বাইসনের শিং

বাইসনের শিং

কলকাতার রাস্তায় শীতের মরশুমে প্রতি বছর ভুটানিরা দল বেঁধে সোয়েটার, টুপি, মাফলার বিক্রি করতে আসে।

ওয়েলিংটন স্কোয়ারের ধারে যারা বসে তাদেরই একজনের কাছ থেকে প্রতিবার কিছু না কিছু কিনি। লোকটি বৃদ্ধ। চোখে-মুখে সরলতার ছাপ আছে। ওর কাছে দাম সস্তা বলেই মনে হয়। জিনিসও খারাপ দেয় না।

এবারও একটা মাফলার কিনেছিলাম। সঙ্গে খুচরো টাকা ছিল না। ও আমার বউবাজারের বাসা চিনত। বলেছিল, এক সময়ে বাসায় এসে টাকা নিয়ে যাবে।

শীত শেষ হতে চলল, ভুটানিরা ফিরে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছে। এখনও লোকটি দাম নিতে এল না কেন ভাবতে ভাবতে তালা খুলে ঘরে ঢুকতেই আমি রীতিমতো ঘাবড়ে গেলাম। দেখলাম ঘরের একটা জানলা একদম খোলা। আর দুপুরের দমকা হাওয়ার সঙ্গে যে এক পশলা শেষ মাঘের বৃষ্টি হয়েছিল তাতে আমার টেবিলের কাগজপত্র চারিদিকে ছড়িয়ে ভিজে একা হয়ে গেছে।

আমি কয়েক মিনিট দরজার কাছে বিভ্রান্তের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। জানলা খোলা থাকলে বাতাসে কাগজপত্র উড়ে যাবেই বৃষ্টির ছাটে ভিজেও যাবে। এ তো জানা কথা। কিন্তু জানলা তো খোলা ছিল না। এই ঘরটাতে আমি একাই থাকি। এবং যখনই বেরোই তখনই সব জানলা ভালো করে বন্ধ করে যাই। এটা আমার অভ্যাস হয়ে গেছে।

জুতোটা দোরগোড়ায় খুলে আমি জানলাটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখলাম জানলার একটা পাল্লা তখনও বন্ধ রয়েছে। অন্য পাল্লার লোহার ছিটকিনিটা তোলা। ভেতর থেকে কেউ যেন একটা পাল্লা খুলে ফেলেছে। এরকম অসম্ভব ঘটনা কি করে ঘটল তা ভেবে পেলাম না।

জামাকাপড় না ছেড়েই অবসন্ন দেহে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। একবার। ঘরের চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম। না, বৃষ্টি বা ঝোড়ো বাতাসে আর কিছু এলোমেলো হয়ে যায়নি। হ্যাঁঙ্গারে শার্ট দুটো ঝুলছে, খবরের কাগজটা দেরাজের উপরে যেমন ভাঁজ করা ছিল তেমনিই আছে। দেওয়ালে অনেকগুলি দেব-দেবীর ছবি। সেগুলো সব যেমন ছিল তেমনটিই আছে। ওপাশে দামী কাঠের ওপর মাউন্ট করা বাইসনের শিং জোড়াটাও এতটুকু নড়েনি।

দেব-দেবীর ছবিগুলো আমার নয়। ওগুলো বাড়িওলার। আমি সরিয়ে নিতে বলেছিলাম, বাড়িওয়ালা রাজী হননি। অগত্যা থেকেই গেছে। বাইসনের শিং জোড়াটাই আমার।

কিছুদিনের জন্যে নেপালে বেড়াতে গিয়েছিলাম। ফিরেছি গত সপ্তাহে। এখানে ফিরে পর্যন্ত লক্ষ্য করছি প্রায় প্রতিদিনই কিছু অস্বস্তিকর ঘটনা ঘটছে। এতই সামান্য ঘটনা যে লোককে ডেকে বলার বা দেখাবার কিছু নেই। যেমন প্রথম দিন অফিস থেকে ফিরে তালা খুলতে গিয়ে দেখি তালা কিছুতেই খুলছে না। এমন কোনোদিন হয় না। শেষে রাস্তা থেকে কোনোরকমে একজন চাবিওয়ালাকে নিয়ে এলাম। সে আমারই চাবি নিয়ে তালায় ঢোকানো মাত্র তালা খুলে গেল। আশ্চর্য!

চাবিওয়ালা একটু হেসে চলে গেল।

পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে টাইমপীসটার দিকে তাকাতে দেখি ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেছে। অবাক হলাম। কেননা প্রতিদিন সকালে উঠেই  আমি সব আগে ঘড়িতে দম দিই। একবার পুরো দম দিলে তা অন্তত দুপুর পর্যন্ত চলে। কিন্তু সেদিনই দেখলাম ব্যতিক্রম। ভাবলাম, নিশ্চয় পুরো দম দেওয়া হয়নি। যাই হোক, নতুন করে দম দিতে লাগলাম। আর সঙ্গে সঙ্গেই স্পিংটা কটু করে কেটে গেল।

কী ঝঞ্জাট! এখন ছোটো ঘড়ির দোকান। উটকো খরচা তো আছেই, তার চেয়ে ঢের অসুবিধে, এখন বেশ কিছুদিন ঘড়িটা পাব না। রিস্টওয়াচ একটা আছে ঠিকই কিন্তু চোখের সামনে ঘড়িটা না থাকলে আমার চলে না। আসলে আমি একা থাকি। ঘড়িটাই যেন আমার সঙ্গী। রাতদুপুরে হয়তো ঘুম ভেঙে গেল। এই কলকাতা শহরেও নিঝুম রাতে সরু গলির মধ্যে চুন-বালি-খসা পুরনো ঘরটার মধ্যে কেমন গা ছমছম করে। তখন টাইমপীসটার টিটি শব্দ শুনলে যেন মনে হয়, সচল কিছু একটা আমার ঘরে আছে।

আমি রোজ স্নানে যাবার আগে দাড়ি কামাই। রোজ দাড়ি না কাটলে চলে না। সেদিন খবরের কাগজ পড়তে পড়তে দেরি হয়ে গিয়েছিল। তাড়াতাড়ি সেটিরেজার নিয়ে শেভ করতে গিয়ে দেখি ব্লেড নেই। এমন কখনও হয় না। ব্লেড ফুরোবার আগেই নতুন এক প্যাকেট ব্লেড কিনে রাখি। যাক গে, হয়তো ভুলেই গেছি। তাড়াতাড়ি লুঙ্গির ওপর শার্ট চড়িয়ে ব্লেড কিনতে বেরোলাম। ব্লেড কিনে ফিরে এসে দেখি ব্লেডের একটা গোটা প্যাকেট আয়নার সামনেই রয়েছে।

ইস্! এমন চোখের ভুলও হয়!

 যাই হোক, দেরি হয়ে গেছে বলে তাড়াতাড়ি দাড়ি কামাতে বসলাম। দুটো টান দিয়েছি, অমনি থুতনির নিচেটায় খচ্‌ করে কেটে গিয়ে রক্ত পড়তে লাগল।

একে নতুন ব্লেড, তার ওপর তাড়াতাড়ি হাত চলছিল–কেটে যাওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু রক্ত কিছুতেই আর বন্ধ হয় না। আমি তখন এমন নার্ভাস হয়ে গেলাম যে কোনোরকমে তুলো দিয়ে জায়গাটা জোরে চেপে ধরে শুয়ে রইলাম। ডাক্তারখানায় যাব সে শক্তিটুকুও ছিল না।

এসব ঘটনা কাউকে জানাবার নয়, তবু আমার কাছে রীতিমতো অস্বস্তিকর। সেদিন রক্তপাত দেখে ভয় পেয়েছিলাম। মনে হয়েছিল কিছু একটা অশুভ ঘটনা যেন ঘটতে চলেছে। আজ খোলা জানলা দেখে আরো ঘাবড়ে গেলাম। মনে হলো অশুভ কিছু একটা প্রতিদিন যেন এক পা এক পা করে এগিয়ে আসছে। অথচ কী যে করব ভেবে পাচ্ছি না।

কদিন পর।

কোথা থেকে একটা বেড়াল এসে জুটেছে। সাদা লোমে ঢাকা বেড়ালটা দেখতে বেশ সুন্দর। খুব আদুরে। এসেই আমার পায়ে লুটোপুটি খেতে লাগল। বুঝলাম কারো বাড়ির পোষা বেড়াল। ভুল করে এখানে চলে এসেছে। এসেছে যখন থাক। দুবেলা আমার পাতের এঁটোকাটা খেয়ে ও থেকে গেল। ভাবলাম ঘড়িটা তো দোকানে। এখন বেড়ালটাই আমার সঙ্গী হোক।

আমাদের এই গলির মুখে কতকগুলো রাস্তার কুকুর রাত্তিরে আড্ডা জমায়। অচেনা লোক দেখলেই এমন ঘেউ ঘেউ করে ওঠে যে বাছাধন পালাতে পথ পায় না। ফলে চোর-টোরের ভয় থাকে না।

রাত তখন কত জানি না। হঠাৎ কুকুরের ডাকে ঘুম ভেঙে গেল। এত রাত্রে কুকুরগুলো অমন করে ডাকছে কেন?

আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম। প্রথমে অন্ধকারেই দেখলাম সাদা বেড়ালটা পাগলের মতো একবার ভোলা জানলাটার দিকে যাচ্ছে, একবার খাটের তলায় কছে। ওদিকে রাস্তার কুকুরগুলো ক্রমাগত চিৎকার করে যাচ্ছে। কিন্তু এ চিৎকার অন্যরকম। অচেনা লোক দেখে তাড়া করে যাওয়া নয়–এ যেন কিছু একটা দেখে আতঙ্কে আর্তনাদ করে ওঠার মতো।

আশ্চর্য! কুকুরগুলো এত রাত্রে এই গলির মধ্যে এমন কী দেখল যে ভয়ে অমন করে ডাকছে!

তাড়াতাড়ি উঠে আলো জ্বেলে জানলা দিয়ে মুখ বাড়ালাম। আলো আর সেই সঙ্গে পরিচিত মুখ দেখে কুকুরগুলো শান্ত হলো।

পরের দিন পাড়ার লোকদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তাঁরা রীতিমতো ভয় পেয়ে গেছেন। আজ দিন দশ-পনেরো ধরে প্রতি রাত্তিরেই নাকি কুকুরগুলো ঐরকম বীভৎস সুরে ককিয়ে ককিয়ে ডাকে। কেন যে অমন করে ডাকে কে জানে! নিশ্চয় ভয়ানক কিছু দ্যাখে, কিন্তু সেটা কী বস্তু?

আমি বুঝলাম, অন্য দিনের ডাক আমি শুনতে পাইনি।

আমার ঘরটা পুরনো, ভাঙাচোরা। রাতের বেলা আরশোলা, উচ্চিংড়ে প্রভৃতি নানারকম পোকামাকড় ওড়ে। মাকড়সাগুলো তো রীতিমতো ঘরবাড়ি বানিয়ে ফেলেছে।

কি একটা জিনিস যেন পড়ে গেল–সেই শব্দে হঠাৎ গভীর রাত্রে ঘুম ভেঙে গেল। আলো জ্বেলে দেখি আলমারির গায়ে ছাতাটা ঝুলিয়ে রেখেছিলাম, সেটা পড়ে গেছে। আর অমন ধীর শান্ত বেড়ালটা হঠাৎই বীর বিক্রমে বাইসনের শিং ধরে ঝুলছে।

শুধু ঝোলাই নয়, তার দুটো থাবা থেকে সরু সরু আটটা বাঁকানো তীক্ষ্ণ নখ বের করে বাইসনের মুখটা আঁচড়াচ্ছে।

নিশ্চয় দেওয়ালে পোকামাকড় ধরবার জন্যে লাফাতে গিয়ে বাইসনের শিং-এ আটকে গিয়ে ঝুলছে–তা বলে নেপাল থেকে কেনা আমার অমন শখের বাইসনটার মুখ আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত করে দেবে?

আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। উঠে, হাতের কাছে আর কিছু না পেয়ে ছাতাটা তুলে নিয়ে বেড়ালটাকে দু-চার ঘা দিয়ে ঘর থেকে দূর করে দিলাম।

পরের দিন ঘুম থেকে উঠেই চোখ পড়ল বাইসনের মাউন্ট করা মুখটার দিকে। হতভাগা বেড়ালট্রা মুখটাকে একেবারে নষ্ট করে দিয়েছে। একে বীভৎস মুখ, তার ওপর বেড়ালের নখের আঁচড়ে আঁচড়ে এখন ভয়ংকর হয়ে উঠেছে।

বাইরে থেকে নেপালে যারা বেড়াতে যায় তারা যে শুধু ইমপোরটেড গুম্স অর্থাৎ বিদেশী জিনিসপত্তর, যেমন ছাতা, টর্চ, সেটিরেজার, লাইটার, রেকর্ড-প্লেয়ার কেনে তা নয়, কিউরিও থেকেও দুষ্প্রাপ্য পুরনো আমলের জিনিস কেনার দিকেও ঝোঁকে।

নেপালে যে হোটলে ছিলাম সেখানে সবার মুখেই শুনলাম, এখানে কোথাও বাইসনের মাউন্ট করা শিংসুন্ধু মাথা পাওয়া যায়। দুর্দান্ত জিনিস। ভক্তপুরে নেয়ার রাজাদের ঘরে নাকি বহুকাল ছিল। তারপর এখন নেপালের কিউরিও সপে তার গতি হয়েছে।

কিন্তু কোন কিউরিওর দোকানে পাওয়া যায় তা সঠিক কেউ জানে না।

জিনিসটা যে কী, কেনই বা দুর্দান্ত, কিসের জন্যেই বা লোকের এত আকর্ষণ কিছুই জানি না। শুধু ওটা কেনার জন্যে পাগল হয়ে উঠলাম। নানা মঠ, মন্দির, প্যাগোজ দেখতে দেখতে একদিন একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে ভক্তপুরে চলে এলাম।

ভক্তপুর নাম থেকেই বুঝতে পারা যায় এক সময়ে জায়গাটায় ভক্তরা থাকতেন। তাঁরা হিন্দু কি বৌদ্ধ তা জানি না। তবে কাছাকাছি হিন্দুদের অনেক পুরনো মন্দির দেখতে পেলাম।

ভক্তপুর জায়গাটা নেপালের রাজধানী কাঠমাণ্ডু থেকে পুব দিকে আট মাইল দূরে। এখানেই এক সময়ে দুশো বছরেরও আগে নেয়ারি রাজারা বাস করতেন। তাদের রাজপ্রাসাদ এখনো আছে।

ঘুরতে ঘুরতে এখানে একটা কিউরিওর দোকান পেলাম। ভেতরে ঢুকে দেখি, নানারকমের পুরনো পুঁতির মালা, রুদ্রাক্ষের মালা, কারুকার্যকরা বড়ো বড়ো ছোরা, দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখার জন্যে ভীষণদর্শন মুখ, এমনি অনেক জিনিস রয়েছে। আমি কৌতূহলী হয়ে এদিক-ওদিক কিছু খুঁজছি দেখে দোকানি জিজ্ঞেস করল কী চাই?

আমি একে বিদেশী, তার ওপর এদেশের কিছু জানি না–সসংকোচে বাইসনের শিং-এর কথা জিজ্ঞেস করলাম।

দোকানদার আমার মুখে বাইসনের শিং-এর কথা শুনে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, আপনি কিনবেন?

এমনভাবে বলল যেন ও জিনিস কেনার অধিকার আমার নেই।

বললাম, দামে পোষালে আমি কিনব। অর আগে জিনিসটা দেখতে চাই।

লোকটি তখন একজন কর্মচারীর হাতে একগোছা চাবি দিয়ে আমাকে কোথাও নিয়ে যেতে বলল।

দোকান থেকে বেরিয়ে গলি-পুঁজি দিয়ে শেষে একটা বিরাট প্রাসাদের মন্ত কাঠের দরজার কাছে লোকটা এসে দাঁড়াল। এ চাবি ও চাবি দিয়ে গোটা পাঁচেক দরজা খুলে শেষে সুন্দর একটা সাজানো-গোছানো ঘরে এনে দাঁড় করাল।

ঘরটি পুরনো কালের রাজা-রাজড়াদের জিনিসপত্রে ভর্তি। রাজসিংহাসন, রাজার মাথার ছাতা, বিরাট ঢাল, বাঁকা তরোয়াল, গোলাপপাস, আতরদান, ঝাড়লণ্ঠন এমন কত কী! হঠাৎ লক্ষ্য পড়ল দেওয়ালে টাঙানো রয়েছে বিরাট এক মোষের মাথা। দেখেই বুঝলাম এইটেই সেই বাইসন!

বাইসন হচ্ছে আমেরিকার এক জাতীয় বুনো মোষ। মোষ যে এরকম ভয়ংকর হয় তা জানা ছিল না। চোখ দুটো লাল–যেন ক্রোধে জ্বলছে। মোটা মোটা দুটো বাঁকানো শিং।

বোঝা যায়, কোনো এককালে কোনো রাজা দুর্ধর্ষ এই জীবটিকে শিকার করেছিলেন। তারপর তাঁর এই বীরত্বপূর্ণ কীর্তিটাকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্যে গোটা মাথাটা রাসায়নিক প্রক্রিয়ার সাহায্যে যেমন ছিল তেমনি রেখে হরতনের আকারে একটা কুচকুচে কালো কাঠের ফ্রেমে মাউন্ট করে রেখেছেন। এর বিশেষত্ব হচ্ছে, শিংগুলো এমন কিছু দিয়ে রং করা যা দেখলে যে কেউ মনে করবে এটা বুঝি সোনার।

একটা কথা ভেবে আশ্চর্য হলাম–আমেরিকার বাইসনের নাগাল নেপালের রাজা পেলেন কি করে!

সে কূটতর্ক থাক। জিনিসটা দেখে আমার এত পছন্দ হলো যে টাকার মায়া না করে কিনে ফেললাম।

হোটেলে সবাই এই দুষ্প্রাপ্য মহামূল্যবান জিনিসটা দেখে ঈর্ষায় ফেটে পড়ল। শুধু হোটেলের ম্যানেজার আমায় বললেন, বাবু, এটা তো কিনলে কিন্তু রাখবে কোথায়?

বললাম, কেন? আমার ঘরে।

ম্যানেজার হেসে বললেন, এ বাইসন যে সে ঘরে থাকে না। রাজপ্রাসাদ চাই। কত জনে নিয়ে গেছে, শেষে বিনা পয়সায় ফেরত দিয়ে বেঁচেছে।

আমি কোনো উত্তর দিইনি। বুঝলাম ম্যানেজার আমায় ঠাট্টা করছে। আমার ঘর-বাড়ি যত ভালোই হোক, এ জিনিস মানাবে না।

কুসংস্কারে বা অলৌকিকত্বে আমার এতটুকু বিশ্বাস নেই। আমি ওটিকে কলকাতায় এনে আমার সেই ভাঙাচোরা ভাড়াটে ঘরে সযত্নে টাঙিয়ে রেখেছিলাম। তারপর থেকেই যে সব ছোটোখাটো ঘটনা ঘটছিল তা অস্বস্তিকর হতে পারে কিন্তু অস্বাভাবিক বা অলৌকিক বলে মনে করিনি। আজ বেড়ালটার নখের আঁচড়ে আঁচড়ে বাইসনের অমন মুখটা বিকৃত হয়ে যাওয়ায় দুঃখ পেলাম।

.

কয়েক দিন পর।

অফিস-ফেরত ওয়েলিংটন স্কোয়ারের দিকে গিয়েছিলাম সেই ভুটানিটার সন্ধানে। দেখি ওরা এ বছরের মতো পাততাড়ি গোটাচ্ছে। আমি যে লোকটির কাছ থেকে মাফলার কিনেছিলাম সে লোকটিও রয়েছে। কিন্তু সে তখন তার দেশীয় লোকদের সঙ্গে কি একটা বিষয় নিয়ে দুর্বোধ্য ভাষায় এমনই তর্ক করছিল যে আমায় দেখে লজ্জা পেল। আমি কিছু বলার আগেই সে ইশারায় আমায় বাড়ি চলে যেতে বলল। একটু পরে সে নিজেই গিয়ে টাকা নিয়ে আসবে।

তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। তার ওপর লোডশেডিং। শেষ মাঘে হঠাৎ শীতটা যেন আঁকিয়ে বসেছে। সর্বাঙ্গে চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে অন্ধকার গলির মধ্যে দিয়ে সাবধানে হেঁটে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। পকেট হাতড়ে চাবি বের করে তালা খুললাম। সঙ্গে সঙ্গে গা-টা কেমন যেন ছমছম করে উঠল। এমন তো কোনদিন হয় না।

আমি চৌকাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে জুতোটা খুললাম। দু হাতে দরজার দুটো পাল্লা ছড়িয়ে দিলাম। এবারে অন্ধকারে মেঝেতে পা ফেলতেই যে দৃশ্য দেখলাম তাতে আমার হৃৎপিণ্ডটা লাফিয়ে উঠল। মেঝেতে সাদা মতো কি একটা পড়ে আছে। আর তার সামনে দুটো জ্বলন্ত চোখ। শুধু জ্বলন্ত নয়, জীবন্ত।

সেই জীবন্ত চোখ দুটো যেন অন্ধকারের মধ্যেও আমাকে চেনবার চেষ্টা করছে।

আমি ভয়ে চিৎকার করতে গেলাম। কিন্তু স্বর বেরোল না। আমার মাথা ঘুরতে লাগল, পা টলতে লাগল। বুঝতে পারলাম আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলছি…আর ঠিক সেই সময়েই কে যেন বাইরে থেকে ডাকলবাবুজি।

কেমন করে তারপর দশ-পনেরো মিনিট কেটেছে জানি না। হঠাৎই দেখলাম কারেন্ট এসে গেছে। আর ভুটানি লোকটি একদৃষ্টে মেঝের ওপর লক্ষ্য করছে। বেড়ালটা রক্তাক্ত অবস্থায় মরে পড়ে আছে–তারই পাশে বাইসনের শিংসুষ্ঠু মাথাটা কাঠ থেকে খুলে পড়েছে।

ভুটানি জিজ্ঞেস করল, বাবুজি, এ জিনিস কোথায় পেলেন?

দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে দাঁড়িয়ে ক্লান্তস্বরে সব ঘটনাই বললাম।

ও বলল, বাবুজি, এ জিনিস ঘরে রাখবেন না।

বললাম, কি করব?

সে বলল–আমি ব্যবস্থা করব। তবে এখন নয়, রাত বাড়লে। আর বাবু, আজকের রাতটা আপনি এখানে থাকবেন না। আমি একাই থাকব।

অগত্যা প্রাণের দায়ে এক অচেনা অজানা ভুটানির হাতে ঘর ছেড়ে দিয়ে আমি এক আত্মীয়ের বাড়ি চলে গেলাম।

পরের দিন সকালে এসে দেখি ঘরের সামনে লোকের ভিড়। বাড়িওলা ভোরে উঠে দেখেন ঘর খোলা অথচ আমি নেই। বুঝলেন চোর এসেছিল। তারপরই লোক ডাকাডাকি করেছেন। আমায় দেখে তিনি ব্যস্ত হয়ে বললেন, কি মশাই! কাল কোথায় ছিলেন? এদিকে

আমি সব কথাই চেপে গেলাম। শুধু বললাম, বিশেষ দরকারে কাল রাত্তিরে এক আত্মীয়ের বাড়ি থাকতে হয়েছিল।

দেখুন দেখি। আর সেই সুযোগেই চোর এসে হানা দিল। কুকুরগুলোও ডাকল না মশাই! আশ্চর্য!

ঝড়িওলা আলাদা ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন, কি কি জিনিস চুরি গেছে, ঠাণ্ডা মাথায় একটা লিস্ট করে ফেলুন। থানায় জানাতে হবে তো। বলে তিনি শশব্যস্তে ওপরে চলে গেলেন।

লিস্ট করার দরকার হয়নি। কেননা আমি ভালো করে দেখেছি, কিছুই চুরি যায়নি। যাবার মধ্যে গেছে বাইসনের শিংওয়ালা মাথাটা আর নিখোঁজ সেই ভুটানি লোকটি।

তাকে ধন্যবাদ সে আমাকে বাঁচিয়ে দিয়ে গেল।

.

.

নিষেধ

কেন যে হঠাৎ সুদূর দিল্লি থেকে মধুপুরে মিসেস অ্যান্টনিকে চিঠি লিখে বসলাম সে কথাটা ভেবে আশ্চর্য হয়ে যাই।

লিখলাম–দিন দশেকের জন্যে নদীর ধারে মিস্টার গুহর সেই বাড়িটা ভাড়া পাওয়া যাবে কি?

উত্তর সঙ্গে সঙ্গেই পেলাম। মিসেস অ্যান্টনি লিখছেন–চেঞ্জে আসবে তো? তা ওটা কেন? ভালো বাড়ি আমার হাতেই আছে। মিস্টার গুহর বাড়িটা সংস্কারের অভাবে প্রায় অব্যবহার্য হয়ে গেছে।

উত্তরে লিখলাম–ঠিক চেঞ্জে যাবার জন্যে নয়। ঐ বাড়িটার সঙ্গে আমাদের পরিবারের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। হঠাৎই বাড়িটা একবার দেখতে ইচ্ছে করছে। আপনি অনুগ্রহ করে জানান কত ভাড়া লাগবে। টাকাটা পাঠিয়ে দেব। আর বাড়িটা মোটামুটি বাসোপযোগী (অন্তত একটি ঘর–কেননা আমি একাই যাব) করতে যা খরচ লাগবে তাও পাঠিয়ে দেব। তবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্যবস্থা করবেন। আমি আবারও বলছি–হঠাৎই যাবার খেয়াল হয়েছে। দেরি হলে হয়তো মত বদলে যাবে।

মিসেস অ্যান্টনিদের সঙ্গে আমাদের পরিবারের যোগ অনেক দিনের। আমরা যতবারই মধুপুর চেঞ্জে গিয়েছি, মিসেস অ্যান্টনিই বাড়ি ঠিক করে দিতেন। গুহসাহেবের বাড়িটাই আমাদের বেশ পছন্দ হয়েছিল। নদীর ধারে বাড়িটা। লোকের কোলাহলও নেই। শান্ত পরিবেশ। বাড়িটাও বেশ বড়ো। অনেকগুলো ঘর। চারিদিক ঘিরে বিরাট কম্পাউন্ড। তার অনেকটাই ঝোপজঙ্গলে ভর্তি হয়ে থাকত। গুহসাহেব কলকাতায় থাকেন। এখানে বড়ো একটা আসেন না। বাড়িটা দেখাশোনার ভার মিসেস অ্যান্টনিকেই দিয়ে রেখেছেন।

আগেই বলেছি, এ বাড়িতে আমরা সপরিবারে অনেকবার এসেছি। মাঝে কয়েক বছর আসা হয়নি। শেষ এসেছিল শুধু দিদি আর জামাইবাবু অসীমদা। মাসখানেক ছিল। তারপর কী যে হয়ে গেল! আর কেউ এমুখো হতে চায় না। মধুপুরের কথা উঠলেই বাবা গম্ভীর হয়ে যান। মা নিঃশব্দে চোখের জল ফেলে। আমিও ঠিক করেছিলাম আর কখনও এখানে আসব না। ব্যস! মধুপুরের সঙ্গে সব সম্পর্ক শেষ। তারপর হঠাৎই কী হলো, মধুপুরে সেই বাড়িতে যাবার জন্যে মনটা ছটফট করে উঠল।

টাঙ্গা থেকে যখন বাড়িটার সামনে নামলাম তখন শীতের বেলা মিইয়ে এসেছে। মাঘের শীত বেশ জেঁকে বসছে। মিসেস অ্যান্টনি হাসতে হাসতে ওঁর বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। আমাদের সকলের কুশল সংবাদ নিয়ে চাবিটা দিয়ে বলে গেলেন–জলটল সব রেডি আছে। হাতমুখ ধুয়ে নাও। চা পাঠিয়ে দিচ্ছি।

গেট ঠেলে কম্পাউন্ডের মধ্যে ঢুকলাম। এই সেই বাড়ি। তাহলে আবার এখানে আসতে হলো।

তখন সূর্য ডুবছে। বাড়ির সামনে দীর্ঘ ইউক্যালিপ্টাস গাছের মাথায় পড়ন্ত সূর্যের ম্লান আলো। এমনি পড়ন্ত রোেদ এর আগেও এই বাড়িরই কার্নিসে কার্নিসে, টানা বারান্দার পশ্চিমদিকের মেঝের ওপর কতবার দেখেছি। কিন্তু এমন মনকেমন-করা ভাব কখনো হয়নি।

তালা খুলে ঘরের মধ্যে ঢুকলাম। এটাই এবার আমার বেডরুম। কিছু কিছু প্লাস্টারের কাজ হয়েছে, হোয়াইট ওয়াশও হয়েছে। জানলায়, দরজায় নতুন ছিটকিনি লাগানো হয়েছে। একটা চৌকিরও ব্যবস্থা হয়েছে দেখে খুশি হলাম। বিছানাপত্তরও নিশ্চয় মিসেস অ্যান্টনিই দিয়েছেন। ঘরের কোণে জলভর্তি কুঁজোটি পর্যন্ত।

একটু পরে মিসেস অ্যান্টনির বাড়ি থেকে ডিমের ওমলেট, দু-স্লাইস পাঁউরুটি আর চা এল। খুবই খিদে পেয়েছিল। তাড়াতাড়ি প্লেটটা টেনে নিলাম।

দুবেলা খাওয়ার ব্যবস্থাও মিসেস অ্যান্টনির বাড়ি। কাজেই শুধু উদ্দেশ্যহীন বেড়ানো আর মিসেস অ্যান্টনির বাড়ি আড্ডা দেওয়া ছাড়া আমার আর অন্য কাজ ছিল না।

দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ কেটে গেল। কোনো অসুবিধে নেই। অত বড়ো বাড়িতে একা থাকি, তাতেও ভয় পাই না। কিন্তু একটা কথাই বারে বারে মনে হচ্ছিল–কেন হঠাৎ এলাম? এমন কি আমার আসার খবর পর্যন্ত দেশের বাড়িতে জানাইনি। জানাইনি তার প্রধান কারণ–কেন এলাম তা তো পরিষ্কার করে কাউকে বোঝাতে পারব না।

সাত দিন কেটে গেল। আর মাত্র তিন দিন থাকব। কিন্তু আমার কেবলই মনে হচ্ছিল আমার এই আসাটা একেবারে নিরর্থক নয়, নিশ্চয় কিছু একটা ঘটবে। কিন্তু কী ঘটতে পারে সে সম্বন্ধে আমার কোনো ধারণাই ছিল না।

মিসেস অ্যান্টনির বয়স হয়েছে। ছেলে, ছেলের বৌ, নাতি-নাতনি নিয়ে তাঁর বেশ বড়ো সংসার। ওঁদের বাড়ি গেলেই মিসেস অ্যান্টনি পুরনো দিনের কথা তোলেন। জিজ্ঞেস করেন–মা কেমন আছেন, বাবার বয়েস কত হলো, হাঁটাচলা করতে পারেন কিনা। তারপরেই স্মৃতি হাতড়িয়ে জিজ্ঞেস করেন–তুমি বোধহয় এখানে লাস্ট এসেছিলে যখন তোমার দিদি-জামাইবাবু এখানে ছিলেন।

কথাটা এড়িয়ে যাবার জন্যে সংক্ষেপেই উত্তর দিই।

–তোমার জামাইবাবু মানুষটাও বেশ ভালোই ছিলেন। যেমন হ্যান্ডসাম চেহারা, তেমনি হৈচৈ করতে ভালোবাসতেন।

বললাম–অসীমা সত্যিই খুব চমৎকার মানুষ। আমি তো যে কদিন এখানে ছিলাম–

বাধা দিয়ে মিসেস অ্যান্টনি বললেন–তবে উনি বোধহয় একটু ক্রেজি টাইপের ছিলেন।

–ক্রেজি! অস্বাভাবিক প্রকৃতির? না-না

–আমি দুঃখিত। ক্রেজি বলাটা আমার ঠিক হয়নি। আসলে কিছু কিছু ছেলেমানুষি ছিল।

আমি হেসে বললাম যত বয়স্কই হোক না কেন, সবার মধ্যেই অল্পবিস্তর ছেলেমানুষি থাকে।

–তা বলে নির্জন দুপুরে কোনো বয়স্ক মানুষ একা একা ইঁদুরের ল্যাজে দড়ি বেঁধে ঘোরায় না। বলে মিসেস অ্যান্টনি তার সামনের পড়ে যাওয়া দাঁত দুটোর ফাঁক দিয়ে হাসলেন।

বললাম–সে হয়তো দিদিকে ভয় দেখাবার জন্যে। ইঁদুর, আরশোলা, মাকড়সায় দিদির খুব ভয় ছিল।

–তোমার দিদির হার্টের ট্রিটমেন্ট জামাইবাবু করিয়েছিলেন?

 মিসেস অ্যান্টনির এই ধরনের জেরা আমার ভালো লাগছিল না। তবু একটু উঁচু গলাতেই বললাম–দিদির যে হার্টের অসুখ ছিল তা আমরাই কখনও জানতাম না।

–তা বটে। বলে মিসেস অ্যান্টনি একটু যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন।

–এই দ্যাখো না আমার অবস্থা। একদিন মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। তবে না জানা গেল আমি হাই প্রেসারের রুগী হয়ে আছি। সে থাক, তোমার সেই সুন্দরী বোনটির খবর কি? কি যেন নাম?

–আমার পিসতুতো বোনের কথা বলছেন? মিন্টু?

—হ্যাঁ হ্যাঁ। ওর বিয়ে-থাওয়া হয়েছে?

 বললাম–না, চেষ্টা চলছে।

পিসেমশাই, পিসিমা মারা যাবার পর সেই কোন ছোটবেলায় মা-ই ওকে নিজের কাছে এনে রাখে। সেই থেকে ও আমাদের সংসারেই রয়েছে। দিদির চেয়ে বেশ কয়েক বছরের ছোটো হলেও দিদি ওকে খুব ভালোবাসত। যখনই কোথাও যেত মিন্টুকে সঙ্গে নিয়ে যেত। দুই বোন ম্যাচ করে একই রকম শাড়ি-ব্লাউজ পরত। শুতোও দুজনে একসঙ্গে। এক কথায় ওরা শুধু দুবোনই নয়, যেন দুই বন্ধু। দিদির বিয়ে দিতে গিয়ে বাবা প্রায় সর্বস্বান্ত হয়ে গেছেন। এখন দুর্ভাবনা মিন্টুকে নিয়ে।

.

নটা দিন কেটে গেল। কাল চলে যাব।

মিসেস অ্যান্টনি বললেন, পুরো একমাসের ভাড়া গুনলে, আর কটা দিন থেকে যাও। এই সময়টাই তো চেঞ্জের পক্ষে ভালো।

বললাম না মাসিমা, ছুটি ফুরিয়ে গেল। কাল যেতেই হবে।

মিসেস অ্যান্টনি বললেন, এত তাড়াতাড়িই যদি যাবে তাহলে দিল্লি থেকে এত খরচ করে মাত্র দশ দিনের জন্যে শুধু শুধু এলে কেন?

কি উত্তর দেব? শুধু একটু হাসলাম। সে প্রশ্নের উত্তর আমিও তো খুঁজছি।

.

রাত তখন নটা।

শীতের রাত। এমনিতেই পল্লীটা নিঝুম। এখন এই রাত নটাতেই মনে হচ্ছে যেন একমাত্র আমি ছাড়া আর কেউ জেগে নেই। মনে হলো যেন আমি কোনো মৃতের রাজ্যে বাস করছি।

মৃতের রাজ্য কথাটা মনে হতেই গা-টা কেমন ছমছম করে উঠল। এই নদিনের মধ্যে কোনোদিনই আমার এমন ভয় করেনি। হঠাৎ আজই বা কেন এইরকম একটা বিশ্রী অস্বস্তি হচ্ছে বুঝতে পারলাম না।

আমি একটা বই পড়ছিলাম। বইটা বন্ধ করে অড়াতাড়ি শুয়ে পড়ব বলে উঠে দাঁড়ালাম। আলো নেভাবার আগে দরজাটায় ঠিকমতো খিল দিয়েছি কিনা দেখে নিলাম। জানলাগুলোও দেখে নিলাম ভেতর থেকে বন্ধ।

আলো নেভাতে যাচ্ছি হঠাৎ মনে হলো এই মুহূর্তে ঘরে আমি একা নই। এতক্ষণ ঘরের মধ্যে যে বদ্ধ বাতাসটা ছিল, হঠাৎ তার তাপমাত্রাটাও কেমন কমে গেল অস্বাভাবিক মতো। আমি শীতে কুঁকড়ে গেলাম। আর তখনই দেখলাম কেউ একজন প্রায় নিঃশব্দে আমার বিছানার দিকে এগিয়ে আসছে।

আমার সর্বাঙ্গ ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।

তারপরই যা দেখলাম তাতে একই সঙ্গে ভয়, বিস্ময়, আনন্দ আমাকে একেবারে অভিভূত করে দিল।

দেখলাম–আমার দিদি, যে কয়েক বছর আগে এই বাড়িতেই হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা গিয়েছিল, সে আমার বিছানার এক কোণে তার সেই চিরঅভ্যস্ত ভঙ্গিতে বসে রয়েছে।

দিদির সেই সুন্দর মুখখানি এক স্বর্গীয় আভায় আরও সুন্দর লাগছিল। তাকে বাড়িতে যে প্রিয় শাড়িখানি পরে প্রায় ঘোরাফেরা করতে দেখতাম সেই শাড়িখানাই পরা, তার এলো খোঁপা ঠিক আগের মতোই কাঁধের ওপর যেন ভেঙে পড়েছে।

কয়েক মুহূর্ত আমি দিদির দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমি ভুল দেখছি কিনা মেলাবার জন্যে খুবই সচেতনভাবে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ লক্ষ্য করতে লাগলাম।

না, ভুল নয়। ভুল হতে পারে না। তার যে হাতখানি কোলের উপর রাখা তা কঙ্কাল নয়, জীবন্ত মানুষেরই হাত। তার চুড়ি, বিয়ের আংটি, কানের দুল সবই ঠিক ঠিক। শুধু গলায় কালো কারের সঙ্গে পাথরের যে সকেটটা সবসময়ে পরে থাকত সেই লকেটটা নেই। আছে শুধু কালো কারটা। পরিবর্তনের মধ্যে দিদি যেন একটু মোটা হয়েছে। কেননা ওর মেরুন রঙের ব্লাউজটা গায়ে টাইট হয়ে এঁটে আছে–যেমন কালো কারটা বৈষ্ণবীদের কণ্ঠীর মতো গলার সঙ্গে লাগা।

এবার স্পষ্ট করে দিদির দিকে তাকালাম। দিদি একটু হাসল। কিন্তু বড় ম্লান সে হাসি। তারপরই স্পষ্ট দেখলাম দিদি ধীরে ধীরে হাতটা তুলে কারটা একবার চুলো, যেন খোলবার চেষ্টা করল।

–দিদি! বলে আমি চেঁচিয়ে উঠলাম। কিন্তু দিদি উত্তর দিল না।

 আমি পাগলের মতো দিদিকে ছোঁবার জন্যে ছুটে গেলাম আর তখনই আলোটা নিভে গেল। বোধহয় লোডশেডিং হলো। আমি অন্ধের মতো এগোতে গিয়ে অন্ধকারে দেওয়ালে দেওয়ালে ঠোক্কর খেতে লাগলাম। কোনোরকমে বিছানায় গিয়ে টর্চটা নিয়ে জ্বালোম। কিন্তু দিদি তখন অদৃশ্য।

.

দিল্লি যাওয়া হয়নি। পরের দিনই সোজা চলে গেলাম দেশের বাড়িতে। এত বড়ো খবরটা মা, বাবা, মিন্টুকে না দিলেই নয়। দিদির অকাল, অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর পর থেকে ওদের মানসিক অবস্থা যাকে বলে অবর্ণনীয়, তাই।

যে উত্তেজনা নিয়ে খবরটা দিতে গিয়েছিলাম, বাড়ি ঢুকেই আর একটা খবরে উৎসাটা যেন মিইয়ে গেল।

প্রথমেই দেখা বাবার সঙ্গে। বাবা হেসে বললেন, এই যে তুমি এসে পড়েছ! আজই তোমায় সুখবরটা লিখতে যাচ্ছিলাম।

যাক–তবু সুখবর।

বাবা বললেন, শেষ পর্যন্ত অসীমের সঙ্গেই মিন্টুর বিয়ে ঠিক করলাম। রীণা চলে যাবার পর থেকে এ কবছর ও তো পাগলের মতো কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত মিন্টুকেই চাইল। বলল, আমাদের সঙ্গে সম্পর্কটা বাঁচিয়ে রাখতে চায়।

সুখবর বৈকি! অসীমদার মতো ছেলে দেখা যায় না। দিদির নিতান্ত দুর্ভাগ্য–এমন স্বামী পেয়েও এক বছরের বেশি ঘর করতে পারল না। চলে গেল হঠাৎই। সেই অসীমের সঙ্গে যদি মিটার।

তবে তোমার মায়ের তেমন ইচ্ছে ছিল না। ওর যে কী অদ্ভুত ধারণা! তা যাক। এখন উনি রাজী হয়েছেন।

একটু পরে চা-জলখাবার খেয়ে সকলের সামনেই মধুপুরের ঘটনাটা হুবহু বলে গেলাম। বাবা ওঁর চিরাচরিত অবিশ্বাসী মন নিয়ে ঠাট্টার হাসি হেসে ইজিচেয়ারে গিয়ে শুলেন। কিন্তু মা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগল। আর দুচোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়তে লাগল।

তারপর যখন গলায় লকেট ছাড়া কারটার কথা বললাম তখন মা হঠাৎ চমকে উঠল।

লকেটটা ছিল না?

—না।

-কেন? শাড়ি থেকে আংটি পর্যন্ত সব রইল আর লকেটটা নেই। শুধু কারটা?

–হ্যাঁ। আর সেটাও আবার বোধহয় মোটা হবার জন্যে, গলায় আঁট হয়ে বসেছিল। দিদি একবার হাত তুলে সেটা খোলবার চেষ্টাও করল যেন–তখনই। লোডশেডিং হয়ে গেল।

–ওগো শুনছ! বলেই মা হঠাৎ কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল।

মায়ের অবস্থা দেখে বাবা চমকে উঠলেন।

~~-আমি যা ভয় করেছিলাম তাই। তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করনি, কিন্তু আজ এতদিন পর নিজে দেখা দিয়ে যা ঘটেছিল তা জানিয়ে গেল।

আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না।

মা যেন উদভ্রান্তের মতো ড্রয়ার হাতড়াচ্ছে। অনেক খুঁজে একটা ইনল্যান্ড খাম পেল। সেটা আমার দিকে ছুঁড়ে দিল।

-তোমার বাবাকে দেখিয়েছিলাম। হেসেছিল। এখন তুমি পড়ে দ্যাখো।

 চিঠিটা মধুপুর থেকে লেখা। বিশেষ কিছু নয়। শুধু কয়েক ছত্র।

–মাগো, খুব ভয় পেয়ে এই চিঠি গোপনে তোমায় লিখছি। এখানে এসে দেখছি মাঝে মাঝে ও যেন কিরকম হয়ে যায়–বিশেষ গভীর রাতে। আমায় কিরকম ভয় দেখায়। আমি প্রথম প্রথম ভাবতাম মজা করছে। কিন্তু কাল রাত্তিরে যা করল–কোথা থেকে একটা বেড়াল ধরে এনে তার গলায় ফাঁস

আর লেখা হলো না। ও আসছে।…

অর্ধেক লেখা চিঠিটা পড়েই আমার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। মনে পড়ল মিসেস অ্যান্টনির কথা।–নির্জন দুপুরে অত বড় মানুষটা ইঁদুরের ল্যাজে দড়ি বেঁধে ঘোরাত। তবে কি

মা বললে, তখনই বলেছিলাম পোস্টমর্টেম করাও। কিন্তু তোমরা কেউ শুনলে না। আমি মা বলেই তার সব কথা বুঝতে পেরেছিলাম। আমার একটা মেয়ে গেছে, আর একটাকে কিছুতেই যেতে দেব না।

সেদিনই বাবা সম্মতি জানিয়ে অসীমদাকে চিঠি লিখে রেখেছিলেন। শুধু পোস্ট করার অপেক্ষা। মায়ের ওপর রাগ করে বাবা চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলে দিলেন।

.

 দিল্লি ফিরে এসেছি।

মাস কয়েক পর কাগজে একটা খবর পড়ে চমকে উঠলাম। কলকাতায় কোন এক অসীম চৌধুরীকে পুলিশ খুনের অপরাধে গ্রেপ্তার করেছে। সে

নাকি তার নব বিবাহিতা স্ত্রীকে গলায় কালো কারের ফাঁস লাগিয়ে হত্যা করেছে। হত্যার কারণ জানা যায়নি। ছবিটাও দেখলাম। এ আমারই অতি প্রিয় জামাইবাবু।

আজ এক এক সময় ভাবি, মিন্টুর সঙ্গে যাতে বিয়ে না হয় সেই কথাই কি দিদি সেদিন রাত্তিরে ইঙ্গিতে জানিয়ে গেল? সেই কথা তাড়াতাড়ি জানাবার জন্যেই কি অদৃশ্য এক শক্তি সুদূর দিল্লি থেকে আমায় মধুপুরে টেনে নিয়ে গিয়েছিল?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *