গভীর রাতের ভয়ঙ্কর

গভীর রাতের ভয়ঙ্কর

অশুভ সংকেত

 এই বাগানবাড়িতে যেদিন জনার্দন তার স্ত্রী আর ছেলেকে নিয়ে একমাসের জন্যে বেড়াতে এল সেদিন ওদের আনন্দের পরিসীমা ছিল না। এক মাস এই ফাঁকা জায়গায় সবুজ প্রকৃতির কোলে প্রাণভরে নিশ্বাস নিয়ে বাঁচবে।

যেদিন এখানে প্রথম এল সে দিনটা ছিল ৯ ফেব্রুয়ারি। তখনও তারা জানত না এই দিনটির পিছনে একটার পর একটা কী ভয়ঙ্কর অশুভ ঘটনা অপেক্ষা করে আছে।

ডায়মন্ড হারবার রোড থেকে প্রায় আধ মাইল ভেতরে বাড়িটা। বোধহয় কোনোকালে জমিদারদের বাগানবাড়ি ছিল। বাড়ির সামনে ধুলোভরা রাস্তাটা যে কোথায় চলে গেছে তার খোঁজ জনার্দন রাখেনি। রাখার দরকারও ছিল না। নির্জন বলেই জায়গাটা তার পছন্দ। একঘেয়ে কলকাতায় থেকে থেকে সে যেন হাঁফিয়ে উঠছিল। এখানে এসে হাত-পা ছড়িয়ে বিশ্রাম করবে কিছুদিন, সম্ভবত এই ছিল তার মনের ইচ্ছে।

বাড়ির ভিতরে অনেকখানি খালি জায়গা। ঝোপঝাপ বুনোফুল ছাড়া আর কিছু নেই। জায়গাটা দক্ষিণ দিকে ক্রমে ঢালু হয়ে একটা পুকুরে গিয়ে পড়েছে।

বাড়ির পশ্চিম দিকে রাস্তা দিয়ে এগোলে আদিবাসীদের কয়েকটা ঘর। তারা চাষবাস করে। কিন্তু কেন কে জানে সন্ধে হলেই যে যার ঘরে এসে ঢোকে। ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দেয়। সকালের আগে কিছুতেই দরজা খোলে না। এদের মাটির ঘরগুলোয় জানলা থাকে না। ওদের সংস্কারসন্ধের পর খোলা পেলেই অশুভ আত্মা ঢুকে পড়ে। জায়গাটাও তেমন ভালো নয়। অল্প দূরে একটা পুরনো কবরখানা। বেলা পড়ে এলে আদিবাসীরা কেউ ঐদিকে তাকায় না।

এখানে এসে জনার্দনের স্ত্রী মালতীও খুব খুশি। হোক পুরনো তবু কত বড়ো বড়ো ঘর। হাত-পা খেলিয়ে থাকা যাবে কদিন।

সবচেয়ে খুশি টনি। বয়েস তার বছর তেরো। পাতলা একহারা চেহারা। চোখের দৃষ্টি ছটফটে। দেখলেই মনে হয় খুব সাহসী। কলকাতায় আঁটসাট চার দেওয়ালের বদ্ধ ঘরে কেবল পড়া-পড়া করে হাঁপিয়ে ওঠে। এখানে এই খোলামেলা জায়গায় এসে সে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

বেলা তিনটেয় ওরা মালপত্র নিয়ে এ বাড়িতে এসে পৌঁছল। ওর বাবা-মা লেগে গেল ঘর গোছাতে। আর সে ফুক করে বেরিয়ে গেল ঘুরতে। চারিদিক ফাঁকা ফাঁকা। গাছে গাছে কোকিল ডাকছে। ডাকছে অদ্ভুত স্বরে হাঁড়িচাচা। ও মনের আনন্দে ঘুরতে ঘুরতে এসে দাঁড়ালো কবরখানার কাছে। পাঁচিলঘেরা অনেকখানি জায়গা। পাঁচিল ভেঙে পড়েছে কোথাও। একটা মস্ত লোহার গেট। একটা পাট তার উধাও। কেউ কোথাও নেই। টনি ঢুকে গেল কবরখানার ভেতর। দুপাশে আম গাছের ছায়ায় ঢাকা চওড়া পথ। সেই পথ থেকেই আবার ডাইনে বাঁয়ে বেরিয়ে গেছে অনেকগুলি সরু সরু পথ। তারই দুধারে পর পর সমাধি। সিমেন্ট বাঁধানো। কোনো কোনোটার ওপরে শ্বেতপাথরের ফলক লাগানো। বেশির ভাগ সমাধিই ভেঙে পড়েছে। বিরাট বিরাট ফাটল।

টনি বুঝতে পারল সমাধিক্ষেত্রটা বর্তমানে পরিত্যক্ত। নতুন করে এখানে কাউকে আর কবর দেওয়া হয় না।

আশ্চর্য! টনির এতটুকু ভয় করল না। বরঞ্চ তার ভালোই লাগল জায়গাটা।

সে যখন বাড়ি ফিরে এল তখন সন্ধে হয় হয়। জিনিসপত্র গোছানো হয়ে গেছে অনেকটা। মা জলখাবার বানাচ্ছে। এর পর রাতের রান্না।

এ বাড়িতে একটাই অসুবিধে ইলেকট্রিক নেই। ছিল একসময়ে। এখন লাইন কাটা। কেউ তো থাকত না। শুধু কালো কালো তারগুলো সাপের মতো ঝুলছে দেওয়ালে দেওয়ালে।

এখনও বেশ শীত আছে। কাজেই পাখার দরকার নেই। আলো? তিনটে-চারটে লণ্ঠন সঙ্গে করে এনেছে। টনি খুব খুশি। একঘেয়ে ইলেকট্রিক আলো ভালো লাগে না। সে মাকে বলে, কেমন নির্জন জায়গা, পুরনো বাড়ি, লণ্ঠনের টিমটিমে আলো, বেশ রহস্য-রহস্য নয় মা?

তোর যত অদ্ভুত কথা। স্নেহের সুরে বলে মা। নে খেতে বোস দেখি।

ডাইনিং টেবিলের সামনে বসেছে তিনজনে। টেবিলের ওপর জ্বলছে লণ্ঠন। দেওয়ালে তাদের মস্ত মস্ত ছায়া।

সবে পরোটায় কামড় দিয়েছে টনি হঠাৎ বাথরুমের দিকে শব্দ। কিছু যেন ভেঙে পড়ল। চমকে উঠল তিনজনেই। কি হলো?

দাঁড়াও, আমি দেখছি। টনি উঠতে যাচ্ছিল, বাধা দিল মা।

টনির বাবাকে বলল, তুমি দ্যাখো না। লণ্ঠন নিয়ে উঠে গেল জনার্দন বাথরুমের দিকে। দেখল দেওয়াল থেকে একটা মস্ত বড়ো চাঙড় ভেঙে পড়েছে।

আরে ওটা কী?

ততক্ষণে টনি আর তার মাও এসে দাঁড়িয়েছে। একটা সাদা বেড়াল–মাথাটা তার থেতলে গেছে চাঙড়ের চাপে।

ইস! কী বীভৎস দৃশ্য! মা আঁতকে ওঠে। এখন এটাকে ফেলতে হবে। নইলে পচে দুর্গন্ধ বেরোবে।

চা-পরোটা খাওয়ার আনন্দ মাথায় উঠল। বাড়ি ঢুকতে না ঢুকতেই দুর্ঘটনা!

কিন্তু ঝড় নেই বৃষ্টি নেই হঠাৎ অত বড়ো চাঙড়টা পড়ল কি করে? অবাক হয়ে প্রশ্ন করে মা।

সে ভেবে লাভ নেই, উত্তর দেয় জনার্দন। এখন মরা বেড়ালটা ফেলতে হবে।

টনি বলল, বাবা, আমি ওটা ফেলে দেব?

মা বললে, না। তোমার বাবা ফেলবে।

অগত্যা পাথর সরিয়ে বেড়ালটার লেজটা হাতে ধরে জনার্দন সেটা পিছনের জমিতে ফেলে দিয়ে এল। মরা বেড়ালের ফোঁটা ফোঁটা রক্ত বারান্দাময় ছড়িয়ে।

জনার্দনের গা-টা কেমন করে উঠল।

টনি বলল, রক্তটা আমি ধুয়ে দেব মা?

মা বলল, না, আমি পরিষ্কার করে দিচ্ছি।

যে রকম আনন্দ করে প্রথম রাতটা কাটাবে ভেবেছিল তেমন আনন্দ হলো না। বাধা পড়ল। মালতীর মনে হলো এটা একটা অশুভ লক্ষণ।

নটা বাজতে না বাজতেই নিঝুম রাত। গোটা হলঘরটা থমথম করছে। বহুদিন পর এ বাড়িতে লোক সমাগম দেখে বাড়ির দেওয়াল থেকে কড়িকাঠ পর্যন্ত যেন অবাক হয়ে দেখছে। এরা তিনজন নড়ছে চড়ছে আর লণ্ঠনের আলোয় তাদের ছায়াগুলো যেন ভৌতিক চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

রাত সাড়ে নটায় সব লণ্ঠন নিভিয়ে শুধু শোবার ঘরের লণ্ঠনটার পলতে কমিয়ে শুয়ে পড়ল ওরা। টনির জন্যে আলাদা ঘরের ব্যবস্থা। টনি সেখানেই শুতে চেয়েছিল। কিন্তু মা শুতে দেয়নি। বললে, আজকের মতো আমাদের সঙ্গে শোও।

গভীর রাত। ঘুম ভেঙে গেল জনার্দনের। একটা বেড়াল বাড়ির চারিদিকে ক্রমাগত ডেকে চলেছে। ডাকটা যেন ভয়-পাওয়ার মতো।

এত রাত্তিরে রাস্তায় বেড়াল এল কোথা থেকে?

তারপরই কেমন খসখস শব্দ। কেউ যেন জুতো টেনে টেনে হাঁটছে। প্রথমে জনার্দন ভেবেছিল শব্দটা বুঝি ঘরের ভেতরেই। কান খাড়া করে অনেকক্ষণ শুনল শব্দটা। না, ঘরের ভেতরে নয়, বাইরে।

এই শুনছ? জনার্দন ঠেলা দিল মালতীকে।

হ্যাঁ, শুনছি।

 ধড়মড় করে উঠে বসল টনি। চাপা গলায় বলল, আমিও শুনছি।

শব্দটা কিন্তু থেমে গেছে।

পরক্ষণেই আবার শব্দ-খস খস খস।

 শব্দটা এবার বাড়ির পিছন দিকে। একটু পরে শব্দটা পাশের দিকে।

কেউ যেন বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করছে।

বাবা, আমি গিয়ে দেখব?

মা ধমকে উঠল, খবরদার! চুপ করে শোও।

পরের দিন ঘুম ভাঙল অনেক বেলায়। সারারাত ভালো করে ঘুম হয়নি। কেমন যেন ভয়ে ভয়ে কেটেছে রাতটা। কিসের ভয় তা ঠিক বুঝতে পারছিল না। অথচ এখন দিনের আলোয় সব পরিষ্কার। ভয়ের কোনো চিহ্নমাত্র নেই। মনে হচ্ছে যেন সারারাত ওরা দুঃস্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু খস খস শব্দটা তো সবাই শুনেছিল। কে ঘুরে বেড়াচ্ছিল বাড়ির চারিদিকে?

কৃপানাথ, যার কাছ থেকে বাগানবাড়িটা জনার্দন কিনেছিল, বলেছিল বটে, জায়গাটা কিন্তু ভালো নয় জনার্দনবাবু। সমাজবিরোধীদের আড্ডা। নিরিবিলিতে তারা জড়ো হয়, চুরি ডাকাতির প্ল্যান করে। তারপর ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। এমনকি অন্য কোথাও খুন-খারাপি করে লাশ এনে পুঁতে দেয় ঐ বেওয়ারিশ কবরখানায়।

তাহলে কি কাল রাত্তিরে চোর-ডাকাতরাই কেউ ঘোরাফেরা করছিল?

দ্বিতীয় দিনটা বেশ ভালোই কাটছিল। কিন্তু দুপুরের দিকে হঠাৎ সূর্য নিস্তেজ হয়ে পড়ল। কুয়াশার মতো একটা মেঘ দেখা দিল। সেই সঙ্গে শিরশিরে বাতাস। টনি খুব খুশি। খেয়েদেয়েই সে বেরিয়ে গেছে।

জনার্দনও বেরিয়েছিল দুপুরে। কলকাতার বাস ধরতে হয় আধ মাইল হেঁটে ডায়মন্ড হারবার রোডে গিয়ে। বাড়িতে গোছানো এখনও অনেক বাকি। তাই বিকেল-বিকেল ফিরছিল।

বাস থেকে নেমে সে হেঁটে আসছিল বাড়ির দিকে। আসতে আসতে একটু অবাক হলো, মেঘ করেছে! অথচ যখন বাস থেকে নামল মাত্র পাঁচ মিনিট আগে তখনও তো বেশ রোদ ছিল।

যাই হোক সে বাড়ির দিকে জোরে পা চালাল।

জায়গাটা নির্জন। দুপাশে খাঁ খাঁ মাঠ। ধুলোভরা রাস্তার পাশে সার সার বাবলা গাছ। কোথাও কোথাও মাদার গাছে লাল টকটকে ফুল যেন রেড সিগন্যাল দিচ্ছে।

জনার্দন হাঁটছিল। হঠাৎই তার মনে হলো রাস্তায় সে এই মুহূর্তে একা নয়। কেউ যেন পিছনে পিছনে আসছে।

চমকে পিছন ফিরে তাকাল। না, কেউ নেই।

মনের ভুল ভেবে জনার্দন এগিয়ে চলল। এবার স্পষ্ট শুনল খসখস শব্দ। পিছনে কেউ আসছেই।

আবার ফিরে তাকাল। না, কেউ নেই।

এরকম মনে হচ্ছে কেন? জনার্দন নিজেকেই নিজে জিজ্ঞেস করল। তার পরে ও কিছু না  বলে মনকে বুঝিয়ে আরও জোরে হাঁটতে লাগল।

বেশি দূর যেতে হলো না। স্পষ্ট অনুভব করল কেউ যেন অদৃশ্য থেকে একেবারে তার ঘাড়ের কাছে এসে পড়েছে। একটা কনকনে ঠান্ডা হাওয়া তার সারা দেহ অবশ করে দিচ্ছে। একটা হিমস্রোত যেন পিঠ থেকে উঠে গলাটা চেপে ধরছে….

এমনি সময়ে কে যেন ডাকল, বাবা! জ্ঞান হারাবার মুহূর্তে জনার্দন দেখল বিপরীত দিক থেকে ছুটে আসছে টনি।

বাবা, আমি এখানকার সব রাস্তাগুলো চিনে ফেলেছি। তাড়াতাড়ি বাড়ি চলল। এখুনি বৃষ্টি নামবে।

আশ্চর্য! টনি কাছে আসার সঙ্গে সঙ্গে পিছনে যে ছিল সে কোথায় মিলিয়ে গেল। জনার্দন প্রাণভরে নিশ্বাস নিল।

হ্যাঁ, চলো বাড়ি যাই। তোমার মা একা রয়েছে।

.

সেই দিনই

রাত বোধহয় এগারোটা। বৃষ্টি হয়নি। কিন্তু আকাশটা থমথম করছে। ঠান্ডাটা যেন নতুন করে পড়ল। আপাদমস্তক লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়েছিল জনার্দন। কানে এল গত রাতের মতো একটা বেড়াল রাস্তায় কেঁদে কেঁদে বেড়াচ্ছে…যেন অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। তারপরেই ওদিকের ঘরের জানলা ঠেলছে। কিংবা ইট ছুঁড়েছে।

মালতীরও ঘুম ভেঙে গেল।

কিসের শব্দ?

জনার্দন বলল, বুঝতে পারছি না।

 ঝড়?

না, ঝড় কোথায়?

কিন্তু উনি যে ও ঘরে একলা। আমার বড় ভয় করছে।

দাঁড়াও দেখছি।

জনার্দন লণ্ঠনটা বাড়িয়ে দিল। হাতে টর্চ নিয়ে দরজা খুলে গিয়ে দাঁড়াল টনির ঘরের সামনে। পিছনে মালতী।

টনি!

আমি জেগে আছি।

 একটা শব্দ শুনলে?

 হ্যাঁ, শুনেছি।

মালতী বলল, তুমি আমাদের ঘরে চলে এসো।

 না। আমি ঠিক আছি।

.

সন্ধেবেলায় আগন্তুক

 আজ বাগানবাড়িতে থাকার তৃতীয় দিন। কাল বৃষ্টি হয়নি। কিন্তু আজ দুপুরবেলায় সমাধিভূমির দিক থেকে দৈত্যের মতো ঘন কালো মেঘ এগিয়ে আসতে লাগল। শীতকালে এরকম মেঘ দেখা যায় না। এ যেন আষাঢ়ের জলভরা মেঘ।

তারপরেই নামল বৃষ্টি।

এখন সন্ধে। সারা দুপুর টানা বৃষ্টি হবার পর এখন ঝিরঝিরে বৃষ্টি। তারই সঙ্গে হাড় কাঁপানো ঠান্ডা।

দরজা-জানলা বন্ধ করে হলঘরে বসে জনার্দন তার কনট্রাক্টারি কাজের খাতাপত্র ঠিক করছিল। একটু দূরে টেবিলের ওপর বই-খাতা নিয়ে পড়ছিল টনি। ভেতরে রান্নাঘরে ওর মা রান্না করছে।

টনি বলল, যেরকম আকাশের অবস্থা, আমার মনে হচ্ছে বন্যা হবে। তাহলে মন্দ হয়। চারিদিকে জল থৈ থৈ করবে। তার মধ্যে দ্বীপের মতো জেগে থাকবে আমাদের বাড়িটা আর তিনটি মাত্র প্রাণী তুমি, মা আর আমি।

তুমি মন দিয়ে পড়ো তো!

এই তো পড়ছি। বলে টনি কিছুক্ষণ চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পড়ল। তারপর মাকে উদ্দেশ করে বলল, মা, খিচুড়ি করছ তো?

হ্যাঁ, খিচুড়ি আর ডিম ভাজা।

বাঃ! ফাইন।

জনার্দন ধমকে উঠল, পড়তে পড়তে খাওয়ার চিন্তা! কিসসু হবে না তোমার।

 মালতী ঘর থেকে বেরিয়ে এল। কফি খাবে নাকি?

দাও।

হঠাৎ এই সময়ে দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। চমকে উঠল জনার্দন। সচকিত হলো টনি।

এই দুর্যোগে কে আবার এল?

শুধু যে কৌতূহল তা নয়, জনার্দনের মতো শক্তসমর্থ মানুষটাও কেমন ভয় পেল।

হ্যাঁগো, কেউ যেন কড়া নাড়ল। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল মালতী।

জনার্দন চাপা গলায় বলল, চুপ! একেবারে চুপ!

 রীতিমতো ভয় পেয়েছে জনার্দন। তার বোধহয় মনে পড়েছিল কৃপানাথের কথা। বাগানবাড়িটা কেনার সময়ে বলেছিল জায়গাটা সমাজবিরোধীদের আড্ডা। সেই সঙ্গে সাবধান করে দিয়েছিল, ওরা যদি কেউ আসে, দু-একদিন থাকতে চায়, বাধা দেবেন না যেন। ওদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করলে ওরা কিছু বলবে না। তা নইলে বিপদে পড়বেন। কেউ ঠেকাতে পারবে না।

হ্যাগো, কে কড়া নাড়ল?

 জনার্দন মাথা নাড়লে, জানি না।

চোর-ডাকাত নয় তো?

 জানি না।

একবার নেড়েই থেমে গেল কেন?

জানি না বলেই টনিকে ধমকে উঠল, হাঁ করে আমাদের কথা শুনছ কি? পড়ো না। আর তুমি রান্নাঘরে যাও তো।

তা যাচ্ছি। কিন্তু কে কড়া নাড়ল তখন?

ও শোনার ভুল। বাইরে ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। বোধহয় তাতেই কোনোরকমে—

কথা শেষ হলো না। আবার কড়া নাড়া খট খট খট

 জনার্দনের মুখটা চুপসে গেল।

নাঃ, সত্যিই কেউ এসেছে। কিন্তু এই দুর্যোগে—

বাবা, আমি দরজাটা খুলে দেব?

দাঁড়াও। আর একবার নাড়ুক।

তিন জনে কান খাড়া করে রইল। একটু পরেই আবার কড়া নাড়া। টনি ছুটে যাচ্ছিল, ওর মা হিস্টিরিয়া রোগীর মতো চেঁচিয়ে উঠল, না, তুই যাবি না। আমার মনে হচ্ছে কোনো বিপদ ঘটতে চলেছে।

এমনও তো হতে পারে মা, এই ঝড়-বৃষ্টির রাতে কেউ আশ্রয় চাইছে।

অনুমতির অপেক্ষা না করে টনি এগিয়ে গেল দরজার দিকে। জনার্দন তেমনি বসে রইল। ফ্যাকাসে মুখ নিয়ে।

টনি দরজা খুলে দিতেই একটা দমকা ঠান্ডা বাতাস ঘরে ঢুকে জনার্দনের কাগজ পত্র উড়িয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গেই মাথা থেকে পা পর্যন্ত ওয়াটারপ্রুফ পরা লম্বা একটা লোক ধীরে ধীরে কালো রবারের জুতো পরা পা ফেলে ঘরে ঢুকল। পা দিয়ে ঠেলে দরজাটা বন্ধ করে দিল। হাত ব্যবহার করল না। হাত দুটো শীতের জন্যেই বোধহয় পকেটে ঢোকানো ছিল।

কে আপনি? কি চান? শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করল জনার্দন।

লোকটা বর্ষাতির টুপির তলা থেকে ক্রুর দৃষ্টিতে একবার চারিদিক দেখে নিল। তারপর বলল, ডায়মন্ড হারবার থেকে ফিরছিলাম। গাড়িটা খারাপ হয়ে আছে খালের ধারে। এখানে থাকতে চাই।

কিন্তু ডায়মন্ড হারবার রোড তো অনেক দূরে। এদিকে এলেন কী করে?

আগন্তুকের মুখ চাপা রাগে থমথম করতে লাগল। বলল, ভুল করে।

মালতী তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে নমস্কার করে বললে, ঠিক আছে, ঠিক আছে। এই রাতে আপনি আমাদের মাননীয় অতিথি। অনুগ্রহ করে বসুন।

ধন্যবাদ।

এতক্ষণে জনার্দন নিজেকে ঠিকঠাক করে নিতে পেরেছে। যদিও সে এই উটকো আগন্তুককে মোটেই পছন্দ করছিল না তবু কৃপানাথের কথাগুলো মনে পড়ায় তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে খুব খাতির করতে লাগল। লোকটা যে খুনে ডাকাত-ফাঁকাত ছাড়া আর কিছু নয়, তা তার রাগী রাগী মুখ দেখলেই বোঝা যাচ্ছিল। যদিও ওয়াটারপ্রুফের টুপিতে অর্ধেক মুখ ঢাকা ছিল।

যে ডাইনিং টেবিলে জনার্দন কাজ করছিল তার থেকে বেশ কিছুটা দূরে দরজার কাছে। একটা চেয়ার ছিল। লোকটা সেখানেই পা ক্রশ করে বসল।

জনার্দন তার কাছে গিয়ে হাত জোড় করে বললে, আপনি কোনোরকম সংকোচ করবেন না। এ বাড়িটা আপনার নিজের বাড়ি বলেই মনে করবেন।

লোকটা ভদ্রতা করেও তার উত্তর দিল না। টনির পর্যন্ত সেটা খারাপ লাগল।

আপনি যদি ভিজে ওয়াটারপ্রুফটা খুলে আমায় দেন তাহলে টাঙিয়ে রাখতে পারি। বলেই সন্দিগ্ধভাবে লোকটার ভেতরের পকেটের দিকে তাকাল। লোকটা সেই থেকে দুপকেটে দুহাত খুঁজে রেখেছে। পকেটে রিভলভার নেই তো?

লোকটা গম্ভীরভাবে বলল, চিন্তা করবেন না। আমার ব্যবস্থা আমি নিজেই করে নেব।

এই সময়ে টনির মা এক কাপ কফি আর টোস্ট এনে টেবিলে রাখল। তারপর হাসিমুখে অতিথিকে টেবিলে আসতে অনুরোধ করল।

আগন্তুক বলল, শুধু কফিটা আমায় দিন।

অর্থাৎ টেবিলে সে আসবে না।

অগত্যা মালতী একটা ছোটো টুল এনে কফির পেয়ালা তার ওপর রাখল।

টোস্ট না খান দুটো বিস্কুট দেব?

না, ধন্যবাদ।

কথা বলতে বলতে মালতী লক্ষ্য করল লোকটা ঘরের চারিদিক কেমন খরদৃষ্টিতে দেখছে।

মালতী কফি রেখে ডাইনিং টেবিলের কাছে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। সে অবাক হলো, লোকটা টেবিলে এল না কেন? মালতী তাকালো টনির দিকে। দেখল সেও তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।

সামনে টুলের ওপর গরম কফি। ধোঁওয়া উড়ছে। আগন্তুক সেদিক তাকিয়ে আছে। তার দুহাত তখনো ওয়াটারপ্রুফের ভেতরে। মনে হচ্ছে তার এত শীত করছে যে হাত বের করতে পারছে না। তবু হাত তো বের করতেই হবে। নইলে কফি খাবে কি করে?

এতক্ষণে তার বাঁ হাতটা পকেটের মধ্যে নড়ে উঠল। আর তখনই লণ্ঠনটা নিভে গেল।

এ আবার কী! আজই তো লণ্ঠনে তেল ভরেছি। মালতী বলে উঠল। অন্ধকারেই জনার্দন দেখল আগন্তুকের বাঁ হাতটা যেন পকেট থেকে বেরোল। জনার্দন অজানা আতঙ্কে তাড়াতাড়ি টেবিলের নীচে মাথাটা গুঁজে দিল। তার মনে হলো এখনই একটা শিসের গুলি ছুটে এসে ওর মাথার খুলিটা উড়িয়ে দেবে।

অন্ধকারে দেশলাই খুঁজে নিয়ে মালতীই লণ্ঠনটা জ্বালল। দেখল আগন্তুকের বাঁ হাতটা আবার পকেটে ঢুকে গেছে। কফির পেয়ালা শূন্য।

আশ্চর্য, অত গরম কফি এক নিশ্বাসে খেল কী করে!

মালতী এগিয়ে গিয়ে শূন্য কাপটা তুলে নিল। হেসে বলল, কফিটা কি জুড়িয়ে গিয়েছিল?

 আগন্তুক তার উত্তর দিতে চাইল না। বেজার মুখটা অন্য দিকে ফেরালো।

মালতী হেসে বলল, আপনার শোবার ব্যবস্থা করছি ওদিকের ছোট ঘরটায়। খুব নিরিবিলি। অ্যাটাচড় বাথরুম। আপনার অসুবিধে হবে না। বিছানা রেডি করা আছে। খাওয়ার পর বিছানাটা ঝেড়ে মশারি টাঙিয়ে দেব। এখানে বড্ড মশা।

ধন্যবাদ। কোনো কিছুরই দরকার নেই। নিজেই সব ঠিক করে নিতে পারব। রাতেও কিছু খাব না। এখন একটু বিশ্রাম করতে চাই।

একেবারেই কিছু খাবেন না? ক্ষুণ্ণ স্বর বেরিয়ে এল মালতীর গলা থেকে।

না। বললাম তো।

ঘরটা দেখিয়ে দেবার জন্যে মালতী এগিয়ে গেল। ঠিক পিছনেই লোকটা। ঘাড়ে নরম নিশ্বাসের মতো কি লাগছিল। ফিরে দেখল লোকটা একেবারে পিছনে। ভয়ে মালতীর বুক কেঁপে উঠল। আর আশ্চর্য তার স্বামী; ডাইনিং টেবিলের সামনে মুখ চুমড়ে বসে শুধু দেখছে।

হঠাৎ টনি এগিয়ে এসে বলল, আপনার নামটা তো জানতে পারলাম না, আঙ্কেল।

আগন্তুক থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। বর্ষাতির টুপির তলা দিয়ে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকালো টনির দিকে। খসখসে গলায় বলল, তুমি ছেলেমানুষ। আমার নাম জানতে চাও কেন? এটা তোমার স্পর্ধা।

আঙ্কেল, কিছু মনে করবেন না। গেস্টের নাম জিজ্ঞেস করা কী অন্যায়?

লোকটা এবার তার জন্য নির্দিষ্ট ঘরের ভেতরে ঢুকল।

একটা লণ্ঠন এনে দিই? মালতী জিজ্ঞেস করল।

দরকার নেই। হ্যাঁ, আর শুনুন আমি হয়তো ভোরবেলা চলে যাব। আবার আসব যে কোনোদিন। জায়গাটা আমার পছন্দ হয়েছে। ভাবছি খানিকটা জমি কিনে কারখানা করব। আর আমার খাবারের ব্যবস্থা করবেন না। বলেই মিস্টার গুর্গে দরজা বন্ধ করে দিলেন।

.

দুশ্চিন্তার রাত

সর্বসাকুল্যে চারখানি ঘর। দরজা দিয়ে ঢুকলেই সামনে বেশ বড়োসড়ো হলঘর। মাঝখানে ডাইনিং টেবিল। খান চারেক চেয়ার। এছাড়া আরও কয়েকটা চেয়ার এদিক-ওদিক ছড়ানো। হলঘরের বাঁ দিকে একটা বেডরুম। এখানে শোয় জনার্দন আর তার স্ত্রী মালতী। তার পাশেই একটা ছোটো ঘর। দুঘরের মধ্যে সেকালের তৈরি কাঠের পার্টিশান। এই ছোটো ঘরে থাকে জিনিসপত্র। ডাইনিং হল আর এই ছোটো ঘরের পাশে রান্নাঘর। রান্নাঘরের পিছনে সেকলে খাটা-পায়খানা। একটা কুয়ো। এদিকে পাঁচিলটা নিচু। সেই নিচু পাঁচিলের নিচে বেঁটে খিড়কি দরজা।

ডাইনিং হলের ডান দিকে ছোটো ঘরটার মাপে একটা ঘর। এখানে টনি শোয়। তার গায়েই আর একটা ঘর বাইরের দিকে। দুঘরের মধ্যে আগের ঘরের মতোই কাঠের পার্টিশান। কাঠ জীর্ণ হয়ে ফেটেফুটে গেছে। এটা গেস্টরুম। বড়ো একটা ব্যবহার হয় না বলে তালা দেওয়া থাকে।

জনার্দন চুপচাপ শুয়েছিল। পাশে মালতী। সেও চুপচাপ। বাইরে তখনও টিপ টিপ বৃষ্টি পড়েই চলেছে।

এই আগন্তুকটি আসার পর থেকে জনার্দনের অস্বস্তির শেষ নেই। সবটাই যেন কেমন রহস্যজনক। হঠাৎ বৃষ্টির সন্ধ্যায় লোকটা এল। সে নাকি ডায়মন্ড হারবার থেকে গাড়ি নিয়ে আসছিল। ভুল করে এই পরিত্যক্ত রাস্তায় ঢুকে পড়েছে। কিন্তু ভুল হওয়ার কারণ নেই। ডায়মণ্ড হারবার রোড পিচঢালা পাকা রাস্তা। সেই পথ ছেড়ে ভুল করে এই ধুলোভরা কাঁচা রাস্তায় এসে পড়বে তা বিশ্বাসযোগ্য নয়।

তারপর কোথায় যাবে তাও স্পষ্ট নয়। এখানে এসে জায়গাটা পছন্দ হয়েছে। খুব ভালো কথা। কিন্তু অন্ধকারে জায়গাটা দেখল কী করে? বলল, এখানে মাঝে মাঝে আসবে। কিন্তু খাবে না। এখানে না খাবে তো খাবে কোন চুলোয়? কাছাকাছির মধ্যে একটা মুদিখানার দোকান নেই তো হোটেল! আসলে সবই ধাপ্পা।

সে আশ্রয় নিতে এসেছে, কিন্তু কোনো বিনয় নেই। কথা নেই। যেটুকু কথা বলে তা যেন অর্ডার করা! যেন তার নিজের বাড়িতে এসেছে। এ বাড়ির সেইই যেন কর্তা!

এই সব দেখেশুনে জনার্দনের মনে হচ্ছে লোকটা সমাজবিরোধীদেরই একজন। ভাগ্যি কৃপানাথ আগে থেকে সাবধান করে দিয়েছিল ভালো ব্যবহার করতে। এখন সকালবেলায় মানে মানে বিদেয় হলেই বাঁচা যায়।

কিন্তু সকাল? সে তো ঢের দেরি। এখন সবে রাত দশটা। গোটা রাত পড়ে রয়েছে।

যদি ডাকাতই হয় তাহলে কী মতলবে আজ রাতের অতিথি হলো বোঝা যাচ্ছে না। বোঝা যাচ্ছে না বলেই ভয় হচ্ছে। খুব সাবধানে থাকতে হবে। অবশ্য সাবধান আর হবে কি নিয়ে? একটা ভোতা দা পর্যন্ত নেই। তার ওপর টনিটা হয়েছে রামপাকা। খামোকা নাম জিজ্ঞেস করতে গিয়ে খচিয়ে দিল লোকটাকে।

.

…টনির মাও শুয়ে আছে চোখ বুজিয়ে। ঘুম আসছে না। আজ সন্ধে পর্যন্ত মনটা বেশ ভালোই ছিল। কড়া শীত। সেই সঙ্গে বৃষ্টি। বেশ মৌজ করে গরম খিচুড়ি আর ডিম ভাজা খাবে বলে সাত তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে ঢুকেছিল। কিন্তু কোথা থেকে একটা উটকো লোক এসে মেজাজটা খিঁচড়ে দিল। এমনি সাধারণ লোক হলে ভাবনার কিছু ছিল না। কিন্তু এ লোকটা যেন কেমন। মুখটাও ভালো করে দেখা গেল না।

লোকটা বোধহয় অবস্থাপন্ন। গাড়ি করে আসছিল। শুধু কফি খেল। আর কিছু খেল না। এটা কি তাদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা? এমনকি রাতেও কিছু খেতে চাইল না। ভেবেছে কি তারা খুব গরিব?

একটু গল্পগুজব তো করবে। তাও না। সাত তাড়াতাড়ি শুতে চলে গেল। বিছানা পরিষ্কার করা, মশারি টাঙানো এটুকুও করতে দিল না। এমনকি ঘরে লণ্ঠন পর্যন্ত নিল না।

কেন?

এখন যে ভয়টা করছে, সেটা হচ্ছে লোকটা বোধহয় ডাকাতই। কৃপানাথবাবু তো আগেই সাবধান করে দিয়েছিলেন।

আর একটা গোলমেলে ব্যাপার আছে। সেটা অবশ্য নিজেদের ব্যাপার।

গড়িয়ায় তাদের নিজেদের একটা ছোটোখাটো বাড়ি আছে। সেখানেই বেশ দিন কাটছিল। হঠাৎ কর্তার কী খেয়াল হলো বাইরে কোথাও গিয়ে মুক্ত আলো বাতাসে একটু হাঁপ ছেড়ে বাঁচবে।

প্ল্যানটা খারাপ লাগেনি। তা বলে এই জায়গা! এ তো একটা ভুতুড়ে বাগানবাড়ি! তবু কেন কর্তা শেষ পর্যন্ত এই জায়গাটাই পছন্দ করলে বোঝা গেল না। জিজ্ঞেস করলেও ভালো করে উত্তর দেয় না।

এখন মনে হচ্ছে লোকটা খুনে ডাকাতই হবে। যেন সব সময়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে চায়।

তা ডাকাতই যদি হয় তাহলে এ বাড়িতে কেন? কী এমন আছে তাদের যে ডাকাতি করবে? তা ছাড়া এই নির্জন বাড়িতে ডাকাতের অতিথি সেজে আসার দরকার ছিল কি? ঘরে ঢুকে পকেট থেকে রিভলভার বের করে তাক করলেই তো কাজ হাসিল হয়ে যেত।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, লোকটা সব সময়ে পকেটে হাত গুঁজে ছিল বটে!

 মহা মুশকিল! এরকম রহস্যজনক লোক বাড়িতে ঢুকিয়ে রাত কাটানো যায়?

ঠং ঠং করে দেওয়াল ঘড়িটায় বারোটা বাজল।

নাঃ, ঘুম আসছে না। ওদিকে কর্তা লেপ মুড়ি দিয়ে পড়ে আছে। ঘুমিয়ে গেছে নিশ্চয়ই।

কিন্তু টনি একা ওর ঘরে কী করছে? ভয় পাচ্ছে না তো? খুব বুদ্ধিমান ছেলে। একটুতেই সব বুঝে ফেলে। তেমনি সাহসী। ওর বাবা যখন গ্যাট হয়ে বসে রইল তখন ও-ই তো গিয়ে দরজা খুলে দিল। ও-ই তো ঐ অদ্ভুত লোকটার কাছে গিয়ে নাম জিজ্ঞেস করল। তাতে লোকটা রেগে গেল। আবার ওর বাবাও রেগে গেল ছেলের ওপর কী দরকার পাকামো করে তার নাম জিজ্ঞেস করার?

ছেলেটা একটু অদ্ভুত প্রকৃতির। ছোটোবেলা থেকেই ওর মনটা বড়ো উদাস। নির্জন জায়গা পছন্দ করে। চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে কী ভাবে। কারো সঙ্গে মিশত না। এখনও তাই। এই নিরিবিলি জায়গা ওর খুব ভালো লেগেছে। এখন ইস্কুলের ছুটি। এখানে এসে পর্যন্ত বাড়ি থাকে না। সারা দুপুর টো টো করে ঘুরে বেড়ায়।

একদিন দেখল টনি ওদিকের ঐ কবরখানা থেকে বেরিয়ে আসছে। কী সব্বনাশ! শ্মশানে মশানে-কবরখানায় কেউ শখ করে যায়?

জিজ্ঞেস করলে হেসে বলল, জায়গাটা ওর খুব ভালো লাগে। ওখানে কত কাল ধরে কত লোকে মাটির নিচে শুয়ে আছে। আহা বেচারি।

টনি একটা অদ্ভুত কথা বলল, জান মামণি, আমি গেলে ওরা খুব খুশি হয়। আমার সঙ্গে ওরা ইশারায় কথা বলে।

না না, ওখানে খবরদার যাস নে।

 কিন্তু টনি শোনে না। শুধু হাসে। সত্যিই ছেলেটা অদ্ভুত।

পাদ্রীবাবা বলেছিলেন, এর দিকে নজর রেখো। ওর অযত্ন করো না। ও অন্য ধরনের ছেলে।

অনেকদিন পর পাদ্রীবাবার কথা মনে পড়ল। ঋষিতুল্য লোক। ওঁর দয়াতেই তো—

 ঠং করে ঘড়িতে একটা বাজল।

নিশুতি রাত। বাইরে এখনও টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। আবার সেই বেড়ালের কান্না। এই বৃষ্টিতে রাস্তায় বেড়াল কোথা থেকে এল?

হঠাৎ টনির মার কান দুটো সজাগ হয়ে উঠল। কোনো কিছুর শব্দ হলো কি? এ ঘরে নয়। ওদিকের ঘরে…।

টনি ভালো করে দরজায় খিল দিয়েছে তো?

 এই সময়ে জনার্দন এপাশ ওপাশ করল।

ঘুমোওনি?

জনার্দন অস্ফুট স্বরে বললে, না। ঘুম আসছে না।

আমারও। একটু থেমে বলল, আমি ভালো বুঝছি না।

 বুঝে দরকার নেই, বললে জনার্দন। সকালে যদি না যায় ওকে এড়িয়ে থেকো।

এই বলে জনার্দন উঠল। অন্ধকার ঘর। মালতীও হঠাৎ উঠে বসল। কোথায় যাচ্ছ?

বাথরুমে।

 আমার মনে হচ্ছে আমাদের দরজার কাছে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে।

.

টনির সংশয়

আজকের সন্ধেটা টনির বেশ ভালোই লাগছিল। শীতকাল তার খুব পছন্দ। তার ওপর যদি সন্ধে থেকে বৃষ্টি হয় তাহলে তো কথাই নেই। একটাই আনন্দ কখন লেপের তলায় ঢুকবে। আজ আবার গরম খিচুড়ি আর ডিম ভাজা। তোফা!

কিন্তু দরজায় কড়া নাড়াটাই সব গণ্ডগোল করে দিল। হ্যাঁ, এইরকম সন্ধায় হঠাৎ কেউ এলে একটু ভয়-ভয় করে বৈকি। কিন্তু তার ভয় করেনি। সে ভেবেছিল নিশ্চয় কোনো আশ্রয়প্রার্থী। আর ক্ষুধার্ত মানুষকে যে দুমুঠো খেতে দেয় কিংবা আশ্রয়প্রার্থীকে যে আশ্রয় দেয়, ঈশ্বর তাকে ভালোবাসেন। তাই শুধু মানুষ কেন, একটা কুকুর-বেড়াল হলেও সে তাড়িয়ে দেয় না।

দরজাটা সে খুলে দিতে গেল। কিন্তু বাবা গেল না। বাবা শক্তসমর্থ মানুষ। তবুও বাড়িতে এক এক সময়ে কেমন যেন অন্যমনস্ক থাকে। সব সময়ে কী যেন ভাবে।

বাবা দরজা খুলতে গেল না। আশ্চর্য! বাবা ভয় পেল।

মুশকিল! বাবাও যদি কাউকে দেখে ভয় পায় তাহলে বিপদের সময় কে সাহস দেবে? অথচ বাবা কখনোই ভীতু নয়। ভয় পাবার অবশ্য কারণ ছিল।

লোকটার মুখ ভালো করে দেখা যাচ্ছিল না। তাকে আশ্রয় দেওয়া হলো কিন্তু তার কোনো কৃতজ্ঞতাবোধ নেই। খসখসে গলায় শুধু শুকনো ধন্যবাদ দিল।

সে কফি খেল দূরে বসে। ডাইনিং টেবিলে এল না। কোনো গেস্ট এলে সে কি তফাতে বসে?

আরও ব্যাপার আছে। কফি খাবার জন্যেও পকেট থেকে হাত বের করছিল না। সে সময়ে হঠাৎ লণ্ঠনটা নিভে যায়। সেই অন্ধকারের মধ্যে লোকটা কফি খেয়ে নেয়। খেয়েই সে হাত দুটো পকেটে ঢুকিয়ে দেয়।

কেন? তার হাতে কি পোলিও হয়েছে? না কি কুষ্ঠ?

আরও আশ্চর্যের ব্যাপার, অত গরম কফি এক মিনিটে খেল কী করে? ম্যাজিক?

এই ছোটো ছোটো ব্যাপারগুলো তাকে ভাবিয়ে তুলেছে। যতই ভাবছে, ততই তার কৌতূহল বাড়ছে। বেশ মজার। ধীরে সুস্থে মাথা খেলাবার মতো একটা জিনিস পেয়েছে।

আর একটা আশ্চর্য ব্যাপার–লোকটা এ বাড়িতে এসে নিজের পরিচয় ভালো করে দিল না। এ বাড়ির কর্তারও কোনো পরিচয় জানতে চাইল না। যেন সে এ বাড়ির লোকদের চেনে।

সত্যিই কি চেনে?

সে নিজের নাম পর্যন্ত বলেনি। তাই বাধ্য হয়ে টনি নিজেই নাম জিজ্ঞেস করল। হয়তো এটা ছোটো মুখে বড় কথা। তবু কৌতূহল। কিন্তু লোকটা অযথা তার ওপর রেগে গেল। কেন?

আচ্ছা, কাল রাত্তিরে জানলায় অমন শব্দ হলো কেন? কেউ কি সত্যিই জানলা ঠেলছিল? তার সঙ্গে আজকের এই লোকটার কি কোনো সম্পর্ক আছে? ভাবতে ভাবতে টনির মাথাটা কিরকম গরম হয়ে উঠল।

ওদিকের ঘড়িতে ঢং ঢং করে বারোটা বাজল। এত রাত পর্যন্ত সে কখনও জাগে না। আজ ভেবেছিল বই-খাতা গুটিয়ে, খিচুড়ি খেয়ে তাড়াতাড়ি লেপের মধ্যে ঢুকবে। কিন্তু তা আর হলো না। ঐ লোকটা এসে সব নষ্ট করে দিল।

তার ঘরে তার একটা ছবি ছিল। সেটার দিকে চোখ পড়তেই সে যেন একটু আরাম পেল। সে ছবির কথা ভেবে ভয় ভুলে থাকতে চেষ্টা করল। তার চার-পাঁচ বছরের ছবি। ছবিটা তুলেছিলেন পাদ্রীবাবা চার্চের চাতালে বসিয়ে। ছবি তোলা সে কখনও দেখেনি। সেই প্রথম ছবি ভোলা দেখল। নিজের ছবি দেখে অবাক।

সেই ছবিটার দিকে চোখ পড়তেই তার ছোটোবেলার কথা মনে পড়ল। তখন সে খুবই ছোটো। তার মা-বাবার কথা মনে নেই। চন্দনপুর গ্রামের একটা চার্চের চাতালে সে বসেছিল। কী করে সে এখানে এল তা সে জানে না।

সেই চার্চের এক দয়ালু পাত্রী তাকে একা দেখে নিজের কাছে নিয়ে রাখেন। পাদ্রীর কাছে সে মাস ছয় ছিল। এইটুকু বয়েস থেকেই সে পাদ্রীর সঙ্গে রোজ চার্চে যেত। প্রেয়ার শুনত। আর প্রভু যিশুর কথা ভাবত। সেই থেকে তার মনটাই কেমন উদাস হয়ে গেল। আর সেই সঙ্গে বেড়ে গেল সাহস। মনের জোর।

তাকে যখন পাদ্রীবাবা তার কাছে নিয়ে আসেন তখন প্রবল শীতে তার পরনে একটা ময়লা হাফপ্যান্ট আর ছেঁড়া হাফশার্ট ছাড়া আর কিছুই ছিল না। আর ছিল একটা লোহার কবচ কালো কারে বাঁধা। কবচটা তার রোগা রোগা হাতের তুলনায় বেশ ভারী। পরে থাকতে কষ্ট হতো। পাদ্রীবাবা সেটা প্রায়ই দেখতেন। একদিন জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কি মনে আছে কবচটা তোমায় কে দিয়েছিল? সে জানিয়েছিল মনে নেই। পাদ্রী বলেছিলেন, তুমি যেখানে যে অবস্থাতেই থাক কবচটা কখনো খুলো না।

তা সে কখনো খোলেনি। তবে সে মাঝে মাঝে লক্ষ্য করত লোহার কবচটা কিরকম সোনার মতো জ্বলজ্বল করছে। তখনই তার মাথাটা কিরকম ঝিমঝিম করে উঠত। তারপর আবার ঠিক হয়ে যেত। সে এও লক্ষ্য করেছে যখনই কোনো বিপদে পড়েছে তখনই ওটা রঙ বদলাতো। বিপদ কেটে গেলে আবার আগের মতো ম্যাড়ম্যাড়ে লোহা।

তারপর একদিন

ঘড়িতে ঢং ঢং করে একটা বাজল। বাইরে বৃষ্টি পড়েই চলেছে। হঠাৎ তার মনে হলো লোকটা তো পাশের ঘরেই আছে। কী করছে দেখা যাক।

টনি বিছানা থেকে উঠল। পার্টিশনটা অনেক ফঁকফোকর। সেই ছিদ্র দিয়ে ঘরের মধ্যে দেখতে লাগল। কিন্তু কিছুই দেখতে পেল না। শুধু অন্ধকার। সে অন্ধকারটাও কেমন ভয়ঙ্কর। মনে হলো ঘরভর্তি যেন আলকাতরা ঠাসা।

একটু পরে অন্ধকারে যখন দৃষ্টি সয়ে গেল তখন সে দেখে অবাক হলো–বিছানায় কেউ নেই।

লোকটা গেল কোথায়? অথচ দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ।

আশ্চর্য! লোকটা ঘর থেকে উবে গেল নাকি? ম্যাজিক-ট্যাজিক জানে?

হঠাৎ সে চমকে উঠল। দেখল মাটিতে কিছু একটা যেন নড়ছে। ফুটোর ওপর আরও ঝুঁকে পড়ল টনি। তখনই যে দৃশ্যটা দেখল তাতে সে ভয়ে শিউরে উঠল।

দেখলো খাটের তলা থেকে কেউ যেন গড়িয়ে গড়িয়ে বেরিয়ে আসছে।

 হ্যাঁ, সে মিস্টার গুর্গে।

কিন্তু বিছানা থাকতে চৌকির নিচে মাটিতে শুয়েছিল কেন?

এই কথাটা মনে হতেই তার যেন শিরদাঁড়া বেয়ে একটা বরফের স্রোত বয়ে গেল।

বুঝতে পারল লোকটা তাহলে ধুলোতেই শোয়। তার ঐ যে দেহটা, ওটা বিছানায় শোবার জন্য নয়।

টনির মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। মনে হলো এখনি অজ্ঞান হয়ে যাবে। কিন্তু অসাধারণ মনের জোরে সামলে নিল। দেখতেই হবে লোকটা কী করে?

লোকটা উঠে দাঁড়াল। তার গায়ে এখনও সেই সন্ধের পোশাক। শুধু ওয়াটারপ্রুফটা যেন একটু বেশি দীর্ঘ বলে মনে হচ্ছে।

লোকটা দরজা খুলে ভেতরের ডাইনিং হলের দিকে এগোতে লাগল। তার অস্বাভাবিক লম্বা ওয়াটার প্রুফটার একটা অংশ মাটিতে লুটোচ্ছে।

কিন্তু একী! লোকটা বাবার ঘরের দিকে যাচ্ছে। তার প্রতি পদক্ষেপ একটা অস্বাভাবিক শব্দ হচ্ছে খস্ খস্ খস্।

লাফিয়ে উঠল টনি। সোয়েটারটা গায়ে দিতে গেল আর তখনই কবচটা তার বাহুতে খচ করে লাগল। লোহার কবচটা ধীরে ধীরে রঙ বদলাচ্ছে।

বুকে অমিত সাহস নিয়ে টনি বেরিয়ে এল ঘর থেকে। এসে দাঁড়াল একেবারে সেই লোকটার সামনে।

আঙ্কেল!

 চমকে ফিরে তাকাল মিস্টার গুর্গে। দুচোখে যেন আগুন ঝরছে।

 আঙ্কেল, আপনি এত রাতে এখানে?

বাথরুমটা—

বাথরুম তো আপনার ঘরের পাশেই। মা তো দেখিয়ে দিয়েছে।

ও! ঠিক আছে। বলে টনির দিকে বিষাক্ত তীরের মতো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেল।

ঠিক তখনই দরজা খুলে বেরিয়ে এল টনির মা। কি হয়েছে টনি?

কিছু না। তুমি ঘুমাও গে।

.

দু’বছর আগের একটি ঘটনা

ভোরবেলা।

তখনও জনার্দন ওঠেনি। টনির মা অতিথির জন্যে চায়ের জল চাপিয়ে দিয়েছে। একটা দীর্ঘ কালো ছায়ার মতো মিস্টার গুর্গে এসে দাঁড়াল বেশ একটু তফাতে। সন্ধেবেলার সেই একই পোশাক। ওয়াটাবপ্রুফটা শুধু কাঁধের ওপর একটা বিরাটাকার মরা শকুনির মতো ঝুলছে।

আমি এখন যাচ্ছি। খসখসে গলায় বলল গুর্গে।

সে কি! চা খেয়ে যাবেন না?

না।

এই সময়ে জনার্দন ঘুম চোখে বেরিয়ে এল। টনিও এসে দাঁড়িয়েছে। তার কৌতূহলের শেষ নেই।

চললেন নাকি? জনার্দন জিজ্ঞেস করল।

গুর্গে বিশ্রীভাবে মিনিটখানেক তাকিয়ে রইল জনার্দনের দিকে। তারপর বলল, হ্যাঁ। আবার আসছি। দেখা হবে। কাজ বাকি আছে।

কী কাজ আর জানতে চাওয়ার সাহস হলো না জনার্দনের।

একটা অভদ্র দুর্বিনীত লোকের মতো গুর্গে বেরিয়ে যাচ্ছিল, টনিকে দেখে বলল, এই যে তুমিও রয়েছ। আমার সঙ্গে এসো তো। খালের ধারে আমার গাড়িটা রয়েছে। একটু ঠেলার দরকার হবে।

লোকটার একটু উপকার করার জন্য টনির মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠল। তা ছাড়া ভাবল লোকটাকে হয়তো ভালো করে জানাও যাবে, কী তার উদ্দেশ্য। তাই সে রাজি হলো। মা তখন রান্নাঘরে। ইচ্ছে করেই মাকে কিছু বলল না। হয়তো মা যেতে দেবে না।

কিন্তু মায়ের প্রাণ, হঠাৎ অজানা একটা ভয়ে ছটফট করে উঠল। এদিকে টনি তখন দরজা খুলে গুর্গের পিছু পিছু বেরোচ্ছে, তার হাতের কবচটা রঙ বদলাচ্ছে। কবচটা কেমন ভারী হয়ে উঠছে।

এখন হচ্ছে কেন? টনির মনে দুশ্চিন্তা। তবে কি কোনো বিপদ

আর তখনই ওর মা ছুটে এসে ডাকল, টনি, কোথায় যাচ্ছ? সকালবেলা পড়াশোনা নেই?

অগত্যা টনিকে ফিরতে হলো। একবার পিছন ফিরে দেখল মিস্টার গুর্গে যেন একটা বাজ-পড়া তালগাছের মতো জ্বলছে।

গত রাতে গুর্গের ঘরে উঁকি মেরে দেখে টনির যা অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে তার সংশয় আরো বেড়ে গেল। লোকটা যেই হোক, গভীর রাতে বাবার শোবার ঘরের দরজার পাশে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে ছিল কেন? তবে কি বাবার ওপর আক্রোশ আছে? কিসের জন্য আক্রোশ? টনি ঠিক করল এটার একটা ফয়শালা করতে হবে।

বেলা নটা। জনার্দন তার ঘরে বসে কী সব হিসেবপত্র করছিল, টনি এসে দাঁড়াল।

একটা কথা জানতে ইচ্ছে করছে। বলবে?

জনার্দনের মেজাজটা ভালো ছিল না। ভুরু উঁচিয়ে টনির দিকে তাকালো।

 তুমি কি ওই লোকটাকে চেনো?

ঐ লোকটাকে? না, কখনোই না।

মিস্টার ওর্গে যেন তোমায় চেনে বলে মনে হলো।

কী সব পাগলের মতো বকছ! যাও! কাজ করতে দাও।

একবার টনি ভাবল বলে ফেলে সাবধান হও। সামনে ভয়ঙ্কর বিপদ। কিন্তু বলল না। বলে লাভ নেই। বাবা বিশ্বাস করবে না। বিমর্ষ মনে টনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

টনি চলে গেল কিন্তু জনার্দন আর কাজে মন বসাতে পারল না। তার কেবলই মনে হতে লাগল কেন টনি ঐ কথা বলল। গুর্গেকে সে সত্যিই চেনে না। কখনো ঐ রকম কাউকে দেখেনি। গুর্গেই বা তাকে চিনবে কী করে? তবু কেন টনি ও কথা বলল? কিসে তার ঐরকম উদ্ভট চিন্তা মাথায় এল?

জনার্দন গুম হয়ে বসে ভাবতে লাগল। গড়িয়ায় নিজের বাড়িতে এতকাল থেকেছে, নিজের কন্ট্রাক্টরি কাজ নিয়ে অনেকের সঙ্গেই মেলামেশা করতে হয়েছে। কিন্তু মনে রাখার মতো ঘনিষ্ঠ লোক…হা, দুজন ছিল।

মনে পড়ল, প্রায় দুবছর আগে একদিন

সন্ধেবেলায় গড়িয়ার বাড়িতে একটি ছেলে এল। ছেলেটির বয়স আঠারো-উনিশ। সুন্দর স্বাস্থ্য, ফর্সা রঙ, মুখে শান্ত ভাব। তাকে দেখে জনার্দন অবাক হলো।

কাকে চাই?

 আপনাকে।

 আমাকে! আমাকে তুমি চেন?

ছেলেটির মুখে হাসি নেই। যেন এক বোঝা দুশ্চিন্তা মাথায় করে এসেছে। বলল, আপনি তো জনার্দনবাবু। আমার বাবা রতিকান্ত–

ও! আচ্ছা, তুমি রতিকান্তর ছেলে? বেশ বেশ। আমি তো কখনো তোমায় দেখিনি।

কিন্তু আমি আপনাকে দেখেছি অনেকবার। আমাদের বাড়ি গিয়ে বাবার সঙ্গে দরজা বন্ধ করে গল্প করতেন।

জনার্দন একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিল। সামলে নিয়ে বলল, হ্যাঁ, ও-ই আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে ওর ঘরে বসাতো। বিজনেসের কথাবার্তা হতো। তা বলো কী ব্যাপার?

কাকাবাবু, বাড়িতে বাবা-মার মধ্যে কেবলই ঝগড়া অশান্তি হচ্ছে। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আমার মনে হচ্ছে কোনোদিন কিছু একটা বড়ো ধরনের বিপদ ঘটে যাবে।

জনার্দন একবার এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিচু গলায় বললে, তোমার কাকিমা এখন ব্যস্ত। চা খাওয়াতে পারছি না। তাছাড়া এসব ব্যাপার বাড়িতে আলোচনা করা ভালো নয়। চলো, রাস্তায় দাঁড়িয়ে শুনি।

দুজনে রাস্তায় নেমে একটা নিরিবিলি জায়গায় এসে দাঁড়াল।

 তা আমায় কী করতে বল?

আপনি বাবার একমাত্র বন্ধু। বাবাকে বোঝান যেন মায়ের ওপর অত্যাচার না করে।

তা না হয় বলব। কিন্তু কেন অত্যাচার করে তা তো জানি না।

ছেলেটি এবার চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো। কাকু, সত্যিই কি আপনি জানেন না?

জনার্দন ঢোঁক গিলে বলল, না, ঠিক জানি না। তা ছাড়া অন্যের পারিবারিক ব্যাপার নিয়ে

বাবা যে লোক ভালো নয় তা তো জানেন। বাবার অনেক কুকীর্তি আছে। মা তা সহ্য করতে পারে না। তারপর লক্ষ্মীনারায়ণ আবার আমাদের বাড়িতে যাওয়া-আসা শুরু করেছে।

লক্ষ্মীনারায়ণ!

জনার্দনের মুখটা মুহূর্তে ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। ছেলেটার তা লক্ষ্য এড়াল না। বলল, লক্ষ্মীনারায়ণকে তাহলে আপনিও চেনেন?

হ্যাঁ, চিনি বৈকি। সে তো সাংঘাতিক লোক?

সেই লক্ষ্মীনারায়ণ বাবাকে একেবারে হাতের মুঠোর মধ্যে পুরে ফেলেছে। বাবা বোধহয় অনেক টাকা ধার করেছে ওর থেকে।

শোধ করছে না?

 করছে অল্প অল্প করে। কিন্তু

থামলে কেন? বলো।

আসলে লক্ষ্মীনারায়ণের মতলব অন্যরকম। আমাদের বাড়িতে একটা খুব মূল্যবান জিনিস আছে। সেটা লক্ষ্মীনারায়ণ হাতাতে চায়। কিন্তু মা প্রাণ থাকতে তা দেবে না। বাবা প্রাণের দায়ে সেটা লক্ষ্মীনারায়ণকে বেচে দিতে চায়।

.

…এ কী ঘুমোচ্ছ! অফিস যাবে না? জনার্দন যেন ঘুম থেকে জেগে উঠল। এমনি ভান করে তাকাল।

ওঃ তাইতো অনেক বেলা হয়ে গেছে। কাল রাত্তিরে ভালো ঘুম হয়নি। তাই

 আজ হবে তো? ম্লান হাসল মালতী। তিনি তো আবার আসবেন বলে গেছেন।

জনার্দনের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

.

আরও রহস্য

 গুর্গে নামে লোকটা চলে যাবার পর টনি ঐ ঘরটায় ঢুকল। ভাবল ঘরে তেমন কিছু পাওয়া যায় কিনা দেখতে হবে। সে তন্নতন্ন করে সারা ঘর খুঁজছিল। কিন্তু গত রাত্রে যে এই ঘরে কেউ ছিল তার কোনো চিহ্ন দেখতে পেল না। তবে একটা জিনিস অনুভব করল ঘরের ভেতরের বাতাসটা যেন বড্ড ভারী। আর গুমোট ভাব। দম আটকে আসে। অথচ এই ঘরে সে তো আগেও এসেছে, তখন এমন মনে হয়নি।

ফিরে আসবার সময়ে হঠাৎ ওর কী খেয়াল হলো চৌকির তলাটা হেঁট হয়ে দেখল। সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠল। ওগুলো কী? অর্ধেক মেঝে জুড়ে কালো কালো কী নড়ে বেড়াচ্ছে?

ভালো করে ঠাওর করে দেখল একঝাঁক মাছি। এই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ঘরে এত মাছি এল কোথা থেকে?

গা-টা শিউরে উঠল টনির। সবই মিলে যাচ্ছে–কেন বিছানা থাকতেও মাটিতে ধুলোয় শোয়, কেনই বা তার শোবার জায়গায় মাছি ভনভন করে!

টনি সকালের চ-জলখাবার খেল। কিন্তু খুবই অন্যমনস্ক। কিছুতেই মন শান্ত করতে পারছে না। লোকটা সত্যিই কি প্রেতাত্মা? মানুষের চেহারা ধরে এসেছে তাদের ক্ষতি করতে? ঠিকমতো জবাব পায় না।

মনটা এরকম উতলা হলেই ও চলে যায় কবরখানায়। ওখানে নিরিবিলিতে বসে ঠান্ডা মাথায় ভাবতে পারে। আজও তাই সে কবরখানার দিকে চলল।

কবরখানার কাছাকাছি যখন গিয়েছে তখন দেখল একটা লোক কবরখানার দিকে যাচ্ছে। খুব আশ্চর্য হলো। যে কবার সে এখানে এসেছে কখনো সে কাউকে এদিকে আসতে দেখেনি। এ আবার কে?

আরও একটু এগোতেই সে চমকে উঠল। বাবা!

টনি খুব খুশি হলো বাবাকে কবরখানার দিকে যেতে দেখে। সে অমনি ছুটল। কাছে গিয়ে ডাকল, বাবা!

জনার্দন চমকে পিছন ফিরে তাকাল।

 বাবা, কোথায় যাচ্ছ?

জনার্দন কেমন থতমত খেয়ে গেল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, আমি? না, আমি তো কোথাও যাইনি।

টনি হেসে বলল, যাওনি কী? এই তো যাচ্ছ?

 জনার্দন ফ্যালফ্যাল করে চারিদিকে তাকাল। যেন বুঝতে পারল না কোথায় যাচ্ছে।

 কি হলো? দাঁড়িয়ে পড়লে কেন? চলো।

 জনার্দন যেন ঘুমের ঘোরের মধ্যে বলল, কোথায়?

 টনি হাসল। বলল, যেখানে যাচ্ছিলে, কবরখানায়। দেখবে কী চমৎকার জায়গা।

হঠাৎ জনার্দন চমকে উঠল। ভয়ানক ভয় পেল। চেঁচিয়ে বলল, না না, আমি ওখানে যাব না। বলেই হনহন করে বাড়ির দিকে ফিরে চলল।

টনি অবাক হয়ে ভাবতে লাগল বাবার হলো কী! কেনই বা অফিস যাব বলে বেরিয়ে কবরখানার দিকে যাচ্ছিল, কেনই বা অমন করে ফিরে যাচ্ছে? যাই হোক সেও বাবার পিছুপিছু রাড়ি এসে ঢুকল।

সে রাত্রেও ওরা ভয়ে ভয়ে বিছানায় শুলো। না জানি আজ আবার কোনো শব্দটব্দ শোনা যায় কিনা।

না, তেমন কিছু হলো না। মাঝে মাঝে শুধু পিছনের মাঠে একটা বেড়ালের কান্না শোনা যাচ্ছিল। তারপর একসময়ে তাও থেমে গেল। এক ঘুমেই রাত কাবার। সকালে জনার্দন চুপচাপ তার কাজ করল। কিন্তু বড়ো গম্ভীর। বেলা বারোটার মধ্যে নাওয়া-খাওয়া শেষ। তারপরেই জনার্দন ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ল।

মালতী জিজ্ঞেস করল, আজও কাজে যাবে না?

জনার্দন বললে, না, শরীরটা ভালো নেই। বলে পাশ ফিরে শুয়ে চোখ বন্ধ করল।

….একদিন গভীর রাতে জনার্দনের গড়িয়ার বাড়ির দরজায় টোকা পড়ল।

এত রাতে কে এল? জনার্দন ভয় পেল। তবু সে সাবধানে বেরিয়ে এল। দরজা খুলে দেখল রতিকান্ত।

আমার খুব বিপদ। তুমি শিগগির এসো।

বাড়িতে কিছু না বলে সে তখনই রতিকান্তর সঙ্গে বেরিয়ে এল। একটু ভয়-ভয় করছিল। কী এমন বিপদ যে এত রাত্রে তাকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে? লক্ষ্মীনারায়ণের মুখোমুখি হতে হবে না তো?

রতিকান্তর বাড়ি এসে জনার্দন দেখল রতিকান্তর বৌটা মরে পড়ে আছে। ভীষণ ভয়ে সে বলে উঠল, এ কী কাণ্ড!

চুপ করো। একটি কথাও জিজ্ঞেস করো না। এখন বলল কি করা উচিত।

জনার্দন সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার ছেলে কোথায়?

জানি না। আমাদের অশান্তির জন্যে দুদিন বাড়ি ঢোকেনি। যাই হোক এখন যা করার তুমি করো।

একটু থেমে বলল, জানই তো আমি মোটেই পুলিশের সুনজরে নেই। ব্যাটারা আমাকে দেখলেই পাকড়াবে। তারপরে ঘরে বৌয়ের লাশ দেখলে আর রক্ষে নেই। একেবারে কঁসিকাঠের ব্যবস্থা পাকা হয়ে যাবে।

রতিকান্ত আবার একটু থামল। তারপর বলল, ঐ পাসটা রাখো। টাকা আছে। ঐ দিয়ে লাশটার গতি করো।

হ্যাঁ, বন্ধুর জন্যে জনার্দন চমৎকারভাবে সব ম্যানেজ করল। কাকপক্ষীতে টের পেল। তারপর

মালতী এসে বলল, ওঠো ওঠো। চা হয়ে গেছে।

জনার্দন ধীরে ধীরে উঠে চায়ের টেবিলে গিয়ে বসল।

টনি বলল, আজও অফিস গেলে না। কি হয়েছে?

শরীরটা ভালো নেই।

চলো একটু বেড়িয়ে আসি। তাহলেই শরীর ঠিক হয়ে যাবে।

কোথায় যাবি?

খিদিরপুর চলো না। জায়গাটা আমি দেখিনি। ওখানে ডক আছে। না?

খিদিরপুর শুনেই জনার্দন চমকে উঠল। তারপর কী ভেবে বলল, আচ্ছা, চলো।

চা খেয়ে দুজনে বেরিয়ে যাচ্ছিল, মালতী জনার্দনের হাতে টর্চটা দিয়ে বলল, এটা রাখো। আর তাড়াতাড়ি ফিরো। বাড়িতে আমি একা।

তবে থাক। যাব না।

মালতী তাড়াতাড়ি বললে, না না, ঘুরে এসো। সবসময়ে তো বাড়িতেই বসে আছ।

.

চন্দনপুরের পাদ্রীবাবা

বিকেলে জনার্দন আর টনি বেরিয়ে গেল। মালতী লক্ষ্য করল মানুষটা আজ বড়ো অন্যমনস্ক। সবসময়ে কী যেন ভাবছে। অবশ্য ভাবাটা কিছু অস্বাভাবিক নয়। গুর্গে নামে লোকটা সবাইকেই ভাবিয়ে তুলেছে। সবচেয়ে ভয়ের কথা লোকটার আচরণ। পরশু রাতদুপুরে কেন লোকটা তাদের শোবার ঘরের দরজার কাছে এসে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়েছিল? বাথরুম খুঁজছিল এটা মিথ্যে কথা।

আর টনি? টনিকে নিয়েই এখন তার যত দুর্ভাবনা। বড্ড বেশি সাহস ওর। আর বড্ড বোকা। নইলে ঐ লোকটা গাড়ি ঠেলবার জন্যে ডাকতেই যেতে চাওয়া উচিত হয়েছিল? তার মায়ের প্রাণ অশুভ কিছু ঘটবে টের পেয়েছিল। তাই আটকে ছিল।

হ্যাঁ, মায়ের মন……

.

শূন্য সংসারে যখন বুকচাপ কান্না গুমরে গুমরে উঠত তখনই বুঝি ভগবান মুখ তুলে চাইলেন। চন্দনপুর গ্রামে শিবের মেলায় সন্তানকামনায় হত্যে দিতে গিয়েছিল একাই। ফেরার পথে যখন জল তেষ্টায় কাতর তখন এক বৃদ্ধ পাদ্রীর সঙ্গে দেখা। তিনি বললেন, মা, আমি খ্রিস্টান। তুমি হিন্দু নারী। পুজো দিয়ে ফিরছ। আমার হাতে কি জল খাবে?

সে হেসে বলেছিল, বাবা, জল-বাতাস তো ঈশ্বরের দান। মানুষের হাতে কি তার পবিত্রতা নষ্ট হতে পারে?

পাদ্রী খুশি হয়ে তাকে নিজের কোয়ার্টারে নিয়ে গেলেন। সেখানেই প্রথম দেখল টনিকে। এক নজরেই মায়া পড়ে গেল। তারপর যখন শুনল ওর মা-বাবা কেউ নেই, কেউ তাকে চার্চের চাতালে ফেলে রেখে গিয়েছিল তখন সে তাকে চাইল।

পাদ্রী খুশি হয়ে বললেন, ছেলেটি খুবই ধর্মপ্রাণ। এইটুকু ছেলের ঈশ্বরভক্তি দেখে আমি অবাক হই। এই ছেলে বড়ো হলে একদিন যদি মহাপুরুষ হয়, আমি আশ্চর্য হবো না, তবে মা, আমি বুড়ো হয়েছি। কবে মরে যাব, কে তখন ওকে দেখবে ভেবে দুশ্চিন্তায় থাকি। এখন তুমি যখন ওকে নিতে চাইছ তখন আমি নিশ্চিন্ত।

তারপর তার হাতের কবচটা দেখিয়ে বললেন, এই কবচ ওকে কে দিয়েছিলেন জানি না। তবে এটা সাধারণ কবচ নয়। ঐ দ্যাখো কবচে একটা পঞ্চশূল আঁকা। এই চিহ্ন আগে তান্ত্রিকরা ব্যবহার করতো। যাই হোক দেখো, এই কবচ যেন ও কখনো না খোলে। এটা সম্ভবত ওকে অনেক বিপদ থেকে রক্ষা করবে। আর মাঝে মাঝে ওকে নিয়ে আমার কাছে আসবে। মন খারাপ করলে ওকে দেখতে ইচ্ছে করবে। তোমার ঠিকানাও রেখে যাও।

এইভাবে ছ বছরের টনি তার কোল জুড়ে বসল।

আজ দেখতে দেখতে প্রায় সাত বছর কেটে গেছে। মালতীর ভয় ছেলেটা যেরকম উদাসী কোনোদিন সন্ন্যাসী হয়ে না যায়।

আর ঐ কবচটা? সত্যিই কি ওর তেমন কোনো গুণ আছে? তবে কবচটার কালো কারটা ক্রমশ পল্কা হয়ে যাচ্ছে। ওটা বদলাতে হবে।

কিন্তু আজ হঠাৎ টনির খিদিরপুর যেতে ইচ্ছে করল কেন? কর্তাও এককথায় রাজি হয়ে গেল। হয়তো কিছুই নয়। তবু

মালতীর কেমন ভয় করতে লাগল। এখানে এসে এই কদিনেই সে কিরকম যেন ভীতু হয়ে গেছে।

.

ইদ্রিশ আলি লেন

 ধুলোভরা কাঁচা রাস্তা ধরে হাঁটছিল জনার্দন। ডায়মন্ড হারবার রোড একটু দূরে। সেখানে থেকে বাস ধরে তবে খিদিরপুর।

হ্যাঁ, খিদিরপুর!

তখনই তার আবার সেই দিনকার কথা মনে পড়ল।

…রতিকান্তর স্ত্রীর মৃত্যুর দিন দশেক পর জনার্দনের নিজস্ব ছোটোখাটো অফিসটায় ফোন বাজল।

হ্যালো।

আমি রতিকান্ত।

রতিকান্তর নামটা শুনেই জনার্দনের বুকটা ছ্যাৎ করে উঠেছিল। মনে হয়েছিল ও তো সর্বনাশের পথে এগিয়ে চলেছেই, তাকেও ঐ পথে টেনে নিয়ে যাবে।

ভয়ে ভয়ে বলল, কী বলছ বলো।

 খুব সংক্ষিপ্ত উত্তর এল, বিশেষ দরকার। আজ সন্ধেবেলায় তুমি আসবে।

এ যেন আদেশ। রতিকান্ত তার একমাত্র বন্ধু ঠিকই। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, তার হাত থেকে নিস্তার পেলেই বাঁচে। কিন্তু অত সহজে নিস্তার পাওয়া যায় না। এদিক দিয়ে সে দুর্বল প্রকৃতির।

যথাসময়ে জনার্দন গেল। দরজা ভালো করে বন্ধ করে দিয়ে রতিকান্ত গম্ভীর মুখে একটা চিঠি বের করে দেখাল। চিঠিটা লিখছে ওর একমাত্র ছেলে বাসু।-তোমার কাছে থাকতে আর ইচ্ছে করে না। তোমার ড্রয়ারে টাকা ছিল। নিয়ে চললাম। আমার খোঁজ করা বৃথা চেষ্টা।

যাঃ! ছেলেটাও কেটে পড়ল। বৌ তো আগেই মরেছে। তাহলে তুমি তো এখন মুক্ত পুরুষ হে!

না জনার্দন, বৌ গেছে যাক। কিন্তু ছেলেটাই আমার সব ছিল। ও ওর মায়ের মৃত্যুর জন্যে আমাকেই দায়ি করেছে। সে যাই হোক, এখন বলি যে জন্যে তোমায় ডাকা। ব্যাপারটা খুব গোপনীয়। বিশ্বসংসারে একমাত্র তুমিই জানবে।

একটু থেমে বলল, এদিকে আমি আর একটা ব্যাপারে ফেঁসে গেছি। পুলিশ এখনও টের পায়নি। পেলেই আমায় ধরবে। এখন তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই। তাই

এমনি সময়ে দরজায় কড়া নাড়া। রতিকান্তর মুখ শুকিয়ে গেল। পুলিশ?

 দরজা খোলো।

না পুলিশ নয়। এ গলা লক্ষ্মীনারায়ণের। সাক্ষাৎ যমদূত।

রতিকান্ত ফিসফিস করে বলল, তুমি আজ যাও। কাল এই সময়ে অবশ্য আসবে।

জনার্দন বেরোতেই লক্ষ্মীনারায়ণের সঙ্গে মুখোমুখি। কটমট করে জনার্দনের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্মীনারায়ণ বলল, তুমিই ছিলে এখানে! এতক্ষণ কী শলাপরামর্শ হচ্ছিল? শায়েস্তা করে দেব। বলেই লক্ষ্মীনারায়ণ লাথি মেরে দরজাটা ভালো করে খুলে ঘরের মধ্যে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিল।

শায়েস্তা করে দেব কথাটা তখনও জনার্দনের কানের কাছে বিশ্রী শব্দ করে ঘুরছিল। বুকটা ভয়ে কেঁপে উঠল। তবু, সে চলে গেল না। কী কথা হচ্ছে জানার জন্যে দরজায় কান পেতে রইল।

সব কথা শোনা গেল না। মাঝে মাঝে রাগের মাথায় চেঁচিয়ে যে কথাগুলো বলছিল সেগুলোই শুনতে পেল। যেমন–তুমি পালাবার মতলব করেছ? আগে আমার সব টাকা একেবারে শোধ করো নইলে তোমার কাছে যে জিনিসটা আছে ওটা আমায় দাও।

ওটা আমার কাছে নেই।

কোথায়?

বাসু নিয়ে গেছে।

কোথায় গেছে?

জানি না।

মিথ্যে কথা।

 মা কালীর দিব্যি।

জিব ছিঁড়ে ফেলে দেব। বলো সেটা কোথায়?

 বলছি তো আমার কাছে নেই। ইচ্ছে করলে খুঁজে দেখতে পারো।

ঠিক আছে। সাত দিন পর আবার আসব। তোমার ছেলের কাছেই রাখ আর তোমার ঐ জনার্দনের কাছেই রাখ, সেদিন ওটা আমার চাই। নইলে লাশ ফেলে দেব…

জনার্দনের শরীর কেঁপে উঠল। তাড়াতাড়ি পালিয়ে এল।

পরের দিন সন্ধ্যায় কথামতো দুরুদুরু বক্ষে জনার্দনকে যেতে হলো। রতিকান্ত অপেক্ষা করছিল। তার ঝোড়ো কাকের মতো বিভ্রান্ত অবস্থা দেখে জনার্দন ভয় পেল।

সময় সংক্ষিপ্ত। যে কোনো মুহূর্তে লক্ষ্মীনারায়ণ হানা দিতে পারে। তাই কথা না বাড়িয়ে একটা পেতলের বাক্স খুলে বার করল একটা সোনার মুকুট। আলো পড়ে মুকুটটা ঝলমল করে উঠল। জনার্দনের চোখ ধাঁধিয়ে গেল। কাঁপা কাঁপা গলায় রতিকান্ত বলল, এটা আমাদের বংশের মুকুট। এটার ওপর লক্ষ্মীনারায়ণের শকুনির দৃষ্টি। তোমায় বিশ্বাস করে এটা রাখতে দিলাম। খুব সাবধানে রাখবে। আমার ছেলে ফিরে এলে তাকে দেবে।

একটু থেমে বলল, আর একটা কথা, আমার গোপন ডেরা একমাত্র তুমিই জানো। যত চাপেই পড় না কেন সেখানকার ঠিকানা কাউকে দেবে না। বিশ্বাসঘাতকতা করলে বন্ধু বলে খাতির করব না।

শপথ করে জনার্দন মুকুট নিয়ে চলে এসেছিল। দিন চারেক পরে তার গড়িয়ার বাড়িতে স্বয়ং লক্ষ্মীনারায়ণ এসে হাজির। জনার্দনের বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল।

তোমার বন্ধু পালিয়েছে। তুমি জান ও কোথায় গেছে?

না।

ওর ছেলে কোথায় জান?

না।

জানি এই উত্তরই তুমি দেবে। ঠিক আছে। আমি মানলাম তুমি কিছুই জান না। এখন বল দিকি ও কোথায় কোথায় থাকতে পারে।

জনার্দন বলতে চায়নি। কিন্তু লক্ষ্মীনারায়ণ খুব অল্প কথার মানুষ। ঠান্ডা মাথায় বললে, জনার্দন, বৌ ছেলে নিয়ে ঘর কর। শুধু শুধু জীবন বিপন্ন করবে কেন? ঠিকানাগুলো দাও।

অগত্যা জনার্দন গড়গড় করে ঠিকানাগুলো বলে গেল।

ঠিকানাগুলো লক্ষ্মীনারায়ণ নোট করে নিল। তারপর বললে, আর?

আর নেই।

উঁহু। আরও আছে। খিদিরপুরের কাছাকাছি ওর আরও একটা ডেরা আছে না?

হ্যাঁ আছে। জনার্দন জানে রতিকান্ত প্রায়ই সেখানে গিয়ে লুকিয়ে থাকে। কিন্তু ওর সে ঠিকানা কিছুতেই বলা যাবে না। জনার্দন মন শক্ত করে রইল।

কি হলো, বোবা হয়ে গেলে যে?

লক্ষ্মীনারায়ণের পাথরের মত ভোতা কঠিন মুখের দিকে তাকিয়ে জনার্দন ভড়কে গেল।

 …বাবা, আমরা তো ডায়মন্ড হারবার রোডে এসে পড়েছি না?

হ্যাঁ।

একটা বাস এসে দাঁড়াল। ওরা উঠে পড়ল। মিনিট দশেকের মধ্যেই ওরা খিদিরপুর ব্রিজের কাছে এসে নামল।

টনি জিজ্ঞেস করল, বাবা, এই রাস্তাটা কোথায় গেছে?

এসপ্ল্যানেড।

 এখান থেকে আমাদের গড়িয়ার বাড়ি কতদূর?

অনেক দূর।

কিসে করে যেতে হয়?

এসপ্ল্যানেড থেকে বাস আছে।

আর এদিকটা?

 জনার্দন অন্যমনস্কভাবে উত্তর দিল, এটা গেছে মেটিয়াব্রুজের দিকে।

 ডকটা কোথায়?

 ঐ দিকে।

বাবা, একদিন ডকটা দেখাবে?

জনার্দনের কাছে থেকে তখনই উত্তর পাওয়া গেল না।

জনার্দন কি ভাবছে?

ও বাবা!

 অ্যাঁ।

ডকটা একদিন দেখাবে?

 দেখাব।

ওখানে অনেক জাহাজ আছে, না?

হ্যাঁ।

টনি ফুটপাতে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক দেখতে লাগল। জনার্দন নিজের মনেই বলল, ইদ্রিশ আলি লেনটা যেন কোন দিকে?

একজনকে জিজ্ঞেস করল। সে বলতে পারল না। তারপর একটা পান-বিড়ির দোকানে জিজ্ঞেস করলে বলল, ডকের দিকে মিনিট দশেক হাঁটতে হবে।

জনার্দন হাঁটতে শুরু করল।

টনি জিজ্ঞেস করল, বাবা, ইদ্রিশ আলি লেনে কি আছে?

 কিছু না। এমনিই।

টনি একটু ভাবল। এমনি এমনি কেউ একটা অচেনা রাস্তা খোঁজে? বাবা নিশ্চয় তাকে বলতে চাইছে না।

মিনিট পনেরো হাঁটার পর ডকের কিছু আগে একটা বাঁহাতি রাস্তায় ঢুকল। তারপর আরও কিছুদূর গিয়ে সরু একটা গলি। এটাই ইদ্রিশ আলি লেন। জনার্দন হিসেব করে দেখল এই রাস্তাটা ডায়মন্ড হারবার রোডের সমান্তরাল। অর্থাৎ ডায়মন্ড হারবার রোড থেকে খিদিরপুর না এসে বাঁ দিকেই এই রাস্তাটা। জানা ছিল না বলে এত ঘুরপথে আসা।

ইদ্রিশ আলি লেনের কাছে এসে জনার্দন দাঁড়িয়ে পড়ল। তখন সন্ধ্যে হয় হয়। জায়গাটা খুবই নির্জন। কিছু গরিব মুসলমানের বস্তি। কোনো যানবাহন নেই। লোক চলাচলও কম।

তুমি এখানে একটু দাঁড়াও। আমি আসছি।

কোথায় যাচ্ছ?

ঐ গলির মধ্যে আমার এক বন্ধু থাকত। সেই বাড়িটা একবার দেখতে ইচ্ছে করছে।

সে বন্ধু এখন নেই?

না। তুমি দাঁড়াও। আমি এখুনি আসছি।

জনার্দন টনিকে একলা দাঁড় করিয়ে রেখে গলির মধ্যে ঢুকল। টনি অবাক হলো।

গলিটা সরু। দুপাশে টালির ঘর। জনার্দন কিসের নেশায় যেন টালির ঘরগুলো দেখতে দেখতে চলল।

তারপর ডান দিকে একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। হ্যাঁ, এই তত পেয়ারা গাছটা। ঐ যে সিমেন্ট বাঁধানো রক। সামনেই দরজা। দরজায় শেকল ভোলা। কিন্তু তালা লাগানো নেই। ঘরটার পিছনে ঝোপঝাপ, তার পরে পোড়ো জমি।

হ্যাঁ, এই বাড়িটায় মাত্র একবার এসেছিল। পরিবেশটা ভালো লাগেনি। ওখানে যারা ছিল তারা ভদ্রলোকের সঙ্গে মেশার অযোগ্য। তাই আর সে এখানে আসেনি। আজ দুবছর পর জনার্দন এল। কেন এল তা সে নিজেও জানে না।

তখন অন্ধকার হয়ে এসেছে। জনার্দন একবার এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে শেকলটা খুলল। ঝনাৎ করে লোহার শেকলটা দরজার ওপর আছড়ে পড়ল। দুহাতে দরজা ঠেলল জনার্দন। দুবছর আগে দেখা লক্ষ্মীনারায়ণের মুখটা মনে পড়ল জনার্দনের। সেই পাথরের মতো ভোতা মুখটা। জিজ্ঞেস করেছিল, খিদিরপুরে রতিকান্তর একটা ঠিকানা আছে না?

দরজাটা বিশ্রী শব্দ করে খুলে গেল। একটা ভ্যাপসা গন্ধ। ইস্! টর্চটা টনির কাছে রেখে এসেছে। টর্চটা থাকলে একবার জ্বেলে দেখত। কি দেখত? দেখবার আজ আর কি আছে?

কিছুই না। তবু

জনার্দন অন্ধকার ঘরে দুপা এগোল। আর সঙ্গে সঙ্গেই তার পা দুটো আটকে গেল। দেখল একটা ভাঙা চেয়ারে কেউ একজন বসে আছে।

জনার্দন স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে রইল। না পারছে এগোতে, না পারছে বেরিয়ে যেতে।

 মিনিট দুই চুপ করে থেকে জনার্দন অতিকষ্টে দুটো কথা মাত্র উচ্চারণ করল, কে তুমি?

লোকটা উত্তর দিল না। উঠে দাঁড়াল। তারপর এক পা এক পা করে সাক্ষাৎ মৃত্যুর মতো এগিয়ে আসতে লাগল। জনার্দন ভয়ে আর্তনাদ করে উঠল। সেই ভয়াবহ মূর্তিটা তখন একেবারে কাছে এসে পড়েছে। জনার্দন পালাতে গেল কিন্তু অন্ধকারে দরজাটা খুঁজে পেল না।

এমনি সময়ে অন্ধকার ঘরে টর্চের আলো এসে পড়ল।

বাবা, এখানে কি করছ? বলে টনি এসে দাঁড়াল। তার হাতের কবচটা ভারী হয়ে উঠল। আর সোনার মতো জ্বলজ্বল করতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে মূর্তিটা জনার্দনকে ছেড়ে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

টনির সমস্ত শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল। টর্চের আলোয় মুহূর্তের জন্য যাকে দেখল, কে সে?

ফেরার পথে জনার্দন একটি কথাও বলল না। শুধু বাড়ি ঢোকার মুখে ক্লান্ত স্বরে বলল, টনি, মাকে এসব কথা বোলো না।

টনি বলল, আচ্ছা।

.

পরিত্যক্ত কবরখানায় নতুন কবর

সেদিন রাত্রে টনি ভালো করে ঘুমোতে পারল না। কেবলই ইদ্রিশ আলি লেনের ঘটনাটা মাথায় ঘুরতে লাগল।

সেই পরিত্যক্ত টালির ঘরে লোকটা কে ছিল? ও কি মানুষ, না অন্য কিছু? ও কি বাবার জন্য অপেক্ষা করে ছিল? ও কি জানত বাবা ওখানে যাবেই? আর বাবাই বা হঠাৎ কেন ওখানে গেল, যাবার তো কথা ছিল না। সে বাবা বলে ঢোকামাত্র লোকটা পালালো কেন? এসব কথা নিয়ে কারো সঙ্গে আলোচনা করা যাবে না।

পরের দিন সকালে ঘুরতে ঘুরতে বেলা একটা নাগাদ টনি কবরখানায় ঢুকল। কিছু ফুল তুলে নিল। তারপর সার সার সমাধিগুলোর ওপর সেগুলো ছড়িয়ে দিল। সে অনুভব করল একটা স্নিগ্ধ বসন্তবাতাস যেন তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সে হাত জোড় করে অশরীরী আত্মাদের উদ্দেশে প্রণাম করল।

তারপর একটা গাছের তলায় গিয়ে বসল। ঘটনাগুলো ঘটার পর তার কাছে এখন অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়ে গেছে। বুঝতে পেরেছে মিস্টার গুর্গে আসলে একটা দুষ্ট প্রেতাত্মা। মানুষের রূপ ধরে তাদের, বিশেষ করে বাবার ক্ষতি করতে এসেছে। তাকেও সহ্য করতে পারে না। এখন কয়েকটি প্রশ্ন

১। কেন ক্ষতি করতে আসা? বাবা কী এমন অপরাধ করেছে? ২। বাবা কেন কাল ইদ্রিশ আলি লেনে গেল? ৩। আজ এতদিন পর এই বাগানবাড়িতে আসার পরই প্রেতহানা কেন? ৪। আর বাবাই বা কেন হঠাৎ এই বাগানবাড়িটা পছন্দ করল?

নাঃ সব প্রশ্নের মীমাংসা করা এখনই সম্ভব নয়। মাথাটা কিরকম গরম হয়ে উঠেছে। শরীরটা দুর্বল ঠেকছে। ও উঠে পড়ল।

এক জায়গায় দেখল অনেকগুলো নতুন কবর। অবশ্য অন্যগুলোর তুলনায় নতুন। এগুলো বাঁধানো নয়। বোধহয় এগুলো বেওয়ারিশ লাশ। সম্ভবত সমাজবিরোধীরা খুন করে রাতারাতি এই পরিত্যক্ত কবরখানায় পুঁতে দিয়ে গেছে।

হঠাৎ একটা কবরের কাছে এসে থমকে দাঁড়াল। এটা অপেক্ষাকৃত নতুন কবর। কিন্তু মনে হলো যেন মাটিটা ফাঁপা। কেউ যেন মাটিগুলো সরিয়ে আবার পরে চাপিয়ে দিয়েছে।

এরকম কেন?

কেউ কি এখান থেকে মড়া তুলে নিয়ে গেছে? এরকম নাকি যায় কিছু লোক কঙ্কালের ব্যবসা করার জন্য। হয়তো তাই হবে।

তাহলে অন্যগুলো থেকে তোলেনি কেন?

হয়ত আগেই তোলা হয়ে গেছে।

হঠাৎ একটা বিশ্রী গ্যাস কবরটা থেকে উঠে এল। কিরকম যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বাতাসটাও ভারী হয়ে উঠেছে। সেদিন যে ঘরে মিঃ গুর্গে ছিলেন সে ঘরে এইরকম ভারী বাতাস অনুভব করেছিল। কিন্তু এখানকার বাতাসটা যেন আরও তীব্র, আরও

এ কী দম বন্ধ হয়ে আসছে যে!

হঠাৎ তার নজরে পড়ল কবরের ওপরের মাটিগুলো যেন কাঁপছে। এখনই যেন ফেটে চৌচির হয়ে যাবে।

তখন বেলা দেড়টা। খাঁ খাঁ করছে কবরখানা। কাছে জনমানুষ নেই। একটা কাক বিকট চোখ করে তাকে দেখছে।

টনি কেমন ভয় পেল। গেটের দিকে এগোতে লাগল। কিন্তু পা দুটো এত ভারী লাগছে। কেন? আর কবচটা আবার হাত থেকে পড়ে যাবার জন্যেই যেন নেমে নেমে আসছে। কবচটা হাতের বাহুতে তুলে সে জোরে হাঁটতে লাগল। কিন্তু

কেউ কি তার পিছন পিছন আসছে? সে প্রাণপণে ছুটতে লাগল। ঐ তো ওদের বাড়িটা দেখা যাচ্ছে। টনি ছুটছে…ছুটছে…ছুটছে…

এত ছুটেও বাড়ি পৌঁছচ্ছে না কেন সে? হঠাৎই তার খেয়াল হলো সে কোথায় কত দূরে এসে পড়েছে। সামনে একটা খাল….একটা নৌকো..মনে হলো যেন কেউ নৌকোটার ওপর বসে আছে। নৌকোটা এগিয়ে আসছে তার দিকে। নৌকোতে যে রয়েছে সে আর কেউ নয়, স্বয়ং মিস্টার গুর্গে।

টনি বুঝতে পারল তার শরীরটা কেমন করছে।জ্ঞান হারাচ্ছে। কবচটা আবার বাহু থেকে কজিতে নেমে আসছে। ও প্রাণপণে সেটা ওপরের দিকে ঠেলে দিয়েই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেল।

.

টনি কোথায় গেল?

বেলা দুটো বেজে গেল তবু টনি ফিরল না। মালতীর মন ছটফট করতে লাগল। কোথায় গেল ছেলেটা? এত বেলা পর্যন্ত তো বাইরে থাকে না। ওর কি তবে কোনো বিপদ হলো? বিপদ একটাই হতে পারে। আর সে কথা ভেবে তার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।

মালতী অনেক বার দরজায় দাঁড়িয়ে দেখল। কয়েকবার টনি টনি করে চেঁচিয়ে ডাকল। শেষে আর থাকতে পারল না। দরজায় তালা দিয়ে টনিকে খুঁজতে বেরোল।

টনির যাবার জায়গা একটাই–কবরখানা। সকালে-বিকালে ওখানেই যায়। গিয়ে বসে থাকে। বিদেহী আত্মারা নাকি তাকে ভালোবাসে। শুনলেও বুকের রক্ত জল হয়ে যায়।

মালতী সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে কবরখানায় গেল। সারা জায়গাটা খুঁজল। কিন্তু কোথাও তাকে পাওয়া গেল না। এবার কি করবে? বাড়িই ফিরতে হয়। কিন্তু বাড়ি গিয়েও যদি দেখে টনি ফেরেনি? তাহলে? তখন কি করবে? কর্তাও বাড়ি নেই যে খোঁজ করে দেখবে। এমনিতে রাত করে ফেরে। তবে আজ পইপই করে বলে দিয়েছে যেন সন্ধের আগে বাড়ি ঢোকে। কিন্তু সন্ধের তত ঢের দেরি। এখন?

ভাবতে ভাবতে মালতী বাড়ি ফিরে এল। না, টনি ফেরেনি।

মালতী তালা খুলল। দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল।

ঘরে ঢুকতেই কেমন হাঁপ ধরল। সারা ঘরে যেন কুয়াশার মতো হালকা ধোঁওয়া। ঘরে ধোঁওয়া এল কোথা থেকে?

ডাইনিং হলটা পেরিয়ে ডান দিকে টনির ঘর। টনির ঘরটা উঁকি দিয়ে দেখল। বৃথাই দেখা। দরজা তো তালাবন্ধ ছিল।

এবার সে নিজের ঘরে ঢুকতে গেল। থমকে দাঁড়াল। দরজায় শেকল দিয়ে গিয়েছিল না? তাহলে শেকল খুলল কে? দরজা হাট করে খোলা। তাহলে বোধহয় ভুল করেই দরজা খুলে রেখে গেছে।

মালতী ঘরে ঢুকল। এ কী! ট্রাঙ্ক স্যুটকেস খোলা পড়ে আছে। জিনিসপত্র লণ্ডভণ্ড।

কে করল এমন? চোর এসেছিল? নিশ্চয় চোর এসেছিল। টাকা-পয়সা খুঁজছিল। কিন্তু চোর ঢুকল কী করে? বাইরের দরজা তো তালাবন্ধ ছিল।

এ তো বড়ো অদ্ভুত ব্যাপার। দিন-দুপুরে চোর। চিৎকার করে লোক ডাকতে ইচ্ছে করল। কিন্তু লোক কোথায়?

মালতী কী করবে এই মুহূর্তে ভেবে পেল না। কিন্তু সে কেমন করে যেন বুঝতে পারল বিপদ এখনো কাটেনি। আরও কিছু ঘটতে যাচ্ছে। তখনই সে ঠিক করল বাড়িতে তার একদণ্ড একা থাকা উচিত নয়, বেরিয়ে যাবে। এই বলে ঘরের বাইরে আসতেই সে কাঠ হয়ে গেল। দেখল পর্দার আড়ালে ডাইনিং টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে মিস্টার গুর্গের পৈশাচিক মূর্তি।

মালতী চিৎকার করে মাটিতে পড়ে গেল। মূর্তিটা পায়ে পায়ে তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।

এমনি সময়ে মা মা বলে টনি ঘরে এসে ঢুকল। চুল উস্কোখুস্কো। দুচোখে ঘুমের ঘোর। কিন্তু মুহূর্তেই তার ঘুম ছুটে গেল। ছুটে গিয়ে মাকে আঁকড়ে ধরল। গুর্গে সমস্ত শক্তি দিয়ে টনিকে ধরতে গেল। টনির হাতের কবচটা হঠাৎ ভারী হয়ে উঠল। লোহার রঙ বদলাতে লাগল। মূর্তিটা পিছতে লাগল। পিছতে পিছতে খোলা জানলা দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

.

ঘুম নেই

সন্ধের আগেই বাড়ি ফিরে সব শুনে জনার্দন থমকে গেল।

মালতী বার বার একই কথা বলতে লাগল, বলো কী খুঁজতে ও এসেছিল? টাকা-পয়সা তো কিছুই নেয়নি। বলো, দোহাই তোমার চুপ করে থেকো না। আমাদের কাছে কি এমন জিনিস আছে যার জন্যে একটা ভয়ঙ্কর প্রেত হানা দিচ্ছে?

এই শীতের সন্ধেতেও জনার্দনের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠল। মিনমিন করে বলল, তা আমি কেমন করে জানব?

হ্যাঁ, জান। নিশ্চয় জান। আমার কাছে তুমি লুকোচ্ছ।

একটু থেমে বলল, তুমি আমায় সব কথা বলো। প্রতিকার করতে হবে। নইলে আমাদের সবাইকে মরতে হবে। টনি তো আজ মরতে মরতে বেঁচে গেছে।

তবু জনার্দন চুপ করে রইল। উত্তর দিতে পারল না।

 রাত সাড়ে এগারোটা।

ভালো করে দরজা এমনকি জানলাগুলোও বন্ধ করে জনার্দন শুয়ে আছে। পাশে মালতী। আজও কারো চোখে ঘুম নেই। কিন্তু কথা বলতেও সাহস হয় না। কে জানে হয়তো বাইরে কেউ ওৎ পেতে আছে।

রতিকান্ত……রতিকান্ত….রতিকান্ত…

এখন এই গভীর রাতেও জনাদনের একমাত্র চিন্তা রতিকান্তকে নিয়ে। রতিকান্ত যে সত্যিই খুন হবে জনার্দন তা ভাবতে পারেনি। তার মনে হয়েছিল লক্ষ্মীনারায়ণ ভয় দেখিয়েছিল মাত্র। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রতিকান্ত খুন হয় ডায়মন্ড হারবার রোডের কাছে ইদ্রিশ আলি লেনে ওর গোপন ডেরায়। ঠিকানাটা লক্ষ্মীনারায়ণকে জানিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল।

রতিকান্ত তার কাছে সোনার মুকুটটা গচ্ছিত রেখেছিল। জনার্দন সেদিন সহজ মনেই সেটা রেখেছিল। লকারে রাখার কথা মনে হয়েছিল, কিন্তু পরের জিনিস-ফ্যাসাদ হতে পারে, এইসব সাত-পাঁচ ভেবে সে ওটা গড়িয়ার বাড়িতেই রেখেছিল।

কিন্তু পনেরো দিনের মাথায় খবর পেল রতিকান্ত খুন হয়েছে। তবে তার লাশ যে তার এই বাগানবাড়ির কাছেই ঐ পরিত্যক্ত কবরখানায় পুঁতে দেওয়া হয়েছে তখনও তা জানত না।

রতিকান্তর হত্যার খবর শুনে জনার্দন দুঃখ পেয়েছিল, ভয় পেয়েছিল, আবার খুশিও হয়েছিল। তার মাথায় দুর্বুদ্ধি চাপল মুকুটটার তাহলে দাবিদার কেউ রইল না। তার ছেলে ফিরবে কিনা তার ঠিক নেই। ফিরলেও জিনিসটা যে তার কাছে গচ্ছিত আছে তা জানার উপায় নেই। জনার্দন সেদিনই মনস্থ করে ফেলল মুকুটটা রতিকান্তর ছেলেকে দেবে না।

ওটা কলকাতার বাসায় রাখা নিরাপদ নয়। লক্ষ্মীনারায়ণ চড়াও হতে পারে। তাই খোঁজ পাওয়ামাত্র এতদূরে নিরিবিলি আর নিশ্চিন্ত থাকার জন্য জলের দরে এই বাগানবাড়িটা কিনে ফেলল। রতিকান্তকে কাছেই কবর দেওয়া হয়েছে জানলে হয়তো এদিকেই আসত না।

এখানে আসার পর থেকেই শুরু হলো প্রেতহানা। প্রথমে বুঝতে পারেনি কে সে? এখন পরিষ্কার। কী উদ্দেশ্যে তার আক্রমণ তা এই মুহূর্তে জনার্দনের বুঝতে বাকি নেই। মুকুটটা তাকে ভোগ করতে দেবে না। আর বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি মৃত্যু।

মুকুটটা সে তাদের চৌকির গুপ্ত ড্রয়ারের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে। তার স্ত্রীও তা জানে না।

কিন্তু এর পর?

.

এত রাতে কে ও?

ঘুম নেই টনির চোখেও। আজ কত বড়ো বিপদ থেকে যে সে বেঁচে গেছে সেই কথাই ভাবছিল। কিন্তু কেমন করে বাঁচল? কে বাঁচালো? এ কথা ভাবতে ভাবতেই তার ডান হাতটা উঠে গেল কবচটার ওপরে। ইস্! কারটা বদলাতেই হবে। নইলে কখন টুক করে ছিঁড়ে পড়বে।

কবচটার কথা মনে হতেই তার মনে পড়ল পাদ্রীবাবার কথা। সেই শান্ত করুণ স্নেহভরা। মুখখানি। সাদা পোশাক, সাদা দাড়ি। গলায় ঝুলছে কালো কর্ডে বাঁধা ক্রুশ।

কতদিন তাকে দেখেনি। ঠিক করল, এবার একদিন বাবা-মাকে নিয়ে চন্দনপুর যাবে। তখনই অন্য ভাবনা মাথায় এলো। সেই প্রেতমূর্তিটা এখন দিনের বেলাতেই হানা দিচ্ছে। কিন্তু কেন?

তারপরেই ভাবল এভাবে বাঁচা যাবে না। ঐ পিশাচটা বাবাকে তো মারবেই, মারবে মাকেও। আর সেও রেহাই পাবে না।

তাহলে?

বাড়ির দক্ষিণ দিকের জানলাটা খোলা ছিল। এই জানলা দিয়ে তাদের বাড়ির লাগাও যে অংশটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে সেটা দেখা যায়। সেইদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ তার মনে হলো জমির শেষপ্রান্তে কী যেন নড়ছে।

লাফিয়ে উঠে বসল টনি। এগিয়ে গেল জানলার কাছে। কী নড়ছে ওখানে?

একটা মানুষ…ও কি ছাতা মাথায় দিয়ে? রাত্রে ছাতা মাথায় কেন? এখন তো বৃষ্টি হচ্ছে না।

চোর? ডাকাত? সমাজবিরোধীদের কেউ? ছাতার আড়ালে লুকিয়ে কিছু করছে? নাকি গুগেই নতুন বেশে? কিন্তু কি করছে ওখানে ছাতা মাথায় দিয়ে?

টনি একবার ভাবল ছুটে গিয়ে জাপটে ধরে লোকটাকে। কিন্তু এই প্রথম সাহস হলো না। অন্ধকারে গা মিশিয়ে সে জানলার গরাদে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

মিনিট পনেরো পরে মূর্তিটা উঠে দাঁড়াল। তারপর

মূর্তিটা এগিয়ে আসছে এদিকে। টনির গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। আজ রাত্রেও তাহলে কী–

অনেকটা এগিয়ে এসেছে মূর্তিটা। পরনে কালো প্যান্ট, গায়ে চাদর জড়ানো। মাথায় কালো ছাতা। অন্ধকারে বেশ মিশে গেছে।

মূর্তিটা চলে এল বাড়ির কাছে। খিড়কির দরজার কাছে। হাতে কোদাল!

আবার কারো লাশ পোঁতা হলো নাকি? এবার বাগানবাড়িতেই?

তারপরেই চমকে উঠল টনি। এ কী? বাবা।

 টনি দেখল চোরের মতো বাবা পা টিপে টিপে খিড়কির দরজা দিয়ে বাড়ি ঢুকল।

আশ্চর্য! এত রাতে বাবা ওখানে কোদাল নিয়ে কী করতে গেছিল? আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারল না টনি। গায়ে সোয়েটার চড়িয়ে টর্চ নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ল। বেরোতে গিয়ে জোরে হোঁচট খেল।

আন্দাজে আন্দাজে ঠিক জায়গাটায় গিয়ে পৌঁছল টনি। খুব সাবধানে হাতের আড়ালে টর্চটা একবার জ্বেলে জায়গাটা বুঝে নিল। তারপর দুহাত দিয়ে মাটি তুলতে লাগল। আর তখনই যে কবচটা ছিঁড়ে পড়ে গেল সেটা জানতে পারল না। এক সময়ে হাতে শক্ত মতো কিছু ঠেকল। টেনে তুলল সেটা। একটা বড়ো ক্যাশবাক্স। খুলে ফেলল ডালাটা। অমনি অন্ধকারে ঝলমল করে উঠল সেটা। একটা সোনার মুকুট।

আবার সাবধানে টর্চ জ্বালল টনি। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল মুকুটটা। মুকুটের গায়ে একটা স্লিপ আঁটা–এই মুকুট আমার একমাত্র পুত্র বাসুর জন্যে। অন্য কারো অধিকার নেই। –রতিকান্ত।

টনি অবাক! রতিকান্তকাকা। বাবার বন্ধু! উনি তো দুবছর আগে অ্যাকসিডেন্টে মারা গিয়েছেন। তার জিনিস বাবা কী করে পেল? এক মুহূর্তে সবকিছু তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। লজ্জায়, দুঃখে টনির দুচোখ জলে ভরে উঠল।

এটা নিয়ে কী করবে এখন? বাবাকে তো বলা যাবে না, মাকেও না। তার চেয়ে যেমন আছে তেমনিই থাক। ভেবে সেটা আবার মাটি চাপা দিয়ে রাখল।

টনি উঠে দাঁড়াল। ঠিক তখনই তার পিঠে গরম নিশ্বাসের ছেকা লাগল। চমকে ফিরে দাঁড়াতেই দেখল মিস্টার গুর্গে একেবারে তার গায়ের কাছে দাঁড়িয়ে। এবার কোটের ভেতর থেকে ডান হাতটা বেরিয়ে এল। হাত নয়, শুধু সাদা হাড়। হাতটা ক্রমশ এগিয়ে আসছে টনির গলার দিকে।

টনি একবার প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠল, বাবা! তারপরেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

.

মৃত্যুর পদধ্বনি

১৬ ফেব্রুয়ারি।

এ বাড়িতে ওরা এসেছিল ৯ ফেব্রুয়ারি। মাত্র আট দিনে তিন জনের এই সংসারের ওপর দিয়ে যেন ঝড় বয়ে গেল। আজ সেই চরম দিনটি।

জনার্দন-মালতীর জীবনে শেষ আশার প্রদীপটি নিভতে চলেছে।

ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। বিছানায় পড়ে রয়েছে টনির শীর্ণ দেহ। গোটা শরীর বিছানার চাদরের মতো সাদা।

সারা রাত্রি মাথার কাছে বসে রয়েছে জনার্দন আর মালতী। মালতী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। জনার্দন যেন নিশ্চল পাথর।

বেলা দশটা।

টনির শরীর হিম হয়ে আসছে। মালতী চেঁচিয়ে উঠে বলল, বসে বসে দেখছ কী? ডাক্তার ডাকো।

ডাক্তার এখানে কোথায় পাব?

এখানে না পাও যেখান থেকে পার নিয়ে এসো।

অগত্য বেরোতে হল জনার্দনকে।

জোরে হেঁটে চলল জনার্দন-যেন ছুটছে।

তারপর যখন ট্যাক্সিতে করে ডাক্তার নিয়ে এল, বেলা তখন একটা।

ডাক্তার দেখলেন। প্রেশার মাপতে গিয়ে তিনি হতাশ হলেন। মুখ গম্ভীর করে তিনি উঠে গেলেন।

কেমন দেখলেন ডাক্তারবাবু? ওষুধপত্তর?

কোনো লাভ নেই। রাত কাটবে না।

জবাব দিয়ে ডাক্তার চলে গেলেন। নিরুপায় স্বামী-স্ত্রী চুপচাপ বসে রইল। মালতীর বুঝি কদার শক্তিও নেই। সে কেবল বলছে, আমি ওর মা নই। কিন্তু যিনি ওর সত্যিকার মা তিনি যেখানেই থাকুন তার ছেলেকে রক্ষে করুন।

যে জনার্দন জীবনে কখনো ভগবানের নাম মুখে আনেনি, হঠাৎ তার ঠোঁট কেঁপে উঠল। বিড়বিড় করে বলল, টনিকে বাঁচিয়ে দাও। আমি আর পাপের পথে যাব না।

কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। সন্ধে সাড়ে পাঁচটা।

শেষ শীতের বেলা–এখনও ছোটো। এরই মধ্যে ধূসর হয়ে আসছে। দেওয়ালের গায়ে অস্তসূর্যের একফালি রশ্মি কী করুণভাবে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে।

টনির দুচোখ বসে যাচ্ছে। ঘাড় বেঁকে যাচ্ছে। জোরে জোরে নিশ্বাস টানছে। শেষ প্রাণশক্তি দিয়ে নিশ্বাস নেবার চেষ্টা করছে।

জনার্দন চেঁচিয়ে উঠল, মালতী, মন শক্ত করো। টনি চলে যাচ্ছে।

 মালতী ডুকরে কেঁদে উঠল।

ঠিক তখনই কে যেন দরজায় মৃদু কড়া নাড়ল। দুজনেই চমকে উঠল। কে এল আবার?

নিঃসংকোচে, নির্ভয়ে আজ জনার্দন উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল।

এ কী আপনি!

সামনে দাঁড়িয়ে চন্দনপুরের পাদ্রীবাবা। সাদা গাউন, সাদা দাড়ি, সাদা চুল। গলায় ঝুলছে কালো কর্ডে কুশ। হেসে বললেন, টনিকে অনেকদিন দেখিনি। মন কেমন করল তাই চলে এলাম।

মালতী হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল। আর কী দেখবেন পাদ্রীবাবা? টনি তো–

ফাদার ধীরে ধীরে টনির বিছানার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। একবার কপালে হাত রাখলেন। তারপর চমকে উঠে বললেন, ওর কবচটা কোথায়?

তাই তো!

তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগল ওরা। কিন্তু পাওয়া গেল না।

পাদ্রী বললেন, নিশ্চয় কোথাও ছিঁড়ে পড়ে গেছে। কোথায় পড়েছে শিগগির খুঁজে দেখুন।

জনার্দনের কী মনে হলো, সে তখনই ছুটল যেখানে কাল রাত্তিরে টনি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। ভাগ্যক্রমে পেয়ে গেল কবচটা। হাঁপাতে হাঁপাতে হাতের মুঠোর মধ্যে ধরে নিয়ে এল ওটা।

ফাদার আর দেরি করলেন না। একটানে ছিঁড়ে ফেললেন নিজের গলার ক্রুশটি। সেই ছেঁড়া কর্ড দিয়ে কবচটা বেঁধে দিলেন টনির হাতে।

আপনাব ক্রুশ ছিঁড়ে ফেললেন। ওরা অবাক।

ফাদার হাসলেন। বললেন, এই তো পকেটে রাখলাম। এটা এবার আমার সঙ্গে কবরে যাবে।

সত্যিই কি ঐশ্বরিক ক্ষমতা বলে কিছু আছে? না কি সম্মোহনী শক্তি?

দশ মিনিটের মধ্যে টনির নিশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে এল। বিবর্ণ মুখে রক্ত চলাচলের লক্ষণ দেখা দিল।

ফাদার আরও আধ ঘণ্টা রইলেন। তারপর বললেন, আর ভয় নেই। এবার আমি চললাম। আর শোনো, যত তাড়াতাড়ি পার এখানে থেকে চলে যেও।

ফাদার চলে গেলেন। ওরা দুজনে কৃতজ্ঞ চিত্তে হাত জোড় করে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিল। বলল, টনি একটু সুস্থ হলেই আপনার কাছে নিয়ে যাব। ও কেবলই আপনার কথা বলে।

ফাদার কিছু বললেন না। একটু হাসলেন মাত্র। ডান হাতটা তুললেন। বিদায়!

ওরা ভেবেছিল ফাদার বোধহয় ট্যাক্সিতে এসেছিলেন। কিন্তু কোথায় ট্যাক্সি? অতখানি পথ হেঁটে এসেছিলেন?

নিশ্চয় তাই। ঐ তো হেঁটেই যাচ্ছেন। ঐ তো এখনও দেখা যাচ্ছে….

.

জনার্দনরা গড়িয়ায় নিজেদের বাসায় ফিরে এসেছে। মাসখানেক পর ফুল আর মিষ্টি নিয়ে ওরা তিন জনে গেল চন্দনপুরে। কিন্তু ফাদারের সঙ্গে দেখা হলো না। এক মাস আগে মারা গেছেন।

মৃত্যুর তারিখটা ছিল ১৬ ফেব্রুয়ারি। সময় বিকেল পাঁচটা।

[শারদীয়া ১৪০৩]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *