২.৭ পলাতক জীবন

১৩. পলাতক জীবন

 শিকার করে একদিন অতিবাহিত করার পরে বাবর ধীরে ঘোড়া নিয়ে সেরাম ফিরে আসছে। তার চারপাশের কৃষিজমিতে গ্রামের লোকেরা, উজ্জ্বল লাল,নীল আর সবুজ ঘাঘড়াচোলি পরিধান করে এই মওসুমের শস্য চাষ করার জন্য জমি প্রস্তুত করছে। বাবর সহসা সন্ধ্যার ম্লান সূর্য পেছনে রেখে সোনালী ধূলো উড়িয়ে তিনজন অশ্বারোহীকে বসতির দিক থেকে এগিয়ে আসতে দেখে। তারা এগিয়ে আসতে বাবর দু’জনকে তার দেহরক্ষী দলের সদস্য হিসাবে চিনতে পারে। তৃতীয়জন একজন অপরিচিত আগন্তুক। তিনজন ঘোড়া থামাতে, আগন্তুক ঘোড়ার পিঠ থেকে লাফিয়ে নেমে বাবরের সামনে শুকনো মাটিতে শুয়ে পড়ে শ্রদ্ধা জানায়।

“উঠে দাঁড়াও। কে তুমি?”

“আপনার সৎ-ভাই জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে আগত বার্তাবাহক। আমি আল্লাহতালার প্রতি কৃতজ্ঞ যে শেষ পর্যন্ত আপনাকে খুঁজে পেয়েছি। আমি আপনাকে বেশ কিছু দিন ধরে খুঁজছিলাম। আপনাকে খুঁজে পাওয়া খুব কষ্টকর।”

 “সেটাই স্বাভাবিক। খুব কঠিন সময়ের ভিতর দিয়ে আমি অতিক্রম করছি। জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে কি বার্তা নিয়ে এসেছো? আমি সত্যি বলতে তার কাছ থেকে এই মুহূর্তে বিশেষ করে যখন ভাগ্য আমার প্রতি বিরূপ- তখন তার কাছ থেকে কোনো বার্তা প্রত্যাশা করিনি।”

“আমার প্রভুর প্রতিও ভাগ্য সমান বিরূপ বলে প্রতিপন্ন হয়েছেন। সাইবানি খান পশ্চিম দিক থেকে ফারগানা আক্রমণের জন্য এগিয়ে আসছে। সুলতান জাহাঙ্গীর আপনাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করেছেন যতো দ্রুত সম্ভব আপনি আপনার সৈন্যবাহিনী নিয়ে যেনো ফারগানায় উপস্থিত হন।”

“আমি কেন সেখানে যাব? সমরকন্দ রক্ষার জন্য যখন আমি সাহায্যের আবেদন জানিয়ে ছিলাম সে কোনো সৈন্যবাহিনী পাঠায়নি।”

 “সুলতান, আমি সেসব কিছুই জানি না। আমি কেবল এটুকুই জানি ফারগানার লোকেরা আতঙ্কিত হয়ে আছে এবং আপনার সাহায্য তাদের প্রয়োজন।”

 বাবর সাথে সাথে কোনো উত্তর দেয় না। তারপরে সে বলে, “কারণটা যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু উত্তর দেবার আগে আমাকে একটু ভাবতে হবে। ইত্যবসরে আমরা বসতিতে ফিরে যাই। সেখানে তুমি পরিষ্কার হয়ে ভালমতো খেয়ে নাও।” দু’ঘণ্টা পরে বাবর তার আম্মিজান আর নানীজানের কক্ষের দিকে এগিয়ে যায়। সে কক্ষের কাছাকাছি আসতে ভেতর থেকে এসান দৌলতের বীণার আওয়াজ শুনতে পায়। সে ভেতর প্রবেশ করলে তিনি বাদ্যযন্ত্রটা নামিয়ে রাখেন এবং খুতলাঘ নিগার তার সূচীকর্ম বন্ধ করেন। “জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে আগত বার্তার কথা আপনারা শুনেছেন?” সে জানতে চায়।

“অবশ্যই। তুমি কি প্রত্যুত্তর দেবে?”

 “গত এক ঘণ্টা ধরে আমি সেটাই ভাবছি। আমার ন্যায়সঙ্গত মসনদ ছিনিয়ে নেয়ায় জাহাঙ্গীরের প্রতি আমার কোনো দুর্বলতা নেই আর তামবালের প্রতি আরও না। অবশ্য সম্মানিত একজন মানুষ হিসাবে আমি কেবল একভাবেই প্রতিক্রিয়া জানাতে পারি। আমার লোকদের জানের শত্রু- বর্বর উজবেকদের হাত থেকে আমি অবশ্যই ফারগানাকে রক্ষা করতে সাহায্য করবো। আমার জন্মস্থান আমি ভালোবাসি। সেখানেই আমার মরহুম আব্বাজান তার সমাধিতে শায়িত আছেন। তিনি যখন। জীবিত ছিলেন, তখন তার আর আম্মিজান আপনার সাথে সেখানে কাটানো অনেক আনন্দময় স্মৃতি আমার রয়েছে। আমার জন্মভূমি আক্রান্ত আর পরাভূত হবে আমি সেটা দাঁড়িয়ে দেখতে পারি না। আমার পক্ষে যতোজন লোক সংগ্রহ করা সম্ভব তাই নিয়ে আমি শীঘ্রই আকশির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবো।”

 “আমি বা তোমার আম্মিজান এর চেয়ে কিছু কম তোমার কাছে প্রত্যাশা করিনি,” এসান দৌলত বলেন।

***

বেগুনী রঙের মেঘ গর্ভবতী মেয়ের মতো পেটভর্তি বৃষ্টি নিয়ে বেশতর পর্বতের তীক্ষ্ণ চূড়া মুকুটের মতো ঘিরে রেখেছে- বাবর তার শৈশবে এই দৃশ্য অসংখ্যবার দেখেছে। পূর্ব দিক থেকে একটা ঝড় ধেয়ে আসছে এবং ঘণ্টাখানেকের ভিতরে তাদের উপরে এসে ঝাঁপটে পড়বে। বাবর ভাবে তাদের কোথাও আশ্রয় নেয়া উচিত। আর তাছাড়া প্রায় দশ ঘণ্টা তারা ঘোড়ার পিঠে রয়েছে। এখন বিশ্রাম নেয়া দরকার। সে রেকাব থেকে পা বের করে এবং পা আলগাভাবে ঝুলতে দেয়। আড়ষ্ঠ উরু আর পায়ের ডিমের মাংসপেশী আরাম পায়। তার কালো বিশাল স্ট্যালিয়নটা অস্থিরভঙ্গিতে তার দুপায়ের ফাঁকে নড়াচড়া করতে সে এর ঘামে ভেজা গলায় আলতো করে চাপড় দেয়।

 “আমরা ওখানে ছাউনি ফেলবো।” দুইশ গজ দূরে লাল বাকল বিশিষ্ট স্পিরাই গাছের ফুথের দিকে সে ইঙ্গিত করে। যা তাদের গুপ্তচর আর বৃষ্টি দুটোর হাত থেকেই আড়াল দেবে। সে যখন ছোট ছিলো ওয়াজির খান তখন ঘোড়া চালাবার জন্য ব্যবহৃত চাবুকের হাতল এই স্পিরাই গাছের কাঠ থেকে তৈরি করে দিয়েছিলো যা দেখতে অনেকটা খোলা চোয়ালের ভেতর থেকে জিহ্বা বের হয়ে থাকা শিয়ালের মুখের মতো দেখতে। কিন্তু মৃতদের বা অতীত নিয়ে নস্টালজিক হবার সময় এটা না। স্পিরাই গাছের নমনীয় কাঠ তীর তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। আর সামনের দিনগুলোতে এই কাঠ তাদের প্রচুর পরিমাণে প্রয়োজন হবে। “বাইসানগার সামনের ঐ পাহাড়ের উপরে প্রহরী নিয়োগ করেন।”

 বাবর ঘোড়ার পিঠ থেকে নেমে সেটাকে চড়ে বেড়াবার সুযোগ দিয়ে আলগা করে একটা গাছের সাথে বেঁধে রাখে। তারা সেরাম এতো তাড়াহুড়ো করে ত্যাগ করেছে যে কোনো তাঁবু আনতে পারেনি। সে তার বেগুনী রঙের ঘোড়সওয়ারীর আলখাল্লাটা শক্ত করে। গায়ের সাথে জড়িয়ে নিয়ে একটা পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে বসে। তার লোকদের কেউ কেউ তীর ধনুক নিয়ে বনমোরগ বা ঘুঘু শিকার করতে বনের ভেতরে প্রবেশ করে বাকিরা আগুন জ্বালাবার জন্য কাঠ সংগ্রহ করে।

সে ভাবেনি এভাবে তাকে কখনও ফারগানায় ফিরে আসতে হতে পারে।

“সুলতান?”

 বাবর চোখ তুলে তাকিয়ে বাবুরীকে দেখতে পায়।

 “আপনাকে বিষণ্ণ দেখাচ্ছে।”

“আমি আসলেই বিষণ্ণ বাবুরী, দু’দিনের ভেতরে আমরা আকশি পৌঁছাবো, কিংবা তারচেয়েও আগে। কিন্তু আমরা হয়তো ইতিমধ্যেই দেরি করে ফেলেছি।”

 “আমরা যতো দ্রুত সম্ভব ঠিক ততোটাই দ্রুত এসেছি…”

 “সেটা ঠিক আছে। কিন্তু এটা আমার জন্মভূমি। সমরকন্দের স্বপ্ন আমাকে এতটাই বিমোহিত করে রেখেছিল যে আমি আমার জন্মভূমির কথা বিস্মৃত হয়েছিলোম। আমি যদি বেপরোয়াভাবে উচ্চাভিলাষী না হতাম, তাহলে আজও হয়তো আমি এর সুলতান থাকতাম। আর সাইবানি খানও আমার বোনকে কুক্ষিগত করতে পারত না…”

“হাড়হারামী উজবেকদের কাছে কেউই নিরাপদ না। সাইবানি খান আপনার সাথে শত্রুতা করে যাবে যতদিন আপনি বা অন্যকেউ- বেজন্মাটার মাথা তার ধড় থেকে আলাদা না করছে…”

বাবর সম্মতি জানায়। বাবুরীর কথাই সম্ভবত ঠিক। এমন কিছু হয়তো ভিন্ন হতো না। দিগন্তের বুকে বেশতর পাহাড়ের পরিচিত, আঁকাবাঁকা আকৃতি চোখে পড়তে যে অপরাধবোধ আর বিষণ্ণতা নেমে এসেছিলো তা কিছুটা হলেও প্রশমিত হয়।

বৃষ্টি শুরু হয়। বাবর উঠে দাঁড়িয়ে উপরের দিকে মুখ তোলে, টের পায় বৃষ্টির ফোঁটা তার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। বৃষ্টি এভাবে পড়তে থাকলে আজ রাতে আর আগুন জ্বালানো যাবে না। ঝলসানো মাংসের বদলে, সেরাম থেকে আনা বাসি রুটি আর শুকনো কিন্তু মিষ্টি খুবানি, যা তাদের পর্যানে রয়েছে তাই খেয়ে তাদের ক্ষুধা নিবৃত্তি করতে হবে এবং ভেজা মাটিতে পেটের গুড়গুড় আওয়াজ শুনতে শুনতে ঘুমাবার চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু একটাই শান্তি সে শীঘ্রই তার জন্মভূমি আবার দেখতে পাবে এবং তার সঙ্গের সামান্য লোকবল নিয়েই সাইবানি খানকে হামলা করার একটা সুযোগ পাবে।

***

বাবরের গুপ্তদূতেরা প্রথম জিনিসটা দেখতে পায়- আকশি থেকে চল্লিশ মাইল দূরে তিকান্ড বসতি থেকে আগুনের ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। গ্রামটা সে খুব ভালো করেই চেনে, বিশেষ করে আব্বাজানের সাথে শিকারে আসবার কথা তার ভালোই মনে আছে। যখন সে তার সাদা রঙের ছোট নাদুসনুদস টাটু ঘোড়াটা নিয়ে তৃণভূমির সাদা তিনপাতা বিশিষ্ট ক্লোভার গাছের মাঝে হরিণ তাড়া করতো, বা গ্রামের বাচ্চাছেলেদের সাথে মিরতিমুরি তরমুজের ক্ষেত থেকে লেজবিশিষ্ট নধর তিতির দাবড়ে দিত। তিকান্ড ছিলো সুন্দর, সমৃদ্ধ একটা গ্রাম, যার উর্বর জমিতে পানি সরবরাহের জন্য একটা জটিল সেচব্যবস্থা ছিলো।

কিন্তু এখনকার এই তিকান্ড একদম আলাদা। বাবর নিজেও একটু পরে আকাশে কালো আর ঝাঁঝালো ধোয়া আকাশে ভেসে উঠতে দেখে। চা গরম করবার জন্য। গোবরের ঘুঁটে দিয়ে এই আগুন জ্বালানো হয়নি বা দুপুরের খাবার রান্নার জন্যও না। পুরো গ্রামটাই সম্ভবত আগুনে পুড়ছে।

 সে আর তার লোকেরা অস্ত্র হাতে সামনে এগিয়ে যায়, কোথাও কিছুই নড়াচড়া করে না, এমনকি কোনো পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দও ভেসে আসে না। তাদের সামনে সূর্যের আলো পড়তে একটা খালের পানি চিকচিক করে কিন্তু এর চারপাশের আপেল, নাশপাতি আর খুবানির একদা সুন্দর বাগানের গাছগুলো ধবংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। প্রতিটা গাছের কাণ্ড কেটে ফেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। তরমুজের ক্ষেতেও যেনো মত্ত মাতালের তাণ্ডব।

কিন্তু খারাপটা আরও সামনে ছিলো। একটা গাছ কেবল দাঁড়িয়ে আছে একটা হৃষ্টপুষ্ট আপেলের গাছ, যা শীঘ্রই সাদা গোলাপী ফুলে ভরে উঠবে ভালো ফলনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে। কিন্তু গাছটা ইতিমধ্যে ভরে উঠেছে পাঁচটা বাচ্চাছেলের লাশ এর শক্তপোক্ত ডাল থেকে ঝুলে আছে। তাদের রুক্ষভাবে কাটা চুল, পরণের মোটা সুতার টিউনিক, আর পায়ে পরিহিত আচ্ছাদন ছেলেবেলায় সে নধর তিতির। যাদের সাথে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতে সেইসব মসৃণ ত্বকের হাস্যোজ্জ্বল আর অন্তরঙ্গ ছেলের দলের মতো। কেবল একটাই পার্থক্য এদের মুখ ফুলে বেগুনী হয়ে আছে। কোটর থেকে চোখ বের হয়ে এসেছে এবং রুক্ষ্ম দড়ি তাদের কোমল ত্বকের যেখানে কামড় বসিয়েছে, গলার সেই জায়গাটায় রক্ত জমে আছে। জমাট বাঁধা রক্তের চারপাশে মাছি ভনভন করছে। বাবর এগিয়ে গিয়ে বাতাসে দুলতে থাকা একটা বাচ্চাছেলের গাল স্পর্শ করে। বেচারার ত্বক তখনও হাল্কা উষ্ণ রয়েছে।

 “দড়ি কেটে এদের নামাও।”

 “সুলতান, এদিকে দেখেন।” বাইসানগার, খাল থেকে পানি তুলে রাখার জন্য নির্মিত কাছের একটা ইঁদারার দিকে দেখায়।

ঘোড়া থেকে নেমে, বাবর উঁকি দিতে নিচে নারী আর পুরুষের দলা হয়ে পড়ে থাকা লাশের স্তূপ দেখতে পায়। সে যতোটুকু দেখতে পায়, বুঝতে পারে সবারই শিরোচ্ছেদ করা হয়েছে। পঞ্চাশ ফিট দূরে, বাজারে বিক্রির জন্য যেভাবে পাকা তরমুজ সাজিয়ে রাখা হয় তেমনিভাবে মাথাগুলো একটা নিখুঁত স্তূপে সজ্জিত। স্তূপের একেবারে উপরের মাথাটা উড়তে থাকা সাদা দাড়ির এক বৃদ্ধের। প্রপিতামহ না হলেও সম্ভবত একজন পিতামহ। তার কর্তিত রক্তাক্ত লিঙ্গ দুঠোঁটের মাঝে খুঁজে দেয়া হয়েছে আর চোখের কোটরে ঠাই পেয়েছে অণ্ডকোষ দুটি।

 বাবর আর তার লোকেরা নিরবে টিকান্ডের কেন্দ্রস্থল পর্যন্ত এগিয়ে যায়। উজবেক বর্বরগুলো বাড়ি আর আস্তাবল পুড়িয়ে কেবল অগ্নিদগ্ধ একটা খোলস রেখে গিয়েছে। চারপাশে মৃতদেহ পড়ে আছে। কিছু কিছু লাশ এমন অশ্লীল ভঙ্গিতে বিন্যস্ত যেনো দেখে মনে হয় মৃত্যুর যন্ত্রণার মাঝেও তারা রমণে উদগত হয়েছিলো। উজবেকরা নিশ্চয়ই দ্রুত এগিয়ে গিয়েছে, তাই পশুর পাল নিয়ে যেতে পারেনি। সেজন্য তারা অবলা প্রাণীগুলোর অঙ্গহানি করেছে, তাদের পেশীত কেটে দিয়ে গিয়েছে। বাবর তার লোকদের বলে যেসব পশু তখনও বেঁচে আছে তাদের যেনো জবাই করা হয়।

আধ ঘণ্টা পরে, তার লোকেরা যখন আদেশমত নির্মম কাজটা পালন করতে ব্যস্ত, তার এক গুপ্তদূত- একজন সৈনিক, কাছের বারা কোহ পর্বতের পাদদেশে যারা পরিবার বসবাস করে, এবং এলাকাটা যে ভালো করেই চেনে- বল্পিত বেগে ঘোড়া হাঁকিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসে। তার চোখে মুখে একটা জরুরীভাব ফুটে রয়েছে।

“কি খবর?”

 “আমরা উজবেকদের কাফেলার খোঁজ পেয়েছি। ঘোড়ার তাজা বিষ্ঠা দেখে বোঝা যাচ্ছে মাত্র দু’ঘণ্টা আগে তারা এখান থেকে রওয়ানা দিয়েছে এবং তাদের ঘোড়ার পায়ের ছাপ দেখে বোঝা যাচ্ছে লুটপাট ভালোই করেছে কারণ খুরের দাগ মাটিতে চেপে বসে আছে এবং ধীরে ধীরে অগ্রগামী হচ্ছে। তারা মনে হয় আকশির দিকেই এগিয়ে চলেছে।

 “দারুণ। আমরা রওয়ানা দিচ্ছি।”

 বাইসানগার, আর বাবুরীকে দুপাশে নিয়ে বাবর গুপ্তদূতদের অনুসরণ আরম্ভ করে। সে আর তার লোকেরা যদি উজবেক হানাদারদের অতিক্রম করে একবার এগিয়ে যেতে পারে,তাহলে সে এখানের এই নির্মমতার হিসাব তাদের কাছ থেকে কড়ায়গণ্ডায় উসুল করবে- রক্তের বদলে রক্ত, চিৎকারের বদলে চিৎকার। কৃষক যেভাবে কাক মেরে থাকে, ঠিক তেমনি তাচ্ছিল্যে হত্যা করা ঐসব বাচ্চাদের মৃত্যুর বদলা অবশ্যই নেয়া হবে।

 তিকান্ড থেকে প্রায় পনের মাইল দূরে এক পাথুরে, আগাছাপূর্ণ ভূমি অতিক্রম। করতে গিয়ে তারা উজবেকদের পায়ের চিহ্ন হারিয়ে ফেলে। উচবেকরা সম্ভবত একপাশে সরে গিয়ে অন্য কোনো গ্রাম আক্রমণ করতে অগ্রসর হয়েছে কিন্তু তিকান্ড আর আকশির মাঝে হামলা করার মতো কোনো জনবসতি নেই। বাবর অপেক্ষা। করার সিদ্ধান্ত নেয়। উজবেকরা যদি টের পায় তাদের অনুসরণ করা হচ্ছে তাহলে, সেই হয়তো উল্টো ফাঁদে গিয়ে পড়বে। সে দু’জন গুপ্তদূত সামনে পাঠায় আর চারজনকে ঘুরে পেছনটা দেখতে বলে। দু’জন বামদিক দিয়ে আর দু’জন ডানদিক দিয়ে ঘুরে আসবে, তাদের দায়িত্ব দেয়া হয় উজবেকরা পেছন থেকে আক্রমণের পায়তারা করছে কিনা সেটা দেখার দায়িত্ব তাদের দেয়া হয়।

 বাবর আর তার বাকি লোকেরা নিরবে, চোখ কান খোলা রেখে অপেক্ষা করতে থাকে। ঘোড়ার লাগাম শক্ত করে ধরা, যাতে প্রয়োজন হলে মুহূর্তের ভিতরে দৌড় শুরু করা যায়। বেশ কিছুক্ষণ পরে সামনে পাঠানো এক গুপ্তদূত ফিরে আসে।

“সুলতান, আমরা উজবেকদের খুঁজে পেয়েছি। ব্যাটারা জঙ্গলে ঢুকেছিলো।”

উজবেকদের রেখে যাওয়া সংকীর্ণ পথ দিয়ে ঘোড়া নিয়ে যাবার সময় বাবর ভাবতে থাকে এই ঘন অন্ধকার অরণ্যে ব্যাটারা কেন প্রবেশ করেছে। আকশি পৌঁছাবার এটা দ্রুততম পথ না। তারপরে বিদ্যুৎ চমকের মতো তার মনে পড়ে। বহু আগে, তার বাবার সাথে শিকারে আসলে, যা এখন বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গিয়েছে, তিনি তাকে বনভূমির উত্তরে নিচু টিলার মাঝে অবস্থিত বিখ্যাত আয়না পাথর দেখিয়েছিলেন। অতিকায় পাথরটা দেখে সে বিমোহিত হয়েছিলো। প্রায় ত্রিশ ফিট লম্বা, এবং মাঝে মাঝে এক মানুষ সমান লম্বা পাথরটার ধূসর উপরিভাগ মোটা মোটা পাথুরে স্ফটিকের শিরায় শোভিত। যেখানে দুপুরবেলা সূর্যের আলো পড়তে পাথরটা আয়নার মতো চমকায়, উজ্জ্বল আলোর রশি বিকিরিত করে। বলা হয়ে থাকে পাথরটার অতিন্দ্রীয় ক্ষমতা রয়েছে…কোনো যোদ্ধা যদি পাথরটার ধারালো প্রান্তে নিজের তরবারির ফলা ঘষে নেয়, তবে যুদ্ধক্ষেত্রে কেউ তাকে পরাস্ত করতে পারবে না। উজবেকরা সম্ভবত তাদের রক্তের লালসা প্রশমিত হতে- এখন। পাথরটা দেখে এর শক্তি পরখ করতে চায়।

আধ ঘণ্টা পরে, বাবর আর তার লোকেরা বনের মাঝে একটা খোলা স্থানে বের হয়ে আসে। সেখানে আবার ঘোড়ার পায়ের ছাপ দেখতে পায় উত্তর দিকে এগিয়ে গিয়েছে। বাইসানগার আর বাবুরীকে পাশে ডেকে এনে বাবর তাদের আয়না পাথরের কথা বলে। “উজবেকরা যদি আসলেই সেখানে গিয়ে থাকে আমরা তাহলে তাদের বেকায়দায় ফেলতে পারি। তারা চিন্তাও করবে না কেউ তাদের অনুসরণ করতে পারে। কিন্তু আমাদের তবুও সতর্ক থাকতে হবে… আমার যদি ঠিক ঠিক স্মরণ থাকে, তবে পাথরটা এখান থেকে তিন মাইল দূরে অবস্থিত। আমার লোকদের যতোটা সম্ভব নিরবতা পালন করে অস্ত্র হাতে প্রস্তুত থাকার আদেশ দেন…’

 বাবর আর তার লোকেরা সন্তর্পণে এগিয়ে যেতে একটা নিচু টিলার শৈলপ্রান্তের উপর দিয়ে উজবেকদের হট্টগোল আর হাসির শব্দ ভেসে আসতে শুনে। বাবর তার লোকদের ঘোড়া থেকে নামার আদেশ দেয় এবং ছয়জন যোদ্ধাকে ঘোড়াগুলো আগলে রাখার দায়িত্বে রেখে যে টিলার পেছন থেকে কর্কশ কোলাহলের শব্দ ভেসে আসছে বাকি সৈন্যদের নিয়ে সেটার উপরে উঠে আসে। গুঁড়ি দিয়ে অবস্থান করে তারা ঝুঁকে নিচের দিকে তাকায়।

তখন প্রায় দুপুর হয়ে এসেছে এবং সূর্যের আলোয় আয়না পাথর এমন চমকাচ্ছে যে, বাবর চোখ বন্ধ করে নেয়। তারপরেও বন্ধ চোখের পাতার নিচে উষ্ণ সাদা বিন্দু নাচতে থাকে। পাথরটার উজ্জ্বলতার কথা সে ভুলে গিয়েছিলো। হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে, সে আবার নিচের দিকে তাকায়। পাথরের নিচে উজবেক দস্যুর দলটা অলস ভঙ্গিতে শুয়ে আছে। চামড়ার তৈরি মদের মশক- কিছু ভর্তি, কিছু খালি- তাদের চারপাশে ছড়ানো ছিটানো অবস্থায় পড়ে আছে। তাদের অস্ত্রশস্ত্রেরও একই দশা। তাদের সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশ জন হবে সব মিলিয়ে। পাথরের ডান দিকে গাছের সারির নিচে টিকান্ড থেকে লুট করা মালামাল বোঝাই অবস্থায় দড়ি দিয়ে বাধা।

সহসা বাম দিকে কোথাও থেকে উচ্চকণ্ঠের একটা চিৎকারের আওয়াজ ভেসে আসতে বাবর চমকে ফিরে তাকায়। দুই উজবেক অর্ধনগ্ন এক মহিলার দু’হাত ধরে টেনে তাকে পাথরের পাদদেশে নিয়ে আসছে। আরও চিৎকারের রোল উঠে উচ্চসুরে আর তীক্ষ্ণ- উজবেকরা নিশ্চয়ই পাথরের আড়ালে তাদের মহিলা বন্দিদের লুকিয়ে রেখেছিলো নিজেদের অবসর সময়ে তাদের সঙ্গ উপভোগ করবে বলে।

 উজবেকরা আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে চিৎকার করতে থাকা মহিলার পরণের কাপড় ছিঁড়ে তার কোমল ধুসর দেহ নগ্ন উন্মুক্ত করে। তারপরে একজন হাটু মুড়ে বসে তার কব্জি মাটিতে চেপে ধরে রাখে। আর আরো দু’জন তার দু’পা দু’পাশে টেনে ধরে তাকে অসহায় অবস্থায় চার হাতপা মেলে রাখা একটা প্রতিকৃতিতে পরিণত করে। তখন চতুর্থ একজন সেঁতো হাসি মুখে লটকে পাজামার বেল্ট খুলতে আরম্ভ করে। বাবরের মস্তিষ্কে খানজাদার কথা ঝলসে উঠে। সে লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দিনের প্রথম তীরটা শূন্যে ভাসিয়ে দেয়। লোকটা তখনও তার পরণের কাপড় নিয়ে ধ্বস্তাধ্বস্তি করছে, সেই অবস্থায় তীরটা তার কণ্ঠ বিদীর্ণ করে। চোখেমুখে একটা অবিশ্বাসের অভিব্যক্তি নিয়ে নিজের গোপনঅঙ্গ আকড়ে ধরে সে পেছনে উল্টে পড়ে।

বাবরের দ্বিতীয় তীরটা মেয়েটার কব্জি আঁকড়ে রাখা উজবেকের বাম চোখে বিদ্ধ হয়, যে তার সঙ্গির অবস্থা দেখে আহাম্মকের মতো সরাসরি বাবর পাহাড়ের উপরে আকাশের নিচে যেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেদিকে তাকিয়েছিলো।

 “ফারগানার জন্য!” হুঙ্কার তুলে বাবর তার লোকদের নিয়ে পাহাড়ের উপর থেকে নেমে আসে। তাদের সবার মনেই টিকান্ডের অধিবাসীদের হত্যাকাণ্ডের বদলা নেবার উদগ্র বাসনা।

***

“আমাদের কল্যাণে ভালই ভোজ হবে ব্যাটাদের।” বাবুরী আয়না পাথরের উপরে বাতাসে বৃত্তাকারে কালো ডানা মেলে উড়তে থাকা পাখিগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে।

 “আরও ভালো ভোজ হতো যদি বেশি থাকতো,” বাবর বিড়বিড় করে বলে। হানাদারদের এই দলটাকে নিশ্চিহ্ন করাটা মশার কামড়ের মতই নগণ্য ব্যাপার। সাইবানি খান তার ক্ষমতা আর শক্তি নিয়ে সামনে কোথাও অপেক্ষা করছে। তারপরেও সে তার নাম লিখে রেখে এসেছে: এক উজবেকের দাঁতের ফাঁকে রক্ত দিয়ে তার নাম লেখা কাগজ গুঁজে দিয়েছে। সাইবানি খান শীঘ্রই জানতে পারবে এটা কার কাজ।

“আমাদের একজন লোকও আহত হয়নি। আর তাদের সব ঘোড়া আর লুট করা সামগ্রী আমরা নিয়ে এসেছি।”

বাবর আড়চোখে দলের পেছনে আরোহীশূন্য ঘোড়ার সারির দিকে তাকায়। তার লোকেরা সাতজন মেয়েকে খুঁজে পেয়েছিলো- সবচেয়ে অল্পবয়স্ক যে, তার বয়স কোনোমতেই বারো বছরের বেশি হবে না- তারা এখন উজবেকরা টিকান্ড থেকে লুটের মালামাল বহন করার জন্য যে দুটো খচ্চরটানা গাড়ি নিয়ে এসেছিলো তাতে আলখাল্লা মুড়ে বসে রয়েছে। আরও এগিয়ে যাবার আগে তাদের একটা বন্দোবস্ত করতে হবে। এখান থেকে পূর্বে একটা বসতি রয়েছে যেখানে মেয়েরা আপাতত নিরাপদে থাকবে। সে তাদের সাথে লোক দিয়ে সেখানে পাঠিয়ে দেবে।

বাবুরী কথা বলার জন্য মরিয়া হয়ে থাকলেও, বাবর নিরবে এগিয়ে চলে। আকশির কাছাকাছি সে চলে এসেছে। কি অপেক্ষা করছে সেখানে তার জন্য? অন্য সর্দাররা কি জাহাঙ্গীরকে সহায়তা করবে? দূর্গ তোরণের সামনে সাইবানি খান হাজির হবার আগইে কি তারা তার সাহায্যে হাজির হবে? ওয়াজির খানের প্রজ্ঞার অভাব সে খুব বেশি করে অনুভব করে। তিনিও, ফারগানায় জন্ম নেয়া আর বেড়ে ওঠা একজন ছিলেন। বাবরের মনোকষ্ট তার চেয়ে ভালো আর কেউ বুঝতে পারতো না।

অন্ধকার নেমে আসতে তারা জাক্সারটাসের একটা শাখা নদীর তীরে রাতের মতো। অস্থায়ী ছাউনি স্থাপন করে। আকশির এতো কাছে তারা যেখানে আছে সেখান থেকে মাত্র দু’ঘণ্টার পথ- বাবর অনেক কষ্টে আরও এগিয়ে যাবার আকাক্ষা দমন করে। রাতের আঁধারে এগিয়ে যাওয়াটা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হতো না। উজবেক প্রহরীরা যেকোনো স্থানে থাকতে পারে।

 স্রোতস্বিনীর কিনারে বসে সে পানির বহমান ধারার দিকে তাকিয়ে থাকে। সে বোকার মতো একটা কাজ করেছে। আয়না পাথরের নিচে উজবেকগুলোকে কচুকাটা করার আগে তাদের কাছ থেকে সাইবানি খানের অবস্থান তার সেনাবাহিনীর শক্তিমাত্রা সম্বন্ধে জেনে নেয়াটা উচিত ছিলো। তারবদলে, প্রতিশোধের আগুনে অন্ধ হয়ে সে কেবল তাদের মৃত্যু কামনা করেছিলো। নাহ্, তার আরও অনেক কিছু শেখার বাকি আছে…

 “সুলতান, আমরা এই মেষপালককে তার ভেড়ার পালসহ কাছেই খুঁজে পেয়েছি। তার কথা আপনার শোনা উচিত।”

বাবর ঘুরে তাকিয়ে বাইসানগারকে দেখতে পায় এবং তার পেছনে দু’জন সৈন্যের মাঝে বছর চল্লিশের সর্তক অভিব্যক্তির এক লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। তাকে অস্থির দেখালেও বিস্মিত কোনোমতে বলা যাবে না। সে আশা করেনি এভাবে তাকে ধরে বাবরের ছাউনিতে নিয়ে আসা হতে পারে।

 “আমার লোকদের কাছে যে গল্পটা বলেছো সেটা আবার বলো। কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করবে না।”

বাইসানগার লোকটার কাধ ধরে তাকে বাবরের মুখোমুখি দাঁড় করায়।

মেষপালক গলা পরিষ্কার করে। “সাইবানি খান পাঁচদিন আগে আকশি দখল করেছে।” বাবরের দিকে সে উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে থাকে। “সবাই বলাবলি করছে। সে সুলতান জাহাঙ্গীরের সাথে প্রতারণা করেছে। সে জাহাঙ্গীরকে নাকি বলেছিলো ফারগানা নয় কেবল উপঢৌকন পেলেই সে খুশি হবে। সুলতান যদি তাকে নিজের সম্রাট বলে স্বীকার করে নিয়ে জনসম্মুখে বাৎসরিক খাজনা দিতে সম্মত হয় তাহলেই তিনি তার সেনাবাহিনী নিয়ে সমরকন্দ ফিরে যাবেন…”

 “বলে যাও।” বাবরের হাত পা সহসা শীতল হয়ে আসে।

 “আমি অবশ্যই সেখানে ছিলাম না। আমি তাই যা শুনেছি কেবল সেটাই আপনাকে বলতে পারি… তারা বলছে দূর্গের নিচে জাক্সারটাসের তীরে অনুষ্ঠানটার আয়োজন করা হয়েছিলো। লাল রেশমের চাঁদোয়ার নিচে আমাদের সুলতান সাইবানি খানের সামনে নতজানু হয়ে বসে। তিনি তখন সোনার জরির কাজ করা চাদরে ঢাকা একটা নিচু আসনে উপবিষ্ট অবস্থায় ছিলেন, এবং তাকে “প্রভু” বলে সম্বোধন করেন। সুলতান নতজানু হয়ে বসে থাকা অবস্থায় সাইবানি খান উঠে দাঁড়িয়ে মুখে কুটিল হাসি নিয়ে তার বিখ্যাত বাঁকানো তরবারি কোষমুক্ত করে। হাসি মুখে তিনি সুলতানের দিকে এগিয়ে যান। “এখন তুমি যখন আমার অধীনস্ত প্রজা, আমি তোমার সাথে যা ইচ্ছা আচরণ করতে পারি।” কথাটা বলেই তিনি তার শিরোচ্ছেদ করেন। সুলতানের শিরোচ্ছেদ ঘটাবার সাথে সাথে মৃত সুলতানের দাঁড়িয়ে থাকা অমাত্যদের উপরে সাইবানি খানের যোদ্ধারা ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের হত্যা করে।

“তামবাল?” তাকেও কি হত্যা করা হয়েছে? আর বাকি বেগ, ইউসুফ আর অন্যান্যদেরই বা কি খবর?”

“সবাই মারা গেছে। আমি আরো শুনেছি- আকশি থেকে পালিয়ে আসা দুই আস্তাবল কর্মীর কাছে যে সাইবানি খান দূর্গে প্রবেশ করে হারেমের মহিলাদের বাধ্য করেছে তার সামনে দিয়ে হেঁটে যেতে। কিছু মেয়েদের নিজের জন্য রেখে বাকিদের সে নিজের লোকদের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছে। সবশেষে তিনি মৃত সুলতানের মা রোক্সানাকে ডেকে পাঠান। তারা বলেছে, মৃত সুলতানের কাটা মাথা তার সামনে তুলে ধরতে তিনি তাকে অভিশাপ দেন, আর তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বিলাপ করতে থাকেন। তখন তার বিলাপ বন্ধ করতে সাইবানি খান তার কণ্ঠনালী ছিন্ন করার আদেশ দেন। মেষপালক বলে।”

বাবরের মাথা চক্কর দিতে থাকে। তার সংবাদবাহকরা এসব কিছুই জানতে পারেনি, এবং গল্পটাও সম্ভবত অতিরঞ্জিত। কিন্তু গল্পের সারবস্তু সম্বন্ধে বাবরের মনে কোনো সন্দেহ নেই- যে সাইবানি খান চালাকি করে জাহাঙ্গীর, তামবাল আর সবাইকে খুন করে ফারগানা দখল করেছে। রোক্সানার ভাগ্য নিয়েও তার মনে কোনো দ্বিধা নেই এবং এক মুহূর্তের জন্য সে তার মরহুম আব্বাজানের রক্ষিতার প্রতি করুণা বোধ করে।

সারারাত নির্ঘম কাটাবার পরে, সকাল বেলা, বাবর তার ঘোড়ার বাঁধন খুলে একাকী খাড়া ঢালের দিকে এগিয়ে যায়। যেখান থেকে সে জানে আকশি দেখা যাবে। তারা চূড়ায় উঠে আসতে তার স্ট্যালিয়নটার দেহ ঘামে ভিজে যায়। অনেক নিচে, তার পূর্বপুরুষদের নির্মিত তাদের এতোদিনের আস্তানা, জাক্সারটাস নদীর তীরে দাঁড়িয়ে থাকা দূর্গটা দেখতে পায়।

 দূর্গের তোরণে পতপত করে একটা নিশানা উড়তে দেখা যায়। এতদূর থেকে বাবর রঙটা ঠিকমত চিনতে পারে না। কিন্তু সে জানে আর যাই হোক সেটা ফারগানার উজ্জ্বল হলুদ বর্ণ না। সেটা সাইবানি খানের কালো নিশান। যে সমরকন্দ দখলের মতো তার পূর্বপুরুষের ভূখণ্ডও চুরি করে নিয়েছে। বাবর তার দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া কান্নার বেগ রোধ করতে পারে না, বা যন্ত্রণায় ফুঁপিয়ে উঠাও নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে না। কিন্তু সেটা কোনো ব্যাপার না। পাহাড়ের এই চূড়ায় কেউ তাকিয়ে নেই। কেবল মাথার উপরে বাজপাখির দল পাখা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে।

***

“আমাদের সামনে এটাই একমাত্র পথ।” এসান দৌলত কণ্ঠে গুরুত্ব ফুটিয়ে বলেন। জাহাঙ্গীর আর তোমার চাচাতো ভাই মাহমুদ খানকে সে যেভাবে হত্যা করেছে তোমাকেও সেভাবে সে হত্যা করবে। তৈমূরের বংশের প্রত্যেক শাহজাদাকে খুন করার শপথ সে নিয়েছে। আর আমি তোমাকে বলে রাখছি সে তার শপথ বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর।”

 “আমি তার কাছ থেকে পালাবো না। আমি কাপুরুষ নই…”।

 “তাহলে তোমাকে বোকাই বলতে হবে। তার নেতৃত্বে হাজারের উপরে যোদ্ধা রয়েছে। পুরোটা গ্রীষ্মকাল জুড়ে, সে সমরকন্দ আর ফারগানা দখল করার পরে উত্তরের তৃণভূমিতে বসবাসকারী গোত্রগুলো তার অধীনতা মেনে নিয়েছে। প্রতিদিন তার শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে আর তুমি হৃতশক্তি হচ্ছো।” এসান দৌলত আগুনে থুতু ফেলেন- বাবর তাকে আগে কখনও এমন করতে দেখেনি। “তোমার সমর্থনে কতোজন রয়েছে?” তিনি বলতে থাকেন। “পঞ্চাশজন? একশজন? বাকিরা সবাই নিজনিজ গ্রামে ফিরে গেছে। তোমার এমনকি কোনো স্ত্রী নেই…উত্তরাধিকারীর কথা বাদই দিলাম।”

এসান দৌলত তাকে সবকিছুর জন্য দোষারোপ করেন। কিন্তু বাবর কৃতজ্ঞ যে আয়েশা চিরতরে বিদায় নিয়েছে। ইবরাহিম সারুর কাছ থেকে পাঠানো কাঠখোট্টা বাতাটা যাতে তিনি বলেছেন যে, কোনো সালতানাত্তীন ভিখিরীর সাথে তিনি তার মেয়ের বিয়ে দিতে চাননি এবং বিয়ের বাধ্যবাধকতার পালা চুকে যাবার ফলে বাবর ততোটাই উৎফুল্ল হয়েছে, ঠিক যতোটা ক্রুদ্ধ হয়েছেন তার নানীজান। চিঠিটা নিয়ে এসেছিলো যে বার্তাবাহক তার ভাষ্য অনুযায়ী- সে বিয়েতে আয়েশাকে দেয়া বাবরের অলংকারও ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে- বাবরের পাঠানো বিয়ের প্রস্তাবের আগে আয়েশার সাথে তার নিজ গোত্রের যার বিয়ের কথা হয়েছিলো সেই লোকের সাথেই শীঘ্রই তার বিয়ে হবে। বাবর অবশেষে তার প্রতি আয়েশার নির্লিপ্ততার কারণ খুঁজে পেয়েছে বলে মনে করে কিন্তু তার কাছে যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল আয়েশার অন্য পুরুষের শয্যাশায়িনী হতে পারে- আয়েশাকে উষ্ণ করতে পারবে এমন যে কোনো পুরুষের প্রতি তার শুভেচ্ছা রইল।

“আমার এখন স্ত্রীকে দেবার মতো সময় নেই,” সে কাঠখোট্টা ভঙ্গিতে বলে। “আমার নিয়তি সুলতানের নিয়তি, আর আমি অবশ্যই হামলা করবো…”

“তুমি যদি সত্যিই তোমার ভাগ্যে বিশ্বাস করো তুমি কথা শুনবে। এখন পর্যন্ত সাইবানি খান তোমাকে খুঁজছে। সে জানে আয়না পাহাড়ের কাছে তার লোকদের তুমিই হত্যা করেছে এবং ইতিমধ্যে সে এটাও জেনে গিয়েছে যে তুমি এখানে, সেরামে ফিরে এসেছে। তার স্বর্ণমুদ্রার লোভে অনেকেই আছে যারা তোমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে দ্বিধা করবে না।”

 “আমি খানজাদাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলোম…”

“সেটা তুমি রাখতে পারবে না, যদি সাইবানি হারামজাদা তোমার কাঁধের উপর থেকে মাথাটাই নাই করে দেয়। আর সাইবানি যখন রসিয়ে তোমার মৃত্যুর খবর তাকে বলবে, তখন কি খানজাদার কষ্ট কিছু কমবে?” বাবরের চোখে তিক্ততা দেখতে পেয়ে বৃদ্ধার কণ্ঠস্বর কিছুটা কোমল হয়। “তোমার বয়স এখনও কম। তোমাকে ধৈর্যশীল হতে হবে। আমার মতো যখন তোমার বয়স হবে তখন তুমি বুঝতে পারবে যে পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়। কখনও কখনও সবচেয়ে সাহসী সবচেয়ে কষ্টকর বিষয় হলো- অপেক্ষা করা।”

 খুতলাঘ নিগার মাথা নাড়েন। খানজাদাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবার পরে তিনি এতোটাই নিরব হয়ে পড়েছেন যে, তার মুখ থেকে কদাচিৎ কোনো শব্দ শোনা যায়। “তোমার নানীজান ঠিকই বলেছেন। এখানে থাকলে তোমার সামনে কোনো সুযোগই নেই। সে আমাদের সবাইকে তাহলে খুন করবে। আমি নিজের জন্য পরোয়া করি না। কিন্তু তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে…ভুলে যেও না তোমার ধমনীতে কার রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে। মামুলি ডাকাতের মতো সাইবানি খান যেনো তোমাকে পরাস্ত করতে না পারে।”

খুতলাঘ নিগার তার ভারী নীল শালটা আরও ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নেন এবং ঝুড়িতে জ্বলতে থাকা আগুনের উপরে হাতটা মেলে ধরেন। শীতকাল আসতে আর বেশি দেরি নেই। সেরামের মাটির বাড়ি আর খিড়কী দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করা বাতাস সে কথাই জানান দিচ্ছে।

বাবর তার শীর্ণ গালে চুমু দেয়। “আমি তোমাদের দুজনের কথাই বিবেচনা করে দেখবো।”

 এসান দৌলত পুনরায় তার বীণা তুলে নেন। বীণাটার অবস্থা বেশ সঙ্গীন। শুক্তি দিয়ে তৈরি নার্গিস ফুলের গোছার দৃশ্যের অনেকটাই খসে পড়েছে। কিন্তু তার আঙ্গুলের মৃদু টোকায় সৃষ্ট কোমল মধুর শব্দ বাবরকে আকশিতে তার বাল্যকালে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।

 বাইরে বের হয়ে এসে সে আঙ্গিনার উপর দিয়ে হেঁটে গিয়ে গ্রামের দেয়ালের উপরে উঠে দাঁড়ায় এবং ঘনিয়ে আসা অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে নিজেই নিজের সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু মনে মনে সে জানে তার আম্মিজান আর নানীজান ঠিকই বলেছেন। তার এখন প্রধান বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত বেঁচে থাকা।

‘সুলতান।” সে তার পেছনে নিচে থেকে বাবুরীর কণ্ঠস্বর ভেসে আসতে শুনে। তার কোমরের পরিকরে তিনটা নধর কবুতর পা বাঁধা অবস্থায় ঝুলছে- নির্ঘাত সে শিকারে গিয়েছিলো। সে সিঁড়ির ছোট ছোট ধাপ নিরবে উঠে এসে দেয়ালের উপরে বাবরের পাশে নিরবে দাঁড়িয়ে থাকে।

 “বাবুরী, তুমি কখনও কি তোমার ভাগ্য নিয়ে সন্দিহান হয়েছে?”

“বাজারের ছেলের ভাগ্য বলে কিছু থাকে না। ভাগ্যে বিশ্বাসের বিলাসিতা কেবল সুলতানদের সাজে।”

 “সারাটা জীবন আমি কেবল শুনে আসছি এই পৃথিবীতে আমার জন্ম হয়েছে কিছু অর্জন করতে। সেটা যদি সত্যি না হয় তাহলে কি হবে…”

“আপনি আমার কাছে কি শুনতে চান? যে আপনি চেঙ্গিস খান আর তৈমূরের বংশধর? যে কণ্টকহীন জীবনে কেবল আপনারই অধিকার?”

বাবুরীর কণ্ঠস্বর অধৈর্য, রুক্ষ আর আবেগবর্জিত। বাবর তার সাথে তাকে এভাবে আগে কখনও কথা বলতে শোনেনি। “আমার কপালটাই খারাপ।”

 “না আপনার কপাল খারাপ না। জন্মের কারণেই আপনি ভাগ্যবান। আপনার সবকিছু আছে। আপনি এতিম নন। আপনাকে আমার মতো আস্তাকুড়ের খাবারের জন্য মারামারি করতে হয়নি।” সহসা বাবুরীর নীল চোখে ক্রোধ ঝলসে উঠে। “আকশি থেকে ফিরে আসবার পর থেকেই আমি আপনাকে খেয়াল করছি, কেমন আত্ম-বঞ্চনার একটা আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছেন। আশেপাশের কারো সাথে কোনো কথাই বলছেন না। আপনি কেমন বদলে গিয়েছেন। ইয়াদগার যখন আপনার কণ্ঠলগ্না থাকতো, বা আমরা যখন একসাথে ঘোড়া নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম, আপনি তখন এমন ছিলেন না। সেটা ছিলো বাঁচার মতো বেঁচে থাকা। আপনি ভুলেই গেছেন কেমন ছিলো সেই জীবনটা। বিপর্যয়ের মুখোমুখি হলে আপনি যদি এভাবে মুষড়ে পড়েন, তাহলে সম্ভবত আপনি এই মহান নিয়তি’র- খোদামালুম সেটা কেমন যোগ্য নন, যা আপনি একটা বোঝার মতো বহন করে চলেছেন।”

কিছু বুঝে উঠার আগেই, বাবর বাবুরীকে লক্ষ্য করে সপাটে ধাক্কা দেয় এবং দুজনে জড়াজড়ি করে দেয়ালের উপর থেকে নিচের শক্ত মাটিতে আছড়ে পড়ে। দুজনের ভিতরে বাবর ওজনে ভারী এবং সে বাবুরীকে মাটিতে ঠেসে ধরে। কিন্তু বাইম মাছের মতো পিচ্ছিল বাবুরী একপাশে মোচড় দিয়ে সরে যেতে চায় এবং এক হাতের আঙ্গুল দিয়ে বাবরের চোখে একটা বেমক্কা খোঁচা দেয় আর অন্য হাতে মাথার পাশে একটা সিক্কা ওজনের ঘুসি বসিয়ে দেয়। ব্যাথায় গুঙিয়ে উঠে বাবর গড়িয়ে সরে গিয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায় এবং বাবুরীর উপরে আবার ঝাঁপিয়ে পড়ে, জড়িয়ে ধরে। বাবুরীর মাথা এবার দু’হাতে শক্ত করে ধরে মাটিতে ঠুকতে শুরু করে। কিন্তু মুহূর্তের ভিতরে বাবুরী পা এসে তার উরুদ্বয়ের সন্ধিস্থলে নিজের সদম্ভ উপস্থিতি জানান দেয়। যন্ত্রণায় কোঁকাতে কোঁকাতে সে বাবুরীকে ছেড়ে দেয় এবং গড়িয়ে সরে যায়।

তাদের দু’জনেরই চুল উসকোখুসকো আর এলোমেলো পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকে। বাবুরীর নাক দিয়ে দরদর করে রক্ত ঝরছে, এবং বাবর টের পায় কানের উপরের একটা কানা জায়গা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। আর বাবুরী বাম চোখে যে খোঁচাটা মেরেছিলো সে জন্য এখনই ওই চোখটা খোলা রাখতে সমস্যা হয়।

“আপনি দারুণ একজন পথিক রঙবাজ হতে পারতেন অনায়াসে।” বাবুরী বলে। “আপনাকে কখনও অনাহারে থাকতে হবে না- ভাগ্য সহায় থাকুক বা না থাকুক।” তাদের হাতাহাতির শব্দে সচকিত হয়ে, লোকজন দ্রুত দেয়ালের উপর দিয়ে তাদের দিকে দৌড়ে আসে। একেবারে সামনে রয়েছে উদভ্রান্ত চেহারার বাইসানগার, দু’জনের তার অভিব্যক্তির দিকে তাকিয়ে হো হো করে হেসে উঠে।

*

বাতাস এতো ঠাণ্ডা যে বাবরের মুখে যেন খোঁচা মারছে। প্রতি দুই কি তিন পা সামনে এগোবার পরেই তার পায়ের চামড়ার বুট জুতো বরফে পিছলে যায়। কিন্তু তার পরেও ফারগানা থেকে দক্ষিণমুখী এই খাড়া গিরিপথটা সাইবানি খানের ধাওয়াকারী সৈন্যদের নাগালের বাইরে পালিয়ে থাকার জন্য একমাত্র ব্যবহারযোগ্য পথ এবং তার লোকেরা বাবরের দলবলকে শিয়ালের মতো তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে আর যেখানে পাচ্ছে নির্বংশ করে ছাড়ছে।

তাদের সাথে ঘোড়া না থাকার কারণে বাবরের নিজেকে কেমন নাঙ্গা মনে হয়। যদিও বরফাকীর্ণ পাহাড়ের এই উচ্চতায় কারো মুখোমুখি হবার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। সে আর তার লোকেরা সবসময়েই অশ্বারোহী ছিলো কিন্তু এই মুহূর্তে নিজের সহ্য ক্ষমতার উপরেই তাদের নির্ভর করতে হবে। নিচের ঢাল বেয়ে যাত্রা শুরুর প্রথম কয়েকদিন বাবর তার সাথে করে যে চারটা খচ্চর নিয়ে এসেছিলো তার মালপত্র বহন করার জন্য তার দুটোতে খুতলাঘ নিগার আর এসান দৌলতকে উঠিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু ঢাল ক্রমশ খাড়া হতে শুরু করতেই আবহাওয়া আরও বিরূপ হয়ে উঠতে, বাবর খচ্চরগুলোকে জবাই করে তাদের মাংস সংরক্ষণের আদেশ দেয়।

তারপরে এসান দৌলত আর খুতলাঘ নিগারকে কখনও কখনও তার সবচেয়ে শক্তিশালী লোকদের কাঁধে করে বহন করা সম্ভব হয়েছে। আর বাকী সময়টা বাবরের সাথে তখনও যে জনা চল্লিশেক লোক রয়েছে তাদের মতোই নিজেদের দুজন পরিচারিকাসহ দুজনকেই হাঁটতে হয়েছে। জমে থাকা বরফের উপরে কাঠের লাঠিকে সম্বল করে উপর দিকে উঠতে হয়েছে। খুতলাঘ নিগার তার ভারসাম্যবোধ আর চটপটে ভাব দিয়ে নিজের ছেলেকে বিস্মিত করেছেন। নিজের দুর্বল মায়ের খাতির কোনো ধরণের সাহায্য তিনি নিতে চাননি। বাবর এখনও তাকে সামনে এগিয়ে যেতে দেখে। ভেড়ার চামড়ায় আপাদমস্তক ঢেকে থাকার কারণে তার কিছুই দেখা যায়। অনেক লোকের চেয়ে দ্রুত গতিতে পাথরের উপর দিয়ে এগিয়ে চলেছে। কাশিমের চেয়েও তিনি ভালোই অগ্রসর হচ্ছেন। সে নিয়মিত বিরতিতে আছাড় খাচ্ছে আর দৃশ্যতই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

আশ্রয়ের জন্য তাদের সাথে কেবল চারটা পশমের আস্তরণ দেয়া তাবু রয়েছে। আর সামান্য কিছু ভেড়ার চামড়া একটা লাঠির সাথে মুড়িয়ে বাঁধা অবস্থায় আছে যা তার তিনজন লোক একজনের পেছনে আরেকজন দাঁড়িয়ে কাঁধে করে বহন করছে বহন করতে পারে। বাবর নিজেও লাঠিটা বহন করেছে, মাটির উপরে দাঁড়াতে কষ্ট হবার কারণে তার পিঠ বেঁকে যায়।

আরো একদিন পরে, তারা গিরিপথ অতিক্রম করবে। সামনের উপত্যকায় অবস্থিত গ্রামে তারা হয়তো আশ্রয় নিতে পারবে এবং পরে সেখান থেকে ঘোড়াও সংগ্রহ করতে হবে। সেদিন রাতে তার চারপাশে বাবুরী আর তার সঙ্গীদের চেপে থাকা শরীরের আকর উষ্ণতার মাঝে বাবর এই ভাবনাটা থেকে স্বস্তি পেতে চেষ্টা করে।

*

দিন দুই পরে, শীতে জমে বরফ হয়ে যাওয়া একটা নহরে জলবিয়োগরত অবস্থায় একটা বাচ্চা ছেলে বিস্ময়ে হাঁ করে গিরিপথের ভেতর দিয়ে একটা জবুথবু কাফেলাকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে। তারপরে সে ঘুরে দাঁড়িয়ে কোনো দিকে আর না তাকিয়ে আরও কয়েকশ গজ সামনে পাহাড়ের ঢালে তার নিজের গ্রামের দিকে ভো দৌড় দেয়। যাবার সময়ে বারকয়েক সে বরফে বুঝি আছাড়ও খায়।

 ‘সুলতান, আমি কি সামনের অবস্থা দেখে আসার জন্য লোক পাঠাব?” বাইসানগার জানতে চায়।

বাবর মাথা নাড়ে। ঠাণ্ডায় যদিও সে আড়ষ্ঠ হয়ে আছে, গর্ব আর স্বস্তিবোধ তাকে ধীরে ধীরে উজ্জীবিত করে তোলে। সে পেরেছে। সে তার পরিবার আর লোকদের পাহাড়ের ভিতর দিয়ে নিরাপদে পার করিয়ে এনেছে। যদিও তারা এখন সংখ্যায় নগণ্য কয়েকজন। একসময়ে সে বিশাল যে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিতে তার তুলনায় সংখ্যাটা কিছুই না। এই মুহূর্তে সেটা কোনো ব্যাপার না।

কয়েক মিনিট পরে, বাইসানগারের সৈন্যরা একজনকে ধরে নিয়ে আসে। যাকে দেখতে- কয়েক পরত পুরু জোব্বা আর মাথায় কালো রঙের পশমের কাপড় ভালো করে জড়ানো- একজন বয়স্ক লোকের মতো দেখায়। তারা নিশ্চয়ই তাকে আগে থেকে বলেছে যে। কে বাবর, কারণ সে সোজাসুজি এসে তার সামনে নতজানু হয়ে। পায়ের নিচে জমে থাকা তুষারে মাথা ঠেকায়।

 “এসবের কোনো দরকার নেই।” বহুদিন পরে কেউ বাবরকে এভাবে শ্রদ্ধা দেখালো। সে লোকটার কাঁধ জড়িয়ে ধরে এবং আলতো করে তাকে দাঁড় করায়। “আমরা বহুদূর থেকে এসেছি এবং ভীষণ পরিশ্রান্ত। আর আমাদের সাথে শাহী হারেমের বাসিন্দারাও রয়েছেন। আপনি কি আমাদের আশ্রয় দেবেন?”

“বছরের শেষের দিকে গুটিকয়েকজন লোকই এখান দিয়ে যাতায়াত করে।” বৃদ্ধ লোকটা বলে। “আমি এখানকার সর্দার। আমাদের গ্রামে আমি আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।”

সেই রাতে বাবর সর্দারের বাহুল্যবর্জিত মাটির বাড়িতে আগুনের পাশে আড়াআড়ি পা রেখে বসে আছে। নিচের তলাটায় একটাই বড় ঘর। যার মেঝেতে ভেড়ার পশমের তাকিয়া রাখা শোবার জন্য- এসান দৌলত, খুতলাঘ নিগার আর সর্দারের স্ত্রী উপরের তলায় একটা ছোট ঘরে আছেন। বাইরে অবস্থিত কাঠের সিঁড়ি দিয়েই কেবল সেখানে পৌঁছানো যায়। বাবুরী তার পাশে একই ভঙ্গিতে বসে আছে এবং দু’জনেই গম্ভীর মুখে নিজেদের পায়ের ফোস্কা আর হিম-দংশ পরীক্ষা করছে।

 “মাঝে মাঝে আমার মনে হয়েছে জীবনে বুঝি আর হাঁটতে পারবো না- প্রাণে যদি বেঁচেও যাই।” বাবুরী পায়ের একটা নাজুক ক্ষতস্থান স্পর্শ করে ব্যাথায় কুঁকড়ে ওঠে।

“আমাদের কপাল ভালো। আমরা অনায়াসে পাহাড়ে পথ হারাতে বা গিরিকন্দরে আছড়ে পড়তে পারতাম।”

 “এটাকে কি ভাগ্য বলবেন, নাকি আপনার সেই অমিত পরাক্রমশালী ‘নিয়তি’?” বাবুরী হেসে বলে।

বাবরও হাসে, কিন্তু প্রশ্নটার কোনো উত্তর দেয় না।

*

সকালবেলার কুয়াশা থাকা সত্ত্বেও, বাবর একটা নিচু বরফাবৃত ঝোপের পেছন থেকে খরগোসটাকে মাথা বের করে, কান খাড়া করে রেখে একদম স্থির হয়ে বাতাস গন্ধ নিতে দেখে। খরগোসটার দিক থেকে বাতাস তার দিকে বয়ে আসছে খরগোসটার পক্ষে তার অবস্থানের কথা জানা সম্ভব না। সে যত্ন করে ধনুকের ছিলায় একটা তীর সংযোজন করে। খরগোসটার উপর থেকে নিমেষের জন্যেও চোখ না সরিয়ে নিয়ে, পরিস্থিতি নিরাপদ মনে করে যেটা এখন চকিত চোখে ইতিউতি দেখছে, ছিলাটা টেনে ধরে।

 সহসা বাবরের পেছন থেকে ধাবমান পায়ের শব্দ ভেসে আসে এবং খরগোসটা নিমেষে উধাও হয়ে যায়। মেজাজ বিগড়ে যেতে সে ঘুরে তাকিয়ে দেখে তারই একজন লোক উত্তেজিত ভঙ্গিতে হাঁপাচ্ছে। “সুলতান, কাবুল থেকে একজন দূত এসেছে। গত দু’মাস ধরে, বরফ গলতে শুরু করার পরে থেকেই সে নাকি আপনাকে খুঁজছে। সর্দারের বাসায় সে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।”

বাবরের তিক্ত মেজাজ নিমেষেই প্রশান্ত হয়ে উঠে। বাবর তার নীরের মুখ বন্ধ করে। ধনুকটা কাঁধের উপর দিয়ে গলিয়ে দিয়ে মেঠোপথ ধরে গ্রামের উদ্দেশ্যে দৌড়াতে শুরু করে। কাবুলের সুলতান, তার মরহুম আব্বাজানের চাচাতো ভাইয়ের কাছ থেকে নিশ্চয়ই বার্তাটা পাঠানো হয়েছে… কিন্তু বাবরের যতোদূর মনে পড়ে দু’জন ভিন্ন জায়গায় ছিলো। আর তাদের মধ্যে কদাচিৎ যোগাযোগ হয়েছে।

ময়ূরকণ্ঠী নীল রঙের আলখাল্লা পরিহিত। দূতের চেয়ে কেতাদুরস্ত পোশাকে বাবর বহুদিন কাউকে দেখেনি। তার ঘন কালচে নীল পাগড়িতে ঝুলন্ত স্মারকছাপে পাথর বসানো কজায় পালক আটকানো রয়েছে এবং তার সাথের দু’জন পরিচারকের পরনে নীলের উপরে সোনার জরির কাজ করা পোশাক। তার লোকেরা তাকে খুঁজে বের করার ফাঁকে তারা নিশ্চয়ই পোশাক বদলেছে। বাবর মনে মনে হাসে। পাহাড়ী পথে কেউ এসব ধড়াচূড়া পরে ভ্রমণ করবে না… যাই হোক গত কয়েক মাসের ভিতরে এই প্রথম সে নিজেকে কেমন দেখাচ্ছে সে বিষয়ে কৌতূহলী হয়- তার কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুল, হলুদ পশমের মামুলী জোব্বা আর ছাগলের নরম চামড়ার চোস্ত।

কিন্তু দূতের চেহারায় এসব নিয়ে কোনো হেলদোল দেখা যায় না। বাবর তার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে খেয়াল করে খোঁজার পালা শেষ হবার তার চোখেমুখে স্বস্তির একটা ছাপ ফুটে উঠেছে। দূত মাথা নিচু করে অভিবাদন জানায়। “সুলতান, আমার অভিবাদন গ্রহণ করুন।”

“তোমাকে স্বাগত জানাই। আমাকে বলা হয়েছে আপনি কাবুল থেকে আসছেন। আমার কাছে আপনি কি চান?”

“সুলতান, আমি বিষাদময় আবার একাধারে গৌরবান্বিত সংবাদ বহন করে এনেছি। আপনার মরহুম আব্বাজানের ভাই, আমাদের সুলতান, উলুঘ বেগ মির্জা, গত শীতে কোনো উত্তরাধিকারী না রেখে ইন্তেকাল করেছেন। তার ইন্তেকালের দু’মাস আগে তার শেষ বেঁচে থাকা পুত্রসন্তান জ্বরের কবলে পড়ে মারা যান। কাবুলের শাহী দরবার আমাকে এই বার্তাটা আপনাকে পৌঁছে দিতে বলেছে। আপনি যদি সেখানে যান, তবে সিংহাসনে আপনাকে অধিষ্ঠিত করা হবে। দরবারের অমাত্যদের ধারণা কাবুলের অধিবাসীরা তৈমূর বংশের আরেক সন্তানকে তাদের শাসক হিসাবে স্বাগত জানাবে। বিশেষ করে এমন কেউ যিনি যুদ্ধক্ষেত্রে পরীক্ষিত সেনাপতি আর বয়সে তরুণ। শাহী দরবার আপনাকে সমর্থন জানালে, যা পবিত্র কোরানের নামে তারা শপথ করে বলেছে আপনার উপরে অর্পিত করবে। আপনি কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীর সম্মুখীন হবেন না।”

বাবর তার বিস্ময় গোপন করতে হিমশিম খেয়ে যায়। কাবুলের সালতানাতের সে তার অসম্ভব, অবাস্তব কল্পনাতেও কখনও চিন্তা করেনি। বহু দূরে অবস্থিত একটা স্থান- পাঁচশ মাইলেরও বেশি হবে। সেখানে পৌঁছাতে হলে তাকে প্রশস্ত অক্সাস অতিক্রম করতে হবে আর হিন্দুকুশের আঁকাবাঁকা সর্পিল, ছুরির ফলার ন্যায় ধারালে গিরিপথের ভিতর দিয়ে যেতে হবে। কিন্তু তারপরেও পুরো ব্যাপারটাই কপালের উপরে নির্ভর করছে। সে সেখানে পৌঁছাবার মাঝে অনেক কিছুরই বদল হতে পারে। শাহী দরবারের অমাত্যরা যারা এখন তাকে সমর্থন করছে, আল্লাহতালাই ভাল বলতে পারবেন এর কারণ। তারাই হয়তো ক্ষমতাচ্যুতির ভয়ে বা প্রলোভনের বশবর্তী হয়ে অন্য প্রার্থীকে সমর্থন করে বসবে।

 কিন্তু এটাও ঠিক একটা বছর হতে চলল, বাবর ক্রমশ উত্তেজিত আর উদ্দীপিত হয়ে উঠতে উঠতে ভাবে, সে এখানে বসে কেবল খরগোস আর খরগোসের ছানাপোনা শিকার করতে পারে না। হিংস্র সাইবানি খানের নাগালের বাইরে কাবুল অবস্থিত। সমৃদ্ধ আর শক্তিশালী একটা কেন্দ্র। আবারও তার চারপাশে যোদ্ধার দল ভীড় করবে। সেখানে সে তার ক্ষমতা পুনরায় মজবুত করবে তারপরে পরবর্তী পদক্ষেপ সম্বন্ধে ভাবা যাবে।

 “ধন্যবাদ আপনাকে।” সে দূতকে উদ্দেশ্য করে বলে। “আমি শীঘ্রই আমার উত্তর আপনাকে জানাবো।” কিন্তু সে ইতিমধ্যে সেটা অনুধাবন করে ফেলেছে। তার পরবর্তী গন্তব্য হবে কাবুল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *