৬. বর্তমান সময়

৫১. বর্তমান সময়

পঞ্চম দিন

আলেকজান্ডারের রহস্য

“আপনি নিশ্চয় তামাশা করছেন!” নিজেকে সামলাতে পারল না রাধা। সত্যিই ব্যাপারটা একেবারে অবিশ্বাস্য। শত শত বছর আগেই আলেকজান্দ্রিয়া থেকে আলেকজান্ডারের দেহ উধাও হয়ে গেছে। সবাই সেটাই জানে।”

“সঠিকভাবে বললে চতুর্থ শতকে।” রাধাকে শুধরে দিলেন সাক্সেনা। “আরো নিখুঁতভাবে বললে ৩৯১ খ্রিস্টাবের কাছাকাছি কোনো এক সময়ে। অর্ডার তাঁর মমি চুরি করে আরেকটা স্থানে রেখে দিয়েছে যেখানে পচনের হাত থেকে সুরক্ষিত থাকবে।”

“কিন্তু এক অর্থে অর্ডারই তো এ নীতি ভঙ্গ করে তার শরীরকে কাটা ছেঁড়া করে একটা ভাইরাস আর ব্যাকটেরিয়া বের করেছে।” রাধা বুঝতে পারল যে অর্ডার কেবল নিজের কথাই ভাবে। পবিত্র বলে কিছু নেই। কোনো কিছুকেই তারা পরোয়া করে না। যেমন এখন সেরকমই একটা স্থাপনাতে সে বন্দী হয়ে আছে। সব ধরনের তথ্যকে একসাথে জোড়া লাগিয়ে বুঝতে পারল যে ইমরানও পরীক্ষাতে এই দুটো জীবাণুই পেয়েছিলেন। অজ্ঞ ভলান্টিয়ারদের উপরেই অজানা এসব প্যাথোজেন ব্যবহার করে সাক্সেনা আর তার দল বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আসছিল। পরিণামে লোকগুলো ধীর কিন্তু নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ধাবিত হয়েছে। ক্রোধ বেড়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল রাধা। কয়েকদিন আগেই তাকে যে চেতনানাশক দেয়া হয়েছিল এসব কী তারই প্রতিক্রিয়া কিনা কে জানে। এই মুহূর্তে রেগে উঠা ঠিক হবে না। তাতে কেবল নিজের ক্ষতি হবে।

কাঁধ ঝাঁকালেন সাক্সেনা, “ওয়েল, বিজ্ঞানের উন্নতির জন্য এটাতো করতেই হত।” যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে জানালেন ডাক্তার। “যাই হোক এই দুই প্রাণিসত্তার মাঝে লুকিয়ে আছে সেই রহস্য যা আমাদেরকে রোগ বালাইয়ের বিরুদ্ধে আরেকটা বর্ম তৈরি করতে সাহায্য করবে।”

“আমি এখনো বুঝতে পারছি না” অভিব্যক্তি আর গলার স্বরেই ফুটে উঠল রাধার অবিশ্বাস, “আপনি বললেন যে আলেকজান্ডার এই মহারহস্যের খোঁজে অভিযানে বেরিয়েছিলেন। আর সেটা খুঁজেও পেয়েছেন। তারপরেও দুই বছর পরেই মারা গেছেন। আর ভুক্তভোগী সকলের ক্ষেত্রেও কয়েক বছরের মধ্যে আলেকজান্ডারের মতই একই শারীরিক চিহ্ন ফুটে উঠেছে। তার মানে এই প্রাণিসত্তাদ্বয় কেবল মৃত্যুই ডেকে আনবে।”

“এখানেই তুমি ভুল করছ! হিসহিস করে উঠলেন সাক্সেনা; অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছেন। “এই অর্গানিজমগুলো জীবন দান করে। কম্পিউটারের পর্দায় যেগুলো দেখছ সেগুলো প্রকৃত অর্গানিজম নয় যা আলেকজান্ডারে দেহে প্রবেশ করেছিল। রেট্রোভাইরাস হল একটা ব্যাকটেরিয়ানাশক আর ভাইরাস ব্যাকটেরিয়াকে দূষিত করে।”

পর্দার ইমেজ বদল করে বললেন, “ভাইরাস নিজে থেকে পরিবর্তিত হতে পারে না। এ কারণেই তাদেরকে অন্য কোনো কোষ/সেল ছিনতাই করে পরাশ্রয়ী হতে হয়। আর এটাই হল ভাইরাসের পরিবর্তন প্রক্রিয়া।” পর্দার ডায়াগ্রামের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, “একটা ভাইরাস প্রথমে টার্গেটকৃত কোষের সাথে নিজেকে সংযুক্ত করে আর তারপর আশ্রয়দাতা কোষের ঝিল্লির সাথে সংমিশ্রণ কিংবা জিন সম্বন্ধীয় উপাদানসমূহের অবস্থান পরিবর্তনের মাধ্যমে আশ্রয়দাতা কোষের দেয়াল ভেদ করে ভেতরে ঢুকে পড়ে। আর একবার যদি তা করতে পারে তাহলে আশ্রয়দাতা কোষের কোষবিশিষ্ট কলকজা ব্যবহার করে পরিবর্তিত হয় আর প্রায়োগিক ও কাঠামোগত প্রোটিন তৈরি করে। নবগঠিত জীবকোষ বিদ্যমান দুটি জটিল যৌগের একটি নিউক্লেইক অ্যাসিড আর কাঠামোগত প্রোটিন একসাথে মিলে গঠিত হয় ভাইরাসের নিউক্লিওক্যাপসিড। নবগঠিত এসব ভাইরাস কিংবা ভিরিয়নস লাইসিস নামক একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মুক্ত হয়ে যায়; যার ফলে আশ্রয়দাতা কোষ প্রচুর ভিরিয়ন উদগিরণ করে দেয়। আর একই সাথে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে হোস্ট সেল।”

পর্দায় উদয় হল আরেকটা ইমেজ, “আমরা যে ভাইরাস নিয়ে কাজ করছি তা হল একটা রেট্রোভাইরাস।” বলে চললেন সাক্সেনা, “এর জিন সম্পর্কীয় তথ্যসমূহ ডিএনএ নয় বরঞ্চ আরএনএ’র সংকেতে আবদ্ধ আছে। রেট্রোভাইরাসের মধ্যে আরো আছে আরএনএ’র উপর নির্ভরশীল ডিএনএ অণুযোগে গঠিত যৌগ, যেটা একটা নকলের (Transcriptase) উল্টো পিঠ। এর মাধ্যমেই আশ্রয়দাতা কোষের সংক্রমনের পর ডিএনএ’র সংশ্লেষণ ঘটে।”

রাধার চেহারায় শূন্য অভিব্যক্তি দেখে থেমে গেলেন ডা. সাক্সেনা। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে একটু আগে যা বললেন মেয়েটা তার বিন্দু বিসর্গ কিছুই বোঝেনি। “ওকে” আরেকবার চেষ্টা করে জানালেন, “এটা তো নিশ্চয় বুঝতে পারছ যে, সমস্ত প্রাণিসত্তার জিন সম্পৰ্কীয় তথ্যসমূহ ডিএনএ’তে লিপিবদ্ধ থাকে আর তা একটা দ্বৈত ধারা, ঠিক? ওয়েল, রেট্রোভাইরাসের মধ্যে জিনের তথ্যগুলো আরএনএ’তে আবদ্ধ থাকে আর এটা হল একটাই তন্ত। সাধারণত সমস্ত প্রাণিসত্তায় যখন কোষের পরিবর্তনের সময় জিনের তথ্যসমূহের নকল তৈরি করতে হয়, তখন ডিএনএ আরএনএতে বদলে যায় আর জিনের তথ্য পরিবহনের জন্য প্রোটিনের সৃষ্টি করে।”

রাধা কতদূর বুঝতে পারছে দেখার জন্য আবার থেমে গেলেন সাক্সেনা। তাই মেয়েটা মাথা নাড়তেই আবার শুরু করলেন, “রেট্রোভাইরাস পরিবর্তনের সময় কিন্তু আরএনএকে ডিএনএ’তে রূপান্তরিত হতে হয়। একারণেই এটাকে উল্টো দিকে যাত্রা হিসেবে ধরা হয়। একারণেই ট্রান্সক্রিপটেজ প্রোটিনের প্রয়োজন, যেন সক্রিয় থাকে পুরো প্রক্রিয়া। রেট্রোভাইরাস একবার যখন আশ্রয়দাতা কোষের অভ্যন্তরে মিশে যায় তখনই আরএনএ মুক্ত হয়ে পড়ে। আর হয়ে উঠে একতম্ভ বিশিষ্ট ডিএনএ। এই ডিএনএ’ই আবার উল্টো দিকে বদলে যাওয়ার মাধ্যমে হয়ে উঠে দ্বৈত ধারা সমৃদ্ধ এক বিশেষ ডিএনএ। ভাইরাস থেকে নেয়া আরেকটা জৈব রাসায়নিক পদার্থ (Engyme) ব্যবহার করে আশ্রয়দাতা কোষে এই বিশেষ প্রো-ভাইরাস বসিয়ে দেয়া হয়, যাকে বলা হয় সংহত করা, আর তারপরই আরএনএ’তে বদলে যায়। একটা নতুন ভাইরাস নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিনের উৎপাদন কাজে আরএনএর অনুবাদ করা হয়; ঠিক যেমনটা হয় সাধারণ প্রতিলিপি তৈরির ক্ষেত্রে। আশ্রয়দাতা কোষ থেকেই বলপূর্বকভাবে বহিস্কৃত করে দেয়া হয় এসব ভিরিয়ন।”।

সাক্সেনা কেন এত সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন তা এতক্ষণে বুঝতে শুরু করেছে রাধা, “তো তার মানে একটা রেট্রোভাইরাস প্রকৃতপক্ষে একটা আশ্রয়দাতা জিনের অংশ হয়ে উঠবে?”

“ঠিক তাই। যখন জীবনব্যাপী সংক্রমণের শুরু হয়। আশ্রয়দাতা কোষের গঠনতন্ত্রকে অর্জন কিংবা বদলে দেবার ক্ষমতা আছে এই রেট্রোভাইরাসের।

এগুলো এমনকি আশ্রয়দাতা কোষের জিনের জীবাণুর মধ্যেও মিশে গিয়ে স্থান পরিবর্তনশীল উপাদান হিসেবে কাজ করতে পারে। মানে হল এরা ডিএনএ’র এমন এক অংশ যারা আশ্রয়দাতা জিনের চারপাশে যখন খুশি ঘুরে বেড়াতে পারে, জিন বদলে দিতে পারে আর আশ্রয়দাতা ডিএনএ’র রূপান্তরের কারণও সৃষ্টি করে। জিনকে সক্রিয় কিংবা নিষ্ক্রিয়ও করে দিতে পারে। আর নির্দিষ্ট পরিবেশ উদ্দীপক পেলে রূপান্তর আর পুনঃমিশ্রণের মাধ্যমে দ্রুত নিজেদের জিনকেও বদলে ফেলতে পারে। এই কারণেই এইচআইভি ভাইরাস এতটা মারাত্মক। এটাও একটা রেট্রোভাইরাস। সাধারণত সুস্থ মানুষের ডিএনএ’কে বদলে দেয়।”

রাধার মাথা ঘুরে উঠল। এত তথ্য একসাথে শুনেছে যে বুঝতে কষ্ট হচ্ছে। “যাই হোক, খানিকটা বুঝেছি। কিন্তু একটা রেট্রোভাইরাস যদি এতটা মারাত্মক হয় তাহলে কিভাবে রোগের বিরুদ্ধে বর্ম তৈরিতে সাহায্য করবে?”

.

৫২. অমরত্ব

“এটাই হচ্ছে সমস্যা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালেন সাক্সেনা, “ভাইরাসদের তেমন কোনো সুখ্যাতি নেই; আর সেটা ঠিকও। বেশিরভাগ মারাত্মক আর দুরারোগ্য সংক্রমণের কারণও এরাই। ছোট ছোট এই দস্যুগুলোকে খতম করা আসলেই বেশ কঠিন। এমনকি আশ্রয়দাতা মারা গেলেও এরা ঠিকই গুপ্ত থেকে সুযোগ মত অন্য কোনো কোষে সংক্রামিত হয়ে চক্রটাকে টিকিয়ে রাখে। এও জানা গেছে যে শক্তিসত্তা না হারিয়েই হাজার হাজার বছর ধরে সুপ্ত থাকতে পারে। তবে ভাইরাসের আরেকটা দিক আছে যা মানুষ খুব বেশি জানে না। তুমি জানো মাইক্রোবিয়ম কি?”

কোথায় যেন শব্দটা পড়েছে! স্মরণ করে রাধা বলল, “ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এমন সব প্রাণিসত্তার সন্নিবেশ যা মানুষের মাঝেই বাস করে।”

“রাইট। এটা একটা প্রতীকী অস্তিত্ব। বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থান। এদের মাঝে সবচেয়ে সুপরিচিত হল ব্যাকটেরিয়া। খাবার আর আশ্রয়ের বিনিময়ে ব্যাকটেরিয়া আমাদেরকে হজম ও রাসায়নিক বিপাক ক্রিয়াকে সচল রাখতে সাহায্য করে। কিন্তু এমন কোনো প্রতীকী ভাইরাসের গল্প শোনা যায়নি যা কিনা খারাপ ব্যাকটেরিয়াকে টার্গেট করে। আর তখনই ঘটে আমাদের ছোট্ট রেট্রোভাইসের আগমন। আগেই যেমনটা বলেছি, এটা একটা ব্যাকরেটিওফেজ। উদাহরণস্বরূপ, মানুষের মিউকাস মেমব্রেন-নাক আর গলার নরম টিস্যুগুলো ব্যাকটেরিয়াওফেজে সমৃদ্ধ। যা আমাদের জন্যই ভালো; কারণ ব্যাকটেরিয়া মিউকাসের মধ্যে বংশবিস্তার করতে পারে। তাই মিউকাস সম্পর্কীয় সংক্রমণের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়া শিকার করে, এসব ভাইরাস আশ্রয়দাতার প্রতিষেধক প্রক্রিয়ার জন্য বর্ম তৈরি করতে পারে।”

“তার মানে আলেকজান্ডারের শরীরে আপনারা যে রেট্রোভাইরাস পেয়েছেন তা ব্যাকটেরিয়াকে দূরে রাখতে সক্ষম?”

“এর চেয়েও ভালো। এই কারণেই ক্লিনিকাল ট্রায়ালগুলো এত কাজে লেগেছে। নতুবা সফলতার জন্যে প্রয়োজনীয় আবিষ্কার করা সম্ভব হত না। আমরা আলেকজান্ডারের মমিতে ভাইরাস আর ব্যাকটেরিয়া খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু সাবজেক্টের শরীরে প্রতিটাকে পৃথক পৃথকভাবে সংক্রমণ আর এর ফলাফল পর্যালোচনা করার আগ পর্যন্ত এদের সংযোগ বুঝতে পারিনি। ফলাফলের একটা হল রেট্রোভাইরাস নিজে ব্যাকটেরিয়ার অনুপস্থিতিতে আশ্রয়দাতা প্রাণিসত্তা হিসেবে মানব শরীরে আরো ভালোভাবে মিশে যেতে পারে। আর একবার মানব পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারলে প্রোটিন উৎপাদনকারী জিনে স্থানান্তরিত হয়। যার ফলে ধীর হয়ে যায় বয়স বাড়ার গতি। অর্থাৎ বুড়ো হওয়া প্রায় থেমে যায়। উদাহরণস্বরপ বলা যায় আইজিএফ ওয়ান এর কথা, যা পেশি নির্মাণের জন্য দায়ী মূল প্রোটিন। এ প্রোটিনের অনুপস্থিতিতে পেশি দুর্বল হয়ে পড়া ছাড়াও মেরামত আর পুনঃজন্মের ক্ষমতা কমে যায়। এছাড়াও আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিন হল টেলেমারেজ, বৃদ্ধ হবার প্রক্রিয়াকে ধীর করার জন্য যেটির উপরে প্রচুর বিতর্ক হয়েছে। আমরা যে বৃদ্ধ হই আর মারা যাই, তার পেছনে টেলোমারেজের অনুপস্থিতিই যে প্রধান কারণ এর স্বপক্ষেও শক্ত প্রমাণ আছে। তবে টেলোমারেজের সমস্যা হল এর উপস্থিতিতে কোষগুলো বিরতিহীনভাবে পরিবর্তিত হতে থাকে, অন্য কথায় বলতে গেলে ক্যান্সার। কিন্তু রেট্রোভাইরাসের উপস্থিতি বিআরএএফের উৎপাদন বাড়ায়; এটি এমন এক প্রোটিন যা সবল কোষের বৃদ্ধি আর বিভক্তির চক্রকে নিয়মিত রাখে, ক্যান্সারের বিরুদ্ধে বাধা বলতে পারো। ধারণা করা হচ্ছে যে রেট্রোভাইরাস পি ফিফটি থ্রি নামক একটা প্রোটিনকেও কোনো না কোনোভাবে সক্রিয় করে তোলে, যা সমস্ত কোষেই সুপ্ত অবস্থায় থাকে। পি ফিফটি থ্রি এমন সব জিনের প্রকাশ ঘটায় যার মাধ্যমে কোষের চক্র থেমে যাওয়াসহ অপকারী কোষের বংশ বিস্তার রোধ হয়। এটাকে আরো সহজভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়। শরীরে নতুন রেট্রোভাইরাসের উপস্থিতি ইন্টারফেরনের উৎপাদন বাড়িয়ে দেয়; এমন এক প্রোটিন যা পি ফিফটি থ্রি’র সংকেত ধারণকারী জিনের বদলকে উদ্দীপ্ত করে তোলে। ফলে পি ফিফটি থ্রি প্রোটিনের প্রাচুর্য বেড়ে যায়।” খানিক থেমে রাধার দিকে তাকিয়ে বললেন, “চাইলে আমি আরো ব্যাপকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি। নতুন আরো কিছু জিন পাওয়া গেছে যার মাধ্যমে আরো অজানা সব প্রোটিনের উৎপাদন হতে পারে এবং এগুলো আমাদের গবেষণার মাধ্যমে মানব শরীরের শক্তিমত্তা, পুনঃনির্মাণ আর মেরামতের জন্য উপকারী হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।”

“অসাধারণ।” মন্তব্য করল রাধা। শুনে মনে হচ্ছে চিকিৎসাশাস্ত্রে এক যুগান্তকারী আবিষ্কার ঘটতে যাচ্ছে। আপনি আরো বলেছিলেন যে ভাইরাস ব্যাকটেরিয়াকে সংক্রমণ করে। এগুলোকে মেরেও ফেলে নাকি? এই ভাইরাস বর্মের কথাই বলেছেন?”

মাথা নাড়লেন সাক্সেনা, “যা ভাবছ তার চেয়েও অনেক বড় কাজ করে। মানুষকে শুধু ব্যাকটেরিয়া দিয়ে দূষিত করার পরে দুটো জিনিস পেয়েছি। প্রথমত, ব্যাকটেরিয়া মানুষের জন্য অত্যন্ত ভয়ংকর। কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে নয়। গলাধঃরণ হয়ে গেলেই এগুলো এক ধরনের বায়োফিল্ম তৈরি করে যেখানে কোষগুলো বিপুল পরিমাণে খনিজ পদার্থ দ্বারা আবৃত থাকে। শরীরের প্রাকৃতিক প্রতিষেধকের হাত থেকে ব্যাকটেরিয়াকে সুরক্ষা দেবার জন্যই এমনটা ঘটে। সেই মুহূর্তে কোষের মধ্যস্থতায় ব্যাকটেরিয়া নিজেও সুপ্ত অবস্থায় চলে যায়। যা সংক্রমণকে ধরে রাখে; ধ্বংস করেনা। তাই কিছু সময়ের জন্য কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়ার চিহ্ন দেখা যায় না। আমরা সন্দেহ করেছি যে রেট্রোভাইরাস ব্যাকটেরিয়াকে সংক্রমিত করে এর জিনগত বৈশিষ্ট্যকে পরিবর্তন করে দিলেই মানুষকে মেরে ফেলে এমন প্রোটিনের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। হয়ত এর ফলে ব্যাকটেরিয়া মানুষের জন্য উপকারী কোনো প্রোটিনেরও জন্ম দিতে পারে। আসলে তা এখনো জানি না। এই কারণেই প্রকৃত ভাইরাসটা প্রয়োজন।”

“কিন্তু আপনি তো বলেছেন যে আলেকজান্ডারের মমিতে ব্যাকটেরিয়া থেকে পৃথক ভাইরাস পেয়েছেন” মনে করিয়ে দিল রাধা, “এটাই কি সেই পৃথক ভাইরাস নয়?”।

“না। আমি বলেছি যে ক্লিনিকাল ট্রায়ালের ফলে দুটো আবিষ্কার করেছি। তোমাকে তো কেবল প্রথমটা বললাম। দ্বিতীয় যা পেয়েছি তা হল প্রোফেজের আকারে ব্যাকটেরিয়ার জিনের মাঝে ইতোমধ্যেই ভাইরাস আছে। একটা পর্যায়ে রেট্রোভাইরাস ব্যাকটেরিয়াকে সংক্রমিত করলেও আমি আগে যেভাবে বলেছি সেভাবে পরিবর্তিত হতে পারেনি। হয়ত কোনো কারণে মারা গেছে। কিন্তু ব্যাকটেরিয়ার জিনে জিনগত উপাদান হিসেবে মিশে গেছে, একটা প্রোফেজ। আর তখনই পুরো ব্যাপারটা হয়ে উঠে অত্যন্ত চমকপ্রদ। এমন কিছু আমরা এখনো জানি না, এমন কী? যা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের পরে প্রোফেজের সংস্পর্শকে উদ্দীপ্ত করে তোলে। তখনি রেট্রোভাইরাস লাইসোজেনিক চক্রের মাধ্যমে মানব কোষে রূপান্তরিত হয়।”

বেশি বেশি মেডিকেল টার্ম ব্যবহার করছেন বুঝতে পেরে হাত তুললেন ডা. সাক্সেনা, “মূল কথা হল রেট্রোভাইরাসের এই সুপ্তাবস্থা-প্রোফেজ ব্যাকেটিয়ার ক্রোমোজমেই থাকে। একে বলা হয় প্রোফেজ ইনডাকশন। একবার তা ঘটে যাবার পর সাধারণ নিয়মেই ভাইরাস রূপান্তরিত হয়ে আরো প্রতিলিপি তৈরির জন্য মানব কোষকে আদেশ করে। তখনই রেট্রোভাইরাল ইনফেকশন ঘটে। কিন্তু, যেমনটা আগে বলেছি, তাতে আশ্রয়দাতার কোনো ক্ষতি হয় না, কারণ রেট্রোভাইরাস হল উপকারি।”

দুহাত ভাঁজ করে রেখে বিজয়ীর ভঙ্গিতে রাধার দিকে তাকালেন সাক্সেনা, “তার মানে বুঝতেই পারছ যে এই ভাইরাস কতটা শক্তিশালী? আর মানব জাতির জন্য তা কতটা কল্যাণ বয়ে আনবে? আর শুধু ভাবো যে অর্ডার এ সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রণ করবে। বৃদ্ধ হবার প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দেয়ার ক্ষমতা। যে কোনো রোগের সাথে লড়াই করার ক্ষমতা। অ্যান্টিবায়োটিকসের কথা ভুলে যাও। আমাদের কাছে অমর হবার ক্ষমতা থাকবে। আমাদের পায়ের কাছে আঁছড়ে পড়ে ভিক্ষা চাইবে পুরো পৃথিবী। তাই তো একে দেবতাদের রহস্য বলা হত!”

ভ্রুকুটি করল রাধা। কোথায় যেন খটকা আছে। “যদি ভাইরাসটা সত্যিই এত মহান হয় তাহলে গলাধকরণের পর আলেকজান্ডার মারা গেলেন কেন? আপনার ধারণানুযায়ী ব্যাকরেটিয়ার জিনটাকে কেন পরিবর্তন করে দেয়নি?”

“কারণ খাবার সময় নিশ্চয় কোনো গন্ডগোল করেছিলেন। আমরা এখনো প্রকৃত ভাইরাসটা খুঁজে পাইনি। কেবল প্রোফেজ পেয়েছি। তাই ভুলটা কোথায় ছিল সে ব্যাপারে আমার কোনো ধারণাই নেই। কিন্তু প্রকৃত ভাইরাস ছাড়া ব্যাকটেরিয়ার পরিবর্তন হবে না। ততক্ষণ পর্যন্ত গুপ্ত থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত না কিছু তাদের জিনের রসকে চালিত করে। আর একবার তা ঘটতে পারলেই আর রক্ষে নেই। আমরা আমাদের সাবজেক্টের উপরই এর প্রতিফলন দেখেছি। বিভিন্ন সময় আর তারপর আবার। ব্যাকটেরিয়া একবার সক্রিয় হয়ে উঠলেই কয়েক দিনের মাঝেই মারা গেছে সাবজেক্ট। কখনো কখনো এক কি দুমাস পর্যন্ত টিকে থাকত। আর এই কারণেই প্রকৃত ভাইরাস আর প্রকৃত ব্যাকটেরিয়া দরকার। আলেকজান্ডার এগুলো কোথায় পেয়েছিলেন সে স্থান খুঁজে বের করতে হবে। আর তারপরেই বোঝা যাবে যে রেট্রোভাইরাস আসলেই কিভাবে কাজ করে?

“তার মানে কিউবটার জন্যই অলিম্পিয়াসের সমাধি খোঁড়ার প্রয়োজন ছিল। যেন প্রকৃত প্রাণিসত্তার উৎসের কাছে পৌঁছানো যায়।” ঘটনাগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক বুঝতে পেরেছে রাধা।

“ঠিক তাই। তাহলেই সিক্রেটটা আমাদের হাতের মুঠোর চলে আসবে।”

“তাহলে কিভাবে নিশ্চিত হচ্ছেন যে আলেকজান্ডার ভুল করেছিল? হয়ত তা না। হয়ত এগুলো শুধুই প্যাথোজেন। যন্ত্রণা দিয়ে মৃত্যু ঘটায়।”

এবার সাক্সেনা ক্রু কুঁচকে ফেললেন, “দুটো কারণে। এক, আমাদের ক্লিনিকাল ট্রায়াল। এই মাত্র আমি যা বললাম তার সবকিছুই প্রমাণিত হয়ছে। আর দুই নম্বর হল, আরো প্রাচীন আর বিশ্বাসযোগ্য এক সূত্র।” থেমে গিয়ে খানিক পরেই জানালেন, “কারণ মহাভারতেই এর প্রমাণ পাওয়া গেছে।”

বিস্ময়ে হা হয়ে গেল রাধা। এই ধরনের কোনো উত্তর শুনবে বলে আশা করেনি। মেয়েটার প্রতিক্রিয়া দেখে খুশি হয়ে হেসে ফেললেন সাক্সেনা, “এই রূপকথা তুমি শুনেছ। কেবল এর সত্যিকারের অর্থটা এতদিন জানতে না।”

একটুক্ষণ বিরতি দিয়ে আরো এক বিশদ বিবরণ শুরু করলেন ডাক্তার সাক্সেনা। শেষ করার পরে বিমূঢ় হয়ে বসে রইল রাধা। এই মাত্র যা শুনল যেন দুলে উঠেছে পুরো পৃথিবী। কেউই আসলে এটা বিশ্বাস করতে পারবে না। কিন্তু গত বছর মহাভারতের সময়কার বিজ্ঞান নিজের চোখে দেখার পর সাক্সেনার কথা বিশ্বাস করতেই হল।

আর যদি তাই হয় তাহলে অর্ডারের দাসে পরিণত হবে পুরো দুনিয়া।

.

৫৩. আলেকজান্ডারের পথ অনুসরণ

হতাশ হয়ে একে অন্যের দিকে তাকাল এলিস, কলিন আর ডা. শুক্লা। কোনো রকম অগ্রগতি ছাড়াই কেটে গেল দিনের বেশিরভাগ সময়। সমস্ত কাগজপত্র উল্টেপাল্টে দেখল। পরীক্ষা করল সবকটি ছবি আর মানচিত্র। কিউবের বাকি চারটা পদ্য ছাড়াও ইউমেনিসের জার্নালের বাড়তি কবিতাগুলোও আলোচনা করে দেখল। কিন্তু কোনো লাভ হল না। হাতে কেবল গতকালের মর্মোদ্ধার করা কবিতা।

আগের দিন কিছুক্ষণের জন্য দুর্গের ল্যান্ডলাইনে ফোন করেছিল বিজয়। জানিয়েছে যে কুপার ওকে একটা স্যাটেলাইট ফোন দিয়েছে। ফলে কুনার উপত্যকার মত পার্বত্যঞ্চলে সেলফোনের সিগন্যাল না থাকলেও বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রাখতে কোনো সমস্যাই হবে না। অল্প সময়ের জন্য ফোন করায় তেমন কিছু বলতে পারেনি। তবে গলার স্বরে বেশ উত্তেজনা ছিল। এও বলেছে যে “দেবতাদের রহস্য”, আসলে হল অমৃত-অমরত্বের রহস্য মহাভারতের একটা পৌরাণিক কাহিনিতে যেটার বর্ণনা দেয়া আছে। সময় সংক্ষিপ্ত থাকায় বিস্তারিত বলার সুযোগ পায়নি। একই সাথে খানিকটা আকুতিও ছিল। কারণ সময় দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। তাই শীঘ্রিই কয়েকটা উত্তর খুঁজে বের করতে হবে।

এতক্ষণ ওরা নিজেরাও কিছু পাবে বলে আশা করেছিল। ছেলেটার আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে সব সম্ভাব্য সন্ত্রাসী আর পেশাদার খুনি, ভাবতেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠে আর রাধাসহ তাদের সবার জীবন নির্ভর করছে বিজয়ের প্রতিজ্ঞার উপর, মনে হলেই দিশেহারা লাগে।

“চলেন আবার প্রথম থেকে শুরু করি।” ডা. শুক্লাকে তাগাদা দিল এলিস। কন্যার দুশ্চিন্তায় এমনিতে উনার অবস্থা খারাপ। মেয়েটা কোথায় আছে কেউ কিছুতেই বের করতে পারছে না।

কাগজগুলো আরেকবার চেক করে দেখে ভ্রুকুটি করল এলিস। শুরু থেকেই একটা মানচিত্র দেখে কী যেন একটা মনে আসি আসি করেও আসছে না। কী সেটা?

মানচিত্রটাকে নিজের কাছে টেনে আরো একবার মনোযোগ দিয়ে দেখল। মানচিত্রে আফগানিস্তানের মধ্যে আলেকজান্ডারের ভ্ৰমণ পথগুলো দেখা যাচ্ছে। এরই মাঝে বহুবার দেখে ফেলেছে এ মানচিত্র। এই পথগুলোর সাথেই পদ্যে লেখা স্থানের মিল খুঁজতে হবে। কিন্তু ভারতে আসার সময় আলেকজান্ডার যত জায়গায় গিয়েছিলেন তার সাথে কবিতার স্থানগুলোর কোনো সম্পর্কই বের করতে পারছে না তারা।

গভীর চিন্তায় মগ্ন এলিসকে খেয়াল করে কলিন জানতে চাইল, “কিছু পেয়েছ নাকি?”

ঠোঁট কামড়ে ধরল এলিস। “কিছু একটা আমাকে খোঁচাচ্ছে। কিন্তু বুঝতে পারছি না কী। খুব পরিচিত কিছু একটা চোখে পড়েও পড়ছে না।” মাথা ঝাঁকাল এলিস।

মানচিত্রটাকে একটু টেনে নিয়ে কলিনও তাকাল, “আলেকজান্ডারের ভ্রমণ পথ।” মন্তব্য করে বলল, “ইন্টারেস্টিং। আফগানিস্তানে ঢুকে কান্দাহার, কাবুল আর গজনী দিয়ে উত্তরে মোড় নেবার আগে দক্ষিণে এগিয়ে গেছেন। এরপর হিন্দুকুশ পার্বত্যাঞ্চল পার হয়ে উত্তরে গেছেন। সগডিয়ান রকের চারপাশে ঘোরাঘুরি করে জালালাবাদ আর কুনার ভ্যালিতে মোড় নেয়ার আগে বাল্কে ফিরে এসেছিলেন। মনে হচ্ছে পরিকল্পনা করেই পুরো অঞ্চল ঘুরেছেন। দুর্ঘটনাবশত এমনটা ঘটেছে বলে বিশ্বাস হচ্ছে না।”

এলিস একদৃষ্টে এমনভাবে মানচিত্রের দিকে তাকিয়ে রইল যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। কলিনের কথা শুনে এইমাত্র যেন ব্রেইনের অন্ধকার অংশে আলো জ্বলে উঠল। এবারে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। এতক্ষণ ধরেই ওর চোখের সামনে ছিল। কিন্তু গাধার মতন সে কিছুই বোঝেনি।

“এই তো!” আঙুল নাড়াতেই কৌতূহলী হয়ে তাকাল কলিন।

“কী?” জানতে চাইল।

“বিজয়ের কথাই ঠিক।” উত্তর দিল এলিস। “আগে যে কেন দেখলাম? কুনার উপত্যকাতেই লুকিয়ে আছে সেই সিক্রেট। এটাই তাদের গন্তব্য।”

ডা. শুক্লাও ধাঁধায় পড়ে গেলেন, “তোমার কেন এটা মনে হল এলিস?”

“দেখুন।” মানচিত্রে সগডিয়ান রকের স্থানে আঙুল রাখল এলিস। “পর্যায়ক্রমটা খেয়াল করুন। জালালাবাদের আগে হল সগডিয়ান রক। হয়ত আমাদের ধাতব পাতটার কোনো প্রয়োজনই নেই। সম্ভবত ইউমেনিসের জার্নালের পদ্যগুলোকে ভৌগোলিক ক্রমানুযায়ী সাজানো হয়েছে আর আলেকজান্ডারও সেটা অনুসরণ করেই ভ্রমণ করেছেন। প্রথম দুটো পদ্যের অবস্থান চিহ্নিত করতে পারলেই আমার যুক্তির সত্যতা প্রমাণ হয়ে যাবে।”

সবাই মিলে একসাথে মানচিত্রের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

খানিকক্ষণ পরেই চোখ তুলে তাকালেন ডা. শুকলা, “আমার মনে হয় আমি ঠিকভাবে মনোসংযোগ করতে পারিনি।” লাজুকভাবে হাসলেন প্রাজ্ঞ ভাষাবিদ, “আরো আগেই এটা বোঝা উচিত ছিল। আজ সকালের ফোনেই তো সূত্র দিয়েছে বিজয়। অথচ আমি তবুও বুঝিনি। কিন্তু এলিসের মুখে আলেকজান্ডারের ভ্রমণ পথের সূচি শুনেই ব্যাপারটা মাথায় এসেছে।” এলিসের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি ঠিকই বলেছ।”

মানচিত্র জুড়ে বয়ে চলা নদীটাকে ইশারা করে বললেন, “এটা অক্সাস নদী। আর মনে হয় দ্বিতীয় পদ্যে এ নদীর কথাই বলা হয়েছে। সংস্কৃত শব্দটা হচ্ছে “চক্ষু” মানে চোখ! এতক্ষণ এভাবেই অনুবাদ করেছিলাম। কিন্তু মহাভারতে অক্সাসকেই চক্ষু বলা হয়েছে। অক্সাসের পদ্যের আগেই সগডিয়ান রকের পদ্যটা এসেছে। যদি মহাভারতের অমৃতকেই দেবতাদের রহস্য হিসেবে ধরা হয় তাহলে মহাভারতের মাঝেই লুকিয়ে আছে এর সূত্র। ফলে মহাকাব্যে বর্ণিত শুক্রের কথাও বোঝা যাচ্ছে এখন।”

আরেকবার মানচিত্র দেখল এলিস, “আমারও মনে হয় আপনি ঠিক কথাই বলেছেন ভা, শুক্লা। এর পেছনে যুক্তিও আছে। পদ্যে অক্সাস পার হবার কথা বলা হয়েছে। একমাত্র একটা নদীই “দ্রুত গতিতে বইতে পারে।”

“আর প্রথম পদ্যটা-যেটা কিউবে নেই; কিন্তু জার্নালে আছে” বলে উঠলেন শুক্লা, “এখন যেহেতু আমরা জানি যে রহস্যটা মহাভারতের সাথে জড়িত তাহলে এটার অর্থ বুঝতেও কষ্ট হচ্ছে না। পরাজিত শক্তিমান রাজার লাইনটা হল কৌরভের লাইন। এই পদ্যে শক্তিমান রাজা বলতে ধৃতরাষ্ট্রকে বোঝানো হয়েছে। কৌরভেরা ছিল তার পুত্র। সকলেই মারা গেছে। শেষ দুই লাইনে কৌরভদের ধ্বংসের কারণ “প্রবঞ্চনার প্রতিও ইঙ্গিত করা হয়েছে : “খুঁটি গড়িয়ে যাওয়া।” এখানে শকুনির খুঁটি গড়ানোর কথা বলা হয়েছে। তিনি কৌরভদের মামা অর্থাৎ ধৃতরাষ্ট্রের পত্নী গান্ধারীর ভাই ছিলেন। কৌরভরা ছিল একশত ভাই। গান্ধারের রাজকন্যা ছিলেন গান্ধারী। মহাভারতের একটা ভার্সন অনুযায়ী-আমার মনে হয় এটা অন্ধ্র প্রদেশ থেকে এসেছে-শকুনির পিতা সুবলকে পুরো পরিবারসহ ভীস্ম কারাগারে বন্দী করেছিলেন। শকুনি তাদেরকে অনাহারে মৃত্যুবরণ করতে দেখেছে যেন সে বেঁচে থেকে এর প্রতিশোধ নিতে পারে। পৌরাণিক এই কাহিনি অনুযায়ী সুবল শকুনিকে বলে গিয়েছিলেন যেন তাঁর হাড় থেকে খুঁটি তৈরি হয় যা মহাভারতে ব্যবহৃত হয়েছে। এটাই হল, ‘ছল বা কৌশল, মৃত্যু থেকে জাত, প্রতিশোধ নিতে ব্যগ্র’ খুঁটি, সুবলের মৃত্যুর মাধ্যমে যার সৃষ্টি আর প্রতিশোধ নিয়েছে শকুনি। কান্দাহারেরই প্রাচীন নাম হল গান্ধার।”

নীরবে সবাই আবার ম্যাপের দিকে তাকাল। এখন বোঝা যাচ্ছে পদ্য আর আলেকজান্ডারের ভ্রমণ পথের মাঝে সম্পর্ক। কান্দাহার থেকে কাবুল। কাবুল থেকে বাল্ক। বাল্ক থেকে অক্সাস নদী পেরিয়ে সগডিয়ান রক আর তারপর আবার কাবুলে প্রত্যাবর্তন এবং এরপর জালালাবাদ।

“তবে লবণহীন সমুদ্র” এখনো বুঝতে পারিনি” অবাক হয়ে জানাল কলিন, “পদ্যনুযায়ী ওখানে মনে হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু আছে। “অভিযানের কেন্দ্রস্থল।”।

“এটা অবশ্যই অক্সাস নদীর উত্তর কিংবা পশ্চিমের কিছু একটা হবে।” গভীর ধ্যানে ডুবে গেলেন ডা. শুক্লা। জানালেন, “কিন্তু আরেকটা কথা কী জানো, তিনজন ভ্রাতা কে? আর তীরের মাথা মানে কী? ‘সাপের সিলের কথা না হয় নাই বললাম।”

‘আলেকজান্ডার তো একটা রেডিমেইড মানচিত্র পেয়েছিলেন” চটে উঠল কলিন, “আর এখানে আমরা রহস্যময় সব ধাঁধার অর্থ খুঁজতে বসেছি।”

“গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল কুনার উপত্যকাই যে এই ভ্রমণের শেষ গন্তব্য তা অন্তত বের করতে পেরেছি।” উপসংহার টানলেন ডা. শুক্লা। “তার মানে পদ্যের শেষ দুটো লোকেশন উপত্যকার ভেতরেই কোনো স্থান। যাক অবশেষে বিজয়ের জন্য কিছু পাওয়া গেল?” কণ্ঠস্বরে ঝরে পড়ল আশা।

আর তাঁর কথাকে সত্য প্রমাণ করতেই যেন বেজে উঠল ডেস্ক ফোন। লাফাতে লাফাতে গিয়ে তুলে নিল কলিন। বিজয়। যা যা খুঁজে পেয়েছে সব খুলে বলল কলিন।

“শুনে তো যুক্তিযুক্তই মনে হচ্ছে।” সম্মত হল বিজয়, “আমার হয়ে সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে দিও কলিন। এখন রাখি। ওরা যাত্রার জন্য তৈরি হয়ে আছে। এগোবার জন্য হাতে কিছু পাওয়া গেল।”

.

৫৪. জালালাবাদ, আফগানিস্তান

ফোন ডিসকানেক্ট করে দিতেই চোখে প্রশ্ন নিয়ে বিজয়ের দিকে তাকাল ভ্যান ক্লক। এছাড়াও বাসায় বিজয় যে দু’বার ফোন করেছে প্রতিবার উপস্থিত থেকে সব শুনেছে। তাই বিজয়ের শুধু একটাই কাজ করার আছে দলের সাথে যোগাযোগ করে ধাঁধার সমাধান করা।

“কুনার উপত্যকাই সর্বশেষ গন্তব্য।” কলিনের সাথে কী আলোচনা হয়েছে তা সংক্ষেপে খুলে বলল বিজয়, “দিন-রাত্রি আর সর্পের ভয়ংকর দৃষ্টি এ দুটো পদ্যের বর্ণিত স্থান কুনার উপত্যকার মাঝেই অবস্থিত।

পাশেই দাঁড়ানো কপারের দিকে তাকাল ভ্যান ক্লক, “আমাদের গাইড কী বলে?”

“পর্বতে শিবের জিনিস বলতে কী বুঝিয়েছে সে সম্পর্কে কিছু জানে না” মাপা স্বরে জবাব দিল কুপার, “কিন্তু একই সাথে এও বলেছে যে সে এখানকার স্থানীয় নয়। জালালাবাদ থেকে এসেছে। তাই উপত্যকার চারপাশের গ্রামে খোঁজ নিতে হবে। এখান থেকে ৯০ মিনিট গেলেই আসাদাবাদ। রাস্তার অবস্থাও ভালো। ইউএস এইডের প্রজেক্ট হিসেবে মাত্র কয়েক বছর আগেই পাকিস্তান সীমান্তের সাথে কাবুলকে জুড়ে দেবার জন্য তৈরি হয়েছে এ রাস্তা। আমি বলব গিয়ে একবার দেখে আসা যাক।”

“আমার মনে হয় না এত দূর আসাদাবাদ পর্যন্ত যেতে হবে।” ধ্যানমগ্ন ভ্যান ব্রুক জানাল, “রাস্তা ছেড়ে পর্বতে যাবার নিশ্চয় অন্য কোনো রাস্তা আছে। আলেকজান্ডার আর কোনো ভাবে স্থান পেয়েছিলেন?”

নিঃশব্দে একমত হল বিজয়। গাঢ় কালো অন্ধকারেও সে স্থানে পৌঁছে গিয়েছিলেন ইউমেনিস আর আলেকজান্ডার। সিক্রেট জার্নাল অনুযায়ী হাতে ছিল কেবল মশালের আলো। পর্বতের এত গভীরে যখন যেতে পেরেছিলেন তার মানে পায়ে হাঁটা কোনো পথ নিশ্চয় আছে। যেখানে খুব বেশি কষ্ট করতে হবে না। কিংবা ক্লাইম্বিং গিয়ারও লাগবে না।

কিন্তু মুখে কিছুই বলল না। সিক্রেট জার্নাল সম্পর্কে এদেরকে কিছু জানাতে চায় না। পরিবর্তে তাকিয়ে দেখল যে উঠার পায়তারা কষছে ভ্যান কুক আর নিজের লোকদেরকে প্রস্তুতির জন্য তাগাদা দিতে গেল কুপার।

.

একটা অংশ এখনো নিখোঁজ

কঠোর দৃষ্টিতে আইভরি কিউবটার দিকে তাকাল কলিন। নিজের রহস্যের বেশির ভাগই উন্মুক্ত করে দিলেও আলেকজান্ডারের ভ্রমণ পথের একটা লোকেশন এখনো জানায়নি কিউবটা। তিন ভ্রাতা আর সাপের সিলঅলা পদ্যটার মর্মোদ্ধার করা যায়নি।

“আমি কিছুতেই শান্তি পাচ্ছি না।” জানাল কলিন, “যদি কিউবের প্রত্যেকটা পদ্যই সমান গুরুত্বপূর্ণ হয় তাহলে এটাকে তো বাদ দেয়া যাবে না। নিখোঁজ অংশটুকু ছাড়া ধাঁধাটা সম্পূর্ণ হচ্ছে না। কুনার ভ্যালিতে ওরা যেটাই পাক না কেন উদ্দেশ্য সফল হবে না। কেননা এ পদ্যেই আছে “অভিযানের কেন্দ্রস্থল।” যদি সিক্রেটটা কুনার উপত্যকায় থাকে তাহলে কেন্দ্রস্থলের কথা কেন বলল? তার মানে এটাই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ তাই না?”

মাথা খাটাতে গিয়ে ভ্রু কুঁচকে ফেলল এলিস, “এই পদ্যটা আসলেই জটিল। অক্সাস নদী সম্পর্কেও জেনে গেছি। তাছাড়া আর কিছু তো বুঝতে পারছি না।”

অভিব্যক্তিহীন চেহারা নিয়ে বসে আছেন ডা. শুক্লা। তবে মাথায় যে চিন্তার ঝড় চলছে তা বলাই বাহুল্য।

“এটাকে ভাঙার একটাই উপায় আছে” অবশেষে জানাল কলিন, “এ ধরনের পরিস্থিতিতে বিজয় যা করে আমিও এখন তাই করব। না পাওয়া পর্যন্ত ইন্টারনেটে ঘুরতে থাকে। কিছু না কিছু অবশ্যই বের হবে।”

.

কুনার উপত্যকা, আফগানিস্তান

একেবারে সামনের ল্যান্ড রোভারে বসে পেছনের ল্যান্ড রোভারের সারির দিকে তাকাল বিজয়। পা থেকে মাথা পর্যন্ত সশস্ত্র মানুষে ঠাসা ছয়টা এসইউভি। খেয়াল করে দেখেছে যে স্থানীয় আফগানগাইড ছাড়া বাকি সকলেই ককেশীয়। হয়ত, ইউরোপ আর ইউএস থেকে আসা ভাড়াটে সৈন্য। অথবা অর্ডারের ব্যক্তিগত সেনাবাহিনির একাংশ। যাই হোক না কেন অর্ডারের পেশিশক্তির এরকম প্রদর্শনী সত্যিই ভীতি জাগানিয়া।

এই রাস্তাটা কাবুল থেকে জালালাবাদের পথের মত নয়। গিরিখাদ আর খাড়া ঢালগুলো নেই। যতদূর চোখ যায় রাস্তাটা কুনার নদী ধরেই এগিয়ে গেছে। দুপাশে ক্ষেত ভর্তি সমতল উপত্যকা। স্থানে স্থানে সংকীর্ণ হলেও এখন পর্যন্ত বেশ চওড়াই বলা চলে।

ডান দিকে, উপত্যকা বেয়ে সাপের মত এঁকেবেঁকে চলে গেছে কুনার নদী। একেবারে দক্ষিণে, সফেদ কোহ্ পর্বতমালা যা পাকিস্তানের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত প্রদেশকে চিহ্নিত করেছে।

বাম দিকে আফগানিস্তানের মেরুদন্ড, হিন্দুকুশ পর্বতমালা। সুউচ্চ আর ভয়ংকর। এখানেই কোথাও লুকিয়ে আছে দেবতাদের রহস্য।

আলেকজান্ডারের উপর সে নিজে যে গবেষণা করেছিল তা স্মরণ করল বিজয়। পারস্য সম্রাট দারিয়ুস আলেকজান্ডারের হাতে পরাজিত হবার পর নিজ সভাসদ বিসাসের হাতে খুন হয়েছিলেন আর অবমাননাকর এক মৃত্যুবরণ করেছেন। এরপর পঞ্চম আরটাজারজেস নাম ধারণ করে বিসাস হিন্দুকুশ থেকে ব্যাকট্রিয়া পর্যন্ত পালিয়ে বেরিয়েছেন এই আশায় যে আলেকজান্ডার তাকে খুঁজে পাবেন না। কিন্তু বিপদসংকুল পথ পার হয়ে খাওয়াক পাসের মধ্যে দিয়ে হিন্দকুশ এসেছিলেন আলেকজান্ডার। এমনকি যাত্রাপথে সেনাবাহিনির রসদের অভাবও দেখা দিয়েছিল। তারা বাঁচার জন্য নিজেদের জীব-জন্তু হত্যা করে কাঁচা মাংস খেতেও বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু আলেকজান্ডার বিসাসকে ধরতে ঠিকই সফল হয়েছিলেন। নিষ্ঠুর অত্যাচার করে মেরে ফেলা হয় পঞ্চম আরটাজারজেসকে।

এরপর দক্ষিণে সগডিয়ান রকের দিকে এগিয়ে গেছেন। আর এখানেই কোথাও সেনাবাহিনি ছেড়ে নিজের গোপন মিশনে বেরিয়ে পড়েন ক্যালিসথিনস। এখনো যেসব পদ্যের মর্মোদ্ধার করা যায়নি সেসব স্থানেও গিয়েছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ফিরে আসার সময় আলেকজান্ডারের জন্য কী এনেছিলেন? কুনার উপত্যকায় কী এর উত্তর পাওয়া যাবে?

.

৫৫. এক বন্দীর ভাবনা

নিজের ছোট্ট কুঠুরির মেঝেতে দুই হাঁটু আঁকড়ে ধরে বসে আছে রাধা। গতকাল সাক্সেনার কাছে যা শুনল তারপর থেকেই যেন বোধবুদ্ধি সব অসাড় হয়ে গেছে। আর সে ছাড়া ব্যাপারটা অন্য কেউ জানেও না। বুঝতে পারছে অর্ডার নিজের মিশন পুরো করেই ছাড়বে। গন্তব্যে পৌঁছানোনার জন্য তাকে থামানোর কেউ নেই।

কিন্তু নিজের ব্যর্থতাই রাধাকে বেশি করে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। ভাবতে ভাল লাগছে না যে ওর কিছুই করার নেই। এখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে চাইছে দুনিয়াকে জানাতে যে সত্যিকারে কী ঘটছে। ক্লিনিকাল ট্রায়ালগুলো কেন হয়েছে। অথচ এটাও জানে যে সাক্সেনা তাকে সব খুলে বলেছে কারণ ওর কোথাও যাবার উপায় নেই। ভেতর থেকে খোলা যায় না এমন একটা কুঠরিতে বন্দী হয়ে আছে রাধা। বাইরের করিডোর ইনস্টল করা সিসিটিভি ক্যামেরা ওর সেলের উপর সার্বক্ষণিক নজর রাখছে। যে কোনো ধরনের অস্বাভাবিক আচরণই সাথে সাথে ধরা পড়ে যাবে। নিয়মিত বিরতিতে এসে চেক করে যায় একটা পুরুষ গার্ড। আর কোনোভাবে যদি গার্ডকে পরাস্ত করে বাইরে বের হতেও পারে। সেখানকার অবস্থাও তো জানা। পুরো দালানটাই ভূর্গভস্থ। বাইরে যাবার কোনো দরজাই দেখেনি।

তাই ভয়ংকর সত্যিটাকে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। এখান থেকে বেরোবার কোনো উপায় নেই। যদি না কেউ এসে ওকে উদ্ধার করে।

কিন্তু সেটার সম্ভাবনাও শূন্য। কারণ কেউ তো জানেই না যে সে কোথায় আছে।

.

পথ নির্দেশকের খোঁজে

জালালাবাদ ছাড়ার পর থেকেই কেবল উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা। উপত্যকা এখন বেশ সংকীর্ণ হয়ে গেছে। উধাও হয়ে গেছে দু’পাশের ক্ষেত। ডানদিকে নদী রেখে হিন্দুকুশের পাদদেশে এঁকেবেঁকে উঠে গেছে রাস্তা।

পথিমধ্যে অসংখ্য গ্রাম পার হয়ে এলেও তাদেরকে কাঙিক্ষত লোকেশনে পৌঁছে দিতে পারে এমন কোনো সাইনপোস্ট চোখে পড়েনি।

এখন বিপজ্জনক অঞ্চলে ঢুকে পড়েছে। মাঝে মাঝেই কানে আসছে রকেট ফায়ারের গুরুগম্ভীর আওয়াজ। আফগানিস্তানের এই উপত্যকায় যুদ্ধক্ষেত্রগুলো এখনো সক্রিয়। আলেকজান্ডারের পর দু’হাজার বছর পেরিয়ে গেলেও রক্তপাত এখনো থামেনি। কুপার অবশ্য ভ্যান কুককে আশ্বস্ত করেছে যে উপত্যকায় তাদের উপস্থিতি সম্পর্কে তালিবানের স্থানীয় ইউনিটকে আগেই জানানো হয়েছে।

“আজ ওরা আমাদের রাস্তায় মিসাইল ছুড়বে না” ভ্যান ক্লককে জানিয়েছে। কুপার। মনে হচ্ছে প্রতিজ্ঞাটা আসলেই সত্য। বিজয় শুধু আশা করছে যেন জালালাবাদ পুনরায় ফিরে আসা পর্যন্ত তা বলবৎ থাকে।

সামনে গজিয়ে উঠল মাটির ঘরে ভর্তি আরেকটা গ্রাম। থেমে গেল পুরো গাড়ি বহর। স্থানীয় লোকদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহের জন্য লাফ দিয়ে নেমে গেল গাইড।

এবার মনে হচ্ছে কিছু একটা পেয়েছে। চওড়া হাসি দিয়ে সামনের পর্বতমালার দিকে ইশারা করল লোকটা।

তারপর প্রথম এসইউভির দিকে এগিয়ে এলো; যেখানে বসে আছে বিজয়; কুপার আর ভ্যান কুক। কুপার গাড়ি থেকে নেমে গাইডের সাথে খানিকক্ষণ কথা বলে ভ্যান কুকের দিকে তাকাল।

“গ্রামবাসীদের মতে এখান থেকে এক কি. মি গেলেই পর্বতে যাবার রাস্তা পাওয়া যাবে। এরপর দুই ঘন্টা পাহাড়ে চড়ার পর পাওয়া যাবে প্রাচীন আমলের কয়েকটা পাথুরে লিপিসর্বস্ব কাঠামো। গাইড বলছে সাইন পোস্টও ওখানেই পাওয়া যাবে।”

গাইডের দিকে এক নজর তাকাল ভ্যান ক্লক, “ও যে আমাদেরকে ভাওতা দিচ্ছে না সেটাই বা কিভাবে বুঝব? হয়ত উপরে উঠে দেখব চল্লিশ হাজার বছর আগে পাথরের উপর আঁকিঝুঁকি কেটে গেছে কোনো গুহামানব।”

অট্টহাসি দিল কুপার। “ওতো আমাদের সাথেই যাচ্ছে আর এও জানে যে যা খুঁজছি তা না পেলে ওর পরিণতি কী হবে।”

“ঠিক আছে, তাহলে চলল।” আবারো দুলে উঠল পুরো ল্যান্ড রোভার বহর।

.

পালানোর পরিকল্পনা

রাধার মাথায় আস্তে আস্তে শেকড় ছড়াল এক ভাবনার বীজ। বাইরে থেকে কেউ যদি এই ফ্যাসিলিটির প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেঙে দেয় তবেই কেবল ওকে উদ্ধার করতে পারবে, ব্যাপারটা উপলব্ধি করার সাথে সাথে চিন্তাটা মাথায় এলো। যদি কী খুঁজতে হবে তা কাউকে জানানো যায় তাহলে কিন্তু ব্যাপারটা একেবারে অসম্ভব নয়।

ধরা যাক রাধা এখান থেকে বাইরে মেসেজ পাঠাবার কোনো একটা উপায় খুঁজে পেল? যেমন করেছিল আনোয়ার। কিন্তু আনোয়ারের দুর্ভাগ্যের কথা মনে হতেই অসুস্থবোধটাকে দূরে সরিয়ে দিতে বাধ্য হল।

জানে ওর ভাগ্যে কী লেখা আছে। বিজয় যেন ওদেরকে সাহায্য করে তার জন্য রাধাকে দর কষাকষির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করছে। তাদের উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়ে গেলেই রাধা খতম। অথবা তার চেয়েও খারাপ কিছু। যেমন তাদের ভয়ংকর সব এক্সপেরিমেন্টের সাবজেক্ট বনে যাওয়া। ফ্রিম্যানের প্রজেক্ট নিয়ে সাক্সেনার মন্তব্য মনে পড়ে গেল। ওরা যা করছে তাতে কি প্রজনন শাস্ত্রও জড়িত?

তবে আপাতত তা নিয়ে ভাবছে না। গুরুত্বপূর্ণ হল আইটি সেকশনে পৌঁছানো আর কোনো ভাবে একটা মেসেজ পাঠানো যায় কিনা তা দেখা।

অন্তত একবার চেষ্টা করে দেখা উচিত। যদিও ব্যর্থতার পরিণাম কী তাও জানে। কিন্তু এভাবে তো হাত পা গুটিয়ে বসে থেকে সাক্সেনা আর তার দলের মিশনের সফলতা দেখা যায় না।

.

আশার ক্ষীণ আলো

ল্যাপটপের কাছে বসে ক্লান্ত চোখ দুটোকে ঘষল কলিন। অনেকক্ষণ ধরেই একনাগাড়ে কাজ করছে। বাইরে নেমে এসেছে রাত। এবার উঠে গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়ালো। নিচে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের পাদদেশ অবস্থিত ছোট্ট গ্রামটার আলো।

পদ্যের একটা অংশের মর্মোদ্ধার করতে পেরেছে অথবা তেমনটা ভাবছে। কিন্তু কোনো উপকারে লাগল না।

অন্যদের সাথে বিস্তর আলোচনা আর ইন্টারনেটে বিভিন্ন ধরনের গবেষণার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে “লবণহীন সমুদ্র” বলতে আসলে আরাল সমুদ্রকে বোঝানো হয়েছে; অক্সাস নদীর জলে পুষ্ট একটা লেক, বর্তমানে যা আমু দরিয়া নামে পরিচিত।

ষাট বছর আগে আরাল সমুদ্র কী ছিল সে সম্পর্কে ধারণা ক্ষীণ হলেও মনে হচ্ছে এ সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। প্রথমত, অক্সাস নদীর কাছাকাছি এই একটাই সমুদ্র আছে। দ্বিতীয়ত, যদি কেউ বাল্ক থেকে আসে তাহলে আরাল সমুদ্রে পৌঁছানোর জন্য অক্সাস নদী পার হতেই হবে। তৃতীয়ত, আরাল সমুদ্র প্রকৃতপক্ষেই বিশুদ্ধ পানিতে ভর্তি ছিল। অতঃপর নদীর গতিপথ পাল্টে যাওয়ায় আর সমুদ্রের নিজের প্রাক্তন আকার ছোট হয়ে যাওয়ায় কয়েক দশক ধরে নোনা জলে পরিণত হয়েছে। পানিতে বেড়ে গেছে লবণ আর দূষিত পদার্থের পরিমাণ।

তবে পদ্যের ইঙ্গিত অনুযায়ী অন্তত তিনটা শর্ত পূরণ করায় আরাল সমুদ্রকেই বেছে নিয়েছে কলিন। কিন্তু আরাল সমুদ্র কিংবা অক্সাস নদীর সাথে “তিন ভ্রাতার কী সম্পর্ক তা এখনো বোধগম্য হয়নি।

একই সাথে মনে হচ্ছে চোখ সম্পর্কে ডা. শুক্লার অনুবাদেও খানিকটা গরমিল আছে। হতে পারে এটা কেবলই একটা চোখ, কোনো নদী নয়? তাহলে অবশ্য নতুন এক ধাঁধার উদয় হবে : “দ্রুত বহতা চোখ” মানে কী?

দীর্ঘশ্বাস ফেলল কলিন। যতটা সহজ ভেবেছিল ব্যাপারটা আসলে ততটা সহজ নয়। বিজয় কী করছে, কেমন আছে তাই বা কে জানে! আর কোনো ফোনও করেনি।

আবার ল্যাপটপের সামনে এসে বসে পড়ল। সময় একেবারে নেই। তার। জন্য। কিংবা রাধা আর বিজয়ের জন্যও।

.

৫৬. পর্বতে

একটা বোল্ডারের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভ্যান কুক। চারপাশে সাইন পোস্টের খোঁজ করছে তার দল। দিনের আলো দ্রুত কমে এলেও তাদের সাথে শক্তিশালী পোর্টেবল সার্চলাইট আছে। ফলে আশপাশের পর্বতমালা আর পাথরগুলোও আলোকিত হয়ে উঠেছে।

কথা মত দু’ঘণ্টাতেই শেষ হয়েছে ট্রেক। তারপর এখানে এসে গাইডের নির্দেশে থেমে গেছে সকলে। লোকটার দাবি পদ্যে উল্লেখিত লোকেশনের জন্য এখানেই খুঁজতে হবে সাইনপোস্ট।

তবে চারপাশ দেখে অন্তত পদ্যের একটা অংশের সাথে মিল আছে বোঝ যাচ্ছে। তারা এখন কুনার নদীর উপরে। ভ্যান কুক হিসাব করে দেখেছে উপত্যকার মেঝে থেকে ২০০ ফুট উপরে, দুটো ঢালু অংশের সংযোগ স্থল বলা যায়। আর পদ্যে নদীর উপর ঢালের কথাই বলা হয়েছে।

এছাড়াও বসে বসে ভাবছে যে গন্তব্যে পৌঁছবার সত্যিকার মানেটা কী? অর্ডারে আরো এক ধাপ উপরে উঠে যাওয়া। একেবারে শীর্ষের কাছাকাছি। এমনকি হতে পারে অর্ডারকে চালিত করে যে ছোট্ট দলটা তার কাছাকাছিই পৌঁছে যাবে। তার পরিবারের সদস্যরাও শত শত বছর ধরে এই অর্ডারেরই সদস্য। জলদস্যু হিসেবে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ানোর সময়েও বিশ্বস্ততার সাথে পালন করছে নিজেদের দায়িত্ব। কিন্তু ভ্যান কুক সেসব দিন দেখেন নি। এখন তো তারা অত্যন্ত ধনী। আরো বেশি শক্তিশালী। লোকে তাদেরকে শ্রদ্ধা করে। তাই কয়েক বছর ধরে অর্ডারে পদমর্যাদাও বেড়েছে।

আর আজ তো অর্ডারের সর্বোচ্চ পুরস্কার একেবারে হাতের নাগালে চলে এসেছে। পরিচালকের সাথে একই টেবিলে বসার সুযোগ করে দেবে এ অবস্থান। যেখানে কেবল রক্তের সম্পর্কে প্রকৃত উত্তরাধিকারীরাই বসতে পারে। অর্ডারের সাথে একই সময়ে শুরু হওয়া এ বংশ পরিক্রমা হাজার হাজার বছর ধরেই বিশুদ্ধ হিসেবে টিকে আছে।

চোখ তুলে তাকাতেই দেখা গেল অন্ধকার চিরে দিয়েছে সার্চলাইটের আলো। নিজের বাহিনিকে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। তবে দৃষ্টি গিয়ে বিজয়ের উপর নিবদ্ধ হল। এই ছেলেটাকে কেন যেন বুঝতে পারছে না। ওর মাথায় কি নেই যে তার আর বাগদত্তার দিন শেষ হয়ে এসেছে? এতটা বোকা তো হতেই পারে না। অথচ এত কিছুর পরেও ছেলেটার মুখে আত্মপ্রত্যয়ের ছাপ। নাকি অন্য কোনো ব্যাক আপ প্ল্যান ও করে রেখেছে? ভ্যান কুক যতটা জানেন বিজয়ের সাথে কোনো অস্ত্র নেই। মাথা ঝাঁকিয়ে চিন্তাটাকে দূরে সরিয়ে দিল। যদিও সেটা কোনো সমস্যাই না। ধাঁধার সমাধান করে প্রহেলিকার জাল ছিন্ন করা এই ছোকরার কাছে ডাল-ভাত। গত বছরেও ইচ্ছের বিরুদ্ধে হলেও ওদেরকে সাহায্য করেছিল। আর এখন তো স্বয়ং নিজের ইচ্ছেতেই করছে। ইউরোপীয়ান হয়ে এর বেশি কিছু আর আশাও করেনা।

সার্চলাইট হাতে সশস্ত্র দুই লোকের সাথে গোধূলি আলোয় ঘুরে বেড়াচ্ছে বিজয়। যে ঘটনার অভিজ্ঞতা নেই কিংবা যে দৃশ্য আগে দেখা হয়নি তা মনে পড়ে যাওয়ার মত একটা অনুভূতি হচ্ছে। মনে পড়ল যে গত বছর ঠিক একই ধরনের একটা অভিযানে গিয়েছিল। তবে আজকের পরিস্থিতি ভিন্ন। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের কোনো পথ দেখছে না।

তাই নিজের ভাগ্যের কথা না ভেবে আশেপাশের পর্বতমালা আর পাথরগুলোর উপর মনোযোগ দিল। পাথরের উপর খোদাইকৃত ব্যাখ্যা আর চিত্র সম্পর্কে গ্রামবাসী ও গাইডের কথাই ঠিক। চারপাশে অসমাপ্ত শিল্পকর্ম আর ব্যাখ্যা সমেত বড় বড় পাথরের চাই। তবে এসব বোল্ডারের একটারও পদ্যের বর্ণনার সাথে মিল নেই।

পাহাড়ের আরেকটা অংশে যেতেই একপাশে গভীর চোরাকুঠুরি নজরে পড়ল। অথবা আরো ভালোভাবে বলতে গেলে মাত্র কয়েক ফুট চওড়া একটা গলিপথ যার শেষ মাথায় পাথরের দেয়াল। প্রবেশমুখটা আয়তকার। আর ঠিক এর উপরেই মনে হচ্ছে পাথর কেটে তৈরি করা হয়েছে একটা চারকোণা ফাটল। কিন্তু এত ছোট যে কেউ হামাগুড়ি দিয়েও যেতে পারবে না। বিজয় বিস্মিত হয়ে ভাবল যে ফাটলের উদ্দেশ্য চোরাকুঠুরিতে প্রবেশ না হয় তাহলে কেনই বা তৈরি হয়েছে? প্রবেশমুখটাও তত বন্ধ। তাই গার্ডদেরকে ইশারায় অন্ধকারে ঢাকা চোরাকুঠুরির পাথরের গায়ে সার্চলাইটের আলো ফেলতে বলল।

প্রাকৃতিক চোরাকুঠুরির কাছেই একটা পাথরগাত্রে ভয়ংকর দৃশ্যটা দেখে কেঁপে উঠল বিজয়। উদ্যত ধনুক হাতে বোঝা যাচ্ছে না এমন এক প্রাণী শিকার করছে দুই ধনুর্বিদ। সম্ভবত একটা হরিণ আর একজন শিকারীর পাশে আরেকটা ছোট জন্তুও আছে। হতে পারে একটা কুকুর। কিন্তু চিত্রটা অসম্পূর্ণ থাকায় স্পষ্ট বোঝার কোনো উপায় নেই।

প্রথম প্রতিক্রিয়ায় মনে হল ভ্যান কুকের ধারণাই ঠিক। অসমাপ্ত চিত্রগুলো দেখে মনে হচ্ছে হাজার বছর আগেকার শিকারী কোনো গুহাবাসীর হাতে আঁকা। তাদের অভিযানের সাথে এ চিত্রগুলোর কোনো সম্পর্ক কি তাহলে আছে?

আরেকটু হলেই দৃষ্টি সরিয়ে নিচ্ছিল। আর তখনই চোখে পড়ল ব্যাপারটা।

চিত্রের একটা অংশ সে বাদ দিয়ে গেছে। এই দৃশ্যের অনেকখানি উপরে পাথর কেটে তৈরি হয়েছে পাঁচ মাথাঅলা একটা তারা আর বাইরের দিকে রশ্মি। ছড়িয়ে দেয়া একটা বৃত্ত। বুঝতে পারল কী দেখছে।

“এইখানে।” চিৎকার করে ডাকল সবাইকে, “প্রথম সাইনপোস্ট।” স্থির দৃষ্টিতে ড্রয়িংটাকে দেখছে। শুক্র কোথায়? ঋষি ভ্রিগু’র পুত্র? নিচের শিকারীদের কেউ একজন নাকি?

সাথে নিজের বাকি লোকদেরকে নিয়ে স্তপায়ে বিজয়ের আবিষ্কার দেখতে এগিয়ে এলো ভ্যান ক্লক।

“দিন আর রাত্রির সন্নিবেশ” ব্যাখ্যা করে বলল বিজয়, “সূর্য আর তারা, দিন আর রাত্রিকে বোঝাচ্ছে। একসাথে একই চিত্রে। তারমানে এটাই সেটা।”

“হুমমম” চোখ পিটপিট করে চিত্রটাকে দেখল ভ্যান কুক, “মনে হয় তোমার কথাই ঠিক। কিন্তু এখন শিবের লাঠি কোথায় পাবো?”

উবে গেল বিজয়ের আবিষ্কারের উত্তেজনা। কারণ এ প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই ওর কাছে।

.

৫৭. প্রথম পদক্ষেপ

রাধার মনে হল এই-ই সুযোগ। আরেকটু অপেক্ষা করলে হয়ত বেশি দেরি হয়ে যাবে। গভীরভাবে দম নিয়ে গার্ডকে ডেকে পাঠানোর জন্য কল বাটনে চাপ দিল। সাধারণত টয়লেটে যাওয়া কিংবা শাওয়ার নিতে হলেই এমনটা করত। পুরো ফ্লোরের বাসিন্দারা একসাথে ব্যবহার করতে পারবে এত সংখ্যক কিউবিকল সমেত একটা কমন বাথরুম আছে। এর ঠিক পাশেই টয়লেট!

রুটিন মত চলে এলো গার্ড। হাতে টেজার হিসেবে কাজ করে এরকম একটা বেতের লাঠি। এটা ইলেকট্রিক চার্জ হিসেবে কাজ করে, যেন প্রয়োজন হলে শক দিয়ে স্থবির করে দেয়া যায়। গার্ড এই লাঠি ওর উপর কখনো ব্যবহার না করলেও অন্যদের উপর কয়েকবার প্রয়োগ করতে দেখেছে রাধা। লোকটা নিজের ভিকটিমদেরকে বিশেষ করে নারীদেরকে কিলবিল করে উঠতে দেখলে মজা পায়। নিজের পরিকল্পনা নিয়ে মত্ত রাধা তাই গার্ডের প্রতি কোনো সমবেদনাই বোধ করল না।

দ্রুত পায়ে করিডোর বেয়ে নেমে এলো রাধা, যেন তার তর সইছে না। গার্ডও লম্বা লম্বা পা ফেলে ওর সাথে তাল মেলাতে চাইল। চোখের কিনার দিয়ে লোকটার সেঁতো হাসি কিন্তু রাধা ঠিকই দেখতে পেল। পরিষ্কার বোঝা গেল যে গার্ড কত আমোদে আছে। তাই নিজের প্ল্যান পূরণের জন্য আরো দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হল।

টয়লেটের সারির কাছে পৌঁছে গেল। ছোট ছোট কিউবিকল যেটার দরজা কেবল বাইরের দিকে খোলে। দরজার হাতল ধরে মনে মনে ঝালিয়ে নিল পুরো পরিকল্পনা। স্তরে স্তরে পার্টিকেল বোর্ড দিয়ে তৈরি হওয়ায় কিউবিকল বেশ ঠুনকো। ওর উদ্দেশ্য সফল হবে তো?

প্রমাণিত হবার কেবল একটাই রাস্তা আছে। ভেতরে ঢুকে পড়ল রাধা। কোনো হুড়কো নেই। আগেই ধারণা করা হয়েছে হয়ত কেউ ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করতে পারে।

অপেক্ষা করছে রাধা। পুরো ব্যাপারটাই এখন ভাগ্যের হাতে। তাই জোর করে মাথা থেকে চিন্তা দূর করে দিল। চাইছে হয়ত ইচ্ছে শক্তির আকর্ষণে পেয়ে যাবে সব সুযোগ।

একের পর এক মিনিট কেটে যাচ্ছে। কিছুই হল না।

কিউবিকলের ভেতরটা সম্পূর্ণ নিপ। আর বাইরেও। নিজেকে শক্ত করল রাধা। ধৈর্য রাখতে হবে।

এখনো, কিছু ঘটছে না।

আর তারপর ঠিক যখন সে হাল ছেড়ে দেবে তখনি দরজার কাছে এগিয়ে এলো গার্ড। উঠে দাঁড়াল রাধা। এসে গেছে সেই কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত। আঘাত করার জন্য যার সম্পূর্ণ ব্যবহার করতে হবে।

গার্ড প্রয়োজনীয় দূরত্বে এসে দাঁড়িয়েছে অনুমান করেই নিজের সবটুকু ওজন নিয়ে সর্বশক্তিতে দরজার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল রাধা।

তীব্র বেগে বাইরের দিকে খুলে গিয়েই গার্ডের মুখের উপর আঘাত করল দরজা। তাল হারিয়ে পেছন দিকে পড়ে গেল গার্ড। ভারসাম্য হারিয়ে গড়িয়ে গেল।

রাধা নিজেও তাল সামলাতে না পেরে লোকটার উপর ধাক্কা খেল। নাক চেপে মেঝেতে শুয়ে আছে গার্ড।

কিন্তু দ্রুত আবার নিজেকে ধাতস্থ করে উঠে বসার চেষ্টা করল। বুঝতে পারছে রাধা কী করতে চাইছে। ভাঙ্গা নাক বেয়ে মুখের উপর গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। ডান হাতে ধরা ইলেকট্রিক লাঠি মেয়েটার উপর আছড়ে পড়তে প্রস্তুত।

সেকেন্ডের ভগ্নাংশেরও কম সময়ের জন্য আতঙ্কিত হয়ে উঠল রাধা। ওর প্ল্যান বুঝি ভেস্তে গেল। ভেবেছিল গার্ড অজ্ঞান হয়ে যাবে।

যাই হোক, নিজেকে শক্ত করল। স্মরণ করল টাস্ক ফোর্সে যোগ দেবার সময়কার ক্লোজ কমব্যাট ট্রেনিং সেশনের কথা। কোমরকে ভর হিসেবে ব্যবহার করে এক পা তুলে জোর লাথি কষালো গার্ডের উপর। ঠিক কারাতের রাউন্ডহাউজ কিকের মতই গার্ডের মাথার একপাশে আঘাত করল গোড়ালি। আবারো পড়ে গেল গার্ড।

লোকটার ইলেকট্রিক লাঠি হাতে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখল রাধা। যেমনটা ভেবেছিল, এটা টেজারের আধুনিক সংস্করণ। বিভিন্ন শক লেভেল আছে। নিথর করে দেয়ার জন্য গার্ডের শরীরে চেপে ধরল লাঠি।

কয়েকবার ঝাঁকুনি দেবার পরপরই নিঃসাড়ে পড়ে রইল গার্ড। কিন্তু অজ্ঞান হয়ে যায়নি। কেবল চলৎশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। রাধার কোনো ধারণাই নেই যে গার্ডের সম্বিত ফিরতে কতক্ষণ লাগবে। তাই সময়ের সদ্বব্যবহার করা ছাড়া গতি নেই।

নিশ্বাস দ্রুত হয়ে ঘামতে শুরু করেছে রাধা। এতক্ষণ পর্যন্ত সবকিছু চমৎকারভাবে হয়েছে। তবে কঠিন অংশটা এখনো বাকি।

.

শিবের লাঠির খোঁজে

গভীর চিন্তায় ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে আছে বিজয়। পদ্যের ব্যাপারে ওদের ধারণাই ঠিক। কুনার উপত্যকার কথাই বলা হয়েছে। নদীর উপরে গিরিখাদটাও খুঁজে পেয়েছে। দিন রাত্রির সম্মেলনও দেখেছে। কিন্তু শুক্র কোথায়? শিবের লাঠিই বা কোথায় পাবে?

“আমি বাকিদের সাথে কথা বলে দেখি।” স্যাটেলাইট ফোন থেকে দুর্গের ল্যান্ডলাইন নাম্বার ডায়াল করতে গিয়ে ভ্যান কুককে জানাল।

“চটপট কাজ সারার চেষ্টা করো।” পাল্টা মন্তব্য করল ইউরোপীয় ভ্যান। চারপাশে অন্ধকার হয়ে গেছে। যন্ত্রপাতি আর লটবহর দিয়ে এরকম কোনো জায়গায় রাত কাটাবার তার কোনো ইচ্ছে নেই। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অভিযান শেষ করে চলে যেতে চায়।

কয়েকবার রিং বাজার পর ক্লান্ত কণ্ঠে উত্তর এলো, “ইয়েস?” কলিন ফোন ধরেছে।

“হেই, আমার যে সাহায্য দরকার।” খুব দ্রুত পরিস্থিতির কথা খুলে বলল বিজয়। “অন্যেরা কী করছে? খানিকক্ষণ সমাধানের জন্য কাজ করা যাবে না?

“ওরা যে কোথায় আমি জানি না।” উত্তর দিল কলিন, “দেখা যাক তুমি আর আমি পারি কিনা। তুমি বলছ যে শিকারের চিত্র আর তার উপরে সূর্য আর তারা দেখেছ?”

“রাইট। আর পদ্য অনুযায়ী দিন আর রাত্রি একত্রিত হবার পর শিবের লাঠি দেখিয়ে দেবে শুক্র। কিন্তু শুক্রের সাথে মিল আছে এমন কিছু তো দেখছি না।”

“হুমমম। বেশ জটিল ব্যাপার। অনেক কৌশলে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। ওকে, চিত্রটা আমাকে আরেকবার বর্ণনা করো। ঘোট ঘোট কোনো কিছু বাদ, দেবে নো।”

পর্বতের পাশের চোরা কুঠুরি আর পাথরের গায়ের উপরকার চিত্র সবিস্তারে বর্ণনা করল বিজয়।

“ধুত্তোরি।” চটে গেল কলিন। “আমরা তো ভেবেছিলাম যে ছবির প্রত্যেকটা অংশ একসাথে পাবো{ দিন, রাত, শুক্র। হাসি-খুশি একটা পরিবার। সমস্ত কিছু মিলে হবে ত্রিশূল। কিন্তু ব্যাপারটা এত সহজ নয়। তাইনা?”

কলিনের আগডুম বাগড়ম শুনছে বিজয়। জানে ওর বন্ধু এভাবেই চিন্তা করে। কোনো কিছুকে বিশ্লেষণের জন্য এটাই কলিনের ধারা।

“তো, ছবিটা যদি তোমাকে রাস্তা না দেখায় তাহলে অন্য কিছু খুঁজতে হবে, তাই না?”

“হ্যাঁ। কিন্তু সেটা কী?”,

“লম্বা একটা ফিরিস্তি হলেও তুমি চেষ্টা করে দেখতে পারো। কথা বলতে বলতে আমি গুগলে শুক্র সার্চ করেছি। কী পেয়েছি জানো?”

.

৫৮. শুরু হল রাধার অ্যাডভেঞ্চার

ইলেকট্রিক লাঠিটা হাতে নিয়ে মেঝে থেকে উঠে দাঁড়াল রাধা। ঠিক করল এটাকে সাথেই রাখবে। গার্ডের অ্যাকসেস কার্ডটাও কাজে লাগতে পারে ভেবে সেটাও ছিনিয়ে নিল। পকেটে দরকারি আর কিছু নেই।

সময় নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি টয়লেট থেকে বেরিয়ে এলো। গার্ডের চেতনা ফিরে এলেই জানা কথা যে এলার্ম বাজিয়ে সবাইকে সচকিত করে তুলবে আর মাথার উপর নরক ভেঙে পড়বে।

তখন যে কী হবে তা ভাবতেও ভয় হচ্ছে। আনন্দদায়ক যে হবে না সেটা নিশ্চিত। কিন্তু এরই মাঝে সীমা লঙ্ঘন করা হয়ে গেছে। তাই পেছনে তাকাবার কোনো উপায় নেই।

পরবর্তী গন্তব্য হচ্ছে লিফট। এই ফ্লোরে আর কিছু নেই। পুরো ফ্যাসিলিটির নার্ভ সেন্টার কিংবা প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে বেজমেন্ট।

আগেরবার সাক্সেনা যে তলায় নিয়ে গিয়েছিল সেখানে কোনো আই-টি রুম দেখেনি। তাহলে নিশ্চয় ফ্রিম্যানের প্রজেক্টের তলাগুলোর কোনোটাতে আছে।

কিন্তু হাসপাতালের গাউন পরে যততত্র ঘুরে বেড়ানো যাবে না। সাথে সাথে ধরা পড়ে যাবে। কিন্তু সমস্যা হল কখনো কাপড় বদলায়নি আর নিজের কাপড় কোথায় সেটাও জানে না। যদি আদৌ থেকে থাকে তো।

মিনিট খানেকের জন্য দাঁড়িয়ে সাজিয়ে নিল আরেকটা আইডিয়া। তেমন একটা ভরসাযোগ্য না হলেও হাতে আর কোনো অপশন নেই।

খুলে গেল লিফটের দরজা। দম বন্ধ করে ইলেকট্রিক লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল যেন কেউ বের হলেই তার উপর ব্যবহার করতে পারে।

কিন্তু নাহ, ভেতরে কেউ নেই। লাফ দিয়ে ঢুকেই আগেরবারের ফ্লোরের বোতাম টিপে দিল। গার্ডের অ্যাকসেস কার্ড ঢোকাতেই সচল হয়ে উঠল লিফট।

দ্রুত আর নিঃশব্দে কাঙিক্ষত ফ্লোরে পৌঁছে গেল লিফট। নীরবে খানিকটা খুলে গেল দরজা।

দুরু দুরু বুকে কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে রইল রাধা। নিজের পরিকল্পনায় অটল থাকতে চাইলেও যেন ভেতর থেকে চিৎকার করছে সমগ্র সত্তা, দরজাটা আবার বন্ধ করে নিজ সেলে ফিরে যেতে বলছে।

কিন্তু এখন আর ফেরার উপায় নেই। অনেক দূর চলে এসেছে। গার্ডের উপর আক্রমণের কথা চাপা থাকবে না। কিংবা এর পরিণাম থেকে পালাতেও পারবে না।

তাই গভীরভাবে নিশ্বাস নিয়ে লিফটের বাইরে পা ফেলল রাধা।

.

জাদুর জন্য অপেক্ষা…

ফোন কেটে দিল বিজয়। কলিনের কথায় অবশ্যই যুক্তি আছে। আর অন্য কোনো আইডিয়া মাথায়ও এল না। শুধু এটুকুই আশা যেন তাদের দু’বন্ধুর ধারণাই সঠিক হয়।

আগ্রহ নিয়ে বিজয়ের দিকে তাকাল ভ্যান কুক। “আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে।” কলিন কী কী বলেছে সব খুলে বলল বিজয়। “হয়ত আর একটুক্ষণ হলেই চলবে। সূর্য প্রায় ডুবে গেছে। এখন উত্তর-পশ্চিম দিকে তাকাতে হবে।”

ভ্যান ক্লকের চোখে সংশয় দেখা দিল, “তুমি নিশ্চিত যে এটা কাজ করবে? আমার কাছে তো সব আবোল-তাবোল মনে হচ্ছে।”

“খানিকক্ষণের মাঝেই যা দেখবে তারই মত দেবতাদের রহস্যের মাঝেও লুকিয়ে আছে বিজ্ঞান।” নির্দ্বিধায় বলে উঠল বিজয়।

দিগন্তের আড়ালে নেমে গেল সূর্য। অন্ধকারে ঢেকে গেল পুরো পর্বতমালা। সবাই মিলে সাগ্রহে অপেক্ষা করায় ভারী হয়ে উঠল এ নীরবতা।

বেশ কয়েক মিনিট পার হয়ে গেলেও কিছুই ঘটল না। দরদর করে ঘামছে বিজয়। আদৌ কি কিছু ঘটবে?

.

হাসপাতালে

হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে মুখ বিকৃতি করলেন ইমরান। ব্যথায় নয়; বরঞ্চ এটা ভাবতেই বিরক্ত লাগছে যে সবাই যখন রাধাকে খুঁজছে তিনি তখন বিছানায় শুয়ে আছেন। আর তাকে যারা মারার চেষ্টা করেছে তাদেরকেও তো খুঁজে বের করতে হবে।

গতকাল এসে এ পর্যন্ত যা যা হয়েছে তার সবকিছু জানিয়ে গেছে বিজয়। ছেলেটাকে দেখে ইমরানও খুশি হয়েছেন।

“আমরা তো আরো ধরেই নিয়েছিলাম যে আপনি মারা যাচ্ছেন। তারপর বিজয় বলেছে, “ঈশ্বরকে অসংখ্য ধন্যবাদ যে কিছু হয়নি।”

“এই আর কি।” দুর্বলভাবে হেসেছেন ইমরান। এ্যাপনেল তার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ আর ধমনিগুলোকে মিস করে যাওয়ায় এই যাত্রায় টিকে গেছেন। জানালার কাঁচ ভাঙ্গার সাথে সাথে তৎক্ষণাৎ পাশের রুমে ঝাঁপিয়ে পড়ার বুদ্ধিটা মাথায় আসাতে বেঁচে গেছে জীবন। প্রচুর রক্তক্ষরণের কারণে দুর্বল হয়ে পড়লেও লড়াই করার জন্য এখনো অটুট আছেন। সত্যিই তাই; তিক্ত হল ইমরানের চেহারা।

এরপর রাধার কথা শুনে তো চমকে গেছেন। আরো অবাক হয়েছেন এই শুনে অপহরণের পর দু’দিন পার হয়ে গেলেও মেয়েটার কোনো খবরই বের করা যাচ্ছে না। ঠিক যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।

বিজয় চলে যাবার সাথে সাথে তাই বৈদ্যকে ফোন করে রাধার খোঁজে নামার অনুমতি চেয়েছেন ইমরান। এও জানিয়েছেন যে হাসপাতালের রুমে শুয়েই টাস্ক ফোর্সের কাজ করবেন।

বাধ্য হয়েই রাজি হয়েছেন বৈদ্য; জানেন যে ইমরানের সাথে তর্ক করে কোনো লাভ হবে না। তাছাড়া এটাও ঠিক যে ফিল্ডে যেতে না পারলে কি হয়েছে; রুমে থেকেই সবকিছু তদারকি করতে পারবেন ইমরান। কেননা তিনিই তো টাস্ক ফোর্সের ভারত প্রধান।

ফলে ইমরানের রুম এখন একটা ছোটখাটো আইটি সেন্টারে পরিণত হয়েছে। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে একগাদা তার, যন্ত্রপাতি, রাউটার আর সার্ভার। বিভিন্ন এঙ্গেলে স্থাপন করা হয়েছে তিনটা ফ্ল্যাট স্ক্রিন মনিটর। বিভিন্ন লোকেশনে যেসব টিম কাজ করছে তাদের সার্বক্ষণিক সচল চিত্র প্রচার করছে এসব মনিটর। একটা মনিটর আবার সরাসরি প্যাটারসনের সাথে সংযুক্ত।

সারা দিন বিভিন্ন দলের সাথে আলোচনা করেন ইমরান; তাদের প্রধান খবর বিশ্লেষণ করে বুঝতে চেষ্টা করেন যে কী ঘটছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই তেমন অগ্রগতি হচ্ছে না।

কিছুই না।

যেন রাধার অস্তিত্বই বিলীন হয়ে গেছে।

.

৫৯. সাহায্যের হাত

দিনের শুরুতেই সাক্সেনা যেখানে নিয়ে এসেছিলেন ধীরে ধীরে সেদিকে এগিয়ে এল রাধা। যতটা সম্ভব নিঃশব্দে চলাফেরার চেষ্টা করছে। এতক্ষণ পর্যন্ত ভাগ্য যথেষ্টই সহায়তা করেছে। আগের বারের মতই করিডোরের দু’পাশের বেশির ভাগ দরজাই বন্ধ। আর কয়েকটা খোলা থাকলেও ভেতরে ল্যাবরেটরি কোট পরিহিত কর্মীরা এতটা ব্যস্ত যে করিডোরে কী হচ্ছে তাতে কারো কোনো খেয়ালই নেই।

রাধা লক্ষ করে দেখল যে কোথাও কোনো মেয়ে নেই। শুধু পুরুষ। বিস্মিত হয়ে ভাবল এর কারণ কী। যাই হোক এখন সেসব নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলবে। এমনিতেই পাকস্থলীর মাঝে গুলিয়ে উঠছে ভয়। মনে হচ্ছে ক্রমেই এগিয়ে এসে ওর চেতনা গ্রাস করে নেবে।

বিভিন্ন সময়ে আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে খুব কাছ থেকে সাক্সেনাকে পর্যবেক্ষণ করেছে রাধা। উপসংহারে পৌঁছেছে যে লোকটা দুর্বলদেরকে ভয় দেখিয়ে কাজ করতে বাধ্য করেন। আর তাই অন্যদের উপর প্রভাব খাটাতে পারলেই স্বস্তি বোধ করেন। আশেপাশের মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করা, তারা কখন খুশি হবে আর কখনই বা দুঃখ পাবে তা নির্ণয় করার মাধ্যমে সঞ্চয় করেন নিজের আত্মবিশ্বাস। তাই রাধা আশা করছে নিজ অন্তরে লোকটা হবেন পুরোপুরি একটা কাপুরুষ আর ভীতুর ডিম। কেননা স্পষ্টভাবেই বোঝা যায় যে সাক্সেনার এরকম আচরণের পিছনে আছে তার অভ্যন্তরের অনিরাপত্তা বোধ আর বিভিন্ন ধরনের মনোবিকৃতি। নিজের চেয়ে ক্ষমতাবান কারো সামনে পড়লে কুঞ্চিত হয়ে আত্মসমর্পণ করবে আর তখনই হবে রাধার জিত।

কিন্তু যদি ওর ধারণা সঠিক না হয় তো…

সাক্সেনাকে অফিসেই পাওয়া যাবে ভেবে এগিয়ে চলল রাধা।

স্বস্তি পেল দেখে যে কম্পিউটার মনিটরের সামনে বসে নোটবুকে হিজিবিজি কীসব লিখছেন সাক্সেনা।

সন্দেহের দোলাচলে দুলে উঠল রাধার মন। কিন্তু এসে যখন পড়েছে ঢুকতেই হবে। ফেরার আসলেই কোনো পথ নেই। সময়ও দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে। সিসিটিভি ক্যামেরাতে নিশ্চয়ই ওর প্রতিটা গতিবিধি ভিডিও হয়ে গেছে। কেউ না কেউ দেখেই ফেলবে যে এখানে এসেছে। তাই যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে।

চট করে রুমে ঢুকেই দরজা আটকে দিল রাধা। ভেতর থেকে বন্ধ করে দিতেই অবাক হয়ে তাকালেন সাক্সেনা।

বিস্ময় কেটে গিয়ে প্রথমে চমকে উঠলেও তারপর কী ঘটছে বুঝতে পেরেই রেগে উঠলেন ডাক্তার।

“চুপ।” সাক্সেনা কিছু বলার আগেই ডেস্কের উপর ইলেকট্রিক লাঠি দিয়ে বাড়ি দিল রাধা।

লাঠিটাকে ঠিকই চিনতে পারলেন ভাইরাসবিদ। কেঁপে উঠে তৎক্ষণাৎ পিছিয়ে গেলেন। হেসে ফেলল রাধা। যা ভেবেছিল লোকটা ঠিক তাই। এতদিন সবার উপরে চোটপাট করলেও এখন ভয়ে আধমরা হয়ে যাচ্ছেন।

“তুমি জানো যে এটা দিয়ে পার পেতে পারবে না?” রাধাকে সাবধান করে দিলেও কথা বলার সময় নার্ভাস ভঙ্গিতে লাঠি আর মেয়েটার উপর চোখ বোলাচ্ছেন সাক্সেনা, “একটু পরেই সিকিউরিটি এসে তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে।”

“ততক্ষণে আমার কাজ সারা হয়ে যাবে।” পাল্টা উত্তর দিল রাধা, “ইন্টারনেট ব্রাউজার ওপেন করুন।” কথা বলার সময় তীব্র বেগে ঘোরাল হাতের লাঠি।

“এত বড় সাহস!” একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন সাক্সেনা। “চেষ্টা করে দেখুন কিছু করতে পারেন কিনা।” রাধা জানে তার পালানোর সম্ভাবনা অতি নগণ্য। আর সাক্সেনা প্রতিশোধ নিতেও পিছ পা হবেন না। কিন্তু বাইরের দুনিয়াকে এই ফ্যাসিলিটির খবর জানাতেই হবে। তার ভাগ্যে যাই থাকুক না কেন। তাই বাইরে মেসেজ পাঠাবার এটাই একমাত্র সুযোগ। নতুবা আর কোনো সম্ভাবনা নেই।

মেয়েটার চেহারায় দৃঢ় সংকল্পের ছাপ দেখতে পেলেন সাক্সেনা। তার নিজেরও কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। এতদিন তার হাতেই ছিল সব ক্ষমতা। শাস্তি কিংবা পুরস্কার যাই হোক না কেন, সিদ্ধান্ত নিতেন তিনি। তাই বলতে বাধা নেই যে কাজটা তিনি অত্যন্ত উপভোগ করেন। তবে এবারে পাল্টে গেছে খুঁটির চাল। যার একফোঁটাও সহ্য হচ্ছে না। কেমন যেন বমি বমি লাগছে। শীত করছে। মনে পড়ে গেল বিদ্যালয়ের দিনগুলোর কথা-সিগারেট হাতে বয়েজ রুমে ধরা পড়েছিলেন। সেই অপরাধের শাস্তি স্মৃতিতে এখনো জ্বলজ্বল করে। এই ঘটনার পর থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তিনিই হবেন সর্বেসবা। যেন অন্যদেরকে শাস্তি দিতে পারেন।

অথচ আজ, এত বছর পরে আবার ফিরে গেছেন বয়েজরুমে। লাঠি হাতে সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা মেয়ে। তাকে আঘাত আর অপদস্থ করার সমস্ত ক্ষমতা এখন ওর হাতে।

বহু বছর পরে তীব্র ভয়ের স্বাদ পেলেন সাক্সেনা। কিন্তু পুরোটাই একতরফা। এছাড়া মানসিক আর শারীরিক আরেকবার আঘাত পাবার কথা চিন্তাই করতে পারেন না। “ফাইন। আমি সহযোগিতা করব। কিন্তু তুমি তো এখান থেকে বাইরে ই-মেইল পাঠাতে পারবে না। এটা একটা সিকিউর ফ্যাসিলিটি। কোথাও কোনো ধরনের মেইল কিংবা ফোন করা যায় না। আমাদেরকে উপরে যেতে হবে। গ্রাউন্ড ফ্লোরে।”

“ফাইন। তাহলে চলুন।” দরজার দিকে ইঙ্গিত করল রাধা।

দুজনে একসাথেই অফিস থেকে বের হল। রাধা সাক্সেনার কাছাকাছিই রইল। যেন প্রয়োজনের মুহূর্তে ইলেকট্রিক লাঠিটাকে ব্যবহার করতে পারে।

কিন্তু অবাক হয়ে দেখল যে ও নিজে যেদিক দিয়ে এসেছে সেই বামদিকের লিফটের পরিবর্তে সাক্সেনা ডান দিকে মোড় নিলেন-করিভোরের একেবারে শেষ মাথার বিশাল সাদা দরজাটার দিকে। রাধা ভেবেছিল হয়ত অন্য কোন সিঁড়ি; কিন্তু ওর ধারণা ভুল।

সাক্সেনা নিজের অ্যাকসেস কার্ড ব্যবহার করতেই দরজা খুলে উনোচিত হল আরেকটা লিফটের ল্যান্ডিং। রাধা যতটা ভেবেছিল এই ফ্যাসিলিটি তার চেয়েও কয়েক গুণ বিশাল। কিন্তু কেন যেন তেমন বিস্মিত হল না; ডানে যে কাজ হচ্ছে তাতে এরকমটাই লাগার কথা।

তারা এলিভেটরে চড়ে বসতেই সাক্সেনা নিজের কার্ড অ্যাকসেস করে গ্রাউন্ড ফ্লোর বেছে নিলেন। উঠতে শুরু করল এলিভেটর।

এবার রাধা উপলব্ধি করল যে এই লিফটে আগে থেকেই পেশেন্টদের আটটা ফ্লোর প্রোগ্রাম করা আছে। তার মানে ল্যাবের কর্মীরা ওসব ফ্লোরে যেতে পারে না।

থেমে গেল এলিভেটর। দরজা খুলতেই দেখা গেল ডান-বাম উভয় দিকেই কেবল সারি-সারি দরজা। সাক্সেনা ডান দিকে মোড় নিতেই পিছু নিল রাধা।

“ওই দরজাগুলোর পেছনে কী আছে?” পেছনের দিকে ইশারা করে জানতে চাইল রাধা।

“রিসেপশন আর মেইন ক্লিনিকের দরজা।” মুখ গোমড়া করে উত্তর দিলেন সাক্সেনা। চিন্তিত ভঙ্গিতে রাধার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমাকে ভয় দেখিয়ে মেসেজ পাঠানো সম্পর্কে এখনো চাইলে নিজের মত বদলাতে পারো।” ইলেকট্রিকের লাঠির প্রতি ইশারা করে বললেন, “আর অ্যাকসেস কার্ড ব্যবহার করে বরঞ্চ ওই দরজা দিয়ে পালিয়ে যাওয়া সহজ হবে।”

ক্রোধে জ্বলে উঠল রাধা। বুঝতে পারল সাক্সেনা ব্যঙ্গ করছেন। স্বাধীনতার একেবারে কাছাকাছি চলে এসেছে। বাইরের মুক্ত দুনিয়া আর তার মাঝে আছে কেবল এক সারি দরজা। কিন্তু একই সাথে এটাও জানে যে পালিয়ে যাবার কোনো উপায় নেই। এতক্ষণে নিশ্চয় সবাই সর্তক হয়ে গেছে আর সিসিটিভি মনিটরে বসে দেখছে ওর গতিবিধি।

আজ আর হাতে কোনো অপশন নেই। তাই নিজের ভাগ্যের কথা ছেড়ে আরো বড় কিছু ভাবার কথা ঠিক করল। মানুষের জীবনকালই যদি অর্ডারের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে; তাহলে ওদের হাতে এসে যাবে সর্বময় ক্ষমতা। পৃথিবী পরিণত হবে অর্ডারের ভূতত্য। না জেনে এমনটা করলেও রাধা এটা হতে দিতে পারে না। আর দেবেও না।

তার চেয়ে ভালো নিজের পরিকল্পনা মত কাজ করা। প্রায় পৌঁছে গেছে বলা যায়।

“সামনে হাঁটুন।” উত্তরের পরিবর্তে সাক্সেনাকে আদেশ দিল রাধা।

একটা অফিসে ঢুকে ডেস্কের উপর রাখা ল্যাপটপে ওয়েব ব্রাউজার ওপেন করে দিলেন সাক্সেনা। পর্দায় ব্রাউজার দেখা দিতেই বললেন, “গো এহেড।”

চারপাশে তাকাল রাধা। মেইল-টাইপ করার সময় চায় না যে সাক্সেনা পাশে থাকুক। ইলেকট্রিক লাঠিটাকে নামিয়ে রাখতে হবে আর তাহলেই ধরা পড়ার সম্ভানা আছে। কিন্তু রুমে এমন কিছু দেখা যাচ্ছে না যা ওর কাজে লাগতে পারে।

তাই দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হল। “এখানে বসুন” ডেস্কের চেয়ার দেখিয়ে দিল রাধা। শান্তভাবে চেয়ারে বসে পড়লেন সাক্সেনা। তাকিয়ে দেখলেন পাওয়ার কেবল থেকে ল্যাপটপের প্লাগ খুলে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে রাধা। বুঝতে পারলেন ও কী করবে।

“যাবার আগে শুনে যাও” পেছন থেকে বললেন সাক্সেনা, “যখন এসব শেষ করে তুমি তোমার সেলে ফিরবে তখন আমি ব্যক্তিগতভাবে বাকি জীবন তোমার যাতনাভোগ নিশ্চিত করব। এটা আমার প্রতিজ্ঞা হিসেবে ধরে নাও।”

মনে মনে অসম্ভব ভয় পেয়ে গেল রাধা। জানে সাক্সেনা নিজের প্রতিজ্ঞা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে। কিন্তু পরিকল্পনা করার সময়েই নিজের ভাগ্যের ব্যাপারে দুশ্চিন্তা করা ছেড়ে দিয়েছে। তাই যা খুশি হোক, কোনো পরোয়া নেই।

রুম থেকে বেরিয়ে বাইরে থেকে হুড়কো টেনে দিয়ে দ্রুত নিজের ই মেইল অ্যাকাউন্ট ওপেন করল। সেল থেকে রাধার পালিয়ে আসা, এতক্ষণ কারো নজরে না পড়লেও এখন নিশ্চয় ভেতর থেকেই অ্যালার্ম বাজিয়ে দেবেন সাক্সেনা। তাই নিজের কাজ সমাধা করতে হয়ত হাতে কেবল কয়েক মিনিট সময় পাবে।

যত জনের কাছে সম্ভব মেসেজ পাঠানোর জন্য দ্রুত হাতে টাইপ করল রাধা। ওরা কখন দেখবে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। আশা শুধু এতটুকুই যেন দেরি না হয়ে শীঘি হয়।

সেন্ট বাটনে চাপ দেবার পর ফিরতি কনফার্মেশন মেসেজও পেয়ে গেল। ল্যাপটপ নিচে নামিয়ে দরজার গায়ে ধপ করে বসে পড়ল। সাথে সাথে ঝাঁপিয়ে পড়ল এতক্ষণের আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠা।

নিজের সাথে বলতে গেলে যুদ্ধ করেই কোনোরকম আবার উঠে দাঁড়াল। সিকিউরিটি গার্ডদের এখনো কোনো পাত্তা নেই। হয়ত হাতে তাহলে আরো সময় পাওয়া যাবে।

সাদা দরজাগুলোর দিকে হাঁটতে শুরু করল, যেগুলোর পেছনে সাক্সেনার কথা মত লুকিয়ে আছে ওর মুক্তি।

এতক্ষণ তো সবকিছু ভালোই এগোল। তার মাত্র কয়েক ফুট।

ঠিক তখনি সত্য হল রাধার দুঃস্বপ্ন। স্বাধীনতার দরজা হঠাৎ করেই নরকের দরজায় পরিণত হল। ঝট করে দরজা খুলেই হাতের অস্ত্র নাড়তে নাড়তে ওর দিকে ধেয়ে আসছে তিনজন সশস্ত্র গার্ড।

রাধা উপলব্ধি করল যে ওর খেলা শেষ। বাইরের দুনিয়া আর দেখা হল না।

.

৬০. পথ দেখিয়ে দিল শুক্র

স্থির দৃষ্টিতে উত্তর-পশ্চিম আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে বিজয়। মনে মনে চাইছে যেন কলিনের কথা মতই সবকিছু ঘটে।

পেছনে দাঁড়িয়ে অধৈর্য হয়ে শব্দ করছে ভ্যান ক্লক। নির্বিকার চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কুপার। এ ব্যাপারে ইতোমধ্যে নিজের শঙ্কাও প্রকাশ করেছে।

সূর্যের শেষ রশ্মিটুকুও মুছে দিয়ে শুরু হল অন্ধকারের রাজত্ব।

“জানো” ভ্যান ক্লক কিছু বলতে শুরু করলেও হঠাৎ যেন জমে গেল।

বিজয় নিজেও দেখতে পেয়েছে। শুরু হয়েছে।

“ভালো ভাবে লক্ষ্য করো।” অন্যদেরকে উত্তেজিত ভঙ্গিতে নির্দেশ দিয়ে বলল, “কোথায় দেখা যাবে তার একেবারে সঠিক নোট রাখা চাই।” চট করে একবার পেছনে তাকিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিল যে ছোট্ট চোরাকুঠুরির পাথরের চিত্রের সামনে কেউ দাঁড়িয়ে নেই।

চোখের সামনে রাতের আকাশ চিরে ফুটে উঠল উজ্জ্বল আলোর একটা বিন্দু। অন্যান্য তারার চেয়েও এত দ্বীপ্তিময় যে এর আলোয় ফিকে হয়ে পড়েছে।

বাকিদের আলো।

দিনের আলোর মাঝে বন্দী হয়ে থাকা শুক্রের আভা মুক্তি পাবার সাথে সাথে আলোকিত করে তুলল চোরা কুঠুরির পাথরের গায়ে খোদাইকৃত পাঁচ মাথাঅলা তারা।

“এই তো, পেয়ে গেছি!” তীক্ষ্ণস্বরে চেঁচিয়ে উঠল বিজয়, “এটাই শুক্র। পশ্চিম দুনিয়ার কাছে পরিচিত ভেনাস গ্রহ। আর এর ঠিক নিচেই পর্বতের মাথায় খুঁজে পাবো শিবের লাঠি! এখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়।”

এবারে বুঝতে পারল চোরা কুঠুরির উপরকার ফাটলের উদ্দেশ্য। এটা আসলে আলো প্রবেশ করার জন্য দেওয়ালে বসানো জানালা। যেন গ্রহের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠে চোরা কুঠুরির গায়ে খোদাইকৃত তারা।

সবাই নিঃশব্দে উঠতে শুরু করল বিজয়ের নির্দেশিত জায়গায়। দ্বিতীয়বারের মত চোরাকুঠুরির দিকে তাকাল কুপার; যেন যা দেখছে তা কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না।

এখন বোঝা গেল আলেকজান্ডার কেন রাতে এসেছিলেন; আপন মনেই ভাবল বিজয়। শুধু যে সৈন্যদের কাছ থেকে নিজের মিশন গোপন করতে চেয়েছেন তা নয়; বরঞ্চ শিবের লাঠির অবস্থান জানার জন্য শুক্র গ্রহের আলো প্রয়োজন ছিল।

শক্তিশালী সার্চ লাইটের আলোয় প্রাকৃতিক একটা পথ ধরে গন্তব্যের দিকে এগোল সবাই। যত কাছে যাচ্ছে, কী পাবে ভেবে তত অবাক হচ্ছে বিজয়।

.

পারবে রাধা?

করিডোর ধরে ধেয়ে আসছে তিনজন গার্ড। হঠাৎ করেই একেবারে সামনের লোকটা ঘ্যাৎ করে থেমে নিশানা করে রাধার দিকে ছুঁড়ে মারল এক ঝাঁক বুলেট।

বুকের উপর যেন ডিনামাইট বিস্ফোরিত হল। এমনভাবে কেঁপে উঠল রাধা। মনে হল অন্তত পাঁচ ফুট দূরে ছিটকে পড়ল। শরীরের নিচ থেকে যেন হারিয়ে গেল পা। ধপ করে মেঝেতে বসে পড়তেই স্লো মোশনে ঘুরতে লাগল চারপাশের সবকিছু। সমস্ত ইন্দ্রিয় যেন দ্রুত সচল হয়ে উঠল। ঠিক যেন কোনো উচ্চ গতিসম্পন্ন ক্যামেরা স্লো মোশনে কাজ করছে। মেঝেতে শুয়ে পড়তেই সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ল প্যারেসথিসিয়া। ডান দিকের ফুসফুস সংকুচিত হয়ে শুরু হল নিঃশ্বাসের যন্ত্রণা। প্রতিবার নিঃশ্বাসের সময় মনে হল কেউ যেন ডান দিকের ফুসফুসে চাকু চালাচ্ছে। তীব্র ব্যথার মাঝেও টের পেল আরেকটা অনুভূতি বুলেটের ক্ষত থেকে ঝরে পড়ছে উষ্ণ রক্ত। হাসপাতাল গাউন ভিজে শরীরের সাথে আটকে গেল। মনে মনে কিছু একটা ভাবতে চাইলেও নিঃসাড় দেহে কোনো চিন্তাই এলো না মাথায়। গুলি বর্ষণ থামিয়ে চারপাশে কারা যেন চিৎকার করছে। অস্পষ্টভাবে কানে এলো সাক্সেনার কণ্ঠস্বর। শব্দগুলোও এলোমেলো। সাদায় ঢেকে গেছে চারপাশ। হাইপো ভোলেমিক শক্ পাওয়ায় ঝাপসা হতে শুরু করেছে দৃষ্টিশক্তি। তারপরই সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *