ক্ষুধা

ক্ষুধা

ট্রেনে সাধারণত থার্ড ক্লাসের খদ্দের আমি। স্লপার কোচে সাড়ে চার টাকার বাড়তি মাশুল গুনে রাতে ঘুমোবার জন্যে একখানা বেঞ্চ পেলেই খুশি। ফলে অভ্যেসখানা এমন হয়েছে যে, বরাতজোরে সদ্য বর্তমানে ফার্স্ট ক্লাস রিজার্ভ কোচের চারজনের বিচ্ছিন্ন কম্পার্টমেন্টে এত আরামের জায়গা পেয়েও ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষণ বাদেই ভেতরটা ওই থার্ড ক্লাসের জন্যেই আনচান করে উঠেছিল। অথচ একটু আগে এই অভিজাত খুপরিতে পদার্পণ করে এবং আসন নিয়ে ভেতরটা প্রসন্ন হয়ে উঠেছিল। পরিষ্কার চকচকে কামরা, দুদিকে দুটো পুরু গদিআঁটা বার্থ, আর ওপরে তেমনি গদিআঁটা আরো দুটো বার্থ। বেশ চওড়া। শুলে পিঠের সিকিভাগ বেরিয়ে থাকার সম্ভাবনা নেই। মাথার ওপর চারজনের জন্যে চারটে পাখা, দুটো বড় সাদা লাইট, একটা সবুজ লাইট, শিয়রের দিকের ওপরে নাচে চার কোণে চারটে শেড-দেওয়া ছোট পড়ার লাইট-স্বাচ্ছন্দ্যের আরো কিছু আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা। সামনের দরজাটা টেনে দিলেই চারটি যাত্রী ট্রেনের মধ্যে থেকেও বিচ্ছিন্ন।

মোট কথা, এই শ্রেণীর যাত্রীদের মান এবং মর্যাদা সম্পর্কে রেল কর্তৃপক্ষ কিছুটা সচেতন। তা যত গুড় তত মিষ্টি। এয়ার-কনডিশন আরো আরামের, এরোপ্লেনে ততোধিক, আর এই গুড় যদি নিজের পকেট থেকে ঢালতে না হয় তাহলে যাকে বলে মিষ্টি মধুর। এই যাত্রায় আমি চলেছি সম্মানিত অতিথি হিসেবে একজন সহযাত্রীর কাঁধে ভর করে যিনি পকেটের পরোয়া করেন না। ফলে আমার দিক থেকে এটি নির্ভেজাল আনন্দ-যাত্রা। আনন্দের আরো কিছু ফিরিস্তি দেওয়া যেতে পারে। কোন ভবঘুরের উক্তি, আপনার বেড়াবার আনন্দ অনেকখানি নির্ভর করছে আপনার সহযাত্রীর ওপরে। সহযাত্রী বা যাত্রীরা যদি স্বল্পভাষী অথচ রসিক হন তাহলে আপনি ভাগ্যবান, তিনি বা তারা যদি আপনার থেকে বাকপটু হন তাহলে আপনার ভাগ্যটা মাঝারি, আর যদি পলকা বাক্যবাগীশ হন তো আপনার দুর্ভাগ্য। কিন্তু তাঁদের মধ্যে একটি মাত্র যদি সুদর্শনা রমণী থাকেন আর তিনি যদি সহযাত্রীর ওপর হাবভাবেও সামান্য একটু সহৃদয়া হন আর অল্পসল্প মিষ্টি হাসেন আর একটু-আধটু কথা বলেন তো আপনার ভাগ্যের তুলনা নেই–পথ যত দীর্ঘ বা ক্লান্তিকর হোক, আপনার ভিতরটা রংদার তাজা ফড়িংয়ের মত আনন্দের ডালে ডালে ঘুরেফিরে বেড়াবে।

তা আমি এ-যাত্রায় প্রায় সব দিক থেকেই তুলনারহিত ভাগ্যবান। চার বার্থের এই অভিজাত কম্পার্টমেন্টে আমাকে বাদ দিলে আর দুজন সহযাত্রী এবং একজন সহযাত্ৰিনী। ভদ্রলোক দুজনের একজনের বয়েস পঁয়তাল্লিশ একজনের বড়জোর পঁয়ত্রিশ। তারা মামাতো-পিসতুতো ভাই। এ-যাত্রায় ওই পঁয়তাল্লিশ, ভদ্রলোকটির গৌরী সেনের ভূমিকা। নাম তার যাই হোক, সকলে মজুমদার মশাই বা বড়বাবু বলে ডেকে থাকে। বাংলা ছায়াছবির মোটামুটি নামী প্রযোজক অর্থাৎ প্রোডিউসার তিনি। এতদিন নিতান্ত মাঝারি প্রোডিউসার ছিলেন, কিন্তু সম্প্রতি পর পর তার দুখানা ছবি ঊর্ধ্ব মার্গের বক্স অফিস হাট। সেই বিত্তের হিড়িকে রাতারাতি বৃত্ত বদল হয়ে গেছে তার। প্রযোজনার সামনের সারিতে এসে হাজির হয়েছেন। সেই দুখানা ছবিই রিলিজের পর পর আমি দেখে নিয়েছিলাম এবং আশাহত হয়েছিলাম। খরচের টাকা উশুল হবে কিনা সংশয় ছিল। কিন্তু সব সংশয় বরবাদ করে ভদ্রলোক প্রমাণ করেছেন বাংলা ছবির দর্শক-মনের কত নির্ভুল বিচারক তিনি। দুবছরে পর পর দুখানা ছবি। তাক লাগানো ভাবে লাগিয়ে দিয়ে এখন সাদা আর কালো টাকার হিসেব-নিকেশে মশগুল হয়ে আছেন। এবারে তার, যাকে বলে একখানা প্রেস্টিজ ছবি করার বাসনা। কিন্তু প্রযোজকের শুধু প্রেস্টিজ ধুয়ে জল খেলে চলে না। কাগজওয়ালারা গত দুটো হট ছবির একটিরও সদয় মন্তব্য করেনি। অতএব এবার নাম চাই আর সেই সঙ্গে টাকাও চাই।

অনেক খেটে অনেক জল্পনা-কল্পনা করে এই প্রেস্টিজ ছবির যে গল্প বাছাই করা হয়েছে, ভাগ্যক্রমে সেটা আমারই লেখা। সত্য কথা বলতে কি, আমি নিজেই একটু অবাক হয়ে গেছলাম। আগের ওই সুপারহট পিকচার যারা করেছেন তাদের কেউ এ গল্পের ছায়া মাড়াতে পারেন, ভাবিনি। কিন্তু আমার ভাবনা নিয়ে তো আর জগৎ চলছে না, আর বলা বাহুল্য, এই ব্যতিক্রমের ফলে অন্তত ভদ্রলোকের সম্পর্কে ধারণা অনেকখানি বদলেছে। এখন আমার ধারণা, টাকা কি করে করতে হয় ভদ্রলোক জানেন, সেই সঙ্গে ভালো-মন্দের বিচার-বোধও আছে। ব্যবসায়ী হিসাবে গল্পের দাম নিয়ে প্রথম দফায় কিছু ঝকাঝকি করেছেন আমার সঙ্গে, ফয়সলা হয়ে যাবার পর তিনি ভিন্ন মানুষ।

দিলদরিযা অতিথি-বৎসল। গল্পের আলোচনার জন্য বাড়িতে ধরে নিয়ে গিয়ে। অনেক খাইয়েছেন। এই ছবিতে নিযুক্ত নামী পরিচালকটির কাছে নিজের বক্তব্য শেষ করার জন্য আমাকে ঠেলে দিয়েছেন। লক্ষ্ণৌতে আউটডোর শুটিং-এ চলেছেন। এঁরা। ইউনিট নিয়ে পরিচালক দুদিন আগেই যাত্রা করেছেন। মজুমদার মশাই, অন্যথায় বড়বাবু, ইনকাম ট্যাক্সের ব্যাপারে আটকে পড়েছিলেন বলে দুদিন পরে যাচ্ছেন। বড়বাবুর সর্বকাজের প্রধান দোসর তার এই পিসতুতো ভাই হিরন্ময় বা হিরু গুপ্ত। বড়বাবু না নড়লে তারও নড়ার উপায় নেই। অতএব ম্যানেজারির ভার অন্যের ওপর চাপিয়ে সে-ও দুদিনের জন্য পিছিয়ে গেছে। আমার সঙ্গী হবার বাসনাটা সে-ই বড়বাবুকে জানিয়েছিল, শোনামাত্র ভদ্রলোক আমাকে দরাজ আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।

এ-হেন সহযাত্রী আর যাই হোক অবাঞ্ছিত নন। তাছাড়া ভদ্রলোক কথা বেশি বলেন না, তার থেকে ঢের বেশি মিটিমিটি হাসেন। তখন তার খুশি-খুশি ফোলা গাল দুটোকে টসটসে রসালো মনে হয়। লক্ষ্য করেছি তার কথায় সোজা সায় দিলে তিনি সেটা চাটুকারিতা ভাবেন, কিন্তু প্রতিবাদ করে শেষে যুক্তি খুঁজে না পেয়ে হার মানলে তুষ্ট হন। হিরু গুপ্তের আচরণে এই বৈশিষ্ট্যটুকুই লক্ষ্য করেছি। প্রতি কথায় প্রথমে বাধা দিয়ে পরে স্বীকার করবে, তুমি ঠিকই বলেছিলে, আমি আগে বুঝিনি, বা এদিকটা খেয়াল করিনি, ইত্যাদি।

পাঠানকোট সকালে ছাড়ে, পরদিন সকাল সাড়ে আটটায় লক্ষ্ণৌ পৌঁছায়। অতএব আমাদের গোছগাছ নিয়ে তাড়ার কিছু ছিল না। কিন্তু গাড়িটা ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মজুমদার মশাই উঠে দাঁড়িয়ে বার্থগুলো একনজর দেখে নিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছেন, ওপরে না নীচে?

আমি জবাব দেবার আগেই হিরু গুপ্ত মন্তব্য করেছে, ওনার নীচের বার্থ হলেই সুবিধে হয় বোধহয়, কিন্তু…

কিন্তুর দিকে না গিয়ে তাড়াতাড়ি বলেছি, না না, ওপরের বার্থে আমার একটুও অসুবিধে হবে না। সঙ্গে সঙ্গে সামনের মহিলার দিকে চোখ গেছে। তার নির্লিপ্ত মুখভাব। নীচের আর একখানা বার্থ তার দখলে থাকবে জানা কথাই।

মৃদু হেসে মজুমদার মশাই নিজের হাতে আমার বেডিং খুলতে গেলেন। তার উদ্দেশ্য বোঝার আগেই হিরু গুপ্ত হাঁ-হাঁ করে উঠল, আহা, ওঁর বিছানা পরে করে দেওয়া যাবে- সর্বব্যাপারে তোমার ব্যস্ততা

পরে নয় এখনই করে দে তাহলে। আর ওই বার্থে তোরটাও পেতে ফেল –সবকিছু পরিপাটি ছিমছাম না হলে আমার অস্বস্তি।

আমি কিছু বলার ফুরসুত পেলাম না। হিরু গুপ্ত অপ্রসন্ন মুখে আমার হোলড অলটা টান মেরে খুলে ফেলল। অতএব ব্যস্ত হয়ে আমিও তার সঙ্গে হাত লাগালাম। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আমার ফিটফাট শয্যা রচনা হয়ে গেল। এরপর দ্বিতীয় বাংকে সে নিজের তকতকে শয্যা বিছালো, তারপর নেমে এসে বলল, এবার তোমাদেরটাও শেষ করে যে যার শুয়ে পড়া যাক।

অল্প হেসে মজুমদার মশাই বললেন, আমাদেরটা এখন কি, বসতে হবে, খাওয়া দাওয়া সারতে হবে

বলতে বলতে ঝুঁকে বড় ট্রাংকটা খুলে দুটো ঝকমকে গালচে বার করলেন।–নীচে আপাতত এই দুটো বিছিয়ে দে।

নীচের গদি-আঁটা বেঞ্চদুটোয় শৌখিন গালচে বিছানো হল। এ ব্যাপারে দেওরের সঙ্গে মহিলা নিজেও হাত লাগালো। তারপর জিনিসপত্রগুলোও জায়গামত গোছগাছ করে রাখল। এই সামান্য কাজটুকু দেখেই আমার কেমন মনে হল, মহিলার রুচিবোধ আছে। তাছাড়া ওপরে বিছানাপত্র সুবিন্যস্ত করা আর নীচে গালচে দুটো পেতে অন্য। জিনিসগুলো গুছিয়ে রাখার পরে ছোট কামরাটার শ্রীই বদলে গেল। ধপ করে হাত পা ছড়িয়ে বসে পড়ে ঈষৎ অপ্রতিভ মুখে হিরু গুপ্ত মন্তব্য করল, সত্যিই এখন ভালই তো লাগছে দেখি।

তোষামোদটুকু যার উদ্দেশ্যে তিনি অর্থাৎ মজুমদার মশাই সেটা স্মিতহাস্যে গ্রহণ। করে আমার দিকে ফিরলেন।–বসুন, এখন কি খাবেন বলুন?

এবারও হিরু গুপ্ত আগেই তড়বড় করে উঠল, এই তো খেয়ে বেরুনো হল সবে, এখনই আবার খাওয়া কি!

আমিও সায় দিলাম, যাক খানিকক্ষণ।

মজুমদার মশাই স্ত্রীর উল্টোদিকের আসনে গা ছেড়ে দিয়ে বসলেন। ঠোঁটের ফাঁকের হাসির অর্থ–দেখা যাক কতক্ষণ কাটে।

এবারে দ্বিতীয় সহযাত্রী হিরু গুপ্তর প্রসঙ্গ। আধময়লা লম্বাটে চেহারা। নাকের ডগা একটু থ্যাবড়া, চোখ দুটো মন্দ নয়, কিন্তু চাউনিটা বেশ প্রখর। এ চোখের দিকে তাকালে মনে হয় ওর মাথার মধ্যে সর্বদাই কিছু একটা জল্পনা-কল্পনা চলছে, সেই কারণে ওর মনটা যথার্থ স্থানে যেন প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত নয়। ফলে চাউনির মধ্যে এক ধরনের ধারালো সংশয়ের ছায়া।

সহযাত্রী হিসেবেও একে কোন শ্রেণীতে ফেলব বলা শক্ত। কারণ কথা যখন বলে অনর্গল বলে যেতে পারে। আবার যখন চুপ করে থাকল একেবারে চুপ। হাবভাব ছটফটে গোছের। আজ নয়, আগেও মনে হয়েছে ওর ভিতরে কিছু একটা অসহিষ্ণুতা দানা বেঁধে আছে। সেই ঝোঁকে চলে, সেই ঝোঁকে কথা বলে। বড়বাবুর সে ডান হাত, ইউনিটে স্বভাবতই তার অখণ্ড প্রতাপ।

আমার সঙ্গে এর প্রথম আলাপ ছবির এই গল্প নিয়েই। এ গল্প নির্বাচনের ব্যাপারে সে-ই যে প্রথম উদ্যোক্তা এটা সে গোড়াতেই আমার কাছে জোর গলায় জাহির করেছে, দাদা কি সহজে বুঝতে চায় মশাই, নাকি এসব হাই জিনিস সহজে তার মগজে ঢোকে। ঠেসে ঢোকাতে হয়েছে মশাই, বুঝলেন? এ-জন্য ডিরেক্টরকে পর্যন্ত আগেভাগে হাত করতে হয়েছে। গল্প পড়ে তিনি টলতে দাদা ঢলল। গল্পটা ভাল করে মাথায় ঢোকার পরে অবশ্য দাদার উৎসাহ সকলকে ছাড়িয়েছে। আমার অবিশ্বাসের কারণ নেই, কারণ কি ছবি উনি আগে করেছেন দেখেছি। ভিতরে ভিতরে হিরু গুপ্তর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। দিনকয়েক বাড়িতে আসার ফলে বেশ খাতির হয়ে গেছল। সেই খাতির জমাট বেঁধে গেল কিছুদিন আগের এক সন্ধ্যায়। সেই সন্ধ্যায় বাড়িতে এর জন্যে আমি প্রস্তুত হয়েই অপেক্ষা করছিলাম। কারণ সেই দিন আমার এই ছবির গল্পের পুরো দাম অর্থাৎ বেশ কয়েক হাজার টাকা প্রাপ্তিযোগ আছে।

নির্দিষ্ট সময়ের প্রায় ঘণ্টাখানেক বাদে হিরু গুপ্ত এলো। আশা করেছিলাম ফাইনাল লেনদেনের ব্যাপারে তার দাদাও আসবেন। কিন্তু গাড়ি থেকে হিরু গুপ্ত একাই নামল।

তার দিকে চেয়ে আমি অবাক একটু। শুকনো ক্লান্ত মুখ, উসকো-খুসকো চুল। এসেই টাকার বাণ্ডিল সামনে ফেলে দিয়ে রিসিট বার করে বলল, দেখে নিয়ে সই করে দিন

দেখে নেওয়া অর্থাৎ টাকা গুনে নেওয়া দরকার বোধ করলাম না। যারা দিচ্ছে দেখেশুনে গুনেই দিচ্ছে। রিসিটটা নাড়াচাড়া করতে করতে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনাকে ভালো দেখাচ্ছে না, অসুস্থ নাকি?

-না মশাই, এই লোহা-মার্কা শরীরে অসুখ-বিসুখ নেই–সেই সকাল থেকে আপনার এই ছবির ব্যাপারে ছোটাছুটি, তারপর তিনটে থেকে ছটা পর্যন্ত ইনকাম ট্যাক্স, সেখান থেকে ডিরেক্টরের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট সেরে আপনার এখানে আসছি –সকাল থেকে চান দূরে থাক পেটে একটা দানা পড়েনি।

আমি ব্যস্ত হয়ে উঠলাম।সে কি! নিজে না এসে বাদাকে পাঠালেই তো পারতেন!

হাসল। হাসিটা কেমন তিক্ত মনে হল আমার। জবাব দিল, তিনি আজ ব্যস্ত বড়, তাঁর ব্যস্ততার সবটুকুই আনন্দের। নিন সই করুন চটপট

রিসিট রেখে টাকার বাণ্ডিল হাতে করে আমি উঠে দাঁড়ালাম। সই পরে হবে, আপনি ঠাণ্ডা হয়ে বসুন, বিশ মিনিটের মধ্যেই আমি আপনার খাওয়ার ব্যবস্থা করছি।

এই আন্তরিকতার ফলে উল্টে কেউ যে বিরক্ত হতে পারে ধারণা ছিল না। হিরু গুপ্ত যথার্থই বিরক্ত। উঠে দাঁড়াল একেবারে।- দেখুন মশাই, আমার মেজাজপত্র এখন ভাল নয়, সই করবেন তো করুন, নইলে আমি চললাম, পরে সই করে পাঠিয়ে দেবেন।

মেজাজ দেখে সত্যিই বিব্রত বোধ করলাম একটু। বসে রিসিট সই করে দিলাম। সেটা দেবার ছলে তার হাত ধরে সকাতরে বললাম, দেখুন সমস্ত দিন উপোস করে আপনি টাকা দিতে এসে শুধু-মুখে ফিরে গেলে খুব খারাপ লাগবে, আপনি দশটা। মিনিট বসুন, আমি যা হোক কিছু ব্যবস্থা করছি।

বিরক্তি চাপতে চেষ্টা করে সোজা মুখের দিকে তাকালো। তারপর কি ভেবে থমকালো একটু।–খাওয়াতে চান?

–যা হোক একটু কিছু

–একটু কিছু কি খাওয়াবেন?

–একটু সময় দিলে যা খেতে চাইবেন তাই খাওয়াব।

হাতঘড়িটা দেখে নিল। সাড়ে সাতটা। আবার চোখে চোখ রেখে দুই এক পলক ভেবে নিল। তারপর কষ্ট করে হেসে বলল, সমস্ত দিন বাদে একটু কিছু খেয়ে আর কি হবে, আজ আপনার সুদিন, খাওয়াতে চান তো ভালো করেই খাওয়াবেন চলুন, আমি গাড়িতে বসছি, চটপট রেডি হয়ে আসুন।

আমি হতভম্ব একটু। হিরু গুপ্ত ততক্ষণে দরজার দিকে পা বাড়িয়েছে। অগত্যা। তাড়াতাড়ি ভিতরে এসে জামাকাপড় বদলে নিলাম। কি খেতে চায় ভগবানই জানেন। নোটের বাণ্ডিল থেকে দুটো একশো টাকার নোট পকেটে ফেলে বেরিয়ে এলাম। স্ত্রী ততক্ষণে খুশিচিত্তে নোটের তাড়া নিয়ে গুনতে বসেছেন।– যা মনে হয়েছিল তাই। গাড়িতে পাঁচটা কথাও হল না, অভিজাত এলাকায় এসে যে ভোজনশালাটি বেছে নিল সেটি পানশালাও বটে। আমি অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম। হিরু গুপ্ত ড্রিংক-এর অর্ডার পেশ করল। আমার চলে না শুনে একটু যেন বিরক্ত। বেয়ারা চলে যেতে মন্তব্য করল, আপনি একেবারে জলো লেখক দেখি

নিঃশব্দে দুদফা গেলাস খালি করল। ইশারায় বয়কে আবার ঢেলে দিতে বলল। ইতিমধ্যে খাবার অর্ডারও সে-ই দিয়েছে। এতক্ষণে একটু একটু করে মেজাজ আসছে। মনে হল। মুখে সস্তা কড়া সিগারেট লেগেই আছে। ঘন ঘন সিগারেট খাওয়াটাও রোগ হিরু গুপ্তর। হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, মদ কেন খাই বলুন তো?

-অভ্যেস করে ফেলেছেন!

-কেন অভ্যাস করতে গেলাম? ভালো জিনিস তো কিছু নয়। এই যে আমি একাই গিলে চলেছি, সামনে বসে আপনি খাচ্ছেন না–আপনার ওপর আমার রাগই হচ্ছে।

জবাব এড়াতে চেষ্টা করে বোকার মত একটু হাসলাম শুধু। চো করে হিরু গুপ্ত গ্লাসের অর্ধেক সাবাড় করল। সিগারেটের ডগায় নতুন সিগারেট ধরিয়ে বলল, আসলে যন্ত্রণা ডোবাবার এ একটা মোক্ষম দাওয়াই। আমিও খেতাম না, এখন এন্তার খাই। শালারা খাবার দিতে এত দেরি করেছ কেন? কি বলছিলাম, যন্ত্রণা! আপনি আমার। সঙ্গে পনেরো দিন এসব জায়গায় ঘুরুন, তারপর বাড়ি ফিরে একদিন দেখুন অন্য কোন লোকের সঙ্গে আপনার বউ পালিয়েছে বা সেই গোছের কিছু একটা হয়েছে। –তখন দেখবেন মদ আপনার একমাত্র বন্ধু। হেসে উঠল, এটা একটা কথার কথা, মানে উপমা

হিরু গুপ্ত এখন কথার মুড-এ আছে। আর এক চুমুকে গেলাস খালি করে হাঁক দিল, বোয়!

হন্তদন্ত হয়ে এসে বয় গেলাস বদলে সোডার বোতল খুলে সামনে রাখল। তার। দিকে চেয়ে হিরু গুপ্ত নৃশংস অথচ ঠাণ্ডা গলায় বলল, পাঁচ মিনিটমে টেবিল পর। খানা নহী আয়ে- তো

বাকিটুকু শেষ করে পাঁচ আঙুলে খোলা সোডার বোতলটা চেপে ধরল সে। এখানকার বয় সম্ভবত খদ্দেরের এই গোছের মেজাজ দেখে অভ্যস্ত। গলা দিয়ে জি সাব নির্গত করে চকিতে উধাও সে। হিরু গুপ্ত গেলাসে সোডা মেশালো। এইবার আমি আন্দাজে একটা ঢিল ছুঁড়লাম। বললাম, আপনার যন্ত্রণাও মেয়েঘটিত নিশ্চয়ই!

গেলাস মুখে তুলতে গিয়েও তোলা হল না। হিরু গুপ্ত আকাশ থেকে পড়ল যেন একেবারে।–আমার যন্ত্রণার কথা আপনি জানলেন কি করে? আমি কিছু বলেছি?

নেশার ঘোরে আলোচনার প্রসঙ্গ এরই মধ্যে ভুলেছে মনে হল। আমার সুবিধেই হল, বললাম, আপনাকে দেখে কেন যেন আমার সেই রকমই মনে হয়।

–কি মনে হয়? উদগ্রীব।

–কোন মেয়ের কাছ থেকে আপনি বড় রকমের আঘাত পেয়েছেন।

থমথমে চোখে মুখের দিকে চেয়ে রইল খানিক। তারপর বড় করে এক টোক গিলে নিয়ে বলল, এই জন্যেই আপনারা লেখক, আপনারা জীবনশিল্পী–আপনার। সম্পর্কে আমার ধারণাই বদলে গেল।

অমায়িক একটু হেসে খাবারের প্রত্যাশায় আমি ঘাড় ফেরালাম। খাবার না আসা পর্যন্ত গেলাসের চাহিদা থামবে বলে মনে হয় না। খাওয়ার ফাঁকে হিরু গুপ্তর যন্ত্রণা প্রসঙ্গে পাড়ি দেবার ইচ্ছে।

গেলাস আধা-আধি খালি। সামনের দিকে ঝুঁকে সাগ্রহে সে এক ধরনের দার্শনিকতার মধ্যে ঢুকে পড়ল।–আপনি আজ টাকা পেলেন আপনার সুদিন, আর সমস্ত দিন উপোস আর ধকলের পর আপনাকে সেই টাকা দেবার জন্য ছুটতে হল বলে আমার মাথায় রক্ত উঠে গেছল। ওদিকে দেখুন, দাদার আজ সব থেকে আনন্দের দিন আর ওই এক কারণে আজই আমার সব থেকে খারাপ দিন। একই কারণে একজনের ভালো তো একজনের খারাপ–একজনের খারাপ তো একজনের ভালো! আশ্চর্য না?

সদয় মুখ করে মাথা নেড়ে সায় দিলাম।-আজকের দিনেই বোধহয় আপনি কাউকে খুইয়েছিলেন?

বেদনায় আর বিস্ময়ে হিরু গুপ্তের ভারী চোখ দুটো বিস্ফারিত।- আপনি তো অদ্ভুত মানুষ দেখি, আঁ! এমনিতে তো মনে হয়, ভাজা মাছখানা উল্টে খেতে জানেন না! সাগ্রহে আরও সামনে ঝুঁকল, গলার স্বর ভাঙা-ভাঙা।–কিন্তু এ যন্ত্রণার শেষ কোথায়? শেষ আছে?

–কি জানি!

–জানেন, জানেন–আপনি অনেক জানেন–বলুন।

ভেবে নিলাম একটু।–শুধু এইটুকু বলতে পারি, আপনার যন্ত্রণা যদি সত্যি হয়, তার একটা ভাগ তিনিও পাচ্ছেন।

নেশা ছোটার উপক্রম। লাফিয়ে উঠল যেন।–পাচ্ছেন? পাচ্ছেন? আপনি ঠিক জানেন?

ভারী গলায় জবাব দিলাম, তা নাহলে যন্ত্রণা আর যন্ত্রণা থাকে না–বিস্বাদ হয়ে যায়।

কি বুঝল হিরু গুপ্ত সে-ই জানে। দুচোখ টান করে চেয়ে রইল।

খাবার এলো।

সেই খাবারের পরিমাণ দেখে আমার চক্ষুস্থির। এত অর্ডার দেওয়া হয়েছে কল্পনাও করিনি। প্রমাণ সাইজের টেবিলটায় হিরু গুপ্তর সোডার বোতল আর গেলাস রাখারও জায়গা নেই। এক চুমুকে সে গেলাসটা খালি করে দিল। টেবিল পরিষ্কার করে দুটো বয় আটটা বড় ডিসে একরাশ খাবার সাজিয়ে দিয়ে গেল।

হিরু গুপ্ত নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসল। ঘোর-লাগা দুই চোখ টান করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ভোজ্যসামগ্রী একদফা নিরীক্ষণ করে নিল। তারপর কাঁটা-চামচে সব একধারে সরিয়ে রেখে হাত লাগালো। আমার উদ্দেশে অস্ফুট স্বরে বলল, শুরু করুন।

আমি শুরু করলাম কি করলাম না দেখার ফুরসত নেই। হিরু গুপ্ত ক্ষিপ্র মেজাজে খেতে লাগল। খাওয়ার ব্যাপারে এই গোছের তৎপর একাগ্রতা কমই দেখেছি। যেন অনেক দিন খেতে পায়নি। তার মধ্যে একরাশ খাবার হাতের কাছে পেয়ে হামহুম করে খেয়ে চলেছে। এই খাওয়ার ঝোঁক দেখে এতক্ষণ সে কোন রাজ্যে ছিল কল্পনাও করা যাবে না। মুখে কথা নেই, অবিরাম মুখ নড়ছে আর হাত নড়ছে। দুচোখ খাবারের ডিশগুলোর ওপরেই চক্কর খাচ্ছে। বলা বাহুল্য, মোট খাবারের চার ভাগের তিন ভাগই সে অক্লেশে উদরস্থ করল। এই খাওয়ার ফাঁকে দুই-একবার আমি পূর্ব প্রসঙ্গ উত্থাপনের চেষ্টায় ছিলাম, কিন্তু তার খাওয়ার তন্ময়তায় চিড় ধরানো গেল না।

একেবারে খাওয়া শেষ করে তবে মুখ তুলল। বড় একটা তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, বেশ খেলাম, আপনার হয়েছে?

-অনেকক্ষণ।

 –চলুন তাহলে ওঠা যাক।

বিল মিটিয়ে আবার তার গাড়িতে গিয়ে উঠলাম। এখনো আশা করছিলাম হিরু গুপ্ত তার যন্ত্রণার প্রসঙ্গ তুলবে। কিন্তু সেটা ওই একরাশ খাবারের তলায় চাপা পড়ল কি আর কিছুর, ভেবে পেলাম না। কিন্তু যা-ই হোক, এই এক সন্ধ্যার পর থেকে হিরু গুপ্ত আমাকে একেবারে তার বুকের কাছের মানুষ ভাবে।

তৃতীয়, সহযাত্ৰিনী প্রসঙ্গ।

ভবঘুরের উক্তির সঙ্গে অনেকটা মেলে। রমণী শুধু সুদর্শনা নয়, সুলক্ষণাও। সুন্দর মুখে একধরনের চাপা মিষ্টি অভিব্যক্তি ছড়িয়ে আছে। মুখ তুলে সোজা মুখের দিকে তাকাতে পারে, কিন্তু চাউনিটা নরম আর ঠাণ্ডা গোছের। বয়েস বড়জোর তিরিশ, লম্বা গড়ন, স্বাস্থ্যও পরিমিত। নড়াচড়ার ফাঁকে নিজেকে একটু ঢেকেঢুকে রাখার সহজাত প্রবৃত্তিটুকুও মিষ্টি লাগল। পঁয়তাল্লিশ বছরের স্থলবপু মজুমদার মশাইয়ের পাশে একটুও মানায় না। কিন্তু সংসারের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ-রকম বেমানান জটিই দেখা যায়। নাম শুনলাম মিলু। মজুমদার মশাই এর মধ্যে বারকয়েক তাকে ওই নামেই ডেকেছেন। সম্ভবত সংক্ষিপ্ত আদরের ডাক এটা।

এক্ষুণি খাওয়ার প্রসঙ্গ বাতিল করে হিরু গুপ্ত তার সস্ত কড়া ব্র্যাণ্ডের সিগারেট বার করে ঠোঁটে ঝোলালো। তার পরেই একটু থমকে রমণীর দিকে তাকালো। রমণীর ঈষৎ অপ্রসন্ন ঠাণ্ডা চাউনি লক্ষ্য করলাম আমিও। এটুকুও সুচারু মনে হল। ১৬২

ঠোঁট থেকে সিগারেট নামিয়ে হিরু গুপ্ত বলে উঠল, যাচ্ছি বাবা, বাইরে যাচ্ছি। এই জন্যেই নিজের জন্য আলাদা কম্পার্টমেন্ট করতে চেয়েছিলাম, এখন পনেরো মিষ্টি অন্তর উঠে বাইরে গিয়ে সিগারেট খেয়ে আসতে হবে

গজগজ করতে করতে উঠে দাঁড়াল সে। মজুমদার মশাইয়ের হাসিতে হে। ঝরল–তোরই তো দোষ, এতদিনে সিগারেটের গন্ধটাও সহ্য করাতে পারলি না–

প্রোডিউসার দাদার মুখের ওপর বেশ জুতসই সরস জবাব দিতে পারে দেখলাম হিরু গুপ্ত। বলল, দখলদার তুমি, আর সহ্য করানোর দায় আমার?–চেষ্টা করলে তোমার খুব ভালো লাগবে?

আমি বাইরের মানুষ সামনে বসে বলেই হয়তো রমণীর আরক্ত মুখ। মজুমদার মশাই জোরেই হেসে উঠলেন। মিলুর মুখের ওপর একটা বিরক্তিসূচক কটাক্ষ নিক্ষেপ করে সিগারেট ঠোঁটে ঝুলিয়ে হিরু গুপ্ত দরজা টেনে করিডোরে চলে গেল।

স্টেশনে আসা এবং ট্রেনে ওঠার পর থেকে এইটুকু সময়ের মধ্যেই আমার ভিতরে ভিতরে একটা নিঃশব্দ প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে। স্ত্রটির সঙ্গে মজুমদার মশই স্টেশনেই আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর থেকে এই অবকাশটুকুর মধ্যে আমার কেবলই মনে হয়েছে, সেই সন্ধ্যায় পানাসক্ত হিরু গুপ্ত যে যন্ত্রণার কথা বলেছিল সেটা এই রমণীর কারণে। হিরু গুপ্ত সেটা আভাসেও আমার কাছে ব্যক্ত করেনি, শুধু সেই সন্ধ্যার কিছু কথা মনে পড়েছে। এই যোগাযোগে তার বিরক্তি, গাম্ভীর্য আর পরোক্ষ মনোযোগ এই রমণীর প্রতি যেন বিশেষভাবে নিবিষ্ট দেখেছি। ট্রেন আসতে ব্যস্তসমস্তভাবে হাত ধরে মিলুকে গাড়িতে তুলতে দেখেছি। অথচ এই ব্যস্ততার কোন হেতু নেই। ওদের পিছনে আমি। কুলির মাল তোলা হলে মজুমদার মশাই ধীরেসুস্থে আসবেন বোধ হয়। সরু করিডোর ধরেও রমণীটিকে পিছন থেকে প্রায় আগলে নিয়ে এসেছে হিরু গুপ্ত। চোখের ভ্রম কিনা জানি না, এমনও মনে হয়েছে–কনুইয়ের মৃদু ধাক্কায় রমণী তাকে একটু ঠেলে সরাতে চেষ্টা করেছে আর তখন অস্ফুট স্বরে হিরু গুপ্ত গলা দিয়ে একটু ক্রুদ্ধ আওয়াজ বার করেছে। চলতি ট্রেনে জিনিসগুলো টুকটাক গুছিয়ে রাখার সময় ঝাঁকুনিতে রমণী দুই-একবার বেসামাল হয়েছিল, কিন্তু তাকে রক্ষা করার জন্য পিছনে হিরু গুপ্ত মজুত। সে তক্ষুণি তার দুই বাহুর ওপর দখল নিয়েছে। আর তারপর হিরু গুপ্তর বিরক্তিমাখা গম্ভীর চোখ কতবার যে ওই রমণীর মুখে এবং দেহে বিদ্ধ হতে দেখেছি ঠিক নেই। আমার ধারণা, পুরুষের এই চাউনি আমি চিনি। কিন্তু মজুমদার মশাই এ-সব সংশয়ের ধার-কাছ দিয়েও হাঁটেন মনে হয় না।

সিগারেট শেষ করে তেমনি অপ্রসন্ন মুখে তার জায়গায় এসে বসল। আপাতত তার জায়গা বলতে মিলুর পাশে। এদিকের বার্থে আমি আর মজুমদার মশাই। কথায় কথায় ছবির প্রসঙ্গ উঠল–অর্থাৎ যে ছবিতে মজুমদার মশাই হাত দিয়েছেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন হবে বলুন?

–আমি কি বলব!

–বাঃ আপনার গল্প, আপনি বলবেন না তো কে বলবে?

মহিলার দিকে ফিরে ঈষৎ আগ্রহে জিজ্ঞাসা করলাম, বইটা আপনি পড়েছেন?

মৃদু হেসে মিলু সামান্য মাথা নাড়ল। মজুমদার মশাই বলে উঠলেন, বা রে, এই গল্প সিলেকশনের পিছনে আসল ব্যাপারটাই তো আপনি জানেন না দেখছি! বই পড়ে ও-ই তো প্রথমে আমার পিছনে লাগে–এবারে এই গল্পটা করো। আপনার বই তো আমি আজও পড়িনি মশাই, তিনবার করে ওর মুখে গল্প শুনেছি।

লেখক মাত্রেরই ভালো লাগার কথা! ভালো লাগল। মিলুরও হাসি-হাসি মুখ। চকিতে হিরু গুপ্তর দিকে তাকালাম। তার অসহিষ্ণু বিরস বদন। কারণ আমার কাছে গল্প সিলেকশনের যে ফিরিস্তি সে দিয়েছে তার সঙ্গে এটা মিলছে না। চোখাচোখি হতে মর্যাদা রক্ষার তাগিদে ঠোঁটের ফাঁকে হঠাৎ একটু হাসি ঝুলিয়ে উঠে একেবারে আমার কানের সঙ্গে মুখ ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বলল, ঠাকরোণকে দিয়ে কলকাঠিটি কে নেড়েছে দাদা সেটা জানলেও বলবে না। নিজের জায়গায় ফিরে গেল আবার। মিলুর চকিত চাউনি। মজুমদার মশাই ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলেন, কি বললি শুনি?

হিরু গুপ্ত সাদাসাপটা জবাব দিল, বললাম, দাদা কার ক্রেডিট কাকে দিচ্ছে দেখুন! বউদির তোয়াজ করার সুযোগ পেলে তুমি ছাড়ো না!

মজুমদার মশাই সহাস্যে বললেন, তুই তো তোর বউদির কিছুই ভালো দেখিস না–এ গল্প কে আমার মাথায় ঢুকিয়েছে জেনেও লাগতে ছাড়বি না!

হিরু গুপ্তর হাসিটা তখনো ঠোঁটে ধরা আছে কিন্তু গলার স্বর একটু যেন অসহিষ্ণু।–তাহলে নাও গো, গল্পের ছবি কেমন হবে তুমিই লেখককে বলো।

নির্বাক মহিলার দুই চোখ অব্যাহতি চাইছে। হৃষ্টবদন মজুমদার মশাই বললেন, ও কি বলবে ছবি কেমন হবে না হবে! সে তো তোর ওপর নির্ভর করছে। আমার দিকে ফিরলেন–হিরু না থাকলে আমার ব্যবসা অচল আমিও অচল–সেটা জানে বলেই ওর এত দেমাক, বুঝলেন?

বার বার শাড়ির আঁচল টেনেটুনে বসাটা মহিলার একটা মিষ্টি অভ্যাস ভেবেছিলাম। এখন কেমন মনে হল, সেটা হিরু গুপ্তর ঘন-কটাক্ষ প্রতিহত করার দরুনও হতে পারে। মালিকের প্রশস্তি শুনে তার প্রসন্ন গম্ভীর তির্যক চাউনিটা রমণীর মুখের ওপর বিধে থাকল খানিক। আমার মনে হল, মিলু মজুমদারের ধড়ফড়ানি দেখলাম একটু।

হিরু গুপ্ত উঠে দাঁড়াল। মালিকের মন রক্ষার সুরে বলল, মুখ না চললে সত্যিই আর ভালো লাগছে না।

মজুমদার মশাই হাসলেন। ভাবখানা–আমি তো আগেই বলেছিলাম।

দুটো ছোট ডিশ আর একটা বড় ডিশে দুভাগ করে হিরু গুপ্ত শুকনো খাবার সাজালো। লোভনীয় সন্দেহ নেই। পেল্লাই সাইজের একটা করে চপ আর চিকেন কাটলেট, সঙ্গে মুখরোচক স্যালাড। ছোট ডিসের একটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল, একটা মজুমদার মশাইয়ের দিকে। তারপর বড় থালার মত ডিশটা নিজেদের বেঞ্চের মাঝখানে রেখে রমণীর উদ্দেশে গম্ভীর রসিকতা করল, এসো–আমারটা নিয়ে টানাটানি কোরো না আবার!

সকলের চোখের ওপর বড় ডিশে দুজনের খাবারটা একসঙ্গে নেওয়া এমন কিছু দৃষ্টিকটু নয়, অথচ আমার ভালো লাগল না। ওদিকে রসিকতার জবাবে মিলু মজুমদার বলে ফেলল, আমি এখন খাবই না কিছু।

গলার স্বরটুকুও নিটোল মিষ্টি। কিন্তু এতেই হিরু গুপ্তের মেজাজ চড়ল, খাবে না মানে?

বিব্রত মুখে মিলু হাসতে চেষ্টা করল একটু।–খাব না মানে আবার কি—

–খাবে না তো আগে বললে না কেন?

তেমন মৃদু হাসি।–আগে তুমি জিজ্ঞাসা করেছ?

–আমাকে খাবার বার করতে দেখেও বললে না কেন?

–আচ্ছা আমারটা আমি রেখে আসছি।

–রেখে আসতে হবে না, তুমি খাবে কি খাবে না আমি জানতে চাই।

মিলু তার চোখে চোখ রেখেই আবার ডাইনে বাঁয়ে মাথা নাড়ল– অর্থাৎ না। মজুমদার মশাই এতক্ষণ দেওর-ভাজের কথা-কাটাকাটি উপভোগ করছিলেন যেন। এবারে বললেন, আহা মিলু, ওকে রাগাচ্ছ কেন, যা হোক একটা তুলে নাও না!

বিরক্তি চাপতে চেষ্টা করে মিলু বলল, আমার এখন খাওয়ার ইচ্ছে নেই তবু জোর করছ কেন?

স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি হিরু গুপ্ত অপমান বোধ করছে। শেষবারের মতই জিজ্ঞাসা করল, তুমি খাবে না তাহলে?

তাকে জবাব দেবার বেলায় আবার হাসি-হাসি মুখ মিলুর। জবাব দিল না, মাথা নাড়ল– খাবে না।

সরোষে বড় ডিশটা নিজের দিকে টেনে নিল হিরু গুপ্ত। আমি ভাবলাম ওটা বুঝি এবার জানলা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দেবে! না, তার বদলে নিজে খাওয়া শুরু করল। ওর খাওয়ার এই একাগ্র ধরনটা আমি আগেও দেখেছি। আমাদের আগেই নিজের ভাগটা শেষ করল। পরে দ্বিতীয় ভাগটাও। আমি আর মজুমদার মশাই হাসছি। অল্প। অল্প হাসছে মিলু। হাসি নেই শুধু হিরু গুপ্তের মুখে।

খাওয়া শেষ করে তিনটে ডিশই একসঙ্গে করে কোণের দিকে সরিয়ে রাখল। অ্যাটেনডিং কারে চাকর আছে, স্টেশনে গাড়ি থামলে সে এসে ওগুলো পরিষ্কার করে রেখে যাবে। আমরা আগেই জল খেয়ে নিয়েছিলাম। হিরু গুপ্ত ঢক ঢক করে এক গেলাস জল খেয়ে পকেট থেকে সিগারেট বার করতে করতে দরজা খুলে করিডোরে চলে গেল। অর্থাৎ রাগ তার একটুও পড়েনি।

আমার দিকে ফিরে মজুমদার মশাই প্রসন্ন মন্তব্য করলেন, বেজায় চটেছে, ভয়ানক ভালবাসে তো–আর ও-ও ফাঁক পেলেই রাগাবে।

আড়চোখে রমণীর মুখখানা দেখে নিলাম। দুচোখ জানলা দিয়ে দূরের দিকে প্রসারিত।

সিগারেট একটু আধটু আমিও খাই। সেই অছিলায় বাইরে চলে এলাম। করিডোরে এসে দরজাটা আবার টেনে দিয়েছি।

বইরের দিকে চেয়ে হিরু গুপ্ত সিগারেট টানছে। আমার সিগারেট ধরাবার শব্দে একবার ফিরে তাকালো। গম্ভীর রাগ-রাগ মুখ।

বলে ফেললাম, আপনার হঠাৎ এত রাগের কি হল, ভদ্রমহিলার খিদে পায়নি তাই খেতে আপত্তি করেছেন।

ঠোঁটের সিগারেট হলদে দুই আঙুলের ফাঁকে উঠে এলো হিরু গুপ্তর। গোল দুটো চোখ আমার মুখের ওপর স্থির একটু। ক্রুদ্ধ চাপা স্বরে বলল, খিদের আসল চেহারাট আপনি জানেন? দেখেছেন কখনো?

মনে হল ইন্ধন যোগাতে পারলে হিরু গুপ্ত কিছু কথা বলতে পারে। কলকাতার। সেই হেঁটেলের পানভোজনের রাত থেকেই আমার মনে হয়েছে শোনানোর মত কিছু কথা হিরু গুপ্তর ঝুলিতে আছে। বোকা মুখ করে বললাম, সে আবার কি?

-আমি দেখেছি, বুঝলেন? তিন দিনে একদিন খাওয়া জোটে না, এই দুটো হাত ধরে বিবা মা আর মেয়ের সে কি আকৃতি–আমি গিয়ে না পড়লে খিদের জ্বালায়। ওই মেয়েকেই কটা হায়নার মুখে গিয়ে পড়তে হত খুব ভালো করে জানি–বুঝলেন?

সিগারেটে লম্বা অসহিষ্ণু দুটো টান দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে মন্তব্য করলে, আর এখন। তার এত অঢেল যে খিদে পায় না, যতসব ঢং–ওতে দাদা ভোলে, আমি ভুলি না!

একটু চেষ্টা করে মনে করতে হল।-হ্যাঁ, কেন বলুন তো?

-সেদিন আপনার মেজাজ-পত্র ভালো ছিল না। খেতে খেতে কি একটা যন্ত্রণার। কথা বলহিলেন–আর বলছিলেন আপনার দাদার সেটা সব থেকে আনন্দের দিন আর সেই কারণেই ওটা আপনার সব থেকে খারাপ দিন।

গেল দুটো চোখ আমার মুখের উপর চক্কর খেল একপ্রস্থ। গাম্ভীর্য সত্ত্বেও অন্তরঙ্গ সুরেই বলল, আপনি খুব চতুর লোক, সেদিন বেমক্কা পেয়ে কথা বার করে নিয়েছেন।–সত্যি এক এক সময় এত যন্ত্রণা হয়!

বললাম, আত্মত্যাগের একটু-আধটু যন্ত্রণা আছেই।

শেষেরটুকু কানে গেলই না বোধ হয়, সাগ্রহে কাছে সরে এসে জিজ্ঞাসা করল, আমার আত্মত্যাগের কথা ও আপনাকে বলেছিলাম নাকি?

-না, অনুমান করেছিলাম।

-কই করেছিলেন। বড় একটা নিশ্বাস ফেলে সিগারেটের খোঁজে পকেটে হাত ঢোকালে

যুর জায়গায় মোচড় পড়তে এরপর হিরু গুপ্ত যা জানালো তার সারমর্ম, বিধবা আর তার মেয়ে মিলুকে সে আগেই জানত। হুগলীর দিকে থাকত তারা। মেয়েটা দেখতে শুনতে ভালো আর খুব চালাক-চতুর। বরাবরই হিরু গুপ্তর ভালো লাগত। নেক দিনের ছাড়াছাড়ির পর আবার যখন দেখা, ওই মা-মেয়ের অচল অবস্থা। তখন, ওয়া জোটে না, পরনের কাপড় জোটে না। সময়ে সে গিয়ে না পড়লে আর পাঁচজনে ছিঁড়ে খেত ওই মেয়েকে, ওদের ঘর আঁস্তাকুড় হয়ে উঠত। হিরু গুপ্ত মিলুকে ছবিতে নামাবে ঠিক করে কলকাতায় নিয়ে এসেছিল। মিলু সানন্দে রাজী হয়েছিল কালে দিনে এই মেয়ে নামী নায়িকা হতে পারত। আর তারপর বিয়েটাও সে-ই করত। কিন্তু সব ভণ্ডুল করল দাদা অর্থাৎ মজুমদার মশাই। মিলুকে একটা ভালো জায়গায় রাখা হয়েছিল আর তার সবে তখন ট্রেনিং চলছিল। দরাজ হাতে দাদাই খরচ যোগাচ্ছিল। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যে তার এমন মনে ধরে গেল যে মেয়েটাকে আর ছবিতে নামতেই দিল না। বিয়ের প্রস্তাব করল। হিরু গুপ্ত কত বড় আঘাত পেল সে-ই জানে–দাদার জন্যেই সব, দাদার জন্যেই যা-কিছু। নিজে ওদের বিয়ে দিল। মিলু প্রথমে রাজী হয়নি, শেষে অনেক বোঝাতে তবে রাজী।…

এখন সেই মেয়েরই নাকি খিদে হয় না, সিগারেটের গন্ধ সহ্য হয় না!

দুজনেই চুপচাপ খানিক। চাপা আগ্রহে হঠাৎ হিরু গুপ্ত আবার বলল, কলকাতার। সেই হোটেলে আপনিও যেন কি বলেছিলেন–আমার যন্ত্রণার একটা ভাগ আর একজনও পাচ্ছে নাকি–সত্যি যন্ত্রণা পাচ্ছে? বলুন না?

মহিলার সপ্রতিভ মিষ্টি মুখখানা চোখে লেগে আছে। আজ আর হিরু ও গুর কথায় সায় দিতে পারা গেল না। বললাম, সেদিন কি বলেছিলাম মনে পড়ছে না–তবে সে রকম যন্ত্রণা কিছু পুষছেন বলেও তো মনে হয় না।

মিলু মজুমদার পরস্ত্রী হিরু গুপ্ত এই ভবিতব্যটা মেনে নিক এটুকু আমার কাম্য। তাই বলা। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে লোকটার মুখ থমথমে আবার। সিগারেটে দুটো অসহিষ্ণু টান দিয়ে বিড়বিড় করে বলল, আপনার মতে তাহলে উনি সুখের সাগরে ভাসছেন এখন, কেমন? কিন্তু ও নির্বোধ না হলে এতদিনে এও ওর বোঝা উচিত, সব সুখ আমি ঝাঁঝরা করে দিতে পারি–এই দুনিয়ায় দাদা আমাকেই সব থেকে বেশি বিশ্বাস করে, আমার ওপরই সব থেকে বেশি নির্ভর করে। ওকে ছাড়া দাদার চলতে পারে কিন্তু আমাকে ছাড়া চলে না সেটা ও জানে।

বিরক্তি গোপন করে জবাব দিলাম, ভালই যদি বাসেন তো এতবড় ক্ষতি আপনি করবেন কেন?

যন্ত্রণাপ্রসঙ্গে আমার সেই মন্তব্যের ফলেই মিলু মজুমদারের সঙ্গে তার পরের আচরণ আরো রুক্ষ হয়ে উঠল কিনা জানি না। কেবিনে ঢুকেও তার সঙ্গে আর কথাবার্তা কইতে দেখলাম না। তার রাগ মহিলা ঠিকই আঁচ করেছে মনে হল। তার তোয়াজের মুখ একটু। কিন্তু হিরু গুপ্ত নির্লিপ্ত, কঠিন।

ভোজের ব্যাপারে রসিক দেখলাম বটে আমার সহযাত্রী দুজন। চব্বিশ ঘণ্টার রাস্তার জন্য এত খাবারও কেউ আনে কল্পনা করা যায় না। বড় বড় অনেকগুলো ডিশে হিরু গুপ্তই একরাশ করে দুপুরের খাবার সাজালো। তারপর কতকগুলো ডিশ আমার আর তার দাদার দিকে ঠেলে দিল আর বাকি কটা নিজের দিকে টেনে নিল। মহিলা খাবে কি খাবে না তা নিয়ে যেন তার কোন মাথাব্যথা নেই।

মজুমদার মশাই ভাইয়ের রাগ দেখে মুখ টিপে হাসছেন। আমার চোখে চোখ। পড়তে মিলু বিড়ম্বনার ভাবটা কাটিয়ে সহজ হাসিমুখেই দেওরের দিকে তাকাল– আমাকে দিলে না?

মুখ ঈষৎ বিকৃত করে হিরু গুপ্ত তিক্ত প্রশ্ন ছুঁড়ল, আমার ছোঁয়া তোমার চলবে?

 হাসি-হাসি মুখেই মিলু মাথা নাড়ল–অর্থাৎ চলবে।

এই তোষামোদেও হিরু গুপ্তর মেজাজ নরম হল না। সে নিবিষ্ট রুক্ষ মুখে। খাবার চালান করতে লাগল। হাসিমুখে মজুমদার মশাই চাপা গলায় আমাকে বললেন, বেজায় ক্ষেপেছে দেখছি আজ… আবার ভাব হতেও খুব বেশি সময় লাগবে না, আপনি খান!

তবু মহিলার দিকে চেয়ে বললাম, আমি দেব আপনাকে?

হিরু গুপ্তর ক্রুদ্ধ দুচোখ আমার মুখের ওপর চড়াও হল–আপনার দরদ দেখাতে হবে না, সকলেরই দুটো হাত আছে সেটা ও সকালেই বুঝিয়ে দিয়েছে।

কথা-কাটাকাটির ভয়েই যেন মিলু মজুমদার তাড়াতাড়ি উঠল। একটি মাত্র বড় ডিশ নিয়ে খাবার তুলে নিল। আমাদের তুলনায় অতি সামান্যই নিল বলতে হবে। এত সামান্য যে চোখে পড়ে। আমি বললাম, ও কি, নিজে নেবার ফলে যে কিছুই নিলেন না!

অল্প হেসে জবাব দিল, আমি এর বেশি পারি না।

খেতে খেতে হিরু গুপ্ত তপ্ত ব্যঙ্গ ছুঁড়ল, অঢেল থাকলে তখন বেশি পারা যায় না, না থাকলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড খেতে পেলেও বেশি হয় না।

মিলু হাসছে বটে! কিন্তু হাসিটা কেমন নিষ্প্রভ মনে হল আমার। –হিরু গুপ্ত বলেছিল সমস্ত সুখ আঁঝরা করে দিতে পারে, সেটা সত্যি মহিলা জানে মনে হল। তোয়াজের অভিব্যক্তিটুকু হয়তো সেই কারণে।

বিকেলের ভারী জলযোগ-পর্বেও হিরু গুপ্তর মেজাজ একটুও নরম দেখলাম না। কি হল ভেবে না পেয়ে মিলও যেন বিস্মিত একটু। তবে রাতের আহার-পর্বের সময় হিরু গুপ্তর রুক্ষ মুখ কিছু ঠাণ্ডা মনে হল। তেরছা সুরে সে জিজ্ঞাসা করল, আমার পরিবেশন চলবে, না অশুদ্ধ হবে?

হাসিমুখেই মিলুকে তাড়াতাড়ি মাথা নাড়তে দেখলাম। অর্থাৎ চলবে। হিরু গুপ্তর মেজাজের পরিবর্তন অন্য কারণেও হতে পারে। সে খাবার সাজাবার তোড়জোড় করার সঙ্গে সঙ্গে মজুমদার মশাই আস্ত মদের বোতল বার করেছেন একটা। ঈষৎ সঙ্কুচিত চোখে মিলু আমার দিকে তাকিয়েছে। আমার সহজ হবার চেষ্টা–এ যেন অস্বাভাবিক কিছুই না।

আমার চলে না শুনে মজুমদার মশাই দুই-একটা হালকা রসিকতা করলেন। তার পর নিজের গেলাসে বেশ খানিকটা মদ ঢেলে নিলেন। দ্বিতীয় গেলাসে ঢালার আগেই হিরু গুপ্ত বাধা দিল, আমি এখন না, শরীরটা ভালো লাগছে না।

-সে কি রে! ভালো লাগছে না বলেই তো এটা বার করলাম! সেই সকাল থেকে তোর যে রকম মেজাজ চলছে, খেলেই হালকা হয়ে যাবে, নে–

হিরু গুপ্ত বলল, তুমি খাও তো, আমার এখন ইচ্ছে করছে না, পরে দেখা যাবে। মজুমদার মশাই গোড়াতে একটু ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন বোধহয়, কিন্তু গেলাসের তরল পদার্থ প্রথম দফায় শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি হৃষ্টচিত্ত। আর বিপুল আহার সহযোগে আধখানা বোতল খালি হয়ে যাবার পর স্বতঃস্ফুর্ত আনন্দে দুলছেন তিনি, অর্থাৎ সোজা হয়ে বসতেও পারছেন না।

রাতেও মিলুর সেই পরিচ্ছন্ন স্বল্পাহার লক্ষ্য করলাম। ঠিক দেখছি কিনা জানি না, তার মুখে একটু শংকার ছায়া। আড়চোখে এক এক বার দেওরকে দেখে নিচ্ছে। হিরু গুপ্ত গভীর মনোযোগে খেয়ে চলেছে।

শরীরটা আসলে আমারই খুব খারাপ লাগছিল। মাথাটা সেই থেকে ধরে আছে, আর এখন বেজায় টন টন করছে। এই এক রোগ আমার। তখন কড়া ঘুমের বড়ি খেয়ে পড়ে থাকতে নয়, নইলে সমস্ত রাত ধরে যন্ত্রণা চলবে। সেই ট্যাবলেট সঙ্গেই থাকে। খাওয়া শেষ করে স্যুটকেস থেকে ট্যাবলেটের শিশিটা বার করতে দেখে মজুমদার মশাই টেনে টেনে জিজ্ঞেস করলেন, কি ওটা?

-ঘুমের ওষুধ, মাথায় বড় যন্ত্রণা হচ্ছে সেই থেকে।

মজুমদার মশাই হেসে উঠলেন, বললেন, একেই বলে কপাল, যন্ত্রণার আর ঘুমের এমন মহৌষধ হাতের কাছে থাকতে আপনি ট্যাবলেট গিলছেন!

মিলুর খাওয়া আগেই হয়ে গেছল। এদেরও শেষ। ডিশ আর পাত্রগুলো সব একত্র করে হিরু গুপ্ত বাইরের করিডোরে রেখে এলো। নীচে খবরের কাগজ পাতা হয়েছিল, সেগুলো জড়ো করে জানালা দিয়ে ফেলে দিল। তারপর মুখ হাত ধুয়ে। মুহে সে বাইরে সিগারেট খেতে যাওয়ার উদ্যোগ করতে মজুমদার মশাই আবেদনের সুরে বললেন, আমার বিছানাটা আগে ঠিক করে দিয়ে যা–

অর্থাৎ তিনি আর বসতেও পারছেন না। কোনরকম উঠে ধপ করে মিলুর পাশে বসলেন। হিরু গুপ্ত তৎপর হাতে তার শয্যারচনা করে দিতে তিনি সেটি গ্রহণ করে বাঁচলেন যেন।

মিলুর শয্যাও একই সঙ্গে বিছানো হয়ে গেল। আমার কেমন মনে হল, ও যেন একটু বেশি চুপচাপ এখন। আমি ততক্ষণে আমার বার্থে উঠে গা এলিয়ে দিয়েছি। মি তার জানালার পাশে বসল। চড়া বাতিগুলো নিভিয়ে দিয়ে হিরু গুপ্ত সবুজ আলোটা জ্বালতে মজুমদার মশাই বিড় বিড় করে উঠলেন, নিভিয়ে দে, নিভিয়ে দে–কি দরকার!

অতএব সেটাও নিভিয়ে ঘর অন্ধকার করে হিরু গুপ্ত বাইরে সিগারেট খেতে গেল। আর তার দুমিনিটের মধ্যে মজুমদার মশায়ের পরিতৃপ্ত নাসিকা-গর্জন শোনা যেতে লাগল।

আমি হঠাৎ অস্বস্তি বোধ করছি কেন একটু, জানি না। মিনিট পনেরো বাদে হিরু ও নিঃশব্দে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল টের পেলাম। ঘুমে তখন দুচোখ বুজে আসছে আমার। ভিতর থেকে দরজা লক করে ঘুরে দাঁড়াল। অন্ধকারে চুপচাপ দাঁড়িয়েই রইল একটু। জানলা খোলা থাকায় নীচের দিকটা সামান্য আবছা দেখা যাচ্ছে। ওপরটা একেবারে অন্ধকার।

হিরু গুপ্ত পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে মিলুর বেঞ্চির অন্য ধার ঘেঁষে বসল। এক্ষণি আপার বার্থে উঠে শোবার ইচ্ছে নেই বোধহয়। মজুমদার মশাইয়ের নাকের গর্জন বেড়েছে। মিলু জানলার দিকে মুখ করে বসে আছে।

ঘুমে চোখ তাকাতে পারছি না, কিন্তু ভিতরের অস্বস্তি বাড়ছেই। মিলুর মুখে শঙ্কার ছায়া দেখেছিলাম কেন–হিরু গুপ্ত মদ খাচ্ছে না বলে?

অস্বস্তি নিয়েই তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়েছিলাম হয়তো। কতক্ষণ কেটেছে জানি না। চোখ টান করে দেখি মিলু তেমনি জানলার কাছে বসে আছে, আর হিরু গুপ্ত ওখানে বসেই সিগারেট টানছে–সস্তা কড়া সিগারেটের উগ্র গন্ধ নাকে আসছে।

হঠাৎ রাগই হচ্ছে আমার। কিন্তু বেশিক্ষণ চোখ তাকিয়ে থাকা গেল না। এবারে ঘুমিয়েই পড়লাম।

কিন্তু ভিতরের অস্বস্তিটাই আবার আমাকে জাগিয়ে দিয়েছে কিনা জানি না। যে দৃশ্য দেখলাম, ভিতরটা ধড়ফড় করে উঠল। মিলু জানলার কাছ থেকে সরে এসেছে। আর হিরু গুপ্ত খানিকটা ওধারে সরেছে। দুজনের মাঝে বড়জোড় হাত খানেক ফারাক। সেটুকুও কমিয়ে আনার জন্য হিরু গুপ্ত মিলুর একখানা বাহু ধরে টানাটানি করছে, আর মিলু একবার তার হাত ঠেলে সরাচ্ছে আর দুহাতে এক-একবার ধাক্কা দিয়ে। তাকে বেঞ্চির ওধারে ঠেলে সরাতে চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। ফলে হিরু গুপ্তর। উপদ্রবের চেষ্টাটা এক-একবার আরো অশালীন হয়ে উঠছে।

দুজনের কারো মুখে ফিস ফিস শব্দটিও নেই। শুধু মজুমদার মশাইয়ের নাকের গর্জন শোনা যাচ্ছে।

মাথায় রক্ত উঠছে আমার। চিৎকার করে ধমকে উঠতে ইচ্ছে করছিল। এদের এই নিঃশব্দ লীলা কতদূর গড়াবে আরো?

গাড়ির গতি হঠাৎ শ্লথ হয়ে আসতে নীচের ওই দুজন সচেতন একটু। হয়তো স্টেশন আসছে। গতি কমছেই। শেষে বিচ্ছিরি রকমের একটা ঘটাং-ঘটাং শব্দ করে গাড়িটা থেমেই গেল। সেই শব্দে যেন ঘুম ভাঙল আমার। গলা-খাঁকারি দিয়ে আড়মোড়া ভাঙলাম। তারপর উঠে বসলাম।

হিরু গুপ্ত ততক্ষণে বেঞ্চির এধারে সরে এসেছে। জিজ্ঞাসা করলাম, স্টেশন নাকি?

–না, এমনি থেমেছে।

–আপনি শোননি এখনো? কটা বাজল?

অন্ধকারেই ঘড়ি দেখে জবাব দিল, একটা। আমার অত চট করে ঘুম আসে না। একটু বাদেই গাড়ি চলতে শুরু করল আবার। আর আমিই বা শুয়ে না পড়ে কি করব! বেশ খানিকক্ষণ জেগেই ছিলাম, ওরা তফাতেই বসে আছে। শেষে ঘুমের জ্বালায় অস্থির হয়ে ওদের দুজনকেই মনে মনে জাহান্নমে পাঠিয়ে ও-পাশ ফিরলাম।

আবার যখন ঘুম ভাঙল, সকাল।

হিরু গুপ্ত আপার বার্থে অঘোরে ঘুমুচ্ছে। নীচে মজুমদার মশাইয়ের ঘুম ভাঙেনি তখনো। মিলু জানলার পাশে বসে আছে। একটু আগে মুখে-চোখে জল দিয়ে এসেছে। বোধহয়। ভেজা-ভেজা মুখখানা মিষ্টি। কিন্তু আমার কুৎসিত লাগছে। রাতের লীলা কোন পর্যন্ত গড়িয়েছে আমি জানি না।

আটটায় পৌঁছবার কথা। সকাল সাড়ে ছটা নাগাদ সকলে উঠে পড়েছে।

 মনে হল মিলু আর হিরু গুপ্ত এক-একবার আমাকে লক্ষ্য করছে। আমি ওদের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছি না বলেই হয়তো।

গাড়িটা একটা গণ্ডগ্রামের মত জায়গায় থেমে আছে কেন বুঝছি না। ধারে-কাছে লোকালয় নেই। দুদিকে খাঁ-খাঁ মাঠে আধা-শুকনো একটা বিল–দূরে জঙ্গলের রেখা।

খানিক বাদে কনডাক্টর-গার্ডের মুখে শুনলাম, সামনে কি গণ্ডগোল হয়েছে তাই গাড়ি লেট। পরের বড় স্টেশন ফয়েজাবাদ, কিন্তু সেও সাতাশ মাইল দূরে এখান থেকে। ওখানে পৌঁছাবার আগে চা বা কোনরকম খাবার মেলার আশা নেই।

মজুমদার মশাই আর হিরু গুপ্তর মুখ দেখার মত। সকালে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ এ যেন এক বজ্রাঘাত। বেলা দশটা না বাজতে অন্য কেবিনের যাত্রীদেরও ছটফটানি দেখা গেল। গাড়ির বহু যাত্রী নীচের প্রাঙ্গণে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

বেলা দেড়টা নাগাদ হিরু গুপ্ত খবর নিয়ে এলো ফয়েজাবাদের আগে কোথায় এঞ্জিন উল্টে আছে। লাইনও গেছে। আমাদের গাড়ির এঞ্জিন সাহাযার্থে সেখানে চলে গেছে। অতএব এ গাড়ি কখন নড়বে তার কিছুই ঠিক নেই।

শুনে মজুমদার মশাই হাল ছেড়ে শুয়েই পড়লেন। এদের দুজনকে দেখে মনে হল বেলা দেড়টার মধ্যেই যেন দেড় দিন ধরে উপোসী!

ক্লান্তিকর ভাবে ঘড়ির কাটা বিকেল সাড়ে চারটের কাছাকাছি পৌঁছল। এক গাড়ি লোকের একটা ক্ষুধার অসহিষ্ণ চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠছে। গাড়ির পাঁচ ভাগের চার ভাগ লোক তখন নীচে। শুনলাম অনেকে খাওয়ার সন্ধানে চার মাইল দূরের গাঁয়ের দিকে চলে গেছে। যারা জানে এ এলাকা তারা বলছে, ওই গণ্ডগ্রামে চিড়ে-মুড়ি জুটবে কিনা সন্দেহ! অদূরের প্রায়-শুকনো বিলে কয়েকজন গাঁয়ের লোক ছিপ ফেলে মাছ। ধরছে। সেখানেও ভিড় করে ট্রেনের যাত্রী দাঁড়িয়ে গেছে। দুই-একটা পাঁকাল মাছ। উঠতে দেখলে উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠছে আর চোখ দিয়ে গিলছে।

বেলা বাড়ছে। সূর্যের তেজ কমছে। যাত্রীদের ফার্স্ট সেকেণ্ড থার্ড ক্লাসের বিভেদ ঘুচে গেছে। তাদের মিলিত জটলায় শুধু ক্ষুধার চিত্রটাই উদগ্র হয়ে উঠছে। মজুমদার মশাই হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়েছেন। আমার মনে হল খিদের জ্বালায় ধুকছেন তিনি। ধুকছে হিরু গুপ্তও। কিন্তু তার ক্ষিপ্ত অসহিষ্ণু আচরণ। একবার নেমে যাচ্ছে, খানিক বাদে উঠে আসছে, আবার নামছে। আর কার উদ্দেশে অনবরত গালি-গালাজ ছুঁড়ছে। সে-ই জানে। মিলু জানলার ধারে বসে আছে সেই থেকে। তারও মুখখানা শুকনো। তবু গতরাতের কথা ভুলতে পারি না, ভিতরটা তার ওপরে বিতৃষ্ণ হয়েই আছে।

সূর্য পাটে নামল। দিনের আলোও দ্রুত কমে আসতে লাগল। একটু বাদেই ওই খোলা আকাশের নীচের অন্ধকারে আমরা ডুবে যাব। প্রায় ছটা, এখন বিকেল। ক্ষুধার অসহিষ্ণু চিত্র জমজমাট। শোনা গেল বেশি রাতের আগে এখান থেকে গাড়ি নড়ার আশা নেই।

-রাম নাম স্যত হ্যায়! রাম নাম স্যত হ্যায়!

আমরা সচকিত হয়ে সামনের দিকে তাকালাম। এবড়ো-খেবড়ো মাঠের ওপর দিয়ে চাদরে ঢাকা শব নিয়ে আসছে মাত্র চারজন গ্রামের লোক। মজুমদার মশাই চমকে উঠে বসেছেন। আমরা ট্রেনের জানলা দিয়ে দেখছি। নীচের বহু যাত্রীরও দৃষ্টি ওই শবের দিকে। লোকালয় ছাড়িয়ে এই নির্জন প্রান্তরে কোথায় শ্মশান ধারণা নেই। লোকগুলো শব নিয়ে ট্রেনটার একেবারে পিছন দিক দিয়ে ঘুরে যাচ্ছে দেখলাম।

একটু বাদেই নীচের যাত্রীদের কারো কারো মধ্যে একটু যেন চাঞ্চল্য লক্ষ্য করলাম। দ্রুত পায়ে তারা ট্রেনটার পিছন দিকে চলেছে। পরক্ষণে হতচকিত আমরা। হিরু গুপ্ত বাইরে ছিল, ছুটে এসে কেবিনে ঢুকল, তার পরেই ঝোলানো জামার পকেট থেকে মানিব্যাগটা তুলে নিয়ে সা করে ছুটে বেরিয়ে গেল। কি ব্যাপার আমরা ভেবে পেলাম না। ঝুঁকে দেখলাম দ্রুতপায়ে আরো অনেকে যেন ট্রেনটার পিছনের দিকে চলেছে। কিন্তু তখন অন্ধকার ঘন হয়ে এসেছে, কিছুই ঠাওর হল না।

প্রায় মিনিট কুড়ি বাদে মস্ত একটা শালপাতার ঠোঙা হাতে ঘর্মাক্ত হিরু গুপ্ত কেবিনে ঢুকল। মুখে দিগ্বিজয়ের হাসি।

আমাকে বলল, কেবিনের দরজাটা বন্ধ করুন শিগগীর!

করলাম।

মস্ত শালপাতার ঠোঙায় খাদ্যসামগ্রী দেখে আমরা বিস্মিত এবং পুলকিত। ওতে আছে অনেকগুলো বড় বড় আলু-সেদ্ধ, তার ওপরে একগাদা কাবলিছোলাসেদ্ধ আর শশা, এবং তার ওপর একরাশ ফুচকা। অন্য ছোট ঠোঙায় নুন, লঙ্কাগুঁড়ো আর পেঁয়াজ।

মজুমদার মশাই উল্লাসে লাফিয়ে উঠলেন।–এত কোত্থেকে পেলি?

হিরু গুপ্ত হাসিমুখে যে সমাচার শোনাল, আমরা হতভম্ব। গাঁয়ের ওই চারটে লোক লুঠপাটের ভয়ে এই খাবারগুলো দিয়েই একটা শব সাজিয়ে নিয়ে এসেছিল। এ-রকম ওরা নাকি আগেও করেছে। ভিড়ের মধ্যে মাল আনলেই লুঠ হয়ে যায়। ট্রেনের শেষ মাথায় বেশ একটু দূরে দাঁড়িয়ে শবের ঢাকা খুলে বিক্রি শুরু করেছে। বরাতজোরে হিরু গুপ্ত ওদিকেই ছিল তখন। একটু দেরি হলেই কিছুই আর জুটত না। ব্যাটারা এরই দাম নিয়েছে নটাকা।

সোল্লাসে চারটে ডিশে ওই আলু-সেদ্ধ কাবলিছোলা শশা আর ফুচকা সাজাল হিরু গুপ্ত। এখনো দেখলাম মিলু তার ডিশে বেশি দিতে দিল না।

এই খিদের মুখে এই খাদ্যও অমৃত মনে হতে লাগল আমাদের। খুশি মেজাজে গোগ্রাসে গিলছে হিরু গুপ্ত আর মজুমদার মশাই। কিন্তু লক্ষ্য করলাম, মিলু তার ডিশ সরিয়ে রেখেছে, খাচ্ছে না।

লক্ষ্য মজুমদার মশাইও করলেন–কি হল, খাচ্ছ না যে?

মিলু মৃদু জবাব দিল, সন্ধ্যাটা পার হোক, তোমরা খাও।

এই মেয়েলিপনা দেখে ওরা বিরক্ত। হিরু গুপ্ত শাসালো, দেরি করলে আমিই মেরে দেব কিন্তু, এখন বেজায় খিদে!

মিলু হেসেই জবাব দিল, নাও না–দেব?

–থাক, অত আত্মত্যাগে কাজ নেই।

আমাদের আহার সমাধা হল। মজুমদার মশাই আর হিরু গুপ্ত ঢকঢক করে জল খেয়ে পরিতৃপ্তির নিশ্বাস ফেলল। এখন একটু জোর পাওয়ার ফলে হিরু গুপ্তর সঙ্গে এবারে মজুমদার মশাইও কেবিনের বাইরে গেলেন।

আমি মজুমদার মশাইয়ের সচিত্র ফিল্ম ম্যাগাজিনটা ওল্টাতে লাগলাম।

একটু বাদেই মিলু মজুমদারকে একটু যেন সচকিত দেখলাম। মুখ না তুলেও মনে হল বার বার আমার দিকে তাকাচ্ছে। কিছু বলবে কিনা ভেবে পেলাম না। কৃত্রিম মনোযোগে চোখ দুটো জার্নালের দিকে আটকে রেখেছি।

নিঃশব্দে একবার উঠে কেবিনের দরজা দিয়ে দুদিকের করিডোর দেখে নিল মিলু। তারপর আবার এসে বসল। আমার পড়ার মনোযোগ লক্ষ্য করল। তারপর নিজের খাবারের ডিশটা আঁচলের আড়ালে নিয়ে তেমনি নিঃশব্দে কেবিন ছেড়ে বেরুল।

জার্নাল ফেলে আমি কেবিনের দরজার সামনে দাঁড়ালাম।

দেখলাম ডিশ হাতে মিলু দ্রুত ডানদিকের খোলা দরজার সামনে গেল। আমি পায়ে পায়ে এগিয়ে এসেছি। মিনিট দুই-তিনের মধ্যেই নীচের দুতিনটে অল্পবয়সী গ্রাম্য ছেলে এসে দাঁড়াতে ওদের ডেকে ডিশের সব খাবার ঢেলে দিয়েই মিলু তাড়াতাড়ি ফিরতে গেল।

-আমি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে।

চকিতে বিমূঢ় ভাবটা কাটিয়ে আমার পাশ ঘেঁষে দত্তপায়ে কেবিনে ঢুকে গেল সে। আমিও এলাম।

অপ্রতিভ মুখখানা আবার লালছে দেখাচ্ছে একটু।

 জিজ্ঞাসা করলাম, খাবার সব এভাবে দিয়ে দিলেন যে?

বিব্রত সুরে জবাব দিল, রাম নাম করে যেভাবে শব সাজিয়ে ওগুলো নিয়ে এসেছে… মনে হচ্ছিল ওতে শবের ছোঁয়া লেগে গেছে… ইয়ে আমার বড় খারাপ অভ্যেস–তারপরেই অনুনয়ের সুরে বলল, ওই শয়তানটাকে আপনি যেন কিছু বলবেন না, আমাকে তাহলে খেয়ে ফেলবে

শয়তান অর্থাৎ হিরু গুপ্ত। চুপচাপ মুখের দিকে চেয়ে আছি। সংযমের এক অনির্বচনীয় কমনীয় মূর্তি দেখছি যেন। গতরাতের বিতৃষ্ণ অনুভূতিটা দ্রুত নিঃশেষে মিলিয়ে যাচ্ছে।

মাথা নাড়লাম– বলব না। নিঃসংশয়ে অনুভব করছি, এই মেয়েকে শুচিতার গণ্ডি থেকে বার করবে এমন সাধ্য হিরু গুপ্তর নেই।