০৫. আয় ঘুম

০৫. আয় ঘুম

ঘুমাই আমরা সবাই। কিন্তু ঘুম নিয়ে সমস্যারও অন্ত নেই। কেউ কেউ অভিযোগ করে, তারা ঘুমায় বটে, কিন্তু তাদের ঘুম যথেষ্ট গম্ভীর হয় না। ফলে ঘুম থেকে জাগার পর যে ঝরঝরে, তাজা ভাবটা আসা দরকার তা আসে না; শরীর ম্যাজম্যাজ করে, ব্যথা করে, বিগড়ে থাকে মেজাজ, কাজে মন বসে না, দুর্বল লাগে ইত্যাদি। কারো কারো অভিযোগ, তাদের ঘুম খুব ছোটো, যথেষ্ট লম্বা নয়। ভোর হতে তখনো তিন ঘন্টা বাকি, ভেঙে গেল ঘুম, কি জ্বালাতন! আবার ঘুম কাতুরে লোকেরও অভাব নেই। ক্লাসে বসে, পিকনিকে গিয়ে, বাসে উঠে, রিক্সায় চড়ে, অফিসে পৌঁছে…মোট কথা জায়গা বা পরিবেশের কোনো বাছ বিচার নেই, সুযোগ থাক বা না থাক, দু’চোখ ভরা ঘুম এসে তাদেরকে ঘায়েল করে ফেলে। উল্টোটাও ঘটে, বিছানায় শুয়ে ছটফট করে কিছু লোক, জপ করে আয় ঘুম, ঘুম আয় বলে–এরা অনিদ্রায় ভুগছে। এগুলোই সব নয়, ঘুম নিয়ে আরো অনেক সমস্যা আছে।

আলফা লেভেলে পৌঁছে নিজেকে সাজেশন দেয়ার নিয়ম আপনার জানা আছে। ঘুম নিয়ে আপনার যদি কোনো সমস্যা থাকে, সমাধান –মূলক সাজেশন দিয়ে সে সমস্যা। কাটিয়ে উঠতে পারবেন আপনি। হাতে আরো উপায় আছে আপনার, মনের পর্দায় সমস্যা এবং সমাধানের ছবি দেখলেও উপকার পাবেন। যার ঘুম কম হয় তিনি প্রথমে দেখবেন রাত দুপুরে ঘুম ভেঙে গেল, এই ছবি আপনি মাত্র একবার দেখবেন। ছবি টাকে ডান দিকে সরিয়ে দিয়ে বাঁ দিক থেকে আরেকটা ছবি আনবেন পর্দায়, এই ছবিতে সমস্যার সমাধান থাকবে–ছবিতে দেখবেন, আপনি ঘুমাচ্ছেন, চারদিকে নানা গোলমাল এবং শব্দ হচ্ছে তুবু আপনার ঘুম ভাঙছে না। এভাবে যার যা সমস্যা, সমস্যা অনুসারে সমাধান তৈরি করে নিয়ে পর্দায় ছবি দেখতে পারেন। ছবি দেখার সাথে সাথে তিন আঙুল পদ্ধতিও ব্যবহার করা যেতে পারে।

এবার ঘুমের প্যাটার্ন সম্পর্কে সাধারণ একটা ধারণা দেবার চেষ্টা করবো। স্বাভাবিক ঘুম কাকে বলে সেটা জানা থাকলে অনেক অকারণ দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হওয়া যায়। তারপর আসবে ঘুম গভীর করার অনুশীলন।

ঘুমের গভীরতা পরিমাপ করার একটা মাধ্যম হলো ঘুম সাইকেল। একটা ঢেউ, ওঠানামা করতে করতে ঘুমের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অবিচ্ছিন্ন ভাবে এগিয়ে যায়। শুরুতে এই ঢেউ নিচের দিকে মুখ করে এগোয়, তারমানে তখন আমরা ডেলটা লেভেলে নেমে যাই। তারপর যতোই এগোতে থাকে ঢেউটা ততোই নিচের দিকে নামার প্রবণতা কমে আসে। এটাই স্বাভাবিক গতি এবং প্রবণতা। এই প্যাটার্ন যদি বদলে যায় তাহলে মনে করতে হবে বিশ্রামে বিঘ্ন ঘটছে। তাই স্বাভাবিক ঘুম বজায়। রাখা এবং সেটাকে আরো গভীর করা আমাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। সেটা নিচের এই পদ্ধতির সাহায্যে সম্ভব করে তোলা যেতে পারে।

স্লিপ কন্ট্রোল বা ঘুম নিয়ন্ত্রণ একটা ফর্মুলা-টাইপ টেকনিক, এর সাহায্যে স্বাভাবিক, সাধারণ, সাইকোলজিক্যাল ঘুম যে-কোনো সময়, যে কোনো জায়গায় ওষুধ ছাড়াই নিয়ে আসা যায়।

যখনই আপনি ঘুম নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবেন, তিন–এক পদ্ধতি ব্যবহার করে বেসিক লেভেলে পৌঁছান। বেসিক লেভেল থেকে আরো গভীরে চলে যাবার কৌশল আপনার জানা আছে, ইচ্ছে করলে সেখানেও চলে যেতে পারেন। এবার পর্দায় একটা ব্ল্যাকবোর্ড দেখুন। মনে মনে কল্পনা করুন, আপনার হাতে একটা চক আর একটা ডাস্টার রয়েছে।

এরপর ব্ল্যাক বোর্ডে একটা বড়সড় বৃত্ত আঁকুন। বৃত্তের ভেতর চক দিয়ে তৈরি করুন একটা গুণন বা ক্রস-চিহ্ন। তারপর হাতের ডাস্টার দিয়ে ক্রস-চিহ্নটাকে মুছে ফেলুন–মুছতে শুরু করবেন মাঝখান থেকে, কোনোভাবেই যেন বৃত্তের গায়ে ডাস্টারের ছোঁয়া না লাগে।

বৃত্তের ভেতর ক্রস-চিহ্ন মুছে ফেলার পর, বৃত্তের বাইরে এবং ডান দিকে ইংরেজিতে লিখুন ডীপার বা বাংলায় লিখুন আরো গভীর।

এবার বৃত্তের ভেতর লিখুন ১০০। ডাস্টার দিয়ে সেটা মুছে ফেলুন–মুছতে শুরু করবেন মাঝখান থেকে যাতে বৃত্ত-রেখা এতোটুকুও মুছে না যায়।

বৃত্তের ভেতর ১০০ সংখ্যাটি মুছে ফেলার পর, বৃত্তের বাইরে এবং ডান দিকে লিখে রাখা ‘ডীপার’ বা ‘আরো গভীর’ লেখার ওপর চক বুলান।

এবার বৃত্তের ভেতর লিখুন ৯৯। একই ভাবে সেটা মুছে ফেলুন। তারপর ডীপার বা আরো গভীরের ওপর চক বুলান।

এভাবে ৯৮, ৯৭, ৯৬, ৯৫, ৯৪, ৯৩ নিচের দিকে নামতে থাকুন, যতোক্ষণ না ঘুম আসে।

.

সময় মতো ঘুম ভাঙে না, এটাও অনেকের জন্যে সমস্যা হয়ে দেখা দেয়। যারা এই সমস্যায় ভুগছেন, নিচের এই অনুশীলন চর্চা করতে পারেন, ভাল ফল পাবেন। ঘড়ির অ্যালার্ম বাজবে না, তবু ঠিক যখন চান তখনই ঘুম থেকে জাগতে পারবেন।

ঠিক ঘুমাতে যাবার আগে তিন–এক পদ্ধতির সাহায্যে বেসিক লেভেলে পৌঁছান।

তারপর আরো গভীর লেভেলে পৌঁছে মনের পর্দায় একটা ঘড়ি দেখুন। মনে মনে ঘড়ির কাঁটা ঘুরিয়ে নির্দিষ্ট একটা ঘরে নিয়ে আসুন, ঠিক যে সংখ্যার ঘরে কাঁটা উপস্থিত হলে ঘুম থেকে জগতে চান আপনি। এরপর নিজেকে বলুন, এই সময়ে ঘুম থেকে জাগতে চাই আমি, আর ঠিক এই সময়েই ঘুম থেকে আমি জাগবো। দেখবেন ঠিকই ভাঙছে ঘুম।

অনেক সময় জেগে থাকা জরুরী দরকার হয়ে পড়ে। কাল পরীক্ষা, রাত জেগে পড়া দরকার। কিংবা সময় ধরে রোগীকে ওষুধ খাওয়াতে হবে, কোনোমতেই ঘুমিয়ে পড়া চলবে না। অথবা কোথাও সময় মতো পৌঁছুতে হলে অনেক রাত পর্যন্ত গাড়ি চালাতে হবে, ঘুমিয়ে পড়লে সর্বনাশ। এই ধরনের অনেক কারণেই অনেক সময় জেগে থাকা। দরকার হয়।

সাধারণ একটা ধারণা হলো, রাত জাগলে শরীরের ক্ষতি হয়। ক্ষতি যে হয়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু ক্ষতিটা হয় ব্রেনের অনুমতি না দিয়ে রাত জাগা হলে। আমরা জানি, ব্রেনই আমাদের শরীরকে এনার্জি বা শক্তি বরাদ্দ করে। জেগে থাকার জন্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ এনার্জি বরাদ্দ করা হয়, এই বরাদ্দ বাড়াতে হলে ব্রেনকে অনুরোধ করতে হবে। এই অনুরোধ জানাবার আনুষ্ঠানিক নিয়ম আছে, সেটা পালন করলে রাত জাগার জন্যে অতিরিক্ত যে এনার্জিটুকু আমাদের দরকার তা পাওয়া যাবে। তাহলেই রাত জাগলে বা বেশিক্ষণ জেগে থাকলে শরীরের ক্ষতি হবে না। এবার অনুশীলন।

যখনই তন্দ্রার ভাব বা ঘুম আসতে চাইবে, বিশেষ করে আপনি যখন গাড়ি চালাচ্ছেন, রাস্তার একধারে গাড়ি থামিয়ে স্টার্ট বন্ধ করুন, তিন–এক পদ্ধতির সাহায্যে। বেসিক বা আরো গভীর লেভেলে চলে যান।

নিজের লেভেলে পৌঁছে মনে মনে নিজেকে বলুন, ‘আমার ঘুম পাচ্ছে কিন্তু আমি ঘুমাতে চাই না; আমি সম্পূর্ণ সজাগভাবে জেগে থাকতে চাই, জেগে থাকা অবস্থায় পুরোপুরি সুস্থ এবং ঝরঝরে তাজা থাকতে চাই।’

তারপর নিজেকে মনে মনে বলুন, ‘এক থেকে পাঁচ পর্যন্ত গুণতে যাচ্ছি আমি। পাঁচ পর্যন্ত গুণে চোখ খুলবো, সম্পূর্ণ সজাগ অবস্থায় জেগে থাকবো, পুরোপুরি সুস্থ এবং ঝরঝরে তাজা থাকবো। ঘুমঘুম ভাব থাকবে না। সম্পূর্ণ সচেতনভাবে টনটনে জ্ঞান নিয়ে জেগে থাকতে পারবো আমি।

মনে মনে গুণতে শুরু করুন, ধীরে ধীরে–১, ২, ৩। তিন পর্যন্ত গুণে নিজেকে আবার স্মরণ করিয়ে দিন, ‘পাঁচ পর্যন্ত গুণে চোখ খুলবো, সম্পূর্ণ সজাগ অবস্থায় জেগে থাকবো, ঝরঝরে আর তাজা থাকবো। ঘুম ঘুম ভাব একটুও থাকবে না, সম্পূর্ণ সচেতনভাবে, টনটনে জ্ঞান নিয়ে জেগে থাকতে পারবো আমি।

এরপর মনে মনে গুণুন, ৪, ৫। পাঁচ পর্যন্ত গুণে, চোখ খুলুন। নিজেকে মনে মনে বলুন, ‘আমি সম্পূর্ণ সজাগ অবস্থায় জেগে আছি, শরীরটা আগের চেয়ে ভালো, তাজা আর ঝরঝরে লাগছে।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *