২.৬ মুঠোয় সোনালী হাতি এক বৃদ্ধা

১২. মুঠোয় সোনালী হাতি এক বৃদ্ধা

ফেব্রুয়ারির এক সন্ধ্যাবেলা। বাবর তার সামনের বিশাল, খোলা অগ্নিকুণ্ডে প্রজ্জ্বলিত কাঠের টুকরো হাতের লাঠি দিয়ে খোঁচা দেয় সেখান থেকে আরেকটু বেশি উষ্ণতা পেতে। তার দেহের সামনের অংশ আর মুখমণ্ডল যদিও সরাসরি উত্তাপের কারণে উষ্ণ। কিন্তু তার পরণে বাদামী রঙের মোটা পশমের আলখাল্লা থাকা সত্ত্বেও মাটির-ইটের তৈরি বাড়িটার ছোট, চাকচিক্যহীন, কোনমতে বন্ধ করা জানালার উপরে ঝুলে থাকা পর্দার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত কনকনে শীতল বাতাসের কামড় পিঠে ঠিকই অনুভব করে। এই বায়ুপ্রবাহের ফলে অবশ্য একটা লাভ হয়েছে যে চিমনি দিয়ে কিছুটা হলেও কাঠের ধোঁয়া বের হয়ে যেতে পারছে। ধোয়াটা এত ঘন আর ঝাঝালো যে বাবরের চোখ জ্বালা করছে।

 সে ভাবে যে গত শরতের সেই দিন যখন, চারপাশে বাতাসের দাপটে উড়তে থাকা তুষারের দাপটের ভিতর দিয়ে সে তার খুব বেশি হলে দুইশ লোকের বহরটা নিয়ে প্রশস্ত গিরিপথ অতিক্রম করে সেরামের এই ক্ষুদ্র বসতিতে উপস্থিত হয়েছিলো। তার পরে থেকে সে কেবল চোখের পানিই ফেলে চলেছে। সত্যি কথা বলতে, জায়গাটা আসলে একটা দেয়ালঘেরা ছোট পশুপালকদের গ্রাম। যেখানে দুটো কি তিনটা সরাইখানা রয়েছে কদাচিত উপস্থিত হওয়া আগন্তুকদের খিদমত করতে। কিন্তু দুটো কারণে স্থানটা বাবরকে আকৃষ্ট করেছে। গ্রামের গাট্টাগোট্টা সর্দার, হুসেন। মজিদ, সমরকন্দে মাহমুদের হাতে নিহত আলী মজিদ বেগের চাচাত ভাই এবং বাবরের একনিষ্ট অনুগত। আরেকটা ব্যাপার হল বসতিটা প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত। কাশগর থেকে আগত একটা মোটামুটিভাবে প্রচলিত বাণিজ্য পথের ধারে গ্রামটা অবস্থিত হলেও, ফারগানার সীমান্তচৌকী আর সাইবানি খানের বাহিনী দু’দলের কাছ থেকেই জায়গাটা অনেক দূরে।

বাবর জানে সমরকন্দ থেকে বিতাড়িত হবার পরে জাহাঙ্গীরের প্রস্তাবিত শরণ প্রত্যাখ্যান করে সে মোটেই ভুল করেনি। প্রথমত প্রস্তাবটার আন্তরিকতা বিষয়ে সে ভীষণভাবে সন্দিহান এবং দ্বিতীয়ত সে তার সৎ-ভাই আর তার নিয়ন্ত্রক তামবালের খপ্পড়ে গিয়ে পড়তে চায়নি। আর তাছাড়া, জাহাঙ্গীর আর তার ফন্দিবাজ মা, রোক্সানাকে একদা মৌন সহনশীলতা বলে সে মেনে নিয়েছিল। এখন সেই ভঙ্গুর সম্পর্ক সে ব্যবহার করতে চায় না।

বাবরের প্রত্যাখ্যান করার অর্থ হল সে তার পরিবারের মেয়েদেরও জাহাঙ্গীরের কাছে বিশ্বাস করে পাঠাতে পারবে না। তার নিজের উপস্থিতি ব্যাতীত তাদের পুনরায় সেই বন্দিদশার ভাগ্যই বরণ করতে হবে। সে যাই হোক, খুতলাঘ নিগার আর এসান দৌলত প্রস্তাবটা শোনার সাথে সাথে সেটা নিয়ে আলোচনা করতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তারা বাবরের বিপদসঙ্কুল ভবঘুরে জীবন আর তদজনিত অভাব হাসিমুখে সহ্য করতে রাজি আছেন।

 তারা এখন অন্তত মাথার উপরে আবার ছাদের নিরাপত্তা পেয়েছে এবং এই বাসস্থানের শীতল পরিবেশে নিভৃতে থাকার জন্য ছোট হলেও একটা কামরা পেয়েছেন। কিন্তু তাদের অবিন্যস্ত দীঘল চুলের জট থেকে উকুনের ডিম বাছতে গিয়ে একটা মাত্র হাতির দাঁতের তৈরি চিরুনী তাদের পালাক্রমে ব্যবহার করতে দেখে বাবর চোখের জল চেপে রাখতে পারেনি। তাদের কেউই এটা বা বিছানার ছারপোকা নিয়ে একবারও অভিযোগ জানায়নি। বাসি বা অপ্রতুল খাবারের ব্যাপারেও তাদের কোনো আপত্তি নেই- রান্নাঘরে চর্বি আস্তরনযুক্ত একটা ঢাউস তামার পাত্র থেকে প্রতিদিন ঘোড়ার শক্ত মাংস আর শালগম খেতে দেয়া হয়। এসান দৌলত, তার শ্রদ্ধেয় পূর্বপুরুষ, চেঙ্গিস খানের এটা খুবই পছন্দের খাবার ছিল বলে জানিয়ে দিয়েছেন।

নিজের উপরেই নিজে ক্ষুব্ধ বাবর ভেবেছিল, খানজাদাকে সাইবানি খানের হাতে তুলে দেবার জন্য আম্মিজান বা নানীজান তাকে দোষারোপ করবে। কিন্তু বরাবরের মতোই। এসান দৌলত তাকে আবারও বিস্মিত করেছে। একদিন সকাল হবার অনেক পরে তিনি বাবরকে মাটির দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে রেখে ভ্রুণের অবস্থানে কুঁকড়ে নিজের কক্ষে শুয়ে নিরবে কাঁদতে দেখেন। “বাবরজান কি হয়েছে যে নিজের অবস্থান আর পৌরুষ ভুলে গিয়েছো?” তিনি জানতে চান। সে কোনো উত্তর না দিলে তিনি আবার জানতে চান। এবার অনেক কোমল তার কণ্ঠস্বর। “বাবরজান, বলবে না কি হয়েছে?”

সে কোঁকড়ানো অবস্থান থেকে সোজা হয় এবং নানীজানের দিকে জবাফুলের মতো লাল চোখে তাকায়। “আপনি কি জানেন না? অনুমান করতে পারছেন না? সমরকন্দ আরো একবার হাতছাড়া হয়েছে বলে আমি নির্বিঘ্ন কিন্তু তারচেয়েও বড় কথা সাইবানি খানের কাছে এভাবে আপোষে খানজাদাকে সমর্পন করায়। আমার নিজের নিজেকে চাবকাতে ইচ্ছা করছে। পরিবার প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হওয়ায়, আর ভাই হিসাবে নিজের একমাত্র বোনকে যাকে আমি এতো ভালোবাসি, তাকে রক্ষা করতে না পারায় আমি প্রচণ্ড অপমানিতবোধ করছি। তাকে উদ্ধার করার জন্য এখনও কিছুই করতে পারছি না। এতোটাই হীনবল আজ আমি ভাবতেই নিজেকে কেমন ক্লীব মনে হচ্ছে।”

এসান দৌলত বাবরের বিশাল হাতের পাঞ্জা এবার নিজের ছোট ছোট হাতের মুঠোয় আঁকড়ে ধরে। তারপরে তিনি তাকে চেঙ্গিস খানের প্রথম স্ত্রীর ভাগ্যে কি ঘটেছিলো সেটা তাকে মনে করিয়ে দেন। “সমুদ্রের মহান অধীশ্বর হবার অনেক আগে তিনি বোর্তে নামে কোনগ্রেট গোত্রের এক পৃথুলা সুন্দরী কিশোরীকে বিয়ে করেছিলেন এবং তার গোত্রের সমর্থন নিয়ে মারকিট নামে এক প্রতিবেশী গোত্রের সাথে সংঘাতের মাধ্যমে নিজের ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়াস পান। অবশ্য, তখন তিনি নিতান্তই অনভিজ্ঞ আর মারকিটরা ছিলো ভীষণ ধূর্ত। মারকিটরা তার ছাউনি একবার অপ্রত্যাশিতভাবে আক্রমণ করে বোর্তেকে উঠিয়ে নিয়ে যায় এবং চেঙ্গিসের অনুসারী যোদ্ধাদের হয় হত্যা করে বা ছত্রভঙ্গ করে দেয়। নিঃসঙ্গ একাকী অবস্থায় তিনি কেনতাই পাহাড়ে পালিয়ে যান যেখানে মারকিটরা তাকে খুঁজে পায় না। পাহাড়ের আড়াল তিনি ভালোই ব্যবহার করেন। চেঙ্গিস খান এরপরে যতদিন বেঁচে ছিলেন প্রতিদিন পাহাড়ের দেবতার পূজা করেছেন এবং প্রতিদিনই তার উদ্দেশ্যে বলি দিয়েছেন।

“পাহাড়ে আত্মগোপন করার মাত্র এক বছরের ভিতরেই কোনগ্রেট গোত্রের গঠন করা আরেকটা বাহিনীর সহায়তায় তিনি মারকিটদের পরাজিত করেন এবং বোর্তেকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করেন। কয়েক মাস পরে সে যখন তার প্রথম পুত্রসন্তানের জন্ম দেয়, যার নাম রাখা হয় জর্চি, কারো সাহস হয়নি সেই ছেলের পিতৃত্ব নিয়ে কোনো প্রশ্ন করে। বড় হয়ে এই ছেলে চেঙ্গিস খানের অন্যতম এক সেনাপতি হয়েছিলেন।

“খানজাদা আর বাবর তোমরা দুজনেই চেঙ্গিস খান আর বোর্তের রক্ত বহন করছো। কখনও হতাশ না হয়ে কঠোর বাস্তবের মোকাবেলা করে পরিণামে জয়ী হবার মতো তোমার সাহস।” এসান দৌলত এবার শক্ত করে তার হাত আঁকড়ে ধরে। “যতো কঠিন আর কষ্টকরই হোক নিজের মনোবল শক্ত কর। পেছনে না তাকিয়ে সামনের দিকে কেবল সামনে তাকাবার মতো ইস্পাত কঠিন করো নিজের মন।”

নানীজানের সেই সান্ত্বনাবাণী সত্ত্বেও, আজও সাইবানি খানের রুক্ষ্ম হাত তার বোনের কোমল দেহের গোপনতম প্রান্তরে বিচরণ করছে মনে হতেই বিতৃষ্ণা আর বিবমিষাবোধ তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। মুষ্ঠিবদ্ধ হাতের তালুকে চেপে বসা নখে সে নিজের সমস্ত মানসিক শক্তি একত্রিত করে ভাবনাগুলোকে মন থেকে সরিয়ে দেয়। তারপরে সে আল্লাহতালার কাছে দোয়া করে, তার বোন যেনো বেঁচে থাকার মতো মানসিক শক্তি বজায় রাখতে পারে- যেমনটা বজায় রেখেছিলেন বোর্তে এবং সাইবানি খানের কথামত চলে। সে প্রতিবাদ করতে চাইলে সেটা তার মৃত্যুই ডেকে আনবে। তাদের দুই ভাইবোনের পক্ষে সে একাই সাইবানি খানের সাথে যুদ্ধ করবে তাকে পরাভূত করতে আর তাকে এবং পরিবারের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করবে।

এখন যদিও মধ্যরাত্রি প্রায় সমাগত এবং কামরার ভিতরে তার চারপাশে সবাই ঘুমে বিভোর। মাঝে মাঝে বিক্ষিপ্ত নাসিকাগর্জন তার সাক্ষী। নিজের ভাবনা নানা কারণে বিক্ষিপ্ত। তার সাথে যা ঘটে গিয়েছে সেসব কারণে অসহায় আর অস্থির এবং সর্বোপরি ভবিষ্যতের গর্ভে তার আর তার পরিবারের জন্য আরও কি ভোগান্তি অপেক্ষা করছে ভেবে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ বাবর ঘুমাতে চেষ্টা করে। ঘুম পাবার বদলে ক্রুদ্ধ কিন্তু অক্ষম আক্রোশে রক্ত টগবগ করতে থাকলে, সে আলখাল্লাটা গায়ে চাপিয়ে নেয় এবং এলামেলোভাবে শুয়ে থাকা পরিচারকদের ঘুমন্ত শরীরের উপর দিয়ে নিজের ভাবনাগুলোকে গুছিয়ে নিতে, মনকে প্রশমিত আর শীতল করতে সে রাতের হাড় কনকনে শীতে ভেতর বাইরে বের হয়ে আসে।

 বাইরে, আকাশে তারার মেলা, এবং একটু আগে যে তুষারপাত হয়েছে জমে বরফের কুচিতে পরিণত হয়েছে। কনকনে হিম বাতাস প্রাঙ্গণের উপরে ঝড়ের মতো বইছে। গ্রামটা ঘিরে রাখা মাটির দেয়ালের দিকে সে এগিয়ে যায়। মাটির এবড়োখেবড়ো ধাপ বেয়ে সে দেয়ালের উপরে উঠে এবং সামনের আবছা সাদা ভূপ্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকে। গিরিপথের উপরে পাহাড়ের চূড়ায় চাঁদের আলো পড়ে চমকায়। পুরো দৃশ্যপটের অনাবিল সৌন্দর্যের দিকে সে রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে থাকে।

 সহসা পশুর খোয়াড়ের দিক থেকে সে একটা নিঃসঙ্গ কান্নার আওয়াজ ভেসে আসতে শুনে। তারপরে হট্টগোলের ভিতরে আরেকটা আওয়াজ ভেসে আসে। মিনিটখানেক পরে ঠিক তার নিচে বরফের উপর দিয়ে একটা কালো জন্তু ছুটে এসে দাঁড়ায় এবং বরফাবৃত মাটির উপর দিয়ে ছুটে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। প্রাণীটা পালিয়ে যেতে, পশুর খোয়াড়ের রক্ষীরা তাকে লক্ষ্য করে তীর ছুঁড়তে থাকে। ধাওয়া দিয়ে তারা জন্তুটাতে তাড়িয়ে এনেছে। বাবর এখন দেখে প্রাণীটা একটা ধূসর বর্ণের বেশ লম্বা নেকড়ে, মুখে কিছু একটা কামড়ে ধরে রেখেছে- খুব সম্ভবত মুরগী।

“ব্যাটাকে মারতে পারলে…” দেয়ালের নিচ দিয়ে একজন প্রহরী দৌড়ে যেতে বাবর তার কাছে প্রশ্ন করে।

 “না, সুলতান। গত কয়েক রাত ধরে আমাদের গৃহপালিত পশুদের আক্রমণ করছে এই ধূর্ত নেকড়েটা। প্রথমে ঘোড়ার আস্তাবলের দিকে সে ভেতরে প্রবেশের একটা রাস্তা খুঁজে বের করে এবং গত বছর জন্ম নেয়া একটা অশ্বশাবককে আক্রমণ করার চেষ্টা করে। সেটা অসুস্থ ছিলো বলে আমরা তাকে চিকিৎসা করার জন্য আলাদা করে রেখেছিলাম। ঘোড়ার দল তাদের পায়ের খুর দিয়ে ব্যাটাকে সে রাতের মতো তাড়িয়ে দেয়। গতকাল সন্ধ্যাবেলা সে ভেড়ার খোয়াড়ে ঢুকে আর আমরা তাকে তাড়িয়ে দেবার আগে একটা ছোট ভেড়ীকে এমন বাজেভাবে কামড়ে দেয় যে আমরা বাধ্য হই তাকে জবাই করতে- আজ রাতে আমাদের মাংসের সুরা ঘোড়ার মাংসের দিলে এটার মাংস দিয়েই তৈরি হয়েছিলো, স্বাদ পরিবর্তনের জন্য। কিন্তু আজ রাত নেকড়েটা মুরগীর খোয়াড়ে ঢুকে, আর মুরগীদের চিৎকারে আমরা আসবার আগেই একটা মুরগী নিয়ে হারামজাদা পালিয়ে যায়। নাছোড়বান্দার মতো লেগে থাকার পুরস্কার সে পেয়েছে।”

বাবর আবার সামনের অন্ধকার প্রান্তরের দিকে তাকায়, যেখানে বিজয়ী নেকড়েটা হারিয়ে গেছে। সম্ভবত তার জন্য এটা একটা ইঙ্গিত। বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে, চেঙ্গিস খানের তৈমূরের মতো- অটল থাকতে হবে। নিজের অভীষ্ট সিদ্ধির জন্য ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করো। লক্ষ্য আদায় না হওয়া পর্যন্ত হাল ছাড়বে না। নেকড়েটা ঘোড়া আর ভেড়ার খোঁয়াড়ে হামলা চালিয়ে ব্যর্থ হলেও মুরগীর খোয়াড় আক্রমণ করে ঠিকই সফলতা লাভ করেছে। সমরকন্দ আর ফারগানার প্রতি এই মুহূর্তে কম মনোযোগ দিয়ে তার উচিত সম্ভবত অন্যকোনো এলাকার কথা বিবেচনা করা, যেখানে সে নিজেকে শাসনকর্তা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে পারে, সালতানাৎ বাড়িয়ে তোলার আগে। তার নায়ক তৈমূর চীন থেকে ভারতবর্ষ এবং তুরস্ক পর্যন্ত উন্মত্তের মত হামলা করেছেন।

 বাবর দেয়ালের উপর থেকে নেমে বাসার দিকে ফিরে আসবার সময়ে সে নিচু চালাযুক্ত মহিলা পরিচারিকাদের বাসস্থান অতিক্রম করে। বহুদিন পরে সে প্রথমবারের মতো তার বাবার বিশ্বাস জোরে জোরে নিজেকে আউড়াতে শোনে: “তৈমূরের রক্ত আমার শরীরে।” বাকি রাতটুকু সে নির্বিঘ্নে আর শান্তিতে ঘুমিয়ে কাটায়।

***

ধূসর ঘোড়াটা চকরাবকরাটার চেয়ে দ্রুতগামী…সবাই সেটা দেখতে পাবে।”

“বাবুরী, তুমি ভুল করছে। ববফ গলার পরে আমরা যখন আবার যাত্রা করবো তখন আমি তোমাকে সেটা দেখাবো।” হাত গরম করতে আগুনের উপরে রেখে সে বলে।

 দরজা খোলার শব্দ আর বাতাসের একটা শীতল ঝাপটা অনুভব করে, বাবর ঘুরে তাকিয়ে হুসেন মজিদকে এগিয়ে আসতে দেখে। উচ্চতা আর কলেবরের কারণে তার পাশে পাশে এগিয়ে আসা গাঢ় সবুজ রঙের পশম দেয়া জ্যাকেট পরিহিত বৃদ্ধ মহিলার বেটে কুঁজো অবয়ব একটা মজাদার জুটি তৈরি করেছে। বয়স আর ভগ্নস্বাস্থ্য সত্ত্বেও একটা লাঠির উপরে ভর করে সে বেশ ভালোই হুসেন মজিদের সাথে তাল মিলিয়ে হেঁটে আসে।

 অসম জুড়িটা বাবরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে তাকে প্রথা মাফিক অভিবাদন জানায়। “সুলতান, এর নাম রেহানা।” বাবরের বিস্ময় দেখে হুসেন মজিদ তাকে বলে। “আমি যখন বাচ্চা ছিলাম তখন সে আমার লালনপালন করেছিলো এবং এখনও আমার পরিবারের খিদমত করে আসছে। আজ খুব সকালে সে আমার কাছে আসে। সে আমাকে বলে যে গতরাতে মুরগীর খোঁয়াড়ে নেকড়ে হামলার গোলমালে ঘুম ভেঙে যেতে সে মেয়ে পরিচারিকাদের বাসস্থানের রান্নাঘরে চা গরম করছিলো। তখন আপনি পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময়ে তৈমূরের বিষয়ে কিছু বলছিলেন। সে আমাকে মনে করিয়ে দেয়- ছেলেবেলায় যা আমি বহুবার শুনেছি যে তার দাদাজান দিল্লী আক্রমণের সময়ে তৈমূরের সাথে ছিলো এবং প্রায়ই তাকে সেখানকার কথা বলতো। সে জানতে চায় আপনি তার গল্প শুনতে আগ্রহী কিনা। আমি তাকে বলেছি এক বৃদ্ধ সৈনিকের মুখে শোনা গল্প আরেক বৃদ্ধা মহিলার কাছে শুনতে আপনি আগ্রহী হবেন না। কিন্তু নাছোড়বান্দার মতো অনুরোধ করতে থাকলে বাধ্য হয়ে আমি তাকে আপনার কাছে নিয়ে এসেছি।”

কথাটা বলার সময়ে রেহানা চোখ তুলে বাবরের দিকে তাকাতে সে বৃদ্ধার চোখে ঝলসাতে থাকা গর্ব দেখে মুগ্ধ হয়।

“পূর্বপুরুষের বীরত্বগাঁথা শুনতে আমার ভালোই লাগবে। রেহানাকে আগুনের পাশে আরাম করে বসার বন্দোবস্ত করে দিয়ে কাউকে বলেন আমাদের চা দিয়ে যেতে।” রেহানা ধীরে ধীরে তার বৃদ্ধ শরীরটা নিয়ে একটা টুলের উপরে বসে।

 “বলেন কি বলতে চান।”

রেহানা এমন মর্যাদাসম্পন্ন শ্রোতাদের সামনে একট ভক্তিপূর্ণ সম্পর্কের ব্যাপারে তার কথা বলতে চাওয়ার অনুরোধ পূরণ হওয়ায় বুঝতে পারে না তার কোথা থেকে শুরু করা উচিত। সে বিড়বিড় করে কিছু বলতে গিয়ে আবার চুপ করে বসে থাকে। “আপনার দাদাজানের নাম কি ছিলো?” বাবর তাকে মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করে।

 “তারিক।”

 “তৈমূরের বাহিনীতে তিনি কি ছিলেন?”

“তিনি ছিলেন একজন অশ্বারোহী তীরন্দাজ- শ্রেষ্ঠদের মধ্যে অন্যতম।”

“আর তৈমূরকে তিনি প্রথম কোথায় দেখেন?”

 “১৩৯৮ সালের গ্রীষ্মকালে, সমরকন্দে, তিনি হিন্দুস্তান- উত্তর ভারত আক্রমণের প্রস্তুতি তখন মাত্র শুরু করেছেন। তার বাবা- তৈমূরের পূর্ববর্তী অভিযানের পোড় খাওয়া যোদ্ধা- আমার দাদাজানকে নিয়ে এসেছিলেন, সমরকন্দের দেয়ালের ঠিক বাইরে দিল খোশ বাগিচায়। তৈমূর নিজে সেবার যাদের নিয়োগ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন তিনি সেই দলে ছিলেন।”

 “তৈমূর তখন দেখতে কেমন ছিলো সেটা কি তিনি বলেছিলেন?”

“তার বয়স তখন প্রায় ষাট বছর। আমার এখনকার বয়সের চেয়ে মাত্র বিশ বছরের ছোট,” রেহানা বলে, বয়সের বরাভয় অর্জন করা বৃদ্ধলোকদের প্রচ্ছন্ন গর্ব তার কণ্ঠ থেকে ঝরে পড়ে। সে চুপ করে থাকে যেন প্রশংসা আশা করছে। বাবর তাকে হতাশ করে না। আমি বুঝতে পারিনি এতগুলো ঋতু পরিবর্তন দেখার সৌভাগ্য আপনার হয়েছে।”

বৃদ্ধা এবার হাসেন। “কিন্তু আমার দাদাজান আমাকে বলেছিলেন ঘন সাদা চুলের তৈমূর তখনও লম্বা আর অনত। তার ছিলো চওড়া কপাল, মন্দ্র কণ্ঠস্বর আর প্রশস্ত কাঁধ। তরুণ বয়সে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যাবার কারণে আহত ডান পায়ের জন্য তখন তিনি বেশ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েই হাঁটতেন। দূর্ঘটনার কারণে তার এক পা অন্য পায়ের চেয়ে বেশ খাটো হয়ে গিয়েছিলো…” ভীরুতা কেটে যেতে, সামান্য দুলতে দুলতে রেহানা পূর্ণোদ্যমে কথা বলতে থাকে। বাবর অনুমান করে বৃদ্ধা তার দীর্ঘ জীবনে অসংখ্যবার এই গল্পগুলো বলেছে।

“নিজের গিল্টি করা সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে তৈমূর তার লোকদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়। আমরা হিন্দুকুশ অতিক্রম করে গিরিপথের ভিতর দিয়ে গিয়ে সিন্ধু অতিক্রম করে হিন্দুস্তানের সমৃদ্ধ রাজধানী দিল্লী আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়েছি। সিকান্দারও যে শহরে পৌঁছাতে পারেন নাই। কিংবা চেঙ্গিস খান তিনি কেবল সিন্ধু অববাহিকা পর্যন্ত গিয়েছিলেন। প্রাপ্তির সম্ভাবনা অসীম। হিন্দুস্তান- হীরা, পান্না আর চুনি পাথরে সমৃদ্ধ। সভ্য দুনিয়ার একমাত্র হীরক খনি সেখানে অবস্থিত। কিন্তু সেখানের অধিবাসীদের এসব রত্নে কোনো অধিকার নেই। সেখানকার কিছু শাসক যদিও আমাদের আল্লাহতা’লার অনুসারী, কিন্তু বেশিরভাগ লোকই অর্ধেক জন্তু আর অর্ধেক মানুষের বিকৃত মূর্তির পূজারী, ভীরু স্বভাবের কাফের। তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যে শহীদ হবে আল্লাহতালা তাকে নিশ্চয়ই বেহেশত নসীব করবেন। প্রজাদের ভিতরে বিদ্যমান অবিশ্বাস দূর্বলচিত্তে মেনে নেয়া এসব শাসক আর তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহতালা অবশ্যই আমাদের বিপুল ভাবে বিজয়ী করবেন। আমরা বিপুল পরিমাণ ধনসম্পদ লাভ করবো।’

 “কিছুদিন পরেই সেনাবাহিনী শহর ত্যাগ করে। নব্বই হাজার যোদ্ধা- বেশিরভাগই অশ্বারোহী- সমরকন্দের বাইরে রোদে পোড়া তৃণভূমির উপরে ধূলোর একটা মেঘের জন্ম দিয়ে, কাতারবন্দি হয়ে যুদ্ধ যাত্রা শুরু করে। তিন দিনের ভেতরে তারা সবুজ শহর, তৈমূরের জন্মস্থান শাখরিস অতিক্রম করে যায় এবং লোহার দরোজা নামে সুপরিচিত সুরক্ষিত গিরিন্দর দিয়ে লালচে করকটে মরুভূমি কিজিল খুমে নেমে আসে।

“বিরতীহীনভাবে এগিয়ে গিয়ে তারা অক্সাস, বালখ আর আন্দারাব অতিক্রম করে। এই পুরোটা সময় তারা তৈমূরের সাম্রাজ্যের সীমান্তের ভিতরের অবস্থান করেছিলো। এরপরে তৈমূর ত্রিশ হাজার যোদ্ধার একটা অগ্রগামী দল নিয়ে আমার দাদাজান এই বাহিনীতে ছিলো- খাওয়াক গিরিপথের ভিতর দিয়ে পৃথিবীর ছাদে উঠে আসেন এবং হিন্দুকুশে পৌঁছান। সেখানে তারা প্রথমবারের মতো শীতের মোকাবেলা করেন আর সমভূমির লোকদের কাছে অপরিচিত এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। বরফের উপরে তাদের ঘোড়ার পা পিছলে যেতে থাকে। আছাড় খেয়ে কিছু কিছু ঘোড়া আরোহীসহ মৃত্যুমুখে পতিত হয়। কোনো কোনো ঘোড়ার পা ভেঙে কেবল রান্নার পাত্রের উপযুক্ত হয়ে পড়ে।

 “তৈমূর তার লোকদের দিনের বেলা বিশ্রাম নিয়ে রাতের বেলা যখন দিনের বেলায় বরফের উপরে জমে থাকা বরফগলা পানির স্তর শক্ত হয়ে কম পিচ্ছিল থাকে তখন যাত্রা করার আদেশ দেন। শীঘ্রই তারা একটা পাহাড়ী ঢালে পৌঁছে দড়ির সাহায্য ছাড়া যেখান থেকে অবতরণ করা অসম্ভব। তখন আমার দাদাজান আমাকে বলেছেন- তৈমূরের লোকেরা তাকে একটা খাঁটিয়ায় করে পাথুরে কিনারা থেকে একশ ফিট নিচে নামিয়ে আনে যেহেতু তার নিজের পক্ষে দড়ি বেয়ে নামা সম্ভব ছিলো না। এসময় ঠাণ্ডার ফলে তার ডান পায়ের পুরানো ক্ষতমুখ খুলে যায় এবং তিনি তার পুরো দেহের ভর এই পায়ের উপরে চাপাতে সাহস পান না। আর এই পুরোটা সময় তারা স্থানীয় উপজাতি আর কাফেরদের চোরাগোপ্তা হামলা প্রতিহত করে চলে। বরফ প্রায়ই উজ্জ্বল রক্তে সিক্ত হয়ে উঠত…

“কিন্তু অনেক পরিশ্রম করে তারা অবশেষে কাবুলে পৌঁছায়। আমার দাদাজান আমাকে বলেছেন, পাহাড়ের উপরে অবস্থিত একটা দূর্গ দ্বারা সুন্দর এই শহরটা গিয়ে বালিয়াড়ির আড়ালে আত্মগোপন করে থাকতে বলেন। অবশ্য পরে তিনি ফিরে এসে একটা কাঁটাযুক্ত ঝোপের নিচে তার দেহটা অর্ধেক ঢাকা অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন যার আড়ালে সে আত্মগোপন করতে চেয়েছিল কিন্তু বেচারার মাথাটা দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে। আমার মনে আছে আমার দাদাজান সবসময়ে বলতেন সমরকন্দের বাজারে অর্ধেক কাটা পাকা তরমুজের মত দেখতে লাগছিলো মাথাটা এবং আশেপাশের ধবংসযজ্ঞের দিকে তাকিয়ে এবং দুর্গন্ধে তার মনে হতো তিনি বোধহয় কসাইয়ের দোকানে দাঁড়িয়ে রয়েছেন।

 “তৈমূর আশা করেন এই হত্যাকাণ্ড হয়তো দিল্লীর সুলতানকে আরেকবার আক্রমণ করতে প্ররোচিত করবে এবং তিনি যুদ্ধের প্রস্তুতি নেন। সবচেয়ে ভীতিকর হাতির পালকে প্রতিহত করতে তিনি তার লোকদের- অশ্বারোহী বা পদাতিক, সেনাপতি বা সৈনিক নির্বিশেষে সবাইকে নিজ নিজ অবস্থানের সামনে গভীর খাদ খুঁড়তে আদেশ দেন এবং খোঁড়া মাটি দিয়ে অস্থায়ী প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে বলেন। এরপরে তিনি তার কামারদের বলেন সবচেয়ে তীব্র আলো প্রজ্জ্বলিত করতে এবং তীক্ষ্ণ প্রান্তযুক্ত তিন-মাথা বিশিষ্ট দণ্ড তৈরি করে হাতির দলের যেখানে আক্রমণ করার সম্ভাবনা বেশি সেসব জায়গায় ছড়িয়ে দিতে বলেন। তিনি এবার মহিষের পালের মাথা আর পা চামড়ার দড়ি দিয়ে বাঁধার আদেশ দিয়ে পরিখার সামনে এবং সুচাল দণ্ডের পেছনে তাদের দাঁড় করিয়ে রাখেন। তিনি উটের পিঠে শুকনো কাঠ আর খড় বোঝাই করে তাদের একসাথে বেঁধে আলাদা করে রাখেন। সবশেষে তিনি তার তীরন্দাজ বাহিনীকে আদেশ দেন হাতির পিঠে কানের পেছনে উপবিষ্ট মাহুতকে লক্ষ্য করে কেবল তীর ছুঁড়তে বলেন। মাহুত মারা গেলে, হাতির পাল নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।

“ডিসেম্বরের মাঝামাঝি নাগাদ- আমার দাদাজান বলতেন আকাশ ধূসর হয়ে উঠে এবং আবহাওয়া শীতল হতে- সুলতানের দল সত্যি সত্যি তৈমূরের ধারণা অনুযায়ী, হাতির পিঠে বাঁধা পিতলের বিশাল দামামা বাজিয়ে দূর্গ ছেড়ে আক্রমণ করতে বের হয়ে আসে, তাদের পায়ের নিচে মাটি যেনো কেঁপে কেঁপে উঠে।

 “কিন্তু আমার দাদাজান তখন তৈমূরের পরিকল্পনার প্রজ্ঞা নিজের চোখের সামনে দেখতে পান। হাতির পাল তাদের অবস্থান পর্যন্ত পৌঁছাতেই পারে না। লোহার কাঁটায় হোহাচট খেয়ে তারা মহিষের পালের সামনে এসে হুমড়ি খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। আর এরপরেই তৈমূর তার শেষ চালটা দেয়। উটের পিঠে রাখা শুকনো কাঠ আর খড়ের গাদায় আগুন ধরিয়ে দিয়ে তিনি তাদের হাতির পালের দিকে দাবড়ে নিয়ে যেতে বলেন। বিশাল প্রাণীগুলো কাটার খোঁচা সামলে নিলেও এবার ধোয়ার আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে আতঙ্কিত হয়ে উঠে এবং ভয়ে পালাবার সময়ে পিঠের সৈন্যদের ছুঁড়ে ফেলে আর পায়ের নিচে তাদের মাথা পিষ্ট করতে থাকে। বিজয় এসে তৈমূরকে বরণ করে। দিল্লী এখন তার অধীনস্ত।

 “যদিও তৈমূরির শাহী ফরমান ছিলো যে অনুমতি ছাড়া কেউ দিল্লীতে প্রবেশ করতে পারবে না। কিন্তু তার সব আদেশের ভিতরে কেবল এই আদেশটাই কড়াকড়িভাবে সুরক্ষিত এবং ব্যস্ত বাণিজ্য পথের মিলনস্থলের উপরে অবস্থিত। সমরকন্দের চেয়ে ছোট আর কম চাকচিক্যময় অবশ্যই, কিন্তু তারপরেও আপন মহীমায় ভাস্বর।”

“নিশ্চয়ই, আমার বিশ্বাস সেটা এখনও তেমনই আছে।” বাবর বিড়বিড় করে বাবুরীকে বলে। “আমার বাবার এক ভাই শহরটার শাসনকর্তা।”

 “সমরকন্দে আমার যেমন প্রতিটা দোকানে পরিচিত রয়েছে, তেমনি প্রতিটা মসনদে আপনার আত্মীয়রা অধিষ্ঠিত…”

“রেহানা, আমাদের কথায় কান না দিয়ে আপনি বলতে থাকেন।”

“সেপ্টেম্বর নাগাদ, তৈমূর চামড়ার ফালি দিয়ে বাঁধা নৌকা দিয়ে তৈরি করা একটা সেতুর সাহায্যে সিন্ধু নদী অতিক্রম করেন। দিল্লী থেকে তখন তারা মাত্র পাঁচশ মাইল দূরে। তার বাহিনী যখনই সুযোগ পেয়েছে মানুষজন বন্দি করেছে যাদের পরে সমরকন্দের দাসবাজারে বিক্রি করা হবে। কিন্তু তার আগে তারা সেইসব বন্দিদের বাধ্য করেছে তাদের কাজ করতে। আমার দাদাজানের ছিলো পাঁচজন বন্দি। রাভি নামের কালো চোখের ছোট একটা এতিম ছেলে তার খুব প্রিয় ছিলো।

“ডিসেম্বর মাসে, তৈমূরের অগ্রগামী গুপ্তদূতেরা দিল্লী শহরের দেয়ালের ভেতর অবস্থিত বিশাল গম্বুজ আর মিনার প্রথমবারের মতো দেখতে পায়। কিন্তু দিল্লীর সুলতানের ছিলো একটা শক্তিশালী সেনাবাহিনী। যার ভিতরে অন্তর্ভুক্ত ছিল তার সবচেয়ে ভীতিকর আয়ুধ দেড়শ রণহস্তীর একটা বাহিনী- ইস্পাতের চকচকে বর্ম, একটার উপরে আরেকটা বিন্যস্ত, পরিহিত হাতি যাদের লম্বা গজদন্তের সাথে বাঁকানো একধারী খাটো তরবারি সংযুক্ত।

“তৈমূর দেয়ালের নিকটে ব্যয়বহুল আর অনিশ্চিত যুদ্ধের সম্ভাবনা এড়িয়ে যেতে আগ্রহী ছিলেন এবং সুলতানের বাহিনীকে প্ররোচিত করেন দূর্গের নিরাপদ আশ্রয় ত্যাগ করে বেরিয়ে এসে আক্রমণ করতে। কিন্তু সুলতানের সেনাবাহিনী, যুদ্ধের ভেতরেই, যে দরোজা দিয়ে বের হয়ে এসেছিলো সেই একই দরোজা দিয়ে শহরে ফিরে যায়।”

রেহানা একটু চুপ করে দম নেবার জন্য। গল্পের এই অংশটা বিষাদময়। যুদ্ধবন্দির দল সুলতানের বাহিনীর সমর্থনে বিশাল জয়োধ্বনি দিলে। তাদের ধারণা ছিলো সুলতান জয়ী হলে তারা মুক্তি পাবে, তৈমূরের কানে সেটা পৌঁছে এবং আশঙ্কা করেন যে পরবর্তী আক্রমণের সময়ে আবেগের বশবর্তী হয়ে যুদ্ধবন্দির সংখ্যা ছিলো প্রায় এক লক্ষ তারা হয়তো বিদ্রোহ করে বসতে পারে।

 “আবেগের বশবর্তী না হয়ে এবং দৃঢ়চিত্তে, তিনি সব যুদ্ধবন্দি হত্যা করার আদেশ দেন। তার চেয়েও বড় কথা, প্রত্যেককে নিজ নিজ যুদ্ধবন্দি হত্যা করতে হবে।

“তার লোকেরা অশ্রুসজল চোখে ঠাণ্ডা মাথায় বন্দিদের হত্যা করে। এমনকি প্রিয়পাত্রীতে পরিণত হওয়া মহিলা বন্দিদেরও রেহাই দেয়া হয় না এবং কেউ কেউ বলে থাকে তৈমূর তার হারেমের মেয়েদের বাধ্য করেছিলো তাদের খিদমতকারী। বন্দিদের হত্যা করতে। আমার দাদাজান তার প্রাপ্তবয়স্ক বন্দিদের আদেশ মতো হত্যা করলেও রাভির বেলায় তিনি আদেশ পালনে ব্যর্থ হন। তিনি তাকে পালিয়ে পালিত হয়নি। আমাদের সৈন্যরা লুটপাটের আশায়- আমার বলতে দ্বিধা নেই মেয়ে মানুষের খোঁজে শহরের ভেতরে ছড়িয়ে পড়ে। আমার দাদাজানও ছিলেন তাদের ভিতরে, পরিত্যক্ত সরাইখানায়, শহরের অধিবাসীরা তাদের কিছু সাথীকে খুন করেছে এমন গুজব ছড়িয়ে পড়তে সেটার মালিক পালিয়ে গিয়েছিলো, মুফতে আকণ্ঠ সুরা পান করেছেন…

 “প্রায় মাতাল অবস্থায়, সৈনিকরা এবার রাস্তায় নামে। মাথা ঝিম ধরে থাকার কারণে তারা তাদের চারপাশে কেবল শত্রু দেখতে পায় এবং সামনে যাকে পায় তাকেই হত্যা করে। শীঘ্রই তারা দোকানপাট আর বাসায় অগ্নিসংযোগ শুরু করে কেবল মজা দেখতে।

 “মদের নেশা কেটে যেতে, আমার দাদাজান নিজের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত বোধ করেন এবং একটা সংকীর্ণ লম্বা বাসায় প্রবেশ করে। সেখানে তিনি প্রায় রাভির সমবয়সী এক ছেলেকে মার্বেলের তৈরি হাম্মামখানায় লুকিয়ে থাকা অবস্থায় খুঁজে পান। রাভি আর তার প্রায় দ্বিখণ্ডিত মাথার কথা মনে পড়তে আমার দাদাজান আরও ধাতস্থ হন। তিনি ছেলেটাকে ইশারা করে ঘরের এক কোণে রাখা একটা বিশাল সিন্দুকে লুকিয়ে থাকতে বলেন এবং ইশারা ইঙ্গিতে বলেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সে যেনো সেখানেই লুকিয়ে থাকে।”

রেহানা তার পরনের পুরু পশমের স্তর দেয়া কোটের পকেট হাতড়ে সোনালী জরির কাজ করা রেশমের কাপড়ে মোড়া কিছু একটা বের করে। কাপড়ের আবরণ সরাতে বাবর দেখে ভেতরে একটা ছোট সোনার তৈরি হাতির মূর্তি, যার চোখ দুটো রুবির। সে হাতিটা বাবরের দিকে এগিয়ে ধরে। “সেই বাচ্চা ছেলেটা আমার দাদাজানকে এটা দিয়েছিলো এবং তার অন্য আর কোনো নাতি জীবিত না থাকায় এটা আমাকে দিয়ে যান- বাকি সবাই আমার জন্মের আগে গুটি বসন্তে মারা গিয়েছিলো।

“ভবনটা ত্যাগ করার আগে আমার দাদাজান তূর্কী ভাষায় একটা ইস্তেহার লিখেন, যেখানে বলা হয় এই ভবনটা তল্লাশি করা হয়েছে মূল্যবান আর কিছু এখানে নেই। তিনি এটাও জানতেন পড়তে জানা গুটিকয় লোকদের ভিতরে একজন বিধায়, এবার তিনি একটা ছবি আঁকেন যেখানে লোকদের ভেতরে প্রবেশ করা থেকে বিরত রাখা হয়েছে। তিনি দুটো কাগজই দরজায় লটকে দেন।

“দুদিন পরে তৈমূর হত্যাযজ্ঞ আর অগ্নিসংযোগ বন্ধ করার আদেশ দেন। আমার দাদাজানের ইস্তেহার আর ছবি ভালোই কাজ করে বোঝা যায়। কারণ দু’দিন পরে তিনি সেই বাসায় ফিরে এসে দেখেন বাসাটা অক্ষত রয়েছে আর সেই ছেলেটা বাড়ির সামনে সিঁড়ির ধাপে বসে রয়েছে…

“আমার দাদাজান- বাকি সব সৈন্যদের মতই- অনেক কিছু লুট করেছিলো।” সিদ্ধিলাভের অভিপ্রায়ে রেহানার চোখ প্রায় বন্ধ হয়ে আসে। “সুলতানের প্রাসাদে তারা মাটির নিচে মূল্যবান রত্নে পরিপূর্ণ প্রকোষ্ঠ খুঁজে পেয়েছিলেন- মসৃণ দীপ্তিময় মুক্তা, আকাশের মতো নীল পান্না, দক্ষিণের খনিগর্ভে প্রাপ্ত ঝকঝকে হীরকখণ্ড- আর সোনা এবং রূপার মোহর। ঠিক যেমন প্রতিশ্রুতি তৈমূর তাদের দিয়েছিলেন। আমার দাদাজান তার প্রাপ্য অংশ বুঝে পেয়েছিলো। এছাড়াও তিনি অলংকৃত বর্ম আর একজোড়া সাদা টিয়াপাখি যা তিনি রাস্তার পাশে এক পরিত্যক্ত বাড়িতে খাঁচাবন্দি অবস্থায় খুঁজে পেয়েছিলেন, সাথে করে নিয়ে আসেন।

 “সহসা, দিল্লীতে মাত্র তিনদিন অতিবাহিত করার পরে, তৈমূর তার বাহিনীকে শহর ত্যাগ করার আদেশ দেন। তার সেনাবাহিনী মন্থর গতিতে উত্তর আর পূর্বদিকে ফিরতি যাত্রা শুরু করে। কখনও কখনও দিনে চারমাইল পথ মাত্র অতিক্রম করে লুটের মালামালে এতোটাই ভারী হয়েছিলো বাহনগুলো। সমরকন্দ পৌঁছাবার অনেক আগেই আমার দাদাজান তার লুট করা সব ধনসম্পত্তি জুয়া খেলে হেরে যায়। কেবল সাদা টিয়াপাখি জোড়া আর এই হাতিটা শেষ পর্যন্ত তিনি নিয়ে আসেন।

“কিন্তু হিন্দুস্তানের কথা বলার সময় তার চোখ চকচক করতে থাকতো। যুদ্ধ আর নিজের কৃতিত্ব সম্বন্ধে তাকে খুব অল্পই বলতে শুনেছি। তিনি প্রায়ই পানি প্রবাহের কারণে সবুজ মাঠে চরে বেড়ানো মোটা গরু আর ভেড়ার পাল। মার্বেল আর বেলেপাথরে নির্মিত সুন্দর ভবনসমূহ আর হিন্দুস্তানের মূল্যবান পাথরের কথা বলতেন। তিনি বলতেন সেইস্থানের অফুরান প্রাকৃতিক সম্পদের কথা বলে শেষ করা যাবে না কখনও। বিশ্বাস করতে হলে নিজ চোখে সেসব দেখতে হবে…”।

রেহানার গল্প শেষ এবং তার জটিল রেখাসঙ্কুল মুখ হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে।

“তোমার কল্যাণে তৈমূরের জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্জন আমি আজ পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে জানতে পারলাম।” রেহানার ফুটিয়ে তোলা দৃশ্যপট বাবরকে অভিভূত করে। “তৈমূরের যুদ্ধ প্রণালী আর হিন্দুস্তান সম্পর্কে তুমি যা বলেছে তা এতোটাই অবিস্মরণীয় যে, আমি আমার মুনশিকে আদেশ দেবো পুরো বর্ণনাটা লিখে রাখতে যাতে অন্য লোকেরা তার শ্রেষ্ঠত্ব সম্বন্ধে জানতে পারে। আর আমিও প্রয়োজন হলে এটা পুনরায় আলোচনা করতে পারি। ধন্যবাদ তোমাকে।”

 রেহানা টুল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তার লাঠিতে ভর দিয়ে কক্ষ ত্যাগ করে। ফিরতি পথে তার পায়ের গতি বাবরের কাছে আগের চেয়ে অনেক চপল বলে মনে হয়।

“সুলতান।” হুসেন মজিদ কথা বলে। “তৈমূর হিন্দুস্তান তার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত করেননি কেন?”

 “আমি জানি না। তৈমূরের হামলার বিষয়বস্তু নিয়ে লিখিত একটা কবিতার কয়েকটা পংক্তি আমার মরহুম আব্বাজান প্রায় বলতেন। হুবহু শব্দগুলো আমার মনে নেই, কিন্তু বিষয়বস্তু অনেকটা এরকম “দিল্লী লুণ্ঠিত হবার পরে দু’মাস আকাশে একটা পাখিও দেখা যায়নি, আর হিন্দুস্তানের ভিতর দিয়ে তৈমূরের যাত্রাপথের আশেপাশে বাতাস দূষিত করে তোলা লাশের স্তূপ কেবল দেখতে পাওয়া যেতো”। কবিরা প্রায়ই বাড়িয়ে বলে কিন্তু তৈমূরও সম্ভবত বুঝতে পেরেছিলেন যেখানে তিনি এতো ধবংসযজ্ঞ সাধন করেছেন সেই অঞ্চল শাসন করাটা কঠিন হবে…সম্ভবত তিনি এটাও অনুধাবন করেছিলেন তার বয়স হচ্ছে এবং তখনও অনেক কাজ বাকি-অনেক অভিযান আর লুটপাট করা তখনও হয়নি। তাছাড়া দিল্লী থেকে ফিরে আসবার পরে তিনি সমরকন্দের কেবল চার মাস অবস্থান করেন। তারপরে পশ্চিমে ভূমধ্যসাগরের তীরে দামেস্ক আর আলেপ্পো দখল করে রওয়ানা দেন এবং আঙ্কারার। যুদ্ধে তিনি অটোমান তুর্কীদের মহান ম্রাট, বজ্রপাত বায়েজিদকে বন্দি করেন। তিনি তাকে আক্ষরিক অর্থেই একটা খাঁচায় বন্দি করে রাখেন, যা ভ্রমণের সময়ে। তাদের সাথেই থাকতো। সবাই বলে খাঁচায় বন্দি থাকা অবস্থায় মহামান্য সুলতান। নাকি বাচ্চাছেলের মত কাঁদতো…আর তৈমূর চীন অভিযানের সময়ে মৃত্যুবরণ করেন… হিন্দুস্তান তার বহু অভিযানের ভেতরে অন্যতম একটা অভিযান ছাড়া আর কিছুই না…”

“হিন্দুস্তানের বহুমূল্যবান রত্নরাজি সম্পর্কে রেহানার কথাই ঠিক। মাঝে মাঝে সওদাগরেরা সমরকন্দে নিয়ে আসে বিক্রি করতে এবং মূল্যবান পাথরগুলোর দীপ্তি অসাধারণ।” বাবুরী বলে। “আমি প্রায়ই কল্পনা করি দেশটা দেখতে না জানি কেমন।”

 “তোমার আশা হয়তো পূরণ হবে।” বাবর চিন্তিত কণ্ঠে বলে। “গতরাতে আমি দেয়ালে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম সমরকন্দ ছাড়া অন্য কোথাও আমি আমার সাম্রাজ্যের ভিত্তি শুরু করতে পারি কিনা। তৈমূরের হিন্দুস্তান বিজয়ের কাহিনী রেহানা তার পূর্বপুরুষের বয়ানে বলে একটা আশীর্বাদের মতো কাজ করেছে।”

***

“অলস কোথাকার।” বাবর চিৎকার করে। তার খালি পায়ের নিচে লতাগুল্মহীন পাথুরে মাটি এবং ঢালটা বেশ খাড়া। কিন্তু সে তার প্রতিবাদ করতে থাকা দেহ নিয়ে উপরে উঠতে থাকে। বাবুরী বেশ চটপটে কয়েকগজ পেছনে সে বাবুরীর হাঁফাতে হাঁফাতে এগিয়ে আসা পায়ের শব্দ শুনতে পায়। কিন্তু সে তার চেয়ে দ্রুততর আর বিষয়টা তাকে প্রীত করে…বসন্তের আগমনের সাথে সাথে অভিযানে বেরিয়ে পড়ার আকাঙ্ক্ষা আবার তার মাঝে প্রবল হয়ে উঠেছে আর সেই সাথে ভবিষ্যতের যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত আরও চৌকষ করে তোলার সংকল্প। গত দুসপ্তাহ ধরে প্রতিদিন সে এই প্রত্যন্ত পার্বত্য এলাকার আর উপত্যকার উপর দিয়ে দৌড়ে এসে হিমশীতল নদীর পানিতে খালি গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। তার সাথে তখন কেবল বাবুরী থাকে। লম্বা শিংযুক্ত ছাগলের পাল ছাড়া হিংস্র আর কারো সাথে এখানে মুখোমুখি হবার সম্ভাবনা নেই।

সে নিজের মনে পরিকল্পনার ছক কষে। সাইবানি খানের সাথে তার বোঝাঁপড়া এখনও শেষ হয়নি- খানজাদাকে উদ্ধার না করা পর্যন্ত সেটা শেষ হবেও না। তারপরের কথা কে বলতে পারে? সমরকন্দ তার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। কিন্তু তুষারাবৃত পাথুরে চূড়া শোভিত হিন্দুকুশের অন্য পাশের সমৃদ্ধ আর বিচিত্র অঞ্চলের ভাবনা মন কিছুতেই সে দূর করতে পারছে না। তৈমূর যদি সেখানে অভিযান পরিচালনা করে থাকেন, তাহলে সেও যাবে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *