১০ অধ্যায় – দ্য টেরেইন

১০ অধ্যায় – দ্য টেরেইন

সানজু বলেন:

প্রকৃতি অনুসারে ভুমিকে একসেসেবল, এন্ট্রপিং, ইনডিসাইসিভ, কনট্রিকটেড, প্রেছিপশাস, এবং ডিসট্যান্ট এই ছয়ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সানজুর মতে,

এক. একসেসেবল গ্রাউন্ড হল এমন ধরনের জায়গা যেখানে যাতায়াতের ভাল রাস্তাঘাট থাকে, তাই চলাচল সহজ আর দ্রুত হয়। এই ধরনের ভুমির ক্ষেত্রে যারা আগে পৌঁছুতে পেরেছে এবং উঁচু আর সূর্যের দিক করে অবস্থান নিতে পারে এবং সৈন্যদের জন্য রসদ সরবরাহ ঠিক রাখতে পারে; সেই লড়াইয়ে সুবিধা জনক অবস্থানে থাকে।

দুই. যে এলাকায় ঢোকা সহজ কিন্তু সেখান থেকে ফিরে আসা কঠিন তেমন জায়গাকে বলা হয় এন্ট্রপিং বা এন্ট্যাংলি। এমন জায়গার প্রধান একটা বৈশিষ্ট্য হল যদি শত্রু অপ্রস্তুত থাকে তবে আপনি তাকে সহজেই পরাজিত করতে পারবেন। আর শত্রু যদি প্রস্তুত থাকে আর আপনি হেরে গেলেন, তবে সেখান থেকে বেঁচে ফেরা অসম্ভব হয়ে পড়বে। আর তাই এমন জায়গায় আক্রমণ করা অলাভজনক।

তিন. ইনডিসাইসিভ বা টেম্পেরাইজিং গ্রাউন্ড হল এমন এক ধরনের এলাকা যেখানে উভয় দলের জন্য প্রবেশ করা কষ্টসাধ্য। এ ধরনের এলাকায় ছোট নদীনালা, কর্দমাক্ত চাষা জমি, জলাভুমি এসব থাকে। ফলে সেনাদের চলার গতি কমে যায়। এ ধরনের জমির ক্ষেত্রে নিজে সেখানে প্রবেশ না করে শত্রু সেখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য প্রলুব্ধ করুন। আর শত্রুর অর্ধেক সৈন্য বেরিয়ে আসলেই আক্রমণ করুন যাতে শত্রুর বাকি অর্ধেক সৈন্য বেরিয়ে এসে যুদ্ধে অংশ নেয়ার আগেই প্রথম অর্ধেক পরাজিত হয়।

চ্যাং ইউ এর ভাষ্যমতে, লি চিং এর ‘আর্ট অব ওয়ার’ বলছে: ‘যে ভুমিতে কোন পক্ষের জন্যই সৌভাগ্য অপেক্ষা করছে না তেমন জায়গায় প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে শত্রুকে বেরিয়ে আসার জন্য বাধ্য করুন। অপেক্ষা করুন, তাদের অর্ধেক সৈন্য বেরিয়ে এলেই আক্রমণ করুন।’

চার. কনস্ট্রিকটেড গ্রাউন্ডে প্রবেশের পর চারিদিক থেকে ঘেরা থাকে। তবে সেখানে প্রবেশের বিভিন্ন রাস্তা থাকতে পারে। এমন জায়গায় যদি আপনি আগে পৌঁছুতে পারেন তবে ঢুকে প্রবেশের সবগুলো রাস্তা বন্ধ করে দিন। আর আপনার প্রতিপক্ষ আগে প্রবেশ করে রাস্তা বন্ধ করে দিলে অরক্ষিত কোন রাস্তা খুঁজে বার করুন। একেবারেই তেমনটা না পেলে আক্রমণের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন।

পাঁচ. প্রেসিপশাস গ্রাউন্ডে আগে দখল করে কিছুটা উঁচু জায়গায় সূর্যের দিক মুখ করে প্রস্তুতি গ্রহণ করে শত্রুর জন্য অপেক্ষা করুন। আর শত্রু যদি এমন জায়গাটা আগে থেকেই দখল করে রাখে, তাহলে তাকে অনুসরন করার চেষ্টা না করে বরং চেষ্টা করুন শত্রুকে তার অধিকৃত এলাকা থেকে নেমে আসতে বাধ্য হত।

চ্যাং ইউ এর ভাষ্যমতে, সমতল ভুমিতে কেউ যদি আগে থেকে প্রস্তুতি নিয়ে থাকে তাহলে এই জায়গাটা আর কতটুকুই বা বিপজ্জনক হতে পারে! শত্রুর জন্য এমন জায়গা কি ছেড়ে দেয়া উচিত?

শত্রুর সমপরিমাণ শক্তি থাকলে যখন শত্রু আপনার থেকে বহু দুরে থাকে তখন শত্রুর কাছে গিয়ে যুদ্ধ করা মানে তার জানাশোনা এলাকায় যুদ্ধ করা। আর তেমনটা করা অনর্থক। এগুলো হল ছয় ধরনের যুদ্ধক্ষেত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। এক্ষেত্রে একজন সেনাপ্রধানের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হল এমন জায়গাগুলো অত্যন্ত সুদক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করে ভুমি অনুযায়ি রণকৌশল প্রস্তুত করা।

মেই ইয়াও-চেন এর ভাষ্যমতে, আর তাই বলা যায়, টেরেইন হল যুদ্ধের মৌলিক একটা উপাদান যার আনুকুল্যতার মাধ্যমে সৈন্যরা সহজে জয় নিশ্চিত করতে পারে।

.

সৈন্যরা যখন অবাধ্য, ক্ষুদ্ধ, বিশৃঙ্খল অথবা বিদ্ধস্ত তখন তারা পালাতে বাধ্য হয়, আর এমনটা ঘটে সেনাপ্রধানের ভুলের কারণে। এটাকে প্রকৃতির প্রতিকুলতার উপর কখনও দায়ি করা যায় না। অন্যান্য কারণগুলিও সমভাবে দায়ী:

এক. যদি টেরেইনের সুবিধাটা নিয়ে শত্রু বাহিনী তার শক্তির চেয়ে দশগুন। শক্তি অর্জন করতে পারে তবে ফলাফল অত্যন্ত জঘন্য হতে পারে।

তু-মু-এর ভাষ্যমতে, যখন একজনকে দশজনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়, প্রথমে প্রতিপক্ষের সেনাপ্রধানের বিচক্ষণতা এবং কৌশলগুলির সাথে তুলনামুলক বিচার করতে হয়। সেক্ষেত্রে সৈন্যরা কি সাহসী না ভীতু, আবহাওয়া, টেরেইনের থেকে কি কি সুযোগ পাওয়া যেতে পারে, সৈন্যরা কি ক্ষুধার্ত, তারা কি চিন্তিত আর ক্লান্ত কিনা।

দুই. সৈন্যরা যখন অফিসারদের থেকে বেশি বুদ্ধিমান হয় তখন সৈন্যদল অবাধ্য হয়ে উঠে।

তিন. অফিসাররা যখন সাহসী আর সৈন্যরা নিষ্ক্রিয় তখন পুরো দলের মধ্যে বিক্ষোভ দেখা দেয়।

চার. বয়োজ্যেষ্ঠ অফিসাররা যদি রাগি এবং অবাধ্য হয়, এবং সব কিছুর পর্যবেক্ষণ না করে শত্রুর মুখোমুখি হয় অথবা কমান্ডারের নির্দেশ পাওয়ার জন্য অপেক্ষা না করে আক্রমণে যায়, তখন পুরো সৈন্যদলের শৃঙ্খলা ভেঙে যেতে বাধ্য।

পাঁচ. সেনানায়কের নৈতিক মনোবল যদি দৃঢ় না হয় এবং তার শিষ্যরা যদি কঠোর না হয়, যখন তার নির্দেশনা সকলকে প্রলুব্ধ করতে না পারে, যখন অফিসারদের জন্য ধরাবাধা নিয়ম তৈরি করে দেয়া হবে এবং যখন সৈন্যদের গঠনাকৃতি অগোছালো হয় তখন সৈন্যদলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।

ছয়. কমান্ডার যখন শত্রু সৈন্য অনুমান করতে ব্যর্থ হন এবং অপেক্ষাকৃত কম সৈন্য পাঠান বিশাল কোন শত্রুর বিরুদ্ধে, অথবা কম শক্তিশালী সৈন্য পাঠায় দুর্ধর্ষ কোন সৈন্যদের মোকাবেলা করতে, তখন এর ফলাফল ভয়ঙ্কর হয়।

যখন এই ছয়টি পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে সেই সেনাদল কিন্তু তখন পরাজয়ের দ্বার প্রান্তে পৌঁছে গেছে বলে বুঝে নিতে হবে। এই পরিস্থিতিগুলো সেনানায়ককে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে মোকাবেলা করতে হয়।

যুদ্ধক্ষেত্র এবং সৈন্য শিবির থেকে সেখানে চলাচলের পথটা যদি দখলে আনা যায় তবে সেটা বিজয়ী হওয়ার সবচেয়ে বড় সহযোগিতা। আর তাই শত্রুর বর্তমান অবস্থার অনুমান, দূরত্ব পরিমাপ করা, টেরেইনের বাধাবিপত্তিগুলো জানাই হল একজন সেনানায়ক হিসেবে জয় নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখা। যিনি এই বিষয়গুলো ভালোভাবে রপ্ত করে যুদ্ধ করেন তবে নিশ্চিত বিজয়ী হবেন; আর যিনি এসব সম্পর্কে জ্ঞান রাখবেন না তার পরাজয় নিশ্চিত।

পরিস্থিতি যদি এমন হয় যে যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার দ্বার প্রান্তে কিন্তু সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ আক্রমণ না করতে নির্দেশ প্রদান করল, তখন সেনানায়কের উচিত হবে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া। যদি পরিস্থিতি পরাজয়ের দ্বার প্রান্তে হয়, আর সার্বভৌম কর্তৃপক্ষ যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ প্রদান করল, তবে সেনানায়কের পক্ষে নির্দেশ অমান্য করাই উপযুক্ত কাজ।

এবং যে সেনানায়ক ব্যক্তিগত খ্যাতির জন্য চিন্তা না করে যুদ্ধ পরিচালনা করেন এবং শুধুমাত্র নিজের শাস্তির কথা না ভেবে যুদ্ধ বন্ধের নির্দেশ দেন, কিন্তু তার একমাত্র উদ্দেশ্য হল তার লোকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা তিনিই হলেন রাষ্ট্রের অমুল্য সম্পদ। কারণ এমন সেনানায়ক তার সৈন্যদেরকে তারই সন্তানের মত মনে করেন। আর তাই সৈন্যরাও তার সাথে বিপদসংকুল পথে যেতেও রাজি থাকে এবং তার কথায় মৃত্যু বরণ করতেও প্রস্তুত থাকে।

একজন সেনানায়ক যদি যুদ্ধে সৈন্য পাঠিয়ে তাদেরকে যথাযথভাবে পরিচালনা করতে না পারেন; তিনি তাদেরকে এতটাই ভালোবাসেন যে তার কমান্ড মান্য করতে বাধ্য করতে না পারেন; সৈন্যরা যদি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে আর সেনানায়ক তাদেরকে শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হন, তবে তারা নষ্ট সন্তানদের সাথে তুলনার যোগ্য এবং কোন কাজের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। সানজুর মতে জয়-পরাজয়ের পাল্লা কার দিকে কোনটা যাবে তা আগে থেকেই পূর্বলক্ষণ দেখে বলে দেয়া যায়:

এক। আপনার সৈন্যরা যদি আক্রমনের জন্য একেবারে প্রস্তুত হয়ে থাকে, কিন্তু আপনি জানেন না যে শত্রুর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অভেদ্য কিনা তবে আপনার জয়-পরাজয়ের চান্স ফিফটি ফিফটি।

দুই. আপনি যদি জানতে পারেন যে শক্র আক্রমণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট পারদর্শী আর তারা যদি জানতে পারে যে আপনার সৈন্যরা তাদের আক্রমণের জন্য এখনও প্রস্তুত নয়, তবে সেক্ষেত্রেও আপনার জয়-পরাজয়ের চান্স ফিফটি ফিফটি।

তিন. আপনি যদি জানেন যে শত্রু আক্রমণ করতে একেবারে প্রস্তুত এবং আপনার সৈন্যরাও আক্রমণের জন্য উপযুক্ত কিন্তু টেরেইনের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য আপনার আক্রমণ করাটা উচিত হবে না, সেক্ষেত্রে আক্রমণ করলে আপনার জয়-পরাজয়ের চান্স ফিফটি ফিফটি। তাছাড়া যারা যুদ্ধে পারদর্শী তারা কোন ভুল-ত্রুটি ছাড়াই অগ্রসর হোন; যখন দ্বন্দ্ব যুদ্ধ শুরু করেন তখন তাদের জন্য যুদ্ধের সরঞ্জামাদি আর খাবারের কোন অভাব হয় না। আর তাই আমি বলতে চাই: ‘শত্রুকে জানুন, নিজের সক্ষমতা সম্পর্কেও জ্ঞান রাখুন; তাহলেই আপনার জয় কেউ ঠেকাতে পারবে না। টেরেইন এবং যুদ্ধক্ষেত্র সম্পর্কে যথেষ্ট জানুন, আবহাওয়া সম্পর্কে খোঁজ রাখুন; তবেই আপনি অপরাজেয় হতে পারবেনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *