০৬ অধ্যায় – সক্ষমতা এবং দুর্বলতা

০৬ অধ্যায় – সক্ষমতা এবং দুর্বলতা

সানজু বলেন:

সাধারণত যুদ্ধক্ষেত্রে যারা প্রথমে আসে এবং শত্রুর আসার অপেক্ষায় থাকে তারা সেখানে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিতে পারে; যারা পরে আসে তারা সাধারণত ক্লান্ত অবস্থায় এবং দুশ্চিন্তায় থাকে। আর যারা যুদ্ধে অত্যন্ত সুদক্ষ তারা শত্রুর আমন্ত্রণে যুদ্ধক্ষেত্রে আসে না বরং শত্রুকে কৌশলে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে আসে।

একজন যোগ্য যোদ্ধা শত্রুকে বিভিন্ন সুযোগের লোভ দেখিয়ে নিজের সুবিধাজনক স্থানে নিয়ে আসার সামর্থ্য থাকতে হবে। আবার যোগ্য যোদ্ধাই শত্রুর থেকে পাওয়া সুযোগের লোভকে প্রতিরোধ করে তাকেই শিকারে পরিনত করেন।

তু-মু এর ভাষ্যমতে, শত্রুর আসার গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাগুলোতে যদি আপনি তাকে আটকে দিতে পারেন তবে সে আসার সাহস পাবে না। আর তাই মাস্টার ওয়াং বলেন: ‘ইঁদুর গর্তের মুখে যদি একটা বিড়াল দাঁড়ায় তবে দশ হাজার ইঁদুরও সেখান দিয়ে আসার সাহস করবে না; যখন দুর্গের মুখে একটা বাঘ পাহাড়ায় থাকে তখন দশ হাজার হরিণও সীমানা পার হওয়ার সাহস করে না।’

.

শত্রু যখন শান্ত হতে যাবে, তখন তাকে অশান্ত করে তোলার সামর্থ্য থাকতে হবে; যখনই খেতে চাইবে, তখন তাকে ক্ষুধার্ত রাখতে হবে; যখন জিরিয়ে নিতে যাবে, তখন তাকে দৌড় করিয়ে মারতে হবে।

এমন জায়গায় উদয় হোন যেখান থেকে সে শক্তি বাড়িয়ে নিতে যাবে; যেখানে সে আপনাকে আশা করেনি সেখানে গোপনে তৈরি থাকুন। যদি একহাজার লি কোন বাধা ছাড়া এগুতে পারেন তবে বুঝতে হবে আপনি শত্রুর কোন উপস্থিতি ছাড়াই এতটুকু এগিয়েছেন।

সাও সাও এর ভাষ্যমতে, বাধা ছাড়াই এগিয়ে যান, প্রয়োজনে আঘাত করুন, যেখানে শত্রু প্রতিরক্ষা করবে সেখানে এড়িয়ে যান, এমন জায়গা থেকে আঘাত করুন যেখানে শত্রু ঘুনক্ষরেও ভাবতে পারে নি।

নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে যেখানে আপনি আক্রমণ করছেন সে জায়গাটা এমন হবে যেখানে শত্রু আপনাকে বাধা দেয়ার কোন সুযোগ না পায়। নিশ্চিত হয় নিতে হবে যেখানে আপনি প্রতিরক্ষা করছেন সে জায়গায় শত্রু আক্রমণ করার সাহসও না পায়। আর তাই, যারা আক্রমনে দক্ষ, শত্রু জানতেও পারবে না তারা কোথায় আক্রমণিত হতে পারে; যারা প্রতিরক্ষায় সামর্থ্যবান, তখন শত্রু সিদ্ধান্তও নিতে পারবে না কোথায় আক্রমণ করতে হবে।

.

ধুর্ত এবং অত্যন্ত বুদ্ধিমানেরা নিজেদের চলার পথে কোন চিহ্ন রেখে যায়; তাকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আর এভাবেই তিনি শক্রর জন্য আতঙ্ক হয়ে ওঠেন।

হো ইয়েন-সি এর ভাষ্যমতে, আমার শক্তিশালি জায়গাটাকে শত্রুর কাছে দুর্বল হিসেবে প্রতিয়মান করি এবং দুর্বলতাটাকে শক্তিশালী হিসেবে যার কারনে তার শক্তিটাকে আমি দুর্বল করে তুলি আর তার মধ্যে এমন বিশ্বাস করাতে পারি যেন সে আমার থেকে শক্তিশালী নয়। আমার কাছে আসার পথগুলিকে গোপন করে রাখি যাতে করে কেউ সেটা ধরে এগিয়ে আসতে না পারে; নিশ্চুপ অপেক্ষা করি যাতে করে কেউ আমার উপস্থিতি বুঝতে না পারে।

যারা অপ্রতিরোধ্য তাকে দুর্বল জায়গায় আঘাত করুন; যে পালিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাকে অতর্কিত আক্রমণ করুন।

চ্যাং ইউ এর ভাষ্যমতে, বাতাসের বেগে আক্রমণ করুন, আলোর বেগে ধাবিত হোন।

সানজু বলেন, যখন আমি যুদ্ধের ইচ্ছা প্রকাশ করি, আমার শত্রু তখন উঁচু দেয়াল তুলে প্রতিরোধ করেও যুদ্ধে না জড়িয়ে পারে না, তাকে এমনভাবে আক্রমণ করি যেখান থেকে সে উদ্ধার পাওয়ার চেষ্টা করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। আমি যখন যুদ্ধ এড়িয়ে যেতে চাই, মাটিতে একটা লম্বা লাইন একে আমি নিজেকে প্রতিরক্ষা করি; শত্রু আমাকে আক্রমণ করাতে সক্ষম হবে না কারণ সে যে দিকে যেতে চায় আমি তাকে অন্যদিকে ধাবিত করি।

তু-মু এর ভাষ্যমতে, চু-কো লিয়াং একবার ইয়াং পিং এ ঘাটি তৈরি করে এবং ওয়েই ইয়েন আর তার অন্যসব জেনারেলদের নির্দেশ দেন সকলে একত্রিত হয়ে যেন পুর্ব দিকে ধাবিত হয়। চু-কো লিয়াং দশহাজার সৈন্য রেখে যান শহর রক্ষার কাজে। তারপর অপেক্ষা করেন ফলাফল শোনার জন্য। সুসু-মা আই বলেন: ‘চু-কো লিয়াং শহরেই ছিলেন; তার সৈন্যসংখ্যাও যথেষ্ট ছিল না; আর তিনি যুদ্ধে ততটা পারদর্শীও ছিলেন না। তার জেনারেল আর অফিসাররা নিজেদের উপর ভরসা হারিয়ে ফেলেছিল।’ ঠিক সে সময়ে চু-কো লিয়াং এর তেজস্বীতা জেগে উঠল। তার সৈন্যদেরকে আদেশ দিলেন শুয়ে যেতে এবং তাদের ব্যনার আর পতাকা নামিয়ে রাখতে এবং ডামাডোল বন্ধ রাখতে। তার সৈন্যদেরকে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বাইরে যাওয়ার নিষেধ করলেন। চারটা দরজা খুলে দিয়ে রাস্তা খালি করে দিলেন।

সুসু-মা আই শত্রু সেনাদের ঘাপটি মেরে থাকা সন্দেহ করল, এবং তার সৈন্যদেরকে উত্তরের দিকে তাড়িয়ে দিলেন।

চু-কো লিয়াং তার প্রধান অফিসারকে উদ্দেশ্য করে বললেন: ‘সুসু-মা আমি ভেবেছিলাম আমি একটা গোপন আস্তানা প্রস্তুত করে রেখেছি এবং পাহাড়ের ভেতরে লুকিয়ে গেছি।’ সুসু-মা আই ব্যপারটা পরে জেনেছিল এবং খুব দ্রুততার সাথে সেখান থেকে উদ্ধার পেয়েছিল।

তিনি বলেন, যদি আমি শত্রুর সৈন্য বিন্যাস ব্যবস্থা সম্পর্কে যথেষ্ঠ জানতে সক্ষম হই ঠিক তখনই আমি নিজের সৈন্যবিন্যাস গোপন করে ফেলব আর তারপরই আমি আক্রমণে গিয়ে তার বাহিনীর মধ্যে বিভক্তির সৃষ্টি করব। আর আমি যদি শত্রুর সৈন্যবিন্যাসের বিভক্তির সময় আক্রমণ করি তখন সমস্ত শক্তি দিয়ে তাকে আঘাত হানব। সেখানে বিভিন্ন দিক থেকে তার চেয়ে এগিয়ে থাকব। তারপর আমি যদি শক্রর নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় বারবার আঘাত হানি, যেগুলোকে আমি আগে থেকে সরাসরি আক্রমনের পরিকল্পনা করেছিলাম।’

তু-মু এর ভাষ্যমতে, অনেক সময় আমি সাধারন কিছু সৈন্য এবং তেজস্বী ঘোড়া দ্বারা আক্রমণ করি যেখানে শত্রু অপ্রস্তুত থাকে, মাঝেমাঝে শক্তিশালী তীরন্দাজ এবং আচার দ্বারা আক্রমণ করি শত্রুর একেবারে মুলে আঘাত করার জন্য, তাকে সেখান থেকে পরিকল্পনা পরিবর্তন করতে বাধ্য করি, ডান থেকে বায়ে ঘুরি এবং সামনে গিয়ে সতর্কবার্তা শব্দ করি, এবং এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে আক্রমণ করি।

দিনের আলোতে আমি তাকে পতাকা এবং ব্যনার দেখিয়ে এড়িয়ে যাই আর রাতে যুদ্ধ ডামাডোল বাজিয়ে হতভম্ভ করে দিই। তারপর ভয়ে সে তার সৈন্যদেরকে বিভক্ত করে দেয় পূর্ব সতর্কতামূলক অযথা প্রস্তুতি নেয়ার জন্য।

প্রতিপক্ষ কখনও জানবে না আমি কোথায় তাকে আক্রমণ করব, যদি সে তা জানতে না পারে তবে আমাকে আটকানোর জন্য সে তার সৈন্যদেরকে বিভক্ত করে বিভিন্ন স্থানে প্রস্তুতি নেবে। আর যখন সে অনেকগুলো জায়গায় আমার সাথে যুদ্ধ করতে যাবে তখন সেখানে সৈন্যসংখ্যা এমনিতেই কম হবে। সে যদি সামনের দিকে প্রস্তুতি নেয় তবে তার পেছনের দিকে অবশ্যই দুর্বল থাকবে, এবং যদি পেছনের দিকে প্রস্তুতি নিতে যায় তবে সামনের দিকটা থাকবে নড়বড়ে প্রতিরক্ষা। বামে যদি প্রস্তুতি নেয় তবে ডানের প্রস্তুতি হবে ভয়ানকভাবে দুর্বল এবং ডানে নিলে বায়ে সৈন্য থাকবে একেবারে নগণ্য। আর সে যদি সব দিকে প্রস্তুতি নিতে যায় তবে তার সব দিকটায় দুর্বল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হবে।

চ্যাং ইউ এর ভাষ্যমতে, শত্রু পক্ষ অনুমানও করতে পারবে না আমার রথ গাড়িগুলো প্রকৃতপক্ষের কোন দিকে যাবে, বা অশ্বারোহী সৈন্যরা কোন দিক থেকে আসবে, বা পদাতিক সৈন্যবাহিনী কোন দিক থেকে আক্রমণে যাবে, আর তাই তারা বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত হয়ে সব দিকে প্রতিরক্ষা গড়ে তোলার চেষ্টা করবে। যার ফলে তারা এমনিতেই ভীত এবং দুর্বল হবে এবং তার শক্তি বিভক্ত হয়ে আমার সাথে বিভিন্ন জায়গায় যুদ্ধ করতে যাবে এবং এই সুযোগে আমি আলাদাভাবে তাদের প্রতিটা দলের সাথে আমার বিশাল শক্তি নিয়ে যুদ্ধ করতে পারব।

.

যারা সংখ্যায় নগণ্য তারা শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহন করবে; যারা সংখ্যায় বেশি তারা তার প্রতিপক্ষকে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রস্তুতি নিতে বাধ্য করবে। সেনানায়ক যদি জেনে থাকেন তাকে কোথায় এবং কখন যুদ্ধ করতে হবে তার সৈন্যরা একহাজার লি পর্যন্ত এগিয়ে যেতে পারবে এবং যুদ্ধক্ষেত্র খুঁজে বের করবে। কিন্তু কেউ যদি যুদ্ধক্ষেত্র এবং কোন সময়ে যুদ্ধ হবে তা সুস্পষ্টভাবে জানা না থাকে তবে বামের সৈন্যরা ডানের সৈন্যদের এবং ডানের সৈন্যরা বামের সৈন্যদের সামনের সৈন্যরা পেছনের এবং পেছনের সৈন্যরা সামনে সাহায্য করতে পারবে না।

তু-ইউ এর ভাষ্যমতে, যারা যুদ্ধে পারদর্শী তারা অবশ্যই জানে কোথায় এবং কখন লড়াই করতে হবে। ফলে তারা রাস্তার দূরত্ব মেপে নেয় এবং দিনক্ষণ ঠিক করে নেয়। তারা সৈন্যদেরকে আলাদা আলাদা লাইনে এগিয়ে নিয়ে যায়। যারা দূরের তারা প্রথমে রওয়ানা দেবে, যারা কাছের তারা অপেক্ষাকৃত পরে যাত্রা শুরু করবে। এভাবে করলে বিভিন্ন জায়গা থেকে রওয়ানাকৃত সৈন্যরা যদি একহাজার লি দূরে থেকেও যাত্রা করে তবুও তারা একই সময়ে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় মিলিত হতে পারবে। এটা এমন যেন মানুষ শহরের বাজারে আসছে।

সানজু বলেন, ইউয়েহ এর সৈন্যসংখ্যা আমি অনুমান করতে পেরেছিলাম, আমার শক্তি সামর্থ্য বেশি থাকার কারনে আমি এর থেকে কি সুবিধা পেতে পারি? তাই আমি বলতে পারি বিজয় নিজেই সৃষ্টি করা যায়। শত্রু সংখ্যা যতই বেশি হোক আমি তাকে আমার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত করতে প্রতিরোধ করতে পারব।

চিয়া লিন এর ভাষ্যমতে, শত্রু সংখ্যা বেশি হলেও, যদি সে আমার সামরিক কৌশলগুলি ধরতে না পারে, তবে তাকে একটু পর আমার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতে বাধ্য করতে পারব যাতে করে সে স্থির হয়ে কোন পরিকল্পনা করতে না পারে।

এভাবে শত্রুর পরিকল্পনাগুলি জেনে নিতে পারলে আপনি নিজইে বুঝতে পারবেন আপনার নেয়া কোন পরিকল্পনা কাজে লাগবে আর কোনটা নয়। সেজন্য,

এক. তাকে উত্তেজিত করে তুলুন এবং তার গতিবিধি নিশ্চিত করুন।

দুই. তার সৈন্যবিন্যাস লক্ষ করুন এবং যুদ্ধক্ষেত্র নির্ণয় করুন।

তিন. তার পরিকল্পনার ভেতরে প্রবেশ করুন এবং জানুন কোথায় তার প্রচুর শক্তি রয়েছে এবং কোথায় দুর্বলতা রয়েছে।

চার. চুড়ান্ত কাজটা হল তার সৈন্যের বিন্যাস গঠন প্রনালি জানা। আর তা করতে পারলে যতই গোয়েন্দা কার্যক্রম চালাক না কেন আর যতই পরিকল্পনা সাজাক না কেন আপনার বিরুদ্ধে তা ব্যবহারে কোন কাজে আসবে না। সৈন্যবিন্যাসটা এমন হতে পারে যে আমি পরিকল্পনা করেছি জয়ের জন্য কিন্তু বেশির ভাগ সৈন্যই তা জানতে পারল না। বাহ্যিক বিষয়টা সকলের দৃষ্টিগোচর হলেও কেউই বুঝতে পারবে না আমার বিজিত হওয়ার কৌশলগুলি।

তারপর, আমি যখন একটা জয় অর্জন করি, সেই কৌশলগুলি আমি আর কাজে লাগাই না কিন্তু পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে অসংখ্য কৌশল আমি তৈরি করে নেই।

.

একজন সৈনিককে পানির সাথে তুলনা করা যেতেই পারে, যেমনটা পানি উঁচু পাহাড়কে এড়িয়ে গিয়ে পাশের নীচু জমিকে প্লাবিত করে, ঠিক একজন সৈনিক শক্তিশালী জায়গাটা ছেড়ে গিয়ে দুর্বল জায়গায় আঘাত হানে। আর পানি যেমন ভুমির গঠনের উপর ভিত্তি করে নিজেকে সেভাবে গড়ে তোলে, ঠিক সেভাবে একজন সৈনিক পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে জয় ছিনিয়ে আনে। আর পানির যেমন নির্দিষ্ট কোন গঠন নেই, ঠিক তেমনি যুদ্ধের কোন নির্দিষ্ট শর্তও নেই। এভাবেই, একজন যোদ্ধা তার কৌশলগুলি পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে পরিবর্তন করে জয়ী হতে পারে। মনে রাখবেন, এই পাঁচটা উপাদানের কোনটাই স্থায়ী নয়; চারটা ঋতুর কোনটাই সারাজীবন স্থায়ী নয়; কোন কোন দিন ছোট আবার কোন কোন দিন বড়, আর চাঁদেরও অমাবশ্যা-পূর্নিমা আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *