালের মতো তত সুন্দর নেই দেখতে কিন্তু এমন একটা মুখ যা হুমায়ুন তার তেইশ বছরের জীবনের পুরোটা সময় ভালোবেসেছে আর বিশ্বাস করেছে। খানজাদা আরেকটু কাছে এগিয়ে আসতে চন্দনকাঠের হালকা সৌরভ টের পায় সে যা জেনানা মহলে কারুকার্যখচিত সোনার তশতরিতে ক্রমাগত জ্বলছে।

‘আমাকে অনেক কিছু বিবেচনা করতে হচ্ছে। আমার এখনও পুরোপুরি মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে যে আমার বাবা ইন্তেকাল করেছেন।’

‘হুমায়ুন, সেটা আমি বুঝি। আমিও তাকে ভীষণ ভালোবাসতাম। বাবর তোমার বাবা ছিল বটে কিন্তু ভুলে যেও না আমার আদরের ছোট ভাইও ছিল সে। সে আর আমি একসাথে অনেক ঝড় ঝাপটা সহ্য করেছি, এবং কখনও চিন্তা করিনি এতো শীঘিই আমরা তাকে হারাব…কিন্তু সেটাই আল্লাহর ইচ্ছা।’

হুমায়ুন দৃষ্টি সরিয়ে নেয়, প্রথম মুঘল সম্রাট, তার বাবাকে সে আর কখনও দেখতে পাবে না এই ভাবনায় যে তার চোখের কোণে অশ্রুবিন্দু চিকচিক করছে সেটা সে এমনকি খানজাদাকেও দেখাতে অনিচ্ছুক। শক্তিশালী, পোড় খাওয়া এক যোদ্ধা, যে তার যাযাবর ঘোড়সওয়ার বাহিনীকে কাবুল থেকে পাহাড়ের গিরিপথের ভিতর দিয়ে নীচে নেমে এসে, একটা সাম্রাজ্যের খোঁজে সিন্ধু নদ অতিক্রম করেছিল, আজ মৃত, এই ভাবনাটাই কেমন অসম্ভব মনে হয়। এমনকি এই ভাবনাটা আরও বেশী অবাস্তব মনে হয় যে মাত্র তিনমাস আগে কোমরে ঈগলের মস্তক শোভিত হাতলযুক্ত তাঁর পিতার তরবারি আলমগীর আর আঙ্গুলে তাঁর পূর্ব পুরুষ তৈমুরের অঙ্গুরীয় ধারণ করে নিজেই নিজেকে মোগল সম্রাট বলে বিঘোষিত করেছে সে।

 ‘সবকিছু এতো বিচিত্র… অনেকটা একটা অলীক কল্পনার মতো যা থেকে প্রতিনিয়ত আশা করছি জেগে উঠব আমি।’

‘এটাই বাস্তব দুনিয়া আর তোমার উচিত একে মেনে নেয়া। বাবর যা চেয়েছিল, যার জন্য জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছিল সে, সবকিছুর কেবল একটাই উদ্দেশ্য ছিল- একটা সাম্রাজ্য হাসিল করা এবং রাজবংশের পরম্পরার পত্তন। আমি যেমন এটা জানি তুমিও জানো- মোগলদের জন্য হিন্দুস্তান হাসিল করতে পানিপথের যুদ্ধে যখন সুলতান ইব্রাহিম লোদিকে পরাস্থ করেছিল সে তুমি কি তোমার পিতার পাশে সেদিন লড়াই করনি?’

হুমায়ুন নিশ্চুপ থাকে। কোনো কথা না বলে আরেকবার আকাশের দিকে তাকায় সে। যখন সে আকাশের দিকে তাকায়, স্বর্গের বুক থেকে একটা উল্কা খসে পড়ে মিলিয়ে যেতে দেখে, এর জ্বলন্ত পুচ্ছের বিন্দুমাত্র চিহ্নও থাকে না। আড়চোখে খানজাদার দিকে তাকালে দেখে যে তিনিও উল্কাপাতটা লক্ষ্য করেছেন।

‘উল্কাপাত সম্ভবত কোনো একটা কিছুর পূর্বলক্ষণ। এটা সম্ভবত ইঙ্গিত করছে লজ্জাকরভাবে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাবে আমার রাজত্ব…আমার কথা কেউ মনে রাখবে না…’।

‘তোমার বাবা যদি এখন এখানে থাকতেন তাহলে নিজের প্রতি এই ধরনের সন্দেহ আর চলচিত্ততা তাকে কুদ্ধ করতো। তোমার নিয়তিকে তুমি বরণ করে নাও বরং এটাই চাইতেন তিনি। নিজের উত্তরাধিকারী হিসাবে তোমার বাকি তিন সৎ-ভাইদের ভিতর থেকে একজনকে পছন্দ করতে পারতেন তিনি কিন্তু তোমাকে মনোনীত করেছেন। তুমি সবার ভিতরে বড় এটাই কারণ না- আমাদের গোত্রের লোকেরা বিষয়টা কখনও এভাবে বিবেচনা করে না। তিনি তোমাকে সবচেয়ে যোগ্য আর গুণী ভেবেছিলেন সেজন্য। হিন্দুস্তানের উপরে আমাদের আধিপত্য এখনও অনিশ্চিত- মাত্র পাঁচ বছর আগে আমরা এদেশে এসেছি এবং চারপাশ থেকে বিপদের আশঙ্কা এখনও রয়ে গেছে। বাবর তোমাকে নির্বাচন করেছিলেন কারণ তিনি কেবল তোমার সাহসিকতায়, যা তুমি ইতিমধ্যে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রমাণ করেছে, আস্থাশীল ছিলেন না বরং সেইসাথে তোমার আত্মবিশ্বাস, আর তোমার আত্মার শক্তি, আমাদের পরিবারের শাসন করার অধিকার সম্বন্ধে তোমার বিবেচনা বোধ, যা এখানে এই নতুন ভূখণ্ডে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে আর সমৃদ্ধি লাভ করতে আমাদের রাজবংশে অবশ্যই থাকতে হবে।’ খানজাদা দম নেবার জন্য থামেন।

হুমায়ুন যখন কোনো উত্তর দেয় না, তিনি মশালের আলোয় নিজের মুখ তুলে ধরেন এবং তাঁর ডান ভ্র থেকে প্রায় চিবুক পর্যন্ত নেমে আসা একটা সরু সাদা ক্ষতচিহ্নে আলতো করে নিজের আঙ্গুল দিয়ে স্পর্শ করেন। আমি মুখে এটা কিভাবে এসেছে, আমি যখন তরুণী ছিলাম আর উজবেকদের হাতে তোমার বাবাকে সমরকন্দ তুলে দিতে হয়েছিল তখন কিভাবে তাদের গোত্রপতি সাইবানি খান আমাকে অপহরণ করেছিল আর তার ইচ্ছার কাছে আমাকে নতজানু হতে বাধ্য করেছিল। সে আমাদের মতো, যাদের ধমনীতে তৈমূরের রক্ত বইছে, তাদের সবাইকে ঘৃণা করতো। আমাদের বংশের কোনো যুবরাজকে অবমানিত আর তার মর্যাদাহানি তাঁকে পৈশাচিক আনন্দ দিত। আমি কৃতজ্ঞ যে তাঁর হারেমে বন্দিনী অবস্থায় পুরোটা সময় আমি কখনও হতাশ হইনি… কখনও ভুলে যাইনি আমি কে বা এটা আমার দায়িত্ব যে আমাকে বেঁচে থাকতে হবে। মনে রেখে যে আরেকটা মেয়ে যখন অতর্কিতে আক্রমণ করে আমার সৌন্দর্যের কিছুটা চুরি করেছিল, আমি এই ক্ষতচিহ্ন সম্মানের স্মারক হিসাবে ধারণ করেছিলাম- সবাইকে দেখাতে চেয়েছিলাম যে আমি এখনও বেঁচে আছি এবং নিশ্চয়ই একদিন আবারও মুক্ত হব। সেই দিনটা এসেছিল সুদীর্ঘ দশ বছর পরে। আমার ভাইয়ের সাথে আমি পুনরায়– মিলিত হই আর আমার প্রত্যাবর্তন উপলক্ষ্যে সাইবানি খানের করোটি দিয়ে নির্মিত একটা পানপাত্র থেকে তাঁকে পান করতে দেখে সেদিন আনন্দে উদ্বেলিত হয়েছিলাম আমি। হুমায়ুন আমার যেমন ছিল, তোমাকেও সেই একইরকম আত্মবিশ্বাসে আর চারিত্রিক দৃঢ়তায় বলীয়ান হতে হবে।

‘সাহসিকতায় আপনার সমকক্ষ হওয়া খুব কঠিন, কিন্তু কথা দিচ্ছি আমার বাবার ইচ্ছা বা আমাদের বংশের কোনো অমর্যাদা আমি হতে দেব না।’

‘তাহলে কি নিয়ে এতো চিন্তা করছো? তুমি বয়সে নবীন, উচ্চাকাঙ্খী… তোমার বাবা অসুস্থ হবার বহু পূর্বেই মসনদের প্রতি আগ্রহী ছিলে তুমি; সে আমার সাথে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করেছিল।’

‘তাঁর মৃত্যু যখন হয় তখন বিষয়টা খুবই আকষ্মিক ছিল। আমি অনেক কথাই তাকে বলতে পারিনি। সম্রাটের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য আমি এখনও নিজেকে প্রস্তুত বলে মনে করি না…নিদেন পক্ষে এত দ্রুত বা এভাবে নয়।’

হুমায়ুন তাঁর মাথা ঝুঁকে পড়তে দেয়। কথাটা সত্যি। তাঁর বাবার অন্তিম মুহূর্তগুলো তাঁকে এখনও তাড়িয়ে নিয়ে ফিরে। বাবর নিজের শেষবিন্দু শক্তি একত্রিত করে, তার ব্যক্তিগত পরিচারকদের আদেশ দিয়েছিলেন রাজকীয় আলখাল্লায় সজ্জিত করে তার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করতে তাঁকে এবং তাঁর অমাত্যদের তাঁর সামনে হাজির হতে। পরিপূর্ণ রাজদরবারের সামনে, দূর্বল কণ্ঠে কিন্তু নিজের সংকল্পে অবিচল, বাবর তার আঙ্গুল থেকে ক্রুদ্ধ গর্জনরত বাঘের মস্তক খোদিত তৈমূরের ভারী সোনার অঙ্গুরীয় খুলে নেয়ার জন্য হৃমায়ুনকে আদেশ দেন এবং বলেন, এটা গর্বের সাথে ধারণ করবে এবং এটা তোমার উপরে যে দায়িত্ব অর্পন করছে সেটা কখনও বিস্মৃত হবে না…’ কিন্তু বাবরের তখন মাত্র সাতচল্লিশ বছর বয়স, তখনও নিজের শ্রেষ্ঠ সময়ের তুঙ্গে এবং নিজের বিকাশমান সাম্রাজ্যের দায়িত্ব আরেকজনের হাতে তুলে দেয়ার জন্য বড্ড অল্প বয়স।

‘কোনো মানুষ, এমনকি একজন সম্রাটের পক্ষেও জানা সম্ভব না কখন আর কিভাবে তার কাছে বেহেশতের ডাক এসে পৌঁছাবে। আমাদের কারো পক্ষেই নিজেদের জীবনের গতিপথ পুরোপুরি অনুমান বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। নশ্বরতার চরম অনিশ্চয়তা আর সেই সাথে ভাগ্যের নানা উত্থানপতন মেনে নিয়ে বাঁচতে শেখাই প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে বেড়ে উঠার অংশ।’

‘মানছি। কিন্তু আমি প্রায়শই চিন্তা করি আমাদের জীবনের অন্তরালে মূলগত নকশা অনুধাবনে আমাদের অনেক কিছুই করণীয় রয়েছে। ঘটনা পরম্পরা যা আপাত দৃষ্টিতে এলোমেলো মনে হয় হয়ত তেমনটা নয়। খালাজান, আপনি এইমাত্র যেমন বললেন যে আমার আব্বাজানের মৃত্যু ছিল পরম করুণাময়ের কাম্য, কিন্তু আপনি ভুল করেছেন। সেটা ছিল আদতে আমার আব্বাজানেরই অভিপ্রায়। আমার জন্য তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন।’

খানজাদা চোখে জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকিয়ে থাকে। তুমি কি বলতে চাইছো?

 আমাকে বলা আব্বাজানের শেষ কথাগুলো কখনও কারো কাছে প্রকাশ করিনি আমি। তিনি মারা যাবার ঠিক পূর্বমুহূর্তে ফিসফিস করে বলেছিলেন যে কয়েক মাস পূর্বে আমি যখন কঠিন জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলাম, আমার জ্যোতিষী শারাফ তাঁকে বলেছিল সে গ্রহ নক্ষত্র বিবেচনা করে জেনেছে আব্বাজান যদি আমাকে জীবিত দেখতে চান তাহলে তাঁর কাছে যা সবচেয়ে মূল্যবান সেটা অবশ্যই উৎসর্গ করতে হবে তাকে। আর তাই সেজদায় নতজানু হয়ে আমার জন্য আল্লাহর কাছে নিজের জীবন অর্পণ করেছিলেন।

তাহলে এটা বাস্তবিকই আল্লাহর অভিপ্রায়-পরম করুণাময় তার ত্যাগস্বীকার গ্রহণ করেছেন।

না! শারাফ আমাকে বলেছে, সে আসলে বলতে চেয়েছিল যে আমার আব্বাজানের উচিত কোহ-ই-নূর হীরকখণ্ডটা নিবেদন করা তাঁর নিজের জীবন নয়। কিন্তু আমার আব্বাজান তার কথার ভুল ব্যাখ্যা করেছিল…এটা আপাতদৃষ্টিতে আপুতকর যে আমার আব্বাজান আমাকে এতো ভালোবাসতেন, আমাদের সাম্রাজ্যের ভবিষ্যতের জন্য আমাকে এতো গুরুত্বের চোখে দেখতেন যে তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। আমার প্রতি এতোটা বিশ্বাসের যোগ্য আমি কিভাবে হয়ে উঠব? আমার মনে হয় একদা যে মসনদের জন্য এত উদগ্রীব ছিলাম আমি বোধহয় তার উপযুক্ত নই। আমার ভয় হয় যে এভাবে সূচিত হওয়া রাজত্বকালের ললাটে কলঙ্কের তিলক জুটবে…

এসব ভাবনা অবান্তর। কার্য আর কারণের পেছনের ছক খুঁজতে তুমি বড্ড পরিশ্রম করছে। অনিশ্চয়তা আর ব্যর্থতার ভিতর দিয়ে অনেক রাজত্বেরই সূচনা হয়েছে। তোমার রাজত্বের সমাপ্তি সেরকম হবে না সেটা তোমার নিজের কর্মোদ্যোগের দ্বারা নিশ্চিত করার দায়িত্ব তোমার উপরেই বর্তায়। বাবর কোনো ত্যাগস্বীকার করে থাকলে তোমার জন্য তাঁর ভালোবাসা আর তোমার প্রতি তাঁর বিশ্বাস থেকেই সেটা করেছে। এটাও মনে রেখো সে কিন্তু সাথে সাথে মৃত্যুবরণ করেনি- তুমি সুস্থ হয়ে উঠার পরেও সে আরো আট মাস সময় জীবিত ছিল। সেই সময়ে তাঁর মৃত্যু হলে সেটা একটা নিছকই কাকতালীয় ব্যাপার হত। খানজাদা দম ফিরে পেতে কথার মাঝে একটু বিরতি দেয়। সে কি তার শেষ সময়ে তোমাকে অন্য আর কিছু বলেছিল?

তিনি আমাকে দুঃখ করতে নিষেধ করেছিলেন…চলে যেতে হচ্ছে বলে তাঁর মন মোটেই ভারাক্রান্ত ছিল না। তিনি অবশ্য আমার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছেন- আমার সৎ-ভাইদের বিরুদ্ধে কিছু না করতে, যতই সেটা তাদের প্রাপ্য হয়ে থাকুক।

খানজাদার মুখে বিদ্রূপ খেলা করে। হুমায়ুন এক মুহূর্তের জন্য ভাবে তাঁর ভাইদের বিরুদ্ধে সে বোধহয় কোনো মন্তব্য করবে, কিন্তু সেটা না করে, সে নিজের ছোট কিন্তু অভিজাত মাথাটা কেবল আন্দোলিত করে, আপাতদৃষ্টিতে সে কোনো মন্তব্য না করাই শ্রেয় মনে করেছে।

এবার চল। এসব চিন্তাভাবনা অনেক হয়েছে। হারেমে চাদর বিছানো হয়ে গিয়েছে। তোমার আম্মিজান আর অন্যান্য মহিলাদের তুমি নিশ্চয়ই অপেক্ষা করিয়ে রাখবে না। কিন্তু হুমায়ুন…একটা শেষ অভিপ্রায়। ভুলে যেও না যে তোমার নামের মানে ভাগ্যবান। সৌভাগ্য তোমার পায়ে এসে লুটিয়ে পড়বে যদি শারীরিক আর মানসিকভাবে তুমি শক্তিশালী হও আর সুযোগের সদ্ব্যবহার কর। নিজের প্রতি তোমার এসব অর্থহীন সন্দেহ পরিত্যাগ কর। অন্তবীক্ষণ একজন কবি বা সুফিসাধকের জীবনে হয়ত গুরুত্ব বহন করতে পারে কিন্তু একজন ম্রাটের জীবনে এর কোনো স্থান নেই। তোমার আব্বাজান- আর নিয়তি তোমাকে যা দান করেছে দুহাতে সেটা গ্রহণ কর।

শেষবারের মতো আকাশের দিকে তাকিয়ে সে দেখে চাঁদ মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে গেছে, হুমায়ুন ধীর পায়ে তার খালাজানকে অনুসরণ করে পাথরের সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায় যেটা জেনানা মহলের দিকে নেমে গিয়েছে।

*

কয়েক সপ্তাহ পরের কথা- সম্রাটের ব্যক্তিগত কামরায় হুমায়ুনের সামনে তাঁর অশ্বশালার নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত সচরাচর উফুল্ল, আর কিঞ্চিৎ স্কুলবুদ্ধির বাবা ইয়াসভালো নিজেকে ভূম্যবলুণ্ঠিত করে, কোনো বিচিত্র কারণে সে সন্ত্রস্ত। লোকটা আনত অবস্থা থেকে পুনরায় যখন উঠে দাঁড়ায় এবং মুখ তুলে তাঁর দিকে তাকায়, হুমায়ুন লক্ষ্য করে যে লোকটার চোখের নিম্নাংশের চওড়া হাড়ের উপরে তার ত্বক যেন অস্বাভাবিকভাবে টানটান হয়ে প্রসারিত হয়ে রয়েছে এবং তার কপালের পাশে একটা শিরা দপদপ করছে।

সুলতান, আমাকে একাকী যদি আপনার সাথে কথা বলার অনুমতি দিতেন? বাবা ইয়াসভালো রৌপ্য নির্মিত হুমায়ুনের নীচু বসবার আসনের দুপাশে দণ্ডায়মান প্রহরীদের দিকে চকিত দৃষ্টিতে তাকায়। একটা অস্বাভাবিক অনুরোধ। নিরাপত্তার খাতিরে সম্রাট কদাচিৎ একাকী অবস্থান করেন। এমনকি তিনি যখন হারেমে অবস্থান করেন তখনও ঘাতকের তরবারির আঘাত নাকচ করতে সতর্ক প্রহরীর দল সবসময়ে তার আশেপাশেই অবস্থান করে। কিন্তু বাবা ইয়াসভালো, যে হুমায়ুনের মৃত আব্বাজানের অধীনে বিশ্বস্ততার সাথে যুদ্ধ করেছে, তাকে বিশ্বাস করা যায়।

হুমায়ুন প্রহরীদের কামরা ত্যাগ করতে আদেশ দেয় আর ইঙ্গিতে বাবা ইয়াসভালোকে কাছে আসতে বলে। লোকটা সামনে এগিয়ে আসে বটে কিন্তু কথা বলতে ইতস্তত করে, সে তার মাথার খোঁচা খোঁচা চুল চুলকায়, যা তাঁকে তাঁর গোত্রের সনাতন পদ্ধতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, হিন্দুস্তানে আসবার পরে সে মাথা কামান শুরু করলেও, ধুসর রুক্ষ চুলের একটা গোছা সে রেখে দিয়েছে যা একটা টাসেলের মতো দোল খায়।

বাবা ইয়াসভালো, বলল। তুমি আমাকে কি বলতে চাও?

খারাপ খবর…সুলতান, ভয়াবহ খবর… বাবা ইয়াসভালের মুখ দিয়ে প্রায় আর্তনাদের মতো একটা দীর্ঘশ্বাস নির্গত হয়। আপনার বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্র দানা বেধেছে।

ষড়যন্ত্র? সহজাত প্রবৃত্তির বশে হুমায়ুনের হাত তার হলুদ পরিকরের ভাঁজে গোঁজা রত্নখচিত দুধারি খঞ্জর স্পর্শ করে এবং কিছু বুঝে উঠার আগেই সে দাঁড়িয়ে পড়ে। কার এতো বড় দুঃসাহস…?

বাবা ইয়াসভালো নিজের মাথা নত করে। সুলতান, আপনার সৎ-ভাইয়েরা।

আমার ভাইয়েরা…? মাত্র দুমাস আগে সে আর তার ভাইয়েরা আগ্রা দূর্গের প্রাঙ্গণে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল যখন বারোটা কালো ষাড় জোতা গিল্টি করা গাড়িটা তাঁদের মরহুম আব্বাজানের রূপার শবাধার নিয়ে কাবুলের পথে দীর্ঘ যাত্রায় রওয়ানা হয়, বাবর সেখানেই তাকে সমাধিস্থ করার অনুরোধ করেছিলেন। তার নিজের মতো তার সৎ-ভাইদের চোখে মুখেও শোকের একটা স্পষ্ট ছাপ ফুটেছিল এবং সেই শোকাবহ মুহূর্তগুলোতে তাঁদের প্রতি স্নেহ আর মমত্ববোধের একটা আকষ্মিক বেগ তাঁকে আপুত করে তুলে এবং আস্থার জন্ম দেয় যে তাঁদের মরহুম আব্বাজানের অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করতে তাঁরা তাঁকে সাহায্য করবে: হিন্দুস্তানে মোগলদের আধিপত্যকে অনাক্রম্য করতে।

বাবা ইয়াসভালো হুমায়ুনের চোখে মুখে অবিশ্বাস আর সংক্ষোভ ঠিকই পড়তে পারে। সুলতান, আমি সত্যি কথাই বলছি, যদিও আমাদের সবার স্বার্থে আমাকে এটা বলতে না হলেই আমি খুশী হতাম… বাবা ইয়াসভালো এখন যখন বলতে শুরু করেছে, সে সাহস সঞ্চয় করছে বলে মনে হয়, পুনরায় পানিপথে মোগলদের হয়ে লড়াই করা সেই পোড় খাওয়া যোদ্ধার সত্তা তার ভিতরে ফিরে আসতে থাকে। তার মাথা এখন আর নত না এবং সে হুমায়ুনের চোখের দিকে নিঃশঙ্কভাবে তাকিয়ে রয়। আপনি আমাকে সন্দেহ করবেন না যখন আমি আপনাকে বলবো যে আমি এই তথ্য আমার ছোট ছেলের কাছ থেকে জানতে পেরেছি…সে ষড়যন্ত্রকারীদেরই একজন। সে মাত্র ঘন্টাখানেক আগে আমার কাছে এসে সবকিছু স্বীকার করেছে।

সে এটা কেন করেছে? হুমায়ুনের চোখ সরু হয়ে আসে।

কারণ নিজের জীবনের জন্য সে ভীত…কারণ সে বুঝতে পেরেছে সে চরম নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছে…কারণ সে জানে তার কর্মকাণ্ড আমাদের গোত্রের জন্য কেবল অসম্মান আর ধ্বংসই ডেকে আনবে। এই শেষের শব্দগুলো যখন সে বলছে, বাবা ইয়াসভালোকে নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে বেশ পরিশ্রম করতে হয় বলে তাঁর চোখমুখ কুচকে যায়।

আমার কাছে এসে সবকিছু খুলে বলে তুমি ভালোই করেছে। আমাকে সবকিছু বলো।

মহামান্য সুলতান, আপনার মরহুম আব্বাজানের শবাধার কাবুলের পথে রওয়ানা হওয়ার বড়জোর এক পক্ষকাল পরেই, যুবরাজ কামরান, আসকারি আর হিন্দাল এখান থেকে ঘোড়ায় চড়ে যেতে দুদিন লাগে এমন দূরত্বে অবস্থিত একটা দূর্গে মিলিত হয়। আপনি হয়ত অবগত আছেন যে আমার ছেলে কামরানের অনুগত, সে ষড়যন্ত্রে অংশ নেয়ার জন্য তাঁকে প্রচুর পারিতোষিকের লোভ দেখায়। মাথা-গরম অল্পবয়সী নির্বোধ যা সে আসলেও, সে তাদের সাথে যোগ দিতে সম্মত হয়, আর তাই সবকিছু দেখে আর শোনে।

আমার ভাইয়েরা কি পরিকল্পনা করছে?

আপনাকে বন্দি করবে আর তারপরে আপনাকে বাধ্য করবে সাম্রাজ্য ভাগ করতে আর তাঁদের কাছে আপনার কিছু এলাকা সমর্পন করতে। সুলতান তারা সনাতন প্রথায় ফিরে যেতে চায়, যখন প্রত্যেক সন্তানই তাদের বাবার ভূখণ্ডের একটা অংশের অধিকার লাভ করতো।

একটা নিষ্প্রাণ হাসি হুমায়ুনের চেহারায় ভেসে উঠে। আর তারপরে কি হবে? তারা কি এতেই সন্তুষ্ট থাকবে? অবশ্যই না। তারা অচিরেই একে অপরের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবে আর সেই সুযোগে শত্রুরা আমাদের চারপাশ থেকে ঘিরে ধরবে।

সুলতান, আপনি ঠিকই বলেছেন। তারা এমনকি এখনই নিজেদের ভিতরে একমত হতে পারছে না। কামরান হল আসল উস্কানিদাতা। পুরো ষড়যন্ত্রটাই তার মস্তিষ্কপ্রসুত আর তার সাথে যোগ দিতে সেই সবাইকে প্ররোচিত করেছে, কিন্তু তারপরেই আসকারি আর তার ভিতরে রীতিমতো হাতাহাতি শুরু হয়েছে সমৃদ্ধ প্রদেশগুলো তাদের ভিতরে কে নেবে সেটা নিয়ে। তাদের অনুগত লোকেরা কোনোমতে তাঁদের হাতাহাতি থেকে বিরত করেছে।

হুমায়ুন কোনো কথা না বলে পুনরায় বসে পড়ে। বাবা ইয়াসভালের কথা তার কাছে সত্যিই মনে হয়। তার চেয়ে কেবল পাঁচ মাসের ছোট, তার সৎ-ভাই কামরানকে যখন কাবুল শাসনের জন্য সেখানের রাজপ্রতিভূ হিসাবে রেখে আসা হয় তখন সে নিজের অসন্তোষ গোপনের কোনো চেষ্টাই করেনি। হিন্দুস্তানের অভিযানে হুমায়ুন তাদের আব্বাজানের সঙ্গী হয়। কামরানের আপন ভাই, পনের বছরের আসকারিকে, তাঁদের সাথে যোগ দেবার জন্য খুব বেশী একটা কষ্ট করতে হয়নি। কামরান যেখানে যেত সেখানেই একনিষ্ঠ ভক্তের মতো সে সবসময়ে তাঁকে অনুসরণ করতে যদিও কামরান তাকে কখনও দূর্বল পেয়ে নিপীড়ন করতো আবার কখনওবা তাঁকে প্রশ্রয় দিত। কিন্তু বাবা ইয়াসভালের বক্তব্য যদি সঠিক হয়, এখন তাহলে আসকারি প্রায় প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ হয়ে উঠেছে বড় ভাইকে দ্বৈরথে আহ্বান জানাতে সে মোটেই ভীত নয়। সম্ভবত তাঁদের দুজনকেই তাদের কঠোর মনোভাবসম্পন্ন মা গুলরুখ উসকে দিয়েছে।

কিন্তু তাঁর সৎ-ভাইদের ভিতরে কনিষ্ঠতমের এসবের সাথে কি সম্পর্ক? হিন্দাল কেন এসবের ভিতরে নিজেকে জড়াতে গেল? তার এখন মাত্র বার বছর বয়স আর হুমায়ুনের আপন মা, মাহামের স্নেহ ছায়ায় সে বড় হয়েছে। বহু বছর আগে হুমায়ুনের পরে আর কোনো সন্তানের জন্ম দিতে ব্যর্থ হয়ে নিজের অপারগতায় বিপর্যস্ত মাহাম বাবরের কাছে মিনতি করে তার অন্য স্ত্রী, দিলদারের সন্তানকে চেয়ে নেয়। হিন্দাল যদিও তখনও মাতৃগর্ভে, বাবর- তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রীর অনুরোধ ফেলতে পারে না- সদ্যোজাত সন্তান তাঁকে উপহার দিবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু হিন্দালের এই প্রতারণায় সে অবশ্য খুব একটা অবাক হয় না। বাবরের নিজের যখন মাত্র বার বছর বয়স তখন প্রথম তিনি রাজা হন। উচ্চাকাঙ্খার আগুন এমনকি কনিষ্ঠতম যুবরাজের ভিতরেও জ্বলে উঠতে পারে।

সুলতান, বাবা ইয়াসভালের ব্যগ্র, আন্তরিক কণ্ঠস্বর হুমায়ুনকে বর্তমানে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। আমার ছেলের বিশ্বাস যুবরাজরা নিজেদের ভিতরে একমত হতে পারেনি বলেই ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা বাতিল হয়েছে। কিন্তু গতরাতে এখানে এই আগ্রা দূর্গে, তারা পুনরায় মিলিত হয়। আপনাকে তাদের কজায় না আনা পর্যন্ত তারা নিজেদের ভিতরের মতপার্থক্য ভুলে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা তাদের ভাষায় আপনার নির্জনতার জন্য সম্রাটের পক্ষে বেমানান আকাঙ্খার সুযোগ নেবে বলে ফন্দি এঁটেছে এবং পরেরবার আপনি যখন ঘোড়া নিয়ে একাকী বের হবেন তখনই তারা আপনাকে আক্রমণ করবে। কামরান আপনাকে এমনকি হত্যা করার কথাও বলেছে এবং পুরো ব্যাপারটাই যেন একটা দূর্ঘটনার মতো দেখায়। আমার ছেলের তখন বোধোদয় ঘটে। মহামান্য সুলতান আপনার আসন্ন বিপদের কথা অনুধাবন করতে পেরে, সে আমাকে সবকিছু খুলে বলে যা কয়েক সপ্তাহ আগেই তার কবুল করা উচিত ছিল।

বাবা ইয়াসভালো, এভাবে সরাসরি আমার কাছে আসার কারণে, আপনার সাহসিকতা আর আনুগত্যের জন্য আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। আপনি ঠিকই বলেছেন। পুরো ব্যাপারটার ব্যাপ্তি ভয়ঙ্কর বিশেষ করে যখন আমার সৎ-ভাইয়েরা আমারই বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, আর তারচেয়েও বড় কথা আমাদের আব্বাজানের ইন্তেকালের পরে এতো শীঘই। আপনি কি এ বিষয়ে আর কারো সাথে আলোচনা করেছেন?

না, সুলতান।

ভালো করেছেন। বিষয়টা নিয়ে আর কারো সাথে আলোচনা করা থেকে আপনি আপাতত বিরত থাকবেন। আমাকে এখন একটু একা থাকতে দেন। কর্তব্য করণীয় নিয়ে আমি একটু ভাবতে চাই।

বাবা ইয়াসভালো একটু ইতস্তত করে, তারপরে কক্ষ ত্যাগ না করে সে সরাসরি হুমায়ুনের পায়ের কাছে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সে মেঝে থেকে অশ্রুসিক্ত চোখে মুখ তুলে তাঁর দিকে তাকায়। সুলতান, আমার ছেলে, আমার আহাম্মক ছেলেটা…তাকে এবারের মতো মার্জনা করুন…সে সত্যিই নিজের ভুলের জন্য অনুতপ্ত। সে ভালো করেই জানে এবং আমিও জানি আপনার ক্রোধ স্বাভাবিক আর মৃত্যুদণ্ডই তার প্রাপ্য, কিন্তু আমি আপনার কাছে তাঁর প্রাণ ভিক্ষা চাইছি, তার প্রতি একটু করুণা প্রদর্শন দেখান…

বাবা ইয়াসভালো। এই ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র সম্বন্ধে আমাকে অবহিত করার জন্যই শুধু আপনার অতীত আনুগত্যের কথা স্মরণে রেখে আমার কৃতজ্ঞতার নিদর্শন স্বরূপ আমি আপনার ছেলেকে কোনো শাস্তি দেব না। তার কর্মকাণ্ডকে অল্প বয়সের অবৈচক্ষণ্য হিসাবে আমি এবারের মতো বিবেচনা করবো। কিন্তু এই ঝামেলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত আশা করবো আপনি তাকে নিরাপদ কোনো স্থানে আটকে রাখবেন।

বাবা ইয়াসভালের দেহের ভিতর দিয়ে যেন একটা কম্পনের রেশ বয়ে যায় এবং এক মুহূর্তের জন্য লোকটা কৃতজ্ঞতায় চোখ বন্ধ করে। তারপরে সে উঠে দাঁড়ায় এবং মুণ্ডিত মস্তক নুইয়ে, ধীরে ধীরে পিছনের দিকে সরে যায়।

হুমায়ুন, নিঃসঙ্গ হওয়া মাত্র, দ্রুত নিজের পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায় এবং কারুকার্যখচিত একটা পানপাত্র আকড়ে ধরে রাজকীয় কক্ষের ভিতর দিয়ে দৌড়ে যায়। নির্বোধের দল! যত্তসব আহাম্মক! তার ভাইয়েরা যদি নিজেদের পথ নিজেরাই বেছে নিতে শুরু করে তাহলে অচিরেই মোগলরা মামুলি গোত্রগত যুদ্ধেরত যাযাবর জীবনে ফিরে যাবে এবং তাদের এতো কষ্টের বিনিময়ে অর্জিত সাম্রাজ্য হাতছাড়া হবে। তাদের আব্বাজানের কাছে তাঁরা যে ঋণী সেই বোধটা তাঁদের কোথায় গেল, কোথায় গেল নিয়তি সম্পর্কে তাদের চেতনা?

মাত্র পাঁচ বছর আগের কথা হুমায়ুন বাবরের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে খাইবার গিরিপথ দিয়ে নীচের সমভূমির দিকে ধেয়ে এসেছিল গৌরবের বিজয়তিলক ছিনিয়ে নিতে। যুদ্ধের সেই রক্ত আর গর্জন, তার ঘোড়ার ঘামের তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধে নাসারন্ধ্র ভরে যাওয়া, সুলতান ইব্রাহিম লোদীর রণহস্তীর বৃংহন, মোগল কামানের হুঙ্কার আর তাদের মাস্কেটের গর্জন যখন এইসব নতুন অস্ত্র কাতারের পর কাতার শত্রু সেনার প্রতিরোধ গুঁড়িয়ে দিয়েছিল সেইসব স্মৃতির কথা মনে পড়তে আজও তাঁর নাড়ীর বেগ দ্রুততর হয়ে উঠে। বিজয়ের মাহেন্দ্রক্ষণ সে আজও স্পষ্ট স্মরণ করতে পারে যখন- রক্তরঞ্জিত তরবারি হাতে- পানিপথের ধূলোয় ধুসরিত সমভূমি জরিপ করে সে উপলব্ধি করেছিল হিন্দুস্তান মোগলদের করায়ত্ত হয়েছে। আজ তাঁদের সব অর্জন হুমকির মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।

মধ্য এশিয়ায় আমাদের লোকেরা যখন শাসন করতো তখন তারা যেমন বলতো তখত বা তক্তা সিংহাসন বা শবাধার- আমার এসবের কোনো প্রয়োজন নেই। হুমায়ুন ভাবে, আমরা একটা নতুন দেশে এসেছি এবং অবশ্যই নতুন রীতি গ্রহণ করতে হবে নতুবা আমরা সবকিছু হারাব। সে তার গলায় একটা সুক্ষ সোনার হারের সাথে ঝোলান চাবির খোঁজে তাঁর পরিধানের আলখাল্লার ভিতরে হাত ঢুকিয়ে, উঠে দাঁড়ায় এবং কক্ষের একপ্রান্তে অবস্থিত গম্বুজাকৃতি বাক্সটার দিকে এগিয়ে যায়। সে বাক্সটার তালা খুলে, ঢাকনিটা পেছনের দিকে সরিয়ে দেয় এবং সে যা খুঁজছিলো সেটা দ্রুত খুঁজে বের করে ফুলের নক্সার একটা রেশমের থলে যেটার মুখ সোনার সুতো দিয়ে ভালো করে পেঁচিয়ে বাঁধা। সে খুব ধীরে, প্রায় শ্রদ্ধার সাথে থলের মুখটা খোলে, এবং ভেতরে রক্ষিত সামগ্রী বের করে আনে একটা অতিকায় হীরকখণ্ড যতবারই সে এটা দেখে এর আলোকপ্রবাহী তীব্র ঔজ্জ্বল্যে তার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে। আমার কোহ-ই-নূর, আমার আলোর পর্বত পাথরটার দীপ্তিময় উপরিতলে আলতো করে নিজের আঙ্গুল বুলাতে বুলাতে সে ফিসফিস করে বলে। পানিপথের যুদ্ধের পরে এক ভারতীয় রাজকুমারী যার পরিবারকে সেই বিশৃঙ্খলার মাঝে রক্ষা করেছিল তাঁকে এটা উপহার হিসাবে দিয়েছিল সে, পাথরটার এমন একটা নিখুঁত সৌন্দর্য আছে যা দেখে তাঁর সবসময়েই মনে হয় ভারতবর্ষে মোগলরা যা খুঁজতে এসেছে- গৌরব আর জাঁকজমকপূর্ণ সমৃদ্ধি যাঁর পাশে পারস্যের শাহকেও ম্লান মনে হবে-তার সবকিছুই এর মাঝে প্রতিভাত হয়ে আছে।

পাথরটা হাতে ধরা অবস্থাতেই, হুমায়ুন চিন্তিত ভঙ্গিতে তাঁর চেয়ারের কাছে ফিরে আসে। সে একাকী আর বিষণ্ণ ভঙ্গিতে সেখানেই বসে থাকে যতক্ষণ না। নিচের প্রাঙ্গনে দরবারের সময়রক্ষক ঘড়িয়ালী নিজের প্রহরের তার প্রহরার সমাপ্তি ঘোষণা করতে তাঁর পিতলের চাকতিতে আঘাতের শব্দ ভেসে আসে- তাঁকে মনে করিয়ে দেয় যে রাত শেষ হয়ে এল।

সে অনুধাবন করে যে এটা তাঁর প্রথম গুরুতর পরীক্ষা আর সে নিজের সামর্থ্য প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর। তাঁর ব্যক্তিগত অনুভূতি যাই হোক- এই মুহূর্তে তার ইচ্ছে করছে সবগুলো সৎ ভাইয়ের গলা পর্যায়ক্রমে টিপে সব কটার ভবলীলা সাঙ্গ করে দেয়- সে অবশ্যই হঠকারী কোনো পদক্ষেপ নেবে না, সর্বোপরি এমন কিছু করবে না যার ফলে বোঝা যায় যে ষড়যন্ত্রের কথা ফাঁস হয়ে গিয়েছে। নিভৃতে দেখা করার জন্য বাবা ইয়াসভালের অনুরোধ কেউ হয়তো খেয়াল করে থাকবে। তার দাদাজান বাইসানগার, বা তার উজির করিম, যে তার মরহুম আব্বাজানের সবচেয়ে বিশ্বস্ত পরামর্শদাতাদের অন্যতম, যদি এখন কেবল এখানে উপস্থিত থাকতো। কিন্তু দুই বয়োজ্যেষ্ঠ লোকই বাবরের শবাধার বহনকারী কাফেলার সাথে কাবুলের পথে রয়েছে সেখানে তাঁকে সমাধিস্থ করার বিষয়টা তারা তদারকি করবে। আগামী কয়েক মাসের ভিতরে তাঁদের ফিরে আসবার কোনো সম্ভাবনা নেই। রাজত্বের গুরুভার, এর সাথে বিদ্যমান একাকীত্ব সম্পর্কে, তার সাথে একবার তার মরহুম আব্বাজান আলোচনা করেছিল। সে খুব ভালো করেই জানে, তাঁকে নিজেকে এবং একমাত্র তাঁকে নিজেকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে করণীয় সম্বন্ধে কিন্তু তার আগে তাঁকে অবশ্যই তার মনোভাব গোপন রাখতে হবে।

হুমায়ুন নিজের ক্রোধকে প্রশমিত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে, সে সিদ্ধান্ত নেয় রাতটা সে তার প্রিয়তমা রক্ষিতার সাথে কাটাবে- কাবুলের উত্তরের পাহাড়ী অঞ্চল থেকে আগত গোলকার মুখাবয়ব, ধুসর চোখের এক সুনন্যা তরুণী। সালিমা তার রেশমের মতো ত্বক আর কচি ডালিমের মতো স্তনযুগল ব্যবহার করে খুব ভালো করেই জানে কিভাবে তাঁর দেহকে আত্মহারা করে তুলতে হবে এবং পুরো বিষয়টা সে স্পষ্টতই উপভোগ করে। সালিমার প্রণয়স্পর্শ সম্ভবত আজ রাতে তাঁকে মন পরিষ্কার করতে আর তার ভাবনাগুলোকে বিন্যস্ত করতে সাহায্যই করবে এবং তাহলে হয়তো অনাগত ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা একটু হাল্কা হবে যা সম্ভবত সহসাই আর অলুক্ষণে ভঙ্গিতে কৃষ্ণ বর্ণ ধারণ করেছে।

তিন ঘন্টার পরে, হারেমে সালিমার কক্ষে রেশম-আবৃত একটা তাকিয়ায় হেলান দিয়ে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র অবস্থায় হুমায়ুন শুয়ে থাকে। তার পেষল শরীর, পোড় খাওয়া পরীক্ষিত একজন যোদ্ধর পক্ষে মানানসই ক্ষতচিহ্নে অলঙ্কত, বাদাম তেলে সিক্ত হয়ে দীপ্তি ছড়ায় মেয়েটা তার ত্বকে চটুল ভঙ্গিতে সেটা মালিশ করেছে যতক্ষণ না এক মুহূর্তও অপেক্ষা করাটা অসহ্য হয়ে উঠে, হুমায়ুন তাকে বুকে টেনে নেয়। সালিমার ধুসর হলুদ বর্ণের মসলিনের স্বচ্ছ আলখাল্লা- হুমায়ুনের সদ্য অধিকৃত ভূখণ্ডের একটা সামগ্রী, যেখানের তাঁতিরা এতো সূক্ষ আর কমনীয় কাপড় বয়ন করে তারা যার নাম রাখে বায়ুর হৃৎস্পন্দন বা ভোরের শিশির- ফুলের নক্সা ভোলা কার্পেটের উপরে অবহেলায় পড়ে রয়েছে। সালিমা যদিও তাঁকে পরিতৃপ্ত করেছে এবং তাঁর প্রতি মেয়েটার সাড়া বরাবরের মতোই প্রবল আর হুমায়ুনের উত্তেজনা শিথিল হয়েছে, তার মনে তখনও বাবা ইয়াসভালের ফাঁস করা কথাগুলোই ফিরে ফিরে আসে, তাঁর ক্রোধ আর হতাশাকে পুনরায় জাগরিত করে।

সালিমা, কষ্ট করে আমাকে পান করার জন্য একটু গোলাপজল এনে দেবে।

সে নিমেষের ভিতরেই রূপার পানপাত্র যাতে মূল্যবান পাথর দিয়ে গোলাপের বৃত্তাকার প্যানেল প্রণিহিত করা রয়েছে নিয়ে ফিরে আসে। পাত্রের পানির উটের কাফেলায় করে উত্তরের পাহাড় থেকে অতিকায় চাইয়ের আকৃতিতে কেটে আনা বরফ দিয়ে শীতল করা গন্ধটা মুখরোচক। বিছানার পাশে রাখা একটা ছোট কাঠের বাক্স থেকে, হুমায়ুন কয়েকটা আফিমের গুলি বের করে এবং সেগুলো পাত্রের ভিতরে ছেড়ে দেয়, গুলিগুলো পানিতে একটা দুধালো ঘূর্ণি সৃষ্টি করে মিলিয়ে যায়।

পান কর। সে পানপাত্রটা সালিমার ঠোঁটের কাছে তুলে ধরে এবং তাকে ঢোক গিলতে দেখে। তার আনন্দে তাঁকে অংশীদার করাই তার অভিপ্রায়, কিন্তু সে কিছুটা লজ্জিতও বটে তার এমন আচরণের পেছনে আরো একটা অন্য উদ্দেশ্যও রয়েছে। তার আব্বাজান প্রায় প্রাণ হারাতে বসেছিলেন যখন বুয়া- পরাজিত শত্রু সুলতান ইবরাহিম লোদির মা তার ছেলের মৃত্যুর জন্য প্রতিশোধ নিতে তাঁকে বিষ প্রয়োগের চেষ্টা করেছিল। সেই সময় থেকে, অন্য কেউ আগে পরীক্ষা করেনি এমন যে কোনো খাদ্যদ্রব্য সম্বন্ধে হুমায়ুন সবসময়ে সর্তক থাকে…।

আমার প্রভু, নিন। সালিমা, গোলাপজলে আকর্ষণীয়ভাবে সিক্ত ঠোঁটে, সে তাকে চুমু খায় আর পানপাত্রটা হাতে তুলে দেয়। সে পানপাত্রে গভীর চুমুক দেয়, কামনা করে সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে আফিম যেভাবে তার শোকাবেগ ভোতা করে দিয়েছে আর তার উদ্বেগ হ্রাস করেছে সেভাবে কাজ শুরু করুক, তার মানসপটে আলতো করে কুণ্ডলীমুক্ত হয়ে তাঁকে প্রীতিপ্রদ বিস্মরণের মাঝে নিয়ে যাক।

কিন্তু আজ রাতে সে বোধহয় মাত্রা অতিক্রম করেছে বা এর প্রশমন ক্ষমতার কাছে অনেক বেশী কিছু প্রত্যাশা করছে। সে তাকিয়ায় দেহ এলিয়ে দিতে, তার মনের অলিন্দে অশুভ লক্ষণযুক্ত নানা অবয়বের সৃষ্টি হতে থাকে। তার সামনে দীপ্তিময় নীল গম্বুজ আর সরু মিনারযুক্ত একটা অপূর্বসুন্দর শহর ভেসে উঠে। যদিও সেখানে তার সংক্ষিপ্ত অবস্থান মনে রাখার পক্ষে তাঁর বয়সটা খুবই অল্প ছিল, তবুও সে বুঝতে পারে শহরটা সমরকন্দ, তাঁর মহান পূর্বপুরুষ তৈমূরের রাজধানী আর সেই শহর যা তার বাবা দখল করেছিলেন, হারিয়েছিলেন আর সারাটা জীবন সে জন্য আকুল হয়ে থেকেছেন। বাবরের রেখে যাওয়া প্রাঞ্জল বর্ণনা পড়া থাকার কারণে হুমায়ুন বুঝতে পারে সে শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত রেগিস্তান চত্বরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তার চোখের সামনে আকাশের দিকে উঠে যাওয়া তোরণদ্বারের উপরে স্থাপিত গুটিসুটি দিয়ে থাকা কমলা রঙের বাঘটা জীবন্ত হয়ে উঠে, তার কান দুটো মাথার সাথে লেপটে রয়েছে, তীক্ষ্ণ দাঁতের উপরে ঠোঁট টানটান, অবজ্ঞা প্রকাশের জন্য থুতু ফেলতে প্রস্তুত। বাঘটার চোখ দুটো কামরানের চোখের মতো সবুজ।

সহসা, হুমায়ুন নিজেকে বাঘের পিঠের উপরে আবিষ্কার করে, নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে সে ওটার সাথে ধ্বস্তাধ্বস্তি করছে, টের পায় বাঘটার পেষল শরীর তার নীচে মোচড় খাচ্ছে। সে নিজের উরু দিয়ে তাঁকে শক্ত করে আকড়ে ধরে, প্রাণীটার তপ্ত নিঃশ্বাসের গন্ধ পায় যখন জন্তুটা নিজের দেহ বাকিয়ে, মাথা এপাশ ওপাশ দোলাতে থাকে, তাঁকে ছিটকে ফেলে দেয়ার জন্য বেচারা প্রাণপণ লড়াই করে। হুমায়ুন জটাকে তার দুপা দিয়ে আরও শক্ত করে আটকে ধরে আর টের পায় এর পাঁজর ব্যথায় মোচড়াচ্ছে আর নতুন করে দাপাদাপি শুরু হয়। সে কোনভাবেই ছিটকে যাবে না। সে সামনের দিকে ঝুঁকে আসে, জটার দেহের নীচে নিজের হাত দুটো পিছলে যেতে দেয়। তার হাতের আঙ্গুলগুলো মাংসপেশী অনুভব করে যা নরম আর মসৃণ এবং তার ভেতরে রয়েছে একটা উষ্ণ, ছন্দোবদ্ধ নাড়ীর স্পন্দন, জটার প্রাণশক্তির উৎস। সে তার মুষ্ঠি শক্ত করার উদ্দেশ্যে চাপ বাড়াতে আর প্রবলভাবে ধাক্কা দিতে থাকলে আচমকা জন্তুটার শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ কর্কশ হয়ে উঠে আর খিচুনী শুরু হয়।

সম্রাট…দয়া করেন…

আরেকটা দুর্বল কণ্ঠস্বর কোথাও থেকে তার মনোযোগ আকর্ষণ করতে চায়। কণ্ঠস্বরটা নিঃশ্বাস নেবার জন্য হাঁসফাঁস করছে। সে চোখ খুলে তাকায় এবং নিজের প্রসারিত তারারন্ধ্রের ভিতর দিয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে, হুমায়ুন হিংস্র কোনো বাঘের বদলে সালিমাকে দেখতে পায়। সালিমার দেহ, তার নিজের দেহের মতোই ঘামে চুপচুপে হয়ে ভেজা যেন চুড়ান্ত মুহূর্ত নিকটেই উপস্থিত। কিন্তু যদিও সে আসলেই তাঁর মালিক, হুমায়ুনের পেশল হাতের তালু সালিমার পেলব স্তন প্রচণ্ড জোরে আকড়ে রেখেছে যেন সালিমাই সেই হিংস্র জন্তু যাকে পরাভূত করতে সে লড়াই করছিল। সে তার হাতের মুঠি শীথিল করে কিন্তু রমণের বেগ বাড়িয়ে দেয় যতক্ষণ না তারা দুজনেই সুখানুভূতির শীর্ষে পৌঁছে এবং অবসাদে ভেঙে পড়ে।

সালিমা, আমি দুঃখিত। তোমার উপরে এভাবে হামলে পড়া আমার মোটেই উচিত হয়নি। আমার কেবল মনে হচ্ছিল তোমার জন্য আমার কামনার সাথে প্রভুত্ব স্থাপনের ভাবনাগুলো কেমন এক হয়ে মিশে যাচ্ছে।

দুঃখিত হবার মতো কিছু হয়নি- আপনার প্রেমিক-সুলভ আচরণ আমাকে ভোগসুখে উদ্বেল করে তোলে। আপনি অন্য এক জগতে ছিলেন আর আমি এখানে যেমন করে থাকি আমি সেখানেও নির্দ্বিধায় আপনার সেবায় রত ছিলাম। আমি খুব ভালো করেই জানি আপনি কখনও ইচ্ছাকৃতভাবে আমাকে কষ্ট দেবেন না। এখন এসব ফালতু আলোচনা বাদ দিয়ে আমাকে আরেকবার সঙ্গসুখের তুঙ্গে নিয়ে যান, এইবার একটু কোমলতা আমি আপনার কাছে আশা করতেই পারি।

হুমায়ুন সানন্দে তার প্রত্যাশা পূরণ করে। কামনার ঝড় স্তিমিত হয়ে এলে, সে যখন ক্লান্ত হয়ে শুয়ে থাকে এবং তখনও আফিমের ঘোর পুরোপুরি কাটেনি, হারেমের পরিচারিকার দল সুগন্ধি মেশান শীতল পানি নিয়ে এসে তার গা মুছিয়ে দেয়। অবশেষে সালিমার বাহুডোরে নিজেকে সপে দিয়ে সে নিন্দ্রাদেবীর বরাভয় লাভ করে। এইবার ঘুমের ভেতর কোনো দুঃস্বপ্ন তাকে তাড়া করে না, হারেমের সেই কক্ষের জাফরি-কাটা জানালা দিয়ে যখন দিনের প্রথম আলোর কোমল আভা তীর্যক ভঙ্গিতে প্রবেশ করে তখনই কেবল তার সুপ্তির ঘোর কাটে। সে শুয়ে শুয়ে তার মাথার উপরের বেলেপাথরের নক্সা করা ছাদের নীচের অংশে খেলা করতে থাকা আলোক রশ্মির তীব্রতা বৃদ্ধির দিকে আনমনে তাকিয়ে থাকার সময়েই সে জানে তাকে কি করতে হবে। বাঘের সাথে তার ইচ্ছা শক্তির লড়াই তাকে সে কথা বলে দিয়েছে। সে হল একজন শাসক। সে অবশ্যই সবসময়ে অমায়িক থাকতে পারে না। কখন কঠোর হতে হবে সেটা জানা থাকলেই কেবল কেউ সম্মান অর্জন করতে পারে।

*

মহামান্য সুলতান। আপনার আদেশ পালিত হয়েছে।

দর্শনার্থী কক্ষ-দরবার হলের মর্মরের বেদীতে স্থাপিত তার সিংহাসনে উপবিষ্ট অবস্থা থেকে হুমায়ুন তাঁর দেহরক্ষী দলের প্রধানের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় তাঁর অমাত্য আর সেনাপতিরা কঠোর অগ্রগণ্যতার বিন্যাস বজায় রেখে তার চারপাশে নিজ নিজ স্থানে অবস্থান করছে। সে ইতিমধ্যে জেনে গিয়েছে আদতেই কি ঘটেছে মধ্যরাত্রি অতিক্রান্ত হবার সামান্য পরেই দেহরক্ষী দলের আধিকারিক তার সাথে নিভৃতে দেখা করতে এসেছিল। কিন্তু সেই সাথে এটাও গুরুত্বপূর্ণ যে দরবারের সবাই বিষয়টা শ্রবণ করেছে এবং আসন্ন ঘটনাবলী প্রত্যক্ষ করেছে।

তুমি দারুণভাবে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছে। কি ঘটেছিল সেটা দরবারের সামনে খুলে বল।

মহামান্য সম্রাট যেমন আদেশ করেছিলেন, আমি আর বাছাই করা দেহরক্ষীদের একটা ছোট দল সম্রাটের সম্ভাইদের গত রাতে গ্রেফতার করেছি যখন তারা শাহজাদা কামরানের প্রাসাদে পানাহারে মত্ত ছিল।

হুমায়ুন তার চারপাশে সশব্দে একটা শ্বাসটানার আওয়াজ হতে, অতিকষ্টে নিজের হাসি চেপে রাখে। সে সময়টা ভালোই নির্বাচন করেছিল। বাবা ইয়াসভালো তাঁকে সতর্ক করে দেবার পর থেকে পুরো সময়টা নিরাপত্তার খাতিরে সে নিজেকে দূর্গের অভ্যন্তরে অন্তরীণ রেখেছে। তারপরে সপ্তাহখানেক আগের কথা, কাবুলের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট, উচ্চণ্ড আর দামী, লাল সুরার একটা চালান গজনী থেকে খচ্চরের কাফিলায় করে এসে পৌঁছে- বাইসানগার, তাঁর নানাজানের কাছ থেকে আগত একটা সময়োচিত উপহার। সুরার প্রতি কামরানের দুর্বলতার কথা জানা থাকার কারণে, হুমায়ুন চালানের একটা অংশ তাঁকে উপহার দেয়। সে যেমনটা আশা করেছিল যে কামরান বাকি ভাইদের তার সাথে পানাহারে যোগ দেবার জন্য আমন্ত্রণ জানাবে, তাকে খুব বেশী একটা সময় অপেক্ষা করতে হয় না। হুমায়ুন যথোচিত সৌজন্যের সাথে আমন্ত্রণ গ্রহণ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখে কিন্তু আসকারি আর অল্পবয়সী হিন্দাল, যে এখনও সুরাপান উপভোগ করার মতো বয়সে পৌঁছায়নি, কিন্তু নিশ্চিতভাবেই যারা সেটা উপভোগ করে তাদের সাহচর্যে থাকতে শ্লাঘাবোধ করে, দ্বিতীয় কিছু না ভেবেই ব্যগ্রতার সাথে আমন্ত্রণ গ্রহণ করে। ষড়যন্ত্রের তিন কুশীলব একসাথে, সর্বোপরি অপ্রস্তুত, নিশ্চায়ক হামলার জন্য উপযুক্ত সুযোগ।

 আমার ভাইয়েরা কি প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিল?

শাহজাদা কামরান নিজের খঞ্জন বের করেছিলেন আর আমার একজন লোককে তার কানের লতি দ্বিখণ্ডিত করে তাঁকে আহত করেছে, কিন্তু তার এই প্রয়াস ছিল ক্ষণস্থায়ী। অন্যেরা লড়াই করার কোনো আগ্রহই প্রকাশ করেনি।

হুমায়ুনের চাহনী তাঁর সামনে দাঁড়ানো লোকগুলোর উপর দিয়ে ভেসে বেড়ায়। কয়েকদিন আগে, আমি আমার বিরুদ্ধে একটা ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পারি। আমার সৎ-ভাইয়েরা আমাকে অপহরণের এবং বলপ্রয়োগ করে আমার সাম্রাজ্যের কিছুটা আদায়ের পরিকল্পনা করেছে- সম্ভবত তারা আমাকে হত্যাই করতে চেয়েছিল। তার অমাত্যদের আদতেই বিক্ষুব্ধ দেখায়। হুমায়ুন ভাবে, তাদের ভিতরে কতজন অভিনয় করছে। কয়েকজন, অবশ্যই, ষড়যন্ত্রের কথা আগে থেকেই জানতো, এমনকি নিরব সমর্থন দিয়েছে। উপজাতীয় গোত্রপতিদের কয়েকজন যারা হিন্দুস্তান বিজয়ের অভিযানে বাবরের সাথে ছিল কখনই তাদের নতুন বাসস্থানের সাথে মানিয়ে নিতে পারেনি। এই নতুন ভূখন্ত্রে বৈচিত্র্যহীন, আপাতদৃষ্টিতে শেষ না হওয়া সমভূমি, এখানকার বাতাসের উষ্ণতা আর তার সাথে প্রবাহিত বালুকণা এবং অঝোর ধারায় সিক্ত করা বর্ষাকাল তারা অপছন্দ করতো। তারা গোপনে অন্তরে লালন করতো, বরফাবৃত পাহাড় এবং খাইবার গিরিপথ আর তার ওপারে তাদের মাতৃভূমির শীতল স্রোতস্বিনীর জন্য তাদের ভেতরে একটা আকুতি ছিল। তাদের ভিতরে অনেকেই হয়তো ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে গোপনে সহযোগিতা করার এই সুযোগকে স্বাগতই জানিয়েছিল যার ফলে তারা হয়তো বেশ ভালো রকমের ধনসম্পদ নিয়ে দেশে ফিরে যেতে পারবে। বেশ, এখন ব্যাটারা উৎকণ্ঠায় একটু ঘামলে মন্দ কি…

আমার গুণধর ভাইদের আমার সামনে এনে হাজির কর যাতে করে তাদের সহযোগিদের বিষয়ে আমি তাদের প্রশ্ন করতে পারি।

হুমায়ুন আর তার অমাত্যের দল যখন অপেক্ষা করে চারপাশে সমাধি গর্ভের পরম নিরবতা বিরাজ করতে থাকে। অবশেষে, দরবার কক্ষের বাইরের আঙিনায় পাথরের মেঝেতে ধাতব শেকলের ঘষা খাবার শব্দে এই অস্বস্তিকর নিরবতার সমাপ্তি ঘটে। হুমায়ুন মুখ তুলে তাকিয়ে দেখে প্রহরীদের দ্বারা প্রায় ছেড়ে নিয়ে আসার ভঙ্গিতে টলতে টলতে তার ভাইয়েরা সারিবদ্ধভাবে প্রবেশ করছে। প্রথমেই রয়েছে কামরান, তার পাতলা ঠোঁট আর বাজপাখির মতো নাক বিশিষ্ট মুখাবয়বে পরিষ্কার তাচ্ছিল্য ফুটে আছে। তার পায়ে হয়ত শেকল পরান হয়েছে কিন্তু তার স্পর্ধিত মস্তক বহনকারী দেহটার ভঙ্গিমায় স্পষ্ট বোঝা কোনো প্রকারের ক্ষমা প্রার্থনার অভিপ্রায় তার নেই। আসকারির, খর্বকায় আর হাল্কাপাতলা, ব্যাপারটা আবার একেবারেই ভিন্ন। তাঁর দাড়ি না কামানো মুখের ভাঁজে ভাঁজে আতঙ্ক বিরাজ করছে এবং তার কালো র নীচের ছোট ছোট চোখ দুটো সকাতরে হুমায়ুনের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। হিন্দাল, তার বড় দুভাইয়ের পেছনে প্রথমে প্রায় ঢাকা পড়ে ছিল, মাথা ভর্তি একরাশ জটপাকান কালো চুলের নীচে তার কিশোর মুখাবয়বে ভয়ের চেয়ে কেমন বোধহীন শূন্য একটা অভিব্যক্তি যেন যা কিছু ঘটতে চলেছে সবকিছুই তার বোধগম্যতার বাইরে।

তাদের কাছ থেকে প্রহরীরা সরে যেতে, আসকারি আর হিন্দাল, প্রথাগত অভিবাদন কুর্নিশ এর রীতি অনুসারে নিজেদের হুমায়ুনের সামনে প্রণিপাতের ভঙ্গিতে আনত করে। আসকারি বেশ কিছুটা সময় ইতস্তত করার পরে, মুখে একটা ঔদ্ধত্যপূর্ণ হাসি ফুটিয়ে তুলে একই কাজ করে।

উঠে দাঁড়াও।

 তিনজনের প্রত্যেকের উঠে দাঁড়াবার জন্য প্রাণান্তকর প্রয়াস শেষ না হওয়া পর্যন্ত হুমায়ুন চুপ করে থাকে। এখন সে আরও ভালোও করে খুটিয়ে তাঁদের অভিব্যক্তি যাচাই করতে পারে সে দেখে যে কামরানের মুখের একপাশে একটা কালশিটের দাগ রয়েছে।

নিজেদের কার্যকলাপের জন্য তোমরা কি সাফাই দেবে? তোমরা প্রত্যেকে আমার সৎ-ভাই। আমার বিরুদ্ধে কেন তোমরা ষড়যন্ত্র করতে গেলে?

আমরা কিছুই করিনি…এটা মোটেই সত্যি নয়… উদ্বিগ্ন আর কর্কশ, আসকারির কণ্ঠস্বর মোটেই প্রত্যয়দীপ্ত নয়।

তুমি মিথ্যাচার করছে। তোমার চোখে মুখে সেটা স্পষ্ট ফুটে আছে। তুমি আবারও সে চেষ্টা কর, আমি বাধ্য হব তোমাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করতে। কামরান, এদের ভিতরে যেহেতু তুমিই সবার বড়, আমার প্রশ্নের উত্তর তুমিই দাও। আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার চেষ্টা কেন করতে গেলে?

কামরানের চোখ- তাদের মরহুম আব্বাজান বাবরের চোখের মতোই সবুজাভ দীপ্তিময় সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হুমায়ুনের দিকে সে যখন মুখ তুলে তাকায়, কুচকে সরু হয়ে যায়। ষড়যন্ত্রের ধারণাটা আমার মস্তিষ্কপ্রসুত শাস্তি দিতে হলে আমাকে দাও, ওদের নয়। আমাদের প্রতি যে অবিচার করা হয়েছে সেটা সংশোধন করার এটাই একমাত্র পথ। তুমি নিজেই বলেছে যে আমরা সবাই বাবরের সন্তান। আমাদের সবার ধমনীতেই কি তৈমূরের রক্ত বইছে না? আর সেই সাথে আমাদের নানীজান খুতলাঘ নিগারের কারণে চেঙ্গিস খানের রক্ত? অথচ দেখো তোমার চামচা করে আমাদের রাখা হয়েছে, তোমার মর্জিমাফিক এদিক সেদিক বিনাবাক্যব্যয়ে ছোটার জন্য। শাহজাদা নয়, ক্রীতদাসের মতো তুমি আমাদের সাথে আচরণ কর।

আর তোমরা তোমাদের সবাই, কেবল কামরান একা না- ভাইয়ের মতো না, বরং ছিঁচকে অপরাধীর মতো আচরণ করেছে। আমার প্রতি নয় নাই থাকলো, কিন্তু আমাদের রাজবংশের প্রতিও কোনো আনুগত্যবোধ তোমাদের ভিতরে নেই? তার সিংহাসনের ডানপাশের দেয়ালের অনেক উঁচুতে স্থাপিত কাঠের সূক্ষ কারুকাজ করা জাফরির দিকে হুমায়ুন আড়চোখে তাকালে, নিমেষের জন্য একজোড়া কালো চোখ সে দেখতে পায়। নিঃসন্দেহে খানজাদা, আর সম্ভবত তার আম্মিজান মাহাম জাফরির পেছনে অবস্থিত ছোট্ট অলিন্দ থেকে, যেখানে রাজঅন্তঃপুরের রমণীরা নিজেদের লোকচক্ষুর অন্তরালে রেখে, দরবারের কার্যক্রম দেখতে আর শুনতে পারেন, তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। গুলরুখ আর দিলদারও সম্ভবত সেখানে রয়েছে, শিহরিত শঙ্কায় প্রতীক্ষা করছে তাদের সন্তানের প্রতি সে কি শাস্তির বিধান ঘোষণা করে।

কিন্তু এখন যখন সেই মুহূর্ত প্রায় সমাগত, হুমায়ুন এক বিচিত্র অনীহা নিজের ভিতরে অনুভব করে। সে কি করবে সে বিষয়ে মাত্র আধঘন্টা আগেও সে ভীষণভাবে নিশ্চিত ছিল- তৈমূরসম নির্মমতায়, সে কোনো প্রকার কালক্ষেপন না করে কামরান আর আসকারির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেবে, আর হিন্দালকে প্রত্যন্ত কোনো দূর্গে আজীবনের জন্য নির্বাসনে পাঠাবে। কিন্তু তাঁদের তিনজনের দিকে তাকিয়ে অবাধ্য আর উদ্ধত কামরান, আসকারি আর কিশোর হিন্দাল আক্ষরিক অর্থেই আতঙ্কিত- হুমায়ুন বুঝতে পারে তাঁর ক্রোধ প্রশমিত হচ্ছে। মাত্র কয়েক মাস আগেই তাদের আব্বাজান ইন্তেকাল করেছে, আর তাছাড়া সে কিভাবে বাবরের অন্তিম ইচ্ছার কথা উপেক্ষা করবে? তোমার ভাইদের বিরুদ্ধে কখনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে যেও না, সেটা তাঁদের প্রাপ্য বলে তোমার যতই মনে হোক। প্রেমিকসুলভ আচরণের ক্ষেত্রে আমরা যেমন করে থাকি, কখনও এমন সময় আসবে যখন কঠোর হতে হবে, আর কখনও হতে হবে সহৃদয়।

হুমায়ুন তার সিংহাসন থেকে নীচে নেমে এসে, ধীরে ধীরে তার শিকলাবদ্ধ ভাইদের দিকে হেঁটে যায়, এবং তাঁদের আলিঙ্গন করে, কামরানকে বাহুবন্দি করা দিয়ে বিষয়টা শুরু হয়। তাঁর সামনে মৃদু টলতে থাকা ত্রিমূর্তির চোখে মুখে বিভ্রান্ত অভিব্যক্তি, তার এহেন আচরণের মানে খুঁজতে তারা তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমরা ভাইয়েরা নিজেদের ভিতরে লড়াই করবো এটা ঠিক আমাদের শোভা দেয় না। আমাদের এই নতুন ভূখণ্ডের মাটিতে আমারই হাতে আমাদের বংশের কারো রক্ত ঝরুক এটা আমার কাম্য নয়। আমাদের রাজবংশের জন্য সেটা একটা অশুভ লক্ষণ বলে বিবেচিত হবে। আমার প্রতি তোমরা আনুগত্যের শপথ নাও আর তোমরা তাহলে প্রাণে বেঁচে যাবে। শাসন করার জন্য আমি তোমাদের প্রদেশও প্রদান করবো যা যদিও এই সাম্রাজ্যেরই অংশ, কিন্তু আমার কাছে জবাবদিহি করা ছাড়া, তোমরা স্বাধীনভাবেই শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারবে।

হুমায়ুন তার চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা অমাত্যবর্গ আর সেনাপতিদের ভেতরে প্রথমে একটা বিস্ময়ের ধ্বনি শুনতে পায় এবং ধীরে ধীরে সেটা সম্মতির ব্যঞ্জনা লাভ করে, এবং গর্বে তার বুকটা ভরে উঠে। চুড়ান্ত মহত্ত্ব একেই বলে। এটাই একজন সত্যিকারের সম্রাটের আচরণ- শক্তহাতে সব মতপার্থক্যের বিনষ্টিসাধন কিন্তু তারপরেই মহানুভবতা প্রদর্শন করা। সে দ্বিতীয়বারের মতো যখন তাঁর ভাইদের আবার আলিঙ্গন করে, আসকারি আর হিন্দালের চোখে তখন কৃতজ্ঞতার অশ্রু চিকচিক করে। কিন্তু কামরানের সবুজাভ চোখ শুকনো থাকে, আর মুখাবয়বে বিষণ্ণ আর দুর্বোধ্য একটা অভিব্যক্তি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *