অলৌকিক জল্লাদ ও জীবন্ত কঙ্কাল

অলৌকিক জল্লাদ ও জীবন্ত কঙ্কাল

রহস্যের সূত্রপাত

খুব বেশি দিন না হলেও দেখতে দেখতে পনেরো বছর হয়ে গেল আমি কলকাতায় পুলিশের কাজ করছি। এই পনেরো বছরে কত চোর-ডাকাত ধরলাম, কত খুনিকে আদালতে পাঠালাম। কত মারামারি কত রক্তপাত! ফলে মনটা যেমন কঠোর তেমনি ভয়শূন্য হয়ে গেছে। সঙ্গে রিভলবারটা থাকলেই হলো।

শুধু চোর-ডাকাত-খুনি নিয়ে কারবার হলে মনে তেমন দাগ কাটত না। ওসব তো প্রায় সব পুলিশ অফিসারদের জীবনেই ঘটে। কিন্তু আমার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্যবশত জীবনে এমন কিছু অবিশ্বাস্য ভয়াবহ অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে যা কোনদিন ভুলতে পারব না। এই ঘটনাগুলো লিখে রাখার জন্যেই আপাতত এক মাসের ছুটি নিয়ে নিরিবিলি দেশের বাড়িতে এসেছি।

জায়গাটা নিরিবিলি। কিন্তু বাড়িটা নিরিবিলি নয়। আমাদের এই দোতলা বাড়িটা খুবই পুরনো। বাড়ির পিছনে অনেকদূর পর্যন্ত আমবাগান আর বাঁশঝাড়। এখনও গভীর রাতে শেয়াল ডাকে, খটাস বনবেড়াল ঘুরে বেড়ায় নিশ্চিন্তে। বাড়ির পশ্চিমে একটা পচা পুকুর। তার এদিকে একটা ভাঙা শিবমন্দির। ছোটোবেলায় ঐ পুকুরপাড়ে, আসশ্যাওড়ার ঝোপে কত চোর পুলিশ খেলেছি। তখন কি ভেবেছিলাম বড়ো হয়ে আমাকেই চোর-ডাকাত ধরে বেড়াতে হবে!

বাড়িটার সবচেয়ে আকর্ষণ বিরাট ছাদ। এই ছাদে কত ঘুড়ি উড়িয়েছি, ছোটাছুটি দাপাদাপি করেছি। আজও এ বাড়ির ছোটো ছেলেমেয়েরা ছাদেই খেলা করে।

এ বাড়িতে পাকাপাকিভাবে থাকে আমার মেজো আর ছোটো ভাই তাদের স্ত্রী, পুত্র কন্যাদের নিয়ে। এখন কলকাতা থেকে আমি এক মাসের জন্যে এসেছি স্ত্রী আর বারো বছরের দুষ্টু নোটনকে নিয়ে। আমার ভাগে যে দুখানি ঘর তা উত্তর দিকে। একখানি ঘর আমার একেবারে নিজস্ব। ঐ ঘরে বসে আমি দেশ-বিদেশের যত অপরাধ কাহিনি পড়ি। আর এখন এই ঘরে বসেই লিখছি আমার জীবনে ঘটে-যাওয়া বেশ কয়েকটি অলৌকিক ঘটনা।

আমার ঘরের জানলা দিয়ে তাকালে প্রথমেই চোখে পড়ে আমাদের উঠোনের ওপর নারকেল গাছটা। সেই ছোটবেলা থেকে দেখছি গাছটাকে। এখনও দিব্যি আছে। নারকেল গাছটা যেন আমাদের পরিবারেরই একজন হয়ে গেছে। গাছটাকে আমরা সবাই ভালবাসি। তারপরেই চোখে পড়ে সেই বিশাল আমবাগান আর বাঁশঝাড়ের জঙ্গল। যতদূর দেখা যায় শুধু গাছের সবুজ মাথা। যখন সন্ধের অন্ধকার নেমে আসে তখন ঐ বাগান-জঙ্গলকে কেমন রহস্যময় বলে মনে হয়। কেমন ভয় করে। মনে হয় যেন কোনো অজানা আতঙ্ক ওৎ পেতে আছে গাছগুলোর ডালে ডালে।

লেখাটা শুরু করা উচিত ছিল অনেক আগেই। কিন্তু হঠাৎ নেপালের কাঠমাণ্ডুতে বেড়াতে যাবার সুযোগ এসে গেল। এখন বর্ষাকাল। বর্ষাকালে কেউ বড়ো একটা পাহাড়ে যায় না। কিন্তু আমারই সহকর্মী কলকাতার পুলিশ অফিসার প্রণবেশ যাচ্ছে জেনে আমিও তার সঙ্গ নিলাম। সর্বসাকুল্যে ওখানে আমরা দশ দিন ছিলাম। ওখানে নানা জায়গায় ঘুরেছি। বেশ উপভোগও করেছি। কিছু ভয়াবহ অভিজ্ঞতাও হয়েছে। তা তো হবেই। পুলিশ আর গোয়েন্দা যেখানেই যায়, তাদের মনোমতো একটা কিছু ঘটে থাকেই। যাই হোক মোটামুটি আনন্দ করে দেশের বাড়িতে ফিরে এসেছি। একটি লাভ হয়েছে। একটি নেপালী ছেলে পেয়েছি। বছর তেরো-চোদ্দ বয়েস। খুব কাজের ছেলে। নাম রাজু সুব্বা। একে পেয়ে আমার স্ত্রী আর নোটন খুব খুশি। রাজু একে নোটনের প্রায় সমবয়সী, তার ওপর বিদেশী। তাই ওর সঙ্গে নোটনের যত ভাব তত কৌতূহল ওর বিষয়ে।

এখন সন্ধেবেলা।

একটু আগেও বৃষ্টি হয়ে গেছে। গায়ে একটা হালকা চাদর জড়িয়ে লিখতে বসেছি। লোডশেডিং বলে লণ্ঠনের আলোয় লিখছি। ভালোই লাগছে। কেননা এই সব খুনখারাপি, অলৌকিক কাহিনি লিখতে গেলে এইরকম লণ্ঠনের টিমটিমে আলোরই প্রয়োজন। পরিবেশটা বেশ জমে। বাড়ির বৌরা নিচে রান্না করছে আর গল্প করছে। আমার ঘরে আমি একা। লিখছি। ফাটা দেওয়ালের গায়ে একটা টিকটিকি অবাক হয়ে আমার লেখার কাজ দেখছে।

হঠাৎ পিছন থেকে নিঃশব্দ পায়ে কেউ এসে লণ্ঠনটা নিভিয়ে দিল। মুহূর্তে ঘর অন্ধকার। সঙ্গে সঙ্গে একটি বালককণ্ঠের প্রাণখোলা হাসি। বুঝলাম আমার দুষ্টু ছেলে নোটনের কাজ। ভয় দেখাবার জন্যে আলো নিভিয়েছে। কিন্তু–ঘরে আরও যেন কেউ রয়েছে।

অন্ধকারেই হাঁকলাম–কে রে? কে রে?

কোনো উত্তর নেই। নোটনের হাসিও থেমে গেল।

-নোটন, তোর সঙ্গে আর কে আছে রে?

উত্তর নেই।

 হঠাৎ নোটন চিৎকার করে কেঁদে উঠল–ও গো মা গো! বাবা গো!

কী হলো! নোটন অমন করে কেঁদে উঠল কেন? পুরনো বাড়ি। কিছু কামড়ালো নাকি?

অন্ধকারেই আমি চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠলাম। টেবিলে ধাক্কা লেগে লণ্ঠনটা পড়ে গেল। কেরোসিন তেলের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল।

অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে আন্দাজে নোটনের কাছে যাবার চেষ্টা করলাম। তার আগেই ওর কান্না শুনে নোটনের মা, ওর কাকা-কাকীমারা আলো নিয়ে ছুটে এসেছে। দেখলাম দেওয়ালের এক কোণে দাঁড়িয়ে নোটন তখনও ভয়ে কাঁপছে।

–কি হয়েছে?

প্রথমে উত্তর দিতে পারছিল না। তারপর শুধু বলল–ঘরে কিছু ঢুকেছিল।

–ঘরে কে ঢুকবে? কখন ঢুকবে?

 –আমরা ঢোকার পরই

–আমরা?

এতক্ষণে ঘরের মধ্যে দ্বিতীয়জনকে দেখতে পেলাম। সেও দেওয়ালে ঠেস দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।

–কিন্তু ঘরে আর কে ঢুকবে? কাকে দেখে অমন ভয় পেলি?

নোটন বলল–আমি স্পষ্ট দেখেছি দুটো জ্বলজ্বল চোখ দরজার কাছে।

এই অসম্ভব অবাস্তব ব্যাপার নিয়ে আমরা আর মাথা ঘামালাম না। দোতলার এই ঘরে জ্বলন্ত চোখবিশিষ্ট জন্তু-জানোয়ারের ঢোকা সম্ভব নয়। সদর দরজা সন্ধে হতেই বন্ধ হয়ে যায়।

এবারে রাজু সুব্বার দিকে তাকালাম। সে একে রোগা ডিডিগে, কম কথা বলে, তার ওপর এইরকম কান্নাকাটিতে কেমন ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছে। ওর চোখের স্বাভাবিক চাউনিটাও একটু অদ্ভুত রকমের। ছোটো ছোটো সরু চোখ। চোখের মণি দুটো একটু বেশি উপর দিকে ওঠা। ফলে সাদাটাই বেশি দেখা যায়। যেন চোখ উল্টে আছে। হঠাৎ দেখলে মনে হয় বুঝি অন্ধ। ওর চোখের দিকে তাকালে বোঝা যাবে না ও রেগে আছে না ভয় পেয়েছে কিংবা খুশি হয়েছে।

রোগা রোগা সরু হাত, দেহের তুলনায় নারকেলের মতো লম্বাটে মাথাটা বেশ বড়। রোয়া রোঁয়া পাতলা চুল। খালি-গা হলে বুকের পাঁজরাগুলো একটা একটা করে গোনা যায়। কণ্ঠের হাড় বেরিয়ে আছে। মনে হয় একটু ঠেলা দিলেই ছিটকে পড়ে যাবে। কিন্তু এই শরীর নিয়েই সে যে কী অসম্ভব তাড়াতাড়ি কাজ করতে পারে তা না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না।

সুব্বা বাংলা বলতে না পারলেও বাংলা মোটামুটি বোঝে। খুব কম কথা বলে। যেটুকু বলে ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে। মাঝে মাঝে সে নেপালী ভাষাও বলে ফেলে। যেমন–চাকে বলে চিয়া, কমলালেবুকে বলে সন্তালা।

একটা জিনিস লক্ষ করছি–যদিও আমিই ওকে এখানে নিয়ে এসেছি তবু ও আমাকে যেন এড়িয়ে চলে। ডাকলে চট করে আসে না। সাড়াও দেয় না। যেন শুনতেই পায়নি। কেন এমন ব্যবহার তা বুঝতে পারি না। তবে নোটনের সঙ্গে ওর খুব ভাব। দুজনে গল্প করে, খেলা করে। নোটনের মাকেও পছন্দ করে। নোটন কখনো ওকে ডাকে রাজু বলে। কখনও ডাকে ওর পদবী ধরে-সুব্বা।

এই কদিনেই আর একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি–ও আমাকে জব্দ করতে চায়। একটা ঘটনা বলি।–প্রায়ই আমার মাথার যন্ত্রণা হয়। তার জন্যে সবসময়ে কাছে ওষুধে রেখে দিই। যন্ত্রণাটা এবার অনেক দিন হয়নি। কিন্তু নেপাল থেকে ফিরে এসে উপরি উপরি তিন দিন যন্ত্রণা হলো। প্রথম দুদিন ওষুধ খাবার জন্যে সুব্বাকে জল দিতে বলেছিলাম। বেশ দেরি করে জল এনে দিয়েছিল। ওর সামনেই ওষুধ খেয়েছিলাম। কিন্তু তৃতীয় দিন ও জল এনে দিল না। ধমক দিলেও এমন ভান করল যেন ও আমার কথা শুনতেই পায়নি। কিন্তু আশ্চর্য ওষুধের প্যাকেটটা খুঁজে পাওয়া গেল না। ওষুধ খাওয়া হলো না। সারারাত্রি যন্ত্রণায় ছটফট করলাম। পরের দিন দেখলাম ওষুধের প্যাকেটটা পিছনের জঙ্গলে পড়ে আছে। কেউ জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। সবাইকে ডেকে দেখালাম। কিন্তু কে ফেলেছে কেউ বলতে পারল না। নোটন আড়ালে সুব্বাকে জিজ্ঞেস করেছিল। সুব্বা উত্তরে মাথা নেড়ে বলেছিল– নেহি। তবুও বোঝা গেল ওষুধটা ও-ই ফেলে দিয়েছিল। কিন্তু কেন? ও তো নিতান্ত ছোটো শিশুটি নয়।

আরও আশ্চর্যের কথা–পরে জেনেছিলাম সেদিন সুব্বাই চুপি চুপি একা ঘরে ঢুকে আলোটা নিভিয়ে দিয়েছিল। নোটন যে ওকে চুপি চুপি ঘরে ঢুকতে দেখে কৌতূহলের বশেই ঘরে ঢুকেছিল, সুব্বা তা টের পায়নি। ঘর অন্ধকার করে সুব্বা আমাকে ভয় দেখাতে যাচ্ছে ভেবে নোটন জোরে হেসে উঠেছিল।

কিন্তু যে ছেলেটা আমার কথা শুনতে চায় না, ডাকলে সাড়া দেয় না, কাছে ঘেঁষে না, সে কেন ঘর অন্ধকার করে আমার সঙ্গে মজা করতে এল?

এ কথা নিয়ে বাড়িতে কারও সঙ্গে আলোচনা করিনি। নিজের কাছেও সদুত্তর পাইনি।

এ ছাড়া অন্ধকার ঘরে কেন কি দেখে নোটন অমন ভয় পেয়ে চেঁচিয়ে উঠেছিল তাও ঠিক আমার কাছে পরিষ্কার হয়নি। সত্যিই ও ঘরের মধ্যে জ্বলন্ত চোখ দেখেছিল কিনা, কিংবা কার চোখ তাও অমীমাংসিত থেকে গেছে।

.

ভয়ংকর ঘণ্টাকর্ণ

সুব্বাকে পাবার পিছনে একটা বিশেষ ঘটনা আছে।

নেপালের কাঠমাণ্ডুতে যে হোটেলে প্রণবেশ আর আমি উঠেছিলাম, সে হোটেলটি একেবারে শহরের মধ্যে। হোটেলে বেশ কয়েকজন অল্পবয়সী ছোকরা কাজ করত। আমাদের যে দেখাশোনা করত সে নেপালী হলেও বাংলা বুঝত আর মোটামুটি বলতেও পারত। সে বলত–এখানে বাঙালিবাবুরাই বেশি বেড়াতে আসে। তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে বাংলা শিখে গেছি।

ওর নাম জং বাহাদুর। ও বাংলা জানায় খুব সহজেই ওর সঙ্গে আলাপ জমিয়ে নিলাম। শুনে কষ্ট হলো ওদের মতো যারা হোটেলে কাজ করে তারা খুবই গরিব। তাই অল্পবয়সী ছেলেরাও কাজের খোঁজে ইন্ডিয়ায় চলে যায়। শিলিগুড়ি, কলকাতাই তাদের লক্ষ্য।

আমার তখনই মনে হলো কলকাতায় আমার বাসার জন্যে ঐরকম একটা কাজের ছেলের দরকার। কলকাতায় তো চট করে কাজের ছেলে পাওয়া যায় না। তাই জং বাহাদুরকে বলেছিলাম–তোমার মতো একটা ছেলে পেলে আমিও নিয়ে যাই।

জং বাহাদুর বলেছিল–দেখব।

তারপর ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম–কাঠমাণ্ডুতে দেখবার কী কী আছে?

ও এক নিশ্বাসে অনেকগুলো জায়গার নাম করে গেল বুড়ো নীলকণ্ঠ, স্বয়ম্ভু মন্দির, দক্ষিণাকালী বাড়ি, গুর্জেশ্বরী মন্দির, দেবী কুমারী বা জীবন্ত দেবী আর পশুপতিনাথ তো আছেনই।

জিজ্ঞেস করেছিলাম–এখানে উৎসব কী কী হয়?

ও চটপট উত্তর দিয়েছিল ত্রিবেণী মেলা, শ্রীপঞ্চমী, মাঘী পূর্ণিমা, মহাশিবরাত্রি, হোলি, নববর্ষ

বাধা দিয়ে বলেছিলাম–তা তো বুঝলাম। কিন্তু এখন কোনো উৎসব হয় কি?

–হয় বৈকি। খুব উৎসাহের সঙ্গে ও উত্তর দিয়েছিল–নাগপঞ্চমী, ঘণ্টাকর্ণ। জিজ্ঞেস করেছিলাম–ঘণ্টাকর্ণ কি?

ও হঠাৎ চোখ বুঝিয়ে দু হাত জোড় করে কারও উদ্দেশে যেন নমস্কার করল। তার। পর যা বলল তার মানে হলো–ঐ পুজোটা হচ্ছে দানব আর অশুভ আত্মাদের সন্তুষ্ট করার জন্যে। এই জুলাই-আগস্ট মাসে নেপালের পাহাড়ে পাহাড়ে অশুভ শক্তিরা ঘুরে বেড়ায় দানবের মূর্তি ধরে। তাদের সামনে পড়লে মানুষ, জীবজন্তু কারো রক্ষা নেই। তাদের আটকাবার ক্ষমতাও কারো নেই। তাই সেই দানব-দেবতাদের পুজো দিয়ে সন্তুষ্ট করে সসম্মানে বিদেয় করার চেষ্টা। এই জন্যেই ঘণ্টাকর্ণ পুজো।

এইসব অশুভ আত্মা, দানব-দেবতার কথা শুনে ঘণ্টাকর্ণ পুজো দেখবার খুব ইচ্ছে হলো আমাদের। ওকে বলাতে ও খুব উৎসাহ করে কোথা দিয়ে কেমন করে যেতে হবে তার হদিস বলে দিল। শেষে গলার স্বর নিচু করে বললে,–এখানে যাবেন যান। কিন্তু কেউ বললেও যেন দক্ষিণের ঐ উঁচু পাহাড়টার নিচে যাবেন না।

জিজ্ঞেস করলাম–কেন? ওখানে কী আছে?

ও একটু চুপ করে থেকে বললে, ঐ পাহাড়ের নিচে একটা নদী আছে। সেই নদীর ধারে একটা গুহায় ঘণ্টাকর্ণের এক ভয়ংকর মূর্তি আছে। ওখানেও ঘণ্টাকর্ণের পুজো হয়। কিন্তু সে পুজো খুব গোপন। বাইরের লোক তো দূরের কথা–সব নেপালীরাও ওখানে যেতে পারে না। গেলে আর তাদের ফেরা হয় না।

প্রণবেশ ব্যাপারটা আমাকে বুঝিয়ে বললে যে, আমাদের দেশে যেমন নির্জন জায়গায় তান্ত্রিক, কাঁপালিকরা গোপনে কালীপুজো করে, এও সেইরকম। তান্ত্রিক, কাঁপালিকরা যেমন ভয়ংকর প্রকৃতির লোক হয়, এরাও সম্ভবত সেইরকম।

যাই হোক দিন তিনেক পরে জং বাহাদুরই একটা জিপের ব্যবস্থা করে দিল। ড্রাইভার আমাদের কাছাকাছি দুতিন জায়গায় ঘণ্টাকর্ণ পুজো দেখিয়ে আনবে।

বেঁটেখাটো ফর্সা ধবধবে নেপালি ড্রাইভার। ঠিক যেন একটা মেশিন। চমৎকার ড্রাইভ করে নিয়ে গেল পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে।

দুজায়গায় ঘণ্টাকর্ণ পুজো দেখলাম। পাহাড়ের নিচে খানিকটা সমতল জায়গায় বেশ লোকের ভিড়। সেখানে মাদলের মতো একরকম বাজনা বাজছে দ্রিম দ্রিম করে। সারা গায়ে কালো কাপড় জড়িয়ে মুখে ভয়ংকর একটা মুখোশ এঁটে একটা মূর্তি তেড়ে তেড়ে যাচ্ছে। আর একজন পুরোহিতের মতো লোক ফুল ছুঁড়ে ছুঁড়ে তাকে মারছে। জানলাম এইরকম করেই নাকি পুজোর মধ্যে দিয়ে অশুভ শক্তির দানবকে তাড়ানো হয়। ঘণ্টাকর্ণের নকল ভয়ংকর মূর্তি ছাড়া আর কিছুই তেমন মনে দাগ কাটল না।

এবার আমাদের হঠাৎ ইচ্ছে করল সেই পাহাড়ের নিচে নিষিদ্ধ পুজোটা দেখার। কিন্তু ড্রাইভার রাজি হলো না। ওখানকার কথা তুলতেই ভয়ে ওর মুখ শুকিয়ে গেল। ওকে আমরা অনেক করে বোঝালাম যে, কোনোরকম ভয় নেই। ভূত, প্রেত, দানব, অশুভ শক্তি যাই থাকুক না কেন, এই রিভলভারের কাছে সব ঠান্ডা হয়ে যাবে বলে কোটের পকেট থেকে রিভলভার বের করে দেখালাম। তাছাড়া আমরা যে দুজনেই কলকাতার পুলিশের অফিসার তাও জানিয়ে দিলাম।

তাতেও ও যখন ইতস্তত করছিল তখন একটা পঞ্চাশ টাকার নোট ওর কোটের পকেটের মধ্যে খুঁজে দিলাম। আমাদের পঞ্চাশ টাকা মানে নেপালের পঁচাশি টাকা। এবার কাজ হলো। গরিব মানুষ ওরা। টাকা পেলে যমের দুয়োর পর্যন্ত যেতে পারে।

অগত্যা বিমর্ষ মনে ও গাড়িতে স্টার্ট দিল। গাড়িতে একটা কালীঠাকুরের ছবি ছিল। ড্রাইভার সেই ছবিতে বার বার মাথা ঠেকাল। তারপর গাড়ি চালাতে লাগল।

চারিদিকে জঙ্গলভরা পাহাড়। তারই মধ্যে দিয়ে খুব সাবধানে জিপটা চালিয়ে নিয়ে চলল ড্রাইভার। কখনো অনেক উঁচুতে উঠছে, কখনও নিচে নামছে।

প্রায় ঘণ্টাখানেক যাবার পর আমরা একটা ফাঁকা জায়গায় এসে পড়লাম। ডান দিকে আমাদের পশ্চিমবঙ্গের মতোই সবুজ ধানক্ষেত। বাঁ দিকে যে সরু নদীটা ঝির ঝির করে বয়ে যাচ্ছে, ড্রাইভারের কাছ থেকে নাম জেনে নিলাম–বিষ্ণুমতী নদী। ড্রাইভার সেই নদীর উদ্দেশে নমস্কার করল।

আবার সামনে পাহাড়। পাহাড়ের পর পাহাড়। পাইন গাছে ঢাকা।

হঠাৎ ড্রাইভার জোরে ব্রেক কষল। আমরা ঝকানি খেয়ে চমকে উঠলাম।

কি হলো?

অমন শক্তসমর্থ ড্রাইভার ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল–বিল্লি!

বিল্লি! বেড়াল! তা একটা বেড়াল দেখে এত ভয় পাবার কী আছে?

দেখলাম বনবেড়ালের মতো মস্ত একটা কালো বেড়াল পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে জিপের দিকে তাকিয়ে আছে।

মনে পড়ল এ দেশের সংস্কারের কথা। নেপালে কোথাও বেড়াল দেখা যায় না। এ দেশে কেউ বেড়াল পছন্দ করে না। তাদের মতে বেড়ালের চেয়ে কুকুর ভালো। বেড়াল কোনো উপকার করে না। বরঞ্চ ক্ষতি করে। সিদ্ধিদাতা গণেশের বাহন যে ছুছন্দ্ৰ (ইঁদুর), তাদের বেড়াল হত্যা করে। কাজেই বেড়াল গৃহস্থের অকল্যাণ করে। আর যদি কালো বেড়াল হয় তাহলে রক্ষে নেই। কেননা, এদের বিশ্বাস, কালো বেড়াল অশুভ আত্মার ছদ্মরূপ।

যাই হোক প্রণবেশ গাড়ি থেকে নেমে বেড়ালটাকে তাড়িয়ে দিল। বেড়ালটা ফাঁস করে কামড়াতে এসেছিল কিন্তু দ্বিতীয় বার তাড়া খেয়ে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেল।

অনিচ্ছুক ড্রাইভার আবার গাড়ি চালাতে লাগল।

গাড়ি চলেছে ধীরে ধীরে পাহাড়ের ওপর ঘুরে ঘুরে। কিছুক্ষণ চলার পর গাড়ি নামতে লাগল। নিচের দিকে তাকালে মাথা ঘুরে যায়। কুয়াশায় ঢাকা পড়ে গেছে পথ। খুব সাবধানে গাড়ি চালাচ্ছে ড্রাইভার। পাশেই গর্ত। স্টিয়ারিং একটু এদিক-ওদিক হলেই আর রক্ষে নেই। গাড়িটা ডান দিকের আরও সরু পথ ধরে চলল। পাহাড়ের গায়ে অজস্র সল্ট, চিলোনী, মহুয়া আর বাজ গাছের জটলা।

প্রায় দেড় ঘণ্টা যাবার পর এক জায়গায় সরু রাস্তাটা তিন দিকে চলে গেছে। হঠাৎ ড্রাইভার সেখানে ব্রেক কষল। আমরা কিছু বুঝে ওঠবার আগেই দেখি রাস্তার দিকে তাকিয়ে ড্রাইভার প্রণাম করছে।

কাকে প্রণাম করছে?

মুখ বাড়িয়ে দেখি ঠিক মোড়ের মাথায় একটা মস্তবড়ো খুঁটের ওপর লাল এক টুকরো ন্যাকড়া, ওদেশের একরকম হলদে রঙের জায়ে আর জবার মতো লাল লালি গোলাপ ফুল, সরু সরু ডালসুষ্ঠু পাতা। ড্রাইভার সেইগুলোর উদ্দেশেই প্রণাম করছে। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে যেটুকু বুঝতে পারা গেল তা হচ্ছে এগুলো আমাদের দেশে তুক করার মতো। আজকাল অবশ্য তুকতাক বড়ো একটা দেখা যায় না। কিন্তু ছোটোবেলায় আমরা গ্রামে দেখেছি। রাস্তার মোড়ে এইরকম মন্ত্রপূত তুক সাজিয়ে রেখে দিত এক শ্রেণীর হিংস্র স্বভাবের মানুষ লোকের চরম ক্ষতি করার জন্যে। এই তুক মাড়ালে সর্বনাশ হয়। এও সেইরকমের তুক। ড্রাইভার জানাল এই তুক করেছে ভয়ংকর স্বভাবের তান্ত্রিক যে এই বিশেষ ঘণ্টাকর্ণ পুজো করে। রাস্তার মোড়ে তুক সাজিয়ে রেখে লোককে হুঁশিয়ার করে দিচ্ছে–কেউ যদি ভুল করেও এতদূর এসে পড়ে, তারা যেন আর না এগোয়।

কাজেই আমাদের ড্রাইভার আর এগোতে নারাজ। অগত্যা আমরা নেমে পড়লাম। জেনে নিলাম এই পাহাড়টা থেকে এক কিলোমিটার নেমে গেলেই বিষ্ণুমতী নদী। সেই নদীর তীরেই

ড্রাইভার আর কিছু বলতে চাইল না। আমরা নামতেই ও গাড়ি ঘুরিয়ে নিল যাতে দরকার হলেই স্টার্ট নিতে পারে। এমনও বিপদ হতে পারে যখন গাড়ি ঘোরাবার আর সময় থাকবে না। শুধু তাই নয়, গাড়িটা রাখল আরও এগিয়ে নিরাপদ দূরত্বে। আমাদের পরিষ্কার বলে দিল বেশি দেরি হলে সে এখানে গাড়ি নিয়ে থাকবে না। কেননা বেশি দেরি হলে বুঝে নেবে আমরা আর বেঁচে নেই। নিষিদ্ধ পুজো দেখতে যাওয়ার শাস্তি মৃত্যু।

কথাটা শুনে আমাদের গা শিউরে উঠল। সত্যিই কি সব জেনেশুনে আমরা মৃত্যুর মুখে এগিয়ে চলেছি?

যাই হোক পকেটের ভেতর থেকে রিভলভারটা বের করে, মুঠোর মধ্যে ধরে আমরা নামতে লাগলাম।

ঢাল পথে আমরা হুড়মুড় করে নেমে চললাম। নিস্তব্ধ পাহাড়ে পথ। দুপাশে যেন পাথরের আকাশচুম্বী খাড়া প্রাচীর। এখানে মরে পড়ে থাকলে কাক-পক্ষীতেও টের পাবে না।

প্রায় দশ মিনিট ধরে নামার পর আমরা নিচে বিষ্ণুমতী নদী দেখতে পেলাম। তবে তো আমরা এসে পড়েছি।

পাহাড়ী নদী। জল কম। শীর্ণ। নদীর বুকে ছোটো-বড়ো নানারকমের নুড়ি।

 হঠাৎ প্রণবেশ আমার হাতটা চেপে ধরল।

–কি হলো?

 –ওগুলো কি? বলে প্রণবেশ নদীর ওপারে আঙুল তুলে দেখাল।

যা দেখলাম। মাথার চুলগুলো পর্যন্ত খাড়া হয়ে উঠল। গোটা পনেরো মাথার খুলি ছড়িয়ে রয়েছে নদীর ওপরে। মাথার খুলিগুলো আকারে ছোটো।

আমরা পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। এত মড়ার মাথার খুলি এল কোথা থেকে?

আমরা আরও একটু নামলাম। দশ হাত নিচেই নদী। ওপরে পাহাড়টা আলসের মতো ঝুঁকে রয়েছে। মনে হচ্ছে যেন মস্ত একটা গুহার মুখ!..ঐ যে কয়েকজন লোক..কী ভয়ংকর সব চেহারা! কিন্তু কারও মুখে কথা নেই। অথচ ব্যস্ত। সবার গলায় ছোটো ছোটো পাতার মালা।

হঠাৎ দেখি দুজন লোক একটা ছেলেকে ধরে নদীর দিকে আসছে। হৃষ্টপুষ্ট ছেলেটি। ফর্সা রঙ। সুন্দর দেখতে। বয়েস বছর দশেক। খালি গা। শীতে কাঁপছে। গলায় লাল ফুলের মালা ছেলেটির মুখ ভয়ে শুকিয়ে গেছে।

–কি ব্যাপার? প্রণবেশকে ফিফিস্ করে জিজ্ঞেস করলাম।

 –স্নান করাতে নিয়ে আসছে।

–ধরে নিয়ে আসছে কেন? গলায় মালা কেন?

 প্রণবেশ ম্লান হাসল। বলল বুঝতে পারছ না?

এবার আর বুঝতে বাকি রইল না। ঘণ্টাকর্ণ পুজোয় ছেলেটাকে বলি দেবে। বলি এই প্রথম নয়। ঐ যে ছোটো খুলিগুলো দেখলাম, ওগুলোও হতভাগ্য ছেলেদের।

মুহূর্তেই কর্তব্য স্থির করে ফেললাম। বড়ো পাথরের আড়ালে আমরা শিকারী কুকুরের মতো নিঃশব্দে এগিয়ে চললাম। দুজনের হাতে মুঠোয় শক্ত করে ধরা রিভলভার।

ওরা যখন ছেলেটাকে স্নান করিয়ে ফিরছে, আমরাও তখন সাবধানে হেঁটে হেঁটে নদী পার হলাম। এখনও পর্যন্ত ওরা আমাদের দেখতে পায়নি।

আমরা যথেষ্ট তফাৎ রেখে এগোচ্ছি। একটু দূরে গিয়ে ওরা থামল। এটা সেই ঝুলে পড়া পাহাড়ের মুখ। দেখলাম পাহাড়ের গুহায় অন্ধকারে পাথরের মস্ত একটা পিদিম জ্বলছে। ভেতরে বোধ হয় ঘণ্টাকর্ণের মূর্তি। মূর্তিটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। সামনে পুজোর আয়োজন। একজন মোটাসোটা লোক পুজো করছে। গায়ে লাল চেলি। গলায় লাল ফুলের মালা। সামনে–ঐ যে হাঁড়িকাঠ। আর ওটা কী? একটা বেঁটেখাটো মানুষের কংকাল ঝুলছে গুহাটার বাঁ দিকে। বাতাসে কংকালটা দুলছে। এইরকম একটা কংকাল প্রকাশ্যে টাঙিয়ে রাখার কারণ কী বুঝতে পারলাম না।

প্রায় দশ মিনিট পর লোকটা পুজোর আসন থেকে উঠল। এবার লোকটাকে স্পষ্ট দেখতে পেলাম। জীবনে কখনো তান্ত্রিক বা কাঁপালিক দেখিনি। এই প্রথম দেখলাম। বড়ো বড়ো হিংস্র ভয়ংকর চোখ। কপালে সিঁদুর ল্যাপা। পেশিবহুল হাতে রুদ্রাক্ষের মালা।

লোকটি এগিয়ে আসতেই আরও যে চার-পাঁচজন বসেছিল তারা উঠে দাঁড়াল। তান্ত্রিক বলিদানের নির্দেশ দিল।

এবার ছেলেটাকে ধরে আনা হলো। পাছে চেঁচায় তাই মুখটা কালো কাপড় দিয়ে বাঁধা।

প্রণবেশ অধৈর্য হয়ে চাপা গলায় বলল, আর দেরি নয়। অ্যাকশান।

আমি বাধা দিয়ে বললাম, আর একটু দেখি। হ্যাঁ, শোনো তুমি আটকাবে তান্ত্রিকটাকে। আর আমি সামলাব ঐ পাঁচজনকে।

হাঁড়কাঠে ছেলেটার মাথা আটকে দেওয়া হলো। এবার স্বয়ং তান্ত্রিক বিরাট একটা খাঁড়া হাতে নিয়ে এগিয়ে এল। সঙ্গে সঙ্গে পাথরের আড়াল থেকে আমরা দুজনে দুদিকে রিভলভার হাতে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।

প্রণবেশ একেবারে তান্ত্রিকটার মুখোমুখি। আমি একা বাকি পাঁচজনের সামনে রিভলভার ঘোরাতে লাগলাম।

এই অকস্মাৎ আক্রমণে ওরা প্রথমে ভ্যাবাচাকা খেয়ে গিয়েছিল। তার পরেই ওরা আমার দিকে তেড়ে এল। আমি একটা ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার করলাম। পাহাড় কাঁপিয়ে গুলির শব্দটা ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে মিলিয়ে গেল। ওরা ভয়ে পিছিয়ে গেল। তারপর প্রায় পাঁচ মিনিট ওরা আর এগোচ্ছে না। মাথার ওপর গাছের ডালে একটা মস্ত কাক কাঁক কাঁক করে ডেকে উঠল। কাক যে এত বড়ো হয় তা জানা ছিল না। বোধ হয় পাহাড়ী কাক বলেই এত বড়ো।

চকিতে প্রণবেশের দিকে তাকালাম। তান্ত্রিক আর প্রণবেশ পাঁচ হাতের ব্যবধানে মুখোমুখি নিশ্চল দাঁড়িয়ে। তান্ত্রিকের হাতে খাড়া। কিন্তু–এ কী! প্রণবেশ নেতিয়ে পড়ছে কেন? দেখি তান্ত্রিক ভয়ংকর দৃষ্টিতে প্রণবেশের দিকে তাকিয়ে আছে। তার দুচোখ দিয়ে যেন আগুন ঝরছে। বুঝলাম তান্ত্রিক হিপনোটাইজ করছে। আর প্রণবেশের হাত থেকে রিভলভার খসে পড়ছে।

তখনই আমি বাঁ হাতের রিভলভারটা অন্যদিকে তাক করে প্রণবেশকে ঠেলা মেরে সরিয়ে দিলাম। ওর হাত থেকে রিভলভারটা কেড়ে নিলাম। এখন আমি একা। শুধু দু হাতে দুটো রিভলভার। প্রণবেশ হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে মাটিতে বসে পড়েছে। তান্ত্রিক সেই একইভাবে আমার দিকে তাকাল। কিন্তু প্রণবেশের চেয়ে আমার মনের জোর বোধহয় বেশি। আমি ওর চোখের দিকে না তাকিয়ে হুংকার দিয়ে বললাম–পিছু হটো।

ওরা শুনল না। কাঁপালিকও ছুটে এল আমার দিকে। আমি দ্রুত দশ পা পিছিয়ে গেলাম। কাকটা আবার বিকট শব্দে ডেকে আমাদের মাথার ওপর উড়তে লাগল। ওদের ভয় দেখাবার জন্যেই আমি উড়ন্ত কাকটাকে গুলি করলাম। দু-পাক ঘুরে কালো ডানায় রক্ত মেখে কাকটা এসে পড়ল তান্ত্রিকের মাথায়। আমি লাফিয়ে গিয়ে বুকে রিভলভার ঠেকালাম। অন্যরা ভয়ে পালাতে লাগল। মুহূর্তে পাহাড়ের আড়ালে কে যে কোথায় গা ঢাকা দিল আর তাদের দেখা গেল না। প্রণবেশও ততোক্ষণে সামলে উঠেছে। তখন উদ্যত রিভলভারের সামনে তান্ত্রিক আর ছেলেটাকে নিয়ে আমরা ওপরে উঠে এলাম। রিভলভারের সামনে তান্ত্রিক বাবাজি আর মেজাজ দেখাল না।

তান্ত্রিকের এই অবস্থা দেখে আমাদের এই ড্রাইভার ভয়ে বিস্ময়ে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল। তারপর হঠাৎ তার পায়ের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। বোধহয় বোঝাতে চাইল তার দোষ নেই। সে নিরুপায়। তার ওপর তার যেন ক্রোধ না পড়ে।

ড্রাইভারকে বললাম–সোজা থানায় চলো।

কিন্তু–লিখতে লজ্জা করছে, শেষ রক্ষা হয়নি। মাঝপথে হঠাই আমাদের অপ্রত্যাশিতভাবে ঢুলুনি এসেছিল। তন্দ্রা ছুটলে দেখি জিপের মধ্যে ছেলেটা রয়েছে। কিন্তু তান্ত্রিক নেই। তাকে আমাদের দুজনের মাঝখানে বসিয়েছিলাম। তবু কী করে যে পালাল বুঝতে পারলাম না।

থানায় গিয়ে নিজেদের পরিচয় দিয়ে সব কথা বললাম। পুলিশকর্তা আমাদের সাহসের জন্যে ধন্যবাদ দিলেন। প্রতিশ্রুতি দিলেন খোঁজখবর নিয়ে ছেলেটিকে ওর বাপ-মায়ের কাছে পৌঁছে দেবেন।

হোটেলে ফিরে জং বাহাদুরকে সব ঘটনা বললাম। আশ্চর্য! সে মোটেই খুশি হলো না। মুখের ওপর রীতিমতো ক্রোধের ছায়া নেমে এল। যেন ওখানে গিয়ে আর ছেলেটাকে বাঁচিয়ে আমরা অন্যায় কাজ করেছি। শুধু থমথমে গলায় বলল, কাজটা ভালো করলেন না স্যার। ফল পাবেন। বলেই চলে গেল।

পরের দিন আমাদের ঘরে জল দিতে এল একজন বয়স্ক লোক। বাহাদুরের কথা জিজ্ঞেস করায় ও জানাল দুদিনের ছুটি নিয়ে ও কোথায় গিয়েছে।

মরুক গে। যে কেউ একজন আমাদের দেখাশোনা করলেই হলো।

দুদিন পর জং বাহাদুর ফিরে এল। দেখি কপালে ওর সিঁদুরের লম্বা তিলক। বুঝলাম কোনো ঠাকুর-দেবতার মন্দিরে গিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ এমন কী ঘটল যার জন্যে ছুটি নিয়ে ঠাকুরবাড়ি যেতে হলো? তখনই–কেন জানি না সন্দেহ হলো সেই তান্ত্রিকের আখড়ায় যায়নি তো?

যাই হোক ওকে আর কিছু জিজ্ঞেস করিনি।

যাবার আগের দিন সন্ধেবেলা হোটেলে ঢুকছি, দেখি একটা রোগা-পটকা ছেলে দরজার কাছে বসে আছে। জিজ্ঞেস করায় সে ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে বলল, সে বাড়ির কাজ খুঁজছে। যদি দরকার হয় তাহলে আমাদের সঙ্গে কলকাতায় যেতে পারে।

জং বাহাদুরকে ডাকলাম। শুনে বলল, আপনি তো কাজের ছেলে খুঁজছিলেন। তা এ যখন না ডাকতেই এসে পড়েছে তখন নিয়ে যান।

ওর চেহারা দেখে বললাম, এর শরীর তো এই। ও কি কাজ করতে পারবে?

এ কথা শুনেই ছেলেটা অদ্ভুত কাণ্ড করে বসল। ঐ প্রবল শীতে জামা খুলে ফেলে বার কতক ভল্ট খেলো। দুবার দুমদাম করে বড়ো বালতিটা নিয়ে পাঁই পাঁই করে নিচে নেমে গেল। আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে এক বালতি জল নিয়ে দৌড়ে এসে পড়ল। আশ্চর্য! এক ফোঁটা জল চলকে পড়েনি। দেখে যত না খুশি হলাম, তার চেয়ে বেশি হলাম অবাক। ছেলেটা কি ম্যাজিক জানে, না পাহাড়ী ছেলে বলেই এই গোপন শক্তি?

ইতস্তত করছি–জং বাহাদুর বলল, ভাবছেন কী, নিয়ে যান একে। এর কাজ দেখবেন।

ওকে নিয়ে যখন গাড়িতে উঠছি, দেখি বাহাদুর দূরে দাঁড়িয়ে হাসছে। সে হাসিটা যেন কীরকম! ঠিক বিদায়ের হাসি নয়।

.

অশুভ সংকেত

 আমার বন্ধু প্রণবেশ নেপাল থেকে ফিরে কলকাতাতেই থেকে গেল। আমি রাজু সুব্বাকে নিয়ে চলে এলাম দেশের বাড়িতে। প্রণবেশকে ছুটির মধ্যে অতি অবশ্য একবার আমার দেশের বাড়িতে বেড়াতে আসতে বলেছি। ও আসবে বলেছে।

যদিও জুলাই মাস। বৃষ্টির সময়। আকাশ মেঘলা। কিন্তু ঝড়ের সময় নয়। আশ্চর্য! স্টেশনে নেমে সুব্বাকে নিয়ে রিকশা করে অর্ধেক পথ যেতেই হঠাৎ ঝড় উঠল। সে কী ঝড়! সঙ্গে সঙ্গে মেঘের তর্জন-গর্জন। স্টেশনে ফিরে যাবার উপায় নেই। ঐ ঝড়ের মধ্যেই রিকশার পর্দা দুহাতে চেপে ধরে আমরা এগোতে লাগলাম। কিছুক্ষণ ধরে একটা কীরকম পচা ভ্যাপসা গন্ধ পাচ্ছিলাম। এখন বুঝলাম গন্ধটা আসছে সুব্বার গা থেকে। আমার ভেতরটা কীরকম ঘুলিয়ে উঠছিল। কিন্তু উপায় কি? গরিবের ঘরের ছেলে। নোংরা। ভালো করে সাবান মেখে স্নান করতে পায় না। গন্ধ তো হবেই। তাছাড়া ওর গায়ের জ্যাকেটটাও জঘন্য।

যাই হোক রিকশাটা যখন ঝড়ের মধ্যেই বাড়ির কাছে এসেছে তখন হঠাৎ আকাশের বুক চিড়ে বিদ্যুৎ ঝলকে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে কানের পর্দা ফাটিয়ে প্রচণ্ড শব্দে কাছেই কোথাও বাজ পড়ল। জীবনে কখনও বাজ পড়া দেখিনি। এই প্রথম দেখলাম। আর আমার প্রথম দেখা বজ্রটি একটা আগুনের গোলা হয়ে প্রথমে আমাদেরই বাড়ির নারকেল গাছটার ওপর পড়ল। তারপর বাড়ির আলসে ভেঙে বেরিয়ে গেল।

চারিদিকে ভয়ার্ত চিৎকারের মধ্যে দিয়ে আমাদের রিকশাটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। আমি বিহ্বল–সন্ত্রস্ত। শেষ পর্যন্ত আমাদের বাড়িতেই বজ্রপাত!

কিন্তু আশ্চর্য, সুব্বার কোনো বিকার নেই। সে তার ড্যাবড্যাবে সাদা চোখ নিয়ে শুধু আমার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন প্রতিটা মুহূর্ত ও আমাকে ওর লক্ষের মধ্যে রাখতে চাইছে।

এইভাবেই বিশ্রী একটা দুর্ঘটনার মধ্যে দিয়ে রাজু সুব্বা আমাদের বাড়ি ঢুকল। ঢুকল না বলে বরঞ্চ বলি আমাদের বাড়িতে নিজের অধিকার পাকা করে নিল।

.

এখানে এসে প্রথম কদিন আমার চেনাজানা প্রতিবেশীদের সঙ্গে দেখা করলাম।

হেরম্ব ভট্টাচার্যের কথা মনে ছিল না। বৃদ্ধ মানুষ। সারা জীবন ঠিকুজি, কুষ্ঠী, কররেখা গণনা করেই কাটালেন। ভালো জ্যোতিষী বলে ওঁর খুব নামডাক ছিল। আমি এ-সবে বিশ্বাসী কোনোদিনই ছিলাম না। তাই তার কাছে যেতে ইচ্ছে করত না। কিন্তু উনি আমাকে ছোটবেলা থেকেই চিনতেন। বাবার সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব ছিল। আমি কোথায় থাকি, কি করি না করি সব খবরই রাখতেন। বোধহয় ভেতরে ভেতরে আমার ওপর টান ছিল।

সেদিন সকালে বাজার করে ফিরছি, দেখি হেরম্ব জ্যাঠা রাস্তার ধারে বারান্দায় ইজিচেয়ারে শুয়ে পাঁজি দেখছেন। আমায় দেখে সোজা হয়ে বসে বললেন-সুশান্ত না? কবে এলে?

অগত্যা বারান্দায় উঠতে হলো। প্রণাম করলাম। উনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমার কাজকর্মের কথা জিজ্ঞেস করলেন।

পুলিশের অফিসার হয়েছি শুনে তিনি যেন বিশেষ খুশি হলেন না। শুধু বললেন, ওসব চাকরি বড়ো দায়িত্বজনক। বিপদের সামনে এগোতে হয়। না এগোলে দুর্নাম, এগোলে জীবন সংশয়।

হেসে বললাম, তবু তো পুলিশের কাজ কাউকে না কাউকে করতেই হবে। কেউ পুলিশের কাজ না নিলে চোর-ডাকাতদের ধরবে কে?

আমার কথায় হেরম্ব জ্যাঠা একটু অপ্রস্তুতে পড়লেন। সসংকোচে বললেন, আমি ও ভেবে বলিনি। আসলে এইসব কাজে বিপদ আছে। তুমি আমাদের ঘরের ছেলে বলেই তোমায় বললাম। নইলে আমার কি?

আমি নিতান্তই ওঁকে খুশি করবার জন্যে ভান করে হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, দেখুন তো আমার শিগগিরই জীবন সংশয়ের যোগ আছে কিনা।

খুশি হওয়া তো দূরের কথা, উনি যেন একটু বিরক্ত হলেন। বুঝলেন আমি মজা মারছি। তিনি আমার হাতের দিকে তো তাকালেনই না, শুধু চোখের দিকে মিনিট দুয়েক তাকিয়ে থেকে বললেন, ভবিষ্যৎবাণী করাটা ছেলেখেলা নয় সুশান্ত। অন্য কেউ হলে উত্তরই দিতাম না। তুমি বলেই বলছি–জীবন সংশয়ের সম্ভাবনা অতি সন্নিকট।

আমি হেসেই বললাম, কবে?

 উনি গম্ভীরভাবে বললেন, এক মাসের মধ্যে।

আমি আবার হাসলাম। জিজ্ঞেস করলাম, বাঁচবার উপায়?

এই সময়ে বাড়ির ভেতর থেকে তার ডাক পড়ল। স্নানের সময় হয়েছে। তিনি ঘরে যেতে যেতে বললেন–এক মাসের মধ্যে কখনও একা থেকো না। বলেই চলে গেলেন। আমি নিশ্চিন্ত হলাম। এক মাসের মধ্যে একা থাকার সম্ভাবনা নেই।

.

অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা

 যদিও হেরম্ব জ্যাঠার কথাটা উড়িয়ে দিয়েছিলাম তবু প্রথম কদিন মাঝে মাঝেই চিন্তা করতাম–কেন তিনি ঐরকম ভবিষ্যৎবাণী করলেন! তিনি তো অন্তত আমাকে মিছিমিছি ভয় দেখাবেন না। তাহলে?

কারও কারও ভবিষ্যত্বাণী তো মিলেও যায় বলে শুনেছি। তাহলে তাহলে কি সত্যিই এক মাসের মধ্যে এমন কোনো বিপদ আসছে যাতে আমার মৃত্যু হতে পারে?

কিন্তু তা সম্ভব কী করে? বিশেষ এটা তো কলকাতা নয় যে পথেঘাটে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এটা শান্ত নির্ঝঞ্ঝাট গ্রাম। আমার নিজের দেশ। এখানে সবাই আমার চেনাজানা। কলকাতায় হলে না হয় বোঝা যেত চোর-ডাকাতের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে আমার মৃত্যু হতে পারে। কিন্তু এখানে? এখানে আমি ছুটিতে। কোথাও ডাকাতি হলেও নিশ্চয় আমায় ছুটতে হবে না। তাহলে এখানে বাকি এই কটা দিনের মধ্যে আমার মৃত্যুর সম্ভাবনা কোথায়? যাই হোক দিন দুয়েকের মধ্যেই আমার মন থেকে হেরম্ব জ্যাঠার কথাটা দূর হয়ে গেল।

কয়েক দিন কেটে গিয়েছে। সুব্বা এ কয়দিনেই আমাদের বাড়ির একজন হয়ে উঠেছে। যদিও ও এখন নিয়মিত তেল মেখে সাবান দিয়ে স্নান করে, নোটনের পুরনো জামাগুলো পরে, তবু যখনই ও আমার ঘরে ঢোকে তখনই হঠাৎ মুহূর্তের জন্যে সেই বিশ্রী গন্ধটা পাই। একদিন স্ত্রীকে গন্ধর কথা বললাম। স্ত্রী অবাক হয়ে বলল কই না তো!

আমার স্ত্রী বা বাড়ির অন্য কেউ যখন গন্ধ পায় না তখন বুঝলাম ওটা আমারই ভুল। প্রথম দিনের সেই বিশ্রী গন্ধটা এখনও আমার নাকে লেগে আছে।

নারকেল গাছটা ছিল বহুকালের। কোন ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি। এত দিন পর তার মৃত্যু হলো বজ্রাঘাতে আমারই চোখের সামনে। দেখতে পাই পাতাগুলো কিরকম জ্বলে গেছে। একটা একটা করে বালদাসুদু পাতা সশব্দে খসে পড়ছে। মনটা খারাপ হয়ে যায়।

কিন্তু এসব সামান্য ব্যাপার নিয়ে মন খারাপ করলে চলবে না। যে জীবনকাহিনিটা লিখতে আরম্ভ করেছি, তাড়াতাড়ি সেটা শেষ করতে হবে। ছুটি ফুরোতে আর বেশি দিন নেই। আর এও জানি কলকাতায় গিয়ে কাজের মধ্যে পড়লে লেখা আর শেষ হবে না।

কিন্তু তাড়াতাড়ি শেষ করব বললেই তো আর শেষ করা যায় না। এই যে সেদিন সন্ধেবেলায় ঘটনাটা ঘটল, যত সামান্যই হোক, তবু তো ভুলতে পারছি না। কেন সুব্বা চুপি চুপি আমার ঘরে ঢুকেছিল, কেনই বা আলো নিভিয়ে দিয়ে আমায় ভয় দেখাতে চেয়েছিল, ঘরের মধ্যে কী এমন দেখে নোটন চিৎকার করে উঠেছিল? যতই সন্তোষজনক উত্তর পাই না, ততই কৌতূহল বাড়ে, ততই কেন যেন সুব্বাকে লক্ষ করি। ওকে বোঝবার চেষ্টা করি। ছেলেটা ঠিক আর-পাঁচটা ছেলের মতো নয়। ওর অদ্ভুত কাজকর্মের কিছু নমুনা নেপালের হোটেলে দেখেছিলাম। অবাক হয়েছিলাম বটে তবু কেমন অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল। এখানে এসেও একদিন ঐরকম একটা ঘটনা ঘটিয়ে বসল।

দুপুরবেলায় নোটন ছাদে ঘুড়ি ওড়ায়। নেপালে ঘুড়ি ওড়ে কিনা জানি না তবে সুব্বা কখনো ঘুড়ি দেখেনি। তার খুব উৎসাহ। নোটনের সঙ্গে সেও ছাদে দাপাদাপি করে বেড়ায়।

সেদিন দুপুরে খেয়েদেয়ে নিজের ঘরে বসে লিখছিলাম। হঠাৎ বাড়ির পিছনে মড়মড় শব্দ করে কী যেন ভেঙে পড়ল। চমকে উঠলাম। কী ভাঙল! কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি তো? ছুটে গেলাম ছাদে। ততক্ষণে আমার স্ত্রী, আমার ছোটো ভাই আর ভাইয়ের স্ত্রীও ছাদে ছুটে এসেছে। যে অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম তাতে সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল। আমাদের বাড়ি থেকে বিশ ত্রিশ হাত দূরে একটা আমগাছ। দেখি তারই একটা ডাল ধরে সুব্বা ঝুলছে। ঝুলছে নয়, দোল খাচ্ছে। আর নোটন লাটাই হাতে করে স্তম্ভিত হয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে।

কী ব্যাপার? ব্যাপারটা এই–নোটনের ঘুড়িটা আমগাছে আটকে গিয়েছিল। কিছুতেই ছাড়াতে পারছিল না। তখন নাকি সুব্বা পাঁচিলে উঠে এক লাফ দিয়ে আমগাছে গিয়ে পড়ল। ঘুড়িটা খুলে নিচে ফেলে দিল। আর তার পরেই গোটা ডালটা মড়মড় করে ভেঙে পড়ে। রাজু ততক্ষণে আর একটা ডাল ধরে ঝুলতে থাকে।

আমাদের দেখে একটু যেন হেসে সার্কাসের খেলোয়াড়ের মতো ডাল থেকে দোল খেতে খেতে এক আঁকানি দিয়ে ছাদে এসে পড়ল।

ওর এই তাজ্জব কাণ্ডকারখানা দেখে আমার রাগ হয়ে গেল। চিৎকার করে বললাম, হতভাগা, তুই নিজে মরবি, আমাকেও জেলে পাঠাবি? বলে ঠাস্ করে গালে একটা চড় বসিয়ে দিলাম। কিন্তুগাল কোথায়? মনে হলো যেন এক টুকরো শক্ত কাঠে চড় বসালাম।

রাজু এক ফোঁটা চোখের জল ফেলল না। শুধু তার সেই অদ্ভুত চোখের মণিটা ওপর দিকে ঠেলে আমার দিকে তাকাল।

বাড়ির সবাই ওর এই দস্যিপনায় বিরক্ত হয়েছিল। কিছু না বলে তারা নেমে গেল। আমি ফের ধমক দিয়ে বললাম, এরকম করলে তোমায় আমি দূর করে দেব মনে রেখো।

রাজু সুব্বা কোনো জবাব দেয়নি।

ঘটনাটার কথা কদিন পর আর কারও মনে রইল না। সুব্বা দিব্যি বাড়ির কাজ করতে লাগল। নোটনের সঙ্গে খেলাধুলোও চলতে লাগল। কিন্তু আমার মন থেকে কিছুতেই একটা সংশয় ঘুচল না–ঐ রোগা হালকা ছেলেটার ভারে আমগাছের শক্ত ডাল ভেঙে পড়ে কী করে? নিজেকেই বোঝাই হয়তো ডালটা পা ছিল, ভেঙে পড়তই। রাজু উপলক্ষ মাত্র।

একটা জিনিস ইদানিং লক্ষ করছি–যে রাজুকে আমি নিয়ে এসেছিলাম সুদূর নেপাল থেকে–যার আদর-যত্নের অভাব এতটুকু রাখিনি, সেই রাজু সুব্বার ওপর আমার কেমন বিতৃষ্ণা জাগছে। কেন জানি না ওকে আর সহ্য করতে পারি না। মনে হচ্ছে ওকে না আনলেই হতো। ও চলে গেলেই বাঁচি। আর আমার ওপরও রাজুর রাগ যে ক্রমশই বাড়ছে তাও বুঝতে বাকি থাকে না। সেই বিরাগ এখন চাপা আগুনের মতো ওর চোখে-মুখে ফুটে উঠছে। আমাকে একলা পেলে ও ওর ড্যাবডেবে চোখের সাদা অংশটা এমন বিশ্রী বড়ো করে তাকায় যে আমার কেমন ভয় করে। সন্দেহ হয়–ও কি সত্যিই মানুষের বাচ্চা?

আমার জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে যে অলৌকিক উপন্যাসখানা লিখছি, তার মধ্যে রাজু সুব্বার কথা লিখব কিনা ভাবছি। ভাবছি এই জন্যে যে, হয়তো সুব্বার ব্যাপার-স্যাপারগুলো কোনো অলৌকিক কাণ্ড নয়। হতে পারে অস্বাভাবিক। তাও অসম্ভব কিছু না। কেননা সুব্বা এদেশের ছেলে নয়। কোথায় হিমালয়ের কোলে পাহাড়-পর্বত-জঙ্গলঘেষা নেপালে ওর জন্ম। ওখানেই তার ছেলেবেলা কেটেছে। ওখানেই ও বড়ো হয়ে উঠছে। হয়তো ওর মা নেই, বাবা নেই, আত্মীয়-স্বজন নেই। নিতান্ত পেটের দায়ে আমার সঙ্গে এসেছে। কাজেই ও যদি লাফ দিয়ে গাছের ডাল ধরে ঝোলে কিংবা অস্বাভাবিক তাড়াতাড়ি কাজ করে তাহলে অবাক হবার কিছু নেই। নোটনের মতো বাঙালি ঘরের আদুরে ছেলের সঙ্গে ওকে মেলাতে গেলে ভুল হবে। এও মনে রাখতে হবে ছেলেটা চোর নয়, টাকা-পয়সার দিকে বা খাওয়ার দিকে লোভ নেই। সবচেয়ে বড় কথা নোটনের সঙ্গে খুব ভাব। কাজেই ছেলেটার মধ্যে কিছু অস্বাভাবিকতা থাকলেও ভয় পাবার মতো অলৌকিক কোনো ব্যাপার নেই। তবু আমার ডায়েরিতে ওর প্রতিদিনের আচার-আচরণ লিখে রাখছি।

এই যেমন সেদিন সন্ধেবেলা–আমার মেজো ভাই, ছোটো ভাই এক নেমন্তন্ন বাড়িতে গেছে। আমার স্ত্রী আর দুই ভাইয়ের বৌ নিচে রান্নাঘরে। নোটন বাইরের ঘরে পড়ছে। আমি আমার ঘরে বসে লিখছি।

পল্লীগ্রাম। এর মধ্যেই যেন নিশুতি হয়ে গেছে। রাস্তায় লোকচলাচল বিশেষ নেই। বাড়ির পিছনে দীর্ঘ আমগাছের বাগানটা অন্ধকারে গা মিশিয়ে যেন কোনো কিছুর জন্যে অপেক্ষা করছে।

আমি একমনে লিখছি। হঠাৎ পিছনের দরজার কাছ থেকে ছোটো বৌমার উত্তেজিত গলা শোনা গেল–সুব্বা, কী করছ? চমকে পিছন ফিরে দেখি আমার ঠিক পিছনে রাজু দাঁড়িয়ে আছে দু হাত বাড়িয়ে। ওর চোখের কটা রঙের মণি দুটো যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। মুখের ওপর একটা হিংস্র ভাব যা কখনো দেখিনি।

–কী চাই? ধমকে উঠলাম।

সুব্বা শান্ত গলায় শুধু বলল, ম্যাচিস। ম্যাচিস অর্থাৎ দেশলাইটা চায়।

–দেশলাই নিয়ে কী করবে?

উত্তরে ও জানাল ওর ঘরে নাকি আলো নিভে গেছে। মোম জ্বালবে।

ততক্ষণে ছোটো বৌমা ঘরের ভেতর এসে দাঁড়িয়েছে। সুব্বাকে তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, কখন আলো নিভল? এই তো দেখলাম আলো জ্বলছে।

আমি কিরকম ভয় পেলাম। একটা ফয়শালা করতেই হয়। চেয়ার থেকে উঠে বললাম, চল্ তো দেখি কেমন আলো নিভেছে?

ও দোতলার সিঁড়ির ঘরে থাকে। গিয়ে দেখি সত্যিই ঘরটা ঘুটঘুঁটে অন্ধকার।

ছোটো বৌমা বললে, অবাক কাণ্ড! সুব্বা এ ঘরে যখন ঢুকে আসে, আমি তার পরে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসেছি। দেখেছি ওর ঘরে আলো জ্বলছে।

বললাম, তার পরেই হয়তো আলো নিভে গেছে।

ছোটো বৌমা কঠিন সুরে বললেনা। সুব্বা বলছে আলো নিভে গেছে বলেই নাকি দেশলাই চাইতে এসেছিল। মিথ্যে কথা। আবার বলছি ও যখন এঘরে এসে আপনার পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল, আমি দেখেছি তখনও আলো জ্বলছিল।

আমি আর কিছু বললাম না। রাজুর হাতে দেশলাই দিয়ে ওকে চলে যেতে বললাম।

পরের দিন ছোটো বৌমা আমার ঘরে এসে চুপি চুপি বলল, দাদা, রাজুর ব্যাপার স্যাপার আমার ভালো ঠেকছে না। ও দেশলাই নিতে আসেনি। আমি স্পষ্ট দেখেছি ও আপনার গলা টিপে মেরে ফেলতে এসেছিল।

হেসে বললাম, না না, তাই কখনো ও পারে? কেনই বা আমাকে মারবে? তা ছাড়া ঐ তো দুখানা হাড়-বের করা চেহারা

ছোটো বৌমা বলল, ঐ দুখানা হাড়েই ও কিন্তু ভেল্কি দেখায় ভুলবেন না। যাই হোক আমার বিবেচনায় যত শিগগির পারেন ওকে বিদেয় করুন।

বলে চলে যাচ্ছিল, ফিরে দাঁড়িয়ে বলল, এ কথা আর কাউকে না বলাই ভালো। ভয় পাবে। শুধু আপনি একটু সাবধানে থাকবেন। বলেই চলে গেল।

এই একটা নতুন ভাবনা শুরু হলো। সুব্বা কি সত্যিই আমায় মেরে ফেলতে চায়? কিন্তু কেন? ওকে সেদিন মেরেছিলাম বলে? ওর এত বড়ো সাহস হবে বাড়িতে এত জনের মধ্যে আমায় মারার? তা হতে পারে না। ও হয়তো সেদিনের মতো ভয় দেখাতেই এসেছিল। ছোটো বৌমা দেখে ফেলায় ধরা পড়ে গেছে।

এর ঠিক তিন দিন পরে ছোটো ভাইয়ের কাছে চিঠি এল, সামনের সপ্তাহে ছোটো বৌমার বোনের বিয়ের দিন হঠাৎ ঠিক হয়েছে। দিন দশেকের জন্যে ওরা যেন চলে আসে।

ছোটো বৌমা মহা আনন্দে ছোটো ভাইয়ের সঙ্গে বাপের বাড়ি চলে গেল। যাবার সময়ে আমায় গম্ভীর মুখে বলে গেল রাজুকে তো সরাবেন না। ওর কাছ থেকে সাবধানে থাকবেন।

আমিও চাই রাজুকে সরিয়ে দিতে। কিন্তু সরাবার তো স্পষ্ট কারণ থাকা চাই। তা ছাড়া ও যাবে কোথায়? নেপালের সেই কাঠমাণ্ডুতে? ওখানে কি ও একা যেতে পারে? তা হলে ওকে একা কোথায় তাড়িয়ে দেব?

ছোটো বৌমা আমায় সাবধানে থাকতে বলল। কিন্তু নিজের বাড়িতে সবার মাঝখানে কী এমন সাবধান হতে পারি?

.

আরও কাণ্ড

সেদিন আবার একটা কাণ্ড হলো।

দুপুরবেলা। আমি আমার ঘরে একা বিছানায় বসে লিখছি। মাথার ওপর পাখা ঘুরছে। হঠাৎ মনে হলো ফ্যানের হাওয়াটা কিরকম এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। একভাবে গায়ে লাগছে না। তাকিয়ে দেখি পাখাটা এদিক থেকে ওদিকে দুলছে।

অবাক হলাম। এ আবার কি! ফ্যানটা এমন দুলছে কেন? ভাবলাম নিশ্চয় ভূমিকম্প হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে ভূমিকম্পের কথা জানাতে গেলাম। আর ঠিক তখনই পাখাটা ভীষণ শব্দ করে আমার বিছানার ওপর খুলে পড়ল সেই শব্দে সবাই ছুটে এল আমার ঘরে। সবাই বলল, খুব ভাগ্যের জোরে বেঁচে গেছি। কিন্তু আর কারো ঘরে পাখা এতটুকু দোলেনি। সবাই খুব আশ্চর্য হয়ে গেল।

আমি লক্ষ করলাম সবাই ছুটে এসেছে। আসেনি শুধু রাজু।

কী মনে হলো জিজ্ঞেস করলাম, সুব্বা কোথায়?

কেউ বলতে পারল না। আমি তখনই ছাদে উঠে গেলাম। দেখি হতভাগা সরু পাঁচিলের ওপর হাঁটতে হাঁটতে পেয়ারা খাচ্ছে। পেয়ারা তো সব ছেলেই খায়। কিন্তু ও গোটা পেয়ারাটা মুখে পুরে ছাগলের মতো চিবোচ্ছে। আর সারা মুখে পেয়ারার বিচিগুলো বিচ্ছিরিভাবে লেগে রয়েছে।

–এখানে কি করছ? মেজাজ গরম করেই ওকে জিজ্ঞেস করলাম।

ও কোনো উত্তর না দিয়ে পাঁচিল থেকে নেমে বাঁদরের মতো ছাদের ওপর লাফাতে লাফাতে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল।

ইলেকট্রিক মিস্ত্রি ডাকা হলো। সে তো দেখে অবাক। বলল, যে আঁকশিতে পাখাটা ঝুলছিল সেটা ঠিকই আছে। পাখাও খারাপ হয়নি। তা হলে পড়ল কি করে?

পড়ল কী করে সে কথা আলাদা। আমার কিন্তু মনে হলো আমাকে মারবার জন্যেই যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি একাজ করেছিল। আমার কোনো শুভ শক্তি আমাকে এ যাত্রাতেও বাঁচিয়ে দিল।

.

ছোটো ভাইরা ছেলেমেয়ে নিয়ে চলে গেলে বাড়িটা অনেকখানি ফাঁকা হয়ে গেল। ওদের জন্যে হঠাৎ মন কেমন করতে লাগল। মনে হলো ওরা না গেলেই ভালো হতো। আর তো মাত্র সপ্তাহ দুয়েক আছি। সবাই একসঙ্গে থাকলে ভালোই লাগত। বিশেষ করে ছোটো ভাইয়ের স্ত্রী ঐ যে আমায় চুপি চুপি সাবধানে থাকার কথা বলে গিয়েছিল, সে কথা মনে করে আমার অস্বস্তি হতে লাগল। যাক, কদিন পরেই তো ওরা আসছে। তা ছাড়া বাড়িতে আমার স্ত্রী, নোটন ছাড়াও মেজো ভাই, মেজো ভাইয়ের স্ত্রী রয়েছে। কাজেই আমার কোনো অসুবিধা নেই।

সুব্বা বড়ো একটা এদিকে আসে না। আমার ঘরের সামনের বারান্দা দিয়ে যখন যায় তখন একবার ঘাড় ঘুরিয়ে এমনভাবে আমাকে দেখে যেন আমি ওর দুচক্ষের বিষ। আমার মনেও একটা পৈশাচিক ভাবের উদয় হয়। ইচ্ছে করে ওর সরু গলাটা টিপে ধরি।

মাত্র দুদিন পরেই মেজো বৌমার বাপের বাড়ি থেকে জরুরি খবর এল–ওর বাপের বাড়ির জমিজমা ভাগ হচ্ছে। সেইজন্যে কয়েক দিনের জন্যে মেজো বৌমাকে যেতে হবে। পরের দিনই মেজো ভাই, মেজো বৌমা ছেলেমেয়ে নিয়ে চলে গেল। যাবার সময়ে মেজো বৌমা হেসে বলে গেল, দিদি তো রইলেন। আপনার অসুবিধে হবে না এক সপ্তাহের মধ্যেই চলে আসব।

যাক মেজো ভাইরাও চলে গেল। এত বড়ো বাড়িটা এখন যেন আমায় গিলতে আসছে। এখন শুধু আমার স্ত্রী আর নোটন। রাজু তো দিব্যি বহাল তবিয়তে আছেই।

ওরা না থাকায় আমার স্ত্রীর কোনো অসুবিধে হচ্ছে বলে মনে হলো না। এত বড়ো বাড়িটা খালি হয়ে গেল, তার জন্যে তার কোনো কষ্টও নেই। জোড়া বটতলায় শিগগিরই মেলা বসবে, অনেক সাধু-সন্ন্যাসী আসবে। তাদের দেখতে যাবে সেই আনন্দেই মশগুল।

আর নোটন? সে তো রাজুর সঙ্গে দিব্যি ঘুড়ি ওড়াচ্ছে।

কিন্তু আমি? আমার যে শুধু খারাপই লাগছে তা নয়–সত্যি কথা বলব, পুলিশের লোক হয়েও আমার কেমন ভয় করছে। কিসের ভয় তা ঠিক বুঝতে পারি না। ঐ একফোঁটা ছেলে রাজু সুব্বাকে? পাগল হয়ে গেলাম নাকি? ওকে ভয় পেতে যাব কেন? ওর সাধ্য কী আমার ধারেকাছে ঘেঁষে!

.

রহস্যময় রাজু

 আমাদের এই গ্রামে বারো মাসে তেরো পার্বণ লেগেই আছে। বিশেষ করে এই সময়ে জোড়া বটতলায় বিরাট মোচ্ছব হয়। মোচ্ছব চলতি কথা। আসল কথা হচ্ছে মহোৎসব (মহা উৎসব)। বহুকাল থেকে এই জোড়া বটতলায় এক পক্ষ কাল ধরে মেলা বসে। জোড়াবটের নিচে একটি ঠাকুর আছে। ঠাকুরের কোনো বিশেষ মূর্তি নেই। একটা পাথর আগাগোড়া সিঁদুর মাখানো।

এই মেলা উপলক্ষ করে পাশাপাশি গ্রাম-গঞ্জ থেকে বহু লোক আসে। কাছেই বিরাট একটা দীঘি। সেখানে স্নান করে সবাই জোড়া বটতলায় পুজো দেয়। সেদিন সবাই দীঘির পাড়েই রাঁধাবাড়া করে খায়। মেলায় নাগরদোলা, সার্কাস, ম্যাজিক থেকে শুরু করে বাদামভাজা, পাঁপড়ভাজা সবই থাকে। মিষ্টির দোকানের তো ছড়াছড়ি। সবচেয়ে আকর্ষণের ব্যাপার এই মেলায় দূর-দূরান্তর থেকে দুর্গম পথ পেরিয়ে সাধু-সন্ন্যাসীরা আসেন। ভস্মমাখা দেহে, কপনিমাত্র পরে তারা ধুনি জ্বালিয়ে সারা রাত ধ্যান করেন। মাঝে মাঝে নাগা সন্ন্যাসীদেরও দেখা যায়। শোনা যায় তারা হিমালয় থেকে নেমে আসেন।

এইসব ভিড়ভাট্টা মেলা, ঠাকুর পুজো, সাধুদর্শন আমার ভালো লাগে না। আমি পুলিশ অফিসার। আগেই বলেছি আমরা সন্দিগ্ধ স্বভাবের। পুলিশের কাজ করতে করতে মনের কোমল বৃত্তিগুলো, ভাবাবেগ সব নষ্ট হয়ে গেছে। এখন সবকিছুই হাস্যকর বলে মনে হয়। কিন্তু আমার স্ত্রীর আবার উল্টো। তিনি বাচ্চা ছেলেদের মতো মেলা দেখতে ভালোবাসেন। পুজো না দিলে তার তৃপ্তি নেই। সাধু-সন্ন্যাসী পেলেই তাদের পায়ে আছড়ে পড়েন।

এখানে মেলা বসছে শুনে স্ত্রী বললেন, আমি যাব।

বললাম, যাও। দয়া করে সঙ্গে আমায় যেতে বোলো না।

স্ত্রী হেসে বললেন, তোমাকে দরকার নেই। আমি নোটন আর সুব্বাকে নিয়ে যাব।

–সেই ভালো, বলে লেখায় মন দিলাম। একটু পরে গৃহিণী ফিরে এসে বললেন, সুব্বা যেতে চাচ্ছে না।

বললাম, না গেল তো নাই গেল।

 বাঃ! ছেলেটা এখানকার মেলা দেখেনি। দেখবে না?

 বললাম, তার যেতে ইচ্ছে না করলে কি করবে?

স্ত্রী বললেন, তুমি একটু বল না।

 বিরক্ত হয়ে বললাম, ওকে আমি কিছু বলতে পারব না।

অগত্যা গৃহিণী বিমর্ষ মুখে চলে গেলেন।

হঠাৎই আমার মনে হলো–রাজু যেতে চাইল না কেন? বাড়িতে এখন ওর এমন কী রাজকার্য আছে?

বিকেলে গৃহিণী ফিরে এসে ঘটা করে মেলা দেখার কথা বললেন। অনেক সাধু-সন্ন্যাসী দেখেছেন। গুনে গুনে পঞ্চাশ জন সাধুর পায়ের ধুলো নিয়েছেন। খুব ভালো লেগেছে। পরে হঠাৎ গলার স্বর খাটো করে বললেন, সুব্বা তো যাব না বলল। কিন্তু ও গিয়েছিল। আমি ওকে দেখেছি। কিন্তু ও আমাকে দেখেও এড়িয়ে গেল।

এর উত্তর আমি আর কী দেব? চুপ করে রইলাম। শুধু বললাম, ও বড়ো পাকা ছেলে। দিন দিন বেয়াড়া হয়ে উঠছে।

গৃহিণী আর কিছু বললেন না। চলে গেলেন।

মেজো, ছোটো ভাইরা কেউ নেই। বাড়িটা বড্ড খালি-খালি লাগছে। কলকাতায় দুখানা মাত্র ঘরে আমার সঙ্গে শুধু নোটন আর নোটনের মা থাকে। মাত্র তিনজন। সে একরকম সয়ে গিয়েছে। কিন্তু এখানে এত বড়ো বাড়িতে মাত্র আমরা তিনজন আর হতচ্ছাড়া ঐ রাজুটা মোট চারজন। বড় ফাঁকা লাগে। এই সময়ে প্রণবেশ যদি এসে পড়ত তাহলে খুব ভালো হতো। বলেও ছিল–আসবে। কিন্তু এল কই?

সেদিন বিকেলে ছাদে পায়চারি করছিলাম। সূর্য ডুবে গেছে। কিন্তু অন্ধকার হয়নি। হঠাৎ বাড়ির পিছনের জঙ্গল থেকে এক ঝাক পাখির ভয়ার্ত চেঁচামেচি শুনে চমকে উঠলাম। পাখিগুলো অমন করে চেঁচাচ্ছে কেন দেখবার জন্যে ছাদের ঐ দিকে গিয়ে দাঁড়ালাম।

আমাদের বাড়ির পিছন দিয়ে একটা সরু ধুলোভরা রাস্তা এঁকেবেঁকে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সেই দীঘির দিকে গেছে। পাঁচিলের কাছে গিয়ে দেখলাম রাজু ঐ রাস্তা দিয়ে খুব তাড়াতাড়ি যাচ্ছে। আর গাছে গাছে যত পাখি ছিল, সব ওর মাথার ওপর গোল হয়ে ঘুরছে আর কিচমিচ্ করছে। রাজু কিন্তু সেদিকে তাকাচ্ছে না। হনহন্ করে হেঁটে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেল।

আমি অবাক হলাম। এই ভর-সন্ধেবেলা রাজু জঙ্গলের মধ্যে গেল কেন? কেনই বা পাখিগুলো অমন করে আর্তস্বর চিৎকার করছিল? অনেক ভেবেও কোনো জুৎসই উত্তর খুঁজে পেলাম না।

নিচে নেমে এসে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, রাজুকে কোথাও পাঠিয়েছ?

স্ত্রী বললেন, না তো।

বললাম, তাহলে ওকে জঙ্গলে ঢুকতে দেখলাম কেন?

স্ত্রী অবাক হয়ে বললেন, জঙ্গলে! জঙ্গলে কেন যাবে?

–সেটাই তো আমার প্রশ্ন। আর ও যখন ঐদিকে যাচ্ছিল তখন এক ঝাঁক পাখি ওর মাথার ওপর উড়ছিল আর চিৎকার করছিল।

-কী যে বল!

 –ঠিক আছে। ও এলে আমার সঙ্গে দেখা করতে বোলো।

–ও তো বাড়িতেই ছিল। দাঁড়াও দেখছি। বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। পাঁচ মিনিটের মধ্যে রাজুকে নিয়ে ফিরে এলেন, এই তো। এখানেই রয়েছে।

আমি অবাক। দশ মিনিট আগে ছাদ থেকে ওকে আমি স্বচক্ষে জঙ্গলে ঢুকতে দেখেছি। এর মধ্যে কখন ফিরে এল? তবে কি আমি ভুল দেখলাম? এতখানি ভুল হওয়া কি সম্ভব?

তবু জিজ্ঞেস করলাম, তুই কোথায় ছিলি?

ও ভাঙা হিন্দিতে বলল, আমার ঘরে।

–তুই পেছনের রাস্তা দিয়ে জঙ্গলের দিকে যাসনি?

ও খুব সংক্ষেপে রুক্ষ গলায় বলল, নেহি।

আমার বেজায় রাগ হলো। আর সঙ্গে সঙ্গেই রাগ প্রকাশের ছুতোও খুঁজে পেলাম। বললাম, সেদিন তোর মাইজি ওদের সঙ্গে মেলায় যেতে বলল। তুই বললি যাবি না। কিন্তু লুকিয়ে লুকিয়ে একা গিয়েছিলি। অথচ সেকথা বলিসনি। কেন? কেন একা একা মেলায় গিয়েছিলি?

ও আগের মতোই ঘাড় শক্ত করে শুধু বলল, নেহি।

আমার স্ত্রী চেঁচিয়ে উঠে বললেন, তুই তো আচ্ছা মিথ্যেবাদী! আমি নিজে চোখে দেখলাম যেখানে সাধুরা বসেছিল সেখানে ঘুরছিলি। আর বলছিস কিনা–

ও ফের ঘাড় নাড়ল–নেহি।

 স্ত্রী বললেন, তুই ডাহা মিথ্যেবাদী। নোটনকে জিজ্ঞেস কর। সেও দেখেছে।

নেহিনেহি–বলতে বলতে রাজু যেন পালিয়ে গেল।

 সেদিন রাত্রে স্ত্রী প্রথম বললেন, শোনেনা, রাজুকে আমার কেমন যেন লাগছে।

 আমি চুপ করে রইলাম।

 স্ত্রী আবার বললেন, কিছু বলছ না যে?

–কি আর বলব? আমিও টের পাচ্ছি। ওর ঐ রোগা-পটকা শরীর নিয়ে দুমদাম করে কাজ করা, ছাদ থেকে লাফিয়ে গাছের ডাল ধরে ঝোলা, ছাদের সরু পাঁচিলের ওপর দিয়ে হাঁটা, হাঁটতে হাঁটতে মস্ত বড়ো হাঁ করে গোটা পেয়ারা চিবনো, ওর অস্বাভাবিক চোখ, আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকানো, মেলায় যাব না বলে লুকিয়ে লুকিয়ে যাওয়া, সন্ধেবেলায় দীঘির পথে জঙ্গলে ঢোকা, ওকে দেখে ভয় পেয়ে পাখির ঝাঁকের তাড়া করা–অথচ ও নাকি জঙ্গলের পথে যায়নি, ঘরেই ছিল–সবই রহস্যময়।

স্ত্রী শিউরে উঠে বললেন, কী হবে গো! আমার যে কেমন ভয় করছে। ওকে তাড়াও।

–ও নিজে থেকে চলে না গেলে কি তাড়ানো যায়? কোথায় যাবে?

স্ত্রী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, এত বড়ো বাড়িতে এভাবে থাকতে আমার খুব ভয় করছে। কেবলই মনে হচ্ছে খারাপ কিছু ঘটবে। কবে যে ওরা সবাই আসবে–

পরের দিন হঠাৎ আমার স্ত্রীর বাপের বাড়ি থেকে ওর এক ভাই এল। ওর মা খুব অসুস্থ। এখুনি আমার স্ত্রীকে নিয়ে যাবে।

শুনে চমকে উঠলাম। ওর মা অসুস্থ বলে নয়, আমাকে একা থাকতে হবে বলে।

যাবার সময়ে স্ত্রী ব্যাকুল হয়ে বললেন, বাধ্য হয়ে যেতে হচ্ছে। তোমায় একা ফেলে যেতে কিছুতেই মন সরছে না। খুব সাবধানে থেকো। যত তাড়াতাড়ি পারি চলে আসব।

আমি মুখে হাসি টেনে বললাম, কিচ্ছু ভেবো না। আমি একজন পুলিশ অফিসার। কেউ না থাক সঙ্গে রিভলভার আছে।

বললাম বটে কিছু ভেব না। কিন্তু নিজেই কিরকম দুর্বল হয়ে গেছি।

রিভলভার? রিভলভার কি সব ক্ষেত্রে কাজ দেয়?

.

গভীর রাতে পায়ের শব্দ

 নোটনকে নিয়ে আমার স্ত্রী চলে যাবার পরই আমি যেন কিরকম অসহায় হয়ে পড়লাম। আমি কিছুতেই আর এ বাড়িতে টিকতে পারছি না। কেবলই মনে হচ্ছে ভয়ংকর কিছু যেন ঘটতে যাচ্ছে। একটা কথা ভেবে অবাক হলাম–কী অদ্ভুতভাবে একে একে সবাইকে চলে যেতে হলো। ছোটো ভাই গেল, মেজো ভাই গেল, শেষ পর্যন্ত আমার স্ত্রী-পুত্রও গেল। ব্যাপারটা কি? মনে হলো কোনো অশুভ শক্তি পরিষ্কার মতলব করে একে একে সবাইকে সরিয়ে দিচ্ছে। একটি মাত্রই উদ্দেশ্য–আমাকে একা রাখা। আর তখনই আমার জীবনহানির ব্যাপারে হেরম্ব জ্যাঠার সাবধানবাণী মনে পড়ল–এক মাসের মধ্যে জীবন সংশয় হতে পারে। এই সময়টায় যেন কখনো একা না থাকি।

কথাটায় তখন গুরুত্ব দিইনি। এখন গুরুত্ব দিতে হচ্ছে। ভয় পাচ্ছি।

আবার এটাও পরিষ্কার নয়–কিসের জন্যে ভয়? এখানে আপাতত একা থাকলেও পাড়া প্রতিবেশী আছে। দুবেলা তারা আমার খোঁজ-খবর নেয়। আমিও যাই তাদের বাড়ি। কোথাও কোনো অস্বাভাবিকতা নেই। বিপদের আভাস পর্যন্ত নেই, যত ভয় শুধু আমার বাড়ির ভিতরেই। এইটুকু নিশ্চিতভাবে বুঝেছি ঐ নেপালী ছোঁড়াটাই আমার কাছে অস্বস্তির কারণ। ওর হাবভাব, চাল-চলন কেমন যেন অদ্ভুত। তার চোখ দুটো ঠিক মানুষের চোখ নয়। তার চোখের দৃষ্টিতে মরা জন্তুর চাউনি। অথচ সে বাড়ির কাজকর্ম করে, আমার ছেলের সঙ্গে খেলা করে, ঘুড়ি ওড়ায়।

তাহলে? তাকে ভয় কিসের জন্যে?

এ প্রশ্নের মীমাংসা করতে পারি না। কিন্তু বেশ বুঝতে পারছি শ্রীযুক্ত বাবু সুশান্তকুমার সরকার, কলকাতার পুলিশ অফিসার–এই আমি কিন্তু এই খালি বাড়িতে টিকতে পারছি না। প্রতি মুহূর্তে এখন অকাল অপমৃত্যুর ভয় পাচ্ছি। স্পষ্ট দেখছি–দুয়ারে মৃত্যুর দূত দাঁড়িয়ে।

প্রণবেশটাও যদি এই সময়ে এসে পড়ত!

ওরা চলে গেছে বেলা বারোটার সময়ে। যাবার আগে আমার স্ত্রী দুবেলার মতো বেঁধে দিয়ে গেছে। কাজেই আজকের দিনটা চলে যাবে। কাল থেকে আমাকেই যা হোক কিছু রাঁধতে হবে।

ওরা চলে যাবার পর আমি সারা দুপুর ঘরে বসে রইলাম। আর লক্ষ্য রাখলাম সুব্বার দিকে। বাঁচোয়া সে একবারও আমার সামনে আসেনি। যদিও জানি সে বাড়িতেই আছে।

কেমন করে জানলাম ও বাড়িতে আছে? ঠিক বলতে পারি না। তবে ইদানিং টের পাই ও বাড়িতে থাকলে বাড়ির মধ্যে বাতাসটা কিরকম ভারী হয়ে থাকে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। ও বাড়িতে থাকলে পরিষ্কার বুঝতে পারি এ বাড়ির প্রত্যেকটা ইট, কড়ি, বরগা, এমনকি কুয়োর জল পর্যন্ত থিরথির করে কাঁপে। আজ এখনও কাঁপছে। তাই বুঝতে পারছি ও বাড়িতেই আছে। কিন্তু কোথায় আছে, কী করছে জানি না।

হঠাৎ আমার দম বন্ধ হয়ে এল। মাথাটা কিরকম ঝিমঝিম করতে লাগল। আমি সচকিত হলাম–পায়ের শব্দ পাচ্ছি…সে শব্দ কখনোই তেরো বছরের ছেলের পায়ের শব্দ নয়– যেন একটা ভারী বোঝা টেনে নিয়ে যাবার শব্দ।…বুঝলাম রাজু সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে। ও এল। বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে ও একবার দাঁড়াল। আমার ঘরের দিকে তাকাল। আমার সঙ্গে চোখাচোখি হলো। আমার বুকের মধ্যে রক্ত চলকে উঠল।

ও কি আমায় দেখে হাসল? ও কি হাসতে জানে? ওকে তো কখনো হাসতে দেখিনি। ওটা কি হাসি? দাঁতের মতো কতকগুলো কী যেন ওর ঝুলে-পড়া ঠোঁটের ওপর ঝিকঝিক্‌ করে উঠল। আমি ছুটে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম।

তারপরেই শুনলাম ধুপধাপ শব্দ করে ও ছাদে চলে গেল। ছাদটা ওর বড় প্রিয় জায়গা।

বিকেলে জোর করে একটু বেরোলাম। কতক্ষণ আর ঘরে একা চুপটি করে বসে থাকা যায়?

কোথায় যাব? কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক ঘুরে কী খেয়াল হলো বাড়ির পিছনের বাগানের দিকে যে সরু রাস্তাটা গেছে, সেই রাস্তায় হাঁটতে আরম্ভ করলাম।

কাজটা ভালো করিনি। কেননা তখন সন্ধের মুখ। অন্য কিছুর ভয় না পেলেও সাপের ভয় তো আছে। টর্চটাও আনিনি।

কিন্তু কেন এই অসময়ে এই পথে এলাম? বোধহয় মনের মধ্যে কালকের বিকেলের ঘটানাটা কৌতূহলী করে তুলেছিল। ঐ যে রাজু সুব্বা ঐ পথে যাচ্ছিল আর পাখির ঝাঁক ভয়ে চিৎকার করে ওকে তাড়া করছিল! বোধহয় ভেবেছিলাম ঐ পথে কী আছে তা দেখতে হবে।

বেশ কিছুদূর এগিয়ে গেছি, হঠাৎ দেখলাম একটা লোক–হ্যাঁ, লোকই–আমার সামনে সামনে হেঁটে চলেছে। থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। এই সন্ধেবেলায় কে ওদিকে যাচ্ছে? একটু ঠাওর করতেই স্পষ্ট বুঝতে পারলাম ও রাজুই। ঐ যে ওর নারকেলের মতো মাথা, রোঁওয়া রোঁওয়া চুল।

কিন্তু রাজু হঠাৎ এত বড়ো হয়ে গেল কি করে? আমি কি তবে ভুল দেখছি? চোখ বগড়ে স্পষ্ট করে তাকালাম। হ্যাঁ, রাজুই।

আমি ওকে ডাকতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু না ডেকে ওর কাছে যাবার জন্যে জোরে হাঁটতে লাগলাম। অবাক কাণ্ড–যতই জোরে এগোচ্ছি ততই ও দ্রুত সরে সরে যাচ্ছে।

একটা কুকুর আসছিল সামনে দিয়ে। বললে কেউ বিশ্বাস করবে না, কুকুরটা রাজুকে দেখেই কেঁউ কেউ শব্দে ভয়ার্ত চিৎকার করে ছুটে পালিয়ে গেল।

কুকুরটা অকারণে ভয় পেল কেন? রাজু তো ওর দিকে ফিরেও তাকায়নি। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এলাম।

সন্ধে সাতটা বাজতে না বাজতেই রাজুর ঘরে ওর খাবার ঢাকা দিয়ে রেখে নিজের ঘরে ঢুকে খিল বন্ধ করে দিলাম।

রাজু তখন বাড়ি ছিল না। ও আজকাল কখন কোথায় যায় কিছুই জানায় না। ও আমাকে কেয়ারই করে না।

অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম আসেনি। রাত নটা নাগাদ বাইরের দরজায় খিল দেবার শব্দ পেলাম। বুঝলাম শ্রীমান রাজু ফিরলেন। অমনি আমার বুকের মধ্যে কেমন করতে লাগল। এই রহস্যময় ছেলেটার সঙ্গে আমায় একা সারারাত কাটাতে হবে! আগে মনে হতো ও আমার কোনো ক্ষতিই করতে পারবে না। এখন মনে হচ্ছে ও সবই করতে পারে। ওর ঐ হাড়-বেরকরা শরীরে অমিত শক্তি। যদি চোখের ভুল না হয়ে থাকে তা হলে আজই সন্ধেবেলায় আমবাগানের দিকে যেতে গিয়ে দেখেছি ওর অস্বাভাবিক লম্বা দেহটা। অস্বাভাবিক মানে–ওর বয়সী ছেলে অত লম্বা হতে পারে না। আর ও মোটেই লম্বা নয়। অথচ সে যে রাজুই তাতে সন্দেহ মাত্র ছিল না। এখন বুঝতে পারছি রাজু বলে যে ছেলেটাকে বিশ্বাস করে বাড়িতে এনেছিলাম সে অন্য ছেলেদের মতো নিতান্তই রক্তেমাংসে গড়া বালকমাত্র নয়। ওর ভেতর একটা পিশাচ লুকিয়ে আছে। এখন আমার স্থির বিশ্বাস হয়েছে–প্রথম দিন সন্ধেবেলা আমি যখন লিখছিলাম, রাজুই তখন নিঃশব্দে পিছন থেকে এসে আলো নিভিয়ে দিয়েছিল আমায় গলা টিপে মারবার জন্যে। এমনিতে সে স্বাভাবিক। কিন্তু যখন হিংস্র হয়ে ওঠে তখন ওর চোখের দৃষ্টি বদলে যায়। চোখে আগুন জ্বলে ওঠে। সেদিন নোটন যে জ্বলন্ত চোখ দেখে ভয়ে চিৎকার করে উঠেছিল সম্ভবত সে চোখ রাজুরই।

এরপরই ছোটো বৌমা রাজুকে দেখেছিল ঘরের মধ্যে দুহাত বাড়িয়ে ঢুকতে। রাজু যে আমাকে মারতেই ঢুকেছিল ছোটো বৌমা সে সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ।

কিন্তু কেন? কেন আমায় মারতে চায়? ও যদি সত্যিই কোনো অশুভ আত্মার দেহ হয় তাহলে ও কেন নিজে থেকেই এল আমার সঙ্গে সুদূর নেপাল থেকে এই গ্রামে? আমাকে মেরে ফেলার জন্যে? আবার সেই একই প্রশ্ন থেকে যায় কেন? কার কাছে আমি কী অপরাধ করেছি?

ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল। মনে হলো কেউ যেন দরজা ঠেলছে। আমি কান খাড়া করে রইলাম। তারপর পরিষ্কার শুনলাম কেউ যেন ভারী ভারী পায়ের শব্দ করে আমার ঘরের সামনে চলাফেরা করছে। ভয়ে আমার গায়ে কাটা দিয়ে উঠল। তবুও মড়ার মতো পড়ে রইলাম। একটু পরে শুনলাম পায়ের শব্দটা নিচে নেমে যাচ্ছে।

তারও কিছুক্ষণ পরে শুনলাম নিচের খিড়কির দরজাটা কেউ খুলল।

দরজা কে খুলতে পরে রাজু ছাড়া? এত রাত্রে ও কোথায় বেরুচ্ছে?

এবার আমি এক লাফে উঠে পড়লাম। সাহস সঞ্চয় করলাম। মনকে বোঝালাম– এটা বিজ্ঞানের যুগ–আর আমি একজন নামকরা পুলিশ অফিসার। আমি ভয় করব অলৌকিক ব্যাপারকে? রাজু আর যাই হোক তবু তো সে রক্তেমাংসে গড়া একটা বালক মাত্র! সে খায়, ঘুমোয়, আমার ছেলের সঙ্গে খেলা করে। তা হলে তাকে এত ভয় কিসের?

রিভলভারটা বালিশের তলা থেকে তুলে নিয়ে আমি দরজা খুলে বেরোলাম। লাইট জ্বালোম না।

সিঁড়ির ঘরের সামনে এসে দেখি রাজুর ঘরের দরজা ঠেসাননা। আস্তে আস্তে ঠেলোম। কাচ করে একটা শব্দ হলো। সেই সামান্য শব্দেই বুকটা কেঁপে উঠল। দরজা খুলে গেল। টর্চের আলো ফেললাম। কেউ নেই।

নিচে নেমে এসে দেখলাম খিড়কির দরজা হাট করে খোলা। কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। ভাবলাম কী করি? ঠিক করলাম রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে দেখি। এই তো সোজা রাস্তা–কোথায় কতদূর ও যেতে পারে?

বেরোচ্ছিলাম–তখনই মনে হলো ও যদি বাগানের রাস্তায় গিয়ে থাকে?

না, ও রাস্তায় আমি এত রাত্রে যাব না। ঐভাবে দরজাটা ঠেসিয়ে রেখেই ওপরে উঠে এলাম। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়লাম।

ভেবেছিলাম যতক্ষণ না ও ফেরে ততক্ষণ জেগে থাকব। কিন্তু কখন এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়াল ছিল না।

সকালে উঠে দেখি রাজু অন্য দিনের মতোই ঘরদোর ঝাট দিচ্ছে। ও আমার দিকে ফিরেও তাকাল না। ভাবলাম ওকে জিজ্ঞেস করি কাল রাত্রে ও কোথায় গিয়েছিল? কিন্তু ওর সঙ্গে কথা বলতেও সাহস হলো না। কটা দিন যত দূরে দূরে থাকা যায় ততই মঙ্গল।

কিন্তু নিচে নেমে আসতেই চমকে উঠলাম। উঠোনের ঠিক মাঝখানে ওটা কি?

অবাক কাণ্ড! কে একটা বলিদানের হাঁড়িকাঠ পুঁতে রেখেছে।

এর মানে কি? বাড়িতে হাঁড়িকাঠ কেন? কার এত বড়ো সাহস এটা এখানে পুঁতল?

তখনই হাঁকলাম, রাজু!

রাজু এসে দাঁড়াল। ভাবলেশহীন মুখ। ওর চোখের সাদা অংশটা ড্যাবড্যাব করে নড়ছে।

–তুই ওটা এখানে পুঁতেছিস?

 –নেহি। বলে সে তখনই চলে গেল।

ওর এত দূর স্পর্ধা আমার সামনে আর দাঁড়াল না! অনুমতি না নিয়ে চলে গেল।

আমি তখনই হাঁড়িকাঠটা উপড়ে বাইরে ফেলে দিলাম।

.

রাত্রে বাগানের পথে

নোটন আর নোটনের মা চলে গেছে মাত্র তিন দিন। কবে ফিরবে জানি না। যদি নোটনের দিদিমার খারাপ কিছু হয় তাহলে কবে ফিরবে কে জানে! ছোটো ভাইরা চলে গেছে এক সপ্তাহ হয়ে গেল। বিয়ে কি এখনও মেটেনি? মেজো বৌমাদের বিষয়-সম্পত্তি ভাগ হতে আর কতদিন লাগবে? আমি তো আর এভাবে একা থাকতে পারি না। অথচ আমাদের পাড়াতে প্রতিবেশীরা রয়েছে। তাদের কাছে যাই আসি। ওদের এত কাছে থেকেও আমি কী নিদারুণ আতংকের মধ্যে রয়েছি, ওরা তা ভাবতেও পারে না। ওদের কিছু বলতেও পারি না। কেননা বললে ওরা কেউ বিশ্বাস করবে না।

আমি এখন নিজের ঘরেই স্টোভ জ্বেলে যা হোক কিছু বেঁধে নিই। একা রান্নাঘরে যেতে সাহস হয় না। রাজুর খাবারটা রান্নাঘরে রেখে আসি। আমি যে ভয়ে ভয়ে আছি রাজু তা বুঝতে পারে।

এখন আবার মাঝে মাঝেই আর একটা প্রশ্ন জাগে, হাঁড়িকাঠটা পোঁতার কারণ কী? উত্তর পাই না। তখন আবার মন থেকে ব্যাপারটা ঝেড়ে ফেলি।

বিকেলে একটু বেরোই। বড়ো রাস্তাটা ধরে হাঁটি। সন্ধে হবার আগেই বাড়ি এসে ঢুকি। তখন বাইরে থাকতে ভয় করে। আবার বাড়িতে থাকতেও ভয়। বাড়িতে তো সেই মূর্তিমান আতঙ্কটি রয়েছে। সে বাড়ি থাকলেও ভয়–বাড়ি না থাকলেও ভয়। কোথায় কী মতলবে ঘুরে বেড়াচ্ছে কে জানে!

সেদিন রাত তখন সবে নটা। এরই মধ্যে পাড়া নিঝুম। আমি যৎসামান্য রাতের খাওয়া সেরে একটা বই নিয়ে শুয়ে পড়লাম। রাত দশটা নাগাদ লোডশেডিং হয়ে গেল। ব্যস্ ঘুরঘুট্টে অন্ধকার।

সন্ধের পর থেকেই বাড়ির বাতাসটা ভারী হয়ে আছে। বাতাস ভারী হলেই নিশ্বাসের কষ্ট হয়। একটা চাপা কাশি গলা চেপে ধরে। এখন তাই হচ্ছে। বুঝলাম রাজু বাড়ি আছে। কিন্তু কোথায় আছে জানি না। কেননা সন্ধে পর্যন্ত ও ওর ঘরে ছিল না। বইটা বুকের ওপর রেখে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, হঠাৎ মনে হলো বারান্দার দিকের জানলাটা কেউ ভোলার চেষ্টা করছে। আমি রিভলভারটা হাতের মুঠোয় নিয়ে শক্ত হয়ে শুয়ে রইলাম।

শব্দটা থেমে গেল। তারপরই নিচের দরজাটা খোলার শব্দ। আমি লাফিয়ে উঠে রাস্তার দিকে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখলাম রাজু বেরোচ্ছে পা টিপে টিপে। আরও দেখলাম ও যাচ্ছে পিছনের রাস্তা দিয়ে বাগানের দিকে। তখনই আমি টর্চ আর রিভলভার নিয়ে রাস্তায় নেমে গেলাম।

আমি জানি কতবড়ো মারাত্মক ভুল করে সর্বনাশের পথে এগোচ্ছি। কিন্তু আজ আর কোনো বাধাই মানলাম না। আমার পৌরুষ অথবা নিয়তি আমাকে ঠেলে নিয়ে চলল।

বিশ হাত দূরে রাজু চলেছে। আমিও নিঃশব্দে ওর কিছু পিছু চলেছি। রাজু বাগানের ভেতর ঢুকল। আমিও ঢুকলাম। শুকনো পাতায় যাতে শব্দ না হয় তার জন্যে খুব সাবধানে পা ফেলতে লাগলাম। অন্ধকারে রাজু বার বার হারিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু আমি হুঁশিয়ার। আবার রাজুর সেই ঢ্যাঙা চেহারা। আমার গা শিউরে উঠল। কিন্তু না, আজ আমায় একটা ফয়শালা করতেই হবে। কোথায় ও যায় দেখতেই হবে। নিজেকে ঝাঁকানি দিয়ে দেখে নিলাম–আমি ঠিক আছি।

প্রায় মিনিট দশেক এগোবার পর দেখি এক জায়গায় আলো জ্বলছে। পরে বুঝলাম আলো নয়, আগুন। অবাক হলাম। নির্জন বাগানে আগুন জ্বালল কে? ওদিকে রাজুর গতি দ্রুত হচ্ছে। মনে হচ্ছে ওকে যেন কেউ টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে কি আমাকেও কেউ টানছে?

আর একটু এগোতেই দেখলাম একজন সন্ন্যাসী ধুনি জ্বেলে এই দিকেই তাকিয়ে আছে। আমি চট করে একটা গাছের আড়ালে সরে গেলাম। চোখের সামনেই দেখলাম রাজু গিয়ে ওঁর পায়ের কাছে লম্বা হয়ে আছড়ে পড়ল। আর ঠিক তখনই ধুনির আগুনের আভায় সন্ন্যাসীকে ভালো করে দেখতে পেলাম। চমকে উঠলাম–এ কী! এ যে কাঠমাণ্ডুর পাহাড়ের সেই তান্ত্রিক! কিন্তু

কিন্তু কী করে সে পাহাড়-পর্বত ডিঙিয়ে পথ চিনে চিনে আমার দেশে হাজির হলো?

আমার হাত-পা কিরকম অবশ হয়ে এল। বুঝলাম এখানে আর এক মুহূর্ত থাকলে আমি জ্ঞান হারাব। আর জ্ঞান হারালেই তান্ত্রিকের হাত থেকে রেহাই নেই।

আমি পায়ে পায়ে পিছোতে লাগলাম। একবার রাজুর দিকে তাকালাম। দেখি একটি কংকালসার দেহ–দেহ নয়, মৃতদেহ উপুড় হয়ে পড়ে আছে।

সে রাত্রে কি করে যে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম মনে করতে পারি না। তবু ওরই মধ্যে ইচ্ছে করেই বাইরের দরজায় খিল এঁটে দিয়েছি যাতে রাজু আর বাড়ি ঢুকতে না পারে। নিজের ঘরের দরজাতেও ভালো করে খিল দিয়ে শুয়ে পড়লাম। ততক্ষণে কারেন্ট এসে গেছে।

ঘুমের ঘোরের মধ্যেই একটা কথা মনে হতে চমকে উঠে বসলাম। মেলার কদিন ঐ বাগানের মধ্যে দিয়েই লোকজন নদীর ধারে জোড়া বটতলায় পুজো দিতে গিয়েছিল। তখন বাগানে কেউ এই তান্ত্রিককে দেখেনি। সব তান্ত্রিক, সাধু সন্ন্যাসীই ছিল নদীর ধারে। সম্ভবত ইনিও ওখানে ছিলেন।

মেলা তো শেষ হয়ে গেছে বেশ কয়েকদিন হলো। সব সাধুরাই ফিরে গেছেন। ইনি যাননি কেন? কেনই বা এখন বাড়ির কাছে আমবাগানে এসে একটা আস্তানা গেড়েছেন? রাজুর সঙ্গেই বা চেনা হলো কী করে? রাজু মেলায় চুপিচুপি একা গিয়েছিল। সে কি তবে তান্ত্রিকের সঙ্গে দেখা করতে? তবে কি রাজু ঐ তান্ত্রিকেরই পাঠানো অলৌকিক জল্লাদ? আমাকে শেষ করে দেবার জন্যে অথবা আমার ওপর প্রতিশোধ নেবার জন্যে নিজেই ক্রমশ এগিয়ে আসছে আমাদের বাড়ির দিকে? রাজু শুধু ওঁকে নিশানা দিয়ে যাচ্ছে? তাহলে–তাহলে নির্জন বাড়িতে আমাকে বলি দেবার জন্যেই কি হাঁড়িকাঠ পোঁতা হয়েছিল?

.

সিঁড়ির ঘরে চোর?

পরের দিন সকালে দেখলাম বাইরের দরজার খিল বন্ধই আছে। বুঝলাম রাজু ফেরেনি। অথবা বাড়ি ঢুকতে পারেনি। খানিকটা নিশ্চিন্ত হলাম।

একটু বেলা হলে পাড়ার একটা ছেলেকে ডেকে বললাম, শুনছি একজন সাধু নাকি পিছনের বাগানের শেষের দিকে বসেছেন। একটু দেখে এসো তো। ছেলেটা তখনই যাচ্ছিল, ফের ডেকে বললাম, ওঁর কাছে যাবার দরকার নেই। দূর থেকে দেখো।

ঘণ্টাখানেক পরে ছেলেটা ফিরে এসে জানাল বাগানে কেউ নেই।

–কেউ নেই! তুমি জায়গাটা খুঁজে পেয়েছিলে তো?

ছেলেটি বলল, হ্যাঁ, পোড়া কাঠ, ছাই পড়ে আছে দেখলাম।

নিশ্চিন্ত হলাম। যাক, আপদ বিদেয় হয়েছে। সেই সঙ্গে রাজুও।

কিন্তু সেদিনই সন্ধেবেলায় ছেলেটি হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল–সাধুবাবা আবার এসেছেন। ধুনি জ্বালিয়ে বসেছেন। এবার অত দূর নয়, আরও কাছে।

আমি চমকে উঠলাম। ওকে বললাম, ঠিক আছে।

ছেলেটা চলে গেলে আমি কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম। অদ্ভুত তো ঐ তান্ত্রিকটা। কেমন ধীরে ধীরে তিন মাইল দূরে জোড়া বটতলা থেকে আমাদের বাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। কেউ বাধা দেবার নেই। এবার তো বাড়ি এসে ঢুকবে।

তাহলে একা আমি এখন কী করব?

তখনই সাহস এনে মনকে বোঝালাম–এটা যে নেপালের নির্জন অরণ্য বা পাহাড়ের গুহা নয়, এটা যে কলকাতার কাছেই কোনো লোকালয়–একটা হাঁক দিলে দলে দলে লোক ছুটে আসবে, এটা কি তান্ত্রিক বাবাজি জানেন না? নাকি লোকবল, অস্ত্রবলের চেয়েও ওঁর কাছে আরও কোনো অব্যর্থ ভয়ংকর মারণাস্ত্র আছে যা দিয়ে আমায় শেষ করে দিতে অসুবিধে হবে না? চোখের সামনেই তো দেখলাম কী ক্ষমতায় রাজুকে অস্ত্র বানিয়ে আমার বাড়িতে পাঠিয়েছিল! রাজু কি সত্যিই রক্তে-মাংসে গড়া মানুষ, না কোনো মৃতদেহ? তান্ত্রিকের পায়ের কাছে ও যখন আছড়ে পড়েছিল তখন স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলাম ওর দেহে প্রাণ ছিল না। একটা শুধু চামড়া-ঢাকা কংকাল যেন ঝন্ করে পড়ে গেল।

আরও সন্দেহ হচ্ছে কাঠমাণ্ডুর হোটেলের জং বাহাদুরও ঐ তান্ত্রিকের দলেরই একজন। তান্ত্রিকের সঙ্গে সেইই হয়তো যোগাযোগ করে রাজু সুব্বা নাম দিয়ে একটা জীবন্ত কংকালকে আমার সঙ্গে পাঠিয়েছিল। আর তখনই চোখের সামনে ভেসে উঠল গুহার মুখে সেই ঝুলন্ত কংকালটা। বাতাসে দুলছে।

যাক, রাজু বিদেয় হয়েছে। আজ দুদিন ও আর আসেনি। বাগানে তান্ত্রিকের কাছেও ওকে দেখা যায়নি। দেখা গেলে পাড়ার ছেলেটা বলত।

.

আজ রাত্রে পাড়ার একজনদের বাড়িতে আমার নেমন্তন্ন ছিল। আমি একা থাকি বলে মাঝে মাঝে নেমন্তন্ন পাই।

রাত মাত্র আটটা।

আকাশে ঘন মেঘ থমথম্ করছে। এখনি হয়তো বৃষ্টি নামবে।

আমি তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলাম।

রাস্তা ঘোর অন্ধকার। কোনোরকমে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে সাঁতার কাটতে কাটতে বাড়ি এসে তালা খুলে ঢুকলাম।

একতলার উঠোন পার হয়ে ডান দিকে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি। সবে অর্ধেক উঠেছি– ওপরে সিঁড়ির ঘরে যেখানে সুব্বা থাকত সেখানে যেন কার পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম।

অবাক হলাম। তালাবন্ধ বাড়িতে কে কিভাবে আসতে পারে? থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। চোর নয় তো? ছাদ দিয়ে উঠে এসেছে?

ইস্! রিভলভারটাও কাছে নেই। এদিকে সদর দরজাটাও ভুলে খুলে এসেছি। এখন ওপরে উঠব, না পালাব? রুদ্ধ নিঃশ্বাসে কয়েক মুহূর্ত ধরে ভাবলাম। আর ঠিক তখনই সিঁড়ির ওপরে নজর পড়ল। অন্ধকারের মধ্যে দুটো জ্বলন্ত চোখ আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

আমার গায়ের প্রত্যেকটি লোম খাড়া হয়ে উঠল। ও কার চোখ?

কিছু ভেবে দেখবার আগেই দেখি চোখ দুটো নেমে আসছে। শুধু চোখ নয়, একটা ছেলের দেহ। সে দেহে এতটুকু মেদ নেই, মাংস নেই, হয়তো বা রক্তও নেই। শুধু কালো কুচকুচে চামড়া দিয়ে ঢাকা। চিনতে পারলাম নারকেলের মতো মাথাটা দেখে।

রাজু সুব্বা!

 তিন দিন পর কোথা থেকে রাজুর আবির্ভাব?…কিন্তু–এ কি সেই রাজু, না তার প্রেতাত্মা?

দুটো সরু সরু হাত বাড়িয়ে রাজু এগিয়ে আসছে। আগে দুবার চেষ্টা করেছিল পিছন থেকে। এবার আর চুপি-চুপি লুকিয়ে নয়, একেবারে সামনে মুখোমুখি।

পালাতে গেলাম। কিন্তু পা দুটো থরথর করে কেঁপে উঠল। আমি আর দাঁড়াতে পারছিলাম না। মৃত্যু নিশ্চিত জেনে আমি সিঁড়ির দেওয়ালে ঠেস দিয়ে কোনোরকমে দাঁড়িয়ে রইলাম। কিছু করার নেই।…

রাজু মুখে একরকম অদ্ভুত শব্দ করতে করতে ক্রমশ আমার দিকে এগিয়ে আসছে। ওর দুটো হাত তখন আমার গলার কাছে। আমি নিজের দুহাত দিয়ে ওর সরু সরু হাত দুটো চেপে ধরতে গেলাম কিন্তু বরফের ছুরির মতো ওর হাত দুটো আমার হাত অবশ করে দিল। আমি শেষবারের মতো চিৎকার করে উঠলাম বাঁচাও।

কাকে উদ্দেশ করে চেঁচালাম তা জানি না, তবে সাড়া পেলাম তখনি।

সুশান্ত, তুমি কোথায়, বড্ড অন্ধকার!

 চমকে উঠলাম! এ যে প্রণবেশের গলা!

আমি দ্বিগুণ জোরে আবার চেঁচিয়ে উঠলাম–বাঁচাও!

সঙ্গে সঙ্গে নিচে থেকে জোরালো টর্চের আলো এসে পড়ল সিঁড়ির ওপর।

–এ কী! সুশান্ত! তুমি এখানে দাঁড়িয়ে? কি হয়েছে?

হঠাৎ জ্বলন্ত চোখ দুটো নিভে গেল। টর্চের আলোয় রাজুকে পরিষ্কার দেখা গেল। রাজু আমাকে আর প্রণবেশকে ধাক্কা দিয়ে বিরাট এক লাফ মেরে নিচে নেমে অদৃশ্য হয়ে গেল।

.

শেষ কথা

রাজু সুব্বাকে নিয়ে এই অলৌকিক কাহিনিও আমার ডায়রিতে লিখে রেখেছি। তবে শেষটুকু লেখা হয়নি।

পরের দিনই সবাই ফিরে এল। সকলেই আমার এ কদিনের ঘটনা শুনল। ছোটো ভাইয়ের স্ত্রী বলল–আমি তখনই বুঝেছিলাম ও ছেলেটা মানুষ নয়, সাংঘাতিক কিছু। যাক, খুব বেঁচে গেছেন।

আমার স্ত্রী তখনো ভয়ে নির্বাক।

তখনও তিনদিন ছুটি বাকি ছিল। ভেবেছিলাম প্রণবেশকে নিয়ে এই তিনটে দিন এখানেই কাটিয়ে যাব। কিন্তু সন্ধেবেলায় সেই ছেলেটা এসে খবর দিল–সাধু আজও এসে বসেছে। এবার বাড়ির আরও কাছে।

শুনে সবারই মুখ শুকিয়ে গেল। এ কি আমায় শেষ না করে এখান থেকে যাবে না?

সেদিনই আমার স্ত্রী সুটকেস গুছিয়ে নিলেন। বললেন–আর নয়। কাল ভোরের ট্রেনেই কলকাতায় ফিরে চলল। ওসব পাহাড়ে তান্ত্রিকদের হাত থেকে সহজে নিস্তার পাওয়া যায় না।

ভয়ে ভয়ে ভোরবেলাতেই একরকম পালিয়ে এলাম বলা চলে। যথাসময়ে ট্রেন এল। তাড়াতাড়ি সামনে যে বগি পেলাম তাতেই উঠে পড়লাম।

গার্ড হুইশল দিল। সবুজ ফ্ল্যাগ দুলে উঠল।

 হঠাৎ নোটন চেঁচিয়ে উঠল–বাবা, দ্যাখো দ্যাখো সুব্বা!

জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখি একটা কংকাল যেন অস্বাভাবিক জোর ছুটে আসছে ট্রেন ধরার জন্যে। অন্তত পিছনের বগিতেও যদি উঠতে পারে। কিন্তু তখনই ট্রেন চলতে শুরু করে প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে গেল। রাজু অল্পের জন্যে ট্রেনের নাগাল পেল না।

.

প্রণবেশ বলল–সুব্বা তোমাকে ছাড়বে না দেখছি।

নিরাপদে কলকাতায় পৌঁছেছি। কিন্তু এখনও সুস্থির হতে পারিনি। কি জানি রাজু আবার এখানেও এসে না পড়ে।

[শারদীয়া ১৩৯৭]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *