ছত্রিশগড়ের ভাঙা গড়

ছত্রিশগড়ের ভাঙা গড়

দশ নম্বর ঘর

হোটেলের ম্যানেজার ভদ্রলোকটিকে প্রথম দর্শনেই আমার ভালো লেগেছিল। এক একটি মুখ আছে যেটা আগে-ভাগেই যেন জানিয়ে দেয় মানুষটি কেমন হবে। এ ক্ষেত্রেও তাই। হোটেলে ঘর বুক করার জন্যে কাউন্টারের সামনে দাঁড়াতেই অপরিচিত মানুষটি নিতান্ত চেনা মানুষের মতো হেসে বললেন, নিশ্চয়ই কলকাতা থেকে আসছেন। একাই এসেছেন বুঝতে পারছি। আর নিশ্চয়ই ওপরে খোলামেলা একটা ঘর চাই যাতে চারদিকে প্রকৃতির শোভা দেখতে পান। তাই তো?

আমি হেসে বললাম, এক্কেবারে ঠিক।

ভদ্রলোক একটা লম্বা খাতা মেলে ধরে বললেন, নিন, এখানে নামধাম লিখুন। ভালো ঘরই দিচ্ছি।

নামধাম লিখতে লিখতে মনে মনে বললাম, ভালো ঘর যে সহজেই পাব তা বুঝতেই পারছি। কারণ ঘর নেবার জন্যে মোটেই ভিড় নেই।

কদিনের জন্যে থাকবেন ভাবছেন?

বললাম, দেখি। ভালো লাগার ওপর সব নির্ভর করছে।

আপনি নিশ্চয় এখানে এসেছেন ছত্রিশ-গড়িয়াদের উৎসব দেখতে?

হেসে বললাম, হ্যাঁ। কিন্তু আলাপ হতে না হতেই কী করে আসার কারণ পর্যন্ত ধরে ফেললেন? গোয়েন্দা-টোয়েন্দা নন তো?

ভদ্রলোক হেসেই বললেন, আরে না মশাই, ওসব কিছু নয়। আসলে দেখেছি কলকাতায় এক রকমের টিপিক্যাল বাঙালি আছেন যাঁরা প্যান্ট আর হাওয়াই শার্টের সঙ্গে কাঁধে একটা শান্তিনিকেতনী ব্যাগ ঝোলাতে ভোলেন না। এঁরা প্রায়ই হন কবি, শিল্পী কিংবা গবেষক। আপনার হাতে তো আবার দেখছি এ অঞ্চলের আদিবাসীদের নাচগানের ওপর লেখা ইংরিজি বইও রয়েছে–ফোক ডান্স।

মনে মনে ভদ্রলোকের লক্ষ করার শক্তির প্রশংসা করলাম। মুখে বললাম, হ্যাঁ, বইটা পড়তে পড়তে আসছিলাম, হাতেই থেকে গেছে।

ভদ্রলোক বললেন, কদিনের জন্য থাকবেন? আপাতত এক সপ্তাহ না হয় লিখুন।

 আমি তাই লিখে টাকাপয়সা চুকিয়ে দিলাম।

 আপনার নামটা জানতে ইচ্ছে করছে।

ভদ্রলোক তখনই ব্যাগ থেকে একটা কার্ড বের করে দিলেন। বললেন, নাম জানার ইচ্ছে বললে কম হয় মিস্টার বর্ধন, আমার নামটা জানতেই হবে। নইলে এই সাত দিন ধরে কি কেবল মিস্টার মান্না মিস্টার মান্না করবেন?

হেসে বললাম, আপনি ঠিকই বলেছেন, সুরঞ্জনবাবু। ধন্যবাদ।

সুরঞ্জনবাবু বললেন, দাঁড়ান, এবার আপনার ঘরের ব্যবস্থা করে দিই। লাগেজ তত বেশি নেই দেখছি। বলে টেবিলের ওপর রাখা পেতলের ঘণ্টিটা বাজালেন। একবার…দুবার……তিনবার। কিন্তু কেউ এল না।

নাঃ, এদের একটাকেও পাবার উপায় নেই। আসলে হয়েছে কী, বোর্ডার কম তো, কঁহাতক আর বসে বসে গামছা নেড়ে মাছি তাড়ায়। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে একটু আড্ডা দিতে বেরিয়েছে আর কি। চলুন, আমিই আপনাকে ঘরটা দেখিয়ে দিই। বলে কী-বোর্ড থেকে চাবি নেবার জন্যে উঠতে যাবেন, একটা গাড়ি এসে থামল।

কে এল রে বাবা? বলে সুরঞ্জনবাবু চেয়ার থেকে অর্ধেক উঠে উঁকি মারলেন।

দেখলাম লম্বা-চওড়া বিরাটবপু একজন ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নেমে ঝকঝকে জুতোয় মস মস শব্দ তুলে এগিয়ে এলেন। ভদ্রলোকের গায়ের রং কালো। পুরু গোঁফ। উজ্জ্বল দৃষ্টি। পরনে দামী সুট। তিনি যে যথেষ্ট ধনী তা তাঁর হাবভাব আর দুহাতের ছটা আঙুলে হিরে সমেত অন্য দামী পাথরের আংটির বহর দেখলেই বোঝা যায়।

সুরঞ্জনবাবু অন্তরঙ্গ বন্ধুর মতো আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন, উনি কী উদ্দেশ্যে এখানে থাকতে চান বলতে পারেন?

মাথা নাড়লাম।

বললেন, আমার ধারণা যদি ভুল না হয় তাহলে উনি হচ্ছেন একজন ঝানু ব্যবসাদার। এখানে এসেছেন নতুন কোনো ব্যবসার তাগিদে।

বিপুল চেহারার লোকটি কাউন্টারের সামনে এসে সুরঞ্জনবাবুর দিকে ডান হাতটা বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে বললেন, I am Kartik Virabagu from Ranchi.

কার্তিক! চমকে উঠে বললেন সুরঞ্জনবাবু। বাঙালি?

মিস্টার ভিরাবাও যেন অনেক কষ্টে একটু হাসলেন। ক্ষণেকের জন্য ওপরের সারিতে তার সোনা বাঁধানো দাঁতটা দেখা গেল। বললেন, হ্যাঁ, আমি বাঙ্গালি খৃস্টান আছি। তবে বাঙ্গালা দেশের সঙ্গে আমার সম্পর্ক খুব কম আছে। আমার যা কিছু বিজনেস্ সব এদিকে। যাই হোক, কয়েক দিনের জন্যে একটা ভালো ঘর দিন। দোতলার দশ নম্বর ঘরটাই আমার পসন্দ।

সুরঞ্জনবাবু অবাক হয়ে বললেন, দশ নম্বর। যত দূর আমার মনে হচ্ছে এ হোটেলে এর আগে আপনি কখনও আসেননি। তাহলে দশ নম্বর ঘরটাই চাইছেন কেন? কোনো বিশেষত্ব আছে কি?

মিস্টার ভিরাবাগুর চোয়ালটা শক্ত হল যেন। একটু ভেবে ভাঙাভাঙা বাংলায় বললেন, speciality আছে কিনা জানি না তবে আমার পরিচিতদের মধ্যে আগে যাঁরা এখানে থেকে গেছেন তাদের কেউ কেউ বলেছেন, এখানে এলে যেন দশ নম্বর ঘরটা নেবার চেষ্টা করি। কারণ ও ঘরটা নাকি পয়া। অ্যান্ড ইউ নো, আমি যখন নতুন ব্যবসার সন্ধানে এ অঞ্চলে এসেছি তখন ঐ ঘরটাই নেব।

But I am sorry, আমি খুবই দুঃখিত মিস্টার ভিরাবাগু, এ ঘরটা মাত্র ক মিনিট আগে বুকড় হয়ে গেছে।

কিন্তু ঐ ঘরটাই যে আমি চাই। তার জন্যে যদি বেশি টাকা দিতে হয় দেব।

বেশি টাকার কথায় অমন হাসিখুশি সুরঞ্জনবাবুর গলার স্বর বদলে গেল। বললেন, একবার একটা ঘর কাউকে অ্যালট করা হয়ে গেলে ডবল টাকা দিলেও তা আর কাউকে দেওয়া যাবে না।

এররম স্পষ্ট কথায় মিস্টার ভিরাবাগুর দুই চোখ জ্বলে উঠল। তিনি শান্ত গম্ভীর গলায় বললেন, একটা কথা জিগ্যেস করতে পারি?

করুন।

এই হোটেলের মালিক কি আপনি?

সুরঞ্জনবাবু বললেন, না। আমি কর্মচারী মাত্র।

তা হলে মালিকের সঙ্গে আমি কথা বলতে চাই।

 তিনি এখানে থাকেন না।

কোথায় থাকেন?

 দিল্লিতে।

ব্যবসায়ী ভদ্রলোক যেন হতাশায় ভেঙে পড়লেন, My God!

একটু ভেবে নরম গলায় বললেন, তা হলে কোনো উপায়ই নেই?

অত বড়ো লোকটার ঐ রকম হতাশ হয়ে পড়া অবস্থা দেখে আমার মনটাও ভিজে গেল। আমার কাছে পয়া-অপয়ার কোনো ব্যাপার নেই। ছত্রিশগড়ের আদিবাসীসের নানারকম পরবের কথা শুনেছি, হাতে অঢেল সময়, তাই ছুটে এসেছি এখানে। আদিবাসীদের পরব দেখা ছাড়াও প্রকৃতির দৃশ্য, পুরনো গড় এসব দেখার লোভও আছে। এসবের সঙ্গে পয়া অপয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। কাজেই দশ নম্বর ঘরটার বদলে যদি নয় নম্বর ঘর পাই তাতে আমার ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। বরঞ্চ আর একজনের উপকার হবে।

মনে মনে কথাগুলো আউড়ে মুখে প্রকাশ করতে যাচ্ছি, সুরঞ্জনবাবু তা বুঝতে পেরে আমায় হাত টিপে নিরস্ত করলেন। ব্যবসায়ী বাবু তা বুঝতে পারলেন না।

সুরঞ্জনবাবু বললেন, আমি খুবই দুঃখিত মিস্টার ভিরাবাগু, এখনই ঐ ঘরটা দিতে পারছি না।

ভিরাবাগু বললেন, তা হলে দোতলায় নর্থ ফেসিং যে কোনো একটা ঘর দিন। বলে পার্স খুলে একগোছা নোট বের করলেন।

সুরঞ্জনবাবু হোটেলের খাতাটা বের করে সামনে ধরলেন। মিস্টার ভিরাবা নাম-ঠিকানা ইত্যাদি লিখলেন।

ঘর বুক করা রইল। মালপত্তর নিয়ে একটু পরে আমি আসছি।

বলে চলে যাচ্ছিলেন, ফিরে দাঁড়িয়ে বললেন, হয়তো আরও জনা তিনেক আসতে পারেন। আমার নাম করলে অনুগ্রহ করে তাদেরও একটু জায়গার ব্যবস্থা করে দেবেন।

আচ্ছা। বলে সুরঞ্জনবাবু খাতাপত্তর তুলে রেখে কী বোর্ড থেকে চাবি নিয়ে আমাকে ডাকলেন, আসুন।

.

অদৃশ্য হাতের চাপ

ঘরের তালা খুলে নিজে হাতে ঝাড়ন দিয়ে বিছানা, চেয়ার, টেবিল, ড্রেসিং আয়না পরিষ্কার করে আমায় সযত্নে ঘরে অধিষ্ঠান করিয়ে দিয়ে সুরঞ্জনবাবু যখন নীচে অফিস ঘরে চলে গেলেন তখন সবে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। আশ্বাস দিয়ে গেলেন সন্ধেবেলায় আবার আসবেন। আমি ব্যাগ থেকে হালকা একটা চাদর বার করে বিছানায় পেতে নিলাম। টর্চটা রাখালাম বালিশের পাশে।

একটা পুরনো বাড়ির ঘর আর কত ভালো হতে পারে? তবু চারদিক খোলা উত্তরমুখী ঘরটা ভালোই। সে আমলের মোটা মোটা গরাদ আর খড়খড়ি দেওয়া বড়ো বড়ো জানলা দিয়ে আলো-বাতাসের অবাধ খেলা চলছে।

বাড়ির মতো টেবিল চেয়ারও পুরনো। টেবিলের পায়া বোধহয় ভেঙে গিয়েছিল। সম্প্রতি নতুন একটা পায়া লাগানো হয়েছে। ঘরের লাগোয়া বাথরুমে একটা শাওয়ার আছে বটে তবে জল পড়ে না। বাথরুমের জানলার শার্শি বিপজ্জনকভাবে ভাঙা। বিপজ্জনক এই কারণে যে, পাশেই যে আমগাছটা ডাল মেলে দিয়েছে হোটেলের ছাদের ওপর, সেই ডাল ধরে যে কেউ বাথরুমের জানলাটার নাগাল পেয়ে যাবে। তারপর ভাঙা শার্শির মধ্যে দিয়ে হাত ঢুকিয়ে ছিটকিনি খুলতে অসুবিধে হবে না।

ঠিক করলাম সন্ধ্যায় সুরঞ্জনবাবু যদি আসেন তা হলে কালকেই যাতে নতুন কাচ বসানো হয় সে কথা ওঁকে বলব। আর সেই সঙ্গে জিগ্যেস করব হোটেল করার আগে বহুদিনের এই বাড়িটা কী ছিল? অর্থাৎ আজ থেকে পনেরো-বিশ বছর আগে এই সব জায়গায় ক্কচিৎ লোক বাস করলেও পাকা বাড়ি তৈরি করে কোনো ধনী দুঃসাহসী লোক ছেলেপুলে নিয়ে থাকত এমন তো বিশ্বাস হয় না।

বেলা সাড়ে চারটের সময় হোটেলের বয় বেশ বড়ো কাপে চা আর প্লেটে খানকয়েক বিস্কুট দিয়ে গেল। তার সঙ্গে ভাব জমাবার জন্যে জিগ্যেস করলাম, তোমার নাম কী?

বিরস মুখে উত্তর দিল, মহেন্দ্র সেনাপতি।

 দেশ কোথায়?

ভুবনেশ্বর।

তার মানে ওড়িয়া?

 হ।

 তা এত দূরে এলে কেন? কাছেপিঠে কি খুঁজলে কাজ পেতে না?

মহেন্দ্র তার উত্তর না দিয়ে নীচে নেমে গেল। বুঝলাম ছোকরা আলাপী না। অবশ্য তার ট্রেতে আরও কয়েক কাপ চা আর বিস্কুট ছিল। অন্য বোর্ডারদের বোধহয় এখনি দিতে হবে।

চা খেয়ে সামনের খোলা বারান্দায় পায়চারি করতে লাগলাম। আমার ঘরের ডান দিকে আরও তিনখানা ঘর। আলাপ করার মতো তেমন কেউ আছেন কিনা দেখবার জন্য ওদিকে গিয়েছিলাম। কিন্তু দেখলাম তিনটে ঘরেই তালা ঝুলছে। বুঝলাম ঘরগুলোতে বোর্ডার নেই। অগত্যা চুপচাপ নিজের ঘরের সামনের বারান্দায় পায়চারি করতে লাগলাম।

পায়চারি করতে করতে কত কথাই মনে হতে লাগল। কোথায় কলকাতা আর কোথায়। এই ছত্রিশগড়!

কিছুকাল আগেও কেউ ছত্রিশগড়-এর নাম শোনেনি। শোনবার কথাও নয়। ভারতবর্ষের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো প্রদেশ ছিল মধ্যপ্রদেশ। চার কোটি পনেরো লক্ষের মতো লোক বাস করত। তার মধ্যে বাঙালিই ছিল দু লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজারের কাছাকাছি। তারপর এই সেদিন মধ্যপ্রদেশের বিরাট শরীর থেকে বেশ কিছু অংশ কেটে হাল্কা করে দিয়ে তৈরি করা হল আলাদা একটা রাজ্য। যার নাম হল ছত্রিশগড়। এর মধ্যে ঢুকল বিলাসপুর, সুরগুজা, রায়গড়, রায়পুর, দ্রুগ, স্যাডোল আর বস্তারের মতো ভালো ভালো জেলাগুলো।

ছত্রিশগড়! পুরাতত্ত্ব বিভাগের তথ্য অনুযায়ী বুদ্ধদেবের সময়ে আজকের এই ছত্রিশগড়েরই নাম ছিল নাকি মহাকোশল!

তাহলে কোশল থেকে ছত্রিশগড় নাম হল কী করে? দুটো নামের মধ্যে তো এতটুকু মিল নেই।

এই সব প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে আমার বেশ ভালো লাগে।

আসলে ইতিহাসবেত্তারা শুনিয়েছেন অন্য কথা। এক সময়ে ঐ মহাকোশলে রাজত্ব করতেন ছেদী বংশের রাজারা। তাদের নাম থেকেই ছেদিসগড়–তা থেকে হয়ে দাঁড়াল ছত্রিশগড়।

বহু প্রাচীন জায়গা এই ছত্রিশগড় বা ছেদিসগড়। তাই মনে হতে লাগল চারিদিকে এই যে শাল-সেগুনের গভীর অরণ্য, দূরে ঐ যে অস্পষ্ট পাহাড়ের রেঞ্জ, এই যে পুরনো পুরনো ভাঙা বাড়ি–এসবের মধ্যে লুকিয়ে আছে না জানি কত ইতিহাস–কত ভয়ংকর কাহিনি।

এখন শরৎকাল। বেলা ছোটো হয়ে এসেছে। বড্ড তাড়াতাড়ি সন্ধে হয়ে আসছে। এখনও দূরে বাতাসে কাশফুলের মাথাগুলো দুলতে দেখা যাচ্ছে।

হঠাৎ দূরে ঘোর কালো কী একটা বস্তু যেন দৈত্যের মতো মাটি খুঁড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে বলে মনে হল। এতক্ষণ ওদিকটায় মেঘ ছিল বলে ওটা দেখা যায়নি। এখন মেঘ সরে যাওয়ায় জিনিসটা চোখে পড়ল।

কী ওটা? ছোটো একটা পাহাড়? অথবা দুর্গের আকারে কোনো উঁচু বাড়ি?

যাই হোক, কেন জানি না ঐ দিকে বেশিক্ষণ তাকানো যায় না। কেমন যেন ভয় করে। তাই ঘোর অন্ধকারে ওটা দৃষ্টির আড়ালে অদৃশ্য হবার আগেই আমি ঘরের দিকে পা বাড়ালাম। কিন্তু

কিন্তু বারে বারেই সেই বস্তুটার দিকে তাকাবার জন্যে মনের মধ্যে উথালপাথাল করতে লাগল। সেই তীব্র আকর্ষণের কাছে আমাকে শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতেই হল। ঘরের দিকে আমি দুপা এগোই আর একবার করে পিছনে ফিরে দেখি।

এক সময়ে আমার এমনও মনে হল ঐ বিশ্রী বস্তুটা অন্ধকারে গা মিলিয়ে দুলতে দুলতে যেন আমাদের হোটেলটার দিকেই এগিয়ে আসছে।

কেন এরকম মনে হল তার কোনো কারণ আজও খুঁজে পাই না। তখনও জানতাম না একটু পরেই আরও কিছু অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হবে।

আমি যখন ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম তখন অন্ধকার হয়ে গেছে। খোলা বারান্দায় পায়চারি করতে আসার আগে আমি ঘরের দরজায় শেকল তুলে এসেছিলাম। এখন দরজা খোলবার জন্যে শেকলে হাত দিতে গিয়ে আঁতকে উঠলাম। লোহার মতো একটা কঠিন হাত শেকলটা মুঠোর মধ্যে ধরে আছে যেন দরজা খুলতে দেবে না। আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, কে?

সঙ্গে সঙ্গে সেই অপরিচিত হাতখানি অদৃশ্য হয়ে গেল। শেকলটা ঝনাৎ করে আপনিই খুলে গেল।

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে আমি বিভ্রান্ত হয়ে পড়লাম। কোন দিকে সুইচ, কোন দিকে আমার বিছানা, কোন দিকে ড্রেসিং টেবিল সব যেন খুলিয়ে গেল। এদিকে বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ডটা লাফালাফি করছে। এই শরতের সন্ধ্যাতেও কপালে বিনবিনে ঘাম। এখন সর্বাগ্রে দরকার আলো। কিন্তু সুইচটা কোন দিকে?

বেশ কয়েকবার এদিক থেকে ওদিক ঘুরে, দেওয়ালে বার কতক ঠোক্কর খেয়ে সুইচটা খুঁজে পেলাম। আলো জ্বলে উঠল, এতক্ষণে আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।

পুরো এক গেলাস জল খেয়ে আমি বিছানায় বসলাম। তারপর শুয়ে পড়লাম।

এবার ভাবতে লাগলাম, ব্যাপারটা কী হল? আমি শহর কলকাতায় থাকি। এই ধরনের অলৌকিক, অবৈজ্ঞানিক ব্যাপার মোটেই বিশ্বাস করি না। তা হলে একটু আগে এই যা ঘটল তার ব্যাখ্যা কী? প্রথমটার কথা ছেড়েই দিলাম। ওটা না হয় পরিবেশের প্রভাবে মনের ব্যাপার, কিন্তু শেকল চেপে ধরেছিল যে হাতটা সেটা তো শুধুই মনের ব্যাপার নয়। কে? বলে হুংকার দিতেই হাতটা যে সরে গেল সে ব্যাপারটাকে তো কিছু না, মনের ভুল বলে উড়িয়ে দিতে পারব না। তাছাড়া ঝনাৎ করে শেকলটার খুলে পড়া? আমি তো খুলিনি।

এই সব ভাবছি, এমনি সময়ে সিঁড়ির দিকের দরজায় শব্দ হল ঠুকঠুকঠুক।

কে আবার এল এখন? মনে পড়ল সুরঞ্জনবাবুর আসার কথা। উনি এলে ভালোই। কিন্তু ওঁকে কি এই যা সব ঘটল, যার কোনো প্রমাণ নেই, তা বলা যাবে?

.

পাহাড়ের উপর কেল্লা

সুরঞ্জনবাবু ঢুকলেন হাসতে হাসতে। প্রথমেই বললেন, সিঁড়ির দরজাটা শুধু ভেজিয়ে রেখেছিলেন, খিল দেননি?

অন্যমনস্কভাবে উত্তর দিলাম, তা হবে। সন্ধেবেলাতেই খিল লাগাতে হবে ভাবিনি।

সুরঞ্জনবাবু গার্জেনের মতো উপদেশ দিয়ে বললেন, নানা, সব সময়ে খিল দিয়ে রাখবেন। পাহাড়-জঙ্গলের জায়গা, বিপদ ঘটতে কতক্ষণ?

অবাক হবার ভান করে বললাম, বিপদ? কিসের বিপদ?

সুরঞ্জনবাবু সহজভাবেই বললেন, বিপদ যে কত রকমের হয় আর কখন কোন দিক দিয়ে ঘাড়ে এসে পড়ে তা কেউ বলতে পারে না, সোমেশ্বরবাবু। মোট কথা একটু সাবধানে থাকতে হয়। বাঃ, এর মধ্যেই ঘরটা বেশ গুছিয়ে ফেলেছেন তো!

বলতে বলতে উনি বিছানার ওপর বসে পড়লেন। বিকেলে চা দিয়েছিল?

মাথা দুলিয়ে সায় দিলাম। তবে ছেলেটা খুব মিশুকে বলে মনে হল না। একটু যেন এড়িয়ে চলতে চায়।

আসলে কী জানেন? এ অঞ্চলের লোকেরা যেমন নিরীহ তেমনি ভীতু। ওদের কেবলই ভয় এই বুঝি চাকরি গেল। বড়ো গরিব। অল্পে তুষ্ট। সামান্য বাসি ভাত আর একটু নুন হলেই এরা খুশি। সে তুলনায় হোটেলে তো ওরা রাজভোগ খায়। তাই সব সময় তটস্থ।

এখানকার খাওয়ার স্ট্যান্ডার্ড বোধহয় ভালোই?

সুরঞ্জনবাবু হেসে বললেন, এ বেলা খেলেই বুঝবেন। মাংসে অরুচি নেই তো?

হেসে বললাম, না, মোটেই না।

উনি আমার অনুমতি নিয়ে একটা সিগারেট ধরালেন।

বললাম, তখন বলেছিলেন এই হোটেলের মালিক দিল্লিতে থাকেন, তা হলে তো আপনার দায়িত্ব অনেকটাই।

সুরঞ্জনবাবু বললেন, তা বলতে পারেন। এক সময়ে রায়পুরে যখন উনি থাকতেন তখন আমার বাবার সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব ছিল। নিতান্তই শখ করে রায়পুর-বিলাসপুর থেকে ঢের দূরে এই রকম নির্জন জায়গায় তিনি হোটেল খুললেন। উদ্দেশ্য বাইরে থেকে ভ্রমণবিলাসীরা এসে এখানকার আদিবাসীদের নানা উৎসব, যা একেবারে খাঁটি লোকসংস্কৃতি বলতে পারেন, দেখবার সুযোগ পায়। আর সে উৎসব বছরে দুটো চারটে নয়, প্রায় প্রতিমাসেই দুটো-তিনটে। আপনিও তো বললেন সেই উদ্দেশ্যেই এখানে এসেছেন।

বললাম, হ্যাঁ। আমি আদিবাসীদের নিয়ে গবেষণা করি।

তা ছাড়া এখানে নানা খনিজ সম্পদ আছে। যেমন ধরুন কয়লা, ডলোমাইট, বক্সাইট, আয়রন ওর, লাইম স্টোন, টিন, ম্যাঙ্গানিজ–এত খনিজ সম্পদ ভারতবর্ষে আর কোথাও আছে বলে জানি না। আর এই সব খনিজ সম্পদের টানেও ধনী লোকেরা ব্যবসার খাতিরে এখানে আসতে চান। কিন্তু থাকার জায়গা ছিল না। আমার বাবার বন্ধু সেই অসুবিধাটা দূর করলেন। এতটুকু লাভের মুখ চেয়ে নয়, নিতান্তই পরোপকারের জন্য। আর আমাকে দায়িত্ব দিয়ে গেলেন হোটেলটা চালাতে। যাবার সময় একটা অদ্ভুত কথা বলেন, লাভ হলে তোমার, লোকসান হলে আমার। বলে সুরঞ্জনবাবু হাসলেন।

বললাম, এ রকম মানুষ বড়ো একটা দেখা যায় না। তা আপনি তো এখানেই থাকেন?

হ্যাঁ।

একাই?

 হ্যাঁ। একাই বেশ আছি। হোটেলেই খাই। হোটেলেরই ওদিকের একটা ঘরে থাকি।

একটু চুপ করে থেকে বললাম, কত বছর হোটেলটা হয়েছে?

তা দশ বছর হল।

রেডি বাড়ি পেয়েছিলেন বলে হোটেল খোলা সম্ভব হলো।

 সুরঞ্জনবাবু একটু ভেবে বললেন, তা ঠিক। তাও একরকম বেওয়ারিশ বাড়ি।

আমি চমকে উঠে বললাম, বেওয়ারিশ বাড়ি। মানে?

সুরঞ্জনবাবু বললেন, রতনলালকাকু, অর্থাৎ বাবার সেই বন্ধু অত বড়ো খালি বাড়িটা কিনতে গিয়ে বাড়ির মালিকের সন্ধান পেলেন না। কাগজে কাগজে বিজ্ঞাপন দিলেন। তবু কেউ দাবি করল না। স্থানীয় আদিবাসীদের কাছে খোঁজ নিতে যেতেই তারা ভয়ে শিউরে উঠল। ওরা জানাল বাড়িটা ভূতের। দিনের বেলাতেও কেউ ঐ বাড়ির ত্রিসীমানা দিয়ে হাঁটে না।

রতনলালকাকু তবু দমবার পাত্র নন। তিনি আদিবাসীদের সর্দারকে ডেকে জানতে চাইলেন কেন বাড়িটাকে ভূতের বাড়ি বলা হয়। সর্দারের বক্তব্য ইংরেজ সাহেবরা নাকি এখানেই প্রথম লাশকাটা ঘর করেছিল। কত বেওয়ারিশ লাশ এই বাড়ির মাটিতে পোঁতা আছে তার হিসেব নেই। এমনকি এক যুবরাজের লাশও নাকি এখানে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। এই রকম নানা কথা। গল্পগুলো রতনলালকাকুর মনে ধরল। তিনি ঠিক করলেন স্থানীয় লোকের ভয় দূর করার জন্যে এই বাড়িটাকেই হোটেল বানাবেন। বাইরের পাঁচ-দশ জন লোক যাতায়াত করলেই এখানকার লোকের অহেতুক ভয় দূর হয়ে যাবে।

বুঝলাম।

একটু পরে জিগ্যেস করলাম, আপনি তো অনেক দিন এখানে আছেন। তেমন কিছু

সুরঞ্জনবাবু বললেন, তেমন কিছু বলতে কী জানতে চাইছেন? ভূত-টুত? না মশাই, তেমন কিছু ঘটেনি আজ পর্যন্ত। আশা করি ঘটবেও না। তবে

তবে কী?

তবে মাঝে মাঝে উত্তর দিক থেকে, ঐ পাহাড়ের দিক থেকে একটা দমকা বাতাস বয়ে যায়। এখানকার লোকেরা ঐ বাতাসকে বড্ড ভয় পায়। বলে প্রেতের দীর্ঘনিশ্বাস।

বললাম, আপনিও কি তা বিশ্বাস করেন?

পাগল!

একটু থেমেই আবার বললেন, যাক ওসব বাজে কথা। যেজন্যে আপনি এসেছেন অর্থাৎ আদিবাসীদের পালপার্বণ দেখতে, তার কোনো প্রোগ্রাম করেছেন? কবে কোনটি দেখবেন? তা হলে আপনার সঙ্গে একজন অভিজ্ঞ লোক দিতে পারি।

বললাম, সবে তো আজ এলাম। কাল ঠিক করব। আর এ বিষয়ে আপনার সাহায্য নিতেই হবে।

হ্যাঁ, অবশ্যই বলে দেব কোন সময়ে কোন উৎসব। পোলা আর তিজা উৎসব শেষ হয়ে গেছে। এর পরই গণেশ পুজো। তারপর নবরাত্রি, তারপর দশেরাসুরঞ্জনবাবু থামতেই চান না। অথচ আমার মাথায় তখন অন্য রহস্যের জাল জড়িয়ে আছে।

বললাম, আচ্ছা, মিস্টার ভিরাবাগুর খবর কী? এসেছেন?

সুরঞ্জনবাবু বললেন, না। টাকা জমা দিয়ে গেছেন যখন আসবেন নিশ্চয়। তবে কী জানেন? এঁদের কথার ঠিক নেই। আমাদের মতো সাধারণ মধ্যবিত্তদের পাত্তাই দিতে চান না।

জিগ্যেস করলাম, ওঁকে কোন ঘরটা দেবেন ভাবছেন?

উনি তো এই ঘরটাই নেবার জন্যে জেদাজেদি করছিলেন।

 তা দিলেন না কেন? আমার অন্য ঘর হলেও চলত।

সুরঞ্জনবাবু বললেন, তা জানি। কিন্তু যে ঘরটা একজনকে দেওয়া হয়ে গেছে সেটাই তাঁকে পেতে হবে তার কী মানে আছে? আমায় আবার টাকার লোভ দেখাচ্ছিলেন!

তা হলে কোন ঘরটা দেবেন?

ভাবছি আপনার পাশের ঘরটা কিংবা তার পরেরটা।

কদিন থাকবেন?

 এক সপ্তাহের জন্যে বুক করেছেন। শেষ পর্যন্ত কদিন থাকবেন বলতে পারি না।

 কথার জের ধরে বললাম, উনি কি ব্যবসার ধান্দাতেই এখানে এসেছেন?

তাই প্রথম মনে হয়েছিল। কারণ বড়োলোকেরা খনিজ সম্পদের খোঁজেই এখানে আসেন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এঁর অন্য কোনো ধান্দা আছে।

কী রকম?

 সুরঞ্জনবাবু পকেট থেকে তাসের মতো একটা রঙিন নকশা সাবধানে বার করে দেখালেন।

আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। বললাম, এর অর্থ কী? কোথায় পেলেন এটা?

সকালে কাউন্টারের সামনে যেখানে দাঁড়িয়ে মিস্টার ভিরাবাগু কথা বলছিলেন, উনি চলে যাবার পর সেইখানেই এটা কুড়িয়ে পাই। বোধহয় পার্স খুলে টাকা দেবার সময় পড়ে গিয়েছিল।

কিন্তু জিনিসটা কী?

এটা একটা সাংকেতিক চিহ্ন।

হেসে বললাম, স্কুল লাইফে এই রকম গুপ্তধন সংক্রান্ত ম্যাপ বা সাংকেতিক চিহ্ন নিয়ে অনেক অ্যাডভেঞ্চারের বই পড়েছি।

সুরঞ্জনবাবু কিন্তু হাসলেন না। বললেন, বইগুলো হয়তো লেখা হয়েছিল কল্পনা করে। কিন্তু তখনকার দিনে অনেক রাজা-মহারাজা জমিদারেরা শত্রুর আক্রমণের ভয়ে ধনসম্পত্তি কোনো গোপন জায়গায় লুকিয়ে রাখতেন যাতে শত্রু প্রাসাদে ঢুকে সেসবের সন্ধান না পায়। আবার সেই গোপন জায়গাটা যাতে পরে উত্তরাধিকারীরা খুঁজে পায় তার জন্যে নকশা বা সাংকেতিক চিহ্নর ব্যবস্থা থাকত।

বললাম, সে তো জানি। কিন্তু এই ছত্রিশগড়ে রাজা-জমিদার কোথায়?

 সুরঞ্জনবাবু বললেন, আজ নেই, কিন্তু একদিন ছিল।

ও আচ্ছা, আপনি ছেদী রাজবংশের কথা বলতে চাইছেন?

হ্যাঁ। আজকের ছত্রিশগড় নামটা শুধু ছেদিসগড় থেকেই হয়নি। ছেদী রাজাদের ছত্রিশটা বিশাল বিশাল গড় অর্থাৎ দুর্গ ছিল। সেসব দুর্গের মধ্যে রতনপুর, বিজয়পুর, মারো, ছুরি, কেন্দ্রা, পেন্ড্রা এইরকম কতকগুলো গড় এখনও দেখা যায়। বাকিগুলি ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। এইসব গড়ে শত্রু আক্রমণকালে গোটা রাজপরিবার তাদের সোনাদানা, হিরে, জহরৎ সব নিয়ে আত্মগোপন করে থাকতেন। কাজেই এইসব পরিত্যক্ত গড়গুলোতে

বললাম, বুঝতে পেরেছি। গোপন ঐশ্বর্য থাকা সম্ভব। তা আপনি কি মনে করে মিস্টার ভিরাবাগু সেই রকম কোনো গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছেন?

অসম্ভব নয়।

আমি একটু ভেবে বললাম, আচ্ছা, উনি এই ঘরটা নেবার জন্যে এত ঝুলোকুলি করছিলেন কেন?

সে তো শুনলেনই। ঘরটা নাকি পয়া। অদ্ভুত কথা। যিনি আগে কোনো দিন এখানে আসেনইনি, তিনি কী করে জানলেন এই ঘণ্টা পয়া? ভদ্রলোক ভেবেছেন আমি এতই বোকা! শেষ পর্যন্ত স্বীকার করলেন নিজে না এলেও আগে যারা এসেছিল তাদের কাছ থেকেই নাকি শোনা। গুল মারার আর জায়গা পায়নি। সত্যি বলছি সোমেশ্বরবাবু, ভদ্রলোকের এইরকম চালবাজি দেখে আমি খুব বিরক্ত হয়েছি।

একটু থেমে ফের বলতে লাগলেন, এই ঘরটার ওপর তার আগ্রহের কারণ সম্বন্ধে আমার এখন অন্য ধারণা হয়েছে।

সুরঞ্জনবাবু একটু থামলেন।

 সাগ্রহে জিগ্যেস করলাম, কী?

প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে আমার বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ডটা লাফালাফি শুরু করে দিল। সত্যি কথাই বলছি–আমি হঠাৎ ভয় পেলাম। মনে হল এই ঘর সম্বন্ধে কোনো কথা এই রাত্রিবেলা না তুললেই পারতাম। কারণ যে যাই বলুক আজই সন্ধেবেলা এই ঘরের শেকল খুলতে গিয়ে আমার হাতের ওপর যে অদৃশ্য হাতের চাপ অনুভব করেছিলাম তা তো ভুলতে পারিনি।

সুরঞ্জনবাবু বললেন, আপনার ঘরের বারান্দা থেকে সোজা উত্তর দিকে তাকালে অল্প দূরে একটা পাহাড়ের ওপর দুর্গ দেখতে পাবেন। এটা ঠিক দুর্গ কিনা আমার পিতৃদেব কিংবা রতনলালকাকুও বলতে পারেননি। উচ্চতায় ছোটো কিন্তু অনেকখানি জায়গা নিয়ে পাহাড়ের ওপর ওটা বোধহয় একটা গড়ই ছিল। যে কোনো কারণেই হোক ওটার একটা দিক ভেঙে পড়েছে। গড়টা আগাগোড়া কালো পাথরে তৈরি। পাথরে গড়া বাড়ি ভাঙল কী করে সে এক রহস্য। দ্বিতীয় রহস্য হচ্ছে এখান থেকে খুব দূরে না হলেও এটি দিনের বেলাতেও সব সময়ে খালি চোখে দেখা যায় না। পাথরটার রঙ এমনই যে, মাঝে মাঝেই এটা যেন হারিয়ে যায়। আবার হঠাৎই স্পষ্ট হয়ে ভেসে ওঠে। এই গড় নিয়ে এখানে নানারকমের কাহিনি প্রচলিত আছে।

সুরঞ্জনবাবু একটু থামলেন। বললেন, আমার কথাগুলো শুনতে ইনটারেস্টিং লাগছে?

বললাম, অবশ্যই। কিন্তু বললাম না আজই বিকেলে সেই দুর্গা দেখতে পেয়েছিলাম।

সুরঞ্জনবাবু ফের একটা সিগারেট ধরিয়ে বলতে লাগলেন, অনেক রকম কাহিনি, উপকথা, গালগল্প চলে আসলেও আসল সত্যটা হল ওখানে কোনো একসময়ে ছেদী বংশের এক যুবরাজ থাকতেন। তাঁকে একদিন ওখানেই অতর্কিতে আক্রমণ করে হত্যা করা হয়। তাঁরই অগাধ ধনরত্ন ওই গড়ের মধ্যে কোথাও লুকানো আছে যার সন্ধান সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, ইংরেজ গভর্নমেন্ট পর্যন্ত তন্নতন্ন করে খুঁজেও পায়নি। কেউ কেউ বলেন গড়ের একটা অংশ ইংরেজরাই কামান দেগে উড়িয়ে দিয়েছিল ধনরত্ন হাতাবার উদ্দেশ্যে। কিন্তু সফল হয়নি।

হোটেলের এই দশ নম্বর ঘরটির বৈশিষ্ট্য দুপুরবেলায় সূর্য যখন ঠিক মাথার ওপর থাকে তখন এখান থেকে ঐ ভাঙা দুৰ্গটার ভেতর পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যায় যা অন্য কোনো জায়গা থেকে দেখা যায় না।

সুরঞ্জনবাবু একটু থামলেন। তারপর বললেন, মনে হচ্ছে ভিরাবাগু সাহেব নিশ্চয় ওখানে যাবার মতলব করছেন। তবে ওখানে গেলে যে কী মারাত্মক বিপদ ঘটতে পারে তা উনি জানেন না।

কীরকম বিপদ একটু বলবেন?

জবাব দেবার আগে উনি একবার ঘড়ির দিকে তাকালেন। বললেন, রাত নটা বাজতে চলল এখনও সাহেবের দেখা নেই। তারপরই আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে যাচ্ছিলেন এমনি সময়ে গাড়ির শব্দ শোনা গেল। উনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ওই ওনারা এসে পড়েছেন। আজ আর কথা বলা যাবে না। বলেই উঠে পড়লেন।

.

মিস্টার ভিরাবাগুর রাগ

সুরঞ্জনবাবু চলে যেতেই আমি সিঁড়ির দরজায় খিল দিলাম। হোটেলের ছোকরাটি, কী যেন নাম? হ্যাঁ, মহেন্দ্র সেনাপতি, রাতের খাবার দিয়ে গিয়েছিল। রুটি, আলুর দম আর বাটিভর্তি মাংস। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিলাম।

খাওয়া শেষ হলে সন্ধেবেলার কথা মনে পড়তেই আমার কীরকম ভয় করতে লাগল। একা ঘরে রাত কাটানো! আমি এমনিতে মোটেই ভীতু নই। কিন্তু আজ যে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা তো কোনোদিন ভুলতে পারব না।

আমি ঠিক করলাম যত তাড়াতাড়ি মশারি টাঙিয়ে ঘুমিয়ে পড়া যায় ততই ভালো।

 ভাবা মাত্র ঘরের দরজায় খিল দিয়ে মশারি টাঙিয়ে শুয়ে পড়লাম।

সবে ঘুম এসেছে এমনি সময়ে পাশের ঘরে হৈ হট্টগোল শুনে ঘুম ছুটে গেল। প্রথমে কিছুক্ষণ লাগল ব্যাপারটা বুঝে নিতে। তারপর যখন টের পেলাম পাশের ঘরে লোক এসেছে, আর তারা ওই মিস্টার ভিরাবাগু ও তার দলবল তখন রাগে আমার মাথা পর্যন্ত গরম হয়ে উঠল। বড়োলোক বলে কি এটুকু বিবেচনা করবে না যে পাশের ঘরে একজন ঘুমোচ্ছে? ইচ্ছে করছিল চেঁচিয়ে ধমকে উঠি। কিন্তু আমার ভদ্রতায় বাধল। তা ছাড়া এই রাত্তিরে চেঁচামেচি করলে অশান্তিই বাড়বে। বিশেষ যখন ওরা দলে ভারী।

ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালে উঠে চা খেয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এসে দেখলাম পাশের রুমগুলো বন্ধ। বুঝলাম অনেক রাত পর্যন্ত দাপাদাপি করে তারা এখনও ঘুমোচ্ছে।

আমি আরও কিছুক্ষণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই কালো কেল্লাটা দেখবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু দেখতে পেলাম না।

সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ নীচ থেকে ব্রেকফাস্ট সেরে ওপরে এসে সবে বসেছি, এমনি সময়ে মিস্টার ভিরাবাগু এসে ঢুকলেন। ভদ্রতা করে অনুমতি নেবার প্রয়োজনটুকুও মনে করলেন না।

ঘরে ঢুকেই তিনি হাঁকড়ে উঠলেন, এই দশ নম্বর ঘরটা আমি চেয়েছিলাম। এটা দেওয়া হল না কেন?

তার ধমকানিটা হজম করতে আমার একটু সময় লাগল। তারপর শান্ত গলায় বললাম, কাকে কোন ঘর দেওয়া হবে সেটা ঠিক করেন হোটেলের মালিক। এক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। এই ঘরটার জন্যে আপনার মতো আমি জেদ ধরিনি।

মিস্টার ভিরাবাগু বললেন, ঠিক আছে। এখন ঘরটা আমায় ছেড়ে দিন।

এবার আমি কঠিন স্বরে বললাম, না, এখন আর তা সম্ভব নয়। আমি গুছিয়ে বসেছি।

মিস্টার ভিরাবাগুর মুখটা চাপা রাগে থমথম করতে লাগল। একটু পরে বললেন, এখানে। আপনি কতদিন থাকবেন?

বললাম, ঠিক নেই। আপাতত সাত দিন তো বটেই। দরকার হলে আরও বেশি দিন হতে পারে।

এবার উনি অভদ্রের মতো আমাকে কিছু না বলেই আমার বিছানার ওপর পা ক্রস করে বসে বললেন, ঠিকঠাক বলুন তো কী জন্যে এখানে এসেছেন?

ঠিকঠাক কারণটা জানিয়ে দিলেই কথা কাটাকাটি ব্যাপারটা ঘটত না। কিন্তু ঐ যে মেজাজ বলে একটা রোগ আছে না ঐতেই বিপদ বাড়ে।

বললাম, সেটা জেনে আপনার লাভ?

উনি দ্বিগুণ রেগে বললেন, লাভ আছে বৈকি।

কিন্তু আমার কোনো লাভ নেই।

তা হলে আপনি বলবেন না?

বললাম আপনাকে বলতে আমি বাধ্য নই। আপনি আমায় বলবেন কি কোন উদ্দেশ্যে আপনারা এখানে এসেছেন?

এর উত্তর না দিয়ে ভিরাবাগু সাহেব উঠে পড়লেন। দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে উত্তেজিত ভাবে বলে গেলেন, আপনি আমায় চেনেন না। আপনার এই অবাধ্যতার প্রতিফল শিগগির পাবেন।

আমি ভেবে রেখেছিলাম আজ সকালে সুরঞ্জনবাবুর সঙ্গে বসে আদিবাসীদের কোন কোন উৎসবে যাব ঠিক করে ফেলব। কিন্তু কাল রাত্তিরে সুরঞ্জনবাবুর কাছে পাহাড়ের ওপরে ঐ রহস্যময় কালো পাথরের দুর্গার কথা শুনে আর তার আগে সন্ধেবেলায় শেকল খুলতে গিয়ে সেই অদৃশ্য হাতের চাপ আমাকে এতই ভাবিয়ে তুলেছিল যে, আদিবাসীদের উৎসব দেখার ব্যাপারটা চাপা পড়ে গিয়েছিল। কেবলই মনে হচ্ছিল অদৃশ্য হাতের সঙ্গে ঐ রহস্যময় দুর্গের কোনো সম্পর্ক আছে কিনা।

একটা প্রাচীন দুর্গ বা প্রাসাদ হলেই যে তা রহস্যময় হয় তা নয়। কিন্তু কাল সন্ধ্যায় ঐ দুর্গ সমেত পাহাড়টা যখন কোন মন্ত্রবলে দূর থেকে একেবারে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল তখন কিছুক্ষণের জন্যে আমি বিহ্বল হয়ে গিয়েছিলাম। আর তখনই দুর্গটিকে মনে হয়েছিল রহস্যময় বলে। তাছাড়া ঐ দুর্গে গেলে কী বিপদ ঘটতে পারে তা সুরঞ্জনবাবুর কাছ থেকে এখনও শোনা হয়নি। আমি তাই মাঝে মাঝেই বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই যদি দুৰ্গটা ভালো করে আরও একবার দেখতে পাই। কিন্তু হতচ্ছাড়া ভিরাবাগু সক্কালবেলাতেই আমার মেজাজটা খারাপ করে দিল।

বেলা যত বাড়তে লাগল ভিরাবাগুর সঙ্গীরা ততই হৈ-হট্টগোল করতে লাগল। এক সময়ে ওরা আমার দরজা লক্ষ করে ইট-পাটকেল এমনকি কাপডিশও ছুঁড়তে লাগল। জানলা লক্ষ করে একটা হাঁসের ডিম এমনভাবে ছুড়ল যে আমার বিছানাটা নষ্ট করে দিল। শেষ পর্যন্ত আমি বাধ্য হলাম নীচে গিয়ে সুরঞ্জনবাবুর কাছে নালিশ করতে। সব শুনে সুরঞ্জনবাবু বললেন, কিছু করার নেই, সোমেশ্বরবাবু। কাছেপিঠে পুলিশও নেই যে ডেকে আনব।

তা হলে আমি কী করব?

সুরঞ্জনবাবু বললেন, একমাত্র উপায় আপনি যদি ঘরটা ছেড়ে দেন। মনে হয় তা হলেই উৎপাত থামবে। কিন্তু আমি বলব আরও একটু ধৈর্য ধরে থাকুন। ওরা থেমে যাবেই। ঘরটা ছেড়ে দিলে ওদেরই জিৎ হবে।

বললাম, ঘর আমি ছাড়ব না।

খুব ভালো। তা ছাড়া আমি যা ভেবেছিলাম তাই ঘটতে চলেছে। খুব সম্ভবত ওরা দু-একদিনের মধ্যে ঐ দুর্গের দিকে যাবে। আমি অবশ্য ওদের নিষেধ করব। শোনা না শোনা তাদের মর্জি।

কিন্তু কেন নিষেধ করবেন কাল আপনার কাছ থেকে শোনা হয়নি।

সুরঞ্জনবাবু বললেন, যদি আজ সময় পাই তা হলে বলব।

বিকেলের দিকে ওরা হৈচৈ করে কোথায় বেরিয়ে গেল। নিশ্চয়ই এই অবেলায় গড়ের দিকে যাবে না।

তা হলে?

 জাহান্নমে যাক আর যেখানেই যাক ওরা যতক্ষণ না থাকে ততক্ষণ আমার মঙ্গল।

রোদ একটু পড়ে এলে আমি খোলা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালাম। তারপর উৎসুক নেত্রে তাকিয়ে রইলাম উত্তর দিকে–যদি সেই ভয়ংকর গড়টা দেখা যায়। কিন্তু অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও দেখা গেল না। তারপর সন্ধ্যার মুখে যখন ঘরে ঢোকবার জন্যে পা বাড়িয়েছি তখন হঠাৎই উত্তর দিকে আকাশের গায়ে পাহাড়ের ওপর কষ্টিপাথরের মতো কালো গড়টা ভেসে উঠল। কিন্তু মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্য। তারপরেই অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

ঐটুকু দেখেই আমি খুশি হলাম বটে কিন্তু গতকালের মতো ওটা এগিয়ে এল না তো।

আমি ধীরে ধীরে ঘরে এসে ঢুকলাম বটে কিন্তু সেই অলৌকিক গড়টা বারে বারে দেখার জন্য, মনটা ছটফট করতে লাগল।

.

অন্ধকার পাহাড়ে দেওয়ালি?

 সন্ধের পর ঘরে একলা মুখ বুজে কী করব ভেবে যখন কুল পাচ্ছি না তখন মনে পড়ল সুরঞ্জনবাবু বলেছিলেন আজ সন্ধ্যায় উনি আসবার চেষ্টা করবেন। উনি এলে সময় কাটাবার কোনো অসুবিধে হবে না। কিন্তু উনি আজ আসবেন কী?

ভাবতে ভাবতেই দরজায় মুদু শব্দে কড়া নড়ে উঠল। আমি দরজা খুলে দিলাম।

ওর ঠোঁটে ভদ্রতাসূচক এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল।

ভাবছিলেন তো বুঝি এলাম না?

 হাসলাম। বললাম, আসলে আপনার সঙ্গটুকু পাবার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

ধন্যবাদ। বলে একটু হাসলেন। তারপর বললেন, দুদিন তো কেটে গেলে। আদিবাসীদের উৎসব কবে কোনটে দেখবেন ঠিক করলেন কিছু?

অন্যমনস্কভাবে আমি মাথা নাড়লাম।

সুরঞ্জনবাবু একটু যেন অবাক হয়ে বললেন, এখানকার উৎসবগুলো দেখবার টানেই তো আপনি এখানে এসেছেন।

বললাম, ঠিকই বলেছেন। কিন্তু কষ্টিপাথরের মতো কালো দুর্গটি আর ছেদী রাজবংশের সেই হতভাগ্য যুবরাজ এখন আমার মনকে আচ্ছন্ন করে আছে। আপনি ভাবতে পারবেন না সুরঞ্জনবাবু, ওই কালো দুৰ্গটা কীভাবে আমাকে টানছে।

সুরঞ্জনবাবু বললেন, তাই বলে ভুলেও যেন ঐ দিকে যাবেন না। তা হলে আর বেঁচে ফিরতে হবে না।

হ্যাঁ, এইরকম একটা বিপদের কথা আপনি সেদিন বলেছিলেন বটে।

না, সেদিন বলার সুযোগ পাইনি। আজও সুযোগ নেই। এখনই হয়তো মিস্টার ভিরাবা সদলবলে এসে পড়বেন। আপনার সঙ্গে গল্প করছি দেখলে মোটেই খুশি হবেন না। আর উনি বিরক্ত হলে আমাদেরও শান্তিতে থাকতে দেবেন না।

উনি বিরক্ত হবেন? কেন?

সুরঞ্জনবাবু হাসলেন একটু। বললেন, এই ঘরটা নিয়ে আপনি আমি দুজনেই ওঁদের শত্রুপক্ষ হয়ে গেছি। আর এই সব শিক্ষিত ভদ্রলোকেরা তাদের শত্রুপক্ষকে টাইট দেবার জন্যে অনেক কিছুই করতে পারেন। অথচ আমরা দুজনে ঠেকাতে পারব না।

একটু থেমে বললেন, শুনুন, আমার মুখ থেকে শোনার চেয়ে এই পাতলা বইটা চুপচাপ পড়ে ফেলবেন। অনেক সত্য ঘটনা জানতে পারবেন। তবে দেখবেন বইটা যেন অন্য কারও চোখে না পড়ে। বলে খবরের কাগজে মলাট দেওয়া একটা চটি বই আমার হাতে দিলেন।

পাতা উল্টে আমি তো অবাক। ইংরিজিতে লেখা বই। বহু পুরনো। তাও ছাপা নয়। হাতে লেখা। পুঁথির মতো। তুলোট কাগজের মতো পুরু কাগজে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা। বহু জায়গা পোকায় কাটা।

এই বই আপনি কোথায় পেলেন?

বাবার দেওয়াল-আলমারিতে ছিল। সম্ভবত রতনলালকাকু বাবার কাছে রাখতে দিয়েছিলেন। ঐ দুর্গে যে রাতে যুবরাজকে হত্যা করা হয় সে সময়ে একজন ইংরেজ ওখানে গোপনে ঢুকে পড়েছিলেন। আড়ালে, লুকিয়ে লুকিয়ে স্মিথ সাহেব যা কিছু দেখেছিলেন তা নোট করে নিয়েছিলেন। স্মিথ সাহেবের সেই সব নোট নিয়েই এই ডায়েরি। নিন রাখুন। যদি সম্ভব হয় আজ রাত্তিরেই পড়ে ফেলে কাল সকালে আমায় ফেরত দেবেন।

তা না হয় দিলাম, কিন্তু সেই যে সেদিন সন্ধেবেলা শেকল খুলতে গিয়ে আমার হাতের ওপর অন্য এক অদৃশ্য হাতের চাপ পড়েছিল সে কথা তো ভুলতে পারছি না। তাই সুরঞ্জনবাবুকে বলে ফেললাম, আচ্ছা, আমায় একটা কথা বলুন তো, ঐ কেল্লা আর এই হোটেলবাড়ি এ দু-এর মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে কি?

আছে বৈকি। তবে এখন বলতে পারব না। এইটেও আপনি রাখুন। বলে তাসের মতো পুরু রঙিন ছক কাটা একটা কার্ড আমার হাতে দিলেন।

বুঝতেই পারছেন এটা একটা নকশা যেটা ভিরাবার পকেট থেকে পড়ে গিয়েছিল।

এটা ওঁকে দেননি?

না, হাতে হাতে ফেরত দিলে সাহেব বুঝে নেবে আমি ব্যাপারটা জেনে গেছি। তাই দিইনি। এখন অনুগ্রহ করে আপনি এটা সাহেবকে গোপনে দেবার ব্যবস্থা করুন।

ওঁর কথা শুনে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। বললাম, আমি কেমন করে দেব?

সে ব্যবস্থা আছে। ন নম্বর আর দশ নম্বর ঘরের মধ্যে দেখুন কাঠের পার্টিশান। ঐ ঘরে ভিরাবাগু থাকেন। কাঠের পার্টিশানের মধ্যে খুব সূক্ষ্ম ফাঁক আছে। খুঁজলেই দেখতে পাবেন। যখন ঘরে কেউ থাকবে না তখন ঐ ফাঁক দিয়ে কার্ডটা জোরে ঠেলে দেবেন। কার্ডটা হয় ওদের বিছানায় নয় মাটিতে পড়ে থাকবে। ভিরাবাগু ভাবতেই পারবেন না আপনি ওটা ফেলেছেন।

আমি বললাম, তাতে আমাদের কী লাভ?

সুরঞ্জনবাবু বললেন, ভিরাবাগু এখনও জানেন না কেল্লার ঐ সাংকেতিক কার্ডটা তার কাছে নেই। ওটা হঠাৎ পড়ে থাকতে দেখলে নিশ্চয় ঘাবড়ে যাবেন। মনে করবেন এটা কোনো অলৌকিক ব্যাপার। বলেই তিনি সাবধানে চলে গেলেন। যাতে ভিরাবার সামনে পড়ে না যান।

সুরঞ্জনবাবু চলে যেতেই আমার মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠল। এখন সবে সন্ধে সাড়ে সাতটা। রাত দশটার আগে ঘুমনো যায় না। তা হলে এই দীর্ঘ সময় কী করব?

একবার ভাবলাম এখন দোতলায় কেউ নেই। এই সুযোগে যদি নকশাটা পর্টিশানের ফাঁক দিয়ে চুপি চুপি চালান করে দেওয়া যায় তাহলে একটা বড়ো কাজ হয়।

এই কথা ভেবে আমি ঘরের আলো নিভিয়ে একটা টর্চ নিয়ে পার্টিশানের গায়ে কোথায় চিড়টা আছে, খুঁজতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পরেই চিড়টা আবিষ্কার করলাম। এইবার বাকি কাজটুকু খুবই সহজ। তবু

তবু নকশাটা হাতে নিয়েও তখনই পার্টিশানের মধ্যে দিয়ে গলাতে গিয়ে হাত কেঁপে উঠল। ভাবলাম কার্ডটা নিরাপদে ন নম্বরে চালান করে দিলেও ঘরে ঢুকেই আকস্মিক ভাবে ওটা পড়ে থাকতে দেখলে সাহেব যে ক্ষেপে যাবে তাতে সন্দেহ নেই। আর সেই রাগটা এই রাত্তিরে কার ওপর যে অঘটন ঘটাবে ভেবে আমি রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলাম।

কী করব ভাবছি এমনি সময়ে বাইরে গাড়ির শব্দ শুনলাম। বুঝলাম ওনারা এলেন।

এলেন তো বটেই কিন্তু একটা হোটেলে ঐভাবে যে কেউ আসতে পারে তো ভাবা যায় না।

শুধু বুটপরা মিলিত পায়ের শব্দই নয়, সেই সঙ্গে মিলিত গলায় অদ্ভুত সুরে ইংরিজি বাংলা মেশানো গান গাইতে গাইতে সিঁড়ি বেয়ে ক্রমশ উপরে উঠে আসতে লাগল। আমি তাড়াতাড়ি আলো জ্বেলে ঘরে খিল লাগিয়ে বসে রইলাম।

গানের কথা মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারছিলাম না। হেঁড়ে গলায় মিলিত সুর থেকে মাঝে মাঝে যে কয়েকটা কথা কানে আসছিল তা এইরকম….Let us enjoy……পরোয়া করি না কাউকে ভাই…….we dont sleep….ঘুমাতে দেব না কাউকে……হিপ হিপ হুর রে!….

উন্মত্তের মতো গান করতে করতে ওরা যখন আমার ঘরের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল তখন এক এক লাইন গাইবার সঙ্গে সঙ্গে আমার দরজায় প্রতি জনে বুট পরা পায়ে জোরে লাথি মেরে যাচ্ছিল। এ যে কীরকম ভদ্রতা তা বুঝে উঠতে পারলাম না। তা হলে এরা তো দরজা ভেঙে ঢুকে আমায় শেষ করে দিতেও পারে।

অতটা অবশ্য ওরা করল না। ঘরের মধ্যে ঢুকে ওরা বোধহয় হাত ধরাধরি করে নাচতে নাচতে গানটা পুরোপুরি গাইল। গানটা এইরকম–

Let us dear friends, let us enjoy.
পরোয়া করি না কাউকে ভাই,
করি নাকো ভয়।
We dont sleep-sleep at all.
 ঘুমোতে দেব না কাউকে জেনো
 গেলো শুধু ব্রান্ডি আর জল।
 হিপ হিপ হুর রে!
 হিপ হিপ হুর রে!
আনন্দে মেতেছি আমরা।
আনন্দের গাহি জয়।
আনন্দ করতে জানে যারা
আনন্দেতেই রয়।
Let us enjoy.

এমন স্বর্গীয় সংগীত কার রচনা জানি না, এ গান লেখার উদ্দেশ্য কী তাও জানি না। উদ্দেশ্য যেটা প্রধান তা হচ্ছে আমাকে সব রকমে বিরক্ত করা। আমার ঘুমের মাথা চিবিয়ে খাওয়া।

বেশ, তাই হোক। আমি ঘরের আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম।..

তারপর কখন ওদের নাচগান থেমেছিল জানি না, কিন্তু যখন আমার ঘুম ভাঙল তখন গোটা দোতলাটা শান্ত, নিস্তব্ধ।

এরকম মাঝরাতে আমার বড়ো একটা ঘুম ভাঙে না। কিন্তু হঠাৎ আজ কেন ভাঙল ভাবতে ভাবতে আমি অন্ধকার ঘরের চারিদিক দেখতে লাগলাম।

না, অন্য দিনের মতোই সব ঠিকঠাক। আমার ঘরের জানলাগুলো রাত্তিরেও খোলা থাকে। হঠাৎ উত্তর দিকের জানলাটার ওপর নজর পড়ল। চমকে উঠলাম। উঠে বসলাম। ভালো করে চোখ রগড়ে দেখলামনা, ভুল দেখছি না।

অনেক দূরে শাল, সেগুন আর অর্জুন গাছের অরণ্যের ঘন কালো অন্ধকারের মাথার ওপর অনেকগুলো আলো টিপ্ টি করে জ্বলছে। মনে হচ্ছে যেন ঘোর অমাবস্যায় দেওয়ালির রাতে অজস্র প্রদীপ জ্বলছে।

অবাক হয়ে তাড়াতাড়ি দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। আবারও মনে হল, না চোখের ভুল নয়। সত্যিই পাহাড়ের ওপর সেই ভাঙা গড়ের অলিন্দে অলিন্দে কে আলো জ্বেলে রেখেছে।

কিন্তু ঐ জনশূন্য অন্ধকার পাহাড়-দুর্গে এই গভীর রাতে কারা প্রদীপ জ্বেলে রাখল? কেন জ্বালল?

আমি স্তম্ভিত হয়ে দেখতে লাগলাম। এই আলোর মালা কি আমার পথের দিশারী?

হঠাৎ আলোগুলি প্রায় একসঙ্গেই নিভে গেল। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিক থেকে হু হু করে একটা দমকা বাতাস সবেগে বয়ে এসে হোটেল বাড়িটার ওপর আছড়ে পড়ল। আমি ছুটে গিয়ে ঘরের মধ্যে আশ্রয় নিলাম।

.

স্মিথের ডায়েরি

 তুলোট কাগজের ওপর হাতে লেখা পাণ্ডুলিপিটি পড়তে আমার মাত্র এক ঘণ্টা পনেরো মিনিট লাগল। অবশ্য আমাকে খুব সাবধানে পড়তে হয়েছিল, যাতে পুরনো কাগজ মুড়মুড় করে ভেঙে না যায়। বেশ কয়েকটি পাতার লেখা অস্পষ্ট হয়ে গেছিল। অনেক জায়গায় আবার পোকায় কেটে দেওয়ায় লেখা পরিষ্কার পড়াও যাচ্ছিল না।

একটা জিনিস বুঝতে পারছিলাম, স্মিথ সাহেব শুয়ে বসে আরাম করে চা চুরুট খেতে খেতে বই লেখেননি। রুদ্ধশ্বাস বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে যা যা রোমাঞ্চকর ঘটনা স্বচক্ষে দেখেছিলেন শুধু সেগুলোই নোট করেছিলেন। এমনও হয়েছে কোনো কোনো লাইন শেষ করতেও পারেননি। ফলে বক্তব্য পরিষ্কার হয়নি।

আরও একটা ব্যাপার–কোন সময়ে ঘটনা ঘটছে সেই সাল-তারিখের কোনো উল্লেখ নেই। নেই কোনো রাজার নাম। এমনকি যে যুবরাজকে হত্যা করা হল তার নামেরও কোনো উল্লেখ নেই। কাজেই এরকম ডায়েরির কোনো ঐতিহাসিক মূল্যই নেই।

এর মধ্যে শুধু আছে একটা দুর্গম পাহাড়ের ওপর কালো রঙের বিরাট একটা দুর্গের কথা–যে দুর্গের মধ্যে প্রাণভয়ে গোপনে আশ্রয় নিয়েছিলেন ছেদী রাজবংশের যুবরাজ। যুবরাজ যাতে সিংহাসনে বসতে না পারেন তার জন্যেই ছেদী বংশের অন্য শরিকরা তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেন। যুবরাজ যে শেষ পর্যন্ত পাহাড়ের ওপর পাথরের ঐ পরিত্যক্ত ভাঙা দুর্গে ঢুকে লুকিয়ে থাকবেন এটা কেউ ভাবতে পারেনি। ভাবতে পেরেছিলেন শুধু মিস্টার স্মিথ। নিতান্ত অপ্রত্যাশিত ভাবে যুবরাজের সঙ্গে কোনো শুভ মুহূর্তে তাঁর বন্ধুত্ব হয়েছিল। সে বিবরণটাও তিনি ডায়েরিতে লিখে গেছেন। তবে তা খুব সংক্ষেপে, একটা কাহিনির খসড়া হিসেবে। কাহিনিটি এইরকম–

ইংরেজরা তখন ভারতবর্ষে একচেটিয়া ব্যবসা চালাবার জন্যে দেশ জুড়ে কুঠি স্থাপনের নেশায় মেতে উঠেছে। ১৬১১ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ গোলকুণ্ডা রাজ্যের অন্তর্গত মুসুলিপট বন্দরে কুঠি স্থাপন করেন। কয়েক বছর পরে তারা পুলিকটের উত্তরে আসাগাঁও এ কুঠি নির্মাণ করে। ১৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে বিজয়নগরের অন্যতম উত্তরাধিকারী চন্দ্রগিরির রাজার কাছ থেকে জমি নিয়ে ইংরেজরা বর্তমান মাদ্রাজ শহরে Fort St. George নামে নতুন বাণিজ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে।

এইরকম সময়ে স্মিথ কয়েকজন ইংরেজ ব্যবসায়ীর সঙ্গে মধ্যপ্রদেশের নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ান। উদ্দেশ্য কোন জায়গার কোন কৃষিজাত দ্রব্য নিয়ে ব্যবসা করলে প্রচুর টাকা উপার্জন হতে পারে তার খোঁজখবর নেওয়া।

একদিন এক ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাবার সময়ে একটা বিষধর সাপ স্মিথকে তাড়া করে। স্মিথ তাড়াতাড়ি গাছে উঠে পড়েন। স্মিথ যদি একবার চিৎকার করে উঠতেন তাহলে তার দুর্ভাগ্য এত দূর গড়াত না। কিন্তু সামান্য সাপের তাড়া খেয়ে একজন ইংরেজ যুবক ভয়ে চেঁচিয়ে উঠবে স্মিথ তা ভাবতেই পারে নি। ফলে অনেকক্ষণ পরে সাপটা চোখের আড়ালে চলে গেলে স্মিথ যখন গাছ থেকে নেমে এলেন তখন তার সঙ্গীরা অনেক দূর চলে গেছেন। স্মিথ যে সঙ্গে নেই তা সঙ্গীরা খেয়াল করেননি। গভীর অরণ্যমধ্যে পরস্পরের কাছ থেকে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন।

বিপদের ওপর বিপদ, পথ হারিয়ে স্মিথ যখন উদ্ভ্রান্তের মতো জঙ্গলের পথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তখন হঠাৎ তিনি একদল দেশীয় শিকারীর খপ্পরে পড়েন। সেই অরণ্যচারী পাহাড়ী শিকারিরা এরকম কটা চুল, নীলচে চোখ, সাদা চামড়ার মানুষ এর আগে কখনও দেখেনি। ওরা ওঁকে বন্দি করে বেঁধে নিয়ে এল রাজবাড়িতে।

স্মিথের সুন্দর চেহারা দেখে রাজবাড়ির লোকেরা তার ওপর অত্যাচার না করে আলাদা একটা ঘরে রেখে দিল। তাদের কাছ থেকে বেশ আদরযত্ন পেলেন স্মিথ। তবে চিড়িয়াখানায় নতুন কোনো জন্তু এলে লোকে যেমন খাঁচার বাইরে থেকে অবাক হয়ে দেখে, রাজবাড়ির লোকরাও বিদেশি স্মিথকে তেমনিভাবে জাল ঘেরা ঘরের বাইরে থেকে দেখতে লাগল।

এই রাজবাড়ির যুবরাজ (স্মিথ তার ডায়েরিতে নাম দেননি) ছিলেন একটু অন্য ধরনের মানুষ। ভূগোল, ইতিহাস সম্ভবমতো পড়ে তিনি বিদেশের খবর কিছু কিছু রাখতেন। একমাত্র তিনিই ঘরের মধ্যে ঢুকে স্মিথের সঙ্গে আকারে-ইঙ্গিতে কথা বলতেন। এইভাবে দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে গেল।

[ এরপর অনেকগুলো পাতা নেই। ]….

এই যুবরাজ যখন বুঝলেন স্মিথ শত্রু নন, তখন তিনি-ই দরজার আগল খুলে দিলেন। ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন স্মিথ এখন থেকে রাজবাড়ির বাইরেও ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াতে পারেন। খোঁজ করতে পারেন তার অন্য সঙ্গীদের। যদি তাদের দেখা পান তা হলে তাদের সঙ্গে চলে যেতে পারেন। যদি দেখা না হয় রাজবাড়িতেই স্বচ্ছন্দে ফিরে আসতে পারেন।

সেই মতো স্মিথ সারা দিন দূরে দূরে জঙ্গলে ঘুরতেন। ঘুরতে ঘুরতে একদিন তিনি অদ্ভুত গড় বা দুর্গ দেখতে পেলেন। একটা পাহাড়ের ওপর কেল্লাটা। পাহাড়টা ছোটো হলেও জঙ্গলে ঢাকা।

একদিন তাড়াতাড়ি দুপুরের খাওয়া সেরে, একটা ঝকঝকে ফলা বসানো বর্শা হাতে স্মিথ সেই পাহাড়ের নীচে এসে দাঁড়ালেন। সেই যে সেদিন তাঁকে সাপে তাড়া করেছিল, সেই থেকে তার সাপে খুব ভয়। বর্শার ফলা দিয়ে ঝোপ-জঙ্গল পরিষ্কার করতে করতে তিনি কোনো রকমে পাহাড়ে উঠে গড়ের সিংহদ্বারের সামনে এসে দাঁড়ালেন।

নামেই সিংহদ্বার। সত্যিই একদিন পাথরে তৈরি বিরাট সিংহদ্বার ছিল। কিন্তু আজ তার ভগ্নদশা। শুধু সিংহদ্বারটাই নয়–সেই বিশাল প্রাসাদপুরীর একদিকটা একেবারে কে যেন ভেঙে ফেলে দিয়েছে।

কেন?

ডায়েরির এক জায়গায় যা লেখা বাংলায় অনুবাদ করে পাঠকদের উদ্দেশে তা লিপিবদ্ধ করি–

..আমি যখন সিংহদ্বার পেরিয়ে প্রাসাদের ভেতরে প্রবেশ করলাম তখন কেন যেন আমার সমস্ত শরীরের মধ্যে দিয়ে বিদ্যুত্তরঙ্গ খেলে গেল। অজানা ভয়ে আমার গা শিউরে উঠল। অথচ তখনও পর্যন্ত একমাত্র সাপের ভয় ছাড়া অন্য কোনো ভয়ের মুখোমুখি হইনি। প্রাসাদের ঘরগুলি অত্যন্ত ঠান্ডা ছিল। আমার মনে হচ্ছিল হিমশীতল পরিবেশ ছাড়া অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতাই আমার বুকের ধুকপুকানি বাড়িয়ে দিচ্ছিল। আমার এও মনে হচ্ছিল এমন নিস্তব্ধতা বুঝি পৃথিবীর আর কোনো জায়গায় নেই। আর এইরকম অন্ধকার নিস্তব্ধ জায়গাতেই মানুষকে নিশ্চিন্তে গোপনে হত্যা করা সহজ হয়।…

প্রাসাদের ভগ্ন অংশটা বারবার দেখে আমি স্থিরনিশ্চয় হলাম যে, এই অংশটি কোনো এক সময়ে তোপ দেগে ভাঙা হয়েছে। আর এর কারণ–বহু দিন থেকে চলে আসা জনশ্রুতি এই প্রাসাদের কোনো অংশে রাজ-ঐশ্বর্য লুকানো আছে। আর এই রকম রাজ-ঐশ্বর্য যেখানেই গোপনে সঞ্চিত থাকে সেখানেই তার এক মহাশক্তিধর রক্ষকও নিযুক্ত থাকে। এ বিশ্বাস ভারতেও প্রচলিত আছে।

এই ডায়েরি যখন থেকে আমি লিখছি, তখন থেকে কোনো একদিনের জন্যেও সেই রক্ষককে আমি চাক্ষুষ দেখতে পাইনি। সেটা বড়ো আশ্চর্য লাগে। আরও কথা এই যে…

এরপর ডায়েরির কিছু অংশ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তারপর যে অংশ শুরু হয়েছে তাতে স্মিথ সাহেব দেখাচ্ছেন রাজপ্রাসাদে যুবরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র দানা বেঁধে উঠেছে। আর স্মিথ যথাসম্ভব নিজেকে গোপন রেখে যুবরাজকে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন।

কদিন পর রাজপ্রাসাদের মধ্যেই বিপক্ষ দলের সঙ্গে যুবরাজের দলের যুদ্ধ বেধে গেল। যুদ্ধে পরাজিত যুবরাজ কোনোরকেম প্রাণ হাতে করে রাজপ্রাসাদ ছাড়লেন। সঙ্গে বিশ্বস্ত বন্ধুর মতো রইলেন একটি মাত্র মানুষ–স্মিথ।

স্মিথ রাতের অন্ধকারে যুবরাজের হাত ধরে ভয়াবহ অরণ্য অতিক্রম করে তাকে এনে তুললেন পাহাড়ের ওপরের সেই পাথরের ভাঙা দুর্গে। যুবরাজকে বোঝালেন–এই পরিত্যক্ত জায়গায় জনমানব ঢোকে না। তোমার পক্ষে এইটেই একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়। আমি রোজ একবার করে এখানে লুকিয়ে আসব। তোমার খাবার দিয়ে যাব। একা হলেও ভয় পেও না। এখানে অন্তত একজন প্রচণ্ড শক্তিধর রক্ষক আছে বলে আমি বিশ্বাস করি যে গুপ্ত রাজ-ঐশ্বর্য পাহারা দেয়। তাকে চোখে দেখা যায় না। কিন্তু সে আছে। বিপদে তার কাছে আত্মসমর্পণ কোরো।

যুবরাজ একটি কথাও বলেননি। তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন।

মাটিতেই একটা চাদর পেতে যুবরাজ শুয়ে থাকেন।

তৃতীয় দিন স্মিথ যুবরাজের সঙ্গে দেখা করতে এসে থমকে গেলেন। দেখলেন যুবরাজের মুখে কে যেন কালি ঢেলে দিয়েছে। তিনি জানতে চাইলেন যুবরাজ কি অসুস্থ?

তার উত্তরে যুবরাজ সভয়ে জানালেন যে গত রাতে তিনি যখন ঘুমোচ্ছিলেন তখন তার গায়ে কয়েক ফোঁটা রক্ত ওপর থেকে পড়ে। তাজা রক্ত।…রক্ত কোথা থেকে এল সকালে উঠেও তার তল্লাশ করতে পারেননি। তবে পাথরের দেওয়ালে স্মিথ নিজের চোখে অনেকগুলো রক্তমাখা হাতের ছাপ দেখেছেন যা আগে কোনোদিন দেখেননি। স্মিথ স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। রক্তর ফোঁটা কেমন করে পড়ল পাথরের ছাদ থেকে? পাথরের দেওয়ালে রক্তমাখা অতবড়ো হাতের ছাপই বা কার?

এবার স্মিথকে যুবরাজ ছাড়লেন না। তার কাছে কাছেই থাকতে অনুরোধ করলেন। স্মিথ থেকে গেলেন। সারা দিন প্রাসাদের ছাদ, প্রত্যেকটি ঘর, অলিগলি ভালো করে পরীক্ষা করে দেখলেন। কিন্তু কোনো মানুষের অস্তিত্ব খুঁজে পেলেন না। তার ধারণা ছিল এই প্রাসাদে নিশ্চয় গুপ্তধন আছে। আর তা পাহারা দেবার জন্যে মহাশক্তিসম্পন্ন কোনো অশরীরী আত্মা নিযুক্ত আছে। আজ এই রক্ত দেখে সেই ধারণা বদ্ধমূল হল। এমনকি যুবরাজের ঘরে রক্তমাখা হাতের ছাপ দেখে তার এমনও মনে হল কোনো অশুভ ঘটনা খুব তাড়াতাড়ি ঘটতে চলেছে।

ঘটনাটা ঘটল সেই রাত্তিরেই। হঠাৎ অন্ধকার অরণ্যের বুক বিদীর্ণ করে জ্বলে উঠল কয়েকশো মশাল। শত্রুপক্ষ হন্যে হয়ে কদিন ধরে খুঁজে বেড়াচ্ছিল যুবরাজকে। তারপরে কী করে যেন ওরা খোঁজ পেল যুবরাজের। তারপরেই

ঘটনাটা ঘটে গেল স্মিথের সামনেই। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে আত্মরক্ষার জন্যে অন্ধকারে গা ঢাকা দিলেন স্মিথ।

–ডায়েরি প্রায় এখানেই শেষ। তার পরে যেটুকু আছে তার বেশির ভাগ জায়গাই পোকায় কাটা। তবু তা থেকে যেটুকু উদ্ধার করা সম্ভব হল তা এইরকম–

স্মিথ লিখছেন, যদিও আমি রাজবাড়ির লোকেদের দৃষ্টি এড়িয়ে সেই রাতে অনেক দূরে পালিয়ে এসেছিলাম, এবং পরে একটি নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিয়েছিলাম, তবুও মাঝে মাঝে গভীর রাতে পাহাড়ের ওপর সেই গড়ে যেতাম। কী যে এক অসাধারণ শক্তি আমাকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করত তা লিখে বোঝানো যাবে না।

গভীর রাতে সেই কালো পাথরে তৈরি প্রাসাদের সিংহদ্বার অতিক্রম করে ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেতাম একটা অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে আছে।

কে সে আমি আজও জানি না। সে কি যুবরাজের প্রেতাত্মা, না গুপ্ত রাজভাণ্ডারের একমাত্র বিশ্বস্ত প্রহরী?

ভয়ে আমার হাত-পা হিম হয়ে যায়। তাড়াতাড়ি পালিয়ে আসি। কিন্তু –।

 কিন্তু দুদিন পর আবার যাই। আবার তার দেখা পাই….

আর লিখতে পারি না। মনে হয় ঐখানেই একদিন আমার মৃত্যু হবে। কারণ ঐ তীব্র আকর্ষণ মৃত্যুর হাতছানি ছাড়া আর কিছু নয়…..।

.

জ্যোৎস্না রাতের অলৌকিক মায়া

দুটি কাজ আমি নির্বিঘ্নে শেষ করেছি। একটি ডায়েরিটা পড়ে ফেলা। আর একটি দুর্গম দুর্গের ভিতরে ঢোকার সাংকেতিক চিহ্ন আঁকা কার্ডটি পার্টিশানের ফাঁক দিয়ে পাশের ঘরে নিঃশব্দে ফেলে দেওয়া। ছকটা নিশ্চয় ভিরাবার চোখে পড়েছে। কিন্তু সেটা পেয়ে তার মনে যে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছে তা আমি এখনও টের পাইনি।

সুরঞ্জনবাবুকে ডায়েরিটি ফেরত দেবার সময়ে উনি আমাকে জিগ্যেস করলেন, সব কথাই আপনি তো জানতে পারলেন। বোধহয় এর চেয়ে ভালো করে আমি আপনাকে কিছু বলতে পারতাম না।

বললাম, তা ঠিক।

তা হলে বুঝতে পারছেন জায়গাটা বিপজ্জনক কী কারণে?

বললাম, একটা জিনিস আমার কাছে এখনও স্পষ্ট নয়–

আমার কথা চাপা দিয়ে সুরঞ্জনবাবু বললেন, বুঝেছি। জানতে চাইছেন যে প্রেতকায়াকে স্মিথ দেখেছিলেন সেটা কার? রাজভাণ্ডারের কল্পিত অশরীরী রক্ষকের, না যুবরাজের?

বললাম, ওটার মীমাংসার জন্যে আমার আগ্রহ নেই। আমার কৌতূহল পাথরের ছাদ চুঁইয়ে রক্ত পড়া বা দেওয়ালে রক্তমাখা হাতের ছাপ কার?

সুরঞ্জনবাবু বললেন, ওটার উত্তর আমিও খুঁজে পাইনি। পরে আর কেউ সেরকম কিছু দেখেছিলেন কিনা জানা নেই। মনে রাখতে হবে ভৌতিক ব্যাপারটাই তো রহস্যময়। তাই না?

আমি কিছুক্ষণ পরে জিগ্যেস করলাম, বলতে পারেন স্মিথ কোথায় মারা গিয়েছিলেন?

সুরঞ্জনবাবু বললেন, সঠিক বলতে পারব না। তবে ডায়েরিটা নাকি পাওয়া গিয়েছিল পাহাড়ের ওপর ঐ গড়েই।

বললাম, তা হলে তো বোঝাই যাচ্ছে ঐ গড়ের তীব্র আকর্ষণে স্মিথ বারে বারে ছুটে গিয়েছিলেন। তারপর আলোর পোকার মতো ওখানেই একদিন শেষ হয়ে যান।

সুরঞ্জনবাবু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, হয় তো তাই।

একটু থেমে বললেন, তাই আমি বলি দূর পাহাড়ের ওপর ঐ কেল্লার মায়াবী আকর্ষণে যে ছুটে যাবে তাকে মরতেই হবে।

একটু অবাক হয়ে বললাম, আচ্ছা, সুরঞ্জনবাবু, পাথরের তৈরি ভাঙাচোরা একটা কেল্লা সত্যিই হাতছানি দিয়ে মরণডাক ডাকে?

সুরঞ্জনবাবু একটু হাসলেন। ঠাট্টা করে বললেন, আপনিও তো দেখছি মোহগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। ও সব চিন্তা ছাড়ন। কাল আদিবাসীদের একটা বড়ো পরব আছে। আমি ঘোড়ার ব্যবস্থা করব। কাল চলুন, দেখে আসি।

সুরঞ্জনবাবুর আন্তরিক প্রস্তাব আমার কানে গেল না। বললাম, আচ্ছা আমার পাশের ঘরের বন্ধুদের সাড়া পাচ্ছি না তো।

সুরঞ্জনবাবু বললেন, ওঁরা কখন যে কোথায় যান আমায় বলে যান না। অথচ আমায় একটু জানিয়ে যাওয়া উচিত। হাজার হোক অপরিচিত জায়গা তো।

ওরা কজন আছেন?

পাঁচজন।

সবাই বাঙালি?

 হ্যাঁ। সেটাই ভাবনার।

জিগ্যেস করলাম, কেন?

বেশি গভীর জঙ্গলে গিয়ে পথ হারালে বাংলা ভাষায় জিগ্যেস করলে কোনো ফল পাওয়া যাবে না।

সুরঞ্জনবাবু নীচে চলে যাবার অল্পক্ষণ পর সিঁড়িতে ভারী জুতোর শব্দ শুনে বুঝতে পারলাম আমার প্রতিবেশী বন্ধুরা সদলবলেই ফিরল, তবে বেশ ভদ্রভাবে।

তালা খোলার শব্দ পেলাম পর পর তিনটে ঘরে। তারপর জানলা খোলার শব্দ। তারপর একটা ঘরে গেলাস ভাঙার শব্দ…তারপর সব শান্ত–সব স্তব্ধ।

আমিও ঘুমিয়ে পড়লাম।

অনেক রাতে হঠাৎ আমার ঘুমটা ভেঙে গেল। দূরে কোথায় যেন ঘোড়ার খুরের শব্দ আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ এখানে ঘোড়ার খুরের শব্দ এল কোথা থেকে ভাবতে গিয়ে মনে পড়ল আজই সন্ধেবেলা সুরঞ্জনবাবু আদিবাসীদের পরব দেখতে যাবার জন্যে ঘোড়ার ব্যবস্থা করে রাখবেন বলেছিলেন।

তিনি ভালো কথাই বলেছিলেন, কিন্তু একজন পুরোদস্তুর শহরবাসী যে কোনোদিন ঘোড়ায় চড়েনি সে এই জঙ্গল-পাহাড়ের রাস্তায় কীভাবে ঘোড়া চালাবে সেই অসম্ভব, অবাস্তব ব্যাপারটা বোধহয় ঘুমিয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত মাথায় ঘুরছিল। তারই ফলে স্বপ্নের মধ্যে ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনেছি।

ঘুম ভাঙতেই দেখলাম উত্তর দিকের জানলা দিয়ে একরাশ চাঁদের আলো এসে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েছে। এখানে এসে, এমন চাঁদের আলো দেখতে পাব আশা করিনি। ধীর মন্থর পায়ে উঠে বেরিয়ে এলাম। এই আমার সেই প্রিয় বারান্দা। শুধু আমারই প্রিয় তা নয়, এই হোটেলে যেই আসে আগেই সে দাবি করে বসে এই দশ নম্বর ঘরটা–ঐ বারান্দাটুকুর লোভে। আমি ভাগ্যবান তাই এই বারান্দা সংলগ্ন ঘরটা আমিই পেয়েছি।

কৃষ্ণপক্ষের নিস্তব্ধ রাতে চাঁদ যেন দু হাতে করে মুঠো মুঠো জ্যোৎস্না ছড়িয়ে দিয়েছে গাছগাছালির পাতায় পাতায় আর আমাদের এই হোটেলের বারান্দায় বারান্দায়। যে ভাগ্যবান সেই দেখতে পায়।

আমি এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে হঠাৎ উত্তর দিকে ফিরতেই স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। একদিন আমেরিকার উদ্দেশে পাড়ি দিচ্ছিল বিশাল টাইটানিক জাহাজ। অতলান্ত আটলান্টিকের বুকে গভীর রাতে চলতে চলতে মায়াবী জ্যোৎস্নায় ঢাকা মহাসাগরের বুক ফুঁড়ে হঠাৎ বিপুলাকার হিমশৈলকে একেবারে জাহাজের সামনে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জাহাজের ওয়্যারলেসে অপারেটর জ্যাক ফিলিস যেমন হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন, আমিও তেমনি জ্যোৎস্নার আলোয় হোটেলের একেবারে সামনে সেই দুর্গ-প্রাসাদটাকে দেখে ভয়ে বিহ্বল হয়ে গেলাম।

এই নিয়ে দুবার ওটাকে এত কাছ থেকে দেখতে পেলাম। কিন্তু তা মুহূর্তের জন্যে। অল্প পরেই সেটা অদৃশ্য হয়ে গেল।

তারপরেও কতক্ষণ খোলা বারান্দায় আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম খেয়াল ছিল না। এক সময়ে হুঁশ হল। রাত বোধহয় তখন তিনটে। আমি ধীরে ধীরে ঘরে এসে ঢুকলাম আর সঙ্গে সঙ্গেই মনে হল কিছু একটা যেন ঘর থেকে বেরিয়ে আমার গা ঘেঁষে ছুটে বারান্দার পাঁচিলের দিকে গেল। তারপর পাঁচিলে উঠে শূন্যে ঝাঁপ দিল।…..

আমি কাঁপতে কাঁপতে বিছানায় বসে পড়লাম।

.

মৃত্যুর হাতছানি

এবার নিয়ে দুবার হল এই হোটেলে আমার দশ নম্বর ঘরে ভয়ের ব্যাপার ঘটল। প্রথমবার সেই প্রথম দিনের সন্ধ্যাবেলায় ঘরে ঢুকতে গিয়ে শেকলে হাত দিতেই আমার হাতের ওপর অদৃশ্য হাতের চাপ। আর এদিন ভোর রাত্রে আমারই ঘরের মধ্যে ছায়ামূর্তির আবির্ভাব। সন্দেহের অবকাশ নেই বিন্দুমাত্র–সেই ছায়ামূর্তিটি আমার গা ঘেঁষে বেরিয়ে গিয়েছিল। তার পর দোতলার পাঁচিল থেকে ঝাঁপ দিয়েছিল।

এ সব ব্যাপারে সাক্ষ্য প্রমাণ থাকে না। কে কী কারণে এই রকম অদ্ভুত আচরণ করল তারও সঠিক উত্তর পাওয়া যায় না। হয় চোখ-কান বুজে বিশ্বাস করতে হয়, নতুবা উড়িয়ে দিতে হয়।

আমি বিশ্বাস করতে চাই না। কিন্তু উড়িয়ে দিতেও পারি না।

আমি প্রথম দিনের ঘটনা সুরঞ্জনবাবুকে বলিনি। কিন্তু দ্বিতীয়বার যে ঘটনা ঘটল তা সুরঞ্জনবাবুকে জানাতেই হবে। কারণ এখন বুঝতে পারছি আমার এই দশ নম্বর ঘরটি আর নিরাপদ নয়।

কোন অশরীরী আত্মা সেদিন কেন আমার হাত চেপে ধরেছিল এ যেমন জানা শক্ত তেমনি জানা শক্ত এই ঘরের মধ্যেই কার ছায়ামূর্তি সারারাত আস্তানা গেড়ে ছিল। এ বাড়ি বা এই ঘরের সঙ্গে এই দুটি ঘটনার কী যোগসূত্র–কে তা বলতে পারে? তবে এটা স্থির বুঝেছি এই ঘরে আমার থাকা আর মোটেই নিরাপদ নয়।

পরের দিনই আমি সুরঞ্জনবাবুকে সব কথা বললাম। শুনে সুরঞ্জনবাবু কিছুক্ষণ গুম হয়ে রইলেন। তারপর বললেন, প্রথম দিনের ব্যাপারটা আমায় আগেই বলা উচিত ছিল।

তার গলার স্বরে আমার ওপর বিরক্তি ঝরে পড়ছিল। কথার ধরনটা যেন কেমন!

আমি ক্ষুব্ধ হলাম। পাল্টা বিরক্তি প্রকাশ করে বললাম, আপনাকে বলেই বা কী হত? আপনি কি বলতে পারতেন আমার হাতটা যে চেপে ধরেছিল সে কে ছিল? কিংবা এখনই বলুন না যে ছায়ামূর্তিটি ভোরবেলায় আর ঘরে বসে ছিল সে কে?

সুরঞ্জনবাবু কোনোরকম উত্তেজনা প্রকাশ না করে শুধু মাথা নাড়লেন। বললেন, না, এ দুটো ঘটনার কোনো একটির সম্বন্ধেও আমি কিছুই বলতে পারব না। তবু এটা ঠিক, আমি এখানে বহু দিন থাকার সুবাদে এই অঞ্চলের অনেক কিছুই জানা আছে। এই বাড়িতে এর আগেও এইরকম আরো ঘটনা ঘটেছে যা প্রচার হলে হোটেলে কেউ থাকতে সাহস করবে না। যেমন আপনি আর ও ঘরে থাকতে চাইছেন না–এ কথাটা জানাবার জন্যেই সাত-সকালে নেমে এসেছেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। ঠিক কিনা?

সলজ্জভাবে স্বীকার করলাম। বললাম, ও ঘরে থাকাটা আমার পক্ষে এখন আর নিরাপদ নয়।

তা হলে?

আমাকে অন্য একটা ঘর দিন।

সুরঞ্জনবাবু ঠোঁটের ফাঁকে হাসলেন। বললেন দিতে পারি। কিন্তু ভেবে দেখেছেন কি যে ঘরটার জন্যে মিস্টার ভিরাবার সঙ্গে এত অশান্তি হয়ে গেল, আজ আপনি স্বেচ্ছায় সে ঘর ছেড়ে দিচ্ছেন দেখে সব ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যাবে না? শেষ পর্যন্ত ভূতের ভয়ে আপনি ঘর ছাড়লেন, এটা প্রচার হলে আপনার সম্মান থাকবে?

আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, কিন্তু ঐ ঘরে থাকা কি আর সম্ভব?

সুরঞ্জনবাবু বললেন, খুব সম্ভব। বেশ কদিন তো ঐ ঘরেই রইলেন। তেমন কোনো অসুবিধে হয়েছে কি? তবে বাকি যে কটা দিন এখানে থাকবেন ভাবছেন সে কটা দিন চোখ বুজে ভগবানের নাম করে কাটিয়ে দিন। দেখবেন বিপদ আপনার ধারে কাছে ঘেঁষতে পারবে না।

সুরঞ্জনবাবুর পরামর্শ ভালোই লাগল। সত্যিই আজই যদি দশ নম্বর ঘরটা ছেড়ে দিয়ে অন্য ঘরে চলে যাই তা হলে ভিরাবাগু আর তার দলবল যে হাসবে। ভূতের ভয়ে জীবনে কখনও করিনি। আর সবচেয়ে মজার কথা হচ্ছে আজ বাদে কাল যখন কলকাতায় ফিরে যাবো তখন সেই চিরপরিচিত আলো, পাখা, টিভি আর ক্রমাগত ট্রামবাসের যান্ত্রিক শব্দের মধ্যে বসে সুদূর ছত্রিশগড়ের কোনো এক অখ্যাত জায়গায় কয়েকদিনের এই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা মনেই পড়বে না।

কাজেই ঘর বদলাবার কথা চিন্তা না করে মনে সাহস নিয়ে ঐ দশ নম্বরেই থেকে গেলাম।

.

এর পর কয়েকটা দিন উত্তর দিকে তাকাইনি। ভুলতে চেষ্টা করেছিলাম সেই রহস্যময় দুর্গের কথা। এদিকে গত দুদিন মিস্টার ভিরাবাগুদের গলা শুনতে পাচ্ছি না। তারা এখানে আছেন কি না তাও সঠিক জানি না–জানতে ইচ্ছেও করে না।

এরই মধ্যে অন্যমনস্ক থাকার জন্যে একদিন বস্তার জেলার যুবক-যুবতীদের করমা নৃত্য দেখে এলাম। করমা দেবীকে খুশি করার জন্যেই আদিবাসীরা এই নাচ-গানের অনুষ্ঠান করে। সঙ্গে থাকে মাদল, বঁঝ আর ঢোল। বেশ কয়েকঘণ্টা আনন্দে কেটে যায়।

ও অঞ্চলে একদিন রাউৎ নাচ উৎসবও দেখলাম। আমাদের পশ্চিম বাংলায় যাদের গোয়ালা বলে রাউৎ হচ্ছে সেই জাত। এরা গোসেবা করে। দুধ দই বিক্রি করে। এই রাউত্রা নিজেদের শ্রীকৃষ্ণের বংশধর বলে মনে করে। আর গোবর্ধনের পুজো করে।

এমনি ভাবে তিন-চারদিন কেটে গেল। বেশ ভুলেই গিয়েছিলাম অলৌকিক ব্যাপারগুলোর কথা।

কিন্তু হঠাৎ সেদিন ঘটল একটা কাণ্ড। সক্কালবেলাতেই সুরঞ্জনবাবু হন্তদন্ত হয়ে আমার ঘরে এসে হাজির।

জিগ্যেস করলাম কী ব্যাপার? হঠাৎ এইভাবে?

সুরঞ্জনবাবু বললেন, খুব মুশকিলে পড়েছি সোমেশ্বরবাবু। আজ চারদিন হল মিস্টার ভিরাবাগু বা তার সঙ্গীদের কোনো খবর নেই।

অবাক হয়ে বললাম, সে কী। চারদিন কোনো খবর নেই। আমিও ওদের কদিন না দেখে অবাক হচ্ছিলাম। কোথায় গেছেন কিছু বলে যাননি?

সুরঞ্জনবাবু বললেন, অনেকেই বলে যান না। আমি নিজে থেকে জিগ্যেস করি না। তবে এইসব অজানা অচেনা জায়গায় আমাকে একটু বলে গেলে ভালো হয়। এ সাধারণ জ্ঞানটুকুও অনেকের থাকে না।

বললাম, চারদিন আগে মিস্টার ভিরাবাগু কখন বেরিয়েছিলেন?

সুরঞ্জনবাবু বললেন, কদিন থেকেই ভিরাবাগু বলছিলেন পাহাড়ের ওপর ঐ পুরনো গড়টা দেখতে যাবেন। তা আমি নিষেধ করেছিলাম। উনি কিন্তু গুরুত্ব দেননি। তারপর ঐদিন সকাল সকাল খেয়ে ওঁরা বেরিয়ে গেলেন। ইচ্ছে করেই জিগ্যেস করিনি কোথায় যাচ্ছেন। তবে আমি নিশ্চিত যে উনি সদলবলে ঐ পাহাড়টাতেই গেছেন। তার পর থেকে এখনও ফেরেননি।

বললাম, ওখানে রাত্তিরে থাকার ব্যবস্থা আছে?

আমার বোকার মতো কথা শুনে উনি একটু হাসলেন। বললেন, আমি কখনও ওখানে যাইনি। যাবার দরকারও হয়নি। তবে স্মিথের ডায়েরি তো আপনি পড়েছেন। সেখানে কোথায় কীভাবে যুবরাজ বা স্মিথ নিজে রাত্রিবাস করেছিলেন সেইটুকু থেকে যা জানা যায়।

বললাম, ওখানে পৌঁছে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে ফিরতে কত সময়ে লাগতে পারে?

সুরঞ্জনবাবু বললেন, ঘোড়ার চেপে গেলেও ফিরতে ফিরতে সন্ধে হয়ে যাবে। তারপর অন্ধকারে এগোনো যায় না। তবে ভোরবেলায় বেরিয়ে গেলে সন্ধের মুখে ফেরা সম্ভব।

জিগ্যেস করলাম, আপনার কি ধারণা ওনারা ঐখানেই গেছেন?

ধারণা নয়। জানতে পেরেছি মিস্টার ভিরাবাগু শুধু নিজের সঙ্গীদের নিয়েই নয়, কয়েকজন আদিবাসীদেরও মোটা টাকার লোভ দেখিয়ে সঙ্গে নিয়ে গেছেন।

এ খবর আপনি কার থেকে পেলেন?

আদিবাসী পাড়া থেকে। বলে চিন্তায় যেন ভেঙে পড়লেন।

কিছুক্ষণ পর সুরঞ্জনবাবু বললেন, এই যে আমার হোটেল থেকে চারজন মানুষ তার সঙ্গে কয়েকজন আদিবাসী উধাও হয়ে গেল, এর জন্যে পরে হয়তো আমাকেই জবাবদিহি করতে হবে।

তা হলে?

এখন কী কর্তব্য তাই ভাবছি।

বললাম, আমার মনে হয় দু-এক দিনের মধ্যেই ওঁরা ফিরে আসবেন।

সুরঞ্জনবাবু ঈষৎ বিরক্ত হয়ে বললেন, ঐ জায়গা সম্বন্ধে বাস্তবে আপনার কোনো ধারণা নেই বলেই এতটা নিশ্চিন্ত হয়ে এ কথা বলতে পারছেন। কিন্তু আমি বলছি জেনে রাখুন, ওদের একজনও ফিরবে না। ফেরবার হলে প্রথমদিনেই কিংবা তার পরের দিন ফিরে আসত।

এতক্ষণে বিপদের গুরুত্ব বুঝতে পারলাম। বললাম, তা হলে?

সুরঞ্জনবাবু বললেন, সব জেনে সব বুঝে আমি হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না। ভাবছি কাল ভোরেই আমি ওখানে চলে যাব। তারপর যা থাকে কপালে।

আপনি একলা যাবেন!

তা ছাড়া নিশ্চিত বিপদের মুখে কাকে টানব?

 বললাম, ঠিক আছে সুরঞ্জনবাবু, আমি আপনার সঙ্গে যাব।

সুরঞ্জনবাবু কিছুক্ষণ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, সোমেশ্বরবাবু, আপনি কি ভালো করে ভেবে বলছেন?

হ্যাঁ। একেবারে মনস্থির করে বলছি। তবে আমার মনে হয় সব ব্যাপারটা সদরে জানিয়ে রাখা আপনার কর্তব্য।

সুরঞ্জনবাবু বললেন, আমি কালই খবর পাঠাচ্ছি।

.

অভিশপ্ত গড়

 এই অঞ্চলে আদিবাসীরা পাল্কির মতো দোলায় এক-একজন লোক চাপিয়ে দৌড়তে দৌড়তে দূর পথ পার হয়ে যায়। এরা এতই গরিব আর এতই অল্পে তুষ্ট যে, এই দোলায় নিয়ে যাবার জন্যে যে পারিশ্রমিক চায় তা নিতান্তই সামান্য।

আমরা দুজনে দুটো দোলায় চেপে ভোরবেলায় রওনা হয়ে সেই পাহাড়ের নীচে যখন পৌঁছলাম বেলা তখন বারোটা বেজে কুড়ি মিনিট।

চারিদিক নিস্তব্ধ। মাঝে মাঝে জোর বাতাস বইছে। সেই বাতাসের ঝাঁপটায় গাছের পাতা খসে পড়ছে টুপটাপ। আশ্চর্য, পাতা খসার শব্দটুকু ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। এত গভীর জঙ্গলেও পাখির ডাক শুনতে পেলাম না। বেঁজি যদিও বা দু-চারটে চোখে পড়ছে তাও তারা যেন সদাত্রস্ত। এত ভয় কিসের ভয় কে জানে!

দোলার বাহকদের প্রচুর জলযোগের ব্যবস্থা করে আমরা পাহাড়ে উঠতে লাগলাম। যতই উঠতে লাগলাম ততই স্মিথ সাহেবের ডায়েরির কথা মনে পড়তে লাগল। তাতে জঙ্গলে ঢাকা পাহাড়ের যে বর্ণনা পড়েছিলাম হুবহু মিলে যাচ্ছে। অথচ সে আজ কত বচ্ছর আগের লেখা।

আমার আগে আগে কখনও হেট হয়ে, কখনও দু জানুর ওপর ভর দিয়ে, কখনও বা হামাগুড়ি দিয়ে উঠছেন সুরঞ্জনবাবু। আমি ঠিক তার পিছনে।

পাহাড়ে ওঠা সুরঞ্জনবাবুর অভিজ্ঞতা আছে কিনা জানি না। আমার যা আছে তা দেওঘরের নন্দন পাহাড়, বড়োজোর গিরিডির খ্রিস্টানহিল পর্যন্ত। কিন্তু এ পাহাড় একেবারে অন্য জাতের। একেবারে বুনো পাহাড়। সময়ে সময়ে গাছের শেকড় পর্যন্ত ধরে উঠতে হচ্ছে।

উঠছি আর একবার করে মাথা তুলে দেখছি আরও কতটা উঠতে হবে। কিন্তু সুরঞ্জনবাবু। একমনে উঠেই যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে সতর্কভাবে এপাশ ওপাশ দেখছেন পাছে কোনো বুনো জন্তুর সামনে পড়ে যান। এতক্ষণ যে তেমন কোনো জন্তু-জানোয়ারের মুখোমুখি হইনি এটাই আশ্চর্য।

প্রায় ঘণ্টাখানেক পর আমরা পাহাড়ের ওপর উঠলাম। না, নিতান্ত ছোটো পাহাড় নয়।

একবার চারিদিক তাকিয়ে দেখলাম কেমন যেন খাঁ খাঁ করছে। সামনেই কালো পাথরের গড়টা তর্জনী তুলে যেন আমাদের সাবধান করে দিচ্ছে।

গড়টা প্রায় গোটা পাহাড় জুড়ে। সামনের দিকটা অক্ষত। কিন্তু স্মিথ সাহেব বর্ণিত সিংহদ্বার দিয়ে দুপা ভেতরে যেতেই দেখা গেল পিছনের দিকটা ভেঙে ঝুলছে।

অনুমান করলাম গুপ্তধন যদি সত্যিই কোথাও থাকে তা হলে ঐ ভাঙা অংশের দিকটাতেই আছে। আর মিস্টার ভিরাবাগুর দলবলকে যদি খুঁজতে হয় তাহলে ঐ দিকেই।

সিংহদ্বারের মধ্যে দিয়ে আমরা দুজনে এগিয়ে চললাম। কয়েক পা যেতেই হঠাৎ টেম্পারেচারটা যেন হু হু করে নেমে গেল। অবাক হয়ে গেলাম। এত ঠান্ডা! মনে পড়ল। স্মিথও তার ডায়েরিতে এইরকম শীতের কথা লিখেছিলেন। প্রকৃতির কোন খেয়ালিপনায় হঠাৎ জলবায়ুর এই পরিবর্তন তা আমরা বুঝে উঠতে পারলাম না। এই মুহূর্তে এমন একটি প্রাচীন গড়ে এসে ঢুকেছি যে গড়ের পাথরে পাথরে তাপমাত্রার বৈশিষ্ট্য আমাদের জ্ঞানের বাইরে। শুধু তাপমাত্রার বৈশিষ্ট্যই নয়, সামনের হলঘরটার মধ্যে ঢুকতেই যে কী করে রাশি রাশি কুয়াশা চারিদিকের অলিন্দ ঘুলঘুলির মধ্যে দিয়ে আমাদের ঢেকে ফেলল তাও আমাদের জ্ঞানের বাইরে।

আমরা সেই গাঢ় কুয়াশার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চললাম। কোথায় কোন ঘরে বা বারান্দার দিকে চলেছি বুঝতে পারলাম না।

এক সময়ে সুরঞ্জনবাবুকে সতর্ক করার উদ্দেশ্যে তার হাতটা ধরতে গিয়ে যখন তার অস্তিত্বটাই টের পেলাম না তখনই বুঝলাম আমরা দুজনে দুদিকে ছিটকে পড়েছি। আর এই সময় গলা তুলে ডাকতে সাহস পেলাম না। নিঃশব্দেই এগিয়ে চললাম।

হাত দিয়ে দেওয়াল ছুঁতে গিয়ে বুঝলাম অন্য একটা ঘরে আমি ঢুকে পড়েছি। আর এই ঘরে ঢোকামাত্র কুয়াশা কোথায় চলে গেল। আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম।

একবার এদিক ওদিক তাকিয়ে সুরঞ্জনবাবুকে খোঁজবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোথাও তার কোনো চিহ্ন পেলাম না।

আমি গলার স্বর উঁচু করে ডাকলাম, সুরঞ্জনবাবু! পাথরের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে আমার কণ্ঠস্বর বাতাসে মিলিয়ে গেল।

ভয় পেলাম। কোথায় গেল মানুষটা?

আমি ঘরের দক্ষিণ দিকের অলিন্দে এসে দাঁড়ালাম। নীচে নিস্তব্ধ বনভূমির মধ্যে থেকে অনেক মিলিত কণ্ঠের অস্পষ্ট গান শোনা গেল। কিন্তু কাউকে দেখা গেল না। অবাক হলাম। এখানে কারা গান করছে?

কালো পাথরের মোটা একটা থামের পাশ দিয়ে পাক খেয়ে সরু একটা বারান্দা আরও ভেতরে চলে গেছে। সুরঞ্জনবাবুকে খুঁজে বার করবার জন্য সেই পথ ধরে ভেতরের দিকে চললাম। এখানেও একটা ঘর। তবে খুবই ছোটো। ভেতরে ঢুকতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। দেখলাম মেঝের ওপর স্তূপ করে রাখা হয়েছে একরাশ মোটা মোটা সাদা মোমবাতি।

এমনভাবে মোমবাতিগুলো পড়ে আছে যেন মনে হচ্ছে এই মাত্র কেউ মোমগুলো তৈরি করছিল, হঠাৎ লুকিয়ে পড়েছে। লুকিয়ে পড়েছে কাছেই কোথাও।

কয়েক মুহূর্তের জন্যে আমি বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে পড়লাম।

এত মোম কে তৈরি করছিল? কেন করছিল?

তখনই মনে পড়ল সেদিন গভীর রাতে হোটেল থেকে এই প্রাসাদের অলিন্দে অলিন্দে আলো জ্বলতে দেখেছিলাম বটে। এখন দেখছি সে আলো মোমের আলো। আর এইখানেই তার সৃষ্টি। এত বড়ো গড়কে আলোকসজ্জায় সাজাতে কম বাতি লাগে না জানি, তা বলে এত বাতি!

কিন্তু..যাক সে কথা। প্রশ্ন এখন কে এই বাতি তৈরি করছিল? শহর জনপদ থেকে দূরে এই পরিত্যক্ত নির্জন প্রাসাদে নিশ্চয় কোনো সাধারণ মানুষ একদিনে এত মোম তৈরি করতে পারে না। এখানের স্থায়ী বাসিন্দা ছাড়া কোনো একজনের পক্ষে এত মোম তৈরি করা সম্ভব নয়। তিনি যিনিই হন এতক্ষণ একমনে সেই কাজটিই করছিলেন। হঠাৎ অবাঞ্ছিত বাধা এসে পড়ায় তিনি আত্মগোপন করেছেন। আত্মগোপন করার জন্য তিনি বেশি দূরে সরে যেতে পারেননি। কাছেই কোথাও অন্ধকারে ঘাপটি মেরে আছেন। যে কোনো মূহুর্তে ঘাড়ের ওপর লাফিয়ে পড়তে পারেন।

এ কথা মনে হতেই আমার সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। আমি তাড়াতাড়ি দরজার দিকে দুপা পিছিয়ে এলাম। আর তখনই খুব কাছে শব্দ হল-ফোঁস!

চমকে উঠলাম!

না, সাপের গর্জন নয়, কোনো জন্তুরও চাপা রোষ নয়–এ যেন কোনো অপার্থিব জীবের ক্রুদ্ধ শ্বাসক্রিয়া! কাছে, খুব কাছে।….

আমি প্রাণভয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। তারপর ছুটতে লাগলাম। ছুটছি …..ছুটছি…. ছুটছি–

ঠিক কোন দিকে যাচ্ছি জানি না। একমাত্র লক্ষ্য এই গড় থেকে বেরিয়ে যাবার পথ খোঁজা। সরু বারান্দা। প্রত্যেকটা বারান্দার শেষে একটা করে ঘর।

হঠাৎ একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লাম। কে একজন বন্ধ দরজার গায়ে ঠেসান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

এগিয়ে যেতেই চমকে উঠলাম–সুরঞ্জনবাবু!

সুরঞ্জনবাবু সাড়া দিলেন না। কেমন একরকমভাবে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

এ আবার কী! আমি দু হাতে ধরে তাকে নাড়া দিলাম, সুরঞ্জনবাবু!

এতক্ষণে যেন চমক ভাল তার। দু চোখ লাল। কপালের একটা শির ফুলে উঠেছে। বোঝাই যায় প্রচণ্ড মানসিক চাপে শিরটা ফুলে উঠেছে। আমার দিকে তাকালেন।

জিগ্যেস করলাম, কী হয়েছে?

 উনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত রুগির মতো বিকৃত স্বরে শুধু উচ্চারণ করলেন, যুবরাজ

কোথায়?

উনি হাত দিয়ে বন্ধ দরজাটা দেখিয়ে দিলেন। আমি বুঝলাম এ নিশ্চয় মানসিক বিকার। নইলে কতকাল আগের সেই ছেদী রাজপরিবারের হতভাগ্য যুবরাজ, তিনি কী করে থাকবেন ঐ ঘরে? জীবিত তো নয়ই মৃত অবস্থাতেও থাকা সম্ভব নয়। তা হলে কী দেখে সুরঞ্জনবাবুর মতো লোক বলতে পারছেন যুবরাজ পাশের ঘরেই আছেন!

এক ধাক্কায় খুলে ফেললাম শালগাছের কাঠ দিয়ে তৈরি দরজা। ছোট্ট ঘর–যেন কয়েদখানা। একটা পুরনো ভাঙা খাট। তারই সামনে থকথক করছে তাজা রক্ত। আর কিছু নেই।

কোথায় যুবরাজ? আমি সুরঞ্জনবাবুর গা ধরে ঝাঁকানি দিলাম।

উনি রক্ত দেখিয়ে বললেন, ঐ তো। ঐ তো উপুড় হয়ে পড়ে আছেন।

ভুল, ভুল। শুধু চোখেরই ভুল নয়, মনেরও ভুল।

সুরঞ্জনবাবু তখনও অপ্রকৃতিস্থ। সেই অবস্থায় তাকে ধরে ধরে কোনোরকমে বাইরে নিয়ে এলাম।

বাইরে বেরোতেই সুরঞ্জনবাবু যেন সুস্থ হয়ে উঠলেন।

খুব বেঁচে গেলাম, সোমেশ্বরবাবু।

 আমিও।

এবার তাড়াতাড়ি ফেরার পালা।

আদিবাসী বেয়ারারা প্রস্তুত হয়েই ছিল। দোলায় ওঠবার আগে সুরঞ্জনবাবুকে বললাম, কিন্তু যে উদ্দেশ্যে আমাদের আসা, ভিরাবাগুদের দেখা পেলেন?

সুরঞ্জনবাবু মাথা নাড়লেন।

না।

বললাম, তবে প্রাসাদের মধ্যে থেকেও অনেক নীচে আমি মিলিত কণ্ঠে গান শুনেছি। অস্পষ্ট। মনে হচ্ছিল যেন ওঁদেরই গলা।

গান! ওরা গাইছিল?

আমার তাই মনে হয়েছিল।

বিস্মিত সুরঞ্জনবাবু বললেন, চারদিন ধরে এখানে থেকে বেঁচেও যদি থাকেন গান করতে যাবেন কিসের আনন্দে?

বললাম, তা বলতে পারব না। তবে মিলিত গলায় গাইতে শুনেছিলাম।

আদিবাসী বেয়ারা দুজন আমাদের কথা শুনে বলল, হ্যাঁ সাহেবরা…ই…সাত জনা মিলে সেই তখন থেকে নেচে আর গেয়েই যাচ্ছে।

কোথায়? কোন দিকে?

পাহাড়ের ঠিক পিছন দিকে।

 ওরা কি মদ খেয়ে নাচছে? জিজ্ঞেস করলাম।

আদিবাসীরা বলল, না বাবু, বোধহয় পাগল হয়ে গেছে। শুনলাম চারদিন ধরে নেচেই যাচ্ছে। এ কি কোনো মানুষ পারে?

বলেই কাঁধে দোলা তুলে নিল।

 বললাম, ওদের সঙ্গে একবার দেখা করলেন না?

দেখা করে সম্ভবত আর লাভ নেই। সদরে খবর দিয়ে এসেছি। পুলিশ এলে এখানে পাঠিয়ে দেব। ওরা যা করার করবে।

[শারদীয়া ১৪১১]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *