৫. চতুর্থ দিন

৪১. চতুর্থ দিন

খানিকটা আশা

কলিন স্টাডিতে ঢুকে দেখে ডেস্কে হাতের উপর মাথা রেখে অঘোরে ঘুমাচ্ছে বিজয়। সর্বত্র ছড়িয়ে আছে প্রিন্ট আউটের কাগজ। বিজয়ের নোটবুকও খোলা। তার উপরে কলম। সারা রাত যে বিজয় কত ব্যস্ত ছিল তা পরিষ্কার ভাবেই বোঝা যাচ্ছে। শুধু চিন্তা এটাই যে ওর বন্ধু কী করছিল আর এমন কিছু কি খুঁজে পেয়েছে যাতে উপকার হবে?

বিজয়ের কাছে হেঁটে গিয়ে আস্তে করে নাড়া দিল কলিন, “হেই, দোস্ত, উঠো।”

ডেস্ক থেকে মাথা তুলে ঝাপসা চোখে কলিনের দিকে তাকাল বিজয়, “ঘুমিয়ে পড়েছিলাম” বিড়বিড় করে বলে উঠল।

“কোনো সমস্যা নেই। দেখো নিজে কী হাল করেছ। যাও নিচে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো।”

বিজয় মাথা নাড়লেও এখনো ঘুমের রেশ কাটেনি। আর তারপরই কী যেন একটা মনে পড়তেই একেবারে সিধে হয়ে বসল।

“একটা জিনিস পেয়েছি” কলিনকে জানাল, “চলো নাশতা করার সময়ে তোমাদেরকে জানাব।”

রাতে কী খুঁজে পেয়েছে না জানিয়ে বিস্মিত কলিনকে রেখে তাড়াহুড়া করে স্টাডি থেকে বেরিয়ে গেল বিজয়।

এক ঘণ্টা পরেই আবার স্টাডিতে এসে মিলিত হল সবাই। ডেস্কে বসে কাগজপত্র গুছিয়ে তূপ করে রাখল বিজয়।

এদিকে কৌতূহল আর এক রাশ প্রত্যাশা নিয়ে স্থির দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে তিন জোড়া চোখ।

“দ্য গ্রেট আলেকজান্ডারের উপর আমি বেশ খানিকটা গবেষণা করেছি” শুরু করল বিজয়, “মাইকেল উডের বিবিসি ডকুমেন্টারি ডাউনলোড করে সেটাও দেখেছি, পুরো চার ঘণ্টা। উনার সম্পর্কে লেখা বিভিন্ন বইয়ের অংশ পড়েছি। তোমরা বিশ্বাসই করতে পারবে না যে কতজন উনার সম্পর্কে লিখে গেছেন। মেসিডোনিয়া থেকে ভারতে আসার জন্য যে রাস্তা অনুসরণ করেছিলেন। তাও পড়েছি। পথিমধ্যে কাদের সাথে যুদ্ধ করেছেন, বিভিন্ন শহরে কী কী করেছেন সেসব গল্প পড়েছি। তাই অনেক কিছুই জানতে পেরেছি। যেমন উনি ছিলেন ভয়ানক জেদি। একগুয়েমির জন্য কোনো কিছুই তাঁকে রুখতে পারত না। আর ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

“শুনে মনে হচ্ছে অনেকটা তোমার মত”, দাঁত বের করে হেসে ফেলল কলিন, “নিজেকে বর্ণনা করতে হলেও এসবই বলতে হবে তোমাকে।”

বিজয় কুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালেও কোনো উত্তর দিল না।

এলিস কিছু না বললেও মনে মনে সেও একই কথাই ভাবছে। বিজয়ের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মনোভাব, অধ্যবসায় আর সবকিছুকে একবাক্যে বিশ্বাস না করার প্রবণতা ওকে অনেক ক্ষেত্রেই সফল হতে সাহায্য করেছে। এলিস নিজেও এ কারণেই ছেলেটার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। এমন এক পুরুষ যে নিজের সম্পর্কে জানে। আর তাকে অনুসরণ করতে ভয় পায় না। কিন্তু একই সাথে ওদের ব্রেক আপের কারণও এটাই।

“যেটা মনে হয়েছে তা হল প্রতি পদক্ষেপে আলেকজান্ডাকে কিছু একটা প্রেরণা জুগিয়ে ছিল যখন মেসিডোনিয়া ছেড়েছেন এটা ছিল পোথোস আকাঙ্ক্ষা, বহুদিনের অপেক্ষা-পারসীয়দের হাতে গ্রিকদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়া। তাই তিনি পারস্যের অগ্রযাত্রা আর তারপর দারিয়ুসকে পরাজিত করলেন। শুধু তাই না, দারিয়ুস যখন তার নিজের সভাসদদের হাতে প্রাণ হারায় তখন আলেকজান্ডার তাদের পিছু ধাওয়া করে পার্বত্য অঞ্চল পর্যন্ত চলে যান। তারপর সবাইকে ধরে হত্যা করেন। এবার তিনি হন পারস্যের শাসনকর্তা; কিন্তু সেখানেই থেমে থাকেন নি। আরেক আকাঙ্ক্ষার বশবর্তী হয়ে পূর্বদিকে গমন করেছেন। আমি যতগুলো লেখা পড়েছি সে সমস্ত লেখকেরা এ মনোবাসনাকে সারা দুনিয়া জয় করে একেবারে শেষ প্রান্ত পর্যন্ত যাবার উচ্চাকাঙ্ক্ষা হিসেবেই বর্ণনা করেছেন। এরই মাঝে এরিস্টোটলের কাছ থেকে আলেকজান্ডার জেনে গেছেন যে ইন্দুসেই আছে এক বিশাল মহাসমুদ্র আর পৃথিবীর শেষ প্রান্ত।”

কিছুক্ষণ থেমে এলিসের দিকে তাকাতেই মাথা নেড়ে সায় দিল মেয়েটা, “বলে যাও, চমৎকার হচ্ছে।”

“তারপর এখানে এসেই সবকিছু রহস্যময় হয়ে উঠেছে।” সমর্থন পেয়ে আবার শুরু করল বিজয়, “প্রথমত, গ্রিস ত্যাগ করার সময় আলেকজান্ডার তার সেনাবাহিনিকে কখনোই বলেন নি যে তারা পথিবীর শেষ মাথা পর্যন্ত যাবে। শুধু পারস্য জয়ের পরেই জানান যে এবার পূর্বদিকে যাবেন। তবে হ্যাঁ এর যৌক্তিক ব্যাখ্যাও আছে। সৈন্যদেরকে জানালে হয়ত নিজ দেশ থেকে এতদূরে যেতে তারা রাজি হত না। কিন্তু কেন যেন আমার একটু খটকা লাগছে। নেতা হিসেবেই আলেকজান্ডার ছিলেন অসাধারণ। নিজ বাহিনিকে নেতৃত্ব দিয়ে বিশ হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে মেসিডোনিয়া থেকে গ্রিস এসেছেন তারপর আবার ব্যাবিলনে ফিরে গেছেন। সকলে মিলে হাঁড় কাঁপানো ঠাণ্ডায় পার্বত্য অঞ্চল, উত্তপ্ত মরুভূমি পার হয়েছেন। কখনো কখনো খাবার আর পানিও ছিল না। বিনা বাক্য ব্যয়ে সৈন্যরা সর্বত্র আলেকজান্ডারকে অনুসরণ করেছে। কেবল মাত্র পাঞ্জাবের বীজ (Beas) নদী পর্যন্ত গিয়ে আলেকজান্ডারকে দেশে ফেরার আকুতি জানিয়ে আর না এগোনোর বায়না ধরে। তার মানে আলেকজান্ডার যদি চাইতেন তাহলে এ সৈন্যরা হয়ত পৃথিবীর একেবারে গভীর পর্যন্ত চলে যেত।”

চারপাশে তাকিয়ে বাকিদের অবস্থা দেখে নিল বিজয়। তারাও তার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে সন্তুষ্ট হয়ে আবার শুরু করল, “তবে লেখকদের কাছ থেকে এ সম্পর্কে ভিন্ন মত পাওয়া গেছে। কারণ তাদের কাছে সিক্রেট জার্নাল কিংবা কিউবটা ছিল না। তারা এটাও জানত না যে আলেকজান্ডার এক গোপন অনুসন্ধানে লিপ্ত হয়েছিলেন; যে সম্পর্কে কেবল তিনি আর তার মা জানতেন। কিন্তু আমাদের ধারণা যা ঘটেছে তার পিছনে যৌক্তিক ব্যাখ্যা আছে।”

“বুঝতে পেরেছি তুমি কী বলতে চাইছ” বলে উঠল এলিস, “অলিম্পিয়াস আলেকজান্ডারকে কিউব আর পার্চমেন্ট দিয়েছেন। তার মানে হয়ত এ অভিযান গোপন রাখার কথাও বলেছেন। সারা দুনিয়া জয় করে পৃথিবীর শেষ মাথা অব্দি যাওয়ার পেছনে এটাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু মেসিডোনিয়া ত্যাগ করার সময়ে সেনাবাহিনিকে কেবল পারস্যে আক্রমণের কথাই বলেছেন। ইন্দুস উপত্যকার কথা নয়। এমন না যে সৈন্যদের অপারগতার কথা ভেবে ভয় পেয়েছেন; চেয়েছেন যেন তারা “দেবতাদের রহস্য সম্পর্কে না জানে। আর যদি আমার ধারণা সঠিক হয় তাহলে তুমিও ভাবছ যে বীজ নদী তীরে বিদ্রোহের মাধ্যমে আলেকজান্ডারের মিশন সফল হবার ঘটনা আর দেশে ফেরার বাসনাকে ঢেকে দেয়া হয়েছে।”

“ঠিক তাই।” উজ্জ্বল হয়ে উঠল বিজয়ের চেহারা। “যা খুঁজছিলেন তা পেয়ে যাওয়ায় বীজের কাছাকাছি নির্মিত বেদির নিচে ধাতব পাতটাকে সমাধিস্থ করে গেছেন। মনে নেই, ইউমিনেস লিখেছেন যে পাঁচ মাথাঅলা সাপের গুহায় ঢোকার পর থেকে আলেকজান্ডার দেবতা হয়ে গেছেন? আর এটাও জানি যে ব্যাকট্রিয়ার উপজাতিদেরকে হারানোর পর থেকেই আলেকজান্ডার নিজেকে দেবতা হিসেবে দাবি করা শুরু করেছেন-এই কারণে ক্যালিসথিনসকে জীবনও দিতে হল।”

“তুমি তাহলে বলতে চাচ্ছো যে”, ধীরে ধীরে বলে উঠল কলিন, ‘অলিম্পয়াস যে পার্চমেন্টটা দিয়েছিলেন তার সাথে আলেকজান্ডার পারস্য থেকে ভারতে আসার জন্য যে পথ অনুসরণ করেছেন সেটাও জড়িত। তাই তুমি এই রাস্তাটাই খুঁজছিলে।”

‘বিঙ্গো!” উত্তেজনায় চকচক করছে বিজয়ের চেহারা। এটা ওর নিজের যুক্তি। দেখে ভাল লাগছে যে বাকিরাও তাকে অনুসরণ করছে। নিজের অনুমানের বৈধতাও প্রতিষ্ঠিত হল। এর মধ্যেই পরবর্তী পদক্ষেপও ঠিক করে ফেলেছে। নির্ভর করছে কেবল এই আলোচনার শেষাংশের উপর।

“তো, তুমি কী খুঁজে পেলে?” জানতে চাইল কলিন।

.

৪২. বন্দী

ঘুম ভাঙ্গতেই চমকে গেল রাধা। কয়েক মুহূর্ত লাগল ধাতস্থ হতে। চারপাশের একেবারে শ্বেতশুভ্র এই পরিবেশ ওর কাছে পুরোপুরি অপরিচিত।

তারপরেই মনে পড়ল সবকিছু। এয়ারপোর্ট এক্সপ্রেস। পিস্তল হাতে একটা লোক। চেতনা হারালো। হাসপাতাল গাউন। হাতের বাঁধন। অস্বস্তিকর এক ধরনের উপলব্ধির সাথে সাথে ক্রোধে ফেটে পড়া। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও তারপরে আর কিছু মনে করতে পারছে না। কী হয়েছিল? এবার বুঝতে পারল যে আগেরবার যেখানে ঘুম ভেঙেছিল তার চেয়ে ওকে ছোট আরেকটা রুমে নিয়ে আসা হয়েছে।

নিচে তাকাল। পরনে এখনো গাউন। কিন্তু বাঁধনগুলো আর নেই। কতক্ষণ ধরে এভাবে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে?

অত্যন্ত সতর্কভাবে বিছানার উপর উঠে বসে পাশ দিয়ে পা ঝুলিয়ে দিল। বেশ দুর্বল লাগছে। অবসন্ন; যেন কঠিন কোনো শারীরিক পরিশ্রমে সব শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে।

হঠাৎ করেই বুঝতে পারল যে কব্জি আর গোড়ালিতে অসম্ভব ব্যথা করছে। একে একে পরীক্ষা করতে গিয়ে মাংস কেটে বসে যাওয়া নাইলনের দড়ির ক্ষতচিহ্ন দেখে অবাক হয়ে গেল।

বিছানা থেকে নামতেই খালি পায়ে সাদা মার্বেলের মেঝে বেশ ঠাণ্ডা মনে হল। রুমে কোনো স্লিপারও নেই। দেয়ালগুলো একেবারে ইস্পাত কঠিন শক্ত। কাঁচের দরজা থাকলেও তালা লাগানো। হ্যাঁন্ডেল ধরে কয়েকবার ঝাঁকুনি দিয়ে চেষ্টা করলেও কোনো লাভ হল না। দরজাটা কেবল বাইরে থেকেই খোলা যায়। মানুষ চাইলে ভেতরে আসতে পারবে; কিন্তু ও বাইরে যেতে পারবে না। দরজার পাশের সেন্সরকে সক্রিয় করে তোলার অ্যাকসেস কার্ড ছাড়া তো নয়ই। তার মানে ও এখন সত্যিকারের বন্দী।

হাতল থেকে হাত সরাতেই হঠাৎ করে একপাশে সরে গেল দরজা। বাইরের দিকে খুলে গেল। সভয়ে পিছিয়ে এলো রাধা। রুমে ঢুকলেন সাক্সেনা আর ফ্রিম্যান।

“আজ আমাদের রোগিণী কেমন আছে?” আমুদে কন্ঠে জানতে চাইলেন সাক্সেনা।

“আমি রোগী নই!” রাগে জ্বলে উঠল রাধার চোখ,”এখানে কেন আনা হয়েছে আমাকে?”।

“আজ প্রশ্ন কেবল আমিই করব।” বিছানার দিকে ইশারা করলেন সাক্সেনা, “বসো।”

বমি বমি ভাবসহ হঠাৎ করেই দুর্বল বোধ করল রাধা। তাড়াতাড়ি ফিরে গিয়ে বিছানায় উঠে বসল। দাঁড়িয়ে থাকতে না হওয়াতে ভালই লাগছে। জানে না কেন পা দুটোতে কোনো শক্তি পাচ্ছে না।

“মানসিক যাতনা বেড়ে যাবার পরবর্তী অবস্থা” রাধার অস্বস্তি দেখে সাক্সেনাকে মন্তব্য করল ফ্রিম্যান; কারণটাও একেবারে সঠিকভাবে অনুমান করেছে, “বমি ভাব আর দুর্বলতা।”

“উনি কে?” কঠিন স্বরে জানতে চাইল রাধা।

“আহ তোমার সাথে পরিচয়ই করানো হয়নি” ফিম্যানের দিকে তাকালেন সাক্সেনা, “ডা, গ্যারি ফ্রিম্যান। জেনেটিক বিশেষজ্ঞ এবং টাইটান ফার্মাসিউটিক্যালসের জেনেটিকস্ হেড। বহু বছর ধরেই আমাদের হয়ে একটা অতি গোপনীয় প্রজেক্টে কাজ করছেন। আর যুগান্তকারী এক আবিষ্কারের একেবারে কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন। এবার, কয়েকটা উত্তর দাও তো। প্রথম প্রশ্ন : ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো আমাদের মিশন সম্পর্কে কী কী জানে?”

শূন্য চোখে তাকাল রাধা। লোকটা কোন মিশনের কথা বলছে সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণাই নেই। কেবল এটুকু বুঝতে পারছে যে ইমরানের সন্দেহই সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। ধ্বংস হয়ে যাওয়া মেডিকেল সেন্টারের গোপন বেজমেন্টের ক্লিনিকাল ট্রায়ালের সাথে কোনো না কোনো ভাবে টাইটান ফার্মাও জড়িত। কিন্তু একজন জেনেটিকস হেড ক্লিনিকাল ট্রায়ালের সাথে কিভাবে জড়িয়ে গেলেন?

সাক্সেনার চেহারায় বিরক্তি ফুটে উঠল, “আমি একটা উত্তর জানতে চাইছি”, দৃঢ় স্বরে জানালেন, “নীরবতা কোনো পথ নয়। চাইলে তোমাকে কথা বলাবার জন্য কষ্টদায়ক রাস্তাও বেছে নিতে পারি। তবে এখন বেশ ভদ্র আচরণ করছি। তাই আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিও না।”

“আমি জানি না আপনি কী সম্পর্কে কথা বলছেন।” ওর কাছ থেকে কথা বের করার জন্যে সাক্সেনা কী করতে পারে খুঁজে দেখার কোনো মনোবাসনাই নেই রাধার।

“কিন্তু এটা তো বিশ্বাস করা শক্ত। তুমি আমার অফিসে এসেছ, চারপাশে নাক গলিয়ে সাংবাদিকের ভান করেছ। ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর সাথেও জড়িত। যদিও কোন দক্ষতা বলে সেটা এখনো জানি না। পূর্ব দিল্লির মেডিকেল ফ্যাসিলিটির অগ্নিকাণ্ড সম্পর্কেও তুমি সবকিছু জানো। এমনকি পেশেন্টদের জন্য তৈরি সেলগুলোর কথাও। তাই এটা পরিষ্কার যে তুমি আমাদের সম্পর্কে অনেকটাই জানো।”

বিস্মিত হয়ে গেল রাধা। আইবি’র সাথে ওর সম্পর্কের কথা এরা কিভাবে জানল? “আপনি যে কী বলছেন সে সম্পর্কে আমার সত্যিই কোনো ধারণা নেই।” ক্ষীণকণ্ঠে আপত্তি জানাল রাধা; যদিও ওদের জ্ঞানের বহর দেখে যারপরনাই অবাক হয়ে গেছে।

“ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর সাথে আমার কোনো যোগাযোগ নেই।”

মুখ ভেংচি কাটলেন সাক্সেনা। সাবধান করে দিয়ে বললেন, “আমাদেরকে এত হেলা করোনা। আমাদের দ্বিতীয় দল তোমাদের উপর সারাক্ষণ চোখ রেখেছে। তাই জানি যে আইবি এজেন্টসহ তোমরা সকলেই জোনগড় দুর্গে একসাথে ছিলে। যেটা কিনা বলা বাহুল্য তোমার বাগদত্তার সম্পত্তি।”

“ওকে। মানছি যে আমি ইমরান কিরবাঈকে চিনি। কিন্তু বাকিটা কিন্তু সত্যি বলছি”, জোর দিল রাধা। “সন্দেহ করেছিলাম। ভেবেছিলাম যে ছাই হয়ে যাওয়া সেন্টারে যা ঘটছিল তার সাথে হয়ত টাইটনও জড়িত। কিন্তু আসল কারণটা জানি না।”

প্রথমে ফ্রিম্যানের দিকে একবার ফিরে তারপর রাধার দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকালেন সাক্সেনা, “তোমাকে বিশ্বাস করব নাকি করব না কিছুই বুঝতে পারছি না।” যদি নাই জানো যে আমরা কী করছি তাহলে তদন্ত করতে এসেছিল কেন?

দ্বিধায় পড়ে গেল রাধা। এই লোকটাকে যে সব বলে দিচ্ছে তা মোটেই ভাল লাগছে না। আবার খানিকটা ভয়ও পাচ্ছে। ব্যথা আর তার হাত পায়ের কাটা দাগ দেখে ভীত হয়ে পড়েছে। একটু আগেও তো নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিল। জানে এদের পক্ষে সবকিছুই করা সম্ভব। আর যা চায় তার জন্য যে কোনো কিছু করতেও এরা দু’বার ভাববে না।

“আমরা ভেবেছিলাম যে টাইটান বায়োটেররিজমের সাথে জড়িত। মানে এখানে এমন কোনো নতুন ধরনের জীবাণু তৈরি হচ্ছে যা সন্ত্রাসীরা আর একনায়কতান্ত্রিক দেশসমূহ ব্যবহার করতে পারবে?” মনের কথা উগরে দিল রাধা।

এক মুহূর্তের জন্য যেন হয়ে গেল সাক্সেনা। আর তার পরপরই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন, “বায়োটেররিজম!” কনুই দিয়ে আলতো করে ফ্রিম্যানকে তো দিতেই সেও মিটিমিটি হেসে উঠল। “নতুন ধরনের জীবাণু!” মাথা নেড়ে বললেন, “আমাদের প্রজেক্ট সম্পর্কে তুমি সত্যিই জানো না, তাই না?” ফ্রিম্যানের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমার মনে হয় ওকে আর আমাদের কোনো দরকার নেই। তাই ঝেরে ফেলার আগেই আরো কয়েকটা পরীক্ষার কাজে ব্যবহার করে নেয়া যাক।”

দ্বিধান্বিত আর আতঙ্কগ্রস্ত রাধাকে একা রেখে রুম থেকে বেরিয়ে গেল দুই ডাক্তার। নিজের ভাগ্য সম্পর্কে এখন আর কোনো সন্দেহই নেই। গিনিপিগ হিসেবে ব্যবহৃত না হলে এতক্ষণে মরে ভূত হয়ে যেত।

.

৪৩. ধাঁধার একটা অংশ

“দেখো” ডেস্ক থেকে এক তাড়া কাগজ তুলে কফি টেবিলের চারধারে বসে থাকা অন্যদের কাছে নিয়ে এলো বিজয়, “এই ভ্রমণে আলেকজান্ডার যে রাস্তা ব্যবহার করেছিলেন সেটাকে ঘিরে দুটো রহস্য আছে।”

আধুনিক কালের আফগানিস্তান, পাকিস্তান আর ভারতের উপর দিয়ে আলেকজান্ডারের গমন পথ চিহ্নিত করা একটা মানচিত্র বিছিয়ে দিল বিজয়। উজ্জ্বল লাল কালি দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে সব রাস্তা।

“প্রথমটা এখানে” উপকূলের কাছাকাছি দক্ষিণ পাকিস্তানের একটা অঞ্চল ইশারা করে বলল, “ইন্দাস থেকে নেমে ব্যবিলনে ফেরার পথে আলেকজান্ডার সেনাবাহিনিকে দু’ভাগে ভাগ করে ফেলেন। একাংশকে সমুদ্র পথে পারস্য উপসাগরের পথে পাঠিয়ে দেন। উপকূল থেকে তারবাত পর্যন্ত বাকি অংশকে তিনি নিজে নেতৃত্ব দিয়েছেন।”

মানচিত্রে শহর দেখিয়ে বলল, আর তারপর কোনো এক ব্যাখ্যাতীত কারণে পাসনির মধ্য দিয়ে দক্ষিণের সমুদ্রমুখে চলে যান; বিপদ সংকুল পথের মধ্য দিয়ে পার হয়েছেন একশত মাইল মাকরান মরুভূমি। মাকরান পার হতে পুরো ষাট দিন লেগে যায়, আর সেনাবাহিনির বেশ বড় একটা অংশও খুইয়ে বসেন।”

“অদ্ভুত তো।” মন্তব্য করলেন ডা. শুক্লা, “ফেরার পথে কেন সমুদ্র পথে না গিয়ে সেনাবাহিনিকে বিভক্ত করে দিলেন?”

“আর শুধু তাই নয়” এই গল্পটা জানা থাকায় এবারে আলোচনায় অংশ নিল এলিস, “তারাবাত থেকে পারসেপোলিস একেবারে সোজা একটা লাইন।” মানচিত্রের দিকে ইশারা করে বলল, “আলেকজান্ডার মাকরান থেকে পাসনি গিয়ে সোজা পারসেপোলিসের পথ ধরেছিলেন। যদি সেনাবাহিনিকে দু’ভাগে ভাগ করার কোনো যুক্তিও থাকে কিংবা স্থলপথে পারসোপোলিস গেলেও মরুভূমি পার হবার কিন্তু আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল না। আধুনিক কালের লেখকদের ধারণা, আলেকজান্ডার এ মরুভূমিও জয় করতে চেয়েছিলেন। কারণ রানি সেমিরামিস আর দ্য গ্রেট সাইরাসও পার হয়েছিল এ মরুভূমি।”

“হয়ত নিজের বাহিনিকে দেখাতে চেয়েছিলেন যে তিনি সত্যিই এক দেবতা।” অনুমান করল কলিন।

“কেন, সেটা কোন ব্যাপার না” উত্তর দিল বিজয়, “আমি শুধু দেখাতে চেয়েছি যে গোপন এক অভিযানের প্রমাণ করার জন্য আমাদের হাতে দুটো উপায় আছে। মাকরান মরুভূমি হল একটা। যদি আলেকজান্ডার কোনো কিছুর অনুসন্ধানে এসে থাকেন তাহলে মাকরান মরুভূমিতে সেটাই খুঁজছিলেন। এর জন্যই এত ঘুরপথে গিয়েছিলেন।”

“কিন্তু তা তো না” শুরু করল কলিন, “কেননা ততদিনে বীজ নদীতীরে নির্মিত বেদির নিচে তো ধাতব পাতটাকে সমাধিস্থ করে গেছেন। তার মানে নিজের অভিযানের উদ্দেশ্য উপলব্ধি করে ফেলেছেন। তাহলে দ্বিতীয় রহস্যটা কী? আমার মনে হয় তুমি আরো কিছু পেয়েছ?”

বন্ধুর দিকে তাকিয়ে সেঁতো হাসি দিল বিজয়, “মাকরান অভিযানেই যে আলেকজান্ডার কোনো কারণ ছাড়া নিজ সেনাবাহিনিকে ভাগ করে ফেলেছেন তা না; বরঞ্চ এটা ছিল দ্বিতীয় বার। প্রথমবার করেছেন এখানে।” মানচিত্রে একটা শহর দেখিয়ে দিল বিজয়, “এই হল জালালাবাদ। এখান থেকেই সেনাবাহিনির একাংশসহ হেফাসনকে খাইবার পাস পাঠিয়ে দিয়েছেন যেটা বর্তমান দিনের পাকিস্তান। বাকি অংশ নিয়ে তিনি নিজে প্রথমে এই নদী উপত্যকা আর তারপর নাওয়া পাস হয়ে পাকিস্তান চলে যান; যেটি খাইবার পাস থেকে একেবারে উত্তরে।” আরেকটা ম্যাপ টেনে নিল; আফগানিস্তানের মানচিত্র। “আর খেয়াল রেখো-আলেকজান্ডার কেন উত্তরে আর তারপর পূর্বে গেছেন তা নিয়ে কেউ কোনো সন্তুষ্টজনক ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। কয়েকজন লেখক আর কয়েকটা ওয়েবসাইটে সামরিক কিছু ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে–আর তা হল তিনি নিজ বাহিনিকে পাহাড়ি গোত্রদের হাত থেকে রক্ষা করতে চেয়েছেন। কিন্তু পাহাড়ি গোষ্ঠীদের জয় করার জন্য যে লড়াই করেছেন তা কিন্তু কুনার উপত্যকাতে নয়। এর সবকটিই এখানে হয়েছে-বর্তমান সময়ে পাকিস্তান আর আফগানিস্তান বর্ডারে। তিনি চাইলে খাইবার পাস পার হয়ে তারপর পাহাড়ি গোষ্ঠীদেরকে এড়ানোর জন্য সেনাবাহিনি ভাগ করে এক অংশ পূর্ব আর আরেক অংশ উত্তরে পাঠিয়ে দিতে পারতেন।”

“পারসারে পাহাড়ি গোত্রদের সাথে সর্বশেষ যে যুদ্ধটা হয়েছিল তাকে গ্রিকরা ডাকে আর্নস। আর সেটা অবশ্যই পাকিস্তানে, কুনার উপত্যকায় নয়। যদিও আলেকজান্ডারের গতিবিধির এরকম সামরিক ব্যাখ্যা আমার ঠিক মনঃপুত হয়নি।

‘দ্য কুনার রিভার ভ্যালি” মানচিত্র দেখে নামটা পড়ল কলিন, “তোমার ধারণা এখানেই লুকায়িত ছিল সেই গুপ্ত রহস্য?”

“আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।” এলিস এখনো দ্বিধায় ভুগছে, “এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে নির্দিষ্ট কোনো কারণেই আলেকজান্ডার এই কুনার উপত্যকাতে গিয়েছিলেন আর বিশেষ অনুসন্ধানই হচ্ছে সেই কারণ। কিন্তু এটা তো কেবলই একটা অনুমান। তাহলে অন্যদের চেয়ে তোমার ব্যাখ্যা আমাদের অনুমান কেন আরো বেশি বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করতে হবে?”

“এই জন্য।” ইউমেনিসের অনুবাদিত জার্নাল মেলে ধরল বিজয়, “আর কিউবের সেই কবিতাগুলো।” ডা. শুক্লার দিকে তাকিয়ে বলল, “আরো একবার কিউবের পদ্যগুলোকে অনুবাদ করে শোনাবেন প্লিজ?”

মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন ডা. শুক্লা। বিজয়ের মনে কী আছে না জানলেও একটা ব্যাপার স্পষ্টভাবেই বুঝতে পারছেন এটাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে বিজয়। নিজের বাগদত্তার যখন জীবন সংশয় তখন ছেলেটা নিশ্চয় কোনো উপকারে না লাগলে অহেতুক এরকম কোনো রহস্য সমাধানে নেমে পড়ত না।

তাই ডা. শুক্লা কিউবটাকে হাতে নিয়ে পদ্যগুলো পড়তে শুরু করলেন। প্রতিটা কবিতার শেষে মাথা নেড়ে অনাগ্রহ দেখাল বিজয়। একে একে তিনটা পদ্য শেষ হবার পর চতুর্থ পদ্যের সময় বলল, “এটাই। এটাই সেটা।” সবার দিকে তাকাল বিজয়, “এবারে বুঝতে পেরেছ?”

.

৪৪. প্রথম সূত্র

শূন্য চোখে বিজয়ের দিকে তাকিয়ে আছে সবাই। কেউ কিছুই বুঝতে পারছে না। ডা. শুক্লা এইমাত্র যে পদ্যটা পড়লেন তা হল :

“তারপর প্রবেশ করো সেই পাতালে
পূর্ব আর পশ্চিমে যাকে বিভক্ত
করেছে উপত্যকাদ্বয়
সাবধানে বেছে নিও, মনে রাখবে
কোথায় যাচ্ছে, যেথায় সূর্য ঘুমায়।

“ওকে, হাত তুলল বিজয়, “মেনে নিলাম যে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। যাওয়ার কথাও নয়। পুরো অভিযানটাই তো গোপন, তাই না? সাংকেতিক সব পদ্য দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। কী খুঁজছে না জানলে পদ্যগুলোর অর্থই বুঝতে পারবে না। ধাঁধাগুলো তো এভাবেই কাজ করে।”

গত বছর মহাভারতের রহস্য সমাধান করা ধাঁধাগুলোর কথা স্মরণ করল কলিন আর ডা. শুক্লা। যখনই বুঝতে পেরেছে যে কী খুঁজছে তখনই কেবল সংকেত ভেঙে পদ্যগুলোর মর্মোদ্ধার করতে পেরেছিল।

“তার মানে আমরা এমন কিছু খুঁজছি যেটা সম্পর্কে আলেকজান্ডার জানতেন” মওকা বুঝে পাণ্ডিত্য জাহির করল কলিন, “পার্চমেন্টে লেখা এই ছয়টা পদ্যই আলেকজান্ডারকে গাইড করে সিক্রেটের কাছে নিয়ে গেছে; তার মানে প্রতিটা পদ্যই কোনো না কোনো ল্যান্ডমার্ক কিংবা লোকেশনকে ইশারা করছে।”

“রাইট” খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল বিজয়ের চেহারা। “সারা রাত ধরে আমিও এ কথাটাই ভেবেছি। তাই গবেষণা করতে গিয়েই ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার হয়ে ভোর হয়ে গেছে। তখনই খুঁজে পেয়েছি সমাধান।”

ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে উঠল কলিন, “সমাধান! ভোর। আমি তো সকালে এসে দেখি তুমি নাক ডেকে ঘুমাচ্ছো।”

অন্যদিকে এতক্ষণ মন দিয়ে মানচিত্র দেখেছে এলিস। যদি বিজয়ের কথা সত্যি হয় তাহলে পদ্যের সাথে মিল আছে এমন কিছু নিশ্চয় পাওয়া যাবে। এমন কিছু যেখানে দুটা উপত্যকায় যাবার প্রবেশপথ আছে।

বুঝতে পারার সাথে সাথে মনে হল যেন মাথার উপর হাজার টনের ইট। পড়েছে। “জালালাবাদ!” মুখ তুলে বিজয়ের দিকে তাকাল।

“গুডওয়ার্ক” বুড়ো আঙুল উঁচু করে প্রশংসা করল বিজয়। “মানচিত্রে নিশ্চয় দেখতে পাচ্ছো যে জালালাবাদ দুটা নদী উপত্যকার প্রবেশদ্বারে অবস্থিত। একটা গেছে পূর্বে, সেটাই কুনার উপত্যকা। আরেকটা গেছে পশ্চিমে, এটা লাহম্যান উপত্যকা। মনে আছে প্রথম যখন পদ্যগুলো শুনেছিলাম ভেবেছিলাম হয়ত কোনো দিকনির্দেশনা হবে কিন্তু জানতাম না যে কোথায় নিয়ে যাবে? এবারে কিন্তু উত্তরটা পেয়ে গেছি। কবিতার প্রবেশদ্বার”, হল জালালাবাদ। পাঠককে বলা হয়েছে পূর্ব দিকের উপত্যকা বেছে নিতে, যেখানে সূর্য ঘুমায়। রাধা ঠিক কথাই বলেছিল।” মেয়েটার নাম উচ্চারণের সাথে সাথে চুপ করে গেল বিজয়।

“আর পূর্বদিকে আছে কুনার উপত্যকা” মাথা নেড়ে সম্মতি দিল কলিন। “এখন একেবারে খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে।”

“কিন্তু তাহলে অন্য পদ্যগুলোর মানে কী? সেগুলোও নিশ্চয়ই আলেকজান্ডারের ভ্রমণপথের ইশারা করেছে। কিন্তু এরকম আর কোনো লোকেশনের কথা তো মনে আসছে না।” বলে উঠল এলিস।

“আচ্ছা, এমন হতে পারে যে একটা পদ্যে যে পাথরের কথা বলা হয়েছে সেটা হয়ত সগডিয়ান রক?” মনে করিয়ে দিল বিজয়। “যদি আমরা সবাই মিলে ভাবতে আরম্ভ করি তার সাথে খানিকটা গবেষণা তাহলে নির্ঘাৎ অন্য লোকেশনগুলোও পেয়ে যাবো। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল সিক্রেটটা মনে হচ্ছে কুনার উপত্যকার নিচেই আছে।”

“অস্পষ্ট কোনো কিছুই আমার ভাল লাগে না। পুরোটাই আমাদের ধারণা।” এলিসকে তেমন খুশি মনে হল না, “হয়ত আমরা ঠিক; কিন্তু আলেকজান্ডার রহস্যময় কোনো এক কারণে কুনার উপত্যকাতে গিয়েছিলেন এর মানে এই না যে সিক্রেটটাও ওখানেই লুকিয়ে আছে। হতে পারে পথিমধ্যে এমনিতেই থেমেছিলেন। সেটাই আসলে শেষ গন্তব্য ছিল না। ধাতব পাতটা ছাড়া বলার কোনো উপায় নেই যে পদ্যগুলোকে কেমনভাবে পড়তে হবে। আর তা না জানা পর্যন্ত সিক্রেট লোকেশন সম্পর্কেও এত নিশ্চিত হওয়া যাবে না।”

“এই ক্ষেত্রে আমার মনে হয় তোমরাও আমাকে সাহায্য করতে পারো” উত্তরে জানাল বিজয়। “আমার গবেষণার উপর ভিত্তি করে একগাদা তথ্যের প্রিন্ট আউট বের করেছি। ম্যাপ, বিভিন্ন ধরনের বর্ণনা, গুগল আর্থ ভিউ- এতক্ষণ পর্যন্ত আমরা যুক্তিগুলোকে যদি সঠিক বলে ধরে নাও তাহলে সবাইকে একসাথে মাথা খাটাতে হবে। অবশ্যই কিছু না কিছু পাওয়া যাবে।”

“এতে রাধার কী উপকার হবে?” আর অপেক্ষা করতে পারছেন না ডা. শুক্লা। বিজয় আর তার বিচার বিবেচনার উপর পূর্ণ আস্থা থাকলেও হাত গুটিয়ে বসে থাকা তো যায় না। তার কন্যার জীবন সংশয় চলছে আর সবাই কিনা প্রাচীন এক ধাঁধার সমাধানে বসেছে। তাই কোনটা বেশি জরুরি সেটা আগে ঠিক করতে হবে।

দ্বিধায় পড়ে গেল বিজয়। বলাটা ঠিক হবে কিনা তাও বুঝতে পারছে। ফোনের সম্পর্কে আসলে অন্যদেরকে জানাতে চায়নি। কিভাবেই বা জানাবে? তবে বুঝতে পারল আর কোনো উপায় নেই। এবার ব্যাখ্যা করতেই হবে।

“ভেবেছি যে এটাকে একটা দরকষাকষির উপায় হিসেবে ব্যবহার করতে পারব।” অবশেষে জানাতেই হল। “গত রাতে কুপার ফোন করেছিল। কিউবটা চায়। কারণ তাহলে সিক্রেটের কাছে পৌঁছাতে পারবে। আর আমরা যদি পদ্যগুলোর ধাঁধা সমাধান করতে পারি তাহলে রাধার নিরাপত্তার বিনিময়ে তথ্যের লেনদেন করতে পারব। স্বীকার করতে ঘেন্না হচ্ছে; কিন্তু রাধাকে বাঁচাবার এটাই শেষ আশা। যদি আইবি’ই এতক্ষণ পর্যন্ত ওকে খুঁজে বের করতে না পারে তাহলে আমরা কিভাবে পারব জানি না। তাই একটাই উপায় আছে যেন ওরাই রাধাকে ছেড়ে দেয়। আর এর জন্য সমাধানের তথ্য ছাড়া ভালো আর কোনো রাস্তা নেই।”

খানিকক্ষণ ব্যাপারটা নিয়ে গভীরভাবে ভাবলেন ডা. শুক্লা, “মনে হচ্ছে তোমার কথাই ঠিক। দেখা যাক কোনো অগ্রগতি হয় কিনা।”

সারা রাত ধরে জড়ো করা বিজয়ের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল সবাই। কুপার যা চাইছে সেই তথ্য আবিষ্কারে সহায়তা করবে এমন কোনো সূত্র কি তারা খুঁজে পাবে?

.

৪৫. পাল্টা আরেকটা প্রস্তাব

নিজের ঘড়ির দিকে তাকাল কুপার। দুপুর বারোটা। বিজয় সিংকে ফোন করার সময় হয়েছে। বিজয়ের নাম্বার ডায়াল করে শুনল যে ওপাশে রিং বেজেই চলেছে; কিন্তু ছেলেটার কোনো পাত্তা নেই। ভ্রু কুঁচকে ফেলল কুপার। ব্যাপারটা কী বোঝা যাচ্ছে না। ছেলেটার বাগদত্তা তার কাছে বন্দী। তাই প্রথম রিং বাজার সাথে সাথেই উত্তর আশা করেছিল।

কেটে দিয়ে আবার চেষ্টা করল কুপার। এইবার আকুল হয়ে ফোন তুলল ছেলেটা।

“কুপার?” বিজয়ের কণ্ঠের টানটান ভাবটা কুপারকে খুশি করে তুলল।

“তো?” সোজা আসল কথায় এলো কুপার, “কি সিদ্ধান্ত নিয়েছ? বাগদত্তা না প্রাক্তন প্রেমিকা? কে হবে?”

“আমার কাছে পাল্টা আরেকটা প্রস্তাব আছে।” এবার শক্ত হয়ে গেল ছেলেটার কণ্ঠস্বর; যদিও টেনশনের ভাবটা এখনো বজায় আছে।

কপালের ভ্রু তুলে ফেলল কুপার। বেশ কৌতূহল হচ্ছে। এরকম কিছু তো আশা করেনি। তাই ঠিক করল বাজিয়ে দেখবে ছেলেটাকে। দেখা যাক কী হয়।

“বলো” আদেশ দিল কুপার। “তোমার প্রাথমিক আগ্রহ কিন্তু এলিস কিংবা রাধা নয়” শুরু করল বিজয়, “ইন্দাস ভূমিতে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট যে সিক্রেটের খোঁজে এসেছিলেন সেটার অবস্থানটাই জানতে চাও, তাই তো?” থেমে গেল বিজয়। খানিক বিরতি দিয়ে জানাল, “আর এক্ষেত্রে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি।”

বিস্মিত হয়ে গেল কুপার। মনে পড়ল এই ছেলেটা আর তার বন্ধুদের সম্পর্কে ভ্যান কুক কী বলেছিল। এখন তো বিজয়ের প্রতি তার শ্রদ্ধা আরো কয়েক গুণ বেড়ে গেল। একই সাথে আরেকটা কথাও জেনে গেল-বাগদত্তাকে ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে উঠলেও প্রাক্তন প্রেমিকাকেও রক্ষা করতে চাইছে। এতটা সময় ব্যয় করে বহু প্রচেষ্টার পর হাতে থাকা সূত্রগুলোকে মিলিয়ে একেবারে সঠিক উত্তরটা খুঁজে বের করেছে; তার মানে বিজয় সিং সম্পর্ক রক্ষার ব্যাপারে বেশ যত্নবান।

তাছাড়া, কুপারের মনে হল, সাক্সেনাকে খুঁজে বের করতে হবে যে রাধা আর তার আইবি সহকর্মীরা মিশনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছু জানে কিনা। মেয়েটা কিডন্যাপ হবার পরে কি বিজয় সিং এতকিছু বের করেছে? নাকি আগে থেকেই জানত? কুপার যতটুকু জানে তারা যে সিক্রেট খুঁজে বের করতে চাইছে সেটার সত্যিকারের প্রকৃতি সম্পর্কে কেউ ভাবতেই পারবে না। কেবল অর্ডার এই ব্যাপারে জানে। কিন্তু দশকের পর দশক ধরে গোপন রয়েছে এই প্রজেক্ট। তাই এর চেয়ে বেশি আর লোকসমক্ষে আনতে চায়না। বিশেষ করে এখন যখন সফলতার একেবারে কাছাকাছি চলে এসেছে।

কুপার উপলব্ধি করল যে উত্তর দিতে একটু বেশিই সময় নিয়ে ফেলেছে। বিজয় যথেষ্ট বুদ্ধিমান। তাই বুঝে যাবে যে ও সঠিক জায়গাতেই হাত দিয়েছে। কিন্তু এটাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেবার উপায়ও জানে কুপার। তুরুপের তাস এখনো তার হাতেই আছে।

“আর কিভাবে তুমি এ কাজে সাহায্য করবে?” বিজয় যা বলেছে তা অবজ্ঞা করার কিংবা বুঝতে না পারার কোনো ভানই করল না কুপার।

উত্তর শুনেই বোঝা গেল নিজের জয় সম্পর্কে খুশি হয়ে উঠেছে ছেলেটা, “আমরা কিউবের একটা পদ্যের মর্মোদ্ধার করেছি; যেটা তুমি নিজে নিজে পারতে না। তাই পাঁচটা পদ্যের সবকটির মর্মোদ্ধার করে জানিয়ে দিতে পারি যে সিক্রেটটা ঠিক কোথায় অবস্থিত।”

“এখানেই তোমার ভুল হয়েছে।” পাল্টা আঘাত হানল কুপার, “বীজ নদীর তীরে আলেকজান্ডার যে ধাতব পাত রেখে গিয়েছেন সেটা এখন আমাদের কাছে। কিউব আর পাত একসাথে পেলে পদ্যগুলোর মর্মোদ্ধার করাটা বাচ্চাদের খেলা হয়ে যাবে। বুঝেছে? তাহলে তোমাকে কী দরকার?”

“ভেবে দেখো। আমরা কিন্তু আলেকজান্ডারের ধাতব পাতটা ছাড়াই পদ্যের মর্মোদ্ধার করেছি। আমাদের কাছে এমন সব রিসোর্স আছে যা তোমার নেই- এলিস আর ডা. শুক্লা। তুমি যতটা তাড়াতাড়ি পারবে আমরা তার চেয়েও দ্রুত হস্তে তোমাকে উত্তর বের করে দেব।”

পুরো ব্যাপারটাকে ভেবে দেখল কুপার। বিজয়ের দাবি একেবারে মিথ্যে নয়। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে অর্ডারের বিশাল জ্ঞান কাজে লাগিয়ে ওর দলও ঠিক সংকেতগুলোকে ভেঙে ফেলবে। কিন্তু বিজয়ের দল যদি আরো দ্রুত তা করে দেয় তাহলে তো কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। আর যদি কোনো তথ্য ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোকে পাচার করতে চায় তাহলে তো কোনো কথাই নেই, সাথে সাথে সব কটাকে খতম করে দেবে। এই কাজের জন্য আগে থেকেই একটা খালি চেক দিয়ে রেখেছে ভ্যান কুক।

“তোমরা যে ধোকা দিচ্ছ না সেটাই বা কিভাবে বুঝব?”

এরপর মনোযোগ দিয়ে পদ্যটার অর্থ আর কিভাবে তা পেয়েছে সে সম্পর্কে বিজয়ের ব্যাখ্যা শুনল।

ফলে সিদ্ধান্ত নিতেও সুবিধা হল। “তোমার শর্ত?” জানে সেগুলো কী হতে পারে কিন্তু এত সহজে ধরা দেবার কোনো ইচ্ছেই নেই।

“তুমি এলিসের পিছু ধাওয়া করা বন্ধ করে রাধাকে ছেড়ে দেবে।”

হেসে ফেলল কুপার। বিজয় সম্পর্কে যা ভেবেছে তাই ঠিক। এর জন্য ছেলেটার তারিফ করতেই হবে। অধ্যবসায় আর মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়েছে এমন পরিস্থিতিতেও দৃঢ় মনোবলের জন্য ফুল মার্কস। “মেনে নিচ্ছি, কিন্তু দুটো শর্ত আছে। তুমি আর তোমার দল আজ বিকেল চারটায় আমার সাথে ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে দেখা করবে। তারপর সবাই মিলে আজ রাতেই জালালাবাদ যাবো। আর কাল কুনার উপত্যকা। দ্বিতীয়ত, যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমার দাবি সত্য বলে প্রমাণিত হচ্ছে, রাধা আমার জিম্মায় থাকবে। যদি তুমি কোনো গড়বড় করো তাহলে মেডিকেল ফ্যাসিলিটির রোগীদের রক্তে যে ককটেল পাওয়া গিয়েছিল সেটাই ওর শরীরে ইনজেকশনের মাধ্যমে ঢুকিয়ে দেয়া হবে।”

স্থূল আর উচ্চকণ্ঠে এই হুমকি শুনে রাগ সংবরণ করতে গিয়ে খানিক চুপ করে রইল বিজয়, “আমার আর কিছু বলার নেই। তবে শুধু আমি আসব বাকিরা এখানেই থাকবে। আর আমিই বা কিভাবে জানব যে তুমি কথা রাখবে?”

ভেবে দেখল কুপার। যদি অবস্থানটা সম্পর্কে সত্যি কথা বলে; তাহলে তো সিক্রেটটা সবাইকে দেখানোর কোনো মানে হয় না। তাই কুনার উপত্যকা পর্যন্ত সবাইকে বয়ে নিয়ে যাবারও কোনো মানে নেই। শুধু এই ভেবে বলেছিল যেন এ সুযোগে দেশের বাইরে এক লহমাতেই সবকটিকে শেষ করে দেয়া যায়। অন্যেরা না গিয়ে বিজয় একা গেলেও কোনো ক্ষতি বৃদ্ধি হবে না। আফগানিস্তানে স্যাটেলাইট ফোনের মাধ্যমে পরস্পরের সাথে যোগাযোগ রাখাটাও কোনো সমস্যা হবে না। তাছাড়া কেন যেন মনে হচ্ছে যে বিজয় আর তার বন্ধুদের নিয়ে তেমন কোনো চিন্তা নেই। রাধা ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর সাথে জড়িত। বাকিরা নয়। তাই ওদের উপর নজরদারি করার জন্য কুপারের বাকি দল তো আছেই। একটু পরেই সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

এবার তাই কাট কাট স্বরে জানাল, “একটু আগে যেমনটা বললে তোমার আর কোনো উপায় নেই, ধরে নাও তাই। ঠিক বিকেল চারটায় দেখা হবে। ভোন্ট বি লেট।”

.

৪৬. জুয়াখেলার মত ঝুঁকি

ফোন কেটে দিয়ে আস্তে আস্তে স্টাডির কাছে ফিরে এলো বিজয়। একটু আগে কুপারের ফোন ধরার জন্যেই নিচের সিটিং রুমে চলে গিয়েছিল। চেয়েছে অন্যেরা, বিশেষ করে এলিস যেন এ আলোচনা শুনতে না পায়। বাকিদেরকে কিভাবে সংবাদটা দেবে সেটা নিয়ে অবশ্য চিন্তায় পড়ে গেল। আবার একই সাথে এটাও মনে হচ্ছে যে রাধাকে বাঁচাতে গিয়ে না জানি সবাই মিলে আরো বেশি করে কুপারের থাবার মধ্যে পড়ে গেল। স্বস্তির কথা হচ্ছে বাকিরা এখানে জোনগড়ে নিরাপদেই থাকবে। একা বিজয় শুধু কুপারের সাথে যাবে।

স্টাডিতে ঢুকতেই সবাই কৌতূহল নিয়ে তাকাল। জানে সবাই ভাবছে যে কেন এত তাড়াহুড়া করে একটা ফোন ধরার জন্য চলে গিয়েছিল।

“কুপার ফোন করেছিল” প্রতিটা শব্দ বলার সময়েও ভাবছে, “কুপার বলেছিল যে বারোটার সময় ফোন করবে। আমাদের মধ্যে একটা ডীল হয়েছে।” কুপারকে কী প্রস্তাব দিয়েছে তা খুলে বললেও এলিস আর রাধাকে নিয়ে বিজয়ের সিদ্ধান্ত শুনে কুপার ফিরতি কী বলেছে সেটা আর জানাল না।

বিজয়ের কথা শেষ হতেই বাকিরা স্তম্ভিত হয়ে গেল। আর বরাবরের মতই সবার আগে কথা বলল কলিন, “তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি? একটা ওই…ওই…ওদের মাঝে? জানি না ওরা কারা তবে অত্যন্ত খতরনাক! এতদিনেও ওদের রূপ বোঝনি?”

এলিসও মাথা নাড়ল। “তুমি কী ভেবে এমন করলে জানি না বিজয়। গ্রিসে ওরা যা করল আর তারপর এখানে জাদুঘরেও আক্রমণের পর তুমি কিভাবে এমনটা করলে?”

বিজয় একেবারে চুপ। অন্যদেরকে কিভাবে বোঝাবে যে দোটানা থেকে বাঁচার এটাই ছিল একমাত্র পথ? কিভাবে বোঝাবে যে এলিস আর রাধার ভাগ্যের ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টায় সিদ্ধান্ত নেয়াটা কতটা যন্ত্রণাদায়ক ছিল? “রাধাকে বাঁচাবার জন্য এটাই ছিল একমাত্র পথ।” সোজা-সাপটা জবাব দিয়ে দিল। “তোমরা এখন থেকে এসবের বাইরে থাকবে। বিশেষ করে এলিস তুমি। তাই আমি যতক্ষণ ওদের সাথে থাকব তোমরা পদ্যগুলো নিয়ে কাজ করবে। কোনো কিছু পেলেই সাথে সাথে আমাকে জানাবে। যত দ্রুত এই প্রহেলিকার সমাধা হবে তত দ্রুত রাধাকে ফিরে পাবো।”

“তুমি একা যাচ্ছে না” উঠে দাঁড়িয়ে বন্ধুর কাছে হেঁটে এলো কলিন; চোখে চোখ রেখে বলল, “আমরা না দোস্ত, একসাথে সবকিছু করি? গত বছরের কথা মনে নেই? আমিও যাচ্ছি তোমার সাথে।”

তর্ক করে কোনো লাভ নেই তা বিজয় ভালোই জানে। আর যদি সত্যি কথা বলতে হয় তো বলবে যে ও নিজেও কলিনের সঙ্গের জন্যে উন্মুখ। কিন্তু এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। গত বছরের পুনরাবৃত্তি চায় না। তাই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সরি দোস্ত। এবার নয়। গত বছরের কথা এখনো ভুলি নি। এই কারণে এবার বাকিদের সাথেই থাকবে। আর কোনো আলোচনা চাই না আমি।” কলিন কিছু বলার জন্য মুখ খুললেও বিজয়ের ফোন বেজে উঠল। এবার বৈদ্য।

“আমি দুঃখিত যে রাধার ব্যাপারে আর কিছু জানতে পারিনি।” সবিস্তারে জানালেন বৈদ্য। “আমরা এখনো খুঁজছি। এ লোকগুলো মনে হচ্ছে বেশ পেশাদার। এতদিন পর্যন্ত আমাদের রাডারের নিচে কাজ করলেও নিজেদের ট্র্যাক অতি দক্ষতার সাথে ঢেকে রেখেছে। কিন্তু আজ নয়ত কাল ঠিকই ধরে ফেলব।”

“সেরকমই আশা করছি” উত্তরে জানাল বিজয়, “তবে আপনাদের জন্যও কয়েকটা খবর আছে।” কুপারের কথা খুলে বলল।

উত্তর দেবার আগে খুব সাবধানে খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন বৈদ্য, “তুমি অনেক বড় একটা ঝুঁকি নিয়েছ। খুব খুব বড়। জানো তারা এত সহজে রাধাকে ছাড়বে না। তাছাড়া তোমরা সবাই ঝুঁকিতে আছো। ওরা জানে যে তোমরা সবাই, রাধাসহ ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর সাথে জড়িত। আর আমরা যেমনটা সন্দেহ করছি এক্ষেত্রে যদি বায়োটেররিজমও জড়িত থাকে তাহলে তোমরা তো তাদের জন্য রীতিমত হুমকি।”

“আমার কিন্তু তা মনে হয় না।” উত্তর দিল বিজয়। “আমার ধারণা ওরা ভাবছে যে শুধু রাধাই আইবি’র সাথে জড়িত। সম্ভবত কেল্লায় ইমরানের উপস্থিতিকে রাধার জন্য এসেছেন বলে ধরে নিয়েছে। তবে এটা জানে যে রাধা আমার বাগদত্তা। নয়ত এতদিন আমাদেরকেও টার্গেট করত। এমনকি জাদুঘরেও এলিসই ছিল তাদের সত্যিকারের নিশানা। যদি ওর সাথে আমরা না থাকতাম তাহলে আমাদের কোনো ক্ষতিই করত না।”

“আমার মনে হয় তুমি একটু অফিসে এলে ভালো হয়।” জানালেন ডিরেক্টর অর্জুন বৈদ্য, “প্যাটারসনকেও জানানো উচিত। সেই তো টাস্ক ফোর্সের হেড। তাই কী ঘটছে তার জানা প্রয়োজন আছে। আর মনে হয় না তাঁর সাথে যোগাযোগ ছাড়াই এ ধরনের একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছ বলে খুব খুশি হবে।”

“আমি এক্ষুনি আসছি” প্রতিজ্ঞা করল বিজয়, “ওখান থেকে এয়ারপোর্ট চলে যাবো।”

“তার আগে হয়ত হাসপাতালে আসতে চাইবে।” উৎফুল্ল হয়ে উঠল বৈদ্যের কণ্ঠস্বর, “ইমরানের বিপদ কেটে গেছে। জ্ঞানও ফিরে এসেছে। তোমার সাথে দেখা করতে চাইছে।”

ফোন রেখে কলিনের দিকে তাকাল বিজয়; বন্ধুর চোখে মুখে স্পষ্ট বিরক্তি, “আরে তোমার তো খুশি হবার কথা বাছা” বলে উঠল, “এখানেই তোমাকে বেশি দরকার।” অট্টহাসি দিয়ে পরিবেশটাকে হালকা করতে চাইল, “তুমি না বলো আমার চেয়ে তোমার মাথায় বেশি বুদ্ধি। তো এবারে প্রমাণ দেখাও। ধাঁধার সমাধানে এলিস আর ডা. শুক্লাকে সাহায্য করো। আমাকে সহায়তার জন্য এর চেয়ে ভালো আর কোনো রাস্তা নেই, বুঝলে।”

তৎক্ষণাৎ কোনো উত্তর দিল না কলিন। এখনো মেনে নিতে পারছে না বিজয়ের সিদ্ধান্ত। বন্ধুকে ভালোভাবেই চেনে। একবার যখন মনস্থির করে ফেলেছে তখন দুনিয়ার কোনো শক্তিই তাকে টলাতে পারবে না। তাই বাধ্য হয়ে বিজয়কে একা ছাড়তেই হবে। অবশেষে মাথা নেড়ে জানাল, “বলছি না

যে খুব খুশি হয়েছি। কিন্তু তুমি যদি এটাই চাও তো…” থেমে গিয়ে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরল, “নিজের দিকে খেয়াল রেখো দোস্ত; আমি কিন্তু সেখানে থাকব

অন্যদের উদ্দেশ্যে মাথা নেড়ে স্টাডি থেকে বেরিয়ে গেল বিজয়। জানে ও একটা জুয়া খেলা খেলতে যাচ্ছে। বাজিটা জিততে পারবে তো?

.

ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো হেডকোয়ার্টার্স, নিউ দিল্পি

কনফারেন্স রুমের মনিটরে প্যাটারসনের ইমেজের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বিজয় আর বৈদ্য। মাঝরাতে ডেকে তোেলায় আফ্রিকান-আমেরিকানের কঠোর আর অপ্রসন্ন মুখভাবে আজ আরো যোগ হয়েছে একরাশ বিরক্তি।

“ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ হলেই ভালো” কনফারেন্স রুমে অপেক্ষারত দুজনকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন, কাল প্রেডিডেন্টের সাথে মিটিং আছে অথচ ঘুমানোর জন্য মাত্র কয়েক ঘণ্টা আছে হাতে। তোমরা ফোন করার মাত্র একটু আগেই বিছানায় গিয়েছিলাম।”

বিজয় যেভাবে জানিয়েছে সেভাবেই সারা দিনের ঘটনাগুলো খুলে বললেন বৈদ্য। শুনতে শুনতে প্যাটারসনের চেহারা আরো কালো হয়ে চোখদুটো রাগে জুলতে আরম্ভ করল। তিনি নিজে নিয়ম-কানুনের প্রতি কড়া বলে যারা নিয়ম ভঙ্গ করে তাদেরকে তেমন দেখতে পারেন না। নেভীসিল হওয়াতেই পেয়েছেন এ অভ্যাস।

বৈদ্যের রিপোর্ট শেষ হবার সাথে সাথে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বিজয়ের দিকে তাকালেও সাথে সাথে কিছু বললেন না প্যাটারসন। মনে হল এই মাত্র পাওয়া তথ্যগুলো নিয়ে গভীরভাবে ধ্যান করছেন।

“আগের কাজ আগে” খানিক পড়ে জানালেন প্যাটারসন, “কিরবাঈয়ের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। কারণ উনার কথাই ঠিক। গ্রিসে ঘটে যাওয়া ঘটনা আর টাইটান ফার্মাসিউটিক্যালসের মাঝে কোনো না কোনো সম্পর্ক অবশ্যই আছে। আমাদেরকে আরো গভীরে যেতে হবে আর সকাল হলে আমিও দেখব কী করা যায়। কিন্তু আমাদেরকেও সতর্ক আর কৌশলী হতে হবে। ওয়ালেস জড়িত হোক বা না থোক কার সাথে কথা বলছি আর কতটুকু কী বলছি সে ব্যাপারে বিচক্ষণ হতে হবে। পুরো ব্যাপারটাই বেশ নাজুক। বিভিন্ন কংগ্রেসম্যান, সিনেটর আর এমনকি প্রেসিডেন্টের সাথেও ওয়ালেসের বেশ দহরম-মহরম আছে। তাই বেস কিছু করা যাবে না।”

বিজয় আর বৈদ্য দুজনেই মাথা নাড়ল। অপেক্ষা করছে প্যাটারসনের কথা শেষ হবার জন্য।

“নেক্সট”, তীব্র দৃষ্টিতে বিজয়ের দিকে তাকালেন প্যাটারসন, “বিভিন্ন ধাঁধা আর প্রহেলিকার সমাধান করার জন্য তোমার দক্ষতা প্রশংসাজনক হলেও সন্ত্রাসীদের সাথে আলোচনা করার অধিকার তোমার নেই। এমনকি অভিজ্ঞতাও নেই। মনে হচ্ছে ভুলে গেছ যে তুমি টাস্কফোর্সের সদস্য। আর এখানে কে কী করবে সেটার সিদ্ধান্ত আমি নেব। তুমি নয়। তাই মন চাইলেই যা খুশি তা করতে পারো না।”

তারপর এমনভাবে থেমে গেলেন যেন নিজের কথা ওজন করে দেখছেন, “কিন্তু তুমি তাই করেছ। এইক্ষেত্রে আমাদের আর বেশি কিছু করার নেই। তবে একটা কথা বুঝতে চেষ্টা করো, যদি এসব মেয়েটার জন্য করে থাকো তাহলে তুমি একজন মহা বেকুব! একেবারে অথর্ব গাধা। ও এতক্ষণ মারা গেছে। আর যদি ভাবো যে তাদেরকে রূপার থালে করে সিক্রেটটা সাজিয়ে দিলেই মেয়েটাকে ছেড়ে দেবে তাহলে বলব দ্বিতীয়বার আগাগোড়া চিন্তা করে নাও। তুমি এবং মেয়েটা দুজনেই খরচের খাতায় চলে গেছ। তার মানে যা করছ তা মেয়েটার জন্য নয়; করছ টাস্ক ফোর্সের জন্য। তাই নিশ্চিত করার চেষ্টা করবে যে আফগানিস্তান কিংবা অন্য যেখানকার গুহাতেই যা পড়ে আছে তা যেন দুনিয়ার জন্য কোনোরকম হুমকি সৃষ্টি করতে না পারে। এই কারণেই সৃষ্টি হয়েছে এ টাস্ক ফোর্স। আর এখন তা তোমার দায়িত্ব। বুঝতে পেরেছ?”

ঢোক গিলল বিজয়। মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছে প্যাটারসনের কথার সত্যতা। প্যাটারসনের যুক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে ওর সমস্ত সত্তা। কিন্তু আপন হৃদয়ের গভীরে ঠিকই বুঝতে পারছে যে টাস্ক ফোর্সের লিডারের কথায় কোনো ভুল নেই।

চোখের জল আটকাতে প্রাণান্তকর চেষ্টা করে বলল, “বুঝেছি। একেবারে পরিষ্কার।”

“এবার আবার শুরু করলেন প্যাটারসন, “শোন, যদি এই মহান রহস্যের সঙ্গে বায়োটেররিজমের হুমকি জড়িয়ে থাকে তাহলে তো হাতে হাত রেখে বসে ওদেরকে পালিয়ে যেতে দেয়া যায় না। যীশুর দিব্যি, ওরা যে কে সেটাও জানি না!”

“কী করতে বলছেন?” বিজয় বুঝতে পারল প্যাটারসন কী বলতে চাইছেন।

“তুমি তোমার সিদ্ধান্ত মত কাজ করো” বিজয়কে নির্দেশ দিলেন প্যাটারসন, “আমরা এখান থেকে তোমাকে কাভার দিব।”

হতবুদ্ধি হয়ে গেল বিজয়, “কিভাবে? রাধাকে কোথায় রাখা রয়েছে আপনি তো সেটাও জানেন না?”

“মনোযোগ দিয়ে শোন” কণ্ঠস্বর নিচু করে বিজয়কে সব জানিয়ে দিলেন প্যাটারসন; শেষ করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “খুব সাবধানে থাকবে, মাই বয়। আমাদের কোনো অলৌকিক ক্ষমতা নেই। গত সপ্তাহে আরেকটু হলে টাস্ক ফোর্সের এক সদস্যকে হারাতেই বসেছিলাম। আরো দুজনকে হারাবার কোনো ইচ্ছেই নেই।”

.

৪৭. জালালাবাদ, আফগানিস্তান

জালালাবাদের রাস্তায় ঝাঁকি খেতে খেতে এগোচ্ছে ল্যান্ড রোভার। কুপারের পাশেই বসে আছে বিজয়। এয়ারপোর্টে পৌঁছানোর সাথে সাথেই তড়িঘড়ি ওকে একটা অপেক্ষারত গাস্ট্রিম জিফাইভ ফাইভ জিরো জেটে তুলে নেয়া হয়েছে।

তারপর নব্বই মিনিটের ফ্লাইটে চড়ে উড়ে এসেছে দিল্লি থেকে কাবুল। সাথে কুপারের দলের আরো পাঁচজন এসেছে, স্থূলকায়, পেশিবহুল লোকগুলোর ক্ষতচিহ্ন দেখেই বোঝা যাচ্ছে কতটা তেজী, সকলেই সশস্ত্র।

কাবুল এয়ারক্রাফট ল্যান্ড করার সাথে সাথেই টারম্যাকে পার্ক করা আরেকটা প্রাইভেট জেট দেখল বিজয়। গাস্ট্রিম সিক্স ফাইভ জিরো ই আর, দূরপাল্লার জেট। এগুলো যে কার সেটা ভেবেই বেশি অবাক লাগছে। কুপার ওকে আগেই জানিয়েছে যে তারা সরাসরি জালালাবাদ যেতে পারবে না। কারণ বিমানবন্দরগুলো এখন সামরিক উদ্দেশ্যেই ব্যবহৃত হয় আর এ মুহূর্তে কেবল জাতিসংঘের বিমান ওঠা-নামা করে। আশেপাশে আরো দুটো মোটাসোটা কর্মাশিয়াল এয়ারলাইন্স থাকলেও ছোট খাটো কোনো প্লেন নজরে পড়ল না।

ইমিগ্রেশনের ঝামেলা চুকিয়ে নকুই মিনিটের জন্য ল্যান্ড রোভারে চড়ে বসল জালালাবাদের উদ্দেশ্যে। সচরাচর বাহন নিয়ে কোনো কথা বলে না বিজয়। রাস্তাটা বেশ ভালো আর মসৃণ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাহায্য পুষ্ট একটা প্রজেক্ট ২০০৬ সালে নতুন করে গড়ে তুলেছে এ অংশ। কিন্তু মনে হচ্ছে দু’ধারের গ্রাম্য-দৃশ্যকে চ্যালেঞ্জ জানানোর জন্য আফগান ড্রাইভারদেকে আরো উৎসাহ দিয়েছে রাস্তার এই বৈশিষ্ট্য।

কাবুল নদীর প্রায় ২০০ ফুটেরও বেশি উপর দিয়ে বয়ে চলা রাস্তার আশেপাশের শ্বাসরুদ্ধকর দৃশ্য দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। যদিও সারাক্ষণ যেন বিপদ আর মৃত্যু ওঁৎ পেতে ছিল মাথার উপর। হাইওয়েতে মাত্র দুটো লেন আর পাশাপাশি খুব বেশি হলে দুটো গাড়ি চলতে পারবে এতটুকু মাত্র চওড়া।

ভেতরের লেনে, রাস্তার উপর টাওয়ারের মত উঁচু হয়ে আছে খাড়া একটা চূড়া। প্রায় নব্বই ডিগ্রি কোনে বাঁকানো। আর বাইরের লেনকে সুরক্ষা দিচ্ছে মাত্র এক ফুট উঁচু তাক। যার ওপারে খোলা আকাশ আর নিচে উপত্যকার মেঝে।

প্রাচীন লাডাস-সেই সোভিয়েত যুগ থেকেই টিকে আছে। দুর্বল, ভাঙ্গা-ভাঙ্গা বাস আর ক্ষয়ে যাওয়া টয়েটো ট্যাক্সিগুলো একে অন্যের সাথে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে এলোপাথারি গাড়ি চালাচ্ছে। একটু পরেই অবশ্য আবার সোভিয়েত আক্রমণের সাক্ষী খানা-খন্দে পড়ে এদিক সেদিক ছিটকে পড়তে হয়। ল্যান্ড রোভারের পাশ দিয়ে হুশ হাশ করে বেরিয়ে যাচ্ছে স্থানীয় গাড়ি। একে অন্যের কাছ থেকে মিলিমিটার মাত্র দূরত্বে হাই স্পিডে পার হচ্ছে চুলের মত চিকন আর তীক্ষ্ণ বাক। এসব কিছুর মাঝে অসামঞ্জস্য হচ্ছে বোঝা বহনকারী ধীরগতির ট্রাকটার ট্রেইলার। কর্কশ শব্দ করে এমনভাবে গড়িয়ে চলেছে যেন সময় নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই। ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চলা বাকি যানবাহন থেকে একেবারেই আলাদা।

পথিমধ্যে দু’বার প্রতিদিন হাইওয়েতে ঘটে চলা দুর্ঘটনার নজির দেখতে পেল বিজয়। প্রথমটা হচ্ছে গিরিখাতের তলায় দোমড়ানো মোচড়ানো একটা গাড়ির অবশিষ্টাংশ। দ্বিতীয়টা একটা কন্টেইনার ট্রাক আর সেডানের মুখোমুখি সংঘর্ষ। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে দুর্ভাগা ড্রাইভার সময় মত নিজ লেনে ফিরতে

পেরে পূর্ণ গতিতে গিয়ে ট্রাকের গায়ে আছড়ে পড়েছে। ফলে রাস্তার সংকীর্ণ অংশে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে যানবাহনের অবাধ গতি। বিশাল ট্রাক আর গাড়ির নষ্ট হয়ে যাওয়া অংশের পাশ দিয়ে আস্তে আস্তে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে পার হচ্ছে বাকি গাড়ি।

যাক, অবশেষে জালালাবাদ পৌঁছাতে পেরেছে। এখন স্থানীয় এসকর্টের সাথে যাচ্ছে বাকিদের সাথে মোলাকাৎ করার জন্য। এই লোকটাই কাল সকালে তাদেরকে কুনার ভ্যালিতে নিয়ে যাবে।

জীর্ণদশা এক দালানের সামনে এসে থামল ল্যান্ড রোভার। প্লাস্টার উঠে যাচ্ছে, জানালাগুলো ভাঙ্গা। কোনো সন্দেহ নেই যে খুব শিঘ্রই মেরামত প্রয়োজন। তবে মনে হচ্ছে বিলাসিতা এদের কাছে তেমন জরুরি কিছু না। কুপার যে কাদের জন্য কাজ করছে তা ভেবে যারপরনাই বিস্মিত বিজয়।

অবশ্য দোতলা দালানের প্রায় পুরো গ্রাউন্ড ফ্লোর জুড়ে থাকা হলে ঢুকতে গিয়ে খানিকটা উত্তর পেয়েও গেল। কোনো এক কালে হয়ত হালকা হলুদ ছিল এমন এক পোকায় কাটা গদিঅলা সোফায় বসে আছে স্বতন্ত্র চেহারাবিশিষ্ট লম্বা এক লোক। ভদ্রলোকের উন্নত কপাল, ঈগলের মত বাকা নাক আর মাথায় রুপালি ধূসর চুল। ভেতরে ঢোকার সাথে সাথে বিজয়কে মেপে দেখল রীমলেস চশমার ওপারে থাকা ধূসর চোখজোড়া।

সামনেই টেবিলের উপর পড়ে আছে জাতীয় জাদুঘরে দেখা ধাতব পাত, বীজ নদীর কাছাকাছি জিউসের বেদির নিচে যেটি সমাধিস্থ করে গেছেন আলেকজান্ডার।

“শুভ সন্ধ্যা, ক্রিশ্চিয়ান”, লোকটার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল কুপার। একটুও না হেসে পাল্টা মাথা ঝাঁকাল লোকটা।

কোনো কথা না বললেও ঠিক বোঝা যাচ্ছে তার ক্ষমতা আর প্রতিপত্তির বহর। বিজয় জানে না সে কে তবে সন্দেহ নেই যে কুপারের বস। এই পুরো প্রজেক্টের পুরোধা।

এখানেই এই সময়ে আগন্তুকের উপস্থিতি ভালো না মন্দ সেটাও বুঝতে পারছে না। তবে আশা করছে অন্তত এতদিন ধরে তাদের মনের মাঝে জমে উঠা একগাদা প্রশ্নের কয়েকটা উত্তর পাওয়া যাবে।

“অবশেষে বিজয়ের উপর স্থির দৃষ্টি মেলে ধরল লোকটা, ধূসর চোখ জোড়া এখনো ওকে মূল্যায়ন করে চলেছে। কাছেই পড়ে থাকা শতছিন আরেকটা সোফা দেখিয়ে বসতে ইশারা করল। বিজয়ও বসে পড়ল।

“আমার নাম ক্রিশ্চিয়ান ভ্যান ক্লক” নিজের পরিচয় জানাল আগন্তুক, “আমার কথা কখনো শোন নি, না?”

মাথা নেড়ে সম্মতি দিল বিজয়। সত্যিই শোনে নি।

“যাই হোক সেটা কোনো সমস্যা না; তুমি কে সেটা আমি জানি। বলে চলল ভ্যান কুক; কুপারের দিকেও একবার তাকাল, “বেশ ভালো কাজ দেখিয়েছে কুপার। কাল আমাদের অভিযানের জন্য বিশ্বস্ত লোকজনকে তৈরি করো ততক্ষণে আমি এই ভদ্রলোকের সঙ্গে খানিক কথা বলি?”

সম্মত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেল কুপার। এরপর ভ্যান ক্লক ওর দিকে তাকাতেই বিজয় বুঝতে পারল যে কাবুল এয়ারপোর্টের গাস্ট্রিম জেট এ লোকটার হবে নিশ্চয়। কে সে? কণ্ঠস্বরে পুরোপুরি ইউরোপীয় টান। সম্ভবত জার্মানি কিংবা অস্ট্রিয়া থেকে এসেছে। অসম্ভব ধনী, সে ব্যাপারেও কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বিজয়কে কিভাবে চেনে?

“তুমি হচ্ছ আমাদের জন্যে একটা কাটা।” বিজয়কে জানাল ভ্যান কুক। তবে এরকম মন্তব্য সত্ত্বেও তাকে বিরক্ত কিংবা দুঃখী মনে হচ্ছে না, “তোমার জন্য গত বছর আমি একজন ভালো বন্ধুকে হারিয়েছি। আর অর্ডার হারিয়েছে এক কর্মোদ্যমী সদস্য।” মাথা নেড়ে জানাল, “আগামী হাজার বছরেও তোমার কথা ভুলব না।” এবারেও অভিব্যক্তি কিংবা গলার স্বরে কোনো তিক্ততা প্রকাশ পেল না।

কিন্তু শব্দগুলো শোনার সাথে সাথেই বিজয়ের মেরুদন্ড বেয়ে নেমে গেল ভয়ের শীতল স্রোত। ভ্যান কুক কি গত বছর মহাভারতের রহস্য অনুসন্ধানের কথা বলছে? অনুমান করতে কষ্ট হচ্ছে না যে কাদের প্রতি ইঙ্গিত করেছে।

“অবশ্য এখন আর এসবের কোনো মানে হয় না” আবার শুরু করলো ভ্যান, “এসবই অতীত আর আমি অতীতে বসবাস করায় বিশ্বাস করিনা। আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে ভবিষ্যৎ। তাই সামনের দিনগুলোর উপরেই মনোসংযোগ করতে হবে। এখনো অনেক কিছু পাবার বাকি আছে। কিন্তু অতীতও গুরুত্বপূর্ণ, তাই না?” বিজয়কে চিরে দিল মর্মভেদী দৃষ্টি, “অতীত থেকেই শিক্ষা নিয়ে নিরাপদ ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে হবে।”

লোকটা যে কী বলছে সে সম্পর্কে বিজয়ের কোনো ধারণাই নেই। মনে হচ্ছে সব অর্থহীন কথাবার্তা। কিন্তু সামনে বসে থাকা লোকটাকে দেখে তো অসংলগ্ন বলেও মনে হচ্ছে না। তাকে তো বরঞ্চ পুরোপুরি নির্ভুল, পরিকল্পনা মত হিসেব কষে পা ফেলাদের দলেই ফেলা যায়। মোটেই আবেগতাড়িত নয়।

“কুপার আমাকে বলেছে তুমি না-কি পদ্যগুলোর একটার মর্মোদ্ধার করেছ” বিজয়ের বিস্ময়কে পাত্তা না দিয়ে ভ্যান ক্লক জানাল, “তো কুনার উপত্যকায় কী আছে?” সামনে ঝুঁকে বিজয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “বলো।”

পুরো আলোচনার মধ্যে এই প্রথমবারের মত বিজয়ের পরিচিত একটা কিছু নিয়ে কথা বলল ইউরোপীয়ান লোকটা। কিন্তু এবারেও ওর কাছে কোনো উত্তর প্রস্তুত নেই।

“আমি জানি না” উত্তরের পরিবর্তে তাই কাঁধ ঝাঁকিয়ে জানাল বিজয়, “পদ্যটাতে কেবল জালালাবাদের অবস্থান বর্ণনা করা হয়েছে। এই অঞ্চলে আসার জন্য আলেকজান্ডার যে রাস্তা ব্যবহার করেছিলেন তা থেকে কুনার উপত্যকা একটা অনুমান মাত্র।” এরপর ব্যাখ্যা করে জানাল যে কেমন করে কনার উপত্যকাতেই রহস্যটা লুকিয়ে থাকার জোরালো সম্ভাবনা খুঁজে বের করেছে।

বিজয়ের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনল ভ্যান কুক, “তার মানে তুমি সঠিক। অবস্থানটা জানো না। কিন্তু ভাবছ যে এখানেই হয়ত আমাদের অনুসন্ধান শেষ হবে।”

উত্তর দেবার আগে খানিক দ্বিধা করল বিজয়। এতক্ষণ এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল, “তোমরা আসলে কী খুঁজছ জানতে পারলে আমি সাহায্য করতে পারব। এখন তো কেবল কিছু না জেনেই পদ্যগুলোকে মমোদ্ধার করেছি। আলেকজান্ডার সেটা জানতেন। আমরাও যদি জানতে পারি। তাহলে সম্ভবত কাজটা আরো দ্রুত হবে।” এমন এক মানুষের মত একগুয়ে দৃষ্টিতে তাকাল যার কিছুই হারাবার নেই। প্যাটারসন তো জানিয়েছেন যে তার আর রাধার দিন শেষ। আর যদি মৃত্যু এত কাছেই থাকে তবে তার আগে উত্তরটাও ঠিকই জেনে যাবে।

চিন্তায় পড়ে গেল ভ্যান কুক। বিজয়ের কাছ থেকে এ ধরনের কোনো তেজ প্রত্যাশা করেনি। যাই হোক অবশেষে মাথা নেড়ে হাসল; বরফ শীতল এক হাসি যা চোখে ফুটে উঠেনি। “হয়ত তুমিই ঠিক। যদি আরো কিছু জানতে পারো তাহলে হতে পারে আরেকটু বেশি কাজে লাগবে।”

বিজয় অপেক্ষা করছে; আর ইউরোপীয়টা মনে মনে ভাবছে যে কতটা বলবে আর কতটা গোপন রাখবে।

.

৪৮. আলেকজান্ডার সম্বন্ধে সত্য উদঘাটন

“দ্য গ্রেট আলেকজান্ডার সম্পর্কে খানিকটা সত্য বোধ হয় তুমি ইতিমধ্যে বের করে ফেলেছ।” অবশেষে জানাল ভ্যান কুক। “বাস্তব ক্ষেত্রে তার জীবন সম্পর্কে আমরা যতটা জানি-সেটার ভিত্তি হল অসংলগ্ন কিছু তথ্য কিংবা অধিকাংশ ক্ষেত্রে যিনি রেকর্ড করে গেছে সেই ব্যক্তির উদ্দেশ্য, দর্শন অথবা ধ্যান-ধারণা। ফলে কোনটা যে আসল মানুষটা সম্পর্কে লেখা ঐতিহাসিক সত্য আর কোনটা যে মহিমান্বিত হিসেবে ফুটিয়ে তোেলা গল্প তা বের করা আসলেই কঠিন।”

বিজয় যেন এ মন্তব্যে সায় দেয় তাই খানিক অপেক্ষা করল ভ্যান কুক। বিজয় তাই মাথা নেড়ে সম্মতি দিতেই আবার শুরু করল, “আর এ কারণেই কিউবের মত আর্টিফ্যাক্ট গুলো দরকারি। এদের সাহায্যে আলেকজন্ডারের তাবেদারি আর উচ্চকিত প্রশংসা করে লেখা অতি কল্পনার অংশগুলোকে বাদ দেয়া যাবে।”

আবারো মাথা নাড়ল বিজয়। মনে পড়ল তাদের বিশ্লেষণের সময় এলিসের প্রত্যাখ্যানের কথা। বিভিন্ন রেকর্ডে আলেকজান্ডার সম্পর্কে প্রচুর পরিমাণে লোকজ গল্প মেলে ধরা হয়েছে যার সবকটিকে বিশ্বাস করা শক্ত।

হাত বাড়িয়ে দিল ভ্যান ক্লক, “কিউবটা প্লিজ।”

বিজয় কিউবটা ক্লকের হাতে তুলে দিতেই ধাতব পাতের গায়ে লাগিয়ে দিল ভ্যান কুক। সাথে সাথে চমৎকারভাবে বসে গেল, কিউব।

“তো তোমরা কিভাবে জানো যে আলেকজান্ডারের গল্পের কতটুকু সত্য আর কতটুকু অতি কল্পনা?” কৌতূহলী হয়ে উঠল বিজয়। এই লোকটার ক্ষমতার আর জ্ঞানের উৎস কী?

“জেনে কী তোমার ভালো লাগবে?” ব্যঙ্গ করল ভ্যান ক্লক। “কিন্তু একটা কথা বলতে পারি, অলিম্পিয়াস আমাদের অর্ডারের একজন সদস্য ছিলেন। আর তিনি এই কিউবের কথা জানতেন কারণ অর্ডারের একেবারে প্রথম দিককার এক সদস্যই এর সৃষ্টিকর্তা। সে হাজার হাজার বছর আগেকার কথা।”

হতভম্ব হয়ে গেল বিজয়। গত বছর টাক্স ফোর্সে যোগ দেবার পর ইমরান কিরবাঈয়ের কাছ থেকে যতটুকু জানতে পেরেছে তাতে ভেবেছিল যে তাদের অদৃশ্য প্রতিপক্ষ নিশ্চয় অত্যন্ত শক্তিশালী। তবে তারা যে এতটা প্রাচীন সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না। ভ্যান কুকের কথা যদি সত্য হয় তো এই অর্ডার গত বছর আবিষ্কৃত মহান অশোকের ব্রাদারহুডের চেয়েও আরো পুরনো।

বিজয়ের চমকে যাওয়া দেখে উল্লসিত হয়ে উঠল ভ্যান কুক, “তাই আমরা জানি যে ইন্দাস-ভূমিতে আলেকজান্ডারের অভিযান কোনো মস্তিস্কপ্রসূত কল্পনা নয়। যা চেয়েছিলেন তা খুঁজে পাবার রাস্তাও আমরাই সরবরাহ করেছিলাম।”

তবে এবার একটা ফোকর বের করল বিজয়, “এখানে একটা খটকা আছে।” পাল্টা মন্তব্য করে বলল, “আজ তার সেই রহস্য খুঁজছে। কিন্তু যেমনটা দাবি করলে যদি দুই হাজার চারশ কিংবা তার চেয়েও বেশি বছর আগে থেকেই উপায়গুলো জানো তাহলে তখনই কেন খোজোনি? কেন থালায় সাজিয়ে আলেকজান্ডারের হাতে তুলে দিলে, ধাতব পাতটাকেও লুকিয়ে রাখতে দিলে আর তারপর দুই হাজার বছর পর এসেছ খুঁজতে?”

ভ্যান ক্লকের চেহারাতে আঁধার ঘনাল, “কারণ অলিম্পিয়াস আমাদের সাথে ছল করেছিল। আলেকজান্ডারেরও হাজার বছর আগে থেকেই সুরক্ষিত ছিল এ রহস্য। মনে রাখবে এটা দেবতাদের রহস্য। ইন্দাস-ভূমির দেবতাদের। কিউব আর ধাতব পাতটাকেও এই কারণেই তৈরি করা হয়েছে যেন সিক্রেটটা আজীবন সুরক্ষিত থাকে। আর পাহারা দেবার জন্য সৃষ্টি হয়েছে বেদের পুরোহিতদের এক ছোট্ট ব্রাদারহুড। কেবল তারাই এটা জানত। অর্ডারেরও উৎপত্তি সম্পর্কে জানার অযুহাতে নিজ দরবারে পুরোহিতদের একজনকে আমন্ত্রণ করেছিলেন অলিম্পিয়াস। আর কোনো একভাবে পুরোহিতের কাছ থেকে সিক্রেট লোকেশনটাও জেনে নিয়েছেন। এরকম সীমালঙ্ঘনের জন্যই আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর অর্ডার তার উপর থেকে সব ধরনের প্রতিরক্ষাবহ সরিয়ে ফেলে। যদি অর্ডার নিরাপত্তা দিত তাহলে এতটা অবমাননাকর মৃত্যু সইতে হত না।”

“এটা কোন ধরনের অর্ডার?” আবারো নিজের প্রশ্নের ঝাঁপি খুলে বসল বিজয়।

কিন্তু মাথা নাড়ল ভ্যান কুক। “তোমাকে ইতোমধ্যেই আমি অনেকটুকু বলে ফেলেছি। শুধু জেনে রাখো যে আমরা মানবজাতির মতই পুরনো। এমন একটা সময় ছিল যখন সারা দুনিয়া আমাদের কথা জানত আর ভয়ও পেত। তারপর আমরাই সিদ্ধান্ত নিলাম যে লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকলেই প্রভাব প্রতিপত্তি খাটানোটা আরো সহজ হবে।”

আবারো শুরু করার আগে একটু বিরতি দিয়ে জানাল, “যাই হোক, আলেকজান্ডার সিক্রেটটা খুঁজে পেলেও তারপরের ঘটনাসমূহ জট পাকিয়ে যায় আর উনি মৃত্যুবরণ করেন। ইতিহাস নিশ্চয় জানো। তাঁর শেষকৃত্যের শবাধার টলেমি হাইজ্যাক করে আর মমি আলেকজান্দ্রিয়ায় সমাধিস্থ করে যা সেখানেই ছিল চতুর্থ শতক পর্যন্ত।”

“মানে, যখন রহস্যময়ভাবে গায়েব হয়ে গিয়েছিল।” বিড়বিড় করে নিজের গবেষণা স্মরণ করল বিজয়।

“গায়েব হয়ে যায়নি” জানাল আত্মতৃপ্ত ভ্যান কুক, “সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল খ্রিস্টানবাদ। চিহ্নগুলো আমরা পরিষ্কারভাবেই দেখেছি। পৌত্তলিক দেবতাদের সাথে সম্পৃক্ত সবকিছুই ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছিল। আর আলেকজান্ডারকে দেবতা হিসেবেই পূজা করা হত। বহু আগেই তার সমাধিস্থান ভেঙে মমি নষ্ট করে ফেলার কথা ছিল। তাই লাগাম টেনে নিলাম আমাদের হাতে। আলেকজান্দ্রিয়া থেকে মমি তুলে আরেকটা গোপন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হল। সেই সমাধিস্থান সম্পর্কে কাউকেই জানানো হয়নি। কিন্তু অর্ডারের অজ্ঞাতে একটা মানচিত্র তৈরি হল। এত শতক ধরে যা লুকানোই ছিল। মাত্র কয়েক দশক আগে দুর্ঘটনাবশতই তা আবার পুনরাবিষ্কৃত হয়েছে।

আমরা খনন করে মমিটাকে তুলেছি। যা আমাদের জন্য অত্যন্ত অনুগ্রহ বয়ে এনেছে বলতে পারো। তিনি যে সিক্রেটটা আবিষ্কার করেছিলেন শত শত বছর ধরে সে গল্প এক রূপকথায় পরিণত হয়েছে। আমরাও বিশ্বাস করিনি যে এমন কিছু সম্ভব। আর মমিটাকে পরীক্ষা করে দেখেছি। তখনই বুঝতে পারলাম যে রূপকথা আসলে সত্যি। দেবতাদের রহস্য আদৌ কোনো বানোয়াট নয়। আর আলেকজান্ডার প্রকৃত অর্থেই তা আবিষ্কার করেছিলেন। আর তখনই ঠিক করি যে এবার সিক্রেটটাকে খুঁজতে হবে। কিন্তু আমাদের হাতে কিউব আর ধাতব পাতটা ছিল না। তবে জানতাম, অলিম্পিয়াসের সাথে যে পুরোহিত দেখা করেছিলেন তার কাছেই এগুলো শেষবারের মত দেখা গিয়েছিল। কিন্তু মিটিংয়ের পরপরই উধাও হয়ে যান সেই পুরোহিত। আর, কেউ জানে না যে তার সাথে কী হয়েছিল। এরপর যখন অলিম্পিয়াসের সমাধি আবিষ্কৃত হবার সম্ভাবনার কথা শুনলাম, বুঝতে পারলাম যে কিউব আর ধাতব পাতটাও সেখানে পাবার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে।”

“তো এরপর কুপারকে খনন কাজে জড়িত করে স্ট্যাভরসকেও নিজেদের দল টেনে নিলেন?”

“ঠিক তাই। এখন তাহলে তুমি পুরো ব্যাপারটাই বুঝতে পেরেছ।”

ভ্রু-কুঁচকে ফেলল বিজয়, “আমাদের কাছে যেসব তথ্য ছিল তার ফাঁক ফোকরগুলো এবার ভরে গেল। আমি তো খনন কাজ আর ক্লিনিকাল ট্রায়ালের ভেতরেও কোনো না কোনো সম্পর্ক আছে অনুমান করেছিলাম। আলেকজান্ডারের মমির উপর তোমরা যে পরীক্ষা চালিয়েছ…তার ফলাফলকে বৈধতা দেবার জন্য ক্লিনিকাল ট্রায়াল জরুরি ছিল তাই না?”

হেসে ফেললেন ভ্যান কুক, “কাছাকাছি হয়েছে। তবে অংশত। আলেকজান্ডারের মমি পরীক্ষা করায় এমন কিছু জিনিস আবিষ্কৃত হয়েছে যার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। তাই ক্লিনিকাল ট্রায়ালগুলো জরুরি হয়ে পড়ে। দেখো, তোমাদের মহাকাব্য মহাভারত থেকে নেয়া এক পৌরাণিক কাহিনির উপর ভিত্তি করেই কিউবটার সৃষ্টি। আলেকজান্ডার যা পেয়েছেন আর তার উপর পরীক্ষা করে আমরা যা পেয়েছি এ সবকিছুই মহাকাব্যের একটা গল্পে হুবহু বর্ণনা করা আছে। তাই পরীক্ষার ফলাফল বোঝার জন্য জীবিত মানুষের উপর ক্লিনিকাল ট্রায়াল করাটা প্রয়োজন ছিল।

বিজয় নিজের মাথা খাঁটিয়ে মহাভারতের এমন কোনো কাহিনির কথা স্মরণ করার চেষ্টা করল যার সাথে কিনা ক্লিনিকাল ট্রায়াল আর দুহাজার বছর আগে মৃত্যুবরণ করা এক মৃতদেহের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফলের মিল পাওয়া যায়। কিন্তু মাথায় কিছুই এলো না।

“জানি না তুমি কিসের কথা বলছ। অবশেষে জানাতে বাধ্য হল বিজয়।

“ইংরেজিতে এর নাম মহাসাগর মন্থন অথবা আরো সঠিকভাবে বললে হয় সমুদ্রমন্থন।” ভ্যান ক্লক সংস্কৃত শব্দটা একেবারে নিখুঁতভাবে উচ্চারণ করলেও খেয়াল করল না বিজয়। মহাকাব্যের সবচেয়ে বিখ্যাত কাহিনিগুলোর একটি শোনার সাথে সাথেই পুরো মনোযোগ চলে গেছে সেদিকে।

“কিন্তু…কিভাবে?” দ্বিধায় পড়ে গেল বিজয়। “এ কাহিনি তো পুরোপুরি একটা ফ্যান্টাসি, অতি কল্পনা। অমৃত পাবার জন্য দড়ির মত ভাসুকি আর একটা পর্বতকে ব্যবহার করে মহাসমুদ্র মন্থন। এর পেছনে কোনো বিজ্ঞান নেই।”

অনুকম্পা দেখিয়ে হাসল ভ্যান কুক, “সবাই আসলে মহাভারতকে এক মহাকাব্যিক কবিতা কিংবা কাল্পনিক কাহিনি হিসেবেই ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তাই বিশ্বাসই করতে পারবে না যে এর পরতে পরতে লুকিয়ে আছে। বিজ্ঞান।”

সম্মত না হয়ে পারল না বিজয়। কারণ বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিই যে মহাভারতের অন্তঃস্থল গত বছরের আবিষ্কারই তা প্রমাণ করে দিয়েছে। আর এখন এও বেশ বুঝতে পারছে যে দু’হাজার বছর ধরে মহাভারতের মাঝে লুকিয়ে থাকা আরেকটা রহস্যের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে।

“চলো, তোমাকে ব্যাখ্যা করে শোনাই”, সামনে ঝুঁকে শুরু করল ভ্যান

.

৪৯. পঞ্চম দিন

রহস্যের এক ঝলক

সাক্সেনাকে হাসতে দেখে চোখ পিটপিট করল বিস্মিত রাধা। কোনো রকম ঘোষণা ছাড়াই ডাক্তার ওর সেলে এসে জানিয়েছেন যে মেডিকেল সেন্টারের চারপাশে হাঁটতে নিয়ে যাবেন।

“আমাকে বলা হয়েছে যেন তোমার দিকে খেয়াল রাখি।” খোশমেজাজে জানালেন সাক্সেনা, “কুপার তোমাকে এখানে নিয়ে আসায় হাতে আরো বেশি সময় পাওয়া গেল। মনে হচ্ছে তার প্রজেক্টের ডেডলাইন আরো কয়েকদিন বাড়ানো যাবে। মানে আমার অংশও বেড়ে গেল।”

সেল থেকে বেরিয়ে আগে কখনোই দেখেনি এমন সব করিডোরের গোলকধাঁধা ধরে হাঁটতে হাঁটতে ডাক্তারের কথা ভেবে দেখল রাধা। কিন্তু আয়তাকার একটা অ্যাট্রিয়ামের চারপাশের লম্বা ব্যালকনিতে পৌঁছে মাথা থেকে দূর হয়ে গেল সমস্ত চিন্তা। বিশাল স্থানটাকে আলোকিত করে তুলেছে ছাদের শক্তিশালী লাইট আর ব্যালকনির বাতি। অ্যাট্রিয়ামের চারপাশেই আছে এ ব্যালকনি। গুণে দেখল পুরো দালানে আটটা সিঁড়িপথ আছে।

সবিস্ময়ে ভেবে দেখল যে পুরো স্থাপনাটা তাহলে কত বড়। অথচ সেল থেকে টয়লেট ব্লক পর্যন্ত করিডোরের মাঝেই সীমাবদ্ধ ওর গতিবিধি। এজমালি টয়লেট আর বাথরুম এ কারাগারের অন্যান্য বন্দী নিবাসীদেরকে দেখলেও ধারণা করতে পারেনি যে দালানটা এত বড়।

“আড়াইশো সেল আছে।” রাধার দম বন্ধ ভাব দেখে জানালেন সাক্সেনা। “এই ফ্যাসিলিটির আটটা তলাই ভূগর্ভে তৈরি যা এখন চোখের সামনে দেখছ। মাটির উপর কেবল দুই তলা। তাই বাইরে থেকে পুরো ভবনটাকেই নিচু আর বৈশিষ্ট্যহীন দেখায়। কেউ জানেই না যে এখানে কী আছে।”

“কুপার কে?” প্রাথমিক বিস্ময় সামলে উঠে জানতে চাইল রাধা।

“তুমি জানো না? আমি তো ভেবেছিলাম যে আমেরিকান প্রত্নতাত্ত্বিক হয়ত তোমাকে জানিয়েছে। তার খনন কাজের কো-ডিরেক্টরই ছিল কুপার। পুরো নাম পিটার কুপার। আমরাই তাকে ওখানে নিয়োগ দিয়েছি।”

আরো একবার চমকে উঠল রাধা। তার মানে গ্রিসে এলিসের অভিজ্ঞতা আর এই লোকগুলোর মাঝে সম্পর্ক আছে। কিন্তু কী সেই সম্পর্ক? আর “আমরা” মানেই বা কী?

হঠাৎ করেই কথাটা মাথায় এলো। অন্যরা যখন মিউজিয়ামের দিকে যাচ্ছে তখন বিজয়ের সাথে যে আলোচনা হয়েছে তা মনে পড়ে গেল। বিজয় ওকে ইউমেনিসের জার্নাল আর আলেকজান্ডারের দেবতাদের রহস্য অভিযানের কথা বলেছিল। এটাই কি সাক্সেনার অপারেশন আর গ্রিসের প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজের মাঝে সম্পর্ক?

“তার মানে আপনারা কিউবের ধাঁধার মাঝে লুকায়িত সিক্রেট খুঁজে পাবার চেষ্টা করছেন?” জার্নালের কথা উল্লেখ না করেই জানতে চাইল রাধা। যদি জার্নালটা গোপনীয় হয় তাহলে সাক্সেনাকে জানানো উচিত হবে না।

রাধার দিকে তাকিয়ে মেয়েটাকে মেপে দেখলেন সাক্সেনা। “যতটা ভাব করছ তার চেয়ে তুমি আসলে বেশিই জানো। হ্যাঁ, ঠিক কথা বলেছ। এ পর্যন্ত পৃথিবী যা দেখেনি সেই মহারহস্য নিয়েই আমার কাজ। এর মাধ্যমে, কেউ ঘুণাক্ষরে ভাবতেও পারবে না এমনভাবে দুনিয়া শাসন করবে অর্ডার। লাগাম থাকবে আমাদের হাতে আর মানুষ সেই ইশারাতেই পুতুলের মত নাচবে।”

কৌতূহলী হয়ে উঠল রাধা। ষড়যন্ত্রের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তাই তাকে আরো জানতে হবে। সাক্সেনা গালভরা এসব কী বলছে। খানিকটা ফাঁকিবাজি করেই দেখা যাক না, “তো আপনি বলছেন যে অবজ্ঞাভরে বলে উঠল রাধা, “আমি এখানে যে ক্লিনিকাল ট্রায়াল দেখছি তার সমাপ্তি হল মানুষের মৃত্যু। সবাই মারা যাবে। এতে আর কী রহস্য আছে? অর্ডার কী তাহলে মৃতদের দুনিয়া শাসন করবে? আপনারা কি এমন কোনো নতুন জীবাণু আবিষ্কার করেছেন যা পৃথিবীর সব মানুষকে ধুয়ে মুছে সাফ করে দেবে? কেবল টিকে থাকবে অর্ডার? কেউ যদি না-ই থাকে তবে কার উপর আধিপত্য খাটাবেন?”

ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালেন সাক্সেনা, “আমরা মানুষকে খুন করব না” সহানুভূতির স্বরে জানালেন, “বরঞ্চ জীবন ফিরিয়ে দেব।”

স্পষ্ট অবিশ্বাসীর দৃষ্টিতে তাকাল রাধা, “আপনারা ভাবছেন যে, অর্ডারের হয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ করছেন। কিন্তু যেসব ক্লিনিকাল ট্রায়াল করছেন তার সবকটির ফলাফল হল শূন্য। ব্যর্থতা ছাড়া কিছু না।”

মেয়েটার কথা শোনামাত্র ক্রোধে জ্বলে উঠল সাক্সেনার চেহারা। নিজের কাজ নিয়ে তিনি অত্যন্ত গর্বিত। এমন কি সফলতার দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছেন বলা চলে। বহুদিন ধরে সেই স্বীকৃতির জন্য অপেক্ষা করছেন যার জন্য তিনিই যোগ্য। কিন্তু মিশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত অর্ডার কোনো ধরনের স্বীকৃতিই দেবে না। কিন্তু তার অর্জন কিন্তু কম নয়! আর এই মেয়ে, যে কিনা তার কাজ সম্পর্কে কিছুই জানে না অথচ তার সফলতাকে অবমূল্যায়ন করছে। কোনোভাবেই আর সহ্য হচ্ছে না এই আস্পর্ধা।

“আমি যা বলছি তা বিশ্বাস হচ্ছে না, না?” রাধাকে চ্যালেঞ্জ জানালেন সাক্সেনা, “তোমার ধারণা এসব কেবল ভবিষ্যহীন একটা ভাইরাস আর ক্লিনিকাল ট্রায়াল? তুমি…”

কথার মাঝখানে বাধা দিল রাধা, “আমার মনে হয় আপনি আপনার ছোট্ট একটা মিশনকেই ফুলিয়ে ফাপিয়ে বড় করছেন। কিন্তু আসলে তা না আপনার একটা কথাও আমি বিশ্বাস করি না।”

“ফাইন, তাহলে”, ক্ষেপে উঠলেন সাক্সেনা; প্রশংসা আর স্বীকৃতির আকাঙ্ক্ষায় পেয়ে বসল। তাছাড়া মেয়েটা তো আর কোথাও যাচ্ছে না। কেউ কখনো ওকে খুঁজেই পাবে না। “এসো আমার সাথে। চলো তোমাকে প্রমাণ দেখাই।”

এক সারি লিফটের দিকে এগিয়ে কার্ড রিডারে নিজের অ্যাকসেস কার্ড ঢুকিয়ে দালানের একেবারে নিচের তলার বোম চেপে ধরলেন। দ্রুত গতিতে নিচে নেমে গেল হাই স্পিড লিফট। একটু পরেই পৌঁছে গেল গন্তব্যে।

অর্ডার আর অলিম্পিয়াস কিভাবে কিউবটা পেলেন ও পারস্য সাম্রাজ্যে বিজয় লাভ ছাড়াও আরো বড় উচ্চাকাঙ্ক্ষার দিকে আলেকজান্ডারকে ধাবিত করলেন তার সবকিছু সংক্ষেপে খুলে বললেন সাক্সেনা। এরই মাঝে লিফটের ডোর খুলে যেতেই দেখা গেল দুপাশে সারি সারি দরজা সমেত সাদা, লম্বা, একটা করিডোর। বেশির ভাগই বন্ধ। তবে কয়েকটা খোলা থাকায় ভেতরে দেখা যাচ্ছে সব ধরনের যন্ত্রপাতি, ডিভাইস, সার্ভার আর মনিটরে বোঝাই ল্যাবরেটরি। আর সাদা ল্যাবরেটরি কোর্ট গায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে একগাদা টেকনিশিয়ান।

“আমার মিশনে আমাদের অপারেশনের প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে এই জায়গা।” ব্যাখ্যা করলেন সাক্সেনা, “আর আমাদের নিচের দুটো ফ্লোরে চলছে ফ্রিম্যানের প্রজেক্ট।” এরপর রাধাকে নিয়ে করিডোরের একেবারে শেষ মাথায় একটা অফিসে চলে এলেন। রুমটাতে ফার্নিচার বলতে বিশাল বড় একটা ডেস্ক আর এক কোণায় চামড়ার চেয়ার। বিপরীত দিকের দেয়ালের সাথে লাগানো হয়েছে স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি ওয়ার্ক স্টেশন। ডেস্কের এক পাশে লম্বা একটা বুককেস। মেডিকেলের ভারী সব বইয়ের ভারে বাঁকা হয়ে পড়েছে তাক। ডেস্কের উপর আরো আছে একটা এলসিডি মনিটর, কী-বোর্ড আর মাউস।

“বসো।” নিজে চামড়ার চেয়ারে বসে ডেস্কের ওপাশে থাকা দুটো চেয়ারের একটার দিকে ইশারা করলেন সাক্সেনা।

বসে পড়ল রাধা। ওদিকে কম্পিউটার, কী বোর্ড আর মাউস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন সাক্সেনা।

কিছুক্ষণ বাদে মনিটরটা রাধার দিকে ঘুরিয়ে দিলেন ভাইরাসবিদ। হাবভাব এমন যেন বিমূঢ় দর্শকের সামনে কোনো কিছু উপস্থাপন করছেন এক দক্ষ বিজ্ঞানী।

“তুমি ভাবছ যে আমরা জীবাণুর অপব্যবহার করে বায়োটেররিজম ঘটাতে যাচ্ছি।” তিরস্কার করে উঠলেন সাক্সেনা, “যা কিনা সত্যের চেয়ে লক্ষ লক্ষ গুণ দূরে। তুমি চিন্তাও করতে পারবে না কতটা দূরে। সত্যটা হচ্ছে ঠিক এর বিপরীত। আমরা কাউকে খুন করতে চাই না। বরঞ্চ রোগ ভোগের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে চাই।”

“আর আপনি আশা করছেন যে আমি এটা বিশ্বাস করব?” ব্যঙ্গ করে উঠল রাধা, “আপনি আর আপনার লোকজন মিলে যে গুরুতর অপরাধ করেছেন এখন সেটাকে একটা মহৎ উদ্দেশ্য হিসেবে মেনে নিতে হবে?”

“চুপ, একদম চুপ” কঠোরভাবে তিরস্কার করলেন সাক্সেনা, “প্রতিটা মুদ্রার দুটো পিঠ থাকে। তুমি তো কেবল একপাশ দেখেছ। শুধু গত কয়েকদিনের নয়, গত দশকে যা করেছি তার সবটুকুই আমাদের সফলতার জন্য প্রয়োজন ছিল। আমরা এক যুগান্তকারী বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছি; এমনকি আধুনিক প্রযুক্তিও যা আজ পর্যন্ত করে দেখাতে পারেনি। অথচ চিকিৎসা শাস্ত্রের এই বিপ্লবের পেছনকার মহারহস্য দুই হাজার বছর আগে থেকেই কয়েকটা ধাঁধা আর পৌরাণিক কাহিনির আড়ালে লুকায়িত ছিল। যেটির অস্তিত্বের কথা বেশির ভাগ লোক জানেই না; প্রহেলিকার জাল ছিন্ন করাতো বহু দূরের কথা।”

“আপনি যে কী বলছেন, সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই নেই।” স্বীকার করল রাধা।

“নিউজ পেপার তো পড়ো, নাকি না?”

রাধা মুখ কালো করে তাকালেও বুঝতে পারলো যে ভাইরাসবিদ সত্যিকারের আগ্রহ নিয়েই জানতে চাইছেন। তাই উত্তরে জানাল, “অবশ্যই পড়ি।”

“খুব ভালো। তাহলে নিশ্চয় আজকের দিনের চিকিৎসা শাস্ত্রের সবচেয়ে বড় ইস্যুটির কথাও জানো। বছরের পর বছর ধরে এ উদ্বেগের জন্ম হলেও গণমাধ্যমে মাত্র অতি সম্প্রতি চাউর হয়েছে। বহু বছর ধরেই মানুষ অ্যান্টিবায়োটিক অতি ব্যবহার আর অপব্যহার করছে।

ফলাফলে কী হচ্ছে? ব্যাকটেরিয়া জন্ম নিয়ে মানুষ জানে এমন কিছু ভয়ংকর রোগের ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা গড়ে তুলেছে। এসব প্রজাতির কিছু কিছু আবার অসংখ্য ড্রাগের বিরুদ্ধে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই একটা সত্যিকারের হুমকি হল পেনিসিলিনের আবিষ্কারের পর থেকে যে অ্যান্টিবায়োটিকস জীবন ধ্বংসকারী রোগ-বালাইয়ের বিরুদ্ধে বর্ম হিসেবে কাজ করে মানব শরীরকে সুরক্ষা দিয়েছে তা অতি সত্বর বিলীন হয়ে যাবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় প্রাণঘাতী যক্ষ্মারোগের হাত থেকে যে বর্ম এতদিন বাঁচিয়েছে তা দুর্বল হতে হতে সামনে নাই হয়ে যাবে। চিকিৎসাশাস্ত্রের ভাষায় বলতে গেলে আমরা আবার ইতিহাস-পূর্ব যুগে ফিরে যাবো; এমন এক অন্ধকার যুগ যখন ভয়ংকর সব ব্যাকটেরিয়ার ইনফেকশনের কোনো দাওয়াই ছিল না।”

মাথা নাড়ল রাধা। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এই বিষয়ের উপর অনেক প্রতিবেদন দেখেছে। অতি ভয়াবহ এই ভবিষ্যতের সাথে লড়াই করার জন্য আধুনিক বিভিন্ন প্রযুক্তির গবেষণার পাশাপাশি নতুন নতুন পথ আবিষ্কারের চেষ্টাও চলছে। একই সাথে রাধা এই দলটা যারাই হোক না কেন তাদের উদ্দেশ্যও বুঝতে শুরু করেছে। তার মানে ক্লিনিকাল ট্রায়ালের উদ্দেশ্য হল অ্যান্টিবায়োটিকসের স্থলাভিষিক্ত করার জন্য নতুন কিছু আবিষ্কার?” তবে এখনো বুঝতে পারছে না যে যে হুমকির কথা বললেন তার সাথে সাক্সেনা কেমন করে লড়াই করবেন।

পাশের কী-বোর্ডের একটা বোতামে চাপ দিলেন সাক্সেনা আর পর্দায় ধীরে ধীরে ফুটে উঠল একটা ত্রিমাত্রিক ইমেজ। বিশ মাথাঅলা একটা বহুভুজক্ষেত্র। আরেকটা বোতামে চাপ দিতেই ভাগ হয়ে গেল পুরো পর্দা। প্রথম ইমেজের ডান পাশে আরেকটা ত্রিমাত্রিক ইমেজ ফুটে উঠল। তবে এটার গড়ন গোলাকার আর এলোমলো।

“বামপাশে যা দেখছ তা হল একটা রেট্রোভাইরাস।” ব্যাখ্যা করলেন সাক্সেনা। প্রথম ইমেজটা দেখিয়ে বললেন, “আর ডান দিকে একটা ব্যাকটেরিয়া।” খানিক থেমে বললেন, “আগে এই দুটোই ছিল অজ্ঞাত, আর আমরা তা পেয়েছি গ্রেট আলেকজান্ডারের শরীর থেকে।”

.

৫০. ৩২৮ খ্রিস্টপূর্ব

বাল্ক, বর্তমান সময়ের আফগানিস্তান

“কী তোমাকে এত দুশ্চিন্তায় ফেলেছে, প্রিয় ক্যালিসথিনস?” উজ্জ্বল দৃষ্টিতে ইতিহাসবিদের দিকে তাকালেন আলেকজান্ডার। “যেভাবে এগোবার কথা সবকিছু তো সেভাবেই এগোচ্ছে। কাজ করেছে আমার পরিকল্পনা। আমরা পারস্য জয় করেছি। ব্যাকট্রিয়ার গোত্রগুলোকেও অধীনে এনেছি। এমন মহাশক্তিধর সগডিয়ান রককেও পরাভূত করেছি।” ক্যালিসথিনসের কাঁধে এক হাত তুলে দিয়ে বললেন, “আর, প্রিয় ইতিহাসবিদ, তোমাকে যে মিশনে পাঠিয়েছিলাম তাতেও তুমি সফল হয়েছ। সর্বশ্রেষ্ঠ এক মিশন। যেটি আমাকে একজন দেবতায় পরিণত করবে!” তরুণ বিজেতা ইতিহাসবিদের কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি যে কিছু নিয়ে ভাবছো সেটা আমি পরিষ্কারভাবেই বুঝতে পারছি। এবারে বলো কারণটা কী। আমাকে জানতেই হবে।”

আলেকজান্ডারের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকালেও দ্বিধা করছেন ক্যালিসথিনস। ক্লিটাসের ভাগ্য এখনো মন থেকে মুছে যায়নি। পারস্য সাম্রাজ্য বিজয়ের উদ্দেশ্যে মেসিডোনিয়া থেকে যে আলেকজান্ডারের সাথে যাত্রা করেছিলেন ইনি তিনি নন। তখন পিতার জন্য অভিযানে বেরিয়েছিল এক তরুণ। যার কাছে ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্যকে পরাজিত করার স্পর্ধা ও সাহস। আর তৃষ্ণা ও ক্লান্তির সাথে যুদ্ধ করে, ভয়ংকর ঠাণ্ডা ও অনাহারে থেকেও হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিতে নিজ বাহিনিকে উদ্দীপ্ত করে তোলার ক্ষমতা। সেই আলেকজান্ডারের জন্য হাসতে হাসতেও নিজের জীবন দিতে প্রস্তুত ছিল ক্যালিসথিন্স।

কিন্তু আজ সামনে যে আলেকজান্ডার দাঁড়িয়ে আছেন তিনি পুরোপুরি ভিন্ন মানুষ। সফলতাই কি তাকে এতটা উদ্ধৃত করে তুলেছে? প্রথমে দারিয়ুসের পতন আর বিসাস অধিগ্রহণ, দারিয়ুসকে হত্যা করে পারস্যের সিংহাসন দাবি করা, আর সবশেষে সগডিয়ান রক বিজয়ের পাশাপাশি ব্যাকট্রিয়ার গোত্রদের উপরেও পরিপূর্ণ মানুষের বোধশক্তি ঘুরিয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। আর আলেকজান্ডার তো এখনো তরুণ। নাকি এর কারণ মেসিডোনিয়া ত্যাগ করার পর থেকেই যার পিছনে ছুটেছেন সেই সিক্রেট মিশন? মাত্র কয়েকমাস আগেও এ সম্পর্কে কিছুই জানতেন না ক্যালিসথিনস; যখন ব্যাকট্রিয়ার জঙ্গল আর ওপাড়ে অক্সাস নদীর অ্যাসাইনমেন্ট সম্পর্কে জানিয়েছিলেন আলেকজান্ডার। বিসাস হিন্দুকুশ পার হয়ে ব্যাকট্রিয়ার আশ্রয় নেয়ার পরই পুরো সেনাবাহিনি নিয়ে পার্বত্যঞ্চল অতিক্রম করে ব্যাকট্রিয়ার পর্দাপণের সুযোগ পেয়ে যান আলেকজান্ডার।

যুদ্ধের এত ডামাডোল এমনকি অভিযানে যাত্রা শুরু করার পর আলেকজান্ডারের প্রথম পরাজয়ের মধ্যেও কেউ খেয়াল করেনি যে ক্যাম্প ছেড়ে বহুদিনের জন্য উধাও হয়ে গিয়েছিলেন ক্যালিসথিনস। ঠিক যেন ঘটনার পরিক্রমাও আলেকজান্ডারের পক্ষেই ষড়যন্ত্রে মেতেছে।

হয়ত তিনি সত্যিই জিউসের পুত্র আর তার স্বর্গীয় পিতা পুত্রকে খুঁজছেন। তারপরেও কেন যেন ক্যালিসথিনসের মনে হচ্ছে যে আলেকজান্ডারের এমনটা করার কোনো অধিকার নেই।

“মহারাজা” সাবধানে বলে উঠলেন ক্যালিসথিনস, “আপনি অনেক বদলে গেছেন।”

“আসলেই।” ইতিহাসবিদের পিঠ চাপড়ে দিলেন উৎফুল্ল আলেকজান্ডার। আজকাল প্রায়শই যা ঘটছে, প্রচুর পরিমাণে ওয়াইন পান করায় উচ্ছ্বসিত হয়ে আছেন আলেকজান্ডার।

আর ক্যালিসথিনস এও দেখেছেন যে কতটা দ্রুত এই অভিব্যক্তি পাল্টে গিয়ে হয়ে ওঠেন দুর্বিনীত আর প্রতিহিংসা পরায়ণ।

“মনে হয় এ সম্পর্কে অন্য কোনদিন কথা বললেই ভালো হবে।” আলেকজান্ডারের ক্রোধকে আর বাড়াতে চান না। ক্ষিপ্ত না করে রাজাকে সত্যিকারের উত্তর দেয়াটা সম্ভব নয়।

আর ক্যালিসথিনস মিথ্যেও বলেন নি। হয়ত নিজের লেখায় বিজেতা সম্পর্কে একটু বেশিই প্রশংসা করেছেন আর অতি কল্পনার মিশেল ঘটিয়েছেন যাতে বৃদ্ধি পায় তার রাজার মহিমা। কিন্তু স্বয়ং রাজার কাছে সৎ না থেকে পারবেন না। এটাই তার স্বভাব।

এবারে ক্যালিসথিনসের চোখের দিকে তাকালেন আলেকজান্ডার। “তো” চিন্তিত ভঙ্গিতে নিজের চিবুকে হাত বুলিয়ে জানালেন, “মনে হচ্ছে আমার ইতিহাসবিদ আরো কিছু বলতে চায়। এমন কিছু যা সে ভাবছে আমি পছন্দ করব না।”

আলেকজান্ডারের এমন উপলব্ধিকে ঘৃণা করেন ক্যালিসথিনস্। তিনি কিছুই। বললেন না।

“দেখো, ক্যালিসথিনস” তাগাদা দিলেন আলেকজান্ডার, “তুমি ভাবছ আমি বেশি ওয়াইন খেয়ে ফেলেছি? আর সে কারণে তোমার কথা বুঝতে পারব না? তুমি হচ্ছ আমার শ্রদ্ধাভাজন ইতিহাসবিদ। এ কারণেই অন্য কারো কথা এতটা মনোযোগ দিয়ে শুনি না, যতটা না তোমার! খুলে বলল কী তোমাকে এত পেরেশান করছে? প্রতিজ্ঞা করছি যে সবটুকু শুনব।”

ক্যালিসথিনস উপলব্ধি করলেন যে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। এখন এই আলোচনাকে রহিত করার প্রচেষ্টাই বরঞ্চ আলেকজান্ডারের মনে নেতিবাচক ধারণার জন্ম দিবে।

“ঠিক আছে, মাই কিং” গভীরভাবে দম নিয়ে জানালেন ক্যালিসথিন “আপনার ঘোষণা শুনেই আমার যত দুশ্চিন্তা হচ্ছে। আপনি চান যেন পারসীয় প্রথায় আপনার উপাসনা করা হয়।”

এত জোরে হেসে ফেললেন আলেকজান্ডার যে দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হল সে আওয়াজ। “আর তুমি তাতে সম্মত নও?”

একেবারে চুপ করে রইলেন ক্যালিসথিনস।

চিন্তায় পড়ে গেলেন আলেকজান্ডার, “কেন তোমার মনে হচ্ছে যে এটা ভুল?” অবশেষে জানতে চাইলেন, “তুমিই তো দুনিয়াকে জানিয়েছ যে আমি জিউস আমোনের পুত্র। যা একদিন ইতিহাস লিখবে তোমার সেই বই-ই তো

আমার দেবত্ব সম্পর্কে সিউয়ার ওরাকলের স্বীকৃতির কথা প্রচার করেছে। সমুদ্রকে দু’ভাগ করে ফেলার কথা তুমিই লিখেছ।” মাথা তুলে ক্যালিসথিনসের দিকে তাকালেন, “মনে নেই? আরো আছে” ক্যালিসথিনসের কাঁধে এক হাত তুলে দিয়ে বললেন, “ক্যালিসথিনস তুমি তো বিশ্বাস করো যে আমি একজন দেবতা। নিশ্চয় মিথ্যে লেখো না। আর যদি তাই হয় তত আমাকে দেবতা হিসেবে উপাসনা করার বাসনাকে কেন ভুল ভাবছ?”

উত্তর দিলেন না ক্যালিসথিনস। বুঝতে পারলেন যে আসলে আলেকজান্ডারকে দেবার মত তার কাছে কোনো উত্তর নেইও। রাজা যা যা বলেছেন তার সবকিছুই সত্যি। কেবল ক্যালিথিনস যে তার দেবত্বে বিশ্বাস করে সেটুকু ছাড়া। কিন্তু কিভাবে জানাবেন যে বইয়ে তিনি কতটা তোষামোদ করেছেন? দেবতা হবার পরেও আলেকজান্ডারের দরবারে নিজের পদমর্যাদা টিকিয়ে রাখার আশায় করেছেন?

 “তোমার নীরবতা অসহ্য লাগছে।” গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন আলেকজান্ডার, “আমি কি এটাকে হ্যাঁ অর্থে ধরব? নাকি না? কেবল তুমিই দিতে পারো এর উত্তর। আমি কিন্তু ওয়াদানুযায়ী তোমার কথা শুনেছি।”

“আপনি যা বলেছেন মহারাজা, তা সত্য।” ব্যাকুল হয়ে এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি চাইছেন ক্যালিসথিনস। “প্রতিটা শব্দই সত্য।” গলার স্বর প্রায় ফিসফিসের পর্যায়ে নামিয়ে জানালেন, “কিন্তু, মিশন এখনো শেষ হয়নি। যখন গোপন সেই স্থানে পৌঁছে নির্দেশ মত পানি পান করবেন তখুনি কেবল দেবতা হয়ে উঠবেন! এখন না।”

জ্বলে উঠল আলেকজান্ডারের চোখ, “তত তোমার ধারণা মায়ের দেয়া মানচিত্রের প্রতিটি পদক্ষেপ অনুসরণ না করা পর্যন্ত আমি দেবতা নই?”

চোখ নামিয়ে নিলেন ক্যালিসথিনস।

এর সঠিক ব্যাখ্যা করে আলেকজান্ডার ধরে নিলেন যে তার প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে “হ্যাঁ।”

“তাহলে দেবতা থেকে জাত আমার জন্ম? আমার মা কি মিথ্যে বলেছে যে সে জিউসের সাথে থেকেছে? তুমি জানো আমি ওই অপদার্থ ফিলিপের পুত্র হতে পারি না!” উচ্চারিত প্রতিটা শব্দের সাথে বেড়ে যাচ্ছে আলেকজান্ডারের রোষ। “আর সিউয়া’র অরাকলের শব্দ, তোমার কাছে সেসবের কোনো মানে নেই? এটাও মিথ্যে?”

কথা বলতে বলতে দুজন পার হয়ে এলেন একটা কাঠের টেবিল যেটিতে পায়ার উপরে ভারসাম্য রেখে দাঁড়িয়ে আছে একটা তামার তৈরি থালা। আক্রোশ থামাবার চেষ্টায় নিচু হয়ে থালাটাকে তুলে করিডোরে ছুঁড়ে মারলেন আলেকজান্ডার। “ক্যালিসথিনস, আমার জন্ম আর দেবত্ব নিয়ে কথা বলার তুমিই বা কে? একজন ইতিহাসবিদ বৈ তো আর কিছু নও! তোমার কাজ হচ্ছে ঘটনার রেকর্ড রাখা। যা ঘটছে ইতিহাস যেন তা জানতে পারে সেটা নিশ্চিত করা। বিচার করা নয়। কখনো ভুলবে না যে আমি তোমার রাজা। আমার হাতেই আছে তোমার জীবন। ঠিক আমার রাজ্যের অন্যান্য প্রজাদের মতন। যা এখন মেসিডোনিয়া থেকে ব্যাকট্রিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। এটা কি একজন দেবতার শক্তি নয়? জীবন কেড়ে নেয়া?”

ক্যালোসথিনস বুঝতে পারলেন যে আলোচনায় সমাপ্তি টানবার সময় পার হয়ে গেছে। নিজের রাজাকে তিনি ভালো ভাবেই চেনেন। এরই মাঝে ইতিহাসবিদের ভাগ্য নির্ধারণ করে ফেলেছেন আলেকজান্ডার। জানেন কী ঘটতে চলেছে। আর মৃত্যুর মুখে পড়েও তিনি কাপুরুষের ন্যায় আচরণ করতে চান না।

“একজন দেবতার শক্তি হল” শান্ত স্বরে ক্রোধে উন্মত্ত রাজাকে জানালেন ক্যালিসথিনস, “জীবন কেড়ে নেয়া নয় বরঞ্চ দান করা। আর এক্ষেত্রেই আপনি ব্যর্থ হয়েছেন।”

ক্ষোভে উত্তপ্ত কড়াইয়ের মত ফুটছে আলেকজান্ডারের রাগ, “আমি আলেকজান্ডার! দেবতা হিসেবে পূজিত হবার জন্য আমার তোমাকে কিংবা তোমার সমর্থনের কোনো প্রয়োজন নেই।” সমস্ত ইন্দ্রিয়ে ক্রোধ ছড়িয়ে পড়ায় চিৎকার করে উঠলেন, “দেবতা হবার জন্য তোমার গোপন উপকরণেরও কোনো প্রয়োজন নেই। আমি একজন দেবতা আর তাই আমার উপাসনা করা হবে। তোমার কিংবা আর কারো ধারণাকেই কোনো পরোয়া করি না! গার্ড!”

আলেকজান্ডারের চোখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন ক্যালিসথিনস, “পেট্রোক্লাস আপনার চেয়ে বহুগুণে শ্রেষ্ঠ একজন মানুষ ছিলেন, আলেকজান্ডার। কিন্তু তারপরেও মৃত্যু তাঁকে ছাড়েনি।”

গার্ডেরা এসে ক্যালিসথিনসকে চেপে ধরতেই নিষ্ঠুরভাবে হাসলেন আলেকজান্ডার, “এখন আমি বুঝতে পারছি যে বালক-ভূতেরা (Pageboy) কিভাবে আমাকে গুপ্তহত্যার চেষ্টা করার সাহস পেয়েছিল। আমার একেবারে কাছের কেউ তাদেরকে এ বিদ্রোহে উসকানি দিয়েছে। আর সেই সুযোগও। তখন অবাক হয়ে ভেবেছিলাম যে সে কে হতে পারে। কিন্তু এখন জেনে গেছি; তুমিই, তাইনা ক্যালিসথিনস? আর আগামীকালও সেই চেষ্টা করবে। তাই বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি হল ক্রুশবিদ্ধ হওয়া। তুমি সেটা ভালোভাবেই জানো, বিদায় বন্ধু!”

চলে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়ালেও ক্যালিসথিনস এখনো শেষ করেন নি। আর গার্ডেরা টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাবার সময় ইতিহাসবিদের মুখ থেকে উচ্চারিত শব্দগুলো শুনে যেন জমে গেলেন আলেকজান্ডার।

“আপনি হয়ত দেবতা হবার ভান করছেন আলেকজান্ডার। বিশ্বাস করছেন। যে আপনি একজন ঈশ্বর। কিন্তু তা কখনোই হতে পারবেন না। মেসিডোনিয়াতে ফেরার আগেই মৃত্যুবরণ করবেন! জন্মভূমিতে আর পা রাখতে পারবেন না!”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *