ভৈরব

ভৈরব

ছোটনাগপুরের পাহাড়-ঘেরা এই ছোট্ট জায়গাটায় সেদিন যেন ধূসর সন্ধ্যা কেমন একরকম গা-ছমছম-করা রহস্যময় রোমাঞ্চ নিয়ে নেমে এসেছিল।

এমনটা অন্যদিন হয় না। অন্যদিনও এই সময় ধূর্জটিবাবু সর্বাঙ্গে গরম চাদর জড়িয়ে, হাতে দস্তানা পরে টাক মাথার উপর মাংকি-ক্যাপ চাপিয়ে লাঠি ঠুকঠুক করে এসে বসেন। এখন সবে অক্টোবরের মাঝামাঝি। শীত পড়েনি, পড়ব পড়ব করছে। এখনই ঐ কচি শীতের বিরুদ্ধেই ধূর্জটিবাবুর এই রণসাজ। তার এই শীতবস্ত্রের বর্ম দেখে মহীতোষ মজুমদারের স্ত্রী হাসেন। কিন্তু যাঁকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা তিনি নির্বিকার। তাঁর কোনো লজ্জা-সংকোচ নেই। মহীতোষবাবু এক সময়ে পুলিশ অফিসার ছিলেন। অসময়ে চাকরি ছেড়ে দিয়ে এখানে এসে স্থায়ী ভাবে বসবাস করছেন। তাঁর পুলিশি জীবনের নানা ঘটনা শুনতে ধূর্জটিবাবু ভালোবাসেন। সেই লোভে এই কদিন ধরে রোজ সন্ধ্যাবেলা উনি এখানে আসেন।

কেন যে মহীতোষবাবু পুলিশের চাকরির মতো লোভনীয় কাজ রিটায়ার করার আগেই ছেড়ে দিয়েছিলেন সে কথা একমাত্র বাড়ির লোক ছাড়া আর কাউকে বলেননি। কেননা বললেও তা কেউ বিশ্বাস করবে না। শুধু চাকরি ছাড়াই নয়–একেবারে দেশ ছাড়া হতে হয়েছিল।

এখানে উনি এসেছেন মাস ছয় হলো। শান্ত, নিরিবিলি জায়গা। ভদ্রলোকের বাস তেমন নেই। কেননা শহর বলতে যা বোঝায় তা এখান থেকে ক্রোশখানেক দূরে। মহীতোষবাবুর বাংলোর অল্প দূরে একটা পুরনো দোতলা বাড়ি। ঐ একটিই দোতলা বাড়ি। ওপরের জানালাগুলো সব সময়েই বন্ধ। একতলায় লোক থাকে। তারা বাঙালী নয়, মিশুকেও নয়। তবে কয়েক দিন হলো ধূর্জটিবাবু নামে বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি ঐ বাড়িতে এসেছেন। তিনি নিজেই এসে মহীতোষবাবুর সঙ্গে আলাপ করেছেন।

উনি অবশ্য সকালের দিকে আসেন না। বিকেলেও শীতের ভয়ে বড়ো একটা দূরে কোথাও যান না। ঠাণ্ডার ধাত। একটুতেই নাকি বুকে কফ জমে, গলা বসে যায়। তিনি অল্প কথা বলেন, তবু বিদেশে এই বাঙালী অতিথিকে পেয়ে মহীতোষবাবু ও তার স্ত্রী খুব খুশী।

স্বামী-স্ত্রী ছাড়া এ বাড়িতে আর একজন আছে। তার নাম লক্ষ্মণ। লম্বা-চওড়া, যাকে বলে দশাসই চেহারা–তাই। কুচকুচে কালো রঙ। আর পাথরের মতো বোবা। কাজ করে অসুরের মতো। ভোরবেলা আসে। কাজ করে রাতের খাবার নিয়ে চলে যায় নদীরে ওপারে। ধূর্জটিবাবু ওকে প্রথম দেখেই আঁৎকে উঠেছিলেন। ফিসফিস করে বলেছিলেন, ঐ লোকটার কাছ থেকে সাবধান থাকবেন মশাই। আমি বলছি, ও মানুষ খুন করতে পারে।

এ কথা শুনে মহীতোষবাবুর স্ত্রী শিউরে উঠেছিলেন, কিন্তু এক সময়ের দোর্দণ্ডপ্রতাপ মহীতোষবাবু ভয় পাননি। ভয় পেয়েই বা কি করবেন। সন্দেহ করে না হয় ছাড়িয়ে দিলেন। তারপর লোক পাবেন কোথায়?

রোজ সন্ধ্যেবেলা ধূর্জটিবাবু এসে মহীতোষবাবুর কাছে তার পুলিশি জীবনের যত খুন খারাপির গল্প ছেলেমানুষের মতো শোনেন। লণ্ঠনের আলো থেকে চোখ আড়াল করার জন্যে উনি একটা কিছু বই কিংবা কাগজ চিমনির গায়ে ঠেকিয়ে রাখেন। একটা ঘটনা বলা শেষ হয়ে গেলে উনি নাকে কেমন একটা ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ করেন। অর্থাৎ ঘটনাটা তার পছন্দ হলো না। অন্য ঘটনা শুনতে চান। যেন তিনি কোনো বিশেষ ঘটনা খুঁজে বেড়াচ্ছেন। সময়ে সময়ে মহীতোষবাবুর মনে হতো ধূর্জটিবাবু হয়তো বা কোনো ছদ্মবেশী লেখক–প্লট খুঁজে বেড়াচ্ছেন।

শেষে আজ মহীতোষবাবু তাঁর জীবনের সেই একান্ত গোপনীয় রোমাঞ্চকর কাহিনীটা বলতে শুরু করলেন, যে কাহিনীর নায়ক দুটি স্কুলের ছাত্র–মহীতোষ আর ভৈরব।

কাহিনী শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই কেমন যেন কতকগুলো অশুভ লক্ষণ দেখা দিল। দেওয়ালে একটা ছবি টাঙানো ছিল সেটা হঠাৎ ঝনঝন করে পড়ে ভেঙে গেল। এই সন্ধ্যেবেলায় বাড়ির ছাদে কি একটা পাখি বিশ্রী শব্দে ডেকে উঠল। সে ডাক শুনে মহীতোষবাবুর মতো লোকও চমকে উঠলেন। তার পরই মনে হলো যেন প্রচণ্ড ঝড় উঠছে। তিনি জানলার কাছে। গিয়ে দাঁড়ালেন, কিন্তু কালিঢালা অন্ধকার আকাশ ছাড়া ঝড়ের কোনো লক্ষণই দেখতে পেলেন না।

এসব কি হচ্ছে? মনে মনে মহীতোষবাবু যেন নিজেকেই প্রশ্ন করলেন। কিন্তু প্রকাশ্যে কিছু বললেন না। নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে তিনি গল্প বলতে শুরু করলেন।

ভৈরব ছিল তাঁর ইস্কুলের বন্ধু। একই সঙ্গে পড়তেন তারা। কতই বা বয়েস হবে তখন, তেরো-চোদ্দ? ভৈরব ছিল একটু অদ্ভুত প্রকৃতির। তার স্বভাবের সঙ্গে মহীতোষের স্বভাবের কোনো মিল ছিল না। তবু ভৈরব কেন যে মহীতোষকে খুব ভালোবাসত তার কারণ অজানা।

পড়াশোনায় ভৈরবের মন ছিল না। ঐ বয়েসেই সে তুকতাক, ঝাড়ফুঁক শেখার জন্যে গ্রামে গ্রামে ঘুরত। ওঝাদের বাড়ি গিয়ে বসে থাকত। সে ওঝারা সাপের ওঝা নয়, ভূত ছাড়াবার ওঝা।

ওর চেহারাটাও ছিল তেমনি। কালো ষণ্ডাগণ্ডা। ছোট করে কাটা চুল। সে চুলে কখনও তেল পড়ত না। আর চোখ দুটো ছিল পাথরের চোখের মতো নিষ্প্রাণ। ঐ চোখের দিকে তাকিয়ে মাস্টারমশাইরা পর্যন্ত ওর সঙ্গে কথা বলতে পারতেন না।

এমন ছেলেকে কেউ ভালোবাসতে পারে না। মহীতোষও পারতেন না। কিন্তু ছুটির পর ভৈরব একরকম জোর করে মহীতোষকে টেনে নিয়ে যেত নির্জন জায়গায়, বিশেষ করে শ্মশান কিংবা কবরখানায়। সেখানে বসে ও যে সব কথা মহীতোষকে শোনাতো তাতে বেচারি মহীতোষের রক্ত জল হয়ে যেত। যেমন ও বলত ও নাকি ভূত নামানো প্রায় শিখে ফেলেছে। অমুক গ্রামের অমুক ওঝা ওর গুরু।

একদিন বলল, খুব ইচ্ছে করে তিব্বত যেতে। ওখানকার লামারা নাকি প্রেসিদ্ধ। মহী ভাই, চনা, তোতে আমাতে একবার তিব্বত ঘুরে আসি।

শোনো কথা! তিব্বত যেন এপাড়া-ওপাড়া! শুধু গিয়েই, কদিন থেকে ফিরে আসা।

চল না মহী! লেখাপড়া শিখে ভালো ছেলে হয়ে বাড়ি বসে থেকে কি হবে। তার চেয়ে যদি প্রেতসিদ্ধ হতে পারিস তাহলে দুনিয়ার সবকিছু চলে আসবে এই হাতের মুঠোয়।

এসব কথায় মহীতোষ সাড়া দিতে পারতেন না। ভৈরবের হাত থেকে নিস্তার পাবার জন্যে শেষ পর্যন্ত এড়িয়ে যেতে লাগলেন। ছুটি হতে না হতেই তিনি ছুটে বাড়ি পালাতেন।

একদিন ভৈরব মহীতোেষকে একা পেয়ে ওঁর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল। ওর ডান হাতে একটা বাড়তি ছোট আঙুল ছিল। সেটা আবার ছুরির ফলার মতো বাঁকা। দেখলে গা শিউরে উঠত। সেই বেঁটে আঙুলটার তীক্ষ্ণ নখ দিয়ে মহীতোষের হাতে দাগ কেটে দিয়ে বলল, কিরে! আমায় এড়িয়ে যাচ্ছিস? কিন্তু মনে রাখিস, আমায় দূরে ঠেলে দিলেও আমার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবি না। আমি তোকে কাছে টানবই।

ছেড়ে দে ভাই, আমায় ছেড়ে দে। বলে কোনোরকমে সেদিন মহীতোষ ওর হাত ছাড়িয়ে পালিয়েছিলেন।

আবার একদিন পাকড়াও করেছিল ভৈরব। বলেছিল, তুই না যাস আমি একাই তিব্বত যাব। সেখানে যদি মরেও যাই তবু তোকে দেখা দেবই। আমার গুরু বলেন প্রেত-আত্মা খুব ইচ্ছে করলে দেহ ধারণ করে কিছুক্ষণের জন্যে দেখা দিতে পারে। তবে তার জন্যে আত্মাকে প্রচণ্ড কষ্ট পেতে হয়। মুক্তিও আটকে যায়। তা যায় যাক, তবু তোর সঙ্গে দেখা করতে আসব।

এই পর্যন্ত বলে ভৈরব একটু থেমেছিল। তারপর বলেছিল, তবে একটা কথা, দেখা করতে এলে তুই যদি আমায় অপমান করিস, আমায় তাড়িয়ে দিস তাহলে বন্ধু বলেও খাতির করব না। তোকে মেরে আমার সঙ্গী করে নেব।

মহীতোষ তখন ভয়ে থরথর করে কাঁপছেন।

 বল, কথা দে, দেখা দিলে কাছে ডাকবি?

নিষ্কৃতি পাবার জন্যে মহীতোষ তাড়াতাড়ি বলেছিলেন, এখুন মরা-টরার কথা কেন ভাই? এখনও ঢের সময় আছে।

ভৈরত দাঁতের ফাঁকে হেসে বলেছিল, তা আছে। কিন্তু ঐ আর কি যদি-র কথা বললাম। বল, দেখা করতে এলে ফিরিয়ে দিবি না।

না।

প্রতিজ্ঞা?

হ্যাঁ, প্রতিজ্ঞা।

আমায় তখন দেখলে চিনতে পারবি তো? ডান হাতে এই আঙুল–বলে ডান হাতটা মুখের কাছে তুলে ধরেছিল। অমনি ওর ঐ ক্ষুদে আঙুলটা তিরতির করে কাঁপতে লেগেছিল। আর কপালের বাঁ দিকে এই কাটা দাগ। মনে থাকবে তো?

হ্যাঁ ভাই, থাকবে। খুব থাকবে। বলে কোনোরকমে পালিয়ে এসেছিলেন।

এরপর হঠাৎই একদিন ভৈরব বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ। আর তার খোঁজ পাওয়া গেল না।

হঠাৎ ঘরের মধ্যে একরকম ছুটেই ঢুকলেন মহীতোষবাবুর স্ত্রী। তার মুখে-চোখে ভয়ের ছাপ, ছাদে কিসের শব্দ হচ্ছে!

মহীতোষবাবুও চমকে উঠলেন।

ছাদে শব্দ?

হ্যাঁ, শোনো।

মহীতোষবাবু কান পাতলেন। খুব মৃদু একটা শব্দ। কে যেন ছাদে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

মহীতোষবাবু ঘর থেকে বেরিয়ে এসে অন্ধকারে ছাদের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, ছাদে কে?

উত্তর পেলেন না। শব্দটা থেমে গেল। একটা পরে লক্ষ্মণ এসে দাঁড়ালো। সে জানাল, ছাদে একটা খারাপ ধরনের পাখি বসেছিল। সেটাকে ও তাড়াতে গিয়েছিল।

তবু ভালো।

পরক্ষণেই মহীতোষবাবু ভাবেন, তাই বা কেন? এত দিন পর হঠাৎ খারাপ পাখি কোথা থেকে এল?

এত যে কাণ্ড হচ্ছে পরম ধৈর্যবান শ্রোতাটির মধ্যে কিন্তু কোনো চাঞ্চল্য নেই। সেই যে অন্ধকারে মুখ আড়াল করে গল্প শুনে যাচ্ছিলেন, টু শব্দটি নেই। বোধ হয় ঘটনাটা তার ভালোই লাগছে।

.

তারপর অনেকগুলো বছর কেটে গেছে–মহীতোষবাবু আবার তার কাহিনী শুরু করলেন। ভৈরবের কথা ভুলেই গিয়েছিলেন। তখন তিনি কলকাতার কাছাকাছি এক জায়গার থানার ও সি। একদিন একটা মার্ডার কেস এল। মহীতোষবাবু লাশ দেখলেন। প্রবল আক্রোশে কেউ লোকটাকে একেবারে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে। এমন তো কত লাশই দেখেছেন তিনি। কিন্তু কেন যে এই মৃতদেহটা দেখে থমকে গিয়েছিলেন তা বুঝতে একটু সময় লেগেছিল।

মৃতের বয়েস বছর বাহান্ন-তিপ্পান্ন, কালো কুচকুচে রঙ। এই বয়েসেও পেশল চেহারা। নাক থ্যাবড়া। মুখটা যেন চেনা চেনা লাগল। তারপর ডান হাতে ছটা আঙুল দেখেই মহীতোষবাবু চমকে উঠেছিলেন। আঙুলটা আবার ছুরির ফলার মতো বাঁকা।

কপালের রক্তটা মোছো তো। হুকুম দিয়েছিলেন একজন কনস্টেবলকে। রক্তের ছোপ মুছে ফেলতেই দেখা গেল কাটা দাগ। বুঝতে বাকি রইল না এ তার সেই ছোটবেলাকার ক্লাস ফ্রেন্ড ভৈরব। জানা গেল ও নাকি এ অঞ্চলের এক কুখ্যাত সমাজবিরোধী। নিজেদের মধ্যে রেষারেষির জন্যেই প্রাণ হারিয়েছে।

ভৈরব যে তার চেনা মহীতোষবাবু তা প্রকাশ করলেন না। লাশ পোস্টমর্টেমের জন্যে পাঠিয়ে বাসায় ফিরে এলেন। গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলেন, একদিন যে প্রেতসিদ্ধ হবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছিল, শেষ পর্যন্ত সে হয়ে গেল কিনা একটা ডাকসাইটে সমাজবিরোধী।

যাই হোক এই খুনের তদন্তের ভার পড়েছিল মহীতোষবাবুর ওপরেই। কোথায় কোথায় ভৈরব থাকত, তার দলে আর কে কে আছে, কেই বা ওকে খুন করল এইসব তদন্ত শুরু করতে হলো। কিন্তু বিশেষ কোনো ক্ল পাওয়া গেল না। তা ছাড়া এইসব সমাজবিরোধীদের খুনের কেস নিয়ে মাথা ঘামাবার ইচ্ছেও তার বিশেষ ছিল না। কেসটা ক্রমে ধামা চাপা পড়ে যাচ্ছিল, ঠিক সেই সময়ে তাঁর জীবনে একটা মারাত্মক ঘটনা ঘটতে শুরু করল।

একদিন।

রাত বেশ গভীর। নিস্তব্ধ অঞ্চলটা। মনে হলো কে যেন দরজায় টোকা দিচ্ছে ঠুক ঠুক ঠুক।

ঘুম ভেঙে গেল মহীতোষবাবুর। কিন্তু কিছু আর শোনা গেল না। ভাবলেন, বোধ হয় স্বপ্ন দেখছেন। পাশ ফিরে চোখ বুজলেন। একটু পরেই আবার সেই শব্দ। এবার বিছানায় উঠে বসেই হাঁকলেন, কে?

উত্তর নেই।

 পাঁচ মিনিট পরে আবার সেই শব্দ। এবার জোরে।

মহীতোষবাবু উঠতে যাচ্ছিলেন, ওঁর স্ত্রী বাধা দিলেন, যেও না।

মহীতোষবাবু হচ্ছেন পুলিশ অফিসার। এত অল্পে ভয় পেলে কি তার চলে।

দাঁড়াও দেখি। বলে উঠে আলমারি খুলে রিভলবারটা নিয়ে দরজা খুলতে গেলেন, আর ঠিক তখনই দরজার বাইরে থেকে একটা অল্পবয়সী ছেলের গলা শোনা গেল, মহী, আমি এসেছি, খুব দরকার।

গলার স্বর শুনে মহীতোষবাবু অবাক! যেন অনেক দিন আগের খুব চেনা গলার স্বরটা। তাড়াতাড়ি দরজা খুললেন। কিন্তু কেউ কোথাও নেই।

মহীতোষবাবুর বাড়ির সামনে সরু এক ফালি প্যাসেজ আছে। প্যাসেজটা গিয়ে পড়েছে বড়ো রাস্তায়। এই প্যাসেজ দিয়েই যাওয়া-আসা করতে হয়। দরজার সামনে কেউ নেই দেখে মহীতোষবাবু প্যাসেজের উপর টর্চ ফেললেন। দেখলেন সেখানে একটা লোক দাঁড়িয়ে। খালি গা, পরনে একটা লুঙ্গি। মাথায় ফেট্টি বাঁধা। মুখটা রক্তে জবজবে।

এ আবার কে? এত রাত্তিরে এখানে কেন? পুলিশের লোক বলে লোকটা কি নালিশ জানাতে এসেছে?

তাকে কিছু বলতে যাবেন, স্পষ্ট দেখলেন লোকটা হাতের ইশারায় তাকে ডাকছে।

মহীতোষবাবু রিভলবারটা শক্ত করে ধরে এগিয়ে গেলেন। এগিয়ে গেলেন একেবারে ওর তিন ফুটের মধ্যে। সঙ্গে সঙ্গে এক চাঙড় বরফ যেন তার মেরুদণ্ড দিয়ে নেমে গেল। হাত-পা অসাড় হয়ে এল।

কে এ? এ তো ভৈরব। সেই যে খুন হয়েছিল। যার খুনের কিনারা এখনও হয়নি। আশ্চর্য! সে কি করে–

পরক্ষণেই দেখলেন ও এগিয়ে যাচ্ছে রাস্তার দিকে। হাতের ইশারায় কেবলই ডাকছে, এসো–আমার সঙ্গে এসো।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো তিনি ওর পিছনে পিছনে চললেন। ও গলি থেকে পথে নামল। রাস্তা নির্জন–অন্ধকার। আগে আগে চলেছে ভৈরবের ছায়ামূর্তি। পিছনে মহীতোষবাবু। মাঝেমাঝেই সে পিছন ফিরে দাঁড়াচ্ছে আর ইশারায় ডাকছে।

ও কোথায় কী উদ্দেশ্যে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে কে জানে! মহীতোষবাবু চলেছেন তো চলেছেনই। একটা কথাই শুধু ওঁর মনে পড়ছে, দরজা ঠেলবার সময়ে ছোটো ছেলের গলায় ভৈরব বলেছিল, খুব দরকার।

কিসের দরকার? তবে কি ও ওর খুনীর কাছে নিয়ে যেতে চায়?

এ কথা মনে হতেই মহীতোষবাবু খুব ভয় পেলেন। এভাবে একা যাওয়া তার উচিত নয়। তখনই তিনি ফিরে যেতে চাইলেন। কিন্তু ঠিক কোথায় এসে পড়েছেন তা বুঝতে পারলেন না। তার মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। পা দুটো যেন অসাড় হয়ে এল। তিনি আর হাঁটতে পারলেন না। ফুটপাথের ওপরেই বসে পড়লেন।

জ্ঞান ফিরে এল ভোরবেলায়। তখন একটা ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন।

এই পর্যন্ত বলে মহীতোষবাবু থামলেন। ধূর্জটিবাবু সেই যে শীতের ভয়ে অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে গুটিসুটি আধ-শোওয়া হয়ে ছিলেন, তেমনি রয়েছেন। সাড়াশব্দ নেই। ঘরের মধ্যে কেমন একটা অস্বস্তিকর হাওয়া থমথম করছে। বাইরে কতকগুলো কুকুর কেন যে এই বাড়িটা লক্ষ্য করেই ক্রমাগত ঘেউ ঘেউ করতে লাগল কে জানে!

ঘরে এই মুহূর্তে মহীতোষবাবু আর ধূর্জটিবাবু ছাড়া অন্য কেউ নেই। তবে কেন কুকুরগুলো

না, ঘরে আরো একজন কখন নিঃশব্দে এসে দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে মহীতোষবাবুর কথা শুনছে কেউ তা খেয়াল করেনি।

কে? ও লক্ষ্মণ। মহীতোষবাবু যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। দে তো বাবা, জানলাগুলো বন্ধ করে। বড্ড ঠাণ্ডা বাতাস আসছে।

লক্ষ্মণ কোনো উত্তর দিল না। দৈত্যের মতো বিরাট চেহারা নিয়ে ধুপ ধুপ করে পায়ের শব্দ তুলে জানলাগুলো বন্ধ করে দিয়ে ভেতরে চলে গেল।

তারপর

কি মশাই, ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি?

 বলে যান। মুখ না তুলেই কফ-জড়ানো স্বরে সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলেন ধূর্জটিবাবু।

তারপর থেকে প্রায়ই রাত দুপুরে দরজায় শব্দ। মহীতোষবাবুকে উঠতে হতো। দেখতেন দরজার বাইরে ভৈরব দাঁড়িয়ে।

একদিন বিরক্ত হয়ে মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিতে গিয়েছিলেন। উঃ ভৈরবের সে কী রাগ! কী দৃষ্টি! চোখ দুটো যেন হলদে বোতামের মতো অভিব্যক্তিশূন্য অথচ ভয়ঙ্কর। মনে হচ্ছিল তক্ষুণি বুঝি মহীতোষবাবুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর ছটা আঙুল দিয়ে টুটি চেপে ধরবে।

বাধ্য হয়ে মহীতোষবাবুকে বাড়ি বদলাতে হলো। কিন্তু সেখানেও ভৈরব হাজির। এমনি করে যেখানেই যান ভৈরবের হাত থেকে নিষ্কৃতি পান না। একদিন তো সবে সন্ধ্যেবেলা– লোডশেডিং। বাড়ি ফিরছিলেন মহীতোষবাবু। দেখলেন গলির মুখে ভৈরব কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে। এখন আর নাম ধরে ডাকে না। শুধু ওর সেই ভয়ঙ্কর হলুদ বোতামের মতো চোখ দিয়ে যেন গিলতে আসে।

তাই, শেষ পর্যন্ত বলতে পারেন একেবারে দেশ ছেড়ে পালিয়ে এসেছি। কী বলব মশাই, ভৈরবের ভয়ে রাতে ঘুমুতে পারতাম না। এখানে এসে মনে হচ্ছে নিস্তার পেয়েছি।

গল্প আমার এখানেই শেষ। বলে মহীতোষবাবু একটা সিগারেট ধরালেন। আরামে একটা সুখটান দিলে বললেন, এসব কথা কাউকে বলিনি–বলতে চাই না। বললেও কেউ বিশ্বাস করবে না। নেহাৎ আপনি

কথা শেষ হলো না মহীতোষবাবুর। তাঁর মনে হলো ঘরটা যেন হঠাৎ কুয়াশায় ভরে উঠছে।

এ কী! এত কুয়াশা কোথা থেকে এল? জানলাগুলো তো সব বন্ধ।

এমনি সময় সেই কুয়াশার মধ্যে থেকে ধূর্জটিবাবু নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসলেন। হলদে বোতামের মতো দুটো চোখ কুয়াশার ভেতরেই ধিকি ধিকি জ্বলছে। একটানে খুলে ফেললেন হাতের দস্তানাটা। লণ্ঠনের ঘোলাটে আলোয় দেখা গেল শীর্ণ একটা হাত ক্রমশ এগিয়ে আসছে। সেই হাতে ছটা আঙুল। ছুরির ফলার মতো অতিরিক্ত সেই আঙুলটা কাঁপছে তিরতির করে।

আতঙ্কে চিৎকার করে উঠতে গেলেন মহীতোষবাবু কিন্তু কুয়াশায় দম বন্ধ হয়ে গেল।

.

দুদিন পর সুস্থ হয়ে উঠলেন মহীতোষবাবু। কি যে ঘটেছিল কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না। জানলেন সেই রাত্রে লক্ষ্মণই ডাক্তার ডেকে এনে তাকে বাঁচায়। কিন্তু ধূর্জটিবাবুর পাত্তা আর পাওয়া যায়নি।

সেদিন বিকেলে সেই দোতলা বাড়িতে ধূর্জটিবাবুর খোঁজ নিতে গেলেন মহীতোষবাবু। অবাঙালী বৃদ্ধ একজন বললেন, দুদিন আগে হঠাৎ ভোরবেলায় সেই বাঙালীবাবু চলে গেছেন। তিনি এঁদের কেউ নন। চিনতেনও না। কলকাতা থেকে নাকি এসেছিলেন কয়েক দিনের জন্য। কোথাও থাকার জায়গা পাচ্ছিলেন না বলে বাইরের ঘরটা ভাড়া নিয়েছিলেন।

মহীতোষবাবু স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।

[শারদীয়া ১৪০০]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *