৪.৮ নিভে আসা আলোর দীপ্তি

২৭. নিভে আসা আলোর দীপ্তি

 বাবরের মাথার ভেতর কেউ যেনো অবিরাম হাতুড়ি পিটিয়ে চলেছে যা বর্ষাকালের শুরু থেকেই তাকে বিব্রত করছে। আজ নিয়ে তিনদিন মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। কিন্তু এখনও ভারী বাতাসে স্বস্তির কোনো খোঁজ নেই। কয়েকদিন এমনকি মাসব্যাপী নাগাড়ে বৃষ্টি পড়তে পারে। আগ্রা দূর্গে তার শয়নকক্ষে রেশমী তাকিয়ায় হেলান দিয়ে সে ফারগানার বেশতর পর্বতের রুক্ষ্ম চূড়ার উপর দিয়ে বয়ে আসা মিহি শীতল বৃষ্টির কথা ভাবতে চেষ্টা করে এবং ব্যর্থ হয়। তার মাথার উপরের পাঙ্খা দ্বারা সামান্যই বাতাস আলোড়িত হয়। গরম অনুভব না করার অনুভূতি কেমন সেটাই আজকাল কল্পনা করাটা কঠিন। তার নিজের হাতে তৈরি করা উদ্যানেও এখন আর বেড়াতে ভালো লাগে না। কাদায় প্যাঁচপেচে মাটি, পানিতে ভিজে ভারী হওয়া ফুল এবং নহর দিয়ে উপচে বইতে থাকা পানির স্রোত তাকে আরও বিষণ্ণ করে তোলে।

বাবর বিছানায় উঠে বসে এবং রোজনামচার পাতায় কিছু একটা লিখতে চেষ্টা করে। কিন্তু শব্দ খুঁজে না পেয়ে সে তার রত্নখচিত দোয়াতদানী অস্থির ভঙ্গিতে ঠেলে সরিয়ে দেয়। জেনানামহলে গেলে সে হয়তো একটু স্বস্তি পেতে পারে। সে মাহামকে গান গাইতে বলতে পারে। সে মাঝে মাঝে এসান দৌলতের বৃত্তাকার পেট আর মিহি গলা বিশিষ্ট বীণা বাজায়। মাহাম তার নানীজানের মতো দক্ষ না, কিন্তু তারপরেও তার হাতে বীণাটা থেকে মিষ্টি আওয়াজ ঠিকই বেরিয়ে আসে। আবার হুমায়ুনের সাথে এক হাত দাবাও খেলা যায়। তার এই ছেলেটা বিচক্ষণ আর তীক্ষ্ণধী- কিন্তু হলেও, সে গর্বিত বোধ করে, সেই বা কম কিসে এমন একটা ভাব তার ভিতরে কাজ করে এবং সে এখনও তাকে হারাতে সক্ষম। প্রথাগত ভঙ্গিতে শাহ মাত বলে সে যখন বিজয়ের ঘোষণা দেয়, তখন হুমায়ুনের চোখের বিভ্রান্ত দৃষ্টি দেখতে তার ভালোই লাগে। তারা খেলা শেষে বাংলার শাসকদের বিরুদ্ধে বৃষ্টি থামার পরে যুদ্ধ যাত্রার বিষয়ে আলোচনা করে। গাঙ্গেয় অববাহিকায় তাদের নদীবেষ্টিত ভূখণ্ডে থেকে তারা মনে করেছে যে মোঘল আধিপত্য তারা অস্বীকার করতে পারবে এবং বাবরের সর্বময় কর্তৃত্ব নাকচ করবে।

 “আমার বেটা হুমায়ুনকে ডেকে পাঠাও, আর দাবার ছক নিয়ে আসতে বলো।” বাবর এক পরিচারককে ডেকে বলে। আলস্য দূর করার অভিপ্রায়ে সে উঠে দাঁড়ায় এবং নদী দেখা যায় এমন একটা গবাক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে প্রমত্তা যমুনার বুকে উপচে পড়া পলিমাটি মিশ্রিত পানি বয়ে যেতে দেখে। প্রায় উপচে পড়া নদীর পাড় দিয়ে এক কৃষক তার হাডিডসার গরুর পাল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

পায়ের শব্দ শুনতে পেয়ে বাবর ঘুরে দাঁড়ায়, নিজের ছেলেকে দেখবে বলে আশা করে, কিন্তু সাদা জোব্বা পরিহিত পরিচারককে দেখতে পায়।

“সুলতান, আপনার ছেলে আপনার মার্জনা প্রার্থনা করে বলেছেন যে, তার শরীরটা খারাপ এবং তিনি নিজের কক্ষ ত্যাগ করতে অপারগ।”

 “তার আবার কি হলো?”

 “সুলতান আমি সঠিক জানি না।”

 হুমায়ুন কখনও অসুস্থ হয় না। সেও সম্ভবত বৃষ্টির সাথে আগত অসাড়তা থেকে কষ্ট পাচ্ছে, যা প্রাণশক্তি শুষে নেয় এবং প্রচণ্ড প্রাণবন্ত লোককেও ক্লান্ত করে তোলে।

 “আমি তাকে দেখতে যাবো,” বাবর গায়ে একটা হলুদ আলখাল্লা জড়িয়ে নিয়ে ছাগলের চামড়ার তৈরি একটা নাগরা পায়ে গলিয়ে নেয়। তারপরে সে নিজের কক্ষ থেকে স্তম্ভযুক্ত আঙ্গিনার উল্টোদিকে অবস্থিত হুমায়ুনের কামরার দিকে এস্ত পায়ে এগিয়ে যায়। আঙ্গিনায় পদ্মফুলের মতো আকৃতির মার্বেলের ভোলা বেসিনে স্থাপিত ঝর্ণা থেকে পানির ধারা চকচকে বৃত্তচাপ তৈরি করে নির্গত হচ্ছে না, যেমনটা হবার কথা বরং এখন বৃষ্টির তোড়ে কানা উপচে গড়িয়ে পড়ছে।

 হুমায়ুন নিজের বিছানায় শুয়ে আছে। হাতটা মাথার উপরে দেয়া, চোখ বন্ধ, কপালে দানা দানা ঘাম জমে রয়েছে, ঠকঠক করে কাঁপছে। সে তার আব্বাজানের পায়ের শব্দে চোখ খুলে তাকায়। কিন্তু চোখ জবাফুলের মতো লাল হয়ে আছে। চোখের মণি জ্বরের ঘোরে ছলছল করছে। বাবর দূর থেকেই তার ভারী শ্বাসপ্রশ্বাসের আওয়াজ পায়। প্রতিবার নিঃশ্বাস নেবার সময় তাকে রীতিমত প্রাণান্তকর পরিশ্রম করতে হয়, যা তাকে প্রায় কুঁকড়ে ফেলে।

“কখন থেকে তোমার এই অবস্থা?”

 “আব্বাজান, আজ সকাল থেকে।”

“আমাকে কেন জানানো হয়নি?” বাবর তার ছেলের পরিচারকের দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জানতে চায়। “এখুনি আমার হেকিমকে ডেকে আনতে লোক পাঠাও!” তারপরে সে তার নিজের রেশমের রুমাল পানিতে ভিজিয়ে নিয়ে হুমায়ুনের কপাল মুছে দেয়। কপাল সাথে সাথে ঘেমে উঠে- বস্তুতপক্ষে, ঘামে তার সারা মুখ ভিজে রয়েছে এবং এখন যেনো তার কাঁপুনি আগের চেয়ে আরও বেড়ে গিয়েছে এবং দাঁতে দাঁতে ঠকঠক করে বাড়ি খায়।

 “সুলতান, হেকিম এসেছেন।”

 আব্দুল-মালিক কোনো কথা না বলে সাথে সাথে হুমায়ুনের শয্যার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। কপালে হাত রাখে, চোখের পাতা টেনে দেখে এবং নাড়ী পরীক্ষা করে। তারপরে তার ভ্রু কুঁচকে উঠে, সে হুমায়ুনের আলখাল্লার সামনের অংশটা খুলে, এবং ঝুঁকে নিজের নিখুঁতভাবে পাগড়ি বাঁধা মাথাটা তার বুকের উপরে রেখে হৃৎস্পন্দন মনোযোগ দিয়ে শোনে।

“তার কি হয়েছে?”

আব্দুল-মালিক চুপ করে থাকে। “সুলতান, এই মুহূর্তে বলা দুষ্কর। আমাকে আরো ভালো করে পরীক্ষা করতে হবে।”

“তোমাকে কেবল তোমার ঐ অলক্ষুণে মুখটা ফাঁক করে কথা বলতে হবে…”

“আমি আমার সহকারীকে ডেকে পাঠিয়েছি। সুলতান, অভয় দিলে বলি আপনি বরং এখান থেকে এখন যান। আমি শাহজাদাকে ভালোমতো পরীক্ষা করে আপনাকে গিয়ে জানাবো- কিন্তু ব্যাপারটা গুরুতর সম্ভবত প্রাণঘাতী। তার নাড়ী আর হৃৎস্পন্দন দুর্বল আর দ্রুত।” বাবরের সাথে আর কোনো কথা না বলে সে তার রোগীর দিকে ফিরে দাঁড়ায়। বাবর ইতস্তত করে এবং ছেলের ঘামে ভেজা কাঁপতে থাকা মুখের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে কামরা থেকে বেরিয়ে যায়। পরিচারক তার পেছনে দরজা টেনে বন্ধ করে দিলে সে বুঝতে পারে সে নিজেও কাঁপছে।

একটা হিমশীতল অনুভূতি তার হৃৎপিণ্ডকে জড়িয়ে ধরেছে। হুমায়ুনের জন্য সে কতবার শঙ্কিত হয়েছে। পানিপথে ইবরাহিম লোদীর একটা হাতির পায়ের নীচে সে চাপা পড়তে পড়তে বেঁচে গিয়েছিলো। খানুয়াতে সেই রাজপুত যোদ্ধার তরবারির কোপে তার প্রাণ সংহার হতে পারতো। কিন্তু সে কখনও ভাবেনি যে হুমায়ুন- এতো স্বাস্থ্যবান আর শক্তিশালী- অসুস্থতার কাছে পরাভব মানবে। তার প্রিয় ছেলে ছাড়া সে কিভাবে বেঁচে থাকবে? হুমায়ুন মারা গেলে হিন্দুস্তানের এই বিপুল বৈভব মূল্যহীন হয়ে যাবে। এই হাঁসফাঁস করা গরম আর বিষবৎ দেশে যেখানে কেবল বৃষ্টি আর বৃষ্টি এবং রক্তখেকো মশার ভনভনানি ছাড়া আর কিছু নেই। সে কখনও আসতো না, যদি একবার জানতে পারতো তাকে এভাবে এর মূল্যশোধ করতে হতে পারে।

পরবর্তী আধঘণ্টা বাবর ঝিরঝির বৃষ্টি পড়তে থাকা আঙ্গিনায় অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করে কাটায় এবং হেকিম হারামজাদার ঘাড় ধরে হিড়হিড় করে টেনে এনে তার মুখ থেকে কি হয়েছে শোনার আকাঙ্ক্ষা বহু কষ্টে দমন করে। কিন্তু আব্দুল-মালিকই শেষ পর্যন্ত এসে উপস্থিত হয়। বাবর বৃথাই তার মুখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করে।

 “শাহজাদার প্রচণ্ড জ্বর আর তিনি প্রলাপ বকছেন…”

“কি হয়েছে? কেউ বিষ দেয়নি নিশ্চয়ই?”

 “না, সুলতান, বমি হচ্ছে না। আমি অবশ্য কারণও বলতে পারবো না। আমরা কেবল ঘামের সাথে সংক্রমণটা বের করে দেবার চেষ্টা করতে পারি। আমি তার ঘরে আগুন জ্বালাবার আদেশ দিয়ে এসেছি এবং তার রক্তকে আরও উত্তপ্ত করে তোলার জন্য আমি বিভিন্ন মশলা দিয়ে একটা আরক তৈরি করবো…”

“আর কিছু করার নেই? আমি কি কাউকে ডেকে পাঠাবো?”

 “না, সুলতান। আমাদের ধৈর্যধারণ করতে হবে। আল্লাহতালা যেমন আমাদের সবার ভাগ্য নির্ধারণ করেন, তেমনি কেবল তিনিই তার ভাগ্যের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।”

 সারারাত ধরে, আব্দুল-মালিক আর তার সহকারীরা হুমায়ুনের শুশ্রূষা করে। কামরার ভেতরের প্রায় শ্বাসরোধকারী গরমের ভিতরে, বাবর বিছানার কাছে বসে দেখে তার জোয়ান মর্দ ছেলে এপাশ ওপাশ করছে, ছটফট করছে। হেকিমের নির্দেশে তার গায়ে সে ভারী কম্বল চাপানো হয়েছে সেটা ফেলে দিতে চেষ্টা করছে। হুমায়ুন থেকে থেকেই বিড়বিড় করে মাঝে মাঝে সেটা চিৎকারে পরিণত হয়। বাবর অবশ্য শব্দগুলো কিছুই বুঝতে পারে না।

ভোর হবার ঠিক আগে, পূর্বাকাশে হলুদাভ রূপালী আলোর আভা ফুটে উঠতে হুমায়ুনের চিত্তবৈকল্য আরো বৃদ্ধি পায়। তার খিচুনি শুরু হয়। যেনো প্রচণ্ড যন্ত্রণা পাচ্ছে এবং এতো জোরে কাঁপতে থাকে যে, আব্দুল-মালিকের সহকারী তাকে জোর করে চেপে ধরে না থাকলে, সে হয়তো বিছানা থেকে নীচে পড়ে যেতো। তার চোখ কোটর থেকে বের হয়ে এসেছে এবং তার জিহ্বা- হলুদ আর ফোলা ফোলা- শুকনো ঠোঁটের মাঝে বেরিয়ে রয়েছে।

আচমকা ছেলের কষ্টের এই দৃশ্য আর আর্তনাদ বাবরের সহ্যের সীমা অতিক্রম করে যায়। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে কামরা থেকে বেরিয়ে আসে। বাইরের আঙ্গিনায় সে ঝর্ণার এটা পদ্মফুলের বেসিনের উপরে ঝুঁকে এবং পানির নীচে মাথা ডুবিয়ে দেয়। শীতল পানি তার নাক আর কানে প্রবেশ করতে, মনে হয় যেনো- অন্তত এক মুহূর্তের জন্য হলেও-সে পৃথিবীর যাবতীয় উৎকণ্ঠা আর যন্ত্রণা থেকে নিজেকে আড়াল করতে পেরেছে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও সে পানির ভেতর থেকে মাথা তুলে এবং চোখ থেকে পানি মোছে।

 “সুলতান, মার্জনা করবেন…”।

বাবর ঘুরে তাকায়। হুমায়ুনের জ্যোতিষীর ছোটখাট অবয়ব পরণে মরিচা রঙের আলখাল্লা, যা তার আকৃতির তুলনায় বড় দেখায় তার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাবর মুখের উপর থেকে ভেজা চুল সরিয়ে দেয়। “কি বলতে চাও?”

“সুলতান, আমি গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান পর্যালোচনা করছিলাম, আমার প্রভুর ভাগ্যে বিধাতা কি লিখেছেন বোঝার জন্য। আমি আপনাকে একটা কথা বলতে চাই। আপনার ছেলের জীবন এখন আপনার হাতে। আপনি যদি তাকে জীবিত দেখতে চান আপনাকে অবশ্যই মহান আত্মত্যাগ করতে হবে…”

 “তাকে বাঁচাবার জন্য আমি সব করতে রাজি আছি।” বাবর জ্যোতিষীর কথা ভালোভাবে না বুঝেই তার কব্জি চেপে ধরে।

 “আপনার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ আপনাকে উৎসর্গ করতে হবে…”

 “সেটা কি, কি সেটা?”

 “সুলতান, সেটা কেবল আপনিই জানেন।”

 বাবর ঘুরে দাঁড়ায় এবং মাতালের মতো টলতে টলতে দূর্গের মসজিদের দিকে এগিয়ে যায়। মিহরাবের খোদাই করে কারুকাজ করা কুলঙ্গির সামনের পাথরের মেঝেতে সে নামাজ পড়তে শুরু করে। চোখ বন্ধ নিজের সমস্ত একাগ্রতা একত্রিত করে সে। আল্লাহতা’লাকে প্রতিশ্রুতি দেয়: “আমার আত্মত্যাগ স্বীকার করো। আমার সন্তানের কষ্টের বোঝা আমাকে বহন করতে দাও। সে না, আমি, আমাকে মৃত্যুবরণ করতে দাও…আমার জীবন কবুল করো…”

*

তিন তিনটা দীর্ঘ দিন আর রাত, বাবর নিজের কামরা নিজেকে বন্দি করে রাখে। সব রাষ্ট্রীয় কাজ বাতিল করে জলপানি স্পর্শ না করে বসে থাকে সে জানে তার মাহামের কাছে যাওয়া উচিত। কিন্তু ছেলের জন্য তার দুশ্চিন্তার কথা ভেবে- বেচারীর একমাত্র ছেলে- নিজের উদ্বেগের উপরে সেটার কথা ভেবে সে বিহ্বল হয়ে পড়ে। কামরান আর আসকারীকে তাদের দূরতম প্রদেশেও সে খবর পাঠায় না। সে তাদের কি বলবে? হুমায়ুনের অসুস্থতার কথা, নাকি বলবে যে হেকিম সামান্যই আশা দিয়েছেন? সে যদি চিঠি পাঠায়ও তারা সময়মতো আগ্রায় উপস্থিত হতে পারবে না। আর তাছাড়া বাবরের কেন জানি একটা সন্দেহ হয়, যার কারণ সে বলতে পারবে না, যে কামরান আর আসকারী তাদের সৎ-ভাইয়ের অসুস্থতার খবর পেলে মোটেই ব্যাথিত হবে না।

আল্লাহতা’লা তার উৎসর্গ কেন গ্রহণ করছেন না? সে কেন এখনও শ্বাসপ্রশ্বাস নিচ্ছে, যখন হুমায়ুনের জীবন প্রদীপ নিভে আসছে…? সময় গড়িয়ে যেতে বাবর হতাশ হয়ে পড়ে। যে ধরণের হতাশার সাথে তার পরিচয় ছিলো না। সে মনে মনে যাই ভাবতে চেষ্টা করুক, সময় গড়িয়ে যাবার সাথে সাথে, তার জীবন প্রদীপ নিভুনিভু হবার কারণে তার মন ঘুরপাক খেয়ে। যদিও বাবুরীর মৃত্যুর পরে তার দেহের একটা অংশ মরে গিয়েছে বলে মনে হয়েছিলো, যেটা ছিলো ব্যক্তিগত শোক প্রস্তাব। হুমায়ুন যদি এখানে মারা যায়, তবে সেটা হবে একটা ব্যক্তিগত ক্ষতি- নিজের অন্য ছেলেদের চেয়ে হুমায়ুন তার সাথে অনেক ঘনিষ্ঠ- কিন্তু একই সাথে আরো বেশি কিছু। আল্লাহতালার এটার কুদরত এই যে লাঠির মাথাটা আজই বানিয়েছি, হুমায়ুন যদি মারা যায় সেটা হবে ব্যাক্তিগত অপূরণীয় ক্ষতি। আল্লাহতালার বলবার রীতিকে সবকিছু বলে, বাবর কায়মনোবাক্যে যা প্রার্থনা করছে, যা কিছু অর্জন করেছে সেসবের কোনই মূল্য নেই…সে জীবনেও হিন্দুস্তানে কোনো সাম্রাজ্য বা নিয়তি কোনোটার উপরেই ভরসা রাখতে পারবে না… তার এখানে আসাটাই ভুল হয়েছে…বা নিদেনপক্ষে তৈমূরকে পেছনে ফেলার অভিপ্রায়ে এখানে থেকে গিয়ে ভুল করেছে। তার উচিত ছিলো অহঙ্কার না করে, নিজের দম্ভ প্রশমিত করে খাইবার গিরিপথের ওপারে নিজের ধূধূ করতে থাকা তেপান্তর নিয়ে সন্তুষ্ট থাকাটা উচিত ছিলো।

 বাবর তার রোজনামচার পাতার দিকে তাকায়, নীচু টেবিলের উপরে খোলা পড়ে রয়েছে। কি আহাম্মকি না সে করেছিলো হুমায়ুনকে এটার প্রতিলিপি দেয়াটা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে, যে একদিন এটা তাকে শাসনকার্যে সহায়তা করবে। তার মনেই হয়নি যে, সে শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করার মতো দীর্ঘ দিন জীবিতই থাকবে না। তার ইচ্ছা করে হুমায়ূনের কামরায় জ্বলতে থাকা গনগনে আগুনে রোজনামচাটা নিয়ে গিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেয়…কিন্তু হুমায়ুনের কামরায় যাবার মতো সাহস তার ভিতরে আর অবশিষ্ট নেই যে, সেখানে গিয়ে চিত্তবৈকল্যের যন্ত্রণায় কাঁপতে দেখে।

“সুলতান…”

বাবর ঘুরে দাঁড়ায়। হেকিমের এক সহকারী তার সাথে দেখা করতে এসেছে। লোকটাকে ক্লান্ত দেখায়, তার চোখের নীচের ত্বক এতোটাই কালো যেনো কালশিটে পড়েছে। “আমার প্রভু বলে পাঠিয়েছেন যে আপনার একবার যাওয়া উচিত…”

 বাবর দৌড়ে হুমায়ুনের কামরায় যায়।

আব্দুল-মালিক কক্ষের দরজায় তার জন্য অপেক্ষা করছে। হাত পেটের উপর আড়াআড়ি করে রাখা। “সুলতান…আপনার ছেলে বিকট চিৎকার করেছিলো…এবং আমি ভেবেছিলাম- আমি সত্যিই ভেবেছিলাম-তার অন্তিম সময় ঘনিয়ে এসেছে…তারপরে সে চোখ খুলে তাকায় এবং আমাকে চিনতে পারে…এবং যেমন আকস্মিকভাবে জ্বর এসেছিলো, ঠিক তেমনি আকষ্মিকভাবে সেটা ছেড়ে গিয়েছে…” হেকিম তার মাথা নাড়ে, তাকে একাধারে বিস্মিত আর উফুল্ল দেখায়। “আমি আমার জীবনে এমন কিছু দেখিনি, সুলতান…এটা একটা অলৌকিক ঘটনা।”

*

আগ্রা দূর্গের পাদদেশে সূর্যালোকিত নদীর তীরে ঘোড়া ছোটায় হুমায়ুন। তার দাস্তানা পরিহিত হাতে লাল চামড়ার ঘোমটা মাথায় দিয়ে চুপ করে কালো বাজপাখিটা বসে রয়েছে। বাবর ভাবে পরে সে তার সাথে যোগ দেবে। বহুদিন হয় সে বাজপাখি উড়ায়নি। কিন্তু তার আগে সে যমুনার তীরে তার উদ্যান পরিদর্শনে যাবে। সেখানে সে মালিদের সাথে আখরোটের গাছ লাগাবার বিষয়ে শলাপরামর্শ করবে। সে ধীরে ধীরে হুমায়ুনের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। অসুস্থতা থেকে অলৌকিকভাবে সেরে ওঠার মাত্র চারমাস পরে তাকে আবার আগের মতো প্রাণবন্ত আর শক্তিশালী দেখাচ্ছে।

বাবর দূর্গের দেয়ালের পাদদেশে নেমে যাওয়া বেলে পাথরের বাঁকানো সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায়। সিঁড়ির কয়েক ফিট দূরে, আরো কয়েকটা ছত্রাকে ছাওয়া এবং সংকীর্ণ ধাপের পরে সেটা নদীর ঘাটে গিয়ে মিশেছে। যেখানে তার সোনার পানি দিয়ে নকশা। করা বজরা অপেক্ষা করছে নদীর ওপারে তাকে পৌঁছে দেবার জন্য। হঠাৎ তার পেটে প্রচণ্ড একটা যন্ত্রণা হতে সে কুঁকড়ে যায় এবং হাত বাড়িয়ে পাথরের রেলিয়ের পরিক্ষেপ আঁকড়ে ধরে। ব্যাথা কমতে শুরু করলে, সে গভীরভাবে দম নিতে থাকলে ব্যাথাটা আবার ফিরে আসা ঢেউয়ের মতো তার পুরো শরীরকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। সে মাতালের মতো টলতে থাকে…”আমাকে ধরো…’

 শক্ত হাত তার বাহুর নীচে তাকে জড়িয়ে ধরে, টেনে তোলে। কে এটা? সে কৃতজ্ঞ চিত্তে মুখ তুলে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পায় না, কেবল চরাচরগ্রাসী একটা অন্ধকার।

*

“তার পেটে বায়ু চলাচল করছে না…তিনি প্রশ্রাবও করেননি…তিনি কিছু খাচ্ছেনও না। ছত্রিশ ঘণ্টা কেবল সামান্য পানি ছাড়া আর কিছুই তিনি মুখে দেননি…বুয়ার সেই বিষের ফলে এটা হচ্ছে কিনা আমি বলতে পারবো না…”।

বাবর তার চারপাশে উদ্বিগ্ন, চাপা কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। এরা কাকে নিয়ে কথা বলছে? তার মুখ আর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে…তার শুকনো ঠোঁটের মাঝে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে যায়। সে ঢোক গিলতে চেষ্টা করে, কিন্তু সেটা কষ্টকর বলে প্রতিপন্ন। হয়…সামান্য সময়ের জন্য তার চোখের পাতা মিটমিট করে। তার মুখের উপরে ঝুঁকে থাকা অবয়বগুলো ধোঁয়াটে আর অস্পষ্ট। সে আরও পানির স্বাদ অনুভব করে- কেউ একজন আলতো করে তার মুখে একটা চামচ প্রবেশ করায়…সে এবার বুঝতে পারে লোকটা কে, আর সে কোথায় আছে…সে একটা গুহার ভিতরে লুকিয়ে রয়েছে যেখানে শত্রুরা তাকে খুঁজে পাবে না। ওয়াজির খান হাঁটু মুড়ে তার পাশে বসে রয়েছে, ফোঁটা ফোঁটা পানি তার ঠোঁটে দিচ্ছে। সে সুস্থ হয়ে উঠলে তারা একসাথে ফারগানায় ফিরে যাবে…

“ওয়াজির খান…? সে কোনোমতে গুঙিয়ে উঠে। “ওয়াজির খান…” সে আবার চেষ্টা করে। এবার আগের চেয়ে স্পষ্ট বোঝা যায় তার কণ্ঠস্বর।

 “না, আব্বাজান আমি হুমায়ুন।”

হুমায়ুন আবার কোথা থেকে এর ভেতর এলো, বাবর ঠিক বুঝতে পারে না।

“আপনার বেটা।”

এইবার সে বুঝতে পারে। অনেক কষ্টে বাবর নিজেকে বর্তমানে ফিরিয়ে আনে। সবুজ চোখ খুলে এবং আতঙ্কিত ছেলেকে পাশে বসে থাকতে দেখে। “কি…আমার কি হয়েছে…?”

 “আব্বাজান, আপনি অসুস্থ। আপনি চেতন অচেতনের মাঝে ঘোরাফেরা করছেন…অসুস্থ হবার পরে আপনার চারবার আক্রমণ হয়েছে। প্রতিটা আগেরটার চেয়ে ভয়ঙ্কর। আমি প্রচণ্ড ভয় পেয়েছি…কিন্তু দুশ্চিন্তা করবেন না…আব্দুল-মালিক এখনও আশাবাদী। তিনি তার সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন।”

 কয়েক ঢোক পানি পান করে- সে এটাই কোনোমতে গিলতে পারছে- বাবর আবার বিছানায় এলিয়ে পড়ে, সে টের পায় অসম্ভব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু তার ইন্দ্রিয়ের সাড়া আবার ফিরে আসছে। সে নিশ্চয়ই মারাত্মক অসুস্থ… সম্ভবত এতোটাই যে, তার। মৃত্যুও হতে পারে… সম্ভাবনাটা তার মাঝে অনিচ্ছাসত্ত্বেও একটা কাঁপুনির জন্ম দেয়। আসলেই কি অবস্থা এতোটাই খারাপ? তার বিকাশমান সাম্রাজ্যে যখন অনেক কাজ বাকি তখনই তাকে চলে যেতে হবে…জীবনটা উপভোগই করা হলো না। সে তার ছেলেদের পরিণত অবস্থায় দেখতে চায়। আল্লাহতা’লা নিশ্চয়ই তাকে সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত করবেন না…

তারপরে আরেকটা ভাবনা তার মনকে আপুত করে। আল্লাহতালা সম্ভবত হুমায়ুনের প্রাণের বিনিময়ে তার নিজের জীবন উৎসর্গের প্রতিশ্রুতির কথা তাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন। সম্ভবত তার ধারণাই ঠিক, হুমায়ুনের অলৌকিক আরোগ্য লাভে স্বস্তি আর উল্লাসে ৰিক্ত হয়ে সে ভেবেছিলো আল্লাহ বোধহয় তার আকুল প্রার্থনা শুনেছেন…যদি তাই হয়ে থাকে তবে তার জীবনের সেরা কীর্তি বলে এটা বিবেচিত হবার যোগ্যতা রাখে। কারণ আল্লাহতালা হুমায়ুনের ভিতরেই সাম্রাজ্যের ভবিষ্যত নিরাপদ বলে। বিবেচনা করেছেন। সম্ভবত এটা স্রষ্টার লীলাখেলার একটা মহিমা। অবশেষে তার জীবন একটা পরিণতি লাভ করলো। ভাবনাটা তাকে আবেগপ্রবণ করে তোলে। বাবর শুয়ে থাকে। অবজ্ঞা আজ্ঞায় রূপান্তরিত হতে থাকে, তার ক্লান্ত মনে একটা বিজয়ের অনুভূতিও মাঝে মাঝে উঁকি দেয়। সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপনের পরে তার মৃত্যুতে এখন আর কিছু আটকে থাকবে না।

তারপরে তার মনকে একটা নতুন ভাবনার দ্যোতনা সহসা আরো পরম মাত্রায় অসাড় করে ফেলে। ভাগ্যের লিখন বা প্রতিজ্ঞার পালন যেভাবেই তার মৃত্যু হোক, হুমায়ুনের অবস্থান তাকে সুরক্ষিত করে যেতে হবে। নতুবা মোঘল সাম্রাজ্য কুড়িতেই বিনষ্ট হবে। ঠিক তৈমূরের সাম্রাজ্যের মতো নিজের সন্তান আর অনুগত শাসকদের বিদ্রোহের ফলে। হুমায়ুনকে তার একমাত্র উত্তরাধিকারী ঘোষণা করতে হবে…তার সেনাপতি আর অমাত্যদের হুমায়ুনের প্রতি আনুগত্য নিশ্চিত করতে হবে…যতোটুকু সময় তার হাতে আছে এর ভেতরেই তাকে সম্ভব সব পরামর্শ দিয়ে যেতে হবে…।

 বাবর আবার ঘামতে শুরু করে। তার নাড়ীর বেগ বাড়তে থাকে এবং ব্যাথার প্রকোপ পাল্লা দিয়ে বাড়তে শুরু করে। নিজের পুরোটা মানসিক দৃঢ়তা প্রয়োগ করে…যা কোনো যুদ্ধ জয়ের চেয়ে কম না…নিজের দেহের উপরে মনের আধিপত্য বিস্তার করা কিন্তু সে নিজেকে প্রবোধ দেয় তাকে কেউ কাপুরুষ বলবে না। সে বিছানার উপরে উঠে বসে। “আমার মন্ত্রণাসভা আহ্বান করো। তাদের সাথে আমাকে কথা বলতে হবে… একজন প্রতিলিপিকারীকে উপস্থিত থাকতে হবে। আমার প্রতিটা কথা লিপিবদ্ধ করার জন্য। কিন্তু তার আগে আমাকে খানজাদার সাথে নিভৃতে কথা বলতে হবে…তাকে দ্রুত আমার কাছে নিয়ে এসো।”

 সে অপেক্ষা করার সময়ে কি বলবে মনে মনে গুছিয়ে নিতে চেষ্টা করে। কিন্তু তার মন বারবার বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠে।

“বাবর…” খানজাদার কণ্ঠস্বরে তার ঘোর কাটে।

“বোন, বহুবছর আগে তুমিই প্রথম আমার দোলনায় আমাকে সবার আগে আমাকে দেখেছিলে…তারপর থেকে আমরা অনেক কষ্ট সহ্য করেছি, আর অনেক কিছু অর্জনও করেছি। অনেক ভাইয়ের মতোই আমি কখনও তোমাকে বলিনি যে, আমি তোমাকে কতোটা ভালবাসি…পছন্দ করি…আমি এখন সেটা বলছি…এখন যখন আমার মনে হচ্ছে মৃত্যু খুব নিকটে ওঁত পেতে আছে। আমার জন্য দুঃখ কোরো না…মরতে আমি ভয় পাই না, আমি চিন্তিত আমার মৃত্যুর পরে এই সাম্রাজ্যের পরিণতি নিয়ে। আমার ইচ্ছা হুমায়ুন আমার উত্তরসূরী হোক। কিন্তু আমার মনে হয় তার ভাইয়েরা সেটা মেনে নেবে না…তারা তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পারে। আমার সব সন্তানদের কাছে তুমিই তাদের একমাত্র রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়। তারা তোমাকে শ্রদ্ধা করে…পরিবারের জন্য তোমার আত্মত্যাগের কথা বলে তোমাকে ছোট করবো না…আর তাই তারা তোমার কথা শুনবে…আমাকে যেমন একসময়ে দেখে রেখেছিলে, তাদেরও সেভাবে দেখে রেখো…তাদের ঐতিহ্যের কথা সবসময়ে তাদের স্মরণ করিয়ে দেবে। আর তাদের অবশ্যই তাদের কর্তব্যের কথাও…আর তাদের মায়েরা যেনো বিদ্রোহের উসকানি দিতে না পারে…”

বাবর ক্লান্ত হয়ে পড়লে, একটু চুপ করে।

“ছোট ভাইটি আমার আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি।” খানজাদা আলতো করে তার কপালে চুমু খেলে সে আর্দ্রতা টের পায়- খানজাদার অশ্রু- তার গালে স্পর্শ করছে।

 “বোন, আমরা অনেকদূর পথ অতিক্রম করেছি, তাই না?” সে ফিসফিস করে বলে। দীর্ঘ আর কখনও কষ্টদায়ক পথ। কিন্তু সেটাই আমাদের পরিবারকে একটা মহিমান্বিত গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছে…এখন আমার পরিচারকদের বলো আমাকে দরবারের আনুষ্ঠানিক আলখাল্লা পরিয়ে দিতে। আমার হাতে সময় বড় অল্প। আমি তার আগেই আমার অমাত্যদের সাথে কথা বলতে চাই…”।

সোয়া ঘণ্টা পরে, অমাত্যরা যখন দরবারে প্রবেশ করে বাবরকে তার সবুজ আলখাল্লা পরিহিত অবস্থায় সিংহাসনে উপবিষ্ট দেখা যায়, তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে আছে। তারা ভেতরে প্রবেশ করতে বাবর চোখ বন্ধ করে এবং বহু কষ্টে নিজেকে সজাগ রাখে। তাকে পরিষ্কার করে চিন্তা করতে হবে। সে তার চারপাশে একটা গুঞ্জন শুনতে পায়। “আব্বাজান, সবাই এসেছে।”

 চোখ খুলে তাকিয়ে বাবর বুঝতে পারে তার চোখের দৃষ্টি পুরোপুরি পরিষ্কার না…কোনো ব্যাপার না। ব্যাপার হলো তারা তার কথা যেনো পরিষ্কার শুনতে পায়। সে তার হাঁসফাঁস করতে থাকা বুক ভরে শ্বাস নেয় এবং শুরু করে: “আপনারা দেখতেই পাচ্ছেন আমি অসুস্থ…আমার জীবন এখন আল্লাহর হাতে। আমি যদি মারা যাই, তাহলে আমাদের এই এতো পরিশ্রম যেনো উত্তাপ আর ধূলোতে বিলীন না হয়ে যায়…সেটা রক্ষা করার দায়িত্ব আপনাদের উপরে থাকবে। আভ্যন্তরীণ কলহ পাত্তা না দিয়ে এখনকার মতোই সবাই একতাবদ্ধ থাকবে। সেটা অর্জন করতে হলে তোমাদের জানা উচিত কে আমার উত্তরাধিকারী হবে।”

বাবর দম নেবার জন্য একটু চুপ করে। “আমি কিছুদিন যাবৎ হুমায়ুনের সাহস আর তার প্রজ্ঞার জন্য তাকেই আমার উত্তরাধিকারী বলে মনে মনে ভাবছিলাম…কিন্তু নিজে প্রাণশক্তি, কামনা বাসনার কারণে প্রতারিত হয়ে সেটা আমি তোমাদের জানাতে পারিনি। আমি এখন সেটা বলছি। আমি হুমায়ুনকে আমার উত্তরাধিকারী মনোনীত করলাম। তোমাদের সামনে তার নাম সুপারিশ করছি। আমাকে যেমন আনুগত্য আর সাহসিকতার সাথে অনুসরণ করেছো, কথা দাও তাকেও সেভাবে অনুসরণ করবে। তার প্রতি অনুগত থাকার শপথ নাও।”

দরবার এক মুহূর্ত নিশ্চুপ থাকে তারপরে একটা সম্মিলিত কণ্ঠস্বর শোনা যায়: “সম্রাট আমরা আনুগত্যের শপথ নিলাম।”

 “হুমায়ুন আমার হাত থেকে তৈমূরের আংটিটা খুলে নাও। এটা এখন তোমার। গর্বের সাথে এটা পরিধান করবে। আর কখনও নিজের প্রজা আর সাম্রাজ্যের প্রতি দায়িত্বের কথা বিস্মৃত হয়ো না। তোমরা সবাই আমার কথা শুনতে পেয়েছো?”

“হ্যাঁ, সম্রাট।”

 “বেশ, আমাকে এবার হুমায়ুনের সাথে কিছুক্ষণ একলা থাকতে দাও। আমি আমার ছেলের সাথে একটু একা থাকতে চাই…”।

বাবর চোখ বন্ধ করে অপেক্ষা করে। সে গালিচার উপরে দ্রুত পায়ের শব্দ শুনতে পায় এবং তারপরে দরজা বন্ধ হবার শব্দে সবকিছু নিরব হয়ে যায়। তারা কি বিদায় নিয়েছে?”

 “হ্যাঁ, আব্বাজান।”

 “আমার কথা মন দিয়ে শোনো। আমি তোমাকে অন্য বিষয়ে কিছু বলতে চাই। প্রথমে নিজেকে ভালো করে জানতে চেষ্টা করবে এবং কিভাবে কোনো দুর্বলতা থাকলে সেটাকে অতিক্রম করা যায়…কিন্তু তারচেয়ে বড় কথা, যেকোনো মূল্যে সাম্রাজ্যের ঐক্য রক্ষা করবে। আমি বোকা নই, আমি জানি তোমার সৎ-ভাইরা ঈর্ষান্বিত হবে। তাদের প্রাপ্য তাদের দিবে এবং যতোক্ষণ সম্ভব তাদের সহ্য করবে তোমার পক্ষে যতটা সম্ভব। তাদের ভিতরে সমঝোতা তৈরির প্রয়াস নিবে, তাদের বড়ভাইয়ের মতো ভালোবাসবে। মনে রেখো তৈমূর যে আদি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছে, সেখানে শাহজাদাদের প্রাণ পবিত্র বলে গণ্য করা হয়…হুমায়ুন আমাকে কথা দাও…আমার কথা তুমি পালন করতে চেষ্টা করবে।”

বাবরের আবার মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে। সে হুমায়ুনের কোনো কথা শুনতে পায় না। “আমার প্রশ্নের উত্তর দিলে না।”

 “আব্বাজান আপনি শান্ত হোন, আমি আপনাকে কথা দিলাম।”

 বাবরের দেহ তাকিয়ার উপরে নেতিয়ে পড়ে। তার মুখে প্রশান্তির ভাব ফুটে উঠে। কিন্তু তারপরে সে আবার কথা বলতে থাকে। আর একটা বিষয়। আমাকে এখানে হিন্দুস্তানে সমাহিত করবে না। এটা তোমার আর তোমার সন্তানদের মাতৃভূমিতে পরিণত হবে। কিন্তু এটা আমার মাতৃভূমি না। আমার দেহ কাবুলে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে…আমি আমার রোজনামচায় আমার শেষ ইচ্ছার কথা লিখে গিয়েছি…”

হুমায়ুন এবার ফোঁপাতে শুরু করে।

“আমার জন্য দুঃখ কোরো না। তুমি যখন অসুস্থ হয়েছিলে আমি এটাই কামনা করেছিলাম। তোমার জ্যোতিষি আমাকে বলেছিলো কি করতে হবে- আমাকে আমার প্রিয় জিনিসটা উৎসর্গ করতে হবে। আমি তোমার জীবনের বদলে আল্লাহকে আমার জীবন সমর্পণ করেছি এবং এজন্য আমার মনে কোনো দ্বিধা নেই। আল্লাহ করুণাময়। তিনি তার কাছে আমাকে ডেকে নেবার আগে তোমার সাথে নিভৃতে সময় কাটাবার সুযোগ দিয়েছেন…”

হুমায়ুন তার বাবার ক্লান্ত মুখের দিকে তাকায়। সে তাকে কিভাবে বলবে যে জ্যোতিষি এটা বোঝাতে চায়নি। লোকটা পরে তাদের ভিতরের কথোপকথনের কথা হুমায়ুনকে বলেছে। লোকটা তাকে তার সম্পদ, কোহ-ই-নূর দান করার কথা বোঝাতে চেয়েছিলো তার নিজের জীবন উৎসর্গ করতে বলেনি…

কিন্তু তার আব্বাজানের শুকনো ঠোঁটে একটা হাসির রেখা ফুটে উঠে এবং সে আবার কথা বলতে চায়। “দুঃখ কোরো না। এর মানে স্রষ্টা আমার কথা শুনেছেন…আমি কৃতজ্ঞ চিত্তে তার সান্নিধ্যে যাব… আমি এখন জানি আমার শুরু করা কাজ তুমি এগিয়ে নিয়ে যাবে। তারা সবাই, যারা আমার আগে মারা গিয়েছে, বেহেশতে আমার জন্য অপেক্ষা করছে…আমার বাবা-মা, নানীজান, ওয়াজির খান, আমার বন্ধু বাবুরী…এমনকি চোখে মোমবাতির আলোর মতো ম্লান আভা নিয়ে তৈমূরও অপেক্ষা করছে…তার সাথে আমার দেখা হলে তাকে আমাদের অর্জনের কথা। জানাবো…কিভাবে তারই মতো আমরা সিন্ধু অতিক্রম করে বিশাল একটা বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছিলাম…কিভাবে আমরা…”

বাবর অনুভব করে একটা উষ্ণ শান্তি তাকে আবৃত করে নেয়। সে ডুবতে শুরু করে, ভেসে যেতে থাকে, তার চেতনা লুপ্ত হতে শুরু করে। বাবর আর কি বলতে হুমায়ুন সেটা আর কখনও জানতে পারবে না। একটা মৃদু দীর্ঘশ্বাসের মাধ্যমে তার আব্বাজান হইধাম ত্যাগ করে এবং তার মাথাটা সামনে ঝুঁকে আসে।

হুমায়ুন নিজের মাথা নীচু করে দোয়া করতে থাকে: “আমার আব্বাজানকে দ্রুত বেহেশতের প্রশান্তিময় বাগিচায় পৌঁছে দাও। আমাকে তার আরাধ্য কাজ সমাপ্ত করার তৌফিক দান কর, যেনো উপর থেকে আমার দিকে তাকিয়ে তিনি গর্ব অনুভব করেন…আমাকে শক্তি দাও…”

 অবশেষে উঠে দাঁড়িয়ে হুমায়ুন শেষবারের মতো বাবরের দিকে তাকায়। তারপরে চোখ ফিরিয়ে নেয়। তার চোখে আবার অশ্রু টলটল করতে থাকে এবং সে বহু কষ্টে নিজের। কণ্ঠস্বর সংযত রাখে। “আব্দুল-মালিক,” সে ডাকে, “সম্রাট মারা গেছেন…সবাইকে খবর পাঠাও…”

*

দুইদিন পরে, হুমায়ুন কর্পূরে ধোয়া বাবরের মৃতদেহ নরম উলের কাপড়ে মুড়িয়ে রূপার কফিনে নানা সুগন্ধির সাথে ছয়জন সেনাপতি স্থাপন করলে দাঁড়িয়ে দেখে, কফিনটা বারোটা কালো ষাঁড়ে টানা গাড়ির উপরে রাখা। তারপরে ঢোলের মৃদু শব্দের সাথে হিন্দুস্তানের ধূধূ প্রান্তর, সিন্ধু নদ অতিক্রম করে খাইবার গিরিপথের আঁকাবাঁকা পথ অতিক্রম করে উত্তর-পশ্চিমে কাবুলের দিকে শববাহী বহরটা যাত্রা শুরু করে। হুমায়ুন জানে মৃত্যুর পরে তার বাবার নিজের প্রিয় পাহাড়ী এলাকায় ফিরে যাবার ইচ্ছার ভিতরে কোনো বিরোধ নেই।

 বাবরের কথামতো, তার দেহ কাবুলে পৌঁছাবার পরে পাহাড়ের ধারে বাবরের নিজের তৈরি উদ্যানে একটা সাধারণ মার্বেলের ফলকের নীচে তার বন্ধু বাবুরীর পাশে যেনো তাকে সমাহিত করা হয়। সেখানেই তার আম্মিজান আর নানীজানের কবর। বাবরের ইচ্ছা অনুসারে তার কবরের উপরে কোনো বড় সমাধিসৌধ নির্মাণ করা হবে না। আকাশের বিশাল শামিয়ানার নিচে প্রথম মোঘল সম্রাটের সমাধি বাতাস আর বৃষ্টির মাঝে অবারিত থাকবে।

হুমায়ুন আড়চোখে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা কামরান, আসকারী আর হিন্দালের দিকে তাকায়। তাদের বিষণ্ণ মুখ বলে দেয় তারাও তার মতো দুঃখী এবং এখনকার মতো তাদের ভিতরে কোনো বিভেদ নেই। কিন্তু এই একতার স্থায়িত্ব কতোদিন? তারা কি সাম্রাজ্য তাদের ভিতরে ভাগ না করে একা হুমায়ুনকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করে গিয়েছেন বলে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে না। উচ্চাশা অভিযানের আকাক্ষা আর তার ফলে প্রাপ্ত ক্ষমতার মোহ তাকে বহুদিন ধরেই তাড়িত করছে- সেই একই ক্ষুধা তাদের ভিতরেও জাগ্রত হবে। বিশেষ করে কামরানের মাঝে, যে বয়সে প্রায় তারই সমান। কামরানের স্থানে থাকলে কি সেও ক্ষুব্ধ হতো না? কিংবা আসকারী? এমনকি পিচ্চি হিন্দালও শীঘ্রই পৃথিবীকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করবে। সম্রাটের সব সন্তানই চাইবে নিজের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যকে নতুন মহিমায় সিক্ত করতে। বাবরের স্মৃতি আর ভাই ভাইয়ের ভিতরে বিদ্যমান ভ্রাতৃত্ববোধ কতোদিন বজায় থাকবে। তারা হয়তো মাংসের চারপাশে ঘুরঘুর করতে থাকা কুকুরের পালে পরিণত হবে। হুমায়ুন কি করছে বুঝতে পেরে সে সরে আসে। তখনও তার বাকি ভাইয়েরা শববাহী বহরের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। বহরটা একটা বাঁকের কাছে পৌঁছে আগ্রা শহরের ভিতর দিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। পেছনে কেবল একটা কমলা রঙের ধূলোর মেঘ পড়ে থাকে।

“তোমার সৎ-ভাইদের বিরুদ্ধে কোনো ক্ষোভ পোষণ করবে না…তাদের ভালোবাসবে…তাদের ভিতরে সমঝোতা বজায় রাখবে…” হুমায়ুনের মাথার ভেতরে স্নেহপরায়ণ বাবার শেষ আদেশের কথা ঘুরতে থাকে। সে বাবরের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং সেটা সে বজায় রাখবে। সেটা বজায় রাখাটা একটা কঠিন কাজ হবে এবং তাকে সংযমের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে হবে। বাবরের কথাগুলো একভাবে দেখতে গেলে একটা সতর্কবাণী…পুরুষানুক্রমে তৈমূরের বংশধরেরা নিজেদের ভিতরে লড়াই করে শেষ হয়ে গিয়েছে। ভাই ভাইয়ের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে, এবং নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করে তারা দুর্বল হয়ে পড়েছে। উজবেকদের মতো বহিঃশত্রুর সহজ শিকারে তখন তারা পরিণত হয়েছে। নতুন মোঘল সম্রাট হিসাবে সে হিন্দুস্তানে এই রীতির সূচনা করতে দিবে না। এটা তার পবিত্র দায়িত্ব।

হুমায়ুন তার হাতের তৈমূরের ভারী আংটিটা দেখে, একটা অনভ্যস্ত ওজন, যেখানে একটা বাঘের মূর্তি খোদাই করা রয়েছে। অনেক লড়াই, অনেক বিজয়, আংটিটা দেখেছে…তার হাতে আংটিটা আর নতুন কি দেখবে। তার হাতে থাকা অবস্থায় এটা কি বিপর্যয় নাকি গৌরবের অংশীদার হবে। সেটা তার এখনই জানবার প্রয়োজন নেই। কিন্তু যাই ঘটুক সে তার বাবার স্মৃতি বা তার সাম্রাজ্যের জন্য কখনও অসম্মান বয়ে আনবে না। আংটিটা ঠোঁটের কাছে তুলে এনে তাতে আলতো চুমু খেয়ে সে নিরবে একটা প্রতিজ্ঞা করে: “আমি নিজেকে আব্বাজানের যোগ্য উত্তরসূরীতে পরিণত করবো এবং সারা পৃথিবী আমাকে সেজন্য স্মরণ করবে।”

.

ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা

বাবরের জীবন ছিলো যুদ্ধের রক্তে রাঙানো এক মহাকাব্য। তার জীবনে এত যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো যে তিনি স্বয়ং সবকিছু তার স্বরচিত বাবরনামায় লিপিবদ্ধ করতে পারেননি। বাবরনামা ছিলো ইসলামের ইতিহাসের প্রথম আত্মজীবনী। বাবরনামায় তার জীবনের বেশকিছু সময়ের ঘটনার অনুপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। এই সামান্য ত্রুটি বাদ দিলে বাবরের জীবনের সকল প্রধান ঘটনাই বাবরনামায় পাওয়া যায়। যেমন তিনবার সমরকন্দ দখল, উজবেকদের সাথে বাবরের সংঘাত, উত্তর-পশ্চিম ভারতে হিন্দু আধিপত্য খর্ব করে মোঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা। সবকিছুই বাবরনামা আর অন্যান্য ঐতিহাসিক উৎস থেকে জানা যায়। আমি এই সব উল্লেখযোগ্য ঘটনা, তাদের ঐতিহাসিক পর্যায়ক্রম, বিচার বিশ্লেষণ, সংযোজন, পরিমার্জন করে এই গ্রন্থে বর্ণনা করেছি।

বাবরের নানী ছিলেন- এসান দৌলত, যার উপদেশ বাবর তরুণ বয়সে মেনে চলতো। বাবরের আম্মিজান- খুতলাঘ নিগার, বোন খানজাদা, তার বৈমাত্রেয় ভাই জাহাঙ্গীর, সবার অস্তিত্বই পাওয়া যায়। বাবরের পিতা আসলেই কবুতরের চবুতরা ভেঙে পড়ে নিহত হন। বাবরের ঐতিহাসিক শত্রু পারস্যের শাহ ইসমাইল, সাইবানি খান, দিল্লীর ইবরাহিম লোদী এইসব ঐতিহাসিক চরিত্র নিয়ে এই উপন্যাস লিখিত হয়েছে। গল্পের ঘটনা প্রবাহের খাতিরে আরো কিছু নতুন চরিত্র সৃষ্টি করেছি, বাবরের জীবনে প্রভাবশালী লোকদের আদলে। ওয়াজির খান, বাইসানগার, বাবুরী তেমনই সব চরিত্র। অবশ্য বাবরনামাতে বাবুরী নামে একটা বাজারের ছেলের কথার উল্লেখ পাওয়া যায়। সামাজিক আর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট যতোটা সম্ভব এই উপন্যাসে উলেখ করা হয়েছে। যেমন সুন্নী মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও সুরা, চরস, ভাণ প্রভৃতির প্রতি তার আসক্তির বর্ণনা বাবরনামায় পাওয়া যায়। এই উপন্যাসে অটোমান সাম্রাজ্য হতে প্রাপ্ত অস্ত্র আর সেটা ব্যবহারে বাবরের দক্ষতার তথ্য সত্য ঘটনার উপরে প্রতিষ্ঠিত।

একটা সময় আমি বাবরের জীবনের সব উল্লেখযোগ্য স্থান ভ্রমণ করেছি। বাবরের আদি জন্মভূমি ফারগানা, যা বর্তমান উজবেকিস্তান আর কাজিকিস্তানে অবস্থিত। আজও এলাকাটা আপেল, নাশপাতি আর এ্যাপ্রিকটের বাগান শোভিত। এখনও সেখানে ফুটবল আকৃতির তরমুজ হয়। এখনও এই অঞ্চলের নারী পুরুষ গ্রীষ্মকাল শেষ হলে হাতে ধরা কাস্তে দিয়ে ফসল কাটে। এখনও ভোলা আকাশের নীচে ভেড়া, ইয়াক চড়ে বেড়ায়।

বাবরের কবর কাবুলে অবস্থিত। যা বর্তমানে ইউনেসকোর আর্থিক সহায়তায় নতুন করে সংস্কার করা হয়েছে। আমি খাইবার গিরিপথ দিয়ে উত্তর ভারতের মালভূমির উপর দিয়ে দিল্লি, আগ্রা গিয়েছি।

আমার এই দীর্ঘ যাত্রায় আমি যা দেখেছি, উপলব্ধি করেছি তাই লিপিবদ্ধ করেছি বাবরের প্রতি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার নিদর্শন হিসাবে। বাবরের প্রতি আমার এই ভালোবাসা যোদ্ধা হিসাবে মোঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার কারণেই না বরং তার লেখনী, তার উদ্যানপ্রীতি, শিল্পসংস্কৃতির প্রতি উৎসাহ সবকিছুকে অনুপ্রাণিত করেছে।

বাবর মুসলমান চান্দ্র মাসের দিনপঞ্জি ব্যবহার করলেও আমি সেগুলো খ্রিস্টান দিনপঞ্জিতে রূপান্তরিত করেছি কেবলই বোঝার সুবিধার্থে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *