বামনের কঙ্কাল

বামনের কঙ্কাল

সিঁড়িতে পায়ের শব্দ

সেদিন অনেক রাতে অস্পষ্ট একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলাম।

কৃষ্ণপক্ষ। খোলা জানলা দিয়ে দেখলাম চাঁদের ম্লান আলো লুটিয়ে পড়েছে বরাকর নদীর জলে। ওদিকে গভীর শালবন থমথম করছে।

আমি বিছানায় বসে কান পেতে রইলাম।

না, কোনো শব্দ নেই।

তবে কি আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ভুল শুনেছিলাম?

তার পরেই চমকে উঠলাম। আবার সেই শব্দ–খট খট খট….কেউ যেন কাঠের পা নিয়ে কাঠের সিঁড়ির উপর দিয়ে মাতালের মতো টেনে টেনে ওঠবার চেষ্টা করছে।

হঠাৎই শব্দটা থেমে গেল। আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে রইলাম। কিন্তু শব্দটা আর শোনা গেল না।

আশ্চর্য! কে আসছিল সিঁড়ি দিয়ে উঠে? কেনই বা দোতলা পর্যন্ত উঠল না? চোর ডাকাত? চোর-ডাকাত যদি হয় তাহলে কি তাদের পায়ের শব্দ ঐরকম হয়?

কিছুই বুঝতে পারলাম না।

তা হলে?

হঠাৎ একটা অপ্রত্যাশিত সম্ভাবনা বুকের মধ্যে তোলপাড় করতে লাগল। তবে কি

একবার ভাবলাম দরজা খুলে সিঁড়ি পর্যন্ত গিয়ে দেখি। কিন্তু সাহস হলো না। মশারির মধ্যে চুপ করে বসে রইলাম।

.

ভয়ংকরী বুড়িমা

বরাকর জায়গাটা পশ্চিমবঙ্গ আর বিহারের বর্ডারে। বরাকরের এদিকে কুলটি আর ওপারে কুমারডুবি।

বহুকাল আগে আমার পিতামহ বরাকর নদীর নির্জন প্রান্তে শালবনের কাছে একটা দোতলা বাড়ি করেছিলেন। শুনেছি প্রতি বছর তিনি সপরিবারে এখানে হাওয়া বদলাতে আসতেন। কিন্তু এখন লোকে চেঞ্জে বা হাওয়া বদলাতে কেউ বড়ো একটা বিহার বা ছোটোনাগপুরে যায় না। যায় দূর দূর দেশে। সেইজন্যে নির্জন নদীর ধারে পূর্বপুরুষের এই বাড়ির প্রতি কারও আর আকর্ষণ নেই। নিরিবিলি জায়গাটা ভয়ের জায়গা হয়ে উঠেছে। চুরি-ডাকাতি, খুন-খারাপি কি না হতে পারে।

এ বাড়িতে আমিই এখন একা থাকি। আমার পক্ষে এরকম নির্জন নির্বান্ধব জায়গাই ভালো। কেন এইরকম জায়গায় পড়ে আছি সে কথা বলার আগে নিজের বিষয়ে কিছু বলে নিই।

অমি ঠিক সাধারণ মানুষের মতো নই। ঘর-সংসার করিনি। ছোটবেলা থেকে সাধু সন্ন্যাসীদের ওপর তীব্র আকর্ষণ। তখন থেকেই সাধু-সন্ন্যাসীদের ওপর লেখা নানা রকমের বই পড়তাম। যতই পড়তাম ততই তাদের ওপর আগ্রহ বেড়ে যেত। তারপর আমিও একদিন বাড়ি ছেড়ে সন্ন্যাসীদের দলে ভিড়ে পড়লাম। কত যে সন্ন্যাসীর সঙ্গে মিশেছি তার হিসেব নেই। কিন্তু তারা কেউ আমায় পাত্তা দেননি। বলেছেন–তুই ছেলেমানুষ। তোর এখনও সময় হয়নি। বাড়ি ফিরে যা।

বাড়ি ফিরে আসিনি। আবার অন্য সন্ন্যাসী ধরেছি।

একবার এক তান্ত্রিকের সঙ্গ পেয়েছিলাম। তিনি আবার শবসাধনা করতেন। নির্জন ভয়ংকর শ্মশানঘাটে গভীর রাতে একটা মড়ার ওপর বসে সারারাত মন্ত্র পড়ে যেতেন। এই সাধনা খুবই কঠিন। নানারকম ভয়াবহ ঘটনা ঘটত। তাতে ভয় পেলেই মৃত্যু। আর ভয় না পেলে সিদ্ধি। তুমি মহাশক্তির অধিকারী হয়ে উঠবে। আমার সাধ হলো আমিও শবসাধনা শিখব। তান্ত্রিক গুরুকে একথা বলতেই তিনি লাল লাল চোখে কটমট করে তাকিয়ে আমার গালে এক চড় মেরে বললেন–ছেলেখেলা! বেরো এখান থেকে।

সে কী চড়! এক চড়ে মাথা ঘুরে গিয়েছিল।

ওখান থেকে চলে এসে আবার ঘুরতে ঘুরতে একটা গ্রামের বাইরে নির্জন শ্মশানে এক বুড়ির সন্ধান পেলাম। লোকে তাকে বুড়িমা বলে ডাকত। কিন্তু কেউ তার কাছে ঘেঁষত না। বলত ও নাকি ভয়ংকরী বুড়িমা!

শ্মশানটা একটা মজা নদীর পাশে। টোপা পানা আর কলমীর দাম ডাঙার কাছে। এদিকে ওদিকে মরা কুকুর, বেড়াল, ছাগল পড়ে আছে। দুর্গন্ধে প্রাণ ওষ্ঠাগত। এছাড়া পড়ে রয়েছে শ্মশানযাত্রীদের ফেলে যাওয়া ভাঙা কলসি। একটা বিকট মড়ার খুলিও দেখলাম জলের ধারে পাকুড় গাছটার গোড়ায়। গা শিউরে উঠল।

এখানেই একটা বটগাছের নিচে বুড়িমার দেখা পেলাম। ছেঁড়া ময়লা একটা কথা জড়িয়ে পড়ে আছে। মাথায় কঁকড়া চুল জট পাকিয়ে গেছে। সর্বাঙ্গে মড়া-পোড়ানো ছাই মাখা। কথা জড়ানো থুখুরি বুড়িকে দূর থেকে দেখে মনে হয়েছিল যেন একটা ময়লা কাপড়ের পুঁটলি।

যাই হোক বুড়িকে প্রণাম করার অনেকক্ষণ পর মনের ইচ্ছে জানালাম। বুড়ি থু করে আমার গায়ে থুথু দিয়ে খোনা গলায় বললে–দূর হ–দূর হ। নইলে মরবি।

বুড়ির মুখে প্রথমেই মরার কথা শুনে খুব উৎসাহ পেলাম। বুঝলাম এখানে সাঙ্ঘাতিক কিছু ঘটলেও ঘটতে পারে। কাজেই আমি ওখান থেকে নড়লাম না।

ওখানেই পড়ে থাকি। রোজই গাল খাই, মড়া-পোড়ানো কাঠ ছুঁড়ে নির্দয়ভাবে মারে, পিঠ ফেটে রক্ত পড়ে। তবু নড়ি না।

এমনি করে এক মাস, দু-মাস গেল। এর মধ্যে কতরকমের ভয় পেলাম। কতরকমের বুক-কাঁপানো শব্দ। এক-এক সময়ে তিনখানি মাত্র দাঁত নিয়ে বুড়ি হি হি করে ভয়ংকর হাসি হেসে ওঠে। আমি তখন তার দিকে তাকিয়ে মা-মা করে ডাকি। অমনি ভয় কেটে যায়।

ক্রমে বোধ হয় আমার ধৈর্য দেখে বুড়িমা নরম হলো। ভূত-প্রেতের কত কথা শোনাল। বলল–এই শ্মশান বহুকালের জানিস? লক্ষ চিতা জ্বলেছে। এই পবিত্র থানে ভূত, প্রেত, পিশাচ কী নেই? উঁত ছাড়াও আছে গোদান, আছে বেঁকি। মানুষ মরলে চোখে দেখা যায় না। তঁবু তারা থাকে।

বুড়িমা ফোকলা দাঁতে ফক ফক করে কথা বলে।–অঁনেক রকমের প্রাণী-ভূত আছে তাদের বুদ্ধি মানুষের চেয়ে কম কিন্তু শক্তি বেশি। এরা হলো ডাকিনী, শখিনী। আর এক ধরনের অপদেবতা আছে। তারাও সাংঘাতিক। এঁদের বলে হাঁকিনী। মন্ত্রবলে এঁদের বশ করতে পারলে এঁদের যা করতে বলবে তাই করবে। কিন্তু একটু অসাবধান হলেই এরা তোকেই মেরে ফেলবে।

আমি অবাক হয়ে এই প্রেত-সিদ্ধ বুড়িমার কথা শুনি। শ্রদ্ধা বিশ্বাস বাড়ে।

শেষে একদিন ভয়ে ভয়ে শব-সাধনা শিখিয়ে দেবার জন্যে বললাম। এই উদ্দেশেই তো আমার আসা। আমার কথা শুনে বুড়িমা তো চটে আগুন। অনেক কষ্ট করে শেষ পর্যন্ত বুড়িকে রাজী করালাম। বললে, এঁত কঁরে ধরছিস, ঠিক আঁছে দেবো। তঁবে ফেঁতি হলে বাঁচাতে পারব না।

আনন্দে লাফিয়ে উঠে বললাম, সাধনা করতে গিয়ে যদি প্রাণ যায় যাক।

বুড়িমা একটু মুচকে হাসল। বললে, তবে যা বাজার থেকে জিনিসগুলো কিনে নিয়ে আয়।

দু-তিনদিন ধরে বুড়িমার ফর্দমতো জিনিসগুলো শহরে গিয়ে কিনে আনলাম। কিন্তু আসল জিনিস কই? শব? শব তো আর বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না।

আজ বেশ কদিন ঘাটে একটা মড়াও আসেনি। মড়া এলেই কি পাওয়া যাবে? যারা মড়া নিয়ে আসে তারা তো মড়া পুড়িয়ে চলে যাবে। এক যদি প্রবল বৃষ্টি হয়, চিতা জ্বালতে না পেরে মড়া ভাসিয়ে দেয় তাহলে হয়তো সেই শব পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু সে সম্ভাবনাই বা কোথায়?

বুড়িমা মুচকে মুচকে হাসতে লাগল। আমার কান্না পেল। বললাম, তা হলে কি হবে বুড়িমা?

আমার করুণ অবস্থা দেখে বুড়ির যেন দয়া হলো। বলল, তা হলে এক কাজ কর। আমায় গলা টিপে মেরে ফ্যাল। তারপর আমার শবের ওপর বসে–

প্রথমে ভেবেছিলাম বুড়ি বুঝি মস্করা করছে। কিন্তু যখন সে কঁদো কাঁদো হয়ে তার বড়ো বড়ো বাঁকানো রক্তশূন্য নখসুদ্ধ হাত দিয়ে আমার হাত ধরে (উঃ কী ঠাণ্ডা!) বললে, আঁমি বলছি তুই আঁমায় মার। আমার শরীলটা তা হলে বসিদ্ধ হবে। ওরে, আঁমি একটা সঁকাজ করে মুক্তি পাব।

তখন আমি বিভ্রান্ত হয়ে পড়লাম। বললাম, না-না, খুন করে আমি ফাঁসি যেতে পারব না।

বুড়িমা বললে, দূর পাগল! পুলিশ টের পাবে কি করে? এখানে জঁনমনিষ্যি নেই। নে, শেষ করে দে আঁমাকে। বলে সরু খসখসে চামড়ার গলাটা বাড়িয়ে দিল।

আমি খুন করতে পারব না, বলে ছুটে পালাবার চেষ্টা করতেই বুড়িমা খপ করে আমার হাতটা চেপে ধরল। সে যে কী শক্ত হাত তা বোঝাতে পারব না। ঐ থুরথুরে বুড়ি এত শক্তি কোথায় পেল?

বুড়িমা বলল, যেতে হবে না। আমাকে মারতেও হবে না। আঁজ থেকে তিন দিন পর অমাবস্যার রাতে একটা গঁড়া এসে ভিড়বে ঘাঁটে। তাকে নিয়েই কুঁই বসবি।

মড়া আসবেই তুমি জানলে কি করে?

আঁমি জানতে পারি।

কোথা থেকে আসবে?

এখান ঘেঁকে চার পো (এক মাইল) পথ দূরে গদাধরপুরের চামারদের একটা চোদ্দ পনেরো বছরের ছেলে মরবে। আঁমি তাকে দেখেছি। ভারি সুলক্ষণ আছে।

কিন্তু সে মরবেই জানলে কি করে?

বললাম তো আমি জানতে পারি। সে ক্ষমতা আমার না থাকলে তুই এসেছিস কাঁনো আঁমার কাছে?

শুনে কিরকম যেন ভয় পেয়ে গেলাম।

বুড়িমা মনের অবস্থাটা ঠিক টের পেল। বলল, এই দ্যাখ এখুনি তুই ভঁয়ে ভিরমি খাচ্ছিস। তোর দ্বারা কিছু হবে না।

তবু যে সেই ভীতু আমিটা কী করে সব কাজ প্রায় নিখুঁতভাবে করতে পেরেছিলাম তা ভেবে আজ অবাক হই।

সেদিনই গভীর রাতে বুড়িমা বললে, আঁমি একটু ঘুরে আসি। তুই একা থাকতে পারবি তো?

ভয় চেপে রেখে বললাম, পারব। তুমি যাচ্ছ কোথায়?

রেগেমেগে বুড়িমা বললে, আঁত খোঁজে তোর দরকার কী?

বেশ। কখন ফিরবে বলবে তো?

রাঁত থাকতে থাকতেই ফিরব। তোর তো দেখছি শীত করছে। দাঁড়া। বলে চটের বস্তা থেকে একটা ছেঁড়া ময়লা দাগধরা বিছানার চাদর এনে দিয়ে বললে, এটা গায়ে দে। আঁরাম পাবি।

ম্যা গো! এ চাদর পেলে কোথায়?

পাঁব আবার কোথায়? ঘাঁটে মড়া আসে। তাদের গা থেকে খুঁলে নিই।

ঘেন্নায় কুঁকড়ে গেলাম। কিন্তু মুখে তা প্রকাশ করতে সাহস পেলাম না।

দেখলাম বুড়িমা নদীর ধার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বড্ড তাড়াতাড়ি অদৃশ্য হয়ে গেল।

বুড়িমা চলে যেতেই গা থেকে চাদরটা বাঁ হাতের দুটো আঙুলে ধরে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম।

কিছুক্ষণ কেমন যেন বিহ্বল হয়ে বসে রইলাম। তার পরেই গা-টা ছমছম করতে লাগল। এই ভয়ংকর নির্জন শুশানভূমিতে নিশীথ রাতে কখনো একা থাকিনি। সামনে উত্তর-পশ্চিম কোণে একটা ঝাকড়া তেঁতুল গাছ। তার একটা পাতাও নড়ছে না। মাঝে মাঝে বুনো ঝিকুড় ফুলের বিশ্রী গন্ধ। অন্ধকার আকাশে ঝিকমিক করছে তারা। যেন আমাকে ভয় দেখাচ্ছে হাজার হাজার চোখ মেলে। হঠাৎ মাথার ওপর বটগাছের পাতাগুলো নড়ে উঠল। আমি শিউরে উঠলাম। যদিও জানি কোনো বড়ো পাখি পাখা ঝাঁপটাল, কিন্তু কত বড়ো পাখি সেটা যে এত জোরে পাতা নাড়াতে পারে? তখনই লক্ষ্য পড়ল নদীর ধারে সেই খুলিটার দিকে। মনে হলো খুলিটা যেন হঠাৎ খুব বড়ো হয়ে গেছে। ওটাকে তো রোজই দেখি। এত বড়ড়া তো ছিল না। গভীর রাতে কি খুলিও বড়ো হয়ে ওঠে? ওটা আবার গড়াতে গড়াতে আমার কাছে চলে আসবে না তো? আমি ভয়ে চোখ বুজিয়ে বসে রইলাম।

প্রায় রাত তিনটের সময়ে বুড়িমা ফিরে এল। কোথা থেকে, কোন পথে, কেমন করে এল জানি না। শুধু দেখলাম আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাড়াতাড়ি চাদরটা জড়িয়ে নিলাম।

বুড়িমা বললে, কিরে ভঁয় পাসনি তো?

বললাম, না। তোমার কাজ হলো?

 বুড়িমা সংক্ষেপে বলল, হ্যাঁ।

কি এমন জরুরি কাজে তাকে যেতে হলো তা জিজ্ঞেস করতে সাহস হয়নি।

দুদিন পর তিন দিনের দিন অল্প রাতে বুড়িমা ঢুলছিল। হঠাৎ জেগে উঠে বলল, দ্যাখ তো নদীর ধারে বোধ হয় সঁব লেগেছে।

তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে দেখলাম সত্যিই নদীর ধারে বড়ো পাকুড় গাছটার শেকড়ের মধ্যে একটা মড়া আটকে রয়েছে। ছুটে গিয়ে বুড়িকে জানাতেই বুড়ি বললে, ওটা তুলে নিয়ে আয়।

বোঝো কথা! জীবনে আমি অনেক মড়া পুড়িয়েছি কিন্তু তিনদিনের বাসি মড়া এই গভীর রাতে একা একা জল থেকে তুলে আনা যে কী কঠিন কাজ তা যে করে সেইই জানে। কিন্তু শব-সাধনা করতে গেলে এসব আমাকে করতেই হবে।

ছপাৎ ছপাৎ করে আমি জলে নেমে এগিয়ে গেলাম। হাঁটুজল। মড়াটার কাপড় পাকুড়গাছের শেকড়ে আটকে ছিল। কোনোরকমে ছাড়িয়ে মড়াটা দুহাতে পাঁজাকোলা করে তুললাম। মুখের ওপর অন্ধকারে হাত পড়তেই নরম নরম কী ঠেকল। বুঝলাম জিব। ও বাবাঃ! মড়াটার জিব বেরিয়ে গেছে।

যাই হোক সেটা তুলে নিয়ে এলাম। বুড়িমা ইতিমধ্যে কুশ বিছিয়ে মড়াটার জন্যে শয্যা তৈরি করে রেখেছে। বলল, ওটাকে পুঁব দিকে মাথা করে শোওয়া।

সেইভাবে শুইয়ে বললাম, জিব বেরিয়ে গেছে কেন?

বুড়িমা খুব সহজভাবেই বলল, বোধ হয় কেঁউ গলা টিপে মেরেছে।

শুনে কেন জানি না বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। চোদ্দ-পনেরো বছরের ছেলেটাকে গলা টিপে কে মারল?

একটা গভীর সন্দেহ বুকের মধ্যে খচখচ করতে লাগল।

বুড়িমা যেন আমার মনের কথাটা বুঝে নিয়ে বলল, ভাবিস নে। ছোঁড়াটার সদ্গতি হয়ে গেল। নে, এঁবার ওঁর মুখে এলাচ, লবঙ্গ, কঞ্জুর, পান আর একটু মদ দে।

এ সবই এনে রাখা হয়েছিল। মৃতের মুখে একে একে সব দিলাম।

 এবার শবটাকে উপুড় করে দে।

দুহাতে আঁকড়ে ধরে উপুড় করে দিলাম। এরপর সারা পিঠে চন্দন মাখানো, পায়ের তলায় আলতা দিয়ে ত্রিকোণ চক্র আঁকা, আরও কিছু কিছু আনুষ্ঠানিক কাজ করে গেলাম। তারপর বুড়িমার আদেশমতো শবের পিঠে কম্বল চাপিয়ে ঘোড়ার মতো চেপে বসলাম।

বুড়িমা শবের হাত-পা শক্ত করে বেঁধে দিয়ে বললে–এঁবার যা যা মন্ত্র বলেছি চোখ বুজে আঁওড়াবি। দেখিস ভয় পাঁসনি। ভয় পেলেই রবি। নে বল, ওঁ ফটু। বল, ওঁ হুঁ মৃতকায় নমঃ।

বুড়ির মুখ দিয়ে যে এমন সংস্কৃত কথা বার হবে ভাবতে পারিনি। অবাক হলাম। কিন্তু বুড়িমা তখন অধৈর্য হয়ে তাগাদা দিচ্ছে, কী হলো? বল্।

মন্ত্র পড়তে লাগলাম। মন্ত্র কি একটা-দুটো? মন্ত্রের যেন শেষ নেই। মন্ত্র জপতে জপতে চোয়াল ধরে গেল। গলা শুকিয়ে গেল। তবু জপেই চললাম।

রাত দুপ্রহর হলো। চারিদিকে চাপ চাপ অন্ধকার। নদীর জল কালো অন্ধকারে ঢেকে গেছে। দূরে কাষাড় ঝোপে শেয়াল ডেকে উঠল। হঠাৎ আমার মনে হলো এই নির্জন শ্মশানে আমি একা মৃতদেহের ওপর বসে আছি. বুড়িমা নেই।

জানি ভয় পেলে চলবে না। তাই মন শক্ত করে মন্ত্র আওড়েই চললাম। তার পরেই মনে হলো মড়াটা যেন থর থর করে কাঁপছে। শুনেছি এরপর শব আমাকে ফেলে দিয়ে উঠে বসবে। কিন্তু পড়ে গেলে চলবে না। সেই ভয়ংকর অবস্থা কল্পনা করে আমি সিদ্ধির প্রথম ধাপে পৌঁছেই শবের ওপর থেকে লাফিয়ে নেমে ছুটে পালালাম শ্মশান থেকে। পিছনে শুনলাম বুড়িমা হাসছে খল-খল করে।

শবসাধনার এখানেই আমার ইতি। আর কখনো আমি ওমুখো হইনি।

এই হলো আমার জীবনের এক দিকের ইতিহাস। এখন আমি নিরিবিলিতে আমার ঠাকুর্দার পরিত্যক্ত দোতলা বাড়িতে একাই থাকি। জায়গাটা নির্জন। কিছু আদিবাসীদের ঘর। তারা চাষবাস করে। একটা ছোটোখাটো মুদির দোকান। ওরই একপাশে তরি-তরকারি বিক্রি হয়। এরাই হলো আমার প্রতিবেশী। আমি চিরদিন সাধু-সন্ন্যাসীর পিছনে ঘুরেছি। কাজেই লোকালয় আমার পছন্দ নয়। পৈতৃক টাকা-পয়সাও কিছু আছে। তাই নিয়ে একা একা বেশ আছি। তবে বড় অলস জীবন। কিছু করতে চাই। তার মানে চাকরি-বাকরি বা ব্যবসা-বাণিজ্য নয়। অন্য কিছু। কিন্তু সেই অন্য কিছুটা কী ভেবে পাই না।

এমনি সময়ে একদিন

.

জলেশ্বরের আবির্ভাব

 বেলা তখন দুপুর। খেয়ে-দেয়ে বিশ্রাম করছি হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। আমার এখানে বড়ো একটা কেউ আসে না। তাই কে এল ভাবতে ভাবতে নিচে গিয়ে দরজা খুলে দিতেই দেখি একজন বিপুলকায় সন্ন্যাসী দাঁড়িয়ে। তার মাথায় জটা, গোঁফদাড়ি। দুচোখের দৃষ্টি প্রখর। আমায় দেখে গোঁফের ফাঁকে একটু হাসল। গমগমে গলায় বলল, আমায় চিনতে পারছ?

চিনতে একটু সময় লেগেছিল। তারপরই চিনতে পেরেছিলাম।

তুমি জলেশ্বর না?

যাক চিনতে পেরেছ তা হলে?

আমি ওকে সাদরে ওপরে নিয়ে এসে বসালাম।

আমি যখন সাধু-সন্ন্যাসীদের সঙ্গে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছি তখন সেই দলে জলেশ্বরও ছিল। বাঙালি সাধু, তাই আমাদের ভাব হয়ে গেল। ও বেশ চালাক-চতুর আর করিৎকর্মা ছিল। তবে বড় বদমেজাজী। একদিন অন্য এক সাধুর সঙ্গে তর্কাতর্কির সময়ে জলেশ্বর তাকে এমন চড় মেরেছিল যে সাধুটি মরেই গেল। ওর এই হিংস্র প্রকৃতি দেখে আমি ভয় পেয়েছিলাম। অন্য সন্ন্যাসীরা তাকে দল থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। তার জন্যে ওর এতটুকু দুঃখ-কষ্ট হয়নি। আমার সম্বন্ধে ওর খুব কৌতূহল ছিল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমার বাড়ির খবর নিত। আমারে যে বেশ কিছু টাকা-পয়সা আছে জেনে ও জিজ্ঞেস করত তবে কেন সংসার না করে সন্ন্যাসী হয়েছি। তারপর ও যখন শুনল সন্ন্যাসীদের সঙ্গে সঙ্গে ঘোরার আমার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো শবসাধনা করে সিদ্ধিলাভ করা তখন ও-ও একই ইচ্ছের কথা বলেছিল। তবে এও বলেছিল, শবসাধনা এসব সন্ন্যাসীদের কম্ম নয়। যদি শিখতে চাও তো চলো অন্য কোথাও যাই।

তারপর ও তো দল থেকে সরে গেল। তার পরের কথা আর জানি না। জানলাম এতকাল পর। শবসাধনার চেষ্টা এখনও ও চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তেমন সুযোগ হচ্ছে না।

তারপর ও জিজ্ঞেস করল আমি কী করছি। বললাম, কিছু না।

ও বলল, কিছুই যদি না কর তাহলে নির্বান্ধব জায়গায় একা পড়ে আছ কেন?

এমনিই। বলে একটু হাসলাম।

জলেশ্বর আমার কথা বিশ্বাস করল না। বলল, নিশ্চয় কিছু করছ। তুমি আমার কাছে। লুকোচ্ছ।

একটু থেমে বলল, আমার কাছে লুকোচ্ছ কেন? আমরা দুজনেই তো একই পথের পথিক।

তখন বলব কি বলব না ভাবতে ভাবতে বুড়িমার কাছে আমার শবসাধনার কথা বলে ফেললাম। শুনে ও গুম হয়ে গেল।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তবু তো তুমি কিছু করেছ। আমি তো এগুতেই পারছি না। অথচ হাত গুটিয়ে বসে থাকা আমাদের চলে না। একটা কিছু করতেই হবে।

কি করব ভেবেই পারছি না। ও শবসাধনা আমার দ্বারা হবে না।

শোনো আমি একটা মতলব দিচ্ছি। চেষ্টা করে দ্যাখো।

জিজ্ঞেস করলাম, কী?

 মৃতদেহে প্রাণ সঞ্চার।

অবাক হয়ে বললাম, তুমি পাগল হলে নাকি? মড়া বাঁচাতে পারলে তো ভগবান হয়ে যাব।

ও বলল, তুমি কি তা কিছুই করতে পারনি? তা হলে শব নড়ে উঠেছিল কি করে?

 চমকে উঠলাম। তাই তো!

 বললাম, তুমিও তো চেষ্টা করে দেখতে পারো।

জলেশ্বর গম্ভীরভাবে বলল, চেষ্টা করতাম। শুধু দুটো জিনিসের অভাব। এক–মৃতদেহ পাওয়া, দুই উপযুক্ত জায়গা। আমার থাকার আপাতত কোনো নির্দিষ্ট জায়গা নেই। সেদিক দিয়ে তোমার জায়গাটি বেশ। তুমি ফের চেষ্টা করো। আমিও জায়গা দেখছি। চললাম। একদিন এসে খোঁজ নিয়ে যাব।

.

মৃতদেহের সন্ধানে

 জলেশ্বর তো চলে গেল। কিন্তু আমার মাথায় একটা অদ্ভুত ভাবনা ঢুকিয়ে দিয়ে গেল। যদি সত্যিই আমি মৃতদেহে প্রাণ সঞ্চার করতে পারি, তাহলে আমায় দ্যাখে কে? আমি তো প্রায় সর্বশক্তিমান ভগবান হয়ে উঠব। আর কেনই বা পারব না? বুড়িমার দৌলতে শবসাধনার হাতে খড়ি তো হয়েই আছে। মৃতদেহকে নড়াতে তো পেরেছিলাম।

তখনই মনস্থির করে ফেললাম এই এক্সপেরিমেন্টটা আমায় করতেই হবে। আর এই বাড়িরই একতলার ঘর এই কাজে যথেষ্ট উপযুক্ত হবে।

কিন্তু প্রধান সমস্যা মৃতদেহ পাব কোথায়? ও জিনিসটা তো দোকানে কিনতে পাওয়া যায় না।

ভাবতে ভাবতে ছোটোবেলায় পড়া রূপকথার একটা গল্প মনে পড়ে গেল। এক রাক্ষুসী মরা বাঘের হাড়গোড় যোগাড় করে তাকে বাঘের আকৃতি দিয়ে মন্ত্র পড়ে জ্যান্ত বাঘ করে তুলেছিল। হঠাৎ আজ মনে হলো হাড় জোড়া দিয়ে জ্যান্ত বাঘ করার মন্ত্রগুলো কি নিতান্তই লেখকের কল্পনা? এমনও তো হতে পারে তখনকার দিনের মায়াবিনীরা সত্যিই এমন মন্ত্র জানত যাতে হাড়ের ওপর দিব্যি রক্ত-মাংস লাগিয়ে তাতে প্রাণ দেওয়া যেত।

একথা মনে হতেই ভাবলাম হাড়গোড় যোগাড় করা যদি সম্ভব নাই হয় একটা কঙ্কাল যোগাড় করে দেখা যাক।

কিন্তু কঙ্কাল পাব কোথায়?

অনেকেরই জানা আছে হাসপাতালে যেসব বেওয়ারিশ মৃতদেহ পড়ে থাকে সেগুলোকে পুঁতে দেওয়া হয়। কিন্তু ইদানিং এইসব মৃতদেহ নিয়ে ব্যবসা শুরু হয়েছে। কিছু লোক হাসপাতালের জমাদার প্রভৃতিদের গোপনে টাকা দিয়ে এইসব মৃতদেহ নিয়ে যায়। তারপর আরও গোপনে অ্যাসিড দিয়ে গলিয়ে পচিয়ে গোটা কঙ্কালটা বের করে নেয়। তারপর হাসপাতালে যেখানে অ্যানাটমি শেখানো হয় সেখানে অনেক টাকায় বিক্রি করে দেয়। ডাক্তারি পড়তে গেলে গোটা কঙ্কালের দরকার হয়।

এইবার আমি ঐরকম কঙ্কাল-ব্যবসায়ীর সন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম। এর জন্যে আমাকে হাসপাতালে হাসপাতালে গিয়ে জমাদারদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করতে হয়েছে। তারপর ঐরকম একজন ব্যবসায়ীর গোপন ডেরার সন্ধান পেয়ে সেখানে গেলাম।

ব্যবসায়ীটি এ তল্লাটে একজন রাজমিস্ত্রি বলে পরিচিত। সে তো প্রথমে ভালো করে যাচিয়ে নিল আমি পুলিশের লোক কিনা। যখন জানল প্রাইভেটে ডাক্তারি পরীক্ষা দেবার জন্যেই আমি একটা গোটা কঙ্কাল খুঁজছি তখন সে দরজা-জানলা বন্ধ করে দু-তিনটে কঙ্কাল বের করে দেখাল। কিন্তু সবকটাতেই খুঁত আছে। হয়তো খুলিটা একটু ফাটা কিংবা একটা আঙুল ভাঙা। এতে আমার কাজ হবে না বলে যখন হতাশ হয়ে চলে আসছি তখন ছুঁচলো মুখ লুঙ্গিপরা লোকটা দুর্গন্ধপূর্ণ অন্ধকার গুদোম ঘর থেকে একটা বেঁটে কঙ্কাল এনে দেখাল। কঙ্কালটা যেন ন-দশ বছরের ছেলের। খড়ির সঙ্গে কী সব ওষুধ মাখানো। লোকটা নিচু গলায় বলল–এটা কাউকে দেখাই না স্যার। এত পুরনো কঙ্কাল বড়ো একটা পাওয়া যায় না। জম্মু-কাশ্মীরের কাছে পুরনো কবর খুঁড়ে এটা পাওয়া গেছে। ওখানকার লোকে বলে এটা এককালের সাংঘাতিক বামন দৌলত খাঁর কঙ্কাল।

আমি অবাক হয়ে বললাম, এটা বামনের কঙ্কাল?

হাঁ স্যার, দেখছেন না কিরকম মোটা মোটা আঙুল, দেহের তুলনায় কত বড়ো মাথা, বুকের খাঁচাটা কত চওড়া। এ জিনিস পাবেন কোথায়?

এ কঙ্কাল কোনো এক দৌলত খাঁরই হোক আর নসরৎ খাঁরই হোক ও নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে আমি ওটাই যথেষ্ট বেশি দাম দিয়ে কিনে নিলাম।

কিন্তু এটা অতদূরে আমার বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যাব কি করে? কোলে করে তো নিয়ে যাওয়া যায় না।

সে ব্যবস্থা ব্যবসায়ীই করে দিল। ওর চেনাশোনা একটা দুইটাকা গোরুর গাড়ি ডেকে আনল। কঙ্কালটা আপাদমস্তক কম্বল দিয়ে মুড়ে নিরাপদে বাড়ি নিয়ে এলাম।

.

কঙ্কাল সাধনা

আমার বাড়ির নিচের তলার একটা ঘর বেশ অন্ধকার। সেখানেই পুরু করে খড় বিছিয়ে তার ওপর কঙ্কালটা রাখতে গেলাম। কিন্তু কঙ্কালটা যেন হাত থেকে পিছলে পড়ে গেল। আশ্চর্য হলাম। পড়ে যাবার তো কথা নয়। আমি তো দুহাত দিয়ে ধরেছিলাম। আর পড়বি তো পর উপুড় হয়ে।

আমি হাঁটু গেড়ে বসে দুহাতে করে কঙ্কালটা চিৎ করে দিলাম। চিৎ করে দিতেই মন হলো কঙ্কালটার চোখের গর্তদুটো যেন কেমন। গর্তের ভিতরে কি যেন চিকচিক করছে। ভাবলাম বুঝি চোখের কোটরে এক ঝাঁক জোনাকি বাসা বেঁধেছে। একটা কাঠি দিয়ে খোঁচালাম। কাঠিটা চোখের গর্ত দিয়ে দিব্যি নেমে গেল। কিছু মাটি ঝরে পড়ল। প্রথমে চিকচিক করতে দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম–এ আবার কীরে বাবা! এখন নিশ্চিন্ত হলাম। জানলা বন্ধ করে, দরজায় শেকল তুলে দিয়ে ওপরে উঠে এলাম। মনে মনে বললাম, এখানে আরাম করে কিছুদিন ঘুমোও।

ওপরে উঠে এসেও মনটা কেমন খচখচ করতে লাগল। চোখের কোটরে যে কিছু চিকচিক করছিল সে কি সত্যিই আমার দেখার ভুল? নাকি ভয়ংকর কিছুর ইঙ্গিত?

পরের দিনই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র (বুড়িমা যা যা আনিয়েছিল) কেনার জন্যে শহরে গেলাম। কিন্তু মাংস, মদ, গুড়, তিল, কুশ, মাষকলাই, পিদিম জ্বালাবার জন্যে খাঁটি সর্ষের তেল, এলাচ, লবঙ্গ, কর্পূর, জ্বাতি খয়ের, আদা, পান, যজ্ঞকাষ্ঠ, পঞ্চগব্য প্রভৃতি কিনে আনলাম। শবের (এখন শবের বদলে কঙ্কাল) ওপরে বসবার জন্যে হরিণের চামড়ার বদলে কম্বলের আসনের ব্যবস্থা হলো।

তারপরে একটা বিশেষ দিন দেখে শাস্ত্রমতে প্রচুর পরিমাণ মাংস ভাত খেলাম। রাত্রেও খাবার কোনো ত্রুটি রাখলাম না। তারপর রাতের অন্ধকারে কঙ্কালটি দু হাতের ওপর শুইয়ে নদীতে নিয়ে গিয়ে স্নান করিয়ে আনলাম। কঙ্কালটা আকারে ছোটো হলেও বেশ ভারী। বইতে কষ্ট হচ্ছিল। যাই হোক কোনোরকমে বাড়ি এনে কাঁচা শুকনো কাপড় দিয়ে মুছিয়ে দিলাম। তারপর কুশের অভাবে খড়ের বিছানায় বুড়িমার সেদিনের নির্দেশ মতো কঙ্কালটাকে পুব দিকে মাথা করে উপুড় করে শুইয়ে দিলাম (মনে পড়ল কঙ্কালটা আমার হাত থেকে পড়েছিল উপুড় হয়েই)। সর্বাঙ্গে চন্দন মাখিয়ে দিলাম। কেবলমাত্র হাড়ের ওপর কি চন্দন মাখানো যায়? গড়িয়ে পড়তে লাগল। তা আমি আর কি করব? সবটাই তো একটা পরীক্ষার ব্যাপার। এরপর ধূপ জ্বালালাম। তারপর কঙ্কালের ওপর কম্বলের আসন পেতে ঘোড়ায় চড়ার মতো বসলাম। অমনি হাড়গুলো নড়বড় করে উঠল। আমার তখনই কেমন ভয় ভয় করতে লাগল। কেননা আমি জানি ফাঁকি দিচ্ছি। শবসাধনার নামে কবেকার একটা বামনের কঙ্কাল নিয়ে ছেলেখেলা করছি। শবসাধনার নামে আমি কঙ্কাল সাধনা করছি।

তবু আমি নানারকম প্রাথমিক ক্রিয়াগুলি সেরে ফেললাম। তারপর চোখ বুজিয়ে গম্ভীরস্বরে মন্ত্রোচ্চারণ করলাম, ওঁ ফট। তারপর বললাম, ওঁ হুঁ মৃতকায় নমঃ। হে মৃত ব্যক্তি, তুমি যে-ই হও তোমাকে নমস্কার। তারপর তিনবার পুস্পাঞ্জলি দিলাম।

এইভাবে অনেক রাত পর্যন্ত ধ্যান করতে লাগলাম। অন্ধকার ঘরে শুধু পিদিমের আলো জ্বলছে। ধূপের ধোঁয়াগুলো অদ্ভুত আকৃতি নিয়ে চোখের সামনে নাচতে লাগল। আমার কেমন ভয় করতে লাগল। একটু পরেই মনে হলো কঙ্কালটা যেন নড়ছে। আমার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল, ঘামে গা ভিজে গেল।

দরকার নেই বাবা। মনে মনে এই কথা বলে এক লাফে নেমে পড়লাম।

ওটাকে ঐভাবে ফেলে রেখেই বাইরে থেকে দরজায় শেকল তুলে ওপরে উঠে এলাম। দরজা বন্ধ করার সময় স্পষ্ট শুনলাম কঙ্কালটার হাড়গুলোয় খট খট করে শব্দ হচ্ছে।

.

ভয়ংকরের জাগরণ

 এ ঘরে ঢুকি না বটে কিন্তু কী একটা তীব্র আকর্ষণ আমায় ঐ ঘরের দরজা পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়। আর এই আকর্ষণটা তীব্রতর হয়ে ওঠে সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে।

একদিন, তখন বেলা পড়ে এসেছে, নিচের তলাটা এরই মধ্যে অন্ধকার–আমি যেন আমার অজান্তই দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। গোটা বাড়িটা নিঝুম, নিস্তব্ধ। হঠাৎ মনে হলো ঘরের মধ্যে নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ। চমকে উঠলাম। এ তো মানুষের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস। কিন্তু

কিন্তু এ ঘরে মানুষ কোথায়? তবে কি কোনো জন্তু

না-না, এ জন্তু নয়, জন্তু ঢুকবেই বা কি করে? এ নিঃশ্বাস মানুষের। আমার মেরুদণ্ড দিয়ে একটা হিমস্রোত বয়ে গেল। সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়ে উঠল। বুঝতে পারলাম ঘরে জীবিত কেউ আছে।

ভয়ে তাড়াতাড়ি ওপরে উঠে এলাম। তারপর দরজা বন্ধ করে বিছানার ওপর পা গুটিয়ে বসে রইলাম।

এই বাড়িতে বেশ কিছুকাল ধরে একাই থাকি। কোনো দিন ভয় পাইনি। আজ মনে হলো এত বড় বাড়িতে আমি আর একা নই। অন্য কেউ আছে, সে আর যাই হোক মানুষ নয়। আমার গা-হাত-পা কাঁপতে লাগল।

সাধারণত মাঝরাতে আমার ঘুম ভাঙে না। কিন্তু সেদিন ঘটল ব্যতিক্রম।

অনেক রাতে ঘুম ভেঙে গেল। মনে হলো মাথার কাছে বন্ধ জানলাটা বাইরে থেকে। কেউ খোলবার চেষ্টা করছে। চমকে উঠে বসলাম–চোর নাকি?

আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে কান পেতে রইলাম।

কিছুক্ষণ কোনো শব্দ নেই। তার পরেই শব্দ–খটখট—

কেউ যেন জানলার পাল্লা ধরে টানছে।

আমি সর্বশক্তি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, কে?

শব্দটা থেমে গেল। কিন্তু মিনিট দুই পরেই অন্যরকম শব্দ হলো–ধুপ। কিছু একটা ভারী জিনিস যেন জানলা থেকে পড়ে গেল। অথবা কেউ লাফিয়ে পড়ল। তারপরেই শুকনো পাতা মাড়িয়ে কিছু যেন দ্রুত চলে গেল।

সে রাতে আর ঘুম হলো না। কে এসেছিল দোতলার জানলায়–কেনইবা জানলা খোলবার চেষ্টা করছিল কিছুই বুঝতে পারলাম না। হাতের কাছে টর্চ ছিল। কিন্তু জ্বালবার সুযোগ হয়নি।

সত্যিই কি চোর কিংবা ডাকাত উঠেছিল? কিন্তু চোরই হোক বা ডাকাতই হোক উঠবে কি করে? এ দিকের দেওয়াল থেকে জল পড়ার কোনো পাইপ নেই। আর দেওয়াল বেয়ে দোতলায় ওঠা কোনো মানুষের সাধ্য নয়। তবে কি লোকটা মই নিয়ে এসেছিল?

তা হতে পারে। কিন্তু নামবার সময়ে লাফ দিয়ে পড়ল কেন?

 কী জানি।

পরের দিন সকালে জানলার নিচে কোনো ফেলে যাওয়া মই দেখতে পাইনি।

এইভাবে নানা সংশয়ে সন্দেহে আমি যখন দোদুল্যমান তখনই আর একদিন রাতে এই কাহিনীর প্রথমেই যে ঘটনার উল্লেখ করেছি সেই ঘটনাটা ঘটল।

ইদানিং রাতে ভালো করে ঘুম হতো না। কেবলই মনে হতো আবার বুঝি কেউ জানলার কপাট খোলবার চেষ্টা করছে। চোর-ডাকাতে করছে জানলেও নিশ্চিন্ত হয়ে পারতাম। কেননা চোরের কাছ থেকে সাবধান, সতর্ক হওয়া যায়। কিন্তু অন্য কিছু হলে

দ্বিতীয় রাতের ঘটনায় কেউ একজন যেন কাঠের পা নিয়ে খট খট করে দোতলায় উঠে আসছিল। কে আসছিল? যে সেদিন জানলা ভেঙে ঘরে ঢোকবার চেষ্টা করছিল সেই কি?

যে আসছিল সে যে আমার মুখোমুখি দাঁড়াতে চায় সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু কেন? আমাকে তার কীসের দরকার?

একথা মনে হতেই ভয়ে আমার চুলগুলো খাড়া হয়ে ওঠে।

পরের দিন সকালেই নিচের ঘরের সামনে গিয়ে দেখি দরজা তেমনি শেকল ভোলাই রয়েছে। কিন্তু খিড়কির দরজাটা খোলা।

আশ্চর্য! কে খুলল দরজাটা? পিছনের দরজা তো বন্ধই থাকে।

আমি তখনই বেরিয়ে পড়লাম। এদিক-ওদিক ঘুরতে ঘুরতে নদীর ধারে চলে এলাম। হঠাৎ নজরে পড়ল বালির ওপর পায়ের চিহ্ন। সে পদচিহ্ন পূর্ণবয়স্ক মানুষের নয়, কোনো বালকেরও নয়। এক বিঘতেরও কম লম্বা কিন্তু বেশ গভীর। গভীরতা দেখে বোঝা যায় যার পায়ের চিহ্ন সে ওজনে ভারী। তা ছাড়া লক্ষ্য করলাম আঙুলগুলো অস্বাভাবিক ফাঁক ফাঁক। হাড়গুলো তুলনায় সরু।

আমি সেই পদচিহ্ন অনুসরণ করে চললাম শালবনের দিকে। কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে বেশিদূর চিহ্নগুলো খুঁজে পেলাম না।

ফিরে আসব ভাবছি হঠাৎ জঙ্গলের একপাশে পাঁচ-ছটা বাদুড় মরে পড়ে আছে দেখলাম। সব কটাই খণ্ড-বিখণ্ড। এতগুলো বাদুড় একসঙ্গে কি করে মরল আর কেই বা সেগুলোকে অমন করে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়েছে তা বোধগম্য হলো না। পরিষ্কার বোধগম্য না হলেও কেমন একটা সন্দেহ মনের মধ্যে খচখচ করতে লাগল। যিনি একদিন আমার জানলা ভাঙতে গিয়েছিলেন কিংবা গভীর রাতে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে চেষ্টা করেছিলেন সেই বামন-দেবতাটির কাজ নয় তো? ভাবতেও সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।

এতদিন নির্জন বাড়িতে একা একা বেশ ছিলাম। কী কুক্ষণে জলেশ্বর এসে আমার মাথায় মরণখেলার নেশা ঢুকিয়ে দিয়ে গেল!

বাড়ি ফিরেই শেকলবন্ধ দরজার কাছে এসে দাঁড়ালাম। দরজা খুলতে সাহস হলো না। জানলাটা একটু ফাঁক করে দেখলাম তিনি খড়ের বিছানায় দিব্যি শান্তভাবে শায়িত রয়েছেন।

কদিন পর সেটা ছিল বোধহয় রবিবার। আমার বাড়ি থেকে মাইল খানেক দূরে বাজারের দিকে যেতে যে ফাঁকড়া রাস্তাটা একটা বাঁক খেয়ে শালবনের দিকে গেছে সেই মোড়ে পৌঁছাতেই দেখলাম লোকের জটলা। সবারই মুখে-চোখে আতংকের ছাপ। ভাবলাম সাত-সকালে কী এমন ঘটল?

একে-ওকে জিজ্ঞেস করে যা জানলাম তা রীতিমতো ভয়ংকর ব্যাপার। গত রাতে কয়েকজন লোক শালবনের পাশ দিয়ে মড়া নিয়ে কবরখানার দিকে যাচ্ছিল। শববাহীরা আগে আগে চলছিল। পিছনে জনা তিনেক। তাদের হাতে লণ্ঠন, শাবল, কোদাল। হঠাৎ তারা নাকি দেখে মানুষের মতো একটা জীব–প্রায় কঙ্কালসার, তাদের পথ আগলে দাঁড়াল।

আমার বুকটা কেঁপে উঠল। কোনোরকমে একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, লোকটা লম্বায় চওড়ায় কিরকম?

সেও অদ্ভুত মশাই! এই আমার কোমর পর্যন্ত।

শুনে আমি ঢোঁক গিললাম।

 তারপর?

তার চোখ দুটো চিকচিক করে জ্বলছিল। হঠাৎ অন্ধকারে শালবনের মধ্যে ঐরকম একটা বীভৎস মূর্তি দেখে সকলে চিৎকার করে উঠেছিল। অদ্ভুত জীবটা অমনি লাফ দিয়ে মড়ার মাচায় উঠে মড়াটা টেনে নিয়ে বনের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। সবাই স্বচক্ষে দেখেছে মশাই।

তারপর?

শবযাত্রীরা তো পিশাচ পিশাচ বলে ভয়ে ছুটে পালিয়ে গেল।

আমি একরকম হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলাম, তারপর?

তারপর আজ সকালবেলায় মড়াটা ছিন্নভিন্ন অবস্থায় শালবনের ধারে পাওয়া গেছে। পুলিশ জায়গাটা ঘিরে আছে। একবার যান না। দূর থেকে দেখে আসুন।

উত্তর না দিয়ে আমি বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলাম। বুঝতে পারলাম শাস্ত্রর নিয়ম ঠিকমতো না মেনে শবসাধনার বদলে কঙ্কাল সাধনা করতে গিয়ে এই অদ্ভুত জীবের সৃষ্টি করে ফেলেছি। শুধু অদ্ভুত জীবই নয়, ওটা আবার ভয়ংকর মাংসাশী হয়ে উঠেছে। ও যে এখন কতজনের সর্বনাশ করবে তার ঠিক নেই। আমিও নিস্তার পাব না।

বাড়ি পৌঁছেই আমি নিচের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দরজা বন্ধই আছে। জানলা ফাঁক করে দেখলাম বামন বাবাজি তার কঙ্কালখানি নিয়ে শান্তভাবে পড়ে আছেন। বুঝলাম সারারাত ঘুরে শেষে এই ঘরেই এসে একটু বিশ্রাম নেন। এই ঘরটা যেন ওনার নিজের হয়ে গেছে।

সেদিন সকালবেলায় পাড়ার মুদির দোকান থেকে চাল-ডাল কিনতে গেলাম। দেখি কয়েকজন বসে গম্ভীরভাবে কি নিয়ে আলোচনা করছে। আমায় দেখে মুদির দোকানের মালিক রাজেন ঘোষ বললে, এই যে মল্লিকমশাই, খবর সব শুনেছেন তো?

বুঝতে পারলাম কি বলতে চাইছে। তবু না বোঝার ভান করে বললাম, কী খবর?

সে কি মশাই, গোটা গায়ে হৈ-চৈ পড়ে গেছে, লোকে ভয়ে কাঁপছে আর আপনি কিছুই জানেন না?

আমতা আমতা করে বললাম, ও হা, শুনেছি বটে কোথা থেকে একটা পিশাচ দেখা দিয়েছে।

শুধু পিশাচ? ওটা না পুরোপুরি পিশাচ, না ব্রহ্মদত্যি, না ভূত। পশু-পাখি, জীবজন্তু যা পাচ্ছে তাই খাচ্ছে। এমনকি মড়া পর্যন্ত। এবার জ্যান্ত মানুষ ধরে ধরে খাবে।

আমি চুপ করে শুনে গেলাম। বেশি কথা বলতে সাহস পেলাম না। কিন্তু মারাত্মক খবরটা দিল র‍্যাশনের দোকানের কমল গড়াই। বললে তার স্ত্রী নাকি অনেক রাতে আমার বাড়ির কাছে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছিল স্রেফ হাত দুয়েক লম্বা একটা জ্যান্ত কঙ্কালকে। মাথাটা তার ইয়া বড়।

আশ্চর্য হয়ে বললাম, আমার বাড়ির কাছে?

হ্যাঁ। আপনি একটু সাবধানে থাকবেন।

চাল-ডাল কিনে চুপচাপ বাড়ি চলে এলাম।

একদিন বিকেলে আকাশ ছেয়ে মেঘ করেছে। সেই সঙ্গে শুরু হলো ঝড়। জানলা বন্ধ করতে গিয়ে দেখি, ছাদের আলসেতে আমার কাপড় শুকোতে দিয়েছিলাম, সেটা উড়ে যাচ্ছে।

কী আশ্চর্য! আমি কাপড়টা গিঁট বেঁধে দিইনি?

কাপড়টা দিব্যি বাতাসে ঢেউ খেলিয়ে উড়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি নিচে নেমে কাপড়টা উদ্ধার করতে ছুটলাম। কাপড়টা গিয়ে একটা আমগাছের ডালে আটকে গেল। কোনোরকমে ডিঙি মেরে একটা কঞ্চির সাহায্যে ওটা পেড়ে নিলাম।

প্রচণ্ড ঝড়ের মধ্যে বাড়ি ফিরে দোতলায় উঠতে যাচ্ছি–খট খট শব্দ। তাড়াতাড়ি থামের আড়ালে লুকোলাম। দেখলাম কঙ্কালটা সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে। ভাগ্যি আমি ওপরে ছিলাম না।

অদ্ভুত আকৃতির কঙ্কালটা তার দেহটা টানতে টানতে আর বিরাট মাথাটা নাড়তে নাড়তে নির্দিষ্ট ঘরের দিকে চলে গেল। হয়তো এবার ও নিজেই শেকল খুলে ঘরে ঢুকবে।

ও তাহলে দোতলাতেও উঠতে আরম্ভ করেছে। এইটে আরও ভয়ের ব্যাপার। ও আমাকে খুঁজছে। কেন? নিশ্চয় আমার সঙ্গে গল্প করার জন্যে নয়।

আমার হাত-পা হিম হয়ে গেল। এরপর একা বাড়িতে এই মূর্তিমান আতকংটির সঙ্গে থাকব কি করে? না থেকেই বা যাব কোথায়? চিরকালই তো আমি লোকালয় থেকে দূরে থেকেছি। কিন্তু একটা কথা ভেবে পাচ্ছি না–কঙ্কালটা এমন হিংস্র হয়ে উঠল কেন? এর পেছনে কি কোনো ইতিহাস আছে?

যার কাছ থেকে এটা কিনেছিলাম সে বলেছিল এটা নাকি এককালের সাংঘাতিক বামন দৌলত খাঁর কঙ্কাল।

সে কতকাল আগের? কী এমন সাংঘাতিক কাজ করেছিল দৌলত খা?

ভাবলাম ওর ইতিহাস আমায় জানতেই হবে। আর এটা জানাতে পারে সেই ব্যবসায়ীটিই।

সেইদিনই আমি ব্যবসায়ীর সঙ্গে দেখা করতে অনেক দূরে এক অখ্যাত গ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম।

.

পর্বতনিবাসী দৌলত খাঁ

 ব্যবসায়ীর নাম ইদ্রিশ আলি। এদিনও সে পরনে লুঙ্গি জড়িয়ে একজনের সঙ্গে বাড়ি মেরামতির খরচ-খরচার হিসেব কষছিল। আমাকে চিনতে পারেনি। একটু বসতে বলে লোকটির সঙ্গে কথাবার্তা শেষ করে আমার দিকে তাকাল।

বলুন স্যার।

আমার পরিচয় দেবার পর ও মনে করতে পারল। সঙ্গে সঙ্গে গলার স্বর বদলে ফিস ফিস করে বলল, জিনিসটা ভালোই দিয়েছিলাম কি বলুন? আপনার ডাক্তারি শেখা হচ্ছে তো?

প্রকৃত ঘটনা চেপে গিয়ে বললাম, এ তো সাংঘাতিক জিনিস ভাই। ওটা মাঝে মাঝে নড়ছে।

ইদ্রিশ আলি চমকে উঠল। বলেন কী?

বললাম, হ্যাঁ, সত্যি। নইলে এতদূর ছুটে আসব কেন?

 ইদ্রিশ অবাক হয়ে বললে, কিন্তু আমার কাছে এতদিন ছিল, কখনও তো নড়তে দেখিনি।

তারপর বলল, যাই হোক সাবধান, ওটা শুনেছি দৌলত খাঁর কঙ্কাল। সাংঘাতিক বামন ছিল। কত যে খুন করেছিল তার হিসেব নেই। ওটা কিন্তু আর ফেরত নিতে পারব না।

বললাম, ফেরত দেবার কথা ভাবছি না। আমি এসেছিলাম ঐ দৌলত খাঁর কথা জানতে। খুব কৌতূহল হচ্ছে। আপনি কি কিছু জানাতে পারেন?

ইউদ্রিশ আলি বললে, ঐ যতটুকু বললাম তার চেয়ে বেশি জানি না। জানবার ইচ্ছেও নেই। আমি গোপন ব্যবসা করি এই পর্যন্ত। তাছাড়া দৌলত খাঁর ব্যাপার তো বহুকাল আগের।

বললাম, ওর সম্বন্ধে আর কেউ বলতে পারেন কি?

ইদ্রিশ একটু ভেবে বললে, যার কাছ থেকে এটা পেয়েছিলাম হয়তো একমাত্র সেইই বলতে পারে।

তার ঠিকানাটা আমায় দেবেন? বলেই পাঁচটা একশো টাকার নোট ওর হাতে গুঁজে দিলাম।

ইদ্রিশ যে খুশি হলো তা ওর চোখ-মুখ দেখেই বুঝতে পারলাম।

ও বললে, তা না হয় দিচ্ছি। কিন্তু সে তো অনেক দূর। সেই জম্মু-কাশ্মীর পহেলগাম্ ছাড়িয়ে আচ্ছাবা। আপনাকে অবশ্য প্রথমে জম্মুতেই নামতে হবে। তারপর

বললাম, যত দূরই হোক দৌলত খার ইতিহাসটা আমায় জানতেই হবে।

ইদ্রিশ ঠিকানা লিখে দিল। ঠিকানাটা নিয়ে আমি চলে আসছিলাম, ইদ্রিশ পিছু ডাকল, আরে ও মশাই! শুধু ঠিকানা পেলেই হবে? যারা কবর খুঁড়ে পুরনো কঙ্কাল বের করে তারা যে কী সাংঘাতিক তা ভাবতে পারবেন না। পুলিশের স্পাই মনে করে ওরা হয়তো জ্যান্ত পুঁতে ফেলে আপনাকেই কঙ্কাল বানিয়ে দেবে।

আমি হতাশ হয়ে বললাম, তা হলে উপায়?

দাঁড়ান, একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি, বলে আমার সামনে বসেই উর্দুতে একটা চিঠি লিখে দিল। তারপর খামের ওপর একটা লাল ছাপ মেরে দিল।

এবার নিশ্চিন্ত মনে যান। দেখবেন চিঠিটা যেন না হারায়। তবু যদি বিপদে পড়েন তাহলে বলবেন, ইদ্রিশের মাথায় একগাদা উকুন হয়েছে, মনে থাকবে?

হেসে বললাম, হাঁ ধন্যবাদ।

 বুঝলাম কথাটা সাংকেতিক।

ইদ্রিশ ফের ডেকে বলল, আর শুনুন, এইভাবে ধুতি-পাঞ্জাবি-পরা বাবু সেজে গেলে সন্দেহ এড়াতে পারবেন না। ফকির সেজে যাবেন। বলবেন দেশভ্রমণ করেন। নানা জায়গার কবরের উপর কেতাব লিখবেন।

আমি বললাম, তাই করব। কিন্তু ফকির কেতাব লিখবে।

কেন? ফকির হলে বুঝি পড়া-লেখা জানতে নেই?

তা বটে। ধন্যবাদ জানিয়ে চলে এলাম।

.

ফকির, সন্ন্যাসী সাজা আমার পক্ষে কোনো ব্যাপার নয়। জীবনের বেশির ভাগ সময়ই তো আমি সাধু-সন্ন্যাসী সেজে ঘুরে বেড়িয়েছি, এবার না হয় ফকির সাজলাম। বড়ো বড়ো চুল তো ছিলই। অল্প দাড়ি, একটু ছেটে কেটে ঠিক করে নিলাম। কালো একটা আলখাল্লা পরলাম। কালো একটা বড়ো ঝুলি, চোখে সুর্মা, গলায় কাচ-পাথরের মালা। ব্যস, একেবারে নির্ভেজাল ফকির বনে গেলাম। তারপর একদিন শেয়ালদা থেকে জম্মু-তাওয়াই এক্সপ্রেসে চড়ে বসলাম। মনে বেশ আনন্দ। কত দিন পর দেশভ্রমণে চলেছি। তা ছাড়া ঐ হতভাগা কঙ্কালটার হাত থেকেও কিছুদিন রেহাই পাব।

পাক্কা দুরাত্তির কাটিয়ে জম্মু। সেখানে সকালে বাসে উঠে শ্রীনগর। রাত্তিরটা একটা ছোটোখাটো হোটেলে কাটিয়ে পরের দিন পহেলগা। সেখান থেকে মাটান হয়ে আচ্ছাবা।

আঁকাবাঁকা পাহাড়ী রাস্তা। মাঝে মাঝে ঝর্ণা। গোড়ালি ডোবা সরু নদী। কখনও কখনও ছোট ছোট ঘরবাড়ি। এখানেই রয়েছে মোগল বাগান। কাছের ভৃঙ্গী নদীর জলধারা পাহাড় ভেঙে এখানে ঝর্ণা হয়েছে। আর এখানেই ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দে শাহজাহান-কন্যা মোগল উদ্যান তৈরি করলেন যার সুন্দর সবুজ লনে কেয়ারি করা অজস্র রঙ-বেরঙের ফুলের মাধুর্য ছড়িয়ে আছে, স্বপ্নের মতো।

কিন্তু প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করার মতো মনের অবস্থা তখন আমার ছিল না। জালালুদ্দিনের ঠিকানা খুঁজে বের করতেই হবে। জানতে হবে বামন দৌলত খাঁর ইতিহাস। এটা খুব সহজ কাজ নয়।

অনেক খোঁজাখুঁজির পর জালালুদ্দিনের সন্ধান পেলাম। এখানে ছোটো একটা সরাইখানা চালায়। যেমন লোক দেখানো রাজমিস্ত্রির কাজ ইদ্রিশের।

একটা ছোটো ঘরে বসে ছিল তিনজন। লম্বা-চওড়া চেহারা। চোয়াল শক্ত। চোখগুলো সাপের মতো। এরা যে শুধু পুরনো কবর খুঁড়ে কঙ্কাল চুরি করে তা নয়, বোধ হয় আরও কিছু ভয়ানক কাজটাজ করে।

চিঠিটা একজনের হাতে দিয়েই খামের ওপর নাম পড়ে সে আর একজনকে দিল। তার একটা চোখ কানা। সম্ভবত সেই জালালুদ্দিন, কেননা চিঠিটা সেই খুলে পড়ল।

চিঠিটা পড়ে সে প্রথমে একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। তারপর চিঠিটা অন্যদের হাতে দিল। চিঠিটা তিনজনেই পড়ল। এবার আমাদের কথাবার্তা শুরু হলো। ওরা উর্দু-হিন্দি মিশিয়ে কথা বলছিল। ভাঙা ভাঙা বাংলাও জানে। ওদের প্রশ্ন করার ভঙ্গি থেকে বুঝলাম, আমি যে কেতাব লেখার জন্যে দৌলত খাঁর ইতিহাস জানতে চাইছি তা ওরা বিশ্বাস করছে না। শুধু অবিশ্বাস করাই নয় আমি যে একটা প্রতারক এমন সন্দেহও করছিল। আমি ওদের বোঝাতে চাইলাম, চিঠিটি ইদ্রিশ আলি নিজে লিখেছে। হাতের লেখা মিলিয়ে দ্যাখো।

সে কথার উত্তরে একজন বলতে চাইল, চিঠিটা জাল হতে পারে।

বললাম, কিন্তু লাল ছাপটা?

ওটা ইদ্রিশের বলেই মনে হয়।

তা হলে?

ওরা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। সন্দেহ তবু ঘোচে না। আমাকে পুলিশের লোক ভেবেছে। আমি যে পুলিশের লোক নই তা প্রমাণ করতে না পারলে আমায় মরতে হবেই। আমি করুণ চোখে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

আচ্ছা ফকিরসাহেব, ইদ্রিশ কি আর কিছু বলেছে আপনাকে?

কই না তো। বলেছে এই চিঠিখানা দিলেই তুমি যা জানতে চাইছ তা জানতে পারবে।

 ওদের একজন খেঁকিয়ে উঠে বলল, ব্যস। আর কিছু বলেনি?

না, আবার কী বলবে?

ওরা তিনজন চোখে চোখে কথা বলে নিল। বুঝলাম বিপদ আসন্ন।

ওরা বলল, চলুন ফকিরসাহেব, বিশ্রাম করবেন। বলে আমায় পাশের একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে দিল।

আমি প্রমাদ গুণলাম। বুঝলাম আমার আর মুক্তি নেই। আমায় ওরা বিশ্বাস করছে না।

দুদিন কেটে গেল বন্দী অবস্থায়। আমার কেবলই মাথায় ঘুরছিল ইদ্রিশ কি আর কিছু বলেছিল?

না। আর কি বলবে?

ও হাঁ, বলেছিল ফকিরের বেশ ধরতে হবে। তা তো আমি ধরেছি। কিন্তু আর তো কিছু বলেনি।

সেদিন দুপুরবেলায় ওদের একজন ঘরে ঢুকে উর্দু-হিন্দি মিশিয়ে যে কথাটা বললে, বাংলা করলে তা দাঁড়ায় এইরকম–

কি ফকিরসাহেব, কি মতলবে এসেছ খোলাখুলি বলো তো।

 বললাম, ইদ্রিশের চিঠিতেই তা লেখা আছে।

ও চিঠি জাল।

না, জাল নয়।

জাল যদি নাই হয় তা হলে ইদ্রিশ আর কি বলেছে বলো।

না, ও আর কিছু বলেনি।

লোকটা হা হা করে হেসে উঠল। বলল, তা হলে তুমি ধাপ্পাবাজ। আর ধাপ্পাবাজের শাস্তি কি জানলা দিয়ে তাকিয়ে দ্যাখো।

দেখলাম দুজন লোক একটা জায়গায় কোদাল দিয়ে মাটি কোপাচ্ছে।

হায় ভগবান! ওরা আমার কবর খুঁড়ছে।

লোকটা দরজায় তালা বন্ধ করে চলে গেল। আর আমি আসন্ন মৃত্যুর কথা ভেবে গুম হয়ে রইলাম। কী কুক্ষণে ঐ বামনের কঙ্কালটার ইতিহাস জানতে এসেছিলাম! এর চেয়ে ওটার হাতে মরণ ভালো ছিল। তবু নিজের বাড়িতে মরতে পারতাম। কিন্তু..ইদ্রিশ যেন আরও কি বলেছিল। ইস্! মনে পড়ছে না তো। হ্যাঁ, বলেছিল চিঠি পড়েও যদি ওরা বিশ্বাস না করে তা হলে বলো

কী যেন বলতে বলেছিল….ইদ্রিশের কি একটা রোগ হয়েছিল? উদরি? ভিরমি? মাথার গণ্ডগোল? না–না, রোগটোগ নয়, তা হলে? তা হলে যে কী তা কিছুতেই মনে পড়ল না–একটা সাংঘাতিক কথা….

সামান্য একটা কথা ঠিক সময়ে কিছুতেই মনে না পড়লে তার যে কী অপরিসীম যন্ত্রণা

এমনি সময়ে দরজা খুলে তিনজনই ঢুকল। হাতে ছোরা।

ফকিরসাহেব!

হা হা, মনে পড়েছে ইদ্রিশ কিছু একটা বলেছিল, কিন্তু আমি মনে করতে পারছি না। আমায় একটু সময় দাও।

না। তুমি মিথ্যেবাদী! বলে একজন আমার চুলের মুঠি ধরতেই আমার স্মৃতির দরজা হাট করে খুলে গেল। অমি চিৎকার করে বলে উঠলাম, মনে পড়েছে ….মনে পড়েছে– ইদ্রিশ বলেছিল ওর মাথায় একগাদা উকুন হয়েছে।

ব্যস! যেই একথা বলা অমনি যেন জোঁকের মুখে নুন পড়ল। ওরা ছোরা ফেলে দিয়ে আমার পায়ে আছড়ে পড়ল। বলল, ফকিরসাহেব ক্ষমা করো। আমাদের ভুল হয়েছিল।

তারপর আমার দারুণ খাতির, খানাপিনা, আদর-আপ্যায়ন

সে সব মিটতে জালালুদ্দিন দৌলত খাঁর সুদীর্ঘ ইতিহাস আমায় যা শোনাল তা সংক্ষেপে এইরকম–

অনেক দিন আগে একবার নেপালের রাজা হিমালয়ের সংলগ্ন গাড়োয়াল রাজ্য আক্রমণ করেন। গাড়োয়ালরাজ যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে নিজের রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে যান। নেপালীরা রাজপ্রাসাদ, দুর্গ দখল করে যথেচ্ছ অত্যাচার চালায়।

গাড়োয়ালরাজ উপায়ান্তর না দেখে ইংরেজের সঙ্গে সন্ধিস্থাপন করেন। আর ইংরেজদের সাহায্যে নেপালীদের তাড়িয়ে গাড়োয়ালকে ফের স্বাধীন করেন। কিন্তু এর জন্যে ইংরেজকে গাড়োয়ালের অনেকখানি দিয়ে দিতে হয়। এই অংশ ব্রিটিশ গাড়োয়াল নামে পরিচিত হয়। বাকি অংশ স্বাধীন গাড়োয়াল।

গাড়োয়ালরাজ কিন্তু তাঁর রাজধানীতে আর ফিরে এলেন না। রাজধানী থেকে বত্রিশ মাইল উত্তর-পশ্চিমে অলকানন্দার অপর পারে টিহরীতে নতুন করে রাজধানী স্থাপন করেন। তাঁর নতুন পরিচয় হলো টিহরীরাজ।

গাড়োয়ালের মধ্যে দেবপ্রয়াগ একটি প্রসিদ্ধ স্থান। এখানে একটি পুরনো মন্দির আছে। তার মধ্যে রামসীতার মূর্তি। এই মন্দিরের অধিকারী টিহরীর রাজা। মন্দিরে অনেক ধনসম্পত্তি লুকনো আছে। টিহরী রাজ্যের নিয়ম–রাজার মৃত্যু হলে তাঁর নিজের ব্যবহারের সব জিনিস এই মন্দিরে রাখা হয়।

এই গাড়োয়ালের এক পর্বতগুহায় একটা অদ্ভুতদর্শন লোক ছিল। আকারে বেঁটে। মাথাটা দেহের তুলনায় অনেক বড়ো৷ সেই মাথায় রোঁওয়া রোঁওয়া চুল। ভয়ংকর দুটো চোখ। আঙুলে হিংস্র জন্তুদের মতো বাঁকানো নখ। সে লোকালয়ে বড়ো একটা আসত না। জীবজন্তু মেরে খেত। ক্ষুদে রাক্ষসজাতীয় আর কি।

যারা তাকে দেখেছিল তারা ভয়ে পালাত। তার কি জাত কি ধর্ম তা কেউ জানত না। তার একমাত্র পরিচয় ছিল পাহাড়ী শয়তান। কত যে তার বয়সে কেউ বুঝতে পারত না। কে যে কেন তার নাম দৌলত খাঁ রেখেছিল তাও জানা যায় না।

ক্রমে সে লোকালয়ে আসতে আরম্ভ করল। ইচ্ছে করলেই অসাধারণ তৎপরতায় সে মানুষ খুন করতে পারত।

ওদিকে নেপালরাজ প্রতিশোধ নেবার জন্যে নানারকম ফন্দি আঁটছেন। তিনি যখন দৌলত খাঁর মতো হিংস্র বামনের কথা শুনলেন তখন গোপনে তাকে ডেকে পাঠালেন। তার ওপর ভার দেওয়া হলো টিহরীরাজ্যে সন্ত্রাস চালাতে হবে যাতে টিহরীরাজ জব্দ হন।

দৌলত খাঁর এটা বেশ মনের মতো কাজ হলো। অহেতুক নরহত্যায় ওর দারুণ আনন্দ। গভীর রাতে সে টিহরীর পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। যাকেই পায় তীক্ষ্ণ নখ দিয়ে নৃসিংহ অবতারের মতো পেট চিরে ফেলে। অথচ তাকে কেউ ধরতে পারে না। ধরতে পারে না তার কারণ রাতের অন্ধকারে সে তার ছোট্ট দেহটা নিয়ে চটপট লুকিয়ে পড়তে পারে। শুধু তাই নয়, দুমিনিটের মধ্যে গাছে ওঠা বা উঁচু পাঁচিলে ওঠা তার পক্ষে কিছুই নয়।

এমনি ভাবে কত যে সে নরহত্যা করেছে তার হিসেব নেই।

এমনি সময়ে নেপাল থেকে রাজার এক চর ওর কাছে এসে বলল, রাজার ইচ্ছে দেবপ্রয়াগে টিহরীরাজের রামসীতার মন্দিরে যে বিপুল ধনসম্পত্তি আছে তা এনে দিতে হবে।

দৌলত খাঁর ধনদৌলতে লোভ ছিল না। টাকা-পয়সা নিয়ে কী করবে? তার আনন্দ ছিল লুঠপাট, খুন-খারাপিতে।

নেপালরাজের আদেশ পাওয়া মাত্র সে একদিন রামসীতার মন্দিরে অভিযান চালালে। সেই মন্দিরে একজন সাধক থাকতেন। দৌলত খাঁ তাকে হত্যা করতে গেল আর ঠিক তখনি মন্দিরের ভেতর থেকে একটা বিষধর সাপ সাধকের কোলের ওপর দিয়ে এসে দৌলত খাঁকে কামড়ে দিল। মরবার মুহূর্তে দৌলত খাঁ বুঝে গেল ঐ সাধকই তাকে মেরেছে।

এই হলো দৌলত খাঁর ইতিহাস। তারই কঙ্কাল আমার বাড়িতে দিব্যি অধিষ্ঠান করছে।

.

জলেশ্বরের পুনরাবির্ভাব

এক বুক দুর্ভাবনা নিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরে এলাম। কঙ্কালটা কেন যে এত ভয়ংকর হিংস্র তা বুঝতে পারলাম। এও বুঝলাম যেহেতু একজন সাধক তার মৃত্যুর কারণ সেজন্যে দৌলত খাঁর হাত থেকে আমারও নিষ্কৃতি নেই। অথচ দিনের পর দিন দৌলত খাঁর কঙ্কালের সঙ্গেই আমায় থাকতে হবে। কিভাবে ওটার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাব তা ভেবে পেলাম না।

এখানে পৌঁছবার পর দিনই শহরে গিয়ে মিস্ত্রি ডেকে এনে দোতলায় সিঁড়ির মুখে আর প্রত্যেকটা জানলায় মোটা গ্রিল বসিয়ে নিলাম। অনেকটা নিশ্চিন্ত হলেও পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারলাম না। লোহার গ্রিল দিয়ে চোর-ডাকাত ঠেকানো যায়, কিন্তু প্রেতাত্মা? আধুনিক গেট, গ্রিল কি ওদের আটকাতে পারে?

তাহলে?

আমি গ্রামের মানুষ। ভূত-প্রেতের বহু ঘটনা জানি। ওঝারা কি করে ভূত তাড়ায় তাও আমি দেখেছি। তাই তখনই একটা উপায় মাথায় খেলে গেল। বাঁশঝাড় থেকে একটা কাঁচা বাঁশ কেটে এনে তার দুপ্রান্ত খানিকটা পুড়িয়ে নিলাম। তার পর বাঁশটা একতলার সিঁড়ির মুখে আড়াআড়ি করে ফেলে রাখলাম। ওঝাদের মুখে শুনেছি কোনো অশরীরীর ক্ষমতা নেই এই বাঁশ ডিঙোয়।

এবার প্রায় পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘরের দরজায় কোলপসিবল গেট, গ্রিল বন্ধ করে একরকম স্বেচ্ছাবন্দী হয়ে বসে থাকি। রান্না থেকে আরম্ভ করে সব ব্যবস্থাই দোতলায় করে নিয়েছি। ঠিক করেছি খুব দরকার না হলে নিচে আর নামব না।

ভেবেছিলাম এই দুর্ভেদ্য দুর্গে এবার আমি নিশ্চিন্তে রাত কাটাতে পারব। কিন্তু পারিনি। প্রায় রাত্তিরে আমার ঘুম ভেঙে যায়। শুনতে পাই একতলার বারান্দায় কেউ যেন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অনেকটা খাঁচায় বদ্ধ হিংস্র সিংহের মতো। কেউ যেন দোতলায় ওঠবার বার বার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না।

আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে পড়ে থাকি বিছানায়। তার পরেই খিড়কির দরজা খোলার শব্দ। কেউ যেন বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।

বাকি রাতটুকুর জন্যে নিশ্চিন্ত। ও এখন পথেঘাটে জঙ্গলে শিকার খুঁজে বেড়াবে।

কিন্তু….এভাবে কত দিন চলতে পারে? এমনি সময়ে একদিন দুপুরে হঠাৎ জলেশ্বর এসে হাজির। দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল থেকে সাদা দাঁতগুলো বের করে হাসছে।

এই লোকটাকে আমি সহ্য করতে পারি না। লোকটা নিষ্ঠুর, হিংসুটে, বদমেজাজী। সেই নিরীহ সাধুটাকে এমন চড় মেরেছিল যে সে বেচারি মরেই গিয়েছিল। লোকটা মতলববাজও। আমার কত টাকা-পয়সা আছে তা জানতে কৌতূহলী খুব।

তবু আমার এই দুঃসহ নিঃসঙ্গতার মধ্যে ও যখন এসে দাঁড়াল তখন খুশিই হলাম। ওর হাত দুটো ধরে সাবধানে বাঁশটা ডিঙিয়ে ওপরে নিয়ে এলাম।

এখানে আবার বাঁশ কেন?

আমি সত্যি কথাটা চেপে গিয়ে বললাম–হ্যাঁ, ওটা সরিয়ে রাখতে হবে।

ও ওপরে এসে কাঁধের ঝুলিটা বিছানায় রেখে দুপা তুলে জাঁকিয়ে বসল।

আমি ওকে এ কদিনের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা বলব কিনা ভাবছিলাম। ও যা সাংঘাতিক লোক, আমার অন্তত অর্ধেক সিদ্ধির কথা জানলে হিংসেয় জ্বলে মরবে। আর ওর হিংসের ফল আমার পক্ষে ক্ষতিকর হবেই। আবার না বলেও পারছিলাম না। নিজের কৃতিত্বের কথা সবাই জাহির করতে চায়।

বলব কি বলব না ভাবছি, শেষ পর্যন্ত জলেশ্বরই পথ পরিষ্কার করে দিল।

তোমার দরজায় কোলাপসিবল গেট কেন? আরে! জানলাতেও দেখছি গ্রিল! চোরের উৎপাত হচ্ছে নাকি?

আমি আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। আবেগে উৎসাহে বললাম, চোর-ডাকাত নয় ভাই, আরও আরও ভয়ংকর। বলে হড়বড় করে সব ঘটনা বলে গেলাম। বললাম না শুধু দৌলত খাঁর কাহিনী।

শুনে জলেশ্বরের চোখ দুটো লাফিয়ে উঠল, বল কী হে!

জলেশ্বর কঙ্কালটা দেখতে চাইল। ওকে নিয়ে নিচের ঘরে গেলাম। ও কিছুক্ষণ ওটা দেখল। তারপর ওপরে এসে বলল, এ তো সাংঘাতিক জিনিস। বামনের কঙ্কাল তো পাওয়াই যায় না।

এর পর সরাসরি বলল, এটা নিয়ে তুমি খুব অশান্তিতে আছ বলে মনে হচ্ছে। এটা না হয় আমাকে দিয়ে দাও। অত টাকা অবশ্য আমার নেই–

ওকে দিয়ে দিতে পারলেই আমি নিশ্চিন্ত হতাম-দেওয়াই বোধ হয় উচিত ছিল। কিন্তু কেন যেন দিতে মন সরল না।

আশ্চর্য! যে জিনিসটা আমার নিত্য ভয়ের কারণ, যার গতি হলে আমি স্বস্তি পেতাম সেটা আমি ওকে দিতে পারলাম না। যেটাকে আমি তিল তিল করে তৈরি করেছি, যাকে নিয়ে ভয়ংকর পরীক্ষা করেছি, সেটা যেন একমাত্র আমারই সম্পত্তি। আরও স্পষ্ট কথা হলো এই যে, জলেশ্বর মানুষটা লোভী। আমার তৈরি জিনিস দেখে বাগাবার চেষ্টা করছে।

জলেশ্বর বলল, কি ভাবছ এত? ওটা আমায় দাও। পুরো টাকা আর একদিন এসে দিয়ে যাব।

আমি পরিষ্কার গলায় বললাম, না, ওটা আমি দিতে পারব না।

জলেশ্বর যেন গালে চড় খেয়ে থমকে গেল, মুখটা রাগে, অপমানে থমথম করতে লাগল। বললে, ঠিক আছে। তোমার জিনিস তোমারই থাক। এই বলে জলেশ্বর গুম হয়ে বসে রইল।

বসে রইল তো বসেই রইল। ওঠার আর নামই করে না। এদিকে বেলা পড়ে আসছে। একটু পরেই সন্ধ্যে হবে। তখন ও যাবে কি করে? অথচ ও আমার সঙ্গে থাকুক আমি তা মোটেই চাই না।

এমনি সময়ে ও গা-ঝাড়া দিয়ে উঠল। হেসে বলল, আজ রাতটা যদি তোমার কাছে থাকি অসুবিধে হবে?

আমাকে বলতেই হলো, কিছুমাত্র অসুবিধে হবে না।

তবু জলেশ্বরের মতো সাংঘাতিক একটা লোককে নিয়ে একসঙ্গে রাত্রিবাস করা যে কী ভয়ংকর ব্যাপার তা অন্যে বুঝতে পারবে না। ভয়ে ভয়ে প্রায় গোটা রাতটা জেগে কাটালাম।

মুখের ওপর রোদ এসে পড়তেই ঘুম ভেঙে গেল। ধড়মড় করে উঠে বসলাম। দেখি জলেশ্বর আগেই উঠে গেছে। নিজেকে ধিক্কার দিলাম, ছি ছি অতিথি আগে উঠে যাবে আর বাড়ির কর্তা পড়ে পড়ে ঘুমোবে? ছিঃ! ওর মুখ ধোওয়ার জল দিতে হবে, সকালের জলযোগের ব্যবস্থা করতে হবে–

ভাবতে ভাবতে ওর খোঁজ করতে গেলাম। কিন্তু দোতলা একতলা কোথাও তার দেখা পেলাম না। ভাবলাম হয়তো নদীর ধারে গেছে। অপেক্ষা করে রইলাম। কিন্তু সে আর ফিরল না।

অবাক কাণ্ড! এভাবে না জানিয়ে চলে যাবার কারণ কি?

একতলায় এসে ঘুরতে ঘুরতে কোণের ঘরের সামনে এসে দেখি দরজাটা খোলা। কঙ্কালটা নেই।

কঙ্কালের কি হলো বুঝতে বাকি রইল না। জলেশ্বরকে খুব দোষ দিই না। সে চেয়েছিল, আমি দিইনি। কাজেই চুরি করা ছাড়া তার উপায় ছিল না।

যাই হোক কঙ্কালটার একটা গতি হলো। সৎপাত্রে পড়েছে। তবুও নির্মম সত্য এই যে, জলেশ্বর ওটা চুরি করেছে। ও চোর। আমারই কাছে এক রাত থেকে আমারই সাধনার ধন নিয়ে পালিয়েছে। ও বিশ্বাসঘাতক! ওর ক্ষমা নেই।

.

বেশ কিছুদিন কেটে গেছে।

জলেশ্বরের আর দেখা নেই। দেখা দেবেই বা কোন লজ্জায়? কিন্তু আমার কৌতূহল ক্রমশ বেড়েই উঠছে। এটা নিয়ে ও কি করছে? সিদ্ধি হয়েছে? নাকি চড়া দামে কোথাও বেচে দিয়েছে? ওর তো অসাধ্য কিছুই নেই।

আর দৌলত খাঁ সাহেব? তিনি কি একটার পর একটা জীবহত্যা করেই চলেছেন?

সেটা ছিল বুধবায়। ভোরের দিকে মেঘ করেছিল বলে বেলা বুঝতে পারিনি। হঠাৎ বাইরের দরজায় জোর ধাক্কাধাক্কি। ধড়মড় করে উঠে নিচে নেমে গেলাম। দেখি বেশ কয়েকজন লোক জড়ো হয়েছে। উত্তেজনায় তারা থমথম করছে।

কি ব্যাপার?

মুদির দোকানের রাজেন ঘোষ, র‍্যাশনের দোকানের কমল গড়াই, আরও কয়েকজন এগিয়ে এসে বলল, একটা ডেড বডি পড়ে আছে।

ডেড বডি! চমকে উঠলাম।

আজ্ঞে হ্যাঁ।

কার?

তা তো জানি না। আপনার বাড়ির পিছনে তেঁতুল গাছটার তলায়। আপনি চেনেন কিনা দেখে যান।

ভয়ে ভয়ে গিয়ে দেখলাম।

না দেখলেই ভালো হতো। বীভৎসভাবে বিকৃত একটা মৃতদেহ। ঘাড়টা ভেঙে ঝুলছে। মুখ-চোখ ক্ষতবিক্ষত। চেনার উপায় নেই। তবু যে চিনলাম তা তার বিরাট দেহ আর দাড়ি গোঁফ দেখে।

কিন্তু মুখে বললাম, না, চিনি না।

বাড়ি ফিরে নিচের ঘরের দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম দরজা খোলা। জলেশ্বরকে শেষ করে মাটিতে শুয়ে আছে দৌলত খাঁর কঙ্কালখানা….আগের মতোই।

.

শেষ গতি

 কিন্তু এভাবে একটা ভয়ংকর কঙ্কালকে নিয়ে তো চলতে পারা যায় না। প্রতি রাত্তিরেই ও বেরিয়ে যায়। আবার রাত থাকতে থাকতেই এই ঘরে অধিষ্ঠান করে। এখানেই যেন ওর ডেরা। অবশ্য ওর সৃষ্টির মুহূর্ত থেকেই ও তো এই ঘরটাকেই জানে। এটাই ওর সূতিকাগার–এটাই ওর নতুন জন্মভূমি।

এখন আর এক দুশ্চিন্তা–এটাকে নিয়ে কি করব? কোথায় ফেলব?

সেদিন অনেক রাতে গায়ে একটা হিমশীতল স্পর্শ পেয়ে ঘুমটা অতর্কিতে ভেঙে গেল। চমকে উঠলাম। এ কী! ঘরের মধ্যে বুড়িমা। ফিক ফিক করে হাসছে।

কি এঁত ভাবছিস? ওটা আমাকে দিয়ে আঁয়। সঁদগতি করে দেব।

ধড়মড় করে উঠে বসলাম। বুড়িমা যেন ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গেছে। একি স্বপ্ন? হতে পারে। কিন্তু তার বরফের মতো ঠাণ্ডা হাতের স্পর্শটা যে এখনও গায়ে লেগে রয়েছে।

যাই হোক দু-একদিন পরেই আমি গোরুর গাড়ি করে কঙ্কালটা নিয়ে বুড়িমার সেই শ্মশানে এসে হাজির হলাম। যেখানে আমি দিনের পর দিন কাটিয়েছি।

আশ্চর্য! বুড়িমা যেন জানত আমি আসব। হেসে বলল, এঁসেছিস! আঁয়! শখ মিটেছে? দে ওটা।

কম্বলে ঢাকা কঙ্কালটা বুড়িমার সামনে রাখলাম। বুড়িমা বলল, ঐ যে একটা চিতা জ্বলছে। ওখানে শুইয়ে দে। দাঁড়া দাঁড়া, আগের কাজটা আগে সারি। বলে একটা কাঠ দিয়ে কঙ্কালটার মাথায় জোরে আঘাত করল। অমনি ফাটা মাথা থেকে একরাশ কালো কালো পোকা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।

ভঁয় পাস নে। এবার দে চিতায় তুলে।

 তাই দিলাম। আর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বামনের কঙ্কালটা ধোঁয়ায় অদৃশ্য হয়ে গেল।

[অগ্রহায়ণ ১৪০৮]

1 Comment
Collapse Comments
Santu chakraborty April 20, 2021 at 6:28 pm

This story some pera has to copyed by Writer Tarapada Bannerjee, by matupagli

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *