অভিশপ্ত ৩৭

অভিশপ্ত ৩৭

০১.

সামনের মে মাসে আমার সাঁইত্রিশ বছর পূর্ণ হবে। এ কথা মনে করতেই ভয়ে গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে। একটা অজানা ভয়ে গায়ে কাঁটা দেয় তার কারণ এই নয় যে, কোনো জ্যোতিষী আমার হাত দেখে মে মাসে আমার বিপদের কথা জানিয়েছেন। অন্তত আমার তা মনে পড়ে না। তবে

তবে আমার পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছর বয়েসের সময় থেকেই খুব অস্পষ্ট কিছু কিছু যেন চোখের সামনে ভেসে উঠতে চায়। যেমন–নির্জন দুপুরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সামনের দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে অনেক অনেক দিন আগের কথা ভাবতে ভাবতে হঠাৎ সাদা দেওয়ালে ভেসে ওঠে অস্পষ্ট একটা মানুষের চেহারা। সেই চেহারার মধ্যে গোটা মানুষটাকে বোঝা না গেলেও তার নাক চোখ মুখের গঠন যে বিকটাকৃতি ছিল তা বুঝতে অসুবিধে হয়নি। সেই মূর্তি হাত তুলে কাকে যেন কিছু বলছে। যাকে বলছে তার ছায়া এতটা অস্পষ্ট যে কিছুই বোঝা যায়নি।

দেওয়ালে সেই বীভৎস ছায়ামূর্তি দেখার পর থেকে আমার যেন কিছু মনে পড়তে লাগল। কিন্তু তা খুব অল্পক্ষণের জন্য। ফেনার বুদ্বুদ যেমন বাতাসে ভাসতে ভাসতে যায়, সেই রকমই মুহূর্তের জন্যে চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা বাড়ি। তারপরেই সেটা সরে যায়। দেখা দেয় একটা মৃতপ্রায় রোগী। সেই রোগী ভয়ে চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে খোলা জানলার দিকে। মৃতপ্রায় রোগীটি কী দেখছিল জানলা দিয়ে? ঘরে। একটা লণ্ঠন জ্বলছে। তারপরেই ভোজবাজির মতো সব অদৃশ্য।

যেসব কথা বললাম তা কিন্তু স্বপ্ন নয়। একটুও বানিয়ে বা বাড়িয়ে বলা নয়। যেটুকু দেখেছিলাম তাই লিখলাম। কিন্তু তার সঙ্গে আমার জন্মমাসের কী সম্পর্ক? ভয়ের কারণই বা কী ভেবে পাই না।

তারপর আমি পরের ঘটনাগুলো মনে করবার অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু কাছিম যেমন মাঝে মাঝে তার শক্ত ভোলা থেকে একবার মুখ বার করেই খোলের মধ্যে আবার ঢুকিয়ে নেয়, তেমনি আমার স্মৃতিগুলোও একবার ফিরে এসেই পরক্ষণে দূরে মিলিয়ে যায়। মহা মুশকিল। জীবনের একটা সময়ে ভয়ংকর নিশ্চয় কিছু ঘটেছিল। কিন্তু কী ঘটেছিল তা আজ ঠিক মনে করতে পারি না। সেই সময়ের কটা মাস আমার কাছে একেবারে ব্ল্যাক আউট হয়ে গেছে।

এরকম হওয়ার কারণ সেই সময়ে আমি কঠিন ব্যাধিতে পড়েছিলাম। কয়েকদিন জ্ঞান ছিল না। ভগবানের দয়ায় চিকিৎসার গুণে আমি ভালো হয়ে উঠেছিলাম ঠিকই কিন্তু হারিয়ে ফেলেছিলাম আমার স্মৃতিশক্তি। অনেক চেষ্টায় স্মৃতিশক্তি ফিরল বটে কিন্তু অসুখের সময়ের স্মৃতি তেমন ফিরল না। তবে এতদিন পর এখন একাগ্র মনে ভাবতে থাকলে মাঝে মাঝে অস্পষ্ট কিছু মনে পড়ে। কিন্তু সাঁইত্রিশ বছরে পড়লেই ভয়ংকর কোনো ঘটনার মুখোমুখি হতে হবে এমন সম্ভাবনার কথা কেউ সেদিন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল কিনা তা স্পষ্ট মনে পড়ে না।

তবে কেন এই বছরে এই মে মাসটা পড়বার আগেই এত ভয়?

ভয়ের কারণ আছে।

মফঃস্বল শহর। বেশ আরামে থাকি। একলা মানুষ। এক-এক সময়ে খুব নিঃসঙ্গ লাগে– বিশেষ করে সন্ধেবেলাটা। কিন্তু কীই বা করতে পারি। ইচ্ছে করলেই তো যাকে তোক ডেকে বন্ধু পাতানো যায় না।

এ বাড়িতে আমি অনেক দিন আছি–অনেক দিন। তাই এ বাড়ির গলিঘুজি আমার নখদর্পণে। এ বাড়ির উঠোনের মাঝখানে একটা পুরোনো কুয়ো আছে। খুব দরকার পড়লে সেই জল তুলে ব্যবহার করি। জলটা ভালোই। কুয়োর গায়ে একটা নারকেল গাছ। তার পাশেই একটা পেঁপে গাছ। কুয়োতলা থেকে দুধাপ উঠলে একটা রক। একটা বাঁক ফিরে নেমে গেছে খিড়কির দরজার দিকে। বাইরে যাবার এই খিড়কির দরজাটা আমি বড়ো একটা খুলি না। ওটা খিল আঁটা থাকে।

সেদিন–সন্ধে তখনও হয়নি। পুরোনো এই বাড়িতে এরই মধ্যে অন্ধকার নেমে এসেছে। কুয়োতলার অনেকখানি তফাৎ দিয়ে যাতায়াতের যে পথটা দোতলায় উঠে গেছে, আমি সেই পথ ধরে ওপরে ওঠার জন্যে যাচ্ছি, হঠাৎ মনে হল কুয়োতলায় অন্ধকারে গা মিশিয়ে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে চুপটি করে।

নিশ্চয় চোর!

আমি চেঁচিয়ে উঠলাম–কে ওখানে?

উত্তর দিল না। তবে ধীরে ধীরে খিড়কির দরজার দিকে চলে গেল।

মরুক গে। চলে তো গেছে।

নিশ্চিন্ত হয়ে ওপরে উঠছিলাম, মনে হল–তাই তো! চলে গেলে খিড়কির দরজা খুলেই তো যাবে। তা হলে দরজাটা বন্ধ করতে হবে। আর তা করতে হবে আমাকেই।

অগত্যা সেই অন্ধকারেই কুয়োতলাটা বাঁ দিকে রেখে রকের ওপর দিয়ে এগোতে লাগলাম। কেমন যেন ভয় করছিল। হাতে একটা লাঠি পর্যন্ত নেই। খিড়কির দরজার বাঁকে যদি চোরটা দাঁড়িয়ে থাকে!

কিন্তু উপায় নেই। খিল বন্ধ করতে যেতেই হবে। পায়ে কী ঠেকল। দেখলাম একটা শাবল। পরশু দিন কুয়োপাড়ে একটা বাঁশ পোঁতবার জন্যে মাটি খুঁড়ছিলাম। ভালোই হল। সেটা তুলে নিলাম। হাতে একটা কিছু রইল।

কুয়োতলা থেকে এগিয়ে উঁচু রকটা যেখানে তিনখানা সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেছে খিড়কির দরজার দিকে–আমি সেদিকে গেলাম। এখানটায় যেন বড্ড বেশি অন্ধকার। কিন্তু উপায় কী। আমি আস্তে আস্তে এগোতে লাগলাম। কেবলই মনে হচ্ছিল অন্ধকারের মধ্যে থেকে এই বুঝি কেউ ঝাঁপিয়ে পড়বে আমার ওপর।

ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেল। তবু পালালে চলবে না। খিড়কির দরজায় খিলটা লাগাতেই হবে।

তাই অনেক চেষ্টা করে কথা বলতে গিয়ে কোনোরকমে একটা চাপা ভাঙা স্বর বেরিয়ে এল–ক্যা–? আর সেই সঙ্গে লোহার শাবলটা মাটিতে ঠুকে জানান দিলাম–জেনে রেখো আমার হাতে শাবল আছে।

যদি কেউ সাড়া দেয় তাই মিনিট দুই চুপ করে অপেক্ষা করলাম। তারপর মনে মনে জয় মা বলে এক লাফে খিড়কির দরজার কাছে।

না, কেউ কোথাও নেই।

বুঝলাম যে এসেছিল সুবিধে করতে না পেরে কেটে পড়েছে।

কিন্তু ব্যাপারটা যে এত সহজ নয় তা পরক্ষণেই খিল লাগাতে গিয়ে বুঝলাম। আর সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। দরজা তো খোলাই হয়নি। খিল তো ভিতর থেকে লাগানো।

বিশ্বাস হল না। পকেট থেকে দেশলাই বের করে জ্বালোম। যতবারই জ্বালি অমনি নিভে যায়। মন হল কেউ যেন খুব কাছে দাঁড়িয়ে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিচ্ছে। শেষে পাঁচবারের বার জ্বলল। অমনি ক্ষণিকের সেই আলোয় দেখলাম খিলটা যেমন অনেক দিন থেকে আঁটা তেমনিই আছে। কেউ খোলবার চেষ্টা মাত্র করেনি। মাকড়সার জালগুলো পর্যন্ত ছিঁড়ে যায়নি।

তা হলে কী প্রমাণিত হল?

হল এই –যাকে আমি স্বচক্ষে কুয়োতলায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম–তারপর যে গটগট করে খিড়কির দরজার দিকে এগোচ্ছিল সে কিন্তু খিড়কির দরজা খুলে বেরিয়ে যায়নি। কারণ আমি নিজের চোখেই দেখেছি খিল বাড়ির ভিতর থেকে আঁটা।

তাহলে?

তাহলে যিনি ছিলেন তিনি শরীরধারীই হন কিম্বা দেহমুক্তই হন, বাড়ির মধ্যেই কোথাও রয়েছেন। কেমন করে বাড়ির ভেতরে ঢুকেছিলেন জানি না। তবে বেরোতে পারেননি। হ্যাঁ, বাড়ির ভেতরেই কোথাও রয়েছেন!

এ কথা মনে হতেই আমার মাথাটা ঝিমঝিম্ করে উঠল। কারণ তিনি যিনিই হন, এই বাড়িতে গোটা রাত্রি তাঁর সঙ্গে থাকা যাবে না।

থাকা যাবে না বললে কী হবে? না থেকে যাব কোথায়? আর সেই তিনি যে কোথায় গেলেন পরের দিন তন্ন তন্ন করে খুঁজেও হদিস করতে পারলাম না। অগত্যা সব কিছু ভগবান আর ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে নিজের কাজকর্ম নিয়ে ভাবতে লাগলাম।

ভেবেছিলাম ঐ রকম ঘটনা আর ঘটবে না। কিন্তু

সেদিন সন্ধের সময় দোতলার ঘরে বসে লেখালিখির কাজ করছি, হঠাৎ মনে হল কেউ যেন নিঃশব্দে পিছনে এসে দাঁড়াল। শুধু দাঁড়িয়ে থাকা নয়, একদৃষ্টে যেন তাকিয়ে আছে পিঠের দিকে। সেই মুহূর্তে কী করব কিছুই ভেবে পেলাম না। উঠে পালাব সে উপায় নেই। অগত্যা টেবিলের নীচে ঘাড় গুঁজে রইলাম।

কতক্ষণ এইভাবে ছিলাম জানি না। এক সময়ে ঘাড় টন্টন্ করায় সোজা হয়ে বসলাম। জানলা দিয়ে ঠান্ডা বাতাস এল এক ঝলক, সাহস করে পিছন ফিরলাম। কেউ নেই।

এখন কেউ নেই এ কথা যেমন সত্য, তেমনি একটু আগেও কেউ যে ছিল তাও সত্য। কিন্তু কে সে? কী চায়? কেনই বা আমার কাছে এসেছিল? এইসব চিন্তা আমায় বিভ্রান্ত করে তুলল। মন হল কদিন আগে কুয়োতলায় যাকে অস্পষ্ট দেখেছিলাম সেও কি তবে অশরীরী ছিল? কী সর্বনাশ!

হঠাৎ এত কাল পর আমার বাড়িতেই এসব উপদ্রব কেন? কী চায়? এই চাওয়ার সঙ্গে এ বছর মে মাসে আমার যে বিপদের কথা–তার সঙ্গে কি কোনো সম্বন্ধ আছে?

আমি বিভ্রান্ত হয়ে পড়লাম।

 তৃতীয় যে ঘটনাটা মাত্র গতকাল ঘটল সেটা আরও সাংঘাতিক।

বিকেলে প্রায়ই আমি রাস্তায় একটা চক্কর দিয়ে আসি। খোলা জায়গায় নির্মল বাতাসে শরীর-মন জুড়িয়ে যায়। কাল আমি বাড়ির পিছনের গলি দিয়ে ফিরছিলাম। গলির বাঁ দিকে গৌর ঘোষের বিরাট নারকেল গাছের বাগান। সেই পথটুকু পার হচ্ছি হঠাৎ একটা গাছের ওপরে সরসর শব্দ হল যেন নারকেল পাতা খসে পড়ল। তারপরই হাওয়ার একটা জোর ধাক্কা। সঙ্গে সঙ্গে খুব চাপা গলায় কে যেন বলে গেল–আর মাত্র কিছু দিন। সঙ্গে সঙ্গে বাতাসও মিলিয়ে গেল।

আমি চমকে উঠলাম। প্রথমত যে ধাক্কা দিয়ে গেল তাকে দেখতে পেলাম না। হাত থেকে পেনটা পড়তে যতটুকু সময় লাগে তারও কম সময়ের মধ্যে শুধু একটা দমকা হাওয়া ঘুরপাক খেতে খেতে অদৃশ্য হয়ে গেল।

আর দ্বিতীয় যে জন্যে চমকে উঠলাম সেটা হচ্ছে কথাটা যে বলল তার গলাটা যেন চেনা চেনা অথচ কিছুতেই মনে করতে পারলাম না কার গলা। তবে এটা ঠিক, গলার স্বর যারই হোক সে অন্তত এখন জীবিত নয়।

এই শেষের ঘটনায় আমি বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম এ কদিন যে সব অস্বস্তিকর অবস্থা আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল–সত্যি, মিথ্যে, সন্দেহের দোলায় দোলাচ্ছিল এখন তার নিরসন হল। অর্থাৎ যা ছিল সন্দেহ আজ তা দূর হয়ে গিয়ে আমাকে বুঝিয়ে দিল–ব্যাপারটা নিছক মানসিক নয়। সত্যিই কিছু ঘটতে যাচ্ছে।

কথাটা আমি মনে মনেই রাখলাম। কাউকে বললাম না। বললেই নানা রকম উপদেশ, পরামর্শ যা কোনো কাজে দেবে না। তার চেয়ে বরং ভেবে দেখতে হবে গলার স্বরটা কার হওয়া সম্ভব। আর সে এমন একজন যে এখন আর পৃথিবীতে নেই।

পৃথিবীতে নেই আমার জানাশোনা এমন বহু লোক বহুদিন আগে থেকে পরলোকগামী হয়ে আছেন। তার মধ্যে থেকে ঠিক এই কণ্ঠস্বরের মালিকটিকে খুঁজে বের করা কঠিন ব্যাপার। এ তো গোয়েন্দাগিরি নয়। তবু আমাকে খুঁজে বের করতেই হবে।

কাজেই এখন আমার প্রথম কর্তব্য হল একান্তে বসে মৃত আত্মাদের বাছাই করে ফেলা।

কী ভাবে বাছাই করব?

প্রথমে যাদের কথা মনে পড়ে এমন মৃত ব্যক্তিদের একটা তালিকা করা। তারপর সেই লম্বা তালিকা থেকে দশ বছর কি তারও কিছু আগে যারা গত হয়েছে তাদের চটপট বাদ দেওয়া। কারণ এতদিনে তাদের পুনর্জন্ম হয়ে গেছে। এতে তালিকা একটু হালকা হবে।

এইভাবে মৃত আত্মাদের নামের ছাঁটকাট করা তালিকাটি নিয়ে কয়েকদিন পর নিরিবিলিতে একদিন বসলাম।

আমার বাড়ির পরিবেশ খুব শান্ত। কেননা আমি ঝাড়া-হাত-পা মানুষ। অর্থাৎ বিয়ে শাদি করিনি। আত্মীয়-স্বজনরা আমার খোঁজ-খবর রাখে না। তাই আমিও তাদের ত্রিসীমানায় ঘেঁযি না। বাড়িতে একাই থাকি। তবে সত্যি কথা বলতে কি মাঝে মাঝে বড্ড একা বোধ করি। বাড়িতেই থোক, বাড়ির বাইরেই থোক কথা বলার মানুষ চাই।

যাই হোক, সেদিন মৃত আত্মাদের তালিকা নিয়ে কাজ করতে করতে অনেক বেলা হয়ে গেল। হঠাৎ চমকে উঠলাম। কেউ একজন আমার বসার ঘরে ঢুকে পড়ার পর বলল, আসব স্যার?

.

০২.

 তাকিয়ে দেখি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে উনিশ-কুড়ি বছরের একটি ছেলে দাঁত বের করে বোকার মতো হাসছে। প্রথম দর্শনে অবাক হয়েছিলাম। কেমন যেন চেনা চেনা মুখ। অনেক দিন আগে কোথায় যেন দেখেছি। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারলাম না।

বললাম–কী চাই?

ও কিছুমাত্র সংকোচ ন! করে বলল-ভাত খাব।

বলে একটু সলজ্জ হাসল।

আমি তখন ওকে বসিয়ে ওর খবরাখবর নিলাম। নাম নকুল। ওর মা-বাবা যখন মারা যায় তখন ওর বয়েস বারো। বাধ্য হয়ে ও ওর মামার কাছে চলে আসে। মামী প্রথমে এই বয়েসের পরের ছেলের দায়িত্ব নিতে চায়নি। শেযে মামা-মামী দুজনে ঠান্ডা মাথায় পরামর্শ করে ঠিক করল বাজার-দোকান করা, জল ভোলা, বাড়ি-ঘর পরিষ্কার করার মতো ভারী কাজগুলো একে দিয়ে করিয়ে নিলে মাইনে দিয়ে আর লোক রাখতে হবে না।

এই সুবুদ্ধি মাথায় উদয় হতেই মামা-মামী নকুলকে ঠাই দিলেন।

কিন্তু এই সুখ বেচারির বেশিদিন সইল না। মামা-মামীর নির্মম অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে পালিয়ে বাঁচল। তারপর নানা জায়গা ঘুরে খেয়ে, না-খেয়ে, অর্ধাহারে খোলা আকাশের নীচে দিনের পর দিন শুয়ে শেষে একদিন এখানে এসে হাত জোড় করে দাঁড়াল।

ওর কথা শুনে কেমন যেন মায়া হল। বললাম–শোনো, আমার বাড়িতে রাঁধার কেউ নেই। আমি নিজেও রাঁধতে পারি না। হোটেলে খাই। কাছেই হোটেল। তুমি ওখান থেকে খেয়ে নাও। বলে একটা দশ টাকার নোট আর কিছু খুচরো টাকা দিলাম। ও ফের হাত জোড় করে নমস্কার করে চলে গেল।

ভেবেছিলাম একেবারেই চলে গেছে। কিন্তু ঘণ্টাখানেক পরেই সে এসে হাজির। তাকে দেখে বেশ তৃপ্ত বলে মনে হল। বললাম, খেয়েছ?

ও ফের হাত জোড় করে বলল, অনেকদিন পর মাছভাত খেলাম। তিনবার ভাত নিলাম। বলে হাসতে লাগল।

বললাম, পেট ভরেছে তো?

হ্যাঁ–বলে মাথা দোলাল।

তারপর প্যান্টের পকেট থেকে তিনটে টাকা বের করে আমার টেবিলে রাখল। আমি অবাক হয়ে তাকালাম। ও বলল, এ টাকাটা লাগেনি।

তাই ফেরত দিচ্ছ?

 আমার যতটুকু লাগার তাই নিয়েছি।

বললাম, টাকা তিনটে তুমি রাখো।

ও যেন কৃতার্থ হল। টাকা তিনটে তুলে নিয়ে হঠাৎ আমায় প্রণাম করল। বলল, আপনার এই দয়া যতদিন বাঁচব ততদিন মনে রাখব। বলে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। জিগ্যেস করলাম, কোথায় যাবে এখন?

জানি না স্যার। এ বেলা যা খেয়েছি তাতে দুদিন না খেলেও চলবে। আর শোওয়া? রাস্তার ধারে খোলা রক তো কতই পড়ে রয়েছে।

চলে যাচ্ছিল, ডাকলাম, শোনো।

 ও ফিরে দাঁড়াল।

তুমি আমার কাছে থাকবে?

ও কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর অস্ফুটস্বরে বলল, আমায় বলছেন, স্যার?

হ্যাঁ, তোমাকেই বলছি।

ও তবু যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। বলল, আমি এই বাড়িতে থাকব! দুবেলা খেতে পাব?

হেসে বললাম, হ্যাঁ, তাই।

আমায় কী করতে হবে?

কিচ্ছু না। তুমি চা করতে পার?

তা আর পারি না? কত চায়ের দোকনে তো কাজ করলাম।

তাহলে তো ভালোই। তোমার কাজ হবে আমার সঙ্গে গল্প করা। আর মাঝে মাঝে চা করে খাওয়ানো। আর একটা কাজ–আমার কিছু ধানজমি আছে। সাইকেল আছে। মাঝে মাঝে গিয়ে একটু দেখাশোনা করা।

নকুল এবার আর কোনো কথা বলতে পারল না। হঠাৎ ছেলেমানুষের মতো আনন্দে একটা পাক খেয়ে নিল। সেই থেকে নকুল হয়ে গেল আমার সঙ্গী।

নকুলকে পেয়ে আমার সুবিধেই হয়েছে। কথায় বলে, একা না বোকা! তা সত্যি একা থাকলে কেমন ভয় ভয় করে। তাছাড়া যত উদ্ভট অবাস্তব কল্পনা মাথায় খেলে বেড়ায়।

হ্যাঁ, উদ্ভট ভাবনা। নকুল আসার পর থেকে সেই পরলোকগত আত্মাগুলির নাম-পরিচয় বাছাই করার মতো পাগলামি বন্ধ ছিল। সেই অদৃশ্য আত্মাটিও আর উৎপাত করেনি। করবেই বা কী করে? চিরকালই তো শুনে আসছি একের বেশি মানুষ থাকলে আত্মাটাত্মা কাছে ঘেঁষে না। এই কথা ভেবে নিশ্চিন্ত আছি।

নকুল বেশ স্বচ্ছন্দেই আছে। বাড়ির সব কাজই করে। বলতে হয় না। তবে একটু বেশি উৎসাহী। তড়বড় করে ঝুল ঝাড়তে গিয়ে সেদিন একটা ছবির কাচ ভেঙে ফেলল। এসব ব্যাপারে সে মোটেই লজ্জিত নয়। আমিও কিছু বলি না। তবু তো বাড়িতে একটা সচল প্রাণী নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে।

প্রতিদিন ও কী দোকান-বাজার করল তার একটা ফর্দ দেয়। দুজন মানুষের সামান্য খরচ। তবু ও বোধ হয় নিজের সতোর প্রমাণ দেবার জন্যে নিজেই ফর্দ দেয়। আমি মোটামুটি চোখ বুলিয়ে নিয়ে হিসেব বুঝে নিই। একদিন দেখলাম ফর্দের তলায় লেখা ইঁদুর মারার ওষুধ।

আমার বাড়িটা পুরোনো হলেও আজ পর্যন্ত সাপ, বিছে, ব্যাঙ, ইঁদুরের উৎপাত হয়নি। তা হঠাৎ ইঁদুরের এমন উৎপাত হল–কী ব্যাপার?

আমি নকুলকে ডেকে জিগ্যেস করলাম, হঠাৎ ইঁদুর মারার ওষুধ? বাড়িতে ইঁদুর দেখা যাচ্ছে নাকি?

ও ওর স্বভাবমতো মাথা চুলকে বলল, আজ্ঞে না। ইঁদুর দেখা যায়নি বটে কিন্তু মাটি তুলছে খুব।

মাটি তুলছে মানে?

প্রায়ই দেখছি এখানে-ওখানে শুকনো মাটি পড়ে। কত পরিষ্কার করি বলুন তো?

বললাম, ইঁদুর মারার ওষুধে যদি মাটি ভোলা বন্ধ হয় তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু তুমি যা বলছ এখানে-ওখানে মাটি উঠেছে তাহলে তো অনেক গর্ত। গর্তগুলো দেখেছ তো?

নকুল বলল, ইঁদুর মারার ওষুধ খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে দিলেই কাজ হয়। গর্তের খোঁজ করতে হয় না!

নকুল জিগ্যেস করল, তা হলে ইঁদুর মারার ওষুধ কিনব তো?

 বললাম, না কিনে তো উপায় নেই।

ওষুধ কেনা হল। নকুল বঁট দিয়ে ইঁদুরের মাটিগুলো সাফ করে দিল।

তারপর সে ইচ্ছেমতো রুটির সঙ্গে হঁদুর মারার বিষ মিশিয়ে এমন করে যেখানে-সেখানে ছড়িয়ে দিল যে আমাকেই সাবধানে বারান্দায় চলাফেরা করতে হল। নকুল সদাজাগ্রত প্রহরীর পাহারা দিতে লাগল কখন ইঁদুর সেই রুটি খাবে। কিন্তু একটিও মরা ইঁদুর দেখা তো দূরের কথা, ধেড়ে ইঁদুর, নেংটি ইঁদুরও রুটি খেতে এল না।

শেষ পর্যন্ত নকুল হতাশ হয়ে বলল, ইঁদুরগুলোও এখন সেয়ানা হয়ে গেছে দাদা। অত রুটি ছড়িয়ে রাখলাম একটা ইঁদুরও ত্রিসীমানায় ঘেঁষল না।

বললাম, না ঘেঁষুক। মাটি উঠলে ঝাঁট দিয়ে ফেলে দিও। তা হলেই হবে।

নকুল কথা বাড়াল। চলে গেল।

মেঝেতে আর মাটি উঠেছিল কিনা জানি না, ও বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই, তবে নকুল আর ঐ নিয়ে আমার কাছে ঘ্যানঘ্যান করেনি। কিন্তু লক্ষ করছি ও যেন দিন দিন কেমন গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে। কথাবার্তা কম বলছে। ও কি কোনো কারণে আমার ওপর রাগ করেছে? জানি না। রাগ করার তো কোনো কারণ নেই। সকলেই জানে আমি কথায় বার্তায় খুব সংযত। কাউকে রূঢ় কথা কখনও বলি না।

একদিন আর থাকতে না পেরে ওকে ডেকে জিগ্যেস করলাম, নকুল, তোমার কি কিছু হয়েছে?

নকুল গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে জানাল, না।

 তাহলে এত গম্ভীর কেন?

ও চুপ করে রইল।

 বললাম, শরীর খারাপ?

 ও আগের মতো মাথা নেড়ে জানাল, না।

 তবে মন খারাপ?

এবার নকুল মাথা নাড়তে নাড়তে ভেতরে চলে গেল।

এই এক নতুন ভাবনা শুরু হল। নকুলের যে কিছু হয়েছে তা স্পষ্ট বুঝতে পারছি। কিন্তু কী হয়েছে তা ধরতে পারছি না। ভাবনা হল–যাও বা একটা ভালো সঙ্গী পেলাম তাও বুঝি আর টেকে না।

যাই হোক, আমি আর নকুলকে ঘাঁটালাম না; ও নিজের মতো করে যে কদিন কাজ করতে চায় করুক।

একদিন দেখলাম, দুপুরে যখন কাগজ পড়ছি, নকুল নিঃশব্দে এসে দাঁড়াল। বললাম, কিছু বলবে?

ও মুখটা করুণ করে বলল, হ্যাঁ।

অভয় দিয়ে বললাম, বলো।

ও যেন দমকা কাশির মতো বলে উঠল, দাদা, এ বাড়িটা খারাপ।

আমি চমকে উঠলাম। ও-ও কি তাহলে কিছু দেখেছে? সামলে নিয়ে বললাম, মানে?

ও নানাভাবে বোঝাতে চাইল যে, ও নাকি প্রায় সন্ধেবেলায় কাউকে ভেতর-বারান্দায় চলে বেড়াতে দেখে। যে চলে বেড়ায় তাকে ডাকলে সাড়া দেয় না। আলো নিয়ে গেলেও দেখা যায় না। নকুল নিশ্চিত যে, দেখা না গেলেও বুঝতে পারে কেউ একজন আশেপাশে রয়েছে।

সর্বনেশে কথা। আমি ভয় পেলাম। বুঝলাম আগে যাকে দেখতাম সে তাহলে যায়নি। এখানেই আছে। ইদানিং আমায় দেখা দেয়নি।

ভয় পেলাম ঠিকই। কিন্তু নকুলের কাছে তা প্রকাশ করলাম না। একটু হেসে বললাম, তাই বুঝি?

উত্তরে নকুল তার বাঁ হাতের তালুতে ঘুষি মেরে আমায় বলল, আমায় ভয় দেখানো? আমি কিন্তু ছাড়ব না। এবার দেখা পেলে জাপটে ধরবই।

ব্যস্ত হয়ে বললাম, ও সব করতে যেও না। কী থেকে কী বিপদ ঘটে যায় তা বলা হায় না। যাকে মনে করছ আছে সে থাকুক না। সে তো ক্ষতি করছে না।

কী যে বলেন দাদা! রোজ দেখছি সন্ধে হলেই গোটা বারান্দায় দাপিয়ে বেড়ায়। সে। কি শুধু শুধু? ও আপনার ক্ষতি করবার মতলবেই এখানে আসে। হয়তো ঠিকমতো সুযোগ পাচ্ছে না। আপনি কিন্তু দাদা সাবধান হবেন।

মুখে হাসি টেনে বললাম, কী ভাবে সাবধান হব বলো?

নকুল বলল, আপনি বাড়িতেও একা থাকবেন না। আমাকে ডাকবেন। প্রেতাত্মাই হোক আর যাই হোক আমি একাই শায়েস্তা করে দেব। এই বলে ও বীরদর্পে ভেতরে চলে গেল।

মহা সংকটে পড়লাম। প্রেতাত্মাটি আবার বাড়ির মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভেবেছিলাম তিনি যেমন এসেছিলেন, আবার চলেও গেছেন। ভেবে অনেকটা নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম, কিন্তু এখন তো দেখছি নিশ্চিন্ত হবার উপায় নেই। যদিও আমার কাছে আসেননি কিন্তু নকুলকে তো দেখা দিচ্ছেন। উদ্দেশ্যটা কী? তবে কি আমার সাঁইত্রিশ বছর বয়স পূর্ণ হতে যাচ্ছে বলেই

সেদিন দেখলাম বাজার থেকে একটা মোটা লাঠি নিয়ে এসেছে। বললাম, লাঠি দিয়ে কী হবে?

ও বলল, একটা লাঠি বা বল্লম থাকা দরকার। কখন কী দরকার পড়ে

বুঝলাম দরকার তো একটাই। কিন্তু লাটি দিয়ে কি প্রেতাত্মা তাড়ানো যাবে? তা অবশ্য যাবে না কিন্তু এ অবস্থায় কী যে করি! কার পরামর্শ নিই তখনই ভেবে পেলাম না। দেখাই যাক না আর কোনো ঘটনা ঘটে কিনা–ভাবতে ভাবতেই কদিন কেটে গেল।

তারপর সেদিন–

রাত তখন ঠিক কত জানি না। ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙার পরও অনেকক্ষণ বুঝতে পারলাম না ঘুমটা কেন ভাঙল। আমার ঘরের উত্তর দিকের জানলাটা খোলাই ছিল। ওদিকে একটা বড়ো পুকুর। পুকুরের ওপারে ঘন ঝোপঝাড়। তার পিছনে বড়ো বড়ো দেবদারু গাছ। শুক্লপক্ষের বোধহয় ত্রয়োদশী। ফ্যাকাশে জ্যোৎস্না এসে পড়েছে পুকুরপাড়ের সুপুরি গাছটার পাতায়। বাতাস নেই তবু পাতাগুলো অল্প অল্প নড়ছে ঠিক যেমন মফঃস্বলে মড়া নিয়ে যাবার সময় চালিতে শোওয়ানো মৃতের মাথাটা নড়ে এদিক-ওদিক। সুপুরি গাছটার দিকে তাকিয়ে আমার গা-টা কেমন ঘুলিয়ে উঠল। এ তো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয়, অন্য কিছু।

এমনি সময়ে একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনতে পেলাম। নকুল আমার পাশের ঘরে শোয়। সেই ঘর থেকেই শব্দটা এল। নকুল কি ঘর থেকে বেরোচ্ছে? কিন্তু অত চুপি চুপি কেন?

নকুলের ঘরের দিকে খড়খড়িওলা একটা জানলা ছিল। জানলাটা বন্ধই থাকত। খোলার দরকার হত না। আমি ধীরে ধীরে বিছানা থেকে নেমে এগিয়ে গেলাম জানলাটার দিকে। নিঃশ্বাস বন্ধ করে সাবধানে খড়খড়িটা একটুখানি ফাঁক করলাম। ঘরের ভেতর গাঢ় অন্ধকার। প্রথমে কিছুই বুঝতে পারলাম না। তারপর চোখ দুটো সয়ে গেলে কিছু যেন দেখতে পেলাম। কেউ যেন অন্ধকারে নড়ছে।

কী আশ্চর্য! যে নড়ছে সে যদি নকুলই হয় তাহলে সে তো দরজার দিকে যাবে। কিন্তু এখানে চলমান বস্তুটি দরজার দিক থেকে নকুলের বিছানার দিকে যাচ্ছে। …এর মানে কী? কে যাচ্ছে অন্ধকারে গা মিলিয়ে? কোনো চোর? ডাকাত? খুনে?

সে খুব সাবধানে এক পা ফেলছে আর শব্দ হচ্ছে খট। আবার এক পা এগোচ্ছে অমনি শব্দ খট খট্‌–

এ কি মানুষের হাঁটার শব্দ? এ তো হাড়ে হাড়ে ঠোকাঠুকি! কিছু ভাববার আগেই একটা কাণ্ড ঘটে গেল।

ছায়ামূর্তিটা শূন্যে দুপা তুলে দুহাত লম্বা করে যেন প্রচণ্ড আক্রোশে জলে ডাইভ দেবার মতো নকুলের বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছে–আমি হুঁশিয়ার করে দেবার জন্যে চেঁচিয়ে উঠলাম–ন-কু-ল–

সঙ্গে সঙ্গে একটা আলমারির পেছন থেকে উদ্যত লাঠি হাতে যে ত্বরিত গতিতে এগিয়ে এল সে যে নকুল তা বুঝতে বাকি রইল না।

মাত্র দু-তিন মুহূর্তের মধ্যে ঘটনাটা ঘটে গেল। ছায়ামূর্তি দুহাত আরও লম্বা করে শূন্য বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়তেই নকুল সজোরে তার পিঠে লাঠি দিয়ে মারল। অবাক কাণ্ড

মোটরের টায়ার বাস্ট করলে যেমন শব্দ করে বাতাসটা বেরিয়ে গিয়ে টায়ারটা চুপসে পড়ে থাকে তেমনি একটা শব্দ করে কালো আলখাল্লার মতো কী যেন একটা বিছানায় পড়ল। তার পরক্ষণেই সেই পরিত্যক্ত বস্তুটা শূন্যে ভাসতে ভাসতে সরু হয়ে জানলা দিয়ে বেরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে নকুলও পিছন পিছন ছুটল।

আমি ফের চেঁচিয়ে উঠলাম, নকুল–যেও না

নকুল সাড়া দিল না–ততক্ষণে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে। আমিও দেরি না করে দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। সুইচ টিপে আলো জ্বালোম। পাশেই নকুলের ঘর হাট করে খোলা। আমিও ছুটলাম। কিন্তু কোন দিকে যাব?

কী মনে হল, কেন মনে হল জানি না, আমি সামনের রাস্তা ছেড়ে পিছনের দিকের র্থাৎ উত্তর দিকের রাস্তা ধরলাম। আমার হাতে একটা লাঠিও নেই। তবু নকুলকে বাঁচাতেই হবে। আমার জন্যে ওকে মরতে দেব না। কিন্তু এই নিচ্ছিদ্র অন্ধকারে কোথায় খুঁজব ওকে? ও তো সেই অশরীরীর পিছনে উন্মাদের মতো ছুটেছে।

আমিও ছুটতে লাগলাম। এই গভীর রাত্রে কেমন এক শিরশিরে বাতাস বইছে। সে বাতাস যেন পৃথিবীর বাতাস নয়। আমি দুহাত দিয়ে গা আগলে ধরলাম–যেন বাতাসটা সহ্য করতে পারছিলাম না। ছুটতে ছুটতে পুকুরধারে এসে পড়লাম।

এই রকম গভীর রাতে কোনোদিন এই পুকুরের দিকে আসিনি। আসতে সাহস হয়নি। দুর্নাম আছে পুকুরটার। গভীর রাতে এখানে এলে নাকি দেখতে পাওয়া যায় কেউ যেন মাঝ পুকুরে ডুবছে আর উঠছে। অনেকেই পুকুরের মাঝখানে জল তোলপাড় করার শব্দ শুনেছে। কিন্তু কিছু দেখতে পায়নি। ঝুপ করে কে যেন ডুব দিল। তারপর শুধু খানিকটা জল হুস করে উঠল। ব্যস্ এই পর্যন্ত। ও নাকি দেখা যায় না। আমার সৌভাগ্য এদিন ওরকম কোনো শব্দ শুনতে পাইনি। কিছু দেখতেও পাইনি। তবু যা দেখেছিলাম তাই যথেষ্ট।

পুকুরের পাড়ে মানুষের মতো কী যেন পড়ে আছে। ছুটে গেলাম। দেখি নকুল উবুড় হয়ে পড়ে আছে। মাথার কাছে লাঠিটা পড়ে আছে ভাঙা। হুমড়ি খেয়ে ওর বুকে মাথা রেখে বুঝলাম এখনও বেঁচে আছে।

.

০৩.

আমার সৌভাগ্য যে নকুল সে যাত্রায় বেঁচে গেল। কিন্তু উঠে দাঁড়াতে সময় নিল পাক্কা একটি মাস।

তারপর আস্তে আস্তে সুস্থ হল বটে কিন্তু সে রাত্রের ঘটনা কিছুই মনে করতে পারত না। এমন কি অবাক হয়ে আমার কাছে জানতে চাইত অত রাতে পুকুরপাড়ে গেলাম কেন? কী করেই বা গেলাম? আমি অনেক ভাবে প্রকৃত ঘটনাটা মনে করাতে চেষ্টা করেছি কিন্তু ওর কিছুই মনে পড়ত না। বললাম, সে রাতে তুমি বিছানায় না শুয়ে আলমারির পিছনে লুকিয়েছিলে। তুমি কী করে বুঝতে পেরেছিলে সে রাত্রেই এরকম ঘটনা ঘটবে?

ও শুধু কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল। তারপর অন্য দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, জানি না।

বললাম, তুমি যে সেই ছায়ামূর্তির পিছু পিছ তাড়া করে গিয়েছিলে তাও কি মনে করতে পারছ না?

ও শুধু মাথা নেড়ে বলল, না। সব অন্ধকার, দাদা। আমি আর বসে থাকতে পারছি না। ঘুম আসছে।

আমি তখনই ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আমার ঘরে চলে এসেছিলাম। ভাবলাম এই বেলা এগারোটায় ঘুম! তাহলে সুস্থ হল কই?

কিন্তু কী হচ্ছে এইসব? এখন নিশ্চিত হয়েছি–এতদিন যা দেখেছি তা মিথ্যে নয়। কিছু একটা আছেই। সেই অপার্থিব বস্তুটাকে আমি ছাড়া আরও একজন দেখেছে। কিন্তু কে এই ছায়ামূর্তিটা? কেনই বা আমার ঘরেই হানা দেয়? আমার সাঁইত্রিশ বছর বয়েস পূর্ণ হবার সঙ্গে তার কি সত্যিই কোনো সম্পর্ক আছে?

এই জন্যেই অনেক হিসেব-নিকেশ করে মৃতদের একটা তালিকা করতে আরম্ভ করেছিলাম। কাজটা শেষ করা হয়নি। এবার দেখছি আবার এটা নিয়ে বসতে হবে।

ভেবেছিলাম যিনি মাঝে-মধ্যে আসছিলেন তিনি হঠাৎ বেশ কিছুদিন আসা বন্ধ করেছিলেন। আবার আসছেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এখন তার আক্রমণের লক্ষ্যস্থল আমি নই, নকুল। বেচারি নকুল। সে তো সবে এসেছে। এরই মধ্যে কীভাবে জড়িয়ে গেল আমার জীবনের সঙ্গে যার ফলে সেও অশরীরী ক্রুদ্ধ আত্মাটির আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে উঠল!

আত্মাটি তার ওপর এতই ক্রুদ্ধ যে তাকে খুন করতে পর্যন্ত তার ঘরে ঢুকেছিল। এর কারণ কী?

কোন অলৌকিকতার প্রভাবে নকুলকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল নির্জন পুকুরের পাড়ে? কে ভাঙল তার মজবুত লাঠিটা? কেনই বা অচৈতন্য হয়ে পড়ল নকুল? আর কীসের প্রভাবে সে তার স্মৃতি হারিয়ে ফেলল! ঐ রাত্রির ঘটনা যেন নকুলের মন থেকে একেবারে মুছে গেছে।

এসবই আমাকে আবার ভাবিয়ে তুলল। যতই ভাবি কোনো কূলকিনারা পাই না। অথচ এ এমন ব্যাপার যে লোক ডেকে বলা যায় না। কারণ, এমন কোনো প্রমাণ দেখাতে পারব না যা দিয়ে বিশ্বাস করাতে পারব–এমন কি নকুলের ভাঙা লাঠিটাও অবিশ্বাসীদের কাছে তেমন জোরদার প্রমাণ বলে গণ্য হবে না। অথচ এখন মনে হচ্ছে সব ঘটনা জানিয়ে পরামর্শ নেবার একজন বিশ্বস্ত লোক চাই।

চাই তো বটে কিন্তু পাই কোথায়?

তখন মনে পড়ল পাড়াতেই তো থাকেন পাদ্রী জগদীশ অ্যান্টনি। বয়েস হয়েছে। শান্ত স্বভাবের ভদ্রলোক। কারও সাতে-পাঁচে থাকেন না। উনি নাকি এই সব আত্মা-টাত্মার বিষয় বোঝেন। এ নিয়ে গোপনে ক্রিয়াকলাপ করেন কিনা জানি না। তবে পড়াশোনা করেন। শুনেছি ওঁর সিন্দুকে নাকি রোমান হরফে লেখা দুষ্প্রাপ্য প্রেতের বই আছে। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সেই বই ব্যবহার করেন গোপনে।

ওঁর কাছেই যাব ভাবলাম। তবু যাব-যাব করেও যেতে উৎসাহ পেলাম না। কারণ আমার মতো আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত একজন কী করে তার কাছে গিয়ে বলবে, আমার বাড়িতে দুষ্ট আত্মার আবির্ভাব হয়েছে। হে পাদ্রী মশাই, আপনি বিধান দিন কী করে তার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাব।

না, অসম্ভব। এ আমি পারব না। অতএব পাদ্রী-মশাইয়ের কাছে আর যাওয়া হল না। ভাবলাম আর কিছুদিন দেখাই যাক না।

এই কিছুদিনের মধ্যেই একটা ঘটনা ঘটে গেল। নকুলের স্মৃতি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা যখন মাইনাস করে দিয়েছিলাম তখনই নকুল একদিন সকালবেলা গজগজ করতে করতে এসে বলল, দাদা, আমি না হয় বেশ কিছুদিন ঘর ঝাট দিতে পারিনি, তাই বলে কেউ ঝট দেবে না?

আমি থতমত খেয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ঘর ঝাঁট দেওয়ার কথা কাকে বলছে? কে ঝট দেবে? আমার বাড়িতে তো আর কেউ নেই যে ঘর ঝাঁট দেবে? বুঝলাম নকুলের মাথাটা এখনও পরিষ্কার হয়নি। সে কথা চেপে গিয়ে বললাম, কেন? কী হয়েছে? আবার মেঝে খুঁড়ে মাটি তুলছে?

এর আগেও নকুল এই অভিযোগ করেছিল। আমি গুরুত্ব দিইনি। আজ ভাবলাম, এ তো অদ্ভুত কথা। সিমেন্টের মেঝে। ঘরে এমন অপ্রয়োজনীয় জিনিসের জঞ্জাল নেই যে ইঁদুরের বাসা হবে। তা হলে?

চলো তো দেখি।

আমার এ কথায় নকুল খুব উৎসাহ পেল। আমার সামনে সামনে বীরদর্পে এগিয়ে চলল।

ওর ঘরে ঢুকে ভালো করে লক্ষ করে দেখলাম টাটকা তোলা মাটি নয়। বেশ কিছুদিন আগে উঠেছে। তারপর কিছুদিন মাটিতে পড়ে থেকে থেকে কেমন ভিজে ভিজে ঠেকছে। আমি তখন নিজেই একটা ঝাঁটা দিয়ে মাটিগুলো সরিয়ে দিলাম। কিন্তু ইঁদুর কেন পিঁপড়ের গর্তও দেখা গেল না। তখন বুঝলাম মাটিগুলো কোনোদিন উপর থেকে ঝুর ঝুর করে পড়েছে। যেমন পুরোনো বাড়িতে দেওয়াল বা কড়িবরগার পাশ থেকে চুন-বালি খসে পড়ে। এতক্ষণে যেন ব্যাপারটার একটা মানে খুঁজে পেলাম। যদিও একবার মাথা উঁচু করে তাকিয়ে কোনো খসে যাওয়া চুন-বালির চিহ্ন দেখতে পেলাম না।

একে তো ভাবনার অন্ত ছিল না। কে ঐ অশরীরী আত্মাটি? আমার ওপর কেন তার এত রাগ? কী চায় আমার কাছে? বেচারি নকুল এমন কী অপরাধ করল যে, রাতদুপুরে তার জানলা দিয়ে ঢুকে তাকে মেরে দিতে গিয়েছিল! এখন আবার নতুন ভাবনা জুটল হঠাৎ মেঝেতে মাটি এল কোথা থেকে? একবার নয়, কয়েকবার। পাদ্রীবাবার কাছে যাব কি যাব না ভাবতে ভাবতেই দিন চলে যায়।

এমন সময়ে তার কাছে যাবার একটা উপলক্ষ এসে গেল।

জগদীশ অ্যান্টনি প্রতিদিন যখন মিশনে পুরোনো চার্চের দিকে যান তখন পথে আমার সঙ্গে প্রায়ই দেখা হয়ে যায়। কিন্তু কথা হয় না। সেদিন দেখা হতেই উনি বললেন, এই যে বাবাজীবন, রোজই ভাবি বলব, কিন্তু খেয়াল থাকে না।

আমি নম্র গলায় বললাম, আমি কি আপনার বাড়িতে যাব?

হ্যাঁ বাবা, তা তো যাবেই। তবে একটা বই-এর খোঁজ করছি। পাচ্ছি না। তুমি যদি পার

কী বই বলুন।

উনি যে বই-এর নাম বললেন তা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। মনে মনে ভবলাম, এ বই আজ কোথায় পাব?

তবু তাঁকে আশ্বাস দিয়ে বললাম, খুঁজে দেখব। যদি থাকে–

তাই দেখো। বড্ড দরকার হচ্ছে। মানে নিতান্তই কৌতূহল। পাও ভালোই। না পাও তবু এসো। তোমাদের মতো আধুনিক মনের ছেলেদের সঙ্গে কথা বলেও আনন্দ।

এই এক নতুন হাঙ্গামা। উনি ভ্যামপায়ারের ওপর বই খুঁজছেন। সে বই এখানে কোথায় পাব? মনে পড়ল ক্লাস নাইন-টেনে পড়বার সময় প্রথম পড়েছিলাম ভ্যামপায়ার বা রক্তচোষা বাদুড়ের কথা। বইটা জন্মদিনে উপহার পেয়েছিলাম। খুঁজে দেখব যদি পুরোনো আলমারিতে কোথাও থাকে।

দুদিন পর বইটা পেয়ে বেশ উৎসাহ সহকারেই ওঁর কাছে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেটা দেখে উনি এমন ভাবে হেসে উঠলেন যে লজ্জায় আমার মাথা হেঁট হয়ে গেল। বললেন, এ তো ভ্যামপায়ার নিয়ে কিশোর-পাঠ্য গল্পের বই। এ বই নিয়ে কী করব? আমি চাই ভ্যামপায়ারের ওপর তথ্য।

হঠাৎ ভ্যামপায়ার নিয়ে ভাবনা-চিন্তা মাথায় চাপল কেন জিগ্যেস করতে গিয়েও সাহস পেলাম না। শেযে উনি নিজেই বললেন, তুমি অবশ্য ভূত-প্রেত-অশরীরী আত্মায় বিশ্বাসী নও। ও সব নিয়ে মাথা ঘামাও না। তবু বলছি, সময়ের পরিবর্তনে ভূত-প্রেতদের ঠিকুজি কুষ্ঠিও বদলে যাচ্ছে। আগে এদের দেখা যেত শ্মশানে, কবরখানায়। কখনও আসশ্যাওড়া গাছে পা ঝুলিয়ে বসে থাকত কিম্বা পোড়ো বাড়ির ন্যাড়া আলসেতে শুয়ে শুয়ে নিশাচর পাখি ধরে চিবোত। তারপর দ্যাখো, আগে স্কন্ধকাটা, কবন্ধভূত, ব্রহ্মদত্যি, শাঁকচুন্নি, গেছোভূত, মেছোভূত কত কী ছিল। এখন তারা পাততাড়ি গুটিয়েছে। তার বদলে দেখা দিয়েছে কালো বেড়াল, মরা বাঁদরের পা, কুকুর প্রভৃতি। কিন্তু বাদুড় কোন গুণে বেশির ভাগ ভূতের কাহিনিতে জায়গা করে নিল সেটাই জানতে ইচ্ছা করে। সেইজন্যে রক্তচোষা বাদুড়ের ওপর লেখা বই পড়ে দেখতে চাই। বুঝতেই পাচ্ছ, বাদুড় যদি ভূত হতে পারে, তাহলে চিল শকুন কাক ইঁদুর ছুঁচোর ভূত হতে বাধা কী?

ওঁর এই শেষের কথাগুলোয় হঠাৎ আমি এমনই চমকে উঠলাম যে পাদ্রীবাবার কাছে ঘটা করে বিদায় না চেয়েই হঠাৎ উঠে পড়লাম।

আজ যাই। বলেই বেরিয়ে পড়লাম। সারা পথ শুধু একটি কথাই মনে হতে লাগল– তাহলে সত্যিই কি বেড়াল, বাদুড়ের মতো চিল, শকুন, কাকের মধ্যে দিয়েও প্রেতাত্মার আবির্ভাব হতে পারে? আর তাই যদি হয়

হঠাৎ যেন একটা জটিল সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। তাতে যেমন সাময়িকভাবে স্বস্তি পেলাম, তেমনি নতুন ভয় শুরু হল। ইঁদুর দেখা যায় না, ইঁদুরের গর্তও চোখে পড়ে না। অথচ মাটি পড়ে থাকছে। কে তুলছে এই মাটি? কোথা থেকে তুলছে? যে-ই তুলুক সে। যে ঠিক সাধারণ কোনো প্রাণী নয়, জগদীশ অ্যান্টনির মুখের আগা একটি কথাতেই তা পরিষ্কার হয়ে গেল। ইঁদুরও তা হলে ভূত হতে পারে।

লোকে শুনলে হাসবে কিন্তু এ ছাড়া আমার আর কোনো উপায় ছিল না, পরের দিনই আমি মিস্ত্রি লাগিয়ে বেডরুম, কিচেন, দালান–সর্বত্র মেঝে খুঁড়িয়ে নতুন করে সিমেন্ট করে নিলাম। যাতে দৃশ্যই হোক আর অদৃশ্যই হোক ইঁদুরের লেজটুকুও দেখা না যায়।

নকুল বললে, এ কী কাণ্ড করলেন, দাদা? গোটা বাড়ি ভাঙবেন নাকি?

রেগে উঠে বললাম, দরকার হলে তাই ভাঙবসসর্পে চ গৃহে বাসো মৃত্যুরেব ন সংশয়ঃ। মানে বুঝলে?

নকুল অসঙ্কোচে স্বীকার করল মানে কিছুই বুঝতে পারেনি।

 বললাম, এর মানে হল একই বাড়িতে সাপ নিয়ে বাস করলে মৃত্যু নিশ্চিত।

নকুল চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, আবার সাপ এল কোথা থেকে, দাদা?

.

০৪.

বাস্তবিক জগদীশ অ্যান্টনির মুখের ঐ একটি কথাই আমার মাথা গোলমাল করে দিল। আমি নিশ্চিত জানি বাদুড় কীভাবে ভূত হতে পারে–পাদ্রীবাবা এই তর্ক তুলতে গিয়ে এক নিঃশ্বাসে চিল, শকুন, ইঁদুর, ছুঁচোর কথাও বলে ফেলেছিলেন। বিশেষ করে ইঁদুরের ওপর জোর দেবার কোনো কারণ ছিল না। অথচ দ্যাখো, ইঁদুরের কথাটা কানে আসা মাত্র ওটা খটাস করে ব্রেনে লক্ হয়ে গেল। কেমন বদ্ধমূল ধারণা হল বাড়িতে ইঁদুর তো ঢোকেনি, ঢুকেছে ইঁদুরের শরীর ধরে একটা অশুভ আত্মা।

আমি জানি এটা আর কিছুই নয়, ভৌতিক পরিবেশে বাড়িতে বসে থেকে থেকে মনের মধ্যে এক ধরনের দুর্বলতা তৈরি হয়ে গেছে। ছি ছি, শেষ পর্যন্ত ইঁদুরের ভয়ে গোটা বাড়ির মেঝে চটিয়ে ফেললাম! অথচ একটি ইঁদুরের লেজ পর্যন্ত কোনোদিন দেখা যায়নি। ঠিক করলাম এই দুর্বলতা আমাকে কাটিয়ে উঠতেই হবে। নইলে হয়তো পাগল হয়ে যাব।

আর আশ্চর্য যেদিন এই রকম প্রতিজ্ঞা করলাম সেই রাতেই ঘটল একটা ঘটনা। ঘটনাটা এইরকম–কেউ যেন আমার ঘরের দরজায় আস্তে আস্তে কড়া নাড়ছে–খটখটখট–

চমকে উঠে বসলাম। তখনও কেউ কড়া নেড়েই যাচ্ছে–খটাখটখটাখট খটাখট–

না, ভুল শোনা নয়। সত্যিই কেউ আমাকে ডাকছে। মশারির মধ্যে বসেই চাপা গলায় জিগ্যেস করলাম, কে?

উত্তর নেই। শুধু একটানা সেই শব্দ–খটাখট খটাখট খটাখট–

আশ্চর্য! এত রাত্রে কে ডাকছে? বাইরের কেউ নয়। বাইরের কেউ হলে বাড়ির মধ্যে ঢুকবে কী করে? নিশ্চয় এ বাড়িরই কেউ। সেই কেউ নকুল ছাড়া আর কেই বা হতে পারে? চেঁচালাম, এত রাত্রে কী ব্যাপার, নকুল?

উত্তর নেই।

 এবার হাঁকলাম, নকুল!

সাড়া নেই। ধরার লোক না থাকলে টেলিফোনে যেমন রিং হয়েই যায় তেমনি কড়া নাড়া চলতেই লাগল। আমি প্রচণ্ড রাগে বিছানা থেকে নেমে দরজার কাছে এগিয়ে গেলাম।

কে-এ-এ?

তখন মনে হল কড়া নাড়ার শব্দটা যেন আর কাছে নেই। আস্তে আস্তে দূরে চলে যাচ্ছে।

অ্যাই নকুল–বলে খিল খুলতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আশ্চর্য, খিলটা এতটা উঠে এল কী করে? আমি তো ভালো করে এঁটেই বসিয়েছিলাম। কেউ কি তাহলে বাইরে থেকে খিল খোলবার চেষ্টা করছিল? কিন্তু তাই বা সম্ভব কী করে? না, এ রহস্য আর সহ্য করা যায় না। মনের সমস্ত শক্তি একত্র করে খিলটা খুলে ফেললাম।

আবার সেই গা-হিম করা অন্ধকার বারান্দা। আমি কীসের তীব্র আকর্ষণে এগিয়ে চললাম। সামনে কিছু যেন ভেসে যাচ্ছে…. কী ওটা? একটা সাদা চাদর … যেমন দেখেছিলাম সেদিন নকুলের ঘর থেকে জানলার ভেতর দিয়ে ভেসে যেতে।

হঠাৎ আমার পিছনে কার পায়ের শব্দ! তারপরই কেউ ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার উপর। আমি পড়ে যাচ্ছিলাম–কে যেন আমাকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে রইল। বেঁচে গেলাম।

পরের দিন অনেক বেলায় ঘুম ভাঙল। সারা দেহে ব্যথা। নকুল এক বাটি গরম দুধ খাওয়ালো। ও যা বলল সংক্ষেপে তা এই

অনেকক্ষণ ধরেই কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। প্রথমটা ঘুমের ঘোরে বুঝতে পারেনি শব্দটা কোথায় হচ্ছে। পরে নাম ধরে ডাকতেই ধড়মড় করে ওঠে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। দেখল আমি অন্ধকারেই টলতে টলতে চলেছি। আমার সামনে একটা সাদা চাদর বাতাসে ভাসতে ভাসতে যাচ্ছে। বুঝতে পারল আমার বিপদ। তাই আমার পিছনে গিয়ে দাঁড়াল। আমি চাদর লক্ষ করে নাকি শূন্যে লাফ দিয়েছিলাম। আর তখনই নকুল আমাকে আঁকড়ে ধরে ফেলেছিল।

তিন দিন বাড়ি থেকে বেরোতে পারিনি। কিছু চিন্তা করতে গেলেই মাথায় যন্ত্রণা। তাই শুয়ে ঘুমিয়ে, অর্ধজাগরণে বাড়িতে পড়ে রইলাম। ভাগ্যি নকুল ছিল। নিজের ভাই-এর মতো ও সর্বক্ষণ আমার বিছানার পাশে। আবার নকুলকে দেখে অবাক হয়েছি। ওর মুখটা এত চেনা চেনা লাগছে কেন?

এক সপ্তাহ পর যখন উঠে বসতে পারলাম তখন প্রথম যে কথাটা মনে হল তা হচ্ছে এটা কী হল? এতদিন যা হয় একরকম হচ্ছিল। যখন-তখন যেখানে-সেখানে ছায়া দেখা। সে আমার কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা মাত্রও করেনি। শুধু দেখা দিচ্ছিল। যেন ও যে কে তা জানাতে চাইছিল। এতে শুধু কৌতূহলটাই বেড়েছিল। আর কিছু নয়। তারপর হঠাৎ নকুলকে আক্রমণ। কেন?

তারপর গভীর রাতে আমার বেডরুমে হানা। লুকিয়ে-চুরিয়ে নয় রীতিমতো কড়া নেড়ে। তারপর যেই দরজা খুললাম অমনি পালাল। কীভাবে পালাল? ছায়াশরীরটুকু নিয়েও নয়। হালকা চাদরের মতো শূন্যে ভাসতে ভাসতে। নকুল বলছে, আমি নাকি শূন্যে ভাসমান সেই চাদরটা ধরতে গিয়েছিলাম। আশ্চর্য! এতখানি বোকামি আমি করেছিলাম। আর তার পরিণতিতে সাংঘাতিক দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত।

সে না হয় যা হবার তা হত। কিন্তু প্রেতাত্মাটির আসল ইচ্ছাটি কী? সেটা জানা সহজ হত যদি জানতে পারতাম তিনি কে?

ঠিক করলাম কাল সকাল থেকেই আবার সেই মৃতের তালিকাটি নিয়ে বসব। গত পাঁচ বছরে যারা মারা গেছে তাদের লিস্টটা আগে ফাইনাল করব। অবশ্য সেই সঙ্গে একটা ছোটো তালিকা করব ওদের মধ্যে যাদের অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছে তাদের। কারণ, প্রচণ্ড ক্ষোভ না থাকলে কোনো আত্মা বারে বারে এক জায়গায় হানা দেয় না। শুধু এক জায়গাতেই নয় বিশেষ একজনকেই টার্গেট করে আছে।

পরের দিন সকালে চা খেয়ে বাইরের ঘরে বসলাম মৃতের সেই অসমাপ্ত তালিকাটা নিয়ে।

এই ছোটো শহরেই অন্য একটা বাড়িতে আমার জন্ম। সেই বাড়ি থেকেই পড়াশোনা, খেলাধূলা। সেখানেই আসত আমাদের ক্লাসের বন্ধুরা। ক্যারাম খেলা হত। আর একটা খেলা ছিল গোলকধাম। কাজেই গত পাঁচ বছরে এখানকার কারা মারা গেছে তা খুঁজতে অসুবিধা হল না। ঝাড়াই-বাছাই করে দেখলাম ঐ সময়ের মধ্যে এখানকার নজন মারা গেছে। তার মধ্যে তিনজন আমার সমবয়সী, কিন্তু ঠিক বন্ধু নয়, পরিচিত। বাকি ছজন নানা বয়সের।

আজ পর্যন্ত আমি যা লক্ষ করে দেখেছি তাতে বুঝতে পেরেছি যে আত্মাটি আমাকে বার বার দেখা দিয়েছে (বরঞ্চ বলি হানা দিয়েছে) সে কোনো ধীরস্থির মানুষের আত্মা হতে পারে না। অনুমান–সে কোনো উঠতি বয়সের আত্মা।

এই ভাবে বাছাই করতে গিয়ে তালিকাটা বেশ ছোটো হয়ে গেল। খুশি হলাম। দেখলাম সন্দেহভাজনের এই তালিকায় তিনজনের নাম উঠে আসছে। তিনজনেই আমার জানাশোনা, উঠতি বয়সের। তিনজনেই ছিল একটু রাগী স্বভাবের। কাজেই এদের যে কেউ একজন হতে পারে। তিনজনের মধ্যে একজনই মরেছে অপঘাতে। সাপে কামড়ে ছিল। সাপের কামড়ে মৃত্যুকে অপঘাত বলে কিনা ঠিক জানি না। অবশ্য অপঘাতে মৃত্যু হলেই যে ভূত হবে এর কোনো মানে নেই। স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে এমন বহুজনের আত্মা প্রেত হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে বহুকাল। অতএব

আর একটা ক্লু পেয়েছি বলে মনে হচ্ছে। আমি তো কয়েকবার আত্মাটির আকার লক্ষ করেছি। দেখেছি তার হাইট প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট। এখন যে তিনজনকে আমি শেষ পর্যন্ত সন্দেহের তালিকায় রেখেছি তাদের মধ্যে কার হাইট সাড়ে পাঁচ ফুটের কাছাকাছি চোখ বুজে একটু ভাবলেই ধরতে পারব।

সেই রকম চেষ্টা করলাম। কিন্তু তিনজনের হাইট কীরকম গোলমাল হয়ে গেল। অর্থাৎ রামের হাইট শ্যামের গায়ে, শ্যামের হাইট যদুর কাঁধে। মুশকিলে পড়লাম। কী করব ভাবছি, দরজায় শব্দ। উঃ এখন আবার কে এল? যত বাধা

কে? বিরক্তিঝরা গলায় হাঁকলাম, ভেতরে আসুন।

যিনি ভেতরে ঢুকলেন তাকে দেখেই অবাক হলাম। খুশি তো হলামই।

আপনি! আসুন-আসুন। কী সৌভাগ্য! হাসিমুখে ঘরে ঢুকলেন জগদীশ অ্যান্টনি মশাই।

.

০৫.

আমাদের এখানে বর্তমানে খ্রিস্টান পরিবার অল্পই। কিন্তু ইতিহাস হচ্ছে এই–১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাঙালির শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদ্দৌলার শোচনীয় পরাজয়ের পর ইংরেজরা যখন এই বাংলাদেশের মাটিতেই ঘাঁটি গেড়ে বসল তখন থেকেই মোটামুটিভাবে বলা যায় এ দেশে খ্রিস্টানদের বসবাস শুরু। তারপর ১৮০০ সালে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ স্থাপিত হল। এই কলেজ স্থাপনের উদ্দেশ্য ছিল, যেহেতু এ দেশেই সাহেবসুবোদের করে খেতে হবে সেহেতু সর্বাগ্রে দরকার বাংলা শেখা। বাংলা না শিখলে বাঙালিদের সঙ্গে মিশবে কী করে? সেই কারণেই ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ তৈরি।

একদিকে যেমন ইংরেজরা বাংলা শিখতে শুরু করল, অন্যদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অফিসে চাকরি পাওয়ার তাগিদে বাঙালিদেরও ইংরিজি শেখার তাড়াহুড়ো পড়ে গেল। সেই সঙ্গে শুরু হল এ দেশের মানুষের কাছে দয়াল প্রভু যিশু খ্রিস্টের মাহাত্ম্য বর্ণনা করে খ্রিস্টধর্ম প্রচারের কাজ।

এই উপলক্ষে দেশের সর্বত্র গির্জা তৈরি হল। নানা জায়গা থেকে আসতে লাগল সংসারত্যাগী পাদ্রীরা। এই পাদ্রীদের মধ্যে অধিকাংশদের জীবন ছিল সংযত, পবিত্র। তাঁদের স্বভাব ছিল ধীর, স্থির, শান্ত। তাঁরা যিশুর মতোই জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে ছোটোদের কাছে টেনে নিতেন। ফলে সাধারণ গেরস্ত পরিবারগুলি পাদ্রীদের খুব শ্রদ্ধা করত। পাদ্রীদের প্রভাবে এ দেশে বহু দরিদ্র, অল্পশিক্ষিত মানুষ খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করল। আশা ছিল, দুঃখ-দুর্দশায় ইংরেজরা তাদের দেখবে। হয়তো খুব বেশি সাহায্য পাওয়া যেত না তবে এই সব দরিদ্র অবহেলিত মানুষদের তারা অনেক কাছে টেনে নিয়েছিলেন।

আমাদের এখানে শহরের প্রায় বাইরে যে প্রাচীন গির্জাটি আছে সেটির প্রতিষ্ঠা করেছিল চার্চ অফ স্কটল্যান্ড মিশন ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে।

চার্চ তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় খ্রিস্টধর্মীরা নিয়মিত ধর্মচর্চার জন্যে নিজেদের মতো করে একটি পবিত্র আশ্রয় পেলেন। দূর দূর গ্রাম থেকেও খ্রিস্টভক্তরা প্রতি রবিবার এই চার্চে প্রেয়ারে যোগ দেবার জন্যে আসতে লাগলেন।

আমরা খ্রিস্টান ছিলাম না। তবু বাবার এই সব স্থানীয় খ্রিস্টান বন্ধুরা খুব সহজেই আমাদের বাড়ি আসতেন। আমরাও ভোলা মনে তাদের গ্রহণ করতাম। এখানেই প্রথম দেখি একজন লম্বা, কালো স্বাস্থ্যবান মানুষকে যাঁর সঙ্গে বাবা হ্যান্ডশেক করতেন। বাবার এক বন্ধু আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। এঁর নাম ফাদার জগদীশ অ্যান্টনি। সম্প্রতি কৃষ্ণনগর থেকে এখানকার পাদ্রী হয়ে এসেছেন।

তাঁকে প্রথম দেখেই আমার ভালো লাগেনি। কারণ অন্যরা ধুতি-পাঞ্জাবি, শাল গায়ে দিয়েছিলেন, আর উনি সাদা ফুলপ্যান্টের ওপর পরেছিলেন কালো লম্বা একটা জোব্বা। তাঁর গলায় যে রুপোর ক্রসটা ঝুলত সেটাও ছিল পেল্লায় বড়ো, তা ছাড়া তাঁর চওড়া চোয়াল, চ্যাপ্টা মুখের ওপর ড্যাবডেবে দুটো চোখ আমার ভয়ের উদ্রেক করত।

জগদীশ অ্যান্টনি তখন থাকতেন, সেই চার্চের পাশে একটি ঘরে একা। সেখান থেকে বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে আসতেন গঙ্গার ধারে। কখনও আমাদের বাড়ি বাবার কাছ। ছোটোবেলা থেকে তাকে দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। আর ভয় পেতাম না। চেহারা অসুরের মতো হলেও মানুষটা সত্যিই ভালো।

তিনি বেশ কয়েক বছর আমাদের বাড়ির কাছেই বাড়ি ভাড়া করে আছেন তবু কখন কোথায় যান তা লক্ষ করিনি। লক্ষ করার দরকার হয়নি। তাছাড়া, তখন আমার যৌবনকাল। খেলাধূলা, গানবাজনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। একজন বাপের বয়সী মানুষকে নজরদারি করার মানসিকতা আমার ছিল না। কাজের লোকের কথায় গুরুত্ব দিইনি। এখানে প্রথম এসে পর্যন্ত ঐ চার্চে তিনি থাকতেন। একাই থাকতেন। চারিদিকে জঙ্গল। কাছেই বহু কালের পুরোনো খ্রিস্টানদের কবরস্থান। খুব দরকার না হলে বিকেলেও কেউ ওদিকে যায় না। সন্ধের পর গা ছমছম করে তবু তিনি থাকতেন। নিশ্চয় তাঁর ভয করত না। তিনি বিশ্বাস করতেন তিনি একা নন। তাঁর সঙ্গে অদৃশ্য ভাবে রয়েছেন সদাপ্রভু যিশু। আর গলায় ঝুলছে রুপোর ক্রস। তা সেই বহুদিনের পরিচিত জায়গায় তিনি যখন খুশি, যতবার খুশি যেতেই পারেন। কার কী?

এইরকম সময়ে একদিন একটা ঘটনা স্বচক্ষে দেখে পাদ্রীবাবার ওপর একটা বিশেষ ধারণা তৈরি হয়ে গেল।

সেদিন বিকেলে আমার এক পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলাম। যেখানে গিয়েছিলাম সেখান থেকে চার্চটা বেশি দূরে নয়। খোয়াওঠা ধুলোভরা মেন রোড থেকে যে পায়ে চলা পথটা ডানদিকে নেমে আমবাগানের মধ্যে দিয়ে বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে একটা খোলা জায়গায় গিয়ে মিশেছে, সেখানেই চার্চটা তার জীর্ণ ভগ্নদশা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার একটু দক্ষিণে এগোলেই দেখা যাবে অনেকগুলো শ্বেত পাথরের ফলক মাটিতে পোঁতা। এগুলোই এখানকার খ্রিস্টানদের কবরে এক-এক জনের স্মৃতিফলক। হঠাৎ মনে হল পাদ্রীবাবা প্রায়ই তো এই সময়ে এখানে আসেন। দেখি না গিয়ে আজও এসেছেন কিনা।

বন্ধুকে নিয়ে গির্জার চত্বরে গিয়ে দাঁড়ালাম। সন্ধের অন্ধকার ধীরে ধীরে বাদুড়ের ডানার মতো নেমে আসছে। একটা ঢ্যাঙা দেবদারু গাছের মাথায় সিঁদুরের ছোঁয়ার মতো এক চিলতে রোদ লেগেছিল। পাশের চাপাবনের ওপর থেকে একঝাক পাখি যেন ভয় পেয়ে পাখা ঝাঁপটে উড়ে পালাল।

আমরা এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলাম পাদ্রীবাবা নেই। কিন্তু গির্জার পাশেই তাঁর ছোটো ঘরটার জানলার এক পাট খোলা। বুঝলাম উনি এসেছেন। আশ্চর্য! এই সন্ধেবেলা কোথায় বেড়াতে গেলেন!

আমি চেঁচিয়ে ডাকলাম, মিস্টার অ্যান্টনি! আমার গলার স্বরে চকিত হয়ে একটা শেয়াল সামনে দিয়ে ছুটে পালাল। আবার ডাকলাম, মিস্টার অ্যান্টনি।

ও! আপনি! এই যে যাই। বলে কবরখানার পিছন থেকে পাদ্রীবাবা হাসতে হাসতে এসে দাঁড়ালেন। তার পরনের পাজামা আর গেঞ্জি ধুলোয় ভর্তি। আর হাতে একটা কোদাল।

হঠাৎ এই সন্ধেবেলা এখানে! জিগ্যেস করলেন পাদ্রীবাবা।

বললাম, এদিকে বেড়াতে এসেছিলাম। ভাবলাম যদি আপনি এসে থাকেন, একবার দেখা করে যাই।

ভালো করেছেন। তবে দেখা পেতেন না। আমি এতক্ষণ বেরিয়াল গ্রাউন্ডের ঝোপ জঙ্গল সাফ করছিলাম।

আপনি সাফ করছিলেন কেন? করার লোক নেই?

জানি না। থাকার তো কথা। কিন্তু কাউকেই তো দেখতে পাই না। তাই বাধ্য হয়ে আমাকেই কোদাল, গাঁইতি নিয়ে সাফ করতে হয়।

আপনি তো না করলেই পারেন। আপনি পাদ্রী। আপনার অনেক সম্মান।

পাদ্রীবাবা হেসে বললেন, শুধু সম্মানই নয়, অনেক দায়িত্ব, বাবা। এটা কার কাজ এ নিয়ে তর্ক করা আমার মানায় না। এ জায়গা অতি পবিত্র। সেই পবিত্রতা আমাকেই বজায় রাখতে হবে। কিন্তু আপনারা টর্চ এনেছেন তো, বাবা! বড্ড অন্ধকার। সাপ-খোপের ভয়ও আছে।

বললাম, না, টর্চ না আনলেও ঠিকই চলে যাব। আর সাপের ভয়? আপনি যদি এই অন্ধকারে এখানে-ওখানে চলাফেরা করতে পারেন তাহলে আমরাই বা পারব না কেন?

উনি কোনো উত্তর দিলেন না। এগিয়ে এসে আমাদের দুজনের মাথায় গলার বড়ো ক্রসটা ঠেকালেন।

আমার গা-টা কেমন শিরশির করে উঠল। একটা হিমস্রোত বয়ে গেল মেরুদণ্ড দিয়ে।

নিরাপদেই বাড়ি ফিরে এলাম। নতুন করে পাদ্রীবাবার কথা ভাবতে চেষ্টা করলাম। চার্চের এবং বেরিয়াল ফিল্ডের সংলগ্ন জায়গার পবিত্রতা রক্ষা করার দায়িত্ব কি শুধু তাঁর? তিনি যে এত নির্ভয় তা কি শুধু ঐ পবিত্র ক্রসের প্রভাবে? কিন্তু ঐ ক্রস কি বাঁচতে পারে বিষাক্ত সাপের ছোবল থেকে? পারে হয়তো। না, আমরা কল্পনা করতে পারি না।

শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে গেল।

তবু–

তবু কাঁটা খস্থ করতেই লাগল।

এক নম্বর–তিনি কেন আমাদের অন্যদিন বেলাবেলি আসতে বললেন না একবারও?

দুনম্বর–সন্ধে হয়ে গেছে। তবু যে ঘরটায় তিনি বসেন সেটা অন্ধকার। তখনও আলো জ্বালা হয়নি। আলো জ্বালানো হবে তো? নাকি তিনি অন্ধকারেই চলাফেরা করবেন?

আশ্চর্য! অথচ যখন আমাদের পাড়ায় থাকেন তখন আলাদা মানুষ–একেবারে সাধারণ স্বাভাবিক জীবন।

যাই হোক, এ সব ভেবে লাভ নেই। পাদ্রী সাহেব আমার বাবার বন্ধু। পিতৃতুল্য। তাঁকে যেন চিরদিন শ্রদ্ধা করেই যেতে পারি।

.

০৬.

একেবারে ঘরোয়া পোশাকে এসে বসলেন পাদ্রীমশাই। পরনে ধুতি লুঙ্গির মতো করে পরা। গায়ে ফতুয়া।

মন দিয়ে কীসের তালিকা করছেন? নিমন্ত্রিতদের লিস্ট নাকি? দেখবেন আমি যেন বাদ না পড়ি।

হেসে বললাম, এটা যদি নিমন্ত্রিতদের তালিকা হত তাহলে অন্তত আপনি বাদ পড়তেন না। আপনার চেয়ে কাছের মানুষ আমার আর কেউ নেই।

উনি গম্ভীর ভাবে বললেন, আপনি তো এখনও ছেলেমানুষ, অভিজ্ঞতা নেই। তাই জানেন না কাছের মানুষরাই বাদ পড়ে যায়।

এই একটা বদ অভ্যাস ভদ্রলোকের। তার ছেলের মতো হলেও কিছুতেই আপনি ছাড়া কথা বলবেন না। আপত্তি করলে বলেন, আমি তো সেকালের মানুষ। আর কিছুতে না হোক অন্তত কাথায়-বার্তায় ছোটোদেরও সম্মান দেখাতে হয়। কাজেই তুমি, তোমার সঙ্গে যে আপনি আজ্ঞে করি সেটা ধরবেন না। ওটা আমার মুদ্রাদোষ।

আমি কথা ঘোরাবার জন্যে বললাম, আজ তো রবিবার। সকালে প্রেয়ার ছিল। চার্চে যাননি?

গিয়েছিলাম বৈকি। কাজ শেষ করেই বাড়ি ফিরে এসেছি। হ্যাঁ, বাদুড়ের ওপর বইটার কথা যেন ভুলে যাবেন না, ভাই। ওটা আমার খুব দরকার। আপনি যখন কলকাতায় যাবেন, কলেজ স্ট্রিটে বইটার খোঁজ করবেন। বাদুড় নামে হয়তো পাবেন না। প্রাণীজগৎ–এ ধরনের কোনো বই বাংলাতেই হোক কিংবা ইংরাজিতেই হোক দয়া করে একটু খোঁজ করবেন। বেশি দাম হলেও নেবেন। এই একশো টাকা রাখুন।

বললাম, টাকা এখুনি দিতে হবে না। আমার মনে থাকবে।

তখনই মনে হল পাদ্রীবাবাকে যখন হাতের কাছে পাওয়া গেছে তখন ইঁদুরের ব্যাপারটা জেনে নেওয়া যাক। অন্তত একজন ঠিক ব্যক্তির অভিমত জানা যাবে। মতলবটা মাথায় খেলতেই তাঁকে বিনীতভাবে বললাম–একটা কথা আপনার কাছ থেকে পরিষ্কার করে জেনে নিয়ে ইচ্ছে করছে। যদি বিরক্ত না হন–

উনি ব্যস্ত হয়ে বললেন, না না, বিরক্ত হব কেন? বলুন।

আমি তখন আমার বক্তব্যটা মনে মনে গুছিয়ে নিয়ে বলে গেলাম। শেষকালে যোগ করলাম, আপনি কি সত্যিই বিশ্বাস করেন বাদুড়, কালো বেড়াল-এর মতো ইঁদুরের মধ্যে দিয়েও ভৌতিক খেলা চলতে পারে?

উনি প্রথমে একটু হাসলেন। তারপর বললেন, যে কারণে বাদুড়ের ভূত হওয়া সম্ভব সেই একই কারণে ইঁদুরও ভূত হতে পারে। তবে কোন কোন বৈশিষ্ট্যে বাদুড়, কালো বেড়াল শয়তানের চর হয়ে ওঠে সেটা যেমন আমরা জানি না তেমনি ইঁদুর, ছুঁচো, চিল, শকুনের বৈশিষ্ট্যও জানা নেই।

আপনি বলতে চাচ্ছেন ইঁদুর ভূত ব্যাপারটা অসম্ভব কিছু না?

এই পৃথিবীতে রহস্যের শেষ নেই ভাই। মানুষ যতই বলুক আমি শেষ দেখবই, সেটা হবে তার মিথ্যে অহংকার। অনেক কিছুই সম্ভব।

একটু থেমে বললেন, কেন ইঁদুর নিয়ে কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি?

ছোটো কোনো স্টেশনে অনেকক্ষণ ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকার পর সিগন্যাল পাওয়া মাত্রই গাড়ি যেমন ছুটতে থাকে তেমনি পাদ্রীবাবার সম্মতি পাওয়া মাত্র আমার কথা শতধারায় ছুটতে লাগল। কোথাও যে একটু থামা দরকার তাও খেয়ালও রইল না।

কথা শেষ করে একটু জিরিয়ে নিয়ে বললাম, এই হল ব্যাপার। আজ করাত্রি ভয়ে ঘুমোতে পারি না।

বেশ কিছুক্ষণ পরে পায়ের চেটোয় হাত বোলাতে বোলাতে পাদ্রীবাবা বললেন, সব কিছুই তো ভয় থেকে উৎপন্ন। তাই

কিন্তু ভয়েরও একটা কারণ থেকে যাচ্ছে না? শুধু শুধু তো আর ভয় পাচ্ছি না।

পাদ্রীবাবা বললেন, তা হয়তো কিছুটা ঠিক, তা বলে মেঝেতে, দালানে মাটি দেখেই যদি ইঁদুর-ভূতের কাণ্ড ভেবে নেন তাহলে বেচারি ইঁদুরের ওপর অবিচার করা হবে।

তাহলে?

মাটিটা যেমন সত্য, ইঁদুর না থাকাটাও তেমনি সত্য। মনে হয় মাটির ব্যাপারে অন্য কারও হাত আছে।

বিস্ময়ের ধাক্কা সামলাতে না পেরে নড়েচড়ে বসলাম।

আবার কার হাত?

সেটাই লক্ষ রাখুন। আচ্ছা একটা অন্য কথা জিগ্যেস করি। আপনি কি আগে গানবাজনা করতেন?

যা বাবাঃ! কী কথা হচ্ছিল, কোন কথায় এসে পড়া গেল। সামলে নিয়ে বললাম, হা। করতাম। সে অনেক দিন আগে। সাবেক বাড়িতে থাকতে। তখন সবে ম্যাট্রিক দিয়েছিলাম। কিন্তু আপনি জানলেন কী করে? তখন তো আপনি আমাকে চিনতেন না।

পাদ্রীবাবা একটু হেসে আঙুল দিয়ে দেওয়ালের গায়ে সব থেকে উঁচু তাকটা দেখিয়ে দিলেন। পুরোনো বাড়ি ছেড়ে এ বাড়িতে এসেছি, এক সেট বায়া-তবলা একরকম পরিত্যক্ত অবস্থায় কাপড় জড়িয়ে একেবারে চোখের আড়ালে রেখে দিয়েছিলাম। পাদ্রীবাবারই চোখে পড়ল!

সলজ্জ হেসে বললাম, আপনি ঠিক লক্ষ করেছেন তো?

পাদ্রীবাবা হেসেই বললেন, কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর পাইনি। অবশ্য প্রশ্ন আরও আছে। গানবাজনা যে করতেন তা তো দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু ছাড়লেন কেন? তাও ছেড়েছেন যেন আর কোনোদিন ওগুলো ছোঁবেনই না প্রতিজ্ঞা করে। তাই না? সে প্রতিজ্ঞা আজও রক্ষা করে চলেছেন। কী ব্যাপার আপত্তি না থাকলে বলুন।

আমি বোবা হয়ে গেলাম। সত্যি ক্ষমতা আছে পাদ্রীবাবার। আজ হঠাৎ এসেই এমন জায়গায় লক্ষ পড়ল যেখানে আর কেউ তাকায়ওনি। শুধু লক্ষ পড়াই না, উনি একেবারে শেকড় ধরে টানতে শুরু করেছেন। জীবনের যে চ্যাপ্টারটা একেবারে বন্ধ করে দিয়েছিলাম, সেই পরিত্যক্ত জীর্ণ পাতাগুলোই পাদ্রীবাবা নেড়েচেড়ে দেখতে চান। কিন্তু কেন? নিছকই কৌতূহল, না অন্য কোনো রহস্য আছে?

বললাম, কিছুমাত্র না। আসলে গানবাজনা ছেড়ে দেবার পেছনে

বুঝতে পারছি তীব্র অভিমান আছে।

না, অভিমান, রাগ, দুঃখ এসব কিছু নয়

 তা হলে?

.

০৭.

পাদ্রী জগদীশ অ্যান্টনির কাছে সেদিন আমার গানবাজনা চর্চার ইতিকথা তুলে ধরেছিলাম।

আমাদের পরিবারে গানবাজনার চর্চাটা ছিলই। কেউ যে খুব নামকরা গায়ক বা বাজিয়ে হয়ে উঠতে পেরেছিলেন তা নয়। তবে বাড়িতে বসে নির্দোষ আনন্দ করার উপায় ছিল এই গানবাজনা।

আমি ভালো গাইতে না পারলেও মোটামুটি সুরজ্ঞান, লজ্ঞান ছিল। আমার যেমন গায়ক হবার কথা ছিল না, তেমনি বাজিয়ে হয়ে ওঠবার পেছনেও কোনো কারণ ছিল না। তবে কিনা পুরোনো আলমারির একেবারে নীচের তাকে এক জোড়া বাঁয়া-তবলা দেখে সেটা বাজতে ইচ্ছে করত। কিন্তু যেহেতু সেটা আমার ঠাকুর্দার শখের জিনিস ছিল, আর ওতে হাত দিতে সবাই বারণ করত তাই চোখের দেখা ছাড়া হাত দিতে সাহস হত না।

তারপর যখন বড়ো হলাম অর্থাৎ নাইন-টেনে পড়ছি তখন আলমারি খুলে বায়া-তবলাটা দেখে মনে হল–আরে! এমন ভালো জিনিসটা পড়ে পড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। দেখি না যদি বাজানো শিখতে পারি। এতে পরলোকগত দাদু রাগ করবেন কেন?

সেদিনই বাঁয়া-তবলাটা বের করে দাদুর উদ্দেশে প্রণাম করে তবলায় একটা আস্তে করে চঁটি দিতেই যেন তবলার ওপর সুরের ঢেউ খেলে গেল। তারপরে যখন প্রথম বোল তেরে কেটে তাক বাজাতে পারলাম তখন আমার আনন্দ দেখে কে?

এইভাবে রোজ আধঘণ্টা করে বাজাতে বাজাতে একদিন ভালো তবলা-বাজিয়ে হয়ে উঠলাম। কারো কাছে না শিখেই। কী করে তা সম্ভব হল, জানি না। হয়তো দাদুর আশীর্বাদ। ব্যাপারটা অসম্ভব জানি তবু …

আমাদের জায়গাটি নিতান্তই ছোটো। কিন্তু গানবাজনা হতই। আর হত স্টেজ বেঁধে থিয়েটার। তখনও মফঃস্বলে সিনেমার চল হয়নি। পুজোটুজো উপলক্ষে ছেলেরা মিলে থিয়েটার করত। আর থিয়েটার মানেই কনসার্ট, বাজনা থাকবেই। এখানে যে কজন তবলচি ছিল তাদের মধ্যে আমাকেই সকলে বেশি পছন্দ করত। তবলার ওপর আমার আঙুল যত দ্রুত খেলত তেমন আর কারো নয়। ফলে গানবাজনার আসর বসলেই সবার আগে আমার ডাক পড়ত।

এই রকম একটা ঘরোয়া গানের আসরে আমি প্রথম দেখেছিলাম চারু বিশ্বাসকে। অদ্ভুত ছেলেটা।

সন্ধ্যায় গানের আসর বসেছে। আমরা সাত-আটজন বন্ধু। অখিল বলে একটি ছেলে গাইছিল। আমি সঙ্গত করছিলাম। হঠাৎ দরজা ঠেলে কারও অনুমতি না নিয়ে ষণ্ডামার্কা একটা ছেলে এসে একেবারে আমাদের মাঝখানে বসে পড়ল। সে ঢুকেছিল কঁপা কাঁপা ঘাড় নিয়ে। তার মুখটা যে কী ভয়ঙ্কর না দেখলে বোঝানো যাবে না। নাক আর কপালের মাঝখানটা বসা। যেন বড়ো কোনো অপারেশন হয়েছিল একসময়। ডান দিকের ভুরুটা উঠে আছে কপালের ওপর পর্যন্ত। বাঁ ভুরুটা তলিয়ে গেছে বাঁ চোখের কোণে। গোটা মুখটা যে ক্ষতবিক্ষত তা নয়, অমসৃণ–এবড়ো-খেবড়ো। মনে হল তার মুখের চামড়াটা যেন গোটানো। এরকম ভয়ংকর মুখ এর আগে দেখিনি।

ওকে দেখে এ বাড়ির ছেলেরা ছাড়া আর সবাই হৈ হৈ করে উঠলকী চাই? ক চাই?

ও মাথা কাঁপয়ে বলল, আমি গান করব।

ইস! গান করবে! যা ভাগ। পালা।

ও বাড়ির ছেলে মোহন ইশারায় সবাইকে থামতে বলে চারুকে বলল, তুই ঐ এখন গিয়ে বোস।

চারু মাথা গরম করে বলল, আমায় গাইতে দিতে হবে। নইলে–

নইলে কী করবি তুই? আমাদের মধ্যে একজন তেড়ে যাচ্ছিল, মোহন থামিয়ে দিয়ে বলল, ঠিক আছে। তুমি গাইবে। আমি ব্যবস্থা করে দেব। তবে একটার বেশি নয়।

চারু কিছুটা শান্ত হয়ে দূরে চৌকিতে গিয়ে বসল। ঐটুকু যেতেও সে বেঁকে বেঁকে যাচ্ছিল। কী করে যে একা একা পথ হাঁটে কে জানে! চৌকিতে বসে সে ঘাড়টা একবার এদিক একবার ওদিক করতেই থাকল।

মোহনকে নিচু গলায় জিগ্যেস করলাম, কে ও? চেন?

মোহন বলল, ওর বাবা বর্ধমান রাজস্টেটের ম্যানেজার। এরা খ্রিস্টান। এখানে রাজবাড়ির সুপারিন্টেন্ডেন্ট হয়ে সবে এসেছে। ছেলেটি জড়বুদ্ধি। ওকে নিয়ে ওর বাবার অনেক যন্ত্রণা। তবে গানের গলা আছে।

গান চলতে লাগল। আর চৌকিতে বসে চারু ঘাড় নেড়ে, হাতে তাল দিতে লাগল। হঠাৎ তার খেয়াল হল গানের আসর ভাঙার মুখে। অনেকেই উঠে গেছে। তখনই চৌকি থেকে লাফ দিয়ে হারমোনিয়ামটা কেড়ে নিয়ে বাজাতে লাগল। দুবার রিড টিপেই গান ধরল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে হুকুম করল, বাজাও!

তার বলার ভঙ্গিতে রাগ হল। আমি বাজালাম না।

এরপর যা ঘটল তা বলবার নয়। চারু হারমোনিয়াম ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পা দিয়ে শতরঞ্জি ঠেলে দিতে লাগল। কাপ, ডিশ, গেলাস উল্টে একাকার।

আমাকে ইনসাল্ট! আই মোহন, এই ছোকরা তোদের বন্ধু?

মোহন খুব বুদ্ধিমান আর শান্ত প্রকৃতির। চারুর হাত ধরে টেনে বসিয়ে বললে, আর্টিস্টদের মাথা গরম করতে নেই!

সাপের মাথায় যেন মন্ত্রপড়া শেকড় পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে চারু জল। হেসে বলল, ঠিক বলছ আমি আর্টিস্ট?

মোহন বলল, শুধু আমি কেন? সবাই বলছে তুমি আর্টিস্ট। নাও ঠান্ডা মাথায় গান ধরো।

চারু হারমোনিয়াম টেনে নিল। মোহন ইশারা করে আমাকেই বাজাতে বলল। অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাজাতে হল।

আসল কথা হচ্ছে, এক-একজন এমন মানুষ আছে যাকে দেখলেই মেজাজ খিঁচড়ে যায়। চারু সেই রকম একজন। ওর মুখটা যে কী ভয়ংকর তা আপনি না দেখলে ভাবতে পারবেন না ফাদার।

মুখটা কি ওর জন্মগত, না জটিল কোনো অপারেশনের ফল? জিগ্যেস করলেন পাদ্রীবাবা।

 বললাম, জানি না। সেদিনই ওকে প্রথম দেখেছিলাম।

পাদ্রীবাবা একটু ভেবে বললেন, মনে হয় ওটা জন্মগত। জন্মগত বলেই মুখের ছাপ ওর স্বভাবে এসে পড়েছে।

একটু থেমে বললেন, শুধু আমাদের দেশেই নয়, অন্য দেশেও দেখা গেছে মা-বাপের অজান্তে কোনো অশুভ আত্মা জন্ম নেয়। যেমন মহাপুরুষদের ক্ষেত্রে পুণ্যাত্মারা এসে পড়েন। কে কখন আসেন সামান্য মানুষ তা জানতে পারে না। বিজ্ঞান এখানে পরাস্ত। আপনাদের চারু বিশ্বাসের ক্ষেত্রেও তেমনি হয়েছিল। তার জীবনটা চালাচ্ছিল একটি ভয়ংকর অশুভ আত্মা।

আমি বললাম, মোহনের কাছে শুনেছিলাম, ওকে জন্ম দিয়েই ওর মা মারা যান। তারপর যখন ওর বয়েস বছর পাঁচ ওর বাবা আবার বিয়ে করেন। কিন্তু এই ছেলেকে ওর সত্য মোটেই সহ্য করতে পারতেন না। নতুন বিয়ের পরই ওঁরা পুরীর রথযাত্রা দেখতে গেলেন। সেখানে ভিড়ে হাত ফস্কে চারু হারিয়ে যায়। কেউ কেউ বলে ওর সম্মা নাকি ইচ্ছে করেই চারুকে ভিড়ের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে আসেন। বাবা চাইলেও ওর সত্য পুলিশকে জানাতে দেননি।

কিন্তু অবাক কাণ্ড! দিন দশেক পরে ঐ পাঁচ বছরের ছেলে নিজেই বাড়ি ফিরে আসে। ঐটুকু ছেলের এমনই অভিমান যে, কী করে আসতে পারল তা কাউকে বলল না। বাড়ি ফিরে এসে সে আরও ভয়ংকর হয়ে উঠল। তার সমার ওপর রাগ, তার বাবার ওপর রাগ। রাগ সমবয়সী সব ছেলেদের ওপর। আমি যতটুকু জানতে পেরেছিলাম–তা হল এইটুকুই।

পাদ্রীবাবা গম্ভীর ভাবে বললেন, এই জন্যেই ওর এই পরিণতি। যাক, আপনার সঙ্গে ওর সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত কী রকম দাঁড়াল বলুন।

বললাম, সে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। ছেলেটাকে পছন্দ না করলেও যেমন আমি ওর গান পছন্দ করতাম, তেমনি ও-ও আমাকে পছন্দ না করলেও আমার বাজানোটা পছন্দ করত। ও চাইত ও যখনই যেখানে গান করবে তখনই আমি যেন ওর সঙ্গে থাকি। এ এক ধরনের অর্ডার। মোহনদের বাড়ি গেলে আমরা ভয়ে ভয়ে থাকতাম এই বুঝি ঝড়ের মতো চারু এসে হাজির হল!

ক্রমশ চারু আমার উপর জুলুম শুরু করল। যখনই ও গাইবে তখনই আমাকে বাজাতে হবে। শুধু মোহনের বাড়িতেই নয়, অন্য কোথাও গাইতে গেলে ও ওদের বাড়ির কাজের লোকের হাত দিয়ে চিঠি পাঠাত, অমুক দিন আমার সঙ্গে যাবে। কোনো অজুহাত শুনব না।

এ তো অনুরোধ নয়, আদেশ। রাগে গা জ্বলে যেত। বেশির ভাগ সময়ে ছলছুতো করে এড়িয়ে যেতাম।

এড়িয়ে যেতেন কেন? আপনিও তো আর্টিস্ট। প্রশ্ন তুললেন পাদ্রীবাবা।

বললাম, ও হয়তো মন্দ গান করত না। কিন্তু তার সেই পাথরের মতো খসখসে, উঁচু নিচু মুখ, সাপের মতো হিম দৃষ্টি আমি বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারতাম না। তাছাড়া ওর কুচুটে মনের পরিচয় যে কেউ পেয়েছে সেইই এড়িয়ে চলত। কথায়-বার্তায় এতটুকু নম্রতা ছিল না। নিজেকে যে কী মনে করত তা ওই জানত। আমাদের মনে হত, ও আমাদের ওর বাবার মাইনে করা কর্মচারী মনে করত। তাই কখনও অনুরোধ করত না। করত আদেশ।

আর আমি যখনই ওর ডাকে সাড়া দিইনি তখনই ও আমার বাড়িতে এসে হুমকি দিয়ে গেছে। আপনি ওকে, শিল্পী বলে সম্মান করছেন, কিন্তু এই কি শিল্পীর আচরণ?

একটু চুপ করে থেকে পাদ্রীবাবা বললেন, কী করে আপনাদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেল সেই কথাটা বলুন।

বললাম, আমি ওকে ছাড়তে চাইলেও ও আমাকে ছাড়তে চাইত না। আমি দেখলাম যেমন করে হোক ওর সঙ্গে বাজানো আমাকে বন্ধ করতেই হবে। তাই একটা ফাংশানে গিয়ে বাজাতে বাজাতে তাল কেটে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে ও রাগে ফেটে পড়ল। হারমোনিয়াম ঠেলে সরিয়ে দিয়ে আমার বাঁয়া-তবলা ভেঙে দেবার জন্যে তাড়া করে এল। আমি কোনোরকমে সে দুটি বুকে আগলে পালিয়ে এলাম। ঠিক করলাম, আর কখনও ওর ত্রিসীমানায় যাব না।

কিন্তু এর পরই একটা ঘটনায় আমি চমকে উঠলাম। সেই সপ্তাহেই একদিন ঘুম থেকে উঠে বাইরের ঘরে ঢুকে দেখলাম জানলার শিকগুলো দুমড়ানো। কী হল? চোর ঢুকেছিল? কিন্তু বাইরের ঘরে কী পাবে? এ বাবা! বাইরের দরজায় খিলও খোলা!

বেশিক্ষণ ভাবতে হল না। হঠাৎ আলমারির মাথায় চোখ পড়ল। কেমন ফাঁকা ফাঁকা। ওপরেই বাঁয়া-তবলাটা তোলা থাকে। চারুর হাত থেকে বাঁচাবার জন্য ওগুলোকে বাড়ি নিয়ে এসে কোনোরকমে আলমারির মাথায় রেখে দিয়েছিলাম। চোর হঠাৎ বাঁয়া-তবলা নিয়ে গেল কেন? তবলা শিখবে নাকি?

হঠাৎ লক্ষ পড়ল আলমারির নীচে একটুকরো কাগজ ভাঁজ করে রাখা রয়েছে। তুলে নিয়ে পড়লাম। চিঠিই বলা যায়। সেটা এইরকম–

তবলচি সাহেব, আমার কথা যারা মান্য করে না তাদের এই রকম শাস্তিই দিই। জানি এক সেট বায়া-তবলা ফের করাতেই পার। কিন্তু এটা যে তোমার ঠাকুর্দার জিনিস। মূল্যবান স্মৃতিচিহ্ন! কী বল? তাই এটাই হাতালাম।

পার তো পুলিশকে জানিয়ে এ দুটো উদ্ধার কোরো।

—ইতি
চারু বিশ্বাস।

চিঠিটা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে মুখ থেকে একটা কথাই ছিটকে বেরিয়ে এল–শয়তান। কিন্তু শত্রুকে উপযুক্ত শাস্তি না দিয়ে শুধু বাড়ি বসে গাল পাড়াটা অক্ষমের কাজ। তাই আমি চারুকে শাস্তি দেবার কথা চিন্তা করতে লাগলাম।

শাস্তি দিলেন?

 হ্যাঁ, দিলাম বৈকি। তবে একটু অন্যভাবে। যাকে বলে শঠে শাঠ্যং সমাচরেৎ।

কী করলেন? পাদ্রীবাবা নড়েচড়ে বসলেন।

বলছি, দাঁড়ান। তার আগে একটু জল খাই। বলেই হাঁক মারলাম, নকুল, একটু ঠান্ডা জল দাও। কথা বলতে বলতে গলা শুকিয়ে গেছে।

নকুল দুজনের জন্য দু গেলাস জল নিয়ে এল।

আমাকেও খেতে হবে?

খান। এক যাত্রায় পৃথক ফল কেন?

দুজনেই জল খেয়ে খালি গেলাস দুটো নকুলের হাতে দিয়ে আবার কথা শুরু করলাম। বললাম, সত্যিই গলা শুকিয়ে যায়নি। নকুলকে ভালো করে দেখাবার জন্যই ডাকলাম।

পাদ্রীবাবা অবাক হয়ে তাকালেন, ভালো করে দেখার দরকার হল কেন?

কারণ আছে। হ্যাঁ, এবার চারু বিশ্বাসকে কীভাবে শাস্তি দিয়েছিলাম বলি। একটু থেমে বললাম, আপনি নিশ্চয়ই জানেন কোনো কোনো ছিঁচকে চোর, দিব্যি ভদ্রসমাজে থেকে যায়। পাবলিক তাদের চেনে। পুলিশও। তবু তাদের ধরে না। নিতান্ত পেটের দায়ে গেরস্ত বাড়িতে কাজ করে। তারপর সুবিধে পেলে ঘটিটা, বাটিটা হাতসাফাই করে সরিয়ে নেয়। কখনও নেয় শাড়ি, ব্লাউজ যা হাতের কাছে পায়। আমরা ছোটোবেলা থেকে এদের চিনতাম। হয়তো পুরোনো শিশি-বোতল কিনতে বাড়ি ঢুকেছে। মা অমনি সবাইকে বলে দিত, সাবধান। অমূল্য এসেছে। শুধু অমূল্য কেন, আরও কয়েকজন ছিল–গোবরা, পটকা, হারু।

যাই হোক চারুকে শাস্তি দেবার জন্যে আমি রাতের অন্ধকারে ডেকে পাঠালাম নতুন পুকুরপাড়ের গোদাকে। যে-কোনো বাড়িতে ও যেমন করে তোক ঢুকবেই। তারপর রাত থাকতে থাকতেই কাজ হাসিল করে আসবে।

আমাদের মতো বাবুদের বাড়িতে লুকিয়ে ডাক পাওয়া ভাগ্যের কথা। গোদা হাত জোড় করে এসে দাঁড়াল। বললাম, গোদা, একটা কাজ আছে। খুব সাবধানে করতে হবে। তবে তোমার পক্ষে কাজটা মোটেই শক্ত নয়।

বলুন হুজুর।

ওকে তখন কাজটা বুঝিয়ে বললাম, গোদা, আমি এইটুকু জেনেছি বাঁয়া-তবলাটা চারু ওর পড়ার ঘরে লুকিয়ে রেখেছে। তোমার কাজ হচ্ছে ওখান থেকে ওটা হাতিয়ে এনে আমার বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া। এর জন্যে তোমাকে কত দিতে হবে বলো? তবে সাবধান, কেউ যেন জানতে না পারে।

গোদা হাত জোড় করে বলল, আমায় সাত দিন সময় দেবেন। চার দিন লাগবে লক্ষ রাখতে কে কখন বাড়িতে যায়, বাড়ি থেকে বেরোয়। তারপর বাকি তিন দিনের মধ্যে কাজ হাসিল করে আপনার জিনিস আপনার কাছে পৌঁছে দেব। তারপর আপনি খুশি হয়ে গরিবকে যা দেন দেবেন।

বলেই আবার আভূমি নত হয়ে প্রণাম করে চলে গেল।

এর অনেক দিন পর নকুল যখন এল আমাদের বাড়িতে তখন ওকে দেখে প্রথমে গোদা বলেই ভুল করে ফেলেছিলাম। আশ্চর্য মিল! আমি নকুলকে জিগ্যেস করলাম তার কোনো দাদা এদিকে থাকত কিনা। ও জানিয়েছিল ওর আত্মীয়স্বজন কেউ কোথাও নেই।

পাদ্রীবাবা বললেন, এই জন্যেই বুঝি নকুলকে ডেকে আমাকে দেখালেন।

 হ্যাঁ, নকুলকে দেখে গোদা সম্বন্ধে একটা ধারণা করতে পারবেন।

আপনার নির্দেশমতো গোদা কাজ করতে পেরেছিল?

হ্যাঁ, নিখুঁত ভাবে।

পাত্রীবাবা বললেন, তারপর চারু যখন জানতে পারল তখন কী করল?

ও যে ঠিক জানতে পেরেছিল তা আমিও বুঝিনি। শুধু আমি কেন কেউই খবর রাখেনি। এমন কি ও যে কবে হঠাৎ কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিল তাও আমরা জানতাম না। আর ধন্য তার বাবা-মা। ছেলে যে না বলে চলে গেছে তার জন্য কোনো চিন্তা-ভাবনা নেই।

তাহলে আপনার সঙ্গে আপনার বন্ধুর দেখা হল কবে?

অনেকদিন পরে। ততদিনে পুরোনো বাড়ি ছেড়ে এই বাড়িতে এসে গেছি। কোথায় কেন যে এমন গা ঢাকা দিয়েছিল তা আজও জানি না। একদিন রাত্রে হঠাৎই ঘুম ভেঙে গেল। বাইরে কে যেন আমার নাম ধরে ডাকছে। জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখি চারু দাঁড়িয়ে। আমি তো অবাক। জিগ্যেস করলাম, কী ব্যাপার? কবে এলি?

তার উত্তর না দিয়ে বলল, শোন্, আমার শরীর খুব খারাপ। তবু তোকে জানাতে এসেছি আমার ঘর থেকে বাঁয়া-তবলা চুরি করে তুই রেহাই পাবি না। আমি যেখানেই থাকি একদিন তোকে টেনে নেবই। মনে রাখিস। বলতে বলতে সে যেন অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।

মনটা খারাপ হয়ে গেল। এ আবার কী দেখলাম–কী শুনলাম! পরের দিন মোহনকে বললাম। ও বলল, হ্যাঁ, শুনেছি। কিন্তু ও দেখা করল কী করে? ও তো কদিন থেকে জ্বরের ঘোরে রয়েছে। কাল দেখতে গিয়েছিলাম। ডাক্তার রোগ ধরতে পারছেন না। ভুল বকে যাচ্ছে। আমায় দেখে লাল লাল চোখ মেলে দাঁত কড়মড় করে চেঁচিয়ে উঠল, অ্যাই শয়তান বন্ধু! চোর কোথাকার! প্রতিশোধ নেবই। আমি বাইচান্স খ্রিস্টানের ঘরে জন্মেছি। কিন্তু যিশু ভজি না। শোধ তুলবই। বুঝলাম চিনতে ভুল করেছে।

অসুখের মধ্যেও আমার মুন্ডু চিবোচ্ছে!

তুমি কি একদিন দেখতে যাবে?

বললাম, সাহস পাই না। আমায় দেখে যদি উত্তেজনায় হার্ট ফেল করে!

তা বটে। মোহন কাজে মন দিল।

যাব কি যাব না করতে করতে কদিন গেল। তারপর স্থির করলাম, ঝগড়াই হোক আর মনোমালিন্যই হোক একসঙ্গে এতদিন গানবাজনা করেছি। একবার দেখা করে আসি। এটা কর্তব্য।

কিন্তু মনের মধ্যে খোচ থেকেই গেল। সে রাত্রে যখন সে জ্বরের ঘোরে ছিল তখন আমার সঙ্গে দেখা করতে এল কী করে?

.

০৮.

শ্রাবণ মাস। সেদিন আবার শনিবার। ভরা অমাবস্যা। বিকেল বিকেল গেলাম। কিন্তু মেঘে মেঘে বিকেল তলিয়ে গেছে অকাল সন্ধ্যার মধ্যে। ভয়ে ভয়ে ঢুকলাম ওদের বাড়ি। ভেবেছিলাম অনেককেই দেখতে পাব। কিন্তু কোথায়? ওর বাবাকে দেখলাম কোট-প্যান্ট পরে দিব্যি হাসিমুখে একজনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গেলেন। আমাকে দেখে বললেন, এসো।

জিগ্যেস করলাম, চারু কেমন আছে?

ভালো না। বলেই তিনি চলে গেলেন। আশ্চর্য! ভালো না–তবু বাবার মুখে দুশ্চিন্তার ছাপটুকুও নেই। বাড়ির ঠাকুর-চাকরের অসুখ করলে বাড়ির কর্তা ভাবেন। কিন্তু এ যেমনই হোক তবু এ তো নিজের ছেলে।

সংকোচে পায়ে পায়ে ভেতরে ঢুকলাম। কারণ, যার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি সে আমায় মোটেই পছন্দ করে না। এই যে সেদিন গভীর রাতে অলৌকিক ভাবে চারু দেখা দিল তখনও তো রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই শাসিয়ে গেল, যেখানেই থাকি তোকে টেনে নেব। এ কথার মানে কী? আমার সঙ্গে ওর এমন বন্ধুত্ব নেই যে যেখানেই ও থাকুক আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে। আসলে আমাকে শাস্তি দেবার জন্যে। কিন্তু আমার অপরাধটা কী? আমি ওর ঔদ্ধত্য, প্রভুত্ব স্বীকার করতে পারতাম না। ও আমাকে যখন তখন বাজাবার জন্য হুকুম করত। ভাবত আমি যেন ওর মাইনে করা লোক। এটা সহ্য করতে পারতাম না। এড়িয়ে চলতাম, এটাই তার রাগ। সত্যি কথা বলতে কি ওর ভয়েই শেষ পর্যন্ত বাজানো ছেড়ে দিলাম।

তাই ভাবছিলাম রোগের মধ্যে এ রকম অপছন্দের মানুষকে দেখলে সে কি সহ্য করতে পারবে? যাই হোক, ভেতরের যে ঘরে গিয়ে ঢুকলাম–সে ঘরেই একটা চৌকিতে শুয়েছিল চারু। দুচোখ বন্ধ। যেন ঘুমোচ্ছে। ঘরে ওদের সরকারবাবু আর রামতারণ কবিরাজ মশাই ছাড়া আর কেউ নেই। বৃদ্ধ কবিরাজমশাই খুব মনোযোগ দিয়ে নাড়ি দেখছেন। সরকার মশাই ব্যাকুলভাবে তাকিয়ে আছেন কবিরাজমশাইয়ের দিকে। কী বলবেন কে জানে?

দেখেই বুঝলাম চারু ঘোরের মধ্যে রয়েছে। রুগির এই সঙ্গিন অবস্থাতেও কি বর্ধমান থেকে বড়ো ডাক্তার আনানো যেত না? টাকার তো অভাব নেই। আমি একটু দূরে একটা বেঞ্চে গিয়ে বসলাম।

অনেকক্ষণ ধরে নাড়ি দেখে কবিরাজমশাই ধীরে ধীরে চারুর হাতটা ওর বুকের ওপর রেখে দিয়ে চাদরটা দিয়ে ভালো করে ঢেকে দিলেন।

কেমন দেখলেন কবিরাজ মশাই? সরকারবাবু জিগ্যেস করলেন।

কবিরাজমশাই বললেন, নতুন ওষুধ দিয়ে লাভ নেই। মকরধ্বজটা যেমন চলছে চলুক। আর হ্যাঁ, আজ আবার ভরা অমাবস্যা। রাতটা সজাগ থাকবেন।

সরকার মশাই বললেন, তেমন বুঝলে কি আপনাকে খবর দেব?

যেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও কবিরাজমশাই বললেন, দিতে পারেন। আমার বয়স হয়েছে তো। রাতটাও খারাপ

কবিরাজমশাই লাঠি ঠক্ করতে করতে গোমড়া মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। পিছু পিছু গেলেন সরকার মশাই। সেই মুহূর্তে রুগির সামনে আমি একা। ঘর অন্ধকার হয়ে এসেছে। একটা লণ্ঠনও কেউ জ্বেলে দিয়ে যায়নি। পাশের জানলাটা খোলা ছিল। সেখান দিয়ে যতটা আলো আসছিল তার চেয়ে বেশি ঢুকছিল মশা।

একবার তাকালাম চারুর মুখের দিকে। একেই তো তার মুখটা ভয়ংকর, তার ওপর রোগযন্ত্রণা। মুখটা সাদা। মন হল কেউ যেন শরীরের সব রক্তটুকু শুষে নিয়েছে।

একা বসে থেকে কী করব? কেউ বসতেও বলেনি। তা হলে চলেই যাই। তখনই ভাবলাম যার জন্যে আসা তাকে দেখলাম। কিন্তু সে তো জানতেও পারল না। হয়তো ও জানতে পারল না এটাই ভালো হবে আমার পক্ষে। কিন্তু মুমূর্ষ রুগিকে একা ফেলেই বা যাই কী করে?

ভাবতে ভাবতে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম। ঠিক তখনই কেমন যেন অস্বাভাবিক গলায় চারু ডাকল, বলু!

চমকে ফিরে দেখি একটা মৃতদেহ যেন দুখানা হাড্ডিসার হাত ছড়িয়ে দিয়ে বিছানার ওপর উঠে বসেছে।

চারু হাতের ইশারায় কাছে ডাকল। কাছে যেতেই সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে দিয়ে আমায় বসতে বলল।

আমি কেমন ভয় পেলাম। তবু বসলাম। ও শুয়ে পড়ল। তারপর অনেকক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল আমার মুখের দিকে। কী ভয়ংকর দৃষ্টি!

কী দেখছিস অমন করে?

আমার কথা না শুনলে শাস্তি পেতেই হবে। সে শাস্তি যে কী সাংঘাতিক তুই জানিস না।

আমি চুপ করে রইলাম। এ তো পাগলের প্রলাপ। শোনার যোগ্য না হলে ওর কথা শুনতে যাবই বা কেন?

হঠাৎ ওর ভয়ংকর মুখটা অদ্ভুত ভাবে বেঁকিয়ে বলল, সেই কবে খবর দিলাম নিজে গিয়ে। আর এত দেরিতে এলি কেন?

সে রাত্রিতে তুই কেন গিয়েছিলি?

কেন? চালাকি হচ্ছে? আমাকে চিনতে পারিসনি?

পেরেছিলাম কিন্তু অত রাত্রে—

একদম চুপ!

 এমনি সময়ে একজন ঘরে আলো রেখে গেল। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

ঘরে আলো আসতেই দেওয়ালে চাদর মুড়ি দিয়ে শোওয়া অবস্থায় চারুর একটা লম্বা ছায়া পড়ল। এত লম্বা ছায়া? এ কি মানুষের ছায়া!

শ্রাবণের মেঘে ঢাকা আকাশে অন্ধকার দানা বেঁধে আছে, সেই অন্ধকার ছড়িয়ে পড়েছে চারিপাশের জঙ্গলের পাতায় পাতায়। মাঝে মাঝে বুকের মধ্যে কাঁপন ধরিয়ে বিদ্যুতের আলো অন্ধকারকে এফেঁড়-ওফোঁড় করে দিচ্ছে। হঠাৎ চারু গোঁ গোঁ করে উঠল! চমকে ওর দিকে তাকাতেই দেখি ও জানলার দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে।

চারু! কী হয়েছে?

ও হঠাৎ আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল! উঃ কী ঠান্ডা হাতটা! একি মানুষের হাত!

চারু, ভয় করছে?

বলু, তুই বাড়ি যা।

 না, এ অবস্থায় তোকে ফেলে আমি যাব না।

চারু কর্কশ স্বরে বলল, তুই কি কেবলই অবাধ্য হবি? যা বলছি।

কেন?

কথা বাড়াস নে। ঐ দ্যাখ জানলার বাইরে। ওরা এসে পড়েছে। তোকে দেখে খুব রাগ করছে। তুই আছিস বলে আমাকে নিতে পারছে না।

ভয় নেই, আমি তোর সঙ্গেই থাকব। বলে ওকে ভরসা দিলাম।

কিন্তু ও কী বুঝল জানি না। ভাঙা ভাঙা গলায় বলল, এখন নয়। আগে আমি যাই। তার কুড়ি বছর পর–তুই চলে আসবি। তুই এখন যা। যা বলছি

কুড়ি বছর পর কেন?

 অত প্রশ্ন করিস না। আমি জানি না। সব কিছুরই একটা সময় আছে। তুই যা—

কিন্তু জানলার বাইরে কাকে দেখে ও এরকম করছে?

উঠে জানলার ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম। অন্ধকারে তেমন কিছুই দেখা গেল না। মনে শুধু দু-তিনটে ছায়ামূর্তি বাড়ির কাছে ঘুরছে।

বুঝলাম চোখের ভুল। আর ও স্বপ্নের ঘোরে প্রলাপ বকছে।

বলু–বলু, তুই যা। ওই ওরা আমাকে

বললাম, তুই যখন চাচ্ছিস আমি আর না থাকি তাহলে বৃষ্টি থামলেই চলে যাব।

যা খুশি কর। বলেই সে বিছানায় নেতিয়ে পড়ল। আর তখনই একটা হঠাৎ ঝোড়ো হাওয়ায় জানলার পাটাটা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল।

বুঝলাম চারু আর নেই। চারুর কথা যদি সত্যি হয় তা হলে যারা তাকে নিতে এসেছিল তারা কাজ শেষ করে এই মুহূর্তে চলে গেল।

সারা রাত্রি বাড়ির জন দুই মাত্র লোকের সঙ্গে চারুর মৃতদেহ আগলে বসে রইলাম। অনেক বেলায় অল্প কিছু লোক জমল। মাপে মাপে কফিন তৈরি করা হল। তারপর নিঃশব্দে মৌন মিছিল করে কবরখানায়।

আমি বাড়ি ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠছিলাম। আর পারছিলাম না। কিন্তু তখনও একটি কাজ বাকি ছিল। একে একে সকলে কবরে মাটি দেবার পর আমিও কফিনের ওপর মাটি দিয়ে চলে এলাম।……..

.

তারপর? জিগ্যেস করলেন জগদীশ অ্যান্টনি।

বললাম, পরের দিন হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান। জ্ঞান ফিরলেও ঘোরের মধ্যে ছিলাম বেশ কদিন। তারপর ঘোর কাটলেও অনেক কিছু মনে করতে পারতাম না। কেন হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম ডাক্তার তা বলতে পারেননি। তারপর এই কিছুদিন ধরে চলছে নানা উৎপাত।

চিনতে পারছেন কে উৎপাত করছে?

বললাম, প্রমাণ পাইনি। তবে আন্দাজ করছি।

পাদ্রীবাবা এবার আর কথা বললেন না। একটু চুপ করে থেকে উঠে পড়লেন। তারপর আমার হাতটা চেপে ধরে বললেন, ঘটনার যখন শুরু তখন বোধ হয় আপনার বয়েস ছিল ষোলো-সতেরো। তাই না?

বললাম, হ্যাঁ।

তারপর কুড়ি বছর কাটল। তাহলে এই মুহূর্তে আপনার বয়েস সাঁইত্রিশ। বড়ো সাংঘাতিক সময় শুরু হয়েছে আপনার জীবনে। এই মুহূর্তে আপনি ঐ অশরীরী আত্মার টার্গেট হয়ে আছেন। বাডড়া সাংঘাতিক আত্মাটি। কিছুতেই ছাড়বে না।

একটু থেমে বললেন, বলুবাবু ভাই, খুব সাবধানে থাকবেন। প্রমাণ না পেলেও আমারও অনুমান আত্মাটি আপনার সেই প্রথম বয়েসের বন্ধুটিরই। যা শুনলাম তাতে বুঝেছি মোটেই ভালো নয়। এরা এক ধরনের ঈর্ষাপরায়ণ, হিংসুটে, গোঁয়ার, সব সময়ে কর্তৃত্ব করতে চায়। মৃত্যুর পরও স্বভাব বদলাতে পারে না। এ নিশ্চয় আবার হানা দেবে।

হ্যাঁ, আর একটা কথা, বাঁয়া-তবলাটা কোথায়?

বাইরের ঘরে। যেখানে ছিল।

যদি পারেন ওটা পুড়িয়ে ফেলুন। নইলে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিন। ওটার ওপর আপনার বন্ধু চারুর বিষদৃষ্টি আছে।

বললাম, তা আমি পারব না। ওটা আমার দাদুর স্মৃতি।

পাদ্রীবাবা আমার এই স্পষ্ট কথা শুনে আর কিছু বললেন না। শুধু আশীর্বাদের ভঙ্গিতে ডান হাতটা একটু তুলে চলে গেলেন।

.

০৯.

আমার সব কথা শুনে সেদিন পাদ্রীবাবা আমাকে সাবধানে থাকতে বলেছিলেন। সে নাকি আবার আমার বাড়িতে হানা দিতে পারে। কিন্তু কীভাবে তা প্রতিরোধ করব তার কোনো উপায় বলে দেননি তিনি। অশরীরী আত্মার আক্রমণ থেকে কোনো মানুষ শুধু বন্দুক দিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে পারে এমন কথা শুনিনি। তাহলে!

সন্ধেবেলা বিমর্ষভাবে এইসব কথা ভাবছি, হঠাৎ দাদা-দাদা করতে করতে ভয়ে উত্তেজনায় নকুল বাইরের ঘরে এসে ঢুকল।

কী হয়েছে?

শীগগির আসুন। আবার সেইউঃ কী ভয়ংকর মুখ! তেড়ে এসেছিল। কোনোরকমে–

আমি তখনই উঠে পড়ে বললাম, চলো তো দেখি। বলে বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম। বেশি দূর যেতে হল না। দেখি দালানে ঢোকার মুখেই সেই ছায়ামূর্তি। এবার আরও স্পষ্ট। হাত দশেক তফাত থেকে দাঁড়িয়ে লক্ষ করলাম। হাইট প্রায় সাড়ে পাঁচ ফুট। মাথাটা নারকেলের মতো লম্বাটে। চুল নেই। এই হাইট দেখেই অনেকটা নিশ্চিত হলাম এ আমার সেই ছোটোবেলার শত্রু চারু, যে আমাকে বারে বারে হুকুম করত, শাসাত। কিন্তু সারা গায়ে এত মাটি কেন? শরীর ছাড়া ছায়ামূর্তিটি সর্বাঙ্গে এত ধুলো মাখল কোথা থেকে? সে দাঁড়িয়েছিল পিছন ফিরে। কেমন করে যেন বুঝতে পারল আমি এসেছি। তারপর ধীরে ধীরে মুখটা ফেরাল। মুখটা ফেরানোর সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার ঘরে কোথা থেকে আবছা আলো এসে পড়ল। সেই আলোয় যা দেখলাম তা ভোলবার নয়।

মুখ কোথায়? একটা মড়ার খুলি। চোখ নেই, আছে শুধু দুটো গর্ত। গালে চামড়া নেই, এক চিলতে মাংস মুখে নেই, কিন্তু আছে বড়ো বড়ো হলদে ছোপধরা দাঁতের সারি। সেই দাঁতের সারির ফাঁক দিয়ে একটা অচেনা কর্কশ গলার স্বর শোনা গেল।

…..কুড়ি বছর শেষ….যেতে হবে আমার সঙ্গে। বলতে বলতে দুখানা সরু সরু পা সাইকেল চালাবার মতো বাতাসের মধ্যে দিয়ে প্যাডেল করে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।

আমি আঁতকে উঠে দুপা পিছিয়ে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, না, আমি কোথাও যাব না।

খুলিটার মুখ দিয়ে ফ্যাসফেসে একটা হাসির মতো খানিকটা বাতাস সশব্দে বেরিয়ে এল।

স্পষ্ট শুনলাম করোটির মধ্যে থেকে আসা কথা, যেতে তোমাকে হবেই।

আমি খুব ভয় পেলাম। বললাম, কোথায় যেতে হবে শুনি।

যেখানে আমি আছি।

বিদ্রূপ করে বললাম, সেটা কোথায়? স্বর্গে না নরকে?

সে শুনে তোমার কী লাভ? তুমি তো আমার সঙ্গেই যাবে। তা যেখানেই থোক।

 শোনবার দরকার নেই। তোমার গায়ে এত মাটি দেখে বুঝতে পারছি তুমি স্বর্গে থাকই না, নরকেও না। তুমি থাকো মাটির নীচে। অন্ধকারে কবরে। সেই কবর থেকে তুমি উঠে এসেছ।

হ্যাঁ, তাই। এখন আমার সেই কবরেই তোমাকে নেব। কবে থেকে অপেক্ষা করে আছি কুড়ি বছর। এই কুড়ি বছর পর্যন্ত আমার একটা গিট ছিল। যে গিট পেরিয়ে আমি এখন অনেক স্বাধীন, অনেক মুক্ত। আমার ইচ্ছাশক্তি, ক্ষমতা দুইই অনেক বেড়ে গেছে। চলো শীগগির। বলে আরও এগিয়ে এল।

আমি চিৎকার করে বললাম, তোমার সঙ্গে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। তুমি মৃত। এ সংসারের সঙ্গে তোমার আর কোনো বন্ধন নেই। তুমি যেখানে খুশি যেতে পার, যেখানে খুশি থাকতে পার, কিন্তু আমি জীবিত। সুস্থ শরীরে বেঁচে আছি। বেঁচে থাকব। তা ছাড়া তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কও ভালো ছিল না। তুমি অনেকবার আমার ক্ষতি করবার চেষ্টা করেছিলে। তাই তোমার সঙ্গে কোথাও আমি যাব না। চলে যাও তোমার কবরে। আমাকে বিরক্ত কোরো না। তাছাড়া তুমি অনেকদিন থেকে নকুলকে ভয় দেখাচ্ছ কেন? ও কী করেছে? আমার মনে হয় তুমি নকুলকে সেই চোর বলে ভুল করে এসেছ যে আমারই নির্দেশে তোমার বাড়ি থেকে বাঁয়া-তবলা উদ্ধার করে এনেছিল। তার নাম ছিল গোদা। নকুলের দুর্ভাগ্য ওকে গোদার মতোই দেখতে। ও কি! ওভাবে আমার দিকে এগোচ্ছ কেন? আমি আর্তনাদ করে উঠলাম, নকুল! আমাকে বাঁচা!

কিন্তু কোথায় নকুল? সে বোধ হয় ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে।

এদিকে বাতাসে প্যাডেল করতে করতে এক পা এক পা করে চারুর হিংস্র প্রেতাত্মা আমার গলা টেপবার জন্যে এগিয়ে আসছে। তার দুই চোখের শূন্য কোটরে দপ্ দপ্ করে জ্বলছে আগুনের শিখা।

এগিয়ে আসছে…..ক্রমেই এগিয়ে আসছে মূর্তিমান বিভীষিকার মতো। মৃত্যু তাহলে নিশ্চিত এল সাঁইত্রিশ বছর বয়েসেই।

ভয়ে চোখ বুজলাম।

 আর তখনই শুনলাম নকুলের চিৎকার–পাদ্রীবাবা, ঐ যে–ঐ যে–স্বচক্ষে দেখুন।

আমি চোখ খুললাম। দেখলাম পাদ্রীবাবা গায়ে তার সেই জোব্বা চাপিয়ে ক্ৰসখানি হাতে নিয়ে এগিয়ে আসছেন চারুর প্রেতাত্মার দিকে।

চারুও আমাকে ছেড়ে এক পা এক পা করে পিছোতে লাগল।

নির্ভীক প্রৌঢ় পাদ্রীবাবাও পবিত্র ক্রসটি হাতে নিয়ে চারুর মুখোমুখি হলেন। তিনি ভেবেছিলেন এই ক্রসটি প্রেতাত্মার সামনে ধরলেই অশুভ শক্তি পিছু হটবে।

কিন্তু তা হল না। মৃত্যুর পর কুড়ি বছর ধরে চারু অজেয় হয়ে ওঠার জন্যে কী কঠোর সাধনা করেছিল কে জানে! আমাদের হতচকিত করে দিয়ে সে হঠাৎ হাত দুটোকে দুটো বিরাট কালো ডানায় রূপান্তরিত করে লাফিয়ে ওপরে উঠে গেল। তারপর ডানার ঝাঁপটায় পাদ্রীবাবাকে মাটিতে ফেলে দিয়ে বাতাসে ভেসে গেল। সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড একটা শব্দ হল।

মনে হল কাছেই কোথাও বাজ পড়ল। কিন্তু কোথায় বোঝা গেল না।

পাদ্রীবাবা উঠে দাঁড়ালেন। বিমর্ষভাবে বললেন, এমন দুর্ঘটনা আমার জীবনে কখনও ঘটেনি। পবিত্র ক্রসকেও মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিল! হাত দুটো ওর জ্বলে গেল না?

একটু থেমে বললেন, নকুল যখন ছুটতে ছুটতে গিয়ে আমায় সব কথা বলল তখন ভাবতে পারিনি আমাকে এমন একটা দুর্ধর্ষ আত্মার মুখোমুখি হতে হবে। তা হলে প্রস্তুত হয়ে আসতাম।

ভয়ে ভয়ে বললাম, তাহলে এখন আমরা কী করব? বাড়িতে তো শুধু আমি আর নকুল।

পাদ্রীবাবা বললেন, সেটা আজ রাত্তিরে ভেবে দেখব। কাল সকালে যা হয় করবেন, তার আগে এখুনি চলুন বাজটা কোথায় পড়ল দেখি।

বাজ! নকুল বলল, শব্দ শোনা গেল বাড়ির মধ্যে অথচ রাস্তার কেউ শুনতে পেল না! এ কেমন বাজ?

পাদ্রীবাবা বললেন, চলো তো ভালো করে দেখি। অত জোর শব্দ হল অথচ বাড়ির ক্ষতি হল না। আশ্চর্য!

তখনই দুটো লণ্ঠন হাতে নিয়ে ঘরগুলো দেখলাম। না, কোথাও একটা ইটও ভেঙে পড়েনি।

পাদ্রীবাবা হঠাৎ আমার হাত থেকে লণ্ঠনটা নিয়ে উঁচু করে তুললেন।

 ঐ যে দ্যাখো! ওর আক্রোশ যার ওপর তার ক্ষতি করবেই।

 দেখলাম আলমারির ওপর থেকে পড়ে বায়া-তবলাটা ফেটে চৌচির হয়ে পড়ে রয়েছে।

.

১০.

সে রাত্রে খুব ভয়ে ভয়ে শোবার ঘরে ঢুকে খিল লাগালাম। মনে হল, মৃত চারু আজ যে শক্তি সঞ্চয় করেছে তাতে ঐ কাঠের দরজা দূরের কথা লোহার দরজাও তাকে ঠেকাতে পারবে না।

অমন যে নানা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী পাদ্রীবাবা–তিনিই পারলেন না চারুর সঙ্গে। তিনিই বলে গেলেন চারু হয়তো আবার আসবে আরও ভয়ংকর শক্তি নিয়ে আমাকে শায়েস্তা করতে। অথচ তাকে ঠেকাবার কোনো উপায়ই বাৎলাতে পারলেন না। শুধু ভরসা দিয়ে গেলেন কাল সকালে এসে ব্যবস্থা করবেন।

কাল সকাল! তার আগে গোটা রাতটা কাটবে কী করে?

ঘরের মধ্যে উৎকট নাক ডাকার শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখি ঘরের এক কোণে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে নকুল। সাধারণত সে আমার পাশের ঘরে শোয়। আজ যে এ ঘরে এসে শোবে তার জন্যে আমার অনুমতি নেওয়াও দরকার মনে করেনি। সন্ধের মুখে এই বাড়িতেই প্রেতাত্মার ভয়ংকর হানার পরও কেউ যে একা একটা ঘরে শুতে পারে তা ভাবা যায় না। আমিও ভাবিনি। একবার ভেবেছিলাম নকুলকে ডেকে নেব। তা দেখি নকুল নিজেই এসে বেছে বেছে অপেক্ষাকর নিরাপদ জায়গা হিসেবে টেবিলের আড়ালে বিছানা পেতে নিয়েছে।

ও দেখছি আরও একটি কাজ করে রেখেছে। সব জানলাগুলি বন্ধ করে রেখেছে। এমনকি জানলার ফাঁকগুলোতে কাগজ গুঁজে দিয়েছে।

এতক্ষণে ঘুমে চোখ তুলে আসছিল। বালিশের পাশে টর্চটা ঠিক মতো আছে কিনা দেখে নিয়ে ভগবানের স্মরণ করে চোখ বুজলাম।

কতক্ষণ নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছিলাম জানি না। হঠাৎ দড়াম করে একটা শব্দ হল। ধড়মড় করে উঠে বসে টর্চ জ্বালোম। দেখি উত্তর দিকের জানলার একটা পাট খুলে গেছে। ঝড় নেই, বৃষ্টি নেই জানলার পাটটা খুলে গেল কী করে? আপনাআপনি?

নকুলেরও ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। ভয়ে ভয়ে ডাকল, দাদা।

অভয় দিয়ে বললাম, ও কিছু নয়। জানলাটা খুলে গেছে।

মশারির ভেতর থেকেই নকুল বলল, কিন্তু আমি তো দাদা, সন্ধেবেলাতে সব জানলার ছিটকিনি এঁটে দিয়েছিলাম।

তার কোনো উত্তর না দিয়ে বিছানা থেকে নেমে টর্চ জ্বেলে জানলাটা ভালো করে বন্ধ করে দিলাম।

এতক্ষণে মনে হল ঘরটা যেন বড্ড বেশি অন্ধকার। অথচ স্পষ্ট মনে আছে শোবার আগে ডিম লাইটটা জ্বেলে রেখেছিলাম।

সুইচবোর্ডে টর্চের আলো জ্বেলে দেখি সুইচটা অফ করা আছে। কী আশ্চর্য! আমি হলপ করে বলতে পারি ঐ সুইচ আমি নিজের হাতে অন করে আলো জ্বেলে তবে শুয়েছি।

তাহলে? তাহলে ওটা অফ করে গোটা ঘর অন্ধকার করে রাখল কে? কেনই বা করল?

নকুল ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করল, কিছু গোলমাল?

 বললাম, না। তুমি ঘুমোও।

সকালে ধড়মড় করে উঠেই যখন দেখলাম আমার হাত, পা, ঘাড়, গলা ঠিক আছে আর নকুল ঘরের জানলাগুলো সাবধানে খুলছে তখনই মনে পড়ল সকালবেলাতেই পাদ্রীবাবার আসার কথা। তার আসাটা যে কতখানি দরকার তা শুধু আমিই জানি। সারা রাত্রি চিন্তা ভাবনা করে তিনি আজ আমাকে জানাবেন এই ভয়ংকর প্রেতাত্মার হাত থেকে কী ভাবে নিষ্কৃতি পাব। তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে, চা খেয়ে অপেক্ষা করে রইলাম। অপেক্ষা করছি তো করছিই। পাদ্রীবাবার পাত্তা নেই।

অধৈর্য হয়ে নকুলকে পাঠালাম পাদ্রীবাবার বাড়িতে। কিছুক্ষণ পর ফিরে নকুল জানাল উনি বাড়ি নেই। তালা বন্ধ।

অবাক হলাম। সাধারণত উনি বিশেষ কোথাও যান না। যাবার জায়গাও নেই। তা হলে আজ এই সাত-সকালে দরজায় তালা দিয়ে কোথায় গেলেন?

এমন ভয়ও হল চারু ওঁর কোনো বড় রকমের ক্ষতি করে দেয়নি তো?

এইসব আবোল-তাবোল নানা কথা যখন ভাবছি তখন বাড়ির দরজায় একটা রিকশা এসে দাঁড়াল। আর পাদ্রীবাবা হাতে একটা ছোট্ট ব্যাগ নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে এসে দাঁড়ালেন আমার কাছে। উত্তেজিত ভাবে বললেন, বলুবাবু ভাই, আর একটা রিকশা নিয়ে চলুন আমার সঙ্গে।

অবাক হয়ে বললাম, এই রোদ্দুরে–কোথায়? আপনি যে বলেছিলেন কী করতে হবে তার পরামর্শ দেবেন।

পাদ্রীবাবা বিরক্ত হয়ে বললেন, আর সময় নেই। এখনই কবরখানায় গিয়ে আপনার বন্ধুর হাড়গোড় যা পাওয়া যায় তা তুলতে হবে।

সে আবার কী?

 পাদ্রীবাবা ধমক দিয়ে বললেন, কথা পরে। ঐ রিকশাটা দাঁড় করান।

নকুল কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল। বলল, দাদা, আমি যাব না?

পাদ্রীবাবা বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাবে। দরজা বন্ধ করে চটপট উঠে পড়ে।

ইতস্তত করে বললাম, কিন্তু কবর থেকে মৃতদেহ তুলতে গেলে তো অনেক হাঙ্গামা পারমিশান-টারমিশান…

ও নিয়ে ভাববেন না। যা-যা-করার সব করে নিয়েছি। একটা অসুবিধা ছিল চারুর ফ্যামিলির পারমিশান নেওয়া। ওর সাবেক বাড়িতে গিয়ে জানলাম চারুর আত্মীয়স্বজন কেউ নেই।

কবরস্থানে এসে যখন পৌঁছলাম মাথার ওপর তখন মধ্যাহ্নের রোদ গনগন করছে। দেখলাম জিপভর্তি আর্মড পুলিশ আগেই এসে গেছে। চার্চের চত্বরে বসে আছে ঝুড়ি, কোদাল, শাবল নিয়ে জনা চারেক কবর খোঁড়ার লোক। একটু পরেই এসে পড়লেন মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান যিনি তাঁর মোটা শরীর আর বিশাল ভুড়ি নিয়ে রিকশা থেকে নেমেই একটু বিরক্তির সঙ্গে পাদ্রীবাবাকে জিগ্যেস করলেন, কী ব্যাপার বলুন তো মিস্টার অ্যান্টনি? আজকের দিনেও ভুত-প্রেত বিশ্বাস করতে হবে নাকি?

পাদ্রীবাবা বললেন, এতদিন বিশ্বাস করার প্রশ্ন ওঠেনি। আজই উঠেছে।

হ্যাঁ, যা শুনলাম তা সত্যি হলে তো সাংঘাতিক ব্যাপার মশাই! আবার হানা দেবে নাকি?

পাদ্রীবাবা হেসে বললেন, যাতে আর সে-সুযোগ না পায় তার জন্যেই আজকের এই ব্যবস্থা।

এখন কী করতে চান? জিগ্যেস করলেন চেয়ারম্যান।

পাদ্রীবাবা বললেন, এখানেই একটি কবরে কুড়ি বছর ধরে শুয়ে আছে চারু বিশ্বাস। তার দুরন্ত আত্মা আজও শান্তি পায়নি। এই বলুবাবুর ওপর পূর্বজীবনের রাগ পুষে রেখে তাকে মারবার চেষ্টা করছে। এই কবর থেকেই দরকার মতো উঠে এসে হানা দেয় বলুবাবুর বাড়ি। কাল সন্ধেবেলায় আমি স্বচক্ষে যা দেখেছি তা ভয়ংকর।

চেয়ারম্যান বললেন, হ্যাঁ, শুনেছি। তা কী করবেন?

তার অপবিত্র দেহাবশেষ কবর থেকে তুলে পুড়িয়ে ফেলব। তাহলেই আর হানা দেবার কেউ থাকবে না।

কিন্তু এমনও তো হতে পারে আপনার ধারণাটা ঠিক নয়। শুধু শুধু একটা সাধারণ দেহাবশেষ তুলবেন। সে কংকালটা চারু বিশ্বাসের হতে পারে। কিন্তু তা যে প্রেতযযানিপ্রাপ্ত তার প্রমাণ দিতে পারবেন?

পাদ্রীবাবা গম্ভীরভাবে বললেন, কাউকে প্রমাণ দেবার জন্যে আমি নাটক করছি না। আমার অভিজ্ঞতা দিয়ে যা কর্তব্যবোধ করছি তাই করতে যাচ্ছি। যদি না করি–একদিনও দেরি করি–তা হলে ঐ ভদ্রলোকের প্রাণসংশয় হবেই।

হঠাৎ এই সময়ে আকাশে ধোঁওয়ার মতো মেঘ জমে সূর্যকে ঢাকা দিয়ে দিল।

পাদ্রীবাবা চেঁচিয়ে উঠলেন, কুইক কুইক শীগগির কবর খুঁড়ে ফেলো। ও জানতে পেরেছে।

কবর তো খুঁড়বে কিন্তু কোনটা চারু বিশ্বাসের কবর তা তো বোঝবার উপায় নেই। সে সময়ে কবর কেউ বাঁধিয়ে রাখেনি। কুড়ি বছর পর

হ্যাঁ গো, বলুবাবু, আপনার বন্ধুর কবর কোনটা চিনতে পারেন?

 পরপর ধসে যাওয়া মাটির গর্তগুলোর দিকে তাকিয়ে আমি মাথা নাড়লাম।

বললাম, কুড়ি বছর কম সময় নয়। তাছাড়া এতদিন এখানে আমার দরকার হয়নি। জায়গাটার অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। তবে মনে আছে একটা গাছের নীচে

আসুন দেখি।

পাদ্রীবাবার সঙ্গে ঝোপঝাপ ঠেলে কবরগুলো দেখতে দেখতে চললাম। ওঁর দৃষ্টি কবরের দিকে। আমি লক্ষ করছি ধারে তেমন কোনো পুরোনো গাছ আছে কিনা।

একটা কবরের কাছে এসে পাদ্রীবাবা থামলেন। হেট হয়ে মাটি পরীক্ষা করলেন। তারপর গভীর নিশ্চয়তার সঙ্গে বললেন, এইটাই—

আমি অবাক হয়ে পাদ্রীবাবার দিকে তাকালাম। পাদ্রীবাবা হেসে বললেন, কী বিশ্বাস হচ্ছে না? আচ্ছা, পাশাপাশি অন্য কবরগুলো লক্ষ করুন। এর মাটিগুলো ঢিলেঢালা। কেউ যেন মাটিগুলো মাঝে মাঝে সরায়।

শুনে আমার গায়ে কাঁটা দিল। তাহলে এই কবর থেকে কফিন খুলে, মাটি ঠেলে, উঠে আসে চারু!

চেয়ারম্যানবাবু কখন পিছনে এসে নাকে রুমাল চেপে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

কবরের মাটি ছুঁলেন, মিস্টার অ্যান্টনি! বলিহারি যা হোক!

পাদ্রীবাবা হাসলেন। বললেন, কবরের মাটি খুবই পবিত্র। শেষ পর্যন্ত ঐখানেই তো আমাদের গতি! আরে! অন্ধকার হয়ে এল যে!

দেখতে দেখতে কালো মেঘে আকাশ ছেয়ে গেল।

পাদ্রীবাবা ব্যস্ত হয়ে বললেন, মাটি তোলো, আর দেরি নয়। এখুনি ঝড় উঠে সব লণ্ডভণ্ড করে দেবে।

তখনই একসঙ্গে কোদাল, শাবল, গাঁইতি কবরটাকে ক্ষতবিক্ষত করে দিল। দশ মিনিটের মধ্যেই শাবলের ঘা লাগল কফিনের গায়ে। আর তখনই উঠল ঝড়। চারিদিক ধুলোয় ধুলো।

তোলো কফিন! কুইক!

কফিন তোলা হল।

 ভাঙো। যিশুর পবিত্র ক্রস হাতে নিয়ে গম্ভীর গলায় আদেশে করলেন পাদ্রীবাবা।

পুরোনো জীর্ণ উইধরা কফিনের ডানা গাঁইতির এক চাপে ভেঙে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকে পড়ল সবাই।

একটা গোটা কংকাল শুয়ে আছে কফিনের মধ্যে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। কোথাও এতটুকু ধুলোমাটি নেই। মনে হল কেউ যেন কংকালটা ধুয়ে মুছে রেখে গিয়েছে।

চোয়ারম্যানবাবু খুব উঁচু থেকে নাকে রুমাল চেপে কফিনের দিকে তাকিয়ে ওরে বাবা! ও যে আস্ত কংকাল! বলে দশ পা পিছিয়ে গেলেন।

কফিনটা ওপরে তোলা হয়েছে। হঠাৎ পাদ্রীবাবু ঝুঁকে পড়লেন কংকালের ওপরে।

কংকালের পাঁজরের মধ্যে ওটা কী পাদ্রীবাবা?

সবাই দেখল সমুদ্রের বড়ো কঁকড়ার মতো কালো একটা কী পাঁজরের মধ্যে যেন বাসা বেঁধেছে।

পাদ্রীবাবা বললেন, বলা যায়, এটাই ভ্যাম্পায়ারের হার্ট। দাঁড়ান ওটা খুঁচিয়ে ভেঙে দিই।

বলে যে মুহূর্তে পাদ্রীবাবা একটু অন্যমনস্ক হয়েছেন তখনি কংকালটা লাফিয়ে উঠে দুহাত বাড়িয়ে তার গলা টিপতে গেল। বিচক্ষণ পাদ্রীবাবা যেন বুঝতে পেরেছিলেন এরকম কিছু ঘটতে পারে। তিনি তার ব্যাগ থেকে একটা হাতুড়ি বের করে অব্যর্থ লক্ষ্যে ঘা মারলেন কংকালের খুলিতে। খুলি ফেটে চৌচির হয়ে গেল। কংকালটা লুটিয়ে পড়ল কফিনে। আরশোলার মতো অনেকগুলো পোকা খুলি থেকে বেরিয়ে কফিনের মধ্যে ছোটাছুটি করতে লাগল।

যাক শান্তি! দুহাত তুলে বলে উঠলেন পাদ্রীবাবা।

তারপর চেয়ারম্যানের দিকে ফিরে বললেন, চেয়ারম্যানবাবু, আমার কাজ শেষ। এবার আপনার কাজ করুন।

চেয়ারম্যান সে কথার উত্তর না দিয়ে বললেন, কী সর্বনাশ! আর একটু হলেই তো আপনি মরেছিলেন। চোখের সামনে দেখলাম অত বড়ো গোটা কংকালটা লাফিয়ে উঠে আপনাকে মারতে গেল!

যাক মারতে তো পারেনি। এখন কফিনসুদ্ধ কংকালটা নিয়ে গিয়ে পোড়াবার ব্যবস্থা করুন।

তা করছি। কিন্তু আপনি?

আপনারা যান। আমি সামান্য একটু কাজ সেরে যাচ্ছি।

বলে তিনি আমাকে নিয়ে শূন্য কবরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর ব্যাগ থেকে কিছু অজানা গাছের শুকনো লাল পাতা আর কিছু শুকনো লতাপাতা বের করে কবরের মধ্যে ছড়িয়ে দিলেন।

তারপর নকুলকে নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে রিকশায় উঠলাম। তখন ঝড় থেমে গেছে। প্রকৃতি শান্ত।

[শারদীয়া ১৪১৪]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *