মা

মা

বাবা মা ভাই বোন ভাইয়ের স্ত্রী ভগ্নিপতি–সব মিলিয়ে একঘর লোকের সামনে স্ত্রীর এই বেখাপ্পা আচরণ দেখে গৌরীনাথবাবু আধা বিস্মিত আধা ক্রুদ্ধ। তার দুশ্চিন্তা আর দ্বিধার জবাবে স্ত্রী সুপ্রীতি উঠে দাঁড়িয়ে বিছানার তলা থেকে চাবির গোছা বার করে দেয়াল-ঘেঁষা গডরেজের আলমারিটা খুলে ফেললেন। তারপর অন্য চাবি দিয়ে ভিতরের লকারটা। লকার থেকে বড় বড় দুটো গয়নার বাক্স বার করে গৌরীনাথবাবুর সামনে রাখলেন। ঈষৎ অসহিষ্ণু স্বরে বললেন, হাতে টাকা না থাকে তো এগুলো দিয়ে ব্যবস্থা করো–ছেলে ফিরে না পেলে কিসের টাকা কিসের গয়না

ঘরে আর যারা ছিল তারা চুপ। গৌরীনাথবাবুর চোখেমুখে ভর্ৎসনা মেশানো। বিস্ময়। সুপ্রীতি দেবীর আত্মস্থ হবার পক্ষে সেটুকুই যথেষ্ট। আবেগের মুখে কাজটা যে ভালো করা হল না সেটা তক্ষুনি মনে ডাক দিল। কারণ সর্ব ব্যাপারে স্বামীর মুখাপেক্ষী তিনি। নিজের বুদ্ধি বিবেচনার ওপর নির্ভর করে কোনো গুরু দায়িত্বের কাজই ঠিক মতো করে উঠতে পারেন না। গলার সুর নরম করে তক্ষনি ভুলটা শুধরে নিতে চেষ্টা করে বললেন, সর্বদা অত টাকা কারই বা হাতে থাকে, কাজ চালিয়ে নাও পরে না-হয় এর ডবল বানিয়ে দেবে।

কথাটা উঠেছিল ছেলের বিশেষ একটা দৈব আনুকূল্য লাভের প্রবল সম্ভাবনার প্রসঙ্গে। বারো বছরের একমাত্র ছেলে দুরারোগ্য ব্যাধি-কবলিত। এখন একেবারে উত্থানশক্তিরহিত পঙ্গু। ভবিষ্যতের অবধারিত চিত্র আরো ভয়াবহ অন্ধকার। পৃথিবীর সমস্ত চিকিৎসাই ব্যর্থ। তারপর ভারতের বহু তীর্থে বহু দৈব-প্রচেষ্টা, যাগযজ্ঞ ক্রিয়াকলাপ আর দামী-দামী স্টোন ধারণের ফাঁক দিয়েও কত হাজার টাকা জলের মতো বেরিয়ে গেছে, হিসেব নেই। এখন শুধু হতাশা আর হতাশা।

এই সময় এক মহাসাধকের নাম প্রায়ই কানে আসতে লাগল তাদের। কলকাতার দোকানে দোকানে তার ছবি দেখা যেতে লাগল। আর বহু নাম-করা কাগজেও ভগবান-সদৃশ ওই মহাযোগীর এমন সব করুণা-লীলার কাহিনী প্রচার লাভ করল যে পড়লে শুচিশুভ্র আবেগে চোখে জল আসে।

গৌরীনাথবাবু খুব একটা বিশ্বাস করেননি। কিন্তু মন দুর্বল। স্ত্রীর মন ততোধিক দুর্বল। ফলে ওই করুণাময় সম্পর্কে দিশি আর বিদেশী লেখকের বই সংগ্রহ করে দুজনেই পড়তে লাগলেন। সেইসব বাস্তব অভিজ্ঞতার কাহিনী এবং তত্ত্ববিশ্লেষণ অভিভূত হবার মতোই বটে। এ ছাড়া বহু শুভার্থীজনও তাদের। পরামর্শ দিলেন, একবার কপাল ঠুকে চলে যান ছেলেকে নিয়ে, যদি দর্শন মেলে আর দয়া মেলে তাহলে অলৌকিক কিছু হতেও পারে, এমনিতে তো আর কোন আশা নেই।

কিন্তু চলে যান বললেই এই ছেলে নিয়ে বেরিয়ে পড়া যায় না। অলৌকিক বিভূতিসম্পন্ন ওই মহাতপা যেখানে থাকেন ছেলের বর্তমান অবস্থায় সেদিকে পা বাড়ানোটা দুর্গমযাত্রার সামিল। বইয়ে সে-পথের বিবরণ শুনে সুপ্রীতি দেবী পর্যন্ত। দমে যান। ফলে, মনে মনে প্রায় অলৌকিক গোছের একটা আশা নিয়ে বসে ছিলেন। তিনি। খোঁজ-খবর করে এই কলকাতায়ও ওই দেব-মানবের অনেক গণ্যমান্য ভক্তের সন্ধান পেয়েছেন। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। শুনেছেন বাবাকে একবার তারা এই কলকাতায় নিয়ে আসতে চেষ্টা করছেন। তবে এও শুনেছেন, বাবার ইচ্ছে না হলে শত চেষ্টাতেও তা হবে না।

গৌরীনাথবাবু স্ত্রীকে আশ্বাস দিয়েছেন, ইচ্ছে হবেই একদিন। ভক্ত টানলে ভগবানেরও টনক নড়ে। স্বামীর ওপর আর তার কথার ওপর স্ত্রীটির অগাধ আস্থা। কিন্তু আরো প্রায় দেড়টা বছর কেটে যেতে তিনি অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন। ছেলের অবস্থা ধীর কিন্তু অবধারিত গতিতেই সঙ্কটের দিকে গড়াচ্ছে।

এমন দিনে একটা সংবাদ শুনে সুপ্রীতি দেবী আশায় আনন্দে কন্টকিত।ঐশ্বরিক ক্ষমতার ওই মহাযোগী দিল্লীতে আসছেন। সেখানকার ভক্তরা তার সম্মতি পেয়ে বিপুল আয়োজন করেছেন। পাকা খবর। দিন তারিখ পর্যন্ত নির্দিষ্ট। কলকাতার বহু ভক্ত দিল্লীর দিকে ছুটেছেন।

দিল্লী! সুপ্রীতি দেবীর মনে হল দিল্লী একেবারে হাতের মুঠোয়। এরোপ্লেনে দুঘণ্টার পথ। পা ফেলার পর আর কোনো ঝামেলা নেই, সেখানে দেওরের বাড়ি দেওরের গাড়ি। ঠাকুর মুখ তুলে না চাইলে এমন সুযোগ আসে!

শোনার পর মন দুর্বল গৌরীনাথবাবুরও। কিন্তু তাকে সাত-পাঁচ ভেবে দেখতে হবে। অন্ধ অবাস্তব আশার পিছনে ছুটে এযাবত বহু হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। কম করে পঞ্চাশ ষাট হাজার তার ওপর এক-একটা চেষ্টা বিফল হবার পর সে কি হতাশা–বিশেষ করে স্ত্রীর। ভেঙে পড়ার দাখিল একেবারে।

অতএব সবদিক ভেবে দেখারই আলোচনায় বসা হয়েছিল সকলে মিলে। কিন্তু দ্বিধার প্রথম পর্যায়েই সোজা মুখের দিকে তাকিয়ে স্ত্রী জিজ্ঞাসা করে বসলেন, আসল কথা, বাবার সঙ্গে দেখা হলে আর তার করুণা পেলে ছেলে ভালো হয়ে যাবে, এ তুমি বিশ্বাস করো কি করো না?

 গৌরীনাথবাবুর বিব্রত মুখ। বইপত্র যা পড়েছেন, মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেই মন চায়। দ্বিধান্বিত জবাব দিলেন, করুণা পাবই এমন ভরসা কোথায়?

স্ত্রী স্থির প্রত্যয়ে জবাব দিলেন, দেখা পেলে করুণাও পাব।

–সেভাবে দেখা মিলবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই।

সুপ্রীতি আধা বিস্মিত আধা বিরক্ত।কি যে বলো ঠিক নেই, দিল্লীর মতো জায়গায় তুমি নিজে চেষ্টা করলে দেখা হবে না এ আবার একটা কথা নাকি! তাছাড়া এখান থেকে চেনা-জানা ভক্ত যাঁরা যাচ্ছেন তারাও সাহায্য করবেন। তারও দরকার হবে না, তুমি চেষ্টা করলেই হবে–

মনে মনে বিরক্ত একটু গৌরীনাথবাবুও। স্ত্রীর ধারণা, তার স্বামী নাম লেখক। আর কাগজের বড় চাকুরে অতএব দুনিয়ার সমস্ত দরজাই তার কাছে খোলা। বললেন, হ্যাঁ, আমি দিল্লীর লাটসাহেব একেবারে। যাক, এরপর খরচের দিকটাও চিন্তা করার আছে, ওই ছেলেকে নিয়ে যেতে হলে তুমি আমি ছাড়াও আর একজন লোক অন্তত দরকার–এরোপ্লেনে চারজনের যাতায়াত ছাড়াও অন্য খরচা আছে, কম করে চার হাজার টাকা লাগবে।

জবাবে চিরসহিষ্ণু আর চিরমুখাপেক্ষী স্ত্রীর ওই কাণ্ড। সকলের সামনে আলমারি থেকে গয়নার বাক্স বার করে ওই উক্তি।

.

বিস্ময় কাটতে দুচোখের নীরব ভর্ৎসনাটুকুই আরো স্পষ্ট হয়ে উঠল। পরে স্ত্রীর নরম সুরের জবাবদিহিতেও কাজ হল না তেমন। কিন্তু বাইরের আচরণে বরাবর সংযত মানুষ গৌরীনাথবাবু। মৃদু গম্ভীর স্বরে আদেশ দিলেন, ও-দুটো জায়গা-মত রাখো

উঠলেন। খোলা আলমারি থেকে চেক-বই বার করলেন। পকেট থেকে কলম টেনে নিয়ে সামনের ছোট টেবিলটায় বসলেন। খসখস করে চার হাজার টাকার চেক লিখে নাম সই করে চেকটা ছিঁড়ে ছোট ভাইয়ের হাতে দিলেন।–কাল ফার্স্ট আওয়ারে চার হাজার টাকা তুলে এয়ারে চার জনের সীট বুক করবি, টিকিট থাক বা না থাক আমার সেই অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার বন্ধুর কাছে গেলেই সে ব্যবস্থা করে দেবে। টিকিট হাতে পেলেই দিল্লীতে দীপুকে একটা আরজেন্ট টেলিগ্রাম করে দিবি। তারপর ছেলে আর তোর বউদিকে নিয়ে সন্ধ্যার ফ্লাইটে তুই আর দিবা দিল্লী যাবি–সাধ যখন হয়েছে টাকার জন্যে আটকাবে না।

সুপ্রীতি দেবীর শুকনো মুখ, বা রে, তুমি না গেলে কি করে হবে!

–আমার কথা-বার্তা যখন পছন্দ হচ্ছে না, নিজেই চেষ্টা করে দেখো।

গম্ভীর মুখে ঘর ছেড়ে ছেলের কাছে চলে গেলেন গৌরীনাথবাবু। ছেলে বারান্দায় হুইলচেয়ারে বসে।

রাতে মানভঞ্জনের পালা। রাগত মুখেই সুপ্রীতি দেবী বললেন, নিজের ওপর ভরসা করে কবে আমি কোন কাজ করি বা কোন কথা বলি তুমি জানো না?

বলতে না বলতে চোখে জল। একমাত্র এই বস্তুটিকেই গৌরীনাথবাবু মনে মনে ভয় করেন। ফলে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আপোস।

না, স্ত্রী আদৌ অতিশয়োক্তি করেননি। সর্ব ব্যাপারে সর্ব কাজে উনি স্বভাবগত কারণেই স্বামীর ওপর একান্ত নির্ভরশীলা। ঠিক এই জন্যে গৌরীনাথবাবুর কখনো খেদ কখনো অন্তর্ভুষ্টি। স্বামীর মতামত না পেলে কোনো একটা জরুরী ব্যাপারও স্ত্রীটি ফয়সালা করে উঠতে পারেন না। ভদ্রলোকের একবার শক্ত অসুখ হয়ে পড়তে একটা দুশ্চিন্তায় তার দুচোখে জল দেখা দিত।…তার অবর্তমানে হাজার টাকা পয়সা থাকলেও ওই স্ত্রীর অসহায় অবস্থাটা তিনি যেন দেখতে পেতেন। পরে কত সময় ধমকেছেন, একে একে নিজে সব দেখে শুনে বুঝে নাও,কখন কি দরকার হয় ঠিক আছে। কিন্তু তার তাগিদে দেখে-শুনে বুঝে নিতে গিয়ে স্ত্রীর হিমসিম অবস্থা। শেষে গৌরীনাথবাবু নিজেই হাল ছেড়ে তাকে অব্যাহতি দিয়েছেন।

ছেলে স্ত্রী আর একটি ভাই নিয়ে গৌরীনাথবাবু দিল্লী উড়ে এসেছেন। কিন্তু তারপরেই যেন হাবুডুবু অবস্থা সকলের।

মহাযোগী বাবাকে নিয়ে দিল্লীতে এক এলাহি ব্যাপার। বিরাট পার্ক-এ তাবু ফেলে সাজিয়ে গুছিয়ে পঞ্চাশ হাজারের মতো জন-সমাবেশের ব্যবস্থা। কিন্তু আরো বিশ তিরিশ হাজারের বেশি ব্যবস্থা হলেও যথেষ্ট নয়। লোকে লোকারণ্য। সমস্ত দিল্লীবাসী বোধহয় ওই একপথে ভেঙে পড়েছে। দেশ-বিদেশ থেকে কত রোগী এসেছে। ঠিক নেই। বাবার অবস্থানের দুমাইলের মধ্যে মোটর গাড়ি পার্ক করার পর্যন্ত জায়গা। মেলে না।…প্যাণ্ডেলে সকাল-সন্ধ্যার কীর্তনের আসরে বাবা একঘণ্টা দেড় ঘণ্টার জন্যে আসেন, ঘুরে ঘুরে সকলের উদ্দেশে আশীর্বাদ করেন হাত তুলে, ওই বিভোর তন্ময় মূর্তি দেখলেই মনে হয় এ-জগতের কেউ নন। রোগীদের মধ্যেও ঘোরাঘুরি করেন, হঠাৎ হঠাৎ কাউকে বিভূতিও দেন, কারো মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেন। কিন্তু গড় হিসেবে সে-রকম ভাগ্য দুশর মধ্যে একজনেরও হয় কিনা সন্দেহ। বহু ক্লেশে গৌরীনাথবাবু দুবেলাই সপরিবারে বাবার দর্শন পাচ্ছেন–কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা বা কৃপা লাভ করা দুরাশাই বোধহয়। অথচ এই মুহূর্তে গৌরীনাথবাবুরও বদ্ধ বিশ্বাস, কৃপা পেলে উদ্দেশ্য সফল হবেই, অলৌকিক উপায়ে ছেলে ভালো হবেই।

কিন্তু সেই একান্ত সন্নিধানে কি করে যাবেন? পার্কসংলগ্ন যে বিশাল প্রাসাদে তিনি অবস্থান করছেন, তার চতুর্দিকেও জনসমুদ্র। দুর্ভেদ্য পুলিশ প্রহরায় আর ভলান্টিয়ারদের তৎপরতায় বাড়ির গেটের বিশ গজের মধ্যেও কারো যাবার উপায় নেই। অবশ্য বিশেষ ব্যবস্থা করে অনেকেই ভিতরে যাচ্ছেন, বাবার অনুগ্রহ পাচ্ছেন, কিন্তু সেই বিশেষ ব্যবস্থা গৌরীনাথবাবুর অন্তত করায়ত্ত নয়। কলকাতার ভক্তদের সঙ্গেও দেখা হয়েছে, কিন্তু অবস্থা এমন যে তারা নিজেরাই বাবার ধারে কাছে যেতে পারছেন না। এখানে কে কাকে চেনে?

নিরুপায়, সুপ্রীতি দেবী রাতে চোখের জলে বালিশ ভেজান আর প্রার্থনা করেন, বাবা, তুমিই ব্যবস্থা করো, পথ দেখাও।

বাবা দিল্লীতে অবস্থান করবেন সাতদিন। তার মধ্যে চার-চারটে দিন চলে গেছে। গৌরীনাথবাবু মরীয়া হয়ে উঠেছেন। তাদের কাগজের এখানকার শাখা-অফিসের মারফৎ সকল চেষ্টাও ব্যর্থ হতে চলেছে।

এরই মধ্যে হঠাৎ আশার আলো এক টুকরো। অপ্রত্যাশিত যোগাযোগ একজনের সঙ্গে। অবাঙালী। প্রভাব প্রতিপত্তিশালী মন্ত্রী ছিলেন একসময় রাজধানীর। অধ্যাত্মবিদ হিসেবে সুপরিচিত তিনি। বহু শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত এবং সাধু-সন্তদের সঙ্গে হৃদয়ের যোগ তার। তিনি রাজধানীতেই আছেন এবং গৌরীনাথবাবুর কাছে তিনি একেবারে দুর্লভ নন।

ছেলে আর স্ত্রীকে নিয়ে তার কাছেই ধরনা দিয়ে পড়লেন গৌরীনাথবাবু। খবর পেয়েছেন, বাবার সঙ্গে ভদ্রলোকের এই দিনই বিকেলে সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা হয়ে আছে।

ছেলেকে দেখে সহৃদয় ভদ্রলোকটির মন বিচলিত হল। বললেন, আচ্ছা বিকেল ঠিক চারটের সময় ছেলেকে সঙ্গে করে আমার সঙ্গেই চলো, আমি বাবাকে ধরে। পড়ব, আশাকরি ব্যবস্থা হবে।

কৃতজ্ঞতায় গৌরীনাথবাবু নির্বাক খানিক। এমন আশ্বাসের কথা দিল্লীতে এসে এই প্রথম শুনলেন। ফেরার পথে স্ত্রীর দুই চোখও ছলছল। মাঝে মাঝে স্বামীর দিকে তাকাচ্ছেন। নীরব উচ্ছ্বাসের একটাই অর্থ যেন, তুমি চেষ্টা করলে হবে না এমন কিছু আছে নাকি!

.

ঘড়ি-ধরা সময়ে প্রাক্তন মন্ত্রীর সঙ্গে সেই ঈপ্সিত প্রাসাদের কাছাকাছি উপস্থিত হলেন সকলে। ভিড় তখন অপেক্ষাকৃত কম হলেও গাড়ি এগোবার উপায় নেই। খানিকটা তফাতেই নামতে হল। পিছনের ক্যারিয়ার থেকে তাড়াতাড়ি ফোলডিং হুইল চেয়ার বার করে ছেলেকে বসালেন। স্ত্রীও তৎপর হাতে সাহায্য করলেন তাকে। তারপর এগিয়ে চললেন।

সামনে দুজন ভদ্রলোকের সঙ্গে প্রাক্তন মন্ত্রী। পিছনে হুইলচেয়ার ঠেলে নিয়ে চলেছেন গৌরীনাথবাবু, পাশে স্ত্রী। ওঁদের দুজনেরই দুরু দুরু বক্ষ।

সামনের ভিড়ের অবরোধ সহজেই দুভাগ হয়ে গেল। এ সময়ে বাবার সঙ্গে দেখা করতে কে আসছেন ব্যবস্থাপকরা সকলেই জানে।

এবারে সামনে গেট। গেটের ওধারে সারি সারি ভলান্টিয়ার মোতায়েন। ছাড়পত্র না পেলে তারা একজনকেও ঢুকতে দেবে না। গেটের ও-ধারে লম্বা রাস্তার শেষে বাড়ি। সেখানেও বেশ জনাকতক ভাগ্যবান আর ভাগ্যবতীর সমাবেশ। ছাড়পত্র পেয়ে তারা কেউ বাড়ির মধ্যে ঢুকছে, কেউ বা ঢোকার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে।

একজন ব্যবস্থাপক ভলান্টিয়ারদের কানে কানে কি বলতে বদ্ধ গেট একটুখানি খুলে প্রাক্তন মন্ত্রীকে ভিতরে ঢুকিয়ে নেওয়া হল। গৌরীনাথবাবু বা স্ত্রী বা হুইলচেয়ারে আসীন ছেলের ছাড়পত্র নেই। গেট আবার বন্ধ হয়ে গেল।

গেটের ওদিক থেকে সদাশয় প্রাক্তন মন্ত্রীটি গলা খাটো করে গৌরীনাথবাবুকে বললেন, এখানেই অপেক্ষা করো, আমি দেখি কি করতে পারি।

আবার অধীর প্রতীক্ষা। ভলান্টিয়াররা নিছক দয়া করেই বোধহয় তাঁদের তফাতে হটিয়ে দিল না। কিংবা হয়তো বুঝে নিল এরাও ফেলনা লোক নয়।

মিনিট দশেকের মধ্যে একজন ভলান্টিয়ার ভিতর থেকে ছুটে এলো।

গেটের সামনে এসে হুইলচেয়ারে বসা ছেলেকে দেখিয়ে বলল, একে ভিতরে নিয়ে আসুন, জলদি।

হুইলচেয়ার নিয়ে বদ্ধ গেট ঠেলেই তারা ভিতরে ঢোকার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বাধা আবার।–ও নো নো! ওনলি ওয়ান। ছুটে-আসা ভলান্টিয়ারের ব্যস্ত-সমস্ত নির্দেশ।–রোগীর সঙ্গে আপনাদের যে-কোনো একজন আসুন, দুজন আসার নিয়ম নেই।

গৌরীনাথবাবু বিমূঢ় কয়েক মুহূর্তের জন্য। গেট আধখানা খোলা হয়েছে। জোর করে, দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে হুইলচেয়ার ঠেলে ভিতরে ঢুকতে গেলেন। কিন্তু পরক্ষণে কাঁধের কাছে বেশ জোরেই একটা ঠেলা খেয়ে প্রায় নিজের অগোচরে একটু সরে গেলেন। তাজ্জব বিস্ময়ে দেখলেন স্ত্রী তাকে ঠেলে হুইলচেয়ারের দখল নিয়ে বলছেন, সরো সরো, তুমি পারবে না, আমি যাচ্ছি–

বাধা দেবারও অবকাশ পেলেন না গৌরীনাথবাবু। ছেলেসহ হুইলচেয়ার ঠেলে স্ত্রী গেটের ভিতরে ঢুকে পড়েছেন। চিৎকার করে বলতে গেলেন, তুমি তো রোগের নামটাও ঠিকমতো বলতে পারবে না

বলা হল না। হতভম্ব বিস্ময়ে দুচোখ বড় বড় করে চেয়ে রইলেন তিনি। হুইলচেয়ার ঠেলে স্ত্রী তরতর করে যেন এক লক্ষ্যকেন্দ্রের দিকে এগিয়ে চলেছেন। স্ত্রীর এমন আত্মস্থ সমাহিত অথচ তৎপর মূর্তি আর বুঝি দেখেননি। নিষ্পলক চেয়েই আছেন গৌরীনাথবাবু। আর সমস্ত সত্তা দিয়ে অনুভব করছেন, ঠিক এই মুহূর্তে বাপের। তুলনায় ছেলের মায়ের সঙ্গে যাওয়াটার কত তফাৎ।

রাত আর দিনের মতই তফাত।