০৭. মুখের কথাই মন্ত্র

০৭. মুখের কথাই মন্ত্র

ভূমিকায় বলা হয়েছে, প্রথমবার পড়ার সময় কোনো অনুশীলন চর্চা করবেন না। কিন্তু নিচের অনুশীলনটা সেই নিষেধের আওতায় পড়ে না, এটা আপনি এখুনি একবার চর্চা করতে পারেন। করার সময় আপনার সমস্ত কল্পনাশক্তি ব্যবহার করবেন।

আসুন, এবার শুরু করা যাক।

কল্পনা করুন বাড়ির কিচেনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন আপনি, হাতে একটা লেবু। লেবুটা আপনি এইমাত্র বের করেছেন রেফ্রিজারেটর থেকে, আপনার হাতের তালুতে ওটা ঠাণ্ডা লাগছে। লেবুর বাইরের দিকটা ভালো করে লক্ষ্য করুন, হলুদ মোমের মতো গা। লেবুটার দুই প্রান্তে ত্বকের রঙ বদলে গেছে, বিন্দু বিন্দু সবুজ ভাব দেখতে পাচ্ছেন আপনি। একটু চাপ দিন, আঁটসাঁট, শক্ত ভাবটুকু অনুভব করুন, অনুভব করুন। ওজনটুকু।

এবার নাকের কাছে তুলে লেবুটার গন্ধ নিন। লেবুর মতো গন্ধ আর কিছুর নয়, তাই না? এবার লেবুটাকে মাঝখানে কেটে দু’ভাগ করুন, তারপর একভাগের ঘ্রাণ নিন। গন্ধটা এখন তীব্র। এবার দু’সারি দাঁতের মাঝখানে নিয়ে টুকরোটাকে গভীর ভাবে একটা কামড় বসান, রসটুকু ছড়িয়ে দিন আপনার মুখের ভেতর সবখানে। লেবুর মতো স্বাদ আর কিছুর নয়, কি বলেন?

এ পর্যন্ত এসে, আপনি যদি আপনার কল্পনা শক্তিকে ঠিকমতো ব্যবহার করে থাকেন, নিশ্চয়ই আপনার জিভে পানি এসে গেছে।

আসুন, এবার এই ঘটনার তাৎপর্য বিশ্লেষণ করা যাক।

শব্দ, নিছক শব্দ, আপনার স্যালিভারি গ্ল্যাণ্ড কে সচল করে তোলে। শব্দগুলো এমন। কি বাস্তবকেও প্রতিফলিত করেনি, আপনি একটা কিছু কল্পনা করেছিলেন, সেই কল্পনাটাকে প্রতিফলিত করেছে। লেবু সম্পর্কে শব্দগুলো আপনি যখন পড়ছিলেন, সেই মুহূর্তে আপনি আসলে আপনার ব্রেনকে বলছিলেন, আপনার কাছে একটা লেবু আছে। যদিও আসলে ছিলো না, ঠিক আছে বলে বোঝাতেও চাননি আপনি। কিন্তু আপনার ব্রেন ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নেয়, স্যালিভারি গ্ল্যাওকে বলে, ‘লোকটা একটা লেবুতে কামড় দিচ্ছে! জলদি, ধুয়ে অ্যাসিড় সাফ করে ফেললো। গ্লাও নির্দেশটা পালন করেছে।

আমরা সবাই জানি, আমাদের ব্যবহার করা শব্দগুলো অর্থ প্রতিফলিত করে, এবং এই অর্থ খারাপ বা ভালো, সত্যি বা মিথ্যে, শক্তিশালী বা দুর্বল হতে পারে। সত্যি তাই, কিন্তু সত্যের এটা অর্ধেক মাত্র। শব্দ শুধু বাস্তবকে প্রতিফলিত করে না, তারা বাস্তবতা তৈরিও করে–যেমন মুখের লালা।

ব্রেন যে শুধু আমাদের ইচ্ছা আর উদ্দেশ্যের সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা দিতে পারে তাই নয়, তথ্য সংগ্রহ করে নিজের ভাঁড়ারে জমাও রাখতে পারে সে, সেই সাথে আমাদের শরীরের নিয়ন্ত্রণ ভারও নিজের হাতে রেখেছে। তাকে যদি, ‘আমি এখন একটা লেবু খেতে যাচ্ছি, বা এই ধরনের কিছু বলা হয়, অমনি কাজ শুরু করে দেয় সে।

এবার মনের ঘর-দুয়ার পরিষ্কার করার কাজে নেমে পড়া উচিত আমাদের। এর জন্যে কোনো অনুশীলন নেই, ব্রেনকে চালু করে দেয়ার জন্যে কি ধরনের শব্দ আমরা ব্যবহার করবো শুধু সে ব্যাপারে সতর্ক থাকলেই হবে।

এই পরিচ্ছেদের প্রথমেই যে অনুশীলনটা চর্চা করলেন ওটাকে নিউট্রাল বা নিরপেক্ষ বলা যেতে পারে–শারীরিক ভাবে ভালো বা মন্দ কিছুই ঘটেনি। কিন্তু শব্দকে অতো নিরীহ মনে করার কোনো কারণ নেই। আমাদের ব্যবহার করা শব্দের যেমন উপকার করার ক্ষমতা আছে তেমনি ক্ষতি করার ক্ষমতাও আছে।

চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়ে কেউ হয়তো বললো, ‘চা তো নয়, যেন কানা চোখের পানি। চা খুব পাতলা হয়েছে, রঙ হয়নি, তাই এ-কথা বলা। আপাতঃ দৃষ্টিতে এই কথাগুলোর ক্ষতি করার কোনো ক্ষমতা আছে বলে মনে হয় না। কিন্তু দেখা গেল, যারা চা খাচ্ছিলো তাদের মধ্যে একজন চায়ের কাপে চুমুক দিতে পারলো না, বা ইতিমধ্যে দিয়ে থাকলে তার মধ্যে বমি বমি একটা ভাব জাগলো। এ থেকে কি প্রমাণ হয় না, শব্দ ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে? খেতে বসে ছোটো ছেলেরা প্রায়ই একটা খেলা। খেলে। খাবার জিনিসকে তারা দুর্গন্ধময় বা দেখতে কুৎসিত কোনো জিনিসের সাথে তুলনা করে। মাখন হয়ে যায় হলুদ মল, ভাত হয়ে যায় নর্দমার পোকা, ইত্যাদি। কিন্তু ভালো একটা খাবারকে মল বা নর্দমার কীট বলে ভান করা সবার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই দেখা যায়, কিছু না খেয়েই দু’একজন উঠে গেল।

আমরা বড়রাও এই খেলা খেলছি বৈকি। জীবনের প্রতি আমাদের যে আকর্ষণ সেটা আমরা অনেকেই নেতিবাচক বা না-সূচক চিন্তা আর কথা ব্যবহার করে হারিয়ে ফেলছি। হ্যাঁ-সূচক কথার মতোই না-সূচক কথারও ধার এবং ক্ষমতা আছে, না-সূচক কথা বার বার ব্যবহার করে সেই ধার ও ক্ষমতা আমরা আরো বাড়িয়ে তুলি। ফলে জীবনের কাছ থেকে চেয়ে পাবার মতো কিছুই থাকে না।

‘কেমন আছো?’

‘আমাদের আর থাকাথাকি! দিন কেটে যাচ্ছে এই আর কি।‘

 কিংবা, ‘ভালো না।’ অথবা, ‘বেঁচে আছি সে তো দেখতেই পাচ্ছো!’

এই ধরনের কথায় কিভাবে সাড়া দেয় আমাদের ব্রেন?

হয়তো মাথাব্যথা কোনমতে ছাড়তে চায় না। ঘাড়ে ব্যথা পাই। আবহাওয়া। বদলের সাথে সাথে অসুস্থ হয়ে পড়ি। সর্দিটা ভালো হতে চায় না। তবে জেনে রাখা ভালো যে ডাক্তার আর ওষুধের পিছনে যতো টাকা আমরা খরচ করি, তার একটা মোটা অংশ খরচ করাবার কৃতিত্ব আমাদের ব্যবহার করা কথাবার্তার। জীবনের প্রতি আমা দের দৃষ্টিভঙ্গি যদি ইতিবাচক বা হাঁ-সূচক না হয়, আমাদের ব্রেনও নেতিবাচক বা না-সূচক ভূমিকা পালন করে। সে বলে, ‘এই লোক মাথায় ব্যথা চাইছে। ঠিক আছে। ওকে দেয়া হচ্ছে মাথাব্যথা।’

ক্ষতিকর কিছু বললেই সাথে সাথে ব্যথা পাই না আমরা, ক্ষতিটাও তখুনি ঘটে না। শরীরের স্বাভাবিক প্রবণতা সুস্থ থাকা, তার সমস্ত আচরণ আর নিজস্ব গতিধারা সুস্থতা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে কাজ করছে। রোগ আর অসুস্থতাকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতাও তার যথেষ্ট। কিন্তু এই প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় যখন আমরা ক্ষতিকর শব্দ ব্যবহার করে সেই ক্ষমতার গায়ে একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র ছড়ি। একটা সময় আসে, আমরা যা চাই শরীরকে দিয়ে ঠিক সেটাই আদায় করিয়ে নিতে পারে ব্রেন।

দুটো জিনিস আমাদের ব্যবহার করা শব্দ বা কথার ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। এক, আমাদের মনের লেভেল। দুই, আমরা যা বলি তাতে আমাদের ভাবাবেগের মাত্রা।

‘ইস, প্রচণ্ড ব্যথা লাগছে!’ সত্যি যদি প্রচণ্ড ব্যথা না-ও লাগে কথাটা আন্তরিক বিশ্বাসের সাথে বলা হলে প্রচণ্ড ব্যথা সত্যি সত্যি অনুভব করবেন আপনি। ‘গুছিয়ে কোনো কাজ করবো, তার কোনো উপায় নেই এখানে!’ গভীর বিশ্বাসের সাথে কথাটা বলা হলে পরিবেশ সত্যি সত্যি বৈরি হয়ে উঠবে, যেখানে গুছিয়ে কাজ করা কিছুতেই সম্ভব হবে না।

.

ফ্রান্সের এমিল কুয়ে একটা সাজেশন তৈরি করে বিখ্যাত হয়ে আছেন। ‘ডে বাই ডে, ইন এভরি ওয়ে, আই অ্যাম গেটিং বেটার অ্যাও বেটার।’ হাজার হাজার লোকের গুরুতর অসুখ সারিয়ে দিয়েছে এই শব্দ ক’ টা। ড. কুয়ের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলছি, এই বাক্যটির জন্যে তাঁকে আমি শ্রদ্ধা করি। তাঁর সেল-মাস্টারী থু অটোসাজেশন বইটি অমূল্য জ্ঞান দিয়েছে আমাকে।

একজন কেমিস্ট হিসেবে প্রায় ত্রিশ বছর কাজ করেছেন ড, কুয়ে। সম্মোহন নিয়ে পড়াশোনা এবং গবেষণা করার পর তিনি নিজেই একটা সাইকোথেরাপি উদ্ভাবন করেন, যার ভিত্তি হলো অটোসাজেশন। ইংরেজি উনিশ শো দশ সালে নান্সিতে তিনি একটা ফি ক্লিনিক খোলেন, যেখানে তিনি সফলতার সাথে হাজার হাজার লোকের চিকিৎসা করেছেন। তাঁর চিকিৎসা পদ্ধতির সাহায্যে ভালো হয়েছে বাত, ভয়ঙ্কর জাতের মাথাব্যথা, হাঁপানি, হাত বা পায়ের প্যারালাইসিস, তোতলামি, টিউমার, আলসার ইত্যাদি। কিন্তু এ-ব্যাপারে তাঁর নিজের বক্তব্য ছিলো, তিনি কাউকে সুস্থ করেননি, শুধু মানুষকে শিখিয়েছেন নিজেদের কিভাবে সুস্থ করে তুলতে হয়। রোগ যে সারতো সেটা কোনো গল্প-কথা নয়, বাস্তব প্রমাণ আছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় উনিশ। শো ছাব্বিশ সালে তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে পদ্ধতিটিও হারিয়ে যায়। তাঁর এই পদ্ধতি যদি অত্যন্ত জটিল আর কঠিন হতো, এবং ফলে মাত্র অল্প দু’ একজন বিশেষজ্ঞ চর্চা করার জন্যে শিখতে পারতো তাহলে আজও হয়তো টিকে থাকতো সেটা। পদ্ধতিটা একেবারে সহজ। যে কেউ শিখতে পারে, তাই অতটা মূল্য পায়নি ওটা কারও কাছে।

মাত্র দুটি মৌলিক বিধির ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে পদ্ধতিটি।

১। একবারে মাত্র একটি বিষয়ে চিন্তা করতে পারি আমরা, এবং

২। আমরা যখন কোনো চিন্তার ওপর গভীর মনোযোগ আরোপ করি, তখন চিন্তাটা সত্যি হয়ে ওঠে, কারণ আমাদের শরীর-মন সেটাকে অ্যাকশন বা তৎপরতায় রূপান্তরিত করে।

কাজেই আপনি যদি ভেতরের মেশিন চালু করে শরীর বা মনকে সুস্থ করে তুলতে চান, যেটা হয়তো না-সূচক চিন্তা-ভাবনার (সচেতন বা অবচেতন) দরুন অচল হয়ে পড়ে আছে, তাহলে পর পর ত্রিশ বার এই বাক্যটি আওড়ান-’প্রতিদিন সবদিক থেকে উন্নতি করছি। সকাল-বিকেল, ছন্দ মিলিয়ে বলতে থাকুন ত্রিশবার করে, তাহলেই জানবেন ড. কুয়ের পদ্ধতি ব্যবহার করছেন আপনি।

আগেই বলেছি, ধ্যানমগ্ন অবস্থায় শব্দের ক্ষমতা অনেক গুণ বেড়ে যায়। তাই আলফা বা থিটা লেভেলে পৌঁছে এই সাজেশনটা প্রতিদিন একবার দিলেও পারেন। কিন্তু এই সাজেশনের সাথে আরো ক’ টা শব্দ যোগ করবেন, ‘না-সূচক চিন্তা, না সূচক সাজেশন আমার মনের কোনো লেভেলেই কোনো প্রভাব ফেলে না।’

শুধু এই বাক্য দুটোই বেশ অনেকগুলো ফল দিতে পারে। এখানে একজন মার্কিন সৈনিকের কথা উল্লেখ করবো। হোসে সিলভার ট্রেনিং কোর্সে ভর্তি হয়েছিল সে, কিন্তু একদিনের বেশি ক্লাস করার সুযোগ পায়নি, হঠাৎ নির্দেশ পেয়ে তাকে চলে যেতে হয়। ইন্দো-চীনে। তার শুধু মনে ছিলো কিভাবে ধ্যান করতে হয়, আর এই বাক্য দুটো।

ইন্দো-চীনে একজন পাজি সার্জেন্টের অধীনে কাজ করতে দেয়া হলো তাকে। ভয়ঙ্কর বদ-মেজাজী, মদ্যপ সার্জেন্ট; দুর্বল কাউকে পেলে তার ওপর অত্যাচারের স্টীম রোলার চালিয়ে দেয়। মনের সাধ মিটিয়ে অত্যাচার চালাবার জন্যে নতুন আসা এই সৈনিকটিকেই বেছে নিলো সে।

দু এক হপ্তা কাটতেই দেখা গেল, কাশতে কাশতে রাত দুপুরে ঘুম ভেঙে যায় সৈনিকটির। কয়েক দিন পর, যা কোনোদিন ছিলো না, সেই হাঁপানিতে আক্রান্ত হলো। সে। ডাক্তাররা তাকে অত্যন্ত যত্নের সাথে পরীক্ষা করে রায় দিলো, শরীর সম্পূর্ণ সুস্থ। ইতিমধ্যে আরো নানা রকম অসুস্থতা ছেকে ধরলো তাকে। কাজে মন বসে না, শরীর দুর্বল লাগে। কোনো কাজ দিলে লেজেগোবরে করে ফেলে। তার অবস্থার যতো অবনতি হচ্ছে, সার্জেন্টের ভয়ঙ্কর মনোযোগও তার ওপর সেই পরিমাণে বাড়ছে।

তার ইউনিটের আর সবাই ড্রাগসের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। কিন্তু সৈনিকটি আশ্রয় নিলো সেই দুটো বাক্যের। ভাগ্য ভালো বলতে হবে, রোজ তিনবার ধ্যানমগ্ন হবার সুযোগ পেতো সে। ফলাফল? তার নিজের ভাষায় শুনুন, মাত্র তিন দিনের মধ্যে সার্জেন্টের অত্যাচার থেকে বেঁচে গেলাম আমি। আমাকে যা করতে বলতে সব আমি করতাম, কিন্তু তার খোঁচা মারা একটা কথাও আমাকে স্পর্শ করতো না। হাঁপানি আর সর্দি-কাশি সারতে এক হপ্তাও লাগেনি।

মনের যে ক’ টা লেভেলে আমরা মন-নিয়ন্ত্রণ চর্চা করি, শব্দ তার চেয়েও গভীর লেভেলে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। ওকলাহোমার একজন নার্স-অ্যানেসথেটিস্ট, মিসেস জিন মাব্রে তাঁর রোগীদের সাহায্য করার জন্যে এই জ্ঞানটা কাজে লাগান। অ্যানেসথেশিয়ার সাহায্যে একজন রোগীকে অজ্ঞান করার পরপরই তিনি তার কানের কাছে মুখ নামিয়ে সাজেশন দিতে শুরু করেন। প্রায় সব ক্ষেত্রেই আশ্চর্য ফল পাওয়া গেছে। কেউ কেউ দ্রুত সেরে উঠেছে, আবার কেউ বেঁচে গেছে প্রাণে।

একদিন একটা অপারেশনের সময়, যখন প্রচুর রক্তক্ষরণ আশা করা হচ্ছিলো, কিন্তু তার কোনো লক্ষণ নেই দেখে অবাক হয়ে গেল সার্জেন। রক্ত বেরুচ্ছে, কিন্তু তা নেহায়েতই সামান্য। ব্যাপারটা কি? জানা গেল, রোগীকে অজ্ঞান করার পর তার কানে। কানে মিসেস মাত্রে বলেছেন, ‘তোমার শরীরকে বলো যেন বেশি রক্ত না ফেলে। অপারেশন চলাকালেও, প্রতি দশ মিনিট পর পর এই সাজেশন দিয়ে গেছেন তিনি।

আরেকটা অপারেশনের সময় তিনি ফিসফিস করে বলেছিলেন, তুমি জেগে উঠে অনুভব করবে, তোমার আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধব সবাই তোমাকে ভালোবাসে, নিজের ওপরও তোমার ভালোবাসা জন্মাবে। এই রোগিনী তার সার্জেনকে বিশেষ উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল। সারাক্ষণ উত্তেজিত হয়ে থাকতো মহিলা, যে-কোনো ব্যথাই অমঙ্গল ডেকে নিয়ে আসবে বলে ভয় পেতো। এই প্রবণতার ফলে সেরে উঠতে প্রচুর সময় লেগে যাবে। কিন্তু জ্ঞান ফিরে এলে দেখা গেল তার চেহারায় নতুন একটা ভাব। এর তিন মাস পর সার্জেন মিসেস মাব্রেকে জানালেন, তাঁর সেই সদা উত্তেজিত রোগিনী সম্পূর্ণ বদলে গেছে। অপারেশনের ধকল খুব তাড়াতাড়ি কাটিয়ে উঠেছে সে, শুধু তাই নয়, জীবনের প্রতি নতুন আকর্ষণ ও বিশ্বাস জন্মেছে তার, অস্থিরতা কেটে গিয়ে তার মধ্যে এসেছে শান্ত একটা ভাব।

মিসেস মাত্রের কাজগুলো থেকে তিনটে ছবি পাই আমরা। এক, মনের গভীর স্তরে শব্দ বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন বা বিশেষ তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে। দুই, যতোটুকু ধারণা করা হয় শরীরের ওপর তারচেয়ে অনেক বেশি কর্তৃত্ব রয়েছে মনের। তিন, আগেই অবশ্য কথাটা বলা হয়েছে–আসলে আমরা অচেতন হই না, সব সময় সচেতন থাকি।

ঘুমন্ত ছেলেমেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে অনেক মা-বাবাই চিন্তা করেন, এই ছেলেকে মানুষ করবো কিভাবে! লেখাপড়ায় মন নেই, সারাদিন শুধু ভাই-বোনদের সাথে ঝগড়া-ঝাঁটি, ডানপিটের একশেষ, কারো কোনো শাসনই মানে না। এসব ভেবে উদ্বিগ্ন হওয়ার চেয়ে যদি ঘুমন্ত ছেলেমেয়ের কানের কাছে ঠোঁট নামিয়ে ফিসফিস করে কিছু উপদেশ, সাজেশন ইত্যাদি দেয়া হয়, আশ্চর্য ফল পাওয়া যেতে পারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *