রহস্যময় আলমারি

রহস্যময় আলমারি

সাতসকালে ফোন

বেলা তখন নটা।

সবে দ্বিতীয়বার চা খেয়ে কাগজটা পড়ছি, এত সকালে টেলিফোন করছে কে?

মফস্বর শহরে এখন ঢালাও টেলিফোন দিচ্ছে–এমনকি s.T.D.-ও। আমিও নিয়েছি একটা। লোকদেখানো ছাড়া আর কি? কেননা এই ছোটো শহরে কে আর কত ফোন করবে? দরকার হলে পনেরো কুড়ি মিনিট পায়ে হেঁটে কিংবা সাইকেলে চেপে দেখা করে আসা যায়।

তবে একজন আমাকে মাঝে মাঝেই ফোন করে। সে আমার বন্ধু জলধর গাঙ্গুলি। নামটা যেমন সেকেলে, রঙটাও তেমনি জলধরের–মানে জলভরা মেঘের মতোই কালো। মোটাসোটা চেহারা। ছোটো ছোটো চুল। বিয়ে-থাওয়া করেনি। পৈতৃক বাড়িতে একাই থাকে। একমাত্র আমি ছাড়া ওর কোনো বন্ধু নেই। কারো সঙ্গে ও মেশে না। অন্যেও ওর সঙ্গে মিশতে চায় না। তার কারণ আছে। জলধর মানুষটা একটু অন্য ধরনের। তার অদ্ভুত কতগুলো শখ আছে। যেমন নানারকমের পাখি পোষা, পাহাড়-পর্বতে ঘুরে নানারকম পাথর সংগ্রহ করা আর পুরনো আমলের জিনিস কেনা। যেমন এখান থেকে সত্তর মাইল দূরে এক পাদ্রী তার ঠাকুরদাদার পিয়ানোটা বিক্রি করবেন শুনেই জলধর গিয়ে সেটা কিনে নিয়ে এল। যদিও সে কস্মিনকালেও পিয়ানো বাজাতে জানত না। ঐ রকম একটা পিয়ানো কিনে সে দারুণ খুশি। সেদিন আমায় ডেকে পিয়ানোটা দেখাল। সবচেয়ে তাজ্জব ব্যাপার হচ্ছে সেটা বাজেই না।

এ কথা জলধরকে বলায় সে হেসে বলেছিল, তাতে কি? আমি তো আর বাজাব বলে ওটা কিনিনি। একটা ঐতিহাসিক জিনিস বলেই কিনেছি।

ঐ একটা কথা ও শিখে রেখেছে–ঐতিহাসিক। একটা কোনো পুরনো জিনিস পেলেই ও বলে–জানো, দারুণ একটা ঐতিহাসিক জিনিস সস্তায় পেয়ে গেছি।

সঙ্গে সঙ্গে সেটা তার ঐতিহাসিক সংগ্রহশালায় ঠাঁই পেয়ে যায়। সারা দিন সে এই সব নিয়েই ব্যস্ত থাকে। পুরনো আসবাবপত্রগুলো ঝাড়পোছ করে। পোষা জন্তুকে লোকে যেমন আদর করে তেমনি ভাবে এই পুরনো জিনিসগুলোর গায়ে হাত বুলোয়। আবার খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দ্যাখে কলকাতায় কোথাও কোনো পুরনো জিনিস বিক্রি হচ্ছে কিনা। তেমন বিজ্ঞাপন চোখে পড়লে ও আমাকে নিয়ে কলকাতায় যাবে। জিনিসটা ভালো করে দেখবে। নিজের মনে ওর মাথা নাড়া দেখলেই বুঝতে পারি জিনিসটা ওর পছন্দ হয়েছে। তারপর ও যখন জিজ্ঞেস করে–কি হে, জিনিসটা কেমন? আমি তৎক্ষণাৎ বলি–চমৎকার।

ব্যাস্! ওর ঐতিহাসিক সংগ্রহশালায় আর একটি বস্তু এসে ঢোকে।

তা এইরকম মানুষের সঙ্গে কে আর মিশতে চায়? ওরও কারোও সঙ্গে ভাব জমাবার দরকার হয় না।

তবু হঠাৎ ও টেলিফোন নিয়ে বসল। নিজেই বলল, যাক এখন তোমার সঙ্গে কথা বলার সুবিধে হবে। তাই আমি নিশ্চিত জানি এখন টেলিফোন করছে শ্রীমান জলধর ছাড়া আর কেউ নয়। কিন্তু সাতসকালে!–নিশ্চয় কোথাও আবার কোনো ঐতিহাসিক জিনিসের সন্ধান পেয়েছে। তাই ডাকছে।

হ্যালো!

ওপার থেকে জলধরের জলদগম্ভীর গলা পেলাম–শোনো, আজ রাত্রে তুমি আমার বাড়িতে খাবে।

হেসে বললাম–সে তো আনন্দের কথা। কিন্তু হঠাৎ আমাকে আজই নেমন্তন্ন করার উদ্দেশ্য?

ও কিন্তু হাসল না। বলল-উদ্দেশ্য আর কী? রোজ একা একা খাই। আজ একসঙ্গে খাব।

খুব ভালো কথা। কি মেনু করছ?

 কি খাবে বলো। মাংস-ভাত?

বেশ। তোমার কাজের মেয়েটি তো ভালোই মাংস রাঁধে।

ও যেন একটু অন্যমনস্কভাবে বলল-হ্যাঁ।

একটু চাটনি করবে তো? মাংসের সঙ্গে একটু চাটনি না থাকলে

ও তেমনি নিস্পৃহভাবে বলল করব। আর শোনো অত রাতে বাড়ি ফিরতে দেব না। আমার এখানেই থাকবে।

আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, কত আর রাত হবে? ফিরে আসতে পারব।

জলধর বলল–থাকতে আপত্তি কী? অত রাতে এক মাইল পথ ঠেঙিয়ে ফিরবে কেন? এখানে থাকার কোনো অসুবিধে হবে না।

হেসে বললাম, তথাস্তু।

ফোন ছেড়ে দিলাম। একটু অবাক হলাম। যদিও ও মাঝে মাঝেই উপলক্ষ ছাড়াই নেমন্তন্ন করে, তবু এবার যেন ওর গলার স্বরটা কিরকম। যেন জলধর নয়, অন্য কেউ কথা বলছে। খুব অন্যমনস্কভাবে কথা বলছিল।

সবে মাত্র এসে কাগজটা তুলে নিয়েছি আবার ফোন বেজে উঠল। বিরক্ত হয়ে ফোন ধরলাম। জলধরই।

হ্যাঁ, শোনো। রেণু বলছে তুমি একটু তাড়াতাড়ি এসো। ও তো রাত্রে বাড়ি চলে যায়। আজ সাড়ে আটটার মধ্যেই খাইয়ে-দাইয়ে চলে যাবে।

আচ্ছা! বলে ফোন ছেড়ে দিলাম।

মুশকিল। আটটার সময় কি ক্ষিধে পায়? তার মানে ভালো করে খাওয়াই হবে না।

.

জলধরের আচরণ

জলধরের বিরাট দোতলা বাড়িটা শহরের একেবারে বাইরে। পেছনে মাঠের পর মাঠ। বড়ো রাস্তা থেকে একটা সরু পথ এসেছে বাড়িটার কাছে। এই পথের দুধারে ঝোপঝাপ। বুনো ফুলে ভরে থাকে। বাঁ দিকে একটা ভাঙা শিবমন্দির। এদিকে-ওদিকে কয়েক ঘর আদিবাসী আর চাষীর ঘর। বলাই বাহুল্য জায়গাটা খুবই নির্জন। ভাবতে ভাবতে অবাক লাগে এইরকম জায়গায় কেন জলধরের বাপ-ঠাকুর্দা বাস করতেন। এখনই এইরকম অবস্থা–যাট-সত্তর বছর আগে তাহলে কী অবস্থা ছিল সহজেই তা অনুমান করা যায়। জলধর বলে–পিছনের এই মাঠগুলো একসময়ে সবই ঠাকুর্দার ছিল। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও ফসল ফলাতে পারেননি। এ একটা আশ্চর্য ব্যাপার। জলধর অবশ্য অর্ধেক জমি বেচে দিয়েছে একজন কারখানার মালিককে। যে টাকা পেয়েছে তাতে পায়ের ওপর পা দিয়ে বসে খাচ্ছে। আর মনের আনন্দে পুরনো জিনিস কিনে বেড়াচ্ছে।

আমি যখন টর্চ নিয়ে ওদের বাড়ি পৌঁছলাম তখন ঠিক সন্ধ্যে। বিকেলের দিকে বড়ো একটা যাই না। যদি একান্তই যেতে হয় তা হলে টর্চ নিয়ে যাই। জায়গাটা খারাপ। অন্তত সাপের ভয় খুব। কিন্তু একথা জলধরকে বলার উপায় নেই। বললেই চটে যায়। রাগ করে বলে–যত ভয় তোমারই। কই এতকাল আমরা রয়েছি, সাপে কাটা তো দূরের কথা–চোখেও পড়েনি কখনও। তবে হ্যাঁ, শেয়াল, বনবিড়াল আছে। তারা তো আর তেড়ে আসে না।

আমি এ নিয়ে তর্ক করি না। নিজে সাবধান থাকি।

কড়া নাড়তেই জলধর নিচে নেমে এসে দরজা খুলে দিল। অন্যবার প্রাণ খুলে হাসে। এবারও একটু হাসল। কিন্তু তাতে প্রাণের স্পর্শ নেই।

তোমার কথাই ভাবছিলাম। এসো।

আমার কথা ভাববার কি আছে? আসব বলেছি যখন আসবই। তা ছাড়া নেমন্তন্ন বলে। কথা।

আমার এই সরস মন্তব্যের জলধর কোনো উত্তর না দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল। সিঁড়ির পাশে দেখলাম বিরাট বিরাট খাঁচা ঝুলছে। আমি জানি ওগুলোতে সব নানা জাতের পাখি আছে। একতলার উঠোনের ওদিকে একটা ঘরে আলো জ্বলছে। দেওয়ালে একটা ছায়া নড়ছে। হঠাৎ দেখলে গাটা ছমছম করে ওঠে।

কিন্তু ওটা যে জলধরের রাঁধুনী রেণুর ছায়া তা আমি জানি।

দোতলায় বেশ বড়োসড়ো চৌকোনো জায়গা। এখানে চারদিকে চারটে পুরনো অর্থাৎ বাপ-ঠাকুর্দার আমলের সোফা। মাঝখানে একটা সেন্টার টেবিল। টেবিলের ওপর ফুলদানি। একটা অ্যাশ-ট্রে। হঠাৎ লোডশেডিং হলে জ্বালাবার জন্যে একটা মোটা মোমবাতি কাচের স্ট্যান্ডে লাগানো। পাশেই দেশলাই। এসব ছাড়াও বেশ কয়েকটা ছোটো-বড়ো নতুন ধরনের পাথর। ওর পাথরের collection আমি নিচের ঘরে দেখেছি। তবু বোধহয় লোককে দেখাবার জন্যেই কয়েকটি নমুনা সেন্টার টেবিলে যত্ন করে রেখে দিয়েছে।

মুখোমুখি দুটো সোফায় আমরা বসলাম। ও বলল, চা না কফি?

আমি জানি একে ক্ষিধের বালাই নেই। তার ওপর যদি এখন চা কফি খাই তা হলে ক্ষিধের বারোটা বেজে যাবে। তাই বললাম, কিছু না।

ও তার জন্য দুঃখিত হলো বলে মনে হলো না। বরঞ্চ যেন নিশ্চিন্ত হলো।

আমি বললাম, তা হঠাৎ নেমন্তন্ন করার কারণ কী?

ও একটু গম্ভীর হয়ে বলল, সে তো সকালেই বলেছি চুপচাপ একা থাকি। ভালো লাগে না।

ব্যস্ এর পর আর কথা চলে না। তবু আমার মনে হচ্ছিল এই হঠাৎ নেমন্তন্ন করার পিছনে কোনো কারণ নিশ্চয় আছে। ও চেপে যাচ্ছে। নইলে সকাল নটা বাজতে না বাজতেই ফোন করল কেন? একটু বেলাতে করতে পারত।

যাই হোক ও প্রশ্ন আর করলাম না। অন্য প্রসঙ্গ নিয়ে গল্পগুজব চলল।

একসময়ে হঠাৎ ও চকিত হয়ে উঠল। বলল, এবার খাওয়াটা সেরে নিই কি বল?

গির্জার আকারে পুরনো দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম সবে পৌনে আটটা। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বললাম, বেশ তো।

তা হলে চলো নিচে যাই।

আমি জানি খাবার ব্যবস্থা নিচের ঘরে। ওপরেও ব্যবস্থা ছিল, কিন্তু রেণুর পক্ষে দুজনের খাবার বয়ে আনা অসুবিধে।

অন্যবার খাবার সময় জলধর এক নাগাড়ে বক্ করে যায়। বিষয় সেই একই কোথায় কোন প্রাচীন জিনিসের সন্ধান পেয়েছে তারই ফিরিস্তি। এই সব collection নিয়ে একটা একজিবিশান করার ইচ্ছেও ও বারে বারে প্রকাশ করেছে। কিন্তু আজ একেবারেই চুপ। একবার শুধু বলল, আর কি নেবে চেয়ে নিও।

মনে মনে রাগলাম। সন্ধ্যেরাতে কি ক্ষিধে হয় যে বেশি খেতে পারব?

খাওয়ার পর ও বলল, তুমি ওপরে গিয়ে বসো। আমি যাচ্ছি।

আমি জানি ও এখন ওর পাখিদের পরিচর্যা করবে। সব খাঁচাগুলো খুলে খুলে দেখবে যথেষ্ট দানাপানি আছে কিনা।

শীতকাল হলে খাঁচাগুলো ওপরে হালকা কিছু দিয়ে ঢাকা দিয়ে দেয়। তারপর খাঁচার দরজাগুলোর ছিটকিনি ভালো করে পরীক্ষা করে। এখানে খটাসের খুব উৎপাত। সারা রাত পাখির খাঁচার দিকে ছোঁক ছোঁক করে ঘুরে বেড়ায়। সমস্ত একতলাটা তো তখন একদম খাঁ-খাঁ করে।

আমি ওপরে এসে সোফায় সবে বসেছি, হঠাৎ মনে হলো সিঁড়ির দরজার আড়াল থেকে কে যেন উঁকি মারল।

আমি চমকে উঠলাম।

কে ওখানে? চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম।

উত্তর দিল না কেউ।

আমি তখন উঠে গেলাম। দরজার পাটটা ঠেলে খুলে দিলাম। কেউ একজন দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।

কে তুমি? বলেই টর্চ ফেললাম।

এ কী রেণু!

ও ঠোঁটের উপর আঙুল চেপে চুপ করে থাকতে ইশারা করল। তারপর ফিফিস্ করে বললবাবুকে একটু দেখবেন। ওঁকে এখানে একা ফেলে রেখে যাবেন না। খুব খারাপ সময়। বলেই তরতর করে নিচে নেমে গেল।

আমি তো হতভম্ব। রেণু অমন চুপি চুপি ওপরে উঠে এল কেন? কেনই বা বলে গেল, খুব খারাপ সময়। বাবুকে দেখবেন? এর আগে তো কখনো এমন করে বলেনি। হঠাৎ কী এমন ঘটল যে জলধর গম্ভীর হয়ে আছে? সারা বাড়ি যেন থথম্ করছে?

একটু পরে সদর দরজায় খিল্ দেওয়ার শব্দ শুনতে পেলাম। বুঝলাম রেণু চলে গেল। জলধর দরজা বন্ধ করে উঠে আসছে।

সোফায় আরও কিছুক্ষণ বসে রইলাম। জলধর চোখ বুজিয়ে সিগারেট খেতে লাগল। কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তাই বললাম, রেণু চলে গেল?

হ্যাঁ।

ওর আজকে তাড়া আছে দেখলাম।

এবারও জলধর সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল, হ্যাঁ।

তারপর বলল, চলো শোওয়া যাক।

আমি আবার ঘড়িটার দিকে তাকালাম। সবে রাত নটা। মনে মনে ভাবলাম–হ্যায় কপাল! এখুনি শুতে হবে। শুধু তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে শুয়ে পড়ার জন্যেই কি ও নেমন্তন্ন করে আনল?

কিন্তু প্রতিবাদ করলাম না। প্রতিবাদ করতে ইচ্ছেও করল না। কেননা, আজকে এই জলধর যেন আমার চিরপরিচিত জলধর নয়। ও হঠাৎ কিরকম বদলে গিয়েছে। ওর হাসিখুশি ভাবটাই নেই। সবসময়ে ও যেন কিছু চিন্তা করছে।

যাই হোক আমরা বিছানায় গিয়ে ঢুকলাম। বড়ো খাট। স্বচ্ছন্দে চারজন শুতে পারে। নিখুঁতভাবে বিছানা পাতা, মশারি টাঙানো। এর আগেও এই বিছানায় আমরা শুয়েছি পাশাপাশি। আজও শুলাম। আগে গল্প করতে করতেই রাত কাবার হয়ে যেত। কিন্তু আজ ও চুপচাপ শুয়ে আছে।

আমি লক্ষ্য করলাম একটা বেডসুইচ ওর ডান হাতের কাছে ঝুলছে। এটা আগে ছিল না।

বেডসুইচটা নতুন করালে?

 হ্যাঁ, রাত্রে উঠতে হলে এটা কাজে দেয়।

 এ তো সবাই জানে। কিন্তু হঠাৎ আজ কেন?

তবু সে কথা জিজ্ঞেস করতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করে লাভ নেই।

একটু পরে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার কি হয়েছে বলো তো।

ও বললে, জানি না।

তুমি যদি এইভাবে আমাকে এড়িয়ে যাও তাহলে ডাকলে কেন? শুধু মাংস-ভাত খাওয়ানোর জন্যে নিশ্চয় নয়?

ও বলল, রাতটা কাটুক। কাল সকালে বলব।

 বলে পাশ ফিরে শুলো।

আগেই বলেছি, এর আগেও অনেকবার এ বাড়িতে খেয়েছি, শুয়েছি। কিন্তু এবার এবার সবই যেন অদ্ভুত।

জলধর বেলা সাড়ে আটটার আগে কখনো ওঠে না। আজ নটা বাজতে না বাজতেই ফোন করল। সাতসকালে উঠে আমাকে ফোন করার কারণ বুঝতে পারলাম না।

এ বাড়িতে যখন আসতাম তখন দুপাশে ঝোপে-ঝাড়ে, অজস্র ফুল ফুটে থাকত। এবার দেখলাম, ফুলগুলো যেন ঝরে যাচ্ছে।

জলধরের একটা পোষা দিশি কুকুর আছে। সে রোজ বিকেলে দরজার কাছে বসে থাকত। আমায় দেখলেই আনন্দে লেজ নাড়ত। আজ কুকুরটাকে দেখলাম না।

বাড়িতে ঢুকেই কেমন যেন অস্বাভাবিক থমথমে ভাব লক্ষ্য করলাম। অথচ বাড়িতে জলধর আছে, অনেক দিনের পুরনো রেণুও আছে।

সিঁড়িতে উঠতে উঠতে পাখির খাঁচাগুলোর দিকে তাকিয়েছিলাম। অন্ধকারে যদি ভুল দেখে না থাকি তাহলে মনে হয়েছে পাখিগুলো যেন হঠাৎ ভয় পেয়ে জড়োসড়ো হয়ে আছে।

রেণুর তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যাওয়া–লুকিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করা–সবই অদ্ভুত।

আর সবচেয়ে আমায় স্তম্ভিত করে দিয়েছে জলধরের গুম হয়ে থাকা। গল্প করা তো দূরের কথা–দু-একটা মামুলি হা না করে ঘুমিয়ে পড়েছে। এসবের মানে কি?

ভাবতে ভাবতে কখন এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ মনে হলো কে যেন আমায় দু হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরেছে..তাকালাম। দেখি-জলধর।

কি হয়েছে?

জলধর চাপা গলায় বলল, কিছু শুনতে পাচ্ছ?

 কই? না।

ভালো করে কান পেতে শোনো।

এবার শুনতে পেলাম। সোঁ সোঁ করে ঝড়ের আওয়াজ। যেন দুরন্ত কালবৈশাখী ঝড় উত্তর দিকের মাঠগুলোর ওপর দিয়ে ছুটে আসছে।

শুনতে পাচ্ছ?

 হ্যাঁ, ঝড় উঠেছে।

 না। ঝড় নয়। এদিকে জানলার দিকে তাকিয়ে দ্যাখো।

দেখলাম। জমাট কালো অন্ধকার। সার সার নারকেল গাছগুলো নিশ্চল প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে। ঝড়ের চিহ্নও নেই।

অদ্ভুত তো!

আমি উঠে বসলাম।

 তাহলে কিসের শব্দ ওটা?

অপেক্ষা করো। আরও কিছু শুনবে।

হঠাৎ মেঠো ঝড়টা থেমে গেল। তারপরেই দুম্ দুম্ করে শব্দ।

 শুনতে পাচ্ছ?

হ্যাঁ। কিন্তু কিসের শব্দ?

সেটাই তো জানবার জন্যে তোমায় রাতে থাকতে বলা। আজ তিন দিন ধরে প্রতি রাত্রে এই রকম শব্দ। বললে হয়তো বিশ্বাস করতে না। তাই ডেকে এনেছি।

শব্দটা যে একটানা হচ্ছিল তা নয়, মাঝে মাঝে থেমে যাচ্ছিল।

 শব্দটা নিচ থেকে আসছে বলে মনে হচ্ছে।

 হ্যাঁ।

তুমি কোনোদিন নিচে নেমে দেখেছ?

না। সত্যি কথা বলছি সাহস হয়নি।

এমনি সময়ে আবার সেই দুম দুম্ শব্দ।

 চলো দেখে আসি।

 দরকার নেই। এখন কী কর্তব্য বলো।

বললাম, ভালো করে না দেখে কি করে বলব? তুমি না যাও, আমিই যাচ্ছি। বলে আমি মশারির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলাম। সুইচ অন করলাম। কিন্তু আলো জ্বলল না।

জানি জ্বলবে না। পুরো বাড়ি অন্ধকার।

 হোক অন্ধকার। টর্চ আছে।

 আমি টর্চ জ্বেলে নিচে নামতে লাগলাম। দেখি পিছনে পিছনে জলধরও নামছে।

তুমি আবার আসছ কেন?

 কি করব? তোমায় একা ছেড়ে দিতে পারি?

 তোমার একটা কুকুর ছিল না? সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে জিজ্ঞেস করলাম।

এখনও আছে। তবে কদিন ধরে কিরকম হয়ে আছে। বোধহয় রোগে ধরেছে। আর বাঁচবে না। ঐ যে–

বলে টর্চটা সিঁড়ির নিচে ফেলল। দেখলাম, একটা প্যাকিং বাক্সের আড়ালে কুকুরটা কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। মুখটা দেওয়ালের দিকে। যেন এদিকের কিছু দেখবে না– শুনবে না।

কুকুরটাকে আমি কয়েক মুহূর্ত লক্ষ করলাম।

 দুম্ দুম্ শব্দটা কিছুক্ষণের জন্য থেমেছিল। আবার শুরু হলো।

আমি টর্চ জ্বালিয়ে তরতর করে নিচে নেমে এলাম। প্রথমে মনে হয়েছিল শব্দটা রান্নাঘরের পাশ থেকে আসছে। সেই দিকে ছুটে গেলাম কিন্তু তখনই মনে হলো শব্দটা বাঁ দিকের ভাড়ার ঘর থেকে আসছে। সেখানে গিয়ে যখন দাঁড়ালাম তখন মনে হলো শব্দটা বাইরে থেকে আসছে। ছুটলাম মাঠের দিকে। যেমন করে হোক শব্দটার কারণ আবিষ্কার করতেই হবে।

আমি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে মাঠের দিকে ছুটছি তো ছুটছি পিছনে জলধর চিৎকার করে উঠল, রমেন, কোথায় যাচ্ছ? ফিরে এসো।

আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। তাই তো পাগলের মতো কোথায় ছুটছিলাম! এখানে তো কোনো শব্দ নেই। ঠিক তখনই আবার গুন্ গুন্ শব্দ। এবার মনে হলো বাড়ির মধ্যে থেকেই শব্দটা আসছে। ছুটে এলাম বাড়িতে।

কোথায় যাচ্ছিলে? শব্দ তো কাছেই। ঐ শোনো! এই যে–এই যে–এই ঘরে–

জলধর এসে দাঁড়ালো ওর সংগ্রহশালার দরজার সামনে। ও যা কিছু পুরনো জিনিস আজ পর্যন্ত কিনেছে সব এই ঘরে রাখা।

দাঁড়াও। তালাটা খুলি। বলে জলধর ফতুয়ার পকেট থেকে চাবি বের করে তালা খুলতে লাগল। আমি টর্চটা জ্বালিয়ে ধরে রইলাম। দেখলাম ভয়ে উত্তেজনায় ওর হাত কাঁপছে।

ঝনাৎ করে শেকলটা দরজার ওপর আছড়ে পড়ল। আমি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই শব্দটা থেমে গেল। আর একটা ঠাণ্ডা বাতাস কাঁপুনি ধরিয়ে দিল।

এ ঘরের বাতাসটা দেখছি খুব ঠাণ্ডা।

 ও কোনো উত্তর দিতে পারল না।

একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে গেল জলধর, এই ঘরটা থেকেই শব্দটা হয়। তুমি বাইরে গিয়ে শোনো শব্দটা আর অন্য কোথাও হচ্ছে না।

জলধর একবার বাইরে থেকে ঘুরে এসে বলল, ঠিকই বলেছ। শব্দটা কোথাও নেই।

কিন্তু যে দু মিনিট জলধর বাইরে ছিল সেই দু মিনিট একলা এই ঘরে দাঁড়িয়ে আমার শরীরের মধ্যে কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কেউ যেন আমার গলা টিপে নিশ্বাস বন্ধ করে দেবার চেষ্টা করছিল। সে কথাটা অবশ্য জলধরকে বললাম না। ও তা হলে ভয় পাবে। ওকে তো একা এ বাড়িতে থাকতে হয়।

আমি টর্চের আলোটা চারদিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ফেলতে লাগলাম। জিনিসপত্রে ঘর ঠাসা। সবই পুরনোকালের জিনিস। আর এই সব পুরনো জিনিসের একটা বিশেষ গন্ধ আছে। সেই গন্ধটা পাচ্ছিলাম।

তিন-চারটে পুরনো সোফা, দুটো ছেঁড়া কোচ–ভেতরের স্প্রিং বেরিয়ে এসেছে। একটা কাঠের মস্ত রাজকীয় চেয়ার। অসাধারণ কারুকার্য। মস্ত একটা পাথরের খোদাই করা কালীমূর্তি। দেখলে ভয় করে। দেওয়ালে দেওয়ালে টাঙানো বাইসনের শিং, হরিণের শিং, বাঘছাল। সবগুলিরই গায়ে টিকিট লাগানো। কবে কোথায় এই জিনিসগুলি পাওয়া গিয়েছে–এগুলি কতকালের পুরনো জলধর তা লিখে রেখেছে। ওদিকে দেখলাম সেই অকেজো পিয়ানোটা অনেকখানি জায়গা জুড়ে পড়ে রয়েছে–

কিন্তু–এটা কি?

আমি চমকে দু পা পিছিয়ে এলাম।

ঘরটা অন্ধকার বলেই ঠাওর করিনি আমার সামনেই–একরকম পথ আগলে দাঁড়িয়ে রয়েছে কুচকুচে কালো একটা কিছু।

টর্চ ফেললাম। একটা বিরাট উঁচু আলমারি।

এটা আবার কবে আমদানি করলে?

 জলধর বলল, গত সপ্তাহে।

 কোথায় পেলে?

কাল সকালে বলব।

আমি আলমারিটার চারপাশ ঘুরে দেখলাম। টোকা মেরে কাঠ পরীক্ষা করলাম। লোহার পাতের মতো শক্ত। এ ধরনের আলমারি আমি তো কখনও দেখিইনি, খুব কম জনেই দেখেছে। আলমারিটা যে খুব ধনী কোনো ব্যক্তির শখের জিনিস তা বলাই বাহুল্য। কেননা এত বড়ো আলমারি কারোর কোনো কাজে লাগে না। আমি একটু নড়াতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না।

বললাম, খুব ভারী মনে হচ্ছে। ভেতরে কি আছে?

কিছুই না। খালি আলমারি। একটা তাকও নেই। খুলব?

এখন দরকার নেই। কাল দেখব। চলো শুইগে। ঘুম তো আর হবেই না। চোখে খুঁজে পড়ে থাকা যাবে ঘণ্টা দুয়েক।

আমরা দরজা বন্ধ করে ওপরে এসে শুয়ে পড়লাম।

.

নন্দগড়ের রাজবংশ

রেণু খুব সকালেই আসে। এদিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি। চা, টোস্ট আর ডিমসেদ্ধ দিয়ে যখন চলে যাচ্ছিল তখন রেণুকে বললাম, তোমায় কতকগুলো কথা জিজ্ঞেস করব। ঠিক ঠিক উত্তর দেবে। একটি কথাও লুকোবে না।

রেণু বলল, লুকোবো কেন? আমি তো কোনো অন্যায় করিনি। যা দেখেছি, যা বুঝেছি তাই বলব।

একটু থেমে বলল, আপনি কি এখুনি জিজ্ঞেস করবেন?

 হ্যাঁ, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জানা দরকার।

 বলুন। বলে রেণু মাটিতেই গুছিয়ে বসল।

তুমি রাত্রে সাধারণত কখন বাড়ি ফের?

 দাদাবাবুকে খাইয়ে, বাসন মেজে, রান্নাঘর পরিষ্কার করে রাত নটা নাগাদ।

কিন্তু কয়েকদিন তুমি তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছ। কেন?

রেণু একটু চুপ করে থেকে বলল, এ বাড়ি ভয়ের কারণ হয়ে উঠেছে।

 কিরকম?

কিছুদিন ধরে সন্ধ্যেরাতেই ঐ মাঠে ঝড়ের লক্ষণ দেখতে পাই। পরে শুনেছি গভীর রাতে ঝড়ের শব্দ ওঠে। আমি এখানকার মেয়ে। আমার বাবা নামকরা ভূতের ওঝা। বাবা বলেন–ঐ মাঠে যখন দোঠেলা বাতাস বইবে তখন সাবধান থাকবে।

বললাম, দোঠেলা বাতাসটা কি?

রেণু বলল, দুমুখো বাতাস যা বড়ো একটা ঘটে না।

ঘটলে কি হয়?

আসলে দোঠেলা বাতাসে ভর করে খারাপ আত্মারা ঘুরে বেড়ায়। যেখানে নামে সেখানে সর্বনাশ করে দেয়।

আমি হাসি লুকিয়ে বললাম, কিন্তু সে তো গভীর রাত্তিরে। তুমি তো সে ঝড় দেখনি। তাহলে আগে চলে যাও কেন?

রেণু বলল, তেনাদের কেউ যে এ বাড়িতে নেমেছেন।

অবাক হয়ে বললাম, কিসে বুঝলে?

ও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, সন্ধ্যেরাতে আমি একা রান্নাঘরে কাজ করি। এর মধ্যে দুদিন শুনেছি ঐ পুরনো জিনিসপত্তরের ঘরের দরজা কে যেন ঠেলছে।

তারপর?

সঙ্গে সঙ্গে কেন্টু চেঁচিয়ে উঠত।

কেন্টু কে?

এ বাড়ির কুকুর।

চেঁচিয়ে উঠে দরজার দিকে ছুটে যেত। তারপরই খুব ভয় পেয়ে সিঁড়ির নিচে ঐ বাক্সের পাশে লুকোত।

রেণু থামল।

 তারপর? আর কিছু?

হ্যাঁ, পরশুদিন আমি রাত্রে দাদাবাবুর দুধ নিয়ে ওপরে উঠছি–হঠাৎ দেখি ঐ ঘরের দরজার বাইরে কেউ যেন পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। চিৎকার করে ডাকলাম। দাদাবাবু নেমে এলেন। কিন্তু কিছুই নেই। অথচ আমি আমার ছেলের দিব্যি দিয়ে বলতে পারি– আমি ভুল দেখিনি।

একটু থেমে বলল, এ বাড়িতে আমি আর কাজ করব না ঠিক করেছিলাম। কিন্তু দাদাবাবুর খাওয়ার কি হবে ভেবে চলে যেতে পারিনি। এ বাড়িতে ওঁর একা থাকাও ঠিক নয়।

ঠিক আছে রেণু, আর একটা কথা জিজ্ঞেস করব।

রেণু তাকাল।

কবে থেকে তুমি এরকম দেখছ শুনছ বা ভয় পাচ্ছ?

দিন তিনেক।

ঠিক আছে। তুমি যাও।

 রেণু চলে গেলে জলধরকে বললাম, আলমারিটা কত দিন হলো কিনেছ?

দিন দশেক আগে।

বেশ। এবার বলো হঠাৎ আলমারিটার খোঁজ কোথায় পেলে?

জলধর একটু চুপ করে থেকে বলল, তুমি তো নন্দগড়ের রাজাদের কথা জানই। রাজা মানে খুব বড়ো জমিদার ক্লাসের।

হ্যাঁ, জানি। প্রচণ্ড দাপট ছিল তাদের। পাইক-পেয়াদা-বরকন্দাজ নিয়ে প্রায় স্বাধীনভাবে রাজত্ব করত। প্রজাদের ওপর খুব অত্যাচার করত।

হ্যাঁ, অত্যাচার যেমন করত তেমনি পুজো-আচ্চা, দান-ধ্যানও করত।

জলধর বলল, নন্দগড়ে গঙ্গা ছিল না। তাই প্রায় তিনশো বছর আগে জমিদার সারদাচরণ গুপ্তিপাড়ায় গঙ্গার ধারে বিরাট রাজবাড়ি তৈরি করেছিলেন। মাঝে মাঝে গঙ্গাস্নান করার জন্যে গুপ্তিপাড়ায় আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ে আসতেন।

হ্যাঁ, এসব বাবার মুখে শুনেছি।

রাজা আসা-যাওয়া করেন, অতএব এখানেও ছোটোখাটো অফিস বসল। সেরেস্তাদার, গোমস্তা আর সবার ওপর থাকত নায়েব। রাজারা এখানে অনেক মন্দির, দানশালা খুলেছিলেন, দোলনন্দোৎসব হতো। সেসব দেখাশোনা, খরচপত্তর দেখতেন ঐ নায়েব। তিনিই ছিলেন এরকম রাজার প্রতিনিধি।

জলধর বলতে লাগল, তারপর একদিন জমিদারি প্রথা উঠে গেল। রাজাদের অবস্থা পড়ে গেল। তারা নন্দগড় ছেড়ে কেউ কলকাতায়, কেউ বিলেতে চলে গেলেন জিনিসপত্র জলের দরে বেচে দিয়ে।

গুপ্তিপাড়াতেও কম জিনিস ছিল না। নায়েব সনাতন চৌধুরী খুব চৌকস লোক ছিলেন। তিনি চুপিচুপি অনেক জিনিস হাতিয়ে নিলেন। আর কিছু আসবাবপত্র নিজের জানাশোনা লোকের কাছে বিক্রি করে দিলেন চড়া দামে। বুঝতেই পারছ রাজবাড়ির জিনিস–তার কদরই আলাদা। সবাই কিনতে চায়।

তাই তুমিও কিছু কিনতে চাইলে?

হা, কিন্তু সনাতন চৌধুরীর সঙ্গে আমার আলাপ ছিল না। আর উনিও চট করে কাউকে পাত্তা দিতেন না। রাজ-এস্টেটের নায়েব তো। খুব উঁট।

তারপর কি করলে বলো।

নন্দগড়ের শেষ রাজা দেবকুমারের কুলপুরোহিত সদানন্দ ব্রহ্মচারীর সঙ্গে বাবার খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। তিনি নবদ্বীপে থাকেন। এখন তো আর রাজ-এস্টেট নেই, পুজো-পার্বণ উঠে গেছে। সদানন্দ নবদ্বীপে নিজেই পুজো-আর্চা নিয়ে থাকেন। বাবা যৌবনকালে তার কাছে প্রায়ই যেতেন। বাবাকে তিনি খুব ভালোবাসতেন।

রাজবাড়ির জিনিসপত্র বিক্রি হচ্ছে শুনে আমি একদিন নবদ্বীপে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করলাম।

অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি এখনও বেঁচে আছেন?

 জলধর বলল, হ্যাঁ, দিব্যি আছেন। বয়েস চুরানব্বই। কিন্তু বয়স তাকে ছুঁতে পারেনি। আমি তাকে পরিচয় দিয়ে আমার ইচ্ছের কথা বললাম। তিনি তখনই সনাতন চৌধুরীকে চিঠি লিখে দিলেন–যে জিনিস আমি পছন্দ করব তাইই যেন ন্যায্য দামে দেন।

সদানন্দ আরও বললেন, তুমি যেদিন গুপ্তিপাড়ায় কিনতে যাবে, আমায় নিয়ে যেও। আমি জিনিসগুলো একবার দেখব। কেননা রাজবাড়ির সব আসবাবপত্রের তালিকা ইতিহাস আমার কাছে আছে।

জলধর একটু থামল। তারপর বলল, আমায় যেতে একটু দেরি হলো। কিনব বলে টাকা-পয়সা যোগাড় করে যখন নবদ্বীপে গেলাম, তার দুদিন আগে সদানন্দ ব্রহ্মচারী কাশী চলে গেছেন। ফিরতে মাস তিনেক দেরি হবে। আমার আর তর সইছিল না। পাছে ভালো ভালো জিনিস হাতছাড়া হয়ে যায়–তাই ব্রহ্মচারীজির চিঠিটা নিয়েই গুপ্তিপাড়া চলে গেলাম। দেখলাম কুলপুরোহিত বলে সদানন্দ ব্রহ্মচারীকে সবাই এখনও খাতির করে। সনাতন চৌধুরী সাদরে আমাকে রাজবাড়ির জিনিসপত্রের ঘরে নিয়ে গেলেন। সেই ঘরেই আমি ওই আলমারিটা দেখলাম। দেখামাত্রই পছন্দ হয়ে গেল। কেননা এত বড়ো আবলুশ কাঠের আলমারি বড়ো একটা চোখে পড়ে না। দরদস্তুর করে টাকা দিয়ে–লরির ওপর চাপিয়ে আলমারিটা নিয়ে এলাম।

জলধর একটু থামল। তারপর বলল, নিয়ে তো এলাম। কিন্তু তারপর থেকেই এই তো অবস্থা দেখছ!

বললাম, এখনও পর্যন্ত যা জানলাম তাতে মনে হচ্ছে যেহেতু ঐ আলমারিটা আনার পর থেকেই শব্দটব্দ হচ্ছে তখন রহস্যের মূলে ঐ আলমারিটাই।

হা, আলমারিটা যে ভৌতিক তাতে আমার কোনো সন্দেহ নেই। ওটাকে বিদেয় করব।

সে তোমার যা ইচ্ছে তাই করবে। বিদেয় করব বললেই তো আর অত বড়ো আলমারিটা বিদায় করা সম্ভব নয়। কে কিনবে? অত বড়ো আলমারি সে কোথায় রাখবে? সবাই তো আর তোমার মতো পাগল নয়। কিন্তু আমি ভাবছি অন্য কথা–মাঠের ঐ অদ্ভুত ঝড়ের সঙ্গে ঘরের শব্দর সম্পর্ক কী?

জলধর বেজার মুখে বলল, সম্পর্ক নিয়ে তুমি মাথা ঘামাও। আমি বুঝতে পারছি ভূত প্রেতের পাল্লায় পড়েছি। এবার মরতে হবে।

আমি হেসে ওকে সাহস দিয়ে উঠে পড়লাম। কাল রাত্তির থেকে আমি ঘর-ছাড়া। এখন বাড়ি যাই।

নিচে নামতেই রেণু আমার পিছু পিছু রাস্তা পর্যন্ত এল।

 কিছু বলবে?

রেণু মাথা নিচু করে বলল, আজ রাত্তিরেও এখানে থাকবেন তো?

রোজ কি আর থাকা সম্ভব?

 রেণুর মুখটা শুকিয়ে গেল।

তা হলে উনি একা কি করে এই বাড়িতে থাকবেন?

আমি ভেবে বললাম, তোমার ভাই-টাই তো আছে। তাদের থাকতে বলো। দুবেলা খাবে, থাকবে। আমি না হয় জলধরকে বলে দেব।

রেণু আর কিছু না বলে ফিরে গেল।

.

গভীর রাতের পালা

 কদিন পর সকালে বাড়িতে বসে জলধরের কথা ভাবছিলাম। ওর বাড়িতে সেই এক রাত্তিরের অভিজ্ঞতা যা আমার হয়েছিল, তা জীবনে ভুলব না। সত্যিই রহস্যময় অলৌকিক ব্যাপার। তারপর সেদিন আর একটা কাণ্ড ঘটেছিল। সক্কালবেলাতেই জলধরের ফোন। কাঁপা কাঁপা গলায় ও বললে, রোজকার মতো ঐ ঘরটা ঝাট দিতে গিয়ে রেণু দেখে আলমারিটা খানিকটা সরে গেছে। অত ভারী আলমারি সরাবে কি করে? ভীষণ ভয় পেয়ে গেছে জলধর। আমি তখনই সাইকেল নিয়ে ছুটলাম। দেখি রেণু সিঁড়িতে চুপচাপ বসে। ভয়ে মুখ ফ্যাকাশে।

দাদাবাবু কোথায়?

ও কোনোরকমে আঙুল তুলে দোতলা দেখিয়ে দিল। আমি যেতেই ও বলল, এসব কী হচ্ছে রমেন? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। ওকে নিয়ে আমি একতলায় নেমে এসে ঘরটায় ঢুকলাম। দেখলাম সত্যিই আলমারিটা আঙুল চারেকের মতো সরে এসেছে।

এটা কি করে সম্ভব হলো, কিছুতেই ভেবে পেলাম না।

তারপর দুদিন আর কিছু ঘটেনি। কালও সকালে ফোন করেছিলাম। ও বলল, কাল রাত্রে ও ভালেই ঘুমিয়েছে। রেণু ও ঘরে আর ঢুকতে চাইছে না। তবে রেণুর একটা ভাই এসেছে। সে নাকি খুব ডাকাবুকো। সেই ঘরটা পরিষ্কার করেছে।

আমি নিশ্বাস ফেলে বেঁচেছি। যাক রেণু আমার কথা শুনেছে। একটা জিনিস এই বুঝেছি মানুষ যখন নির্জন জায়গায় একা থাকে তখনই যতরকমের ভয় পেয়ে বসে। যেখানে মানুষের পাশে মানুষ সেখানে ভয় ঘেঁষতে পারে না।

কালকের রাতটা জলধর কেমন কাটাল জানার জন্যে ফোন করব ভাবছি এমন সময়ে টেলিফোনটা ঝঝন্ করে বেজে উঠল। মনে হলো যেন ফোনটা অস্বাভাবিক জোরে বাজল। তাড়াতাড়ি রিসিভারটা তুলে নিলাম।

হ্যাঁ, জলধরই কথা বলছে। ভয়ে ওর গলা শুকিয়ে কাঠ।

আজ প্রায় এক হাত সরে এসেছে আলমারিটা।

বল কী!

 হ্যাঁ। শীগগির এসো।

.

ওর বাড়িতে গিয়ে যখন পৌঁছলাম তখন দেখি জলধর সামনের রাস্তায় মাথা নিচু করে পায়চারি করছে। আমায় দেখে কিছু বলল না। শুধু আমার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে ঢুকল।

আমি প্রথমেই সেই ঘরটার দিকে এগোলাম। দেখি দরজাটা খোলা। একটা উনিশ-কুড়ি বছরের ছেলে ঘর ঝাঁট দিচ্ছে। তাগড়া চেহারা। দেখে মনে হলো ছেলেটার ভয়-ডর বলে কিছু নেই।

বললাম, ঐ কি রেণুর ভাই?

 জলধর বলল, হ্যাঁ। দুদিন হলো ও এখানে থাকছে। খুব চটপটে। নাম বিশু।

আমি ভেতরে ঢুকলাম। বিশু ফিক করে এমনভাবে হাসল যেন আমি ওর কত দিনের চেনা।

বললাম, বিশু, তুমি তো দুদিন হলো এ বাড়িতে এসেছে। ভয়ের কিছু দেখেছ বা শুনেছ?

ও তেমনি হেসে বলল, কিছু না।

একটু থেমে বলল, বাবা একদিন আপনার সঙ্গে দেখা করবে।

 তোমার বাবা?

হুঁ। খুব বুড়ো। চোখে ভালো দেখতে পায় না। লাঠি ছাড়া চলতে পারে না। তা ও সঙ্গে লোক চাই।

তা তিনি আমার সঙ্গে দেখা করবেন কেন?

ও ঠোঁট উল্টে চলে গেল। অর্থাৎ ওর বাবা কেন আমার সঙ্গে দেখা করবে তাও জানে না।

জলধরকে নিয়ে আমি আলমারিটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সত্যিই আলমারিটা প্রায় এক হাত সরে এসে একেবারে পিয়ানোটার ঘাড়ের ওপর পড়েছে। মনে হলো কেউ যেন আলমারিটাকে টেনে আনবার চেষ্টা করেছে। অথচ এত ভারী আলমারি কোনো একজন মানুষের পক্ষে টেনে আনা সম্ভব নয়।

তা হলে?

বললাম, জলধর, আলমারিটা খোলো তো দেখি।

আলমারিতে তালা দেওয়া ছিল। জলধর ওপরে উঠে গেল চাবি আনতে। কিন্তু দশ মিনিট কেটে গেল তবু জলধর চাবি নিয়ে এল না।

এদিকে বন্ধ ঘরের মধ্যে থেকে কিরকম একটা গ্যাস উঠছিল। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। আমি বাইরে এসে দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ পরে জলধর শুকনো মুখে নেমে এলো। বলল, কী মুশকিল! চাবিটা খুঁজে পাচ্ছি না।

সে কী? চাবিটা রাখতে কোথায়?

ওপরে টেবিলের ড্রয়ারে।

হতাশ হয়ে বললাম, তাহলে আর কী হবে? চাবিটা পেলে আমায় ফোন কোরো। চলে আসব। মোট কথা আলমারিটা খুলে দেখতে চাই। আর তা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

চলে আসবার সময়ে রেণুর সঙ্গে দেখা হলো। বললাম, তোমার ভাইকে এনে খুব ভালো করেছ।

কিন্তু দাদাবাবু, বিপদ তো বেড়েই চলেছে। ঐ আলমারিটা দূর করতে না পারলে রেহাই নেই।

তা ঠিকই। কিন্তু মাঠের ওপর ঝড়টা?

রেণুর মুখটা শুকিয়ে গেল।

 বলল, বাবাকে বলেছি। বাবা একদিন আপনার সঙ্গে দেখা করবে।

 তোমার বাবা তো ওঝা ছিলেন?

 হ্যাঁ। এখন বুড়ো হয়ে গেছে। এখন আর ঝাড়ফুক করে না। তবু দেখা করবে।

বললাম, খুব ভালো। একদিন তোমার বাবুর কাছে নিয়ে এসো। আমিও থাকব।

.

সারাদিন অপেক্ষা করে ছিলাম কখন জলধরের ফোন আসে। ফোন এল সন্ধ্যেবেলায়।

 চাবিটা পেয়েছি।

 কোথায় ছিল?

সিঁড়িতে পড়ে ছিল। বিশুই পেয়েছে।

ঐ আলমারির চাবি সিঁড়িতে পড়ে থাকল কী করে?

কি জানি!

 এর মধ্যে আলমারিটা খুলেছিলে?

একদিনও না।

 আশ্চর্য! ঠিক আছে। আমি যাচ্ছি।

রাত্রে এখানেই থাকবে কিন্তু।

অবশ্যই। বলে টেলিফোন রেখে দিলাম।

কিন্তু তখনই যাওয়া হলো না।

কলকাতা থেকে আমার এক পুরনো বন্ধু তার স্ত্রীকে নিয়ে দেখা করতে এল। তাকে এসব ঘটনা বলতে পারলাম না। শুনে হয়তো হাসবে। কাজেই ওদের সঙ্গে গল্প করতে লাগলাম। ওরা যখন উঠল রাত তখন নটা বাজে।

আজ আর যাব না কথাটা জানিয়ে দেবার জন্যে ফোন করতে যাচ্ছি, ঠিক তখনই জলধর ফোন করল, কী ব্যাপার! তুমি এখনো এলে না কেন?

আমি সব কথা জানিয়ে ওকে যখন বলতে গেলাম কাল সকালেই যাব-ও একেবারে হাঁ হাঁ করে উঠল। বলল, না। এখুনি এসো। রাত্রে আমার এখানে থাকবে।

অগত্যা যেতেই হলো।

সত্যি কথা বলতে কি আমার নিজেরও গা-টা কেমন ছছ করছিল। বিশেষ করে এত রাত্রে ঐ নির্জন পথ দিয়ে যাওয়া। আমি কোনদিন ভৌতিক কাণ্ডকারখানা দেখিনি। ওসব বিশ্বাসও হয় না। কিন্তু জলধরের বাড়িতে কদিন ধরে যা ঘটছে তা আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে। কিছুই না। তবু ঐ আলমারির চাবিটার কথাই ধরা যাক। চাবিটা দোতলায় টেবিলের ড্রয়ারে থাকত। কেউ কোনোদিন হাতও দেয়নি। হাত দেবেই বা কেন? সেই চাবিটা হঠাৎ হাওয়া। পাওয়া গেল সিঁড়িতে। এর মানে কী? মানে কিছুই নেই। সবই রহস্য। একবার ভেবেছিলাম পুলিশে খবর দিতে বলব। কিন্তু ভেবে দেখলাম পুলিশই বা কী করবে? অগত্যা মাঝে মাঝে জলধরকে সঙ্গ দেওয়া ছাড়া আমার আর কোনো কাজ নেই।

আমি যখন সাইকেল নিয়ে বড়ো রাস্তা থেকে ওর বাড়ির দিকের কঁচা রাস্তায় নামলাম, রাত তখন কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে নটা।

চারদিক নিস্তব্ধ। শুধু দুপাশের বন-ঝোপের মধ্যে থেকে কোনো পোকা-মাকড় চিক্ চিক্ করে ডাকছে। কিছু দূরে সেই ফসলশূন্য ধু-ধু মাঠটা যেন বিশাল একটা সাদা চাদর মুড়ি দিয়ে পড়ে আছে। দেখলে কেমন গা-ছমছম করে।

আমি জোরে সাইকেল চালিয়ে কঁচা রাস্তা দিয়ে চলেছি। সাইকেলের চাকা কখনও ধুলোয় বসে যাচ্ছে, কখনো খোয়র ওপর পড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে।

হঠাৎ মনে হলো আমার সামনে দিয়ে একটা লোক হেঁটে যাচ্ছে।

অবাক হলাম–এত রাত্রে এই পথে লোক এল কোথা থেকে? তা ছাড়া একটু আগেও তো দেখতে পাইনি।

লোকটার বিশাল চেহারা। কঁধ পর্যন্ত ঝাঁকড়া চুল–খালি গা–পরনে একটা কপনি মাত্র।

আমি বেল দিলাম। কিন্তু লোকটা শুনল না। তেমনি সামনে সামনে চলেছে।

আমি আবার বেল দিলাম। কিন্তু লোকটার হুঁশ নেই।

 এ কিরকম লোক? আমি কি ভুল দেখছি?

বাঁ হাত দিয়ে চোখ কচলে নিলাম। না–ভুল নয়। লোকটা এবার জোরে জোরে হাঁটছে। আর আমার মনে হলো ওর জোরে হাঁটার সঙ্গে সঙ্গে আমার সাইকেলটাও ছুটে চলেছে। আমায় প্যাডেল করতে হচ্ছে না। শুধু হ্যাঁন্ডেলটা ধরে আছি।

কিছুক্ষণের জন্যে আমি বোধহয় বাহ্যিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম। হঠাৎ একটা চেঁচামেচিতে আমার সম্বিৎ ফিরল। টর্চের আলো এসে পড়ল আমার মুখে। তারপরই দেখি বিশু ছুটতে ছুটতে আসছে।

এ কী স্যার! কোথায় যাচ্ছিলেন?

ভালো করে তাকিয়ে দেখি আমি সেই মাঠের কাছে দাঁড়িয়ে আছি। সাইকেলটা পড়ে আছে।

এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখলাম। কিন্তু সেই লোকটাকে খুঁজে পেলাম না। যেন মাঠের মধ্যেই অদৃশ্য হয়ে গেছে।

বিশুকে আসল কথা না বলে শুধু বললাম, অন্ধকারে দিকভুল হয়ে গিয়েছিল।

দেখুন দিকি কী সাংঘাতিক ব্যাপার! এই রাত্রে মাঠের মধ্যে গিয়ে পড়লে–আর রক্ষে থাকত না।

তুমি কোথায় ছিলে?

 আপনার দেরি হচ্ছে দেখে দাদাবাবু টর্চ দিয়ে পাঠালেন। ভাগ্যি বেরিয়ে পড়েছিলাম।

জলধরকেও সত্যি ঘটনাটা বলিনি। বললে ও বেচারা খুব ভয় পেত।

আমাকে পেয়ে ও খুশি হলো। বলল, এত রাতে আর আলমারি খুলে দরকার নেই। খেয়ে নিয়ে শোবে চলো।

তাই করলাম।

 রেণু আগেই চলে গেছে। বিশুও রান্নাঘরে খেয়ে নিল।

ওপরে এসে বললাম, বিশু শোয় কোথায়?

জলধর বলল, ও নিচেই শুতে চেয়েছিল। আমিই ওকে পাশের ঘরে ব্যবস্থা করেছি। খুব সাহসী ছেলে।

ভালো করেছ। বলে মশারির মধ্যে ঢুকে পড়লাম।

নিচে দরজায় খিল বন্ধ করার শব্দ শুনলাম। আগে এ কাজটা জলধরকেই করতে হতো। এখন বিশু করে।

খিল বন্ধ করার শব্দটা শুনে মনে হলো–এবার বোধ হয় গভীর রাতের পালা শুরু হবে। জানি না আজ রাত্রে তেমন কিছু ঘটবে কিনা।

আর কিছু ঘটুক বা না ঘটুক–আসবার সময় যা দেখলাম আর যা ঘটতে যাচ্ছিল তা ভাবতেও শিউরে উঠলাম। আমি চোখ বুজিয়ে অনেকক্ষণ চিন্তা করতে লাগলাম–সত্যিই কি কিছু দেখেছিলাম? নিশ্চয় দেখেছিলাম। এখনও তো তার সেই বিরাট শরীরটা চোখের সামনে ভাসছে, আর যদি চোখের ভুলই হয় তাহলে আমি মাঠের ধারে চলে গিয়েছিলাম কি করে? জলধরের বাড়ি তো আমি কম দিন আসছি না যে সত্যিই পথ হারিয়ে ফেলব?

ঠিক করলাম কাল সকালে রেণুকে আড়ালে ডেকে জিজ্ঞেস করব ঐরকম চেহারার কোনো লোকের কথা শুনেছে কি না।

.

ভাবতে ভাবতে কখন এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল। অনেক দূরে কোথাও যেন একটা শব্দ হচ্ছে। এ শব্দ আগের দিনের মতো নয়। এ শব্দটা যেন কোনো ভারী জিনিস টানার শব্দ।

শব্দটা ঠিক কোথায় হচ্ছে প্রথমটা বুঝতে পারিনি। তারপরেই বুঝলাম শব্দটা একতলা থেকে আসছে।

ধড়মড় করে উঠে বসলাম। পাশে জলধর তখন অকাতরে ঘুমোচ্ছে। আমি পাশে শুয়ে আছি জেনেই ও বোধহয় এত নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পেরেছে।

আমি আস্তে ঠেলা দিয়ে ওকে জাগালাম।

 আঁ-আঁ কী হয়েছে! বলে ও চমকে উঠে বসল।

 সাহস দিয়ে বললাম, কিছু না। একটা শব্দ হচ্ছে না?

ও কান পেতে শুনে বলল–হ্যাঁ। নিচের ঘরে।

 আমি স্বচক্ষে আজ দেখব। বলে মশারি থেকে বেরিয়ে এলাম।

দাঁড়াও। আমিও যাব। বলে জলধরও বেরিয়ে এল। দেখি ওর পা দুটো কাঁপছে।

সুইচে হাত দিলাম। ঠিক আগের মতোই আলো জ্বলল না। দুজনে দুটো টর্চ হাতে নিয়ে সিঁড়ির মুখে এসে দাঁড়ালাম–কিন্তু সিঁড়ির ঠিক শেষ ধাপে কেউ যেন দাঁড়িয়ে রয়েছে।

চমকে দু পা পিছিয়ে এলাম।

 টর্চ জ্বালোম। দেখি বিশু। শিকারী বেড়ালের মতো ও নিচে নামছে।

টর্চের আলোয় ও চমকে উঠে পিছন ফিরে তাকাল। তারপর ইশারায় নিঃশব্দে নামতে বলল। বুঝলাম শব্দটা ও-ও শুনেছে। অতি সাহসী তো। তাই একাই দেখতে যাচ্ছিল ব্যাপারটা।

দুটো টর্চ নিভিয়ে, শুধু একটা মাত্র টর্চ জ্বালিয়ে আমরা তিনজনে সেই ঘরটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। ঘরের ভেতরে শব্দটা তখনও হচ্ছে। কেউ যেন ভারী কাঠের দুখানা পা নিয়ে ঘেঁষটে ঘেঁষটে অনেক কষ্টে এগিয়ে আসার চেষ্টা করছে।

জলধরের কাছ থেকে চাবি নিয়ে আমিই দরজাটা খুললাম। তালা খোলার শব্দ হতেই ভেতরের শব্দটা থেমে গেল।

আস্তে করে দরজাটা ঠেলোম। দরজাটা খুলে গেল। একটা ঠাণ্ডা কনকনে বাতাস যেন আমাদের চুল এলোমেলো করে দিয়ে বেরিয়ে গেল।…..ভেতরে জমাট অন্ধকার।

আমরা পায়ে পায়ে এগোতে লাগলাম। এবার তিনটে টর্চই জ্বলছে।

ঘরের চারিদিকে টর্চের আলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ফেললাম।

না, কোনো জীবন্ত প্রাণীর অস্তিত্ব নেই।

আমরা আলমারিটার কাছে এসে দাঁড়ালাম। দেখলাম আরো এক হাত আলমারিটা এগিয়ে এসেছে। আর–ইস্! এটা কী?

দেখি আলমারিটার কাছে একটা মস্ত ইঁদুর চেপ্টে থেঁতলে পড়ে আছে। যেন ভারী কোনো জিনিসে চাপা পড়ে মরেছে।

টর্চের আলোয় বিরাট আলমারিটা ভালো করে দেখলাম। আলমারিটাকে একটা ভয়ংকর দৈত্যের মতো লাগছিল।

সেটার সারা গায়ে ঘুষি মেরে দেখলাম। কোনো কিছু ব্যতিক্রম চোখে পড়ল না।

 তখন আমি বললাম, জলধর, আলমারিটা খোলো।

 জলধর তোতলাতে তোতলাতে বলল, খুলে কি হবে? ওর ভেতরে আমি কিছুই রাখিনি।

 যা বলছি তাই করো। তুমি না রাখলেও আগে থেকে কিছু থাকতে পারে।

জলধর নিজে খুলল না। চাবিটা আমার হাতে দিল।

কাঁচ্ শব্দ করে বিরাট দুটো পাট খুলে গেল। একটা বিশ্রী ভ্যাপসা গন্ধ…তিনটে টর্চের আলো বর্শার ফলার মতো গিয়ে পড়ল।

না, কিছু নেই। ফাঁকা আলমারিটা যেন আমাদের গেলবার জন্য হাঁ করে আছে।

আমার মুখ থেকে একটা অস্ফুট শব্দই শুধু বেরিয়ে এল–আশ্চর্য!

তারপর বিশুকে দিয়ে একটা টুল আনিয়ে তার ওপর দাঁড়িয়ে আলমারিটার ভেতরটা দেখতে লাগলাম। আমার কেমন ধারণা ছিল যে ভেতরে নিশ্চয় কিছু থাকবেই।

আমি টুলের ওপর দাঁড়িয়ে। নিচে ওরা দুজন। তিনটে টর্চই জ্বলছে। আর পাশে পিছনে জমাট অন্ধকার। মনে হচ্ছে ঘরের মধ্যে সবকটা মৃত আসবাবপত্র যেন ভুকুটি করে আমাদের কাজকর্ম লক্ষ করছে।

খুট করে একটা শব্দ হলো। সঙ্গে সঙ্গে তিনটে টর্চ ঘুরে গিয়ে পড়ল জীর্ণ একটা সোফার ওপরে।

একটা ছুঁচো।

চোখে আলো পড়ায় ছুঁচোটা ছুটে পালাল।

আমি আলমারির ভেতরের গাগুলো ভাল করে দেখছি। আরে—

ওটা কী?

বাঁ দিকের গায়ে গোলমাথা পেরেকের মতো একটা বোতাম।

কিছু না ভেবেই আমি বোতামটা টিপলাম। সঙ্গে সঙ্গে আলমারির ভেতরের কাঠটা সরে গেলে।

তারপরই যা দেখলাম তাতে আমার মাথাটা ঝিমঝিম্ করে উঠল। তাড়াতাড়ি কাঠটা বন্ধ করে নেমে পড়লাম।

…একটা মড়ার খুলি। দুচোখের কোটরে জীবন্ত মানুষের মতো জ্বলজ্বল করছে চোখ।

হঠাই টর্চগুলো নিভে গেল। আমরা তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরোতে গেলাম। কিন্তু অন্ধকারে দরজাটা খুঁজে পেলাম না।

জলধর কেবলই গোঙাচ্ছে–আলো-আলো নিয়ে এসো।

 কিন্তু আলো আনবে কি করে?

দরজাটা কোনদিকে তাই ঠাওর হচ্ছে না।

এদিকে আবার সেই শব্দটা শুরু হয়েছে–ঘ্যা-স–ঘ্যাস–ঘ্যাস—

এবার খুবই স্পষ্ট।

কাঠের আলমারিটা পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে..হয়তো ঐ ইঁদুরটার মতোই আমাদের পিষে মারবে।

.

সদাশিবের বিবরণ

ভোর হবার সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান ফিরে আসে আমাদের। দরজা খুঁজে পাই। আলমারিতে আর দরজায় চাবি লাগিয়ে আমরা ওপরে গিয়ে বসি।

সকাল সাতটা নাগাদ রেণু চা দিয়ে গেল। এরই মধ্যে এক ফাঁকে রেণুকে জিজ্ঞেস করে নিয়েছি লম্বা-চওড়া ঝাকড়া চুল কোনো লোককে এখানে কখনো দেখেছে কিনা। রেণু বলেছে তেমন কাউকে কোনোদিন দেখেনি। কেননা ঐরকম চেহারার লোক একবার দেখলে ভুলত না।

বিশু এরই মধ্যে নিচে দিব্যি তার রোজকার কাজ শুরু করে দিয়েছে। গতরাতের কথা যেন তার মনেও নেই। অসম্ভব অবসন্ন লাগছে জলধরুক। দুচোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। ক্লান্ত স্বরে বলল, এখন কি করব রমেন?

বললাম, আমিও বুঝতে পারছি না।

জলধর বলল, ঐ মড়ার খুলিসুদ্ধ আলমারিটা নিয়ে আমি আর এ বাড়িতে থাকতে পারব না।

বললাম, অন্তত খুলিটা ফেলে দেওয়া দরকার। তারপর দেখা যাবে আর কোনো ঘটনা ঘটে কিনা।

জলধর কি বলতে যাচ্ছিল এমন সময়ে বিশু এসে বলল, বাবা নিচে এসে বসে আছে, ওপরে উঠতে পারবে না। আপনারা আসুন।

আমরা তখুনি নিচে নেমে গেলাম। আমাদের এই অবস্থায় রেণুর বাবা কোনো হদিস দিতে পারে কিনা দেখা দরকার।

রেণু বা বিশুর বাবার অনেক বয়েস। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। ছোটো ছোটো পাকা চুলে ভরা মাথাটা কেবলই দুলছে, যেন জরাজীর্ণ দুর্বল শরীরটা মাথার ভার সইতে পারছে না। নাম সদাশিব দাস।

আমাদের দেখে লাঠিটা পাশে রেখে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়াল। দুহাত জোড় করে বিনম্র নমস্কার করে বলল, কর্তাবাবুরা, এ বাড়িতে কদিন ধরে যা ঘটছে রেণুর মুখে সব শুনে আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। তাই আমি যা জানি–মানে বাবার মুখে যা শুনেছি তাই বলতে এলাম।

আমরা দুখানা চেয়ার নিয়ে ওর সামনে বসে ওকে বলতে বললাম।

সদাশিব প্রথমে চোখ বুজিয়ে কারও উদ্দেশ্যে প্রণাম জানাল। তারপর বলল, বাবুমশাইরা, এসবই ঠাকুরবাবার খেলা।

ঠাকুরবাবা কে?

এর উত্তরে সদাশিব ফোকলা মুখে অস্পষ্ট উচ্চারণে কাটা কাটা অসংলগ্ন কথার মধ্যে দিয়ে যা বলতে চাইল তা এইরকম–

প্রায় তিনশো বছর আগে এই সব জায়গা নন্দগড়ের রাজার অধীন ছিল। রাজা সারদাচরণ রাজ্যশাসনে যেমন কঠোর ছিলেন, উল্টোদিকে তেমনি আবার খুব ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন। অনেক দেব-দেউল, অতিথিশালা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

রাজসভায় সেদিন কাজের অবসরে সারদাচরণ খুশমেজাজে রাজজ্যোতিষীর সঙ্গে ভাগ্যফল নিয়ে আলোচনা করছিলেন। পাশে বসেছিল তাঁর পোষ্যপুত্র যুবরাজ মঙ্গলাচরণ। এমনি সময়ে জয় তারা! বলে হুংকার দিয়ে বিকটাকার এক সন্ন্যাসী রাজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। খালি গা, পরনে কনি মাত্র, মাথায় জটা, কপালে সিঁদুর, গলায়-হাতে মোটা মোটা রুদ্রাক্ষের মালা। ডান হাতে মস্ত বড় খাঁড়া কাঁধের ওপর রাখা। তাঁকে দেখে সভার সকলে ভয়ে চমকে উঠল। রাজা উঠে দাঁড়িয়ে প্রণাম জানালেন।

সন্ন্যাসী দূর থেকে তাকে আশীর্বাদ জানিয়ে বললেন, ভিক্ষাং দেহি।

সারদাচরণ বিনীতভাবে বললেন, ভিক্ষা বলবেন না, ঠাকুর। আদেশ করুন কী চান।

সন্ন্যাসী যেন জানতেনই রাজাকে কি বললে রাজা তার কি উত্তর দেবেন। তাই তার উত্তরও তৈরি ছিল। হাত দিয়ে ঐ সব মাঠ দেখিয়ে বললেন, ঐ ভূমি আমায় দান করলে আমি যাগ-যজ্ঞ করতে পারি। আশ্রম তৈরি করে আমার বহু শিষ্যদের স্থায়ীভাবে এখানে নিয়ে এসে রাখতে পারি। তাতে তোমার রাজ্যেরই কল্যাণ হবে।

সারদাচরণ তাই হবে বলে নায়েবকে ডেকে জমির বিলি ব্যবস্থা করে দিতে বললেন। আর সন্ন্যাসীর থাকার, সেবার আয়োজনও যাতে সেই দিন থেকেই শুরু হয় সেইরকম নির্দেশ দিলেন।

সন্ন্যাসী খুশি হয়ে রাজাকে আবার একদফা আশীর্বাদ করে রাজসভা থেকে বেরিয়ে গেলেন।

সন্ন্যাসী চলে গেলে সারদাচরণ জ্যোতিষীকে হেসে জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন ব্যবস্থা করলাম? ভালোই বলো। সন্ন্যাসীর কী রকম চেহারা দেখেছ? খুব উঁচুদরের তান্ত্রিক বলে মনে হলো।

জ্যোতিষী চুপ করে রইলেন।

সারদাচরণ বললেন, আর ঐ মাঠ? শুধু শুধু পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছিল–

জ্যোতিষী বাধা দিয়ে বললেন, সে কী মহারাজ! কত গরিব চাষী আপনার ঐ জমিতে ফসল ফলিয়ে জীবনধারণ করছিল–তাদের মুখের অন্ন কেড়ে নিলেন?

তার কাজের কেউ নিন্দে করলে সারদাচরণ সহ্য করতে পারতেন না। বিরক্ত হয়ে বললেন, চাষীদের পেট ভরানোর চেয়ে ঠাকুরমশাইয়ের আশীর্বাদ পাওয়া আমার ঢের লাভের। বুঝেছ? তাছাড়া রাজ্যের কল্যাণ

জ্যোতিষী বললেন, আমি ভালোভাবেই বুঝেছি মহারাজ। তবু বলে যাচ্ছি, কাজটা ভালো হলো না। ফল অশুভ। বলে রাজসভা থেকে বেরিয়ে গেলেন।

সারদাচরণ তখনই আদেশ করলেন–এই জ্যোতিষী যেন কোনোদিন আর রাজসভায় ঢুকতে না পরে।

জ্যোতিষী চলে যেতেই যুবরাজ মঙ্গলাচরণও উঠে গেল। সারদাচরণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তার মনে হলো তার ছেলেও তার এই কাজ পছন্দ করছে না। রাগে মুখটা থঙ্কম্ করতে লাগল।

তারপরই শুরু হলো সন্ন্যাসীর কর্মযজ্ঞ। দশ দিনের মধ্যেই কোথা থেকে নিয়ে এলেন শ দুয়েক শিষ্যশাগরেদ। জমি দখল করে নিলেন। কিন্তু কাজটা খুব সহজে হয়নি। গরিব চাষীরা দলবদ্ধভাবে তাদের পেটের অন্ন যোগায় যে জমি তা রক্ষা করবার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল। একদিকে স্বয়ং রাজার পাইক-বরকন্দাজ আর সন্ন্যাসী ঠাকুরের শিষ্যরা, অন্য দিকে চাষীরা। সন্ন্যাসী ঠাকুরের পাশে ছিল তার প্রধান আর প্রিয় শিষ্য প্রলয়ানন্দ। বয়েস ত্রিশের মতো। বড় নিষ্ঠুর। সে নিজে খাঁড়া নিয়ে কত চাষীর মুণ্ডু কাটল তার হিসেব নেই। চাষীরাও চুপ করে মার খেল না। তারা দলে দলে তীর-ধনুক নিয়ে সন্ন্যাসী নিধনে নেমে পড়ল। সন্ন্যাসীরা সারা মাঠ জুড়ে যে সব আশ্রম তৈরি করেছিল, সব জ্বালিয়ে দিল চাষীরা। আর চাষীদের নিয়ে সন্ন্যাসীদের বিরুদ্ধে যে যুবকটি লড়াই পরিচালনা করছিল, সে হচ্ছে মঙ্গলাচরণ। তারও বয়েস ত্রিশের মতো।

সারদাচরণ ভাবতেও পারেননি যে তাঁরই ছেলে এইভাবে তার বিরুদ্ধাচরণ করবে। যখন জানতে পারলেন তখনই হুকুম দিলেন মঙ্গলকে বন্দী করো।

বরকন্দাজরা যখন মঙ্গলকে বন্দী করতে এল তখন দেখা গেল মাঠের মধ্যে মঙ্গল মুখোমুখি যুদ্ধ করছে প্রলয়ানন্দের সঙ্গে। প্রলয়ানন্দের হাতে খাঁড়া, মঙ্গলের হাতে তরোয়াল।

মঙ্গল তরোয়াল ঘোরাতে ঘোরাতে বললে, এখন তোমরা আমার কাছে এগিও না। আগে একে বধ করি। তারপর

এই পর্যন্ত বলে সদাশিব চুপ করেছিল। জিজ্ঞেস করলাম, তারপর

তারপরের কথা কেউ বলতে পারে না বাবুমশাই। শোনা যায় মঙ্গলকে বন্দী করে একটা মস্ত বড়ো কাঠের আলমারির মধ্যে আটকে রাখা হয়েছিল। এটা করা হয়েছিল স্বয়ং সারদাচরণের আদেশেই।

আমরা চমকে উঠলাম।

আলমারির মধ্যে যে খুলিটা রয়েছে সেটা তাহলে মঙ্গলাচরণেরই?

তাই সম্ভব।

আর সেই তান্ত্রিক সন্ন্যাসী?

সদাশিব বলল, সন্ন্যাসীকে সবাই ঠাকুরবাবা বলত। ঘোর তান্ত্রিক। এখানে এসেই কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করে প্রতি অমাবস্যায় নরবলি দিয়েছেন। কাউকে ভয় করতেন না। কিন্তু তিনিও শেষ পর্যন্ত বাঁচেননি। চাষীরা তার ঘরে আগুন দিয়ে তাকে পুড়িয়ে মারে।

সেই থেকে তাঁর অশান্ত আত্মা মাঝে মাঝেই দোঠেলা বাতাসে ভর করে সারা মাঠ দাপিয়ে বেড়ায়। কিছু যেন খোঁজেন।

বলে সদাশিব আবার প্রণাম করল।

কিন্তু এখন ঐ আলমারি আর খুলিটা নিয়ে আমরা কি করব? খুলিটা ফেলে দেব?

সদাশিব আৎকে উঠে বলল, নানা, ওটা আপনারা ছোঁবেন না। আপনারা একদিন দুপুর রাতে মাঠের মধ্যিখানে গিয়ে ঠাকুরবাবাকে একমনে ডাকুন। বলুন, ঠাকুরবাবা, আপনি যা চান তা দয়া করে নিয়ে গিয়ে আমাদের শান্তি দিন। আমরা নিরপরাধ।

.

সদাশিবের কথা মতো সেদিন রাত্তিরেই আমরা তিনজন সেই ধু-ধু মাঠের মাঝামাঝি জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম। চারদিক থথম্ করছে। গোটা মাঠটাকে মনে হচ্ছিল যেন মরুভূমি।

জলধরই প্রার্থনা করল। তারপর আমরা ফিরে এলাম। সেই ঘরের আর আলমারির তালাচাবি খুলে রেখে আমরা শুয়ে পড়লাম। রাত তখন একটা।

ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

হঠাৎ ঝড়ের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। দেখি জলধবও উঠে বসেছে। ঝড় উঠেছে মাঠের দিকে। সেই সঙ্গে গুন্ গুন্ শব্দ।

শব্দটা ক্রমেই এগিয়ে আসছে–এগিয়ে আসছে

হঠাৎ শব্দটা থেমে গেল। তারপরই পরিষ্কার খড়মের শব্দ খটখট খট

 শব্দটা বাড়ির নিচে পর্যন্ত এসেছে। আমরা ভয়ে কাঠ হয়ে বসে আছি। ওপরে উঠে আসবে নাকি?

না, ওপরে এল না। খড়মের শব্দ যেন সেই ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল।

কিছুক্ষণ রুদ্ধ নিশ্বাসে আমরা মশারির মধ্যে বসে রইলাম। তারপর

তারপরই হুড়মুড় করে ভীষণ একটা শব্দ…কিছু যেন পড়ে ভেঙে গেল।

কী ঘটছে তা দেখতে যাবার সাহস আমাদের নেই। আমাদের তেমনিই বসে থাকতে হলো যতক্ষণ না সকাল হলো।

যথেষ্ট বেলা হলে আমরা নিচে গিয়ে দেখলাম, অতবড়ো আলমারিটা ভেঙে চুরমার হয়ে চারদিকে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে।

ভালো করে খুঁজে দেখলাম খুলিটা নেই।

যাক বাঁচা গেল। যে জন্যে এত কাণ্ড সেটা দূর হয়েছে। আলমারিটারও গতি হয়েছে। আপনা থেকেই। আমরা নিশ্চিন্ত হয়ে ওপরে এসে বসলাম।

.

জলধরের বাড়িতে আর উৎপাত হয়নি। তবে একটা খটকা আমাদের মনে থেকেই গেল। খুলিটা যখন মঙ্গলাচরণেরই তখন সেই খুলিটা উদ্ধারের জন্যে ঠাকুরবাবার এত চেষ্টা কেন? মঙ্গলাচরণ তো তাঁর শত্রুপক্ষের লোক!

এ রহস্যের মীমাংসা তখনই হয়নি। হয়েছিল আরও কয়েক মাস পরে।

রাজবাড়ির সেই পুরোহিত সদানন্দ ব্রহ্মচারী কাশী থেকে নবদ্বীপে ফিরে এসেছেন জেনে জলধর গেল দেখা করতে। সঙ্গে আমাকেও যেতে হলো।

সব শুনে বৃদ্ধ সদানন্দ গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, আমার ফেরা পর্যন্ত তোমার অপেক্ষা করা উচিত ছিল। আমি থাকলে ঐ আলমারি কখনো কিনতে দিতাম না। ঐ আলমারিটা ব্যবহার নিষিদ্ধ তালিকায় রয়েছে।

তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ঘটনাটা সব শুনেছ তো?

জলধর তখন সদাশিবের বিবরণটা বলে গেল। সদানন্দ চোখ বুজিয়ে শুনে গেলেন। তারপর বললেন, সদাশিব যা বলেছে তা তার বাবার কাছে থেকে শোনা কথা। আর আমার কাছে আছে এই বংশের সমস্ত ঘটনাপঞ্জী। সদাশিবের অনেক কথাই ঠিক। শুধু একটাই ভুল। আলমারিতে আটকে রাখা হয়েছিল রাজকুমার মঙ্গলাচরণকে নয়, তান্ত্রিকের প্রধান আর প্রিয়তম শিষ্য প্রলয়ানন্দকে। কেউ বলে রাজার সেপাইরা ভুল করে মঙ্গলাচরণের বদলে প্রলয়ানন্দকে আলমারিতে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। আবার কেউ বলে, ভুল নয়। ওরা মঙ্গলাচরণকে খুব ভালোবাসত। তাই ওকে ছেড়ে দিয়ে নিষ্ঠুর হৃদয়হীন প্রলয়ানন্দকেই আলমারির মধ্যে গুম করে রাখে। তবে তারপর থেকে মঙ্গলাচরণকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। রাজবংশের তালিকাতেও তাই বোধহয় মঙ্গলাচরণের নাম নেই।

আমরা ফিরে এলাম। এত দিনে পরিষ্কার হলো কেন সেই অশরীরী তান্ত্রিক হানা দিত এ বাড়িতে। সে বোধহয় মুক্ত করতে চাইত তার প্রিয় শিষ্য প্রলয়ানন্দর বদ্ধ আত্মাকে।

[আষাঢ় ১৪০৪]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *