৪.৫ প্রতিহিংসাপরায়ণ বুয়া

২৪. প্রতিহিংসাপরায়ণ বুয়া

শুক্রবারের এক সন্ধ্যাবেলা আগ্রা দূর্গের প্রকারবেষ্টিত পর্যবেক্ষণ বুরুজের বেষ্টনীর ভিতর থেকে দাঁড়িয়ে বাবর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। আকাশের গায়ে গাঢ় ধূসর, প্রায় বেগুনী মেঘের রাশি অবিরল ধারায় বৃষ্টি ধারা ঝরে পড়ছে। আঙ্গিনার শানবাঁধানো পাথরের উপরে বৃষ্টির ফোঁটা ছিটকে উঠে এবং বেলেপাথরের দেয়ালে কাটা গর্তের ভেতর দিয়ে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে পড়ছে। দূর্গের উত্তর আর পূর্বদিকের দেয়ালের ফোকড় গলে নীচ দিয়ে পূর্ণবেগে প্রবাহিত যমুনা নদীতে ঝর্ণাধারার মতো আছড়ে পড়ছে। দক্ষিণ আর পশ্চিম দিকে পানি জমে ইতিমধ্যে বিলে পরিণত হওয়া কুচকাওয়াজ ময়দানে নৃত্যরত ভঙ্গিতে গিয়ে জমা হচ্ছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুচ্চমক নিচু হয়ে আসা, ধোঁয়াটে দিগন্তের বুকে আঁচড় কেটে দেয়। সাথে সাথে দূর থেকে বজ্রপাতের গুরুগম্ভীর ধ্বনি ভেসে আসে।

 বাবর তাকিয়ে থাকার মাঝে টের পায় বাতাসে কেমন উষ্ণ আর আর্দ্রতার আতিশয্য। মধ্য এশিয়ায় বছরের এই সময়ে গ্রীষ্মকালে সূর্যের দাবদাহে অতিষ্ঠ হয়ে গরমের থেকে ভীষণ আলাদা। এখানে হিন্দুস্তানে বৃষ্টির কাল স্থানীয়রা যাকে মৌসুম বলে, ইতিমধ্যে তিন মাস স্থায়ী হয়েছে। সবকিছু স্যাঁতাসেতে করে তুলেছে। সুযোগ পেলে কাপড়চোপড় আর আসবাবপত্রও ক্ষয়কর ছত্রাকের প্রকোপ থেকে রেহাই পায় না। তাকে তার অমূল্য রোজনামচাও আগুনে শুকিয়ে নিতে হয় আর্দ্রতার হাত থেকে বাঁচবার জন্য। ধাতব আস্তরণ দেয়া সিন্দুকের ভেতরেও সেগুলো আর্দ্রতার প্রকোপ থেকে রেহাই পায় নাই।

 যাই হোক, সে ভাবে, কিছুক্ষণের ভিতরেই নিজের কামরায় সে হুমায়ূনের সাথে আহারে বসবে। এটা অন্তত একটা সুসংবাদ- সে এই মুহূর্তে বেশি লোকের সঙ্গ পছন্দ করছে না। সে তার প্রধান রাঁধুনীকে নিজের প্রিয় পদ রান্না করতে বলেছে: কচি খরগোসের মাংস, অল্প আঁচে দারুচিনি, এলাচ আর কিশমিস দিয়ে রান্না করে পরিবেশনের আগে টকদই মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। সুলতান ইবরাহিমের হেশেল থেকে যে চারজন রাঁধুনিকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে সে তাদের বলেছে তার নতুন সাম্রাজ্যের স্বাদ উপস্থাপনকারী গুরুপাক মশলাযুক্ত, রসুন দেয়া পদ রান্না করতে। সে দ্রুত তাদের এই রান্নার ভক্ত হয়ে উঠছে। মুখরোচক খাবারের চিন্তা তার ক্রমাগত মাথাব্যাথা অনেকটাই দূর করে, যা এই বর্ষাকালে তাকে বেশ ভোগাচ্ছে। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে বুরুজ থেকে নেমে নিজের কামড়ার দিকে হাঁটা দেয়।

হুমায়ুন ইতিমধ্যে ফিরোজা রঙের চাদরে ঢাকা আর রূপার খাবার পাত্র সজ্জিত বিশাল নিচু টেবিলের সামনে আসনসিঁড়ি হয়ে বসে আছে। টেবিলের মধ্যেখানে একটা বিরাট বারকোশের উপরে মাখন দিয়ে রান্না করা পোলাও। যাতে নানা পদের বাদাম দেয়া হয়েছে। বাবর কামরার ভেতরে প্রবেশ করতে হুমায়ূন উঠে দাঁড়িয়ে তাকে আলিঙ্গন করে। বাবরের চেয়ে সামান্য লম্বা, সে ইতিমধ্যেই চওড়া আর পেশল দেহের অধিকারী হয়ে উঠেছে হিন্দুস্তান অভিযান তাকে পরিণত করে তুলেছে। বাবর মৃদু হেসে তাকে বসতে ইঙ্গিত করে। তারপরে হাততালি দিয়ে আপাদমস্তক সাদা পোশাক পরিহিত দুই পরিচারককে সে বাকি খাবার পরিবেশনের অনুমতি দেয়। নিমেষের ভিতরে তারা আরো চারজনকে নিয়ে ফিরে আসে, সবার হাতে কাপড়ে আবৃত বিশালাকৃতি ধাতব পাত্র। কাপড় সরিয়ে নিতে ঘরের ভেতরটা সুস্বাদু মশলার গন্ধে ভরে উঠে।

 “সুলতান এগুলো ইবরাহিমের রাঁধুনিদের রান্না করা গুড়ো ধনে আর বাটা সর্ষে, আদা, দারুচিনি আর এলাচের ঘন মিশ্রণে মাখা মাখা করে রান্না করা মুরগীর মাংস। হলুদ, পেঁয়াজ আর ডাল দিয়ে রান্না করা খাসির মাংস। তারপরে শাক দিয়ে রান্না করা মুরগীর আরেকটা পদ- আদা আর জায়ফল দিয়ে একটা পাত্রে আবদ্ধ করে আগুনের মাঝে সেটা পুঁতে রাখার কারণে কেমন ধোয়াটে একটা গন্ধ তৈরি হয়েছে। তারপরে রয়েছে বেগুন আর ওকরার ঝোল- প্রতিটা পদের স্বাদ অপূর্ব।

“সবগুলো পদই সুস্বাদু এবং মুখরোচক। কিন্তু আমার খরগোসের মাংস কোথায়?”

“আপনার পরিবেশনকারী সেটা নিয়ে আসছে।” পরিচারকের কথা শেষ হবার আগেই- লম্বা, মাথা ভর্তি ধুসর চুলের-এক পরিবেশনকারী একটা পাত্র বাবরের সামনে নিয়ে এসে সেটার উপর থেকে কাপড় সরিয়ে নেয়।

 “আহমেদ, বরাবরের মতোই হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।”

“ধন্যবাদ, সুলতান।”

“আমার ছেলে হিন্দুস্তানী পদগুলো চেখে দেখুক, যাতে সে পরবর্তীতে আমাকে বলতে পারে কোনটা খেতে ভালো হয়েছে। কিন্তু আগে আমাকে আমার খরগোসের মাংস দাও।”

 দু’জনে নিরবে খেতে শুরু করে। “আমাকে এবার বলো গুজরাটের সুলতানের কাছে দূত পাঠাবার জন্য কি বন্দোবস্ত করলে।” মুখ ভর্তি খরগোসের মাংস নিয়ে বাবর জানতে চায়।

 “আমি বৃষ্টি থামবার সাথে সাথে যাতে তারা রওয়ানা দিতে পারে সেজন্য তাদের প্রস্তুত থাকতে বলেছি। আমাকে জানান হয়েছে অক্টোবরের আগে যাত্রা করা অসম্ভব। তখন হলে কি কোনো অসুবিধা হবে?”

“আমি দুঃখিত- তোমার শেষ কথাগুলো শুনতে পাইনি। আমার পেটের ভেতরটা আচমকা মোচড় দিয়ে ওঠাতে আমার মন গুজরাট থেকে একেবারে সরে গিয়েছিল।”

“আব্বাজান- আমি কি সুস্থ বোধ করছেন?”

বাবর মোটেই সুস্থ বোধ করছে না। তার সারা মুখ শীতল আর চটচটে ঘামে তার মুখটা ভিজে উঠেছে এবং তার পেটের ভেতরে গনগনে উত্তপ্ত একটা হাত যেনো আবার নাড়ীভুড়ি সব ধরে মুচড়ে দেয়। সে ব্যাথায় কুঁকড়ে যায় এবং হুমায়ুন আর এক পরিচারককে ইশারা করে তাকে তুলে দাঁড় করাতে বলে। তারা তাকে দাঁড় করাবার চেষ্টা করার সময়ে আরেকটা মোচড় তাকে কাঁপিয়ে দেয় এবং সে মুখে বমির টকটক স্বাদ অনুভব করে। সে বমিটা গিলে ফেলতে চেষ্টা করে তারপরে আবার তার অন্ননালী গুলিয়ে উঠতে সে আবার ঢোক গিলে। খাবার টেবিল থেকে তিনপাও এগিয়ে যেতে পারেনি সে পাকস্থলী মুচড়ে বমি করে। সদ্য খাওয়া খরগোসের মাংস, সাথে লাল ওয়াইন আর আগে খাওয়া মিষ্টান্ন গোলাপী আর বেগুনী রঙের গলিচায় ছিটকে পড়ে।

বাবর আরেকটা মোচড়ের সাথে সাথে আবারও ভেতরের সবকিছু উগড়ে দেয়। বমির সাথে এবার রক্ত আর শ্লেষ্ম এবং পাঁচকরস উঠে আসে। যন্ত্রণায় সে পেট চেপে ধরে। “আমাকে মার্জনা করবে। আমি বুঝতে পারছি না কি হলো। আমি কখনও এভাবে অসুস্থ হইনি- অত্যাধিক মদ্যপানও আমাকে অসুস্থ করতে পারেনি। আমাকে ঐ বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দাও।”

হুমায়ুন আর পরিচারক বাবরকে ধরে নিয়ে গিয়ে মাথার নিচে তাকিয়া দিয়ে শুইয়ে দেয় এবং হুমায়ূন হেকিম ডেকে পাঠায়। “আব্বাজান, পানিটা পান করেন।” বাবর সুবোধ বালকের মতো হুমায়ূনের হাতে ধরা পাত্র থেকে চুমুক দেয় কিন্তু পানি তার পাকস্থলীতে পৌঁছানো মাত্র আবার খিচুনী শুরু হয় এবং পিচকারীর মতো বাবর বমি করে।

 “আমাকে শৌচাগারে নিয়ে চলো- আমার পেট যে কোনো মুহূর্তে জানান দেবে।” বাবর উঠে বসতে চেষ্টা করে। হুমায়ুন তার বাবাকে আধা পাঁজাকোলে করে, আধা ধরে শৌচাগারে নিয়ে যায়। যেখানে সে তার পেটের ভেতরের সব কিছু প্রচণ্ড শব্দে, দুর্গন্ধ সৃষ্টিকারী তরল হিসাবে নির্গত করে। পাঁচটা কষ্টকর মিনিটের পরে বাবর শৌচাগার থেকে বের হয়ে আসে। আগের চেয়ে সামান্য সুস্থির হয়ে দাঁড়াতে পারে। এখন কিন্তু মুখ এখনও ফ্যাকাশে হয়ে আছে, আর ঘামে ভেজা। “হুমায়ূন- ওদের বলো বমি যেনো পরিষ্কার না করে আমার ধারণা আমাকে বিষ দেয়া হয়েছে গালিচা থেকে বমি তুলে সেটা একটা কুকুরকে খেতে দাও। খরগোসের মাংস আরেকটা কুকুরকে খেতে দাও। রাধুনীদের, স্বাদপরখকারী আর অন্য পরিচারকদের পাহারায় রাখো। আমাকে এবার শুতে হবে। ভীষণ ক্লান্তবোধ করছি।”

*

পরের দিন সকালবেলা, হুমায়ূন তার বাবার শয্যাপাশে বসে আছে। বাবরের চেহারা তখনও ফ্যাকাশে এবং চোখের নিচে একদিনেই কালো দাগ পড়েছে। কিন্তু তাকে গতদিনের চেয়ে কিছুটা ভাল দেখায়।

“তিনি বমি না করে আজ কিছু তরল পান করতে পেরেছেন।” খয়েরী আলখাল্লা পরিহিত আবদুল মালিক কাবুল থেকে বাবরের সাথে আগত শক্তপোক্ত চেহারার, ধূসর চোখের হেকিম বলেন বাবরের পুরো পরিবারের বহুবছর যাবত সে চিকিৎসা করে আসছে।

“ আব্বাজান, আমরা আপনার কথামতো কাজ করেছি। বমিটা একটা কুকুরকে খেতে দিয়েছিলোম। আর খরগোসের মাংস আরেকটা কুকুরকে এবং সারারাত তাদের উপরে নজর রেখেছিলাম। প্রথম কুকুরটা অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং ভয়ঙ্কর ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়- ঠিক আপনার মতো- তারপরে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠে। দ্বিতীয়টা নিশ্চল হয়ে পড়ে থাকে এবং করুণ স্বরে ডাকতে থাকে, বেচারার পেট ফুলে উঠে। আমরা পাথর ছুঁড়ে তাকে মারলেও তাকে নড়াতে পারিনি বা একটা ডাকও তার গলা দিয়ে বের করতে পারিনি। তারপরে ঘণ্টাখানেক আগে-এই কুকুরটাও বমি করে এবং এখন ধীরে ধীরে চলেফিরে বেড়াচ্ছে। বিজ্ঞ হেকিমের দল সারারাত নিধুম কাটিয়েছে তাদের বইপুস্তক নিয়ে। তারা একমত হয়েছে যে, আপনার সাথে এই কুকুর দুটোর উপসর্গ নিঃসন্দেহে বিষ প্রয়োগের ফলাফল।

 “আমিও তাই ভেবেছিলাম।”

 “কিন্তু আপনাকে কিভাবে বিষ প্রয়োগ করা সম্ভব? আপনার নিজস্ব খাদ্য পরীক্ষাকারী রয়েছে আর রাঁধুনিদের উপরে সবসময়ে নজর রাখা হয়…”

 “টাকা খুব দ্রুত আনুগত্যের পরিবর্তন ঘটাতে পারে। আমাদের খুঁজে বের করতে হবে এর পেছনে কারা রয়েছে। আর তাদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে- এতো কঠোর আর নির্মম শাস্তি দিতে হবে যাতে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর না ঘটে। প্রথমে রাঁধুনি তারপরে খাদ্যপরীক্ষাকারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করো। কেউ বিন্দুমাত্র আমতা আমতা করলে তাকে নিপীড়ন করো। প্রথমে আহমেদকে জিজ্ঞেস করো, সে কাকে সন্দেহ করে। তাদের দিয়ে প্রথমে শুরু করো। আর তোমার প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত থামবে না। আমি অনেক কষ্ট সহ্য করেছি। এবার তাদের পালা।”

দু’ঘণ্টা পরে হুমায়ূন গম্ভীর মুখে ফিরে আসে। “আপনার কথাই ঠিক… আপনাকে বিষপ্রয়োগ করা হয়েছিলো… অপরাধীরা দোষ স্বীকার করেছে এবং তাদের মূলহোতার নাম বলেছে।”

 “বলো আমাকে।”

 “আহমেদ বলেছিলো আমাদের প্রথমে হিন্দুস্তানী রাঁধুনিদের একজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা উচিত- ছোটখাট দেখতে এক লোক। ইবরাহিমের অধীনে দশ বছর ধরে রাঁধুনির কাজ করছে এবং আগামী কয়েকদিনের ভিতরে তার নিজের আত্মীয়স্বজনের সাথে দেখা করতে যাওয়ার কথা ছিলো। লোহার গনগনে লাল শিক দেখে তাকে আর কিছু বলতে হয়নি। সে গড়গড় করে যা জানে সব বলে দিয়েছে। রোসান্নারা, ইবরাহিমের মা বুয়ার এক বৃদ্ধ পরিচারিকা। তার সাথে দেখা করেছিলো। সে তাকে বলে যে বুয়া বর্বরদের’, তিনি আমাদের এই নামেই সম্বোধন করে থাকেন। একটা শিক্ষা দিতে চান। তার ছেলের মৃত্যুর জন্য- রাঁধুনির পুরাতন প্রভু। আপনাকে বিষপ্রয়োগ করাটা একটা গর্বের আর অর্থকরী কাজ বলে বিবেচিত হবে এবং সে তাকে দুটো স্বর্ণ মুদ্রা দেয়। সে মোহর দুটো নেয় এবং বৃদ্ধা তখন তাকে একটা কাগজের পুটলিতে মোড়ানো বিষ দেয়।

“এই লোকটা ভীষণ চতুর। সে সময় ক্ষেপণ করে এবং আপনার একজন খাদ্যপরীক্ষাকারীকে হাত করে-আমাদের লোক যে নিজের দেশে ফিরে যাবার জন্য এত ব্যাকুল হয়ে ছিলো যে, সে তাকে সহজের ঘুষ দিয়ে হাত করে। যাতে সে আপনার খরগোসের মাংস পরীক্ষা না করে…ব্লাঁধুনী ধূর্ততার সাথে হিন্দুস্তানী পদে বিষ মেশায়নি, যাতে সন্দেহ এড়াতে পারে। তারপরে একেবারে শেষ সময়ে খরগোসের মাংসে বিষ মেশাবার সময়ে সে বাধাগ্রস্থ হয়েছিলো। সে কেবল উপরিভাগে বিষ ছড়াতে পারে এবং আগুনে ফেলে দেয়।

“আমরা খাদ্য পরীক্ষাকারী আর বৃদ্ধাকে প্রশ্ন করেছি। পরীক্ষাকারী অচিরেই করুণা ভিক্ষা চাইতে থাকে। কিন্তু বৃদ্ধা অনেক কঠিন চিড়িয়া। কিন্তু গরম লোহার শিক তাকে অচিরেই বশ মানায় যে, সে নিজের ভূমিকা স্বীকার করে। কিন্তু তাকে কে আদেশ দিয়েছিলো তার নাম জানবার জন্য তাকে আমাদের শেষপর্যন্ত পানিতে চোবাতে হয়েছে।”

 “তুমি দারুণ কাজ করেছে।”

“আমরা এই বিশ্বাসঘাতকদের নিয়ে কি করবো?”

“তাদের জনসম্মুখে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।”

 “বুয়াকেও?”

 “না, সে শাহী পরিবারের সদস্য। তাকে আপাতত একটা পর্যবেক্ষণ বুরুজে আটকে রাখো। যেখান থেকে সে প্রাণদণ্ড কার্যকর করা চাক্ষুষ করতে পারে।”

 “অন্যদের মৃত্যুদণ্ড কিভাবে কার্যকর করা হবে?”

“রাধুনীর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছিন্ন করো। খাদ্যপরীক্ষাকারী, বিশ্বাস ভঙ্গের কারণে তার অপরাধ সবচেয়ে বেশি। আর সর্বোপরি সে আমাদের নিজেদের লোক। চাবকে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করবে। এবং বৃদ্ধাকে হাতির পায়ের নিচে পিষে হিন্দুস্তানী রীতিতে প্রাণদণ্ড কার্যকর করবে। মৃত্যুদণ্ডাদেশ দুপুরবেলা কার্যকর করবে- আর দেখো হেঁশেলের রাঁধুনিরাসহ বেশ ভালো লোক যেনো জমায়েত হয় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা দেখতে। তোমাকেই দায়িত্ব নিতে হবে। আমি এখনও ভীষণ দুর্বল।”

*

বৃষ্টি বন্ধ হয়েছে কিন্তু আকাশে তখনও মেঘ রয়েছে। হুমায়ূন যখন কুচকাওয়াজ ময়দানের কাদার ভিতরে লাল শামিয়ানার নিচে তড়িঘড়ি করে তৈরি করা মঞ্চে আসন গ্রহণ করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা পর্যবেক্ষণ করতে। রাধুনীর মৃত্যুদণ্ড দ্রুত কার্যকর করা হয় এবং তার কর্তিত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে যাওয়া হয় দূর্গের তোরণে প্রদর্শন করার জন্য। চাবুকের আঘাতে খাদ্যপরীক্ষাকারীর- মাটিতে হাতপা টানটান করে বাধা অবস্থায় শায়িত উচ্চকণ্ঠের আর্তনাদ প্রায় পাশবিক শোনায়। অনেকক্ষণ ধরে সে চিৎকার করতে থাকে। কিন্তু একটা সময়ে সে নিরব হয়ে পড়লে তার মৃতদেহ পায়ের গোড়ালী ধরে কাদার উপর দিয়ে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয় দূর্গপ্রাকারে সেটা প্রদর্শিত করা হবে বলে। এবার রোশন্নারার পালা।

দূর্গের বুরুজের নিচে অবস্থিত একটা ছোট প্রবেশপথ দিয়ে চারজন প্রহরী তাকে বের করে নিয়ে আসে। তার পরনে একটা সাদা সুতির আলখাল্লা। তার সাদা চুল আর শান্ত অভিব্যক্তির জন্য তাকে দয়ালু দাদীমার মতো সম্ভবত সে আসলেও তাই- দেখায়। সমবেত জনগণের গঞ্ছনা উপেক্ষা করে সে মাথা উঁচু রেখে ধীর পায়ে হুমায়ূনের দশ গজ সামনে স্থাপিত সামান্য উঁচু পাথরের মঞ্চের দিকে এগিয়ে যায়। প্রহরীদের কেউ তাকে স্পর্শ করার আগেই পাথরের উপরে পিঠ দিয়ে শুয়ে পড়ে। প্রহরীর দল এবার পাথরে স্থাপিত চারটা লোহার আংটার সাথে তার চার হাতপা বাঁধে, আংটাগুলোর কাজই এটা। বিষাণের ধ্বনির সাথে সাথে লাল রঙে রঞ্জিত কুচকাওয়াজ মাঠের বিপরীত দিকে অবস্থিত হাতিশালা থেকে হেলেদুলে বের হয়ে আসে ভীড়ের মাঝে। প্রহরীরা তার জন্য রাস্তা পরিস্কার করে দেয়।

হাতিটা একটা বিশাল মর্দা- প্রাণদণ্ড কার্যকর করার জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষিত। ইবরাহিমের আমলে এমন শাস্তির বিধান একটা নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিলো। মাহুতের একটা সংকেতে, সে এখনও কানের পেছনেই বসে রয়েছে। হাতিটা তার বিশাল ডান পা তুলে সেটা বৃদ্ধার শরীরে উপরে রাখে। সে কোনো শব্দও করে না। তারপরে আরেকটা সংকেতের সাথে হাতিটা সুবোধ ভঙ্গিতে রোসান্নার উপরে পুরো পায়ের ভর চাপিয়ে দেয়। হুমায়ূন কোনো আর্তনাদ শুনতে পায় না। কেবল পায়ের চাপে একটা ভোতা শব্দ- সাথে রোসান্নার পেট ফেটে গিয়ে নাড়িভুড়ি বের হয়ে আসতে এবং পাজরের হাড় আর মেরুদণ্ড ভাঙার একটা মড়মড় শব্দ শোনা যায়। তারপরে সে প্রাণহীন আর অসাড় ভঙ্গিতে পড়ে থাকলে তার পরনের সাদা কাপড় রক্ত আর বিষ্ঠায় মেখে গেলে মাহুতের আদেশে হাতিটা ঘুরে দাঁড়িয়ে হতবাক লোকদের মাঝ দিয়ে আবার হাতিশালায় ফিরে চলে। সে বেশ ধীরেসুস্থে দেহের উপর থেকে রক্তাক্ত পা তুলে নেয়।

হাতিশালার দিকে পাঁচ পা ফিরে যাবার আগেই হুমায়ূন তার পেছনে দূর্গপ্রাকারে একটা গোলমালের আওয়াজ শুনতে পায়। সে ঘাড় ঘুরিয়ে তার উপর দিয়ে এক বৃদ্ধাকে চিৎকার করতে করতে দৌড়াতে দেখে, পরনের কালো কাপড় বাতাসে উড়ছে: “আমার প্রিয় ইবরাহিম, প্রিয় রোসান্নারা তোমরা শান্তিতে বেহেশতে বিশ্রাম নাও। বাবর আর তার সন্তানদের অভিশাপ দিয়ে আমিও তোমাদের সাথে মিলিত হতে আসছি। হিন্দুস্তান তার বশ কখনও হবে না। তার ছেলেরা একে অন্যের সাথে লড়াই করে ধ্বংস হবে। তারা সবাই ধূলোয় বিলীন হয়ে যাবে।”

 বুয়া, হুমায়ূন বুঝতে পারে। সে তাকিয়ে দেখে, ধাওয়াকারী প্রহরীদের ফাঁকি দিয়ে সে ছাদের কিনারায় পৌঁছে এবং নিচের প্রমত্তা যমুনার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং পানির স্রোতে কালো চুলের জটলায় পেঁচিয়ে গিয়ে ভেসে যায়। পানিতে পুরোপুরি ডুবে যাবার আগে ঠিক তার মাথার উপরে বজ্রপাতের শব্দ শোনা যায়। বহু প্রতিক্ষিত ঝড় অবশেষে শুরু হয়েছে। মুষলধারে বৃষ্টি পড়তে শুরু করে। কুচকাওয়াজ ময়দানের জমাট কাদার উপরে আছড়ে পড়তে থাকলে হুমায়ূন দ্রুত দূর্গের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে।

সেই রাতে বুয়ার দূর্গের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ার দৃশ্য হুমায়ূনের স্বপ্নে বাবরের কাছে শোনা তার দাদাজানের আকশির দূর্গের দেয়ালের উপর থেকে কবুতরের চবুতরা নিয়ে নিচের গিরিকরে আছড়ে পড়ার দৃশ্যের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।

*

“আমি এখন অনেকটা সুস্থ,” তিনদিন পরে বাবর হুমায়ূনকে বলে। “দুধের সাথে মিশিয়ে যে আফিম আমাকে আবদুল মালিক খেতে দিয়েছিলো পেটের ব্যাথা সেটা অনেকটাই প্রশমিত করেছে। এই প্রথমবারেরমতো আমার মনে হয়েছিলো যেনো মরতে বসেছি…অনেকবার এমন হয়েছিলো যে, আমি অনায়াসে মারা যেতে পারি এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে সে সব পরে কখনও আমার ভাবনায় আলোড়ন তুলেনি। এইবার আমি কৃতজ্ঞ যে এখন প্রাণে বেঁচে আছি। ছোটখাট ব্যাপারও আমাকে আনন্দিত করছে- গবাক্ষ দিয়ে দেখতে পাওয়া ফুলের সৌন্দর্য, পাখির কলতান, সবকিছু। আমি আমার রোজনামচায় আমার ভাবনার কথা লিখে রাখছিলাম- শোনো…

“আল্লাহতালা যতদিন আমার হায়াত রেখেছেন প্রতিটা দিনের জন্য আমি তার কাছে শুকরিয়া জানাই। জীবন এত মধুর আমি আগে এটা বুঝতে পারিনি। মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েই কেবল একজন জীবনের স্বাদ অনুভব করতে পারে। আমাকে আর আমার সন্তানদের দীর্ঘ জীবন দান করার জন্য আমি আল্লাহতালার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *