১.৬ একশ দিবসের রাজত্বকাল

০৬. একশ দিবসের রাজত্বকাল

নীল, সবুজ আর সোনালী টালির উজ্জ্বলতায় সূর্যের আলো ঠিকরে যেতে সবুজাভ নীল তোরণদ্বার ঝিকমিক করতে থাকে। সমরকন্দে আনুষ্ঠানিক প্রবেশের উদ্দেশ্যে তোরণদ্বারের দিকে এগিয়ে যাবার সময়ে বাবরের মনে হয় সে বুঝি সূর্যের কেন্দ্রে ঘোড়ায় চেপে এগিয়ে চলেছে। মৃদু বাতাসে তার পরণের রেশমের সবুজ আলখাল্লা চারপাশে আন্দোলিত হতে থাকে। ক্রুদ্ধ গর্জনরত বাঘের প্রতিকৃতি খচিত তৈমূরের সোনার আংটি তার আঙ্গুলে জ্বলজ্বল করছে, এবং আকাটা পান্নার তৈরি গলার হার তার নিঃশ্বাসের সাথে বুকের উপরে উঠছে আর নামছে। সহস্র চোখ তাকে খুটিয়ে দেখছে, সে বিষয়ে সচেতন। বাবর জোর করে চোখেমুখে একটা কঠোর অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলে, যদিও তার ইচ্ছে করে মাথাটা পেছন দিকে হেলিয়ে দিয়ে আকাশের পানে তাকিয়ে বুকের সবটুকু বাতাস বের করে দিয়ে চিৎকার করে উঠে।

অধীনস্ত গোত্রপতি আর সেনাপতিরা তার ঠিক পেছনেই ঘোড়ার চড়ে তাকে অনুসরণ করছে। ফারগানা থেকে তাদের সাথে আগত উপজাতি চাষাভূষোদের দিয়ে গত দুদিনে ওয়াজির খান একটা চলনসই সেনাবাহিনী দাঁড় করিয়েছেন যারা। শহরের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার সময়ে সবাই ঈর্ষান্বিত চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে থেকেছে। কোক-সরাইয়ের বন্ধ প্রকোষ্ঠগুলোতে যথেষ্ট পোশাক পরিচ্ছদ তারা খুঁজে পেয়েছিল যা দিয়ে তার শিরস্ত্রাণ আর কেবল বর্ম পরিহিত রুক্ষ, যাযাবর যোদ্ধার দলকে, নিজের লোকদের কষ্টে রেখে গ্রান্ড উজিরের জমিয়ে রাখা উজ্জ্বল রেশমের পোশাকে সজ্জিত করা হয়েছে।

 বাবর মনে মনে শপথ নেয়, এই মহান শহরের সমৃদ্ধি সে আবার ফিরিয়ে আনবে, তূর্যধ্বনি আর টানটান চামড়া দিয়ে বাঁধান রণদামামার গুরুগম্ভীর প্রতিধ্বনির মাঝে, সে যে তোরণদ্বার দিয়ে শহরে প্রবেশ করে তার চূড়ো থেকে উজিরের কবন্ধ দেহ। লোহার খাঁচায় ঝুলছে। সূর্যের তাপে যা ইতিমধ্যেই কালো হতে শুরু করেছে। সে সামনের দিকে এগিয়ে গেলে শহরের নীল গম্বুজ আর মিনার দেখতে পায়। শীঘ্রই সে একটা বিশাল বাজারের ভিতর দিয়ে এগিয়ে যায়, যার দুপাশে ভ্রাম্যমাণ বণিকদের আশ্রয় দেয়ার জন্য নির্মিত হয়েছে সারি সারি সরাইখানা। তার মরহুম আব্বাজান প্রায়ই তৈমূরের সময়ের প্রাচুর্যময় কাফেলার কথা বলতেন- হেলেদুলে নাক ঝাড়তে ঝাড়তে এগিয়ে যাওয়া উটের সারিবদ্ধ দল আর ক্ষিপ্রগামী খচ্চরের বহর যারা পশ্চিম থেকে পশম, চামড়া আর মসৃণ কাপড়, পূর্ব থেকে নিয়ে আসত চিনামাটির বাসনকোসন, সোনা রূপার কারুকাজ করা রেশমী বস্ত্র আর তীব্র গন্ধযুক্ত কস্তুরি, এবং সিন্ধু নদী অতিক্রম করে দূরবর্তী অঞ্চল থেকে সুগন্ধি জায়ফল, লবঙ্গ, দারুচিনি আর উজ্জ্বল রত্নপাথর নিয়ে আসত।

সড়কের দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকা জনগণকে সতর্ক কিন্তু মোটেই বিরূপ মনে হয় না। প্রশস্ত রেজিস্তান চত্বরে, ঘোড়ায় উপবিষ্ট অবস্থায় প্রবেশের সময়ে বাবর তাদের কৌতূহল অনুভব করে, যেখানে ডোরাকাটা সবুজ রেশমের চাঁদোয়ার নিচে একটা মার্বেলের মঞ্চ রয়েছে। তার প্রয়াত চাচাজানের পারিষদবর্গ আর সমরকন্দের অভিজাত ব্যক্তিরা মঞ্চের সামনে বশংবদের ন্যায় নতমুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

বাবর ঘোড়া থেকে সরাসরি মঞ্চের উপরে নামে এবং এর কেন্দ্রের দিকে এগিয়ে যায়, যেখানে বাঘের পায়াযুক্ত সোনার গিল্টি করা সিংহাসন অপেক্ষা করছে। সে যেন সহসাই তাকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকা দৃষ্টি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠে। আর তার ঢাউস আলখাল্লা সামলে নিয়ে তার পক্ষে যতটা সম্ভব ভারিক্কী দেখিয়ে সে সিংহাসনে উপবিষ্ট হয়। সে এখনও কিশোর বয়স পুরোপুরি চৌদ্দও হয়নি। জনগণ তাদের সামনে উপবিষ্ট একটা বালকের ভিতরে কি দেখতে চায়? কিন্তু সে নিজেকে প্রবোধ দেয়, সমরকন্দ তার উত্তরাধিকার সূত্রে এবং বিজয় গৌরবে। সে তার চিবুক উঁচু করে এবং গর্বিত ভঙ্গিতে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে।

 জমকালো সিংহাসনে আড়ষ্ঠ ভঙ্গিতে উপবিষ্ট অবস্থায়, সে তার নতুন প্রজাদের আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করে এবং বিনিময়ে তাদের খেলাত প্রদান করে আর গ্রান্ড উজিরের সঞ্চিত ধনসম্পদ বিলিয়ে দেয়। লোকজন সারিবদ্ধভাবে নিজেদের তার সামনে প্রণত করে কিন্তু সে খুব ভালভাবেই জানে যে এদের কেউই তার বিশ্বাসের যোগ্য নয়। চিন্তাটা মাথায় আসতেই সে সংযত হয় আর গ্রান্ড উজিরের ক্রুদ্ধ উক্তিগুলো আবার তার মনে পড়ে যায়: “তুমি কখনও সমরকন্দ দখলে রাখতে পারবে না।”

 জনগণকে সে দেখিয়ে দেবে শাসক হবার যোগ্যতা তার আছে। সে কি ইতিমধ্যে যথেষ্ট করুণা আর উদারতা প্রদর্শন করেনি? যারা তার কর্তৃত্ব মেনে নিয়েছে সে তাদের সবাইকে অকাতরে ক্ষমা করেছে। গ্রান্ড উজিরের হারেমের রমণীকুল, বিজয়ের প্রথম মুহূর্তে বলাৎকারের শিকার হবার বদলে, যথাযথ সময়ে, বাবরের গোত্রপতিদের কাছে ঠাই পাবে। আর উজিরকন্যা, সে ইতিমধ্যে তাকে কুন্দুজে তার চাচাতভাই শাহজাদা মাহমুদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। সে যাবার বিষয়ে কোনো ধরণের অনীহা প্রদর্শন করেনি। বস্তুতপক্ষে, মেয়েটার বরং খুশি হওয়া উচিত। সে যে কেবল তৈমূরের সাক্ষাৎ বংশধরের এক শাহজাদার স্ত্রী হবে তাই না, এই মাহমুদই তাকে মাত্র দু’বছর আগে দস্যুদের হাতে সম্ভ্রমহানির হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। সে তার প্রেমে এতটাই মজেছিল যে তাকে পাবার জন্য সমরকন্দ পর্যন্ত অবরোধ করেছিলো।

 হ্যাঁ, বাবর ভেবে দেখে, সে ভালমতই উতরে গেছে। জনগণের তাকে ভয় পাবার কোনো কারণই নেই বরং তাদের তাকে শ্রদ্ধা করা উচিত। তারপরেও, গ্রান্ড উজিরের কথা তাকে ঘুণপোকার মত কুরে কুরে খেতে থাকে…

সহসা বাবর ওয়াজির খানকে ঘোষণা করতে শোনে, “সমরকন্দের সুলতান, মির্জা বাবর, জিন্দাবাদ!” ঘোষণাটা নিমেষে সহস্র কণ্ঠে ধ্বনিত হলে পুরো প্রাঙ্গন গমগম করে আর বাবরের চিন্তাজাল ছিন্ন হয়। একজন মৃত মানুষ যার কবন্ধ লাশ এখন খাঁচায় ঝুলছে তার কথার কারণে নিজেকে কষ্ট দেয়াটা বোকামী। এই অনুষ্ঠানের যখন আয়োজন করা হয় তখন ওয়াজির খানের সাথে তার যে কথা হয়েছিলো, সেই অনুসারে বাবর এই জয়ধ্বনির খেই ধরে। সে উঠে দাঁড়ায় এবং ধীরে ধীরে মঞ্চের চারপাশে সমবেত হওয়া জনগণের দিকে তাকায়, তাদের নতুন সুলতানকে এক নজর ভাল করে দেখার সুযোগ দেয়। তারপরে সে জনতার উদ্দেশ্যে বলে, “সমরকন্দের প্রতিটা মানুষ আমার শাসনকালে শান্তি আর সমৃদ্ধি লাভ করবে। আমার সদিচ্ছার স্মারক হিসাবে, শহরের বাজার থেকে এক মাস কোনো ধরণের কর আদায় করা হবে না।”

উপস্থিত জনগণ উৎফুল্ল কণ্ঠে তাদের সম্মতি জানায়। তার নিজের অভিব্যক্তি যদিও নির্বিকার থাকে, তার ভেতরটা আবারও বিজয়ানন্দে মেতে উঠে। তৈমূর যখন সমরকন্দ দখল করেন তখন তার বয়স ছিল একত্রিশ বছর, তার এখনকার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। এটাই ছিল তার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বিজয়, যা পরবর্তীতে একটা বিশাল সাম্রাজ্যের ভিত্তি হিসাবে কাজ করেছে। বাবরের ক্ষেত্রেও ঠিক একই ঘটনা ঘটবে।

আজ রাতে তার উদারতার আরেকটা নমুনা হিসাবে অবরোধকালীন দুর্ভোগ প্রশমিত করার উদ্দেশ্যে সে সারা শহরে খাবার বিতরণ করবে। তার আর তার লোকদের জন্য ভোজের আয়োজন করা হবে, এবং এই একটা ক্ষেত্রে সে ইতিমধ্যে তৈমূরকে ম্লান করে দিয়েছে, যার পছন্দ ছিল একেবারেই অনাড়ম্বর নিরাভরণ: ঝলসানো ঘোড়ার মাংস, সিদ্ধ ভেড়া আর ফুটানো চাল। বাইরের তৃণভূমি থেকে নিরন্ন শহরে নধর ভেড়ার পাল ধরে আনা হয়েছে যা তাদের রসনা নিবৃত্ত করবে এবং ইতিমধ্যে বেচারীদের শিকে গাথা অবস্থায় আগুনে ঝলসানোও শুরু হয়ে গেছে। তিতির আর বনমোরগ, তেঁতুল আর ডালিমের রসে ডুবিয়ে ফোঁটান হচ্ছে। মধুর মত মিষ্টি রসে টইটুম্বুর করতে থাকা তরমুজ আর বেগুনী আঙ্গুরের সতেজ থোকা কারুকার্যখচিত ধাতুর ট্রেতে স্তূপাকারে রাখা। বাবরের খিদে পেয়ে যায়।

আনুষ্ঠানিকতা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে কিন্তু বিজয় উদযাপন শুরু হবার আগে। বাবরকে আরেকটা কাজ করতে হবে। সে ধীরে ধীরে মঞ্চ থেকে নেমে আসে এবং ঘোড়ায় উপবিষ্ট হয়। ওয়াজির খান আর তার রক্ষীদের অনুসরণের ইঙ্গিত দিয়ে, সে প্রাঙ্গণ থেকে বের হয়ে গুর এমিরের দিকে রওয়ানা হয়। নীল টালিতে আবৃত খাঁজকাটা, ডিম্বাকৃতি গম্বুজ আর দুটো সুঠাম মিনার যেখানে তৈমূরকে চিরশয্যায় শায়িত করা হয়েছে।

বাবর, দেয়াল দিয়ে ঘেরা সমাধিভবনের লম্বা, খিলানাকৃতি দ্বারের কাছে পৌঁছালে, লাফ দিয়ে ঘোড়া থেকে নামে। ব্যাখ্যার অতীত কোনো অজানা কারণে, সে কিছুক্ষণ একা থাকতে চায়। ওয়াজির খান আর তার রক্ষীদের অপেক্ষা করতে বলে, তারপরে সে ভিতরে প্রবেশ করে। সে একটা আঙ্গিনা অতিক্রম করে যেখানে উঁত গাছের ডালে অসংখ্য চড়ুই পাখি কিচিরমিচির করছে, প্রথা অনুযায়ী পায়ের কারুকাজ করা বুট জুতা খুলে সে ভেতরের সমাধিকক্ষে প্রবেশ করে।

 ভেতরে বাইরের উজ্জ্বল আলোর বিপরীত অবস্থা বিরাজ করায় তার দেখতে কষ্ট হয় এবং চোখ পিটপিট করতে করতে সে একটা অষ্টাভূজাকৃতি কামরায় প্রবেশ করে। ধনুকাকৃতি খিলানের উপরের নকশা কাটা জাফরির ভিতর দিয়ে প্রবেশ করা আলোর ধারায় বিষণ্ণ বৈভব দেখে তার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসে। মার্বেলের উপরে সবুজ অ্যালাব্যাস্টার বসান এবং মাথার উচ্চতায় অধিরোপিত সোনালী টালির দেয়ালে সে আনমনে আঙ্গুল বোলায়। তার উপরে, নীল আর সোনালী কাগজের বোর্ড দিয়ে দেয়ালে নানান নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এবং চারপাশে প্যানেলের ভিতরে অপরূপ সুন্দর লিপিকলায় পবিত্র কোরানের নানা আয়াত উত্তীর্ণ করা রয়েছে। সে গলা উঁচু করে গম্বুজের ছাদে অঙ্কিত সোনালী তারকারাজিকে তাদের নিজস্ব ভূবনে বাড়াবাড়ি রকমের বিন্যস্ত অবস্থায় দেখে।

গম্বুজের সরাসরি নিচে মার্বেলের সমতল পাটাতনে একটা শবাধার দেখা যায়। শবাধারটা প্রায় ছয় ফিট লম্বা এর উপরে সবুজ জেড পাথরের মেরাপ যা এতটাই সবুজ যে প্রায় কালো বলে মনে হয় তৈমূরের উপযুক্ত সমাধিসৌধ, কিন্তু বাবর এখনও জানে না, সে কোথায় শায়িত হবে। সমাধিকক্ষের একপাশে, খিলানাকতি একটা পথ ঢালু হয়ে নেমে নিচের ভূগর্ভস্থ কক্ষে চলে গেছে। কয়েক মুহূর্ত পরে, বাবর সেখানে প্রবেশ করে। করিডোরটা এতটাই সরু যে দু’পাশের দেয়ালে তার কাঁধ ঘষা খায় যখন সে ধীরে ধীরে নিচে নামতে থাকে- খালি পা পাথরের মসৃণ মেঝেতে পিছলে যেতে চায়- একটা অনেক ছোট কক্ষে এসে সে উপস্থিত হয়। একটা ছোট মার্বেলের তিরস্করণী পর্দা দেয়ালের উঁচুতে স্থাপিত আর সেটাতে মৌচাকের মত জাফরি কাটা নকশা কক্ষটার একমাত্র আলোর উৎস, সেখান থেকে হাল্কা আলোর ধারা এসে অলংকৃত সাদা মার্বেলের শবাধারে পড়ছে, যেখানে তৈমূরের মৃতদেহ শায়িত রয়েছে।

চীনের উদ্দেশ্যে অভিযানে যাত্রা করার পরে যখন তৈমূর অকস্মাৎ মৃত্যুবরণ করলে, তার অনুচরেরা গৌরবের সাথে তাকে সমরকন্দে ফিরিয়ে এনে সমাধিস্থ করার পূর্বে গোলাপজল, কর্পূর আর মৃগনাভি দিয়ে তার মরদেহ সংরক্ষিত করে। আড়ম্বরপূর্ণ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও, বলা হয়ে থাকে মহান এই বীর কবরে প্রথমে শান্তি পাননি। রাতের পরে রাত তার শবাধার থেকে আক্রোশপূর্ণ চিৎকার ভেসে এসে সমরকন্দের লোকদের ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলত। মৃত সম্রাট আপাত দৃষ্টিতে অন্তিম শয়ানে শায়িত হতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। এই ক্রোধান্বিত যন্ত্রণাদগ্ধ চিৎকার এক বছর স্থায়ী হলে শহরের লোকেরা মরীয়া হয়ে তৈমূরের ছেলের কাছে ধর্ণা দেয়। তার সামনে হাঁটু ভেঙে বসে তারা, তৈমূর তার যুদ্ধযাত্রার সময়ে যেসব বন্দিদের বিশেষ করে বিভিন্ন শিল্পে দক্ষ কারিগরদের সমরকন্দে নিয়ে এসেছিলেন এর সৌন্দর্যবর্ধনের উদ্দেশ্যে তাদের মুক্তি দিতে অনুরোধ করে। যাতে লোকগুলো তাদের নিজের মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে পারে। তৈমূরও তাহলে অবশেষে তার মহাপ্রয়ানের পথে রওয়ানা হতে পারবেন। প্রজাদের ভীতসন্ত্রস্ত আর বিহ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে তৈমূরের ছেলে তাদের কথা শোনেন। বন্দিদের মুক্তি দিয়ে দেশে ফিরে যাবার ব্যবস্থা করা হয় আর এরপরে তৈমূরের আর্তনাদ আর শোনা যায়নি।

নানী- দাদীর গল্প, বাবর মনে মনে ভাবে। কিন্তু আরেকটা কাহিনী আছে যা সে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে বলা হয়ে থাকে তৈমূরের শবাধারের মেরাপের নিচে একটা সমাধিলিপি খোদাই করা রয়েছে: “আমি যদি আমার সমাধি থেকে উঠে আসি তাহলে পৃথিবী প্রকম্পিত হবে।”

বাবর বিনম্রচিত্তে শবাধারের দিকে এগিয়ে যায়। প্রায় ভীতচকিত ভঙ্গিতে, সে হাত বাড়ায় মেরাপটা স্পর্শ করতে যার উপরিভাগে তৈমূরের বংশ পরিচয় বয়ান করা রয়েছে। বাবর ভাবে, আমারও বংশ পরিচয়। আমার রক্ত। সে মাথা নিচু করে শীতল পাথরের গায়ে চুমু খায়। “আমি তোমার যোগ্য উত্তরসূরী হব,” সে ফিসফিস করে বলে। মহান তৈমূর আর আব্বাজানের কাছে এটা তার প্রতিশ্রুতি। তারচেয়েও বড় কথা এটা তার নিজের কাছে নিজের প্রতিশ্রুতি।

***

তৈমূরের হৃদয় প্রশান্ত করা উদ্যান, বাগ-ই-দিলকুশার কামরার মুক্তার মিহি জালের তৈরি কারুকাজ করা পর্দা ভোরের বাতাসে আলোড়িত হয় যেখানে সমরকন্দে বিজয়ীর বেশে প্রবেশের দুমাস পরে- বাবর ঘুমিয়ে রয়েছে। সমরকন্দের চারপাশের এলাকা আর তৃণভূমিতে তৈমূর যতগুলো উদ্যান নির্মাণ করেছিলেন, এটা বাবরের সবচেয়ে প্রিয়। আগের দিন সন্ধ্যাবেলা, সূর্য যখন অস্ত যেতে বসেছে, হঠাৎ খেয়ালের বশে সে ওয়াজির খান আর তার দেহরক্ষীদের তলব করে। সবুজাভ-নীল তোরণদ্বার দিয়ে তারা বের হয়ে এসে দু’মাইল লম্বা বাতাসে আন্দোলিত রাজকীয়, মার্জিত পপলার গাছে শোভিত রাজপথ ধরে এগিয়ে এখানে এসে উপস্থিত হয়েছিলো। ঘোড়া ছুটিয়ে তারা যখন সদর দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে ততক্ষণে রাত নেমে এসেছে। বাবর তার ভেতরেই তৈমূরের গম্বুজযুক্ত, সমব্যবধানে স্থাপিত স্তম্ভযুক্ত গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ আর তার চারপাশের খোলামেলা ভবনের আবছা অবয়ব অন্ধকার গাছের মাঝে মুক্তার মত চমকাতে দেখে।

বাবর ঠিক করে সে, ছিপছিপে গাঢ় সবুজ বর্ণের সাইপ্রেস, চিনার আর দেবদারু ঘেরা এবং মার্বেলের স্তম্ভের উপরে চীনা পোর্সেলিনের কারুকাজ করা প্রশস্ত ভবনের একটায় রাত কাটাবে। সে জানে, তৈমূরও বাগানে রাত কাটাতে পছন্দ করতো। সে দুটো নহরের সঙ্গমস্থলের উপরে স্থাপিত একটা মঞ্চে নিজের সিংহাসন স্থাপনের মত নির্দেশও দিয়েছিলো। বহমান চারটা ধারা জীবনের চারটে নদীর স্মারক আর ভূগোলকের চারপ্রান্তে তার আধিপত্যের উপস্থাপক।

বাবর তৈমূরের কথা যতই ভাবছে ততই শ্বাসরুদ্ধকর বলে প্রতিয়মান হয় তার দৃষ্টিভঙ্গি আর আকাঙ্ক্ষা। নিজেকে তৈমূরের উত্তরাধিকারী বলাটা সহজ, কিন্তু যখন সে এর দ্যোতনার কথা বিবেচনা করে, সে একাধারে উল্লসিত আর অকিঞ্চিৎকর বোধ করে।

কিছু একটা সম্ভবত তিতিরের ডাক- তাকে স্বপ্ন থেকে জাগিয়ে তোলে। সে চমকে উঠে বসে এবং চারপাশে তাকায়। এই বিলাসিতা- মেঝেতে ধূসর গজদন্ত আর কালো আবলুস কাঠের কারুকাজ, মার্বেলের ভাস্কর্য, সোনার পানপাত্রে পান্না, ফিরোজা আর চুনির কারুকাজ- এসব অবাস্তব বলে মনে হয়। সোনার সুতার কাজ করা গোলাপী রঙের যে রেশমের চাদরে সে শুয়ে আছে সেটায় হাত বুলিয়ে দেখে। গোলাপী পাথরের কারুকাজ সংবলিত রূপা আর সোনার জলে সূক্ষ গিল্টি করা অন্তঃপট তার আর পরিচারকদের দৃষ্টির মাঝে একটা আড়ালের জন্ম দিয়েছে।

গ্রান্ড উজির যত অপরাধই করে থাকুক, সে অন্তত তৈমূরের গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদের ভালই যত্ন নিয়েছিলেন। গোলমালের প্রাথমিক আভাস পাবার সাথে সাথেই তিনি সব মূল্যবান গালিচা, ঝালর আর ফুলদানী এবং পাত্রসমূহ সমরকন্দে নিয়ে যাবার আদেশ দিয়েছিলেন, যা তিনি সেখানের দূর্গপ্রাসাদের ভূগর্ভস্থ কোষাগারে গোপনে সংরক্ষণ করেছিলেন। উজিরের পারিষদবর্গ নতুন শাসকের কাছে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণের অভিপ্রায়ে দ্রুত এসব কিছুর অবস্থান বাবরের লোকদের কাছে প্রকাশ করেছে। যদিও প্রাসাদের অনেক মূল্যবান অলংকরণ কুপিয়ে তুলে ফেলা হয়েছে আর অবরোধেরকালে কাঠের তৈরি কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ ভবন জ্বালানী কাঠের জন্য ভেঙে ফেলা হয়েছে, বাবর ভেবে দেখে প্রাসাদের আসল সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে খুব একটা বেশি খাটাখাটনির প্রয়োজন হবে না।

 শহরটা নিরাপদ হলে সে যখন তার আম্মাজান, আর বোনকে এখানে ডেকে আনবে, তখন তারা কি বলবে সেটা ভেবে বাবর নিজের মনেই হেসে উঠে। সমরকন্দের প্রসিদ্ধ পুরু কাগজে লেখা তার চিঠিগুলোতে শহরের ইতিহাস, মহিমা কিংবা বিশালতার প্রতি সে মোটেই সুবিচার করতে পারেনি। এই শহরটা আর যাই হোক আঠারশ বছর আগে সোনালী চুলের, নীল চোখের দিগ্বিজয়ী বীর আলেকজান্ডার কর্তৃক স্থাপিত। যিনি সুদূর পশ্চিম থেকে তার সেনাবাহিনী নিয়ে তৈমূরের মতই সব প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করে এসেছিলেন। চওড়া র‍্যামপার্টযুক্ত সমরকন্দের বাইরের দেয়াল বাবর মেপে দেখতে বললে দেখা যায় একজন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের পুরো চারপাশটা ঘুরে আসতে এগার হাজার পা হাঁটতে হয়। তৈমূর তার শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতি আসলেই লক্ষ্য রেখেছিলেন- অবশ্য বাবরের প্রথম রাজকীয় আদেশ ছিল যে সুড়ঙ্গ পথে সে ভেতরে প্রবেশ করেছিলো সেটার মুখ পাথর দিয়ে বন্ধ করে দেয়া। সে চায় না অন্যরা- এবং যাদের সংখ্যা অনেক যারা সমরকন্দের দিকে শকুনের দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে- আক্ষরিক অর্থে তার পদচিহ্ন অনুসরণ করুক। সে আরও কোনো সুড়ঙ্গ আছে কি না সেটা তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখবারও আদেশ দেয়।

বাবর আবার তার মাথার চাপে দেবে বসে থাকা বালিশে শুয়ে পড়ে। গত কয়েক সপ্তাহের দৃশ্যপট আর অভিজ্ঞতা এতটাই সমৃদ্ধ যে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় এত অল্প সময় অতিবাহিত হয়েছে। কাছে লেখা তার চিঠিগুলো, যিনি এসব বিষয়ে দারুণ আগ্রহী, সে শহরের বাইরে কোহাক টিলায় অবস্থিত তিনতলা বিশিষ্ট বৃত্তাকার মানমন্দির প্রথমবারের মত দেখে তার বিস্ময়ের কথা চিঠিতে ফুটিয়ে তুলতে চায়, যেখানে তৈমূরের নাতি উলুঘ বেগ সৌর আর চন্দ্র বর্ষপঞ্জি নিয়ে গবেষণা করতেন। বাবর হতবাক হয়ে, উলুঘ বেগের সেক্সট্যান্টের ইটের তৈরি মার্বেলের আস্তরণ দেয়া নিখুঁত বৃত্তচাপটা দেখে, প্রায় দুইশ ফিট লম্বা এবং একশ ত্রিশ ফিট তার ব্যাসার্ধ আর রাশিচক্রের বিভিন্ন চিহ্ন দ্বারা অলংকৃত। সেক্সট্যান্টের উভয় পার্শ্বে ধাতব রেলের উপরে স্থাপিত এ্যাস্ট্রোলোব ব্যবহার করে উলুঘ বেগ তার পর্যবেক্ষণ করতেন।

 সবুজ মাঠের উপর দিয়ে পঙ্গপালের মত একটা ধ্বংসের মেঘের ন্যায় বিচরণ করে তৈমূরের যোদ্ধারা যদি পৃথিবী জয় করে থাকে, তবে তার উত্তরসুরী উলুঘ বেগ স্বর্গ দখল করেছেন। সমরকন্দের জ্যোতিষবিদরা এখনও তার তৈরি করা রাজকীয় জ্যোতিষবিদ্যার চার্ট ব্যবহার করে। বাবর তার পর্যবেক্ষণ আরও বেশি করে পাঠ করতে চায় কিন্তু তারপরেও মানমন্দিরের পরিশীলিত সূক্ষ মাত্রা তার ভিতরে নিজের পূর্বপুরুষ সম্পর্কে এক ধরণের গর্বের জন্ম দেয়। উলুঘ বেগের নিজের ছেলে, বাবার জ্ঞান আর বীক্ষার প্রতি এই সাধনায় অস্বস্তিবোধ নিজের করে এবং ধর্মান্ধ মৌলবাদী মোল্লাদের প্ররোচণায়, যারা ভয় পেয়েছিল হয়ত এর ফলে তাদের রহস্যের মূল উন্মোচিত হয়ে পড়বে আর তাদের ধর্মমত প্রশ্নের সম্মুখীন হবে, নিজের পিতাকে খুন করে।

উলুঘ বেগের নির্মিত মাদ্রাসা বাবর পরিদর্শন করেছে। রেজিস্তান প্রাঙ্গনের একপাশে সেটা অবস্থিত এবং আকাশী আর সবুজাভ-নীল টালিতে শোভিত, এর নকশা এতটাই জটিল যে লোকেরা একে হাজারবাফ “সহস্র-স্রোত” বলে থাকে। শহরের একেবারে কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত বিবি খানম মসজিদ তাকে পুরোপুরি অভিভূত করে। মসজিদটা তার ফারগানার দূর্গের আড়ম্বরহীন, সাদামাটা মসজিদের থেকে একেবারেই আলাদা, যেখানে পূর্ণিমার আলোয় গোত্রপতিরা তার প্রতি অনুগত থাকবার শপথ নিয়েছিল, আজ ঘটনাটাকে মনে হয় যেন বহুযুগ আগের কোনো কথা।

এক মোল্লা বাবরকে বলেছে, কিভাবে তৈমূরের প্রিয় স্ত্রী, বিবি খানম, গজদন্তের মত দেহের তৃক বিশিষ্ট চীনা রাজকুমারী যার দীপ্ত সৌন্দর্য অবলোকন করে তৈমূরের চোখে জল চলে আসত, কোনো একটা অভিযান থেকে ফিরে আসবার পরে তৈমূরকে একটা চমক দেবার জন্য মসজিদটা তৈরি করেছিলেন। কিন্তু পারস্য থেকে মসজিদটা নির্মাণের জন্য রাণীর ডেকে আনা স্থপতি, মুহূর্তের স্বেচ্ছাচারী আবেগেতাড়িত হয়ে, তাকে আলিঙ্গন করে গলায় একটা কামড়ের দাগ বসিয়ে দেয়। এই ঘটনার মাত্র কয়েকদিন পরেই তৈমূর তার অভিযান থেকে ফিরে এসে তার স্ত্রীর আপাত খুঁতহীন ত্বকে দাগটা লক্ষ্য করে এবং খালুমের কাছে পুরো ঘটনাটা শুনে সেই বেয়াদপ স্থপতিকে ধরে আনবার জন্য লোক পাঠালে, সে ভয়তরাসে তার সদ্য তৈরি করা আকাশ-স্পর্শী মিনারের একটার উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে। কাহিনীটার সারবত্ত্বা যাই হোক, লম্বা অভিজাত প্রবেশ পথের দু’পাশে দেড়শ ফুটের বেশি উঁচু মিনার আর তার চেয়েও উঁচুতে অবস্থিত মসজিদটার গম্বুজ- মোজাইকের দ্বারা অলংকৃত- দেখে বাবরের ভিতরে একটা ভয় জাগান সমবোধ জেগে উঠে।

বাবর হাই তুলে এবং আড়মোড়া ভাঙে। তার আম্মিজান যখন সমরকন্দে পৌঁছাবে তিনি আনন্দিত আর পুলকিত হবেন এবং খানজাদা কৌতূহল আর উত্তেজনায় কেমন একটা ঘোরের ভেতরে থাকবে। কিন্তু এসান দৌলতের ব্যাপারটা সে ঠিক অনুধাবন করতে পারে না। তার খুশি করাটা খুব কঠিন একটা কাজ। সে কল্পনার চোখে দেখতে পায়, বলিরেখায় জর্জরিত মুখের সঙ্কটা মোকাবেলায় প্রস্তুত কালো কালো খুদে দুই চোখে তাকিয়ে তিনি মাথা নাড়ছেন এবং সাফল্যের কারণে বেশি উৎফুল্ল না হয়ে তাকে ভাবতে বলছেন এরপরে কি অপেক্ষা করছে।

 বাবর ভাবে, সে যাই হোক তারপরেও সে তার অধিকার আদায় করে নিয়েছে। নিয়তির বাড়িয়ে দেয়া সুযোগ সে অকুণ্ঠ চিত্তে গ্রহণ করেছে। সে হাততালি দিতে একজন পরিচারক সাথে সাথে একটা বিশাল রূপার পাত্র যা এক জগ গোলাপজল মেশান উষ্ণ পানি দিয়ে পূর্ণ নিয়ে হাজির হয়। পাত্রটা সাবধানে নিয়ে সে বাবরের দিকে এগিয়ে আসে, হাতে ধরা একটা কাপড় দিয়ে তাকে পরিষ্কার করার উদ্দেশ্যে। কিন্তু সে হাত নেড়ে তাকে বিদায় করে। তার সব কাজ অন্য কেউ করে দেবে এখনও সে পুরো এই ব্যবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি এবং পরিচারককে সে তার বিছানার পাশে রাখা ছোট টেবিলে কাপড় আর পানির পাত্রটা রেখে যেতে বলে। পানির সমতল পৃষ্ঠে ভেসে উঠা নিজের অবয়বের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ফারগানার কোনো একটা পাহাড়ী ঝর্ণার শীতল পানিতে মাথা ডোবানোর একটা অপ্রত্যাশিত ইচ্ছা তাকে পেয়ে বসে।

 কিন্তু তার এই ভাবনার রেশ সদ্য তৈরি করা রুটি আর পরিজের মন মাতান গন্ধে বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। বেহেশতে বাস করার সময়ে সে যদি বাড়ির কথা ভেবে বা অন্য কারণে মন খারাপ করে তাহলে তাকে আহাম্মক বলতে হবে। তার লোকদেরও আপাতভাবে সন্তুষ্ট মনে হয়- যা একটা বিরল ব্যাপার, গলা আর কাঁধ ডলে পরিষ্কার করতে করতে সে ভাবে। অবশ্য, সে তাদের তার প্রতিশ্রুতিমত বা তার চেয়েও বেশি পুরস্কৃত করেছে। সমরকন্দের মোহরে ঠাসা সিন্দুক তাকে উদার হতে এক্ষেত্রে যথেষ্ট সহায়তা করেছে। সে তার সব গোত্রপতিকে একশটা করে সোনার আশরফি আর তাদের অধিনস্ত লোকদের আশাতীত রকমের রৌপ্যমুদ্রা দিয়েছে। বাবর অবশ্য প্রাপ্ত ধনসম্পদের একটা ভাল অংশ ফারগানায় তার প্রতিনিধি কাশিম আর তার অনুসারীদের পুরস্কৃত করতে আর আশেপাশের ঝামেলাবাজ গোত্রগুলোর আনুগত্য যাতে সে বজায় রাখতে পারে সেজন্য পাঠাতে ভুল করেনি। বাবরের অনেক লোকই নতুন দ্বার পরিগ্রহ করেছে। সে যেমনটা আশা করেছিলো, গ্রান্ড উজিরের হারেমের তরুণীর দল অনেকটা আগ্রহের সাথেই তার লোকদের সাথে গিয়েছে। টাকার থলে ভর্তি বিজয়ী যোদ্ধার আবেদন ছোট করে দেখার উপায় নেই।

 তার এখন পোশাক পরার সময় হয়েছে। নিজের অসহিষ্ণুতা চেপে রেখে সে তার অনুচরদের মোসাহেবের ভঙ্গিতে তাকে ঘিরে ধরে, নরম হরিণের চামড়া দিয়ে তৈরি পাজামা আর সাদা রেশমের কাফতানে তাকে সুসজ্জিত করে তোলার অনুমতি দেয়, তারপরে তাদের বাড়িয়ে রাখা রেশমের একাধিক কারুকাজ করা টিউনিক থেকে একটা- তার নতুন প্রজাদের মন রক্ষার্থে উজ্জ্বল সবুজ রঙের যাতে তার ফারগানার হলুদ ডোরাকাটা রয়েছে সাথে ইস্পাতের বকলেস- সে পছন্দ করে। ফারগানার রুক্ষ কাপড় আর যেনতেন প্রকারে হরিণের চামড়া থেকে তৈরি পোশাকের চেয়ে সমরকন্দের দর্জির নিখুঁত সেলাই করা পোশাক একদম আলাদা মনে হয়। এক পরিচারক তার কোমরে একটা সঞ্জাবযুক্ত পরিকর গাণিতিক নিপূণতায় পরিয়ে দেয়। আরেকজন পায়ের কাছে বসে হাঁটু পর্যন্ত লম্বা সোনার সুতা দিয়ে কারুকাজ করা বুট পরতে সাহায্য করে। তারপরে চন্দনকাঠের একটা বাক্স থেকে বাবর কিছু অলঙ্কার পছন্দ করে। গয়নার প্রতি তার কোনো বিশেষ আগ্রহ নেই কিন্তু আজ বিবি খানম মসজিদে তাকে লোকজনের সাথে নামাজ পড়তে হবে আর উৎসুক জনতার চোখে তাকে যেন পুরোদস্তুর একজন সুলতানের মত দেখায়, যার প্রাচুর্য– আর একই সাথে তার উদারতা- সতত পরিবর্তনশীল মৈত্রী আর আনুগত্যের দুনিয়ায় যেন অফুরন্ত।

 সামনে রাজদণ্ড-বহনকারী আর পেছনে লম্বা চারজন দেহরক্ষী নিয়ে বাবর মার্বেল মোড়া পথের উপর দিয়ে হেঁটে বাগানের দিকে আসে, যেখানে ফুল লতা পাতা শোভিত চাদোয়ার নিচে বিছান গালিচায় তার পারিষদবর্গ আসনপিড়ি হয়ে বসে তার অপেক্ষা করছে। এইসব দীর্ঘ বৈঠক বাবরের বিরক্ত লাগে কিন্তু এখনও অনেক কাজ বাকী রয়েছে। তার চাচাজানের মৃত্যুর পরে উদ্ভূত অনিশ্চয়তা আর দ্বন্দ্ব এবং তারপরে তার অবরোধে অনেক ক্ষতি সাধিত হয়েছে। সমরকন্দের চারপাশের ক্ষেত আর তৃণভূমি যথেষ্ট উর্বর, কিন্তু কৃষকরা ভয়ে চাষই করেনি এবং এ বছরের ফসলের অনেকটাই নষ্ট হয়েছে। ফারগানা থেকে নিজেদের রসদের জন্য আনা শস্যবীজ আগামী বসন্তে চাষীরা যাতে চাষের কাজে ব্যবহার করতে পারে সেজন্য তাদের মাঝে বন্টনের আদেশ দিয়েছে বাবর। আর এছাড়া পশুপালকদের অনেকেই যুদ্ধের হাঙ্গামা থেকে দূরে পশ্চিমের নিজেদের গৃহপালিত পশুর পাল নিয়ে পালিয়ে গেছে। তাদেরও অভয় দিয়ে ফিরিয়ে আনার বন্দোবস্ত করতে হবে।

বাবর ভাবে, তাকে সাহায্য করার জন্য যোগ্য লোক অন্তত তার পাশে আছে। ওয়াজির খান, তার ইচকিসের, পারিষদবর্গের ভিতরে অন্যতম। এছাড়াও বাইসানগার আছে, সমরকন্দের সৈন্যরা তাকে প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করে। শহরের পতনের পরেই কেবল বাবর বুঝতে পেরেছে বাইসানগারের স্তোকবাক্য, নাশকতামূলক তৎপরতা, আর ঘুষের কারণে তাকে এত দুর্বল প্রতিপক্ষ মোকাবেলা করতে হয়েছে। তার প্রতি কৃতজ্ঞতাবশত, সমরকন্দের পুরো নিরাপত্তার দায়িত্ব বাবর বাইসানগারের উপরে অর্পণ করেছে।

আলি মজিদ বেগের পোড় খাওয়া মুখের উপরে তার দৃষ্টি আপতিত হয়। তাকে পারিষদবর্গের অন্তর্ভূক্ত করে সে বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে। অনেকটা অতীত আনুগত্যের কারণে পুরষ্কার যে কয়েকজন গোত্রপতি শুরু থেকে দ্ব্যর্থহীনভাবে শুরু থেকে বাবরকে সমর্থন জানিয়ে এসেছে, সে তাদের অন্যতম। কিন্তু এর ভেতরেও বিচক্ষণতার মারপ্যাঁচ রয়েছে। আলি মজিদ বেগ ফারগানার অন্যতম প্রভাবশালী গোত্রপতি। সমরকন্দে সে যে বাবরের সাথে অবস্থান করছে এটা অনেককেই প্রভাবিত করেছে- বাবরের ধারণা যাদের ভিতরে অনেকেই এই মুহূর্তেই ফারগানায় ফিরে যেতে চায়- থাকতে।

 কিন্তু, অনেকেই অবশ্য ফিরে গিয়েছে। তারা এই অভিযানে এসেছিলো লুট করতে আর একবার সেটা পাবার পরে বাড়ি ফিরে যাবার জন্য তারা অধীর হয়ে উঠেছে। বুনো আর উচ্ছঙ্খল চকরাস, নিষ্ঠুরতা আর বিশ্বাসঘাতকতা যেখানে নৈমিত্তিক ব্যাপার সেখানেও তারা তাদের সতত পরিবর্তনশীল মনোভাব আর নির্মমতার জন্য বিখ্যাত। তাদের দুর্গম পাহাড়ী আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে সটকে পড়তে শুরু করেছে এবং শরৎ কাল এসে পড়ার কারণে প্রতিদিনই আরও বেশি সংখ্যক লোক চলে যাচ্ছে। বাবরের পারিষদগণ সে এগিয়ে আসতে নতজানু হয়। কিন্তু সে হাতের ইশারায় তাদের উঠে দাঁড়াবার ইঙ্গিত দেয়। দিনের কাজ শুরু করার জন্য সে উদগ্রীব হয়ে আছে। সে ইতিমধ্যে একটা কথা হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছে যে, একজন সুলতানকে বড় বড় ব্যাপারেই মাথা ঘামালে কেবল চলবে না। মাত্র গতকালের ঘটনা, শকুনের মত দেখতে দুই গালিচা ব্যবসায়ীর ভিতরে উদ্ভূত ঝগড়ার মধ্যস্থতা তাকে করতে হয়েছে। সুদূর পারস্যের তিবরিজ থেকে আনা লাল, গোলাপী আর নীলরঙের গালিচার মূল্য নিয়ে দুজনেই বালখিল্যসুলভ বিবাদে লিপ্ত হয়েছিলো। সেই জানে। কিভাবে সে হাসি চেপে রেখেছিলো।

“সুলতান, এগুলো আজকের দিনের আর্জি।” তার পরিচারক হাতের রূপার ট্রের দিকে ইঙ্গিত করে। সেখানে একতাড়া কাগজ। বাতাসে যাতে উড়ে না যায় সেজন্য একটা পিতলের ওজন দিয়ে চেপে রাখা আছে।

উপরের আর্জিতে লেখা বিবরণীর দিকে তাকিয়ে বাবরের মন হতাশায় ভরে ওঠে। সম্ভবত কারো ছাগল বা ভেড়া হারিয়ে গেছে বা পাহাড়ের বিরান জমিতে পশুচারণের অধিকার চেয়ে কোনো আর্জি। “আমি ওগুলো পরে দেখবো।” এসবের চেয়ে শিকারে যাবার জন্য তার ভেতরটা ছটফট করে। সে হাতের ইশারায় তার পারিষদবর্গকে বসতে বলে এবং কাঠের নিচু মঞ্চের উপরে তার জন্য নির্দিষ্ট গজদন্তের কারুকাজ করা টুলে উপবেশন করে। তাদের মতো নিচে আসনপিড়ি হয়ে বসা অনেক বেশি কষ্টকর।

 “শহরের নিরাপত্তার পর্যালোচনা কবে নাগাদ শেষ হবে?” সে বাইসানগারকে জিজ্ঞেস করে।

“সুলতান, প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। অস্ত্রাগারে অস্ত্রের মজুদের চুড়ান্ত হিসাব সম্পন্ন হয়েছে। তবে রাজমিস্ত্রীরা এখনও শহর রক্ষাকারী দেয়াল আর র‍্যামপার্টের অবস্থা খুঁটিয়ে দেখছে। তারা বলেছে দু’বছর আগের ভূমিকম্পে দেয়ালের কয়েক জায়গার ভিতে ক্ষতি হয়েছে যা মেরামত করতে হবে।”

 বাবর মাথা নেড়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে। “মেরামত যা কিছু করার, সব দ্রুত শেষ করতে হবে। এতো সহজে সমরকন্দের পতন হয়েছে যে ব্যাপারটা আরো অনেকের মনোযোগ আকর্ষণ করবে। ওয়াজির খান, সাইবানি খান আর তার হায়েনাদের কি খবর?”

“তাদের ফিরে আসবার জন্য আমরা সর্বদা সতর্ক রয়েছি। কিন্তু আমাদের সীমান্তে টহল দেয়া সৈন্যরা এখনও উজবেক আক্রমণকারীদের কোনো আনাগোনা লক্ষ্য করেনি। সাইবানি খান জানে শীতকালের আগে আক্রমণ করার জন্য তার হাতে অল্প সময় আছে।”

 “কিন্তু সে অবশ্যই আসবে।” চিন্তিত কণ্ঠে বাবর বলে। সাইবানি খান ইতিমধ্যে সমরকন্দের একজন সুলতানকে হত্যা করেছে: আরেকজনকে বিশেষ করে কিশোর আর সদ্য সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়েছে এমন একজনকে হত্যা করতে তার ইতস্তত করার কোনো সঙ্গত কারণ নেই।

“হ্যাঁ, সুলতান, আমি জানি সেটা। আমরা সবাই জানি। কিন্তু বসন্তের আগে সে এখানে আসবে না। আমরা ততোদিনে তাকে আর তার বদমায়েশ শিষ্যগুলোকে একটা ভালো শিক্ষা দেবার জন্য প্রস্তুত থাকবো।” ওয়াজির খানের আত্মবিশ্বাস বাবরকে সামান্য হলেও স্বস্তি দেয়।

সহসা অনেকগুলোর কণ্ঠস্বর শুনে তারা সবাই চারপাশে তাকায়। উদ্যানের বিপরীত দিকে কমলা রঙের ম্যারিগোল্ড আর গোলাপী রঙের গোলাপের বাগিচার অপরপাশে, বাবর একজন প্রহরীর সাথে ঝুঁকেপড়া ক্ষুদে একটা অবয়বকে তাদের দিকে হেঁটে আসতে দেখে। লোকটার পরণে ভ্রমণের পোশাক এবং সে কাছে এসে রাস্তার ধূলো থেকে বাঁচবার জন্য মুখের চারপাশে জড়িয়ে রাখা বেগুনী রঙের গলবস্ত্র খুলতে বাবর তার দাদীজানের বয়োবৃদ্ধ খিদমতগার, ওয়ালিদ বাট্টের, বলিরেখায় পূর্ণ মুখমণ্ডল আর পাতলা হয়ে আসা সাদা চুল চিনতে পারে। তাকে দেখে বাবরের কেমন যেনো বিপর্যস্ত মনে হয়, আর সেটার কারণ ঘোড়ায় চড়ে দীর্ঘপত্র পরিক্রমা না- তার বয়সী লোকের জন্য অবশ্য সেটাই যথেষ্ট উপলক্ষ- বরং সে সাথে করে যে লেফাফা নিয়ে এসেছে সেটা।

এক মুহূর্তের জন্য, গ্রীষ্মকালের সন্ধ্যাবেলা সত্ত্বেও বাবর টের পায় একটা শিরশিরে অনুভূতি তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। এসান দৌলত কি তবে মৃত? দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে সে মঞ্চ থেকে নেমে বৃদ্ধ লোকটার কাঁধ জড়িয়ে ধরে। “খিদমতগার কি হয়েছে খুলে বলো? কি সংবাদ তুমি নিয়ে এসেছো?”

 ওয়ালিদ বাট্ট ইতস্তত করে, যেনো বুঝতে পারে না কোথা থেকে শুরু করবে। বাবরের ইচ্ছা করে এক ধমকে তার ইতস্ততভাব ঘুচিয়ে দেয়। কিন্তু জন্মের পর থেকে দেখে আসা লোকটার প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধের কথা স্মরণ রেখে সে নিজের অসহিষ্ণুতা দমন করে।

 “সুলতান, আপনার কাছে এভাবে হাজির হয়েছি বলে আমার অপরাধ মার্জনা করবেন কিন্তু আমাকে দ্রুত আসতে হয়েছে।” খিদমতগার আলখাল্লার ভিতর থেকে একটা চামড়ার থলে বের করে যা একটা ছোট দড়ির সাহায্যে তার গলা থেকে ঝুলছিল এবং সেটার ভেতর থেকে সে ফারগানার রাজকীয় সিলমোহর করা একটা চিঠি বের করে।

বাবর চিঠিটা নিয়ে দ্রুত সেটা খুলে পড়তে শুরু করে। হাতের লেখা দেখে সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কিন্তু তার মানসিক প্রশান্তি অচিরেই বাষ্পীভূত হয়। এসান দৌলতের লেখা শব্দগুলো তার চোখের সামনে যেনো নাচতে শুরু করে। “তুমি যদি আমাদের বিপর্যয়ে সাড়া না দাও তবে আমরা নিশ্চিত ধ্বংসের মুখোমুখি হবো।” পুরো চিঠিটা সে দ্রুত পড়া শেষ করে, কথা পুরোপুরি আত্মস্থ করতে পেরে তার হতভম্বভাবটা আরো বেড়ে যায়।

 “কি হয়েছে, সুলতান?” ওয়াজির খান জানতে চায়।

 “আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। আমার জারজ সৎ-ভাই জাহাঙ্গীরকে ফারগানার সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করা হয়েছে- একটা বাচ্চা পুতুল যাকে নিয়ে খেলছে আমার রক্তসম্পর্কীয় ভাই তামবাল। উপজাতি গোত্রপতিদের বখশিশের লোভ দেখিয়ে সে দলে টেনেছে…নিজের সুবিধার্থে সে জাহাঙ্গীরকে ব্যবহার করছে…” বাবরের আঙ্গুলের ফাঁক গলে চিঠিটা মাটিতে পড়ে গেলে বাতাস সেটাকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে গোলাপ ঝাড়ে আটকে দেয়। সে ভাবে আমার জন্মভূমির মসনদ আমি হারিয়েছি।

ওয়াজির খান চিঠিটা তুলে নিয়ে দ্রুত পড়তে থাকলে আরেকটা আরো ভয়ঙ্কর সম্ভাবনা বাবরের মাথায় উঁকি দেয়। আবার সে ওয়ালিদ বাট্টের কাঁধ চেপে ধরে। এবার এতোটাই জোরে যে কবুতরের মতো পলকা বৃদ্ধ লোকটা ব্যাথায় গুঙিয়ে উঠে। আমার মা, বোন আর নানীকে তুমি শেষবার কখন দেখেছো? তারা কোথায় আছে? তারা কি নিরাপদ আছে?”

ওয়ালিদ বাট্ট অসহায় দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। “দূর্গে আপনার উজির কাশিম আর তাদের সবাইকে বন্দি করে রাখা হয়েছে। আপনার নানীজান অনেক কষ্টে এই চিঠিটা আমাকে দিয়ে বলেছেন আপনার কাছে পৌঁছে দিতে। কিন্তু আমি বলতে পারবো না তারা জীবিত না মৃত। আমি জানি না। গত দু’সপ্তাহ আমার রাস্তাতেই কেটেছে।” তার কণ্ঠস্বর ভেঙে আসে।

সে সহসা টের পায় বুড়ো লোকটাকে ব্যাথা দিচ্ছে, বাবর তার মুঠো আলগা করে। “খিদমতগার, তুমি তোমার দায়িত্ব পালন করেছে। এখন খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নাও। তোমার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।” পেছন থেকে ওয়ালিদ বাট্টের দিকে তাকিয়ে তার মনে হয় বাতাস একটু জোরে বইলে বেচারার ক্ষীণকায় দেহ বোধহয় উড়েই যাবে।

বাবর বিচলিত বোধ করে। তার প্রারম্ভিক অবিশ্বাসের জায়গায় জলোচ্ছাসের মত ক্রোধ এসে ভর করে। তামবালের এত বড় আস্পর্ধা তার সালতানাত দখল করে তারই পরিবারকে অন্তরীণ করেছে…? কিন্তু সে নিজের মনোভাব নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করে। সে এখন যে সিদ্ধান্ত নেবে তার উপরেই সবকিছু নির্ভর করছে। তার দিকে উদগ্রীব চোখে তাকিয়ে থাকা পারিষদবর্গের দিকে তাকিয়ে সে একটা গভীর শ্বাস নেয়।

 “ওয়াজির খান, আমার দেহরক্ষী বাহিনীকে প্রস্তুত করেন। আমরা এই মুহূর্তেই ফারগানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবো। বাইসানগার একটা বাহিনী প্রস্তুত করেন। আমার অধীনস্ত গোত্রপতি আর তাদের লোকদের ডেকে পাঠান- তামবাল আর তার অনুগত উপজাতীয় বাহিনীকে শায়েস্তা করতে হলে দু’হাজার লোকের বাহিনীই যথেষ্ট হবে। আমার ধারণা একবার আকশি পৌঁছালে ফারগানার বেশিরভাগ লোকই তাদের ন্যায়সঙ্গত সুলতানের পক্ষ সমর্থন করবে। যাই হোক, সাইবানি খান আসলে যাতে নিরাশ না হয়, সেজন্য এখানে যথেষ্ট সেনা মোতায়েন রাখেন এবং এক সপ্তাহের ভিতরে আমাদের অনুসরণ করবেন। আর হ্যাঁ, দুরমুজ আর অবরোধ যন্ত্র এবং নিক্ষেপক প্রস্তুত রাখবেন, যেনো আমি নির্দেশ পাঠালে সাথে সাথে পাঠাতে পারেন। আলি মজিদ বেগ আমার অনুপস্থিতিতে আপনি সমরকন্দের রাজপ্রতিনিধি হিসাবে দায়িত্বপালন করবেন। ঠিকমতো পাহারা দেবেন আশা করি।”

তিন বয়স্ক লোক মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। বাবর তার অলংকার খুলতে খুলতে ঘুরে দাঁড়ায় এবং তার ঘোড়সওয়ারের পোশাক আর হাতিয়ার আনতে আদেশ দেয়।

***

ওয়াজির খানের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সে গ্রীষ্মের দাবদাহে এখনও তৃণহীন চারণভূমির উপর দিয়ে ঘোড়া হাকিয়ে যায়। বাবরের মনে নিদারুণ যন্ত্রণার ঝড় বয়ে চলে। নিজের পরিবারের জন্য অপরাধবোধ আর ভয় এবং যারা নয় বছরের এক বালকের সাহায্যে তাকে তার সালতানাত থেকে উচ্ছেদ করতে পারবে বলে ভেবেছে তাদের জন্য তার ভেতরে ক্রোধের দাবাগ্নি ধিকিধিকি জ্বলতে থাকে। গত কয়েক সপ্তাহ সে মূখের স্বর্গে বাস করেছে। স্বপ্নহতের মত সমরকন্দের চারপাশে বিচরণ করে বেড়িয়েছে, নিজের পরিবারকে কিভাবে এই রূপকথার শহর দেখাবে তার পরিকল্পনা করেছে।

ঔদ্ধত্যের সাথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টাই সে এড়িয়ে গেছে। ভেবেছে ফারগানায় সবাই তাকে বীরের চোখে দেখবে আর বিদ্রোহের কথা কল্পনাও করবে না। তামবাল আর তার সমর্থকেরা নেকড়ের মতো পশুপালকের পিঠ ঘুরিয়ে নেয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছে। যাতে তারা নিশ্চিন্তে ভেড়ার পালের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। আর ব্যাটারা অবশ্যই ধূর্ত, নতুবা তার নানীজান, আম্মিজান অথবা কাশিম ঠিকই কিছু একটা গোলমালের আভাস আঁচ করে এবং বাবরকে আগেই সতর্ক করতো। তার পরিবারের মেয়েদের যদি কিছু হয়…রোক্সানা যদি ফারগানার নতুন সুলতানের মা হিসাবে তার প্রতিপক্ষ আর শত্রুদের বিনাশ করতে চায়… সে বিষয়টা নিয়ে আর চিন্তা করতে চায় না।

প্রতি রাতে ঘোড়ার পিঠে বহু ঘণ্টা কাটিয়ে তারা যখন ক্লান্ত হয়ে হয়ে অস্থায়ী ছাউনি ফেলে, তখনও বাবর দুচোখের পাতা এক করতে পারে না। পূর্বদিকে না এগিয়ে বৃথা বিশ্রামে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত তার কাছে বিষবৎ মনে হয় এবং তাকে বিশ্রাম নিতে অনুরোধ করায় সে খামোখাই ওয়াজির খানের উপরে ক্ষেপে উঠে। কিন্তু চতুর্থ রাত্রে ঘুমাবার কোনো প্রশ্নই উঠে না। মাটিতে পাতা বিছানায় পিঠ দেয়া মাত্র সে কাঁপতে থাকে এবং তার কপাল ঘামে ভিজে উঠে। সকাল নাগাদ তার দাঁতে দাঁত লেগে এমন ঠকঠক করতে থাকে যে, সে কোনো কথাই বলতে পারে না। সে যখন উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করে তার পা দেহের ভার নিতে অস্বীকার করায় সে অসহায়ের মতো আবার মাটিতে শুয়ে পড়ে। ওয়াজির খান নিমেষে তার পাশে এসে উপস্থিত হয়, নাড়ী দেখে চোখের পাতা টেনে ধরে মণি দেখতে। “সুলতান আজ আপনি অশ্বারোহন করতে পারবেন না।”

 এই প্রথম বাবর তর্ক করার মত শক্তি খুঁজে পায় না। সে টের পায় ওয়াজির খান তার দেহ ভারী উলের কম্বল দিয়ে মুড়ে দিচ্ছে। কিন্তু চোখ তুলে তার দিকে তাকাতে গেলে তার চোখের সামনে পুরো পৃথিবীটা দুলে উঠে এবং আঁধার হয়ে আসে। তারপরে পুরোটা অন্ধকারে ছেয়ে যায়।

***

জ্বরের উত্তাপে শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁটের ফাঁকে ফোঁটা ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। বাবরের জিহ্বা তালুতে অর্ধেক আটকে ছিলো, এখন খুলে এসে আগ্রহের সাথে পানির স্পর্শ গ্রহণ করে। তার কোনো ধারণাই নেই সে কোথায় আছে। মূল্যবান আর্দ্রতা লাভ করাই এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অবশেষে কেঁপে উঠে তার চোখের পাতা খুলে যায়। ওয়াজির খানের চিরবিশ্বস্ত অবয়ব তার দিকে ঝুঁকে আছে। এক হাতে একটা লম্বা সুতির কাপড়ের টুকরো ধরে রয়েছে। তার অন্য হাতে একটা পানির বোতল। বাবরকে জ্ঞান ফিরে পেতে দেখে সেগুলো মাটিতে নামিয়ে রেখে সে হাঁটু মুড়ে বসে অপেক্ষা করে।

 পিপাসায় বাবরের বুক শুকিয়ে কাঠ হয়ে রয়েছে। আরো পানি।” সে বলতে চেষ্টা করে, কিন্তু শুকনো ঠোঁটের ফাঁক গলে কেবল একটা কর্কশ আর্তনাদ বের হয়। ওয়াজির খান বুঝতে পারে। কাপড়ের টুকরোর একটা প্রান্ত সে বাবরের ঠোঁটের মাঝে স্থাপন করে এবং বাবরের অজান্তে গত এক ঘণ্টা ধরে সে যা করে আসছিলো সেটাই করতে থাকে: কাপড়টাতে পানির একটা ক্ষীণ ধারা ঢালতে থাকে, যাতে বাবরের মুখে কয়েক ফোঁটার বেশি পানি গড়িয়ে না পৌঁছে।

অনেকক্ষণ পরে, বাবর শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পানি ছিটকে ফেলে এবং কোনোমতে উঠে বসে। ওয়াজির খান কাপড় আর পানির বোতলটা আবার একপাশে সরিয়ে রাখে এবং তার কপালে হাত রেখে উত্তাপ অনুভব করে। “সুলতান, আপনার জ্বর অবশেষে কমতে শুরু করেছে।”

চারপাশে তাকিয়ে বাবর দেখে তারা একটা ছোট গুহার ভেতরে রয়েছে, যার কেন্দ্রে আগুন জ্বলছে। তার মাথা আবার ঘুরতে শুরু করলে সে চোখ বন্ধ করে ফেলে। “আমি কতদিন ধরে অসুস্থ?”

“সুলতান, চারদিন হয়ে গেছে। আজ পঞ্চমদিনের দুপুরবেলা।”

“কি হয়েছিলো? নিশ্চয়ই বিষের ক্রিয়া না…?”

ওয়াজির খান অসম্মতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। “না। কেবল জ্বর- খুব সম্ভবত ভেড়ার আঁটুলির দংশন।”

বাবর প্রায় হেসে ফেলে- এই সময়ে ভেড়ার আঁটুলির দংশন!

“কে আছে, সুরুয়া নিয়ে এসো।” ওয়াজির খান তার এক লোককে উদ্দেশ্য করে বলে। যবের আটার তৈরি সুরুয়া ভর্তি পাত্রটা নিয়ে আসলে সে বাবরের পাশে হাঁটু ভেঙে বসে এক হাতে পাত্রটা তার মুখের কাছে তুলে ধরে। অন্য হাতে তার মাথাটা। ধরে। উষ্ণ তরলটার স্বাদ ভালই, কিন্তু সামান্য খাবার পরেই তার পাকস্থলী মোচড় দিয়ে উঠলে সে পাত্রটা একপাশে সরিয়ে দেয়।

“সমরকন্দ থেকে কোনো সংবাদ এসেছে? বাইসানগারের সেনাবাহিনী নিয়ে এতদিনে পৌঁছে যাবার কথা।”

“না, সুলতান। কোনো সংবাদ আসেনি।”

 “আর ফারগানার কি খবর?” এভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ার জন্য বাবর নিরবে ভাগ্যকে অভিশাপ দেয়। কপাল ভালো হলে এতদিনে ফারগানা তাদের দৃষ্টিসীমায় পৌঁছে যাওয়া উচিত ছিলো।

ওয়াজির খান আবার মাথা নাড়ে। “আমি কোনো সংবাদের প্রত্যাশা করিনি। আমি আমার কোনো লোককে রেকী করতেও পাঠাইনি। আমার একমাত্র অভিপ্রায় ছিলো সুস্থ হয়ে উঠা পর্যন্ত আপনাকে লুকিয়ে রাখা। ফারগানা আর এখানে অনেক গুপ্তচর রয়েছে। আপনার অসুস্থতার সংবাদ ফারগানায় পৌঁছালে-…”

সে বাক্যটা শেষ না করলেও বাবর ঠিকই বুঝতে পারে। বালক সুলতানের পেছনের কুশীলবরা যদি একবার ভেবে নেয় যে সে মারা গেছে তবে তার পরিবারের জেনানারা পরের দিনের সূর্যোদয় দেখার জন্য বেঁচে থাকবে না।

 “ধন্যবাদ, ওয়াজির খান। আরো একবার আমার দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে, এমন সব কিছুর প্রতি আপনি লক্ষ্য রেখেছেন।” ওয়াজির খানের কথা শুনে নিজের দুর্দশার কথা তার আবার মনে পড়ে যায়। বাবর আধশোয়া হয়, আশা করে তার দেহে আবার শক্তি ফিরে আসবে। কিন্তু এই মুহূর্তে নিজের দুর্বলতার ব্যাপারে সে পুরোপুরি সচেতন। আজ বাকি দিনটা আমি বিশ্রাম নেবো, কিন্তু কাল থেকে আমরা আবার যাত্রা শুরু করছি।”

 “হ্যাঁ, সুলতান আপনার স্বাস্থ্য যদি আমাদের সে অনুমতি দেয়।”

 “আমি ঠিকই পিরবো।” বাবর পুনরায় চোখ বন্ধ করে মনে মনে দোয়া করে তার কথাই যেনো ঠিক হয়।

পুরো দিনটা আর রাতের বাকি সময়টা সে ঘুমিয়ে কাটায়। কিন্তু পরের দিন সকালের আলো গুটিগুটি পায়ে গুহার ভিতরে প্রবেশ করতেই তার ঘুম ভেঙে যায়। সতর্কতার সাথে উঠে বসে সে দেখে, মাথা আগের চেয়ে পরিষ্কার লাগছে এবং দুর্বল বোধ করলেও কারো সাহায্য ছাড়াই সে উঠে দাঁড়াতে পারে। গুহার শৈবালের প্রলেপযুক্ত দেয়ালের গায়ে হাত রেখে সে আড়ষ্ঠ ভঙ্গিতে হেঁটে এর মুখের দিকে এগিয়ে আসে এবং মাথা নিচু করে বাইরে বের হয়। ভেড়ার চর্বি দিয়ে জ্বালানো উজ্জ্বল আলোর চারপাশে ওয়াজির খান আর তার কয়েকজন দেহরক্ষী আসনপিড়ি হয়ে বসে রয়েছে। একটা অস্থায়ী কাঠামো থেকে আগুনের উপরে একটা পেতলের কেতলি ঝুলছে।

ওয়াজির খান মাটির কাপে ধোঁয়ার গন্ধযুক্ত একটা উষ্ণ পানীয় আর একটুকরো শুকনো রুটি তার হাতে ধরিয়ে দিলে সে চিবোতে শুরু করে। সে চারপাশে তাকিয়ে লক্ষ্য করে ঘোড়ার পাল দড়ি দিয়ে লতা ঝোঁপের সাথে বেঁধে রাখা হলেও ইতিমধ্যে তাদের পিঠে মালপত্র আর পর্যাণ চাপান শেষ। বরাবরের মতোই ওয়াজির খান সবকিছু ঠিকমতো গুছিয়ে রেখেছে। আধঘণ্টার ভেতরেই তারা নিভুনিভু আগুনের উপরে মাটি চাপা দিয়ে কাছের ঝর্ণা থেকে চামড়ার পানির বোতলগুলো ভরে নিয়ে ঘোড়ায় চেপে বসে।

 বাবর তার চিরাচরিত ক্ষিপ্রতা ছাড়াই ঘোড়ার পিঠে উঠে বসলে টের পায় কেবল ওয়াজির খান না, তার দলের বাকি সবাই তাকিয়ে আছে। এক মুহূর্তের জন্য ইতস্তত করে সে সূর্যোদয় আর ফারগানার উদ্দেশ্যে ঘোড়া হাঁকায়।

***

জাক্সারটাস নদী আর তার বাড়ি দূর থেকে চোখে পড়তে বাবরের হৃৎপিণ্ডের গতি দ্রুত হয়ে উঠে। নদীর উপরের চূড়োর অর্ধেকটা নিয়ে নির্মিত দুর্ভেদ্য আকশি দূর্গে তার বাল্যকালের সবচেয়ে মধুর সময় কেটেছে। এই মুহূর্তে সমরকন্দ বিজয়ের গৌরবও তুচ্ছ মনে হয় এবং সে টের পায় তার চোখে অশ্রু জমে উঠছে।

“সুলতান, আজ রাতে আর এগোনো বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।” ওয়াজির খানের। চোখেও অশ্রু টলমল করে। “তারা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমাদের অগ্রগামী বাহিনী পাঠানো পর্যন্ত আমরা আত্মগোপন করে থাকবো।”

 ঘোড়া হাঁকিয়ে দূর্গের ফটকে গিয়ে বাবরের ইচ্ছা করে ভেতরে প্রবেশ করতে। কিন্তু ওয়াজির খানের কথাই ঠিক। টলোমলো ভঙ্গিতে সে ঘোড়ার পিঠ থেকে নামে এবং হাতেপায়ে জ্বরের পরের ব্যাথা অনুভব করে, এবং শুনতে পায় ওয়াজির খান নিজের দুইজন শ্রেষ্ঠ আর দ্রুতগামী ঘোড়সওয়াড়কে সামনে গিয়ে রেকী করে আসবার জন্য আদেশ দিচ্ছে।

দূর্গ এখান থেকে কমপক্ষে একঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত। ক্রমশ ঘনিয়ে আসা। অন্ধকারে আর অগ্রগামী দলটাকে সতর্ক থাকতে হবে সম্ভবত আরও বেশি যেনো কেউ তাদের দেখতে না পায়। তাদের ফিরে আসতে বেশ সময় লাগবে। পাহাড়ের শীর্ষভাগে বাবর আর তার লোকেরা যেভাবে অবস্থান করছে আর ঢালে ফিরে যেতে অনিচ্ছুক সেখানে নিজেদের উষ্ণ রাখতে বা খাবার রান্না করার জন্য আগুন জ্বালানোটা বোকামীর নামান্তর হবে। অবশ্য এমন না যে, তাদের সাথে পর্যাপ্ত রসদ রয়েছে। বাবর আরোগ্য লাভ করার পরের ছয় দিন তারা শিকারের অন্বেষণে এতটুকুও সময় নষ্ট করেনি বরং সমরকন্দ থেকে নিয়ে আসা শুকনো ফল, আপেল, পনির আর প্রায় গুড়ো হয়ে আসা রুটির উপরে নির্ভর করে কাটিয়েছে। বাবর একটা কম্বলে নিজেকে ভালমতো জড়িয়ে নিয়ে একটা শুকনো তরমুজের ফালি চিবুতে থাকে। ফালিটার মিষ্টত্ব তাকে রীতিমত বিরক্ত করে এবং সে সেটা মুখ থেকে ফেলে পানির বোতলে বড় একটা চুমুক দিয়ে মিষ্টির কারণে সৃষ্ট মুখের অরুচি দূর করতে চেষ্টা করে।

 ভোর হবার দু’ঘণ্টা আগে তাদের পাঠানো রেকী ফিরে আসে। আর বাবর যেমনটা আশা করেছিলো পরিস্থিতি ঠিক ততোটাই খারাপ। দূর্গের ফটক বন্ধ আর প্রচুর পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে। নদীর পাশের তৃণভূমিতে আগুন পোহাতে থাকা এক পশুপালক আর তার দু’ছেলেকে পেয়েছিল তার স্কাউটরা, বেচারা তাদের দেখে এতটাই ভড়তে গিয়েছিলো যে গড়গড় করে তারা যা জানতে চেয়েছিলো সব বলে দিয়েছে। যাযাবর গোষ্ঠীর অনেক নেতাই বাবরের সৎ-ভাইকে সমর্থন দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সমরকন্দের বাইরে কৃষকের স্ত্রীকে ধর্ষণ আর তার শস্য চুরির অপরাধে যে গোত্রপতির লোকদের সে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলো তারা বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দিয়েছে জানতে পেরে বাবর মোটেই অবাক হয় না। আর জাহাঙ্গীরের দাদাও তার সাথে রয়েছে। রোক্সানা আর তার ছেলেকে দূর্গে নিয়ে এসেছিলো যে আপাত নির্বিরোধী বুড়ো লোকটা বাবর তার কথা ভাবে। তাদের আশ্রয় দেয়াটাই তার ভুল হয়েছিলো। কিন্তু এছাড়া তার আর কিইবা করার ছিলো? জাহাঙ্গীর তার সৎ-ভাই। রক্ত রক্তই।

 ইউসুফ, তার বাবার সময়ের সেই মোটাসোটা কোষাধক্ষ্য, সাথে বাবা কাশকা, শাহী বাজারসরকার, এবং তার খর্বকায় অস্থিরচিত্ত শাহী জ্যোতিষী বাকী বেগও তার সৎ-ভাইয়ের সাথে যোগ দিয়েছে শুনতে পেয়ে সে মোটেই অবাক হয় না- বাবর যদিও তাদের প্রাণে বাঁচিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু তাদের বাধ্য করেছিলো লাভজনক শাহী পদ থেকে ইস্তফা দিতে।

 বোন, আম্মিজান আর কথা তার মনে ভিড় করে। অগ্রগামী দল তাদের কোনো খবর জানতে পারেনি। নিজের অক্ষমতাকে সে অভিশাপ দেয়। সে নিজে আর সাথের দু’ডজন দেহরক্ষী আর কিইবা করতে পারে? তার মূল বাহিনী এসে পড়া পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতেই হবে।

সূর্য উঠতে বেশতর পাহাড়ের শীর্ষদেশে জমে থাকা বরফ স্ফটিকের মত চমকাতে থাকলে বাবর তার আলখাল্লা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে ইশারায় সে একা থাকতে চায় বলে তারা যেখানে ছাউনি ফেলেছে সেই টিলা বেয়ে উঠতে শুরু করে। তার পায়ের নিচের শিশির সিক্ত পান্না সবুজ ঘাস বেশ পিচ্ছিল। বেশ তাজা আর মিষ্টি একটা গন্ধ। কিন্তু অচিরেই শীত নামবে আর এই ঢাল তখন জমে শক্ত আর সাদা হয়ে উঠবে। ভাবনাটা তাকে বিচলিত করে তোলে। শীতকালে সে কিভাবে অভিযান পরিচালনা করবে?

 পূর্ব থেকে বয়ে আসা বাতাসে শীতের কাঁপন স্পষ্ট। একটা পাথরের আড়ালে বসে বাবর তীক্ষ্ণ চোখে সামনের ভূখণ্ডের দিকে তাকিয়ে থাকে, যার প্রতিটা ঢাল সে এতো ভালো করে চেনে যে সেগুলোকে তার নিজের দেহের একেকটা অংশ বলে মনে হয় সবুজ তৃণভূমির প্রতিটা বিস্তার, প্রতিটা খাড়া ঢাল বিশিষ্ট উপত্যকার ধূসর পাথরের বিন্যাস, পর্বতের আঁকাবাঁকা চূড়া আর জাক্সারটাসের বাঁক। সর্বস্ব হারাবার বেদনা তাকে উদ্বেল করে তুললে সে মাথা নিচু করে বসে থাকে।

 নির্মেঘ, উজ্জ্বল আকাশের অনেক উঁচুতে সূর্য উঠে আসবার পরে বাবর পশ্চিম থেকে ঘোড়ার অস্পষ্ট পায়ের শব্দ ভেসে আসতে শুনে। দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে সে ঘুরে পেছনে তাকায় এবং অশ্বারোহী বাহিনীর একটা লম্বা সারিকে দূর থেকে উপত্যকার ভিতর দিয়ে এগিয়ে আসতে দেখে। চোখ কুঁচকে তাকিয়ে, সে গুনতে চেষ্টা করে সম্ভবত দুইশো হয়তো আরো বেশি এবং সবুজ নিশানের একটা ঝলক সে দেখতে পায়। নিঃসন্দেহে এটা বাইসানগারের পাঠান অগ্রগামী দল।

নিজের ভেতরে নতুন শক্তির একটা স্ফুরণ অনুভব করে। হতাশা ঝেড়ে ফেলে সে ঘুরে দাঁড়ায় এবং পাহাড়ের পাদদেশে স্থাপিত অস্থায়ী ছাউনির দিকে হোঁচট খেতে খেতে নেমে আসে। “ওয়াজির খান, আমাদের বাহিনী এসে পৌঁছেছে।” ছাউনিতে দৌড়ে প্রবেশের ফাঁকে সে চিৎকার করে ঘোষণা করে।

 “আপনি নিশ্চিত তারা আমাদেরই লোক?”

 “আমি নিশ্চিত। সমরকন্দের সবুজ নিশান তারা বহন করছে।”

 “সুলতান, আমি পথ দেখিয়ে তাদের এখানে নিয়ে আসবার জন্য একটা অভ্যর্থনা বাহিনী পাঠাচ্ছি।”

কম্পিত হৃদয়ে বাবর তার লোকদের একটা অংশকে এগিয়ে যেতে দেখে। এবার দূর্গ থেকে অপদার্থ নচ্ছাড়গুলোকে তাড়িয়ে দেবো। তামবাল তার বিশ্বাসঘাতকতার জন্য পস্তাবে এবং তার সাথে বাকি সবাই… বাবর পর্যাণ থেকে তার আব্বাজানের তরবারিটা বের করে আনে। খাপ থেকে সেটা বের করতে বটের চুনি সূর্যের আলোতে ঝলসে উঠে। হাতে নিয়ে তরবারিটার ওজন পরখ করতে তার ভালোই লাগে এবং মানসপটে সে তামবালের ভোলা ঘাড়ে সেটা সে এককোপে নামিয়ে আনতে দেখে, ফারগানা শাসনের প্রথম দিনে সে কামবার আলির ঘাড়ে যেভাবে এটা নামিয়ে এনেছিলো।

অচিরেই বাইসানগারকে সামনে নিয়ে অভ্যর্থনাকারী বাহিনী ফিরে আসে।

বাবর সামনে এগিয়ে যায়। শিরোস্ত্রাণের নিচে বাইসানগারকে বিধ্বস্ত দেখায়। “মূল বাহিনী কখন এসে পৌঁছাবে? তারা কি অনেক দূরে রয়েছে?”

উত্তর দেবার আগে বাইসানগার এক মুহূর্ত ইতস্তত করে। “সুলতান, মূল বাহিনী। বলে কিছু আর অবশিষ্ট নেই।”

বাবরের চোখের আশার আলো যেন দপ করে নিভে যায়। “কি বলতে চাইছো?”

“আপনার চাচাতো ভাই, কুন্দুজের মাহমুদ, সমরকন্দ অবরোধ করেছিলো। তামবালের সাথে সে নিশ্চয়ই আগেই পরিকল্পনা করেছিলো এবং নিজের বাহিনীকে সেভাবে প্রস্তুত রেখেছিলো। অগ্রগামী বাহিনীকে সাথে নিয়ে আমি শহর ত্যাগ করা পর্যন্ত সে অপেক্ষা করেছে। তারপরেই আক্রমণ শানিয়েছে। গ্রান্ড উজিরের কয়েকজন প্রাক্তন পারিষদ যাদের উজিরের কন্যা, মাহমুদের স্ত্রী, বার্তাবাহকদের মাধ্যমে প্রচুর বখশিশের লোভ দেখিয়ে দলে টেনেছিল, তারা তাকে ভেতর থেকে সাহায্য করেছে। আমরা পাঁচদিন পথ চলার পরেই কেবল বার্তাবাহক সমরকন্দ পতনের সংবাদ নিয়ে আমার কাছে পৌঁছে। আমি দুঃখিত সুলতান। আমি আমার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছি।”

 “মাহমুদ…” বাইসানগারের কথা যেনো বাবর বিশ্বাস করতে পারে না। তার সারা জীবনের পরিচিত, যাকে সে বন্ধু মনে করতো, তার সেই ভাই- যাবো স্ত্রীকে সেই তাকে উপহার হিসাবে পাঠিয়েছে। এভাবে তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে এটা যে অবিশ্বাস্য। “আলি মজিদ বেগের কি অবস্থা?”

 “সুলতান তিনি মৃত। সবুজাভ তোরণদ্বারে এখন উজিরের বদলে তার মৃতদেহ ঝুলছে এবং তার সাথে আপনার প্রতি বিশ্বস্ত আরো অনেকেই মারা গিয়েছে।” বাবর ঘুরে দাঁড়ায়, চাচাত ভাইয়ের প্রতি বিতৃষ্ণা এবং অনুগত আলী মজিদ বেগের মৃত্যু তাকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। একই সাথে অন্য আরেকটা ব্যাপারে তার মন ধাতস্থ হতে চায় তার এই সর্বস্ব হারাবার ব্যাপকতা। সমরকন্দ সে ঠিক কতোদিন শাসন করেছিলো। একশ দিন…? আর এখন সে সালতানাহীন এক সুলতান, ফারগানাও তার হাতছাড়া হয়েছে। তার মরহুম আব্বাজানের তরবারি এখনও সে হাতে ধরে রেখেছে এবং বাঁটের নিরেট অনুভূতি তাকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দেয়। বাঁটটা আরো শক্ত করে ধরে সে নিজেকে প্রতিশ্রুতি দেয় এটা তার নিয়তি হতে পারে না। এটা সে কিছুতেই হতে দেবে না। যতো সময়ই লাগুক, যতো রক্তপাত প্রয়োজন হোক, সে নিজের অধিকার আবার আদায় করে নেবে। তাকে যারা অপমানিত করেছে সবাইকে তার মূল্য শোধ করতে হবে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *