অভিরতি

অভিরতি

গাঁয়ের নামে নাম বউটির।

পাহাড়ঘেঁষা রুম্ফ গ্রামটার নাম ভবানী। আর মহেশকরের ঘরের বউয়ের নাম ভবানীবাঈ।

তা বিয়ের আগে নামের মুখরক্ষা করেছিল বটে মেয়েটা। মারাঠী রাজপুত দলবী। ঘরের মেয়ে। পোষ মানাতে গেলে ফোঁস করে ওঠা স্বভাব। তার ওপর ছেলেবেলা থেকে মাথার ওপর কড়া অভিভাবক না থাকার ফলে অপরিণত বয়সের স্বাধীন ইচ্ছায় বাধা-বিঘ্ন তেমন পড়ে নি। ভাই ফৌজে চাকরি করে। বছরে দু-বছরে কখনো-সখনো। এসে দু-দশদিনের জন্য ঘুরে যায়। বাপ অন্ধ। বসন্ত হয়ে প্রথমে একটা চোখ গিয়েছিল, পরে দ্বিতীয়টারও দৃষ্টি গেছে। দারিদ্র্যের সংসার সামাল দিতে দিতেই মায়ের হিমসিম অবস্থা, মেয়েকে আগলাবে কখন?

ফলে সময়ে বিয়েও হয় নি মেয়েটার। ওদের ঘরে ছোট বয়সে বিয়ে হয়। তার ওপর চোখে পড়ার মতো চোখা রূপ নেই যে কেউ সেধে এসে ঘরে নিয়ে যাবে। মোটামুটি সুশ্রী হলেও দুরন্তপনা আর বেয়াড়াপনার ফলে চেহারায় একটা পুরুষালি কাঠিন্য দিনকে দিন বেশি প্রাধান্য লাভ করছিল। তার জ্বালায় অস্থির পড়শিনীদের অনেক সময় মন্তব্য করতে শোনা গেছে, ওটা মেয়ে না হয়ে ছেলে হলে অন্ধ বাপের কাজে লাগত, ও-মেয়ে নির্ঘাত হাত-পা ভেঙে বাপের বোঝা হবে একদিন।

পারলে এমন মেয়ের হাত-পা হয়ত ভেঙেই দিত কেউ। হাত-পা, অল্প-স্বল্প ভেঙে একটু শিক্ষা হোক এমন আশাও যে কেউ করে না এ-কথাও হলপ করে বলা যায় না। ভোর হতে না হতে ছেলেমেয়ের দঙ্গল নিয়ে ভবানী হুড়মুড় করে একেবারে ওই পাহাড়ের ডগায় গিয়ে উঠবে। পাহাড়টার আড়াল থেকে সূর্যোদয় হয় বলেই ওটার নাম সূর্য পাহাড়। সূর্যোদয় দেখে তারা আবার দৌড়ঝাঁপ করে নেমে আসে। এই ওঠা-নামার রেষারেষিতে ছেলেরাও পেরে ওঠে না তার সঙ্গে। আর ওই মেয়ে জখম হওয়ার বদলে একটু আধটু জখম অন্যের ছেলেমেয়েরাই হয়।

পাহাড়ের অনতিদূরে ছাতলি নদী। নামেই নদী, বারো মাস শুকনো নুড়িপাথরের হাড়-পাঁজর বার করেই আছে। ওই শুকনো নদীতেই হুটোপুটি করে সকলে, আর দৈবাৎ কখনো বেশি বর্ষা হলে বা বান ডাকলে আশেপাশের বাসিন্দারা প্রমাদ গোনে। ওই দস্যি মেয়েকে তখন রুখবে কে, সকাল-সন্ধ্যায় চারবার করে সেই খরজলে। ঝাপাঝাপি করবেই। করুক, তাতে আপত্তি নেই, কিন্তু সেই সঙ্গে ঘরের ছেলেমেয়েদেরও যে ঠেকানো-যায় না। একবার তো একজনের মেয়ে ডুবতে ডুবতে বেঁচেছে, আর একবার একটা ছেলে পাথরে চোট খেয়ে পুরো একদিন অজ্ঞান হয়ে ছিল।

এটা মৌজা গ্রাম, অর্থাৎ দোকান-পাট, হাট-বাজার নেই। ভবানী রোজ কসবায় যায় হাট-বাজার সওদাপত্র করতে। যেখানে ওসব আছে তার নাম কসবা। তা সেখানেও নিত্য ঝগড়া করে আসে। যে দামে যে জিনিস পাওয়ার অভিলাষ তা আদায় না করে নড়বে না। দোকানীকে কটু কথা বলবে, সুবিধে বুঝে ভয়ও দেখাবে।

সকলেই তিক্ত বিরক্ত তার ওপর।

এরপর আরো কিছু বয়েস হতে মেয়েটার দুরন্তপনা অতটা প্রত্যক্ষগোচর না হোক, তার বেয়াড়াপনার আঁচ সকলেরই গায়ে লাগে। মেয়ের বিয়ে নিয়ে ওর বাপ-মাকে দুকথা শোনাতে গেলে, এমন কি দুটো সৎ পরামর্শ দিতে গেলেও ওই মেয়ের রসনার ঘায়ে পালাবার পথ মেলে না! অথচ, এ ব্যাপারেও তাদের তৎপর না হয়ে উপায় কি? উঠতি বয়েসের ঘরের ছেলেগুলো যে ওর আশেপাশেই ছোঁক ছোঁক করে বেড়ায়!

শেষে ওদের একঘরে করারই মতলব কেঁদেছিল পাড়াপড়শীরা। এত বয়েস। পর্যন্ত অমন মেয়ে ঘরে পুষে রাখাটা অপরাধেরই সামিল। কত বুড়ো-হাবড়া। অন্ধ-খঞ্জ আছে, একজনের হাতে গছিয়ে দিলেই তো হয়।

বয়স্ক মাতব্বরেরা কথাটা তুলল গাঁয়ের পাটিল ও মোড়ল কেশরকরের কাছে। কেশরকর প্রায় বৃদ্ধ, কিন্তু বেশ সবল পুরুষ। মস্ত যোদ্ধাবংশের সন্তান, তাকেও বীরপুরুষ জ্ঞানে মান্যগণ্য করে সকলে। তাদের বীর-বংশের অনেক কথা আজও উপকথা হয়ে আছে। এই গুণেই গাঁয়ের পাটিল সে। গ্রামের বিপরীত প্রান্তে থাকে। দূরে থাকলেও সূর্য পাহাড়ের ধারের এক দুর্বিনীত দুরন্ত মেয়ের খবর তার কানে। আগেই এসেছিল।

এর বিহিত করতে গিয়েই এক তাজ্জব ব্যাপার ঘটল। শুনে গ্রামবাসীরা অন্তত তাজ্জব বনে গেল। পাটিল কেশরকর নিজে এলো ভবানীর অন্ধ বাপের সঙ্গে দেখা করতে, সেই সঙ্গে তার দৃপ্ত মেয়েটাকেও দেখল। ডাকতে হয় নি, বাপের বিচার হবে কথাটা কানে আসতে কোমরে হাত দিয়ে নিজেই সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল।

তারপর বৃদ্ধ মোড়লকে আরো দুই-একদিন এসে মেয়ের বাপের সঙ্গে শলাপরামর্শ করতে দেখা গেল। অন্ধ বাপ তার দু-হাত ধরে আনন্দে গদগদ।

পাটিল একটা বিহিতের মতোই বিহিত করল বটে। শুনে প্রথমে হাঁ হয়ে গেল সবাই। কেশরকর নিজের ছেলে মহেশকরের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেছে ভবানীর।

প্রথম বিস্ময় কাটতে সকলের হাড়ে হাতাস লাগল। মেয়েটা মোক্ষম জব্দ হবে এইবার।

ঈর্ষার বদলে তাদের এই আনন্দেরও বিশেষ একটা কারণ আছে। মহেশকর বিপত্নীক। বছর দেড়েক হল, ওর বউ রাণীবাঈ আত্মহত্যা করেছে। রাণীবাঈয়ের রূপ ছিল। সেই রূপের জোরেই বোধহয় দুর্দান্ত একরোখা মহেশকরকে সে বশ করতে পেরেছিল। দুজনে দুজনকে ভালোবাসতও খুব। সেই রাণীবাঈ আত্মঘাতিনী হল। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেউ তার নিন্দা করে নি, বরং তাকে মহীয়সী বলেছে। আত্মঘাতিনী হবার কারণ, ছেলেমানুষি কৌতূহল নিয়ে সে কার্তিক পুজো দেখে ফেলেছিল। সংস্কার, সধবা স্ত্রীলোক কার্তিক পূজো দেখলে তার অবশ্যম্ভাবী ফল বৈধব্য। রাণীবাঈ অতশত জানত না, পরে জানল। জেনে নিজের হাতে বৈধব্যযোগ খণ্ডন করে দিয়ে গেল।

মহেশকর ফৌজে চাকরি করে তখন, বিদেশেই থাকে। বীর-বংশের ছেলে বীরপুরুষই হয়–অল্প সময়ের মধ্যেই সে হাবিলদার হয়েছিল। সুযোগ সুবিধে পেলেই এবার বউকে নিয়ে আসবে ভাবছিল। তার মধ্যে এই দুর্ঘটনা। শুনেই দেশে ছুটল সে। তারপর চেষ্টাচরিত্র করে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে বসল।

সকলেই প্রায় বউয়ের নামে ধন্য ধন্য করল তার কাছে। এমন কি মহেশকরের বাপ-মাও। কিন্তু দুই-একজন অতি নির্ভরযোগ্য পড়শী-বন্ধু তার কান বিষিয়ে দিয়েছিল। তারা আড়ালে জানালো রাণীবাঈ বৈধব্যযোগ খণ্ডন করার জন্য আত্মত্যাগ করেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু তার আগে কার্তিক পূজো দেখে ফেলার অপরাধে শ্বশুর-শাশুড়ীর গঞ্জনাও বড় কম ভোগ করে নি। একমাত্র ছেলের শঙ্কায় তারা বউয়ের ওপর বিলক্ষণ ক্রুদ্ধ হয়েছিল।

দুনিয়ায় শুধু এই বাপের মুখের দিকে চোখ তুলে কখনও কথা বলে নি মহেশকর। এরপরেও বলল না। কিন্তু বাপের সঙ্গে একটা নীরব বিচ্ছেদ সৃষ্টি হয়ে গেল।

আবার বিয়ের কথা শুনে ভিতরে ভিতরে ফুঁসে উঠল মহেশকর। বাধার আভাস পেয়ে কেশরকর জানিয়ে দিল, বিয়ে না করলে বাপের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক থাকবে না। অতএব মহেশকর বাধা দিল না। সে চাকরি করে না, বর্ধিষ্ণু বাপের সঙ্গে সম্পর্ক ঘুচে গেলে তার চলবে না। এই সঙ্গে বন্ধুবান্ধবের পরামর্শে শেষ পর্যন্ত সে আর আপত্তি করল না। কিন্তু বাপের সুনজরে পড়ে রাণীবাঈয়ের জায়গা দখল করতে যে মেয়েটা আসছে–সব রাগ বিদ্বেষ গিয়ে পড়ল তার ওপর।

 এদিকে সকলের হাড় জুড়লো, কারণ তারা ভাবল যোগ্যে যোগ্য মিলন হয়েছে। যেমন বেয়াড়া মেয়ে, তেমনি মুগুর জুটেছে। আক্কেল হয়েছে।

মহেশকরকে এখনও ভয়ই করে সকলে। ওই ছেলে ফৌজে চাকরি না করলে, বা এভাবে প্রথম বউ না মরলে, তার দাপটে গাঁয়ে টেকা দায় হত বোধ করি। যেমন রগচটা তেমনি একরোখা! তবে ফৌজী দলে ছিল বলে, আর নিজেকে বীরপুরুষ ভাবে বলে, আগের সেই ছেলেমানুষি অত্যাচারের ঝোঁক গেছে। সমবয়সীরা এখন তাকে তোয়াজ করে চলে–গাঁয়ের খণ্ডোবার সঙ্গে তার তেজস্বিতার তুলনা দেয়। ঘোড়ায় আসীন অসি-হস্তি খণ্ডোবা হলেন দেশক্ষক দেবতা–মহাদেবের অবতার।

মদের গেলাসের ইয়ার-বন্ধুরা ঠাট্টা করল–স্বয়ং ভবানী আসছেন, এবারে কার দাপট বেশি দেখা যাক।…এরও তাৎপর্য আছে, ভবানী হলেন গ্রাম-রক্ষয়িত্রী দেবী –প্রতি গ্রামেই ভবানী-মূর্তি আছে।

আশা সফল হল। বিয়ের মাস না ঘুরতেই দেব-দেবীর খণ্ডযুদ্ধ বেধে গেল। একে তো কার জায়গায় এসে বসেছে নতুন বউ সেই হিসেব করে চলে না, তার ওপর চোখ রাঙাতে গেলে ফিরে যে-ভাবে তাকায়, তা বরদাস্ত করার মানুষ নয়। মহেশকর। তাছাড়া বাপ এনেছে বলে রাগ তো আছেই। ভ্রূকুটি গ্রাহ্য করে না বলে। হাত নিশপিশ অনেকদিন থেকেই করছে, কিন্তু সেদিন মৃতা রাণীবাঈ সম্পর্কে কি একটা উক্তি করে বসতে আর সহ্য হল না। হাতের লোহার মতো পাঁচটা আঙুল ভবানীবাঈয়ের গালের ওপর ফুটে উঠল।

হতভম্ব ভবানী অতিকষ্টে চোখের জল সামলালো। দাঁতে করে ঠোঁট কামড়ে খরচোখে মুখের দিকে চেয়ে রইল।

মহেশকর শাসালো, এই মুখে ফের ওই নাম আনবি তো মুখ একেবারে ভেঙে দেব।

সেই থেকে শুরু। ভবানী ওই নাম মুখে এনেও মার খেয়েছে, আর স্বামীর দাপটের ওপর দাপট করেও মার খেয়েছে। বউ শাসন করা একটা মনের মতো কাজ হয়েছে। মহেশকরের। আর ওই জেদী দুর্বিনীত মেয়েকে শাসন করার ব্যাপারে একটা সুবিধেও আছে। অত মার খেয়েও জোরে কাঁদে না, কাঁদেই না বলতে গেলে। আর শ্বশুরের কাছে নালিশও করে না। শ্বশুর বাড়ি না থাকলে সমান তালে রুখে ওঠে, ফলে আরো বেশি মার খায়। রাগে বিদ্বেষে ভবানীবাঈ এক-একসময় স্বামীর লোকান্তরিত প্রিয়া অর্থাৎ রাণীবাঈয়ের উদ্দেশেও কটুক্তি করে বসে। ফল কি হবে জেনেও করে। অন্ধ আক্রোশে কিল-চড় পড়তে থাকে তখন। ভবানীরও শক্ত সবল হাত আছে দুটো, যতক্ষণ সম্ভব যোঝে সে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত হাল ছাড়তে হয়। অমন অসুর শক্তির সঙ্গে সে পারবে কেন!

কিন্তু হাল ছাড়লেও হার মানে না। ফলে মহেশকরের বউকে শায়েস্তা করার গোঁ আরো বাড়ে।

এই পুরুষের রাতের নিভৃত বাসনার মুহূর্তগুলিও কেমন নির্মম হিংস্র মনে হয়। ভবানীর। মহেশকর জঠরে মদ ঢেলে বাসনার তাপ জুড়তে চেষ্টা করে প্রথম। এক-একসময় বিফল হয় যখন, তখনই শুধু কাছে আসে। আর আসে যখন, ভবানীর ওপর দিয়ে একটা বড় রকমের ধকল যায়। নিষ্ঠুর জড় পেষণের মতো লাগে। মায়ামমতাশূন্য পরপুরুষ কবলিত মনে হয় নিজেকে।

বছর না ঘুরতে কেশরকর হঠাৎ চোখ বুজল। মহেশকরের বউ শাসনের স্বাধীনতা আর একটু বাড়ল। এই করে আরো দুটো বছর কেটে গেল। স্বভাবের ধাত বদলায় নি কারো। কিন্তু ভিতরে ভিতরে দুজনেই কিছুটা শ্রান্ত।

দোলের দিন সেটা। এখানকার যোদ্ধাবংশীয়রা এই দিনে ঘটা করে বীর-উৎসব। করে। মহেশকরের বাড়িতেও এই বীর-উৎসব বহুকাল ধরে চলে আসছে। এ সবে মহেশকরের উৎসাহ খুব। শিবপূজাতেও সে বীরের মতো শোণিত-সুরার অর্ঘ্য দেয়। মদের পাত্রে নিজের বাহু কেটে অনেকটাই রক্ত দিয়ে ফেলে। প্রথমবার তার রক্ত দেওয়া দেখে ভবানী ভিতরে ভিতরে একটু শঙ্কিত হয়েছিল।

হোলির সন্ধ্যায় অতিথি-অভ্যাগতরা এসেছে মহেশকরের বাড়িতে বীর-পূজায় যোগ দিতে। একটু আগে মদ খেয়ে আগুনের চারদিকে নাচ-গান করেছে সকলে। মেয়ে-পুরুষে আগুনের চারদিক ঘিরে বসেছে। এইবার মৃত বীর ব্যক্তিদের উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানানো হবে, তাদের যশের কথা, খ্যাতির কথা, বীরত্বের কথা বলে এই উৎসবে আবাহন করা হবে তাদের। বিশ্বাস, তাদের আত্মা আসে, এক-এক সময় কোনো একটি আত্মা এসে ভর করে তার পরিবারের বা অন্য কারো ওপর। ভর হলে মহা আনন্দের ব্যাপার। যার ওপর ভর হয়, সে অজ্ঞান হয়ে যায়। তার মুখ দিয়ে মৃত আত্মা তখন কথা বলে।

সকাল থেকেই ভবানীর শরীরটা অসুস্থ ছিল। সেও ঘরের এক কোণে চুপচাপ বসে আছে, থেকে থেকে ঝিমুনি আসছে।

মৃত আত্মার স্তুতি এবং আবাহনের মাঝামাঝি সময়ে দেখা গেল, সে হঠাৎ ঢলে পড়েছে! হাত-পা ছুঁড়ে কার সঙ্গে যেন যুঝতে চেষ্টা করল একটু, তার পরেই জ্ঞান। হারালো।

হকচকিয়ে গেল সকলেই। মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। মৃত আত্মা রমণীর ওপরে ভর করে এ-রকমটা শোনা নেই বড়।

সহসা চমকে উঠল সকলে। ভবানীবাই আস্তে আস্তে উঠে বসেছে। তার চোখমুখ স্বাভাবিক নয় খুব। উজ্জ্বল দুই চক্ষু মেলে সে চেয়ে আছে মহেশকরের দিকে।

-আমি রাণীবাঈ এসেছি!

সকলে নির্বাক। মহেশকর বিমূঢ় বিভ্রান্ত। এ-রকম কণ্ঠস্বরও যেন কেউ শোনে নি আর।

তেমনি স্থির স্পষ্ট স্বরে ভবানীবাঈয়ের মুখ দিয়ে রাণীবাঈ বলে যেতে লাগল, তার স্বামী বীর, বীর স্বামীর ভালোবাসার টানে সে কোথাও যেতে পারছে না; সর্বদা পাশে পাশে ঘুরছে। আজ সপত্নীর আশ্রয়ে সে স্বামীর কাছে এসেছে–এসেছে, কারণ। স্বামী সর্বদাই তাকে স্মরণ করছে। এই আশ্রয় সে সহজে ছাড়বে না, স্বামীর মন বুঝে দুঃখ-বেদনা বুঝে, সে মাঝে মাঝে আসবে।

ভবানীবাঈয়ের দুচোখ আবার ঘোলাটে হয়ে আসতে লাগল। মাথা আবার ঢলে পড়ল।

ঘরের মেয়ে-পুরুষেরা স্তব্ধ। মহেশকরের মুখে রক্ত নেই।

সকলে যখন চলে গেছে, সেই রাতে স্ত্রীর শুশ্রূষায় প্রথম বসেছে মহেশকর। পাখার বাতাস করেছে, গায়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়েছে।

ভবানীবাঈ চোখ মেলে তাকালো তার দিকে। মহেশকর মুখের কাছে ঝুঁকে জিজ্ঞাসা করল–কেমন আছিস?

ভবানীবাঈ জবাব দিল না। ক্লান্ত দুই চোখ বুজে এলো আবার।

পরের ছ-সাত মাসে সত্যিই বার পাঁচেক রাণীবাঈয়ের ভর হল ভবানীবাঈয়ের ওপর। এবারে ভর যখন হয়, তখন আর বাইরের লোক কেউ থাকে না, শুধু বাড়ির লোক থাকে। রাণীবাঈ কথা বলে মহেশকরের সঙ্গে। মহেশকর চেয়ে থাকে। সব। শোনে। কথা বলে না।

দেখতে দেখতে মহেশকরের মধ্যে একটা বড় রকমের পরিবর্তন দেখা গেল। স্ত্রীকে অর্থাৎ ভবানীবাঈকে মার ধর করা দূরে থাক, তার ওপর রাগ পর্যন্ত করে না। ভবানীবাঈ ইচ্ছে করে দোষ করলেও না। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হাসে, স্ত্রীকে আদর করতে আসে। ঘর ছেড়ে বাইরে থাকতে চায় না বেশিক্ষণ। তার মুখের রুক্ষ কঠিন ছাপটা ক্রমশই মুছে যাচ্ছে।

কিন্তু পরিবর্তন কিছু ভবানীবাঈয়েরও হয়েছে। বিপরীত পরিবর্তন। কারণে অকারণে তার মেজাজ চড়ে। মহেশকরের হাসি দেখলে তার গা জ্বলে। আদর করতে এলে তাকে ঠেলে সরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। সে তো জানে এত আদর সোহাগ। ভালোবাসা কার উদ্দেশ্যে। সে তো উপলক্ষ মাত্র। শুধু সে কেন, মহেশকরের এমন পরিবর্তনের কারণ বাইরের লোকেরাও জানে। রাণীবাঈয়ের ভর হবার পরে সকল। বৃত্তান্ত অন্যেরাই ভবানীবাঈকে সাগ্রহে শুনিয়ে যায়।

ভবানীবাঈয়ের ভিতরে ভিতরে শুকনো টান ধরছে একটা। চোখ জ্বলে, মন জ্বলে, বুক জ্বলে। অসহ্য লাগে এক-একসময়।

.

আশ্বিনের দশেরার দিন এলো।

এই দিনের দিবাভাগে পুরুষেরা ঘোড়া পূজা, অস্ত্র পূজা, শাস্ত্রগ্রন্থ পূজা করে। মহেশকরের এ-সব অনুষ্ঠানেও ত্রুটি নেই। সন্ধ্যায় স্ত্রীরা কপালে নতুন সিঁদুর দিয়ে, মাথায় আতপ চালের ডালা রেখে স্বামীকে আরতি করে। তারপর তাকে আদর করে বসিয়ে নারকেল বাতাসা খেতে দেয়। স্বামী রুপোর টাকা দেয় স্ত্রীকে।

সন্ধ্যায় মহেশকর ঘরে বসে আছে। কিছুর যেন প্রতীক্ষা করছে সে। অদূরে মেঝেতে ভবানীবাঈ বসে। রুক্ষ, কঠিন মূর্তি। লোকটা বসে আছে বলেই তার রাগ।

স্ত্রীর ভাবগতিক সুবিধের না ঠেকলেও মহেশকর আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করল –আমাকে বরণ করবি না, আরতি করবি না?

জবাবে ভবানীবাঈ শুধু দুই চোখে আগুন ছড়ালো এক পশলা।

মহেশকর আবার বলল–এত ভালোবাসিস তুই আমাকে, আরতি করবি না? কর না–আমি রুপোর টাকা রেখেছি তোর জন্যে।

ভবানীবাঈ ঘোরালো চোখে তাকালো তার দিকে, বুকের আগুন মাথায় উঠেছে। তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলে উঠল–আমি তোমাকে একটুও ভালোবাসি না, তোমাকে ভালোবাসে রাণীবাঈ।

বলতে বলতে হঠাৎ আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল সে, একেবারে কাণ্ডজ্ঞান খুইয়ে বসল। দিশেহারা ক্রোধে এতদিনের সব জ্বালা যেন উদগিরণ করতে লাগল। মহেশকরের হাসিমুখ ঝলসে দিয়ে বলতে লাগল–আমি তোমাকে একটুও ভালোবাসি না, তুমি আকাট বোকা, তাই ভাবো রাণীবাঈ আসে তোমার কাছে তোমার কাছে কেউ আসে না, আমার ওপর কেউ কোনোদিন ভর করে নি–কেউ ভর করে না–সব আমি ইচ্ছে। করে করি, তোমার মতো বোকাকে ভোলাবার জন্যে আমিই সব করি–বুঝলে? আমি তোমাকে একটুও ভালোবাসি না, আমি তোমাকে ঘৃণা করি, ঘৃণা করি

আত্মঘাতী স্পর্ধাভরে ভবানীবাঈ চেয়ে রইল তার দিকে।

 এইবার কি স্ত্রী-হত্যা ঘটে যাবে একটা?

কিন্তু পরমুহূর্তে ভবানীবাঈ হতভম্ব। ওই মুখে বিস্ময় বিরাগ ক্রোধের চিহ্নমাত্র নেই। মুখের দিকে চেয়ে মহেশকর হাসছে। অনুরাগের ভরপুর হাসি।

বলল–আমি জানি, আমার কাছে কেউ কখনো আসে নি-আসে না। এই করে শুধু তুই-ই আসিস। আমাকে যদি ভালোই না বাসবি তাহলে নিজেকে খুইয়ে রাণীবাঈ হয়েও আমাকে পেতে চাস কেন তুই?

রাগ গেছে, ঘৃণা গেছে, ওই হাসিমুখের দিকে ভবানীবাঈ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে শুধু। দেখছে। চোখের কোণ দুটো ঝাপসা হয়ে আসছে, সর্বাঙ্গে কি এক অজ্ঞাত শিহরণ অনুভব করছে। হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে ঘর ছেড়ে ভাঁড়ারের দিকে ছুটল সে–বরণডালা সাজাতে হবে।

আজ ভবানীবাঈ স্বামীর আরতি করবে।